আশ্চর্য প্রদীপ
অনিকেত চাকরি করে একটা আধা-বিদেশি ফার্মে, কেটেকুটে নিয়ে মাসে বেতন পায় সাতশো ছাব্বিশ টাকা। তার মধ্যে বাড়ি ভাড়াতে যায় একশো আশি, দুধ পঞ্চান্ন, ঝি পনেরো। খবরের কাগজ, ইলেকট্রিসিটি, ছেলের ইস্কুলের মাইনে এসব বাদ-সাদ গিয়ে হাতে যা থাকে তা দিয়ে বেঁচে থাকা যায়। তার বউ ঝুমুর আবার একটু বড়লোকের মেয়ে। খুব বড়লোক নয়, তবে কলকাতায় বাড়ি আছে, ওর এক দাদা গাড়িও কিনেছে। ঝুমুর তাই একটু নাক-উঁচু। প্রায়ই বলে —গ্যাসের উনুন কেনো। কিস্তিবন্দিতে একটা ফ্রিজ কেনা যায় না? বাইরের ঘরটায় ভাড়ার টেবিল ফ্যান রেখে মাসে-মাসে টাকা গচ্চা যাচ্ছে, একটা পাখা কিনলেই তো হয়।
ঝুমুর এসব বলে-বলে অনিকেত রাগ করে না। বরঞ্চ তার মনের মধ্যেও ওসব ইচ্ছে হয়। নিজস্ব পাখা, গ্যাসের উনুন, ফ্রিজ এসব আজকাল মধ্যবিত্ত ঘরেও দেখা যায়। তার বন্ধুদেরও অনেকের আছে। একটা তিনশো টাকার ইনক্রিমেন্ট যদি দৈবক্রমে পেয়ে যেত তাহলে বেশ হত। কিন্তু সে আশা নেই। বরং এবছর নাকি বোনাসও কমে যাবে। মনটা নিশপিশ করে। বড্ড গরিবিয়ানামতে তারা থাকে। অনেকদিন ধরে ভালো জামা-প্যান্টও করায় না সে। কত নতুন ধরনের প্যান্ট-জামার কাপড় বেরিয়েছে গত এক বছর ধরে।
পুরোনো বাড়ি ছেড়ে মাসচারেক হল অনিকেত নতুন বাড়িতে এসেছে বন্ডেল গেটে। নতুন বাড়ি বলতে কিন্তু বাড়িটা নতুন নয়। বরং বেশ পুরোনো বাড়ি। দেড়খানা একতলার ঘরের জন্য একশো আশি টাকা গুনতে হয়। এর আগে শেয়ালদার কাছে ছিল, দুখানা ঘরের ভাড়া একশো দশ। কিন্তু ছেলেটাকে সাউথের ভালো স্কুলে ভরতি করার পর থেকেই ঝুমুর সাউথে আসার জন্য। অস্থির। তাই আরও সত্তর টাকা মাসিক গুনাগার দিয়ে চলে আসতে হয়েছে দক্ষিণে। ছেলের ইস্কুলটাই এখন বড় কথা।
বাড়িটা ভালো লাগে না অনিকেতের। বড্ড অন্ধকার। একটা ঘর নীচের তলায়, আর আধখানা ঘর পেয়েছে গ্যারেজের ওপর। গ্যারেজের ওপরকার ঘরটা বড়ই ছিল, বাড়িওয়ালা দেওয়াল তলে সেটাকে দু-টুকরো করে বাকি আধখানা ঘরে তার অনেক পুরোনো জিনিসপত্তর ডাঁই করে রেখেছে। তবু এই ঘরটায় কিছু আলোবাতাস আসে। অনিকেত এটাকেই তার বসার ঘর করেছে, যদিও তার বাসায় লোকজন বড় আসে না। অনিকেতও কাউকে ডাকে না। লোকজন এলে ভদ্রতা-টদ্ৰতা করতে ঝুমুর বড় খুশি হয় না। বউয়ের খুশিটাই তো এখন বড় কথা।
অনিকেত খুব ভাবতে ভালোবাসে। বলতে কি ভাবাটাই হচ্ছে তার সবচেয়ে প্রিয় নেশা। একটা সিনেমা দেখল, কি একটা বই পড়ল, অমনি সিনেমা বা বইয়ের গল্পের সুতো ধরে কত কী চিন্তা তার মাথায় মায়াজাল ছড়িয়ে দেয়। আর সেসব চিন্তার মধ্যে প্রধান হয়ে দাঁড়ায় একটা চিন্তা—আমার যদি অনেক টাকা থাকত!
অফিস থেকে ফিরে এসে প্রায় সময়েই সে একটু রাতের দিকে এই আধখানা ঘরটায় এসে বসে সিগারেট খায় আর ভাবে। ছুটির দুপুরে এখানেই এসে মেঝেয় পড়ে ঘুমোয়।
গ্রীষ্মকাল পড়ে গেছে। রবিবার। বেলা করে খেয়ে অনিকেত চুপচাপ চলে এল দেড়তলার ঘরখানায়। একাবোকা শুয়ে থাকল মেঝেয় শতরঞ্জি পেতে। একটা সিগারেট শেষ হয়েছে, আর একটা ধরাবে কি না ভাবতে-ভাবতে ঘুমের আমেজ চলে এল। ঘুম আসার এই সময়টা বড় ভালো লাগে অনিকেতের। বাস্তবের সঙ্গে স্বপ্ন কেমন গুলিয়ে যায়। এসব ব্যাপারগুলো আছে। বলেই মানুষের বেঁচে থাকাটা একরকম সওয়া যায়।
ঘুমঘোরে অনিকেত আবোল-তাবোল আধোচেতনায় অনেক হিজিবিজি দেখছিল। এ সময়ে একটা ঠুনঠুন শব্দে চটকা ভাঙল তার। পাশ ফিরে দেখল, একটা ধেড়ে ইঁদুর একটা বেশ বড়সড় প্রদীপের মতো কী একটা জিনিস টেনে এনেছে মেঝেয়। প্রদীপটা তাদের নয়, অনিকেত জানে। বোধহয়, বাড়িওয়ালার গুদামঘরটা থেকেই এনেছে। “যাঃ, যাঃ” বলে তাড়া দিতেই ইঁদুরটা প্রদীপ ফেলে পালিয়ে গেল।
অনিকেতের কাছ থেকে খুব দূরেও নয় প্রদীপটা। সে হাত বাড়িয়েই নাগাল পেল। হাতে তুলে নিয়ে দেখল, বেশ ভারী। ‘সলিড মেটাল! সোনা-টোনা নয়তো!’ বলে হাতলওয়ালা মস্ত প্রদীপটা একটু নাড়াচড়া করল সে। প্রদীপটার গায়ে ময়লা পড়েছে বহুদিনের। এটা যে দীর্ঘকালের ব্যবহার হয়নি তা দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু জিনিসটা সুন্দর। এখনও বেচে দিলে পাঁচ-দশ টাকা পাওয়া যাবে। অবশ্য বেচবার কথা এমনিই ভাবল সে। বেচবার প্রশ্নও ওঠে না। অন্যের জিনিস। কিছুক্ষণ প্রদীপটা হাতে নিয়ে শুয়ে রইল সে। হঠাৎ মাথায় ভাবনা এল—আচ্ছা, এটা যদি সেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হত। যদি এটাতে হাতে ঘষলেই এখন একটা দৈত্য এসে দাঁড়ায় আর বলে—কি চাও বলো, এক্ষুনি এনে দিচ্ছি!
ভাবনা-চিন্তারও একটা শক্তি আছে। অনিকেত উঠে বসল। যদি সত্যিই এরকম কিছু হয়। যদিও বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে এসব বিশ্বাস কোনও কাজের নয়, তবু যদি হত! অ্যাঁ! যদি হত?
প্রদীপটা হাতে নিয়ে আঙুলে একটা ঘষা দেয় সে। একা ঘরেও তার হাসি পাচ্ছিল, আর বোকা-বোকা লাগছিল নিজেকে। জানে তো এসব সত্য নয়। এরকম হয় না তবু সে কয়েকবার প্রদীপটার ভিতর দিকে ডান হাতের বুড়ো আঙুল জোরে বারকয়েক ঘষা দিল।
না, কিছুই ঘটল না। কিন্তু হঠাৎ ভেজানো দরজাটার কড়া খুটখুট করে আস্তে নড়ে উঠল। ঝুমুর এল নাকি চা নিয়ে? চট করে হাতের ঘড়িটা দেখে নিল অনিকেত। না, ঝুমুর এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে না। মোটে দুটো পঁচিশ।
–কে?
উত্তর নেই।
অনিকেত প্রদীপটা রেখে গিয়ে দরজা খুলে অবাক। খুব লম্বাচওড়া আর খুব দামি পোশাকপরা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত ছ’ফুট তিন-চার ইঞ্চি লম্বা তো হবেই। বিশাল কাঁধ, প্রকাণ্ড বুক, ইয়া চওড়া হাতের কবজি। বিদেশি সিনথেটিক কাপড়ের সাদা স্যুটপরা গলায় টাই, মৃদু একটা ইনটিমেট সেন্টের গন্ধ ছড়াচ্ছে লোকটার গা থেকে। বোধহয় বকসিং বা কুস্তি করে। কিন্তু খুব ফরসা আর সুপুরুষ, মুখে মৃদু বিনীত একটু হাসি।
অনিকেতকে দেখেই দু-হাত জড়ো করে বলল—আমাকে চিনবেন না। আমি প্রদীপের দৈত্য।
অনিকেত বলল—প্রদীপ দত্ত? প্রদীপ দত্ত! আপনার সঙ্গে কোথাও কী পরিচয়—?
লোকটা মাথা নেড়ে বলল—প্রদীপ দত্ত নয়। প্রদীপের দৈত্য! আপনি এক্ষুনি ওই প্রদীপটা ঘষেছিলেন, তাই না?
স্তম্ভিত অনিকেত মাথা নাড়ল—আজ্ঞে হ্যাঁ।
লোকটা বলল—তাই আসতে হল। বলুন, এখন আপনার জন্য কী করতে পারি?
যদিও অনিকেত বিশ্বাস করতে পারছিল না, লোকটাকে, তবু বলল—ভিতরে আসুন।
প্রকাণ্ড এবং সুপুরুষ লোকটা মাথা নীচু করে ঘরে এল। চারিদিকে চেয়ে বলল—ঘরটা— ভীষণ ছোটো আর স্টাফি, এই ঘরে থাকেন কী করে?
—অভ্যেস। তা ছাড়া পাচ্ছিই বা কোথায়?
লোকটা অনিকেতের সোফা সেটে পা ছড়িয়ে বসল, কিন্তু মুখে সেই অতিবিনীত হাসি আর হাবভাবে নম্রতা ছড়িয়ে আছে।
অনিকেত মুখোমুখি বসল, তার সস্তা সিগারেটের প্যাকেটটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল—আমরা গল্পে পড়েছি, আশ্চর্য প্রদীপ ঘষলে তার ভিতর থেকে ধোঁয়ার মতো বিশাল চেহারার দৈত্য বেরিয়ে আসত। এই বড়-বড় দাঁত, তালগাছের মতো উঁচু চেহারা!
লোকটা সিগারেট দেখে হাতজোড় করে বলল—ওটা পারব না মিস্টার বোস। এখন থেকে আপনি আমার বস। বসের সামনে ধূমপান করাটা বেয়াদবি।
অনিকেত খুশিই হল। প্যাকেটে গোনাগুনতি ছ’টা সিগারেট আছে, আজ আর কিনবার কথা নয়। একটা ফালতু খরচ হয়ে গেলে অসুবিধে হত। সকালে চায়ের পরের সিগারেটটায় টান পড়ত।
লোকটা বলল, হ্যাঁ, যে কথা জিগ্যেস করছিলেন। চেহারার কথা তো! সেই ধোঁয়ার মতো বড় নিয়ে দেখা দিলে, আপনিও খুশি হতেন না, পাঁচজনে চেঁচামেচিও করত। তা ছাড়া ইভোলিউশন বা বিবর্তন বলেও তো একটা কথা আছে। তাই যে-যুগের যেমন দরকার, তেমনি হয়েই আমাকে আসতে হয়। ক্লায়েন্টরা ঘাবড়ে গেলে বা হার্টফেল করলে ফায়দা কী? বলে লোকটা হাঁ করে দাঁতগুলো দেখিয়ে বললেন—এই দুপাশে দুটো মস্ত দাঁত ছিল, সব ছোট করে ফেলেছি স্ক্রেপ করিয়ে। এ যুগে ওসব প্রি-হিস্টোরিক দাঁত কি চলে?
অনিকেতের নিজের এখন সিগারেট খাওয়ার কথা নয়। একটু আগেই খেয়েছে। হিসেব করে না চললে!
লোকটা হেসে বলল—তাই আপনি প্রদীপ ঘষামাত্র আমি প্রদীপ থেকে বেরিয়ে আসিনি, বরং আপনাকে ঘাবড়ে যেতে না দিয়ে খুব ভদ্রভাবে দরজায় নক করেছি।
অনিকেতের বুকটা কাঁপছিল। উত্তেজনায় সিগারেটটা ধরিয়েই বুঝল বেহিসেবি খরচ হয়ে যাচ্ছে। আবার তৎক্ষণাৎ মনে হল—এ লোকটা যদি প্রদীপের দৈত্যই হয়ে থাকে তবে এর কাছে অনায়াসেই তো এক প্যাকেট সিগারেট চাওয়া যায়! একটু ভেবে অনিকেত খুব লাজুক স্বরে বলল —এক প্যাকেট সিগারেট যে এখন কাকে দিয়ে আনাই।
—জাস্ট এ মিনিট। লোকটা টপ করে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে এক প্যাকেট পাঁচশো পঞ্চান্নর কিং সাইজ কুড়িটার প্যাকেট আর-একটা খুদে গ্যাসলাইটার বের করে সেন্টার টেবিলে রেখে বলল—আমি এটা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। ইউ মে নিড এ লট অব সিগারেটস। বলুন, এখন আর কী করতে পারি!
খুবই অবিশ্বাসভরে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা দেখল অনিকেত। তার বুক কাঁপছে, অসম্ভব নার্ভাস লাগছে, ভয় করছে। তবু লোকটার বিনয় আর ভদ্রতা দেখে তার একটু সাহসও হচ্ছিল আস্তে-আস্তে। সে বলল—আমি যা চাই সব দিতে পারবেন?
লোকটা অল্প মাথা নেড়ে বলল—নিশ্চয়ই। যে-কোনও বস্তুগত জিনিসই আমি আপনাকে দিতে পারি। কিন্তু যদি আপনার মন খারাপ লাগে কখনও, বা যদি গানের গলা না থাকা সত্বেও কখনও আপনার সঠিক সুরে গান গাইতে ইচ্ছে করে তাহলে সেসব ক্ষেত্রে আমার কিছু করার
নেই। কিন্তু মন ভালো রাখার জন্য আমি আপনাকে সিনেমার টিকিট, সুন্দরী মেয়ে বা ভালো মদ সাপ্লাই দিতে পারি, গানের জন্য তানপুরা, হারমোনিয়ান বা ভালো ওস্তাদ এনে দিতে পারি।
—যদি অসুখ হয়?
—তার জন্য ডাক্তার বা ওষুধ এনে দেওয়ার ভার আমার, কিন্তু অসুখ সারানোর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। বস্তুগত সব জিনিসই আপনি আমার কাছ থেকে পাবেন, বাট নাথিং অ্যাবস্ট্রাক্ট অর ম্যাজিকাল।
অনিকেত মাথা নেড়ে বলে–বুঝেছি।
লোকটা মিষ্টি হেসে বলল—এ যুগের সঙ্গে আমার ক্ষমতাকেও সীমাবদ্ধ রাখতে হয়েছে।
অনিকেত শ্বাস ফেলে বলল—তাতেই হবে।
লোকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল—ধন্যবাদ। এবার বলুন—
অনিকেতের চাইতে লজ্জা করছিল। একটা লোক তাকে মাগনা মাগনা জিনিসপত্র দেবে ভাবতে কেমন লাগে। তাই সে সরাসরি কিছু চাইতে পারল না। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল— আমার নাম অনিকেত! এ নামের মানে আপনি কি জানেন?
লোকটা হেসে বলল—আলবত! অনিকেত মানে যার নিকেত বা নিকেতন অর্থাৎ বাড়ি নেই। মানে গৃহহীন।
অনিকেত মৃদু লাজুক হেসে বলে—আমি সার্থকনামা। আমার বাড়ি নেই।
—ইট উইল বি অ্যারেঞ্জেড। বলে লোকটা মাথা নেড়ে পকেট থেকে একটা চমৎকার নোটবই আর ডটপেন বের করে বলল—বলুন, কীরকম বাড়ি আপনার দরকার? রিকোয়ারমেন্টগুলো একটু ডিটেলে বলবেন।
অনিকেত ভীষণ সংকোচের সঙ্গে বলে—ছোটখাটো একটা বাড়ি হলেই হবে। যেমন হোক।
—সঙ্কোচ করবেন না মিষ্টার বোস। আমি আপনার যে-কোনও হুকুম তামিল করতে বাধ্য। ডোন্ট বি শাই।
অনিকেত একটু ভেবে বলল—দোতলা। পাঁচ-ছ’খানা ঘর। ভালো বাথরুম-টাথরুম! দক্ষিণে বারান্দা। যদি একটু বাগান—?বলে থামল।
-হুঁ-হুঁ বলুন। ঘরগুলো কত বাই কত?
—মাঝারি। খুব বড় বা ছোট নয়।
–বুঝেছি। ফার্নিচারের কথা কিছু বলবেন?
—ফার্নিচার? হ্যাঁ, ফার্নিচার। ধরুন, ডানলোপিলোর সব চেয়ার, সোফা, বার্মা টিক-এর খাট। মানে, সব মর্ডান জিনিস আর কি! আপনি যেমন ভালো বুঝবেন তেমন! আর আমার স্ত্রী একটা ফ্রিজের কথা প্রায়ই বলেন, আর গ্যাস উনুন।
লোকটা নোটবই বন্ধ করে বলল, বাড়িটা কোন এরিয়ায় হলে আপনার পছন্দ?
—ধরুন, নিউ আলিপুর! না, না, সেখানে বড় নির্জন জায়গা, চাকরেরা দুপুরে বাড়ির গিন্নিকে খুন করে পালানোর কেস কাগজে পড়েছি। তার চেয়ে যোধপুর পার্ক ভালো।
লোকটা মাথা নাড়ল, বলল—ইট উইল বি অ্যারেঞ্জড। ভাববেন না। কাল বেলা এগারোটায় আমি আপনার অফিসে ফোন করব। ততক্ষণে একটা কিছু ব্যবস্থা হবে। আমি আসি তাহলে। বলে লোকটা উঠল।
অনিকেত তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে বলল—আচ্ছা, আমি আপনাকে কী বলে ডাকব বলুন তো?
লোকটা একটুও না ভেবে হেসে বলল—ইজি। আপনি যে নামে আমাকে প্রথম ডেকেছিলেন সেই নামে ডাকবেন। প্রদীপ দত্ত।
লোকটা চলে গেল। হঠাৎ অনিকেতের মনে হল কী বোকা আমি! টেলিভিশনের কথাটা বলে দিলাম না! ভেবে পরমুহূর্তেই সে হাসল। ভাবল, দূর! লোকটাকে তো আবার এক্ষুনি ডাকতে পারি। কিন্তু এক্ষুনি আবার ডাকতে লজ্জা করল বলে ডাকল না। কাল তো দেখা হবেই।
প্রদীপটা খুব সাবধানে কাগজে মুড়ে ঘরের বুক-শেলফে একটা ডিকসনারিকে সরিয়ে খুঁজে রাখল। তার কেবলই মনে হচ্ছিল, এটা স্বপ্ন। কিন্তু পাঁচশো পঞ্চান্ন নম্বরের প্যাকেট আর লাইটার। এখনও পড়ে আছে টেবিলে। সে খুব মেজাজে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর ভাবল—এরকম। হা-ভাতের মতো আমি এতকাল বেঁচে ছিলাম কী করে?
না আচাঁলে বিশ্বাস নেই। সে ঝুমুরকে কিছু বলল না। কাঁপা বুক আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। খেতে পারল না, ঘুমও হল না ভালো করে। আজ তার বারবার মনে হচ্ছিল, ঝুমুর দেখতে নিতান্তই সাদামাটা। এত সাধারণ মেয়ে নিয়ে ঘর করায় কোনও মজা নেই।
পরদিন ঠিক বেলা এগারোটায় ফোন এল। প্রদীপ দত্ত বলল—মিস্টার বোস একটা ট্যাক্সি নিয়ে এক্ষুনি চলে আসুন। আমি আপনার জন্য গড়িয়াহাটের পুব দিকের ফুটপাথে বাসস্টপে অপেক্ষা করছি। অফিস থেকে হাফ ছুটি নিন, আর ট্যাক্সি ফেয়ার আমিই দেব।
তাই হল। যথাস্থানে প্রদীপ দত্ত অপেক্ষা করছিল, ট্যাক্সিতে অনিকেতের পাশে মৃদুতে উঠে বসে অতি সুগন্ধী রুমালে ঘাড় মুখ মুছতে বলল—খুব ভালো বাড়ি পেয়েছি, আপনার যদি পছন্দ হয় তো এ সপ্তাহেই নেগোশিয়েশন হয়ে যাবে।
অনিকেত ভ্রূ তুলে বলল–বাড়িটা কি রাতারাতি তৈরি করলেন?
প্রদীপ দত্ত হেসে ফেলে বলল—আরে না, না। মিস্টার বোস, আগের দিনে যেমন হত তেমন কি আজকালও হবে? ফাঁকা জায়গারও তো ওনার আছে। তা ছাড়া রাতারাতি বাড়ি উঠলে সবাই এসে চেপে ধরবে আপনাকে। কর্পোরেশন, ট্যাক্স, সি ই এস সি, কে নয়? এখন যা হবে সব গ্রু প্রপার নেগোশিয়েশন। আপনাকে আমি তো বিপদে ফেলতে পারি না।
ট্যাক্সি যেখানে এসে থামল সেটা যোধপুর পার্কের চমৎকার একটা চওড়া রাস্তা। বাড়ি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সামনে অনেকখানি লন, ফুলের বেড়। অকল্পনীয় সুন্দর নকশার টালি বসানো মেঝে। নীচের তলায় ছ’খানা ঘর, দোতলায় চারখানা। তিনতলায় দুই ঘরের
স্টাডি, রুফ গার্ডেন।
প্রদীপ দত্ত বলল—সদ্য তৈরি হয়েছে বাড়িটা। এখনও কেউ থাকেনি। বাড়ির মালিক শেয়ার মার্কেটে জোর মার খেয়ে বাড়ি বিক্রি করতে চাইছে।
একটু লজ্জার সঙ্গে অনিকেত বলে কত?
—ছ’লাখ। ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। দ্যাটস মাই হেডেক।
তবু সঙ্কোচ বোধ করে অনিকেত। টি ভি সেটটার কথা বলতে লজ্জা করে।
কিন্তু প্রদীপ দত্ত যেন তার মনের কথা টের পেয়েই বলল—টি ভি সেট বা মোটরগাড়ির কথা আপনার রিকোয়ারমেন্টসে ছিল না, কিন্তু সেসব অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে। এখন আপনার একটা প্রেজেন্টেবল সোর্স অব ইনকাম আর ট্যাক্স রিটার্নগুলো দেখাতে হবে। সে সমস্ত নিয়ে অবশ্য আপনাকে ভাবতে হবে না। লিভ এভরিথিং অন মি। আপনি বরং মিসেসকে নিয়ে এসে বাড়িটা দেখিয়ে দিন।
ঝুমুর! ঝুমুরের কথা অনিকেত ভুলেই গিয়েছিল। এখন অবশ্য ঝুমুরের কথা ভাবতেও তার ভালো লাগছিল না। ইদানীং ঝুমুর বড় মোটা হয়ে গেছে। ভীষণ রাগীও। তা ছাড়া ঝুমুরের মধ্যে রহস্যও নেই আর।
অনিচ্ছার সঙ্গে অনিকেত বলল—আচ্ছা।
প্রদীপ দত্ত তার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাসল, বলল—আর যদি আপনি ইন্টারেস্টেড হন তবে ডিভোর্সের মামলা লড়ার জন্য ভালো উকিলের অ্যারেঞ্জমেন্ট করা যেতে পারে। হাই অ্যালিমনি দিলে মিসেসও খুব ঝামেলা করবেন না। যদি রাজি থাকেন তো সেসব আমিই নেগোশিয়েট করতে পারি।
একটু লাল হল অনিকেত। বুকটা নানা আশা-আকাঙ্ক্ষায় গুরগুর করে পাখির ডাক ডাকছে। মাথা নীচু করে সে বলল—তা নয়। ঝুমুরও থাক। ছেলেটাকে ছেড়ে থাকতে পারি না। তবে অন্য মেয়ে–
প্রদীপ দত্ত হঠাৎ গলা নীচু করে বলল—কীরকম মেয়েছেলে চান?
অনিকেত রুমালে মুখ ঢেকে, লাল হয়ে অনেক কষ্টে তার গোপন ইচ্ছের কথা অস্ফুটে বলল —টিনএজার। সুন্দর লাইভলি।
—ওকে।
সাতদিনের মধ্যেই জীবন পালটে গেল অনিকেতের।
ঝুমুর বাড়ি দেখে এত অবাক যে ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। টুইন গ্যারাজে দু দুটো দামি গাড়ি, ঘরে-ঘরে ভাবা যায় না এমন সব জিনিস চাকর, ঝি, মালি, সফারে বাড়ি গিজগিজ। পাঁচ-সাতটা ঘর এয়ারকন্ডিশন করা। এসব কি আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের কাণ্ড নাকি?
কয়েকবারই জিগ্যেস করেছে অনিকেতকে—এসব কী গো?কী করে হল?
–হয়েছে প্রপার নেগোশিয়েশনস। অনিকেত বলে—সব ট্যাক্স পেইড। চিন্তার কিছু নেই। এর বেশি কিছু বলে না অনিকেত।
একদিন প্রদীপ দত্ত ফোন করল—মিস্টার বোস, একটু দেরি হয়ে গেল কিছু মনে করবেন। আপনার রিকোয়ারমেন্টস অনুযায়ী একটি টিনএজার গার্ল পাওয়া গেছে। না, না, চিন্তার কিছু নেই, এসব ব্যাপারের জন্য ক্যামাক স্ট্রিটে একটা ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট আপনার নামে কেনা হয়েছে। আজ সন্ধেবেলা চলে আসুন। দিস অ্যাপার্টমেন্ট উইল বি ইওর প্লেজার স্পট। আপনার সফার ঠিকানা জানে।
শুনে অবধি অসম্ভব নার্ভাস লাগছিল অনিকেতের। হৃৎপিণ্ড এত জোরে ধাক্কা দিচ্ছে পাঁজরে যে সেই শব্দ নিজের কানে শুনতে পাচ্ছিল সে!
তবু গেল। তীব্র উত্তেজনা। এতদিনে সে জীবনকে উপভোগ করতে পারছে। এই তো জীবন।
সফার এক আটতলা বাড়ির সামনে নিয়ে এল অনিকেতকে। লিফটে সাততলায় উঠে কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে বিনীত হাসিমুখে প্রদীপ দত্ত বলল—এভরিথিং সেট। আসুন স্যার।
অ্যাপার্টমেন্টটা তার নিজের বাড়ির তুলনায় তেমন কিছু নয়। তবু এটাও চূড়ান্ত শৌখিন জায়গা। ঘরজোড়া কার্পেট, সোফা সেট, দুর্দান্ত সব আসবাব। ফ্রিজ, টি ভি সবই আছে। আর আছে ছোট্ট একটা বার, তাতে অন্তত পঞ্চাশ-ষাট রকমের বিলিতি মদ।
অসামান্য সুন্দরী মেয়েটি বসেছিল একদম ভিতরের দিকে একটা ঘরে। দরজার গা-তালায় চাবি ঢুকিয়ে প্রদীপ দত্ত দরজা খুলতে-খুলতে বলল—মেয়েটা অ্যাগ্রেসিভ, ওয়াচ ইয়োর স্টেপস।
শুনে একটু চমকে যায় অনিকেত। ঘরে ঢুকে সে আর একবার চমকায়। ঘরে একটা ডিভান, একটা ড্রেসিং টেবিল, দুটো ছোট টুল আর-একটা হোয়াট নট ছাড়া বেশি কিছু নেই। এক গোছা রজনীগন্ধা ভাঙা ফুলদানি সহ মেঝেয় ছিটিয়ে পড়ে আছে, জলে ভিজে শপশপ করছে কার্পেটমোড়া মেঝে। ড্রেসিং টেবিলের আয়না চুরমার, টুলগুলোয় পায়া ভাঙা; ডিভানে কালো পাতলা একটা হাউস কোট পরে মেয়েটি বসে আছে। এত সুন্দর মেয়ে অনিকেত জীবনে দেখেনি। যেমন ক্ষীণকটি, তেমনি উন্নত বুক। মুখ কে যেন ছেনি দিয়ে লক্ষ বছর ধরে কেটে তৈরি করেছে। গায়ের রং গোলাপি আলোয় ভরে দিয়েছে ঘর। তার চুল এলোমেলো, দুটো চোখ বাঘিনীর মতো জ্বলছে। অনিকেতের দিকে একবার রক্তজল করা চোখে তাকাল।
তারপর উঠে চকিত পায়ে দৌড়ে এল দরজার দিকে। অনিকেত যেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক সেই দিকে। অনিকেত কিছু বুঝবারও সময় পেল না, মেয়েটা প্রচণ্ড নখে হঠাৎ চিরে ফেলতে লাগল তার মুখ। অনিকেত চিৎকার করে উঠল—প্রদীপ দত্ত! প্রদীপ দত্ত!
বন্ধ দরজা খুলে প্রদীপ দত্ত শান্ত পায়ে ঘরে আসে। একটা হাতে মেয়েটাকে তুলে নেয়। অনায়াসে। ডিভানে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অনিকেতকে বলে—আমি ঠিক রিকোয়ারমেন্টস মতো বাছাই করে মেয়েটিকে তুলে এনেছি। কিন্তু আপনার প্রতি ওকে অ্যাট্রাকটেড করে তোলার কোনও উপায় আমার নেই। দ্যাট ইজ ইওর বিজনেস মিস্টার বোস। ট্রাই এগেন।
বলে চলে যায় প্রদীপ দত্ত।
অনিকেতের গাল ছিঁড়ে রক্ত পড়ছে, আগুনের মতো জ্বালা করছে মুখ। মেয়েটা উপুড় হয়ে ডিভানে পড়ে কাঁদছে।
অনিকেতের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। হঠাৎ চিতাবাঘের মতো গিয়ে লাফিয়ে পড়ল ডিভানে।
প্রায় আধঘণ্টা গেল ধস্তাধস্তিতে। অনিকেত মেয়েটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারে না। মেয়েটার দু-খানা লম্বা হাত, হাতে নখ, দু-খানা পায়ে হরিণের গতি, অসম্ভব দম—এসবই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বারদুই ধরতে পেরেছিল সে মেয়েটিকে, কিন্তু কিছু করার আগেই ছিটকে বেরিয়ে গেল মেয়েটি। অনিকেত তীব্র পিপাসায় ছটফট করে। এমন তীব্র নারীদেহের তৃষ্ণা সে আগে কখনও টের পায়নি। কিন্তু তার বয়স প্রায় চল্লিশ, শরীর আগের মতো সতেজ নেই, দম কমে এসেছে। সে তাই হাঁফায় জিভ বের করা কুকুরের মতো।
তারপর প্রদীপ দত্ত আসে।
—সরি মিস্টার বোস।
অনিকেত মুখ তুলে তাকায়। তার একটু লজ্জা করে। সে একটু মাথা নেড়ে জানাল, সে পারেনি।
প্রদীপ দত্ত একবার ‘হু’ বলে একটু ভাবে। তারপর হঠাৎ কোথা থেকে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে ওষুধ জাতীয় কিছু নিয়ে আসে। মেয়েটিকে সে অনায়াসে ধরে ফেলে এক হাতে, তারপর ঝাঁকুনি দিয়ে ডিভানে শুইয়ে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে তার পিঠ, তারপর ইঞ্জেকশনের নির্দয় ছুঁচে তার হাতে ওষুধ ঢুকিয়ে দিয়ে অনিকেতকে বলে—এবার যা খুশি করুন।
মেয়েটি আর বাধা দেয় না, নিস্ক্রিয় পুতুলের মতো শুয়ে থাকে এক ঘোর আচ্ছন্নতায়। অনিকেত তার এতকালের অতৃপ্ত কামনা-বাসনা নিয়ে মেয়েটিকে গ্রহণ করার সময়ে টের পায়, মেয়েটি সম্পূর্ণ কুমারী ছিল।
অনিকেত নির্জীব হয়ে যখন উঠে এল তখন প্রদীপ দত্ত ঘরে আসে। একটু হেসে বলে— ওকে?
অনিকেত অনেক রাত পর্যন্ত মদ খেল বসে। বারংবার মেয়েটির শরীর আক্রমণ করল গিয়ে। কোনওবারই তৃপ্ত হল না। আরও আগুন জ্বলে ওঠে শরীরে। ভোর রাতে সে প্রদীপ দত্তকে ডেকে বলল—আরও মেয়ে। প্রতিদিন নতুন।
প্রদীপ দত্ত মাথা ঝাঁকিয়ে বলে—ব্যবস্থা হবে মিস্টার বোস।
অনেক কাল থেকে চেপে রাখা বহু ইচ্ছে অনিকেতের চিন্তায় নানা রঙের বর্ণালি সৃষ্টি করত। প্রতিদিন চাকরিতে যাওয়ার সময়ে মনে হত হায় রে, যদি ছুটি পেতাম অনন্ত! বড়লোকদের পাড়ায় চমৎকার সব বাড়ি দেখলে মনে হত—এরকম বাড়ি যদি আমার হত! সুন্দরী মেয়ে দেখলে ভাবত—এ যদি হত আমার প্রেমিকা! এরকম ইচ্ছে আর ইচ্ছে।
প্রায় সব ইচ্ছাই পূর্ণ হল অনিকেতের। ছুটি, বাড়ি, আর সুন্দরী মেয়েরা। অবশ্য মেয়েরা যে সবাই তার প্রেমিকা হয়েছে তা নয়। কিন্তু ক্রমে-ক্রমে বশীভূত হয়েছে। কলকাতায় অন্তত দশ বারোখানা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা হয়েছে অনিকেতের নামে। সেরা সুন্দরীরা সেখানে থাকে। যোধপুর পার্কের বাড়িতে বড় একটা যাওয়া হয় না অনিকেতের। এইসব অ্যাপার্টমেন্টেই তার। দিন কাটে। প্রদীপ দত্ত ছায়ার মতো তার সঙ্গে আছে, কোনও গোলমাল হলেই এসে হাজির হয়।
অনিকেত এখন কয়েকটা মস্ত মস্ত প্ল্যান্টের মালিক, বিরাট ব্যাবসা তার। অবশ্য সেসব তাকে দেখতে হয় না, প্রদীপ দত্তই সব দেখাশোনা করে। এখন সে দেশের একজন অগ্রগণ্য লোক। অনেকগুলো সংস্থার সভাপতি, চেয়ারম্যান। বিপুল প্রতিপত্তি তার। খবরের কাগজে তার নাম। ওঠে। অনিকেত কয়েকবারই ঘুরে এল লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, টোকিও। গেল হাওয়াই দ্বীপে ফুর্তি করতে, মোনাকোতে গিয়ে জুয়া খেলল, প্যারিসে মহিলা প্রেমে রইল ডুবে। জীবনটা কানায়-কানায় ভরে উঠেছে, তার কোনও অভাব নেই। কেবল মনে হয়, তাকে যদি ঈশ্বর আরও একটু কামের ক্ষমতা দিতেন, আরও ক্ষুধা-তৃষ্ণা দিতেন তাহলে বড় ভালো হত। পৃথিবী ভরতি সুন্দরী মেয়ে, কত মহার্ঘ সুস্বাদু খাবার, কত চমৎকার পানীয়। কিন্তু একটিমাত্র শরীরে কত ভোগ করা যাবে?
খুব ভোরবেলায় অনিকেতকে উঠতে হয়। খাটো প্যান্ট আর গেঞ্জি, শীতকাল হলে পুলওভার পরে গাড়ি করে ময়দানে যায়। ময়দানে অনেকক্ষণ দৌড়োয় সে। ঠিক দৌড় নয়, প্রদীপ দত্ত বলে, জগিং। দৌড়তে হয় আস্তে-আস্তে, অনেকক্ষণ ধরে। সঙ্গে সবসময়ে প্রদীপ দত্ত থাকে। দৌড়ে ফিরে এলে ব্যায়াম শিক্ষক আসে, তারপর যোগব্যায়ামের শিক্ষক। ব্রেকফাস্ট। প্রদীপ দত্ত এই সময়ে অনেক কাগজপত্রে সই করায়। দশটা বাজতে-না-বাজতেই লোকজন আসে, কনফারেন্স থাকে, আসে খোশামুদরা। প্ল্যান্টে যেতে হয় মাঝে-মাঝে। টেলিফোনে কথা বলতে হয়। বিকেলে ক্লাব রেস্টুরেন্ট কখনও বা মিটিং থাকে। সন্ধের পর থাকে মেয়েরা, ড্রিংকস, কখনও বা বন্ধুবান্ধব জাতীয় কিছু লোকের সঙ্গে থাকে পার্টি। অবশ্য এসব ফেলে রেখে অনিকেত যে-কোনও সময়ে দেশভ্রমণেও বেরিয়ে পড়তে পারে। ভারতের সব বড় শহর, স্বাস্থ্যনিবাস বা সুন্দর জায়গায় তার বাড়ি আছে। বাড়ি আছে লন্ডন, নিউইয়র্ক বা টোকিওতেও। কোথাও কোনও অভাব রাখেনি প্রদীপের দৈত্য ওরফে প্রদীপ দত্ত। নিরাপদ এবং নিশ্চিন্ত তার আরাম। যেদিন তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না বা কাজ করতে ইচ্ছে করে না সেদিন প্রদীপ দত্তই সব সামলায়, কোথাও আটকায় না।
মাসে চারবার তার শরীরের চেক আপ হয়। ডাক্তাররা রক্তচাপ মাপে, চোখ-দাঁত দেখে, কান নাক পরীক্ষা করে, রক্তে চিনির পরিমাণ মাপে, ই সি জি হয়, এক্স-রে হয়। কোথাও একটু খুঁত পেলেই সঙ্গে-সঙ্গে মেরামত করা হচ্ছে, অনিকেতের জীবন বড় নিশ্চিন্ত।
খুব ভোরে অনিকেত দৌড়াচ্ছে মাঠে। শীতকাল। একটা ভারী কুয়াশা চারদিকে ভূতুড়ে করে রেখেছে। সূর্য উঠতে অনেক দেরি। চারদিক আবছায়ার ঘোর। গায়ে যথেষ্ট মোটা একটা পুলওভার, কান-মুখ মাফলারে ঢাকা, পায়ে দৌড়ের জুতো। বেশ লাগছিল অনিকেতের। একটু হাঁফ ধরে আসছিল বটে, কিন্তু সে গতরাতের হ্যাংওভারও হতে পারে।
.
প্রদীপ দত্ত দৌড় বজায় রেখেই বলল—একচল্লিশ বছর তিন মাস তেরো দিন। আজকের দিনটা নিয়ে।
অনিকেত একটু থমকে গিয়ে বলে—চল্লিশ হয়ে গেল এর মধ্যে! কত বললে? একচল্লিশ? এই তো সেদিন আটত্রিশ ছিলাম।
প্রদীপ দত্ত হেসে বলে–ইয়েস স্যার, ম্যাট্রিক সার্টিফিকেটে এখনও আপনার চল্লিশ হয়নি। কিন্তু আসল বয়স—
দৌড় থামিয়ে অনিকেত কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলে—একচল্লিশ ইজ টু মাচ।
—কিছু করার নেই মিস্টার বোস। প্রদীপ দত্ত হতাশভাবে বলে।
আজকাল অনিকেতের মাঝে-মাঝে রাগ হয় প্রদীপ দত্তর ওপর। এখন ওকে সে ‘তুমি’ করে বলে, ধমকায়। ওর কাছে আজকাল কিছু চাইতে আর লজ্জা বোধ করে না অনিকেত। মাঝে মাঝে এমনও ভাবে সে—লোকটা কোনও কাজের নয়। সব দিচ্ছে তবু কোথায় ফাঁকি রাখছে। যেন!
অনিকেত বলল—প্রদীপ দত্ত, তোমার বয়স কত?
প্রশ্ন শুনে প্রদীপ দত্ত একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে—আমার বয়স? সে অনেক। আমি ভারচুয়ালি এজলেস।
—তবু বলো।
প্রদীপ দত্ত একটু হেসে বলে—আমি এই পৃথিবীর সমান বয়সি।
—মিথ্যে কথা প্রদীপ দত্ত।
—মাপ করবেন স্যার, আমার জন্ম কবে হয়েছিল আমার তা জানা নেই।
–তোমার কখনও অসুখ করে না? বুড়ো হওয়ার ভয় ধরে না তোমাকে?মৃত্যুচিন্তা হয় না?
প্রদীপ দত্ত বলল–না।
অনিকেত একটা শ্বাস ছাড়ে। তারপর শ্লথ গতিতে আবার দৌড়োয় সে। পিছনে নিঃশব্দ ছায়ার মতো প্রদীপ দত্ত। দৌড়োতে-দৌড়োতে অনিকেত হঠাৎ বলে—প্রদীপ দত্ত, আমি হাঁফিয়ে পড়ছি কেন? খুব বেশি দৌড়োইনি আজ, তবু কেন আমার হাঁফ ধরছে?
—একটু বিশ্রাম করুন, ঠিক হয়ে যাবে।
—তুমি হাঁফাওনি?
প্রদীপ দত্ত ম্লান একটু হেসে বলে—না। হাঁফিয়ে পড়লে আমার চলে না।
নিজের মার্সিডিস বেনজ গাড়িতে ময়দান থেকে ফিরবার সময়েও অনিকেত বারবার জিগ্যেস করল—আমি আজ হাঁফিয়ে পড়লাম কেন বলো তোর
প্রদীপ দত্ত গম্ভীর বিনয়ের সঙ্গে বলে কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।
–কল দি ডক্টরস।
ডাক্তাররা এল। আগাপাশতলা পরীক্ষা করল তাকে। না, কিছু হয়নি, হার্ট ঠিক আছে, প্রেসার স্বাভাবিক, রক্তে চিনি নেই, লাংস ভালো।
—তবে? প্রশ্ন করে অনিকেত।
প্রদীপ দত্ত তার কানে-কানে আস্তে করে বলে—বয়স! চল্লিশের পর একটু ডিজিনেস আসে। কিছু না। এ-বয়সের যে-কোনও লোকের চেয়ে আপনার হেলথ অনেক ভালো।
অবহেলার সঙ্গে একবার প্রদীপ দত্তকে দেখে নিয়ে অনিকেত বলে—দেখো, হেলথ যেন আর গড়বড় না করে।
–চেষ্টা করব স্যার। সব রকম ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা হবে।
অনিকেত একটু গম্ভীর হয়ে গেল। আজ কোনও কাজ করল না অনিকেত। কেবল ছাদের বাগানে ঘুরে-ঘুরে অজস্র বিরল ফুলের সৌন্দর্য দেখল। তারপর এক সময়ে উত্তেজিত হয়ে ডাকাল—প্রদীপ দত্ত! প্রদীপ দত্ত!
প্রদীপ দত্ত দৌড়ে উঠে আসে ছাদে।
অনিকেত একটা বসরাই গোলাপ গাছে শুকনো ফুল দেখিয়ে বলে—এটা কী? এটা এখানে কেন? জানোনা আমি মরা ফুল দেখতে পারি না!
—দুঃখিত মিস্টার বোস। এক্ষুনি তুলে ফেলে দিচ্ছি।
প্রদীপ দত্ত ফুলটা তুলতে যাচ্ছিল অনিকেত বাধা দিয়ে বলল—থাক, থাক। তুলো না।
কী কারণে যেন প্রদীপ দত্ত একটু হাসল।
অনিকেত ঘরে ফিরে আয়নায় নিজেকে দেখতে-দেখতে আপন মনে বলল—একচল্লিশ! একচল্লিশ!
আয়নায় ছায়া ফেলে প্রদীপ দত্ত কাছে এসে বলল—এমন কিছু নয় স্যার, চল্লিশে যৌবন শুরু।
অনিকেত একটু হেসে বলে—ইফ ফর্টি কামস, ক্যান ফিফটি বি ফার বিহাইন্ড?
কী কারণে যেন প্রদীপ দত্ত আবার একটু হাসল।
কে আমাকে ভালোবাসে? হঠাৎ এই প্রশ্ন মাঝরাতে চাবুকের মতো তার সমস্ত শরীরের চমকে দিল। ঘুম ভেঙে উঠে বসে অনিকেত। প্রশ্নটাকে অসম্ভব জরুরি বলে মনে হয়। যে মেয়েটি তার বিছানায় শুয়ে আছে সে-ই প্রথম দিন খিমচে দিয়েছিল তার গালে। এখন ভীষণ বাধ্য হয়ে গেছে।
অনিকেত ডাকল—মিলি, মিলি!
সঙ্গে-সঙ্গে উঠে বসল মিলি। গায়ের আবরণ সরাতে-সরাতে কটাক্ষ করে হাসল একটু।
অনিকেত মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকে। ও কি ভালোবাসে আমাকে?
অনিকেত বলল—মিলি, তুমি একটু গান গাইবে?
—নিশ্চয়ই। কী গান গাইতে হবে?
—যা খুশি। আনন্দের গান গাও, প্রেমের গান।
—মিলি গাইতে লাগল।
অনিকেত মাথা নেড়ে বলেনা, গান নয়। এসো, দুজনে নাচি।
দুজনে নাচল। নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
–হচ্ছে না। অনিকেত বলে।
–কী?
—কিছু নয়। মিলি, আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে থাকো, তোমার শ্বাসে আমার শ্বাস মিশে যাক, আমি তোমাকে কিছুক্ষণ অনুভব করি।
মিলি আশ্লেষে জড়িয়ে ধরল তাকে। নিঝুম হয়ে খানিকক্ষণ অনুভব করে অনিকেত। মিলিকে। সে যা করতে বলে তাই করে সে। নইলে প্রদীপ দত্ত আসবে, ভয়ঙ্কর শাস্তি দেবে মিলিকে। অনিকেত মিলির বুকের হৃৎস্পন্দন শুনল। জোরে চলছে হৃৎপিণ্ড। এর হৃৎপিণ্ড ভয়ের বাস, লোভের আস্তানা।
ঘোর রাতে গাড়ি বের করতে হুকুম দিলেন অনিকেত। প্রদীপ দত্তকে ডাকতে হয় না, সে আপনিই নিঃশব্দে সঙ্গ নেয়। বিভিন্ন পোষা মেয়েমানুষের কাছে ঘুরে বেড়ায় অনিকেত, নিজের বউ আর ছেলের কাছেও যায়। কিন্তু কোথাও যেন কোনও নিশ্চয়তা পায় না। সবাই বাধ্য, বিনীত, ভদ্র, হুকুমমাত্র যাকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারে অনিকেত। তবু কেমন এক অনিশ্চয়তা। এই গভীর রাতে সে সকলের কাছে গিয়ে-গিয়ে ঘুম ভাঙাল। কেউ বিরক্ত হল না, বরং তটস্থ হল, আপ্যায়ন করল, ভালোবাসা প্রকাশ করল। এমনকী ঝুমুরও।
—আশ্চর্য! অনিকেত গাড়িতে ফিরে আসবার সময়ে বলল।
একটু যেন লজ্জিত হয়ে প্রদীপ দত্ত বলে—আপনি যেমন চেয়েছিলেন ঠিক তেমনই সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করা আছে মিস্টার বোস। আপনি কোনও ত্রুটি পাচ্ছেন না তো?
—পাচ্ছি প্রদীপ দত্ত। আমি একটা মানুষকেও অর্জন করতে পারিনি।
—কেউ বেয়াদবি করেনি তো স্যার? প্রদীপ দত্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বলে।
—না। আর সেইটেই তো বেয়াদপি। এরা কেউ বেয়াদবি করছে না, রাগ করছে না আমার ওপর, অভিমান করছে না, অবাধ্য হচ্ছে না। যে আমাকে ভালোবাসবে সে তো কখনও-কখনও একটু অবাধ্য হবে, অভিমানটান করবে প্রদীপ দত্ত? তাই না?
প্রদীপ দত্ত গম্ভীর হয়ে বলে—ওসব অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিস মিস্টার বোস। আমার এক্তিয়ারের বাইরে।
তুমি কোনও কাজের নও। অনিকেত রেগে গিয়ে বলে।
প্রদীপ দত্ত একটু গুম হয়ে থেকে বলে ঠিক আছে স্যার, আপনি যেমন চাইছেন ওরা এবার থেকে ঠিক সেরকমই বিহেভ করবে। আপনার রিকোয়ারমেন্টগুলো বলুন, আমি টুকে রাখছি— বলে প্রদীপ দত্ত তার নোটবই বের করে গাড়ির ড্যাশ বোর্ডের আলোয় লিখতে-লিখতে আপন মনে বলে রাগ, অভিমান, মাঝে-মাঝে একটুআধটু নন-অ্যাগ্রেসিভ অবাধ্যতা—আর কি বলবেন স্যার?
অনিকেত হাত বাড়িয়ে নোটবইটা কেড়ে নিয়ে বলে—চুপ করো। আমি কিছু চাইছি না। আমি এখন একটু একা থাকতে চাই। আমার যদি কোনও ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্ট থাকে তো সেখানে আমাকে নিয়ে চলো।
—আছে স্যার। একটা দশতলা অ্যাপার্টমেন্ট হাউস আপনার অর্ডার মতো কেনা হয়েছিল, তাতে কোনও ভাড়াটে নেই। আপনার আদেশ মতো বাড়িটার চল্লিশটা ফার্নিশড ফ্ল্যাট ফাঁকা। পড়ে আছে।
দশতলার ফাঁকা কিন্তু চমক্কার সাজানো অ্যাপার্টমেন্ট স্বয়ংক্রিয় লিফটে উঠে এল অনিকেত। ক্লান্তভাবে একটা কৌচে বসে রইল নিঝুম হয়ে।
কেউ কোথাও নেই, শুধু কপাটের আড়ালে উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছে প্রদীপ দত্ত।
—প্রদীপ দত্ত! অনিকেত ডাকে।
—বলুন স্যার। নিঃশব্দে সুপুরুষ দৈত্য ঘরে এসে দাঁড়ায়।
—ভগবান বলে কে একজন আছে না? আমি তার সঙ্গে আধ ঘণ্টার ইন্টারভিউ চাই। অ্যারেঞ্জ করো।
প্রদীপ দৈত্য ভ্রূ কুঁচকে চিন্তা করে বলে—অ্যাবস্ট্রাকশন। আমার এরিয়া নয় মিস্টার বোস। তবে—এই বলে প্রদীপ দত্ত পকেট থেকে একটা ট্যাবলেটের স্ট্রিপ বের করে বলে—একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিন, নিজেকেই ভগবান বলে মনে হবে। সত্যি কথা বলতে কি আপনার ক্ষমতা ঈশ্বরের চেয়ে খুব কম নয়।
ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে চেয়ে থাকে অনিকেত, বলে—আর যখন এর নেশা কেটে যাবে, তখন?
—দেয়ার উইল বি মোর ট্যাবলেটস।
ট্যাবলেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে অনিকেত বলে—প্রদীপ দত্ত, তুমি অপদার্থ। তুমি আমার বয়স হওয়া ঠেকাতে পারোনি, তুমি এমন একটাও মানুষ বা মেয়েমানুষ জোগাড় করতে পারোনি যে আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসে, তুমি ভগবানের সঙ্গে মাত্র আধ ঘণ্টার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট অ্যারেঞ্জ করতে পারোনি। নিজের কান ধরে দাঁড়াও প্রদীপ দত্ত।
প্রদীপ দত্ত দু-হাতে নিজের কান ধরে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
অনিকেত বলল—মানুষের সব চাহিদাই কেন তুমি পূরণ করতে পারো না? তোমার জানা উচিত এত ভোগ্য সামগ্রী উপভোগ করতে হলে মানুষের অনেক আয়ু চাই, অনেক ভালোবাসা চাই, ফর সিকিউরিটি তার একজন ভগবানও দরকার। তুমি যে সব দিতে পারোনি। কান ধরে ওঠবোস কর প্রদীপ দত্ত।
প্রদীপ দত্ত ওঠবোস করতে লাগল। করতেই লাগল। হাঁফিয়ে গেল না, ঘামল না, কোনও কষ্টের শব্দ করল না। ওর অনন্ত ওঠবোস দেখতে-দেখতে ক্লান্ত হয়ে অনিকেত বলল—তোমার ক্লান্তি নেই? বিশ্রাম নেই?
–না।
—মৃত্যু?
—তাও নেই।
হাহা করে হাসল, অনিকেত, বলল—মিথ্যেবাদী। ঠিক আছে, ওই জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ো প্রদীপ দত্ত। আমি তোমার শেষ দেখতে চাই।
প্রদীপ দত্ত স্মার্ট পদক্ষেপে গিয়ে জানলার পাল্লা খুলে বিনা ভূমিকায় লাফ দিল নীচে। জানলার কাছে গিয়ে অনিকেত উঁকি মেরে দেখল ফুটপাথে পড়ে আছে প্রদীপ দত্ত।
হাহা করে হাসল অনিকেত। ঘরের মধ্যে ফিরে এসে হুইস্কি নিয়ে বসল। সামান্য নেশা হল তার। একটু ভুলভাল হচ্ছিল। সেই বিভ্রমেই হঠাৎ ডাকল—প্রদীপ দত্ত! তারপর নিজের মনেই বলল–না, না, ও তো মরে গেছে।
কিন্তু নিঃশব্দে, প্রদীপ দত্ত ঘরে এসে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল—ইয়েস মিস্টার বোস।
তুমি মরোনি? অনিকেত অবাক।
প্রদীপ দত্ত মৃদু হেসে বলে—আই অ্যাম আনপেরিশেবল স্যার। ডেথলেস।
ক্লান্ত অনিকেত বলল—আজ আমার বয়স কত হল বলো তো?
প্রদীপ দত্ত বলল—একচল্লিশ বছর চার মাস দুদিন। আজকের দিনটা নিয়ে।
চমকে উঠে অনিকেত বলে—এই তো সেদিন বললে তিন মাস তেরো দিন। এর মধ্যে আরও উনিশ দিন বেড়ে গেল?
—উনিশটা দিন এর মধ্যে কেটে গেছে মিস্টার বোস।
—তোমার কাটেনি? তোমার বাড়েনি উনিশ দিনের বয়স?
—না। আমি অনন্ত আয়ু। এজলেস।
—তবে আমার কেন বাড়বে প্রদীপ দত্ত?
—প্রকৃতির নিয়ম স্যার।
আচমকা হুইস্কির গ্লাসটা ছুড়ে মারে অনিকেত। প্রদীপ দত্তর মুখে গিয়ে সেটা ফটাস করে ভাঙে। কাচ ছড়িয়ে পড়ে চারধারে। একটুও কাটে না বা লাগে না ওর, রক্তপাত হয় না। প্রদীপ। দত্ত নীচু হয়ে কাচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিতে থাকে।
বিপজ্জনক নীচু স্বরে অনিকেত বলে—স্কাউন্ট্রেল! ইউ স্কাউন্ট্রেল! বলে তড়িতে উঠে গিয়ে টেবিল থেকে কাগজকাটা একটা ছুরি তুলে নেয়। তারপর চকিতে এগিয়ে গিয়ে বারংবার প্রদীপ দত্তর পিঠে, বুকে পেটে ছুরিটা বসিয়ে দিতে থাকে।
বিনীতভাবে প্রদীপ দত্ত অপেক্ষা করে। অনিকেত ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রদীপ দত্ত ছুরিটা নিয়ে টেবিলে রেখে দেয় ফের। নরম স্বরে বলে—একটু ঘুমিয়ে থাকুন। টেক এভরিথিং ইজি।
ক্লান্ত অনিকেত বলে—চলে যাও, প্রদীপ দত্ত, চিরদিনের মতো চলে যাও। আমি আর তোমাকে চাই না।
প্রদীপ দত্ত কেমন যেন একটু হাসে। অত্যন্ত ভদ্র গলায় বলে—গুড নাইট স্যার, টিল ইউ কল মি এগেন।
—আই ওনট কল ইউ বাস্টার্ড। গো অ্যাওয়ে। ডাই।
কিন্তু পরদিনই ঘুম ভেঙে অনিকেত ডাকে—প্রদীপ দত্ত! প্রদীপ দত্ত!
প্রদীপ দত্ত সামনে আসে। খুব যত্নে তাকে বিছানা থেকে তোলে। বাথরুমে পৌঁছে দেয়। বলে সব ঠিক আছে স্যার।
বাথরুমের শার্সি দিয়ে অনিকেত দেখতে পায় নীচে একটা রেইন ট্রি থেকে হলুদ পাতা ঝরে যাচ্ছে। দৃশ্যটা সহ্য হয় না তার। একটা নতুন টুথপেস্টের টিউব আয়নার সামনে থেকে তুলে নেয় অনিকেত। নতুন টিউব, পেস্টে ভরা। অনিকেত কিছু না ভেবেই টিউবটা টিপে ধরে। সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে পেস্ট বেরোতে থাকে। সারা বাথরুমের মেঝে জুড়ে অনিকেত পেস্ট ছড়ায়। পেস্ট দিয়েই সে মেঝেয় লেখে—আমি চাই অনন্ত আয়ু, আমি চাই অনন্ত ভালোবাসা, হায়—পেস্ট ফুরিয়ে যায় এখানে। টিউবটা ছুড়ে ফেলে দেয় অনিকেত। চিৎকার করে ডাকে প্রদীপ দত্ত, কেন টিউবের পেস্ট ফুরোবে? আমি এমন টিউব চাই যার পেস্ট কখনও ফুরোবে না। যাও, নিয়ে এসো।
প্রদীপ দত্ত অনেকগুলো জায়ান্ট সাইজ টিউব এনে দেয়, কিন্তু সেগুলো আর ফিরেও দেখে না। অনিকেত। সে বলে—প্রদীপ দত্ত তুমি কবে আমাকে ছেড়ে যাবে?
—আমি ছেড়ে যেতে পারি না মিস্টার বোস। আমাকে আপনার মৃত্যু পর্যন্ত থাকতে হবে।
—আমার মৃত্যু কবে হবে প্রদীপ দত্ত।
–যথাসময়ে। অপেক্ষা করুন।
—কিন্তু আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। কোনও নশ্বর মানুষ সহ্য করতে পারে এক মৃত্যুহীন মানুষকে? বলো প্রদীপ দত্ত, পারে কেউ?
—দুঃখিত মিস্টার বোস। কিন্তু আমি তো আপনাকে খুশি করার প্রাণপণ চেষ্টা করছি।
অনিকেত খুব ক্লান্তস্বরে বলল—আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। তুমি আমাকে আর খুশি করতে পারো না। আমাকে অনন্ত আয়ু দাও প্রদীপ দত্ত, অনন্ত কাম দাও, অনন্ত ক্ষুধা আর তৃষ্ণা। দাও! একটা নশ্বর শরীর আর-এক জীবনের আয়ু নিয়ে কী করে পথিবীতে ভোগ করা যাবে। প্রদীপ দত্ত! দয়া করো।
চিন্তিত প্রদীপ দত্ত মৃদুস্বরে বলে—অ্যাবস্ট্রাক্ট মিস্টার বোস, আমি দুঃখিত।
—তবে এই মুহূর্তে আমাকে মৃত্যু দাও প্রদীপ দত্ত। আমি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারব। যাও, আমার জন্য যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করো।
প্রদীপ দত্ত কেমন একরকম হাসে। বলে—মৃত্যু?মৃত্যুও অ্যাবস্ট্রাক্ট মিস্টার বোস। আমি তা দিতে পারি না। যথাসময়ে তা ঘটবে। আপনাকে অপেক্ষা করতেই হবে।
হতাশায় ভরে যায় অনিকেত। বলে—তবে যা দিয়েছ তা সব ফিরিয়ে নাও প্রদীপ দত্ত।
–লাভ কী? আপনি ইচ্ছে করলেই আবার সব ফিরে পাবেন।
–প্রদীপটা যদি নষ্ট করে ফেলি প্রদীপ দত্ত?
—ওটা নষ্ট হওয়ার নয়। প্রদীপটা আনপেরিশেবল, শক রেজিস্ট্যান্ট, করোশন প্রভড, ফায়ার রেজিস্ট্যান্ট, অ্যান্ড গ্যারান্টিড ফর ইটারনিটি।
—যদি কাউকে দিয়ে দিই?
প্রদীপ দত্ত একটু হেসে বলে–লাভ নেই মিস্টার বোস। তখন প্রদীপটার জন্য শোকে আপনি পাগল হয়ে যাবেন। যতক্ষণ এটা আপনার কাছে আছে ততক্ষণ আপনি বুঝতে পারছেন না প্রদীপকে আপনার কী ভীষণ দরকার!
ঠিক। খুবই ঠিক কথা। অনিকেত বুঝল। বুঝে একটু শিউরে উঠল ভয়ে, অনিশ্চতায়। বলল —না, না, কাউকে দেব না।
—সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বলে কেমন একটু হাসল প্রদীপ দত্ত।
হাসিটা চেয়ে দেখল অনিকেত। তারপর হঠাৎ সে-ও ঠিক ওইরকম একটু হাসল। খুব বুঝদারের হাসি। হাসতে-হাসতে কখন হঠাৎ চোখে জল এসে গেল তার। প্রদীপের দৈত্য বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে রইল সামনে। পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায়।
Well written