উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

আশার আলো

আশার আলো

এক

মার বড় আশা। আমি বড় হয়ে বিরাট একটা চাকরি করব। লাখ টাকা মাইনে। নিজের জন্যে বেশি খরচ করব না। সকালে এক গেলাস ছাতুর শরবত খেয়ে কাজে চলে যাব। ফেরার পথে পাড়ার দোকান থেকে রুটি-তরকারি কিনে নেব। সবাই বলবে বিয়ে করো, করব না। সুধার সঙ্গে গত বছর ঝুলনের মেলায় নাগরদোলায় ঘুরপাক খেতে খেতে মোটামুটি এইরকম কথা হয়েছিল, যে যাই হই, যেখানেই থাকি, দুজনে দুজনকে ভুলব না। না, না, না।

নাগরদোলার হুসহাসে দুজনেই তখন ভয়ে মরে আছি। একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরে আছি। সুধার চোখ ভর্তি জল। মেয়েরা এমন এমন কাণ্ড করে। মুখে কোনও কথা নেই। মনে এমন কিছু আছে যা জল হয়ে বেরোচ্ছে। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে তাড়াতড়ি বড় হয় তবে আমি কী করব? ভগবানের ইচ্ছে। ‘সুধার মতো মেয়ে হয় না। ওর মনটা ফুলের মতো। ও একটা প্রজাপতি।’ সব্বাই এই একই কথা বলবেন। ভালো হলেই ভালো। ও সুখী হলে আমি কেন দুঃখ পাব! আমার মনটাও কি কম বড়। আকাশের মতো। আমি কারোকে বলি না। অহঙ্কার খুব বাজে জিনিস।

আচ্ছা, সুধা যেমন আছে, যেখানে আছে থাক। আমার মাসিমার ডান হাত। মাসিমার কাছে পড়ে। সে পড়ুক, প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়াটা বাড়াবাড়ি। ও ফার্স্ট হলে আদাজল খেয়ে আমাকেও ফার্স্ট হতে হবে। একটা ছেলের আর কোনও কাজ নেই, দিনরাত খালি পড়বে। আমার পরিকল্পনাটা ছকে ফেলেছি। কয়েকটা দেশ আমাকে দেখতেই হবে। আফ্রিকা আর অ্যামাজন। সিংহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠাস ঠাস করে ছবি তুলব। অ্যামাজনের জঙ্গলে অ্যানাকোন্ডা আর ট্যারানটুলা। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ক্যানিবলদের নাচ দেখব। ঘরের কোণে বসে থাকার জন্যে জন্মেছি না কি! সুধাকে বললেই, না, না করবে। ভীতুর ডিম। রাত্তির হল কি, ভূতের ভয়। সব জায়গায় ভূত। একসঙ্গে অনেক কুকুর ডাকলে হয়ে গেল। এই মেয়েকে নিয়ে আমি আফ্রিকা যাব! আমি কি ম্যাড?

আমার দ্বিতীয় পরিকল্পনা, কাঞ্জনজঙ্ঘা। ওই পাহাড়ের মাথায় আমি উঠবই উঠব। এত ভয় কীসের? হড়কে পড়ে গেলে মরে যাব। দেহটা বরফের তলায় চাপা পড়ে থাকবে। এক হাজার বছর, দু-হাজার বছর। আর একটা ইচ্ছে, সাহারা মরুভূমি। বালি আর বালি। মরীচিকা দেখব। মরীচিকার ছবি তুলব। আজ পর্যন্ত কেউ মরীচিকার ছবি তুলতে পারেনি। পরেশকাকু অতবড় ফটোগ্রাফার। জিগ্যেস করেছিলুম। বললেন, ও শুধু চোখই দেখতে পায়, ক্যামেরার লেন্সে সবই বালি। যে কারণে ভূতের ছবি তুলতে পারবে না। ভূত কি আছে? অবশ্যই আছে। পরেশকাকুদের বাড়িতে আছে। পরেশকাকুর মায়ের বেশ বড় একটা ছবি। তিনি সুন্দর একটা শাড়ি পরে সুন্দরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরেশকাকুদের ভূবনেশ্বরের বাড়িতে তোলা। রাত দুটো থেকে রাত চারটে পর্যন্ত ওই ফ্রেমের ছবিটা থাকে না। ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যান। কোথাও বেড়াতে যান। বড়মামা বিশ্বাস করলেও, মেজোমামা বলেন, যত আজগুবি।

মেজোমামার সন্দেহটা মনে হয় ঠিক। আমি একদিন দেখতে আসব বলায়, কাকু কী ভীষণ রেগে গেলেন, ‘এ কি সিনেমা? দেখতে আসবে? আমাদের পারিবারিক ব্যাপার। এগজিবিশন না কি? দল বেঁধে দেখতে আসবে?’

বাবা রে! মেজোমামা শুনে বললেন, ‘রেগে যাওয়ার কারণটা বুঝলি? ডাহা মিথ্যে কথা। পরেশ আমার ক্লাস ফ্রেন্ড, মিথ্যে কথার মাস্টার। ওর কাছে যাওয়ার দরকারটা কী?’

দুই

বড়মামাকে নিয়ে আমি একটা পাঁচশো কি হাজার পাতার বই লিখব। আমি আমার পয়সাতেই ছাপব। কোনও প্রকাশক ছাপবেন না। আমি কি নামকরা লেখক? লেখক হওয়ার ইচ্ছেও নেই। আমি নাবিক হব। জাহাজের ক্যাপ্টেন। সাগরে সাগরে ভেসে বেড়াব। সুধাকে আমি সেদিন বলে দিয়েছি, আর কয়েকটা বছর। তারপর আমি নেই। ইতালি আমি ভালোবাসি, হয়তো সেইখানেই থেকে যাব। ফ্রোরেনস। মাঝে মাঝে তোকে পিকচার পোস্টকার্ড পাঠাব। এই নয় যে, আমি তোকে ভুলে যাব। তবে বুঝতে পারছিস তো জাহাজের কাপতেনের কত বড় দায়িত্ব। ঝড়, জল, জলদস্যু। ভয় পেয়ে তো চলবে না। সাহস চাই, তবেই জীবনে বড় হওয়া যায়।

সুধা আমার নামে থানায় ডায়েরি করবে। জেলে আটকে রাখবে। আইনকানুন কিস্যু জানে না। পাগলের মতো কথা। ক’টা বাজল। আমি এখন মাস্টারমশায়ের কাছে পড়তে যাব। আমাকে নিয়ে সবাই হাটি-ঠাট্টা করে, কারণ আমি সংস্কৃত পড়ি। আদ্য, মধ্য, বৃত্তি। স্মৃতি, শ্রুতি, ন্যায়। পরীক্ষায় প্রথম হব। বৃত্তি পাব। সংস্কৃত কলেজে পড়ব। তারপরে জার্মানিতে চলে যাব। অক্সফোর্ডেও যেতে পারি। বিরাট ব্যাপার। আমি আমার মতো পড়ব, তোমাদের তাতে কী? বটতলায় ক’টা চ্যাংড়া বসে থাকে। যেই যাব, অমনি চেল্লাবে, ‘পণ্ডিতমশাই। আপনার ছাতা কোথায়? টিকি কোথায়? আমি ওদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। কিছু বলি না। কেবল হাসি। সময় থাকলে পাশে বসে পড়ি। তখন ওদের খুব অস্বস্তি হয়। বুঝতে পারে না, কী করবে। ওদের একজন নেতা আছে—অনাথ। মুখার্জি বাড়ির ছেলে। প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি, কিন্তু ভায়ে ভায়ে মামলা। অনাথ জিগ্যেস করে, ‘তোর পেছনে এত লাগি, তুই রাগ করিস না কেন?’ তখনও আমি হাসি। অনাথ আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি তখন তার চোখে দেখতে পাই গভীর দুঃখ। ঘন হয়ে আছে।

‘জানিস তো, পাড়ায় আমাদের খুব বদনাম। আমরা খারাপ ছেলে। বিজয়দশমীর দিন কারো বাড়িতে গেলে, তাড়াতাড়ি ভাগাতে পারলে বাঁচে। তুই আমাদের পাশে বসে পড়লি?’

তবুও আমি হাসি, মনের আনন্দে হাসি।

‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না?’

‘পাচ্ছি।’

‘তাহলে হাসছিস কেন?’

