আশা

আশা

ভবানীপুরে, যেখানে বেগমত্ত বিক্ষুব্ধ কলকাতা নিজেকে ভুলে একটু নিরিবিলিতে অলসতার আমেজে গা ঢেলে পড়ে আছে। এখানে তার কাজ নেই মোটেই। আর চিন্তা? হ্যাঁ, তা একটু আছে বটে; তবে তার সমস্তটাই অকাজের। সে যেন বিশ্বকর্মার কারখানা পলাতক মজুর, এখানে তার গোপন সখী প্রকৃতির সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যত সব অ-দরকারের আলোচনায় লেগে গেছে।

রোগের পর আরোগ্যের অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শে এখানে এসে একটি বাড়ি ভাড়া করে আছি। ডাক্তার-বন্ধু বললেন, ভবানীপুরেই চল; সেখানে আলো-বাতাস সহজেই পাবে, যা তোমার এখন দরকার। ওখানে আকাশের নীল আর পৃথিবীর সবুজের রঙ-করা ছোট ছোট বাড়িগুলো প্রকৃতির আলোবাতাসের স্পর্শ যেন অযাচিত ভাবেই পায়, নতুন শিশু যেমন মায়ের সোহাগ পায় আর কি। তোমার কলকাতার মত নয় এখানে ধেড়ে ধেড়ে উৎকট বাড়িগুলা পাকা বিষয়ী ছেলেদের মত সেই আলোবাতাস নিয়ে কাড়াকাড়ি ভাগাভাগি লাগিয়ে গিয়েছে। ওরা ও দুটোকে সম্পত্তি বলে টের পেয়েছে কি না, আর রক্ষে আছে!

বাড়ি নিয়েছি শ্রীনিবাস রোডে। ঠিক রোড নয়, তবে গলিও নয় একেবারে। লাল সুরকির রাস্তা নিজের ইচ্ছামত এঁকেবেঁকে গেছে, জিওমেট্রির কোনও কড়া আইনের গোলাম নয়। ফুটপাথ আছে কি না আছে, অর্থাৎ পথিকদের মধ্যে গতির উগ্রতা কি লঘুতা নিয়ে যে বিরোধ এবং তার চুক্তি, এখানে তার কোন নিশানা নেই। মোটেরই হোক, গাড়িতেই হোক, কিংবা পায়ে হেঁটেই হোক, সবাই নিরুদ্বেগ গতিতে নিজের কাজে-অকাজে ওই লাল রাস্তাটুকু দিয়েই যাতায়াত করে। ফুটপাথ যেখানে আছে বা ঘাসে ভরা, যেন অবসরের তৃপ্তি।

বিশ্বকর্মার কারখানার পেয়াদা তার লোক-লস্কর নিয়ে পলাতক মজুরের সন্ধানে ভবানীপুরে প্রবেশ করেছে বটে রসা রোড দিয়ে; কিন্তু এদিকটা খুব তফাতে আছে; তার তাগিদের কর্কশ হুঙ্কার এখানে মোটেই পৌঁছয় না।

বাড়িটা দোতলা। ওপরে ছোট-বড় দুটি ঘর, ডাক্তারে আমাতে পাশাপাশি থাকি। দিনটা প্রায় একলাই কাটে, ডাক্তার যান ‘কলে’। একদিন বললেন, তুমি সমস্ত দিন বড় নিঃসঙ্গ থাক, হাতের কেসগুলো গেলে আর নিচ্ছি না।

বললাম, না, এই চলতি পসারের সময় ছেলেমানুষি নয়। আমি খাসা আছি। এই ছোট্ট পল্লীটিতে অল্পস্বল্প যা কিছুই পাচ্ছি, সেটুকুর মধ্যেই বেশ একটু পরিপূর্ণতা আছে। সুতরাং তুমি নিশ্চিন্ত থাক।

দুপুরে যখন চারিদিকে চুপচাপ, আমি দিব্যি গা এলিয়ে পড়ে থাকি। স্তব্ধ প্রকৃতি তার অপলক দৃষ্টি আমার নিশ্চেষ্ট চোখ দুটির ওপর ফেলে রাখে, ভাবের ব্যাকুলতায় সে যে কি গভীর! কোন মূক নারীকে একঠায় আবিষ্ট হয়ে ব’সে থাকতে দেখেছ কখনও? তা হ’লে অনেকটা বুঝতে পারবে।

দুপুরে যায়। বিকেলে পল্লীটাতে যখন একটু সজীবতা ফিরে আসে আমার মনটা পশ্চিম দিকের প’ড়ো জমিটার ওধারে ওই বাড়িটায় গিয়ে গুটিয়ে বসে। ওটি যেন ভবানীপুরের মধ্যেও ভবানীপুর। এসে পর্যন্ত ওর একটা স্বর শুনেছ? দোর-জানালা বন্ধ করে নিজের স্নিগ্ধতার মধ্যে ডুবে রয়েছে। আমি ওটির ভক্ত হয়ে পড়েছি।

বন্ধু হেসে বললেন, ভক্তি তোমার উড়ে যায়, যদি বাড়িটার সম্বন্ধে আমাদের মালীর মতামতটা শোন।

জিজ্ঞাসা করলাম, কি রকম?

মালীর মতে ওটা এই পাঁচ-ছ বছর থেকে ‘তানাদের নীলেভূমি’ হয়ে রয়েছে। সহজ মানুষ ওখানে আমল পায় না। তানাদের মানে, তোমাদের শুদ্ধ ভাষায় যাদের বল অশরীরী আত্মা তাঁদের, গঞ্জিকার ধুমে যাঁদের জন্ম আর কি। তারপর? দুপুর হ’ল, বিকেল হ’ল—

অন্যমনস্কভাবে বললাম, হানাবাড়ি? যাক, সন্ধের একটু পরে দুটি স্বরের লহরী ওঠে—দূরের ওই বাড়িটাতে একটি মেয়ে গান করে, আর দক্ষিণের ওই হলদে বাড়িটাতে কে ক্ল্যারিওনেট শেখে। তুমি হাসলে বটে, কিন্তু এ নিস্তব্ধতার পটভূমিতে সেই সুরের ছন্দ আর বেসুরে তাণ্ডব মিলে যে কি একটা মায়া রচনা করে, তা যদি তোমায় বোঝাতে পারতাম—

বন্ধু ভীতির অভিনয় করে বললেন, একটা জিনিস বুঝেছি, সেটা এই যে, তোমায় একলা ফেলে রাখা আর মোটেই নিরাপদ হচ্ছে না। তোমার কবিতার খাতাটা সঙ্গে আন নি তো?

বললাম, আনলে ‘বিষ’ বলে একটা লেবেল সেঁটে দিতে, এই তো? কথাটা বলে কিন্তু আমাদের এ দেশটার প্রতি বড় অবিচার করলে ডাক্তার। আমার তো মনে হয়, এ দেশের বর্ণ, স্বর, আলো, বাতাস—এসবের মধ্যে এমন একটা কি আছে, যাতে কবি না হয়েই পারা যায় না। অত কথা কি, এ দেশের চিকিৎসকরাও হতেন কবি; শুধু কবি নন—কবিরাজ। তার মানে, তাঁদের শিক্ষা এই প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের একটা নিগূঢ় যোগ ঘটিয়ে দিত। মানুষের প্রাণশক্তিকে সমৃদ্ধ করবার তাঁদের যে প্রচেষ্টা, তা তাঁদের প্রকৃতির মহাপ্রাণের সঙ্গে পরিচিত করে দিত, যে মহাপ্রাণের বিকাশ দেখি, স্বরে, স্তব্ধতায়, আলোয়, আঁধারে; আর জীবে উদ্ভিদে তো বটেই। তাঁরা হতেন ধ্যানী, না হয়ে উপায় ছিল না। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের সম্বন্ধটা ছিল মৈত্রীর। আর তোমাদের শিক্ষাদীক্ষা কাণ্ডকারখানা সব উল্টো। প্রকৃতির প্রতি তোমাদের ভাবটা সশ্রদ্ধ নয়; ছুরি, কাঁচি, ফর্ক, কাঁটা প্রভৃতি যন্ত্রপাতি নিয়ে

বন্ধু হেসে হাতজোড় করে বললেন, হয়েছে, এবার শরসংহার কর।

হেসে চুপ করলাম। একটু ভাবের ঘোরে পড়ে গিয়েছিলাম বটে, তার কারণ এ জায়গাটা আমার লাগছে বড়ই সুন্দর। শুধু কি এ জায়গাটাই? নিজের কাছে নিজেকেও আজকাল বড় মনোরম বলে বোধ হয়। মনে হয়, আমার নবীভূত প্রাণ যেন ধমনীতে ধমনীতে সঞ্চারিত হয়ে সমস্ত বাহু দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরেছে, আমার প্রতি অনুপরমাণুতে তার উষ্ণ আলিঙ্গন অনুভব করি।

এক এক সময় মনে হয় হঠাৎ যেন একটা কূলভাঙা ঢেউ উঠল। আমার প্রাণ তো আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ওই ছুটল ও—সমস্ত জগৎটাকে স্রোতের টানে নাইয়ে ছুটল, ওই আলোর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে কি এক নূতন বর্ণের সুষমা সৃষ্টি করতে করতে ছুটল, জগতের স্বর-লহরের মধ্যে কি এক নূতন সুর ঢেলে দিলে! এত বিচিত্র সৌরভের উৎসই বা ওর মধ্যে কোথায় লুকানো ছিল?

মাধুর্য আরও উগ্র হয়ে পড়ে! কি উন্মত্ত! আমার মধ্যে হঠাৎ এ কি উত্তাপ সৃষ্টি করলে! তারপর, এ কি, সমস্ত পৃথিবীর, ওরই দেওয়া এই নূতন বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শের ওপরে আমার সমস্ত সত্তাকে দ্রবীভূত করে ঢেলে দিলে যে! সুন্দরের অঙ্গে এ কি অভিনব প্রলেপ দিয়ে দিলে!

আমার রুগ্ন দেহের অন্ধকারের মধ্যে আবদ্ধ এই প্রাণ উষার মত রূপসৃষ্টির অফুরন্ত শক্তি নিয়ে জেগে উঠেছে, মনে হচ্ছে যেন তাকে অভিনন্দিত করবার জন্যে একটা বিরাট সমারোহ পড়ে গেছে চারদিকে।

এই ভাবে সৌন্দর্যের সঙ্গমস্রোত বয়ে চলে, স্নান করে ধরণী অপরূপ হয়ে ওঠে।

কোনো কিছুকেই আর তুচ্ছ বলে মনে হয় না, হীরকখণ্ডের মত এই পৃথিবীর প্রতি রেখা অনুরেখা হতে যেন আলোর দীপ্তি ঠিকরে পড়তে থাকে।

শুধু বাইরেই নয়, যখন ঘুমোই, দেখি—এ সৌন্দর্যের আভাস আমার সুপ্তি ভেদ করে স্বপ্নের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে; কিরণ যেন জলের ওপরটা উদ্ভাসিত করে তার নিম্নতল পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

কয়েকদিন পরের কথা।

সেদিন দুপুরের সৌন্দর্য-পিয়ালায় চুমুক দিতে দিতে যখন ঘুমিয়ে পড়লাম, আমার স্বপ্নলোকে সঙ্গে সঙ্গে একটা অপূর্ব মিলন-বাসর জেগে উঠল—রূপে, আলোয়, সঙ্গীতে অনির্বচনীয় হয়ে। সে এক মহা বিস্ময়কর ব্যাপার। ঘুমটা ভেঙে গিয়ে মন যেন বেদনায় আতুর হয়ে উঠল। আমার এ মনে হল না যে কল্পলোক থেকে বাস্তব জীবনে ফিরে এলাম; মনে হল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিবদ্ধ, রসঘন, এই বাস্তবের চেয়ে অতি বাস্তব একটা জীবনে ফিরে এলাম, আমার জাগ্রত চেতনার মধ্যে এখনও তার আলোর আভা লেগে রয়েছে, তার হাসি আর গানের তরঙ্গ আমার অন্তর্চেতনায় দুলে দুলে উঠছে।

এই ঘোরটা বেশিক্ষণ এরকম নিবিড় রইল না। সমৃদ্ধ পৃথিবী আবার তার স্পর্শ দিয়ে আমায় সচেতন করে তোলবার চেষ্টা করতে লাগল—তার প্রাণের উত্তাপের উষ্ম স্পর্শ দিয়ে। জানলার চৌকো প্রেমে বাঁধানো পটভূমি—ওটুকুর মধ্যেই জীবনের কী বিচিত্র স্রোত চলেছে চলচ্চিত্রের খেলার মত। জানলার গায়ে ঝুমকো জবার গোটাকতক ডাল এসে পড়েছে, দুটো ফুল ঝুলে পড়েছে। ছোট একটা কি পাখি–মিশকালো, লম্বা চঞ্চু দুটো তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে এসে বসল—ডালে নয়, পাতায় নয়, জবার একটা বাঁকা পাপড়ির ওপর একেবারে। মাঝে মাঝে সেই তীক্ষ্ণ আওয়াজ—আনন্দের নিখাদ স্বর; একটু ঘাড় নড়ে, সমস্ত জবাটি দুলে ওঠে। দূরে রৌদ্রের দীপ্তিমাখা নীল আকাশ; সাদা বিচ্ছিন্ন মেঘের ছোট- বড় টুকরো সব ভেসে চলেছে। কোনটার কোলে—শ্বেত অঙ্গে তিলের দাগের মত মন্থরগতি একটা চিল। পৃথিবীর কাছাকাছি গতিটা চঞ্চল–গাছের শাখা-পত্রের দোলা, পাখিদের প্রজাপতিদের ব্যস্তভাবে উড়ে বেড়ানো—

সবচেয়ে চঞ্চলতা পড়েছে আমার জানলার ওপর। পাখিটা বুঝি মধুর সন্ধান পেয়েছে, ফুলেতে আর ওতে বেজায় লুকোচুরি কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে।

জায়গাটা নিজের কুহক ছাড়িয়ে আমার স্বপ্নের বেদনাটা মুছিয়ে দিতে চায়। তবু কোথায় যেন একটু অভাব,–বেদনার রেশ আর মিটতে চায় না। এখনও মনে হয় সত্যই কি স্বপ্ন ছিল ওটা?

ঘুমের জড়িমাটা চোখে লেগে রয়েছে, তাতে চেতনা জগতের স্পন্দনের ওপরেও স্বপ্নের কুহেলিকা বিস্তার করেছে; আশা হচ্ছে, এখনই এমন একটা কিছু ঘটবে যাতে স্বপ্ন আর বাস্তব জগতের অন্তরায়টা মিলিয়ে গিয়ে সব একাকার হয়ে উঠবে। মন যেন সে মুহূর্তটার জন্যে মাঝে মাঝে উদগ্র হয়ে উঠছে।

এমন সময় দৈবাৎ আমাদের বাসার পশ্চিম দিকের জনশূন্য বাড়িটার পানে নজর গেল, এবং একটু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, তার ওপরের জানালা দুটো খোলা। আজ দেড় মাসের মধ্যে এই প্রথম।

মনে মনে বললাম, যাক, লোক শেষ পর্যন্ত এল তা হলে!

এ সিদ্ধান্তে একটু বাধা পড়ল, কাশির আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে দেখলাম, ও-বাড়ির বৃদ্ধ মালী ফটকে তালা লাগিয়ে বাইরে যাচ্ছে। ভাবলাম, বাঃ, এ তো মন্দ হল না!

হঠাৎ বন্ধুর কথাটা মনে পড়ে গেল, এবং সেই সঙ্গে এ প্রহেলিকার মধ্যে যেন একটা অর্থ ফুটে উঠল,—একটা আশা। যেন একটা গূঢ়সঙ্কেতে উঠে গিয়ে আমার ঘরের পশ্চিমমুখো জানালার কাছে দাঁড়ালাম। তারপর যা দেখলাম, তাতে সমস্ত শরীরটা যুগপৎ বিস্ময় আর পুলকে কণ্টকিত হয়ে উঠল।

জানালার পথে ঘরে আলো প্রবেশ করেছে। মাঝখানে একটি শুভ্র শয্যা; তার ওপর কে একজন গা ঢেলে শুয়ে আছে। রঙিন শাড়ির নিম্নপ্রান্তের খানিকটা দেখা যায়, তার পাড়ের বেষ্টনীর নীচে দুখানি অলক্তকমাখা চরণ—দুটি আধফোটা রক্তপ্রান্ত পদ্মকোরকের মত গায়ে গায়ে লেগে রয়েছে।

সুপ্ত কার দুখানি অচঞ্চল চরণ, আর কিছু দেখা যায় না। কিন্তু এই আমার সমস্ত অন্তরাত্মাকে নিমেষে অভিভূত করে দিলে। আমার যদি তখন মনে হয়ে থাকে যে, আমার ধ্যানের দেব—আমার স্বপ্নের মায়াপুরিকা মূর্তি পরিগ্রহ করে নেমে এসেছে—শুধু আমারই সোনার কাঠির স্পর্শটুকুর অপেক্ষা, তো তাতে কিছু আশ্চর্য হবার নেই। আর কোন সময়ে এবং অন্য কোন বাড়িতে এ সামান্য দৃশ্যটুকুর মধ্যে কিছু নূতনত্ব পাওয়া যেত না; কিন্তু ভবানীপুরে, সেই নিঝুম দুপুরে, সেই পরিপাটি, সুবিন্যস্ত অথচ বিসদৃশভাবে জনহীন বাড়ির শুধু একটিমাত্র ঘরে নিদ্রিত নারীর সেরূপ হঠাৎ আবির্ভাব, এতে আর অন্য রকম ধারণার অবসরই ছিল না—বিশেষ করে আমার রোগমুক্ত মনের সে সময়ের অবস্থায়।

মাথার মধ্যে বন্ধুর ঠাট্টাচ্ছলে বলা কথাটাও ঘনিয়ে ঘনিয়ে উঠছিল,—মালীর মতে ওটা ‘তানাদের নীলেভূমি’, যাদের বল—অশরীরী আত্মা, তাঁদের।

সকলের ওপরে ছিল বোধ হয় ও-বাড়ির মালীর ওরকম নির্লিপ্তভাবে ফটক বন্ধ করে চলে যাওয়া; যাতে করে মনে হল, তার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারেই বাড়িটার মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে চলেছে। প্রদীপের যাদুবলে রাজকন্যার শয্যা যে সুরক্ষিত রাজপুরীর মধ্যে থেকে উঠে গিয়ে অন্যত্র দাখিল হত, এ ঘটনাটি যেন ঠিক তারই সগোত্র।

নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইলাম। ক্রমে আমার সমস্ত শরীর মন যেন একটিমাত্র সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় রূপায়িত হয়ে উঠল। রাস্তা দিয়ে তীক্ষ্ণ হর্ণ দিয়ে একটা মোটরগাড়ি চলে গেল। পাশের বাড়ির ঝি খুব আড়ম্বরের সঙ্গে বাসন মাজতে শুরু করে দিয়েছে। পরিচিত সেই শিক্ষানবিশের ক্ল্যারিওনেটের কল্লোল উঠল আজ অসময়েই। ভবানীপুর আমায় এই যুগ এবং এই পৃথিবীর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে অশেষ চেষ্টা করতে লাগল। কানে যাচ্ছিল সব, কিন্তু ওই দুখানি ক্ষুদ্র চরণ যুগাতীত লোকাতীত কি এক মোহ বিস্তার করে আমায় অমোঘ আকর্ষণে সব থেকে টেনে নিতে লাগল।

কোথায় গিয়ে দাঁড়ালে আমার ছায়াময়ী মোহিনীকে সমগ্রভাবে দেখা যায়, নির্ণয় করবার জন্যে চটিজুতোটা পায়ে দিয়ে উঠতে যাবো, এমন সময় বন্ধুবর এসে উপস্থিত। হাতে একটা স্টেটসম্যান, বললেন, ওহে, ওদিকে আফগানিস্তানের খবর যে গুরুতর হয়ে উঠল, বাচ্চা-ই-সাক্কাও—ও কি! আজ তোমার স্তব্ধপুরীর জানালা খোলা যে! যাক, বাঁচা গেল; তবে লোক এসেছে! কি জান? লোক নেই, জন নেই, অথচ সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে রয়েছে, এ রকম বাড়ি যত সব কুসংস্কারের জন্মদাতা। আমি ওই নিয়ে আজকাল একটু মাথা ঘামাচ্ছি কিনা। সেদিন বললাম না তোমায় মালীর কথাটা?

বন্ধুর সেদিন অবসর ছিল, বিকাল পর্যন্ত নানারকম গল্প চলল। দিন বুঝেই কি অবসর হতে হয়?

কয়েকদিন একলা আছি। ডাক্তার দূর মফঃস্বলে একটা ‘কলে’ গেছেন।

.

একলা আছি শরীরে, মনটা একটা অপূর্ব রাজ্যে বিচরণ করছে। সে রাজ্যের সৃষ্টিকেন্দ্র দুখানি চরণ, কিন্তু সেই অল্পকেই আশ্রয় করে কত হাসিকান্না ভাঙা-গড়ার লীলা দিনরাত বয়ে চলেছে!

রজনী আমার কোন এক বিচিত্র প্রবাস-বিলাসে কাটে। ভোরে জাগরণের সঙ্গে যখন ফিরে আসি, দেখি জানালা-দুয়ার সব বন্ধ,—এই রহস্যপুরীতে প্রবেশের আবেদন নিয়ে দিনের আলো বাইরে অপেক্ষা করছে। আমি ব্যাকুল উদ্বেগ নিয়ে চেয়ে থাকি, আশা হয়, এই এখনই জানালা মুক্ত হবে, দুখানি ভুজবল্লরী জানালার পল্লব দুটিকে মুক্ত করতে করতে আলিঙ্গনের আকারে প্রসারিত হয়ে পড়বে, আর বাইরে অপেক্ষমান পৃথিবীর আলো, বাতাস, আকাঙ্ক্ষা তার পূর্ণ অঙ্গের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে—যে বর-অঙ্গের আভাস দুখানি রাতুল চরণে পাওয়া গেছে।

জানালা কিন্তু মুক্ত হয় না। বাড়িও থাকে নিস্তব্ধ, নির্জন, এক সেই বৃদ্ধা মালী ছাড়া। ঘনপল্লবিত বৃক্ষলতার মধ্যে মাঝে মাঝে তাকে এখানে সেখানে দেখা যায়—শীর্ণ, পলিত- কেশ—মনে হয়, যেন হাওয়ার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠে আবার মিলিয়ে গেল।

দুপুরে উঠে দেখি, পরিচিত জানলাটি খুলে গেছে, শুভ্র দেওয়াল থেকে ঠিকরে পালঙ্কের পাশতলায় এক ঝলক আলো পড়েছে, আর অনবদ্য সেই দুখানি চরণ—

অসহ্য হয়ে উঠেছে। বেশ বুঝতে পারছি, রহস্যের গুরুভারটা আমার সুখের মধ্যেও ক্লান্তি এনে দিয়েছে। এক এক সময় মনটা বন্ধুর জন্যে বড় অধীর হয়ে পড়ে,—সে এসে তার হাসিঠাট্টা দিয়ে, তার কল্পনাবিমুখ সুস্থ মনের স্পর্শ দিয়ে আমায় তাদের স্থূল সুনির্দিষ্ট জগতে ফিরিয়ে নিক। আমি কল্পনার ঢেউয়ের দোলায় পরিশ্রান্ত হয়েছি, কঠিন মাটির স্পর্শ চাই।

মনে প’ড়ে গেল, আমাদের মালী তো আসল কথাটা জানে। তাকে ডাক দিলাম।

ডেকেই কিন্তু মনে হ’ল, নাঃ, পরের বাড়ি নিয়ে আলোচনা করাটা, বিশেষ ক’রে চাকরের সঙ্গে, আরও বিশেষ ক’রে আমাদের বয়সের সঙ্গে যখন একটা রহস্য জড়িত রয়েছে—

মালী এলে বললাম, হ্যাঁ, ওর নাম কি, ডাক্তারবাবু কবে আসবেন ব’লে গেছেন?

মালী আমার দিকে স্থিরনেত্রে ক্ষণকাল চেয়ে বললে, সেদিনকে আমি তো ছেলাম না বাবু, ঠাকুর জানে, তাকে ডেকে দি গা? আর, আপনাকে ব’লে যান নি বাবু?

বুঝলাম, প্রশ্নটা বেখাপ্পা হয়ে গেছে, বললাম, বলেছিল আমায়, তবে দেরি হয়ে যাচ্ছে কেন বুঝছি না। দে তো ঠাকুরকে একবার ডেকে।

মালী হঠাৎ পশ্চিমের জানালাটার দিকে একটু চেয়ে বললে, ওটা ভেজায়ে দি বাবু, রোদ আসবার লাগছে, জষ্টির কড়া রোদ আপনার লেগে মোটেই ভাল নয়।

পরের দিন বন্ধু এলেন—দুপুরবেলা, আমি তখন ঘুমুচ্ছিলাম। জাগিয়ে, একথা সে কথার পর বললেন, হ্যাঁ, তোমার নামে এসেই যে এক গুরুতর অপরাধের নালিশ!

বললাম, যথা?

তুমি নাকি পশ্চিম দিকের জানালাটা খুলে রাখ? জান না? এ বয়সের মনডা লোতুন উড়ুখ্যু পাখির পারা—জালও চেনে না, ফাঁসও চেনে না।

ভাষাটা মালীর বুঝে হেসে বললাম, কেন, আমার পাখি তো পিঁজরের মধ্যে বেশ লক্ষ্মীটি হয়ে ব’সে আছে ব’লেই জানি।

ব্যাপারটা বন্ধু সবিস্তারে বললেন, মোটর থেকে নামতেই মালী বিষণ্ণবদনে এসে একটি সেলাম ঠুকে তো দাঁড়াল। একটু ভীত হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, কি রে, খবর ভাল তো?

মালী মাটির দিকে দৃষ্টি নামিয়ে ডাইনে বাঁয়ে শুধু ঘাড় নাড়লে। বলতে কি, আমার শরীরটা হিম হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করলাম, কেন, বাবু ভাল আছে তো?

মালী তেমনই ভাবে বললে, শরীরে তো ভালই আছেন, কিন্তু আমরা না হয় মুরুখ্য- সুরুখ্য লোক, আপনি তো ডাক্তারবাবু। বলি আগে মন, পরে শরীল?

ভরসার নিশ্বাস ছেড়ে বললাম, একশো বার; তা মনই বা ভাল নেই কেন শুনি?

মালী বললে, আপনাকে সেদিন বলতে গেলাম বাবু, তা কথাটা গেরাহ্যির মধ্যে আনলেন না। ও পশ্চিমের বাড়িটা আপনাদের তরে বেলকুলই ভাল নয়, কত লব্য জোয়ানের যে মাথা বিগড়ে একেবারে পাগল করে দিয়েছে বলবার পারি না। ভয়ে ভয়ে আমরা বুড়ারাও ওদিকে লজর করি না; চুপচাপ নিজের কাজটি সেরে ঘরকে যাই। আপনি এই তেতেপুড়ে নামলেন, একটু ঠাণ্ডা হোন গা। মোদ্দা, ওনার লাড়ীটা একবার পরখ করবেন; আর গরিবের আর্জি ওনাকে পশ্চিম দিগের জানলাডা বন্ধ রাখতে বলবেন। কি জানেন বাবু? এ বয়সের মনডা লোতুন উড়ুখ্যু পাখির পারা—জালও চেনে না ফাঁসও চেনে না।

এই তো মালীর অভিযোগ; তোমার পশ্চিম দিকে জানলাও তো খোলা দেখছি, ওদিকে ‘হানাবাড়ির’ জানলাও ঠিক সামনাসামনি খোলা, কোন অলোকসুন্দরীর কুদৃষ্টিতে ঘায়েল হচ্ছ না তো? নাড়ী-টাড়ি হাতড়ে পাব কি?

বন্ধু হাসতে লাগলেন।

অনেক চেষ্টায় মুখের সহজ ভাবটা বজায় রেখে বললাম, কুদৃষ্টি-সুদৃষ্টির খোঁজ রাখি না, তবে আমার নাড়ী বরং বন্ধুবিরহের উদ্বেগে কদিন একটু বেশি রকম চঞ্চল ছিল। তারপর? কেমন ছিলে বল? কই, তোমার এত দেরি হ’ল কেন, বললে না তো? কোন রকম—

কিন্তু বোধ হয় ধরা প’ড়ে গেলাম, সম্ভবত এই চাপা দেওয়ার সবিস্তারে চেষ্টা করতেই ডাক্তারের কৌতূহলটাকে জাগিয়ে তুললাম। তিনি আমার কথাটাই উল্টে নিয়ে আমার ওপর প্রয়োগ করলেন, মুখের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বিস্ময়ের ভান করে বললেন, অ্যাঁ, কি বললে? নাড়ী বেশি রকম চঞ্চল, তবে নির্ঘাত প্রণয়ের চোট, তাতে আর সন্দেহ মাত্র নেই; সে আঘাতে বিদ্যুৎপ্রবাহ থাকে কিনা, চঞ্চলতা আনবেই।

আমি তখনও আত্মগোপনের চেষ্টাটা পরিত্যাগ করলাম না, হেসেই জবাব দিলাম, সত্যি নাকি? তা হলে ওটা তোমাদের ডাক্তারিরই একটা অঙ্গ বল— X’rays battery- গোছের একটা ব্যাপার। এ যুগে নিতান্তই একটা ঘরোয়া জিনিস। তোমরা ‘প্রেম প্রেম’ কর, আমার একটা ভয় ছিল, না জানি বাঘ-ভাল্লুক কি একটা হবে বা।

কথা কি একটু বেশি বলে ফেললাম? বন্ধুর দৃষ্টি আর হাসি দেখলাম আরও ধারালো হয়ে উঠেছে, তাঁর বিশ্লেষণের ছুরির মত। হাসতে হাসতে বললেন, ভয় এবার আমাদের হবার পালা; লক্ষণ তো ভাল বোধ হচ্ছে না।

পরিত্রাণের বৃথা চেষ্টা।

ধরা পড়ে গিয়ে হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে উঠলাম। কেন বলব না? এত গোপনের আয়াস কিসের? যা আমার কাছে দিনের আলোর মত সত্য, তা দিনের আলোর মতই সবার কাছে মুক্ত হয়ে থাক্, এত প্রত্যক্ষ যার চোখে পড়বে না, তার দৃষ্টিশক্তির জন্যেই চিন্তিত হবার কথা।

পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা একসঙ্গে মনে জেগে উঠে সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমার অটল বিশ্বাসের দুর্বার শক্তি নিয়ে আমি যেন বন্ধুর অবিশ্বাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম, বললাম, শোন ডাক্তার, আমি মালী নয়, ওই বাড়িটাতে যে একটা কিছু ব্যাপার হচ্ছে তা তোমায় বিশ্বাস করতেই হবে। আমি স্বচক্ষে দেখেছি—

হাঃহাঃহাঃ—শব্দে চমক ভাঙল। বন্ধু হেসে বললেন, আমার থিওরি, বাড়ি অন্ধ সংস্কার মাথায় ঢোকাবেই। এই দেখ, তোমাকেও পাকড়াও করেছে, শিক্ষাদীক্ষা সব জাহান্নামে গেল। তা হলে মালী বেচারা আর কি দোষ করেছে, বল?

আমার আজ হার, বন্ধুরই জয়, তাঁর ভাষা আমায় বিপন্ন করে তুলেছিল। বলতে লাগলেন, দেখেছ তা হলে? কি দেখলে? কোথাও কিছু নেই, ঘরের মধ্যে এক অনৈসর্গিক আলো ফুটে উঠল, আর দেখতে দেখতে এক অসামান্য সুন্দরী—বল, আমায় একটু এগিয়ে দাও, অকবি মানুষ, তোমাদের ভাষা ধার করেই তো বলতে হবে।

বৃষ্টির ধার প্রবলবেগে নেমে যেমন মাটির স্পর্শমাত্র নিজেই চূর্ণ হয়ে যায়, আমার অত দম্ভের বিশ্বাস যেন তেমনই শতধা খণ্ডিত হয়ে গেল। আমি নিতান্ত অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিলাম। নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে বললাম, আঃ, কি আপদ! সবটা শোনই না আগে, দেখেছি কেউ ও বাড়িটার কাছে ঘেঁষতে চায় না।

বন্ধু বললেন, কিন্তু সেটা কি একটা প্রমাণ? দেখ বন্ধু, বিধাতা দুনিয়াটাকে এমন ঠেসে বাজে জিনিস দিয়ে ভরাট করে দিয়েছেন যে, ওসবের জন্যে আর জায়গা নেই। ভুল করে ফেলেছেন নিশ্চয়, কিন্তু আর উপায় নেই তাঁর। ব’স, ধড়াচূড়ো ছেড়ে আসি; নালিশের বিচার অসম্পূর্ণ রইল।

.

সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে।

বাগানে একটা ক্যাম্প-চেয়ারে বসে ছিলাম। ডাক্তার অনেক পূর্বে কোথায় বেরিয়ে গেছেন।

আজ বিরুদ্ধমুখী চিন্তায় আমায় অবসন্ন করে ফেলেছে।

ডাক্তারের কল্পনাবিমুখ, সুস্থ মনের স্পর্শ চেয়েছিলাম, তা পেয়েছি। কিন্তু তার এই শক্তি থেকে জোর পেয়ে আমি যতই আমার অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি থেকে কল্পনার অংশটা ঠেলে ফেলবার চেষ্টা করছি, ততই সেটা ঘনীভূত অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে, আজ যেন কাকে বিদায় দিতে বসেছি। আমার রোগ, আমার আরোগ্য সমস্তই তারই বিধান, এই সবের মধ্য দিয়ে সে আমায় তার নিজের কাছে আকর্ষণ করে এনেছিল, সেই-ই আমার স্বপ্নের মধ্যে মায়ালোক বিস্তার করেছিল, তারপরই সেই মায়ালোক থেকে নেমে এসে যখন সে আমারই জন্যে নিজেকে এই পৃথিবীর স্পর্শের অধীন করে তুলেছে, আর আমার বাসনার শতদল তার চরণ দুখানি ঘিরে বিকশিত হয়ে উঠেছে, এই সময় বন্ধু এসে একটা বিপ্লব বাধিয়ে সমস্ত ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। আজ এ কি হল? ওরা যাকে বিভ্রম বলে প্রমাণ করতে চাইছে, তারই অভাবে আমার জীবনে কি শূন্যতা, আজ তা কাকে বোঝাব?

আজ চোখে মাঝে মাঝে অশ্রু জমে উঠছিল, এমন আর কোনদিন হয় নি। বাড়িটা এখান থেকে আর কখনও দেখিনি। বৃক্ষ-শাখা-লতার মধ্য দিয়ে বাড়িটার কিছু কিছু দেখা যায়, আভাসের মত। ছায়ার ভাগটা বেলাশেষের দিকে অন্ধকারে গ্রাস করছে, আর যেখানে তার গোলাপী রঙের আঁচ একটু একটু দেখা যায়, সেখানে বাড়িটা যেন অস্তমান সূর্যের কিরণে মিশে গেছে। সজল চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে আজ মনে হচ্ছে, সে আমার জন্যে অজ্ঞাতের তিমির থেকে নেমে এসে নিজেকে আলোর মধ্যে মেলে ধরেছিল, আজ ব্যর্থতার ক্ষোভে সে এই কঠিন জড়পিণ্ডটাকে মুছে নিয়ে তার বিদায়ের চিহ্নহীন পরিচয় রেখে যাবে।

বন্ধুর হাসি মনে পড়ে গেল। নিজের কাছেই লজ্জিত হয়ে চোখের জল মুছে ফেললাম, ভাবলাম, এই ঘেরা জমিটুকুর মধ্যে বসে বসে রাত্রিদিন কি এ আকাশকুসুম রচনা করছি? যাই, একটু ঘুরে আসি।

উঠলাম। রাস্তায় পা দিতেই পশ্চিম দিকের বাড়ির পানে নজর গেল। সঙ্গে সঙ্গে যেন লাগাম কষে দৃষ্টিকে ফিরিয়ে আনলাম। তখন মনের মধ্যে প্রশ্ন হল, আচ্ছা, পশ্চিমদিকটাই কি অপরাধ করেছে? ওদিকে না যাওয়াটাই কি দুৰ্বলতা নয়?

এই প্রশ্নের মধ্যেও একটা সূক্ষ্ম আকর্ষণের ইঙ্গিত ছিল, তাই এর উত্তরস্বরূপ আমি চিত্তের সমস্ত বলপ্রয়োগ করে পূর্ব দিকে অর্থাৎ বাড়িটার ঠিক উল্টো দিকে পা বাড়ালাম এবং অগ্রসর হলাম।

কিন্তু আমার পা যেন একটুর মধ্যেই অতিরিক্ত ভারী বোধ হতে লাগল। লাগবারই কথা, একে দুর্বল শরীর, তায় বসে বসে হাঁটার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার কিন্তু তখন একথা মনে হ’ল না, আমার মনে হ’ল, পূর্ণ বিশ্বাস হল যে কিসের সঙ্গে আমি যেন শৃঙ্খলিত হয়ে গেছি নিরুপায় ভাবে। যতই আগুয়ান হবার চেষ্টা করছি, পেছনে টান ততই প্রবল হয়ে উঠছে।

শেষে ফিরলাম। এতক্ষণ মনের মধ্যে কিসের সঙ্গে একটা তুমুল দ্বন্দ্ব তর্কবিতর্ক চলছিল, হেরে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ফেরবার সময় মনে হল, দিব্যি লঘু গতিতে চলেছি। আমার বাসার সামনে এলাম; একটু দ্বিধা, এক লহমার উপেক্ষা, তারপর পশ্চিম দিকে এগুলাম। এই দ্বিতীয় পরাজয়ে আর একটা আনন্দের দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল।

সেই বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়ালাম, আসা পর্যন্ত এই প্রথম। অনুভব করছি, একটা চাপা উত্তেজনায় পা কাঁপছে, শরীরটা হয়ে এসেছে শিথিল। আর একটি পা বাড়ালেই কোন্ এক নূতন আলোবাতাসের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াব, যেন মৃত্যুর চেয়েও এক পরমাশ্চর্য ব্যাপার এখনই ঘটবে।

আগলটা তুলে প্রবেশ করতে যাব, দেখি ডাক্তার-বন্ধু সেই বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসছেন। কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, তুমি এখানে?

.

আমাদের বাগানে এসে দুখানা চেয়ারে মুখোমুখি হয়ে বসলাম। বন্ধুর ভাবটা আজ নতুন রকম, কিছু বিব্রত, বিষণ্নও। কি ভেবে জানি না, আমায় আর কোন প্রশ্ন করলেন না। বললেন, ও-বাড়িটায় কিছু একটা ব্যাপার হচ্ছে বটে। তবে সেটা এই গরিব অশীতিপরা পৃথিবীরই এলাকার—এই যা।

আর একটু চুপ করে রইলেন, তারপর বলতে লাগলেন, তোমার ঘটকালি করতে গিয়েছিলাম। অপ্সরা-কিন্নরীরা আমাদের এই পোড়া কপালের যুগটাকেই বয়কট করেছেন বলে সেদিন তোমায় বেশি উৎসাহ দিতে পারলাম না, কিন্তু আমাদেরই মত রক্তমাংসের কোন খেঁদি-পেঁচি এসে বাড়িটাতে ডেরা ফেলেছেন এবং আমার বন্ধুটির ওপর ভর করবার জন্যে ডানা ঝাপটাচ্ছেন, তাতে আর আমার কোন সন্দেহ রইল না। ভাবলাম, দেখতে হচ্ছে। যোগাযোগ হয়, বন্ধুকে বুঝিয়ে বললেই হবে, এতেই সন্তুষ্ট হও, গরিবের পক্ষে রাঙই সোনা!

ছুটলাম তাড়াতাড়ি।

গিয়ে দেখলাম এক জোড়া পাগল—স্বামী আর স্ত্রী। অতি সাধারণ ব্যাপার, না? কিন্তু সবটা শোন, তখন টের পাবে, পশ্চিম দিকের বাড়িটার গুজবের উৎপত্তি কোথায়!

দুজনেই বৃদ্ধ এবং একটু বেশি রকম বিষণ্ণ; তবে হঠাৎ পাগল বলে মনে হবার কিছু নেই, সেটা টের পেলাম পরে।

যেতেই অভ্যর্থনা করে বসালেন। কথাবার্তা হল, কিন্তু এত স্বল্প এবং পরিমিত যে, আমার মনে একটা অনধিকার প্রবেশের অস্বস্তি জেগে উঠতে লাগল! মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল, আর রাগ হতে লাগল তোমার উপর। একটা কিছু বলে উঠে আসব আসব করছি, এমন সময় কর্তা হঠাৎ বললেন, এখানে আমরা তিনজন এসে আছি আপাতত, আশা এলেই চারজন হই।

গৃহিণী কথাটা একটু পরিষ্কার করে দিলেন, আশালতা আমাদের মেয়ে, এই এল বলে, যতক্ষণ না আসছে—

যাক, তোমার একটি ‘আশা’ যে আছেন তা হলে, এটুকু আবিষ্কার করে অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু কতক্ষণ গেল, তাঁর আর দেখাই নেই। আসরেও বিশ্রী রকম নিঝুমের পালা।

শেষে প্রশ্ন করলাম, কোথায় গেলেন তিনি?

কোন উত্তর পাওয়া গেল না, দম্পতি শুধু পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। আমার এই সময় একটু খটকা লাগল।

শেষে গৃহিণী বললেন—সে এক অদ্ভুতভাবে, আমায় বিশ্বাস করাবার জন্যে যেন ভয়ানক জোর দিয়ে—যাবার সময় ঠিক বলতে পারলে না কোথায় গেল, কিন্তু আসবে ঠিক, এ কথার কোন

এমন সময় কর্তা ‘যাই মা’ করে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন—এক বিকৃত আওয়াজ। আমার শরীরটা ঘন ঘন শিউরে শিউরে উঠল।

গৃহিণী কথার মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগে যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। কর্তা আস্তে আস্তে উঠে গেলেন, অতি সন্তর্পণে দু মিনিট, চার মিনিট, দশ মিনিট গেল, কর্তা শেষে বেরিয়ে এলেন; এইটুকুর মধ্যেই কত পরিবর্তন হয়ে গেছে চেহারার।

গৃহিণীর যেন চোখ দিয়ে কথা বেরুল, আসে নি?

কর্তা শুধু বললেন, এসেছিল বইকি, ডাকলে, শুনলে না?

আমি মূঢ়ের মত বসে রইলাম, শোকের এ কি ভয়ঙ্কর রূপ।

বোধহয় আধ ঘণ্টার মধ্যে আরও পাঁচ-ছয়বার এই রকম ব্যাপার। কখনও কর্তা ‘যাই মা’ করে উঠে যান, কখনও গৃহিণী; অথচ আমি সমস্ত শরীরটাকে এক জোড়া কানে পরিণত করেও একটু টু শব্দ পেলাম না। আরও কিছুক্ষণ এই ভাবে গেল; তারপর একবার কর্তা সেই রকম ‘যাই মা’ করে উঠে গৃহিণীকে বললেন, আমায়ই ডাকলে বটে, কিন্তু চল এবার দুজনেই যাই। আমায়ও অত্যন্ত মিনতির সুরে বললেন, আপনিও একটু সঙ্গে আসবেন কি? ক্রমাগতই আমাদের সঙ্গে এ কি লুকোচুরি করছে! এরকম ছিল না সে!

তিনজনে ভেতরে গেলাম, আমি রইলাম তাঁদের পেছনে।

তন্নতন্ন করে খুঁজলেন, এক এক জায়গায় ঘুরে ফিরে দু-তিনবার করে। বলতে কি, এই অদ্ভুত সঙ্গীদের সঙ্গে সন্ধ্যের অন্ধকারে বিকৃতি মস্তিষ্কের একটা খেয়ালী সৃষ্টিসাধনে ঘুরতে ঘুরতে আমারও মাথায় যেন একটা ঘূর্ণি পাক দিয়ে উঠতে লাগল। এক এক সময় এমনই আত্মবিস্মৃত হয়ে উঠছিলাম যে মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি এই হালকা অন্ধকারের মধ্যে একটা মূর্তি জমাট বেঁধে উঠবে। শব্দহীন বাড়িটা পর্যন্ত যেন তার জন্যে উৎকট প্রতীক্ষায় নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

নিরাশ হয়ে বৃদ্ধ খোঁজার মাঝে হঠাৎ বলে উঠলেন, দেখলেন তো? আজ পাঁচ বছর এই রকম করে ঘোরাচ্ছে।

পাঁচ বছর চার মাস হল।—বলে গৃহিণী করুণ অনুযোগের দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন।

ডাক্তারের নির্বিকল্প প্রাণ; কিন্তু তবুও যেন আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বললাম, চলুন বাইরে।

আমার পেছনে পেছনে তাঁরা বেরিয়ে এলেন।

খানিকক্ষণ বসে দু-একটা প্রশ্ন করে যা বুঝলাম তা এই যে, বছর পাঁচেক পূর্বে, ঠিক এই সময়টা, এই বাড়িতে, সামনের ওই দোতলার ঘরটাতে ওঁদের একটি সতেরো বছরের মেয়ে মারা যায়। পর হয়ে যাবে বলে তখনও প্রাণ ধরে তার বিয়ে দিতে পারেন নি— সেই আশালতা। তাতেই ওঁদের মস্তিষ্ক একরকম বিগড়ে গেছে। এখন একটা বিশ্বাস দাঁড়িয়েছে যে, শিগগিরই ফিরে আসবে; কোথা থেকে, কোন পথে তার কোন নির্দিষ্ট ধারণা নেই। তার অনির্দিষ্ট আগমনের আশাতেই বারো মাস অষ্টপ্রহর বাড়িটাকে তৈরি রাখেন। বছরের এই সময়টা আর বাইরে থাকতে পারেন না, যেন টেনে নিয়ে আসে। তারপর এই আশা-নিরাশা, শেষ কয়েকদিন দেখে আবার হতাশ হয়ে ফিরে যায়।

শুধু মালীর হাতে বাড়িটি রেখে পাঁচ বছর চার মাস ধরে এই ব্যাপার চলছে। আমার কিন্তু ধোঁকা লেগে রইল, তিনজনের তৃতীয়টি কে? জিজ্ঞেস করতে যাব, এমন সময় আলো নিয়ে মালীটা এসে দাঁড়াল। বললে, চলুন বাবু, রাত হয়ে এল।

দম্পতিও কিছু না বলায় কথাটা অনেকটা ভাল কথায় বের করে দেওয়ার মত শোনাল। নমস্কার করে উঠে পড়লাম; আমার আর প্রশ্ন করা হল না। তাছাড়া ভাবলাম, সম্ভবত মালীকে ধরেই তিনজনের কথা বলেছেন। যাক্, ওটা পরে কোন দিন জেনে নিলেই হবে।

বেরিয়ে এসে যখন রাস্তায় পড়লাম, একটা শব্দে ফিরে দেখি, মালী ফটকে তালা লাগাচ্ছে, ওর অভিপ্রায় নয় আর কি, কেউ এই পাগলের খেয়ালের মধ্যে এসে কোন রকম দখল নেয়।

বন্ধু একটু চুপ করলেন। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা তাঁর ডাক্তারের শরীর-মন থেকে এককালীন যেন ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ইতি উদ্বাহখণ্ডে ঘটকরাজ-কাহিনী সমাপ্ত। ওঠ, চল, ওপরে যাই। ও কি! শ্রুতিফল—মূর্ছা হবার কথা নয় তো! তোমার ও কি চাউনি!

আমার চাউনির মধ্যে যে শোকের অবসাদ আর সফলতার উন্মাদনা একসঙ্গে ফুটে বেরুচ্ছিল।

আমি আর নিজেকে রুখে রাখতে পারলাম না; ডাক্তারের হাতটা চেপে ধরে বলে উঠলাম, ডাক্তার, বিশ্বাস কর। এ কি তোমাদের অত্যাচার! অস্বাভাবিক আবেগে আমি নিশ্চয় কাঁপছিলাম।

ডাক্তার ভীতভাবে আমার মুখের পানে চেয়ে একটু থেমে আস্তে বললেন, কি বিশ্বাস করব? কিসের অত্যাচার?

তোমাদের অবিশ্বাসের। অত্যাচার নয়? এই অবিশ্বাসের বিষ তুমি তো এখানকার বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছ, তা ছাড়া আমার মধ্যেও সংক্রামিত করে আমার সেই তপস্যা নষ্ট করে দিয়েছ, যার দ্বারা আমি তাকে পাবার একেবারে কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিলাম। আবার অবিশ্বাসের হাসি? কিন্তু আমি তোমায় বলছি ডাক্তার, আমি দেখেছি; সেদিন আমি মিথ্যে দিয়ে সত্যিটা ঢাকা দিয়েছিলাম, তোমার হাসির ভয়ে; কিন্তু আজ আমার সে সত্য পূর্ণ হয়ে ফুটে উঠেছে, তোমার গল্পের মধ্য দিয়ে।

কি দেখেছ? কি সত্যের কথা বলছ?

তাকে দেখেছি, আশাকে। সে আছে, কেউ তার ডাক শুনতে পায়। তুমি পাও নি তোমার নিষ্ঠার অভাবে, আর কারুর কাছে সে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে, তাকে আমি দেখেছি।

বেশ, দেখাও আমায়।

কি বলব ডাক্তার, এই সন্ধ্যের মাঝখানে, সঙ্গে সঙ্গে আমি দুপুরটাকে এনে ফেলতে পারলাম না; না হলে দেখতে, সে তার অপার্থিব দুখানি পায়ের শোভায় ঘরটা আলো করে শুয়ে আছে। এই দু-মাস ধরে সে এমনই করে পৃথিবীর কাছে নিজেকে ধরা দিচ্ছে, সন্ধ্যের আবছায়ায় নয়, রাত্রের অন্ধকারেও নয়—ভরা দুপুরে, আলো যখন পৃথিবীর কানায় কানায় ভরে থাকে।

ডাক্তার একটি হাত আমার কাঁধের ওপর দিয়ে বললেন, তুমি বড় চঞ্চল হয়ে পড়েছ। আচ্ছা, বেশ ঠাণ্ডা হয়ে আমার একটি কথার জবাব দাও তো!

কি?

আমি বলছি, তোমার কথাটাই বরং আমার গল্পটাকে পূর্ণ করছে।

আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম, তার মানে?

তুমি যাঁকে দেখে থাক, তিনি হচ্ছেন সেই তৃতীয় ব্যক্তি যাঁকে আমি খুঁজছিলাম।

একটু ব্যঙ্গের সুরে বললাম, মালীকে পেয়ে সন্তুষ্ট হতে পারলে না?

না, কারণ কেউ মালীকে সচরাচর নিজের পরিবারের মধ্যে ধরে না। ওটা হয়েছিল আমার হিসেবের গোঁজামিল।

কিন্তু তুমি তো অত খুঁজেও তাঁকে পাও নি সেদিন।

ঠিক সেইসময়টিতে বোধ হয় ছিলেন না বাড়িতে।

আর ঠিক দুপুরবেলাটিতে থাকেন?

তুমি রোজ ওই সময়টায় দেখ বলেই যে দুপুরবেলাতেই থাকেন, আর আমি একদিন সন্ধের সময় দেখতে পেলাম না বলে কোন সন্ধেয়ই থাকেন না—এ রকম নিয়ম বেঁধে ফেলি কি করে? এবার খোঁজ নিলেই এঁর পরিচয়, গতিবিধি সব টের পাব। একটা কথা ভেবে দেখ, এই রকম দুজন পাগলকে কেউ পরস্পরের ভরসায় ছেড়ে দিতে পারে না, কোন আত্মীয় যে সঙ্গে—

আমি আবার ডাক্তারের হাতটা ধরে অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠলাম, না, আমি তোমার সব কথা বিশ্বাস করে নিচ্ছি ডাক্তার, তুমি তোমার অবিশ্বাসের উপদ্রব নিয়ে ওর মধ্যে যে ও না। তোমার দোহাই, তোমার বিজ্ঞান-দেবতার দোহাই!

সেদিন সন্ধ্যে থেকেই কতকগুলো খণ্ড খণ্ড মেঘ আকাশে এসে জড়ো হয়েছিল। রাত যেমন এগিয়ে চলল, হাওয়াটা একটু প্রবল হয়ে সেগুলোকে আকাশ-প্রাঙ্গণে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করতে লাগল। নীচের জ্যোৎস্না বেয়ে মেঘের দীর্ঘ সচল ছায়াগুলো ঘোরা-ফেরা করে সে রাত্রে পৃথিবীর ওপর কি এক যেন অলৌকিক ব্যাপারের আয়োজন লেগে গেল।

ক্রমে রাত্রি গাঢ় হল। ভবানীপুরের দৈনিক জীবনের শেষ স্পন্দনটুকু থেমে গিয়ে আকাশ-ভূতল স্তব্ধ হয়ে গেল। সুপ্ত জনপদবাসী নিশাচরদের জন্যে আসরটা যেন খালি করে দিলে।

শুধু আমার চোখে ঘুম নেই। আজ পর্যন্ত তর্ক-অবিশ্বাসের আবর্জনা পায়ে ঠেলে যেন এক মহা পুরস্কারের অধিকারী হয়েছি, জানি না তা মিলনের হাসি, কি চির-বিদায়ের অশ্রুজল! কিন্তু আমি বদ্ধাঞ্জলি হয়ে বিনিদ্রনয়নে তারই অপেক্ষায় বসে আছি। বেশ অনুভব করছি, পৃথিবীর সঙ্গে আমার যোগসূত্র দ্রুত শিথিল হয়ে আসছে, তার চিন্তাধারা, তার হিসেবের সঙ্গে যেন কোন মিল নেই।

প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় ক্লান্ত হয়ে শেষরাত্রে বোধ হয় তন্দ্রালু হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটা ব্যস্ত খট-খট খট খট শব্দে তন্দ্রা ভেঙে গেল। হাওয়াটা ঠাণ্ডা ছিল বলে পশ্চিম দিকের জানালাটা একটু আগে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, তারই ওপর যেন সনির্বন্ধ করাঘাত পড়ছে।

হন্তদন্ত হয়ে উঠে খুলে দিতেই একটা দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকে পড়ে আসবাবপত্রগুলোকে বিচলিত করে তুললে।

মনটা যেন ছাঁৎ করে উঠল, যাঃ, একরত্তি ভুল—একটু দেরিতে সব গেল!

তীব্র উৎকণ্ঠায় বাইরে চেয়ে রইলাম।

কিছু নেই। শুধু বাতাসের হা-হা-রব। যেন কার মর্মন্তুদ শোকোচ্ছ্বাস, কোথাও সান্ত্বনার মধ্যে বিরাম না পেয়ে ক্রমাগতই বয়ে চলেছে—হা—হা- -হা-হা—

আর সেই সঙ্গে ছায়ার সেই নিঃশব্দ মিছিল।

বিশেষের মধ্যে চোখে পড়ল, পশ্চিমের বাড়ির পরিচিত জানলা দুটো খোলা। জোর হাওয়ায় দেওয়াল-সংলগ্ন লতার খানিকটা স্থানচ্যুত করে কপাটের ওপর ফেলেছে।

তবে কি রাত্রির শেষ প্রহরেও দিনের নাট্যের আর একটা অঙ্ক অভিনীত হয়? না, এটা—

এই সময় একখণ্ড মেঘ সরে গিয়ে ম্লান জ্যোৎস্নাটা হঠাৎ তীব্রভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠল এবং আমার চিন্তার মাঝখানেই আমার শিরা-উপশিরার মধ্যে রক্ত-চলাচল বন্ধ হয়ে যেন নিশ্চল হয়ে গেলাম।

স্পষ্ট দেখলাম, একটি দীপ্ত নারীমূর্তি আবেগভরে জানলার গরাদের ওপর তার সমস্ত শরীরটা চেপে স্থিরদৃষ্টিতে সমুখের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেহের ঊর্ধ্বভাগ থেকে বসন খসে গেছে আর আলুলায়িত কেশের স্তবক বুকে মুখে বাহুমূলে নিবিড়ভাবে বিলম্বিত।

আমার মনে হল, শরীরের সমস্ত বন্ধনী ছিঁড়ে একটা চিৎকার করে উঠি। কি করতাম জানি না, কিন্তু এই সময় নৈশ আকাশকে দীর্ণ করে একটা বুকভাঙা স্বর উঠল, যাই মা!

আমি সঙ্গে সঙ্গে একটা ‘ওঃ’ করে আওয়াজ করে উঠেছিলাম মনে পড়ে। তারপর ঘরের কপাট খুললাম, বারান্দা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম, বাগান অতিক্রম করে ফটক খুলে বেরুব, কাঁধে একটা শীতল স্পর্শে চকিত হয়ে ফিরে চাইতেই দেখলাম, ডাক্তার!

বললেন, কোথায় যাচ্ছ?

ওদের বাড়িতে। এই মাত্র ‘যাই মা’ করে সাড়া দিলে। আমি যাচ্ছি দেখিয়ে দিতে।

তুমি দেখেছ?

স্পষ্ট, এত স্পষ্ট আমিও কখনও দেখি নি।

বেশ ফেরো, আগে আমায় দেখাও, তারপর নয় দুজনেই যাব।

ফিরে এসে আমরা জানলার সামনে দাঁড়ালাম। আমি সন্তর্পণে বললাম, ওই, জানলায় দেখ!

ডাক্তার একটু স্তম্ভিত বিমূঢ়ভাবে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর মাথাটা হেলিয়ে দুলিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগালেন। শেষে স্থির হয়ে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, এদিককার জানলাটার ওপর একটা লতা ঝুঁকে আছে দেখতে পাচ্ছ?

আবার তর্ক। অথচ সে রূপ তখনও আমি সমস্ত দেহমন দিয়ে উপলব্ধি করছি। আমি সেদিকে না চেয়েই কিছু বিরক্তভাবেই বললাম, পাচ্ছি।

অস্তমান পূর্ণিমার চাঁদটা আকারে প্রকাণ্ড হয়ে ওদিকের ওই খোলা জানলাটার ঠিক সামানসামনি এসে পড়েছে, আর ওদিককার জানলার গায়ে লতার ঝুরিগুলো—

আমি অধৈর্যভাবে বলে উঠলাম, ডাক্তার তোমার হাতে ধরছি, তোমার তর্কের হাত থেকে আমাদের রেহাই দাও, অন্তত এই রাতটা। ওই শোন, আবার সেই আওয়াজ! আমায় একটু মুক্তি দাও, এসে তোমার তর্ক শুনছি। ওই দেখ, এখনও ঠায় সেই ভাবে—

কথাটা শেষ হবার পূর্বেই একখণ্ড গাঢ় মেঘের ছায়া সমস্ত জ্যোৎস্নাটাকে মলিন করে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রদীপ্ত রূপশিখা যেন নিবে বিলীন হয়ে গেল। আমি বুঝলাম, চিরতরেই—

যাঃ, ডাক্তার! …বলে আমি চিৎকার করে উঠলাম। ডাক্তার বলেন, সঙ্গে সঙ্গেই নাকি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলাম।

.

পরের দিন প্রায় নটার সময় বন্ধু এসে বললেন, চল এবার তোমায় একটু লাইলিয়ার সারাউন্ডিংস (livelier surroundings)-এ নিয়ে যাব; ক্রমশঃ সওয়াতে হবে কিনা। বাড়ি ঠিক ক’রে এসেছি হাজরা রোডে। কিই বা আমাদের এত হাঙ্গামা, খাওয়া- দাওয়া করে দুপুরের আগেই বেরিয়ে পড়ব ভাবছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *