2 of 2

আলো-আঁধারির গল্প – সুবর্ণ বসু

আলো-আঁধারির গল্প – সুবর্ণ বসু

শ্যামবাজার বলতেই আজকাল তোমরা বোঝো, আলো ঝলমলে পাঁচমাথার মোড় আর টানটান ল্যাজওয়ালা একখানা ঘোড়ার পিঠে বসা নেতাজির স্ট্যাচু। কিন্তু যে শ্যামবাজারে আমার জন্ম, যে শ্যামবাজারে আমার ছোটবেলাসহ জীবনের প্রথম বিশবছর কাটানো, সেই শ্যামবাজার এরকম ছিল না। সে শ্যামবাজার আজ থেকে আরও সিকিশতক পুরনো। সেই শ্যামবাজারে পাঁচমাথার মোড় থেকে আর জি কর হাসপাতালের দিকে মুখ করে মিনিটদুয়েক হেঁটে এলেই শোনা যেত ভারি অদ্ভুত এক বাজনা। একটি রোগামতো কালো লোক চার্টার্ড ব্যাঙ্কের সামনের সিঁড়িতে বসে বিক্রি করত নানারকম পোকামাকড়ের ওষুধ আর হাতে একটা গোলাকার ডাবলি নিয়ে বাজাত অদ্ভুত সুর। সেই বাজনাই ছিল তার পথচারীদের আকৃষ্ট করার কৌশল। সেখান থেকে বাঁদিকে ঘুরে গেলেই পড়ত ভবনাথ সেন স্ট্রিট, পাল স্ট্রিট, বল্লভ স্ট্রিট নামের সরু—সরু আধো—আলো আধো—অন্ধকার রাস্তা। রাস্তাগুলোর দু—ধারে ছিল পুরনো—পুরনো সব বাড়ি।

প্রায়ান্ধকার বল্লভ স্ট্রিটের শেষ মাথায়, যেখানে রাস্তার আলোটা তেরচাভাবে এসে এক—আধখানা বাড়ির উপর আলো ফেলত, সেখানেই ছিল আমাদের বাড়ি। বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যেত উলটোদিকেই রয়েছে ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের মতো বিশাল বল্লভবাড়ি। বল্লভদের নামেই রাস্তার নাম। কলকাতার আদিযুগের বিশাল ধনী বল্লভরা সেখানে আর কেউ থাকত না সেভাবে। বেশি অংশেই বাড়িটা পোড়ো, কোনো কোনো অংশ গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হত। বাড়ির সামনের ঝোপঝাড় পেরিয়ে আমাদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখিই ছিল পঞ্চানন মজুমদারের কাঠগোলা। সন্ধের পর কালো কাঠের তৈরি বিশাল কাঠগোলাটাও কেমন ভৌতিক চেহারা নিত। বারান্দায় দাঁড়ালে দেখতে পেতাম বল্লভ স্ট্রিটের সামনের রাস্তাটা পেরোলেই বয়ে যাচ্ছে বিশাল খাল, তার পাড়ে গিজগিজে বস্তি। ময়লা, ছেঁড়া জামাকাপড় পরা কালো—কালো বাচ্চা ছেলেপুলেরা খেলে বেড়াত সারাদিন। তাদের পরিবারের পুরুষরা কেউ বাজারে মাছ বেচে, কেউ ঠেলা বা সাইকেল ভ্যান চালায়, কেউ বা জোগাড়ের কাজ করে। পরিবারের মেয়েরা ঠিকে ঝির কাজ করে বাড়ি—বাড়ি। মোটামুটি এই ছিল আমাদের সেই সময়ের পাড়ার চেহারা।

দু—যুগেরও বেশি আগের সেই সময়টা আলাদা ছিল অনেকটাই। তখন লোডশেডিং হত প্রায়ই, কেবল ফল্ট হলে তো অনেক সময় সারারাতও কেটেছে আলো—পাখাহীন। লোডশেডিং হলে আমাদের পাড়া হয়ে উঠত আরও রহস্যময়। সামনের দিকের দেড়খানা বাড়ির উপর এসে পড়া তেরচা সোডিয়ামের আলো বাদ দিলে বাকি পাড়া ডুবে যেত নিঝুম অন্ধকারে।

বাড়ির মধ্যে লোডশেডিং হলেই বেরোত কাচ ঢাকা কেরোসিনের লম্ফ আর মোমবাতি। বড়ো ঘরে আর দাওয়ায় জ্বলত দুটো বড়ো লম্ফ, বাকি সব ঘরে মোমবাতি। সেই আলো—আঁধারিতে ঠাম্মার খাটে চাদরমুড়ি দিয়ে ঝুব্বুস হয়ে বসে ভূতের গল্প শুনতাম আমি, আমার দাদা, দিদিভাই। সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা ছিল, কেউ যাওয়া—আসা করুক—না—করুক, সিঁড়িতেও দেওয়া হত ছোট্ট একটা লম্ফ। আমরা ছোটোরা কারণ জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাওয়া হত। বুঝতাম সিঁড়িতে কিছু রহস্য আছে। ছুটির দুপুরগুলোয় সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি আর আমার দাদা সিঁড়িতে খেলতাম, কিন্তু বিশেষ করে শনি—মঙ্গল বারেই আমাদের দুপুরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। সিঁড়িতে খেলতে দেওয়া হত না। ঠাম্মা ছিলেন খুব চাপা স্বভাবের, প্রচণ্ড ধার্মিক, কড়া ধাতের মানুষ। অনেকদিন জিজ্ঞেস করায় একদিন গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, ‘সিঁড়িতে অন্ধকারে একটা বাচ্চা ছেলে খেলা করত, কেউ কাছে গেলেই বাতাসে মিলিয়ে যেত। রোজা ডেকে তাকে বেঁধে রাখতে হয়েছে… তবু ওই সিঁড়িতে শনি—মঙ্গলবার কেউ পড়ে গেলেই তার জ্বর আসে, সহজে ছাড়তে চায় না…’ আমরা আর ও বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করিনি।

তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমাদের বাড়িতে কাজ করত মলিনা বলে একটি মাঝবয়সি বউ। আমাদের পাড়ার আরও দু—পাঁচটা বাড়িতে কাজ করত ও। থাকত খালধারের ঝুপড়িতে। আমরা বলতাম মলিনাদি। তাকে নিয়েই আমাদের পাড়া উত্তাল হয়ে উঠল সেবার। ওর সমস্যাটা শুরু হয়েছিল অম্বলের ব্যথা আর বুকজ্বালা দিয়ে। আমাদের বাড়ি তিনদিন কাজে এল না ও। ঠাম্মা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্য বউ—ঝিদের থেকে মলিনার খোঁজ নিল। জানা গেল মলিনার বুকে অম্বলের জ্বালা আর কমছে না। ওর বর আর জি করের আউটডোরে নিয়ে গিয়ে মলিনাকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে, বহু ওষুধ খাইয়েছে, কোনো কাজ হচ্ছে না। ঠাম্মা সব শুনলেন। তারপর মলিনা কাজ করতে এল। তখন ঠাম্মা বাইরের ঘরে বসেছিলেন। আমরা এদিক—ওদিক খেলছিলাম… দেখলাম মলিনাদি কেমন চোরের মতো ঢুকল। ঠাম্মা ওর শরীরস্বাস্থ্য সম্বন্ধে খোঁজখবর নিলেন। মলিনাদি মাটির দিকে তাকিয়ে সব উত্তর দিচ্ছিল আর বেশ ছটফট করছিল, যেন ঠাম্মার সামনে থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। ঠাম্মা খুব তীক্ষ্ন চোখে দেখছিলেন মলিনাদিকে। সারাদিনই যেন ওর হাবভাব আমাদের কেমন চোখে লাগছিল। বাসন মাজতে—মাজতে সেদিন আবার ভাঙা—ভাঙা গলায় গানও গাইছিল মলিনাদি। আগে কখনো মলিনাদিকে আমরা গান গাইতে শুনিনি। সেদিন সন্ধেবেলায় সেজোজেঠু বাজার করে টাটকা তেলাপিয়া মাছ এনে একটা বড়ো কাঁসিতে ঢেলে রেখে রান্নাঘরের বাইরের কলে বসে ধুচ্ছিল। রাত্তিরে রান্না হবে। রান্নাঘরের ভিতরে মাজা বাসন জল ঝরিয়ে তাকে গুছিয়ে রাখছিল মলিনাদি। মাছগুলো ধুয়ে ছাড়ানোর জন্য জেঠু বঁটি আনতে উঠেছিল। বঁটি নিয়ে এসেই চিৎকার, ‘এ কী ষোলোটা মাছ ছিল, দুটো কমে গেল কী করে?’ মলিনাদি অমনই পাশ থেকে ‘ওই হুলো বেড়ালটা এখান দিয়ে ছাদের দিকে উঠেছিল সেজদা…’ বলেই দৌড়ে ছাদে উঠে গেল।

আমরা সবাই এসে জড়ো হলাম ছাদে ওঠার সিঁড়ির মুখে। খানিক পরে দুটো মাছের দেহের মাঝখানের কাঁটা হাতে নিয়ে নেমে এসে বলল, ‘হুলোটা খেয়ে গেছে সেজদাবাবু…’

সবার পিছনে যে ঠাম্মা এসে দাঁড়িয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। খেয়াল হল তাঁর গলা শুনে।

‘এইটুকু সময়ের মধ্যে দুটো মাছ খেয়ে ফেলল! আর তুইই বা কাঁটাদুটো হাতে করে আনলি কেন? তোর মুখে কী লেগে রে মলিনা?’ ঠাম্মার গলা রীতিমতো থমথমে। মলিনাদি চট করে মুখ লুকিয়ে সরসর করে আমাদের পাশ দিয়ে নেমে চলে গেল।

‘তোর বুকের জ্বালা কমেছে… হ্যাঁ রে মলিনা?’ গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন ঠাম্মা। চলে যেতে—যেতেই মলিনা বলল, ‘না… আছে একটু…’

‘ও জ্বালা আর কমবেও না… হ্যাঁ রে… তোরা কেউ মলিনার বরকে চিনিস? একবার ডাকিস তো… বলবি আমি ডেকেছি…’ বলতে—বলতে ঘরে ঢুকে গেলেন ঠাম্মা। ততক্ষণে মলিনা চলে গেছে।

মলিনাদির বরের নাম ফটিক। সে পরদিন সকালেই এসে দেখা করে ঠাম্মার সঙ্গে। ঠাম্মা বলে, ‘ফটিক, তোর বউয়ের বুকের জ্বালাটার কী খবর?’

‘কমেনি আজ্ঞে… আজ তিনদিন হাসপাতালের ওষুধ খেল, কাজ হয়নি, হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বলেছে বিকেলবেলা নিয়ে যেতে, না কমলে ইঞ্জেকশন দেবে…’

‘আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে ফটিক, বিকেলে হাসপাতালে নিয়ে যাস, কিন্তু তারপর বাগবাজারের রেললাইনের ধারের হারুকে চিনিস? বাজারে মাছ বেচে? ওর বউ মতিকে আমার নাম করে একবার ডেকে আনতে পারবি? তোর বউটার হাওয়া—বাতাস লেগেছে মনে হচ্ছে।’

‘পারব বড়মা।’

‘তোর সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে মলিনাকে বলার দরকার নেই।’

‘আচ্ছা…’

সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরতে দেরি হয়ে যাওয়ায় হারু মাছওয়ালার বউকে আর ডাকতে যাওয়া হল না ফটিকের। তবে পরদিন ঠিকই কাজ করতে এল মলিনা। সারাদিন কাজকম্ম করল। সন্ধে নামার পর আমি খেলে ফিরে একটা নতুন রবারের বল নিয়ে ড্রপ খাওয়াচ্ছিলাম। ঠাম্মা ঘরে ঘরে ধূপ দেখাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই ধমকে বললেন, ‘অ্যাই! ভরসন্ধেয় খেলে বেড়াচ্ছিস কেন? পড়াশোনা নেই?’

‘এই তো ঠাম্মা যাচ্ছি…’ বলেই বলটা পকেটে পুরে ফেললাম আমি।

‘দাঁড়া… অমাবস্যা পড়ে গেছে… জেঠিমার ঘরে বোস, একা ঘুরিস না।

আমি মেজোজেঠিমার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। মেজোজেঠিমা কী একটা বই পড়ছিলেন। বললেন, ‘আয় বোস…’

সারা বিকেল সাঁতার কেটে, খেলে এসে আমার খুব ক্লান্তি লাগছিল। আমি মেজোজেঠিমার ঘরে ঢোকার আগেই কলতলায় গিয়ে হাতে—মুখে জল দিয়ে এলুম। তারপর শুয়ে পড়লাম মেজোজেঠিমার খাটে। ভরসন্ধেয় শুতে দেখলে ঠাম্মা ফের বকত। কিন্তু এ ঘরে ধূপ দেখানো হয়ে গেছে। চট করে আর আসবে না। আশপাশের বাড়িতে শাঁখ বাজছে। ধূপ—ধুনোর মিষ্টি গন্ধে চোখ জুড়ে এল আমার।

সেই আধো তন্দ্রার মধ্যেই যে কখন একটা অন্যরকমের কড়া অথচ মিষ্টি গন্ধ আমাকে ঘুম থেকে আচ্ছন্নতার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছিল টেরই পেলাম না। তন্দ্রা ভাঙল ঠাম্মার বাজখাঁই চিৎকারে, ‘অ্যা—আ—ই অলুক্ষুণে মেয়েছেলে… সরে যা বলছি…’

ধড়মড় করে উঠে দেখি খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আমার ওপর মুখ ঝুঁকিয়ে রয়েছে মলিনাদি। মুখে অদ্ভুত এক হাসি, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, ঠোঁটের কষে লালা। আমি আঁতকে উঠলাম। যেন চেনা মলিনাদির মুখ এটা নয়। এ যেন অন্য কেউ।

ঠাম্মা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে এসে খপ করে চুলের মুঠি ধরেছে মলিনাদির, ‘বেরো বলছি, বেরো… সর্বনাশ করবার তাল বের করছি আটকুঁড়ির বেটির…’

মলিনাদি চুল সামলাতে—সামলাতে ঘর থেকে বেরিয়ে দে ছুট। ঠাম্মা বারান্দায় চিৎকার করতে লাগল, ‘ওরে কে আছিস, এখুনি ফটিক হারামজাদাকে বাগবাজারে পাঠা… নইলে আর রক্ষে নেই…’

আমাকে একা রেখে যাওয়ার জন্য মুণ্ডুপাত হল মেজোজেঠিমার। মেজোজেঠিমা আমতা—আমতা করে বললেন, ‘বড়দি ডাকল শুনলাম, বড়দির ঘরে গিয়ে শুনি কেউ ডাকেনি, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসেই এই কাণ্ড…’

ঠাম্মা গজগজ করতে লাগলেন।

ঘণ্টাখানেক পরই ফটিকের চিৎকার শুনে ফের বারান্দায় গেল ঠাম্মা, ‘ও বড়মা, মলিনাকে সামলানো যাচ্ছে নে, গান গাইছে, গাছে উঠছে, আরও কী—কী সব করছে… আমি বাগবাজারে চললুম…’

খানিক পরেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছিল আমার। ঠাম্মা আমার মাথায় হাত রেখে বসেছিল অনেকক্ষণ। ঠাম্মার ধবধবে কাচা কাপড়ের গন্ধ, জর্দাপানের গন্ধ, হাতের ধূপধুনো, ফুল—বেলপাতার গন্ধ নিতে—নিতে ফের ঘুম এসে গেল আমার। স্বপ্নে দেখলাম বিরাট এক কালো নিথর ঠান্ডা দিঘি। আমার সমস্ত উত্তাপ যেন নেমে যেতে লাগল ঘুমের মধ্যেই।

পরদিন ভোরে উঠে দেখি জ্বর নেই। শুনলাম কাল রাতে আমার কাছে গোটা বাড়ির লোকজনকে বসিয়ে রেখে ফটিক আর সেই হারু মেছোর বউকে নিয়ে ঠাম্মা গেছিল মলিনাদিদের ঝুপড়িতে। সেই গল্প বাড়ির—পাড়ার সকলের মুখে—মুখে…

সেইসময় মলিনাদির ঘরে মলিনাদি ঘুমিয়ে ছিল। বাগবাজারের মতি এবং ফটিককে নিয়ে ঠাম্মা ঢুকতেও কোনো পরিবর্তন হল না মলিনাদির। মতি বলল, ‘কিছু বুঝতে পারছি না তো, ও তো শান্তই আছে বেশ…’

ঠাম্মা বলল, ‘তোমাকে দেখে ও ভান করছে… একবার ওর গায়ে হাত দাও না বউ!’

মতি ঘুমন্ত মলিনাদির দিকে হাত বাড়িয়েছে সবে, এমন সময় এক বিকট জান্তব চিৎকার করে উঠে বসে মলিনাদি। হাঁ করে কামড়াতে আসে মতিকে।

চমকে পিছিয়ে এসে মতি, তারপর বলে, ‘বুঝেছি…. আমাকে একটু জল এনে দাও তো কেউ।’

তারপর সেই জল পড়ে পড়ে ছিটিয়ে দেয় মতি আর আর্তনাদ করতে শুরু করে মলিনাদি। মতি জিজ্ঞেস করে, ‘কে তুই?’

‘আমার নাম দিয়েছ তোমরা যে নাম বলব? আমার নাম নেই!’ ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলে মলিনাদি। মতি অবাক হয়ে যায়। তারপর কী ভেবে ফটিককে বলে, ‘নাম রাখার আগে কোনো বাচ্চা মারা গেছে কিছুদিনের মধ্যে তোমাদের আশপাশে?’

জানা গেল, কয়েক ঝুপড়ি পরেই নমিতা নামে একজন মৃত বাচ্চা প্রসব করেছিল। নমিতার শরীরের অবস্থাও খুব খারাপ হওয়ায় বাচ্চাটিকে না ভাসিয়েই নমিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মৃত শিশুটিকে রাতে কাপড় জড়িয়ে কোনো এক গাছের তলায় রাখা হয়েছিল দিনের আলো ফোটার অপেক্ষায়। ঘটনাচক্রে খালধারের ঢাল বরাবর যে গাছের তলায় শিশুটিকে রাখা হয়েছিল, সেই গাছটির পাশেই মলিনা প্রাকৃতিক কর্ম সারে। তারপর থেকেই বিপত্তি।

মতি আর কিছু করে না। বলে, ‘আজ ওকে চোখে—চোখে রাখো, অমাবস্যা থাকতে আমি কিছু করব না। তা ছাড়া আমার বাড়িতেও ছেলেপুলে আছে, বাড়ি বেঁধে আসা হয়নি। আমি কাল আসব। আজ কেউ একে চোখের আড়াল কোরো না। রাত্তিরে বাইরে যাওয়ার দরকার হলেও সঙ্গে যেন কেউ থাকে, সকলে সজাগ থেকো…’

সে রাতে আর কিছু হল না। সারা সকাল আমাদের পাড়ায় একটা আলোচনা, কী হবে সন্ধেবেলা? সারাদিন আমরা উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটালাম। সে বড়ো আলোছায়ার সময়। এখন চারদিকে এত বেশি আলো যে, ছায়ারা কোথায় হারিয়ে গেছে। ভারসাম্যের অভাব বড্ড। ছায়া নেই বলে রহস্যও নেই। রহস্যের অস্তিত্বে বিশ্বাসটাও যেন ফিকে হয়ে আসছে আস্তে—আস্তে। আমরা ভুলে গেছি, সজাগ থাকার জন্য মাঝে মাঝে অন্ধকারটুকুরও বড্ড দরকার হয়।

সেদিন দিনের বেলা থেকেই পাড়ার পরিবেশ থমথমে। গড়িয়ে—গড়িয়ে দিনটা কাটার পরই যেন হঠাৎ সন্ধে নামল ঝুপ করে। যথাসময়ে দেখলাম ফটিক আর গুণিনবউ মতি আমাদের পাড়া দিয়ে যাচ্ছে মলিনাদির ঝুপড়ির দিকে। বেশ ছোটোখাটো ভিড় জমে গেছে চারদিকে। মতি ধমকে সবাইকে সরে যেতে বলল। তারপর ওদের ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা। ঠাম্মাও আমাদের সবাইকে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিল। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে মলিনাদির কান—ফাটানো চিৎকার ভেসে এসে রক্ত জল করে দিচ্ছিল আমাদের। আমি ভয়ে জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম ঠাম্মাকে। মনে হয়েছিল ফের জ্বর এসে যাবে।

পরদিন লোকের মুখে শুনলাম মতির মন্তর আর সর্ষেপড়ায় ভূত পালিয়েছে। ঘণ্টাখানেকের প্রবল দড়িটানাটানির শেষে হার মানে মলিনাদি। জলভরতি কাঁসার ঘটি দাঁতে করে রাস্তা পার হয়েই নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। মতি বলেছে, আর ভয় নেই।

কতবছর হয়ে গেল তারপর। শ্যামবাজারের বাড়ি ছেড়ে আমরা চলে এলাম পূর্ব কলকাতায়। আজও যেন চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই সেই আলো—আঁধারি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে মলিনাদি, নির্জনতার সুযোগে ঝুঁকে পড়ছে ঘুমন্ত আমার মুখের ওপর, ঠাম্মার চিৎকারে আঁতকে জেগে উঠছি আমি। ভাবি, ঠাম্মা না থাকলে কী হত সেদিন! মলিনাদির বুকের জ্বালা কমত না কোনোদিন, বড়ো কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারত আমাদেরও। ধবধবে সাদা থান পরা ঠাম্মার ছবি চোখে ভেসে উঠলেই মনে হয় ঠাম্মার শরীর ছিল আলো দিয়ে গড়া, তিনি অন্ধকার থেকে আমাদের বাঁচাতে পারতেন। এখন সেরকম আলোর মানুষ আর নেই। চোখ—ধাঁধানো বহু কৃত্রিম আলোর জৌলুসে সমস্ত রহস্য নিয়ে হারিয়ে গেছে আমার সেই আলো—আঁধারির ছোটোবেলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *