ইংরেজির স্যার
পুজোর ছুটি হবার মাত্র তিন দিন আগে অরূপ ক্লাসে এসে বলল, জানিস, রামগোপাল স্যার স্কুল ছেড়ে দিচ্ছেন।
আমরা সবাই একসঙ্গে অবাক হলুম।
রবীন বলল, যা:, কী বাজে কথা বলছিস!
আমি বললুম, হতেই পারে না!
রমেন বলল, এক-একদিন এই অরূপটা এক-একটা নতুন গুল ছাড়ে।
অরূপ গম্ভীরভাবে বলল, আমি না-জেনে কোনো কথা বলি না। রামগোপাল স্যার কালও স্কুলে আসেননি, আজও আসবেন না।
আমি বললুম, তাহলে নিশ্চয়ই ওঁর জ্বর হয়েছে।
পেছন থেকে শান্তনু বলল, আমি কিন্তু স্যারকে আজ সকালে কেষ্টদার চায়ের দোকান থেকে বেরুতে দেখেছি।
অরূপ বলল, দেখলি?
ঘণ্টা বেজে গেছে, এখনও স্যার আসেননি। প্রথম পিরিয়ডেই অঙ্ক। ভবানীবাবু স্যার একটু দেরিতেই আসেন।
রামগোপাল স্যার আর আসবেন না, একথাটা আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এই নিয়ে একটা গুঞ্জন চলতে লাগল।
আমাদের যে ক-জন টিচার আছেন, তাঁদের মধ্যে রামগোপাল স্যারই সবচেয়ে কড়া। তাঁর ক্লাসে একটাও কথা বলা চলবে না। কেউ বাইরে যেতে পারবে না।
ক্লাসে ঢুকেই রামগোপাল স্যার দরজার কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ধপধপে সাদা প্যান্ট ও সাদা ফুলশার্ট পরে থাকেন রোজ। কোনোদিন তাকে সামান্য একটু ময়লা পোশাক পরে স্কুলে আসতে দেখিনি। মাথায় কুচকুচে কালো চুল একেবারে নিখুঁতভাবে আঁচড়ানো। চোখে আরশোলা রঙের ফ্রেমের চশমা। চৌকো ধরনের মুখ। উনি প্রায়ই ওঁর থুতনিতে একটা আঙুল ঠেকিয়ে থাকেন।
উনি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেই সমস্ত ক্লাস একেবারে চুপ হয়ে যায়। উনি তখন গম্ভীরভাবে হেঁটে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপরে উঠে টেবিলের সামনে দাঁড়ান। তাকিয়ে দেখেন সারা ক্লাসের দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেন, আর ইউ রেডি ফর মি?
এই কথাটার একটা বিশেষ মানে আছে।
বছরের শুরুতেই রামগোপাল স্যার আমাদের বলে দিয়েছিলেন, যাদের পড়তে ইচ্ছে করে না কিংবা ক্লাস শুনতে চায় না, তারা ইচ্ছে করলে বাইরে চলে যেতে পারে। সেজন্য কারুকে তিনি শাস্তি দেবেন না। কারুর যদি ঘনঘন জলতেষ্টা পায় কিংবা বাথরুমে যেতে হয়, তাহলেও তারা আগেই বেরিয়ে যেতে পারে। মাঝখানে আর ফিরে আসতে পারবে না। তাঁর ক্লাস চলার সময় কারুর বেরুনো নিষেধ।
রামগোপাল স্যার আমাদের পড়ান ইংরেজি। অন্য সময় গম্ভীর থাকলেও পড়াবার সময় তিনি নানারকম মজার কথা বলেন, অনেক গল্পও বলেন। কিন্তু কেউ একটু শব্দ করলেই তিনি গর্জন করে ওঠেন, সাইলেন্স। আই ওয়ান্ট পিন ড্রপ সাইলেন্স!
এত কড়া হলেও রামগোপাল স্যারের ক্লাসই আমাদের সবচেয়ে ভালো লাগে। অরূপ বারবার বলতে লাগল, সে পাকা খবর এনেছে যে, রামগোপাল স্যার আর আসবেন না। তবে কোথা থেকে যে ও খবরটা জেনেছে, তা ও কিছুতেই বলবে না।
ভবানী স্যার এসে পড়তেই আমরা যে যার সিটে গিয়ে বসে পড়লুম।
উনি প্রথমে রোল কল করেন। তারপর ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক কষতে শুরু করে দেন পিছন ফিরে। কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস না-করলে নিজে থেকে কিছু বলেন না।
পরের ক্লাস বাংলা। আমাদের বাংলা স্যারের বয়েস বেশ কম, আর অনেকটা ভালো মানুষ ধরনের। ওঁর সঙ্গে আমাদের অনেকরকম গল্প হয়।
বাংলা স্যার পঙ্কজবাবু আমাদের রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পটা পড়াচ্ছেন, হঠাৎ রবীন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার, একটা কথা বলব?
পঙ্কজ স্যার বই থেকে চোখ তুলে বললেন, বলো।
স্যার, আমাদের রামগোপাল স্যার কি স্কুল থেকে চলে যাচ্ছেন?
পঙ্কজ স্যার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, তা তো আমি জানি না! এরকম কোনো কথা তো আমি শুনিনি। হ্যাঁ, তারপর শোনো, ফটিক যখন বলল, আমি বাড়ি যাচ্ছি, অমনি বাড়ি বলতে কোন বাড়ি বোঝাচ্ছে?
পঙ্কজ স্যার চলে যেতেই আমরা সবাই আবার ঘিরে ধরলুম অরূপকে। বললুম, গুলবাজ! এবার তো ধরা পড়ে গেলি? ইংরেজি স্যার চলে গেলে বাংলা স্যার তা জানতেন না?
অরূপ তবু গোঁয়ারের মতন বলল, দেখবি! সব সঠিক সময় জানতে পারবি। অত যদি তোদের সন্দেহ থাকে, তাহলে এবারে হেডস্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখ না।
এই ক্লাসটা নিতে এলেন হেডস্যার। তিনি পড়ান ইতিহাস। তিনি শুধু সাল, তারিখের কচকচি শোনান, কোনো গল্প বলেন না বলে ইতিহাসের ক্লাস শুনতে আমার ভালো লাগে না। তবে হেডস্যারকে সবাই ভয় পায়। হেডস্যার রেগে গেলেই বাড়িতে চিঠি যাবে।
হেডস্যারকে কে জিজ্ঞাসা করবে ওই কথাটা? সবাই ভয় পাচ্ছে! আমরা একজন আর একজনের সঙ্গে চোখাচোখি করছি। কিন্তু কেউ উঠে দাঁড়াচ্ছে না।
ক্লাসের একেবারে শেষদিকে অরূপ নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমাদের ইংরেজির টিচার রামগোপাল স্যার চলে যাচ্ছেন বুঝি?
হেডমাস্টার মশাই স্থিরভাবে তাকালেন অরূপের দিকে। মনে হল রেগে গেছেন। তারপর বললেন, দ্যাট ইজ নান অফ ইয়োর বিজনেস।
হেডস্যার চলে যাবার পর অরূপ বলল, দেখলি, হেডস্যার স্বীকার করলেন কিনা?
কিন্তু হেডস্যারের ওই কথাটাতে যে ঠিক কী বোঝায়, তা আমরা বুঝলুম না। উনি হ্যাঁ-ও বলেননি, না-ও বলেননি।
কিন্তু রামগোপাল স্যার চলে যাবেন কেন?
পরদিনও রামগোপাল স্যার এলেন না। অরূপ ছাড়া আজও তিন-চারজন বলল, তারাও শুনেছে রামগোপাল স্যার সত্যিই আর থাকছেন না এই স্কুলে! আর তিনি আসবেন না কোনোদিন।
আজ আমার মনে হল, এরা বোধহয় সত্যি খবরই বলছে। আমার বুকটা কাঁপতে লাগল। নিজেকে মনে হল, দারুণ একটা অপরাধী।
আমি ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলুম, স্যার কেন চলে যাচ্ছেন রে?
একজন বলল, হেডুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। হেডমাস্টারমশাই ওঁকে দেখতে পারতেন না, জানিস না?
আর একজন বলল, উনি বিলেত চলে যাচ্ছেন।
আর একজন বলল, উনি বিলেত না, বিলেত না, উনি একটা ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে ভালো চাকরি পেয়েছেন।
এর কোনোটাই আমার সত্যি মনে হল না।
আমার মনে হল আমিই এর জন্য দায়ী। আমার ব্যবহারে রাগ করে স্যার আর এ স্কুলেই আসবেন না ঠিক করেছেন।
আমি স্যারের নীল রঙের কলমটা নিয়ে নিয়েছি। তা বলে কলমটা চুরি করিনি আমি। আমার তিন-চারটে ডট পেন আছে, তবু শুধু শুধু আমি ওই রকম একটা কলম চুরি করতে যাব কেন?
সাতদিন আগে হোমওয়ার্ক দেখাচ্ছিলুম রামগোপাল স্যারকে। টেবিলের ওপর ওঁর কলমটা খোলা ছিল। আমিও বাড়িয়ে দিয়েছিলুম আমারটা। তারপর একসময় বদলাবদলি হয়ে গেল।
দুটো কলম ঠিক একই রকম দেখতে। দামও বোধহয় এক। তবে ওঁর কলমটার গায়ে লেখা আছে আর. জি.। নিশ্চয়ই রামগোপাল স্যার নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছিলেন। এটা ওঁর শখের কলম।
ভুলটা ধরা পড়ে রাত্তিরবেলা আমার পড়ার টেবিলে। তখন আমি ঠিক করেছিলুম, পরের দিনই স্যারের কলমটা ফেরত দিয়ে আমারটা বদলে নেব। তারপর ভাবলুম, সেদিনের হোমওয়ার্কটা স্যারের কলম দিয়েই লেখা যাক না।
আশ্চর্য ব্যাপার, ইংরেজি হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে রোজই আমার মাথা গুলিয়ে যায়। ঠিক ঠিক শব্দটা মনে আসে না। কিন্তু সেদিন স্যারের কলম দিয়ে লিখতে গিয়ে লিখে ফেললুম তরতর করে। পরের দিন আমার লেখায় একটাও ভুল বেরুল না।
তখন আমি ভাবলুম, এটা কী কলমের গুণ, না আমার গুণ?
আর একবার পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেদিন আর ফেরত দিলুম না কলমটা। সেদিনও বাড়িতে গিয়ে সব লেখা লিখলুম সেই কলমটা দিয়ে। শুধু ইংরেজি নয়, অন্য সাবজেক্টও অনেক সোজা লাগল। পরের দিন আবার সব ক-টা খাতাতেই ফুল মার্কস পেলুম।
সেইজন্যই আর ফেরত দেওয়া হয়নি কলমটা। স্যারের এই কলমে নিশ্চয়ই কিছু বিশেষত্ব আছে। এই কলম থাকলে আমি ফার্স্ট হয়েও যেতে পারি।
স্যার নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝে গেছেন যে তাঁর কলমটা অন্য কেউ নিয়ে নিয়েছে। কে নিয়েছে তা বুঝতে পারেননি নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁর ছাত্ররা নিজের থেকে কলমটা ফেরত দেয়নি বলে মনে দুঃখ পেয়েছেন, সেইজন্য আর স্কুলে আসছেন না।
সারাবিকেল আমার মন খারাপ হয়ে রইল। খেলতে যেতে ইচ্ছে করল না। সন্ধ্যেবেলা পড়ায় মন বসল না। রামগোপাল স্যারের বাড়ি বেশিদূরে নয়। কারুকে কিছু না-বলে বেরিয়ে পড়ে ছুটতে লাগলুম।
স্যারের বাড়ি দূর থেকেই দেখেছি, কোনোদিন ভেতরে ঢুকিনি। জানি, স্যার দোতলায় থাকেন। দোতলায় সব ঘরে আলো জ্বলছে।
বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইলুম খানিকক্ষণ। স্যার নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন, আমায় দেখে যদি আরও রেগে যান? আমি কখনো কোনো মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খাইনি!
