আশার বাতি

আশার বাতি

স্বপনসায়রে ঝিলের ঢেউ যেখানে দিন-রাত খালি আকাশে হাত তুলে উছলে উঠছে, ঠিক তারই কোল ঘেঁষে, তারই বুকে চঞ্চল ছায়া ফেলে, দাঁড়িয়ে আছে সেই মনোরম প্রাসাদখানি৷

যেন পরির হাতে মায়াতুলিতে আঁকা, ঘুমপুরীর ছবিখানি৷ আগাগোড়া তার আরশির মতন পালিশ-করা মার্বেল পাথর দিয়ে গড়া-হঠাৎ দূর থেকে দেখলে মনে হয়, চাঁদের আলো যেন সেখানে কার জাদুমন্ত্রে জমাট হয়ে আছে৷

পুরীর ফটকের ওপরে জ্বলন্ত সোনার অক্ষরে বড়ো বড়ো করে লেখা রয়েছে-‘এর ভিতরে ঢুকে যে যা চাইবে, সে তাই পাবে৷’

পথিক পথের ওপর দাঁড়িয়ে সেই সোনার লেখা পড়ে দেখল৷ তার বয়স অল্প-ষোলোর বেশি হবে না৷ লেখাগুলো পড়ে পথিকের মন লোভে ভরে উঠল৷ সে ফটকের ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময় শুনল, কে একজন হা হা হা হা করে হেসে উঠল৷

চমকে উঠে পথিক চেয়ে দেখে, ফটকের গায়ে ঠেসান দিয়ে থুত্থুড়ে এক বুড়ো মাটির ওপরে পা ছড়িয়ে বসে আছে৷ তার দাড়ি যাত্রার নারদের দাড়ির মতো ধবধবে সাদা৷ তার পোশাক ছেঁড়াখোড়া, তালিমারা, ময়লা৷ সেই বুড়োই তার দিকে চেয়ে হাসছিল৷

পথিক রাগ করে বলল, ‘বুড়ো, আমাকে দেখে তুমি হাসছ বটে, কিন্তু তুমি হচ্ছ একটি আস্ত গাধা৷’

বুড়ো হাসি থামিয়ে বলল, ‘কেন বলো দেখি বাপু?’

পথিক বলল, ‘ফটকের নীচেই তুমি পথের ভিখারির মতো ধুলোয় বসে আছ-আর তোমার মাথার ওপরে রয়েছে ওই সোনার লেখা, তা কি তুমি চোখে দেখতে পাচ্ছ না? তোমার কি কোনো সাধ নেই?’

বুড়ো বলল, ‘সাধ হয়তো আছে! কিন্তু ওই বাড়িতে ঢুকে আমি আমার সাধ মেটাতে চাই না৷’

পথিক একটু ভয় পেয়ে বলল, ‘বুড়ো, সব কথা খুলে বলো৷ এটা কি কোনো রাক্ষসপুরী? লোভে পড়ে যে এর ভেতরে ঢোকে, সে কি আর প্রাণ নিয়ে ফেরে না?’

বুড়ো মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, তা কেন? তুমি স্বচ্ছন্দে এই প্রাসাদের ভেতরে যেতে পার৷ কেবল এইটুকু মনে রেখো, বিপদকে যে ডাকে, বিপদ শুধু তার কাছেই ঘনিয়ে আসে৷’

পথিক বলল, ‘আমি আবার ফিরে আসতে পারব তো?’

বুড়ো বলল, ‘হ্যাঁ, বাড়ির ভেতরে গিয়ে যদি তোমার মনে কোনো লোভ না হয়৷’

পথিক বলল, ‘সে কী!’

বুড়ো বলল, ‘তা জানো না? লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!’

পুরীর সামনে গিয়ে পথিক দেখল, তার দরজা দুটি জাফরি-কাটা চন্দন কাঠে তৈরি-কী চমৎকার তার ভুরভুরে গন্ধ!

দরজার ওপরে ঝুলছে এক পাকা সোনার ঘণ্টা, তার ভেতরে দুলছে এক মুক্তোর ঘুণ্টি, হাঁসের ডিমের মতন বড়ো৷

মুক্তোটি পাছে ভেঙে যায়, সেই ভয়ে পথিক খুব আস্তে আস্তে ঘণ্টাটি বাজাল৷ চন্দন কাঠের দরজা অমনি খুলে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে একটি সুন্দরী মেয়ে এসে, হাতছানি দিয়ে পথিককে ডেকে গানের মতন মধুর সুরে বলল, ‘পথিক ভেতরে এসো!’

মেয়েটির পরনে ঝলমলে জরির কাপড়, মাথা থেকে পা পর্যন্ত হিরে-মানিকের গহনা- রাত্তিরে ফুলের ঝোপে যেমন হাজার জোনাকের দেয়ালি জ্বলে-ঠিক তেমনি ধারাই ঝকমক করে উঠছে৷

পথিক মোহিত হয়ে বলল, ‘তুমি কি রাজকন্যে?’

সে মুচকি হেসে বলল, ‘না, আমি তাঁর দাসী৷’

পথিক অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল, যাঁর দাসীরই এত রূপ, এত গয়না-না জানি সেই রাজকন্যে দেখতে কেমন! সে বলল, ‘রাজকন্যেকে গিয়ে বলো, এক পথিক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায়৷’

দাসী বলল, ‘রাজকন্যে এখন হাওয়া খেতে গেছেন, ফিরতে রাত হবে৷ ততক্ষণ আপনি ভেতরে আসুন, সব দেখুন-শুনুন, বিশ্রাম করুন৷’

পথিক বলল, ‘তার নাম কী?’

দাসী বলল, ‘কামনা দেবী৷’

পথিক বলল, ‘তাঁর বিয়ে হয়েছে?’

দাসী বলল, ‘না, তিনি বিয়ে করবেন না৷’

পথিক আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সে কী! কীসের দুঃখে তিনি বিয়ে করবেন না?’

দাসী বলল, ‘দুনিয়ার কারুকে তিনি ভালোবাসেন না৷’

পথিক আরও আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কারুকেই না?’

দাসী বলল, ‘কী মানুষ, কী দেবতা, কী যক্ষ-রক্ষ কারুকেই না৷’

পথিক বলল, ‘কেন?’

দাসী বলল, ‘মানুষের বুকের ভেতরে হৃদয় থাকে, আমাদের রাজকন্যের হৃদয় নেই৷’

পথিক শিউরে উঠে বলল, ‘হৃদয় নেই! রাজকন্যের বুকের ভেতরে তবে কী আছে?’

দাসী বলল, ‘পদ্মের রক্তে ডোবানো, বৃষ্টিতে ধোয়া পাথরের মতন কনকনে একখানি রাঙা টুকটুকে পদ্মরাগ মণি-ঠিক হৃদয়েরই মতো তিন কোণা!’

সে যে কী অপূর্ব প্রাসাদ, তা লিখে বলা যায় না৷ তার সমস্ত ঘরের দেয়ালগুলি ঝকমকে ঝিনুক দিয়ে বাঁধানো, তার ছাদের কড়িবরগাগুলো রুপো দিয়ে গড়া, তার মেঝেগুলি স্ফটিক দিয়ে তৈরি-চলতে গিয়ে পথিকের পা পিছলে যেতে লাগল৷ তার মনে হল, সে যেন বরফের উপর দিয়ে চলছে৷

সে বলল, ‘দাসী, স্ফটিকের মেঝে দেখতেই ভালো, কিন্তু কোনোই কাজের নয়৷’

দাসী মুখ টিপে ফিক করে একটুখানি হাসল৷

ঘরে ঘরে রুপোর শিকলে ঝোলানো হাজার হাজার প্রবালের ঝাড়ে, মরকতের ডোমে সার সার বিজলির বাতি জ্বলছে, চারিদিকে যেন মোলায়েম রাঙা আলোর মালা দুলছে৷

পথিক বলল, ‘দাসী, দিনের বেলায় জানলা বন্ধ করে তোমরা আলো জ্বেলে রেখেছ কেন?’

দাসী বলল, ‘সূর্যের আলোয় বড়ো তাত-রাজকন্যের ননির মতন গায়ে তা সইবে না তো৷’

পথিক বলল, ‘কিন্তু জানলা বন্ধ বলে ঘরের ভেতরে যে খোলা হাওয়াও আসতে পারবে না৷’

দাসী বলল, ‘বাইরের হাওয়ায় ধুলো-কুটো থাকে, রাজকন্যের ফোটা গোলাপের মতো রং তাতে ময়লা হয়ে যাবে যে!’

পথিক বলল, ‘কিন্তু আমার যে হাঁপ ধরছে, গরমে প্রাণ যায় যায় হচ্ছে!’

দাসী ইশারায় অমনি দুজন লোক এসে পথিকের দু-পাশে দাঁড়িয়ে শুক্তির বাঁট লাগানো চামর ঢুলোতে শুরু করল৷

পথিক বলল, ‘চামরে হাওয়া হয়, কিন্তু প্রাণ ঠান্ডা হয় না৷’

দাসী মুখ টিপে ফিক করে একটুখানি হাসল৷

পথিক এবার যে ঘরে ঢুকল, সে ঘরের মেঝেতে সাত হাত পুরু মোমের মতন নরম গালচে পাতা-সে গালচে লাখো লাখো প্রজাপতির রঙিন পাখনা দিয়ে তৈরি করা৷

পথিক দেখল ঘরের আশেপাশে এ-কোণে সে-কোণে চারিদিকে মানুষের মতন মাথায় উঁচু দলে দলে সোনার পুতুল দাঁড়িয়ে আছে৷

পথিক বলল, ‘এত সোনার পুতুল কেন?’

দাসী বলল, ‘ওরা আগে মানুষ ছিল, এখন অতি লোভের শাস্তি ভোগ করছে৷’

পথিক বলল, ‘সে কীরকম?’

দাসী বলল, ‘ওরা এখানে এসে বর চেয়েছিল, ওরা যা ছোঁবে তাই যেন সোনা হয়ে যায়৷ কিন্তু লোকগুলো এমনি বোকা যে বর পেয়েই সবাই নিজের নিজের গা অজান্তে ছুঁয়ে ফেলল৷ কাজেই এখন ওরা সোনার পুতুল হয়ে আছে-না পারে নড়তে, না পারে চলতে, না পারে কথা কইতে৷’

আর একটা ঘরে গিয়ে পথিক অবাক হয়ে দেখল একদল বুড়ো ঘরের মেঝেয় শুয়ে একসঙ্গে কান্নাকাটি করছে৷ তারা এমন ভয়ানক বুড়ো হয়ে পড়েছে যে, সকলেরই চোখে ধরেছে ছানি, মুখ হয়েছে ফোকলা, কানে লেগেছে তালা, আর গায়ের কোঁচকানো মাংসগুলো একহাত ঝুলে পড়ে থলথল করছে৷

পথিক ভয়ে ভয়ে বলল, ‘এরা কারা?’

দাসী বলল, ‘এরা বর চেয়েছিল অমর হবার জন্যে৷ কিন্তু এদের তখন খেয়াল হয়নি যে, অমর হলে লোকে মরে না বটে, কিন্তু যতই দিন যায় চিরকাল ধরে ততই বেশি বুড়ো হয়েও বেঁচে থাকতে হয়৷ এরা দাঁড়াতে পারে না, কারণ পায়ে জোর নেই, এরা খেতে পারে না, কারণ হজমের জো নেই, এরা হাসতে পারে না, কারণ মনে সুখ নেই৷ এরা তাই দিনরাত শুধু মাথা কোটে আর কেঁদে মরে৷’

পাশের ঘরে ঢুকে পথিক দেখল, একদল লোক মেঝের উপরে উপুড় হয়ে হুমড়ি খেয়ে আছে, আর তাদের প্রত্যেকের পিঠের ওপরে এক-একটা মস্ত বস্তা! সেই বস্তার চাপে থেঁতলে লোকগুলো থেকে থেকে বিষম চেঁচিয়ে ককিয়ে উঠছে!

পথিক বলল, ‘এ আবার কী ব্যাপার?’

দাসী বলল, ‘এরা এখানে এক-একটা থলে কাঁধে করে এসে বর মেগেছিল, যেন ওদের থলেগুলো মোহরে ভরে যায়৷ তাই হল৷ কিন্তু অমন মস্ত মস্ত থলে-ভরা বিশ-পঁচিশ মন মোহর কাঁধে করতে গিয়ে, সেই যে ওরা ঘাড় গুঁজড়ে মাটিতে আছড়ে পড়েছে, আর উঠতে পারেনি৷’

পথিক বলল, ‘আহা, বেচারিদের বড়ো কষ্ট হচ্ছে তো! তোমরা লোক এনে থলেগুলো ওদের পিঠ থেকে সরিয়ে দাও না কেন?’

দাসী বলল, ‘ওদের লোভ এত বেশি যে, প্রাণ যায় তাও স্বীকার, তবু মোহরের থলেগুলো ছাড়তে ওরা কিছুতেই রাজি হবে না!’

পথিকের চোখ হঠাৎ ঘরের আর-এক কোণে গেল৷ সেখানেও খাটের ওপরে মেয়েমানুষের মতো যেন কারা সব শুয়ে আছে, তাদের দেখতে মানুষের মতোও বটে, আবার মানুষের মতো নয়ও বটে! তাদের মুখ-চোখে-ঠোঁটে রূপের দেমাক যেন মাখানো রয়েছে!

পথিক হতভম্বের মতো তাদের দিকে চেয়ে আছে দেখে দাসী বলল, ‘ওই মেয়েগুলি বর চেয়েছিল, পরমাসুন্দরী হবার জন্যে৷ ওরা রেশমের মতন নরম চুল চেয়েছিল, তাই ওদের মাথার চুলগুলো আসল রেশমই হয়ে গেছে৷ ওরা পটল-চেরা চোখ, বাঁশির মতন নাক, মুক্তোর মতন দাঁত, আর সাদা ধবধবে রং চেয়েছিল, তাই ওদের চোখ হয়েছে বঁটিতে চেরা পটলের মতো, আর গায়ের রংও হয়েছে চুনকামের মতো, ওরা যা চেয়েছে তাই পেয়েছে-কিন্তু দেখতে কী ভয়ানক!’

পথিক বলল, ‘দাসী রূপ তো সবাই চায়! তবে ওদের বেলায় এমন শাস্তি কেন?’

দাসী বলল, ‘শুধু রূপ যারা চায়, তাদের কপাল অমনি খারাপ হয়৷ যার গুণ নেই তার রূপও নেই!’

এমন সময় একটি মেয়ে পথিকের দিকে চেয়ে, যেন হুকুম চালিয়েই বলল, ‘শুনছ আমাকে একটু পাশ ফিরিয়ে দাও তো!’

পথিক বলল, ‘দাসী, ওরা কি আপনা-আপনি পাশ ফিরে শুতেও পারে না?’

দাসী বলল, ‘না! ওরা রূপের সঙ্গে আরও চেয়েছিল ভারী ভারী সোনার গয়নায় মাথা থেকে পা পর্যন্ত মুড়ে ফেলতে৷ তাই-ই হয়েছে৷ এখন গয়নার চাপে আর ভারে ওদের নড়ন-চড়নের ক্ষমতা নেই৷’

পথিক যখন মেয়েটিকে পাশ ফিরিয়ে ভালো করে শুইয়ে দিল, মেয়েটি তখন চেরা-পটল-চোখ তুলে রূপের দেমাকে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘কী গো, এই এক-গা গয়নায় আমায় কেমন দেখাচ্ছে বলো দেখি?’

পথিক বলল, ‘কিম্ভূতকিমাকার!’

মেয়েটি বলল, ‘আমাকে তুমি বিয়ে করবে?’

পথিক ভয়ে চোখ বুজে ফেলে বলল, ‘আগে মরে ভূত হই!’

ঘরে ঘরে এমনই সব ব্যাপার দেখে, পথিকের মন একেবারে দমে গেল৷ সে কাতরভাবে বলল, ‘দাসী, আর আমি এসব দেখতে পারছি না-আমার মন যেন নেতিয়ে পড়ছে৷’

দাসী বলল, ‘পথিক, এসো, এখন কিছু জলখাবার খেয়ে ঠান্ডা হবে চলো৷’

জলখাবার ঘরে গিয়ে পথিক দেখল, চকচকে স্ফটিকের মেঝের ওপরে পোখরাজের চমৎকার কাজ-করা একখানি হাতির দাঁতের পিঁড়ি৷ সামনেই সোনার থালায় নানান রকমের খাবার সাজানো৷ সেসব খাবারের এমন খাসা গন্ধ যে, প্রাণ যেন তর হয়ে যায়!

খিদের সময় এমন ভালো ভালো খাবার পেয়ে পথিকের মনটা ভারি খুশি হয়ে উঠল৷ সে তাড়াতাড়ি খেতে বসে, দুটিখানি পোলাও ভেঙে মুখে দিল৷ কিন্তু তখনই আবার থু থু করে ফেলে দিয়ে বলল, ‘রাম! রাম! পোলাওয়ে চাল নেই, আছে শুধু গরম মশলা৷ কী তেতো-বাপ!’ মাছভাজা খেতে গিয়ে দেখল, সে মাছ তেলের বদলে আতর দিয়ে ভাজা-কার সাধ্যি জিভে ঠেকায়!

‘আর খাবার খেয়ে কাজ নেই বাবা, শুধু জল খেয়েই খিদে মেটানো যাক’-এই ভেবে পথিক জলের সোনার গেলাসটা মুখে তুলেই ‘ওয়াক’ করে পিঁড়ি ছেড়ে উঠে পড়ল৷ গেলাসে ছিল খাঁটি গোলাপজল!

পথিক বলল, ‘দাসী, তোমাদের জলখাবারে মনমাতানো গন্ধ আছে, কিন্তু এতে পেট ভরে না৷’

দাসী মুখ টিপে ফিক করে একটুখানি হাসল৷

পথিক হতাশভাবে বলল, ‘দাসী, এখন আর কী করবার আছে?’

দাসী বলল, ‘এখন শয়নাগারে বিশ্রাম করবে এসো৷ তারপর কামনাদেবী এলে তাঁর কাছে বর চেয়ে নেবে৷’

শয়নাগারের বারান্দায় সারি সারি রুপোর টবে, সোনার গাছে, পান্নার পাতায়, হিরে-চুনি-জহরতের হাজার হাজার রং-বেরং ফুল ফুটে আছে-দেখতে সুন্দর, কিন্তু গন্ধ নেই একটুও৷ ভোমরারা পর্যন্ত সেসব ফুলের কাছে ভুলেও এসে গুনগুন করে গান গায় না৷

ঘরের ভেতরেও সোনার পালঙ্কে ময়ূরপুচ্ছ মোড়া তোষকের ওপরে, হিরে-মোতির চুমকি বসানো, সোনার সুতোয় বোনা অপরূপ চাদর পাতা বিছানা রয়েছে৷

‘তবু ভালো, এখন একটু ঘুমিয়ে বিশ্রাম করে বাঁচব৷’ এই ভেবে পথিক বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বলল, ‘আঃ, আঃ, কী আরাম!’

কিন্তু খানিকবাদেই ভিন্ন সুরে বলল, ‘ওঃ, ওঃ, কী আপদ!’

সে-বিছানায় ঘুম তো দূরের কথা, চুপ করে শুয়ে থাকাই অসম্ভব! সেই সোনার সুতোর চাদরে পথিকের গা ছড়ে গেল, হিরে-মোতির চুমকিগুলো পটপট করে তার পিঠে ফুটতে লাগল৷

এতক্ষণে পথিক স্পষ্ট বুঝল যে, ভগবান মানুষকে যে-ভাবে যে-অবস্থায় পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, মানুষ যদি তাতে তুষ্ট না থাকে, তবে তাকে এমন করেই নাকাল হতে হয়৷

পথিক ধড়মড় করে উঠে পড়ে বলল, ‘দাসী, আমি চললাম৷’

দাসী বলল, ‘সে কী, কামনাদেবীর সঙ্গে দেখা করবে না?’

পথিক বলল, ‘কামনাদেবী আমার মাথায় থাকুন, আমি বর-টর কিছু চাই না৷’

দাসী মুখ টিপে ফিক করে একটুখানি হাসল৷

পুরীর ভিতরে হিরে-মোতি সোনা-দানার মাঝখানে, পথিককে দেখাচ্ছিল ছন্নছাড়া ভিখারির মতো, কিন্তু বাইরে আসবামাত্র চাঁদের আলোর ঝরনা চারিদিক থেকে ঝরে পড়ে, তার সর্বাঙ্গে মুড়ে দিল মধুর রুপোলি সাজে৷ ফুলের গন্ধ নিয়ে বাতাস এসে পথিকের বুক জুড়িয়ে, তার গায়ে যেন ঠান্ডা হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল৷

ফটকের ধারে বসেছিল সেই বুড়ো৷ পথিককে দেখেই সে হা-হা-হা-হা করে হেসে বলে উঠল, ‘বাপু, আমি জানতাম, তুমি আবার ফিরে আসবে! এই দেখো, তোমার জন্যে আমি গাছ থেকে মিঠে ফল, নদী থেকে মিষ্টি জল এনে রেখেছি৷ ভগবানের দেওয়া এই জলখাবার লোক-দেখানো জাঁকজমকের জন্যে নয়, এতে গরম মশলাও নেই, গোলাপজলও নেই, কিন্তু এসব খেলে পেট ভরে, প্রাণ বাঁচে৷ নাও, এখন খাও-দাও, প্রাণ ঠান্ডা করো!’

পথিকের খাওয়া শেষ হলে বুড়ো আবার বলল, ‘ওই দেখো, তোমার জন্যে সবুজ ঘাসের গালচের ওপরে খড়ের তোশক বিছিয়ে, ফুলপাতার চাদর পেতে রেখেছি৷ এতে সোনার সুতো আর হিরে-মোতির চুমকি নেই বটে, কিন্তু এর ওপরে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসির হাত বুলোনো আছে,-শুতে-না-শুতেই ঘুমিয়ে পড়বে৷’

পথিক জিজ্ঞাসা করল, ‘বুড়ো, তোমার নাম কী?’

বুড়ো বলল, ‘সন্তোষ৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *