আশ্চর্য্য হত্যাকাণ্ড :: হরিসাধন মুখোপাধ্যায়

আশ্চর্য্য হত্যাকাণ্ড – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়

(আমার কথা)

(১)

সকাল হইতেই বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছিল। ভাদ্রের ভরা বর্ষা, রাস্তা ঘাট কাদায় পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। খাল বিল কুলে কুলে ভরিয়া উঠিয়াছে। সন্ধ্যার পর একটু বৃষ্টি কম পড়ে, কিন্তু আকাশে মেঘের ঘটার সেই রূপ আড়ম্বরই ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরই পাড়ায় বাহির হই, কিন্তু সেই দিন সেই অন্ধকারে, কাদা পিছলের মধ্যে লণ্ঠন হাতে করিয়া বর্ষার পথ হাঁটা বড় সুবিধাজনক বোধ হইল না। কাজেই সেদিন সন্ধ্যার পর বাড়ীতে ছিলাম।

খানিক ক্ষণ একখানা বই লইয়া একটু পড়িলাম। বর্ষার সঙ্গে যেন বিষন্নতার একট ঘনিষ্ট সম্বন্ধ। যে দিন রোদ হয়, গাছ পালা, নদ নদী – সমগ্র প্রকৃতির ছবি খানি রোদে হাসিতে থাকে, সে দিন কেমন মনে একটা স্বাভাবিক প্রফুল্লতা আপনিই জাগিয়া উঠে। কিন্তু মেঘ ঝড়ের দিন কি যেন একটি বিষণ্ণ ভাব আমাদের হৃদয়ের মধ্যে ভাসাইয়া তুলে, আমরা হাজার চেষ্টা করিয়া তাহার গতি প্রতিরোধ করিতে পারি না।

যাউক, এই বর্ষায় কাজেই আমার বই ভাল লাগিল না। আমি বইখানি তুলিয়া রাখিয়া ছেলেদের পড়িবার ঘরে গিয়া বসিলাম, তাহাদের পড়াশুনাও একটু দেখিলাম, কিন্তু তাহাতেও যেন আমার প্রাণের তৃপ্তি হইল না। তখন অন্য উপায় না দেখিয়া সকাল সকাল আহারাদি শেষ করিয়া, বিছানায় গিয়া পড়িলাম।

বেশ সে দিন শীত পড়িয়াছিল, বিছানায় শুইতেই একটু তন্দ্রা আসিল। তার পর কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম মনে নাই, কিন্তু সেই গভীর রাত্রে, সহসা কে যেন আমার ঘরের দোরে দুই তিন বার জোরে জোরে আঘাত করিল। সেই আঘাতে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল বটে, কিন্তু ঘুমের ঘোর তখনও যায় নাই। আঘাতের উপর আঘাত, তার পর কে যেন কাতর কণ্ঠে ডাকিল, “অঘোর বাবু – অঘোর বাবু।” আমি কার আওয়াজ ঠিক করিতে পারিলাম না, কিন্তু বোধ হইল তাহা স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর, আবার তাহা যেন ভয় পাওয়ার মত।

এত রাত্রে কোন প্রতিবেশিনী হয়ত বিপদগ্রস্ত হইয়া বাড়ী আসিয়াছে, এই ভাবিয়া আলো জ্বলিবার উদ্যোগ করিলাম। মাথার নীচে দেশলাই রাখা অভ্যাস ছিল, বিছানার ভিতর হইতেই হাত বাড়াইয়া আলো জ্বালিলাম। এবার বাহিরের দ্বারে আবার উপরি উপরি দুই তিন বার আঘাত হইল, বাহিরের ব্যক্তি বলিল – “ন বাবু শীঘ্র দোর খুলুন সর্ব্বনাশ হইয়াছে।”

আমি তাড়াতাড়ি দোর খুলিয়া ফেলিলাম। আমি ভাবিয়া ছিলাম, আমার বাসার পার্শ্বে একটি হিন্দুস্থানীর জ্যেষ্ঠ পুত্রের সংকটাপন্ন পীড়া, তাহার বাটীর হয়ত কেহ হইবে; কেন না বাহিরের স্ত্রীলোকে হিন্দুস্থানী ভাষায় কথা বার্ত্তা কহিতেছিল।

কিন্তু দোর খুলিয়া দেখিলাম, সে সেই হিন্দুস্থানীর দাসী নয়, আমার এক খুড়তুত ভাই এর পরিবারভুক্তা দাসী। আমার বাসা হইতে তাঁহার বাড়ী চার রশি দূরে।

আমার নিজের একটু পরিচয় দিই। আমি তখন দেওঘরে গিধোড়ের রাজার অধীনে চাকরী করিতাম। আমার বাসার সন্নিকটে অর্থাৎ এক মহল্লার সীমায় আমার এক জ্ঞাতি ভাই থাকিতেন। তিনি মোটা মাহিনা পাইতেন। এখন চারতিতে ইস্তফা দিয়া পীড়ার জন্য অনেক দিন ধরিয়া বৈদ্যনাথে বাস করিতেছিলেন।

দাদার বাড়ীর দাসী নুরীকে সেই রাত্রে দেখিয়া আমি বলিলাম, “নুরী কি হইয়াছে বল দেখি! কিসের সর্ব্বনশ! দাদা ভাল আছেন ত?

নুরী কাঁদিতে কাঁদিতে মাথা চাপড়াইয়া বলিল, “ন বাবু গো! তিনি থাকিলে আর সর্ব্বনাশ কিসের? আজ রাত্রে কে তাঁহাকে খুন করিয়া গিয়াছে!”

“খুন!! বলিস কি – খুন!! কে এমন সর্ব্বনাশ করিল – হা ভগবান -“

আমি আর অপেক্ষা করিলাম না। নুরীকে বলিলাম, – “আমার চাকর খোদাই তোর সঙ্গে যাইতেছে, তুই থানায় গিয়া খবর দে, আমি বাড়ীর দিকে যাই!”

নুরী চলিয়া গেল। আমি তাহাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করাও প্রয়োজন বোধ করিলাম না। তখন আমার মাথার ভিতর আগুন জ্বলিতে ছিল। আমি অন্য এক চাকরকে জাগাইয়া হুঁসিয়ার থাকিতে বলিয়া ঘটনা স্থলে উপস্থিত হইলাম।

(২)

রাস্তা ঘাট কাদায় পরিপূর্ণ বলিয়া সেখানে পৌঁছিতে আমার পাঁচ সাত মিনিট অধিক বিলম্ব হইল। আমি একেবারে বাড়ীর ভিতরে গেলাম।

প্রথমেই সম্মুখে আমার ভ্রাতৃজায়া – তিনি মূর্চ্ছিতা হইয়া পড়িয়া রহিয়াছেন। তাঁহার দুই কন্যা; একটি ১০ বৎসরের, অপরটি ৭ বৎসরের, তাঁহার মুখের উপর পড়িয়া, “মা,” “মা” – “কথা কও” বলিয়া কাঁদিতেছে। দুই তিনটি দাসী পাখার বাতাস ও জলের ছিটা দিতেছে; কিছুতেই চেতনা হইতেছে না।

সে বাড়ীর ঘর দোর আমার সবই জানা ছিল, আমি একটি ঘরে ঢুকিয়া কোন তীব্র ঔষধ লইয়া তাঁহার নাসিকার কাছে ধরিলাম। ক্রমে তাঁহার চেতনা হইল, তিনি আমায় চিনিতে পারিয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিয়, “আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে” বলিয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

আমি তাঁহাকে যথাসাধ্য সান্ত্বনা করিলাম এবং ধরাধরি করিয়া লইয়া নিকটের একটি ঘরে শোয়াইলাম! বলিলাম, “আপনি চীৎকার করিয়া কান্নাকাটি করিবেন না, পুলিশের লোক এখনি আসিবে।”

গৃহিণী প্রথমেই দাসীর মুখের এই সংবাদ পান, এবং ঘরের বাহিরে আসিতে আসিতে দালানে মূর্চ্ছিতা হন। তাঁহার চীৎকারে দুই চারিটি প্রতিবেশিনী, সেই গভীরে অন্ধকারে বাড়ীর মধ্যে আসিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি তাঁহাদিগকে গৃহিণীর ঘরে পাঠাইয়া দিলাম।

নুরী এখনই ফিরিবে – কারণ আমার বাড়ী হইতে থানা অর্দ্ধঘণ্টার পথ। আমি দাদার খানসামা, রামফলকে বলিলাম, “দেখ রামফল, দাদার ঘরে এখন কেহ যেন না যায়, পুলিস যতক্ষণ না আসে, ততক্ষণ কাহারও ঐ গৃহে প্রবেশ করা উচিত না। তুমি এই দ্বারের কাছে বসিয়া থাক।”

রামফল সাহসী ও প্রভুভক্ত। সে অত্যন্ত কাঁদিতেছিল, চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল – “যো হুকুম খোদাবন্দ।”

আমি দালানের আলোটা জ্বালিয়া দিলাম। ঘড়ীতে দেখিলাম রাত্রি প্রায় দুটা বাজে। এমন সময় নুরী আসিয়া শশব্যস্তে বলিল, “ন বাবু, পুলিশের লোক বাহিরে আসিয়াছে, আপনি বাহিরে যান।”

(৩)

পুলিশ অসিয়াছে শুনিয়া অমি তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিলাম। দারোগা সাহেব আমাদের বাহিরের ঘরের চাতালে বসিয়া ছিলেন, আমি বাটীর ভিতর হইতে আলো আনাইলাম। দেখিলাম দারোগা স্বয়ং ও দুই জন কনস্টেবল সেই ক্ষেত্রে উপস্থিত।

থানার পূর্ব্ব দারোগার সহিত আমার আলাপ ছিল। যিনি তদারকে আসিয়াছেন, তিনি নূতন লোক। সম্প্রতি বদলী হইয়া আসিয়াছেন। আমাদের অভিবাদন ও প্রত্যাভিবাদন হইয়া গেল। দারোগা আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন – “মহাশয় যিনি খুন হইয়াছেন, তিনি আপনার কে হন?”

আমি বলিলাম – “আমার জ্যেঠা মহাশয়ের পুত্র।”

দারোগা বলিলেন – “মেয়ে ছেলেদের সরাইয়া দিন; আমি অকুস্থলে নিজে গিয়া একবার দেখিব।”

দারোগা বাড়ির ভিতর গিয়া হুকুম দিলেন, ‘ কেহ যেন বাড়ীর বাহিরে না যায়। সদর ও খিড়কী দ্বারে, সেই দুইজন কনষ্টেবল পাহারা দিতে লাগিল।

দারোগা রামফলকে আলো লইতে বলিলেন। যে ঘরটিতে খুন হইয়াছে সেটি দক্ষিণ-দ্বারী ঘর। দরোগা সাহেব নিজ হাতে আলো লইয়া মৃতদেহের উপর ধরিলেন। অহো! সে ভয়ানক দৃশ্য আমি এক মুহূর্ত্তের জন্য দেখিয়াছিলম, আজও তাহা আমার মনে জাগিতেছে!

মৃতদেহের গলা কাটা, তাহা হইতে অজস্র ধারে রক্ত পড়িয়া বিছানা ভাসিয়া গিয়াছে। মৃত ব্যক্তির ডান ও বাঁ দিকের বিছানার চাদরের অংশ রক্তস্রোতে লাল হইয়া গিয়াছে। চক্ষু দুটি মুদ্রিত, মুখ হাঁ করা, মুখের কি যেন একটা যাতনা চিহ্ন। মৃত ব্যক্তির গায়ে একটি মেরজাই ও একটি পিরাণ ছিল। মেরজাইয়ের বাঁ দিকের পকেটটির জেব উলটান। তাঁহার ডান হাতের মুঠার ভিতর একখানি ক্ষুর। ক্ষুর খানি তিনি ডান হাতে ধরিয়াছিলেন বটে কিন্তু তাহা মুষ্টিবদ্ধ নহে।

দারোগা বিশেষ করিয়া আহত ব্যক্তির মুখের দিকে আলো ধরিয়া, খুব সাবধানতার সহিত তিন চারবার দেখিলেন। তার পর ঘরের জিনিস পত্রের দিকে তাঁহার নজর পড়িল। সেই ঘরের আসবাবের মধ্যে একটি কাপড়ের দেরাজ, একটি কাচের আলমারি ও দুটি সিন্দুক। ঘরের জিনিস পত্র যেরূপ ভাবে যেখানে ছিল ঠিক সেইরূপই আছে। একটি টুলের উপর নানারূপ ঔষধের শিশি, মেঝের উপর একটি অর্দ্ধভাগ জলে পরিপূর্ণ উচ্ছিষ্ট গ্লাস ও ভুক্তাবশেষ দুগ্ধ-বিশিষ্ট একটি দুধের বাটী।

একটু মনোযোগের সহিত তদারকে দেরাজগুলি বিশেষ পরীক্ষা করায়, তাহার অন্য সকলগুলিই বন্ধ আছে দেখা গেল, কেবল বাঁ ধারের সকলের নীচের টানাটির চাবি খোলা। অপর গুলির চাবির জন্য অনুসন্ধান করা হইল, কিন্তু পাওয়া গেল না। গৃহিণীকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তিনি বলিয়া পাঠাইলেন, চাবি কর্ত্তার কাছেই থাকিত, তিনি বালিসের নীচে বা কোমরে রাখিতেন। বালিসের নীচে বা কোমরের ঘুনসী দেখা হইল, চাবি পাওয়া গেল না।

চাবি না পাওয়াতে দারোগার মুখ গম্ভীর ভাব ধারণ করিল। তিনি সেই খোলা টানাটি একবার খুলিয়া পুনরায় বন্ধ করিয়া সেইখানে বসিলেন।

ঘরের পশ্চিমদিকে একটি পাশ-দোয়ার ছিল। এই দরজাটিতে সর্ব্বদা ভিতর হইতে খিল ও বাহির হইতে চাবি দেওয়া থাকিত। কখনও এ দ্বার খোলা হইত না। দারোগা সাহেব তালাটি বিশেষ করিয়া দেখিলেন। তাহাতে চাবি ঘুরানোর কোন দাগ নেই, দোরের খিলের উপর, কেবল স্থানে স্থানে ধুলা ময়লা ঝরিয়া পড়িয়াছে।

ঘর দোর বেশ করিয়া দেখা হইলে দারোগা বলিলেন – “বাবু, আমি ডাক্তার সাহেবকে খবর দিয়া আসিয়াছি। তিনি এখনই আসিবেন। মৃতদেহ পরীক্ষা না হওয়া পর্য্যন্ত আমি অন্য তদারক করিতে পারিতেছি না।”

তখন প্রভাত হইয়াছে, লূর্য্যের সুবর্ণ কিরণ ধীরে ধীরে জানালার পাশে উঁকি মারিতেছে, কিন্তু আমাদের পক্ষে কি কাল রজনীই প্রভাত হইল! জীবনে মানুষের সুদিন কুদিন দুই ঘটিয়া থাকে, কিন্তু এমন কুদিন যেন অতি শত্রুরও না ঘটে।

দারোগা বাহিরে গিয়া তাঁহার ডায়ারি পুস্তকে সমস্ত ঘটনা লিখিয়া লইলেন। মধুপুরে সৌভাগ্যক্রমে সেই সময়ে একজন ইংরাজ সিবিল ডাক্তার ছিলেন। তাঁহাকে আনিতে ভোরের গাড়িতেই দারোগা এক জনকে রওয়ানা করিয়া দিয়াছিলেন। সকালে আটটার সময় কলিকাতা হইতে যে গাড়ি আসে, তাহাতেই সাহেবের অসিবার সম্ভাবনা ছিল।

আমরা প্রতি মুহূর্ত্তে তাঁহার অপেক্ষা করিতেছিলাম। তিনি আসিয়া হুকুম দিলে তবে মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা হইবে; ঘরে বাসি মৃতদেহ রাখিতে নাই, তাহাতে এ আবার একটি শোচনীয় মৃতু।

ডাক্তার সাহেব আটটার গাড়িতেই আসিলেন। প্রায় এক ঘণ্টার উপর তাঁহার শবদেহ পরীক্ষা করিতে গেল। তিনি পকেট বুকে কতকগুলি আবশ্যকীয় ঘটনা তুলিয়া হইয়া, লাস দগ্ধ করিবার হুকুম দিলেন। দারোগাকে পাশে ডাকিয়া লইয়া গিয়া তিনি অনেকক্ষণ ধরিয়া কি কথাবার্ত্তা কহিয়া, তার পর চলিয় গেলেন।

শবদেহের সৎকারের আয়োজন হইতে লাগিল; এদিকে দারোগা বাড়ীর সকলের জোবানবন্দী লইতে লাগিলেন। সর্ব্বপ্রথমে রামফল খানসামার সাক্ষী লওয়া হইল। রামফল যাহা বলিল তাহার মর্ম্মকথা এই, – যে বাবু খুন হইয়াছেন, তাঁহার নাম রামকালী চট্টোপাধ্যায়, তিনি আমার মনিব। বাবুর নিবাস বঙ্গলা দেশে, কোন গ্রামে বা জেলায় তাহা জানি না। তিনি পীড়ার চিকিৎসার জন্য এখানে আসিয়াছিলেন। শুনিয়াছি বৈদ্যনাথে তিনি তিন বৎসর আছেন। একথাও শুনিয়াছি যে, এর আগে তিনি মধুপুরে ছিলেন। আমি তাঁর নিকট এক বৎসরের উপর চাকরি করিতেছি। বাবু আমায় বড় ভাল বাসিতেন। শ্রাবণ মাস হইতে আমার দুই টাকা মাহিনা বাড়াইয়া দেন। এখন আমি আট টাকা মাহিনা পাই। গত রাত্রে আমি তাঁহাকে এগারটার সময় জীবিত দেখিয়াছি। আমি তাঁহার বিছানা করিয়া দিই। রাত্রি আন্দাজ এগারটার সময় তিনি গরম দুধ খান। প্রতিদিনই রাত্রে গরম দুধ খাইয়া শুইয়া থাকেন। অন্য কিছু খান না, তবে নিতান্ত ক্ষুধা হইলে দুই একখানা লুচী, একটু তরকারি ও মিছরীর গুঁড়া খান। আমি যতদিন আসিয়াছি ততকিন বাবুকে পীড়িত দেখিতেছি। তাঁহার শূল বেদনার মত কি একটা বেদনা মাঝে মাঝে ধরিত, তাহাতে তিনি বড় কাতর হইয়া পড়িতেন। মাসে একবার দুইবার এই বেদনা ধরিত। ঔষধ বার মাসই চলে। বাবু কোনরূপ নেশা করিতেন না। তামাক পর্য্যন্ত সব সময়ে খাইতেন না। যখন শূল বেদনা বাড়িত, তখন সেই সঙ্গে মাথাঘোরা ব্যারাম হইত। পীড়ার যন্ত্রণায় বাবু এক একদিন বলিতেন, “রামফল, আত্মহত্যা করিতে নাই, কিন্তু আমার আর যাতনা সহ্য হয় না।” সে অনেক দিনের অর্থাৎ দুই মাসের কথা। তারপর আর দুইবার সেই রূপ বেদনা ধরে। প্রায় মাসাবধি আর সেই বেদনা ধরে নাই। বাবুর টাকাকড়ি কোথায় থাকে আমি জানি না। তিনি চাকরদের সে সম্বন্ধে বিশ্বাস করিতেন না। গিন্নী মা হয়ত জানেন, তাঁহার চাবি ও টাকাকড়ি কোথায় থাকে। মাসে মাসে কলিকাতা হইতে তাঁহার ডাকে দুই তিন শত টাকা আসে। কখন কখন বা বাবুর এক ভাগনে দেশ হইতে টাকা আনিয়া দিয়া যান। সেই টাকায় শুনিয়াছি সংসার খরচ, চাকর বাকরের মাহিনা প্রভৃতি দেওয়া হয়। টাকাকড়ি বাঁচে কি না তা আমি জানি না। নিজ সম্পত্তি উইল করিয়াছেন কি না, সে খবর আমি রাখি না। চাকর বাকরের সে খবরে কোন দরকার নাই। মাঝে একদিন একজন উকীল বাবু আসিযাছিলেন। তিনি এক দিন এখানে ছিলেন। তাহাতে উইলের কথা শুনিয়াছি। আমার পর, বাবুর ঘরে কাল রাত্রে গিন্নী মা গিয়াছিলেন। তারপর নুরী দাসী বাবুর মশারি ফেলিতে গিয়াচিিল। নুরী ও আমি এক দালানেই শুই। সেই দালান বাবুর কামরার খুব নিকটে। রাত্রে ডাক পড়িলেই আমাদের উঠিতে হয়।”

তার পর নুরী দাসীর জবানবন্দী আরম্ভ হইল। নুরী বলিল, – “আমি বাবুর পশ্চিমে আসা হইতে তাঁর কাছে চাকরী করিতেছি। গৃহিণী ও বাবু আমায় সকল চাকরদের অপেক্ষা স্নেহ করেন। আমি সামান্যা দাসী হইলেও আমার মনিবেরা আমায় সকল চাকরের চেয়ে মাইনে বেশী দেন। গৃহিণীর শরীর সব সময়ে ভাল থাকে না। কাজেই সংসারের সকল কাজ কর্ম্ম আমার হাতে। এত দিন আমি এখানে চাকরি কচ্ছি, কিন্তু মনে হয় না মনিব কখন আমায় তিরস্কার করেছেন কি না! কাল এগারটা রাত্র পর্য্যন্ত আমি তাঁর ঘরে ছিলাম। বাবু রাত্রে কিছু খেতেন না, একটু খানি দুধ তাঁর জন্য ঢাকা দেওয়া থাকত; সেই দুধটা যখন খাবার দরকার হত, তখন গরম করে দেওয়া যেত। কোন দিন গিন্নী মা দিতেন, কোন দিন আমিও দিতেম। কোন দিন বা বাবু দুধ নিয়ে যাওয়া মাত্রই খেতেন। কাল রাত্রে তাই করেছিলেন। চাকরদের মধ্যে আমার উপর তাঁর বেশী বিশ্বাস ছিল; আমায় মাঝে মাঝে সিন্দুকের চাবি খুলতে দিতেন, তবে নিজে বসে থাকতেন। গতরাত্রে আমি সদর ও খিড়কী দরজা পরীক্ষা করে শুয়ে ছিলেম; প্রতিদিনই এরূপ করি। কোন দিন বা আমি করি, কোন দিন বা রামফল করে। কাল আমি শোবা মাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছিলেম। রাত্রে কোন শব্দ শুনি নাই। বাইরের লোকেই অবশ্য খুন করেছে, এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে কি করে সে লোক বাড়ীর ভিতর ঢুকলো তা জানি না।” – ইহার পর নুরী আর কিছু বলিতে পারিল না। চোখে বস্ত্র দিযা কাঁদিতে লাগিল।

নুরীর পর কর্ত্তৃ ঠাকুরাণীর জবানবন্দী হইল। তিনি তখনও ভারি অসুস্থ ও শোকে অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, কাজেই তাঁহাকে আর বেশী কথা জিজ্ঞাসা করা হইল না। এই খানেই জবানবন্দী শেষ হইল; দারোগা সাহেব বিদায় হইলেন।

দারোগার কথা

খুনের তদারক করিয়া আসিলাম বটে, কিন্তু খটকা ভাঙ্গিল না। এমন কোন প্রমাণ পাইলাম না যাহাতে খুনীর কিনারা হয়। সদরে রিপোর্ট করিলাম। হুকুম আসিল, যে রূপেই হউক অপরাধীকে হাজীর করান চাই। আমার ত দিন আর কাটেনা; মনে বড়ই দুর্ভাবনা হইল।

কিন্তু দয়াময় ঈশ্বর – যিনি অপরাধীর গুপ্ত অপরাধের সকল কার্য্যই দেখিতে পান, এক দিন তাঁহার করুণা অদ্ভুত উপায়ে দেখিতে পাইলাম। যে খুনের কিনারা করিতে আমি কেন, আমা অপেক্ষা অধি তীক্ষ্ণবুদ্ধি কর্ম্মচারিও সফল হইতে পারিতেন না, আশ্চর্য্য উপায়ে আমি তাহার গূঢ় রহস্য ভেদ করিলাম।

বাবুর মৃত্যুর পর তাঁহার পরিবারবর্গ দেশে চলিয়া গিয়াছেন। চাকর বাকরদের জবাব হইয়াছে, একথাও শুনিয়াছি। একদিন একটু কাজ পড়াতে আমায় দানাপুরে যাইতে হইয়াছিল। কাজ সারিয়া আমি কাশীর গাড়ির অপেক্ষায় ষ্টেশনে আসিলাম।

ষ্টেশনের টিকিট ঘরের কাচে অনেক লোক ভিড় করিতেছে। কেহবা টিকিট কিনিতেছে, কেহবা পয়সা গুনিতেছে, কেহ বা গাঁটরী বাঁধিতেছে, কেহবা তামাকু খাইতেছে, কেহ বা খালি ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি লাগাইয়াছে।

আমি সেই জনতার পাশ কাটাইয়া যাইবার সময় দেখিলাম, নুরী দাসী একটা জোয়ান বদখত চেহারার হিন্দুস্থানীর সহিত টিকিটঘরের পাশের একটা কামরার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কি ফিস ফিস করিতেছে। কোন লোককে সেই দিকে আসিতে দেখিলেই সে কথাবার্ত্তা বন্ধ করিতেছে। বলিতে পারিনা কি কারণে তাহার উপর আমার বড় সন্দেহ জন্মিল। তাহাদের অবস্থা দেখিয়া বুঝিলাম, কলিকাতায় যাইবার জন্য তাহারা গাড়ির অপেক্ষা করিতেছে। আমি আর তাহাদের দেখা না দিয়া অলক্ষ্যে সঙ্গ লইলাম।

গাড়ি আসিল – গাড়ি ছড়িল। সময় ও রেলের গাড়ি কাহারও মুখ চাহিয়া থাকে না। আমরা গাড়িতে উঠিয়াছিলাম প্রায় ৫১১টা বেলার সময়ে। গাড়ি যখন মোকামা ছাড়াইল, তখন মধ্য রাত্রি অতীত হইয়া গিয়াছে। আমি যে কামরায় ছিলাম, তাহার পাশের বেঞ্চিতেই নুরী ও তাহার সঙ্গীটি বসিয়াছিল।

ঘটনাক্রমে তাহাদের গাড়ি খালি হইয়া পড়িল, কেবল তাহারা দুইজনেই সেখানে বসিয়া। আমার চোখে একটা নীল রঙ্গের চসমা ছিল। কৃত্রিম দাড়িও সঙ্গে ছিল, তাহাও পরিয়া লইলাম। তখন আমাকে কোন প্রকারে চিনিতে পারা তাহাদের কথা দূরে থাক, যাঁহারা অষ্ট প্রহর আমার সঙ্গে থাকিতেন, তাঁহাদেরও অসাধ্য হইত।

আমি বেঞ্চের উপর বিছানা করিয়া শুইলাম। আমার গাড়িও জনশূন্য। তাহাদের গাড়িও তাই নুরী একবার উঠিয়া দাঁড়াইয়া চারিদিক দেখিল, একবার আলস্য ভাঙ্গিয়া হাই তুলিয়া আবার বেঞ্চের উপর বসিল। অমি ঘুমাইতেছি কিনা তাহাও একবার রেলিং এর মধ্যে মুখ দিয়া দেখিল।

আমি কপট নিদ্রায় অভিভূত। না জানি আজ কাহার মুখ দেখিয়া বাটীর বাহির হইয়াছি। যে ঘটনার অনুসন্ধানের জন্য এত করিয়া মাথা ঘামাইতেছি, এত জোগাড়যন্ত্র করিয়াছি, কতদিন রাত্রে ঘুমাইতে পারি নাই, আজ হয়ত তাহার কোন সুরাহা হইবে, এই ভাবিয়া আমি কপট নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতে লাগিলাম।

নুরী প্রথম কথা কহিল। কথাবার্ত্তা হিন্দিতে হইতেছে। নুরী বলিল, “দেখ শিউরাজ! আমার মনে ভাই বড় ভয় হইতেছি। আমি তোর কথায় কলিকাতায় যাইতেছি বটে, কিন্তু আমার মনে যেন কি একটা সন্দেহ ঘুরিতেছে। তোর যন্ত্রণায় ভুলিয়া আমি না করিয়াছি কি? কতদিন ধরিয়া তুই আমায় এই দুষ্কর্ম্মের জন্য ফুসলাইতেছিস, কিন্তু আমি কিছুতেই গা দিই নাই। তখনও আমার ধর্ম্মভয় ছিল। যাই হক, আমি বলি, কলিকাতায় গিয়া কাজ নাই। আজ চল বৈদ্যনাথে নামিয়া পড়ি, কাল দুজনে দেশে ফিরিয়া যাইব। যাহা হইয়াছে, তাহাতে বেশ দুজনের চলিবে। দেশে চাষ বাস করিলে কেহ কোন সন্দেহ করিতে পারিবে না।”

সেই দুরন্ত চেহারা হিনুস্থানীটা বলিল – “দেখ নুরী তুই বড় বোকা। তোর ও রামফলের পেছনে এখনও পুলিশ লাগিয়া রহিয়াছে। যেখানে যাসনা কেন তুই, তোর নিস্তার নাই। তোর হৃদয় দিন দিন সাহস হারাইতেছে। কোন দিন তুই কি করিবি কিছুই জানি না। আমার কথা শোন, রামফল দেশে চলিয়া গিয়াছে, তুই আমার সঙ্গে কলিকাতায় চল। সেখানে বড়বাজারে আমার আয়ি থাকে, সেখানে দুজন বেশ থাকিব।”

নুরী কিছুক্ষণ ভাবিল, পরে ধীরে উত্তর করিল, “আচ্ছা! যখন তোর কথা শুনিয়া এত দূর করিয়াছি তখন শেষও তোর কথা মতে চলিব। যা থাকে অদৃষ্টে! কিন্তু দঙ্খ শিউরাজ, টাকাগুলি কিন্তু আমার কাছে থাকিবে। তোকে আমার অধীন হইয়া চলিতে হইবে।”

শিউরাজ বলিল – “টাকা তোর কাছে থাকিয়া কি হইবে? মেয়ে মানুষের কাছে অত টাকা থাকিলে লোকে সন্দেহ করিবে। টাকা এখনও আমার কাছে, তখনও আমার কাছে। যা বলি নুরী, কেবল তোর ভালর জন্যে। আমার কথা শুনিস, আমার কথায় অমত করিলেই তুই টুস্‌ করিয়া মারা পড়িবি।”

টাকার বন্দোবস্তে নুরী কিছু বেশী উত্তেজিত হইয়া উঠিল, বলিল – “না-না- তা হইবেনা। আমি এত কষ্ট করিলাম অতবড় একটা দুষ্কর্ম করিলাম, কিন্তু তার ফলভোগী তুই কেন হইবে? আমি যদি টাকা জোগাড় করিতে পারি, তবে তাহা কি রাখিবার ক্ষমতা আমার নাই? টাকা কড়ি আমার আমার কাছে দে। তোর উপর আমার সন্দেহ হইতেছে।”

“মর পাজি মাগি? তোর কি কিছু বুদ্ধি নাই? যদি অমনতর ব্যবহার করিস, তবে এখনই তোকে পুলিসে ধরাইয়া দিব।” –

“পুলিশে ধরাইয়া দিব” কথাটায় নুরী বড় জ্বলিয়া উঠিল। সে একটু স্বর উঁচু করিয়া বলিল, “বটে! বটে! বুঝি সেই মতলব আঁটিয়া টাকা গুলি হাত করিয়া বসিয়াছ! খুনে! দাগাবাজ! তোমায় ধরাইয়া দিতে কতক্ষণ! পুলিসের চক্ষে তো আমি খালাস! তোর সেই জুতা এখনও আমার হাতে, সেই বাড়ীর সেই আলমারির নীচে লুকান আছে। পাজি বেইমান যদি কিছু বাড়াবাড়ি করিস, আমার টাকা না দিস, তবে এখনি তোকে ধরাইয়া দিব।”

এমন সময়ে আমি কপট নিদ্রভঙ্গ করিযা উঠিয়া বসিলাম। মনে মনে ভগবানকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম। এত দিন যাহার জন্য ঘুরিয়াছি, আজ তাহার অনুসন্ধান হইল, এই ভাবিয়া আমার মন আনন্দে নাচিতে লাগিল। কিন্তু তখন আনন্দ করিবার সময় নহে। কি করিলে ইহাদের আয়ত্ত করা যায় তাহার উপায় ভাবিলাম। আমাকে উঠিতে দেহিয়া তাহারা দুজনেই কথা বন্ধ করিল। একেবারে চুপ – একেবারে মুখের আশ্চর্য্য ভাব পরিবর্ত্তন, যেন কোন কিছুই ঘটে নাই। আমি তাহাদের এই চাতুরী দেখিয়া মনে মনে হাসিলাম।

গাড়ি গিধোড় ছাড়াইল। নওয়াদিতে আসিল। নওয়াদিতে নামিয়া বৈদ্যনাথের একখানা টেলিগ্রাম করিলাম – “যেন স্টেসনে – প্লাটফর্মে – চারিজন পুলিস প্রহরী প্রস্তুত থাকে।”

কিন্তু গাড়িতে উঠিয়া দেখি সর্ব্বনাশ! তাহারা দুইজনেই নামিয়া গিয়ছে। আমার সকল আনন্দ তখনই ঘোর নিরানন্দে পরিণত হইল। কেন টেলিগ্রাম করিতে নামিয়াছিলাম ভাবিয়া আপনাকে শত শত ধিক্কার দিতে লাগিলাম। নিজের বুদ্ধির দোষে সব নষ্ট করিলাম ভাবিয়া বড়ই আপশোষ হইল।

আমি বিদ্যুৎ গতিতে সকল গাড়িগুলি দেখিলাম। শেষে দেখি, এক খানি মেয়ে গাড়িতে নুরী উঠিয়া বসিয়াছে ও তাহার পাশের গাড়িতে সেই শিউরাজ! এবারে আমি খুব সাবধানে তাহাদের সঙ্গ লইলাম। তাহারা আমায় আর দেখিতে পাইল না, কিন্তু আমি তাহাদের সব দেখিতে লাগিলাম।

গাড়ি যখন বৈদ্যনাথে আসিল, তখন সকাল হইয়াছে। প্রভাতের স্নিগ্ধ বাতাস বড়ই মধুর ভাবে বহিতেছে। সমস্ত রাত্রি জাগিয়াছি, প্রভাতের সেই স্নিগ্ধ বায়ু কাজেই বড় ভাল লাগিল।

প্লাটফরমে নামিয়াই দেখি, হেড কনষ্টেবল ৮ জন পাহারাওয়ালা লইয়া আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। আমি ষ্টেসন মাষ্টারের ঘরে গেলাম, তাহাকে আমার পুলিসের চিহ্ন দেখাইয়া বলিলাম, “যতক্ষণ না আমার আসামী গ্রেপ্তার হয়, ততক্ষণ যেন গাড়ি না ছাড়ে।”

ষ্টেসন মাষ্টার, ষ্টেসনের পুলিস ও আমার নিজের চারি জন পাহারাওয়ালা লইয়া, আম সেই জানানা গাড়ির নিকটে গেলাম। নুরীকে বলিলাম, “তুমি বাহিরে আইস?”

শিউরাজ ও নুরী সমস্ত ঘটনা বুঝিতে পারিল। আমার তখন আর দাড়িও নাই সে চসমাও নাই। নূরী আমায় চিনিতে পারিয়া শিহরিয়া উঠিল।

দেখিলাম – শিউরাজ এই অবসরে পলাইবার চেষ্টা করিতেছে।

আমি বলিলাম – “খবরদার” – সে থমকিয়া দাঁড়াইল। কনষ্টেবলদের বলিলাম, “ইহাদের হাতকড়ি লাগাও” তাহা হইল।

ষ্টেসন লোকে লোকারণ্য। সকলেই হাঁ করিয়া এই দুজনের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহাদিগকে গাড়ি করিয়া পুলিস ষ্টেসনে পাঠাইয়া দিলাম।

শেষ

আদালতে মকর্দ্দমা হইয়া গিয়াছে। আমাদের পাঠকবর্গ হয়ত তাহার কি ফল হইল তাহা জানিতে উৎসুক। নুরী ও শিউরাজ উভয়ের মধ্যে কে দোষী তাহাও জানিতে তাঁহার কৌতূহলী। আমি নীচে নুরীর আদালতের জবানবন্দীর খানিকটা তুলিয়া দিলাম।

“আমি স্বীকার করিতেছি, আমি সম্পূর্ণরূপের আমার প্রভুকে হত্যা করিবার পাপে লিপ্ত। শিউরাজ আমার দেশের লোক, সম্বন্ধে ভগিনী পতি। তাহার প্রলোভনে পড়িয়া আমি আমার প্রভুকে হত্যা করিবার জন্য সহায়তা করিয়াছি। শিউরাজ প্রথম রাত্রে নিজের হাতে তাঁহাকে হত্যা করিতে যায়, আমি দিই নাই; তারপর দ্বিতীয় বারে তাহার উত্তেজনাতে আমি নিজ হস্তে প্রভুহত্যা করিয়া তাঁহার আলমারির চোরা কুঠরী হইতে নগদ সাতশত টাকা অপহরণ করিয়াছি। আদালতের বিচারে আমার ফাঁসী হয়, এই প্রার্থনা।”

নুরী ও শিউরাজের ফাঁসী হইল না বটে, কিন্তু যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আজ্ঞা হইল।

হরিসাধন মুখোপাধ্যায় (১৮৬২-১৯৩৮) সাহিত্যিক। ১৬ আগস্ট ১৮৬২ সালে কলকাতার খিদিরপুরের ভূকৈলাসে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ রাজেন্দ্র বিদ্যাবাগীশ একজন ব্রহ্মদেশপূজ্য নৈয়ায়িক পন্ডিত ছিলেন। তিনি নদীয়াধিপত্য মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিশিষ্ট সভাসদ ছিলেন। হরিসাধনের পিতৃদেব গিরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আদিনিবাস শান্তিপুর ত্যাগ করে কাজের সুবাদে কলকাতার ভূকৈলাসে বাড়ি নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

১৮৭৫ সালের নভেম্বর মাসে হরিসাধন খিদিরপুর-স্কুল হতে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি লাভ করেন। ওই সময়ে তার বিয়ে হয়। ১৮৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি হেয়ার স্কুল হতে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। তিনি এলএ পড়ার জন্য প্রথমে ডভ্টন কলেজে স্বল্পসময় অধ্যয়ন করেন। পরে সিটি কলেজে তাঁর কলেজ জীবনের অবসান হয়। তিনি প্রায় ৩৫ বৎসর সরকারি চাকরি করে ১৯১৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

হরিসাধনের ২৩ বৎসর বয়সে অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত উচ্চমানের মাসিকপত্র নবজীবন এ তাঁর প্রথম রচনা ‘প্রাচীন কলিকাতা’ ছাপা হয়। লেখাটি বাংলা ১২৯১ সনের ফাল্গুন-সংখ্যায় প্রথম প্রবন্ধরূপে মুদ্রিত হয়। এর পূর্বে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের জামাতা প্রচার পত্রিকার সম্পাদক রাখালচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসেন। হরিসাধনের দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ‘ধ্বংসতরু’ নামে প্রকাশিত হয়। এ ধ্বংসতরু যেখানে ছিল, লর্ড কার্জন সে স্থানটি Duel Avenue বলে চিহ্নিত করে গেছেন। উক্ত প্রবন্ধটি পাঠ করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ভুয়সী প্রশংসা করে বললেন-‘‘তোমার লেখায় বেশ Research আছে’’। পরে ওই প্রবন্ধটি পরিবর্তিতরূপে স্বর্ণকুমারী দেবীর ভারতী-তে প্রকাশিত হয়। বাংলা ১২৯২ সন হতে হরিসাধনের রচনা স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত ভারতী ও বালকে নিয়মিত ছাপা হতো। তাছাড়া ভ্রমর, সাহিত্য, সাধনা, প্রদীপ, ঐতিহাসিক চিত্র প্রবাসী, ভারতবর্ষ, জাহ্নবী, অর্চ্চনা, মানসী, বসুধা প্রভৃতি মাসিকপত্রে তাঁর রচনা ছাপা হতো।

দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে হরিসাধন পঞ্চাশটি উপন্যাস, তিনটি নাটক, কলকাতার ইতিহাসবিষয়ক সহস্রাধিক পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ এবং অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: পঞ্চপুষ্প (১৮৯২), শীশ্ মহল (১৯১২), ছায়াচিত্র (১৯০১), রঙ্গমহাল (১৯০১), নূরমহল (১৯১৩), রঙ্গমহল রহস্য (১৯১৪), কলিকাতা-সেকালের ও একালের (১৯১৫), সতীলক্ষ্মী (১৯১৫), সুবর্ণ-প্রতীমা (১৯১৬), লাল-চিঠি (১৯১৬), কঙ্কণ-চোর (১৯১৬), মৃত্যু-প্রহেলিকা (১৯১৭), স্বর্ণ-প্রতিমা (১৯১৭), মরণের পরে (১৯১৭), কমলার অদৃষ্ট (১৯১৭), শাহজাদা খসরু (১৯১৮), শয়তানের দান (১৯১৯), সতীর সিন্দুর (১৯২০), ঔরঙ্গজেব (১৯০৪), বঙ্গবিক্রম (১৯০৬)। তাঁর ঐতিহাসিক নাটক বঙ্গবিক্রম ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হয়ে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। তাঁর মৃত্যু ২০ এপ্রিল, ১৯৩৮।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *