আশ্চর্য মানসিকতা
আমরা পাহাড়ের চূড়ায় বিপজ্জনকভাবে একটি প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের দৃষ্টি দূরবর্তী তলদেশে নিবদ্ধ। এর ফলে আমরা অসুস্থ আর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ি। আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তিকামনাটিই প্রবল হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সে অবস্থা বর্ণনাতীত। ধীরে ধীরে আমাদের ভীতি, অসুস্থতা আর অপ্রকৃতিস্থতা স্তিমিত হয়ে বিশেষ এক ধরণের অনুভূতিতে পরিণত হয়। আরব্যরজনীর মধ্যে বোতল থেকে ভৌতিক আবির্ভাবের যে বর্ণনা আছে অনেকটা তারই মত পূর্ববর্ণিত অনুভূতি আমাদের চিন্তার মধ্যে ধীরে ধীরে একটা রূপ পরিগ্রহ করে। গল্প-কাহিনীর মধ্যে বর্ণিত ভৌতিক মূর্তির তুলনায় এই চিন্তালগ্নরূপটি কিন্তু অনেক বেশী ভয়ঙ্কর। সেই ভয়ঙ্কর একধরণের আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রনে যে ভীষণতা লাভ করে তার সামগ্রিক প্রভাবে আমাদের অস্থিমধ্যস্থিত মজ্জাও হিম হয়ে আসে। পর্বতশিখর থেকে পতনের মুহূর্তে আমাদের অনুভূতির স্বরূপটি এই শ্রেণীর। এই পতন, ধ্বংসের অনিবার্য পরিণতির দিকে এই দুর্বার যাত্রা প্রকৃত মৃত্যুর চাইতেও জঘন্য ও বীভৎস। এর চাইতে জঘন্যতর মৃত্যু অকল্পনীয়। হয়ত এই জন্যেই পতনের মুহূর্তে মৃত্যুকামনাটি এত তীব্র হয়ে ওঠে। আমাদের ভাবরুজগতে এর চাইতে ভয়ঙ্কর এবং ধৈর্যহীন আবেগ আর কিছু নেই।
এই অনুভূতির স্বরূপ পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে যে এ সবই চরিত্র-বিকৃতির লক্ষণ। কাজটা করা উচিত নয় একথা জানি বলেই যেন কাজটা করার জন্যে আমাদের আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে। এর পেছনে বোধগম্য কোন রকমের যুক্তিই নেই। সম্ভবত আমাদের ভেতরে যে অস্থির বুদ্ধি আছে এর মধ্যে তারই প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
আমি এখানে কেন আছি তার কৈফিয়ত হিসেবে আমার কথাগুলোকে গ্রহণ করলে আমার বন্দীদশার একটা অর্থ বুঝতে পারা যাবে। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দীর সঙ্কীর্ণ কক্ষের মধ্যে আমার উপস্থিতির কারণগুলো পূর্বাপর চিন্তা না করতে পারলে আমাকে হয়ত উন্মাদই ভাববেন আপনারা।
যে পরিমাণ সুচিন্তিত পরিকল্পনার সাহায্যে বর্তমান কর্মটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা তুলনাহীন। হত্যা করার পূর্বে তার উপায় সম্পর্কে আমি সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস চিন্তা করেছি। হাজারটা পথ আমি এই জন্যেই পরিত্যাগ করেছি যে সেগুলোর ক্ষেত্রে ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। শেষে একটা ফরাসী পত্রিকায় মাদাম পিলোর মারাত্মক অসুস্থতার কথা পড়ি। আকস্মিকভাবে একটা মোমবাতি বিষাক্ত হয়ে যাওয়ার দরুণ এটা ঘটে। কাহিনীটি পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমি পথের সন্ধান পেয়ে যাই। আমি যাকে হত্যা করতে চাইছিলাম রাত্রে বিছানার মধ্যে কিছু পড়াশোনা করার অভ্যাস ছিল তার। আর এ খবরও আমার জানা ছিল যে তার শয়নকক্ষ অপরিসর আর বায়ুচলাচলের ব্যবস্থা সেখানে অপ্রচুর।
যাক, এসব ছোটখাটো অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা দিয়ে লাভ নেই। যে কোন উপায়ে হোক আমি ওর বিছানার পাশে রাখা বাতিদান থেকে বাতিটি সরিয়ে আমার নিজের তৈরী একটা বাতি সেখানে বসিয়ে দিতে পেরেছিলাম। পরের দিন বিছানায় তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। করোনারের রিপোর্টে এ মৃত্যুকে ঈশ্বরদত্ত স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই বর্ণনা করা হয়েছিল।
তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার পর বেশ কয়েক বছর আনন্দেই কেটে গেল। কোন দিন যে আমার অপরাধের সন্ধান কেউ জানতে পারবে ঘুণাক্ষরেও সে চিন্তা আমার মস্তিষ্কে স্থান পায়নি। মারাত্মক সেই মোমবাতির অবশিষ্টাংশ আমি সযত্নে নষ্ট করে ফেলেছিলাম। আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার বা সাজা দেবার মত কোন সাক্ষ্যপ্রমাণই আমি রাখিনি। আমি নিরাপদ–এই চিন্তা আমাকে কী পরিমাণ পরিতৃপ্তি দিয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারবো না। এই আত্মতৃপ্তি নিয়ে কেটে গেল দীর্ঘকাল। সম্পত্তির উত্তরাধিকার যে সব পার্থিব ভোগবিলাসের আনন্দ আমাকে এনে দিয়েছিল, এ আনন্দ তার চাইতেও বড়।
কিন্তু এর পরই আমার জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হোল । ধীরে ধীরে আমার চিন্তার মধ্যে এক ধরণের ভীতিপ্রদ ও যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি গড়ে উঠল। আমার মন থেকে ওটাকে দূর করতে পারছিলাম না বলেই বড় বেশী যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠেছিল সে চিন্তা। এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে আমি দূরে রাখতে পারছিলাম না। স্মৃতির মধ্যে যা সঞ্চিত ছিল অত্যন্ত সংগোপনেই তাকে জাগিয়ে তুলছিল কোন গানের একটা কলি বা কোন নাটকের একটি ছোট্ট দৃশ্য। আর যন্ত্রণায় আমি কাতর হয়ে পড়ছিলাম। সেই গান আর নাটক যত উচ্চশ্রেণীর হোক না কেন যন্ত্রণার পরিমাণ তাতে হ্রাস পেত না। ধীরে ধীরে আমার নিরাপত্তার চিন্তা আমার মনকে অধিকার করে বসল আর কখনো কখনো নীচু গলায় নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিতে থাকলাম ‘তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
পথে বেড়ানোর সময় একদিন মনে হল সেই স্বগতোক্তির অভ্যাস আর একটু বেড়েছে–আমার কণ্ঠস্বর উচ্চতর হয়েছে আর বক্তব্যেরও কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আমি মাঝে মাঝে বলছি, আমি যদি নিজে মূখের মতো খোলাখুলি ভাবে অপরাধ স্বীকার না, করি, আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
হঠাৎ মনে হোল এই কথাগুলো উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের মধ্যে একটা হিমপ্রবাহ বয়ে গেল। এই ধরণের বিকৃত অনুভূতির অভিজ্ঞতা আমার ছিল তাই একে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলাম প্রাণপণ শক্তিতে। বার বার মনে হোল নিহত ব্যক্তির আত্মা আমাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করছে আর সম্ভবত কোন এক দুর্বল মুহূর্তে আমি অপরাধ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি করেই বসব।
এই চিন্তাকে প্রথমে সবলে পরিহার করতে চাইলাম আর পথচলার গতি দিলাম বাড়িয়ে। কিন্তু সে চিন্তা ক্রমশ প্রবলতর হয়ে উঠল আর আমি একসময় দৌড়াতে শুরু করলাম। পরপর কতকগুলো চিন্তা আমাকে উত্তেজিত করে তুলল আর নিজের ওপর কর্তৃত্বও যেন ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। গতিবেগ তখন আরও বেড়েছে। পথের জনস্রোত ভেদ করে উন্মাদের মত তখন প্রায় দৌড়ে চলেছি আমি। পরমুহূর্তে জনসাধারণের মধ্যেও ভীতির সঞ্চার হোল আর তারাও আমাকে অনুসরণ করতে শুরু করল।
বুঝলাম, নিয়তি আমাকে চরম অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আমি যদি আমার জিহ্বাটিকে ছিন্ন করে ফেলতে পারতাম, হয়ত এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম। কিন্তু আমার কানে কানে কে যেন নির্মমকণ্ঠে কী বলে উঠল, আমার গতি মন্দীভূত হোল। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। পেছন ফিরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে চাইলাম সহজভাবে কিন্তু পরমুহূর্তেই শ্বাসরোধ হয়ে অসার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লাম। আমি যেন একই সঙ্গে অন্ধ, বধির আর মূছাহত হয়ে গেলাম আর ঠিক তখনই কে যেন আমার পেছনে প্রবল আঘাত করল। সুদীর্ঘকালীন অবরুদ্ধ গুপ্ত তথ্য সম্পূর্ণভাবেই প্রকাশিত হয়ে গেল ।
ওরা বলে, আমি নাকি খুব স্পষ্টভাবে একটু দ্রুতগতিতে সব কথা জানিয়েছিলাম। পাছে বক্তব্য শেষ করার আগে কেউ বাধা দেয় তাই আবেগের সঙ্গে আমি নাকি সবটুকু তাড়াতাড়ি বলে নিয়েছিলাম। আর তার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ আজ আমার নিয়তি যুপকাষ্ঠের সঙ্গে নিবদ্ধ হয়ে গেছে। আমার আইনসঙ্গত বিচারের জন্য যেটুকু ‘ক্তব্য প্রকাশ করা দরকার তা করার পরই আমি নাকি সংজ্ঞাহীন হরে যাই। আর কিছু বলার কি প্রয়োজন আছে? শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় আমি এখানে আছি। আগামী কাল এ শৃঙ্খল আমার থাকবে না কিন্তু তখন আমি থাকবো কোথায়?