পৃথিবী জুড়িয়া বেজেছে বিষাণ , শুনিতে পেয়েছি ওই — সবাই এসেছে লইয়া নিশান , কই রে বাঙালি কই ! সুগভীর স্বর কাঁদিয়া বেড়ায় বঙ্গসাগরের তীরে , ‘ বাঙালির ঘরে কে আছিস আয়‘ ডাকিতেছে ফিরে ফিরে । ঘরে ঘরে কেন দুয়ার ভেজানো , পথে কেন নাই লোক , সারা দেশ ব্যাপি মরেছে কে যেন — বেঁচে আছে শুধু শোক । গঙ্গা বহে শুধু আপনার মনে , চেয়ে থাকে হিমগিরি , রবি শশী উঠে অনন্ত গগনে আসে যায় ফিরি ফিরি । কত - না সংকট , কত - না সন্তাপ মানবশিশুর তরে , কত - না বিবাদ কত - না বিলাপ মানবশিশুর ঘরে ! কত ভায়ে ভায়ে নাহি যে বিশ্বাস , কেহ কারে নাহি মানে , ঈর্ষা নিশাচরী ফেলিছে নিশ্বাস হৃদয়ের মাঝখানে । হৃদয়ে লুকানো হৃদয়বেদনা , সংশয় - আঁধারে যুঝে , কে কাহারে আজি দিবে গো সান্ত্বনা — কে দিবে আলয় খুঁজে ! মিটাতে হইবে শোক তাপ ত্রাস , করিতে হইবে রণ , পৃথিবী হইতে উঠেছে উচ্ছ্বাস — শোনো শোনো সৈন্যগণ ! পৃথিবী ডাকিছে আপন সন্তানে , বাতাস ছুটেছে তাই — গৃহ তেয়াগিয়া ভায়ের সন্ধানে চলিয়াছে কত ভাই । বঙ্গের কুটিরে এসেছে বারতা , শুনেছে কি তাহা সবে ? জেগেছে কি কবি শুনাতে সে কথা জালদগম্ভীর রবে ? হৃদয় কি কারো উঠেছে উথলি ? আঁখি খুলেছে কি কেহ ? ভেঙেছে কি কেহ সাধের পুতলি ? ছেড়েছে খেলার গেহ ? কেন কানাকানি , কেন রে সংশয় ? কেন মরো ভয়ে লাজে ? খুলে ফেলো দ্বার , ভেঙে ফেলো ভয় , চলো পৃথিবীর মাঝে । ধরাপ্রান্তভাগে ধুলিতে লুটায়ে , জড়িমাজড়িত তনু , আপনার মাঝে আপনি গুটায়ে ঘুমায় কীটের অণু । চারি দিকে তার আপন - উল্লাসে জগৎ ধাইছে কাজে , চারি দিকে তার অনন্ত আকাশে স্বরগসংগীত বাজে ! চারি দিকে তার মানবমহিমা উঠিছে গগনপানে , খুঁজিছে মানব আপনার সীমা অসীমের মাঝখানে ! সে কিছুই তার করে না বিশ্বাস , আপনারে জানে বড়ো — আপনি গণিছে আপন নিশ্বাস , ধুলা করিতেছে জড়ো । সুখদুঃখ লয়ে অনন্ত সংগ্রাম , জগতের রঙ্গভূমি — হেথায় কে চায় ভীরুর বিশ্রাম , কেন গো ঘুমাও তুমি । ডুবিছ ভাসিছ অশ্রুর হিল্লোলে , শুনিতেছ হাহাকার — তীর কোথা আছে দেখো মুখ তুলে , এ সমুদ্র করো পার । মহা কলরবে সেতু বাঁধে সবে , তুমি এসো , দাও যোগ — বাধার মতন জড়াও চরণ এ কী রে করম - ভোগ । তা যদি না পারো সরো তবে সরো , ছড়ে দাও তবে স্থান , ধুলায় পড়িয়া মরো তবে মরো — কেন এ বিলাপগান ! ওরে চেয়ে দেখ্ মুখ আপনার , ভেবে দেখ্ তোরা কারা , মানবের মতো ধরিয়া আকার , কেন রে কীটের পারা ? আছে ইতিহাস , আছে কুলমান , আছে মহত্ত্বের খনি — পিতৃপিতামহ গেয়েছে যে গান শোন্ তার প্রতিধ্বনি । খুঁজেছেন তাঁরা চাহিয়া আকাশে গ্রহতারকার পথ , জগৎ ছাড়ায়ে অসীমের আশে উড়াতেন মনোরথ । চাতকের মতো সত্যের লাগিয়া তৃষিত - আকুল - প্রাণে দিবসরজনী ছিলেন জাগিয়া চাহিয়া বিশ্বের পানে । তবে কেন সবে বধির হেথায় , কেন অচেতন প্রাণ — বিফল উচ্ছ্বাসে কেন ফিরে যায় বিশ্বের আহ্বানগান ! মহত্ত্বের গাথা পশিতেছে কানে , কেন রে বুঝি নে ভাষা ? তীর্থযাত্রী যত পথিকের গানে কেন রে জাগে না আশা ? উন্নতির ধ্বজা উড়িছে বাতাসে , কেন রে নাচে না প্রাণ ? নবীন কিরণ ফুটেছে আকাশে , কেন রে জাগে না গান ? কেন আছি শুয়ে , কেন আছি চেয়ে , পড়ে আছি মুখোমুখি — মানবের স্রোত চলে গান গেয়ে , জগতের সুখে সুখী ! চলো দিবালোকে , চলো লোকালয়ে , চলো জনকোলাহলে — মিশাব হৃদয় মানবহৃদয়ে অসীম আকাশতলে । তরঙ্গ তুলিব তরঙ্গের'পরে , নৃত্যগীত নব নব — বিশ্বের কাহিনী কোটি কণ্ঠস্বরে এককণ্ঠ হয়ে কব । মানবের সুখ মানবের আশা বাজিবে আমার প্রাণে , শত লক্ষ কোটি মানবের ভাষা ফুটিবে আমার গানে । মানবের কাজে মানবের মাঝে আমরা পাইব ঠাঁই , বঙ্গের দুয়ারে তাই শিঙা বাজে — শুনিতে পেয়েছি ভাই ! মুছে ফেলো ধুলা , মুছ অশ্রুজল , ফেলো ভিখারির চীর — পরো নব সাজ , ধরো নব বল , তোলো তোলো নত শির । তোমাদের কাছে আজি আসিয়াছে জগতের নিমন্ত্রণ — দীনহীন বেশ ফেলে যেয়ো পাছে , দাসত্বের আভরণ । সভার মাঝারে দাঁড়াবে যখন , হাসিয়া চাহিবে ধীরে , পুরবরবির হিরণ কিরণ পড়িবে তোমার শিরে । বাঁধন টুটিয়া উঠিবে ফুটিয়া হৃদয়ের শতদল , জগতমাঝারে যাইবে লুটিয়া প্রভাতের পরিমল । উঠ বঙ্গকবি , মায়ের ভাষায় মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ — জগতের লোক সুধার আশায় সে ভাষা করিবে পান । চাহিবে মোদের মায়ের বদনে , ভাসিবে নয়নজলে — বাঁধিবে জগৎ গানের বাঁধনে মায়ের চরণতলে । বিশ্বের মাঝারে ঠাঁই নাই বলে কাঁদিতেছে বঙ্গভূমি , গান গেয়ে কবি জগতের তলে স্থান কিনে দাও তুমি । এক বার কবি মায়ের ভাষায় গাও জগতের গান — সকল জগৎ ভাই হয়ে যায় , ঘুচে যায় অপমান ।