‘তোমাদের আমার খুব ভালো লাগে। তোমরা এই পাড়ার প্রাণ।’

‘যেমন এই পাড়ার পাঁচটা কুকুর।’

কী হল জানি না। রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল। অনাথের গালে সপাটে এক চড়। তোমাকে আজি আমি মেরেই ফেলব। তুমি আমার দাদা। তোমরা ছাড়া এই পাড়াটা শ্মশান।’

এদের কাছে ছোরাছুরি থাকে। পৃথিবীতে আমার শেষদিন হলেও হতে পারত; অনাথ হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসল, আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ‘আজ থেকে তুমি আমার গরু।’ অনাথের চোখে জল। জমিদারের ছেলে। সুন্দর চেহারা। ভাবুক ভাবুক দুটো চোখ।

‘আমি গুরু কেন হতে যাব? আমরা দুটো ভাই। আমি তো তোমাকে অনেক অনেক দিন থেকে ভালোবাসি। সেই যবে প্রথম আমি এখানে আসি। তখন তোমাদের চণ্ডীমণ্ডপে কত ঘটা করে দুর্গাপুজো হত। জন্মাষ্টমী, ঝুলন, দোল, রাস। সেইসব দিন। তুমি ঘুড়ি ওড়াতে। তোমাদের ব্যয়ামাগারে ব্যায়াম করতে। শীতকালে সাদা পোশাক পরে ক্রিকেট খেলতে। তোমাদের লাইব্রেরিতে কত বই।’

‘সিনিয়াররা মারা গেলেন। সব শেষ। আমার বড় ভাই আমাকে বাড়ি ঢুকতে দেয় না। ইচ্ছে করলে ওর পেটটা আমি ফাঁসিয়ে দিতে পারি। যতই হোক আমার ভাই। আমার মাকে খেতে দেয় না।’

‘অনাথদা! দেখবে, তুমি ঠিক হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘জানিস তো, আমার খুব লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে।’

‘আমি বড়মামাকে বলে তোমাকে ডাক্তার করব।’

‘না, ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে নেই। আমি ঐতিহাসিক হব।’

‘বাঃ, আমিও তো তাই হব। তাহলে মেজোমামা।’

‘তোমাদের বাড়িতে আমাকে ঢুকতেই দেবে না। সবাই জানে তো, আমি একটা থার্ডক্লাস, বাজে ছেলে।’

‘আবার নিজেকে ছোট করছ। স্বামীজি এই ভাব-ভাবনা একদম পছন্দ করতেন না।’

‘স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলছ? কোথায়? তিনি কোথায় আর আমি কোথায়? তিনি আকাশে আর আমি পাতালে।’

‘আমি তা মনে করি না. আমার চোখে তুমি হিরো। তোমার মতো সাহস কজনের আছে? তুমি মা কালীর ভক্ত।’

‘কে বলল?’

‘অনাথদা তুমি মনে করো, তুমিই সকলের সব কিছু জানো, তাই না? আমিও জানি। আমিও একটা সাংঘাতিক ছেলে। আমি তো এখানে থাকব না। ভূপর্যটক হয়ে বেরিয়ে যাব। আমার বাবাও নেই, মা-ও নেই। আমার জন্যে কেউ কাঁদবে না।’

‘ওকথা বলিস না। কেউ না কাঁদুক, এই অনাথ কাঁদবে। আজকের এই সকালটা আমার জীবনের এক নতুন সকাল। তোকে ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। আমিও ভূপর্যটক হব। চল না, স্বামীজির হাত ধরে দুজনে বেরিয়ে পড়ি। স্বামীজির ভারতবর্ষটাকে ভালো করে দেখে আসি। বয়েস বেড়ে গেলে আর পারা যাবে না।’

‘স্বামীজির মতো কষ্ট করতে পারবে?’

‘অনাথ পারে না এমন কাজ নেই। রাত্তিরে আমি কোথায় থাকি জানিস? শ্মশানে। চিতার পাশে। আমি মাকে চাই।’

‘আমিও চাই। তুমি জানো, আমি যাঁর কাছে সংস্কৃত পড়তে যাচ্ছি, তিনি একজন মস্ত বড় তান্ত্রিক। প্রতি অমাবস্যায় পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসেন। তুমি তাঁর চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। তিনি যে কোনও মানুষকে একেবারে বদলে দিতে পারেন। আমাকে বলেছেন, সংস্কৃত ভাষাটা ভালো করে শেখ। বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, তন্ত্র মূল সংস্কৃত পড়, অর তখনই বুঝতে পারবি তুই কে? এই ভারতবর্ষ কত মহান। তুমি আজই চলো। যত দেরি করবে, তত দেরি হয়ে যাবে।’

‘বিশ্বাস কর আমার খুব ভয় করছে। নিজেকে নামাতে নামাতে এতটা নীচে নামিয়েছি—একেবারে নর্দমা হয়ে গেছি।’

‘শোনো অনাথদা, স্বামীজি কী বলেছেন জানো, যে নিজেকে ছোট করে, সে-ই সবচেয়ে বড় পাপী।’

‘তুই বার বার স্বামীজির কথা বলছিস কেন? আমি সহ্য করতে পারছি না। ভূত যেমন রাম নাম সহ্য করতে পারে না।’

‘বাজে না বকে তুমি চলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

পণ্ডিমশাইয়ের বাড়ির সামনের দিকে টোল, পেছন দিকে অনেকটা জায়গা। বাগান, তারা মায়ের মন্দির, পঞ্চমুণ্ডীর আসন। তারপরে ছোট্ট একটা খাল গঙ্গায় মিশেছে। অনেক অনেক দিন আগে এই সব জায়গায় ছিল গভীর জঙ্গল। এই খাল দিয়ে ঢুকত ডাকাতদের ছিপ নৌকো। কালো কালো ডাকাত, লাল লাল চোখ। মাথায় ফেট্টি। হাতে রামদা, বল্লম। খালটার নাম ছিল দেঁতোর খাল। এখন যা আছে, তাকে আর খাল বলা যায় না। একবার এটা মস্ত কুমির ঢুকেছিল। ডাকাতরা জানত না। লেজের ঝাপটায় একটা ছিপ নৌকো উলটে দিয়ে একজন ডাকাতকে চিবিয়ে খেয়েছিল। জঙ্গলে কাপালিক ছিল। প্রায়ই নরবলি হত। মানুষ যে কীভাবে থাকত এখানে! অনাথদের জমিদার বংশ। দুবার ডাকাত পড়েছিল।

অনাথ বেশ যাচ্ছিল। হঠাৎ মায়াদের বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘কী হল?’

‘একটা উপকার করবি?’

‘কী উপকার?’

‘ভেতরে গিয়ে মায়াকে ডেকে আনবি।’

‘যে আমার সঙ্গে কোনওদিন কথা বলেনি, অহংকারে মট মট করে, তাকে ডাকতে গিয়ে মার খেয়ে মরি আর কী? কেন, ডাকব কেন?’

‘শীতলা পুজোর দিন ভোগের লাইনে ওর সঙ্গে আমি অসভ্যতা করেছিলুম। ও কেঁদে ফেলেছিল। আজ আমি সেই অপারধের প্রায়শ্চিত্ত করব। পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইব। বলব, পা থেকে জুতো খুলে আমার গালে মারো। মেয়েরা মায়ের জাত। আমি কত বড় বংশের ছেলে, অথচ আমি কী ছোটলোক! আমার আত্মহত্যা করা উচিত।’

‘শোনো অনাথদা, এই যে বললে এতেই তোমার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেল।’

ঠিক এই সময় মায়া কোথায় যাওয়ার জন্য হুটহাট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। পেছনে তার রাশভারী বাবা। নিজেকে মনে করেন বিরাট ‘কেউ কেটা’। পাড়ার অনেকেই বলেন, একটি কেউটে সাপ। পয়সা আছে। শিক্ষাদীক্ষা তেমন কিছু নেই। মায়ার বাবা আমাদের দুজনকে দেখে, আমাকে খুব তাচ্ছিল্য করে বললেন, ‘এই ডাক্তারের ভাগনে, তুমিও এইটার দলে ভিড়েছ?’

অনাথদা চাবুকের মতো চমকে উঠে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি নীচু গলায় বললুম, ‘একদম না। এর উত্তর আমরা অন্যভাবে দেব, আর কিছু দিন পরে। এখন কোনওরকম বায়নাক্কা না করে চলো।’

আমরা বাঁ-দিকের রাস্তায় ঢুকলুম। শেষ হয়েছে গঙ্গার ধারে। শ্মশান। শিবমন্দির, কালীমন্দির। বাঁ-দিকে অনেক কালের পুরনো একটা বনেদি বাড়ি। নীচের ঘরের জানলায় একটি মেয়ে মুখ। বিষণ্ণ, রক্তশূন্য। মেয়েটি অনাথকে ডাকছে, ‘অনাথদা দশটা টাকা দেবে গো। তাহলে আজ আমরা কিছু খাব।’

অনাথ আমার দিকে তাকাল। দু-চোখে জল। জানলার বাইরে উঁচু রক। জানলার সামনে গিয়ে বললে, ‘আরতি, আমি তোকে কতদিন বলেছি, এইভাবে টাকা চাইবি না, তুই কি ভিকিরি! এই যে এখন পঞ্চাশটা টাকা রাখ। আমি সন্ধ্যেবেলা এসে বাজার করে দেব।’

দু-চারখানা বাড়ির পরেই একটা গয়নার দোকান। তার পাশেই শাঁখা, সিঁদুর, শোলার জিনিসপত্র, তার পরে জিলিপি। অনাথদা সোনার দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘কী হল আবার?’

‘ভাবছি, এই সোনার আংটিটা বিক্রি করে দিই?’

‘কেন?’

‘ওই আরতির মুখটা দেখলে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে? একটা ব্রিলিয়েন্ট মেয়ে, লেখাপড়া বন্ধ। ওর দাদা বউ নিয়ে বিদেশে। মা-বোনের খবর নেয় না। আরতির অ্যানিমিয়া। আরতির মা বাতে শয্যাশায়ী। আরতির বাবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, ওই মর্কটটার জন্যে—মায়ার বাবা। শেয়ারের ফাটকাবাজিতে সর্বস্বান্ত করে দিল। বাড়িটা কোনওরকম বেঁচে গেছে। শোন, মেয়েদের কষ্ট দেখলে আমার বুকটা ফেটে যায়!’

‘তা হলে মেয়েদের টিজ করতে কেন?’

‘কে বলেছে?’

‘এই তো তুমিই বললে, মায়ার কাছে ক্ষমা চাইবে!’

‘টিজ নয়, আমি ওকে সেদিন মেরে ফেলতুম। শীতলাতলায় সেদিন ও একটা বাচ্চাকে ধাক্কা মেরে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল। বাচ্চাটার মা প্রতিবাদ করায় এমন যাচ্ছেতাই সব কথা বলতে লাগল, কে রে তুই? অনাথ কি মরে গেছে? ওর বাপ তোকে আজ যা বললে, আমার আদালতে তোলা রইল, ঠিক সময়ে বিচার হবে। অনাথ মারতে আর মরতে ভয় পায় না। মানুষ জন্মায় একবার, মরেও একবার।’

‘অনাথদা, এখন এসব থাক। তোমার মতো আমিও সব দেখছি। সবাই কীভাবে বসে বসে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। বুড়ো হয়ে যাওয়া ছাড়া আর যেন কিছুই করার নেই। ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলুম। হাই তুলতে তুলতে উঠলুম। কী হল, কী হল করতে করতে মরে গেলুম।’

‘তুই আমাকে স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলছিলিস। তুই কি জানিস অমি বিবেকানন্দ মুখস্থ করি। আমার ‘আমি’ গাড়িটা বিবেকানন্দ পেট্রলে চলে। এই দেখ, আমার পকেটে একটা কার্ড। লেখা আছে বিবেকবাণী—When I asked God for wealth, he showed me how to work hard! When I asked God for favours, he showed me opportunities to work hard.

‘পকেটে রাখলেই হবে? কাজে করো কি?’

‘করি কি করি না, পরে বুঝবি। নাঃ, আংটি বিক্রিই করে দিই। শুধু তো আরতি নয়, অরুণা, অনিমা, গঙ্গা। আঙুলে শুধু শুধু কয়েক হাজার টাকা আটকে রাখার কোনও মানে হয় কি? আংটিটা আমার মায়ের স্মৃতি। তাতে কী হয়েছে? মায়ের টাকায় মায়ের সেবা হবে।’

‘তুমি একটা দিন অপেক্ষা করো। আমি বড়মামার সঙ্গে কথা বলি।’

‘বড়দা কী করবেন? তিনি আদ্দেক লোককে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করছেনই। এরা তো সব বাড়ির লোকের বাঁদরামিতে না খেয়ে মরতে বসেছে। কেউ মদ গিলছে, কেউ রেস খেলছে। এদের জামাই আদর না করে মেরে ফেলা উচিত। স্রেফ খোঁটায় বেঁধে শঙ্কর মাছের চাবুক দিয়ে পেটাও। তুই বল, এগুলো মানুষ।’

‘শোনো শোনো, তোমার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। আমার কথাটা শোনো, বড়মামা আমাকে বলেছিলেন, নিজেরা ভালোমন্দ অনেক খেয়েছি, এখন অন্যের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু অনাথদা, তুমি একটা কথা ভেবে দেখো, কেউ যদি রোজগারের চেষ্টা না করে, তুমি কত দেবে! দিতে দিতে ফতুর হয়ে যাবে।’

‘ঠিক বলেছিস। দান আর কিছু হবে না। কাজ চাই। নেতারা কী করছে?’

‘বক্তৃতা দিচ্ছে। দড়ি পাকানোর মতো দল পাকাচ্ছে।’

‘কী জিনিস, আরতির করুণ মুখটা দেখলেই কান্না পায়। কী ভালো মেয়ে জানিস না।’

‘দাঁড়াও, আমি ওর জন্যে বড়মামার সঙ্গে কথা বলব।’

‘কী কথা বলবি? ও আমার মতো থার্ডক্লাস ছেলেকে কেন ভালোবাসে? আমি ওর জন্যে কী করতে পারব? মাঝখান থেকে ওর বদনাম হবে। ভদ্রঘরে জন্মালেও তো একটা ছোটলোক।’

অর্থাৎ একটা আইডিয়া এল মাথায়, ‘আচ্ছা, একটা কাজ করবে অনাথদা?’

‘কী কাজ?’

‘আরতিকে আমরা আজই পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে নিয়ে যাই চলো। মেয়েরা আজকাল সংস্কৃত পড়ছে, ভালো রেজাল্ট করছে। বিদেশে যাচ্ছে অধ্যাপনা করছে। ওই তো দক্ষিণপাড়ার প্রীতিদি ইংল্যান্ডে চলে গেলেও দেশে-বিদেশে সংস্কৃতের খুব সম্মান। আরতি ভালো ছাত্রী। ও যদি আচার্য হয়, আমাদের জেলার কত সম্মান বাড়বে। অনাথদা ভালো ভালো লোকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শুধু বাড়িঘর রাস্তা পার্ক মল—এই সব কোনও একটা জায়গার একমাত্র পরিচয় হতে পারে না।

‘তা হলে কী বলছিস?’

‘আরতিকে ডাকো।’

‘কী রকম একটা ভয়ভয় করছে।’

‘কীসের ভয়?’

‘আমার তো খুব বদনাম। যেই আরতি আমার ডাকে বাইরে আসবে, আর পথে নামবে, আপনি সব বাড়ির জানলা খুলে যাবে। হে রে রে রে করে তেড়ে আসবে। অনাথ আরতিকে নিয়ে পালাচ্ছে।’

‘তুমি কেন এত ভীতু হয়ে গেছ। ডাকো আরতিকে। লোক, লোক, লোক না পোক। সব পোকামাকড়।’

‘বাবা, তোর মধ্যে এত আগুন, এত আগুন।’

‘হ্যাঁ, ছোরা-ছুরি-বোমা-পিস্তল নেই আমার কাছে, আমার ভেতরে আছেন গৌতমবুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, মা সারদা, মা কালী, মা দুর্গা। আমার কীসের ভয়, কাকে ভয়? আমি আজ এখানে, কাল সেখানে, আমি নিজেকে ভাবি বিরাট একটা পাখি।’

‘তোর মাথাটা?’

‘কোনও চিন্তা নেই। ঠিক আছে। ডাকো আরতিকে।’

আরতি বাইরের ঘরেই ছিল। জানালায় এসে দাঁড়াল। শুনতে পাচ্ছি, অনাথ তাকে বোঝাচ্ছে। কানে এল, আরতি বলছে, ‘যাঁদের হাঁড়ি চড়ছে না, তাদের মেয়ের আবার লেখাপড়া। আমি এখন আয়ার কাজ খুঁজতে বেরোব। লেখাপড়া করার বরাত করে জন্মাইনি অনাথদা। তোমাদের পরিকল্পনা খুবই ভালো। সংস্কৃত আমার প্রিয় সাবজেক্ট। কী করব? এই বাড়িটাও কি থাকবে? মাথার ওপর কেউ নেই।’

প্রথমে খুব রাগ হচ্ছিল, তারপর ভাবলুম—সত্যিই তো। পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। কী করা যায়? এই সমস্যার কী সমাধান?

একমাত্র বড়মামা আর মেজোমামাই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেন। আরতিদি যদি বড়মামার মেয়ে হত। তাহলে? ভগবানের দয়ায় টাকার তো অভাব নেই। গুচ্ছের বাজে খরচ। অনাথদা হতাশ হয়ে রকে বসে পড়েছে। সাংঘাতিক একটা তেজী ছেলে, কিন্তু সমস্যাটা এমন মার-দাঙ্গা করে কিছু হবে না। বাড়িটা যদি কারো কাছে বাঁধা থাকে, তাহলে তো হয়েই গেল। এদের কোনও আত্মীয়-স্বজন নেই না কি?

‘ঠিক আছে। অনাথদা। এখন চলো। যেখানে যাওয়ার যাই। পরে কী করলে এই সমস্যার সমাধান হয়, সবাই মিলে বসে ভাবতে হবে।’

‘ঠিক বলেছিস, ভাবতে হবে। দিনের পর দিন শুধু ভাবতে হবে। ভাবনা ছাড়া আমাদের আর কী আছে? সাধু ভাবছে, শয়তান ভাবছে। আর সাধারণ মানুষ ভুগে মরছে। ধ্যাত তেরিকার জগৎ।’

‘তা তুমি কী করতে চাও?’

‘তুই বল আমি কী করব? আত্মহত্যা? যা আছে, যেমন আছে সব থাক, আমি চলে যাই।’

‘তুমি পালিয়ে যাবে? হেরে যাবে?’

‘যুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে? বলতে পারিস?’

‘ভাগ্যের বিরুদ্ধে।’

‘ওই তোদের একটা অদৃশ্য শত্রু আছে—ভাগ্য। ভাগ্য আমি বিশ্বাস করি না। ভাগ্য, ভাগ্য, ভাগ্য। মানুষ, সব মানুষের কেরামতি।’

‘আরতিদি, তুমি কিছু বলো।’

‘তোমাদের একটা সুখবর দিই—এই বাড়ির দলিলটা কোত্থাও খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘সে কী?’

অনাথ বললে, ‘তোমার বাবা তো একটা চাকরি করতেন?’

‘আমাদের বলেনি, সে চাকরি অনেকদিন চলে গিয়েছিল।’

‘কী আশ্চর্য মানুষ। কোনও দায়দায়িত্ব ছিল না।’

আমি বললুম, ‘আরতিদি, তুমি ওই খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসো তো। আমাদের সঙ্গে চলো। বাইরে না বেরোলে কিছু হবে না। বেরিয়ে এসো। চলো আমরা পণ্ডিতমশাইয়ের টোলে যাব। দেখাই যাক না, কী হয়।’

তিন

পণ্ডিতমশাই যেন শিবঠাকুরটি। বোমভোলা। ফর্সা। ভুঁড়ি আছে। খাড়া নাক। টানাটানা চোখ। হাসিহাসি মুখ। তিনি বলেন, সকালে আমি চাষা। ঠিক তাই। বাগানে খুরপি হাতে ঘুরছেন। মাচায় দোল খাচ্ছে শশা, করলা, সিম। লাউ হয়েছে। কুমড়ো। একপাশে একটা কোদাল, একতাল গোবর, কিছু খড়। পণ্ডিতমশাই কখনও গান গাইছেন, কখনও দু-হাত তুলে নাচছেন। কখনও লাউ, কুমড়োর সঙ্গে কথা বলছেন। চতুর্দিকে নানা রঙের ফুল। বাহারি প্রজাপতি কাগজের টুকরোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। পণ্ডিতমশাইয়ের বাগানে যেন উৎসব হচ্ছে। মাথার ওপর রোদ ঝলমলে শরতের নীল আকাশ। টিয়াদের শরীরে নতুন পালক এসেছে। এ-গাছে, ও-গাছে ভীষণ চেঁচামেচি। আমরা তিনজন হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি, পণ্ডিতমশাই মানুষ না দেবতা। শরীরে অদ্ভুত একটা জ্যোতি। আমাকে প্রায়ই বলেন, ‘এই বয়েসটা খুব সাবধান, ব্রহ্মচর্য, ব্রহ্মচর্য। মেয়েদের পায়ের দিকে তাকাবে। দূরে থাকবে। আত্মীয়স্বজন হলেও সাবধান। অশিক্ষিত মন শত্রু, শিক্ষিত মন চিরবন্ধু।’

এই কথা মনে হতেই দেখলুম, আরতিদি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বেশ দূরে সরে যেতেই অরিতিদি বললে, ‘আমি গরিব বলে সরে গেলি। বেশ করেছিস।’

‘এ কী কথা। আরতিদি! তুমি তো আগে এরকম ছিলে না। এ তুমি কী বললে? আমি যে তোমার কথা সব্বাইকে বলি। মনে মনে ভাবি, যদি কোনও দিন লেখক হই তোমাকে নিয়েই লিখব আমার প্রথম গল্প। তুমি আমাকে এ কী বললে! তোমার চেয়ে আমি গরিব। তোমার মা আছেন, আমার বাবা-মা কেউই নেই। মামারা ভীষণ ভালো, তাই আমাকে রেখেছেন। মামিমা-রা থাকলে কী হত বলতে পারব না। দূর করে দিত। আমি ছাড়া কে আছে আমার এই পৃথিবীতে।’

আরতিদি ঝটিতে আমার কাছে সরে এসে বললে, ‘আমি আছি। আমি আছি।’

পণ্ডিতমশাই কুমড়োগাছের সঙ্গে কথা বলছেন, ‘মা! কেবলই ফুলই দেবে? ফল দেবে কবে? তোমার ফুলে তো পুজো হবে না মা?’

এতক্ষণে দেখতে পেয়েছেন, ‘এ কী রে? তোরা তিনজন কোথা থেকে এলি? চল চল, মন্দিরের দাওয়ায় চল। আরতি এসেছিস? তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। কিন্তু, কিন্তু…।’

অনাথ বললে, ‘এত কিন্তু, কিন্তু করছেন কেন? আরতিকে যা বলার বলুন না, আমরা সরে যাচ্ছি।’

‘আরে না রে, এ কিন্তু সে কিন্তু নয়। মনে হচ্ছে খিদে পেয়েছে। অনেকটা মাটি কুপিয়েছি তো।’

‘কী খাবেন বলুন। কিনে আনি।’

‘আরে খাব কী রে? পুজো হয়নি তো!’

‘তা হলে?’

‘আরে না। জল খাব। ঢকঢক করে জল খাব। আচ্ছা অনাথ। তুই কেন এলি?’

‘আমি একটা বদ, তাই তো?’

‘তোর মতো উত্তম এই পাড়ায় ক’জন আছে? তুই তো শিবের ভৈরব রূপ। কম বয়েসে কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল হতে পারে, কিন্তু সদ্বংশের ছেলে একসময় নিজেকে খুঁজে পাবেই। তখন সে আর ভৈরব থাকবে না, শিব হয়ে যাবে। সদাশিব। তুই কি জানিস, এই টোল তোর পূর্বপুরুষরা স্থাপন করেছিলেন। তখন নবদ্বীপ হয়ে উঠেছিল পণ্ডিতদের জায়গা সংস্কৃত চর্চার প্রাণকেন্দ্র। নবদ্বীপের একজন বালকও তখন পণ্ডিতদের সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করতে পারত।’

দাওয়ায় মাদুর পেতে আমরা সবাই বসলুম। পণ্ডিতমশাই ভেতরে গেছেন, এখুনি আসবেন। ওদের দুজনের কী মনে হচ্ছে জানি না, আমার মনে হচ্ছে স্বর্গে বসে আছি। আলো, বাতাস, ফুল, ফল, পাখির ডাক। আকাশ। অনাথ বললে, ‘কী ভালো লাগছে, তোকে বলে বোঝাতে পারব না। তুই আমাকে স্বর্গে এনেছিস!’

আরতি বললে, ‘এমন মনে হচ্ছে, আমি আর বাড়ি যাব না।’

পণ্ডিতমশাই সাজ বদলে আমাদের মাঝে এসে বসলেন। আরতিকে বললেন, ‘তুই এসে খুব ভালো করেছিস। তুই না এলে আমাকেই যেতে হত। তুই কিছু জানিস?’

‘কী জানার কথা বলছেন?’

‘জানিস না। পরে বলছি, আগে বল, চলছে কীভাবে?’

‘না খেয়ে, এই অনাথদার সাহায্যে।’

‘তাহলে শোন, তোদের বাড়ির দলিল আমার কাছে।’

‘সে কী, আপনার কাছে?’

‘হ্যাঁ আমার কাছে। তোর বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী তোর ছোটমামা, পরোক্ষে দায়ী তোর মা। শুনতে খুব খারাপ লাগলেও ব্যাপারটা খুব সত্যি। তোকে বাঁচাবার জন্যে তোর বাবা দলিলটা আমার কাছে রেখে গেছে। শুধু রেখে গেলে কী হবে? দলিল হারালে কপি বের করতে কতক্ষণ? তাই আর একটা চালাকি করা হয়েছে, তোর বাবা বাড়িটা আমার কাছে বাঁধা রেখে গেছে, আমি যেন তাকে অনেক টাকা ধার দিয়েছি। এসবই তোর জন্যে—আরতি, আরতি, আরতি। ওই বাড়িটা এখন আমার। মানে তোর। তোর মা চিরকালই বাপের বাড়ির ভক্ত। তোর ছোটমামা নয়নের মণি। আরতি! আমি আছি।’

আমরা তিনজনে হাঁ করে শুনছি।

অনাথ বললে, ‘পণ্ডিতমশাই, ওর মামা যদি ওই বাড়িতে এসে ঢুকে পড়ে, তাহলে কী হবে!’

‘হ্যাঁ, সে সম্ভাবনা ছিল, এখন আর নেই। পা ভেঙে হাসপাতালে পড়ে আছে। ফুসফুসে সর্দি জমেছে। অনাথ তোর তো কোনওভাবেই এখানে আসার কথা নয়, কেন এসেছিস? ভগবান টেনে এনেছেন। কাল আমার কাছে সরকারের অনুমোদন এসেছে। আমি আবেদন করেছিলুম, ‘ভরদ্বাজ চতুষ্পাঠী’ স্থাপন করব। ছেলে আর মেয়েরা গুরুকুল পদ্ধতিতে সংস্কৃত শিখবে। উপাধি পাবে। তারা বৃত্তি পাবে। সরকার অর্থ মঞ্জুর করেছেন। আমার এতদিনের লড়াই সফল হল। এই চতুষ্পাঠী হবে আরতিদের বাড়িতে। ওর বাবারও খুব ইচ্ছা ছিল। একটা দলিল করে দিয়ে গেছে। পাঁচ কাঠা জমি সমেত দোতলা বাড়িটা দান করে গেছে। ও যে চলে যাওয়ার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিল, আমি বুঝতে পারিনি, আমি বুঝতে পারিনি।’

পণ্ডিতমশাই কাঁদছেন। ধরাধরা গলায় বললেন, ‘বলতে পারিস, মানুষ কেন মানুষকে বাঁচতে দেয় না। কই একটা ফুল তো আর এটা ফুলকে মেরে ফেলে না। আকাশে কত তারা, কই একটা তারা তো আর একটা তারার মৃত্যুর কারণ হয় না।’

অনাথ বললে, ‘আরতির কী হবে? কী হবে আরতির মায়ের?’

‘এই দেখ, আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। আরতিই তো সব। এই আবাসিকে যে-সব ছাত্র-ছাত্রীরা আসবে, তাদের সব দায়িত্ব আরতির। রান্নাঘর, ঠাকুরঘর আরতির, হোস্টেল আরতির। আরতি মাইনে পাবে, থাকার জায়গা পাবে। আরতি পড়বে, পরীক্ষায় বসবে, উপাধি পাবে।’

‘আর আমি কী করব?’

‘তুই তো আমার ডান হাত।’

‘একটা মূর্খ আপনার ডান হাত হবে? চতুষ্পাঠীর বদনাম। সমালোচনা হবে।’

‘ওটা আমার ওপর ছেড়ে দে। প্রচুর কাজ। বাড়িটার অদলবদল করতে হবে, একটা অংশ বাড়াতে হবে। সবার আগে, দু-তিন দিনের মধ্যে তুই একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দে, ‘ভরদ্বাজ চতুষ্পাঠী’। কাশী থেকে আর একজন পণ্ডিত আসবেন মহামহোপাধ্যায়। আমার বন্ধু। আমরা এখানে সেই অতীত নবদ্বীপকে ফিরিয়ে আনব। এই চতুষ্পাঠীর ছাত্র-ছাত্রীরা ইউরোপ আমেরিকায় যাবে। গবেষণা করবে।’

পণ্ডিতমশাইয়ের টোল থেকে বেরিয়ে এসে আমরা গঙ্গার ধারের বটতলায় গিয়ে বসলুম। অনাথ বললে, ‘ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে হয়ে গেল। এই পরিকল্পনায় আরতির ভবিষ্যৎ তেমন স্পষ্ট হল না। আইন আমি কিছুটা জানি, কারণ পরিবারে মামলা লেগেই আছে। পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের কতটুকু অধিকার? বিয়ের পর আরতি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। তখন? পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে দলিল। ভবিষ্যৎ ঝুলেই রইল। এত বড় একটা পরিকল্পনা একা সামলাতে পারবেন? কোথা থেকে কে এসে যাবে কে জানে? আমরা তো লেখাপড়া করতে চাই। আরতির ছোটমামা কৃষ্ণেন্দু সত্যিই কি এতটা খারাপ?’

আরতি বললে, ‘অনাথদা, পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে ভীষণ ঘোলাটে। এটা ঠিক, বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক থেকে থেকেই খুব খারাপ হয়ে যেত। কথা বন্ধ। খাওয়া বন্ধ। কীভাবে যে আমার দিন কেটেছে। আর ভাবতে পারছি না।’

অনাথ বললে, ‘পণ্ডিতমশাই ভালো মানুষ। তাঁর মাথায় টুপি পরানো খুব সহজ। পণ্ডিতমশাই বেশির ভাগ সময় স্বপ্নে থাকেন। থেকে থেকে কাশীতে চলে যান। টাকা সামলানো, হিসেব—এসব কিছু ওঁর ধাতে নেই। আমার বাড়ির অবস্থা ভয়ঙ্কর। বাবা আর কাকা পারলে একজন আর একজনকে এখনই খুন করেন। দুজনেরই শেষজীবন জেলে কাটবে। আমার বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না। আরতির বাড়িটা একটা কফিন। ওদের ওই সম্পত্তিটার এখন অনেক দাম। দলিল-টলিল যেখানে যাই থাক, সম্পত্তির মালিক আরতির মা—কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাপার; কিন্তু বাড়ি তো টাকা পাড়বে না, উপোস করে মর।’

‘আচ্ছা, তোমরা একটা কথা ভাবছ না কেন? একটা ফ্লোর তো ভাড়া দেওয়া যায়। ভালো ভাড়াটে।’

‘পরে আর তোলা যাবে না, কে মামলা করবে বছরের পর বছর। লাভের গুড় পিঁপড়ে খাবে।’

‘তা হলে এই দাঁড়াল, সমস্যার সমাধান নেই।’

‘আছে। বড়মামা। নির্মল এক মানুষ। সবাই বলে পাগলা দেবতা। আজ রাতে বড়মামার কাছে যাব।’

‘রাত্তিরে কেন? এখনি চলো, চেম্বারে এসে গেছেন।’

‘সব কিছুর একটা সময় আছে।’

আরতি বললে, ‘ওই বাড়িটায় থাকতে আমার ভীষণ ভয় করে।’

‘দিনের বেলা কীসের ভয়?’

‘থাকলে বুঝতে পারতে। কত রকমের শব্দ। এটা পড়ে যাচ্ছে, ওটা পড়ে যাচ্ছে। তিন তলার ছাতে উঠে দেখছি কেউ আগুনে জ্বেলে কী সব পুড়িয়েছে। কাক মরে পড়ে আছে। আমি একা একটা মেয়ে। এই সব দেখলে ভয় করবে না। একজনও কাজের লোক নেই, সারা বাড়িটা ধুলো আর ঝুলে ভরে গেছে। আমি একা কত করব। আর একটা ঘরে মা পড়ে আছে। সব জানালা বন্ধ। দিনের বেলাও অন্ধকার। উঠতে পারে কিন্তু উঠবে না। বারান্দায় গিয়ে বসবে না। আমার কী শাস্তি। মাঝে মাঝে মনে হয়, মাকে ভূতে ধরেছে। মেয়ে হয়ে মায়ের নিন্দা করা উচিত নয়, তবু বলছি, বাবাকে একটা দিনের জন্যেও শান্তি দেয়নি। দিনের পর দিন বাবা না খেয়ে থেকেছে। অমন মায়ের পরিচয় দিতে লজ্জা করে। এই তোমরা চলে যাবে, আমার সারাটা দিন কী ভাবে কাটবে? কেউ আসে না, কেউ আসেন মায়ের দুর্ব্যবহারের জন্যে। কে ইলেকট্রিক বিল দেবে, কে দেবে বাড়ির ট্যাক্স।’

অনাথ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এটা তো ভাবা হয়নি—ইলেকট্রিক বিল, ট্যাক্স!’

সংসার ভেঙে গেলে মানুষের কী অবস্থা হয়! কে কার খবর রাখে। আরতিদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কত মানুষ সারাদিন এদিকে যাচ্ছে ওদিকে যাচ্ছে, কে খবর রাখে ইটের খাঁচায় কী হচ্ছে। খাঁচায়-খাঁচায় জীবনের নাটক।

সকালটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল। একটুও পড়া হল না। আরতির কী হবে? যা হওয়ার তাই হবে। এক একজনর এক এক রকম হয় কেন? ভাগ্য। নাঃ, আমি কাশীতেই চলে যাব। বড়মামা রাজি হয়েছেন। বয়েস বেড়ে যাচ্ছে। গোঁপ-দাড়ি বেরোল বলে। লজ্জাও করছে। আর কয়েক মাস পরেই আমি বড়দের দলে ঢুকে পড়ব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গালে সাবানের ফ্যানা। কিশোর এখন যুবক। এইবার ভাবতে হবে চাকরির কথা। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা। তারপর ভারিক্কি চেহারার ভোঁদকা একটা লোক। ভগবান! আমি বড় হতে চাই না।

পেছন থেকে কে ডাকছে—’অনাথদা। অনাথদা।’ আরতির গলা।

শিবমন্দিরের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি। আরতির খালি পা। বাতাসে চুল উড়ছে।

অনাথ জিগ্যেস করল, ‘কী হল? অমন করছিস কেন?’

‘মা বোধহয় মারা গেছে।’

‘কী বলছিস তুই?’

‘খাট থেকে মেঝেতে পড়ে গেছে। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা।’

খাট আর টেবিলের মাঝের দূরত্ব হাত দশেক। মাঝখানে আরতির মা মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন। একটা খালি জলের ‘জাগ’ একপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

অনাথ বললে, ‘জল তেষ্টা পেয়েছিল, জলের জাগটার কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। হয়তো ধরেও ফেলেছিলেন; কিন্তু খালি, হালকা ফঙফঙে। ভার সামলাতে পারেননি। এক ফোঁটা জলের জন্যে জীবন চলে গেল। কোনও দিনই কেউ দেখল না। কেউ না। স্বামী তো নয়ই, মেয়েটাও না। জাগটা দেখেই বুঝতে পারছি, অনেকদিন কেউ জল ভরেনি এতে। শুধু নিন্দা, নিন্দা, নিন্দা। কেউ এতটুকু সেবা করেনি। সবাই ‘আমার আমার’ করে এই সুন্দর মানুষটাকে মেরে ফেলল। খুন, খুন। সবাই খুনি।’ অনাথ কাঁদছে। ‘কেন তুই মায়ের সেবা করিসনি? কার বুকের দুধ খেয়ে তুই বড় হয়েছিস? তোর বাবা একটা চিট। রেস খেলত, আর লোকের কাছে বউ-এর নামে বলত। মিথ্যে মিথ্যে বলত। যদ্দিন তোর ঠাকুর্দা বেঁচে ছিলেন তদ্দিন সুবিধে করতে পারেনি শয়তানটা। আর ওই পণ্ডিত। ফুলের বাগানে প্রজাপতি ওড়াচ্ছে। এদিনে বুঝেছি, লোকটা বন্ধকি কারবার করে। ধোঁকাবাজ, ধাপ্পাবাজ। চতুষ্পাঠী করবে? নবদ্বীপে করবে। করাচ্ছি।’

আরতি আমাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমাদের দুজনের মনে হয়, একই বয়েস। এই বাড়ির পেছন দিকের মাঠে খেলা করেছি। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন। আরতির মাকে আমরা সবাই বলতুম, আশা বউদি। হাহা করে হাসতেন, গান গাইতেন। খুব ভালো গান। সুন্দর, সুন্দর গান। বৃদ্ধ শ্বশুরমশাইকে নিয়ে গঙ্গার ধারে বেড়াতে যেতেন। অপূর্ব দৃশ্য। ফর্সা ধবধবে এক বৃদ্ধ। সাদা পাঞ্জাবি ধুতি, একমাথা রুপালি চুল, হাতে ছড়ি, পায়ে চটি, পাশে সুন্দরী, হাসিখুশি একটি মেয়ে। দুজনে হাসছেন, গল্প করছেন। মাঝে মাঝে নৌকাভ্রমণ। অনেকের হিংসে হত। কেন এত সুখ। কত কী খাওয়াতেন। কখনও ঘুগনি, কচুরি, আলুর দম। নারকোল নাড়ু, নানারকম পিঠে। বাড়িটাকে আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন। বৃদ্ধের মৃত্যুর পর সব শেষ।

আরতি বললে, ‘অনাথদা, আমি মাকে এতটুকু অযত্ন করিনি। সবসময় এই ঘরে ওই দেয়ালটায় পিঠ দিয়ে বসে থাকতুম। কখন কী দরকার হয়। তোমরা ডাকলে, জোর করে নিয়ে গেলে। ওই জাগটায় বাবা জল খেত। অনেকদিন ওটাতে আর জল রাখা হত না।’

অনাথ বললে, ‘এখন কী হবে? প্রথমে ডাক্তার। মাকে, তার আগে বিছানায় তুলতে হবে। পড়ে গিয়ে মৃত্যু মানে অস্বাভাবিক মৃত্যু, পুলিশ কেস, পোস্টমর্টেম।

‘পোস্টমর্টেম কেন? খুন না কি?’

‘কেউ যদি ফেলে দিয়ে থাকে, বিষয় সম্পত্তির লোভে।’

অনাথ আর আরতি ধরাধরি করে তুলল। এরই মধ্যে দেহ শক্ত হতে শুরু করেছে। এখন বড়মামার কাছে যেতেই হবে।

ডক্টর এস মুখার্জি। সবাই বলেন, ‘হ্যাঁ, একজন ডাক্তার বটে। মরা মানুষকে জ্যান্ত করতে পারেন; কিন্তু ভীষণ খেয়ালি।’

বড়মামার চেম্বারটা ভীষণ সুন্দর জায়গায়। জমিদারদের এলাকা। এক সময় বিদেশিরা এদিকে থাকতেন। এদিকটায় এলেই মনে হয় আমি বিলেতে এসেছি। একটা বাগান ঘেরা কাঠের বাড়ি আছে। এক বৃদ্ধা মেম আজও আছেন। আশ্চর্য নীল চোখ।

বড়মামার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব। বাংলোর দোতলার বারান্দায় বসে হাতে সময় থাকলে দুজনে কফিপান করেন। খুব গল্প হয়। তারপর ‘রুটিন চেকআপ’। মেমসায়েবের স্বামী ছিলেন এক বিখ্যাত জীব-বিজ্ঞানী। কীট-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণার জন্যে এসেছিলেন। শেষ জায়গাটাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছেন দেশে আর ফেরা হল না।

বড়মামা বাংলোর দোতলায় বারান্দায়। কফির আসরে। আমাদের দেখে একটু আশ্চর্য হলেন। নেমে এসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোদের? মুখচোখের এই অবস্থা কেন?’

অনাথ গোছগাছ করে সব বললে। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে দলিল, চতুষ্পাঠী—এই সবই বড়মামাকে জানিয়ে দিল, কারণ পণ্ডিতমশাইয়ের সঙ্গে আরতির বাবার যোগাযোগের কোনও কারণ নেই। বড়মামাও বেশ আশ্চর্য হলেন। আরতির বাবা স্নায়ুর অসুখে ভুগছিলেন। মানুষটা খারাপ ছিলেন না। ডিপ্রেশানের শিকার। ব্যাঙ্কের ভালো চাকরিটা ছাড়তে হল শরীরের কারণে; কিছুই মনে রাখতে পারছিলেন না। মাঝে মাঝে এমনও হত নিজের বাড়ি ভুলে যেতেন। নিজের নাম—ঠিকানা নিজের পরিচিতজনদের চিনতে পারতেন না। আরতির মাকে হঠাৎ বললেন, ‘তুমি কে? কী চাই?’ অনেকেই মনে করত, এসব বদমাইশি।

বড়মামা বললেন, ‘এই ধরনের মৃত্যু নিয়ে গোলমাল করলে করা যায়; তবে কে করবে, কার বিরুদ্ধে করবে?’

অনাথ বললে, ‘আমার সঙ্গে আরতিকে জড়িয়ে আমার ভাইরা!’

‘এতে তাদের কী লাভ হবে?’

‘ওরা চায় আমি মরে যাই। যাবজ্জীবন হলেও মন্দ হবে না।’

‘ছাড়তো এসব। আজেবাজে ভাবনা। তোরা ডাক্তার সরকারকে নিয়ে যা। ওদের ফ্যামিলি ডাক্তার। ভালো মানুষ, বয়েস হয়েছে। সাতে-পাঁচে থাকেন না।’

আমি বললুম, ‘তুমি একবার যাবে না।’

‘না, ইচ্ছে করেই যাব না। আমি কিছুই জানি না। কেউ জানে না। স্বাভাবিক একটা মৃত্যু।’

‘পণ্ডিতমশাইকে বলা হবে?’

‘কেন বলা হবে? তিনি কে?’

‘না, তা নয়, তবে সকালবেলা কথা হল। চতুষ্পাঠী হবে।’

‘ছাড় তো! বললেই হবে।’

‘তুমি কি সরে যেতে চাইছ?’

‘আজেবাজে কথা না বলে এখন কাজের কাজ কর।’

ডাক্তার সরকার হুসহুস করে শব্দ করে চা খাচ্ছিলাম। শুনেই বললেন, ‘জানতুম, রিউমাটিক হার্ট। কেউ দেখার ছিল না। ওষুধও বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার আর যাওয়ার দরকার নেই। এখানে বসেই লিখে দিচ্ছি।’

অনাথ বললে, ‘সেটা ঠিক হবে না। একবার চলুন। দিনকাল ভালো নয়। স্বামী বেঁচে নেই।’

‘কথাটা খুব ঠিক। তা চলো। ওই বাড়িটায় যেতে ইচ্ছে করে না। অপয়া বাড়ি। ভিটেটা বাজে।’

এসব কথার কোনও মানে হয় না। যা করতে হবে তা করতে হবে। অনেকটা সময় চলে গেছে। আরতি একা। তার মায়ের মরদেহ পাহারা দিচ্ছে। তার কেমন লাগছে আমি অনুভব করতে পারছি। উঃ। এই মৃত্যু! অসহ্য, অসহ্য।

ডাক্তার সরকার কিছুতেই পরীক্ষা করলেন না। ঝুঁকে পড়ে একবার দেখলেন। খসখস করে সার্টিফিকেট দিলেন। ভিজিট নিলেন না। শুধু বললেন, ‘মেয়েটা ভীষণ ভালো ছিল। আমাকে একটা সুন্দর সোয়েটার বুনে দিয়েছিল। প্রত্যেক শীতে আমি পরি। আমার মায়ের অসুখে কী সেবাই না করেছিল। এই রকম একটা মেয়ে হয় না। সে চলে গেল। আর আমরা স্টেথিসকোপ গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছি। আশা! আমি তোমাকে কোনও দিন ভুলব না। তুমি অভাবী মানুষের চিকিৎসার কথা বলেছিলে। আমি ভুলিনি আশা। আমি সেই কাজ শুরু করে দিয়েছি। তুমি আমার আলো—আশার আলো।’

ডাক্তারবাবু পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। একটা আয়না। তার নীচে মেয়েদের সাজবার জিনিসপত্তর। চিরুনি, সিঁদুর, সেফটি পিন, চুলের কাঁটা, ক্লিপ। ডাক্তারবাবু চিরুনিটা হাতে তুলে নিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগলেন, ‘থাকে না, কিছুতেই থাকে না। তা হলে তুমিই জিতলে, ডেথ সার্টিফিকেটটা আমাকে দিয়েই লেখালে।’

ডাক্তার সরকার আরতির মাথাটা নিজের চওড়া বুকে ধরে বললেন, ‘ভাবিস না, ভাবিস না। আমি আছি, আমিই তোর বাবা।’

চার

মিটে গেল। শ্রাদ্ধও হল। অনাথ সকলের নাথ। ওর মতো আমি হতে পারব না। আমি একটা প্যানপ্যানে, ঘ্যানঘ্যানে ছেলে। নিজের কথা ভাবতেও ঘেন্না করে। কোনও ব্যক্তিত্ব নেই। একবার ভাবছি এই হব, একবার ভাবছি ওই হব। দুপুরবেলা। আমি, অনাথ, আরতি বসে আছি ওদের ঘরে। হনুমানের একটা দল মাঝে মাঝে এদিক ওদিক আসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে। আজ এসেছে। দাপাদাপি করছে ছাতে। আরতি আলমারি খুলেছিল। ভাঁজ ভাঁজ কাপড়ের তলা থেকে ছোট্ট একটা নোটবুক বেরোল।

‘এই দ্যাখো, মায়ের লেখা।’

অনাথ বললে, ‘পড় না! কী লেখা আছে পড়।’

‘আরতির বাবার মাথা ক্রমশ খারাপ হয়ে আসছে। আমাকেই আর চিনতে পারে না। নিজের মেয়েকে দেখে মাঝে মাঝে বলে ওঠে, এটা কে—কোথা থেকে এল? ও পাগল হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ওর ওপরে কোনও প্রেত ভর করে। তখন দুহাতে নিজের চুল ছেঁড়ে। শক্ত জিনিস কামড়াতে থাকে। তালা, চেয়ারের হাতল, হাতা, খুন্তি। সেই সময় ছুরি দিয়ে আঙুল কেটে নিজের রক্ত চুষে খায়। আরতিকে মেরে ফেলবে না তো। আমার শ্বশুরমশাই উইল করে এই সম্পত্তি দান করে গেছেন। সাক্ষী ডাক্তার সরকার। খাটের তলায় একটা গুপ্তবাক্স লাগানো আছে, কেউ জানে না। তার ভেতর আরতি জন্যে অনেক গয়না, আর সেই দানপত্রটা আছে। চাবিটা আছে মা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে। আরতি সাবধানে থাকিস। আমি আর বেশিদিন নেই। আমি তোকে মুখে না বলে কেন লিখছি? শোনা কথা পেটে থাকে না। তা ছাড়া লেখা একটা প্রমাণ, একরকমের উইল। সব তোর, সব তোর। একা থাকিস না। ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে করিস।’

গুপ্তধন নয়, লুকিয়ে থাকা ধন বেরোল। মোটামোটা গহনা। হার, বালা, বাজু, হিরের আংটি, দানপত্র, একেবারে ছেলেবেলায় তোলা আরতির ছবি। দৌলত বেরিয়ে পড়েছে। আর আমি এখানে থাকব না। এরপর কী হবে কে বলতে পারে। অনেক ভরি সোনা, হিরে। আমি বললুম, ‘অনাথদা। একটা জরুরি কাজ আছে, ঝট করে সেরে আসি।’

‘আমারও একটা খুব খুব জরুরি কাজ আছে। স্টেশানে যেতে হবে।’

আরতি বললে, ‘বাঃ আমার কাছে কে থাকবে? এখন যখের ধন নিয়ে ভূতের বাড়িতে আমি একা কী করে থাকব?’

‘মনে করো এগুলো নেই। যেখানে ছিল সেইখানেই রেখে দে।’

‘একবার জেনে ফেললে আর ভুলে থাকা যায়? তোমাদের কারো কোনও কাজ নেই। তোমরা ভয়ে পালাচ্ছ। এইবার কেউ না কেউ আমাকে খুন করবে, তোমরা ভাবছ সেই খুনের দায় তোমাদের ওপর পড়বে। কাজের কাজ তোমরা কিছুই করলে না, এখন আমাকে ফেলে রেখে পালাতে চাইছ? এই তোমাদের বিচার? কেউ কারো নয়। এই তোমাদের ভালোবাসা।’

‘তোর অসাধারণ বুদ্ধি। ধরেছিস ঠিক। অর্থই অনর্থ। তুই এখন প্রকৃত বড়লোক। আমরা গরিব, অসহায়ের বন্ধু হতে চাই।’

‘আমি বন্ধুত্ব চাই, ধনদৌলত চাই না। এই সব তোমরা নিয়ে যাও, দান করে দাও।’

চালাকি ধরা পড়ে গেলে মানুষকেও কীরকম বোকা দেখায়। আমাদের ঠিক সেই রকম দেখাচ্ছে। মেয়েদের দিকে এক নজরে বেশিক্ষণ তাকাতে নেই, তায় আরতি যথেষ্ট সুন্দরী। ভগবান যাকে যেমন করবেন। অনাথ জমিদার বংশের ছেলে। সে তো সুন্দর হবেই।

অনাথ বললে, ‘আমরা একটা জায়গায় বিশ্রী ভাবে আটকে গেছি। আজ রাতে যখনই হোক একটা মিটিং করব। বড়মামা থাকবেন, ডাক্তার সরকার আর মেমসাহেব।’

‘শেষের দুজন কেন?’

‘ডাক্তার সরকারের মাথায় বেশ কিছু আইডিয়া আছে। ওই কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছে—’আশার আলো’। ওই শব্দটাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আর মেমসাহেব? স্কটল্যান্ডের বাড়ি। সিস্টার নিবেদিতার কথা ভাব। স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড। বীরের দেশ, স্বাধীনতার দেশ।’

‘পণ্ডিতমশাইয়ের চতুষ্পাঠী?’

‘ওঁকে ওঁর মতো এগোতে দে।’

‘বড়মামাকে বলতে হবে তো?’

‘হবেই তো।’

অনাথ আরতিকে বললে, ‘তুই কেন এত ভীতু। তুই কি জঙ্গলে বাস করছিস? সাহসী হ। ওই মেমসায়েবকে দেখ। একেবারে একটা নির্জন জায়গায় একা একটা বাংলোয় থাকেন।’

বড়মামা প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না, ‘আমি একটা খামখেয়ালি। যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করি। উত্তর ভারত, হিমালয় আমাকে টানে। তবে এটাও ঠিক, কিছু একটা করা উচিত। আমাদের দারিদ্র ঘুচবে না। আমাদের স্বভাব অন্যরকম। খেতে পেলে শুতে চাই। পণ্ডিতমশাইকে বলতে হবে। খুব দুঃখ পেয়েছেন। আশার মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়নি। বলেছেন, ওরা আমাকে জোচ্চর ভেবেছে। লোভী ভেবেছে। আমরা সন্ধে সাতটার সময় মেমসায়েবের বাংলোতেই বসব। সুন্দর জায়গা।’

অনাথ সামান্য কিছু বাজার করে আরতির বাড়িতেই ঢুকল। রান্না করবে। খুব ভালো রাঁধে। ছেলেটার অনেক গুণ। এই ক’দিনে বাড়িটার হাল ফিরিয়ে দিয়েছে। সন্ধে সাতটা। আজ পূর্ণিমা। বাংলোর সব ক’টা আলো আজ জ্বলছে। বাগানও আলোকিত। গাছের ফাঁকে নিঃশব্দ পূর্ণিমার চাঁদ। গঙ্গা আজ আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সাদা একটা স্টিমার চলেছে জল কাটতে কাটতে। আশ্রমে হরি নাম হচ্ছে। মেমসাহেব আজ নতুন একটা গাউন পরেছেন। কী তাঁর উৎসাহ! নীচের বড় হল ঘরে মিটিং হবে। ঘরটা কী সুন্দর, যেন কোনও গির্জার প্রেয়ার হল। এমন আলোর ব্যবস্থা, সারা ঘরটা নরম আলোয় ভাসছে। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, ‘আজ কি কোনও উৎসব আছে?’

‘হ্যাঁ আছে, আলোর উৎসব। আশার আলো।’

অনাথ আর আরতি আসছে। আরতিকে আজ কী সুন্দরী দেখাচ্ছে। একটা সাদা শাড়ি পরেছে। চাঁদের আলোয়, দেবদারু আর ঝাউ গাছের ঝিলিমিলি ছায়ায় মনে হচ্ছে পরি। অনাথ পরেছে সাদা পাঞ্জাবি। দুজনকে বেশ মানিয়েছে। আলো-ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে দেখতে পায়নি। রঙ্গনগাছের ঝোপের পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। মাথার ওপর দেবদারু গাছের ডালপালা।

আমি ঈর্ষা করছি না। কেন করব? যার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। এই তো ক’দিন আগে আরতি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে মুখ গুঁজে কাঁদছিল। জানি, জানি, আমি সকলের দুঃখের দিনের বন্ধু। সুখের আসরে আমার স্থান নেই। সকলের জন্যে আশার আলো, আমার জন্যে অন্ধকার কালো। ওরা দুজনে আলোকিত সভাঘরের দিকে চলে গেল। মোরাম বিছানো পথে পায়ের শব্দ তুলে। রাজপুত্র আর রাজকন্যা। একবার ডানপাশে তাকালেই আমাকে দেখতে পেত। কেন দেখবে? ওরা আমার আশার আলো জ্বালাতে যাচ্ছে। পণ্ডিতমশাই যাচ্ছেন। ডাক্তার সরকার। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি। বড় বড় মানুষগুলো কীরকম ছোট ছোট হয়ে যাচ্ছে! উঠছে, বসছে, হাত নাড়ছে, মাথা ঘোরাচ্ছে। এদিকে যাচ্ছে, ওদিকে যাচ্ছে। অনাথ আর আরতি বড় দরজার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মাথার ওপরে জোরালো আলো। আলোর ঝরনাধারায় নায়ক আর নায়িকা! যেন বিয়েবাড়ি! বউভাত।

সবাই এসে গেছেন। লম্বা টেবিলের দুপাশে সবাই বসেছেন। আমি যে নেই—কেউই লক্ষ করছেন না। ‘আশার আলো’র প্রতিষ্ঠা দিবসে একটা আলোকহীন আলো—এই আমি। আমার চারপাশে ফুটে আছে থোকা থোকা রঙ্গন। দেবদারুর ঝালোর ঝালোর পাতায় ঝুলছে শরতের পূর্ণচন্দ্র। কেউ বেরিয়ে এসে এদিকে-ওদিকে আমাকে খুঁজছে না। আমি দাঁড়িয়েই আছি। ওদিকে মালির ঘর। দরজা খোলা। উনুনে আগুন। মালির বউ রান্না করছে।

সরু একটা পথ ঢালু হয়ে গঙ্গার দিকে নেমে গেছে। আজ চাঁদের আলোর নদী। আমাকে ডাকছে, যারা সভা করছে তারা নয়। কেউ একজন ডাকছে, আমি দেখতে পাচ্ছি না। ‘খোকা-খোকা’। আমার মা।

 ‘তুমি কোথায় কত দূরে?’

 ‘এই বোকা; তুই তো আমার কোলে।’

এই ঘাটটার নাম ‘শিলাঘাট’। মহাবীরের মন্দির। না চাইতেই এক মা এসে আমার হাতে লুচি আর হালুয়া দিলেন। চাঁদের আলোয় তাঁর চোখ দুটো জ্বলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *