আলো নিভে গেলে বুঝবে – অনীশ দেব
স্যার, স্যার, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? সবে দেওয়ালঘড়ি রাত দশটা বলছে, সবে আপনার সাদা ঘোড়া মার্কা বোতলের ঘোড়ার কেশর পর্যন্ত খরচা হয়েছে, আর আপনি ঘুমিয়ে পড়লেন! এই সময়েই তো আপনাদের মতো বড়োসাহেবদের আশনাই আর ফুর্তি জমে ওঠে, মনটা মরা গোরু দেখা শকুনের মতো ডানা ঝাপটায়! ভেবেছিলুম, আপনার এই ফুর্তির সময়ে এসে আরও একটা খুশির খবর শোনাব, তা বুঝি আর হয়ে উঠল না। আমি তো স্যার ভয়ে ভয়ে আসছিলুম, বুকটা ধুকুপুকু করছিল, কালকের দিনটা আমার বুঝি আর আধ পেটা খেয়ে থাকতে হল না।
যতই বলুন স্যার, প্রথমে ঢুকতে গিয়েই সদর দরজাটা খোলা দেখে আমার ভারি আশ্চর্য লেগেছে। আপনি তো দরজা এরকম হাট করে খোলা রাখেন না, তাও আবার রাতে! সোজা তো ঢুকে পড়েছি, তবে সত্যি করে বলেছি আপনার শোবার ঘরে ঢুকতে কেউই আমায় আটকায়নি। সব চাকরবাকর বোধহয় খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়েছে। আর আমাদের মতো, ছোটোলোকদের মতো, আপনার তো স্যার আর একটা বউ—থুড়ি—মেমসাহেব নেই যে, যখন তখন আপনার সুখ শান্তির বিঘ্ন করবে! আপনার মেমসাহেবরা আসা—যাওয়ার মধ্যে থাকে। ভীষণ ব্যস্ত! সত্যি, আপনি দেবতা স্যার, দেবতা! অতগুলো পাপীতাপী মেয়েমানুষকে একা তুষ্ট রেখেছেন! সেইজন্যেই কি স্যার আপনাকে এখন এত ক্লান্ত লাগছে? আপনি ভীষণ বোকার মতো হাত—পা ছড়িয়ে মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে আছেন? বিছানাটা লন্ডভন্ড? না কি কাল রাতের পর ওটা পাট করে সাফসুতরো করেননি। আপনার চোখেমুখেও কেমন কালির ছাপ। এ একদম বেমানান। কোথায় আপনাকে হাসিখুশি দেখব ভেবেছিলুম স্যার, স্যার, উঠুন। দেখুন, আমি কে এসেছি! আমি হীরার সোয়ামি, স্যার হীরার সোয়ামি! এই তো… চোখ মেলেছেন…হ্যাঁ—হ্যাঁ, এই যে আমি, আপনার বিছানার পাশে, মেঝেতে। আমরা স্যার নীচু জাত, নীচে থাকাই ভালো—যাক গে, যা বলছিলুম, আপনার বেশি সময় আর নষ্ট করব না। প্রথমেই স্যার আপনাকে সেলাম জানাই, অন্তত এক রাতের জন্যে হলেও আমার বউকে মেমসাহেব বানিয়ে দেওয়ার জন্যে। স্যার, হীরা—হীরুর কপালে এত সুখ জুটেছে! ওই মখমল বিছানায় ও শুয়েছে! আপনার রাজবাড়ির খাবার খেয়েছে! আপনার ধবধবে চকচকে ফরসা বুকে মাথা রেখে শোয়ার সুযোগ পেয়েছে! আপনি কী দয়ালু স্যার, আমাদের মতো নোংরা ছোটোলোকদের ঘেন্না করেন না। হীরার গায়ের রং কালো কুচকুচে বলে ওকে ঘেন্না করেননি। উলটে ‘কালো হীরে’ বলে সোহাগ করেছেন। হ্যাঁ স্যার, ও আমাকে সবই বলেছে। একটুও বাদ দেয়নি। আমাদের মতো গবিরদের জীবনে এ—সুখ কি বারবার আসে? আপনিই বলুন! হীরা তাই কিচ্ছু বাদ দেয়নি, গলায় শাড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার আগে স্যার গান করার মতো সুর করে স—ব বলে গেছে। ও খুব ভালো গাইত, স্যার! কিন্তু আমার মতো আধপেটা খাওয়া সংসারের বউ হয়ে বড়োসাহেবদের বাড়ি দিনরাত্তির ঝি—গিরি করলে কি আর গানের গলা খোলে? কিন্তু কাল রাতের কথা অন্য, স্যার। কাল যে হীরু ভালোমন্দ খেয়েছিল! গান তো গাইবেই!
হীরার খবরটাই আপনাকে দিতে এসেছিলুম, স্যার। ভেবেছিলুম আপনি বকশিশ দেবেন। কী বলছেন…আপনার মন—মেজাজ ভালো নেই! আগেই আপনি খবরটা পেয়েছেন? তা হলে তো আমার বকশিশটাই মার গেল, স্যার। তা যাক। আপনার দয়া আমি কোনোদিন ভুলব না। আমার বউ সাত জন্মে যে—সুখ পেত না, সেই সুখ ওকে আপনি দিয়েছেন— হোক না কেন এক রাতের জন্যে! আমার আধপেটা সংসারকে সিকি—পেট হওয়ার হাত থেকেও বাঁচিয়েছেন। কী বলছেন, স্যার? ঠিক বুঝতে পারলেন? ও, হীরু আপনাকে বলেনি বুঝি ওর পেটে খোকা ছিল! তিন মাসের। বলেনি? হাঃ—হাঃ—হাঃ—দেখেছেন, কী বদমাইশ! বরাবরটা আমার সঙ্গে ওরকম ছেনালি করত। আপনি কি চমকে উঠলেন, স্যার? জানেন, আমিও প্রথম শুনে ওরকম চমকে উঠেছিলুম। কোত্থেকে খাওয়া জোটাব এই নতুন পেটের? আমার দিনমজুরি, আর হীরুর ঝি—গিরি…ওতে কি হয়? আমরা স্যার মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, জন্মরোধের কায়দাকানুন জানি না। তাই গোলমাল যত আমাদেরই হয়। তবে আপনি খুব বাঁচিয়েছেন, স্যার। এখন হীরাও গেছে, বে—আক্কেলে বাচ্চাটাও গেছে। আপনার আশীর্বাদে আমি এখন বোধহয় পুরো পেট খেতে পাব। এ কী, স্যার! এক ঢোকে বোতলের ঘোড়ার লেজ ছুঁয়ে ফেললেন? আমরা যেরকম ঢোক ঢোক জল খেয়ে পেট ভরাই, আপনিও সেরকম স্যার? যত দেখছি, সত্যি অবাক হচ্ছি!
ভালো খবর তো শোনালাম, স্যার। এবার খারাপও একটু আছে, সেটাও বলে ফেলি। তবে আমাকে কোনোরকম দোষ দেবেন না, স্যার। আমি আপনার ভালোই চাই, তাই তো এসেছি। একটা কথা কী জানেন স্যার, কাল রাতের ব্যাপারটায় হীরু বোধহয় তেমন খুশি হয়নি। কী করে হবে! ও যে আমার চেয়েও মুখ্যু, বোকা। ও গান করে করে সবই বলল বটে কিন্তু তারপর পেটে দু—হাত চেপে এমন পাগলের মতো চিৎকার শুরু করল যে, সারা বস্তির লোক একেবারে ছুট্টে এল। ও খালি চিৎকার করে বলছিল স্যার, আপনাকে ছাড়বে না। কিছুতেই ছাড়বে না—আরও কত কী। কিন্তু, সত্যি বলতে কী স্যার, সব শুনে প্রথমটা আমারও যে একটু রাগ হয়নি তা নয়। কিন্তু আমি কী করতে পারি, স্যার। আমার এই হাড় বের করা শরীরে শক্তি নেই, আমার মামলা করার পয়সা নেই, আমার একগাদা জোয়ান বন্ধু নেই। তার ওপর আপনার কাছে তো আবার বন্দুক আছে! তাই পরে নিজেকে সামলে নিয়ে ভেবেছিলুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে। সবই তো ভগমানের হাত। হাজার হোক, বউটা একবারটি অন্তত মেমসাহেবি ঠাটে থেকেছে। কিন্তু হীরু বোধহয় মানতে পারেনি, স্যার। খালি বলছিল রাত এগারোটায় আমার সব্বোনাশ করেছিস, আমিও রাত এগারোটাতেই তোর সব্বোনাশ করব!…শুনলেও হাসি পায়, স্যার। তবে সকালে উঠে ওর ঝোলানো দেহটা যখন নামাই, তখন ওর মুখটা দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিলুম। চোখ দুটো ভাঁটার মতো বেরিয়ে আসছে, মাথার চুলগুলো সব এলো, টুকটুকে জিভটা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে। যেন সাক্ষাৎ মা—কালী! আপনি কপালে হাত ঠেকালেন, স্যার? আপনি ভগমানে বিশ্বাস করেন! সত্যি, আপনি মহান স্যার, আপনি মহান। যাই হোক, সব লোক যখন জানতে চাইল বউটা ম’লো কেন, তখন আমার জন্যে বসে না থেকে ওরা নিজেরাই জবাব দিয়ে দিলে—খিদে, পেটের খিদে। আমি আর মুখ খুলিনি, স্যার। দুনিয়ার সবাই জানে, গরিবরা পেটের জ্বালাতেই মারা যায়।
হীরুকে পুড়িয়ে গঙ্গাচান করে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল, স্যার। পোড়ানোর টাকা তো ছিল না। ওকে ফুটপাথে ফেলে লোকের কাছ থেকে ভিক্ষে করে টাকা তুলতে হয়েছে। বেলা যত বেড়েছে ওর শরীরটা তত ফুলে ফেঁপে উঠেছে, ঝাঁকে ঝাঁকে মাছি ভনভন করতে শুরু করেছে। কিন্তু কী করব, স্যার…কী বলছেন? আপনার কাছে আসতে পারতাম? না, স্যার, ছিঃ, তা হলে আপনার চরিত্রে যে কালি লাগত! সে কি প্রাণ থাকতে আমি করতে পারি? জানেন, স্যার, এখানে আসার আগে দুটো ঘণ্টা আমি মাঠে—ঘাটে বেরিয়েছি। বস্তির ঝোপড়ায় আর ফিরতে পারিনি। মনটা কেমন হু হু করে উঠেছে। হাজার হলেও বউটা আমার খারাপ ছিল না, স্যার। কিন্তু আপনিও তো কম ভালো লোক নন। তাই তো হঠাৎ খেয়াল হওয়ায় ছুটে এলুম আপনার কাছে। আপনাকে সাবধান করতে এগারোটা বোধহয় বেজে এল স্যার। ওই তো! আপনার বসবার ঘরের দামি দেওয়ালঘড়িতে ঢং ঢং শব্দ শুরু হয়েছে। শুনুন স্যার, গুনুন! এক, দুই, তিন, চার জানেন, স্যার, হীরু বলেছিল, ঘরের বাতিগুলো দপ করে নিভে গেলে বুঝবে আমি…গুনুন, গুনুন!…ছয়…সাত…আট….কী হু—হু করে হাওয়া দিচ্ছে, স্যার। জানালা—দরজার পাল্লাগুলো ঠাস ঠাস করে বাড়ি খাচ্ছে—ঝড় উঠল বুঝি?—নয়—দশ— এগারো—এই যাঃ। কী বলছেন স্যার, লোডশেডিং? আপনি এত বড়ো লেখাপড়া—জানা লোক হয়ে এই ভুলটা করলেন, স্যার? দেখছেন না, আশপাশের সবকটা বাড়িতেই আলো জ্বলছে! শুধু আপনার বাড়িতেই—।