আস্তিনের তাস
প্রথমে হুমকি দেওয়া কয়েকটা ফোন পেয়েছিলাম। তারপর অফিসে দুবার হানা দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তারপর আর আসতে পারেননি।
প্রথমবারে যখন আসেন তখন ওঁর চেহারায় পরিপাটি একটা ব্যাপার ছিল। ভেতরে উত্তেজনা থাকলেও মুখে শান্ত ভাব বজায় রেখেছিলেন। আমার চেম্বারে ঢুকে পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি সীমারেখার হাজব্যান্ড—অশোকেন্দু—মানে, অশোক বোস…।’
সীমারেখা। ওর শরীর আর যৌবনের কোনও সীমানা নেই। তাই ওকে সবসময় আমি ‘অসীমা’ বলে ডাকতে ভালোবাসি।
এই লোকটা—এই কালো চেহারার হোঁতকা কালাচাঁদ পাবলিকটা সীমারেখার স্বামী! ভাবাই যায় না।
সীমা অবশ্য বলেছিল, ওর স্বামীকে কুৎসিত দেখতে—শুধু দেখতে নয়, ভেতরটাও কুৎসিত। সুযোগ পেলেই ওকে মারধোর করে। আর ওই স্যাডিস্টটার সঙ্গে বিছানা মানে লাঞ্ছনা আর যন্ত্রণা।
আমি লোকটাকে বসতে বলিনি ইচ্ছে করেই। কারণ, আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তা হলে এই লোকটাই গত ক’দিন ধরে আমাকে টেলিফোনে হুমকি দিচ্ছে।
সে-কথাই জিগ্যেস করলাম অশোকেন্দুকে। এবং আশ্চর্য! তিনি মুখের ওপরে সোজাসাপটা বলে দিলেন, ‘হ্যাঁ—আমিই। আপনি সীমার সঙ্গে বৃন্দাবনটা এবার বন্ধ করুন। নইলে…।’
‘নইলে কী?’ শান্ত চোখে অশোকের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম।
‘নইলে আজেবাজে কিছু হয়ে যেতে পারে। আমি সিরিয়াসলি বলছি। সেইজন্যেই ফোন ছেড়ে আপনার অফিসেই সোজা চলে এসেছি। আপনাকে এটাই আমার লাস্ট রিকোয়েস্ট…।’
একবার মনে হল, লোকজন ডেকে হতচ্ছাড়া স্বামীটাকে কষে পালিশ করাই। কারণ, এই অফিসটার মালিক আমি। আমার মুখের এই অফিসের সংবিধান।
কিন্তু একটু পরেই মনে হল, না, তাতে কেচ্ছা ছড়াবে। তাই ওঁকে বসতে বলে ঠান্ডা গলায় কথা বলেছি। এমনকী বোয়ারাকে ডেকে কোল্ড ড্রিঙ্কও আনিয়ে দিয়েছি।
অনেক করে বুঝিয়েছিলাম অশোকেন্দুকে। বলেছিলাম, ‘দেখুন, ব্যাপারটা শুধু আমার একার নয়—সীমাও জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। ওকে আমি যেমন ভালোবাসি, তেমনই ও-ও আমাকে…। মানে, আপনি ডির্ভোস টাইপের কিছু ভাবতে পারলে ভালো হত। মানে, আমাদের বাকি লাইফটা…।’
‘অসম্ভব। সীমারেখাকে আমি হার্ট অ্যান্ড সোল—মানে, ওকে ছাড়া লাইফ আমি ভাবতেই পারি না। ও আমার কাছে…আমার কাছে…।’
অশোকেন্দুর গলা কাঁপছিল। কিছু-কিছু হাজব্যান্ড এমন সেন্টিমেন্টাল হয় যে, লজিক বুঝতে চায় না। এটাও দেখছি সেই টাইপের।
আমার চেম্বারে এসি চলছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সীমারেখার স্বামী ঘামছিল। লোকটা কি অন্য কোনও মতলব নিয়ে এসেছে নাকি? বারবার প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাচ্ছে, বের করছে। কেমন যেন উসখুস করছে।
আমার সন্দেহ ধীরে ধীরে বাড়ছিল। লোকটা কেমন যেন একটা দোটানায় ভুগছে।
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু কোনও লাভ হল না। অশোকেন্দু তীক্ষ্ন নজরে আমাকে মাপছিলেন। সীমারেখাকে হারানোর ভয়টা ওঁর মুখে ছেয়ে ছিল।
আশ্চর্য! ক’দিন আগেও যে-মানুষটা আমাকে মোবাইল ফোনে হুমকি দিচ্ছিল, আজ সে একেবারে তুলতুলে টুলটুলি!
অশোকের চোখের কোণে দু-একফোঁটা জলও দেখতে পেলাম। মনে হল, বউকে তিনি সত্যি-সত্যিই ভালোবাসেন। কিন্তু কী করব? আমিও যে ওঁর বউকে ভালোবাসি!
অশোককে আমি বললাম, ‘দেখুন, প্রবলেমটা ডিসকাস করার জন্যে আমার এই চেম্বারে আপনি আসতে পারেন…তবে একটু সন্ধে করে আসবেন। তখন অফিস একেবার ফাঁকা হয়ে যায়—ডিসটার্ব করার কেউ থাকে না। আমি তো মাঝে-মাঝে একা-একা বসে একটু এনজয়ও করি…’ হাত বাড়িয়ে আমার ঠিক পেছনে টাঙানো একটা ভারী পরদা সরিয়ে দিলাম। তাকে সাজানো গ্লাস আর বোতলগুলো দেখা গেল। একটা শ্বাস টেনে বললাম, ‘একদিন সন্ধের পর আসুন…দুজনে মিলে একটু ঠুনঠুন পেয়ালা করা যাবে। সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও রাখব। আপনার ভালো লাগবে…আই প্রমিস…।’
অশোকেন্দু এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি ঘেন্না করার মতো একটা কুপ্রস্তাব দিয়ে ফেলছি। কিন্তু আমি ওঁর চাউনি গায়ে মাখলাম না। জীবন কখন কী বাঁক নেয় কে বলতে পারে! হয়তো একদিন এই লোকটাই ছুটে আসবে আমার কাছে—আমার আসরে ভাগ বসাতে চাইবে।
শেষ পর্যন্ত আমাকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে অশোকেন্দু চলে গেলেন।
অশোকেন্দু যখন দ্বিতীয়বার হানা দিলেন তখন ঠিক, যা ভেবেছিলাম, তাই হল। আমার একক আসরে ভাগ বসালেন তিনি। তবে তার আগে যেসব কাণ্ড হল তা রীতিমতো মারাত্মক।
রাত প্রায় আটটার কাছাকাছি। অফিসে আমার চেম্বারে একা-একা বসে একটু ঢুকুঢুকু করছিলাম। হঠাৎই এসি রুমের কাচের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল অশোকেন্দু বোস।
ওঁর যা চেহারা দেখলাম তাকে এককথায় বলা যায় উদভ্রান্ত।
চোখের কোল বসে গেছে। মাথার চুল উসকোখুসকো। শার্টের দুটো বোতাম খোলা। কপালে ঘামের ফোঁটা। অল্প-অল্প হাঁপাচ্ছেন।
ঘরে ঢুকেই আমার গ্লাসটপ টেবিলের ওপরে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন অশোক, ‘সীমারেখা কোথায়?’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? বসুন—।’
‘শিগগির বলুন—রেখা কোথায়?’ অশোকেন্দুর গলা কাঁপছিল।
আমি আর-একটা গ্লাস তৈরি করলাম। সুরা, সোডা এবং জল যথাযথ অনুপাতে মেশালাম। ওঁর সামনে এগিয়ে দিয়ে শান্তভাবে বললাম, ‘বসুন। এটা খেয়ে একটু রিল্যাক্স করুন। আপনি এসেছেন…ভালোই হয়েছে। আপনার সঙ্গে কতকগুলো জরুরি কথা আছে—।’
আমার নির্লিপ্ত মেজাজ দেখে অশোক কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন। ওঁর উত্তেজনার বারুদে ধীরে-ধীরে যেন জল পড়ল। জামার হাতা দিয়ে মুখ মুছলেন। চোখও। তারপর ধরা গলায় বললেন, ‘পরশু থেকে রেখাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে আপনার ইস্যুটা নিয়ে ওর সঙ্গে একটু ঝগড়া হয়েছিল তাতে ও রাগ করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ভেবেছিলাম দু-চার ঘণ্টা পর ফিরে আসবে—কিন্তু আসেনি। পরদিন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছি। সরাসরি সব কথা তো সবাইকে বলা যায় না—তাতে নিজেদেরই কেচ্ছা বেরিয়ে পড়বে।’ বড়-বড় শ্বাস নিলেন অশোক। চেয়ারে বসতে গিয়েও বসলেন না। গ্লাসটা ধরতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘…তবু যতটা সম্ভব ঠারেঠোরে খোঁজ নিয়েছি। খোঁজ পাইনি। সীমারেখা কোথায় কেউই বলতে পারল না। তখন বাকি রইলেন আপনি…।’
কথা বলতে-বলতে টেবিলটাকে পাশ কাটিয়ে আমার কাছাকাছি চলে এলেন অশোক। আচমকা কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘তুই—তুই সব জানিস। বল, রেখা কোথায়?’
অশোক কান্নায় ভেঙে পড়েছেন বটে, তবু একইসঙ্গে মসৃণ ভঙ্গিতে পকেট থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করে আমার গলায় চেপে ধরেছেন।
‘চেঁচালেই গলা ফাঁক করে দেব। বল, রেখা কোথায়।’
আমি ভয় পেলাম। হঠাৎই গলা শুকিয়ে জিভটা শিরীষ কাগজের টুকরোর মতো ঠেকল। কিন্তু বেশ কষ্ট করে মুখের হাসি-হাসি ভাবটা বজায় রাখলাম। কারণ, কানের নীচে ছুরির ধারালো চাপটা টের পাচ্ছিলাম। কোনওরকমে আওয়াজ বের করে বললাম, ‘বলছি—সব বলছি। আপনি প্লিজ ঠান্ডা হয়ে বসুন। প্লিজ…।’
অশোকেন্দু কী ভাবলেন। গলায় ছুরির ছাপটা নরম হল। বুঝলাম, মানুষটার একরোখা ভাব একটু কমেছে। তাই ‘লোহা গরম থাকতে-থাকতে পেটানো দরকার’ সেই সূত্র মেনে অনুরোধ-উপরোধের বন্যা বইয়ে দিলাম।
কাজ হল। অশোকেন্দু আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন। ছুরিটাকে ঢুকিয়ে ফেললেন পকেটে। তারপর: ‘এবার বলুন, সীমারেখা কোথায়?’
আমি গলায় বারকয়েক হাত বুলিয়ে বললাম, ‘আপনি এক্সাইটেড হয়ে এসব কী কাণ্ড করতে যাচ্ছিলেন? যদি সত্যিই ওই ছুরিতে একটা অঘটন ঘটে যেত, আপনি কি পার পেতেন? সীমারেখাই পুলিশে খবর দিত। হয়তো এ-কথাও বলত যে, আমার মার্ডারের ব্যাপারে আপনাকেই ও সন্দেহ করে…।’
অশোকেন্দু অদ্ভুতভাবে হাসলেন, বললেন, ‘অত ভেবে মানুষ খুন করে না। তা ছাড়া খুনের সাক্ষী পুলিশ পাবে কোথা থেকে? আপনার অফিসে তো এখন একটা দারোয়ান ছাড়া আর কেউ নেই। ঢোকার সময় ওকে পাঁচশো টাকা বকশিস দিয়েছি। টাকা নিয়ে ও হাওয়া খেতে গেছে। ও ফিরতে-ফিরতে আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। তা ছাড়া আপনার চেম্বারে ঢোকার প্যাসেজের দরজাটা আমি ভেতর থেকে লক করে দিয়েছি। এখানে আমাদের কেউ ডিসটার্ব করতে আসবে না…।’ টেবিলে আঙুলের টোকা মেরে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। তারপর:’আর সীমারেখার কথা বলছেন? আপনি খরচ হয়ে গেলে প্রথম ক’দিন হয়তো ও কান্নাকাটি করবে। তারপর সামলে নেবে। আর পুলিশ-টুলিশে খবর ও দেবে না। আপনিই যখন আর নেই তখন পুলিশে খবর দিয়ে ও শুধু-শুধু কেন কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির পাবলিসিটি করবে?’ বরং দু-বেলা খাওয়া-পরা-ফূর্তির নিশ্চিন্ত জীবনকেই বেছে নেবে। আমার টাকায় লাইফকে এনজয় করতে রেখা ভালোবাসে…আমার হাসলেন—তবে এবারের হাসিটা আত্মবিশ্বাসের: ‘…তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে বুঝতে পারছেন?’
আমি ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লাম, বললাম, ‘হুঁ, বুঝতে পারছি—।’
‘তা হলে শিগগির বলে ফেলুন, ‘সীমারেখা কোথায়—।’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম: ‘নাঃ, আর লুকিয়ে লাভ নেই। সত্যি কথাটা আপনাকে বলেই ফেলি…।’
‘গুড।’ ঠোঁট বেঁকিয়ে সামান্য হাসলেন অশোকেন্দু।
ওঁর গ্লাসটার দিকে ইশারা করে বললাম, ‘নিন। চিয়ার্স—।’
অশোক গ্লাসটা এবার নিলেন, চুমুক দিলেন। আমার কথা শোনার জন্যে ওঁর চোখ আগ্রহ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
টেবিলের একপাশে একটা শৌখিন টিফিনবক্স রাখা ছিল। সামান্য ঝুঁকে পড়ে ওটা কাছে টেনে নিলাম।
স্টিলের ঢাকনাটা খুলতেই মাটন কাবাবের ফুরফুরে গন্ধ ঝাপটা মারল। পেঁয়াজ আর ক্যাপসিকাম দিয়ে ফ্রাই করা ছোট-ছোট বোনলেস মাংসের টুকরো।
আমার চেয়ারের পেছনের পরদা সরিয়ে একটা টমেটো সসের শিশি বের করে নিলাম। শিশিটায় ঝাঁকুনি দিয়ে টিফিন কৌটোর চিত করা ঢাকনায় সস ঢাললাম। অশোকেন্দুকে ইশারা করে বললাম, ‘নিন, দারুণ খেতে…।’ তারপর আমি একটুকরো কাবাব তুলে নিয়ে সসে ঠেকিয়ে মুখে ফেললাম: ‘আঃ, গ্র্যান্ড!’
অশোক হাত বাড়িয়ে একটুকরো কাবাব পেঁয়াজ আর ক্যাপসিকাম সমেত গুছিয়ে নিলেন। সস মাখিয়ে মুখে দিয়ে তৃপ্তি করে চিবোতে-চিবোতে বললেন, ‘উঁ, একসেলেন্ট। হ্যাঁ, আপনি কী যেন বলছিলেন…।’
‘হ্যাঁ…বলছি। শুনলে আপনার অবাক লাগবে…সীমারেখা কখনও সেভাবে আমাকে ভালোবাসেনি। ও আমাকে—।’
আমাকে বাধা দিয়ে অশোকেন্দু বললেন, ‘ওসব গালগল্প ছেড়ে আসল কথা বলুন।’ তারপর গ্লাসে চুমুক দিলেন।
‘বিশ্বাস করুন, এটাই আসল কথা। এটাই ভেতরের কথা। আর এটা আমি জেনেছি মাত্র তিনদিন আগে। অথচ ওকে বিয়ে করব বলে আমি মনে-মনে তৈরি ছিলাম। আমি…মানে, আমরা দুজনেই তৈরি ছিলাম।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘সবই আমার কপাল! সেদিন যখন রেখাকে বললাম, ”এসো, এবার একটা দিন ঠিক করে সাতপাক হয়ে যাক,” তখন ও বেঁকে বসল। বলল, ”কেন, এই তো বেশ চলছে—এটা খারাপ কী! ডিভোর্সের ব্যাপারটা খুব ডেলিকেট। আমি অনেক ভেবে দেখেছি…আমি ওসব পারব না। প্লিজ, তুমি একটু আমার দিকটা ভেবে দ্যাখো…।”
‘ব্যস, সব আশনাই শেষ। বললাম না, সবই আমার কপাল। সারাটা জীবন আমি ব্যর্থ প্রেমের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাই আমি ড্রিঙ্ক করি মনের দুঃখে।’
আমি একটুকরো কাবাব মুখে দিলাম। স্বাদ নিতে-নিতে আয়েস করে চিবোতে লাগলাম। অশোকেন্দু কৌতূহলী চোখে আমাকে দেখছিলাম। চোখ না সরিয়েই টিফিনবাস্কের দিকে হাত বাড়ালেন। বললেন, ‘আপনার কাবাবে ভাগ বসাচ্ছি…আপনি কিছু মাইন্ড করছেন না তো?’
‘দুর, কী যে বলেন! রেখার খোঁজে আপনি আসতে পারেন ভেবেই বেশি করে তৈরি করেছি।’
‘আপনি এটা রান্না করেছেন নাকি?’ ব্যঙ্গের সুরে প্রশ্ন করলেন অশোক।
‘হ্যাঁ। কেন, খেতে খারাপ লাগছে?’
‘না, না। দারুণ…।’
‘আসলে ব্যাচিলার মানুষ। একা-একা থাকি। তাই রান্না শিখতে হয়েছে বহুকাল আগেই…। যাকগে, যা বলছিলাম…।
‘প্রথম আমি ভালোবেসেছিলাম তানিয়া চৌধুরীকে। হয়তো ও-ও আমাকে। তারপর একদিন বিয়ের কথা উঠল। তাতে ও অসভ্যের মতো হেসে ফেলল। বলল, আমার সঙ্গে নাকি বন্ধুত্ব করা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না। হঠাৎ আমার মধ্যে এমন বিয়ের বাতিক জেগে উঠল কেন…বেশ তো চলছিল। তো এইরকম সব কথাবার্তা বলল তানিয়া। বিয়ে করার সাধটা যে একটা বাতিক সেটা ওর কাছেই প্রথম জানলাম।
‘কিন্তু আমার মুশকিলটা কোথায় জানেন, মিস্টার বোস? আমি কখনও হার মানতে শিখিনি। তাই একদিন ডেকে পাঠালাম তানিয়াকে…ওকে গঙ্গার ধারে আসতে বললাম…আউটরাম ঘাটে।’
কথার ফাঁকে-ফাঁকে কাবাব আর গ্লাস চলছিল। গ্লাস খালি হলেই আমি সোডা, জল আর ইয়ে মিশিয়ে দিচ্ছিলাম। আর আয়েস করে কাবাব চিবোচ্ছিলাম দুজনেই।
‘তারপর?’ আগ্রহে জানতে চাইলেন অশোক। ওঁর চোখে কৌতুকের খেলা দেখে বুঝতে পারছিলাম আমার গল্পটা এখনও গল্পই থেকে গেছে ওঁর কাছে।
‘…তানিয়া এল। সন্ধে হল। দুজনে বসে অনেক গল্প করলাম। আমি অনেক কান্নাকাটি করলাম। তারপর হঠাৎ ওকে খুন করে ফেললাম।
‘নির্জন রাত। নরম গলা। আর আমার শক্ত হাত। কোনও অসুবিধেই হল না ওকে খতম করতে।’ মুখের কাবাবের টুকরোটা শেষ করে গ্লাসে চুমুক দিলাম: ‘পরদিন প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ওর ডেডবডি পাওয়া গিয়েছিল। ওর প্রেমিক হওয়ার সুবাদে পুলিশ আমাকে প্রচণ্ড হ্যারাস করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি। কারণ, কোনও প্রমাণ ছিল না ওদের হাতে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ব্যস। তানিয়া শেষ—তানিয়ার গল্পও শেষ। এবার কুন্তলিনীর গল্প শুরু…।’
অশোকেন্দুর মুখ থেকে কৌতুকের আস্তরণ অনেকটা সরে গেছে। শান্তভাবে গ্লাসে চুমুক দেওয়ার চেষ্টা করলেও লক্ষ করলাম, ওঁর হাত কাঁপছে। একটু যেন উশখুশ করছেন এখন।
‘কুন্তলিনী কে?’
‘আমার দ্বিতীয় প্রেমিকা। কুন্তলিনী রায়। ও ম্যারেড ছিল—সীমারেখার মতো। ওর হাজব্যান্ডের নাম ছিল অলক।
‘যাই হোক, দ্বিতীয়বারেও সেই একই গল্প। কুন্তলকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। ওর পাতলা চেহারা, টানা-টানা চোখ আর চওড়া ঠোঁটে যে কী ম্যাজিক ছিল কে জানে! তা ছাড়া খুব সুন্দর গান গাইতে পারত। ওর দিকে তাকিয়ে আমি সব ভুলে যেতাম। তাই ওকে ”ছেলেভোলানো মেয়ে” বলে ডাকতাম—ওকে খ্যাপাতাম।
‘মাসছয়েক চলেছিল আমাদের প্রবল প্রেম। তারপর, এক সন্ধ্যায়, ওর একক সঙ্গীতের আসর শেষ হওয়ার পর ওকে বিয়ের কথা বললাম।
‘না, কুন্তল তানিয়ার মতো বাজে ভাবে হেসে ওঠেনি। বরং খুব সিরিয়াস মুখ করে বলে উঠেছে, ”অলককে আমি ভীষণ ভয় পাই। বেসিক্যালি হি ইজ আ বিস্ট। ড্রিঙ্ক করলে ওর আর কোনও জ্ঞান থাকে না। ডিভোর্স-টিভোর্সের কথা বললে হি উইল জাস্ট গো ওয়াইল্ড। সব রাগে ছারখার করে দেবে, তছনছ করে দেবে। তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো, প্লিজ…।”
‘ক্ষমা শব্দটা আমি খুব ঘেন্না করি, মিস্টার বোস। আমার দিকটা কুন্তলিনী মোটেই ভাবেনি। ও আমার সঙ্গে রিলেশানটা শেষ করে দিতে চাইল। তাই আমিও ওকে শেষ করে দিলাম…শেষ…চিরকালের মতো।’
আমি একটুকরো কাবাব তুলে নিয়ে সস ছুঁইয়ে কামড় দিলাম। বললাম, ‘দারুণ টেস্টফুল, না? আসলে এটা একটা স্পেশাল কাবাব…।’
অশোকেন্দুও কাবাব চিবোচ্ছিলেন। একটু যেন থমকে গেলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘শেষ করে দিলেন মানে?’
হাসলাম আমি: ‘শেষ মানে শেষ। ফুলস্টপ। ওকে আমি ডিনারে নেমন্তন্ন করেছিলাম। বাড়িতেই। সে-রাতে ঝমাঝম বৃষ্টি হচ্ছিল—রাত ন’টায় রাস্তায় কোনও লোক ছিল না। ও এল ভিজে একসা হয়ে। বলল, ওর হাজব্যান্ড ড্রিঙ্ক করে বেহেড হয়ে পড়ে আছে।
‘বেশ জুত করে আমরা ডিনার সারলাম। তারপর ভারী চপারের এক কোপে কুন্তলের গলার নলি কেটে দিলাম। ডাইনিং টেবিলে সে একেবারে রক্তরক্তি কাণ্ড।
‘যাই হোক, মাঝরাত পর্যন্ত খুব খাটুনি গেল আমার। ওর বডিটা টেনে নিয়ে গেলাম বাড়ির পেছনের ছোট বাগানটায়। রক্ত-টক্ত সব ধুয়ে-মুছে নিলাম। তারপর বডিটা ছোট-বড় টুকরোয় কুচিয়ে ছড়িয়ে দিলাম বাগানে।
‘আপনাকে বলা হয়নি, আমার কুকুর পোষার শখ আছে। তিনটে ডোবারব্যাম। কালো রঙের। কান ক্রপ করা। ওদের দু-দিন না খাইয়ে চেন বেঁধে রেখেছিলাম। চেন খুলে দিতেই গন্ধের টানে ওরা ছুটল বাগানে। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি চলল—তার সঙ্গে চাপা হিংস্র গর্জন। সেদিন প্রায় সারারাত ধরে ওদের ফূর্তি চলেছিল। এবং কুন্তলিনী জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে গেল এই দুনিয়া থেকে।’
আমি চাপা বিষণ্ণ গলায় একঘেয়ে সুরে কুন্তলিনীর শেষকৃত্যের কথা শোনাচ্ছিলাম। লক্ষ করলাম, অশোকেন্দু বেশ গোল-গোল চোখ করে আমাকে দেখছেন। প্রাণপণে বুঝতে চেষ্টা করছেন, গল্পটা বানানো, না সত্যি।
গ্লাসে মদিরা ঢাললাম। অশোকেন্দুর গ্লাসেও। তারপর আমরা প্রায় একইসঙ্গে চুমুক দিলাম।
‘পরশু সকালে, এই ন’টা নাগাদ, সীমারেখা আমাকে ফোন করেছিল। ওকে আবার রিকোয়েস্ট করলাম। হতভাগার মতো কেঁদেও ফেললাম। কিন্তু ও অটল-অনড়। যেমন চলছে চলুক না। ডিভোর্সের কথা বলে আমি নাকি ফর নাথিং কমপ্লিকেশান তৈরি করছি। এত অবুঝ হওয়ার কোনও মানে হয়!
আমি কান্না থামিয়ে মন শক্ত করলাম। সীমাকে বাড়িতে ডেকে পাঠালাম…।’
‘হ্যাঁ, পরশু সন্ধে থেকেই ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।’ উত্তেজিতভাবে বললেন অশোকেন্দু। সামনে ঝুঁকে কাবাব তুলে নিলেন আবার। চিবোতে-চিবোতে জড়ানো গলায় বললেন, ‘আপনি জানেন রেখা কোথায় আছে। বলুন, ও কোথায়?’
আমি গ্লাসে দুবার চুমুক দিয়ে বললাম, ‘সীমারেখা আমার কাছেই আছে। ও আর ফিরবে না, মিস্টার বোস—।’
অশোকেন্দু আমার শেষ কথাটা হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু ওঁর হাসিটা কেমন শুকনো দেখাল। তবু সহজ হওয়ার চেষ্টায় কাবাব খেতে-খেতে জড়ানো স্বরে বললেন, ‘রেখা ফিরবে না এটা হতেই পারে না। বলুন, ও কোথায় আছে?’
আমি কাবাবসুদ্ধু টিফিনবক্সটা অশোকের মুখের সামনে তুলে ধরে বললাম, ‘এইখানে। এই সীমাকাবাব আমি নিজের হাতে রান্না করেছি—।’
অশোক বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করলেন। কাশতে-কাশতে ওঁর মুখ বেগুনি হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। যন্ত্রণা কমাতে বুক খামচে ধরলেন। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন টেবিলের ওপরে। ওঁর গ্লাস, সসের শিশি, সব ভেঙে চুরমার। গোটা টেবিল সুরার গন্ধে ম’-ম’ করে উঠল।
আমি আপনমনেই ঠোঁটের কোণে হাসলাম। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলাম। সীমারেখার নম্বর ডায়াল করলাম।
ও ফোন ধরতেই বললাম, ‘সব শেষ। আর কোনও প্রবলেম নেই। অশোকেন্দু এইমাত্র বিষম খেয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। তোমার সঙ্গে অ্যাট লিস্ট ফিফটিন ডেজ আমার কোনও কনট্যাক্ট থাকবে না। আমাকে একদম ফোন-টোন করবে না। বরং বিধবার রোলে পারফেক্ট অ্যাক্টিং-এর চেষ্টা করো। তুমি এক্ষুনি হোটেল থেকে বাড়ি ফিরে যাও। ও. কে? আই লাভ ইউ, অসীমা…।’
‘আই লাভ ইউ টু—।’ মিষ্টি গলা ভেসে এল।
পরশু থেকে সীমারেখা হোটেল আইল্যান্ড-এ আছে। আর অশোকেন্দুর হার্ট প্রবলেমের খবর ও-ই আমাকে দিয়েছিল। তবে বাকি গালগল্প—মানে, তানিয়া, কুন্তলিনী ইত্যাদি সব আমারই তৈরি।
আমি ছোট্ট করে বললাম, ‘চিয়ার্স’। তারপর আরাম করে গ্লাসে চুমুক দিলাম। একটুকরো কাবাব তুলে নিয়ে সস মাখিয়ে মুখে দিলাম।
সত্যি, নিখুঁত খুনের মজাই আলাদা।