আলো হাতে সেই মেয়েটি

আলো হাতে সেই মেয়েটি

বেড নম্বর টু টুয়েন্টি নাইন, সেকেন্ড ফ্লোর, এই, কে আছো। পেশেন্টকে নিয়ে যাও—

বেলা দশটার কাছাকাছি সময়, হাসপাতালের ভিতর মস্ত লাউঞ্জটায় হাজার লোকের সমাবেশ। যেমন প্যাথোলজি ডিপার্টমেন্টের সামনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার লাইন, তেমনই আউটডোর পেশেন্টদের ভিড়। তুলনায় অ্যাডমিশন কাউন্টারের সামনেটা ফাঁকা।

যে-যুবকটি অ্যাডমিশন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ফর্ম ফিল আপ থেকে শুরু করে যাবতীয় ফর্মালিটিজ করছিল, তার কাজ শেষ হয়ে গেলে এভাবেই হাঁক দিল সে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ইউনিফর্ম-পরা একজন ওয়ার্ডেন পৃথ্বীশের কাছে এসে বলল, আসুন।

পৃথ্বীশ বুঝলেন এখন থেকে তাঁর পরিচয় একজন পেশেন্ট। তাকে অনুসরণ করে লিফটে উঠে একটা লম্বা করিডোর পেরিয়ে পৃথ্বীশ পায়ে-পায়ে গিয়ে পৌঁছোলেন তিনতলায় নির্দিষ্ট রুমের সামনে। পাশাপাশি দুটি বেড, তার ভিতরেরটি তাঁর। সাদা ধবধবে বিছানা, সেই বিছানায় ওঠার আগে একবার তেরচা চোখে দেখে নিলেন সামনে বিছানার পেশেন্টটিকে? এক অবাঙালি বৃদ্ধ কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে আছেন এই প্র‌থম-মার্চের দিনে।

পৃথ্বীশ ধীর পায়ে উঠে বসলেন বিছানায়। ওয়ার্ডেন তার কাজ সম্পন্ন করে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে। বেসরকারি হাসপাতালের ইকনমিক কেবিন, তবু ভিতরটা মোটামুটি ঝকঝকে। বেডের পাশে একটা ছোট্ট আলমারি, বলা যায় মিড-শেল্‌ফ। তার ভিতরে রাখা ব্রাশ-পেস্ট, তোয়ালে, একটা থার্মোমিটার। উপরে ঢাকনি-সহ জলভর্তি কাচের গেলাস। আরও আছে একটি চলমান টেবিল যা টানলে কাছে আসে, ঠেললে দূরে সরে যায়।

বিছানায় বসে দেখা যায় কেবিনের বাইরের করিডোরটা। কেউ না কেউ যাচ্ছে বা আসছে। সাদা ইউনিফর্ম পরা নার্সদের ব্যস্ত চলাফেরা। পৃথ্বীশ তাঁর রাজত্বের সবটুকু দেখে ওঠার অবকাশে একজন অল্পবয়সি নার্স এসে ঢুকল, হাতে এক সেট চেক-চেক কলারবিহীন জামা ও পাজামা। বলল, বাড়ির পোশাক চেঞ্জ করে নিন। এখন যে ক-দিন থাকবেন, এই পোশাকই পরতে হবে।

পৃথ্বীশ এখন জেলখানার মতোই এদের হাতে বন্দি। এই মেয়েটি বোধ হয় ট্রেনি নার্স। সাদা ইউনিফর্মের জায়গায় নীল চেক-চেক কামিজের সঙ্গে সাদা শালোয়ার।

পৃথ্বীশ অতএব সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে তাঁর সাজ বদলালেন সেই কয়েদি-ফ্যাশনের মতো পোশাকে। সে চলে যাওয়ার পর কয়েক মুহূর্ত নীরবতা পালনের মতো অনন্ত স্তব্ধতা। হঠাৎ খেয়াল করলেন ইতিমধ্যে বেডের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সাদা ইউনিফর্ম-পরা একজন নার্স, বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের মধ্যে, ভাবলেশহীন মুখ, তার হাতে প্রে‌সার মাপার যন্ত্র, বলল, দেখি হাতটা।

হাত বাড়ানোই থাকল, তার মধ্যে নার্সটি মিড-শেল্‌ফ থেকে থার্মোমিটারটা নিয়ে বগলে লাগিয়ে দিয়ে মনঃসংযোগ করল প্রে‌সার মাপায়। দ্রুত প্রে‌সার মেনে নিয়ে বগল থেকে বার করে নিল থার্মোমিটাররটা। থার্মোমিটারের পারদ ও প্রে‌সারের মাপ নিয়ে নোট করল নির্দিষ্ট খাতায়, পরক্ষণে বলল, বাড়িতে যেসব ওষুধ খেতেন তার কোনোটা এখন খাওয়ার আছে?

পৃথ্বীশ না বলতেই পরক্ষণে বলল, ডাক্তার আসবেন কিছুক্ষণ পরে। তিনি দেখে অ্যাডভাইস করার পর একটা ব্লাড টেস্ট করার আছে। আমি আসব তখন।

নার্সটির চেহারা ও কথার উচ্চারণ শুনে পৃথ্বীশ নিশ্চিত দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে। নার্স হিসেবে দক্ষিণ ভারতীয়দের চাহিদা আছে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে। পৃথ্বীশের মনে হল এ-মেয়েটিও খুবই দক্ষ ও কর্মতৎপর।

নার্স বেরিয়ে যেতে পৃথ্বীশের সামনে কিছুক্ষণ ফাঁকা সময়। ডা. সরকারের পরামর্শ মতো সে ভর্তি হয়েছে, কাল সকালে তার শরীরে একটা অস্ত্রোপচার হবে বলে। গত কয়েকদিনে বহু রকম ব্লাড-টেস্ট, ইউএসজি ইত্যাদি করার পর ডাক্তার নিশ্চিত হয়েছেন তার শরীরে অস্ত্র না-চালালেই নয়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর এখানকার প্র‌থা অনুযায়ী অপারেশনের আগে আরও কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে।

বেডটির পাশে একটি বড়ো মাপের জানালা, তাতে একটা পর্দা টাঙানো, তার আবরণ সরিয়ে দিতেই দেখলেন বাইরে বোগেনভেলিয়ার লতানে ডাল, নীচে থেকে বেয়ে বেয়ে উঠেছে তিনতলায়, তার ডগায় একগুচ্ছ সাদা ফুল। পৃথ্বীশ জানেন তাতে গন্ধ নেই, কিন্তু জানলার কাচ ভেদ করে তো গন্ধ আসবে না, তার শুভ্রতা ভরে নিলেন ভিতরে।

ডাক্তার সরকার এলেন বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ। সঙ্গে দুজন অ্যাসিস্ট্যান্ট, একজন ফ্রেঞ্চকাট, বছর চল্লিশেক বয়স, অন্যজন তিরিশ-বত্রিশের তরুণী। ডা. সরকার পৃথ্বীশের অসুখের ধারাবিবরণী বলে চললেন, আর তাঁর দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট নোট করে নিলেন তাঁদের ডায়েরিতে। তাঁর নিজেরই করা প্রে‌সক্রিপশন আবার একবার দেখলেন, তারপর বললেন, কাল সকাল দশটায় ওটি। অ্যানেস্থেসিস্টকে খবর দিন।

বলেই ডাক্তার সরকার ব্যস্ত হয়ে চলে গেলেন তাঁর টিম নিয়ে। পৃথ্বীশের মাথায় কিছুক্ষণ আনাগোনা হল আসন্ন অস্ত্রোপচারের দৃশ্যটা। যে কোনও অপারশেন মানেই মনের ভিতর ছটফট করে ওঠে কিছু আতঙ্কের টুকরো। সেই আতঙ্ক মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দক্ষিণ ভারতীয় সিস্টার হাজির হলেন সিরিঞ্জ আর তুলোটুলো নিয়ে। বললেন, হাতের শিরা থেকে দুটো টিউবে রক্ত নেব। দেখি কোন হাতের শিরা ভালো?

তার পরের কয়েক মুহূর্ত কিছু খুচরো যন্ত্রণার। পৃথ্বীশের চোখের সামনে তার শরীরের দু-টিউব রক্ত চালান হয়ে গেল প্যাথোলজির ল্যাবরেটরির অভিমুখে। পৃথ্বীশ জানেন আসল যন্ত্রণার সময় রাত পোহালেই। আপাতত এটুকু কষ্ট টুক করে গিলে ফেলাই সঙ্গত।

তাঁর ভাবনার মধ্যে দুপুরের খাবার এসে গেল চলমান টেবিলটির উপর। এক বাটি ভাতের সঙ্গে রুপোলি রাংতায় মোড়া চারটি বাটি, তার একটায় ডাল, একটায় সবজি, একটায় মাছ, অন্যটায় পায়েস জাতীয় কিছু একটা। রান্নার চেহারা দেখে পৃথ্বীশ নিশ্চিত হলেন এগুলো সবই পেশেন্ট’স ডায়েট। মুখে দিতেই কিছু বিস্বাদ অনুভূতি। কিন্তু গিলতে হল সোনা হেন মুখ করে।

দুপুরটা কাটাতে হল ঘর থেকে আনা কিছু পত্রপত্রিকা চিবিয়ে। তার মধ্যে ঝিমুনিও এলে কয়েক ছিলিম। সেই ঘোর কাটার আগেই আর এক কচি সিস্টার, না ঠিক সিস্টার নয়, অল্পবয়সি ট্রেনি মেয়ে এল মুখে আলতো হাসি দুলিয়ে। বলল, প্রে‌সারটা নেব।

শুধু প্রে‌সারই নয়, সঙ্গে টেম্পারেচারও মাপল। সবই রুটিন মাপামাপি।

হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, কী নাম?

সে হাসল ফিক করে, বলল, আমাদের নাম জানতে নেই। আমরা সিস্টার।

হেসে বললেন, ঠিক আছে, সিস্টারই সই।

সন্ধে পার হয়ে রাত্রি নামে। জানলার বাইরে একখণ্ড আকাশ, অন্ধকারে তার কিছুই দৃশ্যমান নয়। শুধু হাসপাতালের বাইরের আলোয় সেই বোগেনভোলিয়ার শুভ্রতা চকচক করছে কিছুটা স্বস্তি দিতে।

কেবিনের বাইরে একফালি করিডোরে কখনও ওয়ার্ডেনদের, কখনও নার্সদের দ্রুত যাতায়াত। তখনও তাদের নাতি-উচ্চ কণ্ঠস্বর, কাউকে ডাকছে বা নির্দেশ দিচ্ছে!

দৃশ্যের মধ্যে কোনও বৈচিত্র্য নেই বা বলা যায় একঘেয়েমি আছে। এই কেবিনে তাঁকে এখন থাকতে হবে অন্তত ছ-সাত দিন। ক-টা বই এনেছেন, কিছু পত্রপত্রিকা সঙ্গে আছে, কিন্তু অপারেশনের পর সেই অক্ষরগুলি কতটা উপাদেয় হবে তা এখনই বুঝে ওঠা যাচ্ছে না।

একটু পরেই একজন সিস্টার সঙ্গে নিয়ে এসে পৌঁছোলেন এক বয়স্ক মানুষ, মিড-শেল্‌ফের উপর রাখা কেস-হিস্টরির ফাইলটা তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, প্রে‌সার তো নর্মাল, ব্লাড সুগারও নেই, তা হলে তো কোনও অসুবিধেই নেই!

কীসের অসুবিধে তা ভাবার চেষ্টা করছেন পৃথ্বীশ, তখন তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি অ্যানেস্থেসিস্ট। কাল অপারেশনের আগে আপনাকে অসাড় করব। পিঠের শিরদাঁড়ায় একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে—

‘অজ্ঞান করব’ না বলে ‘অসাড় করব’ বলতে যা বোঝার বুঝে গেলেন পৃথ্বীশ। তাঁর অপারেশন মানে মাইক্রোসার্জারি। এখন ফুল-অ্যানেস্থেশিয়া না করে শুধু নিম্নাঙ্গ অসাড় করে ডাক্তার অস্ত্র প্র‌য়োগ করবেন তাঁর শরীরে। জিজ্ঞাসা করা শোভন নয়, তবু পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার নাম?

ডা. সুজিত চ্যাটার্জি।

পরক্ষণে পৃথ্বীশের জিজ্ঞাসা, পিঠের ইঞ্জেকশন দিতে কি খুব ব্যথা লাগে?

ডা. চ্যাটার্জি হাসলেন, ব্যথা! বহুজনকে ইঞ্জেকশন দিতে হয়, কেউ তো বলেননি ব্যথা লাগে!

সঙ্গের সিস্টারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কাল সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে ড্রিপ চালু করে দিও।

পৃথ্বীশ অবাক হলেন, অপারেশন হবে বেলা দশটায়। তার এত আগে ড্রিপ!

হ্যাঁ, কারণ অসাড় করার ইঞ্জেকশন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্লাড প্রে‌সার হঠাৎ ড্র‌প করে যাবে। সেটা ঠেকা দিতেই ড্রিপ।

ডা. চ্যাটার্জি চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ শূন্যমন পৃথ্বীশ, আশ্বস্ত বোধ করার চেষ্টা করলেন, চাইলেন উদাসীন হতে।

তাঁর এই নিস্পৃহ ভাবনার মধ্যে হঠাৎ বেডের সামনে এসে দাঁড়াল হাসি-হাসি মুখের একটি নার্স। ছোট্ট চেহারা, সাদা ধবধবে ইউনিফর্ম যেন তাঁর শুভ্রতার পক্ষে যথেষ্ট নেই, তার গায়ের রংটাও প্র‌ায় ডিমসাদা, মুখের গড়নও ডিমছাঁদের, দু-সারি দাঁত তাও সাদা ধবধবে, সেই দাঁতে হাসি চলকে বলল, কেমন লাগছে এখানে?

কী আশ্চর্য, এরকমভাবে কেউ জিজ্ঞাসা করে নাকি এখানে! হাসপাতালে কি কারও ভালো লাগে, না এটা ভালো লাগার কোনও জায়গা?

উত্তর কিছু একটা দিতে হবে, তাই বললেন, ভালো লাগানোর চেষ্টা করছি।

ঠিক আছে, এবার আপনার একটা হাত দেখি। একটা চ্যানেল করতে হবে।

চ্যানেলের ব্যাপারটা পৃথ্বীশের জানা। যতদিন এখানে থাকবেন, হাতের এই চ্যানেল দিয়েই চলবে ড্রিপ, সেই সঙ্গে যাবতীয় ইঞ্জেকশন। চ্যানেল করা থাকলে বার বার শরীরের অন্যত্র ফোটাতে হয় না সূঁচ। অতএব বাঁ-হাতটা এগিয়ে দিলেন খুদে সিস্টারটির দিকে।

সিস্টার তাঁর বাঁ-হাতটা তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে টিপে টিপে দেখল কিছুক্ষণ, তারপর তুলে নিল ডান হাতটা, সেখানেও শিরা খুঁজে হয়রান হয়ে বলল, না বাঁ-হাতটাই ভালো। বলে সিরিঞ্জটা বার করল খাপ ছিঁড়ে, স্পিরিটে তুলো ভিজিয়ে তাঁর হাতের পাতায় ঘষে ঘষে জীবাণুমুক্ত করল, তারপর সূঁচটা ঢোকাল শিরার ভিতর। পৃথ্বীশের শরীরে সামান্য চিনচিনে ব্যথা। সঙ্গে সঙ্গে সিরিঞ্জের ভিতর রক্ত আসার কথা, কিন্তু কী আশ্চর্য এল না!

ডান হাতে সিরিঞ্জটা ধরা, সিস্টার তার বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে-দিয়ে দেখল রক্ত আসে কি না, না-আসায় একটু নার্ভাস হয়ে সিরিঞ্জটা বার করে দ্বিতীয় শিরার সন্ধানে চোখ ফেলল পৃথ্বীশের হাতের পাতায়, তারপর আবার সূঁচটা ঢোকাল, কিন্তু তার দ্বিতীয় প্র‌চেষ্টাও ব্যর্থ হতে ফরসা ভুরুতে কোঁচ পড়ল, তারপর বেশ নার্ভাস কণ্ঠে বলল, একটু আসছি—

পৃথ্বীশও অবাক হচ্ছিলেন তাঁর শরীরে শিরার অভাব ঘটায়। শিরা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তারা লুকোচুরি খেলছে খুদে সিস্টারটির সঙ্গে। পৃথ্বীশ কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকলেন, একটু পরেই খুদে সিস্টারটি একজন সিনিয়র নার্সকে সঙ্গে নিয়ে ফিরল তাঁর কাছে।

সিনিয়র নার্সকে নিশ্চয় বিবৃত করেছে সব ঘটনা, বলেছে পৃথ্বীশের শরীরে শিরাদের দুষ্টুমির কথাও। সিনিয়র বিনা বাক্যব্যয়ে খুব দক্ষ হাতে খুঁজে বার করল একটি বিশ্বস্ত শিরা, তারপর তৃতীয়বার সূঁচ ফুটিয়ে দ্রুত তৈরি করে ফেলল চ্যানেলটি। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, বেশি নাড়াবেন না এই হাতটা!

পরক্ষণে খুদে সিস্টাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তন্দ্রাণী, দ্যাখ তো দুশো একচল্লিশের পেশেন্ট কী বলছেন?

খুদে সিস্টারের নাম তা হলে তন্দ্রাণী! ইন্দ্রাণী, চন্দ্রাণী শোনা যায়, কিন্তু তন্দ্রাণী বোধহয় আগে শোনেননি। সিনিয়র নার্স কেবিনের বাইরে গেলে আস্তে আস্তে বললেন, বেশ নাম!

তন্দ্রাণী একটু হেসে তাঁর কেবিন থেকে বেরিয়ে ছুটল পাশের কেবিনের উদ্দেশে। পৃথ্বীশ তাঁর হাতের পাতাটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন তাঁর নতুন গয়নাটি, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে রাতের খাওয়া দিয়ে গেল সেই চলমান টেবিলের উপর। পৃথ্বীশ ঘড়িতে দেখলেন আটটা পনেরো। বাড়িতে তাঁর একটু সকাল-সকাল খাওয়ার অভ্যাস, কিন্তু সেই ‘সকাল-সকাল’ও আরও ঘণ্টা দেড়েক পরে। কিন্তু হাসপাতালে খেতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে।

খাওয়াদাওয়া সেরে প্র‌ায় সব কেবিনেই এখন ঘুমের প্র‌স্তুতি, ঠিক দূরপাল্লার ট্রেনে যেমনটি হয়।

পৃথ্বীশ চেষ্টা করলেন কোনও একটি পত্রিকা নিয়ে সময় কাটানোর, কিন্তু পাশের বেডের বৃদ্ধ এখন ঘুমোবেন, তাই নিবে এল সামান্য আলোর স্পন্দনটিও।

পৃথ্বীশ ভাবছিলেন, নতুন জায়গায় অচেনা পরিবেশে ঠিকঠাক ঘুম হবে না, কিন্তু নিশ্চয় এসে গিয়েছিল একটু পরে। কখন এল তা তো জানেন না, কিন্তু বাড়ির মতোই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। ভাঙল তো ভাঙল, আর ঘুম আসে না। লাইট নেবানো ছিল, একটু পরেই হঠাৎ দেখলেন তাঁকে নড়াচড়া করতে দেখে কেউ এসে ঢুকল কেবিনের দরজার ভিতর। অন্ধকারে চোখ ঠাহর করে দেখলেন সেই ডিমছাঁদের মুখ, তন্দ্রাণী। তাঁকে নড়াচড়া করতে দেখে বেডের কাছে এসে নিচু গলায় বলল, আপনার হাতে খুব লেগেছে, তাই না?

হাতের চ্যানেলের কথা বলছে মেয়েটি, পৃথ্বীশ ঘাড় নেড়ে বললেন, সে তখন লেগেছিল, এখন তো তেমন বুঝতে পারছি না!

মেয়েটি তাঁর চ্যানেল করা হাতটা তুলে নিল তার হাতে, একটু একটু করে আঙুল বুলিয়ে দিতে লাগল চ্যানেলের চারপাশে। বলল, কী যে হল তখন, কিছুতেই—

তার হাত বোলানোর স্পর্শ ও অপরাধীর মতো কণ্ঠস্বর শুনে পৃথ্বীশের হাতে যেটুকু ব্যথা ছিল তা পলকে উধাও। কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল, এবার ঘুমোন। এখনও রাত অনেক বাকি।

পৃথ্বীশ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু তোমাকে তো সারা রাত জাগতে হবে?

তন্দ্রাণী হেসে বলল, নাইট ডিউটি। জাগতে তো হবেই।

কৌতূহলবশত পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করলেন, সপ্তাহে ক-দিন নাইট ডিউটি?

পর পর চারদিন। সোম থেকে বৃহস্পতিবার। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ডিউটি করার পর সেদিন অফ, তারপর শনিবার ছুটি। আবার রবিবার সকাল ডে-ডিউটি।

কী ভেবে পৃথ্বীশ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কতদিন হল চাকরি?

এই তো সবে আট মাস। তার আগে ট্রেনিং-এ ছিলাম। এই হাসপাতালেই।

বলেই আবার ধমকের সুরে বলল, কিন্তু এখন আমার সঙ্গে গল্প করলে চলবে না। ঘুমিয়ে নিন। কাল অপারেশন। আমি যাচ্ছি। ওদিকে আমাকে আবার খুঁজবে।

পৃথ্বীশ চেষ্টা করলেন ঘুমোতে। মধ্য রাতে হাসপাতালের চেহারা একেবারে অন্যরকম। কেবিনগুলো অন্ধকার। কেবিনের মধ্যে কোনও কোনও পেসেন্টের মৃদু নাসিকাগর্জন। কারও বা কণ্ঠে কাতরানির শব্দ। শুধু বাইরের করিডোরে আলো। রাতের এই নির্জন প্র‌হরে করিডোরে নার্স বা ওয়ার্ডেনদের আনাগোনাও কমে আসে। কীরকম একটা ভূতুড়ে নৈঃশব্দ্য। তবু তার মধ্যে হঠাৎ-হঠাৎ নার্সদের জুতোয় শব্দ করে যাওয়া-আসা।

পরদিন সকালেই আবার তন্দ্রাণীর আগমন, হাতে এক সেট জামা-পাজামা। কিন্তু এবারের জামাটার অন্য কাটিং। বলল, রাতে ভালোই ঘুমিয়েছেন। আমি দুবার এসে দেখে গেছি। এখন ব্রাশ করে নিতে হবে। চা আসবে। শুধু চা। চা খেয়ে স্নান করে নিতে হবে। সেই সঙ্গে এই ড্রেসটা পরে নেবেন। এটা অপারেশনের ড্রেস। সাড়ে সাতটা থেকে চালু হবে ড্রিপ।

একের পর এক নানা আদেশ দিয়ে তন্দ্রাণী এবার মিড-সেল্‌ফের ভিতর থেকে বার করল ব্রাশ আর পেস্ট। বর‌াশে পেস্ট লাগিয়ে এগিয়ে দিল তার দিকে।

পৃথ্বীশের এখন শুধু হুকুম তামিল করার পালা। ব্রাশ করে বাথরুম থেকে স্নান সেরে, পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে এসে দেখলেন চলমান টেবিলের উপর ছোট্ট কেটলিতে গরম জল, তার পাশে কাপ-প্লেট, চিনি, দুধ আর সুতোয় ঝোলানো টি-ব্যাগ। পাশে দুটি বিস্কুট। কিন্তু ডাক্তারের সুস্পষ্ট নির্দেশ শুধু চা ছাড়া আর কিচ্ছুটি মুখে দেওয়া যাবে না।

তারপরের কয়েকটি মুহূর্ত শুধু প্র‌স্তুতির। বেডের পাশেই একটি স্ট্যান্ডে ঝোলানো হল স্যালাইনের বোতল। তার একটি প্র‌ান্ত চলে এল পৃথ্বীশের হাতের পাতার চ্যানেলের মধ্যে। শুরু হয়ে গেল ড্রিপ। শুরু হয়ে গেল পৃথ্বীশের কাউন্টডাউন। কিছুক্ষণ পরে চলে এল ট্রলির সঙ্গে একটি স্ট্রেচার। সেই স্ট্রেচারে শুয়ে করিডোরের ছাদ দেখতে দেখতে একসময় ঢুকে পড়লেন অপারেশন থিয়েটারের ভিতর। সেখানে মাস্ক পরিহিত কয়েকজন নার্স ও পুরুষ সহচর। প্র‌স্তুত অ্যানেস্থেসিস্ট ডা. চ্যাটার্জি। যেমন রীতি পৃথ্বীশের পিঠের কাছে মেরুদণ্ডে একটি ইঞ্জেকশন দিয়ে একজন সহচরকে বললেন, ডা. সরকারকে খবর দিন।

শোনা গেল ডা. সরকার পৌঁছে গেছেন হাসপাতালে, কিন্তু কারও সঙ্গে সেরে নিচ্ছেন জরুরি কথাবার্তা। একটু পরেই মাস্ক পরে তিনি ওটি-তে ঢুকে শুরু করলেন অস্ত্রোপচার। পৃথ্বীশকে বললেন, আপনি উপরে টাঙানো ওই মনিটরে চোখ রাখুন। দেখুন কীভাবে হচ্ছে আপনার অপারেশন।

ততক্ষণে পৃথ্বীশ অনুভব করলেন তাঁর নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ অসাড়। একটা পা সরিয়ে নিতে গিয়ে বুঝলেন তাঁর দুটি পায়ের একটিও আর নেই। শুধু পা-ই নেই তা নয়, কোমরের পর থেকে আর কোনও রকম সাড় নেই! কীরকম একটা হিম আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল তার মনের গহনে।

কিন্তু সেই আতঙ্ক সরিয়ে দিতে চাইলেন মনিটরের দিকে চোখ রেখে। তাঁর শরীরের ভিতর তখন ঘোরাফেরা করছে একটি অদ্ভুত গড়নের কাঁচি। সেই কাঁচির কারুকাজ দেখতে দেখতে ফুরিয়ে ফেললেন অনেকগুলো মুহূর্ত। ঘণ্টাখানেক পরে ডাক্তার সরকার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ব্যস, আপনার অপারেশন শেষ।

আরও বহুক্ষণ পরে তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হল সেই বেড নম্বর টু টোয়েন্টি নাইনে। বাইরে তখন অপেক্ষা করছে তাঁর বহু আত্মীয়-পরিজন। প্র‌ত্যেকেরই চোখেমুখে চরম উদ্বেগ। পৃথ্বীশ উপলব্ধি করছেন যে-মানুষটিকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই মানুষটা ফেরেনি, ফিরেছে তাঁর অর্ধেক শরীর, বাকি অর্ধেক অসাড়।

তার পরের কয়েক ঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত হল নিজেকে ফিরে পেতে। পৃথ্বীশের শরীরে আপাতত কোনও কষ্ট নেই, শুধু অসাড় নিম্নাঙ্গ নিয়ে একটু একটু করে অতিক্রম করলেন পাঁচ-পাঁচটি ত্রস্ত ঘণ্টা। যখন সাড় ফিরে এল, তাঁর শরীরের যন্ত্রণা উপশম করতে সিস্টাররা হাতের চ্যানেলের মধ্যে পুশ করে চলেছে একের পর এক ইঞ্জেকশন।

একটা পুরো দিন কেটে গেল ঘোরের মধ্যে। চেষ্টা করেছিলেন ঘুমের। একমাত্র ঘুমই পারে তাঁর এই অসহনীয় মুহূর্তগুলির কষ্ট লাঘব করতে। কিন্তু একটুও ঘুম নেই তাঁর চোখে। সারাদিন খাওয়া নেই, সেই না-খাওয়ার বোধটাও এখন নেই, কিন্তু অপারেশনের একটা ধকল তো নিয়েছে এই শরীর!

এতটাই আতঙ্ক, এতটাই অনীহা যে, বিকেলের চা-ও পড়ে রইল অনাঘর‌াত।

ক্রমে রাত হয়ে আসে। যতক্ষণ শরীরে সাড় ছিল না ততক্ষণ এক অস্বস্তি। আবার সাড় ফিরে আসা মানে আর এক অস্বস্তি। ভিজিটিং আওয়ারে উদ্বিগ্ন বাড়ির মানুষগুলির সঙ্গে কথা বলে কিছুটা যন্ত্রণার উপশম। তারা ঘরে ফিরে গেলে আবার গ্র‌াস করে নিঃসঙ্গতা। শরীর ও মনে এমন এক আচ্ছন্নতা যে, বই বা পত্রিকা পড়বেন সে ইচ্ছে একটুও নেই। এমনকি রাতের ডিনার দিয়ে গেল চলমান টেবিলে তা খাওয়ার মতো সামর্থ্য বা ইচ্ছে কোনওটাই নেই।

রাত আটটা নাগাদ হঠাৎ কেবিনে হাজির হল তন্দ্রাণী, সেই এক মুখ হাসি, জুড়োতে থাকা ডিনারের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল, এখনও খাননি?

পৃথ্বীশ ঘাড় ঝাঁকালেন, ইচ্ছে করছে না।

ইচ্ছে করছে না বললে চলবে! তন্দ্রাণীর গলায় ধমক, বলল, সারাদিন খাননি, রাতে না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বেন তো! ঠিক আছে, আমি রেডি করে দিচ্ছি। চামচে করে একটু-একটু করে খেয়ে নিন।

কিন্তু তাতেও কি খাওয়া যায়! সোজা হয়ে বসার উপায়ও তো নেই!

যতটা পারল তন্দ্রাণী সাহায্য করার চেষ্টা করল, তাতে যতটুকু খাওয়ার তা হল সেদিনকার মতো। অতঃপর রাতের মতো ঘুমের আয়োজন। কিন্তু অ্যানেস্থেশিয়ার প্র‌ভাব, মানসিক বিপর্যয়, একের পর এক কড়া-কড়া ইঞ্জেকশন, ক্যাপসুল আর ট্যাবলেট, সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত শরীরে কি ঘুম আসে!

রাত্রির নৈঃশব্দের মধ্যে আবার একটু একটু করে ঘুমিয়ে পড়ে কেবিনগুলো, পৃথ্বীশও চেষ্ট করছিলেন ঘুমোনোর, কিন্তু শরীরের ভিতর একটা যন্ত্রণা হঠাৎ জেগে উঠল প্র‌বলভাবে। কী ভয়ংকর যন্ত্রণা! সেই যন্ত্রণার ধকল নিতে গিয়ে পৃথ্বীশের চোখে ঘুম আসে না।

তখন কত রাত কে জানে, তাঁর এই কষ্টের উসিবিসি চেহারা ধরা পড়ল করিডোরে চলমান তন্দ্রাণীর চোখে, তাঁর কেবিনে ঢুকে বলল, ঘুম আসছে না?

পৃথ্বীশ ঘাড় নাড়েন, যন্ত্রণার কথা বলে কাউকে উত্যক্ত করা তাঁর স্বভাবে নেই, কিন্তু তাঁর মুখের কাতর ছবি ঠিক ধরা পড়ল তন্দ্রাণীর চোখে, বলল, অপারেশনের যন্ত্রণা হচ্ছে?

বাধ্য হয়ে ঘাড় নাড়লেন পৃথ্বীশ। তন্দ্রাণী কী বুঝল, তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে, একটু পরে ফিরে এল হাতে ওষুধভর্তি একটা সিরিঞ্জ নিয়ে বলল, দাঁড়াল একটা পেন-কিলার দিয়ে দি। না হলে যন্ত্রণাটা রাতে সমস্যা করবে!

নিপুণ হাতে কোমরের নীচে ইঞ্জেকশনটা পুস করল, স্পিরিট-ভেজা তুলো দিয়ে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে দিল যাতে ওষুধটা ছড়িয়ে যায় দ্রুত, তারপর হাতের মুঠোয় রাখা একটা ট্যাবলেট দিল, সেই সঙ্গে টেবিল থেকে জলভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, একটা অ্যালজোলামও খেয়ে নিন। ভালো ঘুম হলে সকালে উঠে দেখবেন কোনও যন্ত্রণা নেই।

নির্দেশগুলি পালন করলেন পৃথ্বীশ, অতঃপর তন্দ্রাণী তাঁর মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিতে কী আশ্চর্য কোথায় মিলিয়ে গেল যন্ত্রণাটা। তাঁর ঘুমের মধ্যে কখন যে সে তাঁর কেবিন ছেড়ে গেছে তার কিছুই জানেন না!

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল তারই ডাকে, কী হল! এখনও ঘুমোচ্ছেন? উঠুন, উঠুন। ব্রাশ করে রেডি হোন, আমি ততক্ষণে চা বানিয়ে দিচ্ছি।

তন্দ্রাণী একমুখ উপচোনো হাসি নিয়ে ডেকে তুলেছে তাঁকে। পরক্ষণে নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ল মিড-সেল্‌ফের দিকে, ব্রাশ আর পেস্ট বার করতে করতে বলল, বাথরুমে যেতে পারবেন, না একটা গামলা এনে দেব, তাতে মুখ ধুয়ে নেবেন?

পৃথ্বীশ দ্রুত উঠে বসার চেষ্টা করতেই মনে পড়ল এখন তাঁর শরীর নিজের অধীনে নেই। সর্বত্রই একটা আড়ষ্টতা। শরীরের ভিতরে একটা সদ্য তৈরি ক্ষত, সেখানে ব্যথা অনুভব করতে না পারলেও সাবধানে ওঠা-বসা করতে হবে, নইলে নিশ্চিত অনর্থ। তবু বললেন, বাথরুমে যেতে পারব।

ঘড়িতে সাড়ে ছ-টা, অনেকটাই বেলা হয়ে গেছে, তাঁর খুব ভোর-ভোর উঠে মর্নিং ওয়াকে যাওয়ার অভ্যাস, কালকের অস্ত্রোপচার-জনিত শারীরিক ধকল ও মানসিক উত্তেজনার ফলে রাতে নিদ্রাবিপর্যয় ঘটেছিল ও তারপর অ্যালজোলামের প্র‌তিক্রিয়ায় উঠতে দেরি, জানলার বাইরে রোদের আলোছায়া।

চলমান টেবিলে অপেক্ষমান চায়ের সরঞ্জাম।

তন্দ্রাণী স্যালাইনের লাইনটা খুলে দিতে পৃথ্বীশ বললেন, বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।

পেস্ট লাগিয়ে ব্রাশটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তন্দ্রাণী বলল, কিন্তু সাবধান, ব্যথা না লেগে যায়! আমি চা তৈরি করে টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখছি। তারপর একটু পরে এসে গরম জলে গা স্পঞ্জ করে দেব।

পৃথ্বীশ এই ক্ষুদ্র তরুণীটির তাড়নায় খুব বিহ্বল বোধ করছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল জেলখানায় বন্দি হয়েছেন, এখন অকস্মাৎ এক অলিখিত কর্ত্রীর শাসনে মনে মনে বিপর্যস্ত। আস্তে আস্তে শরীর বাঁচিয়ে বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ করলেন, চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে ফিরে এসে দেখলেন গরম চায়ের কাপ তাঁর অপেক্ষায়। পাশে সাজানো দুটি বিস্কুট।

কাল সারাদিন কিছুই মুখে দিতে পারেননি, এতক্ষণে চায়ের কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে যেন ফিরে পেলেন জীবনের স্পন্দন। এক-এক চুমুকে চেষ্টা করছেন সুস্থির হতে। চোখ রাখলেন বাইরে দোদুল্যমান শ্বেতশুভ্র বোগেনভেলিয়ার দিকে। চা খাওয়া শেষ করে যেই না কাপটা রেখেছেন টেবিলে, তন্দ্রাণী গরম জলের গামলা আর তোয়ালে নিয়ে ঢুকে পড়ল কেবিনে, বলল, জামাটা খুলে ফেলুন–

বলে তাঁর অপেক্ষায় না থেকে পটপট করে খুলতে লাগল কয়েদি-ফ্যাশনের জামাটার বোতামগুলি। পৃথ্বীশ তাঁর হাতের চ্যানেল বাঁচিয়ে জামাটা খুলে সরিয়ে রাখলেন একপাশে। তন্দ্রাণী ততক্ষণে দখল নিয়েছে তাঁর শরীরের, তোয়ালেটা গরম জলে ভিজিয়ে গা মুছল ভালো করে। মুখমণ্ডল, বাহুমূল পরিষ্কার করে ঘষে ঘষে। খুব আরাম লাগছিল পৃথ্বীশের। ট্রেন্ড হাত, পেশেন্টকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে সেবায়-যত্নে।

পরক্ষণে তন্দ্রাণী বলল, এবার পাজামাটা হাঁটু পর্যন্ত তুলুন, পায়ে স্পঞ্জ করলে বেশ ভালো লাগবে দেখবেন।

পৃথ্বীশ নির্দেশ পালন করছেন একের পর এক। স্পঞ্জ শেষ হলে তন্দ্রাণী এবার বলল, এবার বাথরুমে গিয়ে কাচা পোশাকটা পরে আসুন। ব্রেকফাস্ট আসবে। তার আগে দুটো ইঞ্জেকশন দেব।

সব ইঞ্জেকশন আর ওষুধ মিড-সেল্‌ফে সাজানো থরে থরে। তার ভিতর থেকে নির্দিষ্ট ইঞ্জেকশন বেছে নিয়ে প্র‌স্তুত হল, বলল, দেখি চ্যানেলটা।

ইঞ্জেকশনের নাম শুনে পেশেন্টদের যা হয়, পৃথ্বীশও কুঁকড়ে গেলেন এক মুহূর্ত।

তন্দ্রাণী উদ্যত সিরিঞ্জ নিয়ে কাছে এল, হেসে বলল, দেখবেন, প্র‌থম ইঞ্জেকশনটায় ব্যথা লাগবে না, খুব স্লো মোশনে দেব। বুঝতেই পারবেন না! দ্বিতীয়টা অ্যান্টি-বায়োটিক, সামান্য একটু লাগবে। তবু চেষ্টা করছি যাতে না লাগে।

দুটো ইঞ্জেকশন দিল পরপর, খুবই স্লো মোশনে, প্র‌থমটায় লাগল না একটুও, দ্বিতীয়টার সময় পৃথ্বীশের মুখে কোঁচ পড়ল কয়েকটা। তন্দ্রাণীও একটু অপ্র‌স্তুত, বলল, একটু লাগল, তাই না! তবু তো সাবধানে দিয়েছি।

পৃথ্বীশ হঠাৎ বললেন, কাল রাতে তুমি যেন দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়েছিলে! যা যন্ত্রণা হচ্ছিল তখন! ভাগ্যিস পেন-কিলার আর ঘুমের ওষুধটা দিয়েছিলে! তোমাকে কী মনে হচ্ছিল জানো? সেই যে একটা ইংরেজি পিস আছে না, লেডি উইথ দি ল্যাম্প। তুমি যেন সেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। রাতে আলো হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলে কেউ ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে কিনা! পড়েছ সেই পিসটা?

তন্দ্রাণী মিষ্টি করে হাসল, হ্যাঁ, নার্সিংএর পাঠ নেওয়ার সময় এটা পড়তে বলেন টিচাররা।

পরক্ষণে খালি অ্যাম্পুলগুলো হাতে নিয়ে আবার একগাল হাসল, আমার ডিউটি কিন্তু আটটায় শেষ। সারাদিন আর দেখা পাবেন না। আবার রাত্রিবেলা আসব।

ছোট্ট মেয়েটি চলে গেলে পৃথ্বীশ কিছুক্ষণ উদাসীন ভঙ্গিতে বসে। সিস্টাররা বেশিরভাগই রোবটের মতো হয়, পেশেন্টের লাগল কী লাগল না তা নিয়ে নির্বিকার থাকে। তন্দ্রাণী অন্যরকম বলেই—

এতক্ষণ বেশ চনমনে লাগছিল, তন্দ্রাণী চলে যেতে হঠাৎ শারীরিক বৈকল্য একটু একটু করে ফিরে এল। বাঁ-হাতে চ্যানেলের অলঙ্কার থাকায় সারাক্ষণই একটা অস্বস্তি। ফোঁটা ফোঁটা ঢুকছে স্যালাইন। শরীরের ভিতরে কোথায় এক টুকরো ক্ষত, পেন-কিলার দিয়ে অবশ করে রাখা হয়েছে বলে তা শরীরে জানান না দিলেও মনের ভিতরে তার অস্তিত্ব সদা জাগরূক। একটু নড়তে গেলেই মনে হচ্ছে যদি আঘাত লাগে ক্ষতয়! বালিশের তলায় রাখা বই আর পত্রপত্রিকাগুলো বার করলেন, ওল্টাতে শুরু কলেন তার পৃষ্ঠাগুলি। এখন সারাদিন এক অখণ্ড সময়, দিনটা পার হতে হবে মুহূর্ত গুনে গুনে।

কিন্তু সেই অখণ্ড সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ব্রেকফাস্ট এল, সিনিয়র সিস্টার এলেন দশটায়, একটা ক্যাপসুল আর ট্যাবলেট হাতে দিয়ে বললেন, খেয়ে নিন। ডক্টর আসবেন একটু পরে। শরীরে কোনও অসুবিধে থাকলে বলবেন।

ডাক্তার সরকার এলেন সঙ্গে তাঁর সহকারীদের নিয়ে, মিড-সেল্‌ফের উপর রাখা চার্টটা তুলে দেখলেন প্রে‌সার, টেম্পারেটার ইত্যাদি। বললেন, অপারেশন খুব ভালো হয়েছে। সাবধানে থাকুন ক-দিন। খেয়াল রাখবেন জ্বর আসে কি না!

পৃথ্বীশ সারাটা দিন একটু একটু করে এগোতে লাগলেন বিকেলের দিকে। বিকেলে ভিজিটরদের সময়। বাড়ির লোক এল একে একে। স্বভাবতই মুখগুলো ভরা প্র‌বল উদ্বেগে। পৃথ্বীশ আশ্বস্ত করেন, সব ঠিকঠাক আছে। ডোন্ট ওরি।

২.

বাড়ির লোকজন চলে যাওয়ার একটু পরেই পৃথ্বীশের যখন একটু-একটু মন খারাপ লাগছে, সেসময় উল্লসিত হলেন এই দেখে যে, তমোনাশ এসে পড়েছে শেষবেলায়।

কিন্তু তমোনাশ একা কেন! পৃথ্বীশ ধরেই নিয়েছিলেন তমোনাশ দেখতে এলে কখনও একা আসবে না, সঙ্গে দ্যুতি থাকবেই।

আসলে তমোনাশ আর দ্যুতি যেন একে অপরের পরিপূরক। বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘মেড ফর ইচ আদার’। সারাক্ষণ দুজনে দুজনের সঙ্গে সেঁটে থাকে।

মনে পড়ছে বছর দুই আগে আর একবার যখন তিনি ভর্তি হয়েছিলেন কয়েকটা অন্য উপসর্গ নিয়ে, ওরা দু’জন তাঁকে দেখতে একসঙ্গে আসত। তিনদিন ছিলেন, তিনদিনই এসেছিল দুজনে।

তমোনশ আসবে তা তিনি জানতেনই কেন না ক-দিন আগে যখন তমোনাশ অন্য একটি প্র‌য়োজনে ফোন করেছিল, তখনই সে জেনে গিয়েছিল তিনি ভর্তি হবেন হাসপাতালে। তারিখটা শুনে নিয়ে বলেছিল, আমি চলে আসব, পৃথ্বীশদা।

পৃথ্বীশ ব্যস্ত হয়ে বলেছিলেন, না, না আসতে হবে না। ক-টা তো মোটে দিন।

কিন্তু তমোনাশ শোনেনি, বলেছিল, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না! হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকার সময় প্রি‌য়জনেরা দেখতে এলে পেশেন্টের ভিতরে এক অন্য নিরাময়। আমি চলে আসব।

বাধ্য হয়ে পৃথ্বীশ বলেছিলেন, তা হলে নীচে একটু অপেক্ষা করবে। আমার বাড়ির লোকজন পালা করে উপরে আসবে, তাদের যাওয়া-আসার ফুরসতে চলে আসবে তোমরা।

‘তোমরা’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন, কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন তমোনাশ দেখতে এলে দ্যুতি কি ঘরে বসে থাকতে পারবে? বরং তাঁর অপারেশন শুনলে দ্যুতিই তাকে অনবরত বলতে থাকবে, শিগগির চলো। তুমি যা লেট লতিফ, সেজেগুজে যখন হাসপাতালে পৌঁছোবে, শেষ হয়ে যাবে ভিজিটিং আওয়ার।

তার পরের দিনই ফোন করেছিল দ্যুতি, এ-কথা সে-কথার পর পৃথ্বীশ বলেছিলেন তাঁর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা, দ্যুতি অবাক হয়ে বলেছিল, তাই নাকি?

কী আশ্চর্য দ্যুতি শোনেইনি সংবাদটা! তখন খুঁটিয়ে শুনে নিয়েছিল, কবে ভর্তি হচ্ছেন ক-দিন থাকতে হবে— এই সব। তখনই মনে হয়েছিল তবে কি তমোনাশ বলতে ভুলে গেছে!

কিন্তু আজ তমোনাশকে একা আসতে দেখে অবাকই হলেন খুব! তাকে দেখে বললেন, এসো। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে এল বলে।

তমোনাশ হেসে বলল, আসলে নীচে এসে একটা স্লিপ করেছিলাম, কিন্তু উপরে বউদিরা ছিলেন বলে ছাড়ছিল না! বলল, একসঙ্গে দুজনের বেশি কেবিনে ঢোকার নিয়ম নেই। এতক্ষণে অনুমতি দিল!

পৃথ্বীশ জানেন নিয়মটা। হেসে বললেন, বোসো, তাহলে! তারপর, নতুন কিছু লিখলে?

তমোনাশ হাসল, থাক এসব প্র‌সঙ্গ। এখন আপনার খবর বলুন। কী হয়েছে অ্যাকচুয়ালি?

কী আর! শরীরের ভিতর একটা আনওয়ান্টেড গ্রোথ। সেই অনাকাঙ্খিত স্তূপ ছুরি আর কাঁচি ব্যবহার করে ছেঁটে দেওয়াই ডাক্তারের কাজ।

তাহলে অপারেশনের পর এখন ঠিক হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, গ্রোথটা রিমুভ করে দিয়েছেন ডাক্তার। এখন অপারেশনের পর পোস্ট-অপারেটিভ প্রি‌কশন নেওয়া হচ্ছে। একের পর এক ইঞ্জেকশন, আর মুঠো মুঠো ট্যাবলেট। কিন্তু—

পৃথ্বীশ বলতে যাচ্ছিলেন দ্যুতির কথা, কিন্তু সেই মুহূর্তে দ্যুতিকে দেখলেন তাঁর কেবিনের দরজার সামনে, মুখ উজ্জ্বল করে বলে যাচ্ছিলেন, ‘এসো, দ্যুতি, তোমার কথাই ভাবছিলাম’, কিন্তু দ্যুতি কেবিনে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ দেখে ফেলল তমোনাশ বসে আছে তাঁর সামনে, দেখেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, পরক্ষণে তাঁর উদ্দেশে মূকভঙ্গিতে হাত নেড়ে জানাল, পরে আসব।

বলেই বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। পৃথ্বীশ কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত, ঘটনাটা এমন আচমকা ঘটে গেল যে, তিনি কিছু বলতে পারলেন না, বুঝতে তো না-ই। তবে কি তমোনাশ বসে আছে দেখে দ্যুতি কেবিনে না-ঢুকেই বেরিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ!

ব্যাপারটা তাঁর কাছে চরম বিস্ময়ের মতো। তা হলে কি দ্যুতির সঙ্গে তমোনাশের কোনও ঝগড়া-টগড়া হয়েছে! তাই একরকম একটা কাণ্ড!

পৃথ্বীশের যেন গুলিয়ে গেল সব। তমোনাশ আর দ্যুতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় চার-পাঁচ বছর আগে। তমোনাশ তখন মাত্র ক-বছর হল কবিতা লিখছে, একটা ভালো চাকরিও পেয়েছে বড়ো একটা প্র‌াইভেট কনসার্নে। পৃথ্বীশ কিছু লেখালেখি করেন বলে তরুণ কবিদের সঙ্গে পরিচয় হয়, কারও কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গতাও। সেরকমই একটা সম্পর্ক গাঢ় হল যখন তমোনাশ হঠাৎই বিয়ে করে নিয়ে এল এক অতিসুন্দরী তরুণীকে। এসে বলেছিল, পৃথ্বীশটা, দ্যুতিকে বিয়ে করে ফেললাম।

পৃথ্বীশ উল্লাস প্র‌কাশ করে বলেছিলেন, কনগ্র‌াচুলেশন। তা দ্যুতি নিশ্চয় কবিতা লেখে?

বললেন কেন না তমোনাশ বরাবরই বলত, ‘বিয়ে করলে কবিতা লেখে এমন কোনও মেয়েকেই বিয়ে করব। না হলে সে আমার কবিতা লেখা পছন্দ করবে না!’ তা ছাড়া দ্যুতি এমনই সুন্দরী, তার চোখেমুখে এমনই উচ্ছবাস, আর কথাও বলে এত চমৎকার করে যে, তার পক্ষে কবিতা না-লেখাটাই অসম্ভব। তমোনাশের পাশে দ্যুতির দিকে দু-এক পলক তাকিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল মেয়েটির অভিব্যক্তি থেকেই ঝরে পড়ছে কবিতার লাইন।

কিন্তু দ্যুতিকে দেখিয়ে তমোনাশ হাসতে হাসতে বলেছিল, না পৃথ্বীশদা, দ্যুতি কবিতা লেখে না, কিন্তু পাগলের মতো কবিতা পড়ে, আবৃত্তিও করতে পারে একটার পর একটা। এই দেখুন না, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা শঙ্খ ঘোষ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যাঁর কবিতা আপনি শুনতে চাইবেন, একটার পর একটা শুনিয়ে যাবে।

পৃথ্বীশ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমার সঙ্গে পরিচয় হল কী করে?

সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, পৃথ্বীশদা। সেদিন স্টুডেন্ট’স হলে কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে নামছি মঞ্চ থেকে, হঠাৎ একটি মেয়ে আমার সঙ্গে নিজে থেকে আলাপ করে বলল, ‘আমি আপনার কবিতার ডাই-হার্ড ফ্যান’। শুনে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই আর কি! ভাবলাম মেয়েটি নিশ্চয়ই ইয়ার্কি করছে আমার সঙ্গে। সবে দু-তিন বছর কবিতা লিখছি, ক-টাই বা কবিতা লিখেছি, ক-টা পত্রিকায় আর ছাপা হয়েছে! কিন্তু মেয়েটি আমাকে অবাক করে বলল, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ পত্রিকায় আপনার একটা গুচ্ছ কবিতা ছাপা হয়েছে মাস তিনেক আগে, তারপর ‘ইস্কাপন’ পত্রিকায় দুটো, তারপর ‘কালিদাস’ পত্রিকায় একটা দীর্ঘ কবিতা। বলুন ঠিক বলেছি কিনা!’ শুনে তখন আমার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। আমার কবিতা কোথায় ছাপা হচ্ছে তাও তার মুখস্থ!

পৃথ্বীশও বিস্মিত হচ্ছিলেন, বলেছিলেন, বাহ্‌, খুব ভালো খবর। তুমি যে ক্রমশ ভালো কবিতা লিখছ তার প্র‌মাণ পাচ্ছ এবার!

তমোনাশ বলেছিল, না পৃথ্বীশদা, এখনও বিস্ময়ের শেষ হয়নি! পরক্ষণে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাইরে এসে বলল, ‘আপনার কবিতাগুলো আমি মুখস্থ করে ফেলেছি। শুনবেন?’ বলে পর পর তিনটে কবিতা মুখস্থ বলল। কী আশ্চর্য জানেন, আমার কবিতা আমার নিজেরই মনে থাকে না! আর সেই কবিতা একটি মেয়ের কণ্ঠে শুনে আমার প্র‌ায় জ্বর এসে যাওয়ার উপক্রম।

অতঃপর দুজনের মধ্যে প্রে‌ম হতে দেরি হয়নি আর। তার পরেও প্র‌ায় মাস ছয়েক দুজনে ঘোরাঘুরি করে হঠাৎ একদিন বিয়ে। পৃথ্বীশ বলেছিলেন, একেবারে রাজযোটক।

তারপর থেকেই দুজনে একসঙ্গে আসত তাঁর কাছে। বাড়িতে বেশ জমিয়ে বসে অনেক আড্ডা ও আলোচনা হত। দ্যুতিকে বিয়ে করার পর তমোনাশের কবিতায় যেন বেড়ে গেল আরও জৌলুষ। পর পর দু-বছরে দুটি কবিতার বইও প্র‌কাশ করে ফেলল সে। মাঝে মাঝে পৃথ্বীশের কাছে এসে দ্যুতির সামনেই বলত, পৃথ্বীশদা, জীবনসঙ্গিনী যদি কবিতাপ্রে‌মী হয়, তাহলে কবির পক্ষে কবিতা লেখার প্রে‌রণা অনেক বেড়ে যায়, জীবন হয়ে ওঠে কবিতাময়। আর কী আশ্চর্য জানেন, এই দুটি বইয়ের সব কবিতাই দ্যুতির প্রে‌রণায় লেখা। আরও আশ্চর্য, দুটি বইয়ের সব ক-টা কবিতা দ্যুতির কণ্ঠস্থ।

পৃথ্বীশের মনে হয়েছিল দ্যুতি যেন তমোনাশের এক আলোকবর্তিকা, তমোনাশকে সেই আলো দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কবিতার গূঢ় পৃথিবীতে।

পৃথ্বীশ হাসতে হাসতে দ্যুতিকে বলেছিলেন, তমোনাশের বন্ধুরা নিশ্চয় তমোনাশকে হিংসে করছে! এমন কবিতা-পাগল বউ কোনও কবি পেয়েছে কি না সন্দেহ।

দ্যুতি হাসত মুখ টিপে টিপে, আর তমোনাশ বলত, আপনি জানেন, পৃথ্বীশদা, এখন আমার বন্ধুরা কবিতার বই বেরলে আর আমাকে প্রে‌জেন্ট করে না, প্রে‌জেন্ট করে দ্যুতিকে। তাদের সবাইয়ের ধারণা দ্যুতি তাদের কবিতা পড়বে, মুখস্থ করবে, আর সময়মতো আবৃত্তি করবে!

পৃথ্বীশ নিজে একদিন একটি কবিতায় লিখে ফেললেন, ‘তোমার গণ্ড থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে কবিতার আলো’। সেই পংক্তিটি যে দ্যুতিকে নিয়েই লেখা তা কাউকে না বললেও স্বীকার করেছিলেন মনের ভিতর। দ্যুতির ফরসা দুই গালের মসৃণতাই তাঁর ভাবনার উৎস।

কিন্তু আজ প্র‌থমে তমোনাশের একা আসা, তারপর তাকে ভিতরে দেখে দ্যুতির ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে পৃথ্বীশ বুঝে উঠতে পারলেন না তমোনাশ আর দ্যুতির মধ্যে হঠাৎ কী বিপর্যয় ঘটল!

কেবিনের দরজার দিকে তমোনাশ পিছন ফিরে বসে থাকায় বোধ হয় বুঝতে পারেনি দ্যুতির আসার ব্যাপারটা! আগের মতোই কণ্ঠে উৎকণ্ঠা প্র‌কাশ করে জিজ্ঞাসা করল, আপনাকে কবে ছাড়বে বলেছে, পৃথ্বীশদা?

পৃথ্বীশ হেসে বললেন, এখনও পরিষ্কার করে বলেনি। ছ-সাতদিন লাগবে বলে মনে হয়। তাড়াতাড়ি ক্ষত শুকানোর জন্য প্র‌চুর অ্যান্টি-বায়োটিক চার্জ করছে দু-বেলা, কিছুটা শুকিয়ে উঠলেই—

তমোনাশ মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, উফ্‌, হসপিটাল একটা গোলমেলে জায়গা, তাই না?

পৃথ্বীশ হাসলেন, দ্যাখো তমোনাশ, ঈশ্বর আমাদের একটা শরীর দিয়েছেন, সেই শরীরের কোথাও কোথাও অবস্ট্রাকশন তৈরি হয়, কিংবা অহেতুক গ্রোথ হয়, সেই বাধা দূর করতে কখনও ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলে হয় না, তখন ছুরি-কাঁচি দিয়ে কাটা-ছেঁড়া করতে হয়।

তমোনাশ বিষয়টা বুঝল, হেসে বলল, ঠিক বলেছেন। এখন সার্জেনরা অসাধ্য সাধ করতে পারছেন বলে শুনি।

পৃথ্বীশ বুঝে উঠতে পারছিলেন না দ্যুতি এক ঝলক দেখা দিয়েই কোথায় লুকিয়ে পড়ল! সে কি বাইরে কোথাও অপেক্ষা করছে, যেইমাত্র তমোনাশ উঠে যাবে, তখন এসে ঢুকবে কেবিনে? কিন্তু ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে আসছে। তমোনাশ এই একটু আগে এসেছে, ভিজিটিং আওয়ার শেষ না হলে সে উঠবেই না! তা হলে দ্যুতি কি তাকে দেখতে আসতেই পারবে না!

পৃথ্বীশ একটু টেনসনে পড়ে গেলেন হঠাৎ।

প্র‌ায় চার বছর ধরে দেখছেন দুই কপোত-কপোতীকে, দুজনে কী আশ্চর্যভাবে কবিতার বলয়ের মধ্যে মানিয়ে নিয়েছে দেখে খুশিই হতেন খুব, কিন্তু তাঁর অলক্ষ্যে কী ঘটে গেল যে, দুজনের সম্পর্কের মধ্যে দেখা দিয়েছে এমন ফাটল!

পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করব-না করব-না করেও শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু তমোনাশ, তুমি আজ একা কেন?

তমোনাশ মুখটা নিচু করল, বলল, সে অনেক কথা, পৃথ্বীশদা। কিন্তু এখন বলব না, আপনি হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসুন, তারপর বলব।

পৃথ্বীশের তর সইছিল না। তমোনাশ-দ্যুতিকে কবি দম্পতি না বলা গেলেও পৃথ্বীশ তাদের দুজনকে একসঙ্গে আসতে দেখলেই বলতেন, এই যে, কবিতা-দম্পতি এসে গেল।

‘কবি-দম্পতি’ না বলে ‘কবিতা-দম্পতি’।

শুনে দুজনেই হাসত। হঠাৎ-হঠাৎ দ্যুতি বলে উঠত জীবনানন্দ দাশের কবিতার পংক্তিগুলি, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ / খুঁজিতে যাই না আর…’

কিংবা,

‘আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে

কিংবা শঙ্খ ঘোষের কবিতা:

কিছুটা গুলিয়ে গেছে। ঘোড়ার সামনেই গাড়ি জোতা।

অবশ্য নতুনও নয়, এ-রকমই সনাতন প্র‌থা—

বুঝতে একটি দেরি হয়, কোনটা পথ, কোথায়-বা যাব

আসলে যাওয়াই কথা, হোক-না সে যাওয়া জাহান্নমে।

পৃথ্বীশ বললেন, বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন? গল্পটা কি খুবই বড়ো? ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতে আরও মিনিট কয়েক দেরি আছে। ন-মিনিটে আকাশবাণীতে একটা নশো শব্দের গল্প পড়া যায় তা জানো? নশো শব্দ খুব কম নয়।

তমোনাশ বলল, তা হলে বলি। পৃথ্বীশদা, আপনি তো জানেন কবিতা আমার প্র‌াণ। চাকরির সময়টা বাদ দিলে আমি সারাক্ষণ কবিতা নিয়ে থাকতে ভালোবাসি। কখনও কবিতার বই নিয়ে পড়ে যাই একটার পর একটা কবিতা। দ্যুতিকেও কাছে ডেকে নিই, তাকেও পড়তে বলি। আপনি জানেন দ্যুতির উচ্চারণ কী স্পষ্ট, কবিতাটা পড়েও ভালো। কখনও দুজনে বাংলা আকাদেমিতে যাই, আমার কবিতা পড়া থাকলে পড়ি। পড়া না-থাকলেও অন্যের কবিতা শুনি।

পৃথ্বীশ জানেন দুজনের এই জীবনযাত্রা। বললেন, কিন্তু সেরকমই তো চলছিল এতদিন! হঠাৎ কী হল?

তমোনাশ ঘাড় নাড়ল, বলল, দ্যুতি একদম বদলে গেছে পৃথ্বীশদা। ও এখন কবিতা সহ্য করতেই পারছেন না!

সে কী! পৃথ্বীশের অবাক হওয়ার পালা, হঠাৎ কী হল দ্যুতির?

আমার মনে হয় ও এতদিন সিম্পলি অ্যাক্টিং করেছে। দ্যুতি মোটেই কবিতা ভালোবাসে না। আমাকে বিয়ে করার জন্যই এতদিন কবিতা পড়েছে, কবিতা মুখস্থ করেছে।

পৃথ্বীশ স্তম্ভিত হলেন তমোনাশের উক্তিতে, দুজনের মধ্যে চার বছরের গভীর প্রে‌ম, সুখী দাম্পত্যজীবন কি এত সহজে অভিনয় বলে ভাবা যায়! বাধা দিয়ে বললেন, তাই কি হয়, তমোনাশ! কবিতা হল ভিতরের জিনিস। আর সব কিছু বানিয়ে বলা যায়, একমাত্র কবিতা কারও ভিতর থেকে না এলে তার বহিঃপ্র‌কাশ ঘটে না!

না, পৃথ্বীশদা, আমি এতদিন কবিতা লিখছি তো! দ্যুতির সঙ্গেও চার বছর ঘর করেছি। কিন্তু এখন ও আমার কবিতা দেখলেই ছিটকে সরে যায়।

সে কী! কেন?

কবিতা শুনতে শুনতে হঠাৎ একদিন বলল, ‘আর শুনব না!’

হঠাৎ একদিন এরকম বলল? কোনও কারণ ছাড়াই!

হঠাৎ একদিন বলেছে তা নয়! ইদানীং দেখছিলাম আমাকে কবিতা পড়তে বা লিখতে দেখলেই সেখান থেকে উঠে চলে যাচ্ছে। ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অথবা জানলা দিয়ে আকাশ দেখছে! কিছুদিনের মধ্যে কীকরম বদলে গেল হঠাৎ! ভাবাই যায় না! তা আমি ওকে বললাম, তোমার যদি আমাকে ভালো না লাগে, তাহলে তোমার নিজের মতো করে বাঁচো গে।

পৃথ্বীশ জিবে চুক চুক করে বললেন, তারপর?

ও পরদিন সকাল উঠে আমাকে কিছু বলেনি। আমি অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর একটা এসএমএস লিখে আমাকে বলল, আমি চলে যাচ্ছি, আর ফিরব না।

তারপর খবর নাওনি কোথায় গেল? কার কাছে গেল?

খবর নিয়েছি। ও বাপের বাড়িতেই আছে।

কতদিন হল গেছে?

তা এই নিয়ে চার মাস হল।

বাহ্‌, তুমি আর তাকে আসতে বলোনি?

তমোনাশ ঘাড় নাড়ল, আমি ওকে আসতে বলব কেন? যখন চলে যেতে পেরেছে তখন ওখানেই থাক।

ইতিমধ্যে হাসপাতালের ঘন্টি বেজে উঠে জানান দিতে গেল ভিজিটিং আওয়ার শেষ। তমোনাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, পৃথ্বীশদা, তা হলে আমি চলি। আবার একদিন আসব।

তমোনাশকে কেবিনের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে পৃথ্বীশ ফিরে এলেন নিজের সিটে। দ্যুতি সেই যে একবার দেখা দিয়েই বেরিয়ে গেল বাইরে, তারপর আর এল না! সে কি নীচে অপেক্ষা করেছিল যদি তমোনাশ ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে যায়, তবে সে আসবে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। একবার ভাবলেন নীচে নেমে দেখে আসবেন দ্যুতি তখনও দাঁড়িয়ে আছে কি না কোথাও!

কিন্তু না, তাহলে এখনই তাঁকে ডাক্তারের ধমকের মুখে পড়তে হবে। সদ্য অপারেশন হয়েছে তাঁর, এখন আর জ্বালাযন্ত্রণা নেই বলে বুঝতে পারছেন না অপারেশনটা সাংঘাতিক!

কিছুক্ষণ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন তমোনাশ আর দ্যুতির মধ্যে এরকম একটা সংঘাতের সৃষ্টি হওয়ায়। কিন্তু কী কারণে এতখানি দূরত্ব তা এখনও পরিষ্কার নয় তাঁর কাছে।

৩.

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে আবার নতুন একজন সিস্টার, প্রে‌সার আর টেম্পারেচার দেখে, নোট করে, আবার ক্যাপসুল আবার ট্যাবলেট।

পৃথ্বীশ জানালা দিয়ে দেখছিলেন পৃথিবীর বুকে সন্ধ্যার নেমে আসা। বোগেনভোলিয়ার নিরন্তর দুলে ওঠা। চোখে পড়ল দু-একটা পাখিরও ঘরে ফেরা। ভাগ্যিশ তাঁর বেডের পাশে এই এক টুকরো আকাশ ছিল!

রাত আটটা দশে আবার সেই হাসিমুখের প্র‌বেশ, ঠিক আছে তো শরীর?

পৃথ্বীশেরও হাসি-হাসি মুখ, ফার্স্ট ক্লাস।

আমি আবার পরে আসব। একটা পেশেন্ট ক্রিটিকাল আছে। দেখে আসি।

পৃথ্বীশ বুঝলেন সারাদিনের একঘেয়েমি কেটে গিয়ে মনের কোথাও একটা উল্লাস। তন্দ্রাণী এল রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পর, হাসি-হাসি মুখে বলল, দুটো ইঞ্জেকশন আছে।

পৃথ্বীশ মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, সেই অ্যান্টি-বায়োটিকটাও দেবে?

হ্যাঁ, সবে তো কাল হল অপারেশন। না হলে ঘা শুকোবে কী করে! কিন্তু আস্তে আস্তে দেব। একটুও লাগবে না। দেখি চ্যানেলটা—

চ্যানেলটায় হাত দিয়ে বলল, একই জায়গায় পর পর ইঞ্জেকশন চলছে তো! ফুলে গেছে।

দ্বিতীয় ইঞ্জেকশনের সময় আবারও চিনচিন করে উঠল শিরার ভিতরটা। তন্দ্রাণী সিরিঞ্জটা তুলে নিয়েই তাড়াতাড়ি নিয়ে এল একটা অয়েন্টমেন্ট, শিরার উপর সেটি লাগিয়ে দিল ভালো করে। বলল, থ্রম্বোফব। ব্যথা থাকবে না আর।

সত্যি ব্যথা থাকল না। তন্দ্রাণী চ্যানেলটা পরীক্ষা করে বলল, কাল একটা নতুন চ্যানেল করতে হবে। দেখছেন তো কীরকম খুলে উঠেছে হাতটা!

সেদিন রাতে ঘুমোবার ঠিক আছে তন্দ্রাণী এল হাসি-হাসি মুখে, বলল, ডক্টর প্রে‌সক্রাইব করেছেন ঘুম না এলে একটা আলজোলাম দিতে। লাগবে?

পৃথ্বীশ ঘাড় নাড়লেন, দেখি চেষ্টা করে। ঘুম না এলে তোমাকে ডাকব।

এই বোতামটা টিপবেন, তাহলেই চলে আসব।

তন্দ্রাণী চলে যাচ্ছিল, পৃথ্বীশ ডাকলেন, বললেন, একটা কথা জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছে!

কী কথা?

এই রাশি রাশি পেশেন্ট। এক-একজন এক-একরকম। তাদের মধ্যে তুমি সারাক্ষণ হাসি মুখে কী করে থাকো?

তন্দ্রাণীর মুখের হাসি বিস্তৃততর হয়।

কিন্তু তুমি কি জানো তোমার হাসির ছটায় পেশেন্টদের রোগ অনেকটাই নিরাময় হয়? হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা কোরো বাকি জীবন।

তন্দ্রাণীর মুখটা উদ্ভাসিত এক অন্য আলোয়, বলল, চেষ্টা করব।

কিন্তু খুব কঠিন কাজ। তোমার তো চাকরির সবে শুরু। কী জানি ক-বছর পরে কী হবে!

তন্দ্রাণী একই রকম হাসি বজায় রেখে বলল, ছোটোবেলা থেকে বাবাও বলেন, মুখে সবসময় হাসি রাখবি। দেখবি মন, শরীর দুটোই ভালো থাকবে।

পৃথ্বীশের কৌতূহল আর একটু বিস্তৃত হয়, কোথায় বাড়ি তোমাদের?

বর্ধমান।

সেখান থেকে নিশ্চয় যাতায়াত করো না? কলকাতায় কোথায় থাকো?

ঠাকুরপুকুরের কাছে আমরা ক-জন একটা মেসে থাকি। অফ পেলে তবে বাড়ি যাই। যেমন পরশু শুক্রবার যাব।

একা একা যাবে?

একাই যাই। কিন্তু পরশু বাবা বলেছেন হাওড়া স্টেশনে নিতে আসবেন। একসঙ্গে যাব বাড়িতে।

পৃথ্বীশ উল্লসিত হন, তাহলে তো মুখ মজা! বাবার সঙ্গে সারা পথ গল্প করতে করতে যাবে?

তন্দ্রাণীর মুখের হাসি বিস্তৃততর হয়, ঠিকই ধরেছেন। বাবার সঙ্গে খুব মজা করি। আমি ছোটো মেয়ে কি না!

বাহ্‌, ছোটো মেয়ে! ক’ ভাইবোন তোমরা?

আমরা তিন বোন। বড়ো দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়ি ফাঁকা। আমি বাড়ি গেলে বাবা-মায়ের খুব আনন্দ হয়।

এই কথোপকথনের মধ্যে কেউ বাইরে থেকে ডাকল, তন্দ্রাণী, তন্দ্রাণী, তুই কোথায়?

তন্দ্রাণী হাসল, ব্যস, ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেল। ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।

সেদিন রাতে খুব ভালো ঘুম হল পৃথ্বীশের। তবে ঘুম ভাঙল ভোর-ভোর। বিছানায় বসে জানালার বাইরে নজর রেখে দেখলেন অন্ধকার কেটে কীভাবে ভোর হচ্ছে পৃথিবীতে। নিজের বাড়িতে ভোর দেখা একরকম, অন্য কোনও জায়গা থেকে ভোর দেখা আর একরকম। বাইরে নানা জায়গায় ট্যুরে গিয়ে ভোর দেখাটা তাঁর অন্যতম প্রি‌য় বিষয়।

সকালে তন্দ্রাণী যখন তাঁর বেডের সামনে এল, মুখে হাসি ঝরিয়ে বলল, খুব ঘুমোলেন কাল!

পৃথ্বীশ হেসে বললেন, হ্যাঁ, তোমাকে বিরক্ত করতে হয়নি।

কাল রাতে আমি দুবার এসে দেখে গেছি। দেখলাম সাউন্ড স্লিপ।

পৃথ্বীশ মজা করে বললেন, ইস, তাই নাকি! আর আমি তখন স্বপ্ন দেখছি, তুমি একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন নিয়ে এসেছ। বলছ, শিগগির ঘুমোন, নইলে ইঞ্জেকশন দেব।

তন্দ্রাণী হেসে বলল, দু-বেলা ইঞ্জেকশন দিচ্ছি তো, তাই আপনার একটা ভয় হয়ে গেছে আমার সম্পর্কে। কিন্তু আমি কি ইচ্ছে করে ইঞ্জেকশন দিই! ডাক্তার প্রে‌সক্রাইব করেছেন। নইলে অপারেশনের ঘা শুকোবে কী করে!

তারপর ব্রাশ আর পেস্ট বার করতে গিয়ে বলল, বাহ্‌, আজ ব্রাশ করা হয়ে গেছে? গুড! তা হলে চা আসুক। চাপের পাট চুকলে গরম জলে গা স্পঞ্জ করে দেব।

একটু পরেই চায়ের ট্রে এসে পৌঁছোল, পৃথ্বীশ চা তৈরি করার জন্য হাত বাড়িয়েছেন, কেটলিটা হাতে নিয়েছেন, হঠাৎ কোত্থেকে এসে গেল তন্দ্রাণী, বলল, দাঁড়ান, আপনি পারবেন না! বাঁ-হাতের চ্যানেল দিয়ে ড্রিপ চলছে, এক হাত দিয়ে কি চা তৈরি করা যায়! তাছাড়া আপনার ক্যালি বুঝে ফেলেছি। বাড়িতে নিশ্চয় চা করেননি কোনওদিন!

কাপে গরম জল ঢেলে, তাতে পাউচের চিনি ঢেলে, টি-ব্যাগ ডুবিয়ে বলল, নিন, চা খাওয়া শেষ হলে দুটো ইঞ্জেকশন পুশ করব।

কিন্তু অ্যান্টি-বায়োটিকটা দেওয়ার সময় পৃথ্বীশ বুঝলেন চ্যানেলের শিরাটা এমনই ফুলেছে যে, ওষুধ যেতেই পারছে না! তন্দ্রাণী খুব স্লো মোশনে দিয়েও যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দিতে পারল না তাঁকে। ইঞ্জেকশন দেওয়া শেষ হলে আবার ভালো করে থ্রম্বোফব লাগিয়ে আস্তে আস্তে ঘষে দিল বহুক্ষণ, যতক্ষণ না ব্যথাটা মিলিয়ে গেল। বিব্রত কণ্ঠে বলল, ইস, নতুন চ্যানেল করার দরকার ছিল। ঠিক আছে, রাতে এসে ডান হাতে চ্যানেল করে দেব।

একটু পরেই গামলায় ভরে গরম জল নিয়ে এল তন্দ্রাণী, জামাটা খুলে পৃথ্বীশ বললেন, স্নান করতে পারলে ভালো হত। মনে হচ্ছে গায়ে গন্ধ হয়ে গেছে!

তন্দ্রাণী হাসল, গা স্পঞ্জ করে দিতে দিতে বলল, অপারশেন তো হল পরশু। আজই স্নান করা যাবে না। দেখা যাক, আজ ডক্টর এসে হয়তো ড্রিপ অফ করে দিতে পারেন। তাহলে কাল গা স্পঞ্জ করে মাথাটা ধুয়ে দেব। তা হলে একটু আরাম লাগবে।

ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে আটটার কাঁটা। এই সময়টা ব্যস্ত হয়ে পড়ে সব স্টাফ। নতুন স্টাফ এসে যায়, তাদের বুঝিয়ে দিতে হয় প্র‌তি পেশেন্টের রোজনামচা।

হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় কেবিনের দরজায় মুখ বাড়াল খুদে সিস্টার, হাসি-হাসি মুখে বলল, আবার রাতে আসব।

ডাক্তার সরকার এলেন সাড়ে এগারোটার দিকে, বললেন, ভালোই তো আছেন দেখছি।

পৃথ্বীশ তাতে উৎসাহিত হয়ে বললেন, কাল বাড়ি যেতে পারব?

কাল! দাঁড়ান, আজ বিকেলে আপনার ড্রিপটা অফ করে দিতে বলে যাচ্ছি। কাল শুক্রবারটা অবজারভেশনে থাকবেন। রিলিজ করা যাবে না। কোনও কমপ্লিকেশন না হলে রিলিজ করতে শনি বা রবিবার!

ডাক্তার চলে গেলে কিছুক্ষণ উদাসীন হয়ে থাকেন পৃথ্বীশ। ভাবলেন, সত্যিই তো! একটা মেজর অপারেশন, ব্যস্ত হলে চলবে না!

৪.

সেদিন ভিজিটিং আওয়ার শুরু হওয়ার প্র‌ায় সঙ্গে সঙ্গে যে-মুখখানি কেবিনের বাইরে দেখতে পেলেন তা দ্যুতির। দ্যুতি কাল হাসপাতালে এসেও ফিরে গেছে তমোনাশকে কেবিনের ভিতর বসে থাকতে দেখে, তাই আজ ভিজিটিং আওয়ারের একেবারে প্র‌থমেই চলে এসেছে পৃথ্বীশকে দেখতে। গত সপ্তাহেই দ্যুতির সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কথা হয়েছিল, কিন্তু সেই কথোপকথনের সময় দ্যুতি একবারও উচ্চারণ করেনি তার সঙ্গে তমোনাশের মন-কষাকষির কাহিনি। হয়তো পৃথ্বীশকে বলে ভারাক্রান্ত করতে চায়নি তার মন।

আজ বোধ হয় মাস চারেক পরে দেখল দ্যুতিকে, আজও সেরকমই সুন্দরী আছে, এখনও তার গণ্ড বেয়ে ঝড়ে পড়ছে কবিতার আলো, কিন্তু সেই পংক্তির অক্ষরগুলিতে কোথায় যেন নিহিত হয়ে আছে একটুকরো প্যাথোজ। যেন এই সামান্য সময়ে অনেকটাই বদলে গেছে দ্যুতির অভিব্যক্তি।

হয়তো পৃথ্বীশের এতটা নজরে পড়ত না দ্যুতির পরিবর্তন, কাল তমোনাশের সঙ্গে কথা-বিনিময়ের পরে নজরে পড়ল কবিতায় ওতপ্রোত মেয়েটির ভ্রুপল্লবের চোরা-নিরাসক্তি। মিষ্টি সুশ্রী মেয়েটির মুখে সামান্য হাসি, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে একরাশ বিষণ্নতা। তাঁর কাছে এসে বলল, এখন কেমন আছেন আপনি?

আমি তো ভালোই। কিন্তু তুমি কেমন?

আমিও ভালো আছি, পৃথ্বীশদা।

পৃথ্বীশ ঘাড় নেড়ে বললেন, না, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই!

দ্যুতির মুখের হাসি আরও ম্লান হয়ে এল, বলল, তমোনাশ নিশ্চয় আমার নামে অনেক কিছু বলেছে আপনার কাছে?

পৃথ্বীশ হাসলেন, বললেন, তুমি কি কিছু অন্যায় করেছ যে তোমার নামে বলবে?

আমার তো মনে হয় আমি কোনও অন্যায় করিনি।

সে তো তোমাকে আমি এতদিন ধরে চিনি। তুমি কোনও অন্যায় করতে পার বলে আমি মনে করি না!

কিন্তু তমোনাশ মনে করেছে আমি খুব খারাপ মেয়ে। আমার সঙ্গে আর থাকা যায় না!

পৃথ্বীশ বললেন, কিন্তু তমোনাশের মনে করার হেতু কী?

দ্যুতি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর ভারী গলায় বলল, পৃথ্বীশদা, জীবনটা কি শুধুই কবিতার? তার বাইরে কি আর কোনও জগৎ নেই?

জীবন শুধুই কবিতার হতে যাবে কেন!

পৃথ্বীশদা, তমোনাশ ভালো কবি, তার হাত থেকে চমৎকার সব কবিতা বেরোয়, কিন্তু কবিতার বাইরেও তো একটা পৃথিবী আছে!

নিশ্চয় আছে। সেই পৃথিবীও খুব বিশাল।

কিন্তু তমোনাশ মনে করে তার মাত্র দুটো সত্তা, একটি তার অফিসের, অন্যটি কবিতার। অফিসে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কবিতার খাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে থাকে, তারপর অফিসে যায়, সেখানে কতটা কবিতার কথা ভাবে, কতটা অফিসের কথা তা বলতে পারব না, কিন্তু অফিস থেকে বেরিয়ে কোনও না কোনও কবিতার অনুষ্ঠানে যাবে, সেখানে কবিতা পড়ুক না পড়ুক, সেখানে বসে কবিতা শুনবে, তারপর ঘরে ফিরবে অনেক রাতে। তখন তার মধ্যে ভালোবাসা বলে কোনও অনুভূতি থাকে না। বাড়ি ফিরে খাওয়া, তারপর ঘুম।

সে কী! রোজই কবিতার অনুষ্ঠানে যায়?

যদি কোনও দিন অফিস থেকে সাজা বাড়ি ফেরে, ফিরেই বসে যায় বইখাতা নিয়ে। তখনও শুধু কবিতা আর কবিতা। পৃথ্বীশদা, পৃথিবীটা কি শুধুই কবিতার?

গতকাল তমোনাশের কাছে অবহিত হয়েছেন দ্যুতি সম্পর্কে, আজ দ্যুতির কাছে শুনছেন তমোনাশের কর্মকাণ্ড বিষয়ে। দু পক্ষের অভিযোগ শুনে উপলব্ধি করতে পারছেন এক যুবক আর এক যুবতীর মাত্র চার বছরের বিবাহিত জীবনে জমে ওঠা আক্ষেপের স্তূপ। তমোনাশ তার জীবনের প্র‌তি সত্তায় একটু একটু করে মিশিয়ে নিয়েছে কবিতার গূঢ় জগৎ, কিন্তু তার অবকাশে একটুও ভাবেনি দ্যুতি ক্রমশ একা হয়ে পড়েছে!

তবু দ্যুতিকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, দ্যুতি, কবিতা একজন প্র‌কৃত কবির নিশ্বাস-প্র‌শ্বাসের মতো। প্র‌কৃত কবির চিন্তায়-অনুভবে-বীক্ষণে জুড়ে থাকে কবিতার ভিতর-জগৎ, কিন্তু কবিকে এও মনে রাখতে হবে তিনি সংসারে বসবাসকারী একজন মানুষও বটে।

পৃথ্বীশদা, আমি কিছুতেই তমোনাশকে বুঝিয়ে উঠতে পারিনি কবিরও একটা ঘর-সংসার থাকে, আর তা যদি না থাকে তবে কবির উচিত নয় বিয়ে করা, সংসার করার কথা ভাবা, আর একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসে তাকে একেবারেই ভুলে যাওয়া!

পৃথ্বীশ অনুভব করতে পারছেন দ্যুতির যন্ত্রণার জায়গাগুলি। কবিতাকে ভালোবেসে, কবিকে ভালোবেসে সে অবলীলায় তার জীবনে বরণ করেছিল একজন কবিকে। কিন্তু কবির কাছ থেকে ক্রমাগত উপেক্ষা পেয়ে, একাকীত্বের মধ্যে যাপন করতে করতে কবি সম্পর্কে মোহ ভঙ্গ হয়েছে তার, কবিতাকেও সহ্য করতে পারছে না আর।

পৃথ্বীশ চিন্তায় পড়লেন, তমোনাশ আর দ্যুতির সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে ভাবিত হলেন, তারপর বললেন, ঠিক আছে দ্যুতি। আমি তমোনাশের সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলব।

না, বলবেন না, দ্যুতিকে বেশ ত্রুদ্ধ দেখায়, বলে, ওকে আমি অনেক বুঝিয়েছি, গত দু-বছর ধরে ক্রমাগত বোঝানোর পরও যদি কেউ বুঝতে না চায়, তবে তাকে আর বোঝানো নিরর্থক। আমি তো তার কাছে ভিক্ষা চাই না!

তাঁদের কথোপকথনের মধ্যে হঠাৎ কেবিনের বাইরে দেখা গেল তমোনাশের মুখ, আর কী আশ্চর্য, কাল কেবিনের ভিতরে তমোনাশকে দেখে দ্যুতি যেরকমটা করেছিল, আজ কেবিনের ভিতরে দ্যুতিকে দেখে তমোনাশও ছিটকে বেরিয়ে গেল বাইরে।

পৃথ্বীশ বুঝলেন দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে! যে কবিতাকে ঘিরে দুজনের প্রে‌ম, প্রে‌ম থেকে বিয়ে, সেই কবিতাকে ঘিরেই তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের চ্যুতি।

পৃথ্বীশ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখন কোথায় আছ?

দ্যুতি মুখ নিচু করে বলল, কোথায় আর যাব? তখন মা পইপই করে বলেছিল, তমোনাশকে বিয়ে না করতে। বাবাও বলেছিল, ‘ভালো করে ভেবে দেখে তারপর আগুনে ঝাঁপ দিও।’ কিন্তু বাড়ির কারও মতকে মান্য না করে জোর করে বিয়ে করেছিলাম একজন কবিকে। এখন মাথা নত করে বাবা-মায়ের কাছেই ফিরে গেছি।

পৃথ্বীশ খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, কিন্তু কীভাবে দূর করবেন এই ক্ষোভের স্তূপ তা বুঝে উঠতে পারলেন না এই মুহূর্তে।

দ্যুতি আবার বলল, পৃথ্বীশদা, বাড়িতে ফিরে গিয়ে ভালোই আছি, অন্তত প্র‌তিদিনের যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে না! কয়েকদিন খুব মনমরা হয়ে ছিলাম, তারপর নিজেকেই নিজে বুঝিয়েছি। যাকে বলে অটো-সাজেশন। এখন কাটিয়ে উঠেছি সেই অবসাদ। জীবন তৈরি করতে চলেছি নতুনভাবে। চার বছর আগে এম.এ. পড়তে পড়তে বিয়ে করেছিলাম, বিয়ের পর পরীক্ষাটাও দিয়ে ফেলেছিলাম, নম্বর খারাপ পাইনি, এখন ভাবছি যদি একটা পিএইচডি করে ফেলতে পারি, হয়তো একটা চাকরি-বাকরি পেয়ে যেতে পারি।

পৃথ্বীশ বুঝলেন দ্যুতির ফাস্ট্রেশন সম্পূর্ণ ভিন্ন গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

বললেন, দ্যাখো, কিছুকাল আগে একটা বিদেশি শর্ট-ফিল্ম দেখেছিলাম, সেই ছবির পরিণতির পর একলাইন ইংরেজি কোটেশন ভেসে উঠেছিল পর্দার উপর, তাতে লেখা, ‘যদি সে তোমার হয়, তাহলে একদিন না একদিন সে ফিরে আসবে তোমার কাছে। আর যদি সে না আসে তা হলে সে কোনও দিনই তোমার ছিল না!

দ্যুতির দু-চোখের কোণ হঠাৎ চিক চিক করে উঠল, গলাটাও ধরে এল হঠাৎ, বলল, পৃথ্বীশদা, আমি আর তার ফিরে আসার কথা ভাবছি না, শুধু ইতিমধ্যে একটা বিপত্তি ঘটে গেছে।

বিপত্তি! পৃথ্বীশ একটু অবাক হলেন।

হ্যাঁ, ওর সঙ্গে কথা-কাটাকাটির পর যখন ওকে ছেড়ে চলে এলাম, তখন একটু-একটু বুঝতে পেরেছিলাম, শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে। ওকে দুদিন বললামও, ‘শরীরটা ঠিক নেই’। ও বলল, ‘কিচ্ছু হয়নি, এ তোমার মনের অসুখ।’ কিন্তু বাপের বাড়ি ফিরে এসে কয়েকদিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম, আমি ক্যারি করছি।

পৃথ্বীশ চমকে উঠে বললেন, সে কী!

দ্যুতি চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলল, হ্যাঁ তখনই ভেবেছিলাম ওটা নষ্ট করে ফেলি। কিন্তু পারলাম না। বরং ভাবলাম, আমার বেঁচে থাকার একটা রসদ তো হল।

পৃথ্বীশ দ্যুতির মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন পড়ার চেষ্টা করলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, তমোনাশ জানে?

না, জানাইনি। তখন তো ও পাত্তাই দেয়নি আমার শরীরের বৈকল্য।

এখন আর জানাতে চাইও না।

হয়তো আরও কিছু বলত দ্যুতি, হঠাৎ তাঁদের অসমাপ্ত কথাবার্তার মধ্যে এসে গেল পৃথ্বীশের বাড়ির লোকজন। দ্যুতি তার কান্না সামলে হাসতে চেষ্টা করল, বলল, বৌদি, ভালো আছেন? পৃথ্বীশদার অপারেশন হয়েছে শুনে দেখতে চলে এলাম। আমি এখন উঠি।

দ্যুতি কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পৃথ্বীশ অনেকক্ষণ সময় নিলেন সহজ হয়ে উঠতে।

৫.

সারাটা দিন হাসপাতালের বেডে একা-একা বই পড়ে, করিডোরে মানুষের চলাচল দেখে, ভিজিটিং আওয়ারে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ফুরিয়ে ফেলা এক-একটা দিন। তিনি হাসপাতালে থাকা মানে বাড়ির সবাইকার উদ্বেগ, ছোটাছুটি, জীবনযাপনে ব্যস্ততা।

তার মধ্যে ঘনিয়ে আসে রাত। আটটার পর হাসি-হাসি মুখে তন্দ্রাণীর প্র‌বেশ, চ্যানেল করা হাতটা টেনে নিয়ে পরখ করল সিরিয়াস মুখে, বলল, আজ কিন্তু চ্যানেলটা বদলাতেই হবে। কী বিশ্রী রকম ফুলে গেছে।

একটু পরেই নিয়ে এল সরঞ্জাম। বাঁ-হাতের চ্যানেলটা খুলল সাবধানে যাতে বেশি ব্যথা না লাগে, তারপর টেনে নিল ডান হাতটা। খুঁজতে শুরু করল কোনও স্বাস্থ্যবান শিরা, কিছুক্ষণ নিরিখ করে ভুরুতে একটা কোঁচ ফেলে বলল, দাঁড়ান আসছি।

বলে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল কেন জানে! একটু পরেই ধরে নিয়ে এল অনতিতিরিশ একজন সিনিয়র সিস্টার। তাকে নিশ্চয় ব্রিফ করে দিয়েছে, সে এসে শিরা খুঁজে বার করে তৈরি করতে শুরু করল নতুন চ্যানেল। আর তার পাশে মুখ ব্যাজার করে দাঁড়িয়ে তন্দ্রাণী। পৃথ্বীশ মনে মনে হাসলেন তন্দ্রাণীর কাণ্ড দেখে। প্র‌থমদিন তাঁর হাতে চ্যানেল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল, তাই আজ যদি সেই কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাই আগেভাগে ডেকে নিয়ে এসেছে সিনিয়রকে।

চ্যানেল হয়ে গেলে সিনিয়র চলে গেলেন নিজের কাজে। তন্দ্রাণী ততক্ষণে প্র‌স্তুত করছে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। পৃথ্বীশ হেসে বললেন, কী হল! আগের দিন ঠিকমতো হয়নি বলে আজও হবে না ভাবলে কেন!

কাঁচুমাচু মুখে তন্দ্রাণী বলল, সেদিন একবার ব্যথা দিয়েছি, আজও যদি ব্যথা দিয়ে ফেলি, আপনি আমার সম্পর্কে কী ভাববেন?

পৃথ্বীশ হাসলেন, কী আবার ভাবব! তোমাকে তো আরও বহু পেশেন্টের হাতে চ্যানেল করতে হয়। সবসময় কি সিনিয়রদের ডাকো!

তা ডাকি না। কিন্তু আপনাকে ব্যথা দিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছি সেদিন। তাই আজ আর চান্স নিইনি।

নতুন চ্যানেল বলে সেদিন অ্যান্টি-বায়োটিক দিতেও ব্যথা লাগেনি। পৃথ্বীশ তার ইঞ্জেকশন দেওয়াকে ফুলমার্কস দিতে তার আবার হাসিমুখ, বলল, বাবা ফোন করেছিল। বলল, বেশি দেরি করিসনে যেন! একটা ট্রেন ফেল করলে আবার পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে ট্রেন।

পৃথ্বীশ হেসে বললেন, বাড়িতে যাওয়ার সময় যত এগিয়ে আসছে তোমার মুখের হাসি আরও সুন্দর হচ্ছে। যে কোনও মানুষের কাছে বাড়ি ফেরার আনন্দই আলাদা। তুমি যেমন ছটফট করছ কখন বাড়ি যাবে, তেমনি আমিও ছটফট করছি কখন বাড়ি ফিরব।

সেদিন রাতে ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিল পৃথ্বীশের, এক-একদিন কোনও কারণ ছাড়াই তো এরকমই হয়! হাতের কাজ সেরে তাঁর বেডের কাছে এল তন্দ্রাণী, বলল, আপনি কি শনিবারেই চলে যাবেন?

ঠিক নেই। ডাক্তার বলেছেন কাল এসে দেখবেন আমি কেমন আছি, তার উপর নির্ভর করছে বাড়ি ফেরা-না-ফেরা।

তন্দ্রাণীর মুখ একটু ম্লান হল, পরক্ষণে মুখে হাসি এনে বলল, বাবার সঙ্গে একটু আগে কথা বলছিলাম। বললাম, আপনি বলেছেন ‘এই চাকরিতে মুখের হাসি ধরে রাখা খুব কঠিন কাজ। কিন্তু হাসি রাখতে পারলে বহু পেশেন্টের রোগের দ্রুত নিরাময় হতে পারে।’ শুনে বাবা বলল, ‘কথাটা একটা ডায়েরিতে লিখে রাখিস। মাঝে মাঝে ডায়েরির ওই পৃষ্ঠাটা উল্টে দেখবি। তা হলে ধরে রাখতে পারবি হাসিটা।’ কাল বাড়ি গিয়ে লিখে রাখব কথাটা।

পৃথ্বীশ খুশি হয়ে বললেন, ডায়েরি লেখা অভ্যাস আছে?

ঘাড় নাড়ে তন্দ্রাণী, হ্যাঁ। বাবা প্র‌তি বছর একটা করে ডায়েরি কিনে দেন।

বাহ, এটা তো ভালো অভ্যাস। আর কী অভ্যাস আছে এরকম?

খুব গান শুনি। হিন্দি বাংলা যা পাই।

বই পড়ো না।

বই! তন্দ্রাণী মাথা নাড়ে, মেসে থাকি তো, বই পড়া হয় না।

পৃথ্বীশ বইয়ের পোকা, তাই বললেন, মাঝেমধ্যে বই পড়বে।

তন্দ্রাণী হাসি-হাসি মুখ করে, ঠিক আছে, পড়ব।

পরদিন সকালে আবার সেই একই রুটিন। তন্দ্রাণী এসে বলল, ড্রিপ তো খুলে দিয়েছে! তা হলে আজ আগে গা স্পঞ্জ করে দিই। তারপর বাথরুমে নিয়ে গিয়ে মাথা ধুয়ে দেব।

কিন্তু গা স্পঞ্জ করার মধ্যেই তার ডাক পড়েছে, যেতে হবে অন্য পেশেন্টের কাছে। তাড়াতাড়ি গা স্পঞ্জ করে দিয়ে বলল, আমি হাতের কাজ মিটিয়ে আসি। পরে এসে মাথা ধুয়ে দেব।

পৃথ্বীশ লক্ষ করলেন তন্দ্রাণীর মুখে আজ অন্য আলোর উদ্ভাস। বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরবে যে! বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় কাটাতে হয় অনেকগুলো দিন, তার পর তার দু-দিন অফ। এই সময়টুকুর জন্য কত অপেক্ষা, কত প্র‌ত্যাশা। পৃথ্বীশের মনটাও ভালো হয়ে গেল।

কিন্তু তন্দ্রাণী সেই যে গেল, আবার তাঁর কেবিনের সামনে এল তখন বেলা আটটা ছুঁই-ছুঁই। তাঁর কাছে এসেই মনে পড়ল তার রেখে যাওয়া প্র‌তিশ্রুতি, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এই যা, মাথা ধোয়ানো হল না তো! কী হবে! পর পর এত কাজ দিলেন সিনিয়র!

তারপর হঠাৎ বলল, চট করে মাথাটা ধুয়ে দিয়ে যাব?

পৃথ্বীশ মাথা নাড়লেন, না, না, তোমার বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করবেন তো! এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি যাও, নইলে একটা ট্রেন মিস করবে।

তন্দ্রাণী মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, তা হলে আপনি একটু কষ্ট করে ধুয়ে নিন। দু-দিন মাথায় জল পড়েনি! আমি এগোই, হ্যাঁ?

বলেই বেরিয়ে গেল দ্রুত, পরক্ষণে ফিরে এল আবার, আপনার কি কাল ছুটি হয়ে যাবে? তা হলে তো আর দেখা হবে না? যদি রবিবার ছুটি হয় তো দেখা হবে।

ঠিক আছে, তুমি শিগগির বেরিয়ে পড়ো।

হাসি-হাসি মুখ ছিল, এখন তাতে একটু বিষণ্নতার আভাস। তন্দ্রাণী চলে গেলে পৃথ্বীশেরও মন ছুঁয়ে গেল এক টুকরো বিষাদ। ক-দিন আগেও যাকে চিনতেন না, তার জন্য কেন মন খারাপ!

ডাক্তার সরকার এলেন সাড়ে এগারোটায়, পৃথ্বীশকে দেখে বললেন, কী, কালই বাড়ি যেতে চান?

পৃথ্বীশ হাসলেন, আপনি যা বলবেন—

ঠিক আছে, আজ তো ফোর্থ ডে। এত তাড়াতাড়ি কাউকে ছাড়ি না। সেকশনে বলে যাচ্ছি কাগজপত্র তৈরি করে রাখতে। কাল শনিবার। কাল সকালে এসে দেখে তবে সিদ্ধান্ত নেব।

৬.

সেদিন ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার একটু আগেই বাড়ির সবাই চলে গেল, পৃথ্বীশদের কয়েকজন আত্মীয় আসছেন বাড়িতে, তাই।

পৃথ্বীশও কাল থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। হাসপাতালে থাকা মানে জরুরি কাজকর্মগুলোও থমকে থাকে।

ঠিক সে সময় তমোনাশের দেখা পাওয়া গেল কেবিনে, সামনের চেয়ারটিতে বসে বলল, আপনাকে কিন্তু আজ ফ্রেশ দেখাচ্ছে, পৃথ্বীশদা।

পৃথ্বীশ হেসে বললেন, কাল হয়তো রিলিজ করে দেবে। বোধহয় সে-কথা ভেবেই।

এখন নিশ্চয় কোনও কমপ্লিকেশন নেই?

আপাতত নেই।

বলে পৃথ্বীশ কিছুক্ষণ ভাবলেন দ্যুতির কথা, তমোনাশের সঙ্গে তার আর যোগাযোগ নেই, অথচ তমোনাশের সন্তান ক্যারি করছে প্র‌ায় চার মাস হতে চলল!

তমোনাশ পরক্ষণে বলল, পৃথ্বীশদা, মানুষে মানুষে সম্পর্কগুলো কীরকম দ্রুত বদলায়, তাই না?

পৃথ্বীশ বুঝতে চাইলেন তমোনাশের বক্তব্য। বললেন, ইট ডিপেন্ডস। কোনও কোনও সম্পর্ক সারাজীবন একইরকম থাকে, কোনও সম্পর্ক দ্রুত গড়ে ওঠে আবার দ্রুত ভাঙে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুই চরিত্রের মানসিক গঠনের উপর নির্ভর করে বিষয়টা। কেউ একজন যদি সেলফ-সেন্টারড হয়—

তমোনাশ বুঝে ফেলেছে পৃথ্বীশ কী বলতে চাইলেন, বলল, আপনি কি এর জন্য আমাকে দোষারোপ করছেন?

আসলে কী জানো, তমোনাশ, একজন কবির গোটা সত্তা জুড়ে থাকে কবিতা, কিন্তু তার বাইরেও একটা সত্তা থাকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কথাই যদি ধরো, তিনি সারাজীবনে কম লেখেননি। কিন্তু লেখার বাইরেও তাঁর একটা আলাদা জীবন ছিল। ছিল কি না?

তমোনাশ মাথা নিচু করে, ঘাড় নেড়ে জানায়, ছিল।

তাঁর উপর মাঝে মাঝে দায়িত্ব দেওয়া হত জমিদারি দেখাশুনোর। বোটে ঘুরে ঘুরে তিনি জমিদারিও দেখতেন, কবিতাও লিখতেন। আবার অনেক জরুরি বা না-জরুরি চিঠিও লিখতেন তাঁর স্নেহভাজনদের উদ্দেশে।

তমোনাশ বলল, পৃথ্বীশদা, আমি কিন্তু অফিসটা খুব মন দিয়ে করি। প্র‌াইভেট কোম্পানির চাকরি, বুঝতেই পারছেন যেমন স্যালারি দেয়, তেমনই খাটিয়ে নেয়। কিন্তু তারপর যেটুকু সময় পাই, মন দিয়ে না-লিখলে লেখা ভালো হবে কী করে!

পৃথ্বীশ হাসলেন, বললেন, খুব ভালো যুক্তি, কিন্তু সেই উদ্বৃত্ত সময় থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে সংসারকেও দিতে হবে তোমাকে। তুমি কি জানো এ সময়ের একজন ব্যস্ত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়মিত বাজার করতেন গড়িয়াহাট মার্কেটে? নিজেই কিনতেন আলু পটল বেগুন…। তুমি নিশ্চয় তার চেয়ে ব্যস্ত কবি নও?

তমোনাশ চুপ করে থাকে। তার ভিতরে যেন ছটফট করে উঠছে কী এক অসহায়তা।

পৃথ্বীশ আবার বললেন, তমোনাশ, একজন কবিকে যেমন বাজার করতে হয়, সংসারকে সময় দিতে হয়, তেমনি ভাবতে হয় কী করে তার সন্তানকে ঠিকমতো মানুষ করতে হবে!

শেষের বাক্যটি ঠিক যেন সেঁধুল না তমোনাশের মগজে।

পৃথ্বীশ লক্ষ করছিলেন তমোনাশের অভিব্যক্তি, বললেন, একটি মানুষ আর একটি মানুষীর জীবনে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেই ঘটনার স্থায়িত্ব হতে পারে তাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, আবার সেই সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে বিবাহের পর যে কোনও সময়। তবে বেশিরভাগ সম্পর্ক ঠিক কোন সময় ভাঙে সেই পরিসংখ্যান কি তোমার জানা আছে?

তমোনাশ অস্পষ্ট চাউনি দিয়ে ঘাড় নাড়ল, না।

বেশিরভাগ সম্পর্ক ভাঙে বিয়ের তিন-চার বছরের মাথায়। যদি না এই সময়ের মধ্যে মেয়েটি সন্তানের মা হয়ে যায়!

তমোনাশ গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করছিল পৃথ্বীশের হেঁয়ালিমার্কা কথাগুলো।

আসলে বিয়ের তিন-চার বছরের মধ্যে দুজনের শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে একটা শৈথিল্য আসে। সেই শৈথিল্য আলগা করে দেয় তাদের দাম্পত্যজীবন। কিন্তু যদি এই সময়ের মধ্যে স্ত্রী গর্ভবতী হয় বা সন্তানের জন্ম দেয়, তবে সেই সন্তান হয়ে ওঠে দুজনের মধ্যে একটা সেতু।

তমোনাশের দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ।

তমোনাশ, এমনও অনেক সময় হয়, দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গেল, অথচ মেয়েটি সন্তানসম্ভবা সে-কথা ছেলেটি জানলই না!

তমোনাশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পৃথ্বীশের দিকে। হয়তো ভাবছে পৃথ্বীশদা কি ইঙ্গিতে কিছু বলছেন তাকে!

তার মধ্যে একটা অস্থিরতা অনুভব করতে পারছেন পৃথ্বীশ।

তমোনাশ বোধহয় এতক্ষণে বুঝতে পারল বিষয়ের গভীরতা। জিজ্ঞাসা করল, দ্যুতি কি আপনাকে কিছু বলেছে, পৃথ্বীশদা?

পৃথ্বীশের মনে হল দ্যুতি অভিমানবশত তমোনাশকে কিছু বলেনি, কিন্তু একটা সম্পর্ককে জুড়তে গেলে তাঁকে একটা কিছু করতে হবে। দুজনের মধ্যে একটা অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক ছিল, তাকে এভাবে ভেঙে দিতে দেওয়া যায় না, বললেন, তুমি তো খবর রাখো না, দ্যুতির গর্ভে তোমার সন্তান। গর্ভে তার বয়স চার মাস হতে চলল।

তমোনাশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে পৃথ্বীশের দিকে। বিড়বিড় করে বলল, কী আশ্চর্য, আমাকে একবার বললও না!

পৃথ্বীশ একটু ধমক দিয়ে বললেন, তোমাকে নাকি অনেকবার বলেছে, সরাসরি নয়, ইঙ্গিতে। তুমি যদি তার উপর মনোযোগী হতে, তা হলে ব্যাপারটা বুঝতে পারতে। কিন্তু তুমি তো সারাক্ষণ কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকো। বোঝোনি। তুমি কি সত্যিই তার কথা ভাবো?

তমোনাশ ছটফট করে ওঠে, দ্যুতি আপনাকে তাই বলল?

তমোনাশ, কবিতা কি জীবন থেকে বিচ্যুত হতে পারে? জীবনকে এড়িয়ে তুমি যদি কবিতা লেখো, সেই কবিতায় কিন্তু জীবনবোধের অভাব লক্ষ করা যেতে পারে।

তমোনাশ উঠে দাঁড়াল, বলল, পৃথ্বীশদা, আমি এখনই দ্যুতির কাছে যাচ্ছি। সত্যিই আমি ভুল করেছি। কিন্তু—

পৃথ্বীশ গভীরভাবে লক্ষ করছিলেন তমোনাশের অভিব্যক্তি।

কিন্তু দ্যুতি খুব জেদি মেয়ে। আমি গেলেও হয়তো আমাকে ফিরিয়ে দেবে!

পৃথ্বীশ কিছু বললেন না এবারও। তমোনাশের চোখেমুখে বিভ্রান্তি।

পৃথ্বীশদা, দ্যুতি যদি ফিরিয়ে দেয়, তবে আপনি দ্যুতিকে বোঝাবেন তো?

পৃথ্বীশ একটু হাসলেন, বললেন, তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো তো!

তমোনাশ সেরকমই হতচকিত অভিব্যক্তি নিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। পৃথ্বীশ হাসলেন, নিজের ভিতরে এখন অনুভব করছেন স্বস্তির উপশম। তাঁর শরীর ডাক্তারের ছুরি-কাঁচির অব্যর্থ প্র‌য়োগ যেমন তাঁর জীবনযাপনে এনে দিয়েছে উপশম, এক তরুণ দম্পতির মনের ভিতর গজিয়ে ওঠা ভুল-বোঝাবুঝির স্তূপ কাটাছেঁড়া করে জীবনের পথটা সোজা করে দিতে চাইলেন তেমনটাই। আলো হাতে অপেক্ষা করছে যে-মেয়েটি তার কাছেই তমোনাশের গন্তব্য।

৭.

সেদিন প্র‌তিটি মুহূর্ত পৃথ্বীশ কাটালেন খুবই নির্বিকার ভাবে। তাঁর বেডের কাছে এক-একজন সিস্টার আসছেন, যাঁর যাঁর ডিউটি পালন করছেন রুটিন অনুযায়ী, কিন্তু পৃথ্বীশের মনে হচ্ছে প্র‌তিটি মুখ রোবটের মতো। সারাটা দিন কেন যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে এক টুকরো বিষণ্নতা। তন্দ্রাণী মাত্র ক-দিনেই বুঝিয়ে দিয়ে গেল হাসপাতালও ভালোলাগার জায়গা করে তোলা যায়।

পরদিন ছুটি পেতেই পৃথ্বীশ গুছিয়ে নিলেন তাঁর ক-দিনের সংসার। হাসপাতালের পোশাক বদলে পরে নিলেন নিজের জামা। বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে ভাবলেন, তন্দ্রাণী কাল হাসপাতালে ডিউটি করতে এসে অভ্যাসমতো বেড নম্বর টু টোয়েন্টি নাইনে আসবে। হয়তো খুঁজবে তাঁকে। তাঁকে না-পেয়ে হয়তো একটু বিষণ্ণ হবে, তারপর বেডে বসে থাকা নতুন পেশেন্টের কাছে গিয়ে বলবে, এখানে কেমন লাগছে আপনার?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *