1 of 2

আসল-নকল – প্রণব রায়

আসল-নকল – প্রণব রায়

মহকুমা জেলের এক নিভৃত সেলে বসে এই কাহিনী শুনেছিলাম। বলেছিল একজন দ্বীপান্তরের আসামী। তারই জীবন কথা। লোকটার বয়স হবে বছর পঁয়ত্রিশ। শুকনো দোহারা দেহ, বেশ লম্বা, কি এক অদৃশ্য বোঝার ভারে একটু ঝুঁকে পড়া। গাঢ় তামাটে রঙের মুখের রেখায় রেখায় ঠেকে-যাওয়া আর ঠকে-যাওয়া জীবনের প্রচুর ইতিহাস লেখা।

আমি ফৌজদারী আদালতের আইনজীবি। ক্রিমিনাল কেসে নাম আছে অল্পবিস্তর। লোকটা তার জানা একজনকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। মামলার আগে নয়, রায় বেরোবার পর। তার মামলার বিশদ খবর আমি রাখিনি, তবে শুনেছিলাম এমন বিচিত্র কেস এ মহকুমায় আর একটিও আসেনি।

মনে মনে একটু কৌতূহল ছিল, তাই জেলের মধ্যে গিয়ে দেখা করলাম। লোকটা এ তল্লাটের নয়, কি জাত তাও জানিনে। পরনে জীর্ণ কালো রঙের চুড়িদার পায়জামা আর কালো ওয়েস্ট কোট, মাথায় মুখে রুখু ঝাঁকড়া চুল আর গোঁফ-দাড়ি। হাত-পায়ের পেশীগুলো গোটা গোটা, শক্ত। সবচেয়ে অদ্ভুত তার চোখ দুটো। থেকে থেকে মশালের মত দপ করে জ্বলে উঠে নিভে যায়। আর সেই চোখে মাঝে মাঝে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, কিন্তু কিছুই দেখে না যেন। অথবা অশরীরী কিছু লক্ষ্য করে। সেই সময় লোকটার দিকে তাকালে গা ছমছম করে ওঠে।

তার সেলের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, হতে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ির ঝমঝম আওয়াজ করতে করতে সে তখন ছোট্ট সেলটার মধ্যেই অশান্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জেলার বললে, তোমার ব্যারিস্টারবাবু এসেছেন।

লোকটা মশাল-জ্বালা চোখে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হেসে সহজ ভাবে বললে, ভেতরে আসুন কত্তা।

জেলার সেল খুলে দিল। ভেতরে গেলাম। লোকটা সোজাসুজি বললে, আপীল করতে চাই, ব্যালিস্টারবাবু।

আমিও সোজাসুজি জবাব দিলাম, খুনের চার্জ তোমার বিরুদ্ধে, সাজা মুকুব হবে বলে মনে হয়।

লোকটা একটু হেসে বললে, সাজা বদল তো হতে পারে।

মানে?

লোকটা ব্যগ্র গলায় বললে, কালাপানির বদলে ফাঁসি তো হতে পারে। আপনি আমার ফাঁসির জন্যে আপীল করে দিন ব্যালিস্টারবাবু।

কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলাম। এ কেমনতর মানুষ, যেচে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে চাইছে? কয়েদী মাত্রই একটু অপ্রকৃতিস্থ হয়ে থাকে, কিন্তু এ লোকটা আগাগোড়াই অপ্রকৃতিস্থ নাকি? না জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ বীতস্পৃহ?

লোকটা ঝমঝমিয়ে একেবারে আমার সামনে এসে বললে, আমি জানি কত্তা, হাকিমরা আপনার কথা শোনে। আপনি আমার হয়ে আপীল করে দিলে ঠিক ফাঁসি হয়ে যাবে।

বললাম, কালাপানি গিয়েও কত লোকে আবার ফিরে আসে। তুমি ফাঁসি চাইছ কেন?

কেমন অসহিষ্ণু গলায় লোকটা বলে উঠল, সে তো ঢের দেরি কত্তা। সে যাবার সময় বলেছিলাম, আমিও জলদি যাচ্ছি। আমার কথার খেলাপ হয়ে যাচ্ছে হুজুর। সে ভাবছে রূপলালটা বেইমান!

তার মশাল-চোখ দপ করে জ্বলে উঠল, আর দেখতে দেখতে নিভে গেল। তারপর সেই বর্ণহীন চোখের স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দেয়ালের দিকে। যেন অশরীরী কাউকে দেখছে।

গা’টা আমার ছমছম করে উঠল। তবু বললাম, কে তোমায় বেইমান ভাবছে? কার কথা বলছ?

আস্তে আস্তে সহজ হয়ে এল সে। তারপর বললে, গোড়া থেকেই বলি তবে শুনুন।

সেদিন সেই অদ্ভুত কয়েদীর মুখে আরো অদ্ভুত যে কাহিনী শুনেছিলাম, সেটা অপ্রাকৃত কি অলৌকিক, না একান্তই আজগুবি, তা আপনারাই বিচার করুন। আমি শুধু রূপলালের সেই আশ্চর্য কাহিনী শুনিয়ে যাচ্ছি।

পছিয়ার মাঠে ছোট ছোট তাঁবু পড়েছে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে নানা জায়গা থেকে বেদের দল এ গাঁয়ে এসে আস্তানা পাতে। পছিয়ার মাঠই হল তাদের ডেরা। মেলা বসে, বেদের দল বাজীর খেলা দেখায়, লোকের হাতের রেখা বিচার করে, আর বেদেনীরা রঙিন পুঁতির মালা আর কুলো-ডালা বিক্রি করে। তারপর বসন্তকাল পড়লেই মরশুমী পাখির মত সব উধাও।

পছিয়ার মাঠে এ বছর এসেছে এক আজব দল। পায়ে হেঁটে নয়, সাতটা মোষের গাড়ি বোঝাই করে। এরা সার্কাস দেখায়, তিনটে ক্লাউন মজার চেহারা নিয়ে অনবরত তামাসা করে, বাঁদর কুকুর ছাগল সাইকেল চালায়, টিয়াপাখি কথা বলে, আরো কত কি! এ দলের প্রধান আকর্ষণ যে, সে হল ‘কালা যাদুগর’। অন্ধকার তাঁবুর মধ্যে শুধু একটা মোমবাতির আলোয় মুখ দেখে সে মানুষের ভবিষ্যৎ ঠিক-ঠিক বলে দিতে পারে।

ছোট ছোট তাঁবুগুলো থেকে একটু তফাতে ওই যে বড় তাঁবুটা, ওটাই সার্কাসের আসর। বেলা দুপুর গড়িয়েছে, সূর্য মাথার ওপর হেলেছে। বড় তাঁবুর সামনেটা লোকের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। আশপাশের পাঁচখানা গাঁ থেকে লোক আসছে। পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে যেন দিনের কুয়াশা। তাঁবুর দরজার সামনে একটা উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে, একজন ক্লাউন মাথায় ঠোঙার মত রঙিন টুপি পরে ঝাঁঝর-করতাল হাতে চিৎকার করে ছড়া কাটছে:

এসো ভাই, দেখে যাও,

হাজার মজা লুটে নাও।

দু’ আনাতে দেখবে খাসা

কেয়া মজাদার রঙ-তামাসা!

আর দু’ আনা ফেললে পরে

কালা যাদুগরের ঘরে।

যাদুতে ভাই জানতে পাবে

রাজা হবে না ফকির হবে॥

ছড়ার শেষে ঝমর ঝমর করতালের আওয়াজ।

ক্লাউনের ডান পাশে বসে আছে থলথলে চেহারার একজন আধ্যবয়সী লোক। সামনে ডালার ওপর ফুটো-করা একটা বাক্স। তার কাজ শুধু দর্শকদের হাত থেকে পয়সা নিয়ে সেই ফুটোর মধ্যে ফেলে দেওয়া। আর বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে আছে কালা যাদুগর। কালো সাটিনের চুড়িদার পায়জামা পরনে, গায়ে কোমর পর্যন্ত খাটো কালো ওয়েস্ট কোট, মাথায় কালো সাটিনের রুমাল বাঁধা, আর চোখে জলদস্যুদের মত চশমা-প্যাটার্ন মুখোশ। কালো পোশাকে মোড়া লম্বা দেহটা তার স্থির হয়ে আছে।

ওই আমাদের রূপলাল। পাঁচ বছর আগেকার রূপলাল। তখন তিরিশ বছরের জোয়ান। উৎসুক দৃষ্টিতে রূপলাল তাকিয়ে আছে ভিড়ের দিকে। গাঁয়ের দেহাতী লোকদের ভিড়, তাঁবুতে আগে ঢোকার জন্যে ঠেলাঠেলি করছে।

রূপলালের উৎসুক চঞ্চল দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল এক জায়গায়। হ্যাঁ, আজও এসেছে ওরা! বুড়োর হাত ধরে সেই মেয়েটি। ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিয়ে ওরা তিনদিন এল। অথচ তাঁবুর ভেতরে পা দেয়নি একদিনও। বুড়োকে দেখলে গরীব চাষী বলেই মনে হয়। মাথার চুলগুলো একেবারে সাদা। কিন্তু মেয়েটা যেন টাটকা মৌসুমী ফুল! বছর সতেরো আঠারোর বেশি বয়স হবে না। নতুন কচি পাতার মত শ্যামলা রঙ, ঢলঢলে মুখ, চুল বাঁধেনি, মেঠো হাওয়ায় বারবার মুখে এসে পড়ছে।

বুড়োটা তো তাকিয়ে আছে রূপলালের দিকেই, কিন্তু মেয়েটা কেন তাকাচ্ছে না? কেন সে অপলক চোখে একটা নিষ্পত্র বাদাম গাছের দিকে তাকিয়ে রয়েছে?

ভিড় আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে এল। বড় তাঁবুর ভেতরটা প্রায় ভর্তি, খেলা এখুনি শুরু হবে। আসর জমানোর জন্যে ক্লাউন ভেতরে চলে গেছে, চলে গেছে বাক্স নিয়ে সেই থলথলে চেহারার লোকটিও। প্ল্যাটফর্মের ওপর একা রূপলাল। রূপলালের খেলা শেষের দিকে।

মেয়েটার হাত ধরে এগিয়ে এল বুড়ো। রূপলাল আজ যেচেই বললে, খেলা দেখবে নাকি?

বুড়ো ঘাড় নেড়ে বললে, না।

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রূপলাল বললে, পয়সা লাগবে না, দেখো গে যাও!

কিন্তু এত বড় প্রলোভনেও মেয়েটা চঞ্চল হল না। একটু বিষণ্ণ হাসি হেসে বুড়ো বললে, না যাদুগর, খেলা দেখবার লেগে আসি নাই। আমার দরকার তোমার সাথে—একটু নিরিবিলি চাই।

রূপলাল একটু অবাক হয়ে বললে, নিরিবিলি চাই! তাহলে সন্ধের পর আমার তাঁবুতে এসো।

মেয়েটা কেমন যেন ভয় পেয়ে বুড়োর হাত চেপে ধরে বললে, না, রেতের বেলা পছিয়ার মাঠে দানোরা আসে!

রূপলাল হেসে ফেললে। বললে, আচ্ছা, তবে থাক, আমিই যাব। ঘর কোথায় তোমার?

উত্তর দিলে বুড়ো, উই শালতলীতে। খুশিদের ঘর বললে দেখিয়ে দিবে।

খুশি কে?

একটু হেসে বুড়ো বললে, এই যে—আমার মেয়ে। ঠিক যাবে তো কত্তা?

যাব।

চলে গেল মেয়েকে নিয়ে বুড়ো। আশ্চর্য, এতক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটা রূপলালের দিকে, কিন্তু কোন ভাবেরই ছায়া পড়ল না তার চোখে।

মেয়েটির দেহে যৌবন এসেছে, কিন্তু মনের বয়স কি হয়নি?

যাবে বলে পুরোদস্তুর বেদে, রূপলাল হল তাই। বাপ-মা কে, কোথাকার লোক, জানে না। জ্ঞান হওয়া থেকে ঘুরছে বেদের দলের সঙ্গে, বড় হয়ে উঠেছে তাদেরই আওতায়। এ-দল থেকে ও-দল, এ-গ্রাম ছেড়ে ও-গ্রামে।

ছোটবেলায় দড়ির ব্যালান্স শিখেছিল। সরু দড়ির ওপর দাঁড়িয়ে কসরৎ দেখাতো মেলায়। আঠারো বছর বয়স অবধি। তারপর ভিড়ে গেল এক নেপালী বৌদ্ধ তান্ত্রিকের সঙ্গে—পাক্কা ছ’বছর। এই ছ’টা বছর রূপলালের জীবনে সবচেয়ে বিচিত্র অধ্যায়। তার জীবনের মোড় ঘুরে গেল এই ছ’ বছরে।

নেপালী তান্ত্রিক ছিল জ্যোতির্বিদ আর জ্যোতিষবিদ্যায় পারদর্শী। শুধু মুখ আর কপালের গঠন দেখে লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ আশ্চর্যভাবে গণনা করতে পারত। আর কথা কইত মৃত আত্মাদের সঙ্গে। বিশেষ করে যাদের মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে, সেই সব নিম্নস্তরের প্রেতাত্মাদের সঙ্গে। এ হেন তান্ত্রিকের অনুগত চেলা হয়ে রূপলাল গুরুর সঙ্গে চলে গেল তিব্বতের মঠে। সাড়ে পাঁচ বছর বাদে যখন আবার ফিরে এল বেদের দলে, তখন সেই দুর্লভ বিদ্যা তার সম্পূর্ণ আয়ত্ত হয়ে গেছে। সে শিখেছে প্রেতাত্মাদের আবাহন করতে আর তাদের সাহায্যে জীবিত মানুষের ভবিষ্যৎ জেনে নিতে। এখন থেকে রূপলালের রূপ হল অন্য, পেশা হল ভিন্ন। মিশমিশে কালো সাটিনের আঁটোসাঁটো পোশাকে সেজে সে যখন অন্ধকার স্টেজে এসে দাঁড়ায়, হলদে মোমের আলোয় তাকে দেখে দর্শকের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

সেই থেকে তার নাম হল ‘কালা যাদুগর’।

সন্ধের পর নিজের তাঁবুতে বসে একটু জিরিয়ে রূপলাল বেরিয়ে পড়ল শালতলীর উদ্দেশে। জায়গাটা পছিয়ার মাঠ থেকে মাইলটাকের মধ্যে। খুশিদের বাড়িটা জিজ্ঞেস করতেই পাওয়া গেল। বাড়ি বলতে খানদুয়েক মেটে ঘর আর উঠোন। রূপলাল তার কালো পোশাক পরে আসেনি, তাই বুড়ো প্রথমে চিনতে পারলে না। তারপর ডেকে বসালো ঘরের মধ্যে। ডেকে আনলো খুশিকে পাশের ঘর থেকে। বললে, এই এর লেগেই তোমারে কষ্ট দেওয়া যাদুগর। মেয়েটার কপালে কি লেখা আছে, ভাল করে দেখে বলে দাও।

রূপলাল একটু হেসে বললে, এই ব্যাপার! তা কাল তোমার মেয়েকে তাঁবুর মধ্যে নিয়ে গেলেই তো পারতে।

সাদা মাথা নেড়ে বুড়ো বললে, না যাদুগর, ওভেনে ভয়ে খুশি ভড়কে যেতো। তুমি ঘরেই দেখে দাও, তোমার পাওনা আমি ডবল দেব।

ঘরের কোণে কাঠের পিলসুজে একটা প্রদীপ জ্বলছিল। পকেট থেকে হলদে মোমবাতি বের করে প্রদীপ থেকে জ্বলে নিলে রূপলাল, আর ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলে প্রদীপটা। তারপর এসে বসল খুশির মুখোমুখি। হলদে মোমের আলো খুশির মুখের ওপর ফেলতেই চমকে উঠল রূপলাল। ডাগর ডাগর দুই চোখের তারায় মণি নেই। আলোহীন ভাষাহীন বোবা দুই চোখ।

খুশি তাহলে অন্ধ! এতক্ষণে বুঝল রূপলাল, সার্কাসের তাঁবুর সামনে তার দিকে তাকিয়েও ওই দুটি চোখ কেন তার সঙ্গে কথা বলেনি!

রূপলাল প্রশ্ন করলে, খুশির চোখ এমন হয়েছে কদ্দিন থেকে মোড়ল?

একটা নিশ্বাস ফেলে বুড়ো বললে, জন্ম থেকেই। তাই তো পোড়াকপালীর কপালের লেখনটা জানতে চাইছি কত্তা। হাতখান দেখা খুশি।

রুপোর চুড়ি পরা একখানা হাত অসঙ্কোচে এগিয়ে এল রূপলালের দিকে। আর রূপলালেরও একখানা হাত আপনা থেকেই তুলে নিল একমুঠো তুলোর মত সেই নরম হাতখানাকে।

কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই খুশির হাতখানা ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি হাত দেখি না, মুখ দেখে বলি।

মশাল-জ্বালা দুই চোখের দৃষ্টি খুশির মুখের ওপর কেন্দ্রীভূত করে রূপলাল চেয়ে রইল আর অস্পষ্ট দুর্বোধ্য ভাষায় তন্ত্রের মন্ত্র আওড়াতে লাগল। মাঝে মাঝে কাঁপতে লাগল হলদে মোমের শিখা।

বাইরে ঝিঁঝিঁ-ডাকা রাত। মুহূর্তের পর মুহূর্ত চলে যাচ্ছে। দুর্বোধ্য তিব্বতী ভাষার তন্ত্রমন্ত্র রূপলালের চাপা গম্ভীর গলায় ক্রমশ দূরের ঘণ্টাধ্বনির মত মিলিয়ে আসতে লাগল। কেঁপে-ওঠা মোমের আলোয় খুশির ছায়াও পেছনের মেটে দেয়ালে কাঁপতে লাগল। আর মনে হতে লাগল, ঘরের আবছা অন্ধকারে ছায়া ছায়া মূর্তি ধরে কারা যেন নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে, ফিসফিস করে কথা বলছে।

স্থির হয়ে বসে আছে খুশি—দৃষ্টিহীন দুই চোখ মেলে। মোমবাতির হলদে আলোয় মূখখানা তার অসম্ভব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। এই শীতের রাতেও কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রূপলাল বুঝতে পারলে তার ওপর প্রেতাত্মার ভর হয়েছে। তার চোখের মশাল আরো যেন উগ্র হয়ে উঠল। সেই উগ্র চোখের দৃষ্টি খুশির ফ্যাকাশে চোখের ওপর কেন্দ্র করে রূপলাল তার শেষ মন্ত্র উচ্চারণ করলে। বুড়ো দেখতে পেল না, কিন্তু রূপলাল স্পষ্ট দেখল, খুশির মুখখানা শুকনো পাতার মত ক্রমশ কালো হয়ে আসছে। মাথার ওপর চক্র দিচ্ছে একটা বাদুড়। আশেপাশে কিলবিল করছে বিষধর সাপ।

সেই ছবি দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে উঠল রূপলাল, তার চোখের মশাল আস্তে আস্তে নিভে এল। এ কী দেখল সে! এ যে অমঙ্গল—ভয়ানক অমঙ্গলের লক্ষণ! সে তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, খুশির মত সুন্দর, সরল, পবিত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ-জীবনে এমন বিশ্রী অমঙ্গল এমন মর্মান্তিক দুঃখ লুকিয়ে ওৎ পেতে আছে!

অস্থির হয়ে রূপলাল পকেট থেকে ধুপের মত একটা পদার্থ বের করে জ্বালিয়ে দিলে। সুগন্ধি ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে লাগল। সেই ধোঁয়ায় অশরীরী প্রেতাত্মার দল ঘর থেকে একে একে বিদায় নিল। সহজ আর হালকা হয়ে এল ঘরের বাতাস। স্বাভাবিক হয়ে এল খুশির মুখের রং। রূপলাল প্রদীপ জ্বেলে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল।

এতক্ষণে বুড়ো মোড়ল নড়েচড়ে বসল। সংশয় আর অনিশ্চয়তায় কাঁপা গলায় বললে, কী দেখলে যাদুগর, আমার খুশির মুখে? তোমার কালা যাদুবিদ্যের কিরে, সত্যি কথাই বল!

কিন্তু সত্যি কথাটা রূপলাল বলতে পারেনি। বলতে শুধু মুখেই বাধেনি, তার মনেও বেধেছিল। বলেছিল সে উল্টো কথা।

হাসি মুখেই রূপলাল বললে, ভালই দেখলাম মোড়ল। মেয়ে তোমার সুখী হবে—খুব সুখী হবে। দুঃখের আঁচড়টি ওর গায়ে লাগবে না, যদি—

যদি কি?—উৎসুক গলায় বুড়ো বললে।

খুশির ঢলঢলে মুখের দিকে তাকালে রূপলাল। টিকালো নাকের রুপোর নাকছাবি চিকচিক করছে। দেখতে পায় না, তবু বোবা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে রূপলালেরই দিকে। বড় মায়া, বড় মমতা হল রূপলালের, বললে, যদি কেউ ওকে জীবনভোর আগলে রাখে।

ভারি কথা বললে। কে আগলে রাখবে গো সারা জেবন? কানী মেয়েকে কে নেবে?

নেবে বৈকি! সময় হলে ঠিক নেবে—আদর করে নেবে।

সত্যি বলছ যাদুগর?

মিথ্যে বলে লাভ?

বুড়োর মুখখানা জ্বলজ্বল করে উঠল। আর—আর অকারণে আঁচল দিয়ে মুখখানা ঘষে ঘষে লাল করে তুললে, না লাল মুখখানার রং মোছবার চেষ্টা করতে লাগল, একমাত্র খুশিই জানে।

যাবার সময় বুড়ো ট্যাঁক থেকে একটা গোটা টাকাই বের করে দিলে। হেসে ফিরিয়ে দিয়ে রূপলাল বললে, এখন থাক। আমার পাওনা আমি যেচেই নেব। চলি খুশি।

ছোট্ট জবাব এল, এসো যাদুগর।

উঠোন অবধি এগিয়ে দিলে খুশি। যাবার আগে রূপলাল বললে, আমাকে তোমার ভয় লাগে, না খুশি? আমি ভূত নামাই, দানো নামাই।

খুশি বললে, তখন থেকে আর ভয় লাগে না।

কখন থেকে?

একটু চুপ করে থেকে আবছা গলায় খুশি বললে, সেই যখন তুমি আমার হাত ধরলে।

ভারি মিষ্টি আওয়াজ খুশির! সেই আওয়াজের মিঠে রেশ কানে নিয়ে রূপলাল চলে গেল।

শীতের শুরু থেকে আজব সার্কাস পার্টি বসন্তকাল অবধি রয়ে গেল পছিয়ার মাঠে। বড় তাঁবুতে লোকের ভিড় আর কমে না। সেই থলথলে-চেহারা লোকটির বাক্স পয়সাতে উপুছুপু।

রূপলাল রোজ বিকেলে তাঁবুতে ‘কালা যাদু’র খেল দেখায়, আর সন্ধেবেলা গুটি গুটি হাজির হয় শালতলীতে। কোনদিন বা সকালবেলাতে। খুশির হাত ধরে বেড়িয়ে নিয়ে আসে ঝমুকি নদীর ধার অবধি। কোন কারণে এক-আধদিন যেতে না পারলে, পরের দিন খুশি চুপ মেরে যায়। তিনবার না ডাকলে সাড়া মেলে না।

রূপলাল বলে, কি হল তোমার? অমন গুম হয়ে আছো কেন? আসতে পারিনি বলে রাগ-গোসা হল নাকি?

আস্তে আস্তে খুশি বলে, রাগ-গোসা নয় যাদুগর, ভয়। রূপলাল জানে, তবু প্রশ্ন করে, কিসের ভয়?

খুশি বলে, তা জানি না। থেকে থেকে মনে হয় কারা যেন চুপিসাড়ে ঘুরছে আমার পাশে, তাদের নিশ্বেসের হাওয়া গায়ে যেন লাগে।

রূপলাল জানে। তার গুরুর দেওয়া তান্ত্রিক বিদ্যার দৌলতে সে বোঝে, কোন অমঙ্গল, কোন অকল্যাণের ছায়া থেকে থেকে খশির গায়ে বিষ-নিশ্বাস ফেলে যায়। এক মুহূর্তের জন্যে থমথমেহয়ে ওঠে রূপলালের মুখ। বুক ভরে যায় বড় মায়ায়, বড় মমতায়। পরক্ষণেই হেসে খুশির হাত ধরে বলে, এবার? ভয় লাগছে?

খুশির ঢলঢলে শ্যামলা মুখখানি নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় প্রসন্ন হয়ে উঠল। ঝিকমিক করে ঠোঁটের কোণে হাসি। বলে, না যাদুগর, তুমি কাছে থাকলে, তুমি ছুঁয়ে থাকলে আর ভয় করে না।

একটু চুপ করে থেকে রূপলাল বলে, তবে তো মুশকিল হল খুশি, আমি তো বেদে মানুষ, হুট বলতে দলের সঙ্গে কবে ভেসে পড়ব কে জানে। তখন কি হবে?

উত্তরে খুশি রূপলালেরহাতটাজোরে চেপে ধরে।

প্রশ্নটা রূপলাল যেন খুশিকে করে না, করে নিজেকেই। কিন্তু উত্তর আর মেলে না।

তারপর ফাল্গুনের শেষে চৈত্রের গোড়ায় পছিয়ার মাঠ থেকে তাঁবু তোলা শুরু হয়ে গেল। সাত-সাতটা মোষের গাড়ি বোঝাই হয়ে, ধুলোয় ধুলোয় পছিয়ার মাঠ অন্ধকার করে, আবার চলতে শুরু করল। সে গাড়িতে সবাই ছিল, ছিল না শুধু রূপলাল।

রূপলাল রয়ে গেল সেই শালতলীতেই।

বুড়ো মোড়ল প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি। জন্ম-কানী মেয়েকে কেউ জেনেশুনে বিয়ে করতে চায় নাকি? কিন্তু রূপলাল যখন নাছোড়, তখন আনন্দে কেঁদে ফেললে বুড়ো। বললে, তুমি আমায় বাঁচালে যাদুগর। আমার আর ক’দিন বলো? পোড়াকপালীর ভাবনায় রেতে আমার ঘুম ছেলো না—মরতে সুখ ছেলে না!

অবাক হয়ে গেল শালতলীর লোকেরা। কানী মেয়ে খুশির বিয়ে! যার-তার সঙ্গে নয়, সার্কাস পার্টির কালা যাদুগরের সঙ্গে।

বাসর-রাতে খুশি চুপি চুপি বললে, আমার লেগে তুমি একি করলে যাদুগর?

রূপলাল হেসে বললে, এখনো তুমি আমায় যাদুগর বলেই ডাকবে?

ফিক করে হেসে খুশি বললে, তুমি যাদুগরই তো? সেই পেরথম দিন থেকেই আমায় সুদ্ধু যাদু করেছ যে!

রূপলাল পরম আদরে রূপোর নাকছাবি-পরা টিকোলো নাকটি নেড়ে দিলে।

তার পরের বছরই বুড়ো মোড়ল মারা গেল।

বেদেও ঘর বাঁধল। সে-ঘর দু-দশদিনের নয়, চিরদিনের। জীবনটা যে এমন ভাবে হঠাৎ মোড় ঘুরে যাবে, রূপলাল কি তা জানত! রূপলাল কি ভেবেছিল, ত্রি-সংসারে যার কেউ নেই, এই শালতলীতে তার সবচেয়ে আপনজন জুটে যাবে?

আর খুশিও কি কোনদিন স্বপ্ন দেখেছিল, সারাটা জীবন কেউ তাকে আগলে রাখবে? শালতলীর বসন্তকাল কখন যে দুটি মন রাঙিয়ে দিল, তা কেউ জানে না। রূপলাল-খুশিও জানে না।

বড় সুখেই দিন যায়। খুশির মন থেকে ভয়ের ছায়া ধুয়ে-মুছে গেছে। আর রূপলালও ভুলে গেছে খুশির অশুভ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত।

ঠিক এই সময় নিতাইয়ের সঙ্গে দেখা।

ঝুমকির ধারে বসেছিল ওরা। একেবারে পাড় ঘেঁষে একটা বাবলা গাছের তলায়। বেলা তখন ঢলছে। ওপারের হিজল বনের আড়াল থেকে কে যেন মুঠো মুঠো সোনার আবির ছুঁড়ে এপারের সাথে হোলি খেলছে!

রূপলাল আর খুশি যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিল। স্বপটা ভেঙে গেল একটা মেঠো গলার সুরেলা আওয়াজে। আওয়াজটা দূর থেকেই আসছে। রূপলাল তাকিয়ে দেখলে, ডিঙি বেয়ে একটা মানুষ এপারের দিকে আসছে আর গলা ছেড়ে গান ধরেছে:

সিঁয়াকুল তুলতে গিয়ে

হল এ কি জ্বালা লো, হল এ কি জ্বালা।

গলাতে জড়িয়ে গেল বনফুলের মালা॥

ডিঙিটা কাছাকাছি আসতে রূপলাল দেখলে, পাতলাপানা একটা ছোকরা ডিঙি বাইছে। বয়সে তার চেয়ে দু-চার বছরের ছোটই হবে। নিকষ কালো চেহারা। মুখখানা যেন পোটোর হাতে গড়া। ঝাঁকড়া বাবরী চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। হালকা গেরুয়া রঙের খাটো ধুতি সরু মাজায় আঁট করে বাঁধা। গায়ে সেই রঙেরই ফতুয়া।

একটা আশশ্যাওড়া ঝোপের পাশে ডিঙিখানা বাঁধলে সে। তারপর বাবলাতলায় চোখ পড়তেই গানটা তার থেমে গেল। শুধু গান থেমে গেল না, লোকটার নড়াচড়া এমন কি নিশ্বাসটুকুও যেন থেমে গেল।

খুশি হঠাৎই চঞ্চল হয়ে বলে উঠল, চল, ঘরে যাই।

রূপলাল বললে, কেন বল দিকি?

খুশি বললে, কে যেন প্যাঁট প্যঁট করে তাকিয়ে আছে।

অবাক হয়ে গেল রূপলাল অন্ধ খুশির কথা শুনে। সত্যিই তো, লোকটা এদিকেই তাকিয়ে আছে! পথে-ঘাটে তাকায় তো কতজন, কই, খুশি তো টের পায় না! আজ টের পেল কেন? ওকে টের পাওয়াল যে, সে লোকটাই বা কে?

খুশি রূপলালের হাতে নাড়া দিয়ে বলল, ওঠো!

কিন্তু ওরা উঠে যাবার আগেই ডিঙির লোকটা একেবারে কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে। হাসিমুখে বললে, কালা যাদুগর না?

রূপলাল জবাব দেবার আগেই লোকটা নিজেই ঘাড় নেড়ে বলল, হুঁ, চিনতে আমার ভুল হয়নি। গেল শীতে বাদামতলার মেলায় দেখেছিলাম আমি। আমি নেতাই গুণীন।

গুণীন!

রূপলালের মনে হল, গুণীন না হয়ে কবিয়াল হলেই নিতাইকে মানাত ভাল। চোখ দুটো তার সদাই হাসছে।

রূপলাল বললে, কিসের গুণীন?

নিতাই বললে, সাপে কাটলে আমি ঝাড়ফুঁক করি, বাতের ব্যথা আরাম করি, বাঁজা মেয়েছেলেকে ওষুধ দিই, আর ঝুমুর গেয়ে বেড়াই।

গলা খুলে হেসে উঠল নিতাই। নিতাইয়ের চোখ দুটো শুধু হাসে না, সে নিজেও এমন হাসে যে বোঝা যায় মানুষটা দিলদরিয়া। একটু খ্যাপাটেও বটে। মজা লাগল রূপলালের।

হাসি থামিয়ে নিতাই জিজ্ঞেস করল, সঙ্গে উটি কে ওস্তাদ?

রূপলাল বললে, আমার পরিবার।

মোড়ল বুড়োর মেয়ে খুশি, না? তা বেশ, তা বেশ।

গলা ছেড়ে আবার হেসে উঠল নিতাই।

রূপলালের হাতে টান দিয়ে অসহিষ্ণু গলায় খুশি বললে, ঘরে চলো।

ঘর কোথায় ওস্তাদ?—নিতাই প্রশ্ন করলে, শালতলীতে?

রূপলাল বললে, হুঁ। কিন্তু শালতলীতে তোমায় তো আগে দেখিনি? খুশিকে চেনো নাকি?

হা-হা করে আবার হেসে উঠে নিতাই বললে, চিনি বৈকি ওস্তাদ। হাসিকেও চিনি, খুশিকেও চিনি। জেবনটাই যে হাসিখুশির মেলা!

হাতে আবার টান পড়তেই রূপলাল দেখলে, উল্টো পথে খুশি দু-পা এগিয়ে গেছে। পিছু নিলে সে। বাবলাতলায় দাঁড়িয়ে নিতাই চেয়ে রইল সেদিকে। তারপর আচমকা গলা ছেড়ে গান ধরলে:

অলো সই, কেনে এমন

হয়্যাছে মন উচাটন,

বুঝি লো বশীকরণ

জানে চিকনকালা।

হল এ কি জ্বালা লো, হল বিষম জ্বালা॥

দিন দুই বাদে একদিন দুপুরে উঠোনের বেড়ার ওপার থেকে ডাক শোনা গেল; ওস্তাদ, ঘরে আছ?

ঘরেই ছিল রূপলাল। ক্ষেত থেকে ফিরে সবে স্নান-খাওয়া সেরেছে। বেরিয়ে এসে দেখে নিতাই গুণীন। বললে, এই ভরদুপুরে কি মনে করে গুণীন?

কপালের ওপর থেকে ঘামে-ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে নিতাই বললে, কথা আছে ওস্তাদ। আগে দাওয়ায় বসতে বল!

নিতাই অবশ্য রূপলালের বলার অপেক্ষা রাখলে না, নিজেই এসে চেপে বসল। তারপর ফতুয়ার পকেট থেকে ‘লাল লণ্ঠন’ সিগারেট বের করে একটা রূপলালকে দিলে, একটা নিজে ধরালে। কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছেড়ে, আসার কারণটা বললে, আমি জানি যাদুগর, কালা যাদুবিদ্যায় তুমি কত বড় ওস্তাদ। তোমার ওই মহাবিদ্যাটি আমায় শেখাতে হবে।

রূপলাল বললে, সেকি নেতাই, তুমিও তো গুণীন, কত বিদ্যে তোমার জানা।

ঠোঁট উল্টে নিতাই বললে, কিছু না, কিছু না ওস্তাদ। আমার একটা বিদ্যেই জানা, আর সব বুজরুকি।

কোন্ বিদ্যে জানা? রূপলাল প্রশ্ন করলে।

মা ধূমাবতির বিদ্যে—রূপ-বদল।

উৎসুক হয়ে উঠল রূপলাল: ওটা কোন্‌ বিদ্যে গুণীন? শিখলে কোন্ ক্ষ্যামতা বাড়ে?

হেসে নিতাই বলে, সে বড় মজার বিদ্যে। তোমায় শিখিয়ে দেব’খন। কিন্তু আগে তোমার বিদ্যে আমায় দেবে বল?

রূপলাল বললে, দেব না কেন? তবে কালা যাদুবিদ্যে বড় ভজকট—ভূত-পেরেতের কারবার; শিখতে সময় লাগে।

নিতাই বললে, তা লাগুক। —বলে ফতুয়ার পকেট থেকে আরো কয়েকটি জিনিস বার করলে নিতাই। একটি নতুন ছোট কলকে, সিকি তোলা গাঁজা, লাল সুতো এক গজ, পাঁচটা কড়ি আর পাঁচটি টাকা। বস্তুগুলি রূপলালের পায়ের কাছে রেখে নিতাই বললে, আজ থেকে আমাকে সাগরেদ করে নাও।

রূপলাল বললে, আজ নয়, পরশু অমাবস্য—সেদিন থেকে।

ঠিক?

ঠিক।

বাবা ভূতনাথের দিব্যি?

বাবা ভূতনাথের দিব্যি।

চাপা একটা আনন্দে নিতাইয়ের চোখ-মুখ হেসে উঠল। পোড়া সিগারেটের টুকরো টান মেরে ফেলে নিতাই মনের আনন্দে গেয়ে উঠল:

গাজনের বাদ্যি বাজে, বাজে কাঁসি ঢোল,

মন রে, বোম ভোলানাথ বোল।

তারপর হঠাৎ গান থামিয়ে বললে, এক ঘটি জল ফরমাস করো না ওস্তাদ—তেষ্টায় ছাতি ফাটছে।

ঘরের দিকে চেয়ে রূপলাল বললে, এক ঘটি জল দিস তো খুশি!

খানিক পরে কপাটের শিকলটা নড়ে উঠল। তারপরেই মাজা কাঁসার ঘটিতে জল নিয়ে খুশি দাওয়ায় পা দিল। তড়াক করে উঠে গেল নিতাই, হাত বাড়িয়ে নিতে গেল জলের ঘটিটা। আঙুলে আঙুলে একটু ছোঁয়া, অমনি খুশির হাত থেকে জলের ঘটিটা খসে পড়ল।

নিতাই বলে উঠল, আহা-হা, তেষ্টার জলটা পড়ে গেল গা! থাক, আর কষ্ট করতে হবে না।

খুশি আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে গেল। একটা অজানা আতঙ্কে তার মুখে ছায়া নেমেছে, হাতখানা কাঁপছে। নিতাইয়ের আঙুল নয়, একটা সাপের গা ছুঁয়ে ফেলেছে যেন খুশি!

নিতাইও আর দেরি করলে না: আসি গো ওস্তাদ, পরশু আসব। —বলে সেও পা বাড়াল।

পেছন থেকে রূপলাল বলে দিলে: সন্ধের পর মনসাপোতার শ্মশানতলীতে যেও। আমিও যাব।

ঘরে গিয়ে রূপলাল দেখলে, খুশি চুপ করে বসে আছে। পাঁশুটে মুখে ভয়ের ছায়া।

রূপলাল তার গায়ে হাত দিয়ে বললে, কি হল, অমন থমথমা হয়ে রইলি কেনে?

আস্তে আস্তে খুশির মুখ থেকে পাঁশুটে রংটা মিলিয়ে গেল। বললে, অনেকদিন বাদে কেমন যেন গা ছমছম করছিল।

এক মুহূর্তের জন্যে রূপলালের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তারপরেই হেসে বললে, ভয় কি, আমি তো আছি!

স্বামীর হাঁটুতে গাল রেখে খুশি বললে, হ্যাঁগা, ও লোকটাকে তুমি কালা বিদ্যে শেখাবে? নাই শেখালে, ও কিন্তু ভাল নয়।

রূপলাল বললে, দিব্যি গেলে ফেলেছি যে! তারপর একটু হেসে বললে, ছোঁড়াটা খ্যাপাটে, তবে খারাপ নয়।

কৃষ্ণপক্ষের ভরা চতুর্দশীর রাত। দুয়ারে খুটখুট শব্দ হল।

ভেতর থেকে খুশি বললে, কে?

চাপা গলায় আওয়াজ হল, আমি।

দরজা খুলে খুশি বললে, কে, যাদুগর এলে?

না গো, আমি নিতাই!

খুশি যেন একটা ধাক্কা খেলো। দরজার কপাটটা সজোরে আঁকড়ে ধরে বললে, তুমি এখেনে কেন? যাদুগর তো মনসাপোতার শ্মশানতলীতে রয়েছে। সেখেনে যাও।

একঘটি ঠাণ্ডা জল হবে? বড় তেষ্টা।

বিরক্তি আর বিতৃষ্ণায় খুশি বললে, এ কেমনতর কথা বাপু? দিনে-রেতে যখন-তখন তেষ্টা!

গলা ছেড়ে হেসে উঠল নিতাই। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে চাপা গলায় বললে, ঠিক ধরেছ। দিনে-রেতে সব সময়েই আমার তেষ্টা।

জোড়া ভুরু কুঁচকে খুশি বললে, তা আমার কাছে ছাড়া আর কোথাও কি জল নেই?

নিতাই বললে, না গো খুশি। আমার তেষ্টার জল তুমি ছাড়া আর কারো কাছে নেই।

নিতাইয়ের কথাগুলো কেমন লালা-জড়ানো।

খুশি দরজাটা বন্ধ করে দিতে গেল, তার আগেই নিতাই খপ করে একখানা নরম হাত ধরে ফেললে। বললে, জেবনটা হাসিখুশির মেলা গো! যাদুগর তোমায় কি দিয়েছে? আমি তোমায় অনেক দেবো—অনেক সুখ। তুমি আমার হও খুশি, তুমি আমার হও।

খুশির সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে। তার মনে হতে লাগল, কতকগুলো সাপ কিলবিল করে তার গা বেয়ে উঠছে। মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছে বিশ্রী একটা বাদুড়। তার পাখা ঝাপটানোর হাওয়া মুখে লাগছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠেই ঢলে পড়ল খুশি।

নিতাই এতটা ভাবেনি। সে আর দাঁড়াল না, ছুটে বাইরের অন্ধকারে মিশে গেল।

গাঢ় ঘুমের কুয়াশা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। আর তারই মাঝে রূপলাল যেন অনেক দূর থেকে ডাকছে, খুশি, খুশি, খুশি! কি হল তোর খুশি?

চোখের ভারী পাত দুটো মেলে খুশি দেখলে, শিয়রে সত্যিই রূপলাল। স্বামীর বুকে মুখ রেখে হু-হু করে কেঁদে ফেললে সে। তারপর কাঁদতে কাঁদতেই বললে, নেতাই শয়তানকে তুমি আর আসতে দিও না—কক্ষুনো না—ও আমায় গুণ করবে, ও আমায় মেরে ফেলবে—

খুশিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রূপলাল হাঁ করল না, না করল না। গুম হয়ে বসে রইল। শুধু তার মশাল-চোখ একবার দপ করে জ্বলে উঠল।

নিতাইকে মানা করতে হয়নি। নিজের থেকেই সে আর আসেনি।

দেড় দু-মাস কাটল। রূপলাল তবু নিশ্চিন্ত হতে পারল না। খুশি বলেছিল, উ খালভরা যখন আমার হাতখানা ধরল, তখন শরীলটা আমার অবশ হয়ে গেল—মনে হল, তুমি আমার হাত ধরেছ।

বলিস কি! —রূপলাল বললে।

খুশি বললে, হ্যাঁ গো। তারপর উ নচ্ছার যখন বললে, ‘যাদুগর তুমারে কি দিয়েছে’, তখন হুঁশ হল। আমার মন বললে, এ তুমি নয়, এ নিচ্চয় শয়তানটা। আমার শরীলটা কাঁপতে লাগল—আর কিছু মনে নেই।

খুশির কথা শুনে মনে মনে চমকে উঠেছিল রূপলাল। নিতাই গুণীনের হাতের ছোঁয়ায় অবশ হয়ে এসেছিল খুশির সর্বাঙ্গ। মনে হয়েছিল রূপলালই তার হাত ধরেছে। তাহলে খুশিকে ঠিক অবশ নয়, বশ করেছিল নিতাই! তবে কি নিতাই গুণীন ‘ডাকিনী-মন্ত্র’ জানে? এত বড় গুণীন হয়েও কেন সে রূপলালের কাছে এসেছিল, সে তো এখন বোঝাই যাচ্ছে। কালা যাদুবিদ্যার লোভে নয়, এসেছিল খুশি-ফুলের টাটকা মধুর লোভে!

নেপালী তান্ত্রিক গুরুর বিদ্যে কখনো মিথ্যা বলে না। অন্ধ খুশির জীবনে তাহলে ওই শনি—ওই নিতাই গুণীন!

ছ্যাঁৎ করে উঠল রূপলালের বুকটা।

তারপর থেকেই খুশিকে আর চোখের আড়াল করে না রূপলাল।

ফসল কাটার দিন এসে গেছে। আউসের নতুন ফসল। বুড়ো মোড়লের বাইশ বিঘের ফসল তুলে গঞ্জে পাঠিয়ে দিয়েছে রূপলাল। এবার মহাজনের গদি থেকে ‘আদায়’ আনতে যাওয়ার কাজটাই বাকি। ফসল কাটার সময় নিজে একটিবারও মাঠে যায়নি রূপলাল—পাছ খুশিকে চোখের আড়াল করতে হয়। কিন্তু আদায়ের ব্যাপারে নিজে না গেলেই নয়।

রূপলাল বললে, ভোর-ভোর গঞ্জে চলে যাব, আর সূয্যি ঢলবার আগেই ফিরে আসব। ভাবিস নে খুশি। সুদামাকে রেখে যাচ্ছি।

গঞ্জে চলে গেল রূপলাল। কিন্তু যতই তাড়াহুড়ো করুক, ফিরতে ফিরতে সূর্য ঢলে পড়ল। ছোট ছোট কেউটের বাচ্চার মত কুণ্ডলী পাকানো ছোট কালো মেঘ সাঁঝের আকাশে জড়ো হতে লাগল। শালতলীর সীমানায় গাড়ি থেকে নেমে পড়ে জোরে পা চালিয়ে দিল রূপলাল। বলদের গাড়ি বড় ধিকিয়ে চলে।

খানিক দূরে এগোতেই তারই ক্ষেতের ‘মুনিশ’ সুদামার সঙ্গে দেখা। অন্ধকার নেমেছে বলেই বোধ হয় সুদামা কে দেখেনি। কিন্তু রূপলালের বিরক্তির সীমা রইল না। চেঁচিয়ে ডাকলে, এই সুদামা! ঘরে মানুষটাকে একা রেখে চলে যাচ্ছিস? বারে!

সুদামা কেমন একটু ঘাবড়ে গেল। বললে, হাই দ্যাখো! তুমি ঘরে ঢুকলে, তাই তো আমি চলে এলাম কত্তা।

রূপলালের মুখটা হাঁ হয়ে গেল। বললে, আমি ঘরে ঢুকলাম?

সুদামা বললে, ঢুকলে না? এই কতক্ষণ আগেই ঢুকলে তো। নিজে পেত্যক্ষ করলাম।

মাথার ওপর গুরগুর করে মেঘ ডেকে উঠল। গুরগুর করে উঠল রূপলালের বুক। আর কোন কথা না বলেই সে ছুটল ঘরের অভিমুখে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাতাসও হঠাৎ ছুটতে লাগল হু-হু করে। মাথার ওপর ঘনঘন হাঁকার দিতে লাগল অদৃশ্য দৈত্যদানোর দল। কালো কালো অসংখ্য মেঘ-বাদুড়ের দল আকাশে পাখা ঝাপ্টাচ্ছে।

তীরবেগে ছুটল রূপলাল। এক ধাক্কায় উঠোনের আগড়টা ঠেলে দাওয়ায় পা দিয়েই থমকে থেমে গেল। ঘরের কপাট বন্ধ। ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে:

তোমায় ভালবাসি না তো কাকে বাসি গো?

সত্যি?

সত্যি সত্যি সত্যি! তুমি কি আমার মন বোঝ না? থেকে থেকে শুধোও কেনে?

এমনি। তোর মুখে শুনতে মিষ্টি লাগে।

আহা!

মাথাটা ঘুরতে লাগল রূপলালের। দুটো গলার একটা গলা সে চেনে—খুশির। কিন্তু পুরুষের গলাটা যে তার নিজের! হুবহু তার গলার আওয়াজ, তারই বলাই ভঙ্গি! কপাটের আড়ালে কে? কপাটে ধাক্কা দিতে গিয়েও হাতখানা সরিয়ে নিলে রূপলাল। তারপর পা টিপে টিপে নেমে গেল উঠোনে বাতাবি লেবুর গাছটার পাশে। সামনেই আধখোলা জানলা। ভেতরে পিদিম জ্বলছে।

জানলায় উঁকি দিয়ে রূপলাল পাথর হয়ে গেল। দেখলে, বিছানার ওপর দু-হাতে খুশিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে আরেকটা রূপলাল। যেন রূপলালেরই যমজ ভাই।

বাজপড়া তালগাছের মতই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রূপলাল। তার বুঝতে বাকি রইল না ও কে? জানে, নিতাই গুণীন ডাকিনী-মন্ত্র নিশ্চয়ই জানে। ডাকিনী-মন্ত্র ছাড়া রূপবদল করা যায় না। নিতাই বুঝেছিল রূপলাল ছাড়া খুশি আর কারো নয়, আর কারো হতে পারে না। খুশি তার ভালবাসা দিয়ে শুধু রূপলালকেই লতার মত জড়িয়ে আছে। কিন্তু নিতাইয়ের লোভ তবু যায়নি—পাপের গর্ত থেকে তার লালসা লুকিয়ে হাত বাড়িয়েছে খুশির দিকে। ডাকিনী-বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত নিতাই রূপলালের রূপ ধরে খুশিকে ভোগ করতে এসেছে।

দপ করে জ্বলে উঠল রূপলালের দুই মশাল-চোখ, দেখতে দেখতে শক্ত হয়ে উঠল তার দেহের পেশীগুলো। আবার ঘুরে গিয়ে সে দরজার কপাটে ঘা মারলে।

ভেতরে আর একটা রূপলাল সতর্ক হয়ে উঠল।

কপাটে আবার ঘা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার: খুশি!

ভেতরে চমকে উঠল খুশি। বললে, বাইরে তোমারই গলা যেন! ও কে যাদুগর?

কপাটে আবার ধাক্কা। আরো জোরে। আরো জোরে রূপলালের গলা শোনা গেল: দোর খোল খুশি! তোর ঘরে শয়তান ঢুকেছে—ও নেতাই।

ধড়মড় করে উঠে বসল খুশি। আলুথালু হয়ে বললে, ও কি বলছে যাদুগর? শুনছো!

দ্বিতীয় রূপলালের মুখ-চোখ তখনো লালসা-জড়ানো, ঘন নিশ্বাসে প্রথম রিপুর উত্তাপ! খুশিকে কাছে টানবার চেষ্টা করে সেই একই গলায় বললে, ও মিছে বলছে খুশি, আমি রূপলাল, এই তোর কাছে রয়েছি। বাইরে ওটা নেতাই শয়তান।

বাইরের রূপলাল কপাটে আরো জোরে ধাক্কা দিলে—আরো—আরো জোরে। পুরোন কাঠের আগল সইতে পারল না, মড়মড়িয়ে ভেঙে পড়ল। দু-হাট হয়ে গেল দুটো কপাট। আর ঝড়ের মত ঘরে পা দিয়ে বাইরের রূপলাল চিৎকার করে উঠল, কার কোলে শুয়ে আছিস খুশি? ও যে নেতাই গুণীন!

দ্বিতীয় রূপলাল ঠিক তেমনি গলায় বলে উঠল, ওর কথায় বিশ্বেস করিস না খুশি। ও-নেতাই, আমি রূপলাল!

দোরগোড়া থেকে প্রথম রূপলাল বললে, শয়তান গুণীন তোকে গুণ করেন্থে খুশি। আমিই রূপলাল।

হেসে উঠল দ্বিতীয় রূপলাল। হুবহু রূপলালের মতই হাসি। হাসতে হাসতেই বললে, মিছে কথা খুশি, মিছে কথা! এই দেখ আমার হাত মুখ নাক—

খুশির একখানা হাত নিয়ে নিজের মুখে ছোঁয়াতে লাগল, দ্বিতীয় রূপলাল।

দোটানায় পড়ে অন্ধ খুশি কেঁদে উঠল, সত্যি করে বলো না গো, কোন্‌টা আসল যাদুগর!

কামের নেশা বড় নেশা। দু-হাত দিয়ে খুশিকে বুকে সাপটে ধরে, মুখের ওপর মুখ রেখে দ্বিতীয় রূপলাল বললে, আমি—আমি—আমি!

আর স্থির থাকতে পারলে না প্রথম রূপলাল। চালের বাতা থেকে কি একটা জিনিস তার হাতের মুঠোয় চলে এল। পিদিমের আলোয় নিমেষের জন্যে বিদ্যুৎ ঠিকরে উঠল তার হাতে। তার পরেই দ্বিতীয় রূপলালের মুণ্ডুটা কাৎ হয়ে লটকে পড়ল।

আকাশে অদৃশ্য দৈত্য-দানোর দল বিকট শব্দে হাঁকার দিয়ে উঠল। খ্যাপা হাওয়া হেসে উঠল থরথর করে। আর রক্তমাখা রাম-দাখানা হাতের মুঠোয় ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রথম রূপলাল। তারই চোখের সামনে দ্বিতীয় রূপলালের রক্তমাখা দেহটা দেখতে দেখতে নিতাই গুণীনের চেহারা হয়ে উঠল।

খুশি যেন এতক্ষণ বোবা হয়ে গিয়েছিল। ভয়ে আতঙ্কে হঠাৎ চিৎকার করে উঠেই ঢলে পড়ল।

মশাল-জ্বালা চোখের স্থির দৃষ্টি মেলে রূপলাল দেখতে লাগল খুশির গা বেয়ে কিলবিল করে উঠছে বিষাক্ত সাপের দল, মাথার ওপরে চক্র দিচ্ছে রক্তশোষা বাদুড়।

ঠিক এই দৃশ্যই দেখেছিল রূপলাল, যেদিন সে প্রথম এসেছিল খুশির ভবিষ্যৎ গণনা করতে।

নেপালী তান্ত্রিকের দেওয়া বিদ্যা মিথ্যা বলে না।

হাতের অস্ত্রটা ফেলে আস্তে আস্তে খুশির কাছে এগিয়ে গেল রূপলাল। নাকের নিচে হাত রেখে দেখলে, নিশ্বাস পড়ছে না। দুই চোখের মশাল আস্তে আস্তে নিতে এল। খুশির মরা মুখের ওপর টসটস করে পড়ল দু-ফোঁটা জল। তারপর ভিজে গলায় রূপলাল ওধু বললে, তুই এগিয়ে যা খুশি, আমিও জলদি যাচ্ছি।

পরের দিনই পুলিশে ধরা পড়েছিল রূপলাল। নিতাই গুণীনকে খুন করে সে পালায়নি।

কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ফাঁসি হল না তার। হাতে-পায়ে লোহার ডাণ্ডা-বেড়ি পরে ‘দায়মলী’ রূপলাল একদিন আন্দামানের জাহাজে উঠল।

সে আজকের কথা নয়, ব্রিটিশ আমলের কথা। এতদিনে রূপলাল তার খুশির কাছে পৌঁছে গেছে কিনা কে জানে!

প্রশ্ন উঠতে পারে, ডাকিনী-মন্ত্রের বলে মানুষ কি সত্যিই রূপ বদলাতে পারে? তন্ত্র মন্ত্রের কি এমন অলৌকিক ক্ষমতা আছে? আপনারা কি বলবেন জানি না, ইতিহাস কিন্তু বলে, অন্ত্রশাস্ত্র মিথ্যা নয়; বিজ্ঞানের অগোচরে অনেক সত্যিই আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *