আশ্চর্য অলিম্পিক

আশ্চর্য অলিম্পিক

হাঁদুবাবু বেজায় ক্লান্ত। ক্রমাগত ঢুলুনি আসছে, শরীরটাও ভারি ম্যাজম্যাজ করছে, তা ক্লান্তির আর দোষ কী? এবারে দিল্লির অলিম্পিক গেমসের জন্য নতুন রকমের হুকুম হয়েছিল। আকাশের নক্ষত্র দিয়ে পাঁচটি বলয় সাজাতে হবে। কাজ কি সোজা? হাঁদুবাবু একটু গুঁইগুঁই করেছিলেন, কিন্তু হুকুম নড়েনি। গত আড়াই বছরের চেষ্টায় প্রায় আড়াই হাজার নক্ষত্রকে টানাহ্যাঁচড়ায় কক্ষচ্যুত করে নতুন করে সাজাতে হল, পাঁচটি বলয় আবার ভিন্ন ভিন্ন তো নয়, একটার ভিতর দিয়ে আর একটাকে গলাতে হবে। অনেক হিসেব—নিকেশের ব্যাপার ছিল। অলিম্পিকের আর দেরি নেই বলেই উদবোধন অনুষ্ঠান। তবে হাঁদুবাবুর কাজ শেষ হয়েছে। কাজটা উতরেও গেছে চমৎকার। আকাশের দিকে তাকালে যে—কোনো সময়েই পাঁচ—পাঁচটি বলয় দেখা যাবে। হ্যাঁ, এমনকী দিনমানেও। দিনের বেলা যাতে দেখা যায় তার জন্য বিশেষ ট্রিটমেন্টও করতে হয়েছে। আর নক্ষত্র তো আর ছোটোখাটো জিনিসটি নয়। সূর্যের চেয়ে হাজারগুণ বড়ো নক্ষত্রও রয়েছে। সুতরাং হাঁদুবাবু কেন হাঁফসে পড়েছেন তা বুঝতে কষ্ট হয় না। তবে মনটা আজ ভারি ভালো লাগছে। এখন বাড়ি ফিরে স্নান করে চারটি খেয়ে টানা ঘুম দেবেন। কাল অলিম্পিক।

ড্রাইভার উদ্ধব ইন্টারকমে বলে উঠল, স্যার, একটু মুশকিল হয়েছে।

হাঁদুবাবু ঢুলতে ঢুলতে বললেন, মুশকিল আবার কীসের?

শর্টকাট ধরে যাচ্ছি, কিন্তু সামনে একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়েছে। যন্ত্রপাতি সব উলটো গাইছে। কী করে হল তা বুঝতে পারছি না। আসবার সময় এখানে এ—রকম কোনো ব্যাপার তো দেখিনি।

উদ্ধবটা একটা হাঁদা হাঁদুবাবু জানেন। ওর মগজটাকে রি—সেট করেছেন অনেকবার। কিন্তু আই—কিউ বাড়েনি। তবে উদ্ধব পুরোনো লোক বলে তাকে বাতিল করেননি হাঁদুবাবু, তাঁর বড়ো মায়া। কিন্তু এটা ভালোই বুঝতে পারছেন, উদ্ধবের মতো রোবটকে দিয়ে তাঁর আর বেশিদিন চলবে না।

বাইরের দিকে চেয়ে হাঁদুবাবু দেখলেন, মহাজগতের যেখানে এখন রয়েছেন তার নাগালের মধ্যে সেই মৃতপ্রায় লাল তারাটি। অর্থাৎ পৃথিবী আর মাত্র ঘণ্টাখানেকের পথ। হাঁদুবাবু তাঁর সামনে প্যানেলের দিকে চেয়ে দেখলেন, চৌম্বক ঝড়ে যন্ত্রপাতি কিছু উলটোপালটা রিডিং দিচ্ছেও।

হাঁদুবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, উদ্ধব একটু মাথা খাটাতে শেখো। আকাশের অতগুলো নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হয়ে রি—অ্যারেঞ্জড হয়েছে। তার ফলে মহাজগতের ভারসাম্যে বেশ বড়ো রকমের ধাক্কা লেগেছে। ফলে ম্যাগনেটিক স্টর্ম খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তোমাকে অনেকদিন বলেছি যন্ত্রের ওপর নির্ভর করবে না, বিপদে পড়লে ইনস্টিংক্ট কাজে লাগাবে।

উদ্ধব খুব বিনীতভাবে বলল, যে আজ্ঞে। তবে আমিও যে যন্ত্রই, ইনস্টিংক্ট কোথায় পাব?

হাঁদুবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি যন্ত্র হলেও গবেট যন্ত্র। গত দশ বছরে তোমার চেয়ে লায়েক অনেক রোবট তৈরি হয়েছে যাদের ইনস্টিংক্টও তৈরি করে নিয়েছে তারা আর নিজের চেষ্টাতেই। তোমার কোনো চেষ্টাই নেই। এ—যুগে এত ক্যালাস হলে চলে!

উদ্ধব চুপ করে রইল। ইনস্টিংক্ট না থাক, উদ্ধবের আবার অভিমান আছে। হাঁদুবাবু বকাঝকা করলে সে কথা বন্ধ করে দেয়। কাঁদেও নাকি। তবে উদ্ধবের কান্না হাঁদুবাবু কখনো দেখেননি। তাঁর গিন্নি রাধারানী নাকি দেখেছেন। আর সেই জন্যই উদ্ধবকে বকলে রাধারানী খুশি হন না। আর রাধারানীর জন্যই হাঁদুবাবু অন্য কোনো রোবটকে রকেট চালানোর কাজে নিয়োগ করতে পারেন না। উদ্ধবকে দিয়েই কাজ চালাতে হয়।

নেপচুনে একটু না থাকলেই নয়, শচীন হোড় সেখানে একটু খুবই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছে গত বছরটাক যাবৎ। শচীনের সঙ্গে দেখা করা দরকার। এবার অলিম্পিকে অতীতের ক্রীড়াবিদদের আনানোর একটা চেষ্টা চলছে। কতদূর কী হবে তা বোঝা যাচ্ছে না। অতীত বলতে পঞ্চাশ—ষাট বছর নয়, এক—দেড় হাজার বছর। আগেকার ক্রীড়াবিদেরা যাতে আসতে পারেন, সেটাই শচীন হোড়ের গবেষণার বিষয়। টাইম—মেশিনে অতীত বা ভবিষ্যতে যাতায়াত কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হল অতীত থেকে সেই যুগের মানুষজনকে ধরে আনা নিয়ে। অনেক সময়ে দেখা যায় সময়ের বেড়া টপকাতে গিয়ে অনেকেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শচীনকে বলা হয়েছে এমন ব্যবস্থা করতে যাতে কারও কোনো অসুবিধে না হয়। শচীন খাটছেও খুব।

নেপচুন বেজায় ঠান্ডা জায়গা। তবে হাঁদুবাবুকে নামতে হবে না। শচীন থাকে মাটির তলায়, অনেক গভীরে, চাপ—তাপ—নিয়ন্ত্রিত গবেষণাগারে। যেখানে কৃত্রিম আবহমণ্ডল আছে। তা ছাড়া নেপচুনের উপরিভাগকে তপ্ত ও স্বাভাবিক করে তোলারও চেষ্টা চলছে। হয়ে যাবে কয়েক বছরের মধ্যে।

হাঁদুবাবুর বকুনি খেয়ে উদ্ধব রকেটটা ভালোই চালাল। চৌম্বক ক্ষেত্রটা পার হয়ে সাঁ—সাঁ করে সৌরমণ্ডলে ঢুকে পড়ল রকেট।

হাঁদুবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, বেঁধে! বেঁধে! নেপচুনে যে নামতে হবে সে খেয়াল আছে? কবে যে তোমার অন্যমনস্কতা যাবে!

রকেট নেপচুনে নামল এবং সোজা পাতালে গিয়ে একটা চাতালে দাঁড়িয়ে পড়ল।

শচীনের ঘরে ঢুকে হাঁদুবাবু একটু থতমত খেলেন। অনেকগুলো লোক বসে আছে। তাদের অনেকের মুখ বেশ চেনা—চেনা ঠেকছে। হাঁদুবাবুকে দেখে শচীন ভারি খুশি হয়ে বলে উঠলেন, আরে এসো এসো হাঁদু! এই যে দেখ, এঁরা সব এসে গেছেন।

এঁরা কারা?

আরে এই তো জেসি ওয়েন্স, একুশ বছর বয়সে পাকড়াই এঁকে। আর ইনি এমিল জেটোপেক, পঁচিশের ছোকরা। এই যে দেখছ জনি ওয়েসমুলার, বাইশ। ইনি হলেন কার্ল লুইস, বাইশ। এই ইনি বেন জনসন, তেইশ। ওই ডালে টমসন— চব্বিশ। এই যে ইনি মার্ক স্পিজ, তেইশ। কুড়ি বছরের ম্যারি ডেয়ারকে তো চেনোই। এই কোণে বুবকা, মোজেস। আর ওই যে কোমানিচি, উইলসা রুডলফ, ওলগা করবুট…

হাঁদুবাবু বুঝলেন, শচীন সফল হয়েছে। খুব খুশি হলেন তিনি।

শচীনবাবু চোখের ইশারায় তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, একটু সমস্যায় পড়েছি ভাই। এই সব ক্রীড়াবিদদের আনা হয়েছে দর্শক হিসেবে এবং দ্রষ্টব্য হিসেবেও বটে। কিন্তু এঁরা বলছেন এঁরাও অংশ নেবেন। কী করি বলো তো…

হাঁদুবাবু অবাক হয়ে বললেন, তা কী করে হয়? এখনকার অ্যাথলিটরা তো আর…

শচীনবাবু কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, সেইটেই তো কথা…

খুব জোরাজুরি করছেন কি ওঁরা?

সাংঘাতিক। কোনো নিষেধই শুনতে রাজি নয়।

অলিম্পিক কমিটিকে জানিয়ে দাও। তারা যা ভালো বুঝবে করবে।

জানিয়েছি। তারা সব মিটিংয়ে বসেছে। কিন্তু কমিটি যদি প্রস্তাব নাকচ করে দেয় তা হলে এঁরা বোধহয় জোট বেঁধে আমাকে পেটাবে।

হাঁদুবাবু সচকিত হয়ে বললেন, ও বাবা! খেলোয়াড়রা বড্ড সাংঘাতিক লোক হয়। মারপিটের মধ্যে আমি নেই ভাই। শরীরগতিকও ভালো নয়, ধকল বড়ো কম যায়নি। আমি সরে পড়লুম।

বন্ধু হিসেবে তুমি অতি যাচ্ছেতাই।

না ভাই, আমি শুনেছি খেলোয়াড়রা মারলে নাকি খুব লাগে।

এই বলে হাঁদুবাবু তাড়াতাড়ি এসে রকেটে উঠে দরজা এঁটে দিলেন। একটু বাদেই টের পেলেন, উদ্ধব হাঁদারাম ফাঁক পেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। মস্তিষ্ক যাদের কম ক্রিয়াশীল তাদেরই ঘুম বেশি হয়। না, উদ্ধবকে দিয়ে আর চলছে না।

উদ্ধবকে ডেকে তুলে রকেট ছাড়তে বললেন হাঁদুবাবু। মাথায় একটু উদবেগ লেগে রইল। অলিম্পিকে একটা গোল না বাঁধে। অতীতের ক্রীড়াবিদদের নিয়ে আসাটা কি ভুল হল?

বাড়িতে ফিরে হাঁদুবাবু তাঁর স্বয়ংক্রিয় স্নানঘরে ঢুকে গেলেন। যান্ত্রিক সব হাত এসে গায়ে তেল মাখাল, স্নান করাল, দাড়ি কামিয়ে দিল, মাথা টিপে দিল, গা মোছাল, কাপড় পরিয়ে দিল। রাধারানী বাড়ি ছিলেন না, বাজার করতে নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলেন সকালে। দুপুরেই অবশ্য ফিরে আসবেন।

স্নান করে উঠে হাঁদুবাবু হাঁক মারলেন, কই রে টেঁপি, খেতে দে।

যাই বাবা। বলে ফুটফুটে এক যন্ত্রমানবী দৌড়ে এল। চটপট হট বক্স খুলে খাবার সাজিয়ে দিল টেবিলে। শুধু তা—ই নয়, সাধাসাধি করে এটা—ওটা—সেটা যাচাই করে খাওয়াল।

হাঁদুবাবু একটু বিশ্রাম নিয়ে দিল্লির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলেন। শুনলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর নক্ষত্র সাঁজানো দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। নোবেল কমিটিতে তাঁর নাম পেশ হল বলে।

ঘুম ভাঙল রাধারানীর চেঁচামেচিতে। বিকেলে ঘর ঠিকমতো ঝাঁটপাট হয়নি, জলছড়া দেওয়া হয়নি, ঠাকুরের কাছে সাঝের বাতি দেওয়া হয়নি, ধূপ জ্বালানো হয়নি। টেপি নাকি টিভি খুলে একটা সিনেমা দেখছিল।

টেঁপিটাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন হাঁদুবাবু। তাড়াতাড়ি উঠে রাধারানীকে বললেন, আহা থাক থাক, বোকো না। ছেলেমানুষ তো।

তোমার আশকারা পেয়েই তো দিন—দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে। দেখ তো গিয়ে আর—পাঁচটা বাড়িতে। যন্ত্রমানবীরা কেমন সুন্দর সময়ের কাজ সময়ে করে ফেলেছে!

রাত্রিবেলা খেয়েদেয়ে গিন্নির সঙ্গে একটু সাংসারিক কথা বলে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে গেলেন হাঁদুবাবু। সকালেই দিল্লি যেতে হবে। অলিম্পিক বলে কথা!

অলিম্পিকের মার্চ পাস্ট ইত্যাদিতে প্রথম দিনটা ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। অতীতের অ্যাথলিটদেরও মার্চ পাস্টে অংশ নিতে দেওয়া হল। কিন্তু গণ্ডগোল বাধল দ্বিতীয় দিনেই। আমেরিকার প্রতিযোগী দ্বিতীয়জন মাত্র চার সেকেন্ডে একশো মিটার দৌড়ে বাজি জিততেই যেন জনসন আর কার্ল লুইস চেঁচিয়ে বলতে লাগল, এটা কী হচ্ছে। এক সেকেন্ডে একশো ভাগের এক ভাগ সময় কমাতে আমাদের কালঘাম ছুটে যেত। চার সেকেন্ডে একশো মিটার দৌড়ানো যে অসম্ভব।

গোলমাল বাধল আরও পরে। রুশ জাম্পার মেয়াগই ভলাদিমিদি হাই জাম্পে চোদ্দো ফুট ডিঙিয়ে ফেলল। ভালেরি ব্রুমেল আর সোবার্স ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, এটা কী করে হচ্ছে!

বুবকার জন্য আরও বিস্ময় বাকি ছিল। পোল ভল্টে মার্কিন ভল্টার চল্লিশ ফুট পার হয়ে গেল। জিমনাস্টিকস সাঁতার ওয়েটলিফটিং ইত্যাদিতে ইদানীংকালের ক্রীড়াবিদেরা এমন সব কাণ্ড করতে লাগল যে অতীতের ক্রীড়াবিদেরা মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজতে লাগলেন।

অতীতের ক্রীড়াবিদরা এসব কাণ্ডকারখানা দেখে খুবই দমে গেলেন। ইদানীংকালের অ্যাথলিটদের কাছে তাঁরা পাত্তাও পেলেন না। বিজয়ী অ্যাথলিটরা যেন পাত্তাই দিল না তাঁদের।

তবে যা—ই হোক, ভালোয় ভালোয় অলিম্পিক শেষ হয়ে গেল। তেমন কোনো গণ্ডগোল হল না। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট অতীতের অ্যাথলিটদের খুব আদর করে ডিনারে নেমন্তন্ন করলেন। গোমড়া মুখে ক্রীড়াবিদেরা এলেন ডিনারে। তাঁদের ধারণা, অপমান করার উদ্দেশ্যেই তাঁদের অতীত থেকে টেনে আনা হয়েছে।

বিশাল ভাসমান কাচের টেবিলে এলাহি খাওয়া—দাওয়ার বন্দোবস্ত। টেবিল বা চেয়ারের পায়া বলে কিছু নেই। সবই ভেসে আছে। চেয়ারগুলো আবার অদ্ভুত। বসলে টেরই পাওয়া যায় না যে কীসের ওপরে লোকে বসে আছে। ভারি সুখানুভূতি হয়। চারদিকে ভারি চমৎকার রোশনাই, চোখে লাগে না, কিন্তু সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায়। আর খাওয়ার ঘরে যে মৃদু বাজনা শোনা যাচ্ছে, তাও সম্মোহনকারক বিটোফেন। কিন্তু পিয়ানো—টিয়ানো বা বেহালা—টেহালা নয়, সম্পূর্ণ অন্য ধরনের কোনো বাদ্যযন্ত্র। তার মিঠে আওয়াজে কান ভরে যায়।

আয়োজন দেখে ক্রীড়াবিদেরা হতচকিত, মুগ্ধ। আই ও সি—র প্রেসিডেন্ট সবাইকে স্বাগত জানিয়ে অতীতের ক্রীড়াবিদদের নৈপুণ্যের সবিশেষ প্রশংসা করে তাঁদের হাতে এ—যুগের নানা মূল্যবান উপহার তুলে দিলেন। অবশ্য কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি উপহারের মধ্যে ছিল না। কারণ এই সব উপহার অ্যাথলিটদের সঙ্গে অতীতে ফিরে যাবে। এই সব যন্ত্রপাতি অতীতে গেলে বিরাট গণ্ডগোল বেধে যেতে পারে। তাঁদের এমন সব জিনিস দেওয়া হল যা অতীতে গেলেও ক্ষতি নেই।

যা—ই হোক, অতীতের অ্যাথলিটদের পক্ষ থেকে নেতা নির্বাচন করা হল জেসি ওয়েন্সকে। ওয়েন্স এই আপ্যায়ন আর আতিথেয়তার জবাব দিতে উঠে বললেন, মানুষ এ—যুগে ক্রীড়াদক্ষতার এমন জায়গায় পৌঁছেছে যা কোনোদিন সম্ভব বলে আমরা ভাবিনি। কোন মন্ত্রে মানুষ এমন দক্ষতা অর্জন করল তা একটু জানতে পারলে আমি অতীতে ফিরে গিয়ে সেই কৌশলই অনুশীলন করতাম। আমাদের ক্রীড়ানৈপুণ্যের যে—প্রশংসা এখানে শুনলাম, সেটাকে বিদ্রূপ বলেই ধরে নিচ্ছি।

এ—কথায় এ—যুগের মানুষেরা কেন যেন চুপ করে রইল।

হাঁদুবাবু শচীনের কানে কানে বললেন, এঃ, তুমি বলে দাওনি জেসিদাদাকে! দেখ তো কী সব বলে যাচ্ছেন উনি!

শচীন কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, সুযোগও হয়নি, আর সাহসও পাইনি।

হাঁদুবাবু বললেন, মোটেই তা নয়। তুমি আসলে ওঁদের একটু কড়কেও দিতে চেয়েছিলে।

শচীনবাবু ফিচিক করে হেসে বললেন, চুপ চুপ; শুনতে পাবে। আসলে কী জানো, লোকগুলো এমন তেরিয়া হয়ে উঠেছিল, ভাবলুম দিই নামিয়ে, যা হয় হবে।

কাজটা ভালো করোনি। তোমার কপালে দুঃখ আছে।

জেসি ওয়েন্সের বক্তৃতার শেষে ক্ষীণ একটু হাততালি পড়ল। অপ্রস্তুতভাবে আই ও সি—র প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়িয়ে অপ্রতিভ একটু হেসে হাতটাত কচলে বললেন, শ্রদ্ধেয় জেসি ওয়েন্স একটু ভুল করেছেন। হয়তো ভুলটা আমাদেরই। তাঁদের জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল যে, আজকাল অলিম্পিকে কোনো মানুষই অংশ নেয় না।

ঘরে সূচীভেদ্য নীরবতা।

কার্ল লুইস উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তা হলে ওরা কারা?

প্রেসিডেন্ট রুমালে মুখ মুছে একটু জল খেয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন, আসলে বহুকাল আগে থেকেই মানুষের খেলাধুলোর চর্চায় ভাটা পড়ে যায়। তার কারণ হল, আড়াই হাজার সাল নাগাদ ক্রীড়াজগতে মানুষ যতটা উন্নতি করা সম্ভব করে ফেলল। কিন্তু তার পর থেকে আর নতুন কোনো রেকর্ড করা সম্ভব হচ্ছিল না। কত রকম চেষ্টাতেও দৌড়ের সময় কমানো বা লাফের দূরত্ব বাড়ানো গেল না। ফলে ক্রীড়াচর্চায় সেই যে ভাটা পড়ল, সে ভাটা এখনও চলেছে। মানুষ এখনও একটু—আধটু খেলে বটে, তবে নিতান্তই শরীরটা ঠিক রাখার জন্য। তার বেশি কিছু নয়। খেলা নিয়ে মাথা ঘামানোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কী বলব আপনাদের, একটা সময় এল যখন ফুটবল খেলাতেও কেবলই ড্র হয়। আর টস করে জয়—পরাজয় নির্ধারণ করতে হয়। টেনিসে কেবলই ডিউস হতে থাকে। বোঝা গেল এই অচলাবস্থার নিরসন সহজে হবে না। সংগত কারণেই মানুষ খেলাধুলো ছেড়ে দিল। কিন্তু তাই বলে তো আর অলিম্পিক তুলে দেওয়া যায় না। মানুষের বদলে এখন বিভিন্ন দেশ প্রতিযোগী হিসেবে পাঠায় যন্ত্রমানবদের। এবার অলিম্পিকেও আপনারা তাদেরই দেখেছেন। আপনাদের তাদের সঙ্গে নামতে দেওয়ার ইচ্ছে আমাদের ছিল না। শচীনবাবু আপনাদের ব্যাপারটা খুলে বলে দিলে এই গণ্ডগোলটা হত না। যা—ই হোক, ওই যন্ত্রমানবদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে হেরে গেলেও আপনারা কিন্তু যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

এ—কথা শুনে অতীতের অ্যাথলিটরা খানিকক্ষণ হাঁ করে রইলেন। তারপর সবাই হাঃ হাঃ করে হাসতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *