চার
ক্রীকের রাস্তায় এসে ওয়্যাগন থামাল এরিখ; পানিতে নেমে সযত্নে নিজেকে পরিষ্কার করল। কাদামাখা শার্ট ভিজিয়ে নিয়ে সন্তর্পণে মুখ ও ঠোঁটের ক্ষত মুছল। তারপর ঠাণ্ডা পানির ঝাপ্টা লাগাল কয়েকবার। মোটামুটি কাজ হলো এতে। ব্যথার উপশম ঘটল, কিন্তু আহত জায়গাগুলো ফুলে রইল বিশ্রীভাবে।
প্রায় সন্ধের সময় র্যাঞ্চে এসে পৌঁছল সে। ওয়্যাগন থামিয়ে আসন থেকে নড়তে গিয়ে আহত পায়ের ব্যথায় মুখ বিকৃত করে ফটকের বেড়ার দিকে তাকাল। দুটো ঘোড়া বাঁধা ওখানে।
ফটকের দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে বাতির হলুদ আলো এসে এরিখের গায়ে পড়ল। ওয়েন্ডি বেরিয়ে এসেছে। ওর পেছনে দু’জন লোক; কৌতূহলী চোখে দেখছে এরিখকে।
‘সুসংবাদ,’ ওয়েন্ডি জানাল। ‘কাজের লোক পেয়েছি দু’জন।
এরিখ খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ওয়েন্ডিসহ লোক দু’জনও এল পিছু পিছু। বারান্দায় দাঁড়াল ওরা সবাই। এরিখ লোকগুলোর দিকে চাইল। একজন মাঝ বয়স পেরিয়ে গেছে প্রায়, রোদে-জ্বলা চেহারা, পা দুটো ধনুকের মত কিছুটা বাঁকানো। এরিখের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চাইল লোকটা, হাত বাড়িয়ে দিল।
‘ল্যামেল, গাস ল্যামেল,’ নিজের পরিচয় দিল ও। ‘হোয়াইট স্প্রিং অঞ্চলে একসময় ডেভিডের কাজ করেছিলাম। গতকালই রকস্প্রিঙে এসে শুনেছি ওর কাজের লোক দরকার।’
এরিখ পছন্দ করে ফেলল লোকটাকে। ওর সঙ্গী, কালো কঠিন চোখ দুটোকে বাদ দিলে, প্রায় বাচ্চা ছেলেই। কিন্তু, এরিখ সতর্ক হবার তাগিদ অনুভব করল, ছেলেটার কোমরে দুটো পিস্তল ঝোলানো; চওড়া, সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত বাস্কেডারো বেল্টের সাথে নিচু করে বাঁধা।
‘আর ও আমার সঙ্গী চ্যানি বিয়ারি…কাজের ছেলে।’
‘হাউডি,’ চ্যানি বলল। হাসল সে। ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সরাসরি নরক থেকে উঠে এসেছ?’
ওয়েন্ডি এরিখের দিকে চাইল। ‘মারপিট?
‘হ্যাঁ। হলের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিল।’
‘আমি জানতাম, হল মারপিট করতে পারে না।’
‘না।’ এরিখ একমত হলো। কিন্তু ডগ পারে—এবং করেছেও। ছোটখাট হলে কি হবে, বাক্সভর্তি বারুদের মতই লোকটা। আমি ভাগ্যক্রমে হারিয়ে দিয়েছি ওকে।’
চ্যানি তাড়াতাড়ি বলল, ‘তোমার কাছে পিস্তল ছিল।
‘ছিল।’ এরিখ অস্বীকার করল না। কিন্তু ডগ পিস্তলে নিজেকে ততটা দক্ষ মনে করেনি।’
‘ও এটাকে সহজভাবে নেবে না, ওয়েন্ডি উদ্বিগ্নমুখে বলল, ‘আমি তোমাকে সতর্ক থাকতে বলেছিলাম- কোন ঝামেলায় যেতে নিষেধ করেছিলাম। তুমি আমার নির্দেশ অমান্য করেছ।’
এরিখ ওয়েন্ডির দিকে তাকাল। হতে পারে আমি তোমার কাজ করছি, মিস ওয়েন্ডি। তাই বলে তোমার নির্দেশ মানার জন্যে লেইকারের মত একটা বেঁটে-বামনের নোংরা হাসি-ঠাট্টা আর উস্কানিমূলক কথা সহ্য করে ঘরে ফিরে আসতে পারি না।’
‘এমনিতেই আমরা প্রচুর ঝামেলায় আছি, এরিখ।’
এরিখ ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। ‘তুমি আমাকে কাজ করতে বলেছিলে, ম্যাম। সম্ভবত এরপর আমাকে বরখাস্ত করছ তুমি?’
‘সম্ভবত ব্যাপারটাকে,’ নাক গলাল গাস, অহেতুক জটিল করে তোলা হচ্ছে- দু’পক্ষ থেকেই।
ওয়েন্ডি নিজের ঠোঁট কামড়াল। ‘ঠিক আছে, কি ঘটেছে আমি ভুলে যাচ্ছি,’ শান্তকণ্ঠে বলল ও। কিন্তু এরপর থেকে তুমি আমার কথা মেনে চলবে। তা যদি না পারো, তবে তোমার আজকের বেতন নিয়ে চলে যেতে পারো তুমি।’
‘ঠিক আছে,’ এরিখ ওর সিদ্ধান্ত জানাল। ‘মেনে নিলাম। তবে তুমি কাউকে একগালে চড় খেয়ে আরেক গাল পেতে দেবার আদেশ দিতে পারো না।’
ওয়্যাগন থেকে মালপত্র নিয়ে এসে খচ্চরগুলোকে করালে বেঁধে বাঙ্কহাউসে ঢুকল এরিখ। নতুন কর্মী দু’জন দুটো বাঙ্ক দখল করেছে। শুয়ে আছে তারা। এরিখ শার্ট খুলে ওটাকে ভাল করে ধোয়ার জন্যে বেরিয়ে গেল আবার। চ্যানি উঠে ওর পিছু নিল।
গোসলখানায় হাজির হলো সে-ও। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এরিখকে পর্যবেক্ষণ করল কিছুক্ষণ, তারপর মুখ খুলল, ‘আমার বিশ্বাস, কি করে ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে হয় শেখোনি তুমি।’
এরিখ ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে?’
চ্যানি পকেট থেকে মেকিংস বের করে সিগারেট রোল করল। ‘আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানে কেউ মহিলাদের সঙ্গে এভাবে কথা বলে না। সিগারেটে আগুন ধরাল ও।
ছেলেটার মনের ভাব পরিষ্কারভাবে আঁচ করতে পারল এরিখ। দুটো পিস্তল ঝুলিয়েছে, বেশ-ভূষায় যতই মার্জিত হোক, ওটা আসলে বাইরের রূপ। উত্তেজিত হয়ে আছে সারাক্ষণ। পিস্তলের বাঁটে নচের সংখ্যা বাড়াবার জন্যে উন্মত্ত।
হুল ফোটাল এরিখ। ‘তুমি কোত্থেকে এসেছ, জানি না। জানার প্রয়োজনও দেখছি না। তুমি তোমার নিজের চরকায় তেল দাও গে।’
চ্যানি সিগারেটে টান দিল। ‘মানে?’
এরিখ উঠে দাঁড়াল। ‘সকাল থেকে এ-পর্যন্ত যথেষ্ট উত্যক্ত হয়েছি আমি। তোমার সাথে ফালতু বক বক করার যূড আমার একদম নেই।’
চ্যানিকে এখন আর ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে না। এরিখ লক্ষ করল, ওর মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। রাগে বেঁকে গেছে ঠোঁট। টুকসনে আমি একটা লোককে খুন করেছিলাম। এতক্ষণ কথা বলার সময় পায়নি ও।’
এরিখ চোখ পিট পিট করে তাকাল। আঁতকে ওঠার ভান করল ও। ‘সব্বোনাশ! আমার কি দোষ দেখলে?’
চ্যানির মুখ ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অপমানিত বোধ করছে ও। ‘ঠিক আছে। আমি গুলি করব না। তবে তুমি চাইলে ড্র করতে পারি। আমার মনে হয় তোমার জেনে নেয়া উচিত, পিস্তলে আমি কতটা চালু, প্রস্তাব দিল সে।
এরিখ হাসল। আমি এমনিতেই তোমার কথা বিশ্বাস করতে রাজি আছি।’ নিজের পেটের দিকে ইঙ্গিত করল ও, খালি পেটে ড্র করা আমার কখনও পছন্দ হয় না।’
ওর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল চ্যানি। গাস এসে হাজির হলো এ-সময়। সতর্কচোখে দু’জনের দিকে তাকাল একবার। মুচকি হাসল। ‘চ্যানি, মিস ওয়েন্ডির সম্ভবত তোমাকে দরকার। তোমার কথা বলল।’
হাসল চ্যানি। ‘ঠিক আছে, গাস। এক্ষুণি যাচ্ছি আমি।’
‘ব্যাপার কি?’ ভ্রূ নাচাল গাস।
‘মিস ওয়েন্ডির সাথে আমার কথা-বার্তার ধরন তোমার বন্ধুর পছন্দ হয়নি।’
‘উগ্র মেজাজী। তবে ছেলেটা খারাপ না। দোষ একটাই, নিজেকে পশ্চিমের সেরা পিস্তলবাজ মনে করে ও।’
‘আমাকেও তা বোঝাতে চেয়েছে,’ এরিখ শুকনো স্বরে বলল। ‘অবাক হচ্ছি না, যে-কোন জায়গায় খুঁজলে এ ধরনের দু’একজন পাওয়া যাবে।’
‘আমি তাল মিলিয়ে চলি,’ বসল গাস দেয়ালে ঠেস দিয়ে। আগে ও এরকম ছিল না। বেন থম্পসন আর ওয়েস হার্ডিনকে দেখার পর থেকেই এ- রকম মারমুখো হয়ে উঠেছে।’
‘আমাদের নিজেদের মধ্যে গোলমাল করার সময় নেই, গাস। তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে বোলো।’
‘ওকে বোঝানো সহজ নয়, ওয়েন।’
‘আমাকেও গুলি করতে হয়েছে— এবং আমি মিস করিনি,’ বলল এরিখ। ‘গাস, ষোলো বছর বয়সে আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। যুদ্ধ থেকে ফিরেছি বিশ বছর বয়সে।’
গাস সায় দিল। ‘তোমার কথা আমি বুঝি। কিন্তু এখন নতুন নতুন মানুষ উঠে আসছে। এরা উত্তেজনা পছন্দ করে। কিন্তু তা মেটাবার জন্যে যুদ্ধের মত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নেই। সুতরাং বুঝতেই পারছ, ওরা উত্তেজনা খুঁজে বেড়ায়।’
‘রক্তপিপাসু বেজন্মা সব!’ এরিখ গাল বকল।
‘ঠিক তা নয়।’ গাস ওর সঙ্গে একমত হলো না। ‘ওরা আসলে নাম কিনতে চায়। এ জন্যে যাদের সাথেই দেখা হয়, সবাইকে পিস্তলে হারিয়ে দিতে পারাকেই নাম কেনার সহজ উপায় বলে ভাবে ওরা।
থুতু ফেলল এরিখ। ‘তারপর একদিন ওদের চেয়ে চালু কারও মুখোমুখি হয় এবং মারা যায়।’
কাঁধ ঝাঁকাল গাস। তোমার সাথে আমি একমত।’ প্রসঙ্গ পাল্টাল ও। ‘মিস ওয়েন্ডি কিছু গরু কেনার কথা ভাবছে। আমাকে আর চ্যানিকে যেতে বলেছে ক্যানিয়নের দক্ষিণে এক জায়গায়।’
‘কবে যাচ্ছ তোমরা?’
‘আগামী কাল।’
ফিরতে কয়দিন লাগবে বলে মনে করো?’
‘দিন ছয়েক,’ গাস হিসেব দিল। ‘যেতে একদিন। জড়ো করতে মনে করো দু’দিন। বাকি তিনদিন লাগবে ওগুলো নিয়ে ফিরতে।’
ঠিক আছে। ছয় দিনের দিন তোমাদের সাথে ক্রীকের কাছে দেখা করব আমি।’
একটু থামল গাস। ‘গোলমালের আশঙ্কা আছে, এরিখ?’
‘ঠিক জানি না, গাস। তবে তোমাদের কাছে অবশ্যই বিক্রি-রসিদ থাকবে।’
গাস মাথা দোলাল। ‘কি বলতে চাও, বুঝতে পারছি।’
খানিক বাদে খাবারের ডাক পড়ল। চমৎকার প্রশস্ত রান্নাঘর ওয়েন্ডির। ওখানে বসেই রাতের খাবার খেলো ওরা। এরিখ চুপচাপ খেয়ে গেল, খেতে খেতে প্রচুর বক বক করল গাস—কিন্তু আসর জমাল বিয়ারি। ওয়েন্ডির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিল ও, দারুণ মার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলল, সাধারণ কাউবয়দের কাছে অমন ব্যবহার আশা করা যায় না। খাওয়ার পর গাস আর এরিখ বাঙ্কহাউসের বারান্দায় বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। চ্যানি বিয়ারি রয়ে গেল ওয়েন্ডিকে ধোয়া মোছায় সাহায্য করার জন্যে।
গাস সিগারেট রোল করল। ‘আমার ধারণা,’ কথা বলল ও, ‘চ্যানি ওই মেয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।’
‘মেয়েটি নিঃসঙ্গ, গাস, ‘ শান্তস্বরে মন্তব্য করল এরিখ। ‘মন্দ কি?’
‘তুমি কষ্ট পাচ্ছ, এরিখ?’
‘না,’ এরিখ মাথা নাড়ল। আমি ওকে সাহায্য করার জন্যেই রয়ে গেছি। কোন মেয়ের স্কার্টের পাশে ঘুর-ঘুর করার মানসিকতা নেই আমার। যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে আমি দক্ষিণে সনোরায় চলে যাব।’
প্রসঙ্গ পাল্টাল গাস। ‘গোলা-গুলির আশঙ্কা আছে এখানে?’
‘হ্যাঁ। সবকিছুই ওভাবে এগোচ্ছে, গাস।’
উপত্যকার রাস্তায় ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল হঠাৎ। এরিখ সচকিত হলো। কারা আসছে?’
‘চলো দেখি।’
ওরা বেরিয়ে র্যাঞ্চ হাউসের সামনে গেল। রবার্ট বাটলার। ফটকের সামনে ঘোড়া থামাল ও সাবলীল ভঙ্গিতে দোল খেয়ে নামল ওটার পিঠ থেকে। ওয়েন্ডি কোথায়, ওয়েন?’ প্রশ্ন করল ও।
‘ভেতরে।’
বাটলার গাসের দিকে চাইল। ‘এই লোক কে?’
‘গাস ল্যামেল। ডেভিডের সাথে কাজ করত এক সময়। আজ থেকে ওয়েন্ডির কাজ শুরু করেছে।’
‘বুয়েনো,’ সম্ভাষণ জানাল বাটলার। ‘পরে আলাপ হবে তোমার সাথে।’ ভেতরে ঢুকে গেল ও।
গাস সিগারেটে টান দিল। ‘ওয়েন্ডির বন্ধু?’
‘মনে হয়।’ মাথা দোলাল এরিখ। ‘চ্যানির ওখানে থাকাটা ওর মনঃপূত নাও হতে পারে।’
‘চ্যানিও,’ হাসল গাস, ‘ওর শিঙ নাড়া পছন্দ করবে না।’
‘ঝামেলা বাধাবে নাকি?’
‘না’ গাস আশ্বাস দিল। অন্তত ওয়েন্ডির সামনে নয়।’
বারান্দায় এসে বেঞ্চির ওপর বসল ওরা। বারান্দা থেকে কিচেনের মানুষ তিনজনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাটলারকে বারবার চ্যানির দিকে তাকাতে দেখা গেল, বিরস মুখে। খানিক পরে ঘরে গিয়ে ঢুকল ও। চ্যানি বেরিয়ে এল, বারান্দায় এসে গাসের পাশে বসে সিগারেট রোল করতে শুরু করল।
‘কে ওটা, ওয়েন?’ জানতে চাইল চ্যানি।
‘রবার্ট বাটলার।’
‘নাম জেনেছি। কেন এসেছে?’
‘ওয়েন্ডিকে সাহায্য করছে ও। ওর নিজেরও একটা র্যাঞ্চ আছে, ছোটখাট, এখান থেকে সামান্য দূরে।’
চ্যানি সিগারেট ধরাল। একগাল ধোঁয়া ছাড়ল সে। ‘ওয়েন্ডির ব্যাপারে আগ্রহী?’
‘হতে পারে।’
‘তোমাকে ধাক্কা দিয়েছে?’
এরিখের মুখ লাল হয়ে উঠল। চ্যানির দিকে চাইল গাস। ‘থামো তো! মাঝে-মধ্যে তুমি খুব বেশি নাক গলিয়ে বেড়াও।’
হাসল চ্যানি। ‘আমি শুধু ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। এতে তো কোন ক্ষতি নেই।’ এরিখের দিকে চাইল ও। নাকি আছে?’
‘নেই।’
‘আমাকে পছন্দ করেনি ব্যাটা,’ ওয়েন্ডির ঘরের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল ও।
‘তাই?’ এরিখ প্রশ্ন করল। ‘আমার তো মনে হয় না তুমিও ওকে দেখে খুশি হয়েছ।’
দ্রুত ফিরল চ্যানি এরিখের দিকে। ‘না,’ কঠিন মুখে বলল, ‘হইনি।’
‘ও কিন্তু একজন বন্ধু আমাদের। এ সময় আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন।
‘হাহ্! আমি নিজেই তিনজনের সমান গুলি চালাতে পারি।’
বাঙ্কহাউসের দেয়ালে হেলান দিল এরিখ। ‘গুলি ছোঁড়া ছাড়াও আমাদের আরও কাজ আছে, বিয়ারি।’
গাস এরিখের সাথে একমত হলো। ঠিকই বলেছ, ওয়েন।’ চ্যানিকে বলল, ‘আমাদের ঘুমোতে যাওয়া উচিত। কাল লম্বা যাত্রায় বেরোতে হবে।’
চ্যানি ঘরের দিকে চাইল। ‘আমি বসব আরেকটু।’
গাস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বাঙ্কহাউসে গিয়ে ঢুকল। এরিখ পাইপে তামাক ভরল। চ্যানি বেঞ্চিতে পা তুলে বসে ওর চমৎকার বুটজোড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দারুণ জায়গা এটা, ওয়েন। প্রচুর চারণভূমি, অঢেল পানি-যে কেউই কিছু জমি নিয়ে এখানে জমিয়ে বসতে পারে।’
এরিখ স্বীকার করল। ‘ঠিক বলেছ। এটা এই অঞ্চলের সেরা জায়গাগুলোর একটা।
তুমি হয়তো এখানেই থেকে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছ।’ ধূর্ত চোখে চাইল চ্যানি ওর দিকে।
‘না,’ এরিখ ওকে আশ্বস্ত করল। ‘প্রচুর আছে এখানে। তোমার চাহিদার চেয়ে বেশি
‘হাহ্! আমার চাহিদা শুধু একটা খামারেই সীমাবদ্ধ নয়। আমি আরও বেশি চাই।
এরিখ অন্ধকার বাঙ্কহাউসে ঢুকে নিজের বিছানায় বসে পা থেকে বুট খুলতে লাগল। গাস নড়ে উঠল ওর বিছানায়। বক বক করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে, না?’
‘তুমি একা এলেই পারতে, গাস।’
‘অনেক দিন ধরে আছি এক সাথে,’ কৈফিয়ত দিল গাস। ‘নগোলেসের পথে একবার গুলি খাবার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল আমাকে। ওটা ভুলতে পারি না।’
এরিখ জামা খুলে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে ফটকের সামনে ওয়েন্ডি আর বাটলারের অস্পষ্ট অবয়ব দেখা গেল। ওয়েন্ডিকে চুমু খেলো বাটলার, তারপর ফটকের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। উপত্যকার পথে ওর ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল কিছুক্ষণ, মিলিয়ে গেল এক সময়। একটা শূন্যতার অনুভূতি এসে আচ্ছন্ন করল এরিখকে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল ও।
চ্যানি বিয়ারি উঠে ওয়েন্ডির কাছে গেল আবার। কথা বলল ওর সাথে। ওয়েন্ডি চ্যানির সুদর্শন মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনল। এরিখ জানালা থেকে সরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অবসাদ বোধ করছে সে, হতাশাও।
গাস বাঙ্ক থেকে উঠে জানালার কাছে গেল। আবার শুরু করেছে!’ বিরক্তি প্রকাশ করল ও। ‘গাধা কোথাকার!’
‘গাধা হলেও, এরিখ মন্তব্য করল, ‘সুদর্শন। সাহসীও অবশ্য, কথায় কথায় গুলি করার বড়াই বাদ দিলে আকর্ষণীয়ও।’
গাস নিজের বাঙ্কে এসে শুলো। সিগারেট জ্বালাল একটা। প্রতিবার সিগারেট টানতে গিয়ে মৃদু আলোয় ওর পোড়-খাওয়া চোখ এরিখকে পর্যবেক্ষণ করল।
‘একদিন ভাল হয়ে যাবে ও,’ মৃদু স্বরে বলল গাস।
‘আমারও তাই বিশ্বাস,’ এরিখ একমত হলো।
এরিখের দিকে পাশ ফিরল গাস। সিগারেটের আলোয় এরিখ অসংখ্য ভাঁজে-ভরা ওর মুখখানা দেখতে পেল।
‘আমার মনে হয়,’ কথা বলল গাস, ‘তুমি পছন্দ করো মেয়েটাকে।
যতটুকু প্রকাশ করো, তার চেয়ে বেশি।
‘হতে পারে।’
‘তাহলে এগোচ্ছ না কেন?’
‘মেয়েদের ব্যাপারে আমি ততটা চালু নই, গাস।’
গাস বিরক্তি প্রকাশ করল ঘোঁৎ করে। ‘ও তোমাকে পছন্দ করে।’
‘অবশ্যই!’ বলল এরিখ। ‘মানুষ তো একটা ঘোড়াকেও পছন্দ করে।’
কিস্তু জানো না তুমি মেয়েদের সম্বন্ধে।’ গাস ওকে নাকচ করে দিল।
এরিখ হাসল। ‘তুমি প্রচুর জানো মনে হচ্ছে?’
‘দু’বার বিয়ে করেছি।’ হাসল গাসও। ‘কারও সাথে থাকতে পারিনি হয়তো আমার নিজের দোষেই। মেয়েদের স্বভাবই হলো পুরুষদের চালনা করতে চাওয়া, অন্তত যাদের ওরা পছন্দ করে। প্রায় প্রত্যেক ব্যাপারেই ওদের নিজস্ব কিছু মতামত থাকে। আদর্শও বলতে পারো। নিজেদের মতাদর্শের কাছাকাছি পুরুষই ওদের পছন্দ। ওরকম কাউকে পেলে, কিছুটা হলেও—তারা ভালবাসে, বিয়ে করে এবং বাকি জীবনটা ব্যয় করে ওর অসম্পূর্ণতাকে নিজের আদর্শ অনুযায়ী সম্পূর্ণতা দিতে। কিন্তু মজা কি জানো? ওরা তাতে কোনদিনই সফল হয় না।’
এরিখ কোনও মন্তব্য করল না। দরজা ঠেলে চ্যানি এসে ঢুকল। নিজের বাঙ্কে শুয়ে পড়ল সে কাপড়চোপড় না পাল্টেই।
এরিখ চোখ মুছল। ওয়েন্ডিকে ঘিরে রঙিন স্বপ্ন দেখছে চ্যানি বিয়ারি। এটা বাটলার সহজভাবে নেবে না। এবং, এরিখ ভাবল, ও নিজেও কি তা নেবে?