শেষপর্যন্ত উঠে গেলুম সিঁড়ি দিয়ে।
স্যারের বসবার ঘরে অনেক লোক। স্যারের বন্ধু নিশ্চয়ই সবাই। স্যার পরে আছেন একটা পায়জামা আর গেঞ্জি। সাদা প্যান্ট-শার্ট ছাড়া স্যারকে আমি কখনো দেখিনি। তাই স্যারকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।
একবার ভাবলুম, কলমটা দরজার কাছে রেখে চলে যাই। কিন্তু তার আগেই স্যার আমায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে?
তিনি উঠে এলেন দরজার কাছে। আমি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম দেওয়াল ঘেঁষে। আমার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে।
আমায় দেখে চিনতে পারলেন স্যার। তিনি বললেন, আরে, তুমি বরুণ মৌলিক না, ক্লাস এইটের? কী ব্যাপার? এসো, এসো, ভেতরে এসো!
আমি সেখান থেকে নড়তেও পারলুম না। আমার গলা থেকে কথাও বেরুলো না।
আমার কাঁধে হাত রেখে স্যার বললেন, কী হয়েছে, বরুণ? আমায় কিছু বলবে?
আমি পকেট থেকে কলমটা বার করে দিয়ে বললুম, স্যার, আপনার এই কলমটা আমার কাছে ছিল, ফেরত দেওয়া হয়নি।
স্যার অবাক হয়ে বললেন, আমার কলম! কিন্তু আমার তো কোনো কলম হারায়নি।
—এটা আমার সঙ্গে বদলা-বদলি হয়ে গিয়েছিল।
—ও, তাই নাকি? তার মানে তোমারটা আমার কাছে? একইরকম দেখছি।
—স্যার, আমায় ক্ষমা করুন। আপনারটা স্পেশাল কলম, এতে আপনার নাম লেখা…
—স্পেশাল! নাম লেখা? দেখি তো?
কলমটা নিয়ে তিনি ঘুরিয়ে দেখে বললেন, এটা বোধহয় কোম্পানির নাম। আমার নামের সঙ্গে মিলে গেছে। আমি তো আগে লক্ষই করিনি। এটা তুমি ফেরত দিতে এলে? না:, এটা তুমিই রাখো।
…স্যার,আপনার এই কলমটা আমার কাছে ছিল,ফেরত দেওয়া হয়নি…
—স্যার, আপনি আমাদের ইস্কুলে আর আসবেন না! আপনি রাগ করেছেন আমাদের ওপর…
আমি আর বলতে পারলুম না, মুখটা নীচু করলুম।
স্যার বললেন, আমি দিল্লিতে একটা কাজ পেয়েছি, সেখানে চলে যেতে হচ্ছে। এ কী বরুণ, তুমি কাঁদছ? তুমি এই রাত্রে।
স্যারও থেমে গেলেন হঠাৎ। একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বাঁ-হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন, আমি তো আসব মাঝে মাঝে। যখনই কলকাতায় ফিরব, তোমরা এসো দেখা করতে…
আমার কান্না থেমে গেছে। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলুম স্যারের দিকে। ওনার মতো কড়া মানুষও যে আমাদের মতন কাঁদতে পারেন, তা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।
সেদিনই বুঝলুম, মানুষকে নতুন নতুন ভাবে চেনা যায়।