আলো অন্ধকার

আলো অন্ধকার

এক একটা দিন ভোলা যায় না। জীবনে সেই সব দিন যেন নোঙর করা নৌকোর মতো স্মৃতির ভারে দুলতে থাকে। একটু দেরি হল অফিস পৌঁছোতে। আজকাল আর সময়কে কোনো কিছুতেই মাপা যায় না। সময়ের হিসেবে স্থানের দূরত্ব যেন বেড়েই চলেছে। একই যানবাহনে একই জায়গা থেকে আগে যে সময়ে ডালহাউসি পৌঁছোতুম এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। এর একাধিক কারণ। আমরা যে অঞ্চলে রয়েছি সেখান থেকে অনিবার্য কারণে অনেক সুযোগ-সুবিধেই ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে। একটা বড়ো বা প্রধান বাসরুট উঠে গেছে। অন্যান্য বাসের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। দুধ পাওয়া যায় না। পোস্ট অফিস নেই। বাজারের অবস্থাও খারাপ। জিনিসপত্রের চালান নেই। স্কুল, কলেজ অনিয়মিত। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নেই বললেই চলে, গৃহের গন্ডীতে অন্তরীণ। আজকাল দেরিতে অফিস পৌঁছোলে কেউ কিছু মনে করে না। কারণ সব কিছুই অনিশ্চিত। সকলেরই এক অবস্থা। বলতে গেলে—‘ফাদার উই আর অন দি সেম বোট’।

অফিস পৌঁছে আজকাল আর প্রস্তুতির সময় পাওয়া যায় না। ঢুকেই কাজ নিয়ে বসতে হয়। কোনো কোনো দিন এক ঘর ‘ভিজিটার’ নানা সমস্যা নিয়ে মুখিয়ে বসে থাকে। পোর্টফোলিও এক কোণে ফেলেই কাজের স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দিতে হয়। এর মাঝে একমাত্র ‘রিলিফ’—মলয় এক কাপ চা যখন দিয়ে যায়। চুমুকে চুমুকে চা খেতে খেতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকানো পনেরো কুড়ি মিনিটের জন্যে অন্য জগতে, কল্পনার জগতে মুক্তি। টেলিফোন বেজে উঠল। চায়ের সময় ফোন বড়ো বিরক্তিকর। তবুও রিসিভার তুলতে হল। ও প্রান্তে কাবেরী। কী হল! এই তো মাত্র দু-ঘণ্টা আগে তাকে ছেড়ে এলাম। ‘কী হল কাবেরী। একটু তাড়াতাড়ি চলে আসব। আচ্ছা, তুমি যদি এই রকম কর, কাজকর্ম কী করে করব! লোকে আমাকে স্ত্রৈণ বলবে যে। আচ্ছা আজকের দিনটা। বেশ তাই হবে। কিন্তু নট বিফোর ফোর।’

একটা জরুরি ডেসপ্যাচ ছিল। তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললুম। দুটো নোট পাঠিয়ে দিলুম বড়কর্তার ঘরে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এলেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটির বয়স বেশি নয়। এমন করুণ চেহারা যে দেখলেই মায়া হয়। ভদ্রলোক বছরখানেক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বিপর্যয়। এখন মেয়েকে কোনো হাতের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করতে চান। মনে যে ঝড় বইছে তা তো আর কমানো যাবে না, এখন দেহটাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু আন্তরিক ব্যবস্থাপত্র দিলেও, কাজ কী হবে বলা শক্ত। কিন্তু বৃদ্ধ খুশি হয়ে চলে গেলেন। আশা এমন জিনিস, কিছু একটা হতে পারে এই চিন্তায় তিনি হয়তো কয়েক দিন স্বপ্ন দেখে কাটিয়ে দেবেন।

কাবেরীকে কথা দিয়েছি—একটু আগে বেরোবো। সুতরাং কাজ সারতে হবে চটপট। এর পর সামান্য কিছু কেনাকাটাও আছে। আমার সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটের আকর্ষণ প্রকৃতই অসাধারণ। সাজানো-গোছানো ছিমছাম। কাবেরীর শিল্পী মনের ছাপ সর্বত্র। পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, টেবলক্লথ, সোফা সেটের ঢাকা সব এক রঙের। পালিশ-করা অল্পস্বল্প ফার্নিচার। জাপানি কায়দায় ফুল সাজানো। দেয়ালের কয়েকটি নির্বাচিত জায়গায় কাবেরীর নিজের আঁকা, জল তেল রঙের বিভিন্ন স্টাডি। আমার নিজের সংগ্রহশালার কিছু কিছু ছবি। শিল্পসমালোচক হিসেবে আমার নিজের সংগ্রহও বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। এই ছবি দিয়েই আমাদের পরিচয়ের শুরু। অ্যাকাডেমিতে কাবেরীর একক চিত্রপ্রদর্শনীতে আমাদের প্রথম আলাপ। শেষ আমার ফ্ল্যাটে। নির্ঝট, নির্বিবাদী মানুষ শিল্পী না হলেও শিল্পসত্তা একটা আছে, স্ত্রী একজন রুচিসম্পন্না প্রকৃতই যশস্বী শিল্পী। যোগাযোগ অদ্ভুত। ভাগ্য দেখে হিংসে করলে কিছু করার নেই। সবই ভবিতব্য। তবে আমি এইটুকুই জেনেছি, জীবন থেকে এই পাঠই নিতে পেরেছি—সুখ আর দুঃখ চাকায় বাঁধা, জীবনে ঘুরে ঘরে আসে। উৎফুল্ল হবার কিছুই নেই। একটা মুক্ত অনাসক্ত মন নিয়ে চলতে হবে।

সাড়ে তিনটে হল। এবার বেরোতে হবে। দিনের কাজ শেষ। কয়েক দিন দেখছি কাবেরী সঙ্গ চাইছে। ভীষণ ‘মুডি’ মেয়ে। যখন ছবি নিয়ে থাকে তখন তার সেই জগতে আমার প্রবেশ নেই। আবার হঠাৎ হয়তো ডেকে নেবে। ‘দেখ তো কেমন হচ্ছে—সমালোচক মশাই’। ইজেলের ধারে দাঁড়ানো তার দীর্ঘ শরীর, হাতে তুলি, রঙিন শাড়ি, তেলহীন অবিন্যস্ত চুলের ঢল পিঠে ভেঙে পড়েছে—সে তখন নিজেই একটা ছবি। কাকে দেখব? ক্যানভাসের ছবি, না জীবন্ত ছবি। তখন স্বভাবতই একটু অন্যরকম আবেগ মনের মধ্যে টগবগ করে ওঠে। দু-জনের নিভৃত সংসারে, স্থান, কাল পাত্রের তো কোনো বাধা নেই। কাবেরী হয়তো একটু মৃদু আপত্তি জানায়। সে আর কিছুই নয় ব্যাপারটাকে আরও একটু আকর্ষণীয়, উদ্বেল করে তোলা। আমি তখন বলতে চাই—‘দিস ইস লাইফ মাই ডিয়ার লেডি’। তখন সেই অফিস অথবা জীবনসংগ্রাম কিংবা শহরজীবনের কাটাকাটি হানাহানি, অথবা রাজনীতি ইত্যাদি অনেক দূরে। যেন সমুদ্রের গর্জন। কানে আসছে কিন্তু যেহেতু জলে নামি নি সেইহেতু যেন একটা অন্য স্বাদ। সব মিলিয়ে জীবন।

আজকাল ট্যাক্সি কিংবা অফিসের গাড়ি পাড়ায় ঢুকতে চায় না। মানুষের নিরাপত্তা ক্রমশই কমছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন জঙ্গল এখন শহরের চেয়ে অনেক নিরাপদ। বাঘ অথবা হিংস্র অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের গতিবিধি অথবা আচার-আচরণের একটা বাঁধা নিয়ম আছে, কিন্তু মানুষের চাল-চলনের নাকি আজকাল কোনো ঠিক নেই। সেই গল্পের সিংহ যে উপকারীর উপকার মনে রেখেছিল। ‘এরেনার’ সমস্ত মানুষ রুদ্ধনিশ্বাস। বন্দি আর ক্ষুধার্ত সিংহ মুখোমুখি। সিংহ বন্দীর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল। কারণ একদা এই বন্দিই তার পা থেকে কাঁটা বের করে দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ! বিদ্যাসাগর মশাই বলেছিলেন—‘অমুকে আমার সম্বন্ধে যা তা বলছে কেন, কই আমি তো তার কোনো উপকার করেছি বলে মনে পড়ছে না।’ যুগ তো পালটায় নি। মানুষের স্বভাব সেই একই আছে।

নিউ মার্কেট থেকেই পর্দার কাপড় কিছু কিনে নি। একটা বাথ টাওয়েল। আর একটা বিলিতি সেন্ট। কাবেরীকে একটু ‘সারপ্রাইজ’ দিয়ে দেব। কেনাকাটা সাধারণত বিনা দর-দস্তুরে হয় না। ভারতবর্ষে একটা জিনিসের ঠিক কী দাম, বোঝবার উপায় নেই। মুনাফার পরিমাণ কত কেউ বলতে পারবে না। বিক্রেতাদের মেজাজ অত্যন্ত চড়া পর্দায় বাঁধা। বেশি কথা বলারও উপায় নেই।

কেনাকাটা শেষে একবার ট্যাক্সির চেষ্টা করে দেখতে ইচ্ছে হল যদি পেয়ে যাই। দুটো ট্যাক্সি ফ্ল্যাগ ডাউন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে গেল। আমার মতো যাত্রীর আবেদন অথবা অনুরোধ শোনার কোনো ইচ্ছেই দেখা গেল না। একজন থামলেন কিন্তু তিনি আমি যেদিকে যেতে চাই তার উলটোদিকে ছাড়া যাবেন না। আর একজন বললেন তিনি খাওয়া-দাওয়া না করে এক পাও নড়বেন না এবং সেই আহারপর্ব কখন কোথায় শেষ হবে তিনি জানেন না। এরপর ট্যাক্সি করে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হল। যদিও সেই সপ্তাহ ছিল ট্যাক্সি চালকদের সৌজন্য সপ্তাহ।

চৌরঙ্গির মোড়ে তখন জমজমাট অবস্থা। চারদিক থেকে পতাকাধারী মানুষের মিছিল একের পর এক আসছে। কোনো যানবাহনই চলার রাস্তা পাচ্ছে না। এই শতকের মানুষ প্রায়শই সমস্যাগুলোকে দার্শনিকের চোখে দেখে থাকেন। কোনো কিছুই আর তেমন করে মনে দাগ কাটে না। মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে না। অন্য সময় হলে আমিও এতটা ছটফট করতুম না, বাড়ি যাবার জন্যে। কাবেরী এখন এই সময়টা আমার একটু সঙ্গ চায়। আমার অভিজ্ঞতা কম কিন্তু শুনেছি মেয়েদের এই সময়টায় নানারকম মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। বলতে পারে না মুখ ফুটে । শরীর অপটু হয়, মনের মধ্যে সাগরের ঢেউ আছড়া-আছড়ি করে। বাড়িতে মা, অথবা বর্ষীয়ান কোন মহিলা থাকলে এই সময়, ঠিক এই সময়ে হয়তো অনেক সাহায্যে আসতেন। অন্য সময় হলে এই ভীষণ বিভ্রান্তিকর অবস্থা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতুম। কোনো একটা সিনেমার যেকোনো মূল্যের একটা টিকিট কেটে ঢুকে বসে থাকতুম। ইতিমধ্যে মিছিলের মানুষ জমে-থাকা অসংখ্য যানবাহন ঘরমুখো মানুষ সময়ের ভেলায় চেপে এই কেন্দ্রস্থ রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে যে যার দিকে চলে যেত। হয়তো বাস, ট্রাম অথবা অন্যান্য যানবাহন বন্ধ হয়ে যেত। বেশি রাতে হয় হেঁটে না হয় ভাগের ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরে যেতুম।

হঠাৎ একটা প্রায়খালি আমার রুটের গাড়ি মোড় ঘুরছে দেখে অনেকটা জীবনের মায়া ছেড়েই লাফিয়ে উঠে পড়লাম এবং একটা বসার জায়গাও পাওয়া গেল। এই সব ছোটোখাটো ঝুঁকি অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতে হয় অথচ এর থেকে যেকোনো মুহূর্তে বড়োরকমের বিপদ ঘটতে পারে। অবশ্য জীবন মানেই ঝুঁকি। এর পর গাড়ি চলবে শম্বুক গতিতে। জ্যামে আটকাবে। কয়েকবার রাস্তা পালটাবে। আকন্ঠ মানুষ বোঝাই করবে। যেখানে খুশি থামবে। টিকিটের পয়সা নিয়ে ঝগড়া হবে। যাত্রীদের মধ্যে ফাটাফাটি হবে। এ এক চলমান রঙ্গমঞ্চ। এরই মধ্যে চোখ বুজিয়ে বসে থাকা। ঝিমুনি আসতে পারে। কখনো বিরক্ত হয়ে নেমে যাবার ইচ্ছে হতে পারে। অবশেষে নিজের গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি। কিন্তু আজ আর গন্তব্যে পৌঁছোনো গেল না। তার আগেই যাত্রাশেষ। বাস যাবে না। নেমে যান। কে একজন ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে বলল—সামনেই মার্ডার হয়েছে। ভারী লিডার ছিল। অনেক আতঙ্কগ্রস্ত কন্ঠের সমবেত প্রশ্ন—কে, কে, কি নাম? হেঁটে যাওয়া যাবে তো ভাই সামনে। এসব প্রশ্নের তো কোনো উত্তর নেই। সকলেই পালাতে চাইছে।

প্যাকেট ইত্যাদি নিয়ে নেমে পড়তে হল। এসব ঘটনা এই শহরজীবনে বেশ গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমি তো মরি নি, এখনও বেঁচে আছি, অতএব ভাববার কী আছে। জীবনটাকে একটা মোড়কের মতো করে সাবধানে বাড়ি অবধি নিয়ে যেতে হবে। হয়তো কোনো সময় ফসকে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সেই হারাবার মুহূর্তে সাময়িক একটা আপশোস, খুব অল্প সময়ের জন্যে। কেউ কেউ অবশ্য হারাতে হারাতেও ফিরে পেয়ে যেতে পারেন। সে এক ভীষণ অভিজ্ঞতা।

কিন্তু যতই এগোচ্ছি রাস্তা নির্জন থমথমে, সমস্ত দোকান বন্ধ। এখনও দিনের আলো নেভে নি। দিন আর রাত্রির সন্ধিক্ষণ। ঘটনার কেন্দ্রস্থল থেকে সকলেই যেন দূরে চলে যেতে চাইছে। ভীত পশুর মতো। জানি জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। সামনে হয়তো কিছু দূরে মানুষেরই কোনো প্রতিনিধি, ধুলোয়, রক্তে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সেই মৃত্যুর জন্যে কোনো শোক নেই, কোনো করুণা নেই, কারণ আমরা এখন প্রকৃতই দার্শনিক। সেই মৃত্যুর জন্যে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করাও উচিত নয়। প্রশ্ন—আমার নিরাপত্তা আছে কিনা। আমি ওই পথ দিয়ে সোজা, অক্ষত আমার সাজানো সুন্দর ফ্ল্যাটে পৌঁছোতে পারব কিনা, যেখানে আমার জীবনের অনেক নরম মুহূর্ত আমার অপেক্ষায় রয়েছে।

একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিয়ে, কাঁপা কাঁপা দুরুদুরু বুকে যতটা সম্ভব দ্রুত স্থানত্যাগ। একটা টাটকা মৃত্যু। দৃশ্যটা অসহনীয়। মাত্র পনেরো-কুড়ি মিনিট আগের ঘটনা। স্থান জনশূন্য। সকলেই নিজের নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত। সকলেই স্থানত্যাগ করেছে। আমিও করছি। এ ছাড়া কী করার আছে! পশু হলে হয়তো মৃতদেহের পাশে এসে শুঁকে দেখতুম, বিলাপ করতুম। চকাচকী পাখির গল্প শুনেছি। কাকের মৃত্যুও দেখেছি। মানুষ আজকাল পথে-ঘাটে নি:সঙ্গ মরে। মৃত্যুর আর যেন সেই গ্ল্যামার নেই।

সেই নির্জন রাস্তায় হঠাৎ কিছু চরিত্রের আবির্ভাব হল। চার-পাঁচটি ছেলে, প্রত্যেকেরই দু-হাতে গোলাকার পদার্থ। মৃতদেহের কাছাকাছি এসে, একটা গলির মধ্যে, সেই বিস্ফোরক দু-একটা ছুঁড়ে দিল। আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার শবদেহের উপর দিয়েই চলে যেতে চাইবে। কিন্তু আমাকে তারা উপেক্ষা করল। আমার শরীর একটু ঘর্মাক্ত হল। আমার গতি দ্রুত হল। আমার কন্ঠতালু শুষ্ক হল। এখন কী কোনো রিকশা পাওয়া যাবে? আমার পথের সঙ্গী? কোথায় কী, পথ জনশূন্য। যতদূর দৃষ্টি চলে, সরীসৃপ রাস্তা প্রসারিত। সেই প্রসারিত রাস্তায়, মৃত্যুকে সঙ্গী করে আমি যেন কত যুগ ধরে চলেছি। অবশেষে পৌঁছেছি আমার সেই কোমল, কমনীয় গৃহের গন্ডীতে।

কাবেরী উৎকন্ঠিত—। ‘তুমি আসছ না কেন?’ ‘আমি ভাবছি। চারটে বলেছিলে। তারপর কি গোলমাল এই দিকে। তুমি এসেছ।’ কাবেরী আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আরও কী সব করে ফেলল আবেগের মুহূর্তে। একবার মনে হল সেই পথের চার মোহনায় যে পড়ে আছে, তাঁরও জন্যে হয়তো এমনি কেউ জানালার গরাদে মাথা রেখে অপেক্ষা করছে। আমার অক্ষত ফিরে আসার পুরস্কার এই আদর, এই চুম্বন। অবশেষে গরম কফি, কিছু সুস্বাদু ভাজা। জীবনের ছোট ছোট অথচ গভীর সুখ।

রান্নাঘর থেকে প্রেসার কুকারের স্টিম, মাংসের সুগন্ধ নিয়ে আসছে। ভাগ্যিস ওই সব গোলমাল শুরু হবার আগেই কিনে এনেছিলাম। কাবেরী যেন বিজয়ীর হাসি হাসল। মানুষ কত অল্পে, কত তৃপ্ত! মাংস কেনা আর রাজ্য জয় করা যেন দুটো সমান ওজনদার জিনিস। মাংস না পেলেই বা কী অসুবিধে হত। কিছুই না ডিম ছিল। কাবেরী একটু ছড়িয়ে বসল। শরীর বেশ ভারী হয়েছে। এই সময়টা মেয়েদের কেমন যেন ক্লান্ত অথচ পূর্ণ দেখায়। কফি খেতে খেতে কথা হচ্ছে। কিছু অপ্রাসঙ্গিক। চারিদিক নিস্তব্ধ। রাস্তা অন্ধকার জনশূন্য। আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো বাড়িতে একটা রেডিয়ো বাজছে না। একটা থমথমে আবহাওয়া। কখন কী ঘটে যায়! একটু আগে জীবনকে মেডেলের মতো গলায় ঝুলিয়ে ওই পথে যে এসেছি এ যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আশে-পাশে এখনও অনেকে ফিরতে পারে নি। কিন্তু তাতে আমাদের কফি খাওয়া অথবা ছোটো ছোটো গল্পের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। কারণ আমি তো ফিরে এসেছি। যারা আসে নি তারা আসবে হয়ত আসবে না। কী করা যাবে। আজকাল আর কিছু করা যায় না। ঘটনার স্রোতকে প্রতিরোধ করা যায় না। চারিদিক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। তা না হলে হয়তো গান গাওয়া যেত কিংবা রেডিয়োগ্রামে কিছু রেকর্ড বাজানো যেত। কিন্তু ইস্পাতের পাতের মতো এই দুর্ভেদ্য নিস্তব্ধতাকে শব্দ দিয়ে ভেদ করতে ইচ্ছে করছে না।

‘তোমাকে আজ সকাল সকাল আসতে বলেছিলুম, তা না হলে, কী হত বলত! যত রাত বাড়ত ততই গোলমাল বাড়ত। পথঘাট বিপজ্জনক হত। আর আমি একলা এই শরীরে কেবল ঘর-বার করতুম।’ ‘তা ঠিক। তবে কী জান, তুমি কোনোদিন ফুটবাথ নিয়েছ? প্রথমে গরম জলে পায়ের তলা ছ্যাঁক করে ওঠে। পা তুলে নিতে হয়, তারপর সইয়ে সইয়ে আস্তে আস্তে আধখানা পা সহজেই চলে যায় জলের তলায়। এখন যদি ওই অন্ধকার ঘন রাতে, ঘাতকদের মধ্যে দিয়ে আমাকে আসতে হত, উপায় নিশ্চয়ই একটা বের করে নিতুম। ছায়ায় ছায়ায় মিশে, বিপদকে ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পিছনে রেখে, দেখতে ঠিকই এসে উঠেছি তোমার এই ঘরে। দেখবে আমার পরেও এমনিভাবেই অনেকে এসেছে।’

এর পর আমাদের সেই শান্ত গৃহকোণে বাইরের জগতের নানা খবর ভেসে আসতে লাগল। অনেক ঘুরে অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, হাত মাথার উপর তুলে অনেকে ফিরে এলেন। দোকান পুড়ছে। বাড়ি জ্বলছে। অসংখ্য ক্ষিপ্ত মানুষ অসংখ্য মৃত্যু দিয়ে একটি মৃত্যুর ক্ষোভ ভুলতে চাইছে। কে যাবে, কে থাকবে বলা শক্ত। অনেকে এমন কথাও বললেন, আমরা নাকি কেউই নিরাপদ নই। কাবেরী যেন আমার খুব কাছাকাছি এসে একটু নিরাপত্তা খুঁজতে চাইছে। সে যেন এই মুহূর্তে জানালায়, ঘরের কোণে কোণে এমন কি শিলিং-এ পর্যন্ত অসংখ্য কালো কালো মুখ দেখছে।

রান্না বেশ ভালো হয়েছে। আয়োজনে কোনো ত্রুটি নেই। সাজানো খাবার টেবল, পরিষ্কার টেবল-ঢাকা, দুগ্ধশুভ্র চীনেমাটির পাত্রে ভোজ্যসামগ্রী। ফিকে ধোঁয়ায় মৃদু গন্ধ ভাসছে। এই গার্হস্থ্য সুখ। পরিবেশ, বিপ্লব কিংবা ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ অথবা অনেক কৃচ্ছসাধনের কথা ভুলিয়ে দেয়। জৈবিক আর আধ্যাত্মিকের অপূর্ব সমন্বয়। যৌবনবতী নারী, উষ্ণ, কমনীয়। সুস্বাদু ভোজ্যসামগ্রী। একটা সৌন্দর্যঘেরা পরিবেশ। কিছু সৃজনী প্রতিভা, দুটো বিচারশীল মন।

কিছু মানুষ হয়তো এখনও বাইরে, মর্গে কিংবা হাসপাতালের ইমার্জেন্সী বিভাগে অথবা অপারেশন টেবিলে কিংবা ক্রিমোটোরিয়ামে, এমন সমস্ত পরিবেশে যেখানে দৈহিক সুখ নেই, মানসিক স্থৈর্য নেই, কিন্তু আমরা এখন দু-জনে পরম নিশ্চিন্তে একটি সুকোমল শয্যায় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। এর পর ঘুম আসবে দু-চোখ জুড়ে নি:শব্দে, একরাশ পাখির মতো, ডানা নেড়ে নেড়ে।

কাবেরী প্রথমে একটু উসখুস করছিল। যেন ঠিক আরাম পাচ্ছে না। একটু অস্বাচ্ছন্দ্য। একবার জিজ্ঞেস করল কটা বাজল। এগারোটা বেজে দশ মিনিট। কিছুটা নিস্তব্ধতা। হঠাৎ কাবেরী মাথার বালিশ জড়িয়ে ধরে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ‘কী হল তোমার’? ‘অসহ্য ব্যথা, অসহ্য যন্ত্রণা। তুমি যা হয় একটা কিছু ব্যবস্থা করো। আমি আর পারছি না’।

‘কী সর্বনাশ! এখন এই ভীষণ সময়ে আমি কোথায় পাব ডাক্তার, কোথায় পাব গাড়ি। রাস্তায় বেরোবো কী করে? এ তোমার মনের আতঙ্ক। এখন ব্যথা কী? তোমার তো এখন সময় নয়। পুরো দু-মাস বাকি। এ তোমার ‘ফলস’ ব্যথা। চাপ খাওয়া হয়েছে, গ্যাস হয়েছে পেটে। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা অ্যান্টাসিড দিচ্ছি। আমার স্টকে আছে।’

দাঁতে দাঁত চেপে কাবেরী বললে—‘কিচ্ছু হবে না। আমার প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। এ সেই ব্যথা। তুমি যা হয় একটা কিছু করো।’

হা ঈশ্বর, এ কী দুর্দিন! এখন তো সুখশয্যা ছাড়তে হয়। বলা যায় না প্রথম সন্তানের জন্ম ভীষণ বিপজ্জনক। কী হতে কী হয়ে যায়। মৃত্যু। না না কাবেরীকে হারাতে চাই না। ঘরে মৃত্যুর ছায়া, বাইরে মৃত্যুর ছায়া। উঠতে হল। ঘরের সবুজ আলোকে জোর করতে হল। কাবেরীর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলুম। এখন কী করি! এই সমস্যাকে কীভাবে আক্রমণ করব! কাছাকাছি কোনো বাড়ি থেকে ডাক্তারকে ফোন করব। অথবা কোনো নার্সিংহোমে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলব। কিন্তু সমস্ত ‘কল অফিসই’ তো বন্ধ। কোনো বাড়িতে ফোন আছে তাও জানা নেই। প্রথমে থানায় যাই, পুলিশের সাহায্য চেয়ে দেখি, কিন্তু কাবেরী কি একলা থাকবে, তাই বা কী করে হয়?

রাস্তা কী ভীষণ অন্ধকার। পাশের বাড়ির সাহায্য নিতেই হবে। এখন আর ভাববার সময় নেই, সমস্ত কাজ অত্যন্ত দ্রুত সারতে হবে। কলিং বেলে চাপ দিলুম একবার, দুবার, তিনবার, চারবার, কোনো সাড়া নেই। কোন ঘরে আলো জ্বলল না। শুধু মনে হল কারা যেন ফিসফিস করে বলছে, ‘ওই এসে গেছে। সাড়া দিও না, ক-জন আছে, কে জানে। ওরা এখন হন্যে হয়ে আততায়ীকে খুঁজছে’। আমাকে ঘাতক ভেবেছে। কী সর্বনাশ। বলা যায় না কোনো অলক্ষ্য স্থান থেকে কিছু ছুঁড়ে মারতে পারে। আবার আমিও দাঁড়িয়ে আছি একেবারে উন্মুক্ত রাস্তায়। আমি চিৎকার করে বললুম—‘দরজা খুলুন। কোনো ভয় নেই। আপনাদের প্রতিবেশী। আমার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ। আপনাদের একটু সাহায্য চাই’—না কেউ দরজা খুলল না। সেই ফিসফিস গলা—খুলো না, ওসব চালাকি। যেই দরজা খুলবে…

আমার সময় খুবই কম। ওই তো আমার জানালায় আলো জ্বলছে। কাবেরী প্রসববেদনায় ছটফট করছে। আমি তখন ছুটছি। থানা, থানাতেই হয়তো সাহায্য পাওয়া যাবে। এই নির্জন রাস্তায় আমি একলা ছুটন্ত পথিক। আমাকে পেছন থেকে অথবা সামনে থেকে কিংবা চারপাশ থেকে আক্রমণ করতে পারে। দূর থেকে দেখলে আমাকে পলাতক মনে হবে।’

অফিসার-ইন-চার্জ ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। ইতিমধ্যে তাঁর এলাকায় তান্ডব শুরু হয়ে গেছে। মৃতদেহ আসছে একে একে, ছিন্ন-ভিন্ন রক্তাক্ত। কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে? আমাদের গাড়ি নেই। সব টহল দিতে বেরিয়ে গেছে। তবে ফোনটা ব্যবহার করতে পারেন। ফোন, শুধু ফোনে কী হবে! একটা গাড়ি না হলে রুগিকে নার্সিংহোমে অথবা হাসপাতালে নেবো কী করে?

‘কী যে করেন মশাই, আপনারা এই দুর্দিনে! একটু সংযম অভ্যেস করতে পারেন না। এই কি সন্তান আনবার সময় না পরিস্থিতি। দেখছেন দেশজুড়ে লন্ডভন্ড চলছে। দিন থাকতে থাকতে গোলমালের আগে হাসপাতালে দেন নি কেন?’ সেই দুঃসময়েও গল্পের ডুবে-যাওয়া সেই ছেলেটির কথা আমার মনে পড়ল। ডুবছে সে, সাহায্য চাইছে, তীর থেকে তাকে উপদেশ ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে, সাঁতার না জেনে জলে নেমেছিলে কেন?

অবশেষে ফোন। গৃহ চিকিৎসক। ‘আমি কী করব মশাই, এ তো আমার কেস নয়, কোনো গাইনোকোলজিস্টকে যোগাযোগ করুন। তা ছাড়া আমার জীবন এমনিতেই বিপন্ন আজ তো কোনো কথাই চলে না। হাসপাতাল। একের পর এক। রুগি নিয়ে আসুন। অ্যাম্বুলেন্স নেই। কোথায় পাব অ্যাম্বুলেন্স। প্রথমত হাউস স্টাফরা আগের মতো কাজ করে না। এছাড়া আজকের প্রেসারটা বুঝতে রপারছেন না। আপনিও তো আচ্ছা ‘ক্যালাস’, এসব ‘কেস’ বাড়িতে ফেলে রাখে!

‘বলছেন কী? রুগি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে’! ‘যাবে! কী করা যাবে। ও সব ‘সেন্টিমেন্টাল’ কথা বলবেন না। ওতে আর চিঁড়ে ভেজে না।’

—‘কী করি বলুন তো। প্লিজ আপনি একটু সাহায্য করুন। আমার স্ত্রী…’ আমি আর বলতে পারলুম না। অফিসার-ইন-চার্জ সিগারেট খেতে খেতে একটিমাত্রই জবাব দিলেন—শেষ জবাব—‘কাঁধে করে নিয়ে যান।’

আমি প্রায় উড়তে উড়তে ফিরে এলুম আমার ফ্ল্যাটে। সমস্ত বিছানার চাদর হাত দিয়ে খামচাতে খামচাতে কাবেরী যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে, প্রায় ধনুকের মতো হয়ে গেছে। সমস্ত মুখে তার আতঙ্কের ছায়া। না অসহ্য, এ দেখা যায় না। জীবন দিয়েও আমাকে কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি আমি। ইতিমধ্যে ঘামে শরীর ভিজে গেছে। বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি ঘোলাটে হয়ে গেছে।

দরজায় কড়া নড়ে উঠল। ভারী উত্তেজিত গলার আওয়াজ। ‘আলো নেভান’। এই একটা কথায় আমি যেন আলো দেখতে গেলুম। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালুম। হাতে ধারালো অস্ত্র চারজন যুবক। আমি দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে, সরাসরি আত্মসমর্পণ করলুম—‘ভাই তোমরা আমাকে বাঁচাও।’ ‘আপনাকে মারতে আসিনি আমরা। আলো নেভান। আমাদের কাজের অসুবিধে হচ্ছে।’ ‘না সে কথা নয়। আমার স্ত্রী, আমার স্ত্রী আসন্নপ্রসবা। এই মুহূর্তে সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি কোনোভাবেই তাকে হাসপাতালে নিতে পারছি না। তোমরাই আমার ভরসা। তোমরা বাঁচালে বাঁচবে, তোমরা মারলে মরবে।’

—‘পল্টু, দাদা কি বলছে রে! কী করতে হবে আমাদের?’

—‘একটা গাড়ি ভাই। কোনোরকমে আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হবে। আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তোমরা ছাড়া।’

—‘ঠিক আছে, বিশু, তুই ঝট করে একটা রিকশা ধরে নিয়ে আয়। শালারা এমনিতে আসতে চাইবে না। জোর করে ধরে আনবি। কাছাকাছি যে ডাক্তাররা আছে তাদেরও তো পাবি না, সব ‘লকারে’ বসে আছে। শালা প্রাণের কী মায়া! একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে?’

—ওই তো, ওই তো আমার স্ত্রী যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

—শালা ঠিক মার্ডার করলে যেমন আওয়াজ হয় তেমনি হচ্ছে।

—পল্টু তোর কোনো বুদ্ধি নেই, একে বলে প্রসববেদনা। আমাদের মায়েদেরও এমনি, হয়েছিল, বুঝেছিস!

বিশু নামক ছেলেটি একটা রিকশা ধরে নিয়ে এল। ঘুম-জড়ানো চোখ অথবা নেশার ঘোরে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করল কোথায় যেতে হবে? হাসপাতালে। ‘দাদা সময় আমাদের কম, বৌদিকে নামান, গোটা কতক বালিশ আনবেন, বেশ করে সাজিয়ে বৌদিকে আরামে বসান, কিংবা কোলে নিন। একলা নামাতে পারবেন?’

‘দেখি চেষ্টা করে।’

ওরা পাঁচজন নীচে দাঁড়িয়ে রইল, আর আমি একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলুম। কাবেরীর তখন অন্তিম অবস্থা। যন্ত্রণা যে কত ভয়ানক। একটা প্রাণ পৃথিবীতে আসতে চাইছে, সে যে কি অসহ্য দৃশ্য, জন্ম যে এত বেদনাদায়ক, আমার জানা ছিল না।

কাবেরীকে কোনোরকমে পাঁজাকোলা করে তুলে সবে সিঁড়িতে পা রেখেছি প্রচন্ড শব্দে একটা বোমা ফাটল, কাবেরী চমকে উঠল, যন্ত্রণা যেন সাময়িকভাবে অপসৃত হল, অন্যরকম একটা আতঙ্কে। বারুদের গন্ধ এল নাকে, একটা আগুনের ঝিলিক, কিছু শক্ত কঠিন জিনিস দেওয়ালে, কাঁচে লাগল। সিঁড়ির শেষ ধাপে দরজার সামনে তখন ধোঁয়ার কুন্ডলি।

কিন্তু একি, দরজার সামনে বিশু পড়ে আছে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, জীবন আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাওলা নেই, নেই আর চারটি ছেলে। কাবেরীর যন্ত্রণা আবার ফিরে এল। আমার জামাটা খামচাতে লাগল, দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করল শাড়ির আঁচল। ভাবছি এখন কী করব! তারা কোথায়? হঠাৎ অন্ধকার থেকে পল্টু বেরিয়ে এল—‘ভাববেন না কিছু, বৌদিকে বসান রিকশায়।’

—কিন্তু বিশু, বিশুকে তো আগে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। ওকি বাঁচবে? দৃশ্য দেখে কাবেরী তখন মূর্ছিত।

—আপনি কিছু ভাববেন না দাদা, আমরা মরতেই জন্মেছি, ওকে আমরা কাঁধে করেই নিয়ে যাব। আর সময় নেই আপনি উঠে বসুন, ব্যাটা রিকশাওলা ভয়ে ভেগেছে, আশেপাশেই আছে, ধরে আনছি।

ইতিমধ্যে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আর তিনটি ছেলে ফিরে এল।

—শালা, ওরা তিনজন ছিল। দুটো পালিয়েছে, একটাকে খতম করেছি। শালা, কী রক্ত মাইরি, যেন পিচকারি। মানুষের শরীরে এক রক্ত থাকে। দেখ, জামা-প্যান্টের কী অবস্থা।

—তুই আর এগোসনি, বৌদি ভয় পেয়ে যাবে। তোরা একজন রিকশাওয়ালাটাকে ধরে নিয়ে আয়, তারপর চল, বিশুটাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাই। যদি বাঁচে।

রাত তখন ক-টা! হাসপাতাল যেন ক্লান্ত; মৃদু আলোকিত করিডর, সারি সারি নিদ্রিত রোগী। কোথাও কোনো রোগী আধবসা, ঘুম তার আসছে না, কেউ কাৎরাচ্ছে যন্ত্রণায়। ওয়ার্ড খালি, কোথায় নার্স, কোথায় হাউস সার্জেন! কিন্তু এতদূর যখন আসতে পেরেছি তখন বাকিটারও ব্যবস্থা করতে হবে।

কে যেন বলল—রাত এখন তিনটে। উনিশ নম্বর মারা গেছে। একটু জল, নার্স আমাকে একটু জল।

আপনি কী ডাক্তার ভাই! আমার স্ত্রী, একেবারে শেষ অবস্থা। কী কেস? ডেলিভারি কেস। এখানে কী? তবে? চলুন, চলুন, ডেলিভারি ওয়ার্ডে। সার্জেন—কী হয়েছে সিস্টার, ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে আর একটা ছেলে এসেছে। কিছু নেই, একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, ‘বম্ব ইনজুরি’। এখনও প্রাণ আছে। তাপসকে বলুন, অ্যাটেন্ড করতে এখুনি, স্যালাইন রেডি করুন। আমার হাতে ডেলিভারি কেস।

ডেটল, ইথার, ইউরিন্যাল, সব মিলিত, মিশ্রিত গন্ধ। বড়ো বড়ো চওড়া চওড়া করিডর, খোলা গরাদহীন জানালা, উঁচু উঁচু ছাদ, সারি সারি লোহার খাটে, সরু সরু লম্বা রডে পাখা ঝুলছে, ঘুরছে, হাইহীল জুতোর খটখট, চকচকে বড়ো বড়ো বেঞ্চি, কাবেরী এখন ওই ‘ডেলিভারি’ লেখা দরজার ওপাশে। ‘কী হচ্ছে সিস্টার এত দেরি কেন? সিস্টার ঐ যে ছেলেটি এল বললেন সব ঝাঁঝরা, ওর নাম কী বিশু? সিস্টার তাপসবাবু কী ওকে অ্যাটেন্ড করেছে?’

—খবর আছে? কী হল কাবেরীর? সিস্টার—শী ইজ অল রাইট। ভালো আছে সে, আপনার একটা ছেলে হয়েছে, সাড়ে ছ পাউণ্ড ওজন। ঠিক চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে জন্মেছে। না এখন দেখতে পাবেন না। সকাল আটটায় আসবেন।’

সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নামছি। পুবের আকাশে আলোর ছোঁয়া লেগেছে। ছেলে হয়েছে। প্রথম সন্তান! কার মতো দেখতে হয়েছে কে কে জানে। কী নাম রাখব। সময়টা নিশ্চয়ই ভালো ছিল। কেমন হবে! নিশ্চয়ই খুব বড়ো হবে। হাউস স্টাফদের মিষ্টি খাওয়াব, আর ওই ছেলেদের! ওরা না থাকলে কী করতুম!

—দাদা, একটা সিগারেট দেবেন?

—কে পিন্টু তুমি?

—হ্যাঁ দাদা, কী হল আপনার, বৌদি ভালো আছেন তো?

—হ্যাঁ ভাই, ছেলে হয়েছে; কিন্তু বিশু! সে কেমন আছে?

পিন্টু ধোঁয়া ছেড়ে একটা দার্শনিকের মতো বলল—না: বাঁচল না, একেবারে ফর্দাফাই হয়ে গেছে, চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে সব শেষ হয়ে গেল। শালা বোমাটা বেশ জবরদস্ত ছিল। ওর মা-টার বড়ো কষ্ট হবে; ওই একটাই তো ছেলে! যাকগে, অতসব ভাবলে চলে না।

মনটা ভারাক্রান্ত হল। পুত্রলাভের আনন্দের অনেকটাই পুত্রশোকের ব্যাথায় যেন মিলিয়ে গেল।

—আমার জন্যেই হল ভাই।

—দূর দাদা, কী যে বলেন, ও তো হবেই। আমরা এই আছি এই নেই। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। এখন শালা ডেডবডি বার করাই মহা হ্যাপা, পোস্টমর্টেম হবে, মর্গে যাবে। সেই পচে ফুলে উঠবে তবে শালারা ছাড়বে।

—তোমরা একদিন এসো ভাই একটু মিষ্টিমুখ করে যাবে।

—কী যে বলেন দাদা। আমাদের চেনেন না তাই। পাড়ার খবর তো রাখেন না। আমাদেরসঙ্গে বেশি দোস্তি মানেই জানেন তো—এই। পিন্টু গলার কাছে হাতের চেটো নেড়ে একটা ভঙ্গী করল যার মানে—জবাই। পিন্টু সিগারেট খেতে খেতে করিডোরের আলোছায়ায় মিলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *