1 of 2

ইঁদুর ৩/৪

৩.
বারান্দার বাইরেটা বেলুন আর কাগজে সাজানো হয়েছে। বাচ্চারা হৈচৈ করছে। আজকাল হৈচৈ মোটে সহ্য হয় না সুধীনবাবুর। নিজের ঘরেই আছেন। নিচে গাড়ির শব্দ হলো, বোধ হয় বড় বৌমার দাদা-বৌদিরা এলো। সুধীনবাবুর একমাত্র মেয়ে ফুচি। ওরা এখন দিলি্লতেই সেটেল্ড। এক মাসের ছুটিতে এসেছে এখানে। নীহারিকা থাকলে এখানে এসেই উঠত। নীহারিকা যাওয়ার পর আর ওঠে না। কেন ওঠে না তা বলেনি ফুচি সুধীনবাবুকে। কিন্তু সুধীনবাবু বোঝেন যে হয়তো বড় বৌমা বা মেজ বৌমা অথবা দুই বৌমারই কোনো ব্যবহারে ও বা প্রদীপ দুঃখিত হয়েছে। বোঝেন সব কিছুই। মুখে চুপ করেই থাকেন। একটাই মেয়ে। কিছুই করতে পারেন না ওদের জন্যে। উল্টো মেয়েজামাই-ই সুধীনবাবুকে নিয়ে এখানে-ওখানে যায়। থিয়েটার দেখতে, যাত্রা দেখতে। বড় ও ভালো রেস্তোরাঁতে খাওয়া যায়। পাজামা-পাঞ্জাবি বানিয়ে দেয়। এবারের আসার সময় একটা শাল কিনে নিয়ে এসেছে। কত দামি শাল। কবে এবং কোথায় পরবেন সুধীনবাবু? দিন তো ফুরিয়ে এলো।
শিখা আর দীপুর সঙ্গে কিন্তু খুব ভাব ফুচি আর প্রদীপের। প্রত্যেকটা উইক-এন্ডে ওরা ওদের ওখানে গিয়ে থাকে। এটাও একটা প্রচণ্ড অশান্তির কারণ। মেজ বৌ ও বড় বৌয়ের ধারণা, কভেনান্টেভ অফিসারে অফিসারে মিলে গেছে। দুজনেই সাহেব, তা আমাদের কি আর পছন্দ হবে তাদের?
আরেকটা গাড়ির শব্দ হলো। ফুচি, প্রদীপ, শিখা ও দীপু একসঙ্গে নামল গাড়ি থেকে। ওদের গলার শব্দ পেলেন সুধীনবাবু। তার পরই মিষ্টির পরিচিত জুতোর শব্দ পেলেন সিঁড়িতে। হালকা পায়ের নরম থপ থপ শব্দ। মুখস্থ হয়ে গেছে সুধীনবাবুর। নাতিরা এত দুরন্ত নয়। মিষ্টি, মেয়ে হয়েও ভারি দুরন্ত। এনার্জিতে ভরপুর। ওর হাঁটাচলা, কথা বলা সমস্তই এতই প্রাণবন্ত যে, পরপারের পথে চোখ চাওয়া সুধীনবাবুর ওকে দেখে আবার জীবনকে ব্যাক গিয়ারে ফেলে অনেক দূরে পিছিয়ে মিষ্টির বয়সে পৌঁছতে ইচ্ছে করে।
মিষ্টি, গাড়ি থেকে নেমেই সোজা দৌড়ে ওপরে আসে দাদু, দাদু, দাদু ডাকতে ডাকতে। মিষ্টি যখন সিঁড়ি থেকে ডাকে দাদু, দাদু, দাদু, তখন সুধীনবাবুও ঘর থেকে উত্তর দেন কি দাদু, কি দাদু, কি দাদু?
মিষ্টি এসেই সুধীনবাবুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজও পড়ল। সুধীনবাবু ওকে জড়িয়ে ধরলেন জোরে। যখনই মিষ্টিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন সুধীনবাবু, সুধীনবাবুর মনে হয়, যেন বিয়ের সময়ের ছোট্ট বালিকা-বধূ নীহারিকাকেই আদর করেন। তার একটা কারণও ছিল। মিষ্টি যে পাউডার মাখে, নীহারিকাও সেই পাউডার মাখত। একটি পাউডারের গন্ধে মিষ্টির মাধ্যমে তাঁর নীহারিকা তাঁর কাছে ফিরে আসত।
সুধীনবাবু প্রত্যেকবার মিষ্টিকে কোলে নিয়ে ভাবতেন পাউডারের কম্পানি থেকে যায়, শুধু মানুষই চলে যায়।
ফুচি আর প্রদীপও ঘরে এলো দীপুর সঙ্গে। শিখা এলো না। হয়তো পরে আসবে। শিখার মধ্যে, মন-রাখা লোক-দেখানো কোনো ব্যাপারই নেই। সেটা ভালো যেমন, খারাপও। একটু পরে শিখাও এলো। পিছনে পিছনে বড় বৌ মেজ বৌ।
ফুচি হাসতে হাসতেই সত্যি কথাটা বলল, এই বৌদিরা, তোমরা আমার বাবাকে কী করে রেখেছ? ঘরটার কী অবস্থা দ্যাখো তো? এর মধ্যে মানুষ থাকতে পারে? আলমারির মাথায় টিন, নিচে জুতো, ছেঁড়া মশারি, খাটের তলায় পুরো গুদোম! বলেই, চেঁচিয়ে উঠল, ওমা, ওটা কী?
মিষ্টি উত্তেজিত হয়ে হাততালি দিয়ে উঠল, দাদুর কোলে বসে বলল, ইঁদুর। ওমা। পিসি ইঁদুরকে ভয় পায়।
শিখা হাসতে হাসতে বলল, এসব বলিস না ফুচি, বললেই দিদিরা বলবে আমি তোকে শিখিয়ে দিয়েছি।
শিখা কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বড় বৌ বলে উঠল, তুমি তো কয়েক দিন এখানে থেকে বাবার ঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেলেই পারো।
শিখা হাসল। বলল, নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু তা করলে তোমাদের অপমান করা হয় বলে কখনো তা করিনি। তোমরা যদি অনুমতি দাও তো নিশ্চয়ই করব এবং করে দেখিয়ে দেব যে এই ঘরই কিভাবে রাখা যায়।
বড় বৌ চেঁচিয়ে উঠল, ম্যাগো! বলে।
একট বড় ইঁদুর কামড়ে দিয়েছে পায়ে।
মেজ বৌমা বলল, দিদি শিগগির ওষুধ লাগা, প্লেগ হবে; প্লেগ।
প্রদীপ অবাক হয়ে তাকাল মেজ বৌয়ের দিকে। মেজ বৌদি যে এত অশিক্ষিত জানত না প্রদীপ।
ফুচি বলল, বড়দি চল, চল নিচে। শিগগির ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।
তারপর শিখার দিকে চেয়ে বলল, শিখা, আয় দুজনে মিলে কাল এসে বাবার ঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে যাই। বৌদিরা নানা ঝামেলায় সময় পায় না।
শিখা বলল, বেশ তো! খুব ভালো।
ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে দীপু বলল, কেমন আছ বাবা?
এই আছি!
তোমার ব্লাড সুগার? প্রেসার? সব ঠিক?
ঠিকই আছে!
আসলে সুধীনবাবুর এই বয়সে মেপে-খেয়ে, মেপে হেঁটে, প্রেসার মেপে, বেঁচে থাকার আর ইচ্ছা নেই। জীবনের সব প্রয়োজনীয়তা, সার্থকতা তো শেষ। হাইওয়েতে একটা গাড়ির ইঞ্জিন কাট-অফ করে দেওয়া হয়েছে। গিয়ারও নিউট্রাল। এখন যত দূর যায় গড়িয়ে গড়িয়ে। এ গাড়িতে তেল-মবিল দিয়ে আর লাভ কী? গন্তব্যই যখন নেই কোনো, একমাত্র থেমে যাওয়া ছাড়া।
দীপু বলল, আমাদের অফিসের ডাক্তারের সঙ্গে ঠিক করেছি, তোমাকে সপ্তাহে একবার করে দেখে যাবেন।
কেন? আমাদের গজেন ডাক্তার কী দোষ করল?
না। উনিও দেখুন। তবে উনি তো মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে দেন।
ঘর থেকে উঠে চলে যাওয়ার সময় দীপু বলল, বাবা, মিষ্টিকে আজেবাজে কিছু খাইও না যেন। ওর সকাল থেকে পেটের গণ্ডগোল। শিখা টিফিন ক্যারিয়ারে করে ওর জন্যে শুকতো নিয়ে এসেছে। ঐ খাবে। ভাতে মাখে।
সুধীনবাবু মুখে বললেন, ঠিক আছে। মনে মনে বললেন, এদের কায়দার শেষ নেই। ছেলেমানুষ, নেমন্তন্ন খেতে এসেছে; তা না টিফিন ক্যারিয়ারের শুকতো খাবে। যত্ত সব।
রাজা ঘরে এলো। মিষ্টির দুই গুণ বয়স রাজার। রাজা বলল, মিষ্টি নিচে চল আমরা কেক কাটব। তুই গান গাইবি না হ্যাপি বার্থডে?
হ্যাঁ! হ্যাঁ করে নেচে উঠল মিষ্টি।
সুধীনবাবু বললেন, আমিও যাব। তারপর মিষ্টির হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন নিচে। ততক্ষণে বাচ্চারা সকলে ভীষণ মেতে গেছে।
কেক কাটা হলো! গান হলো। কেক খাওয়া কিন্তু হলো না মিষ্টির। শিখা খুব নির্দয় মা। বলল, মিষ্টি তোমার ভাগ আমি বাড়ি নিয়ে যাব। কাল ভালো হয়ে গেলে খাবে।
মিষ্টি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না।
সুধীনবাবু বললেন, চলো, কেক কাটা হলো, আমরা ওপরে যাই। তারপর মিষ্টির কানে কানে বললেন, তুমি কি দই খাবে? যদুবাবুর বাজার থেকে দই আনাব?
নাঃ। বলল মিষ্টি।
ওপরে উঠে দেখেন, দেবেন কাবাব রেখে গেছে দুটো। একটা প্লেটে। আর প্লেটটা রেখেছে খাটের নিচে মাটিতে। একটা চামচ পর্যন্ত দেয়নি। দেবেনটা দিনকে দিন…
সুধীনবাবুর শরীরটাও কাল থেকে ভালো নেই। ঠিকই করেছিলেন যে রাতে শুধু দুধ-খৈ খাবেন।
মিষ্টি মুখে কিছু না বলে এমনভাবে তাকাল সুধীনবাবুর চোখে যে সুধীনবাবুর বুকের মধ্যেটা কেমন যেন করে উঠল। ভদ্রলোক অপত্যস্নেহ কাকে বলে জীবনে জেনেছিলেন। কিন্তু আসলের প্রতি যে স্নেহ, যে দরদ; তার মধ্যে কিছুটা তবু ভারসাম্য থাকে। সুদের প্রতি স্নেহ ও দরদে তা থাকে না। যিনি দাদু বা দিদা হননি, তিনি জানেন না সুদের কী টান। কী কষ্ট? যে নাতি বা নাতনির প্রতি স্নেহ আছে অসীম, কিন্তু যার মালিক তার মা ও বাবা; তাকে আদর করতে, তাকে হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যেতে যখন তাঁর নিজের অনিচ্ছুক ছেলে-মেয়ের অনুমতি চাইতে হয়, তখন বুকের মধ্যে বড় কষ্ট হয়। আসলের চেয়ে সুদ অনেকই দামি। সুদকে ভালোবাসায় ভীষণ জ্বালা!
হঠাৎ সুধীনবাবুর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তাঁর নিজেরও কি কোনো দাবি নেই নাতনির ওপর?
উনি মিষ্টিকে বললেন, তোমার কি এখন পেট ব্যথা করছে?
না তো দাদু।
তবে কী অসুবিধা?
জানি না। সকালে তিনবার পাই করেছিলাম।
তারপর আর যাওনি?
ওষুধ খেয়েছ?
হ্যাঁ। মেকসাফর্ম।
দাঁড়াও। বলে সুধীনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দরজাটা বন্ধ করলেন ঘরের। বন্ধ করেই তাড়াতাড়ি কাবাবের প্লেটটা হাতে করে এনে মিষ্টিকে বললেন, খাও দাদু।
দুটোই? মিষ্টি বলল। তারপর বলল, তুমি একটা খাও দাদু।
দুটোই তুমি খাও। আমি খাব না।
মিষ্টির চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কাবাব মুখে দিল মিষ্টি।
কেমন লাগছে? সুধীনবাবু বললেন।
ভালো। মিষ্টি বলল। তারপর বলল, ঝাল। তার পরই বলল, গন্ধ লাগছে।
সুধীনবাবু ভাবলেন, শিখা মেয়েটাকে বেশি যত্নে যত্নে একেবারে স্পয়েল করে ফেলেছে। এদের ইমিউনিটি বলে কিছুই ডেভেলপ করেনি। যা কিছু খায়, তাতেই অসুখ।
সুধীনবাবু বললেন, আরেকটা খাও।
মিষ্টির চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। বলল, না থাক। খুব ঝাল।
সুধীনবাবু বললেন, দাঁড়াও তোমাকে জল দিই। দেবেনকে এখন ডাকলেই তো জানাজানি হয়ে যাবে। শিখা বা দীপু এক্ষুনি চলে এলে প্রচণ্ড ঝামেলা বাধাবে। ফুচিও আসতে পারে। তাই নিজেই বারান্দায় গিয়ে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে এনে মিষ্টিকে দিলেন।
মিষ্টি জল খেয়েই বলল, দাদু, আমি মার কাছে যাব।
কেন দাদু? কী হলো?
ভালো লাগছে না।
কেন ভালো লাগছে না? হলোটা কী তোমার?
না। এমনিই।
আমি পৌঁছে দিয়ে আসব? না তুমিই যাবে?
আমি যেতে পারব নিচে।
আচ্ছা। তবে যাও। বাড়ি যাওয়ার আগে আমাকে বলে যেও। একটা আব্বা দিয়ে যেও আমাকে।
আচ্ছা!
মিষ্টি দরজার কাছে পৌঁছতেই সুধীনবাবু বললেন, কাউকে বোলো না যেন কথাটা!
মিষ্টি হাসল।
ভারি স্মার্ট মেয়েটা। চোখ পিটপিট করে বলল, কাউকে বলব না। প্রমিস।
দেবেন মশারি গুঁজে দিতে এসেছিল। সুধীনবাবু বাঁধানো দাঁতের পাটিটা খুলে একটা জলভরা বাটির মধ্যে রাখলেন। রাতে দুধ খই-ই খেয়েছিলেন। এখন শরীরটা ভালোই লাগছে। নিচে এখনো ওদের গলা পাচ্ছেন। এগারোটা বাজে। খাওয়া-দাওয়া হতে বারোটা-সাড়ে বারোটা হবে। শিখা মিষ্টিকে নিয়ে আগেই চলে গেছে। মিষ্টির শরীরটা নাকি ভালো নেই। দীপুকে ফুচি আর প্রদীপ নামিয়ে দিয়ে যাবে ট্যাক্সিকরে। মিষ্টির শরীরটা ভালো নেই শুনে ভয়ে সুধীনবাবুর মুখ শুকিয়ে গেছে। শিখার রাগী মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
মশারিটা গুঁজে দিয়ে দেবেন বলল, কাল ঘরে গন্ধ পেলে বলবেন বাবু।
কিসের গন্ধ?
ইঁদুর পচার।
কেন? ইঁদুর পচবে কেন? সুধীনবাবু শুধোলেন।
পচবে না? দুটো কাবাবে ভালো করে ইঁদুর মারা ওষুধ মাখিয়ে রেখেছিলেন খাটের নিচে। একটা এরই মধ্যে খেয়ে ফেলেছে ব্যাটারা। একটা ইঁদুরে নিশ্চয়ই খায়নি। ধেড়ে ইঁদুরের বংশ নির্বংশ হবে এক কামড় খেলে।
সুধীনবাবুর হৃৎপিণ্ডটা খাঁচা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল এক লাফে।
সোজা খাটে উঠে বসলেন। বললেন, দাঁড়া দাঁড়া দেবেন।
তারপর মশারি ছেড়ে বাইরে এলেন। বললেন, কোথায় দেখি, তোর কাবাব।
এই তো! বলেই দেবেন মিষ্টি যে-প্লেটে থেকে খেয়েছিল সেটা টেনে বের করল।
হতভম্ব হয়ে অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলেন সুধীনবাবু।
এমন সময় নিচ থেকে দেবেনকে মেজ বৌমা ডাকল। দেবেন নিচে গেলেই ফিসফিসে গলায় বলল, বাবা শুয়ে পড়েছেন? খেলেন না?
না। শরীর ভালো নেই।
মেজ বৌমা বলল শোনো, মিষ্টির খুব শরীর খারাপ হয়েছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। এক্ষুনি ফোন এসেছিল ছোট বৌদির। বাবাকে এ কথা এখন বোলো না। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই আমরা অসুখের খবর দেব। সকালে দেখতেও নিয়ে যাব।
দেবেন ওপরে ফিরে গেল।
সুধীনবাবু ইজিচেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন। টেবিলের ওপর মিষ্টির একটা ছবি ছিল। সেদিকে তাকিয়েছিলেন। নীহারিকার ছবির দিকেও। দেবেন আসতেই বললেন, বৌদি ডাকল কেন?
না, এমনি…
বেশি চালাক হয়েছিস না? কী হয়েছে বল?
কিছু তো হয়নি। আপনার কাজ শেষ করে নিচে মেজবাবুর বিছানা ঠিক করে দিতে বললেন।
ও। তুই মিথ্যে বলছিস না?
না বাবু।
আমাকে টেলিফোনের বইটা দে। গজেন ডাক্তারের ফোন নম্বর জানিস?
না। বলে, দেবেন বইটা এনে দিল। চশমাটা নাকে লাগিয়ে গজেন ডাক্তারের ফোন নম্বরটা বের করে পাশের ঘরে গিয়ে ডায়াল করলেন। দেবেনকে বললেন, তুই নিচের যা কাজ আছে, সেরে, তারপর আমার কাছে আয়।
দেবেন চলে গেল নিচে।
গজেন?
বলছি। কে? বড় কর্তা নাকি? কেমন আছেন? রোজ শোওয়ার সময় ক্যাম্পোজ খাচ্ছেন তো একটা করে?
তা খাচ্ছি। শোনো, ইঁদুর মারার ওষুধ।
মানে? বলেন কী আপনি? মাথা খারাপ হলো নাকি?
না, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। কোনো খাবারে, ইঁদুর মারার ওষুধ বেশি করে দিয়ে যদি কোনো বাচ্চাকে খাওয়ানো যায়, তবে তার এফেক্ট কী হবে?
গজেন ডাক্তার হেসে বলল, আপনি কি গোয়েন্দা গল্প লিখছেন নাকি?
আঃ, গজেন, যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও।
এফেক্ট আর কী হবে? মরে যাবে।
সুধীনবাবুর হাতটা রিসিভার থেকে আলগা হয়ে এলো।
বললেন, আর উ্য শিওর?
অ্যাব্সলুটলি।
খাওয়ার কতক্ষণ পরে মারা যাবে?
স্টম্যাক পাম্প না করলে অল্পক্ষণের মধ্যেই।
আচ্ছা? ঠিক আছে।
গজেন ডাক্তার বললেন, ব্যাপারটা…
গজেন ডাক্তারের কথা শেষ হবার আগেই সুধীনবাবু ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।
দেবেন ফিরে এলো একটু পরে। বলল, কী হলো বাবু, ঘুমোবেন না। লাইট নিভিয়ে দেব?
সুধীনবাবু বললেন, ঘুমবো রে ঘুমবো। আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে তোদের এত তাড়া কিসের?
তার পরই বললেন, মিষ্টিকে কখন হাসপাতালে নিয়ে গেছে রে?
দেবেন অবাক হলো। তার পরেই ভাবল, গজেন ডাক্তারের কাছে শুনেছেন বোধ হয়।
বলল, এক্ষুনি।
সুধীনবাবু মনে মনে হিসেব করলেন, মিষ্টি সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় তাঁর কাছে এসেছিল। এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। অনেক ঘণ্টা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ দেবেনের ওপর রেগে উঠলেন তিনি। বললেন, তুই ভেবেছিস কী? রয়ে রয়ে মুরলি বাজাবি? এক্ষুনি আরো আন, বিষ আন, সারা ঘরে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে রাখ, যাতে ঘরের যত ইঁদুর আছে এক দিনেই মরে যায়। তুই রোজ রোজ এই রকম বিষ দিবি নাকি? রোজই ইঁদুর পচাবে? এটা কি ধাপার মাঠ পেয়েছিস?
কাবাব তো নেই। অবাক হয়ে বলল, দেবেন। বিষ মেশাব কিসে?
নবাব হয়েছেন। ইঁদুরকে কাবাব খাওয়াতে হবে না। পাউরুটি আন। তাতে বিষ মাখিয়ে রাখ। যা শিগগির যা।
দেবেন চলে যেতেই, স্লিপিং পিলের শিশিটা নিয়ে এলেন তাড়াতাড়ি দেরাজ খুলে।
তারপরে প্যাড বের করে, বলপেন বের করে, চশমা নাকে দিয়ে দ্রুত চিঠি লিখলেন একটা। খামে ভরে, মুখ বন্ধ করলেন সেটার।
দেবেন ফিরে এলেই বললেন, রাখ ওখানে। আমি নিজে দেব আনাচে-কানাচে।
আপনি কেন? আমিই দিচ্ছি। বলে, দেবেন ভালো করে বিষ মাখিয়ে রুটির টুকরাগুলো এদিকে-ওদিকে সব দিকে দিয়ে দিল। আলমারির নিচে, খাটের নিচে—সব জায়গায়।
সুধীনবাবু বললেন, আমি এখন পড়ব। তুই মশারিটা গুঁজে দিয়ে যা। জল দিয়েছিস?
হ্যাঁ। সব দিয়েছি।
দেবেন চলে যাওয়ার আগে খামে বন্ধ চিঠিটা দেবেনের হাতে দিয়ে বললেন, কাল সকালে এই চিঠিটা ছোট বৌদিকে পাঠিয়ে দিবি ড্রাইভারকে দিয়ে। কেউ না থাকলে, তুই নিজে যাবি। জরুরি চিঠি। কাল সকালে বুঝলি?
আচ্ছা। দেবেন বলল।
এবার যা। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া কর। হাত ধুয়ে নিস ভালো করে। অনেক খাটনি গেছে আজ তোর।
দেবেন বলল, খাটনির কথা বলবেন না বাবু! অন্যরা তো সব গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে। খাটনি যা, সব দেবেনেরই। তাও তো আপনি বেশি ভালোবাসেন বলে অন্য সব লোকের কী আক্রোশ আমার ওপর।
দেবেন চলে যাচ্ছিল। সুধীনবাবু ডাকলেন। বললেন, তুই একটা হাতঘড়ি চেয়েছিলি না আমার কাছে? বলেই, নিজের রোলেকস ঘড়িটি বালিশের তলা থেকে তুলে দেবেনকে দিলেন।
বললেন, এটা তুই রাখিস।
এ কী! এ কী! বলল দেবেন। এটা যে আপনার নিজের ঘড়ি। এত দামি!
তা হোক। তুইও দামি। তুই-ই নে। সময়ের দাম ফুরিয়ে গেছে আমার কাছে। ঘড়িতে আমার আর কী দরকার?
তাহলেও। বলল, দেবেন।
এবার যা ভাগ। আমি পড়ব। সুধীনবাবু ওকে তাড়ালেন।
দেবেন চলে যেতে ভাবল, আজ ঘড়িটা কাউকে দেখাবে না। কাল দেখাবে। ঠাকুর, নটবর সকলকে চমকে দেবে ঘড়িটা দেখিয়ে। তার পরই ভাবল, ওরা আবার ভাববে না তো যে চুরি করেছি? ভাবলে কী? বাবুর কাছে ডেকে আনব। বাবুর নিজের মুখেই শুনুক ওরা দেবেনের কী পজিশন এ বাড়িতে।
দেবেন চলে যেতেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন সুধীনবাবু। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সারা ঘরময় ঘুরে ঘুরে পাউরুটির টুকরাগুলো তুলে খেতে লাগলেন। যেন শিশু হয়ে গেলেন সুধীনবাবু। মিষ্টির চেয়েও ছোট। হামাগুড়ি দিয়ে গাবা মেরে মেরে যমকে মুখে পুরতে লাগলেন, তারপর দাঁতে কাটতে লাগলেন। ছিঁড়ে ছিঁড়ে মৃত্যুকে খেতে লাগলেন তিনি।
বড় জ্বালা করতে লাগল বুক, পেট। আঃ মিষ্টি! দাদু আমার। প্রমিস। তুমি তোমার প্রমিস রেখেছ দাদু। অত যন্ত্রণাতেও প্রমিস ভাঙোনি। এ আমি কী করলাম? মিষ্টি সোনা আমার, কী করলাম আমি! শেষে…শিখা তুমিই ঠিক। বুড়োগুলোর কোনো দিশা নেই।
রুটির টুকরোগুলো চিবোতে চিবোতে, গিলতে গিলতে মনে মনে বললেন; তোমার কী হবে শিখা? দীপুরও কী হবে? মিষ্টিকে ছাড়া তোমরা বাঁচবে কী করে? মনে মনে বলতে লাগলেন সুধীনবাবু।
তারপর স্লিপিং ট্যাবলেটের শিশি খালি করে মুঠো করলেন, দু গ্লাস জলের সঙ্গে সব গিলে ফেললেন।
ফেলেই, কোনোক্রমে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *