আশ্চর্য রেডিয়ো
ডান দিকের নব্টায় মোচড় দেওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটল।
হলুদ হয়ে যাওয়া ছেঁড়া পরদার ওপাশ থেকে স্পিকার একটা চাপা আর গভীর শোঁ শোঁ আওয়াজ করে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই শব্দ যেন ঢুকে পড়ল শরীরের ভেতর! প্রথমে শিরদাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত মাথায়। কেমন একটা শিরশিরানি ভাব! ভোম্বলের ভাল লাগছে। খুশি খুশি লাগছে। মনে হচ্ছে, পারবে। চেষ্টা করলে সে অনেক কিছু পারবে!
মন খুশি লাগায় ভোম্বল ঘাবড়ে গেল। আজ তো এমন হওয়ার কথা নয়! সকাল থেকেই সে মনমরা। আজ তার অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে পাশ করতে পারেনি। অর্থাৎ এবছরও তাকে থাকতে হচ্ছে ক্লাস সেভেনে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বিষয়ে তার নম্বরের অবস্থা ভয়ংকর। ইতিহাস, ভূগোল, ইংরেজি এবং বিজ্ঞানের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বিজ্ঞানে ভোম্বল এবার স্কুলের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ কম নম্বর পেয়েছে। মোট সাড়ে সাত। ফেলেরও একটা নম্বর আছে, এই নম্বর তাকেও হার মানিয়েছে। এরকম সময় মন খুশি হওয়া যথেষ্ট ঘাবড়ে দেওয়ার মতোই ব্যাপার।
ভোম্বল তাড়াতাড়ি নব ঘুরিয়ে রেডিয়ো বন্ধ করল। শোঁ শোঁ আওয়াজ থামল। এ কী কাণ্ড রে বাবা! একটা নব ঘোরাতেই মনের মধ্যে এরকম তোলপাড়! এ তো ম্যাজিক! একরকম হওয়ার কথা হচ্ছে আর-একরকম।
ভোম্বল এখন রয়েছে তিনতলায়। ছাদের কোণে, ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে। সময় সুযোগ পেলেই ভোম্বল লুকিয়ে ছাদে চলে আসে এবং এই ঘরে ঢুকে পড়ে। বড় প্রিয় জায়গা তার। আসলে এটা ঠিক ঘর নয়, বাড়ির গোডাউন। রাজের বাতিল, ভাঙা, খারাপ হয়ে যাওয়া জিনিসে বোঝাই। বেতের চেয়ার বেত নেই, দরজা ছাড়া কাঠের আলমারি, ছেঁড়া বই, বাঁকা আয়না, খোঁড়া টেবিলের সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে দাদুর চোঙঅলা অচল গ্রামাফোন, দিদির ফিতে-ছিঁড়ে-যাওয়া ক্যাসেট, ভাঙা রেকর্ড, মায়ের রান্নাঘরের কাটা বল্ব, ঠাকুমার বিয়ের গয়নার বাক্স আর তার লম্বা চাবি, দাদার ফেলে দেওয়া কম্পিউটার চিপ্স। ছড়িয়েছিটিয়ে আছে বাবার মরচে-পড়া স্ক্রু-ড্রাইভার, মাথা-ভাঙা হাতুড়ি, সরু, মোটা নানা ধরনের তার, জং-ধরা কাঁচি, দড়ি। এ ছাড়াও অজস্র নাম-জানা এবং নাম-না-জানা অনেক জিনিস। মজার ব্যাপার হল, এ-ঘরে কয়েকটা চেনা জিনিস পুরনো হয়ে গিয়ে এমন চেহারা নিয়েছে যে, এখন আর চট করে চেনা যায় না। ভোম্বল নাড়াচাড়া করতে করতে মাঝেমধ্যে সেইসব অচেনা জিনিসের কয়েকটা চিনে ফেলে। তখন খুব মজা লাগে। অনেকটা যেন আবিষ্কারের মজা!
তবে মজার পাশাপাশি এই খেলায় বিপদও আছে। এই তো গত রবিবার দুপুরে একটা বিপদ হল। আলমারির ওপরে ভোম্বল দেখল একটা কাঠের সিন্দুক। সেটাকে টেনে হিঁচড়ে নীচে নামিয়ে দেখে, সিন্দুক কই, এ তো একটা হারমোনিয়াম। অনেকগুলো রিড নেই। বেলোটাও আরশোলায় প্রায় খেয়ে নিয়েছে। ঘরের কোণে ফেলে রাখা বাতিল পরদার কাপড়, পেরেক, হাতুড়ি, কঁচি, কাঠের টুকরো নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বসে গেল ভোম্বল। তিনঘণ্টার ঘাম-ঝরানো পরিশ্রমের পর মরা হারমোনিয়াম প্রাণ ফিরে পেল। তবে সে-প্রাণ যে সে প্রাণ নয়। ভয়ংকর প্রাণ! কাঠের টুকরো বসিয়ে তৈরি রিডের ওপর হাত বোলাতে যা ঘটল তা আর যাই হোক, বাজনা নয়। একেবারে আর্তনাদ! সেই আর্তনাদ শুনে তিনতলা থেকে ছুটে এল দিদি। তার হাতে পড়ার বই। সামনেই কলেজের পরীক্ষা। দিদি ভোম্বলের একটা কান ভাল করে পাকড়াতে-না-পাকড়াতে দোতলা থেকে মা এলেন। দুপুরে সবে চোখে-পাতায় হয়েছিল তাঁর। এসেই পিঠে দু’ঘা। এখানেই শেষ নয়। এত বছর চুপ করে থাকা হারমোনিয়ামের প্রাণখোলা আর্তনাদ পৌঁছেছিল একতলাতেও। গম্ভীরমুখো বাবা আরও গম্ভীর হয়ে উঠে এলেন ছাদে। গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন, চিলেকোঠার ঘরে বিকেলেই তালা পড়বে।
বকুনি ভোম্বলের গায়ে তেমন লাগে না। এর জন্য বাবা তাকে বলেন, বোকা।
মা বলেন, গোবেচারা।
দাদা বলে, ইডিয়ট।
দিদি বলে, গাধা।
দাদা-দিদি দু’জনে মিলে বলে, এমন একটা নামের জন্যই নাকি ছেলেটা এত গবেট হয়েছে। বাবা-মা’র উচিত, এখনই ওর ভোম্বল নামটা বদলে দেওয়া। বাবা বলেছেন, তাই দেবেন।
ভোম্বলের নাম এখনও বদলানো হয়নি, চিলেকোঠার ঘরে তালাও পড়েনি। আজ এই ফেলের দিনেও চুপিচুপি এখানে চলে এসেছে ভোম্বল। বহুদিন ধরে সে দেখছে, ঘরের একপাশে মাকড়সার জাল আর ধুলোর মাঝখানে মাঝারি মাপের একটা বাক্স ঝিমোচ্ছ। ঠিক যেন একটা বুড়ো মানুষ! ভোম্বল ভেবেছিল, বাক্সটা একবার নেড়েচেড়ে দেখবে। আজ সুযোগ নিল। জিনিসটাকে কাছে আনল। মাকড়সার জাল সরিয়ে, ধুলো মুছে চমকে উঠল। এ কী! এ যে একটা রেডিয়ো! পুরনো দিনের রেডিয়ো। এ রেডিয়ো আজকাল আর দেখা যায় না। নিশ্চয় ঠাকুরদার আমলের জিনিস। কে জানে, তার আগেরও হতে পারে। রেডিয়োর সামনের পরদাটা ছিঁড়ে গেছে অনেকখানি। ভেতর থেকে উঁকি মারছে স্পিকার। সেটাতেও মরচে ধরেছে। একেবারে নীচে তিনটে বড় বড় নব্। সেগুলোর নীচের লেখা আবছা হয়ে গেছে। ফলে কোনটা কীসের নব্ এখন আর বোঝবার কোনও উপায় নেই।
সময় নষ্ট না-করে ভোম্বল রেডিয়োটা নিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীক্ষার নম্বর তার মাথা থেকে পালাল। রেডিয়ো খোলা বা লাগানোর কাজ সে কিছুই জানে না। জানার কথাও নয়। তবু মিনিট কুড়ির চেষ্টায় স্ক্রু-ড্রাইভার ঘুরিয়ে, হাতুড়ি ঠুকে, কাঁচি দিয়ে কেটে প্রায় সবটাই সে খুলে ফেলল। ভেতরের যন্ত্রপাতি আলাদা করতেও বেশি সময় লাগল না। এতে ছোটখাটো অনেককিছু ভেঙে গেল, কিছু আবার মেঝেতে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ল। দু’-একটা টুকরো গড়িয়ে এদিক সেদিক চলেও গেল। ভোম্বল অবশ্য এতে মোটেও ঘাবড়াল না। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করল ডবল উৎসাহে। এই পর্যায়ে তাকে ভাঙা রেডিয়ো জোড়া লাগাতে হবে। একসময় সে-কাজও শেষ হল। তবে খুলে ফেলা যন্ত্রপাতি লাগাতে এবার তাকে অনেকটাই কল্পনার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। উপায় কী? অনেক কিছুই যে হারিয়ে গেছে, নয়তো ভেঙেছে। ভোম্বলের সাড়ে সাত পাওয়া বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে সেগুলোর বদলে সেলোটেপ, সুতো, আঠা দিয়ে ভেতরে লেগে গেল বাতিল কম্পিউটারের চিপ, গোল্লা পাকানো তার, নারকোল দড়ি, ভাঙা রেকর্ডের অংশ, এমনকী গয়নার বাক্সের জং-ধরা চাবিটা পর্যন্ত!
কাজ শেষ হলে হাতের ধুলো ভাল করে প্যান্টে মুছে নিল ভোম্বল। এবার রেডিয়োটাকে চালাতে হবে। পা টিপে নেমে গেল একতলায়। বড় এমার্জেন্সি আলো থেকে গোপনে চারখানা ব্যাটারি বের করে আবার পা টিপে উঠে এল ছাদে।
ঠেসেঠুসে সেই ব্যাটারি ঢুকিয়ে, প্রথম নব্টা ঘোরানোর পর-পরই ঘাবড়ে দেওয়ার ঘটনাটা ঘটেছে। জোড়াতালি দিয়ে লাগানো বাতিল রেডিয়ো চাপা শব্দে ডেকে ফেল-করা ভোম্বলের মনে খুশির ভাব এনেছে!
রেডিয়ো বগলদাবা করে ছাদ থেকে নেমে এল ভোম্বল। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। কিছুই বুঝতে পারছে না, শুধু বুঝতে পারছে, আজ সে এমন একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছে, সেটা আর যাই হোক, চিলেকোঠার ছাদে ফেলে রাখবার মতো নয়।
হাতে একটা বই নিয়ে দিদি শুয়ে আছে খাটের ওপর। পা নড়ছে। মুখ হাসিহাসি। মনে হচ্ছে, কোনও হাসির বই পড়ছে। আসলে কিন্তু তা নয়। দিদির হাতের বইটা নিঃসন্দেহে খটোমটো ধরনের কোনও পড়ার বই। ওর এটাই গুণ। খুব সহজভাবে পড়াশোনা করে খুব ভাল রেজাল্ট করে।
ভোম্বলকে পরদা সরিয়ে উঁকি দিতে দেখে দিদি বড় করে হাসল। বলল, আরে আয়, আয়, ভেতরে আয়। মিষ্টি এনেছিস?
ভোম্বল ঘরে ঢুকল। গম্ভীরমুখে বলল, মিষ্টি আনব কেন?
দিদি হাসতে হাসতে উঠে বসল। বলল, বাঃ, আনবি না? শুনলাম এবার নাকি দারুণ রেজাল্ট করেছিস।
পড়াশোনায় নিজে খুব ভাল হলে কী হবে, দিদির এই দোষটা খুব বিচ্ছিরি। ভেম্বলের পড়াশোনা নিয়ে সবসময় ঠাট্টা তামাশা করবে। দিদির কথায় পাত্তা না-দিয়ে ভোম্বল রেডিয়োটা টেবিলের ওপর রাখল। দিদি চোখ বড় করে বলল, এটা কী রে! রেডিয়ো মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, রেডিয়োই তো! কোথা থেকে পেলি রে ভোম্বল? স্কুল থেকে প্রাইজ পেলি নাকি? জানতাম পাবি। ভূগোল, ইতিহাস আর বিজ্ঞানে যা নম্বর জুটিয়েছিস মায়ের কাছে শুনলাম, তাতে তোর কপালে যে প্রাইজ নাচছে তা আমি বুঝেছিলাম। তবে এত তাড়াতাড়ি পাবি সেটা বুঝতে পারিনি। একেই বলে একেবারে হাতে-গরম।
ভোম্বল কথা না বাড়িয়ে বলল, দিদি, রেডিয়ো শুনবি?
দিদি খাটে পা ঝুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, শুনব না? আলবাত শুনব। ফেল-করার প্রাইজ বলে কথা! মনে হচ্ছে, এ-রেডিয়ো শোনবার মজাই আলাদা হবে। একটা গান চালা দেখি। এফ. এম. হবে এতে?
রেডিয়োটা দিদির দিকে ঘুরিয়ে ভোম্বল চোখ সরু করে তাকাল। হবে কি? কিছু কি হবে? মনে হয় না হবে। তার যা হয়েছে, সেটা নিশ্চয় ছিল মনের ভুল। পরীক্ষার ফলের জন্য তার মন এখন দুর্বল। দুর্বল মনে অনেকরকম ভুল হয়। দিদির তো আর মন দুর্বল নয়। তাই তার ভুলও হবে না। তবু একবার পরীক্ষা করতে ক্ষতি কী? কোন নব্টা ঘোরাবে সে? এক নম্বরটা? না, এবার দু’নম্বরটা ঘুরিয়ে দেখা যাক।
কাঁপা হাতে নব্ ঘোরাল ভোম্বল। প্রথমে সেই শোঁ শোঁ শব্দ। এবারে যেন আরও চাপা, আরও গম্ভীর। দিদি চোখ নাচিয়ে বলল, কোথায় রে ভোম্বল, গান কোথায় রে? এ তো শুধু নয়েজ্। অবশ্য ফেলের প্রাইজে এটাই অনেক। গান পেয়েছে ফার্স্ট বয়, নয়েজ্ পেয়েছে ফেল বয়। হি হি। নিশ্চয়ই ওরা রেডিয়ো থেকে গানটান ফেলে দিয়ে শুধু নয়েজ্ ভরে দিয়েছে।
ভোম্বল কোনও কথা শুনছে না। তার বুক ধুকপুক করছে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তাকে?
ঠিক দু’মিনিট। দু’মিনিট পরেই দিদির মুখের হাসি ভ্যানিশ। চোয়াল শক্ত। চোখ নাচানো থেমে গেছে। এ কী, দিদি যে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে! চোখদুটো ছলছল করছে না? কী হল? প্রথম নব্টা ছিল খুশির, এটা কি তবে উলটো নব্? দুঃখের? মনে হচ্ছে তাই। অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, দিদি উদাস চোখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে। তারপর ফিসফিস করে বলল, ভোম্বল, তোর কি কষ্ট হচ্ছে?
অবাক হয়ে ভোম্বল বলল, কষ্ট! কই না তো।
দিদি কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, হচ্ছে, নিশ্চয়ই হচ্ছে। তুই বুঝতে পারছিস না। পরীক্ষার রেজাল্ট এরকম হলে দুঃখ-কষ্ট তো হবেই। তুই চিন্তা করিসনি ভোম্বল, এবার তোর ইতিহাস আর ভূগোলের দায়িত্ব আমার। ইস, এতদিন যে কেন তোর দিকে একদম মন দিইনি। খুব খারাপ লাগছে। যাক, সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখবি, পরের বছর দারুণ হবে। ইতিহাস ভুগোলে মার মার কাণ্ড করে দেব। রোজ সন্ধেবেলা আমার কাছে বই নিয়ে চলে আসবি। আমিও পড়ব, পাশে বসে তুইও পড়বি। পড়তে যখন ইচ্ছে হবে না, তখন ভাইবোনে মিলে গল্প করব।
ভোম্বল বুঝতে পারছে, অবস্থা মোটেই ভাল নয়। দিদি রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে। এর পরের স্টেজই নিশ্চয়ই ভেউ ভেউ করে কান্না। ভোম্বল আর কথা না-বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি রেডিয়ো বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। এতক্ষণ তার হাত-পা কেঁপেছে, এবার গোটা শরীরটা কাঁপছে। এ কী জিনিস বানিয়ে ফেলেছে সে! এ তো ভয়ংকর জিনিস! একটা নবে খুশি, আর একটা নবে দুঃখ! বাকি রইল তিন নম্বর নব্টা। সেটায় কোন কারসাজি লুকিয়ে রয়েছে কে জানে!
তিনতলার বারান্দার একপাশে দাদু বসে আছেন। দিনের বেশিরভাগ সময়েই এই ইজিচেয়ারে বসে থাকেন তিনি। লাঠিটা হেলান দিয়ে রাখা থাকে পাশে। বুড়ো মানুষটার চোখ বোজা। তবে চোখ বোজা থাকলেই যে তিনি ঘুমোন এমন নয়। এমনি এমনিই চোখ বুজে থাকেন। সম্ভবত কানও বন্ধ রাখেন। বারান্দার ওপাশে নীল আকাশ, সবুজ গাছ, দূরের ঝিল, পাখিদের ডাক— কিছুই তিনি দেখতে চান না, শুনতে চান না। অবসর নেওয়ার পর থেকেই দাদু এমন ঝিমোনো-মার্কা হয়ে গেছেন। কোনও কিছুতেই তাঁর যেন উৎসাহ নেই। প্রথমদিকে ভাবা হয়েছিল, অসুখবিসুখ করেছে। ডাক্তার দেখানো হল। হার্ট, রক্ত, হাড়— সব পরীক্ষা হল। না, কোনও গোলমাল নেই। বাবা-মা দাদুকে কত বোঝালেন। বড়পিসি গড়িয়া থেকে, ছোটপিসি দমদম থেকে এবং কাকা আসানসোল থেকে এসে পর্যন্ত বলে গেলেন। বাবা বলেছেন, সকালের বাজারটা তো তুমি করলেই পারো। এই তো কাছেই। হাঁটাচলাও হবে। ব্লাড সার্কুলেশন বাড়বে।
মা বলেছেন, “বিকেলে ঝিলের পাশে একটা চক্কর দিয়ে এলেই তো পারেন বাবা। নিদেনপক্ষে ঘরে বসে ভোম্বলের ইংরেজিটা তো একটু দেখিয়ে দিন। আপনি তো ইংরেজির মাস্টার ছিলেন।
কথা কানে যায় না দাদুর। চোখ বোজাই থাকে। মাঝেমধ্যে ঠোঁট উলটে বলেন, ভাল লাগে না, কিছুই ভাল লাগে না। আর তো মাত্র ক’টা দিন। চলে যাওয়ার সময় তো হয়ে গেছে। আজকাল দাদুর বিষয়ে বাড়ির সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
ভোম্বল ভেবে দেখল, রেডিয়োর তিন নম্বর নব্ পরীক্ষা করবার পক্ষে এই মানুষটাই সবচেয়ে সুবিধের। তেমন কিছু গোলমাল হলে অন্তত কাউকে নালিশ করবেন না।
ইজিচেয়ারের সামনে, মেঝের উপর রেডিয়োটা রাখল ভোম্বল। গলা নামিয়ে বলল, ভাল আছ দাদু?
দাদু সামান্য চোখ খুলে ভোম্বলকে দেখলেন। মাথা নাড়লেন। এই নাড়ার মানে ভালও হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে।
ভোম্বল চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে বলল, দাদু, আজ আমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে।
দাদু বললেন, ও। বলে চোখ বুজলেন ফের। ভোম্বল বিরক্ত হল। আচ্ছা মানুষ তো! নাতির পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে তবু কেমন হয়েছে শুনতে চাইছেন না। ভোম্বল এবার একটু গলা তুলে বলল, দাদু, আমি ফেল করেছি। বিজ্ঞানে সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছি। সাড়ে সাত। ইংরেজিও ভাল হয়নি।
দাদু উত্তর দিলেন, ও।
ভোম্বলের বিরক্তি আরও বাড়ল। বোঝে ঠ্যালা। বিজ্ঞানে সাড়ে সাত শুনে সবাই যখন চমকে গেছেন, তখন দাদু বলছেন ও! এ তো মারাত্মক। ভোম্বল এবার বলল, দাদু, রেডিয়ো শুনবে?
দাদু চোখ খুললেন। কোনও উত্তর দিলেন না।
উত্তরের অপেক্ষা না-করে ভোম্বল তিন নম্বর নব্ ঘুরিয়ে রেডিয়ো চালু করল। আওয়াজ উঠল শোঁ শোঁ শো…।
কোথায় একটা পাখি টুইটুই করে ডাকছে। ডেকেই চলেছে। শেষ দুপুরের রোদ-মাখা বাতাস পুবের ঝিল থেকে নিয়ে আসছে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। নবম আলোয় বারান্দা-লাগোয়া নারকোল গাছের পাতাগুলোকে দেখলে মনে হচ্ছে, নীল আকাশের গায়ে ঘন সবুজ রং দিয়ে কেউ আলপনা এঁকে রেখেছে। কিন্তু এসব দিকে ভোম্বলের মন নেই। সে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার ঝিমোনো-দাদুর দিকে।
মিনিটখানেক পর দাদু প্রথমে চোখ খুললেন। তারপর সেই চোখ বড় করলেন। তারপর সোজা হয়ে বসে একমুখ হাসলেন। বললেন, বাঃ বেশ ভাল লাগছে তো হে!
ভোম্বল অবাক হয়ে বলল, কী ভাল লাগছে?
দাদু মাথা নেড়ে বললেন, তা তো জানি না বাপু। ভাল লাগছে, ব্যস, ভাল লাগছে। দাদুর চোখ চকচক করছে। যেন হাসছেন। এ যেন অচেনা এক দাদু!
ভোম্বল তিন নম্বর নব্টা আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ভেবে বলো দাদু, আর-একটু ভেবে বলো তো, কী ভাল লাগছে তোমার?
দাদু ভুরু কুঁচকে ঠোঁটে আঙুল দিলেন। ডান কানটাকে বাড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, অ্যাই, চুপ কর। চুপ কর একেবারে। একটা পাখি ডাকছে না?
ভোম্বল অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ, ডাকছে তো। ঝিলের পাখি। রোজ বিকেলেই তো ওরা উড়ে উড়ে আসে।
দাদু উঠে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ের ধারে চলে গেলেন। ভোম্বল ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়াল। মানুষটার ভিতরে যে এত উৎসাহ লুকিয়ে আছে কে জানত?
দাদু এবার ভোম্বলকে আরও চমকে দিয়ে বললেন, বিকেলে ঝিলের পাশে একটা চক্কর দিয়ে আসব ভাবছি।
নিজের কানে শুনলেও ভোম্বলের কথাটা বিশ্বাস হল না। সে অবাক হয়ে বলল, সত্যি? তুমি যাবে?
দাদু ভোম্বলকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, সত্যি যাব। মরে যাওয়ার আগে মনে হচ্ছে, অনেক কিছু দেখা এখনও বাকি থেকে যাবে। যতটা পারি দেখে নিই। কী বলিস? হা হা। আর হ্যাঁ শোন, তুইও আমার সঙ্গে যাবি। আচ্ছা, বল তো দেখি, ঝিলের পাখিরা কত সুন্দর— এর ইংরেজি কী হবে? পারবি না তো? জানতাম পারবি না। গাধা কোথাকার। আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ভার্ব, টেন্স আর অ্যাডজেক্টিভটা ঝালিয়ে নিবি। ঘরে বসে বই পড়ে শেখার চেয়ে বাইরে ঘুরে, নিজের চোখে দেখে শিখলে অনেক সহজে শেখা যায়। মনে রাখবি, ঠিক চারটের সময় রওনা দেব।
ভোম্বল জিজ্ঞেস করল, দাদু, আমি কি গ্রামার বইটা সঙ্গে নেব?
দাদু গম্ভীর হয়ে বললেন, না, নিবি না। প্রকৃতির মধ্যেই অনেক বই থাকে। আর-একটা কথা শোন, অত হাঁটাহাঁটির পর খিদে পেয়ে যাবে মনে হচ্ছে। তুই বরং এখনই তোর মাকে বলে রাখ, ক’টা বেগুনি রেডি করে রাখতে। ফিরে এসে মুড়ি দিয়ে গরম গরম খাওয়া যাবে। বাড়িতে-ভাজা বেগুনিতে কোনও দোষ নেই।
ভোম্বল হাঁ হয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটার কী হয়েছে সে বুঝতে পারছে না। তবে কিছু একটা হয়েছে। আশ্চর্য রেডিয়োর উৎসাহ-নব্ বন্ধ করবার কথা তার মনে নেই। সেখান থেকে আওয়াজ আসছে শোঁ শোঁ শোঁ…।
এরপর সারাটা দিন ধরে রেডিয়োর খুশি, দুঃখ এবং উৎসাহ-নব্ অনেক কাণ্ড করল। সন্ধেবেলা ভয়ংকর রাগী গৃহশিক্ষক পরিতোষবাবু যখন মার্কশিট হাতে ঠকঠক করে কাঁপছেন, তখন পড়ার টেবিলের তলায় লুকিয়ে-রাখা রেডিয়োতে খুশি হওয়ার নব্টা ঘুরিয়ে দিল ভোম্বল। পরিতোষ মাস্টারের রাগ একেবারে জল হয়ে গেল কয়েক মিনিটে! কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হেসে বললেন, তোমার এই রেজাল্টে আমি খুশি হয়েছি ভোম্বল। এই রেজাল্ট আমার সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করল। ভাল ছাত্রকে ভাল ফল করানো কোনও কাজই হতে পারে না। খারাপ ছাত্রকে ভাল করে তৈরি করাটাই আসল। এবার আমি সেই চেষ্টাই করব। তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট আমার চোখ খুলে দিল। ভেরি গুড। ভেরি, ভেরি গুড। ভোম্বল তোমাকে অভিনন্দন। ফেল-করা ছাত্রকে গৃহশিক্ষক হাত ধরে অভিনন্দন জানাচ্ছেন দেখলে বাড়ির লোকেরা ভয় পেয়ে যাবেন। ভাববেন নম্বর দেখে মাস্টারমশাইয়ের মাথার গোলমাল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি রেডিয়ো বন্ধ করে ভোম্বল অবস্থার সামাল দিল।
বাড়ির কোনও ব্যাপারেই দাদার মন নেই। সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে সে ব্যস্ত। কম্পিউটার নিয়ে অনেক দূর পড়াশোনা করবার পর এই মুহূর্তে তার একটাই চিন্তা, কীভাবে বিদেশে যাওয়া যায়। ভাইয়ের ক্লাস সেভেনের পরীক্ষার ফল তার কাছে অতি তুচ্ছ বিষয়। সেই দাদাকেও ম্যানেজ করে রেডিয়ো শোনাল ভোম্বল। আর শোনানোর সময় ঘুরিয়ে দিল উৎসাহ-নব্। ফালতু জিনিস নিয়ে সময় নষ্ট হচ্ছে ভেবে দাদা প্রথমটায় বিরক্ত বিরক্ত মুখ করে রইল। কিন্তু সে অবশ্য বড়জোর মিনিটপাঁচেকের জন্য। তারপরই পরিস্থিতির বিরাট পরিবর্তন। দাদা লাফিয়ে উঠে বলল, দারুণ, দুরন্ত, দুর্দান্ত! তুই যে একটা মরা জিনিসে প্রাণ ফিরিয়েছিস ভোম্বল! করেছিস কী! অ্যাঁ! এরপর এতে আনবি কথা। তারপর সুর। তুই পারবি, নিশ্চয়ই পারবি। ভাবিস না ভোম্বল, পৃথিবীর বহু মানুষ স্কুল কলেজের দরজা পেরোতে পারেনি, কিন্তু অনেক বড় বড় কাজ করে চমকে দিয়েছে। সেই তালিকা তোকে আমি দিয়ে দেব। তুই তোর আবিষ্কারের কাজ চালিয়ে যা, আমি তোর পাশে আছি। এখনই চল, তোর চিলেকোঠার ঘরটা একবার দেখে আসি।
রান্নাঘরে মা দাদুর জন্য বেগুনি ভাজছেন আর অল্প অল্প হাসছেন। হাসছেন কেন? সকাল থেকে যে-মানুষটা হাঁড়ির মতো মুখ করে ছিলেন, তিনি এখন হাসবেন কেন? ভোম্বলকে ঘুরঘুর করতে দেখে মা বেশি করে হাসলেন। বললেন, নে ভোম্বল, গরম গরম দুটো বেগুনি খেয়ে নে। আর ক’দিনই বা বাড়ির খাবার পাবি?
ভোম্বল চমকে উঠল। মায়ের কথার মানে সে বুঝতে পারছে না। মা বললেন, বুঝতে পারলি না তো? চিন্তা করিস না, পারবি, তোর বাবা অফিস থেকে ফিরলেই সব জলের মতো হয়ে যাবে। সকাল থেকে ভাবছিলাম তোর মতো গুণী ছেলেকে নিয়ে আমরা কী করব? একটু আগে তোর বাবা টেলিফোন করে সেই চিন্তা দূর করেছেন। জানিয়েছেন সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
কথা শেষ করে মা গুনগুন করে গান ধরলেন। ভাবটা এমন যে বাবা ফিরলে খুব মজার কোনও ঘটনা ঘটবে।
মায়ের হাসি, গান— লক্ষণগুলো ভোম্বলের ভাল ঠেকছে না। তার মন বলছে, বড় বিপদ আসছে। সেই বিপদ থেকে বাঁচানো আশ্চর্য রেডিয়োর কম্ম নয়। তবু মরিয়া হয়ে সে একটা চান্স নিল। রান্নাঘরের দরজার আড়ালে জিনিসটা রেখে দুঃখের নব্টা সামান্য একটু ঘুরিয়ে দিল। মিনিটখানেকের মধ্যে মায়ের গুনগুন বন্ধ! আরও মিনিটখানেক পর ভোম্বলকে ডেকে মা নরম গলায় বললেন, বাবা ফেরবার আগেই তাড়াতাড়ি বইটই নিয়ে বসে যা তো ভোম্বল। একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছে। দেখি, তোর বাবাকে কীভাবে ম্যানেজ করা যায়। আর শোন, দ্যাখ তো, কোথা থেকে একটা বিচ্ছিরি শোঁ শোঁ আওয়াজ আসছে। তুই কি শুনতে পাচ্ছিস?
মাকে মিথ্যে বলা ঠিক নয়। তবু ভোম্বল মাথা নেড়ে বলল, কই, না তো!
অফিস থেকে বাবা ফিরলেন রাত করে। শান্তভাবে চা খেতে খেতে টিভিতে খবর শুনলেন। কুম্বলের বলের প্রশংসা করলেন। মঙ্গল গ্রহের রঙিন ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, বাঃ, বিজ্ঞান কত এগিয়ে গেছে। চা খাওয়া শেষ হলে তিনি আরও শান্তভাবে ঘোষণা করলেন, ভোম্বলের জন্য বোর্ডিং স্কুলের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কালই তাকে সেখানে দিয়ে আসা হবে। আপাতত বেশি জিনিস নেওয়ার দরকার নেই। চার সেট জামাকাপড় নিলেই চলবে। তবে সোয়েটার মাস্ট। পুরুলিয়ার ঠান্ডাটা আবার একটু আগে পড়ে কিনা!
পাশের ঘরে বসে ভোম্বলের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই ভয়ংকর বিপদের কথা সে কল্পনাও করতে পারেনি। বাড়ি ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে? তার উপর মনে হচ্ছে, রেডিয়োটা সে ভুল করে বাবার ঘরেই ফেলে এসেছে। ঠিক কোথায় রেখেছে মনে পড়ছে না। টেবিলের উপরও হতে পারে, আবার বইয়ের তাকেও হতে পারে। বাবা যদি ওটা দেখতে পান? শুধু দেখতে পেলে না হয় একটা কথা, কিন্তু যদি চালিয়ে ফেলেন? তা হলে তো কেলেঙ্কারি। হয়তো উৎসাহ-নব্টা ঘুরিয়ে ফেললেন। উৎসাহ বেড়ে গেল চড়চড় করে। এতটাই উৎসাহ যে, কাল সকালের জায়গায় হয়তো আজ রাতের ট্রেনেই ভোম্বলকে নিয়ে পুরুলিয়া রওনা দিলেন। খুশির নবে হাত দিলেও ঝামেলা আছে। বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পেরে বাবা হয়তো দারুণ খুশি হয়ে পড়লেন। এতই খুশি যে, মায়ের হাজার কাকুতি মিনতিতেও কান দিলেন না। বাকি রইল দুঃখের নব্। ভোম্বলের মন বলছে, তাতেও তার মুক্তি হবে না। এই নবের শোঁ শোঁ আওয়াজে ভোম্বলের রেজাল্টের দুঃখ মানুষটার মনে ফুলে-ফেঁপে দশগুণ হয়ে গেল। ভোম্বল কোথায় যেন শুনেছে, খুব দুঃখের সময় মানুষের মন পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। সেই মন সহজে নড়ানো যায় না।
না, বাঁচার আর কোনও পথ নেই দেখা যাচ্ছে। ভোম্বলের ইচ্ছে করছে, ছুটে গিয়ে বাবার ঘর থেকে রেডিয়োটা নিয়ে আসে। তারপর মেঝেতে আছড়ে ভেঙে ফেলে। কেন যে ছাই জিনিসটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েছিল?
কিন্তু ঘটনা ঘটল অন্যরকম।
রাতে খেতে বসার আগে দাদু বাবাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, হ্যাঁরে, শুনলাম ছেলেকে নাকি বোর্ডিঙে পাঠাবি? খেপেছিস নাকি? ভোম্বল বাড়ি থেকে গেলে আমার ঝিলের ধারে বেড়াতে যাওয়ার কী হবে? শুরু করতে-না-করতেই শেষ? তোরা দেখছি আবার আমাকে চেয়ারে বসিয়ে ছাড়বি। ওসব পরিকল্পনা একদম বাদ দাও বাপু। তা ছাড়া ছেলেটাকে সবে টেন্সটা বোঝতে শুরু করেছি। এখনও ভার্ব, অ্যাডজেক্টিভ সব বাকি।
খেতে বসে দাদা বলল, “বাবা, শুনলাম ভোম্বলের জন্য তুমি নাকি বোর্ডিং স্কুল ঠিক করেছ। খানিক আগে হলে আমি বলতাম, খুব ভাল করেছ। কিন্তু এখন সে-কথা বলতে পারছি না। চিলেকোঠার ঘরে ওর যে কর্মকাণ্ড দেখলাম তাতে আমি মুগ্ধ। আমি নিশ্চিত, তুমি যদি দ্যাখো তা হলে তোমারও একই অবস্থা হবে। তুমিও মুগ্ধ হবে। কত অচেনা, হারিয়ে-যাওয়া, ফেলে-দেওয়া জিনিসকে যে ভোম্বল নতুন করে চিনে ফেলেছে, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ফালতু জিনিসও এত কাজে লাগতে পারে। আমার খুবই অবাক লাগছে। পরীক্ষায় ও ছেলের এত খারাপ হবে কেন? বাবা, ঠিক করেছি, কাল থেকে ভোম্বলের অঙ্ক আর বিজ্ঞানটা আমিই দেখিয়ে দেব। সেরকম হলে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা আমি একবছর পিছোতেও পারি।
দিদি বেশি কিছু বলেনি। মাথা নিচু করে বলেছে, ভোম্বলের খারাপ রেজাল্টের জন্য আমিও সমানভাবে দায়ী বাবা। এতদিন ওকে কোনও সাহায্য তো করিনি, উলটে শুধু ঠাট্টা করেছি। ইতিহাস, ভূগোলটা এবার আমিই ওকে পড়াব ভেবেছি। এই অবস্থায় বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দেওয়াটা আমার পক্ষে খুবই অনুশোচনার হবে। বাবা, আমি চাই, তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও।
বছর ঘুরে গেছে। দাদার আমেরিকা যাওয়া পাকা। দিদি দারুণ রেজাল্ট করে কলেজের পড়া শেষ করেছে। দাদু রোজ বিকেলে ঝিলের ধারে হেঁটে আসেন। এদিকে বিজ্ঞানে বিরানব্বই পেয়ে ক্লাস এইটে উঠে পড়েছে ভোম্বল। ইংরেজি, ইতিহাস, ভুগোলেও ভাল নম্বর হয়েছে। সবাই খুব খুশি। রেজাল্টের দিন মা বাড়িতে বেগুনি-পার্টি দিলেন। দাদু সাতখানা খেয়ে বললেন, আর-একটা হবে নাকি বউমা?
আর সেই রেডিয়ো? সেই রেডিয়োর কী হল?
কিছুদিন এ-ঘরে ও-ঘরে পড়ে থেকে সে আবার ফিরে গেছে চিলেকোঠার ঘরে। পড়াশোনার জন্য ভোম্বল ছাদে ওঠবার সময় পায় না মোটে। চিলেকোঠার ঘরে এখন তালা ঝুলছে। মাকড়সার জাল, ধুলোয় চাদর মুড়ি দিয়ে এককোণে চুপ করে বসে আছে আশ্চর্য রেডিয়ো, হঠাৎ দেখলে মনে হবে, একটা বুড়ো মানুষ। খুশি, দুঃখ আর উৎসাহের ম্যাজিক-নব্গুলো বুকে নিয়ে সে অপেক্ষা করে আছে।
বলা তো যায় না, কবে আবার কে আসে।