আশ্রয় – ৫

পাঁচ

গাস ল্যামেল আর চ্যানি বিয়ারি পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন গরু নিয়ে আসার জন্য বেরিয়ে গেল। দুপুরের দিকে এরিখ জিস্টারের পিঠে জিন চাপাচ্ছে, এমন সময় দক্ষিণ দিক থেকে গোলমালের শব্দ ভেসে এল। এরিখ কান খাড়া করল। মানুষের গলার আওয়াজ নয়, বরং ঘন করে খুঁটি গেড়ে তৈরি-করা বেড়ার গায়ে খুব দ্রুত কাঠি ঘষলে যে রকম খটাখট শব্দ হয়, অনেকটা সে রকমের আওয়াজ।

ওয়েন্ডি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ‘কি হলো, এরিখ?’

‘বজ্রপাত মনে হয়।’

ওয়েন্ডিকে না বললেও, কিসের শব্দ এরিখ বুঝতে পারল। এ ধরনের শব্দ অচেনা নয় ওর। যুদ্ধের সময় এই শব্দ ওকে এত বেশি শুনতে হয়েছে যে, ভুল করার প্রশ্নই ওঠে না। দোল খেয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ল ও। ওয়েন্ডির কাছে এগিয়ে এল।

‘আমি পাইনস ভ্যালিতে যাচ্ছি।’

‘ওটা গুলির শব্দ, না?’

‘হ্যাঁ, ম্যাম,’ এরিখ স্বীকার করল। ‘চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকো।’ ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল ও, উপত্যকার রাস্তায় গিয়ে পড়ল। তারপর দ্রুত এগিয়ে চলল দক্ষিণে।

ভ্যালি থেকে আধমাইলটাক দূরে থাকতেই ভ্যালির প্রবেশ মুখ দিয়ে পাক খেয়ে বেরিয়ে আসা ধুলোর মেঘ দেখতে পেল ও। মেঘের ভেতর হতে মেঘগর্জনের মতই ভীত-সন্ত্রস্ত, ক্রুদ্ধ ষাঁড়ের চিৎকার শোনা গেল। আচমকা সূর্যালোকে একটা কিছু ঝিক করে উঠল এবং সাথে সাথেই একটা রাইফেলের অস্পষ্ট আওয়াজ কানে এল ওর। একটা লোক মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাতে দাবাতে। ছুটতে ছুটতে সে একবার পেছন ফিরে গুলি করল। তারপর এরিখের দিকে ঘোড়া ছোটাল। এরিখের হাতে স্পেন্সারটা বেরিয়ে এসেছে স্যাডলবুট থেকে।

গরুগুলো দক্ষিণ দিকে ছুটেছে। তাদের খুরের দাপটে উপত্যকার শুকনো মাটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বাতাসে উড়ছে। এরিখের দিকে এগিয়ে আসা ঘোড়সওয়ার হঠাৎ কোল্ট উঁচিয়ে ধরল। খিস্তি করল এরিখ, ঘোড়া ঘুরিয়ে দূরে সরে গিয়ে স্পেন্সার তাক করল লোকটার দিকে। চেঁচিয়ে বলল, ‘আমি ক্রস অ্যারোর লোক। কি হচ্ছে এখানে?’

লাগাম টেনে ঘোড়ার গতিরোধ করল অশ্বারোহী। ‘আমি জ্যাক মূন রবার্ট বাটলারের কাউবয়। বব আমাকে আর জনকে এখানে গরুর পাহারায় রেখে গিয়েছে,’ থামল ও। জন মারা গেছে।’

‘কি হয়েছে?’ এরিখ ধাবমান গরুগুলোর দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে জানতে চাইল।

‘যা ঘটেছে, তা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না।’ জ্যাকও ওর পেছনে ছুটতে ছুটতে জবাব দিল। ‘আমি আর জন ঘরের ভেতর বসে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ পরপর দুটো গুলি এসে বিধল বেড়ায়। ব্যাপার কি বুঝে ওঠার আগেই বাইরে মানুষের গলা শুনলাম। গরুগুলোকে তাড়িয়ে নিচ্ছে কেউ। দৌড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। আচমকা একটা গুলি এসে বিধল জনের মাথায়। ও পড়ে গেল, আর আমি সাহায্যের আশায় গরুগুলোর আগেই বেরিয়ে এসেছি। চারজন ওরা, গরু তাড়িয়ে এনেছে। সবাই মুখোশধারী।’

জ্যাকের কথা শেষ হতেই সামনে ধাবমান গরুর পেছনে উড়তে-থাকা ধুলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজন মুখোশধারী। ঘুরে পর পর দু’বার গুলি করল লোকটা। এরিখ স্পেন্সার তুলল। পাল্টা জবাব দিল সে-ও। লোকটা ঝাঁকি খেল, বাঁ কাঁধ খামচে ধরল এক হাতে, তারপর ঘোড়া ঘুরিয়ে গরুর পেছনে উড়তে-থাকা ধুলোর মেঘের ভেতর ঢুকে পড়ল আবার।

আরেকজন মুখোশধারীকে দেখা গেল। হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এসেছে লোকটা। গুলি করল সে। এরিখের মাথার ওপর দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট। জ্যাক মূন কোল্ট হোলস্টারে ভরে রাইফেল তুলতে গেল। হঠাৎ পাহাড়ের দিক থেকে আরেকটা রাইফেলের গর্জন ভেসে এল। জ্যাকের ঘোড়া চলতে চলতে পিছলাল কয়েকবার, থমকে গেল হঠাৎ, তারপর ছুঁড়ে ফেলল আরোহীকে।

এরিখ দ্রুত গুলি করল পরপর কয়েকবার। কিন্তু মুখোশধারী কোমাঞ্চিদের মতই চতুর। বাউলি কেটে ধুলোর মেঘের ভেতর ঢুকে গেল সে, পর মুহূর্তেই বেরিয়ে এল আবার। গুলি করল এরিখকে তাক করে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো বুলেট, ধুলোর ভেতর আবার অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা।

এরিখ ঘোড়া ঘুরিয়ে জ্যাকের কাছে গেল। গরুগুলো প্রায় সিকি মাইল দূরে চলে গেছে ততক্ষণে। তাদের খুরের শব্দ আর ক্রুদ্ধ চিৎকারে উপত্যকার বাতাস ভরে রয়েছে।

জ্যাককে গুলি করেছিল যে লোকটা, পাহাড়ের খালি মতন জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এল এবার। স্যাডলের ওপর মাথা নিচু করে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ঘোড়া ছোটাল সে দ্রুত। এরিখ দেখল ওকে, স্পেন্সার তুলল গুলি করার জন্যে, কিন্তু তার আগেই লোকটা কয়েকটা গাছের আড়ালে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জ্যাকের দিকে মনোযোগ দিল ও। কাত হয়ে পড়ে থাকা কাউবয়কে সোজা করে শোয়াল। কপালে গুলি খেয়েছে পাঞ্চার, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জ্যাক চোখ মেলল, পা নাড়াতে চাইল। ঈশ্বর! মারাত্মক আহত হয়েছি আমি!’ কাশল সে। কাশির সাথে বেরিয়ে আসা তাজা রক্তে এরিখের শার্ট ভিজে গেল।

আহত লোকটার মুখের ওপর ঝুঁকল সে। ‘চিনতে পেরেছ কাউকে?’

জ্যাক আবার কাশল। গলায় ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে ওর। মুখোশধারী ছিল…ওরা।’ ওর চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এল। হাসল সে বিকৃতমুখে। ‘বুলরান থেকে অ্যাপোমেটক্স পর্যন্ত…যুদ্ধ করেছি। কখনও আহত হইনি।… মজার ব্যাপার…তাই না?’

এরিখ ওর মুখ থেকে রক্ত মুছে দিল। ‘কাউকে চিনেছ তুমি?’

‘…রাইল…রাইল…’ জ্যাকের মাথা পেছন দিকে এলিয়ে পড়ে স্থির হয়ে গেল। তাকিয়ে আছে সে এরিখের দিকে। এরিখ বুঝতে পারল, ওকে দেখছে না আর কাউপাঞ্চার।

দক্ষিণ দিকে তাকাল ও। যতদূর চোখ যায়, এবড়োখেবড়ো পথে উড়ন্ত ধুলোর ছেঁড়াখোঁড়া মেঘ ছাড়া গরুর কোন চিহ্ন নেই। টুপি ঠেলে দিল সে পেছন দিকে, মুখ থেকে ঘাম মুছে সোজা হয়ে দাঁড়াল। একটা শীতল অথচ কঠিন ক্রোধের অনুভূতি দানা বেঁধে উঠতে লাগল ওর ভেতরে। চোখের সামনে জ্যাকের মৃত্যু ওকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ কি অকারণেই না মানুষকে খুন করতে পারে। কিছুক্ষণ আগেও ওর মধ্যে একধরনের অনিশ্চিতভাব ছিল। ওয়েন্ডির হয়ে ওর র‍্যাঞ্চে কাজ করতে সম্মত হলেও শেষ পর্যন্ত সে টিকতে পারবে কিনা, এ বিষয়ে তার মন সন্দেহমুক্ত ছিল না পুরোপুরি। কিন্তু এখন এই অনর্থক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা অনুভব করছে ও। এই অর্থহীন হত্যাকাণ্ডের হোতা যারা, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে ও, প্রতিজ্ঞা করল।

মৃত লোকটাকে তুলে নিয়ে জিস্টারের পিঠে স্যাডলের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখল এরিখ। তারপর ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে উপত্যকায় প্রবেশ করল। একটা গরুও, দেখল সে, রেখে যায়নি তস্করেরা। একটা লোক পড়ে আছে কুটিরের সামনে হাত-পা ছড়িয়ে। মৃদু বাতাস লোকটার সুন্দর সোনালি চুলে বিলি কাটছে। ওর ডান হাতে একটা চামচ, চামচে কিছু বীন। খাওয়ার সময় পায়নি লোকটা। তার আগেই ঘাতকের বুলেট চিরদিনের জন্যে ক্ষুধামুক্ত করে দিয়েছে ওকে। একটা তিক্ত স্বাদ এরিখের গলার ভেতর থেকে মুখে উঠে এল।

কুটিরের ভেতর ঢুকল ও। পোড়া সীমবিচির গন্ধে গন্ধে জায়গাটা ভারি হয়ে আছে। স্টোভ থেকে সীমবিচির পাত্রটা তুলে নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিল এরিখ। তারপর একটা কোদাল হাতে বেরিয়ে এল কুটির থেকে।

লেকের কাছাকাছি উঁচু একটা ঢিবির ওপর দু’জনের উপযোগী কবর খুঁড়তে শুরু করল ও। ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে উঠছে একই সাথে ক্রোধ এবং ঘৃণা; অসুস্থ বোধ করছে ও।

দু’জনকে কবর দিয়ে চারদিক থেকে পাথর খণ্ড কুড়িয়ে এনে কবরের ওপর বিছিয়ে দিল এরিখ। তারপর জিস্টারকে নিয়ে র‍্যাঞ্চের পথ ধরল।

ওয়েন্ডি অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। ওর জামায় রক্তের দাগ দেখে নিচুস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কি হয়েছে, এরিখ?’

‘গরুচোর,’ এরিখ শান্তকণ্ঠে বলে গেল, ‘পাইনস ভ্যালিতে হানা দিয়ে সবগুলো গরু নিয়ে গেছে। বাটলার ছিল না, ওর লোক ছিল দু’জন। খাচ্ছিল, এমন সময় ওরা আক্রমণ করে। বাধা দিতে গিয়ে দু’জনই মারা গেছে। জন রাফ সাথে সাথেই, আর জ্যাক মূন কয়েক মিনিট পরে।’ ওয়েন্ডির দিকে চাইল ও কথা শেষ করে।

আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে মেয়েটা। ‘কারা ওরা, ওয়েন?’ দুই হাতে নিজের বুক বেঁধেছে ও।

এরিখ কাঁধ ঝাঁকাল। ‘চার-পাঁচজন ছিল- প্রত্যেকেই মুখোশধারী। গরুগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে দক্ষিণে খাঁড়ির দিকে। আমি জন আর জ্যাককে কবর দিয়ে এসেছি।’

ওয়েন্ডি বুক থেকে হাত নামাল। ‘আমি অবাক হব এরপরও কেউ থাকতে চাইলে।’

এরিখ নিচের উপত্যকার দিকে তাকাল। উজ্জ্বল সূর্যালোকে উদ্ভাসিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ‘আমি থাকছি,’ বলল সে। ‘যদি একাও থাকতে হয়।’

করালে গিয়ে ঢুকল ও। ঘোড়া বেঁধে বেরিয়ে এল একটু পরে। বাড়ির ভেতর ঢুকে ওয়েন্ডির কাছে গিয়ে বলল, ‘আমি ওদের অনুসরণ করব ভাবছি।’

‘একা?’ ওয়েন্ডি অবাক হলো। ‘গাস আর চ্যানি আসুক।’

‘অনেকদূর চলে গেছে ওগুলো,’ মাথা নাড়ল এরিখ। ‘পাওয়া যাবে না। তবে খুঁজলে কিছু তথ্য হয়তো- ‘

‘না।’ রাজি হলো না ওয়েন্ডি। ‘প্রয়োজন নেই, এরিখ। এই অর্থহীন ঝামেলায় আমি আর থাকব না ভাবছি।’

এরিখ ওয়েন্ডির গালে আঙুল বুলাল আলতো করে। তুমি কোথাও যাচ্ছ না, ম্যাম। এর শেষ দেখবে বলেছিলে, মনে নেই? আমিও শেষ দেখতে চাই।’

‘কিন্তু তোমাকে খুন হতে দেখতে চাই না আমি।’ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল মেয়েটা।

এরিখ হাসল। ‘আমাকে খুন করা ওদের জন্যে সহজ হবে না। যাই হোক, বাটলার এলে অপেক্ষা করতে বলো। আমি ঠিকই ফিরে আসব। ভাল কথা, তোমাদের এদিকে রাইল নামের কেউ আছে?’

‘কেন?’

‘জ্যাক মূন মারা যাবার আগে এই নাম উচ্চারণ করেছিল।’

‘না।’ ওয়েন্ডি মাথা নাড়ল। ‘আমার জানা নেই।’

এরিখ বেরিয়ে এল ঘর থেকে। করাল থেকে ঘোড়া বের করে উপত্যকার উত্তাই বেয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলল। অপরাহ্নের দিকে উপত্যকার শেষ মাথায় উপস্থিত হলো ও। গরুগুলোর পায়ের দাগ এখনও তরতাজা।

উপত্যকার শেষ মাথায় খাঁড়িটা। গরুর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে খাঁড়ির ভেতর নামল ও। স্বচ্ছ, খরস্রোতা কিন্তু অগভীর খাঁড়ি। গরুগুলো খাঁড়ি পেরিয়ে অপর পাড়ে গিয়ে উঠেছে। এরপর এগিয়ে গেছে পাড় বেয়ে সামনের দিকে। নরম বালুর ওপর তাদের খুরের গভীর ছাপ ধরে এগোল এরিখ, একটা উঁচু দেয়াল বেষ্টিত ক্যানিয়নে গিয়ে পৌঁছল। ঝোপঝাড় আর কাঁটা গুল্মে পরিপূর্ণ ক্যানিয়নের ভেতরটা। উরুর ওপর স্পেন্সারটা আড়াআড়িভাবে রেখে জিস্টারকে নিয়ে ধীরে ধীরে এগোল ও।

সন্ধে হবার কিছু আগেই এবড়োখেবড়ো পাথরে ভর্তি এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছল ও। ট্র্যাক হারিয়ে ফেলল পাথুরে জমিতে। অনুর্বর জায়গাটাকে দেখে মনে হয়, ওখানে কখনও কোন গরু বা ঘোড়ার পা পড়েনি। পাথুরে ভূমির ওপর দিয়ে আরেকটু সামনে গিয়ে তিনটি ক্যানিয়নের মুখের সংযোগস্থলে উপনীত হলো সে। বাইরে থেকে সবগুলো ক্যানিয়নের ওপর চোখ বুলাল, তারপর একটার ভেতরে ঢুকল। কিন্তু ওটা একটা বক্স ক্যানিয়ন, গরু রাখার মত জায়গা নেই ওটার মধ্যে।

বেরিয়ে এসে দ্বিতীয় ক্যানিয়নে ঢুকল ও। এটা আগেরটার চেয়ে সুপরিসর। কিন্তু প্রস্তরবিহীন নরম বালুর জমিতে গরুর পায়ের ছাপ দেখতে না পেয়ে বেরিয়ে এসে তৃতীয় ক্যানিয়নটাতে ঢুকল। ঘন ঝোপঝাড়ে ঠাসা বিরাট ক্যানিয়নটা ঢালু হয়ে পশ্চিম দিকে নেমে গেছে। এরিখ ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল, বাঁধল ওটাকে একটা গাছের সঙ্গে, তারপর সাবধানে চোখ বুলাল ক্যানিয়নের দেয়ালে। ওত পেতে থাকা শত্রুর সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না ও। আস্তে আস্তে, ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে কোনমতে পথ করে নিয়ে পায়ে হেঁটে এগোল। সূর্যাস্তের আর বেশি দেরি নেই। ক্যানিয়নের ভেতর অন্তিম গোধূলির ধূসরতাও ক্রমঅপসৃয়মান। একটু পরেই ঝপ করে সন্ধে নেমে আসবে। এ সময় একটা খাড়া পাহাড়ের ঝুলের নিচে পাথুরে ঢালের ওপর ধ্বংসাবশেষটা চোখে পড়ল ওর। ঝুলের গায়ে অজস্র গুলির দাগ; তামাটে রঙ ধারণ করেছে জায়গাটা বারুদ আর ধোঁয়ার আঁচে।

এরিখ ঢাল বেয়ে ওপরে উঠল। ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘরগুলোর গায়ে শেষ সূর্যের রঙিন আলো পড়ে উজ্জ্বল হলুদ আর গোলাপী আভা ফুটেছে। বিস্ময় বোধ করল ও। কতকাল ধরে এসব এভাবে পড়ে আছে কে জানে! ওর নিঃসঙ্গ চলার পথে সে এর আগেও অনেক ধ্বংসাবশেষ দেখেছে, কিন্তু এ রকম ব্যাপক আর দেখেনি। ঘরগুলোর প্রত্যেকটিরই ধসে পড়ার অবস্থা হয়েছে। কিছু কিছু ঘরের ছাদ ধসে পড়ে ভেতরে ঢোকার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।

চারদিকে সুনসান নীরবতা। এরিখ অভিভূত হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নেবার জন্যে ঘরগুলোর সামনে যেটুকু পথ, সেটুকু দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল ও। সমাধিস্থানের স্তব্ধতা চারদিকে। ঢালের ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচে ক্যানিয়নের দিকে চাইল সে। শান্ত, নিরিবিলি ক্যানিয়নের বুক। জন-প্রাণীর সাড়া-শব্দ নেই। মাঝে-মধ্যে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল ও কিছুই নেই, তবু কেমন যেন একটা শিরশিরে ভাব অনুভব করছে ও মেরুদণ্ডে। মনে হচ্ছে, কেউ কোথাও লুকিয়ে থেকে চোখ রাখছে ওর ওপর। গা ছম ছম করে উঠল ওর। এর আগেও, এরকম জনপ্রাণীবিহীন পোড়ো বাড়িতে ঢুকে ওর একই অনুভূতি হয়েছে।

হঠাৎ একটা ঘরের ওপর ওর দৃষ্টি সেঁটে গেল। লেখার মত কিছু আঁকিবুকি ওখানে। এগিয়ে গেল ও। আঁকিবুকিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল ওর চোখে। দেয়াল কুঁদে লেখা, পড়ল ও :

‘জেফ ক্লীন। মারা যাচ্ছি এখানে। ঈশ্বর রক্ষা করুন আমায়। খাবার নেই, পানি নেই। চারদিক থেকে অ্যাপাচিরা ঘিরে ফেলেছে।’

এরিখ সবচেয়ে কাছের ঘরটার ভেতরে উঁকি দিল। চমকে উঠল ও। একটা কঙ্কাল! পড়ে আছে ঘরটার এক কোণে। ধুলোর স্তর পড়েছে কঙ্কালটার সারা গায়ে। পাশে দেয়ালের সাথে হেলান দেয়া মরচে ধরা একটা রাইফেল।

‘জেফ ক্লীন!’ অস্ফুটস্বরে নিজেকে শোনাল ও। মাথা থেকে টুপি খুলে হাতে নিল।

ঢাল থেকে নেমে আসতে আসতে ঘাড় ফিরিয়ে ধ্বংসস্তূপটাকে বার কয়েক দেখে নিল ও। সম্ভবত জেফ ক্লীনের মৃত্যুর পর ওই প্রথম মানুষ, যে এখানে এসেছে, অনুমান করল ও। এটার খবর আর কেউ জানে না। সিদ্ধান্ত নিল, যদি কখনও আবার ওকে নিরাশ্রয় হতে হয়, এখানেই আসবে। মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলার জন্যে এরকম একটা আশ্রয়ের দরকার ওর। দ্রুতপদে হেঁটে জিস্টারের কাছে চলে গেল ও।

ঘোড়ায় চড়ে উত্তরের পথ ধরল এরিখ। গরুগুলো কোথায় হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে না। ক্যানিয়নের ভেতর অন্ধকার জমে আসছে দ্রুত, খোঁজাখুঁজির সময় আর নেই। আরেকদিন এসে খোঁজার সিদ্ধান্ত নিল সে।

ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতরে র‍্যাঞ্চে পৌঁছল এরিখ। আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র, চাঁদের ক্ষীণাভাস মাত্র ফুটেছে পুবাকাশে। ক্রস অ্যারো র‍্যাঞ্চের মালিকের ঘর থেকে বাতির হলুদ আলোর আভাস দেখা গেল। ও গেটের কাছে আসতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল রবার্ট বাটলার। এরিখের মুখোমুখি হলো লালচুলো র‍্যাঞ্চার।

‘কোন সূত্র পেয়েছ?’

‘না।’ ঘোড়া থেকে নামতে নামতে ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল এরিখ ‘দক্ষিণ দিকে’ বলল সে। ‘খাঁড়ির ভেতর দিয়ে লম্বা একটা ক্যানিয়ন পর্যন্ত ট্র্যাক অনুসরণ করতে পেরেছিলাম। একটা পাথুরে জমিতে গিয়েই মিলিয়ে গেছে ছাপ। দেখে মনে হয় আচমকা গরুগুলোর ডানা গজিয়েছিল, উড়ে গেছে ক্যানিয়নের উঁচু দেয়ালের ওপর দিয়ে।’

ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের কথা বলছ তুমি। ওটার পরেই বিগ স্টোন ক্যানিয়ন। আমার মনে হচ্ছে, ওদিকেই গেছে গরুগুলো।’

‘না, এরিখ দ্বিমত পোষণ করল। ‘ট্রেইলটা ওখানেই হারিয়ে গেছে। আমি ভালভাবে খুঁজে দেখেছি।’

‘অতগুলো গরু গেল কোথায়?’

‘জানি না,’ এরিখ সিগারেট রোল করল।

ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চাইল বাটলার। ‘তোমাকে দেখে কিন্তু খুব বেশি ক্লান্ত মনে হচ্ছে না,’ মন্তব্য করল ও।

এরিখ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। উগ্র লোকটার দিকে সরু চোখে তাকাল। ‘আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। তোমার মত রকস্প্রিঙে বসে ফুর্তি করে সময় কাটাইনি। তাছাড়া, সিগারেটের ছাই ঝাড়ল ও, ‘তোমার চাকরি করছি না আমি, বাটলার।’

রাগে লাল হয়ে গেল লালচুলোর মুখ। পিস্তলের দিকে হাত বাড়াতে গেল ও। ‘তোমার কথা-বার্তা পছন্দ হচ্ছে না আমার।’

‘তাহলে শুনো না,’ মৃদু হাসল এরিখ। ‘চ্যাপম্যান শহরে ছিল?’

‘ছিল।’

‘ডগ, জো, ওক?’

‘জো ছাড়া সবাই ছিল।

‘চ্যাপম্যানের কাজের লোক কতজন হবে?’

হবে পনেরো থেকে বিশজন,’ জবাব দিল বাটলার। ওর র‍্যাঞ্চটা বড়, শহর থেকে কিছুটা দূরে। এছাড়া কয়েকটা চারণভূমি রয়েছে ওর।’

‘তাহলে এর মধ্যে ও ছিল না বলে ধরে নেয়া যায়,’ হাত দিয়ে টুপিটা ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিতে দিতে মন্তব্য করল এরিখ। ‘অবশ্য আমাদের জানার বাইরেও ওর আরও কেউ থাকতে পারে।’

‘আমার একটা গরুও ফিরে পাইনি আমি,’ বাটলার অভিযোগ করল। কি করব বুঝতে পারছি না।’

‘তোমার একারই শুধু এ অবস্থা নয়,’ এরিখ বলল মৃদু কণ্ঠে, ‘আমাদের সবারই তাই।’

‘আমাদের?’ বাটলার সরুচোখে চাইল এরিখের দিকে।

‘কি বলতে চাচ্ছি ঠিকই বুঝেছ তুমি। আমি মিস ক্লে’র কাজ করছি। পাইনস ভ্যালিতে ওর গরুও ছিল। ছিল না?’

‘হুঁ।’ লালচুলো প্রসঙ্গ পাল্টাল। ‘নতুন লোক দু’জন গরু নিয়ে কখন ফিরবে?

‘দু’দিনের মধ্যে।’

‘যদি ফেরে, তাই না?’

‘ঠিকই ফিরবে,’ ওয়েন্ডির প্রতি চ্যানি বিয়ারির মনোভাবের কথা স্মরণ করল এরিখ।

ফিরলেই ভাল। ঘরের দিকে পা বাড়াল বাটলার। ‘গরুগুলো কি আবার খুঁজতে যাবে ভাবছ?’ ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল ও আবার।

এরিখ জিস্টারকে নিয়ে করালের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘তাছাড়া আর কি করার আছে?’

করালে ঢুকে জিন খসাল ও জিস্টারের পিঠ থেকে। ভাল মত দলাই মলাই করে খেতে দিল ওটাকে। তারপর মুখ-হাত ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে কিচেনের দিকে গেল। কপাটে মৃদু টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকল ও।

ওয়েন্ডি উনোনের ধারে বসা, লাল হয়ে আছে ওর মুখ। এরিখ ঢুকতেই ফিরল ও, হাত দিয়ে কপালে এসে পড়া চুলের গোছা ঠিক করে নিতে নিতে চকিতে একবার বাটলারের দিকে বিতৃষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর জন্যে খাবারের প্লেট এগিয়ে দিল। খেতে শুরু করল এরিখ, বুঝতে পারল, ওর আগমনে বাটলারের প্রেমালাপে ব্যাঘাত ঘটেছে। খেতে খেতে ওয়েন্ডিকে কাজের বিবরণ শোনাল ও। তার বক্তব্য শেষ হতেই ওয়েন্ডি মৃদুকণ্ঠে বলল,

‘আমি আর এসব চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি না, ওয়েন। এসব অর্থহীন।

এরিখ জবাব দেবার আগেই বাটলার দৃঢ় স্বরে বলল, ‘আমরা চালাব, ওয়েন্ডি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।’

কিছুই বলল না এরিখ। খাওয়া শেষ করে পাইপ ধরাল ও। আজকের হামলায় বাটলারের শেষ দু’জন লোকও মারা গেছে। কিন্তু, আশ্চর্য বোধ করল ও, এ পর্যন্ত একবারও বাটলার সে কথা তোলেনি। এরিখ মনে মনে স্বীকার করল, বাইরে থেকে লোকটাকে যতই উষ্ণ দেখাক, আসলে ওর ভেতর একটা কঠিন শীতল ভাব আছে।

বাঙ্ক হাউসে এসে নিজের স্পেন্সারটা পরিষ্কার করতে বসল এরিখ। মাঝে মাঝে কিচেনের দিকে তাকাচ্ছে সে ওখান থেকে। ওদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সামান্য ঈর্ষা বোধ করল এরিখ। পরক্ষণেই অবাক হলো নিজের মনোভাব টের পেয়ে। এর কোনই অর্থ হয় না, নিজেকে শাসন করল ও। ওয়েন্ডি ওকে সামান্যতম প্রশ্রয়ও দেয়নি এ ব্যাপারে। জোর করেই ঈর্ষাবোধটাকে সরিয়ে দিল এরিখ ভেতর থেকে।

ধীরে- -সুস্থে কাজ করতে লাগল ও। যত্নের সাথে ঘষে ঘষে সাফ করল অস্ত্রটাকে, এরপর ভাল করে মুছে নিয়ে খাপে ঢুকিয়ে পাইপে তামাক ভরল।

বাঙ্কহাউস থেকে বেরিয়ে বারান্দায় বেঞ্চির ওপর বসল ও। চাঁদ এখন অনেকটা উঁচুতে উঠেছে। উজ্জ্বল আলোয় ঝকঝক করছে অনতিদূরের পাহাড়ের চূড়াগুলো। মৃদু বাতাস বইছে মাঝে-মধ্যে। বাটলার এবং ওয়েন্ডির কথা-বার্তার অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে শুনতে হঠাৎ চমকে উঠল ও। ওয়েন্ডি রেগে গেছে।

উঠানে নামল এরিখ। ওয়েন্ডি তার ঘরের বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে। বাটলার প্রস্থানোদ্যত।

‘এটাই যদি হয় তোমার মনের কথা, তাহলে এখানে ফালতু সময় নষ্ট না করে আমি আমার নিজের কাজে মন দেব। সেটাই ভাল হবে আমার জন্যে,’ যাবার আগে ওয়েন্ডিকে শোনাল লালচুলো।

‘আমার বাবার সঙ্গে তোমার ব্যবসার সম্পর্ক ছিল,’ সমান তেজে জবাব দিল মেয়েটি। ‘সে জন্যে আমার কাছে বিশেষ কোনও সুবিধা দাবি করতে পারো না।’

‘কিন্তু তুমি তো আমাকে জানো। আমার সম্বন্ধে সবসময় ভাল ধারণাই পোষণ করতে। করতে না?

‘করতাম। এখন তা পাল্টেছে, এমনও নয়। তবে তুমি একটা বিষয় বুঝতে চাইছ না যে, বাবার মৃত্যুর পর থেকে কোন ব্যাপারেই ঠিকমত চিন্তা করতে পারছি না আমি।’

‘ঠিক আছে, তোমাকে সময় দিচ্ছি।’

এরিখ চলে আসার জন্যে পা বাড়াল। এটা ওদের সাময়িক কলহ, মিটে যাবে ফের, ভাবল ও।

ওয়েন্ডি ঘরে ঢুকে গেল। বাটলার দ্রুত হেঁটে এরিখের পাশে চলে এল। ‘তুমি আমাদের কথা শুনছিলে?’ রুক্ষস্বরে জানতে চাইল ও।

‘না।’ এরিখ মাথা নাড়ল। তবে তোমাদের তর্কাতর্কি শুনলাম।’

‘আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না, ওয়েন। হুমকি দিল লালচুলো।

এরিখ হাসল, ‘আজ সারাটা সন্ধে ধরেই তুমি তেতে আছ, বাটলার।’

‘তার কারণও আছে।’

‘বেশ, উৎসাহ দিল এরিখ। তারপর বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘এখন দয়া করে বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা হবার চেষ্টা করো।’

বাটলার জ্বলে উঠল। ওয়েন্ডির ঘরের দিকে চাইল ও, ‘মনে হয়, আমার চলে যাবার অপেক্ষায় আছ তুমি?’

‘ঠিক ধরেছ,’ হাই তুলল এরিখ, ‘আমি ঘুমুতে যাব।’

থুতু ফেলল বাটলার, ‘আমার হাত থেকে ওকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলে তোমাকে স্রেফ খুন করে ফেলব।’

এরিখ রাগল না। যা তুমি শেষ করতে পারবে না,’ লালচুলোকে পরামর্শ দিল ও, তা কখনও শুরু করতে যেয়ো না, বাটলার।’

ডান হাত পিস্তলের বাঁটের দিকে বাড়াল বাটলার। এরিখ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মিশে গেল ওর গায়ে। খপ করে ওর কবজি ধরে ফেলল একহাতে, সাথে সাথেই বের করে ফেলল নিজের কোল্ট। ঠেসে ধরল ওটা লালচুলোর পেটে। দেখলে তো?’

বাটলারের হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এল ও। খাপে ঢোকাল পিস্তল 1 বাটলারের হাত তখনও পিস্তলের বাঁটে। ক্ষণিকের জন্যে ইতস্তত করল লালচুলো। তারপর খালিহাত ফিরিয়ে আনল কোমরের কাছ থেকে। চোখের দৃষ্টিতে এরিখকে ভস্ম করতে চাইল সে।

এরিখ নির্বিকার। ঠোঁটের কোণে সামান্য বাঁকা হাসি ওর।

‘গোল্লায় যাও!’ খিস্তি করল বাটলার। ওয়েন্ডির ঘরের দিকে ইঙ্গিত করল সে চোখ নাচিয়ে। ‘অপেক্ষা করছে ও তোমার জন্যে। ওই তৃতীয় শ্রেণীর বেশ্যাটা…’

কথা শেষ করতে পারল না লোকটা, কাঁধের ওপর প্রবল ধাক্কা অনুভব করল। কি হচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই নিরেট ঘুসিটা ওর চোয়াল থেঁতলে দিল। পর মুহূর্তেই তলপেটে প্রচণ্ড লাথি খেয়ে বাঁকা হয়ে গেল সে। প্রায় সাথে সাথেই কপালে আরেকটা ঘুসি খেয়ে উল্টে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ল।

এরিখের শীতল গলা কানে এল বাটলারের, ‘একজন মহিলা সম্পর্কে কিভাবে কথা বলতে হয় তা যদি না জেনে থাকো, শিখে নিয়ো। নইলে ওর ধারে-কাছেও যেন আর তোমাকে না-দেখি।’

ঠোঁটের কোণ বেয়ে নেমে আসা রক্ত মুছে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল বাটলার। এরিখের দিকে বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেল। তারপর ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের ঘোড়ার দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। ঘোড়ায় উঠে নির্মমভাবে স্পার দাবাল সে ওটার পেটে। চমকে উঠল ঘোড়াটা, ঘোঁৎ করে নাক ঝেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল দ্বিতীয়বার গুঁতো খাবার ভয়ে।

ওয়েন্ডি বেরিয়ে এল বারান্দায়। কি হয়েছে, এরিখ, ওর সাথে?’

এরিখ এগিয়ে গেল ওর দিকে। ‘কিছুই হয়নি, মিথ্যে বলল ও। এসব কথা ওকে না জানালেও চলবে।

ওয়েন্ডির দিকে তাকাল এরিখ। নাইট ড্রেসের ওপর ধবধবে শাদা ঢিলে একটা পোশাক জড়িয়েছে মেয়েটা। এরিখের মুখ সামান্য লাল হলো। অপূর্ব দেখাচ্ছে ওকে।

ওয়েন্ডি এগিয়ে এল। ‘মাঝে মাঝে, উদ্বিগ্ন স্বরে জানাল ও, ‘আমাকে খুব চিন্তায় ফেলে দেয় বাটলার।’

‘তোমার সঙ্গে কিসের ব্যবসার কথা বলল যেন?’ এরিখ জানতে চাইল।

‘এখন বুঝতে পারছি, আমি একটা ভুল করতে যাচ্ছিলাম,’ জবাব দিল ওয়েন্ডি। ওর সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছিল আমার। বাবার ধারণা ছিল দু’দিকের সম্পত্তি এক হলে ব্যবসা ভাল চলবে। এ ব্যাপারে কথাবার্তাও চালাচালি হচ্ছিল দুই পক্ষ থেকে। কিন্তু,’ একটু থামল ও, ‘ওটার ছুতো ধরে বাটলার খুব বেশি দাবি করছে আমার কাছে। আমি মত পাল্টেছি, তাছাড়া বাবাও মারা গেল এর মধ্যেও অনেক বদলে গেছে, এরিখ।’

এরিখ এগিয়ে গেল ওর দিকে, বারান্দার রেলিঙের ওপর রাখা ওর হাতের ওপর নিজের ডান হাত রাখল। ওয়েন্ডি হাত সরাল না।

‘ওর ব্যাপারে চিন্তিত হবার দরকার নেই, ম্যাম। ও একটু বেশি কথা বলে, এই যা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *