আ পারফেক্ট সার্কিট

আ পারফেক্ট সার্কিট

ক্রিইইইক। ক্রিইইইক। ক্রিইইইক।

‘স্যর, হাউসকিপিং!’

২০১ নম্বর ঘরে পরপর তিন বার বেল বাজাল হোটেলের বয়। তারপর আবার, আবার। কেউ সাড়া দিল না। হোটেলের বয়ের খুব একটা ভালো লাগল না সংকেতটা। এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়। হয়ওনি কখনও। বিকেল সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছে। এখনও কি ঘরের সবাই ঘুমাচ্ছেন? সবক’টা ঘরের সাফাই হয়ে গিয়েছে। বাকি এটাই। নিজের মনেই বিড় বিড় করতে করতে দ্রুত পায়ে নেমে এল বয়। হোটেলের রিসেপশনে জানাল, ‘২০১ নম্বরে তো কেউ সাড়াই দিচ্ছে না। একটু দেখুন তো।’ আধঘণ্টা পর হোটেলের ম্যানেজার আরও কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে ছুটলেন ২০১ নম্বরে। আবার ডাকাডাকি, এ বার আর শুধু দরজায় টোকা নয়, রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি। নাঃ। এখনও সাড়া নেই। হোটেলের ম্যানেজার জানিয়ে দিলেন, ‘ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। পুলিশকে ইনফর্ম করতে হবে।’

ফোন বেজে উঠল পার্ক স্ট্রিট থানার ডিউটি অফিসারের টেবিলে, ‘স্যর, এক্ষুনি আসুন এখানে। হোটেলের গেস্ট দরজা খুলছেন না।’

থানা থেকে হোটেলের দূরত্ব বেশি নয়। দ্রুতই পুলিশ পৌঁছাল রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের হোটেলে। খোলা হল ২০১ নম্বর রুমের দরজা।

‘ওহ, মাই গড’, আঁতকে উঠলেন পার্ক স্ট্রিট থানার ডিউটি অফিসারটি। ঘরের ভিতরের দৃশ্য খানিকটা এইরকম। অবিন্যস্ত বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে এক তরুণী। পরনে সালোয়ার—কামিজ। হোটেলের চাদরটা তরুণীর কোমর পর্যন্ত টেনে দেওয়া। হাত—পা বাঁধা ইলেকট্রিক তার দিয়ে। দু’হাতে সামান্য কালো পোড়া দাগ, ইলেকট্রিক শক লাগলে যেমন হয়। শরীরের আরও কয়েক জায়গায় ঈষৎ কালো কালো দাগ। নাড়ি টেপার দরকার নেই, এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়, সাড় নেই দেহে।

পার্ক স্ট্রিট থানার ডিউটি অফিসার ডাকলেন, ‘হোটেলের ম্যানেজার কোথায়? ইনি কি একাই এসেছিলেন? সঙ্গে আর কে ছিল? রেজিস্টার বুক কোথায়?’

ম্যানেজার এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্যর, উনি কালই সকালে এসেছিলেন। কিন্তু একা ছিলেন না। সঙ্গে একজন মাঝবয়সি লোক ছিল, একটা বাচ্চা মেয়েও ছিল। লোকটা বলেছিল, স্ত্রী—মেয়েকে নিয়ে কলকাতা বেড়াতে এসেছে। লোকটা নেই। মেয়েটাকেও তো দেখছি না।’

ঘরে একটু খুঁজতে বাচ্চা মেয়েটিকে পাওয়া গেল অবশ্য। বয়স বছর ছয় সাতেকের মধ্যে। জিনস আর চেক শার্ট পরনে। দেখলে মনে হয়, বাইরে বেড়ানোর জন্য যেন তৈরি হয়েই বসে ছিল ফুটফুটে মেয়েটি। হোটেলের রুমেই একটা আলমারির ভিতরে হাত—পা মুড়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে দেহটা। জামাকাপড়ের আড়ালে প্রথমটায় ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল না। তারও হাত বাঁধা। দেহে প্রাণ নেই।

পার্ক স্ট্রিট থানার ডিউটি অফিসারটি ফোন করলেন ওসিকে। খবর গেল লালবাজার কন্ট্রোলরুম, কলকাতা পুলিশের সাউথ ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার, লালবাজারের হোমিসাইড সেকশনেও, ‘ডাবল মার্ডার ইন দ্য হোটেল অফ রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড। রিচ দ্য স্পট অ্যাট দি আরলিয়েস্ট।’

৩০ জুন, ২০১৭, মঙ্গলবার। পার্ক স্ট্রিট ডাবল মার্ডার কেস।

শহরের অভিজাত এলাকা। খবর ছড়াতে দেরি হল না। নিউজ চ্যানেলের প্রাইম টাইমে আলোচনা, কতটা নিরাপদ আমাদের শহর? এমন অভিজাত এলাকায় হোটেলের ঘরে নিঃসাড়ে এক তরুণী ও একটি বাচ্চা মেয়েকে খুন করে চলে যাওয়ার মতো সাহস কীভাবে পেল আততায়ী? পুলিশের উপর চাপ ছিল যথেষ্ট, দ্রুত খুনিকে ধরতে হবে, সে নাগালের বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই।

এরকম ক্ষেত্রে যা হয়, প্রথমে তদন্তকারীরা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন ঘটনাস্থল, হোটেলের ঘরের এক ইঞ্চিও যাতে বাদ না—যায়। ফেলে যাওয়া সিগারেটের টুকরো, নস্যির ডিবে, চশমা, কলম, এমনকি বাস—ট্রেনের টিকিট থেকেও যে বহু অপরাধের কিনারা হয়েছে, হোমস—পোয়ারো থেকে ব্যোমকেশ—ফেলুদার পাঠকরা তা বিলক্ষণ জানেন। বাস্তব গল্পের থেকে অনেকটা আলাদা হলেও অকুস্থলের পরীক্ষা খুঁটিয়ে করতে হয়ই তদন্তকারীকে। প্রথমে হোটেলের ২০১ নম্বর ঘর, তারপর আশপাশের এলাকাটাও। অন্য ঘরের গেস্টদের তালিকাও চেয়ে নিলেন তদন্তকারী অফিসার। ডিসি (সাউথ) থেকে শহরের গোয়েন্দা প্রধান সবাই তড়িঘড়ি চলে এসেছিলেন ঘটনাস্থলে। সঙ্গে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরাও। দুঁদে গোয়েন্দাদের চোখ বলে দিচ্ছিল, দু’জনকেই খুন করা হয়েছে বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে। খুন তো আরও অনেক দেখেছেন হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দারা। কিন্তু এটা কী? বিছানায় শুয়ে থাকা তরুণী এবং আলমারির মধ্যে বসিয়ে রাখা বালিকার হাত দুটো বাঁধা তামার তার দিয়ে। তরুণীর পা—ও ওই তার দিয়ে বাঁধা। সেই তারের সংযোগ রয়েছে সুইচবোর্ড পর্যন্ত। বোঝা যাচ্ছে, সেই তার দিয়েই দু’জনকে বিদ্যুতের শক দেওয়া হয়েছে। হাত—পায়ে খালি চোখে দেখা যায় সেই চিহ্ন। “আ পারফেক্ট সার্কিট,’ বলছিলেন হোমিসাইড বিভাগের অভিজ্ঞ গোয়েন্দাটি।

হোটেলে জমা দেওয়া ভুয়ো পরিচয়পত্র
হোটেলে জমা দেওয়া ভুয়ো পরিচয়পত্র

যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের পরিচয় কী? এঁরা কি মা—মেয়ে? তাহলে সঙ্গে যিনি এসেছিলেন, তিনি কে? তিনি কি ওই তরুণীর স্বামী স্ত্রী—মেয়েকে খুন করে চম্পট দিয়েছেন? হোটেলে আগন্তুক পরিচয় অবশ্যই দিয়েছেন স্বামী স্ত্রী হিসাবে। সেটা কি সত্যি? অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে তদন্তকারী অফিসারের মনে।পার্ক স্ট্রিট থানার এক অফিসার বললেন, ‘এ আর এমন শক্ত কাজ কী? ম্যানেজারবাবু আপনি রেজিস্টার বুকটা নিয়ে আসুন ওখানে তো আগন্তুকের নাম—ঠিকানা নিশ্চয়ই আছে। তিনি যখন বেপাত্তা, আপাতত ধরে নেওয়া যায় খুনটা তাঁরই করার সম্ভাবনা বেশি।’দেখা হল হোটেলের রেজিস্টার। নাম পাওয়া গেল, রামকুমার গুপ্তা। বাড়ি বিহারে। হোটেলে কেউ ঘর বুক করলে নিয়ম অনুযায়ী কোনও সচিত্র পরিচয়পত্রের প্রতিলিপি জমা নেওয়ার কথা ম্যানেজার পুলিশকে বললেন, ‘উনি ভোটার কার্ডের জেরক্স কপি জমা দিয়েছিলেন, স্যর। এই নিন। সেই আইকার্ডে একটা ঠিকানা তো পাওয়া গেল। ছবিটা অবশ্য খুব অস্পষ্ট। —এই লোকটিই কি আপনার হোটেলে ঘর নিয়েছিল? —স্যর, মনে তো হচ্ছে এই লোকই। ঘর আগে দেখে নিলেন। ভাড়া জানতে চাইলেন। সবকিছু পছন্দ হওয়ায় রুম বুক করেছিলেন। ইনিই তো..—আপনার মনে নেই?

—হ্যাঁ, এই হবে। তারপর এই ভোটার কার্ডটা…

—তার মানে লোকটার মুখ না—দেখেই কি আইডেন্টিটি কার্ড জমা নিয়েছিলেন? দেখবেন না, যে লোকটা কার্ড জমা দিচ্ছে, তারই ছবি কার্ডে রয়েছে কি না?

—না, মানে ছবিটা একটু অস্পষ্ট তো! আর ভোটার কার্ড যখন, নিজেরই হবে, অন্যের কেন দেবেন? তাই…

—আপনার হোটেলে সিসিটিভি ক্যামেরা নিশ্চয়ই আছে। ফুটেজ কোথায়? —আজ্ঞে, স্যর, ক্যামেরা ছিল একটা রিসেপশনে। কিন্তু ওটা তো খারাপ আছে ক’দিন হল। সারানো হয়নি।

—এভাবে হোটেল চালাচ্ছেন! ক্যামেরা খারাপ হয়েছে জানেন যখন, সারিয়ে নেননি কেন এতদিন?

মেজাজটা বিগড়ে গেল তদন্তকারী অফিসারের। ফুটেজ থাকলে একবার দেখে নেওয়া যেতে পারত লোকটাকে। ভোটার আইডেন্টিটি কার্ডে যাঁর ছবি রয়েছে, তিনি কি এই লোকটাই? তাছাড়া তিনি কখন বেরিয়েছেন, হোটেলে খুনের আগে—পরে আরও কেউ ঢুকেছিল কি না, সবটা জানা যেত। একটু ধাক্কা খেলেন বটে গোয়েন্দারা। লালবাজারে গোয়েন্দা প্রধানকে গোটা বিষয়টা জানালেন হোমিসাইড বিভাগের ওসি। গোয়েন্দা প্রধান নির্দেশ দিলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ঠিকানায় খোঁজ নাও, রামকুমার লোকটা কে? আপাতত তো এটাই আমাদের কাছে একমাত্র ইনফরমেশন। লোকটা যদি বাড়িতে না—থাকে, খোঁজ শুরু করো।’

দেহ দু’টি ময়না তদন্তে পাঠিয়ে দিয়ে পার্ক স্ট্রিট থানা আর হোমিসাইডের কয়েকজন অফিসার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আরও কয়েকটা বিষয় খোঁজ নিতে। হোটেলের রিসেপশনিস্ট, কয়েকজন বয়—সহ যাঁরা দেখেছিলেন আগন্তুক তিনজনকে, সবার বয়ান নেওয়া দরকার। জানা গেল, মাঝবয়সি লোকটি এই হোটেলে এসেছিলেন যে দিন দেহ উদ্ধার হল, তার আগের দিন, অর্থাৎ সোমবার। দুপুরে হোটেলের ঘরে খাবারের অর্ডার দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। লোকটিকে শেষবার হোটেলের ঘর থেকে বেরোতে দেখেছিল হোটেলেরই কোনও কর্মী, সোমবার বিকেল ৪টে—সাড়ে ৪টে নাগাদ। তারপর তিনি আবার ঘরে ফিরেছিলেন কি না, সেটা অবশ্য নিশ্চিত করে বলতে পারল না কেউ। তবে ওই মহিলা ও বাচ্চা মেয়েটিকে হোটেলের কেউই দেখেনি ঘর থেকে বেরোতে। লোকটির চেহারার একটা বর্ণনা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তদন্তকারীরা। হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরা খারাপ। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সূত্র আর বাকিদের বয়ান থেকে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেল, তা এক এক করে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন তদন্তকারী অফিসার। এক, লোকটির নাম সম্ভবত রামকুমার গুপ্তা, বাড়ি ধরে নেওয়া যেতে পারে বিহারে। অন্তত ভোটার কার্ডের তথ্য তো তা—ই বলছে। তবু সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ। দুই, মৃতরা সম্ভবত তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে, সেই পরিচয়েই হোটেলের ঘর বুক করেছিলেন আগন্তুক। এটাও প্রমাণ সাপেক্ষ। তিন, খুনি নিশ্চিত ভাবে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ ভালো জানে। তা না হলে এভাবে ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট তৈরি করা যে কারও পক্ষে সম্ভব নয়। চার, ঘরের বিছানায় তরুণীর দেহের পাশ থেকে মিলেছিল ঘুমের ওষুধের দুটো স্ট্রিপ, যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে, বিদ্যুতের শক দেওয়ার আগে দু’জনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করা হয়েছিল। তাই বাধা দেওয়ার সুযোগই পাননি কেউ। কিন্তু যে প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল সেগুলোর সমাধান না—করা গেলে তো তদন্ত এগনো মুশকিল। মৃত দু’জন কি সত্যিই আগন্তুকের স্ত্রী ও মেয়ে? তাঁদের নাম কী? খুনি যদি ওই আগন্তুকই হন, তাহলে খুনের মোটিভ কী? খুনির সম্ভাব্য গন্তব্য কোথায়?

ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট চলে এসেছিল বুধবার বিকেল নাগাদ। তদন্তকারীরা যেমনটা আঁচ করছিলেন, সেভাবেই হয়েছে খুন। ২৯ জুন দুপুরের খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্ভবত খুন করা হয়েছে দু’জনকে। খাবার অথবা পানীয়ের সঙ্গে মেশানো হয়েছিল ঘুমের ওষুধ। তারপর বেশ কয়েক মিনিট ধরে দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুতের শক। তবে তদন্তকারীরা মোক্ষম ধাক্কাটি খেলেন রামকুমারের খোঁজ করতে গিয়ে। বিহারের নালন্দার বাসিন্দা রামকুমারকে পাওয়া গেল। তাঁর সাথে কথা বললেন হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দারা। কিন্তু ইনি তো নিপাট ভদ্রলোক। তদন্তকারী অফিসারকে তিনি বললেন, ‘স্যর, আমি তো কলকাতায় আসিইনি। মৃতদের ছবি দেখানো হল তাঁকে। তরুণী বা বাচ্চা মেয়েটি কাউকেই তিনি শনাক্ত করতে পারলেন না। তবু পুলিশের ধন্দ যায় না। পার্ক স্ট্রিট থানার একটা টিম নালন্দায় পাড়ি দিয়েছিল আগেই, যদি সেখান থেকে বাড়তি কোনও সূত্র পাওয়া যায়।

রামকুমার সঠিক তথ্য দিচ্ছেন তো? তিনি যদি কলকাতায় না—আসেন, তাহলে তাঁর ভোটার কার্ড কীভাবে এল কলকাতার হোটেলে? তাঁর কথা যাচাই করতে বাড়ি, কর্মস্থলে গিয়ে কথা বলল পুলিশ। তিনি তো মিথ্যা কথা বলছেন বলে মনে হচ্ছে না। এমনকি রামকুমারের পড়শিরাও কেউ চিনতে পারলেন না মৃত তরুণী আর বাচ্চা মেয়েটিকে? তাহলে হোটেলের লোকটি কে? তাঁর সঙ্গে রামকুমারের যোগাযোগ কীভাবে হল? ওই মহিলা আর বাচ্চা মেয়েটিই বা কারা? হোমিসাইডের দুঁদে গোয়েন্দা তাঁর জুনিয়র অফিসারটিকে বলছিলেন, ‘মার্ডারার ইজ ভেরি ক্লেভার।’ জুনিয়র অফিসারটি বললেন, ‘শুধু চালাক নয় স্যর, লোকটা সাংঘাতিক শয়তান।

খুনের পর উদ্ধার করা মৃতদেহ
খুনের পর উদ্ধার করা মৃতদেহ

ধাক্কা খেলেও তদন্ত থেমে ছিল না। নালন্দার শিলাওয়ে আসল রামকুমারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বেরিয়ে এল একটা সূত্র।

—আপনি কলকাতায় আসেননি। তাহলে হোটেলে আপনার ভোটার কার্ড এল কী করে?

—স্যর, আমার ভোটার কার্ডটা তো খোয়া গিয়েছে।

—কবে? কতদিন আগে? থানায় ডায়েরি করেছিলেন?

—স্যর, আমার ভোটার কার্ডটা তো খোয়া গিয়েছে কয়েক মাস আগে। জামুইয়ে একটা হোটেলের ঘর থেকে?

—হোটেল? কীভাবে? খুলে বলুন তো।

—একটা কাজে যাচ্ছিলাম জামুইয়ে। সেটা গত মে মাসের কথা। ট্রেনে একটা লোকের সঙ্গে আলাপ হল। কথায় কথায় যেমন বাসে—ট্রেনে লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় তেমনই। ওর কথাবার্তা শুনে ভালো লাগল। একটা ব্যবসার ব্যাপারে কথা বলছিলাম। ও বলেছিল, চলুন সামনে হোটেলে গিয়ে কথা বলব। ট্রেন থেকে নেমে দু’জনেই গেলাম হোটেলে। হোটেলের ঘরে কীসব খাবার দিয়েছিল। আর হুশ ছিল না। জ্ঞান যখন ফিরল, ততক্ষণে সব গায়েব। লোকটা, আমার ব্যাগটাও। তখনই খোয়া যায় আইকার্ডটা। থানায় ডায়েরিও করেছিলাম।

বিহার থেকে পুলিশের ইনপুট পৌঁছাল ডিসি সাউথের কাছে। রামকুমারের কাছ থেকে ট্রেনের সেই সহযাত্রীর চেহারার মোটামুটি একটা বর্ণনা পাওয়া গেল। স্কেচ আঁকানো হল লোকটির। সেই ছবি দেখানো হল পার্ক স্ট্রিটের হোটেলের রিসেপশনে। তার চেহারা অনেকটাই মেলে পার্ক স্ট্রিটের হোটেলের লোকটির চেহারার সঙ্গে। ইতিমধ্যে সোর্স নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও হোটেলের সেই আগন্তুকের খোঁজ চলছিল।

পুলিশের সোর্স একটা বিষম বস্তু। ছোট্ট পানের দোকান বা চা—তেলেভাজার গুমটির অনর্গল কথা বলা কর্মী, বাস—ট্রামের যাত্রীর পকেট নিপুণ হাতে কাটায় ওস্তাদ, যৌনপল্লির দালাল—এরকম হরেক স্তরে বিচরণ পুলিশের খোচরের। যার দেওয়া একটা—দু’টো তথ্যে বেরিয়ে আসতে পারে তদন্তের মূল্যবান সূত্র, আবার ঠিকমতো খোচরকে কাল্টিভেট করতে না—পারলে ওই অফিসারেরই পচা শামুকে পা কাটতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। কয়েকজন সোর্সকে দেখানো হল হোটেলে আগন্তুকের মুখাবয়বের স্কেচ। কোনও ট্যাক্সিতে করে হোটেলে এসেছিলেন কি তিনি? হোটেল খুঁজে দিয়েছিল কে? এসব খোঁজ করতে করতেই এক দালালের হদিশ পেলেন তদন্তকারীরা, সে দিন যে ঘর দেখিয়ে দিয়েছিল আগন্তুক আর তার সঙ্গে থাকা মহিলা ও বাচ্চা মেয়েটিকে। তাকে ডেকে আনা হল থানায়। তদন্তকারী অফিসারকে সেই দালাল বলল, ‘স্যর, এই হোটেলটায় তো প্রথমে আমি আনিনি।’

‘তাহলে কোন হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলে?’ প্রশ্ন করেন তদন্তকারী অফিসার।

দালালটি জবাব দেয়, ‘কাছেই অন্য একটা হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলাম ওঁদের। ওখানে রিসেপশনে গিয়ে কথাও বললেন ওঁরা। ঘর পছন্দ হল না বলেই তো এখানে নিয়ে এসেছিলাম। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে এতক্ষণে যেন একটা আলোর দিশা পেল পুলিশ। দালালটিকে সঙ্গে নিয়ে সেই হোটেলে হানা দিলেন তদন্তকারীরা। রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলেন তদন্তকারী অফিসার, আপনাদের হোটেলে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে? ২৯ জুন সকাল থেকে সব ফুটেজ আমাদের দরকার। তরুণ রিসেপশনিস্ট জবাব দেন, ‘ক্যামেরা আছে স্যর। আপনারা দেখে নিন। দালালটিকে পাশে বসিয়ে মন দিয়ে প্রতি মিনিট, প্রতি সেকেন্ডের ফুটেজ পরীক্ষা করছিলেন তদন্তকারী অফিসার। হঠাৎ একটা জায়গায় এসে দালালটি বলল, “স্যর, এই যে, এই লোকটা..’। ‘পজ, জুম করো, আরও একটু..’ সঙ্গে সঙ্গে রিসেপশনিস্টকে নির্দেশ দিলেন তদন্তকারী অফিসার। ফুটেজে একটি লোককে ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেলের রিসেপশনে যেতে দেখা যাচ্ছে। দালালটি বলে, স্যর, এই লোকটাকেই নিয়ে গিয়েছিলাম হোটেলে। এখানে ঘর পছন্দ হল না তো।’ ছবি দেখানো হল আসল রামকুমারকে। চিনতে পারলেন তিনিও, ‘ইয়েস, দিস ম্যান, দিস ম্যান। সেই, কোনও সন্দেহ নেই। এই লোকই রামকুমারকে বেহুশ করে সর্বস্ব লুঠ করেছিল। রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের হোটেলের আততায়ীও সম্ভবত একই লোক। কিন্তু তাকে এখন পাওয়া যাবে কোথায় ? নাম কী, কোথায় বাড়ি—কোনওকিছুই তো জানা নেই। রামকুমারের কাছ থেকে লোকটির একটি নাম জানা গেল। তবে তদন্তকারী অফিসার বললেন, “যে লোক একজনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সর্বস্ব লুঠ করতে পারে, যে অন্য একজনের ভোটার কার্ড দিয়ে হোটেলে ঘর নিতে পারে, সে যে সঠিক নাম—ঠিকানা বলবে না, ধরেই নেওয়া যায়। লোকটা ভীষণ ধূর্ত। সোজা পথে তার নাগাল পাওয়া মুশকিল, অন্য রাস্তা ধরতে হবে। দুঁদে গোয়েন্দার কাজটা টি—টোয়েন্টির ধুমধাড়াক্কা চার—ছক্কা হাঁকানো নয়। বরং অনেকটা বিদেশের সবুজ পিচে পাঁচদিনের ক্রিকেটে বুক সমান। লাফিয়ে ওঠা বল সামলানো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, নাছোড়বান্দা হয়ে। যেখানে একটার পর একটা বাধা আসবে, কিন্তু সে সব ব্যাকরণ মেনে সামলে নাগাল পেতে হবে আততায়ীর। ঠিক সেটাই করে যাচ্ছিলেন পার্ক স্ট্রিট থানা আর হোমিসাইড বিভাগের পোড়খাওয়া অফিসাররা, একটানা, অক্লান্ত। রামকুমারকে মাস খানেক আগে ওই লোকটি যে হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানেও হানা দিল পুলিশের টিম। হোটেল থেকে পুলিশ পেল একটা ফোন নম্বর, যেটা ব্যবহার করেছিল ট্রেনে পরিচয় হওয়া রামকুমারের সেই বন্ধুটি। মোবাইল নম্বরটি বন্ধ থাকলেও যে মোবাইল হ্যান্ডসেটে ব্যবহার হয়েছিল সেই সিমকার্ড—তার খোঁজ মিলল প্রযুক্তির সূত্র ধরেই। জানা গেল, ওই আইএমইআই নম্বরের মোবাইল সেটে ব্যবহার করা হয়েছে আরও ২৬টি সিমকার্ড। যাঁদের নামে সিমকার্ড তোলা হয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই বললেন, হয় খোয়া গিয়েছে মোবাইল, নয় ট্রেনে চুরি হয়েছে। তবু তো যাচাই করতেই হবে প্রতিটি ঠিকানা। কলকাতা পুলিশের টিম একেকটি সিমকার্ডের সূত্র ধরে দৌড়ে বেড়াল জামুই থেকে জসিডি, জসিডি থেকে পাটনা। তবু একটা সূত্র তো পাওয়া গিয়েছে। এ বার শুধু অপেক্ষা, টোপ ফেলে শিকারি যেমন অপেক্ষা করে চলে শিকারের, তেমনই। কখন আবার মোবাইলটা চালু করে আসল খুনি।

খুলতে শুরু করে রহস্যের জট। পুলিশের টিমকে সতর্কভাবে পা ফেলার নির্দেশ গেল কলকাতা থেকে। লোকটা অত্যন্ত ধুরন্ধর। পুলিশ এখানে এসেছে জানতে পারলে পাখি ফুড়ৎ হয়ে যাবে। শেষমেশ চালু হল মোবাইলটা। মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনের সূত্র ধরে জসিডির একটি এলাকার খোঁজ পাওয়া গেল। এ বার দরকার লোকটিকে ‘জিরো ইন’ করা। এলাকা বুঝতে পারলেও তার নির্দিষ্ট ডেরারহদিশ তখনও পায়নি পুলিশ। কারণ, মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনের সূত্র ধরে অবস্থান জানা গেলেও, ঠিক কোন জায়গায়, কোন বাড়িতে রয়েছে অভিযুক্ত—তা নিশ্চিত করে জানা কঠিন। সে জন্য দরকার ম্যানুয়াল সোর্স আর তদন্তকারী অফিসারের দক্ষতা। টাওয়ার লোকেশনের ভিত্তিতে যে এলাকায় পৌঁছালেন তদন্তকারীরা, সেখানকার সম্ভাব্য সবকটা বাড়ির উপরই নজর রাখা হচ্ছিল। তা থেকেই খুঁজে করতে হবে নকল রামকুমারের আসল ডেরা। সাদা পোশাকে আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা। সঙ্গে বিহার পুলিশের টিম। আর কলকাতা থেকে টেকনিক্যাল উইংয়ের গোয়েন্দারা নিরন্তর তথ্য পৌঁছে দিচ্ছিলেন তাঁদের কাছে। হঠাৎ চালু হওয়া মোবাইলটিতে একটা মেসেজ ঢুকতেই টনক নড়ল টেকনিক্যাল উইংয়ের অফিসারদের।

—স্যর, ওই মোবাইল নম্বরে একটা মেসেজ ঢুকেছে। ডিটিএইচ রিচার্জের মেসেজ।

—ইমিডিয়েট লোকেশন দেখুন, কোন ডিটিএইচ শপ থেকে মেসেজ গিয়েছে। ওই চত্বরে নিশ্চিতভাবে খুব বেশি দোকান নেই। দোকানটা খুঁজে বের করাটা খুব কঠিন হবে না।

এ বার কাজটা সত্যিই অনেকটা সহজ হয়ে গেল। জসিডির এই ডিটিএইচ শপের মালিক বাঙালি। ছোট্ট দোকান। পরিচয় দিতে যেচেই সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন দোকানের মালিক।

—স্যর, এই লোকটাকে তো চিনি।

—হ্যাঁ, কিন্তু কোথায় থাকে? নাম কী?

নাম তো জানি না। অল্প কয়েকদিন এসেছে এখানে। কী একটা দরকারে বলল।

—কখনও বাড়ি গিয়েছেন ওঁর?

—গিয়েছিলাম বইকী, ডিটিএইচ সার্ভিসটা চালু করার সময়। একজন মহিলাও আছেন বাড়িতে। হয়তো ওঁর স্ত্রী… —আমাদের একটু দেখিয়ে দেবেন বাড়িটা?

—নিশ্চয়ই চলুন না।

জসিডির কবিরাজ কুঠি—র একটি ফ্ল্যাটে অবশেষে খুনির ডেরার সন্ধান পেয়ে গেলেন গোয়েন্দারা। ওই ফ্ল্যাটে তখন দিব্যি খানাপিনা, অ্যায়স চলছে। ভিতরে কালার টিভি। ঘরে একজন মহিলাকে নিয়ে থাকছেন মাঝবয়সী এক যুবক, ঠিক কলকাতার হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে পাওয়া চেহারার মতো। সেই একই লোক। ঘটনার দশ দিনের মাথায় ধরা পড়ে গেল। কীর্তিমান যুবকটি। নাম বিজয় পণ্ডিত ওরফে আকাশ ওরফে মগন পাণ্ডে। পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। পুলিশকে দেখে তো গোড়ায় আকাশ থেকে পড়ার জোগাড় বিজয়ের।

—আপনারা কারা? আর আমার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস হয় কী করে?

—আমরা লালবাজার থেকে আসছি। যা বলার ওখানে গিয়ে বলবেন।

এখন চলুন আমাদের সঙ্গে।

—কিন্তু আমাকে কেন? কী কী ব্যাপার? পুলিশের বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় এসে পড়ল বিজয়ের গালে। ঘরের এক কোনে ছিটকে পড়ল সে। যার জন্য নাওয়া—খাওয়া ভুলে এতদিন বিহারে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন তাঁরা, সে কি না ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।

—পার্ক স্ট্রিটে ডাবল মার্ডার কেসে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে। এখন চলুন। আপনার কথা পরে শুনব।

আর পাঁচজন ধূর্ত অপরাধী যেমনটা হয়, বিজয় ব্যতিক্রম নয়। কলকাতায় সে কোনওদিন আসেইনি, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের হোটেলের মহিলা ও বাচ্চা মেয়েটিকে চেনে না সে, চেনে না রামকুমারকেও এরকম হাজারো যুক্তি অনর্গল দিয়ে যাচ্ছিল বিজয়। অপরাধ জগতে চালু কথা আছে, লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্টারোগেশন রুম বড় শক্ত ঠাঁই। বেহুশ, একেবারে বোবা সেজে থাকা লোকেরও সম্বিৎ ফিরতে সময় লাগে না বিশেষ। পুলিশের জেরার মুখে বিজয় স্বীকার করে নেয়, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের হোটেলের তরুণী আর বাচ্চা মেয়েটিকে সে—ই খুন করেছে। হোটেলে যে তরুণীর দেহ পাওয়া গিয়েছিল, তিনি হলেন বিজয়ের স্ত্রী কোমল। সঙ্গের বাচ্চা মেয়েটি তাঁর দিদির মেয়ে পদ্মিনী। আর যে মহিলাকে নিয়ে সে থাকছিল জসিডিতে? তিনি কোমলের দিদি প্রমীলা। শ্যালিকাকে অর্ধেক নয়, পুরো ঘরণী করেই হয়তো নতুন করে ঘর বাঁধার অপেক্ষায় ছিল বিজয়। হয়তো নয়।

বিজয়কে জেরায় যা জানা গেল, তা এ পর্যন্ত বলা গল্পের থেকেও রোমাঞ্চকর। সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় এরকম: বিজয়ের বাড়ি বিহারের পাটনায়। কখনও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনও বা রাজমিস্ত্রির কাজ করেছে। ট্রেনে মাদক খাইয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে লুঠপাটের ছোটখাটো কারবারেও তার নাম জড়িয়েছিল। বিহার পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয়ের বিরুদ্ধেই মামলা রুজু করেছিল সেই সব ঘটনায়। তবে বিজয় ধরা পড়েনি।

রামকুমারও তার পাতা ফাঁদে পড়েছিলেন। এ বারের অপারেশনটা অনেক বড় আর সেই জালে যে জড়িয়ে যাবেন তিনিও, ভাবতেই পারেননি রামকুমার। যাক সে কথা। আবার ফেরা যাক বিজয়ের কাণ্ডকারখানায়। জামুইয়ের বাসিন্দা কোমলের সঙ্গে ঘটনার মাস ছয়েক আগে বিয়ে হয় বিজয়ের। তখন থেকেই শ্বশুরবাড়ির বিশাল সম্পত্তির দিকে তার নজর পড়ে যায়। কোমলের সঙ্গে বিয়ে হলেও অল্পদিনের মধ্যেই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যায় তাঁর দিদি প্রমীলার সঙ্গে। পরিবারের বড় মেয়ে। খোঁজখবর নিয়ে বিজয় জানতে পারে, শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির বড় অংশ পাওয়ার কথা প্রমীলারই। স্ত্রী—র দিদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পর্যন্ত ঠিক আছে, গোটা সম্পত্তি হাত করতে হলে তো বাকিদের সরাতে হবে। সেইমতোই ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান কষতে থাকে বিজয়। প্রমীলার মেয়েকে সরানোর ভাবনা প্রথমে প্ল্যানে ছিল না। কিন্তু কোনও এক সময় প্রমীলার সঙ্গে তাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিল মেয়েটি। তাই বিজয়ের কাছে বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছিল সেও। কোমল ও তার দিদি প্রমীলার বছর ছয়েকের মেয়ে পদ্মিনীকে কলকাতা ঘোরানোর নাম করে নিয়ে আসে বিজয়। ট্যাক্সিচালকের পরিচিত এক দালাল মারফত একটা হোটেলে যায় ঘর খুঁজতে। প্রথমে যে হোটেলটিতে নিয়ে যায় দালাল, সেখানে নজরদারি বেশি বলে মনে হয় তার। হোটেলে এত ক্যামেরা, নজরদারি থাকলে তো প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে যাবে। যার জন্য এত কষ্ট করে কলকাতায় আসা ! তাই ঘর দেখে পছন্দ না—হওয়ার ছুতোয় বিজয় ওই হোটেল থেকে বেরিয়ে যায়। তুলনায় সস্তা এবং তার অপারেশনের পক্ষে নিরাপদ একটা হোটেলের খোঁজ করছিল সে। রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের হোটেলটাকে বরং তার কাজের পক্ষে সুবিধাজনক বলে মনে হয়। সেখানেই ঘরে ঠান্ডা মাথায় খুন। দুপুরে বিজয় হোটেলের ঘরেই খাবারের অর্ডার দেয়। ঘুমের ওষুধ মেশানো খাবার ও পানীয় খাইয়ে অচৈতন্য করে ফেলে কোমল—পদ্মিনীকে। তারপর একটানা বেশ কয়েক মিনিট দু’জনকে ইলেকট্রিক শক দেয়। হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে মৃত্যু হয় দু’জনেরই। জেরায় জানা যায়, কোমল—নন্দিনীতেই শেষ হয়নি হত্যালীলা। পার্ক স্ট্রিটের কিছুদিন আগে একই কায়দায় বর্ধমানের একটি হোটেলে ইলেকট্রিক শক দিয়ে প্রমীলার স্বামী সুরজ পণ্ডিতকেও খুন করেছিল সে।

এক এক করে সম্পত্তির সব উত্তরাধিকারীকেই সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল বিজয়। হয়তো প্রমীলাকেও। বড় শ্যালিকার সঙ্গে প্রেমের পর্ব শেষ হলেই হয়তো খতম করে ফেলত তাকেও। ভেবেছিল, ক’দিন যাবে। পুলিশ মিডিয়া হইচই করবে। তারপর সব ঠান্ডা। আর কলকাতা থেকে এত দূরে কে—ই বা তার ঠিকানা খুঁজে পাবে? পেলে তো ধরা পড়বেন রামকুমার। সে ঘুরে বেড়াবে নিরাপদে, নিরুপদ্রবে, পুলিশ আর আইনের নজরজালের বাইরে। তবে দুনিয়ার সবচেয়ে পাকা মাথার অপরাধীও তো ফেলে যায় মূল্যবান সূত্র। কখনও অতিচালাকি, কখনও লোভ, কখনও বুদ্ধিভ্রংশ কাল হয়ে দাঁড়ায় ধূর্ত অপরাধীর। অতি লোভ তাঁত আর তাঁতি—দুটিকেই যে পথে বসায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *