আসরটা যে করলে মাটি
মানুষের জীবনে কত কি ঘটে যায়! একেবারে অকস্মাৎ। তাঁর অসাধারণ সুন্দর স্বাস্থ্য ছিল, পাথর কোঁদা। ভালো চাকরি করতেন। কোনোও এক বড় জুটমিলের স্পিনিং সেকসানের হেড মেকানিক। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, তিনি ছিলেন ওস্তাদ তবলাবাদক। হাতে যেন বোলের খই ফুটত। বড় শৌখিন মানুষ ছিলেন। কালো কুচকুচে চুল পমেড দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা। আলো পড়লে চকচক করে ওঠে। হাফ হাতা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। কালো পাড় ধুতি। পায়ে পালিশ-করা নিউকাট জুতো। কানে আবার একটু আতর গুঁজতেন। সব ভুলে গেছি সেদিনের কথা, ভুলিনি প্রাণখোলা এই রসিক মানুষটিকে। হাহা করে যখন হেসে উঠতেন ঝকঝকে দু-সার দাঁত ঝিলিক মেরে উঠতো। ইচ্ছে করে ভুল ইংরেজি বলে মজা করতেন। তাঁর গোটা দুই চাঁপাফুল রঙের সিল্কের পাঞ্জাবি ছিল, মাঝে-মাঝে পরতেন। তখন তাঁকে ভারী সুন্দর দেখাত।
শহরের একধারে নির্জন এলাকায় অনেকটা জায়গার ওপর ছিল তাঁর তপোবনের মতো বাড়ি। ইচ্ছে করলে কোঠা বাড়িই তুলতে পারতেন, তা তিনি করেননি। চালা বাড়ি, উঁচু দাওয়া, ছ্যাঁচা বেড়া। পরপর এইরকম তিনটি চালায় ছড়িয়ে ছিল তাঁর সংসার। চারপাশে অসাধারণ সুন্দর বাগান। সেই বাগান ছিল তাঁর নিজের সাধনা। গন্ধরাজ, চাঁপা, হাস্নুহানা, তিন-চাররকম জুঁই, মল্লিকা, বেল, কুন্দ, হরেক রকমের জবা, কামিনী, কাঞ্চন, রমণী, রঙ্গন। ফুল আর ফুল। ফুলের হাসি দিয়ে ঘেরা পরিচ্ছন্ন তিনটি চালা। গোল করে ছাঁটা বকুলের তলায় একটি সিমেন্ট বাঁধানো তকতকে লাল বেদি। সেই বেদিতে থুবড়ি হয়ে বসে থাকত তাঁর বড় আদরের সাদা কাবুলি বেড়ালটি। তিনি আমাকে শেখাতেন, কী করে ফুল ফোটাতে হয়। ফুল ফোটানো আর তবলায় বোল ফোটানো প্রায় একই ব্যাপার। তিনি বলতেন। হাতের সাধনা। ফুলের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলতে হয়—ভালোবাসি, ভালোবাসি। সন্ধ্যায় ফুলের গন্ধে বাড়ি যখন ভরে যেত তখন তিনি সুন্দর একটা জাজিমে বসে বিভোর হয়ে তবলা বাজাতেন। কত রকমের বোল আর তেহাই। সেই তালে আর ছন্দে সারা বাড়ি যেন নাচত।
তাঁর বাগানের একপাশে একটা জিমনাসিয়াম ছিল, রিং, প্যারালাল বার, বারবেল ডাম্বেল। ভোরবেলা তিনি ব্যায়াম করতেন। গন্ধরাজ, ঘেরা সেই আখড়াটুকু ছিল স্বপ্নের মতো। বাগানের পাশেই পুকুর। সূর্য ওঠার আগেই স্নান শেষ। মিলের বাঁশি ডাক দেওয়ার আগেই তাঁর সাইকেল মিলের গেটে। সামনে দুলছে ঝকঝকে একটি টিফিন ক্যারিয়ার। তখন তিনি শিল্পী নন, কর্মীর পোশাক। হাফ হাতা জামা ঝকঝকে পালিশ-করা চেহারা। তাঁর অসাধারণ এক জোড়া গোঁফ ছিল। দুপাশ ছুঁচলো সরু। সেই গোঁফে মাঝে মাঝে তিনি পাক মারতেন। সেই সময় তিনি পালোয়ান।
দিনকাল সেই সময় ছিল অন্যরকম। অভাব-অভিযোগ ছিল না। ছিল না তেমন বিক্ষোভ। মানুষের জীবনে বেশ একধরনের শান্তি ও সদ্ভাব ছিল। আমাদের পাড়ায় আর এক শিল্পী ছিলেন, তিনি বাজাতেন সেতার। সেকালের বিখ্যাত লক্ষ্মণ সেতারির শিষ্য। শনিবার আর রবিবার সেতার শিল্পীর চকমেলানো বাড়িতে আসর বসত বিশাল। বড় বড় ওস্তাদরাও আসতেন গাইতে অথবা বাজাতে। শনিবার সন্ধ্যায় শুরু হত গড়িয়ে চলে যেত মাঝরাতে। রবিবার সকালের আসর নেমে আসত দুপুরে। আমি ছিলুম সেই বাড়ির এক বাসিন্দা। চুপটি করে বসে থাকতুম আসরের একপাশে। সেতার-শিল্পী আর আমার তবলিয়া কাকাতে মিলে আসর জমে উঠত সাংঘাতিক। ছেলেমানুষের চোখে মনে হত বুঝি লড়াই হচ্ছে। পরে বুঝেছিলাম বড় হয়ে একেই বলে সওয়াল জবাব। আসরের যাঁরা সমঝদার শ্রোতা তারা সবাই মিলে আহা, আহা করতেন। তেহাই, তিন তেহাই, এক সময় শেষ হত বাজনা। সেতার-শিল্পী সেতার নামিয়ে আমার তবলিয়া কাকাকে জড়িয়ে ধরতেন। তিনি আলিঙ্গনে থেকেই চিৎকার করে বলতেন—’মেডিসিন, মেডিসিন।’ তার মানে চা। ওইভাবে উচ্চারণ করতেন। চা খেয়েই, আবার শুরু হয়ে যেত অন্য বোলে, অন্য তালে বাজনা। সবাই বলাবলি করতেন, ‘তবলায় যেন আগুন ছুটছে।’ গান অথবা বাজনার বদলে সবাই তবলাই শুনতেন। আমাদের বোঝার বয়স হয়নি তখনও, আমাদের ভীষণ ভালো লাগত একদিন, সেইদিন ভুলব না কোনওদিন। দুপুরে খবর এল ‘মিলে’ আমার তবলিয়া কাকার ভীষণ এক দুর্ঘটনা হয়েছে। বড়রা সব ছুটলেন। গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে অস্পষ্ট শুনলুম, তবলিয়া কাকার ডান হাতখানা কনুইয়ের কাছ থেকে স্পিনিং মিল ছিঁড়ে নিয়েছে। বাকি রাত জেগেই কেটে গেল। কেবলই মনে হতে লাগল, অমন সুন্দর তবলা আর কী করে বাজাবেন।
বছর ঘুরে গেল। সেই গানের আসরে তিনি একদিন একপাশে এসে বসলেন। সাদা চাদর একটি বুকের ওপর ফেলা। আধখানা হাত লুকিয়ে রেখেছেন অন্তরালে। বেশ কৃশ হয়ে গেছেন। চোখে আর সেই ঝলমলে জ্যোতি নেই। সেতার শুরু হল। তবলায় বসেছেন আর একজন। বাজনা চলেছে। সেতারে তবলায় ঠোকাঠুকি। তিনি বসে আছেন মাথা নত করে। মাথা অল্প অল্প দুলছে ডাইনে বাঁয়ে। মাঝে মাঝে বাঁ হাতটা তুলছেন, আমার নামিয়ে নিচ্ছেন। তবলা যখন ঠিক বলছে না, তখন তিনি উঁহু, উঁহু করে উঠছেন বেশ রাগের গলায়। এক সময় মাথা তুলে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন,—’তুমি দেখছি আসরটাকে করবে মাটি।’ ধমক দিয়ে বললেন, ‘বাজাও, আমি তোমাকে বোল করে দিচ্ছি।’ তিনি তখন আমার সেই বয়সের দুর্বোধ্য কী সব শব্দ বলে যেতেন—কং-তা-গাদি-ঘেনে-ধা। তবুও হত না। এক সময় মহা বিরক্তিতে তিনি উঠে চলে গেলেন।
আমার মনে পড়ে যায়, বকুলের ছায়াতলে, সাদা চাদরগায়ে এক মুর্তি, স্থির হয়ে বসে আছেন। একজোড়া তবলা। মাথায় গন্ধরাজ। বাগান ভরে আছে ফুলে। আরও ফুল। তিনি বলতেন, বোল ফোটানো আর ফুল ফোটানো…। বোল গেলেও ফুল ছিল। মাঝে মাঝে ঈশ্বরকে বলতেন—আসরটা মাটি করে দিল।