আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়
০১.
সারা গায়ে ভোরের শিশির মেখে ট্রেনটা সাহেবগঞ্জ এসে গেল।
রোদ উঠতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। হিমে আর কুয়াশায় চারদিক ঝাপসা হয়ে আছে। সাঁওতাল পরগণার লম্বা পাহাড়ি রেঞ্জটা দূর দিগন্তে অস্পষ্ট আঁচড়ের মতন মনে হচ্ছে। আকাশের এ-কোণে ও-কোণে এখনও দু-চারটে জ্বলজ্বলে তারা চোখে পড়ে।
রেলের টাইম-টেবলে এই ট্রেনটার একটা জমকালো পোশাকি নাম আছে– আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। আজ খুব ভিড়-টিড় ছিল না। ইঞ্জিনের কাছাকাছি একটা সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে তপতী আর সোমা গা ছড়িয়ে বেশ আরামেই আসতে পেরেছে। কামরাটা এত ফাঁকা, ইচ্ছে করলেই ওরা এক সিটে, মাথা, এক সিটে হাত, এক সিটে পা রেখে আসতে পারত।
তপতীর বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মতন। গোলগাল আদুরে মুখ, ভরাট গলা, কণ্ঠার হাড় কোমল মাংসের তলায় ঢাকা। মসৃণ ত্বকে যেন কচি পাতার লাবণ্য। বড় বড় চোখে কাঁচের গুলির মতন উজ্জ্বল মণি। অজস্র চুল একবেণি করে বাঁধা। সারা রাত ট্রেন-জার্নির ফলে বেণিটা ভেঙে রুক্ষ্ম চুল উড়ছে; কপালের সবুজ টিপটা লেপটানো; পরনের শাড়িটা দলা মোচড়া হয়ে আছে।
সোমা তপতীর চাইতে দু-এক বছরের বড়ই হবে। মুখের গড়ন পানপাতার মতন। চোখ-নাক সব যেন কাটা-কাটা, নিখুঁত। গায়ের রঙ টকটকে; প্রতিমার মতন বিশাল চোখ। চুলগুলো খোঁপায় আটকানো। তপতীর মতন তার চোখে-মুখে চেহারায় উজ্জ্বলতা নেই। ঝকঝকে আয়নার ওপর ধুলো বালি জমলে যেমন দেখায় সোমাকে ঘিরে তেমনি এক বিষাদ মাখানো রয়েছে। চোখের তলায়, কপালে, ঘাড়ে কাঁচে শ্যাওলার মতন ছোপ। সেটা ট্রেনে রাত কাটাবার জন্য নয়। সোমার দিকে তাকালেই মনে হবে, তার ভেতরে অনবরত এক যুদ্ধ চলছে।
প্ল্যাটফর্ম থেকে টি-ভেন্ডারদের ঘুমন্ত ভারী গলা ভেসে আসছে, চা গ্রাম (গরম) চা গ্রাম কুলিরা সামনে চেঁচাচ্ছিল, সাহাবগঞ্জ-সাহাবগঞ্জ-চেঁচাতে চেঁচাতে হুড়মুড় করে কামরায় কামরায় ঢুকে পড়ছিল।
তপতী হাই তুলে আর আঙুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে আলস্য কাটিয়ে নিল। এলোমেলো শাড়িটা ঠিক ঠাক করে মুখের ওপর থেকে উড়ন্ত চুলগুলো দুহাতে সরাতে সরাতে সোমাকে বলল, এবার আমাদের নামতে হবে। জিনিসপত্র গোছগাছ করে নে সোমা। দু-এক বছরের বড় হওয়াটাকে আমলই দেয় না তপতী; সোমাকে সে নাম ধরেই ডাকে।
সোমা উঠে পড়ল। জিনিসপত্র আর কী। দুটো হাওয়া ভর্তি বালিশ, একটা চাদর আর একটা কম্বল হোল্ডল থেকে বার করে ওরা পেতে নিয়েছিল। সময় কাটাবার জন্য দুটো সস্তা থিলারও সুটকেশ থেকে বার করা হয়েছিল।
দ্রুত চাদর-টাদর ভাঁজ করতে লাগল সোমা। তপতী বলল, অত তাড়াহুড়ো করতে হবে না; আস্তে আস্তে গোছা। এখানে দশ মিনিটের স্টপেজ। ইঞ্জিন জল-টল নেবে, তারপর ছাড়বে।
সোমা উত্তর দিল না। ভাজ-করা চাদর-কম্বল হোল্ডলে পুরে ফেলল। এদিকে হাওয়া-বালিশের হাওয়া বার করে বেতের বাস্কেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে তপতী; বই দুটো চালান করেছে, সুটকেশের ভেতর। দুজনের আলাদা আলাদা সুটকেশ। কিন্তু হোল্ডল একটাই, বাস্কেটও তাই। ও দুটো ভাগের। সব গোছানো-টোছানো হলে তপতী বলল, আপার ইন্ডিয়া আজ দারুণ এসেছে। দশ বছর এদিকে যাতায়াত করছি। যতবার এসেছি ততবারই দুতিন ঘন্টা লেট। এই প্রথম গাড়িটা রাইট টাইমে এল।
সোমা বলল, তাই নাকি।
তপতী উৎসাহের গলায় বলতে লাগল, আর এসেছিও গ্র্যান্ড। অন্য অন্য বার ভিড়ে দম আটকে আসে; এবার হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পেরেছি।
শুধু বসেই এসেছিস! সোম হাসল, ঘুমটা বুঝি বাদ গেল! যা নাক ডাকছিল! কতবার ঠেলেছি, ডেকেছি, তোর সাড়াই নেই।
তপতীও হেসে ফেলল, যা বলেছিল ভাই। ট্রেনে উঠলে আমার ভীষণ ঘুম পায়। তবে নাক ডাকে না।
নিজের নাক ডাকা কেউ শুনতে পায়?
তপতী বলল, আমি একাই ঘুমিয়েছি, তুই ঘুমোসনি? তুই বুঝি আমার নাক ডাকা শোনাবার জন্য জেগে বসে ছিলি?
সোমা চুপ করে রইল। তার মনে পড়ল কাল নটা দশে শিয়ালদা থেকে আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ছেড়েছিল। দক্ষিণেশ্বর পেরুবার আগেই তপতী ঢুলতে শুরু করেছিল, তারপর আরো দু-এক কিলোমিটার যেতে না যেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ঘুম ভেঙেছিল সাহেবগঞ্জ আসার খানিকটা আগে। সোমা কিন্তু ঘুমোত পারেনি। একেকটা স্টেশন এসেছে–বর্ধমান, বোলপুর, সাঁইথিয়া, তিনপাহাড়, রাজমহল, পাকুড়-সোমা শুধু জানালার বাইরে অন্ধকার আকাশের দিকে চোখ মেলে রেখেছে। মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে ঘুমন্ত তপতীকে দেখতে দেখতে এক ধরনের বিচিত্র ঈর্ষা অনুভব করেছে। তপতী কত সুখী, কত দুশ্চিন্তাহীন! আর সোমা নিজে? কমাস ধরে সে ইনসমনিয়ার রুগী। জীবনের আশ্চর্য এক জটিলতা তার ঘুম বিশ্রাম সুখ ছিনিয়ে নিয়েছে। দিনের বেলাটা তবু মানুষের ভিড়ে, নানারকম হইচই-তে কেটে যায়। কিন্তু রাত্রিবেলা কলকাতা নামে এক মহানগরের সব শব্দ সব হট্টগোল সব ব্যস্ততা যখন থিতিয়ে থিতিয়ে অতলে নামতে থাকে, পৃথিবী যখন ঘুমের আরকে ডুবে যায় সেই সময় ঘরময় হেঁটে বেড়ায় সোমা। সত্তর লক্ষ মানুষের নিদ্রিত শহরে সেই বোধ হয় একা, যার চোখে ঘুম নেই।
সোমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না তপতী। বলল, এত মোট-ঘাট আমরা নামতে পারব না, দাঁড়া কুলি ডাকি। কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে একটা কুলী ডেকে আনল সে, বলল, সামান উঠাও–
কুলিটা জিগ্যেস করল, কিধার যায়েগী মাঈজি?
ঘাটগাড়ি।
কুলিটা সুটকেশ-টুটকেশ চটপট মাথায় তুলে এগিয়ে চলল। তার সঙ্গে যেতে যেতে পিছন ফিরে একবার কামরাটা দেখে নিল তপতী–কিছু পড়ে-টড়ে আছে কিনা। না, কিছু নেই। দু-তিনটে বেহারি ভদ্রলোক জানালার ধারে বসে দাঁতন করছেন। এক বিপুলদেহ মারোয়াড়ি আর তার স্ত্রী-কাল ট্রেনে উঠে এদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, এখনও পাল্লা দিয়ে ঘুমোচ্ছে, জামা কাপড় আলুথালু। বিশ নম্বর কড়াইর মতন তাদের বিরাট পেট নিশ্বাসের তালে তালে ওঠা নামা করছে।
প্ল্যাটফর্মে নামতেই ঠান্ডা কনকনে হাওয়া ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিল। তাড়াতাড়ি শাড়ি দিয়ে গলা হাত-টাত ঢেকে সোমা বলল, এখানে তো বেশ শীত রে–
তপতী মাথা নাড়াল, হ্যাঁ
আজ মার্চের আট তারিখ। এর মধ্যেই কলকাতার গরম পড়তে শুরু করেছে; ফ্যান ছাড়া রাত্তিরে ঘুমনো যায় না। অথচ কলকাতা থেকে শ দুই মাইল দূরে এই জায়গাটা প্রাণ ধরে এখনও শীতটাকে বিদায় দিতে পারেনি।
তপতী বলল, চারদিকে পাহাড়-টাহাড় আছে কিনা; তাই ঠান্ডাটাও আছে।
প্ল্যাটফর্মে টিউব লাইটগুলো জ্বলছিল; কালো কোট-পরা রেল-বাবুরা চারদিকে ছোটাছুটি করছিল। এধারে ওধারে যাত্রীদের ভিড়, কুলিদের জটলা।
গেটে টিকিট জমা দিয়ে ওরা স্টেশনের পিছন দিকে চলে এল। সেখানে লাইনের ওপর আবছা অন্ধকারে লম্বা সরীসৃপের মতন একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। কুলিটা একটা ফাঁকা কামরায় মালপত্র তুলে দিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে গেল।
হোল্ডল থেকে চাদর বার করে বেঞ্চের ওপর পাততে পাততে তপতী বলল, আর মোটে ঘণ্টা আটেক; তারপরেই বাড়ি পৌঁছে যাব, বুঝলি।
তপতীকে খুব হাসিখুশি আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরতে পারলে কার না আনন্দ হয়। সোমা কিছু বলল না।
তপতী আবার বলল, এখান থেকে সগরিগলি ঘাট যাব; সেখান থেকে স্টিমারে মণিহারি ঘাট। মণিহারি ঘাট থেকে ট্রেনে কাটিহার। কাটিহার থেকে ট্যাক্সিতে পূর্ণিয়া। কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে বলল, এখন ছটা; ঠিক দুটোয় দেখবি বাড়িতে হাজির হয়েছি।
সোমা উৎসাহ দেখাল না। নিরুৎসুক গলায় বলল, ও, তাই নাকি
তপতী নিজের খেয়ালে বলে যেতে লাগল, স্টিমারে নদী পার হওয়াটায় গ্র্যান্ড লাগবে। ট্যাক্সিতে কাটিহার থেকে পূর্ণিয়া ট্রিপটাও খুব এনজয় করবি।
আগের সুরেই সোমা বলল, বেশ তো।
সারা রাত ঘুম হয়নি। চোখ জ্বালা জ্বালা করছিল সোমার। মাথার ভেতরটা ঝিম ঝিম করছে। ঘাড়ের কাছটায় কেউ যেন হাজারটা পিন ফোঁটাচ্ছে। ক্লান্ত গলায় সোমা বলল, এখানে জল-টল পাওয়া যাবে রে? বাসি মুখটা না ধুতে পারলে বিশ্রী লাগছে।
নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। দাঁড়া আনছি। বড় বড় দুটো ওয়াটার বটল নিয়ে স্টেশনে চলে গেল তপতী; একটু পরেই ভর্তি করে ফিরে এল।
সোমা মুখ-টুখ ধুয়ে ঘাড়ে-গলায় জল দিল। সাঁওতাল পরগণার হিমেল বাতাস ছিলই। আস্তে আস্তে অসুস্থ স্নায়ু জুড়িয়ে আসতে লাগল তার।
তপতীও মুখ ধুয়ে নিয়েছিল। ধুয়েই সে আবার স্টেশনে ছুটল। এবার ডেকে আনল একটা টি-ভেন্ডারকে। ভেণ্ডারটা দুজনকে চা দিয়ে চলে গেল।
তপতী বলল, এখানকার চা যাচ্ছেতাই; গরম জলই বলতে পারিস। কী আর করবি, এ-ই খা, কাটিহার গিয়ে ভালো চা-খাওয়াব।
নিঃশব্দে ভড়ে চুমুক দিল সোমা। চা-টা যেমনই হোক; খাবার পর মাথার ঝিমঝিম ভাবটা কমে আসতে লাগল।
দেখতে দেখতে চারদিক ফর্সা হয়ে গেল। একটু আগে আবছা মতন যে অন্ধকারটা আকাশ এবং পাহাড়-টাহাড়ের গায়ে জড়াজড়ি করে ছিল, কেউ যেন লাটাইতে সুতো গুটোনোর মতন একটানে সেটা তুলে নিয়ে গেল। অন্ধকার নেই, তবে সিল্কের মতন সাদা কুয়াশা সাঁওতাল পরগনার দীর্ঘ রেঞ্জটার মাথায় আটকে আছে। সূর্যটা উঁকি ঝুঁকি দিতে দিতে ঝাঁপ করে দিগন্তের তলা থেকে উঠে এল। মার্চের এই সকালে ঝক ঝক পাখি বেরিয়ে পড়েছে। সারা গায়ে ভোরের আলো মেখে তারা পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছিল।
পাহাড়ের রেঞ্জটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে তপতী বলল, দ্যাখ দ্যাখ সোমা, কী ফাইন, না?
সাঁওতাল পরগনার ওই পাহাড় আকাশের কোল ঘেঁষে চলেছে তো চলেইছে। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে হয়তো, দেশ থেকে দেশান্তরে। এদিকে আর কখনও আসেনি সোমা। সাঁওতাল পরগনার এই সকালবেলাটা নিজের অজান্তে কখন যেন তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। পাহাড় দেখতে দেখতে সে আধফোঁটা গলায় বলল, সত্যি ফাইন রে–
সেই ছেলেবেলা থেকে এই পাহাড়ের রেঞ্জটা দেখছি। কতবার দেখেছি। তবু এখনও ভালো লাগে।
ওখানে লোকজন থাকে?
সাঁওতাল-টাওতালরা থাকে। ওদের জন্যেই তো সাঁওতাল পরগনা নাম হয়েছে। সোমা মনে মনে ভাবল, ঠিক তো। জায়গাটার নাম শুনেই সাঁওতালদের কথা তার মনে পড়া উচিত ছিল। বলল, তুই কখনও ওদিকে গেছিস?
না ভাই, তপতী বলতে লাগল, এই সাহেবগঞ্জ থেকে যতটুকু দেখা যায়, ব্যস, ওই পর্যন্ত
সোমা আর কিছু জিগ্যেস করল না।
তপতী এদিক সেদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ওই দ্যাখ দ্যাখ, কী লাভলি সূর্যটা
সোমা সেদিকে তাকাল। সব ব্যাপারেই তপতীর উচ্ছ্বাস একটু বেশি। তবু সুযোদয়টাকে ভালোই লাগল, সোনার থালার মতন সেটা দাঁড়িয়ে আছে।
আরো কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, ঘাটগাড়িটা বোঝাই হয়ে গেছে। এত লোক কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কে জানে। কোত্থেকে একটা ইঞ্জিন এসে গাড়িটার গায়ে লেগে গেল। তারপর গার্ডের হুইসল বাজল, ফ্ল্যাগ নড়ল, ভাঙা গলায় একবার চেঁচিয়ে উঠে ঘাটগাড়ি হেলে দুলে চলতে শুরু করল।
মিনিট পনেরো যাবার পর সোমার চোখে পড়ল, দূরে সাদা কাগজের মতন একটা নদী পড়ে আছে। তপতী প্রায় লাফিয়ে উঠল, নদীটা দেখেছিস সোমা?
অনুচ্চ মৃদু স্বরে সোমা বলল, হ্যাঁ
কী নাইস!
সোমা উত্তর দিল না, পলকহীন নদীটাকে দেখতে লাগল।
তপতী আবার বলল, ওই নদীটা আমাদের পেরুতে হবে।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ওরা সগরিগলি ঘাটে এসে গেল। ঘাটগাড়িটা সাহেবগঞ্জ থেকে যাদের তুলে এনেছিল, হুড়মুড় করে দরজা খুলে তারা বেরিয়ে পড়ল।
স্টেশনটা ভারি মজার। তার একধারে বিশাল মাঠ; আরেক ধারে দুপা বালির ডাঙা ভাঙলেই স্টিমার ঘাট। জেটিতে একটা স্টিমার দাঁড়িয়ে আছে। তার মাস্তুলে একটা শঙ্খচিল ডানা মুড়ে বসে আছে।
একটা কুলি ডেকে মালপত্র তার মাথায় চাপিয়ে ধীরে সুস্থে সোমারা নামল। স্ট্রিমারটার দিকে যেতে যেতে তপতী বলল, ঘাট অনেকটা এগিয়ে এসেছে। নইলে আরো সময় লাগত।
সোমা বলল, ঘাট এগিয়ে এসেছে; সে আবার কী? পিছিয়েও যায় নাকি?
হ্যাঁ। এই তো পুজোর পর যখন এলাম তখন ঘাটটা ছিল দুমাইল দূরে।
এ রকম কেন হয়?
নদী পাড় ভাঙছে, তাই ঘাটটা কখনও এগোয় কখনো পিছোয়।
গল্প করতে করতে ওরা স্টিমারে এসে উঠল। ডেকের একধারে চাদর বিছিয়ে বসতে বলতে সোমা জিগ্যেস করল, নদীটা পেরুতে কতক্ষণ লাগবে?
তপতী বলল, ঘণ্টাখানেক তত নিশ্চয়ই।
সূর্যটা আরো অনেকখানি উঠে এসেছে। নদীর শান্ত স্থির জলে এখন রোদের ছড়াছড়ি। বাতাসে হিমের ভাবটা কেটে এসেছে। তবু বেশ শীত শীত করছে। ঝাঁকে ঝাকে বক নদীর জলে ছোঁ দিয়ে পড়ছিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে লম্বা ঠোঁটে একেকটা শিকার গেঁথে উঠে আসছিল।
এক সময় স্টিমার ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে নদীর এপারটা দূরে সরে যেতে লাগল। দূরে সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ি রেঞ্জটা আবছা হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আগে আর কখনও আসেনি সোমা। সাঁওতাল পরগনা তো অনেক দূরের রাস্তা, কলকাতার পুব দিকেই এই তার প্রথম আসা। কালই প্রথম সে শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকেছে। শিয়ালদার পর থেকে যা কিছু, এতদিন সবই ছিল তার অচেনা, বইয়ে-পড়া কোনও রহস্যময় মহাদেশের মতন।
শিয়ালদা আসার দরকারই হয় না সোমার। ঠাকুরদার আমল থেকেই ওরা ইউপি-তে ডোমিসাইল্ড। ঠাকুরদা তার যৌবনে চাকরি নিয়ে লক্ষৌ গিয়েছিলেন, সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ একরকম ছিন্ন।
ঠাকুরদা অবশ্য সারাজীবন ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে গেছেন, বাবা কিন্তু উত্তর প্রদেশকেই স্বদেশ বলে জানেন। চাকরিতে থাকতে থাকতেই, এই তো সেদিন জায়গাটায়গা কিনে লক্ষ্ণৌতে বাড়ি করলেন। মা অবশ্য মৃদু আপত্তি করেছিলেন, তার মতে বাড়ি-টাড়ি দেশে গিয়েই করা উচিত। দেশ বলতে বাংলাদেশ। বাবা বলেছিলেন, এতদিন পর দেশে ফেরার মানে হয় না। বাংলাদেশটা তার মাতৃভূমি; এই পর্যন্ত। কিন্তু তার কতটুকুই বা তিনি চেনেন। সেখানকার গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন–সবই তার অজানা। এ বয়সে বাংলাদেশে ফিরলে অচেনা বিদেশির মতন থাকতে হবে।
বছর তিনেক হল বাবা রিটায়ার করেছেন, এখন লক্ষ্ণৌতে তার শান্ত অবসরের জীবন। দুই দাদা ওখানেই স্টেট গভর্নমেন্টে বিরাট চাকরি করে, মোটা মাইনে। একমাত্র দিদির বিয়ে হয়েছে কানপুরে; জামাইবাবু অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির অফিসার। তাদের সংসারে মোটামুটি সুখের।
ভাইবোনদের মধ্যে সোমাই ছোট। ছোট বলেই কিনা কে জানে, কিছুটা জেদি, এবং একগুঁয়ে। লক্ষ্ণৌ থেকে বিএ পাশ করার পর হঠাৎ সে ঠিক করে ফেলল কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়বে। দাদারা বাধা দিয়েছিল। কলকাতায় আগে আর কখনও আসেনি সোমা। এই অচেনা শহরে কোথায় গিয়ে থাকবে সোমা, কোনও বিপদ-টিপদ হবে কিনা, এই সব ভেবেই দাদাদের আপত্তি। বড়দা বলেছিল, বিএ পর্যন্ত যখন এখানে পড়েছিস, এম.এ-টাও পড়ে ফেল। ছোটদা তার চাইতে মোটে দুবছরের বড়, দুজনের সম্পর্কটা নিয়ত যুদ্ধের। একজন আরেকজনের পেছনে দিনরাত লেগেই আছে। অবশ্য এই লাগালাগিটা পরস্পরের প্রতি টানেরই ছদ্মবেশ। ছোটদা বলেছিল, পড়িয়ে-টড়িয়ে আর দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে ওটাকে পার করে দেওয়াই ভালো। তক্ষুনি দুজনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাবা তাদের থামিয়ে বলেছিলেন, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির সে গ্ল্যামার আর নেই, তুই বাপু এখানেই পড়। কিন্তু সোমা ঘাড় বাঁকিয়েই রেখেছিল, কলকাতায় সে পড়বেই।
শেষ পর্যন্ত সোমার জেদেরই জয় হয়েছিল। বাবা নিজে এসে তাকে কলকাতায় ভর্তি করে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আর ফিফথ ইয়ারে পড়তে পড়তেই বিকাশের সঙ্গে তার আলাপ। সেই আলাপের দিনটা থেকেই জীবনের এক আশ্চর্য জটিলতার ভেতর পা দিয়েছিল সোমা।
হঠাৎ কানের পাশ থেকে তপতী ডাকল, সোমা–ওই চরটা দেখছিস
সোমা চমকে উঠল। স্টিমার তখন মাঝনদীতে; প্রকাণ্ড এক চরের পাশ দিয়ে ওরা যাচ্ছিল। সোমা সেদিকে তাকাল।
তপতী বলল, চরটা ফার্স্ট ক্লাস না?
সেই সাহেবগঞ্জে নামবার পর থেকে কত কী দেখাচ্ছে তপতী। বায়োস্কোপের বাক্সে চোখ লাগাবার পর বায়োস্কোপওলা যেমন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, আগ্ৰাকা তাজমহল দেখো, কুতুব মিনার দেখো, হাওড়া ব্রিজ দেখো, বম্বাইকা সড়ক দেখো,তেমনি তপতী ক্রমাগত বলে যাচ্ছে সাঁওতাল পরগনার পাহাড় দ্যাখ, নদী দ্যাখ, আকাশ দ্যাখ, নদীর চর দ্যাখ-ইত্যাদি ইত্যাদি–
সোমা বলল, হ্যাঁ, চরটা সত্যি সুন্দর রে–
দিন দিন এটা বড় হচ্ছে। দশ বছর আগে কতটুকু ছিল; আমার মনে হয় চরটা বড় হয়ে হয়ে একদিন নদীটাকেই বুজিয়ে ফেলবে।
সোমা চুপ। তপতী আবার বলল, আমার অনেকদিনের একটা ইচ্ছা আছে। কী?
ওই চরটায় একটা ঘর তুলে কিছুদিন থাকব। চমৎকার লাগবে না কী বলিস? নির্জন চরে, হু-হুঁ বাতাসে, চাঁদের আলোয় যা একখানা ব্যাপার হবে না? তুই থাকবি আমার সঙ্গে?
সোমা হেসে ফেলল, আমাকে কেন তোকে সঙ্গে নেবার লোক তো গোকুলে বাড়ছে। বিয়ের পর হনিমুনটা এই চরেই করিস।
তপতীর বিয়ে একরকম ঠিক হয়েই আছে। ছেলেটি আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ স্কলার; মাস ছয়েকের ভেতর মেটালর্জিতে থিসিস সাবমিট করার কথা তার। ডক্টরেটটা পেয়ে গেলেই দেশে ফিরে বিয়েটা সেরে ফেলবে। ভালো চাকরি-বাকরি পেলে ইন্ডিয়ায় থেকে যাবে, নইলে বউ নিয়ে আবার আমেরিকায় পাড়ি।
হনিমুনের কথায় মুখ লাল হয়ে উঠল তপতীর। একটুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। তারপর ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে চোখের কোণে তাকিয়ে বলল, হনিমুনের সময় তোকেও নিয়ে আসব।
অনেক অনেকদিন পর প্রগলভতার ঈশ্বর যেন সোমার কাঁধে ভর করল। সকালবেলার আকাশ নদী, টলটলে রোদ, সাঁওতাল পরগণার জাদুকর পাহাড়, সব একাকার হয়ে পাষাণভারের মতন তার বিষাদ ভুলিয়ে দিতে লাগল। তপতীর গলায় তর্জনীর আলতো ঠেলা দিয়ে রগড়ের গলায় সে বলল, দুজনেই মজা; তার মধ্যে আরেকজন ঢুকলেই গোলমাল। জানিস, আমাদের লক্ষ্ণৌতে একটা প্রবাদ আছে।
কী?
কাবাবমে হাড্ডি। শুধু শুধু আমাকে জুটিয়ে কেন কাবাবে হাড় ঢোকাতে চাইছিস ভাই?
দারুণ বলেছিস সোমা-শব্দ করে হেসে উঠল তপতী।
স্টিমারটা প্রকাণ্ড চাকায় জল কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল। নদীর ওপারটা দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে। ডেকের ওপর যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিল, কেউ কেউ রেলিঙে ভর দিয়ে জলের উপর ঝুঁকে আছে। বেশির ভাগই স্থানীয় দেহাতি মানুষ, কিছু কিছু আদিবাসী সাঁওতালও চোখে পড়ছে। চোখে গগলস, পরনে চাপা প্যান্ট, কাঁধে ক্যামেরা, হাতে ট্রানজিস্টর-দুচারটে ছোকরাও ডেকের এ-মাথায় সে-মাথায় ঘোরাঘুরি করছে।
ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে সোমা বলল, আজ কতারিখ রে?
আট, কেন?
ফোরটিন্থ কিন্তু পূর্ণিয়া থেকে ফিরে আসব।
আরে বাবা এখনও পূণিয়ায় পৌঁছুলিই না। আগে চল, দুচারদিন থাক, তারপর তো ফেরার কথা।
না ভাই, ফোরটিন্থ ফিরতেই হবে। সেই কথা বলেই তুই এনেছিস। পরে ঝাট করবি না কিন্তু
আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবে। তপতী ব্যাপারটাকে আমলই দিল না।
সোমা বলল, দেখা যাবে বললে চলবে না। যদি আটকাতে চাস, এখনই বলে ফ্যাল। আমি এখান থেকেই ফিরে যাই।
কলকাতায় এখন তোর কোন রাজকার্য যে ফোরটিন্থ না ফিরলেই নয়? কমাসের ছুটি তো পড়ে পড়ে পচছে। আমাদের বাড়ি কদিন বেশি থাকলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
সে তুই বুঝবি না।
রাগ এবং অভিমানের গলায় তপতী বলল, বেশ বাবা, চোদ্দো তারিখেই আসিস। হল তত? ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে কত জায়গায় যাব, কত কী দেখাব
সোমা উত্তর দিল না।
একটু পর স্টিমারটা মনিহারিঘাট পৌঁছে গেল।
.
০২.
খুব ভিড়-টিড় ছিল না; তাই হুড়োহুড়ি ছোটাছুটিও নেই। ধীরে ধীরে যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে। রিস্টওয়াচ দেখে তপতী বলল, সাড়ে নটা বাজে। আরেকটু কষ্ট করতে হবে, তারপরেই বাড়ি।
সোমা হাসল, আরেকটু কেন, অনেকখানি কষ্ট করতে হলেও রাজি। একবার যখন কলকাতা থেকে বেরিয়েছি, তোদের বাড়ি না গিয়ে ছাড়ছি না।
কুলি ডেকে মালপত্তর তার জিম্মায় দিয়ে ওরা উঠে পড়ল। কাঠের গ্যাংওয়ে পেরিয়ে পাড়ে উঠেই থমকে গেল তপতী। স্টিমারঘাট থেকে ওপরে উঠলেই রেললাইন, লাইনের কাছে মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা উদ্বিগ্ন, কিছুটা চিন্তিত। তার চোখ স্টিমারের দিকে। কাউকে খুঁজছে হয়তো।
ঝকঝকে স্মার্ট চেহারা মৃন্ময়ের। বয়স পঁয়ত্রিশের মতন। গায়ের রঙ কালোও না, আর ফর্সাও না। দুয়ের মাঝামাঝি। নাক-মুখ-টুখ, আলাদা আলাদাভাবে দেখলে হয়তো হাজার গন্ডা খুত বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু সব মিলিয়ে ভারি আকর্ষণীয়। পরনে ঢোলা পাজামা আর খদ্দরের ধবধবে পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গুটনো, হাতে দামি ঘড়ি; চোখে গগলস।
মৃন্ময়কে এই মনিহারি ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল। কিছুক্ষণ অবাক থেকে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল তপতী, মৃন্ময়দা
মৃন্ময় চমকে উঠল। তারপর চোখ থেকে গগল্সটা খুলে হাসিমুখে এগিয়ে এল, আরে, তপী
মৃন্ময়ের কথা শেষ হবার আগেই তপতী বলল, তুমি এখানে কী করছ?
তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার জন্যে?
ইয়েস ম্যাডাম। ভেবেছিলাম তোক একটা সারপ্রাইজ দেব।
কিন্তু এখন তুমি এখানে এলে কী করে? কাল বিকেলে কাটিহার থেকে লাস্ট ট্রেন এখানে এসেছে। তারপর তো আর কোনও ট্রেন ছিল না।
কাল বিকেলের ট্রেনটাই ধরেছিলাম। মাঝখানে মনিহারিতে নেমে রাতটা এক বিহারি বন্ধুর বাড়ি কাটিয়েছি। আজ সকালে সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে চলে এলাম। মৃন্ময় হাসতে লাগল।
তপতী বলল, তোমার মাথায় ছিট-টিট আছে।
যা বলেছিস; বলেই মৃন্ময় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হ্যাঁ রে পী, মাসিমার কাছে শুনেছি, তোর কে এক বন্ধু আসবে। তাকে দেখছি না তো–
মৃন্ময়ের সঙ্গে তপতীকে কথা বলতে দেখে সোমা কুলিটাকে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তপতী তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এল, এই যে আমার বন্ধু–সোমা চট্টোপাধ্যায়। তারপর সোমাকে বলল, আর ইনি আমার পূজ্যপাদ মাসতুতো ভাই শ্রীমান মৃন্ময় মিত্র, দিল্লির একটা ফার্মে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। আমার চাইতে পাক্কা তিন বছরের ছোট। তবে দাদা শুনবার খুব শখ কিনা, তাই মৃন্ময়দা বলি।
ইয়ার্কি হচ্ছে! মৃন্ময় চড় তুলল, তপতী চট করে মাথাটা সরিয়ে খুব হাসতে লাগল। মৃন্ময়ও হেসে ফেলল, তারপর সোমার দিকে ফিরে বলল, আপনার এই বন্ধুটি মহা ধনুর্ধর।
মুখ নীচু করে সোমা হাসল।
মৃন্ময় আবার বলল, তপতীর মতন আপনিও কলেজে পড়ান নাকি?
হাঁ–আস্তে করে মাথা নাড়ল সোমা।
আপনার কী সাবজেক্ট?
হিস্ট্রি
বেশ পণ্ডিত লোক দেখছি
মৃদু স্বরে সোমা বলল, কলেজে পড়ালেই পণ্ডিত হয়ে যায় নাকি?
মৃন্ময় বলল, অত শত জানি না। তবে প্রফেসার-ট্রফেসার দেখলে আমার ভীষণ ভক্তি হয়। ইচ্ছে করে পায়ের ধুলো নিই। মাঝে মাঝে তপীর পায়ের ধুলোও নিয়ে থাকি।
ওধার থেকে তপতী ভেংচে উঠল, এ-হে-হে-হে
বিব্রতভাবে সোমা বলল, কী যে বলেন।
সোমার কথা যেন শুনতেই পেল না মৃন্ময়। দ্রুত চারদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে খুব নীচু গলায় বলল, ব্যাপারটা কী জানেন?
কী?
নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে মৃন্ময় বলল, এই যে মহাপুরুষটিকে দেখছেন ম্যাট্রিকের বেড়া ডিঙোতে এঁর সাতটি বছর লেগেছিল। তারপর আর কলেজে যেতে সাহস হয়নি। তাই কেউ এম.এ পাশ করে প্রফেসারি করছে শুনলে মনে হয় তার গোলাম হয়ে থাকি।
ভদ্রলোক ঠাট্টা করছে কিনা সোমা বুঝতে পারল না। সে চুপ করে রইল।
এদিকে লটবহর মাথায় কুলিটা দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, আউর কিতনা টিম (টাইম) খড়া রহেগা
তপতী তাড়া লাগাল, চল চল, সব কথা এখনই ফুরিয়ে ফেললে পরে বলবে কী? বলে চোখ টিপল।
মৃন্ময় লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ চল
ওপারের মতন মনিহারি ঘাটেও মাঠের মাঝখানে রেলস্টেশন। স্টেশন আর কী, অস্থায়ী কটা চালাঘর। তারপর দরমা আর টিনের ছাউনিতে কিছু দোকানপাট চায়ের দোকান, পানবিড়ির দোকান, সস্তা, খাবার-দাবারের দোকান এবং কটা ছোটখাটো হোটেল। সেখানে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল।
মৃন্ময় একটা কামরায় গিয়ে উঠল। তারপর সুটকেশ-টুটকেশ গুছিয়ে অঢেল জায়গা নিয়ে সবাই বসল। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল মৃন্ময়। লম্বা একটা টান নিয়ে ফুক ফুক করে ধোঁয়ার আংটি ছাড়তে লাগল।
হঠাৎ কী মনে পড়তে তপতী মৃন্ময়কে বলল, ওই দ্যাখ, সেই কথাটা জিগ্যেস করতে এক্কেবারে ভুলে গিয়েছি। তুমি দিল্লি থেকে কবে পূর্ণিয়ায় এসেছ?
পরশু। তোর মা জরুরি তলব পাঠিয়েছে যে
কী ব্যাপার?
দুই হাত চিত করে কঁধ ঝাঁকাল মৃন্ময়, কী জানি, এখনও ফুলমাসি (তপতীর মা) কিছু বলেনি! ঝুলি থেকে বেড়াল-টেড়াল একটা কিছু বেরুবেই। তার জন্য অপেক্ষা করছি।
একটু ভেবে তপতী বলল, এবার কিন্তু অনেকদিন পর পুর্ণিয়ায় এসেছ।
হ্যাঁ-মনে মনে হিসেব করে মৃন্ময় বলল, দেড় বছর পর এলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর মৃন্ময়ের কী যেন মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ রে তপী, সাহেবগঞ্জে তোরা কখন পৌঁছেছিস?
ভোরবেলা
কিছু খেয়েছিস?
এক ভাঁড় করে চা শুধু
সে কী রে–মৃন্ময় উঠে পড়ল, বাড়ি যেতে যেতে দুটো আড়াইটে হয়ে যাবে। ততক্ষণ না খেয়ে কি থাকা যায়; সঙ্গে একজন গেস্ট আছেন।
বিব্রত মুখে সোমা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না–
তাই কখনো হয়। মৃন্ময় বলল, এখানে হোটেল রয়েছে। চল, চট করে তিনজনে খেয়ে আসি। ট্রেন ছাড়তে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে।
শক খাবার মতন চেঁচিয়ে উঠল তপতী, ওরে বাবা, রক্ষা করো।
কী হল রে? মৃন্ময় অবাক।
এ সব হোটেলে খেতে-টেতে পারব না। মাটিতে বসে খাওয়া, তার ওপর ভাত-তরকারিতে কিচকিচে বালি, রাঁধুনে ঠাকুর-টাকুরগুলো সাত জন্মে কাপড়-চোপড় কাঁচে না বড় বড় নখ আর ফাটা ফাটা হাতের ভেতর ময়লা–ন্যাস্টি! তপতীর নাক-মুখ কুঁচকে যেতে লাগল।
তোর তো আবার পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোঁরায় খাবার অভ্যাস। কিন্তু মনিহারি ঘাটের এই বেলেমাটির চড়ায় কলকাতার পার্ক স্ট্রিট কোথায় পাই। তুই ট্রেনেই বসে থাক, আমি সোমাদেবীকে খাইয়ে আনি।
আমার চাইতে সোমা অনেক বেশি খুঁতখুঁতে। মেরে ফেললেও ওকে তুমি ওই হোটেলে ঢোকাতে পারবে না।
তাহলে আর কী করব! মৃন্ময়কে হতাশ দেখাল। পরক্ষণেই কী ভেবে খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল সে, এক কাজ করি বরং
তপতী বলল, কী?
ট্রেনের টাইমে এখানে সিঙাড়া নিমকি ভাজে। গরম গরম কটা নিয়ে আসি।
তুমি ক্ষেপেছ মৃন্ময়–পচা তেল-ফেল দিয়ে ভাজে ওই সব। খেলে আর দেখতে হবে না; হাতে হাতে একখানা গ্যাসট্রিক আলসার
ভুরু কুঁচকে ধমকে উঠল মৃন্ময়, অত খুঁতখুঁতনি কীসের রে? এই বয়সে যা পাবি তা-ই খাবি, চব্বিশ বছর না পেরুতেই বুড়ো-বুড়িদের মতন কতাবার্তা।
মৃন্ময় গাড়ি থেকে নেমে গুচ্ছের নিমকি-টিমকি নিয়ে এল।
কিছুক্ষণ নাকের ভেতর খুঁতখুঁত আওয়াজ করে নিতান্ত অনিচ্ছায় একটা সিঙাড়া তুলে নিল তপতী; সোমা নিল একটা নিমকি।
মৃন্ময় সোমাকে বলল, আর দু-একটা নিন-
সোমা বলল, না, না, আর লাগবে না।
তপীর হাওয়া আপনারও গায়ে লেগেছে দেখছি। আর সাধাসাধি না করে বাকি নিমকি-টিমকিগুলো চোখের পলকে শেষ করে ফেলল মৃন্ময়।
.
সাড়ে দশটায় ট্রেন ছাড়ল। ওরা তিনজনেই জানালার ধারে বসে ছিল। বাইরে আদিগন্ত সবুজ মাঠ। ঝোপঝাড়, গাছপালা, মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো রবিফসলের খেত। রুপোলি ঝলকের মতন হঠাৎ একেকটা নদী কিংবা খাল দেখা দিয়েই অদৃশ্য হচ্ছে। কোথাও মোষের পাল চলেছে, তাদের পিঠে ছোট্ট দেহাতি ছেলে অবাক বিস্ময়ে ট্রেন দেখছে। অনেক উঁচুতে পালিশ করা আয়নার মতন ঝকঝকে নীলাকাশ। ট্রেন বাঁক নেওয়াতে সাঁওতাল পরগণার রেঞ্জটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
তপতী বলল, কী বিউটিফুল মাঠ দেখেছিস সোমা।
সোমার ভালো লাগছিল; আকাশ-মাঠ দেখতে দেখতে মাথা নাড়ল সে।
ওধার থেকে মৃন্ময় বলে উঠল, মনেই হয় না আমরা বিহারে আছি; একজ্যাক্ট বাংলাদেশ যেন। একটু থেমে আবার বলল, তপীটা গান জানে না, আপনি জানেন, সোমাদেবী?
সোমা বলল, না।
সত্যিই কিছু জানেন না। বাথরুম সং-টংও কোনওদিন করেননি?
না।
আপনি একটা বোগাস।
সোমার মুখ-টুখ লাল হয়ে উঠল; মাথার ভেতরটা ঝা-ঝ করতে লাগল। মৃন্ময়ের সঙ্গে ভালো করে আলাপই হয়নি। সে যে দুম করে এ রকম একটা কথা বলতে পারে, সে ভাবতে পেরেছিল। রাগ, অপমান–সব মিলিয়ে যেন কেমন হয়ে গেল সোমা। ভারি ইতর তো লোকটা!
সোমার দিকে তাকালও না মৃন্ময়। হঠাৎ উচ্ছ্বাসে মোটা বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল।
আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন, তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা ফাগুনে তোর—
তপতী দুকানে হাত চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, থামো থামো; বেচারি রবীন্দ্রনাথকে অন্তত রেহাই দাও
মৃন্ময় গান থামিয়ে কাচুমাচু মুখে বলল, কেন রে, গানটা ভালো লাগছে না?
গানটা খারাপ কে বলেছে? বাংলা ভাষায় এরকম গান আর কটা লেখা হয়েছে! তবে
বুঝেছি, আমার গলাটা রাবিশ, এই তো? বলেই সোমার দিকে তাকাল, জানেন মিস চ্যাটার্জি, গলায় আমার একদম কনট্রোল নেই। হাঁ করলে একসঙ্গে আঠারো রকমের আওয়াজ বেরিয়ে আসে। সবই জানি, তবু আবেগ উথলে উঠলে নিজেকে আর সামলাতে পারি না। বলতে বলতে হেসে ফেলল মৃন্ময়। সোমা তাকিয়েই ছিল। এমন সরল নিষ্পাপ ছেলেমানুষির হাসি সে খুব বেশি দেখেনি। আশ্চর্য, একটু আগে মৃন্ময়কে মনে হয়েছিল ইতর।
তপতী হঠাৎ বলল, ও গানটা তোমার গাওয়া উচিত না মৃন্ময়টা
মৃন্ময় অবাক, কেন রে?
তুমি বিহারে বর্ন অ্যান্ড ব্রট-আপ। বাংলাদেশ নিয়ে মাতামাতি করার রাইট নেই তোমার। তোমার গাওয়া উচিত, আমার সোনার বিহার, আমি তোমায় ভালোবাসি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মৃন্ময়। তারপর গাঢ় গলায় বলল, যেখানেই জন্মাই আর যেখানেই থাকি, এই বুকের ভেতরটায় যা আছে তার নাম বাংলাদেশ।
চোখ বড় বড় করে কৌতুকের গলায় তপতী বলল, এ যে দেখছি রামভক্ত হনুমানের মতন; বুক চিরে বাংলাদেশ দেখাবে নাকি?
ইচ্ছে করলে তা পারি রে–
মাঠের মাঝখানে একেকটা স্টেশন আসে। কিছু দেহাতি লোক মালপত্র আঁকা-টাকা নিয়ে হুড়মুড় করে ওঠে, কিছু নামে। তারপরই ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠে। ট্রেনটা ছুটতে থাকে।
একটা স্টেশন থেকে এক গাইয়ে ছোকরা উঠল। তেরো-চোদ্দর মতন বয়স। আঁকড়া চুল ধুলো-বালিতে জট পাকিয়ে আছে। পরনের ইজেরটা তেলে-ময়লায় চিটচিটে, খালি গা। দুহাতে দুটকরো কাঠ। সে দুটো বাজিয়ে মিষ্টি গলায় সে গেয়ে উঠল, পাতলী কোমরি হায়, তিরছি নজরী হায়—
মৃন্ময় কষে ধমক লাগল, থাম ব্যাটা—
ছেলেটা ভয় পেয়ে গেল, জি
পন্দর সাল আগের মাল এখনও চালিয়ে যাচ্ছিস ব্যাটা। নয়া গানা লাগা।
নয়া গানামে জ্যাদা পাইসা লাগেগা বাবুজি
চোখ গোল করে মৃন্ময় বলল, ও বাবা, এ যে দেখছি কড়া জিনিস। ঠিক হায়, জ্যাদা পাইসাই পাবি।
বহুত খুব—বলেই গলা চড়িয়ে গান ধরল, রূপ তেরা মস্তানা, পেয়ার মেরে দিওয়ানা সেই সঙ্গে কাঠের টুকরোর বাজনা-টক-টক্টররেট
বহুত আচ্ছা বহুত আচ্ছা—মাথা নেড়ে নেড়ে তাল দিতে লাগল মৃন্ময়।
গান চলছিলই। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে মৃন্ময় বলল, এ ছোঁকরে, গানাকা সথ নাচা ভি তো লাগাও–
গান থামিয়ে ছেলেটা বলল, জি–
আরে বাবা, নাচা-গানা একসাথ। ছেলেটাকে উৎসাহ দেবার জন্য তুড়ি দিয়ে দিয়ে মৃন্ময় কাধ নাচাতে লাগল।
ছেলেটা এবার বুঝতে পারল। বলল, কোন্ সা নাচা সাহাব?
টুইস্ট জানিস,
জি-রাজেশ খান্নাকা তরা?
রাজেশ খান্নাকেও জানিস নাকি!
জরুর; উও তো বঢ়িয়া বাহাদুর
লাগা তাহলে রাজেশ খান্নার মতন
ছেলেটা পা কাঁপয়ে কাঁপয়ে গানের সঙ্গে নাচাও জুড়ে দিল। ঘাড় কাত করে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল মৃন্ময়; তারপর চেঁচিয়ে উঠল, ধুর-টুইস্ট-ফুইস্ট তুই কিছু জানিস না। আমার কাছে শিখে নে। কোমর এবং হাঁটু কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে এক পাক নেচে দেখিয়ে দিল মৃন্ময়।
সোমা অবাক চোখে মৃন্ময়কে দেখছিল। কিছুক্ষণ আগে এই মানুষটাকে সরল নিষ্পাপ বালকের মতন মনে হয়েছিল। আর এখন? মনে হচ্ছে তপতীর এই মাসতুতো ভাইটা ক্লাউন ছাড়া আর কিছু না। কোনও ভদ্র রুচির মানুষ যে এভাবে নাচতে পারে, সোমা কল্পনাই করতে পারে না। বিরক্তি রাগ আর অস্বস্তিতে তার চোখমুখ কুঁচকে যেতে লাগল।
গাইয়ে ছোকরাটা আবার নতুন করে শুরু করল। কিন্তু কিছুতেই আর মৃন্ময়ের পছন্দমতো হচ্ছে না; বারবার ভুল শুধরে দিতে লাগল মৃন্ময়।
তপতী মৃন্ময়ের কাণ্ড দেখে খুব হাসছিল। হাসতে হাসতেই সোমার কাঁধে আঙুলের খোঁচা দিয়ে বলল, দ্যাখ, মৃন্ময়দাটা এক্কেবারে যাচ্ছেতাই
ওই রকম একটা বাজে লোকের কুরুচিকর কোমর-নাচানি দেখে এত হাসবার কী আছে সোমা ভেবে পেল না। সে উত্তর দিল না।
আবার কী বলতে গিয়ে হঠাৎ সোমার দিকে তাকাল তপতী, সঙ্গে সঙ্গে তার হাসি থেমে গেল। সোমার মুখ লাল, চোয়াল শক্ত। কিছু একটা আন্দাজ করে সে মৃন্ময়ের দিকে তাকাল। ধমকের গলায় বলল, কী হচ্ছে মৃন্ময়দা!
মৃন্ময় হকচকিয়ে গেল, আরে ছোঁড়াটার টুইস্ট ঠিক হচ্ছে না, তাই একটু দেখিয়ে দিচ্ছি।
কড়া গলায় তপতী বলল, চুপ করে বোসো তো
এক পলক তপতীকে দেখল মৃন্ময়, তারপর দেখল সোমাকে। দেখতে দেখতে বিমূঢ়ের মতন ঝুপ করে বসে পড়ল।
চাপা গলায় তপতী বলল, এক গাড়ি লোকের সামনে নাচতে তোমার লজ্জা করল না! ছি! বন্ধুর কাছে আমার আর মান-ইজ্জৎ রইল না।
মৃন্ময় বলতে চেষ্টা করল, না মানে তপতী চেঁচিয়ে উঠল, চুপ করো–তারপর সোমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করল, কিছু মনে করিস না ভাই। মৃন্ময়দার মাথায় ছিট-ফিট আছে।
সোমা এবারও চুপ করে থাকল।
গাইয়ে ছোকরাটা হয়তো বিপজ্জনক কিছুর আভাস পেয়েছিল। গান-টান থামিয়ে ভয়ে ভয়ে মৃন্ময়কে বলল, সাহাব, মেরা পাইসা।
নিঃশব্দে পকেট থেকে একটা টাকা বার করে দিতেই ছোকরাটা চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। তারপর সবাই চুপচাপ। সোমা, তপতী, মৃন্ময়–তিনজন অপরিচিতের মতন পাশাপাশি বসে থাকল।
আরো ঘণ্টাখানেক পর ঘাটগাড়ি কাটিহার জংশনে পৌঁছে গেল।
স্টেশনে নেমে মৃন্ময় তপতীকে বলল, এখান থেকে কীসে পূর্ণিয়া যাবি? ট্রেনে, না ট্যাক্সিতে?
তপতী বলল, ট্যাক্সিতে।
ট্রেনে গেলে কিন্তু জানিটা লাভলি লাগত,মৃন্ময় চোরা চোখে একবার সোমাকে দেখে নিল। সোমার মুখ এখনও থমথমে গম্ভীর। মৃন্ময়ের কথা সে শুনেছে বলে মনেই হল না।
তপতী বলল, না-না, এখন শোভা দেখতে দেখতে খাবার সময় নেই। সাড়ে বারোটা বাজে; দারুণ খিদে পেয়ে গেছে। তুমি চট করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসো মৃন্ময়দা
মার্চের সূর্য এখন সোজা মাথার ওপর। সকালের দিকে রীতিমতো শীত শীত করছিল, হিমে গায়ে কাটা দিচ্ছিল। আর এই দুপুরবেলা বাতাস তেতে উঠেছে, বেশ গরম লাগছে।
মৃন্ময় ট্যাক্সি নিয়ে এল। ওরা উঠতেই গাড়িটা এক সেকেন্ড আর দাঁড়াল না; সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট দিল।
তারপর দুমিনিটের মধ্যে কাটিহার জংশন পিছনে ফেলে ট্যাক্সিটা হুস করে যেখানে এসে পড়ল তার দুধারে সবুজ কার্পেটের মতন মাঠ, টুকরো টুকরো বিহারি গ্রাম, একটানা পানিফলের বিল আর মাঝে মাঝে অনেকখানি জায়গা জুড়ে আম বাগান। ছোট ছোট সবুজ গুটিতে আমগাছগুলো বোঝাই হয়ে আছে। আর দেখা যাচ্ছিল বেঁটে বেঁটে অষ্টবক্ৰ মুনির মতো এক ধরনের অদ্ভুত গাছ। এমন গাছ আগে আর কখনও দেখেনি সোমা।
এক জানালায় বসেছিল সোমা, আরেক জানালায় মৃন্ময়। মাঝখানে তপতী। হঠাৎ ওধার থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, মিস চ্যাটার্জী, ওই ট্যারা ব্যাকা গাছগুলো মার্ক করুন–
সোমা যেমন বাইরে তাকিয়ে ছিল তেমনই তাকিয়ে থাকল।
খুব উৎসাহের গলায় মৃন্ময় বলল, ওই গাছগুলোর নাম সীসম। এমন গাছ আপনি বাংলাদেশে দেখতে পাবেন না।
সোমা কোনওরকম কৌতূহল বা আগ্রহ দেখাল না।
ঝুঁকে বসে আবার কী বোঝাতে যাচ্ছিল মৃন্ময়, তপতী বিরক্ত সুরে বলল, তুমি কি একটুও মুখ বুজে থাকতে পারো না মৃন্ময়দা
ঝপ করে আলো নিভে গেলে যেমন হয়, মৃন্ময়ের মুখটা তেমনি মলিন হয়ে গেল। বিব্রতভাবে বলল সে, আচ্ছা বাপু থামছি, আর একটি কথাও বলব না।
কাটিহার থেকে পুরো এক ঘণ্টাও লাগল না, তার অনেক আগেই ওরা পুর্ণিয়ায় পৌঁছে গেল।
.
০৩.
পুর্ণিয়ার যে পাড়ায় তপতীদের বাড়ি তার নাম ভাট্টা। একেবারে দরজার ওপর ওদের নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিটা চলে গেল।
অনেকখানি জায়গা নিয়ে তপতীদের প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি। সামনের দিকে বিরাট ফুলের বাগান। ফুল বলতে শুধু গোলাপ। লাল, সাদা, ফিকে হলুদ– নানারঙের গোলাপে বাগান ছেয়ে আছে
আজকাল কোনও কিছুতেই মুগ্ধ হয় না সোমা; ফুটন্ত দুধের মতন টগবগে আবেগ তার খোয়া গেছে। তবু কয়েক পলক বাগানটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারল না সে। বলল, তোদের বাগানটা তত চমৎকার রে তপতী। এত গোলাপ, এত রকমের গোলাপ, আমি আর কখনও দেখিনি।
তপতী হাসল, পুর্ণিয়ার লোকেরা আমাদের বাড়িটাকে কী বলে জানিস?
কী?
গোলাপবাড়ি।
সার্থক নাম।
দুহাতে দুই সুটকেশ, বেতের বাক্সেট আর বগলে হোল্ডল নিয়ে সোমাদের ঠিক পিছনেই আসছিল মৃন্ময়। বাগানের মাঝখান থেকেই সে গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগল, ফুলমাসি আমরা এসে গেছি। দোলন-ঝুলন–পিন্টু, তোরা কোথায় রে? শিগগির বেরিয়ে আয়
তপতীদের পুরোনো আমলের দোতলায়। মোটা মোটা থাম, চওড়া চওড়া সিঁড়ি, গরাদহীন খড়খড়ি-ওলা বড় বড় জানলা, ঘুলঘুলিতে পায়রা–সব মিলিয়ে তার গায়ে উনিশ শতকের একটা গন্ধ যেন মাখানো।
তপতীরা সিঁড়ির কাছে আসবার আগেই দুটি কিশোরী আর একটি যুবক বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মেয়ে দুটির বয়স চোদ্দ থেকে ষোলর মধ্যে। এখনও শাড়ি-টাড়ি ধরেনি। যুবকটির বয়স কুড়ি একুশের মতন। তিনজনেরই চোখে মুখে তপতীর আদল বসানো। এক পলক দেখেই টের পাওয়া যায়, ওরা তপতীর ভাইবোন।
তপতী ভাইবোনদের সঙ্গে সোমার আলাপ করিয়ে দিল। কিশোরী দুটির মধ্যে যে বড় তার নাম দোলন, ছোটটির নাম ঝুলন। ছেলেটি তপতীর একমাত্র ভাই; ডাকনাম পিন্টু। ওরা সোমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। সোমা বিব্রত মুখে বলল, থাক থাক, আজকাল আবার কেউ পায়ে হাত দেয় নাকি
পিন্টু চমৎকার ছেলে। বলল, বা রে, আপনি আমাদের দিদি না?
সোমার খুব ভালো লাগল ছেলেটাকে। স্নিগ্ধ হেসে বলল, তুমি কী করো, পড়ছ?
হ্যাঁ। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, এটা আমার এম.বি.বি.এস. ফাইনাল ইয়ার।
তপতী বলল, বা রে তোরা সোমাকে প্রণাম করলি। আমাকে করবি না?
পিন্টু বলল, তোর প্রণামটা জমা থাক ছোটদি। ইয়ার এন্ডিং-এ সব একসঙ্গে চুকিয়ে দেব। দোলন-ঝুলন বলল, আমরাও—-
ভাইয়ের মাথায় স্নেহভরে আলতো করে একটা চটি কষিয়ে দিল তপতী, মহা ওস্তাদ হয়ে উঠেছিস।
সোমা অবাক, ব্যাপার কী রে, এক সঙ্গে প্রণাম চুকিয়ে দেবে মানে?
তপতী হেসে ফেলল, ওরা আমাকে এমনিতে প্রণাম করে না। সারা বছরের প্রণাম জমিয়ে রাখে, তারপর বছরের শেষে পাওনা চুকিয়ে দেয়।
সোমা রগড়ের গলায় বলল, সারা বছরে তোর কটা প্রণাম পাওনা হয় রে?
একটু ভেবে নিয়ে তপতী বলতে লাগল, নববর্ষে একটা, বিজয়ায় একটা, আমার জন্মদিনে–একটা হ্যাঁ, আট-দশটা তো হয়ই।
আট-দশটা প্রণাম ওরা একসঙ্গে করে?
তপতী মাথা হেলিয়ে দিল, হুঁ—-
সোমা হেসে ফেলল, বাবা, অফিসের ছুটির মতন প্রণামও যে জমানো যায়, আমার ধারণা ছিল না।
পিছন থেকে আচমকা মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ গল্প করবি তপী? আমার হাত কিন্তু ছিঁড়ে যাচ্ছে।
পিন্টু ছুটে গিয়ে মৃন্ময়ের হাত থেকে একটা সুটকেশ আর হোল্ডলটা নিয়ে তাকে খানিকটা হালকা করল।
তপতী বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চল, ভেতরে যাই। সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
সোমাও তপতীর দুই বোনের কাঁধে হাত রেখে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। দুজনের মধ্যে দোলন বড়, ঝুলন ছোট। সোমা দোলনকে বলল, তুমি কী পড়ো?
ক্লাস টেনে।
হিউম্যানিটিজ গ্রুপ?
না, সায়েন্স।
অঙ্কে তা হলে তোমার দারুণ মাথা
দোলন লজ্জা পেয়ে মুখ নামাল।
সোমা এবার ঝুলনকে বলল, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
ঝুলন বলল, নাইনে
তুমিও সায়েন্স গ্রুপের?
না, হিউম্যানিটিজ। ছোটদির মতন অঙ্ক-টঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না।
গল্প করতে করতে ওরা থামওলা বিরাট বারান্দায় উঠে এল। আর তখনই বাড়ির ভেতর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারল না সোমা। মনে হল, তিনি আসাতে দুপুরের সূর্যালোক যেন আরো অনেকখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বয়স কত হবে? পঁয়তাল্লিশের বেশি কখনওই না; দেখায় কিন্তু তিরিশ পঁয়তিরিশের মতন। গায়ের রঙ যেন শরতের রৌদ্রঝলক। নাক-মুখ-চোখ সব মিলিয়ে তিনি রূপের প্রতিমা। হাতভর্তি গোছা গোছা সোনার চুড়ি তার গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে আছে। গলায় পুরনো আমলের তেঁতুলপাতা হার; নিটোল আঙুলে লাল পাথর বসানো আংটি। পরনে নকশা করা চওড়াপাড় ধবধবে শাড়ি আর গরদের ব্লাউজ। কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ।
তপতী বলল, আমার মা–
সোমা প্রণাম করবার জন্য ঝুঁকল কিন্তু পা ছোঁবার আগেই তপতীর মা তাকে বুকে তুলে নিলেন। সস্নেহ কোমল গলায় বললেন, তুমিই সোমা! এসো মা এসো–সবাইকে নিয়ে ভেতরে যেতে যেতে তিনি আবার বললেন, তোমাকে কিন্তু আরো আগেই আশা করেছিলাম মা। গেল বছর নভেম্বর মাসে তপী লিখেছিল, তোমাকে নিয়ে আসবে, আমরা পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর প্রতি মাসেই ও লিখে যাচ্ছে, তুমি আসছ! তারও এতদিন পর এলে।
তপতী বলল, কত সাধ্যসাধনা করে ওকে আনতে হয়েছে তা তো জানো না মা। কলকাতা থেকে নড়তেই চায় না। কলেজের ক্লাস আর হোস্টেলে নিজের ঘর, এর মধ্যেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছে।
আধফোটা জড়ানো গলায় সোমা কিছু একটা বলল, বোঝা গেল না।
তপতীর মা বললেন, তপী লিখেছিল, তোমরা লক্ষ্ণৌয়ে থাকো?
আজ্ঞে হ্যাঁ
সেখানে যাও না?
যাই মাঝে মধ্যে।
তপতী বলে উঠল, মাঝে মধ্যে না হাতি। জানো মা, আড়াই বছরে সোমা মোটে একবার লক্ষ্ণৌতে গেছে।
সোমা বলল, একবার গেছি। তোকে বলেছে। তাকে অত্যন্ত বিব্রত এবং চঞ্চল দেখাল। তপতীর মা এ সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না।
কথায় কথায় ওরা বাড়ির ভেতর চলে এসেছিল। মাঝখানে প্রকাণ্ড বাঁধানো উঠোনের চারধারে বড় বড় খোলামেলা ঘর। তপতীর মা ওদের নিয়ে দক্ষিণ দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
জানালার ধার ঘেঁষে পুরোনো আমলের নকশা-করা ভারী খাট পাতা। তার ওপর ধবধবে বিছানা। আরেক ধারে ফুল লতাপাতা-আঁকা আলমারি, ড্রেসিং টেবল, খান দুই সোফা, মাথার ওপর দুই ফলা-ওলা ফ্যান।
তপতীর মা বললেন, এটা তোমাদের ঘর। যে কদিন আছ, তোমরা দুই বন্ধু এ ঘরে থাকবে।
এক পলক চারদিক দেখে নিল সোমা। ঘরটা বেশ নিরিবিলি; তার খুব পছন্দ হয়ে গেল।
তপতীর মা আবার বললেন, একটু বিশ্রাম-টিশ্রাম করে স্নান করে নাও। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমোও। নিশ্চয়ই কাল ট্রেনে ঘুম হয়নি।
তপতী বলল, আমি ঘুমিয়েছি। তবে সোমাটা ঘুমোয়নি; ওর ভীষণ ইনসমনিয়ার ধাত। ঘুমের বড়ি খেলে ঘুম আসে না।
তপতীর মা কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থাকলেন। ক্রমশ তার কপাল কুঁচকে যেতে লাগল। এক সময় বললেন, এ তো ভালো কথা না মা; কী এমন বয়স তোমার। এর মধ্যেই যদি ঘুমের বড়ি খেতে হয়-না না, তুমি ভালো ডাক্তার দেখাবে, বুঝলে?
সোমা হাঁ-নার মাঝামাঝি মাথা নাড়ল, মুখে কিছু বলল না। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়, তাদের সঙ্গে সঙ্গে সুটকেশ-টুটকেশ নিয়ে এ ঘরে ঢুকে পড়েছিল সে। চোখাচোখি হতেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল সোমা।
তপতীর মা বললেন, আচ্ছা আমি এখন যাই, তোমরা বেশি দেরি কোরো না
তিনি চলে গেলেন। দোলন-ঝুলন-পিন্টু তার সঙ্গে গেল।
একদৃষ্টে সোমাকে লক্ষ্য করছিল মৃন্ময়; নিঃশব্দে মালপত্র নামিয়ে রেখে সোমাকে দেখতে দেখতে সেও চলে গেল।
.
০৪.
স্নান-টান সেরে তপতী সোমাকে খাবার ঘরে নিয়ে এল। এ ঘরটাও বেশ বড়সড়। মাঝখানে প্রকাণ্ড টেবল। টেবলটাকে ঘিরে সিংহাসনের মতন অনেকগুলো চেয়ার। মাথার ওপর নাইনটিন ফরটি মডেলের ফ্যান ঘুরছে।
সোমারা আসবার আগেই দোলন ঝুলন পিন্টু এবং মৃন্ময় ডাইনিং রুমে এসে বসে ছিল। তপতীর মা-ও ছিলেন ও ঘরে।
তপতীদের দেখেই মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, তোদের জন্যে ঝাড়া একটি ঘন্টা বসে আছি। তাড়াতাড়ি বসে পড় বাপু। খিদেয় পেট চুঁই ছুঁই করছে।
বসতে বসতে তপতী বলল, আমাদের জন্যে বসে থাকতে কে বলেছিল? তুমি খেয়ে নিলেই পারতে
খেয়ে নেব! বেশ বলেছিস! বাড়িতে গেস্ট আছে না–
ও বাবা-তপতী চোখ গোল করল। ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, তুমি এত ফর্মালিটি-টর্মালিটি কবে থেকে মানতে শুরু করেছ?
মৃন্ময় দুই হাত চিত করে কাঁধ ঝাঁকাল, ফর্মালিটির ধার ধারতে আমার বয়েই গেছে। আমি তো খেতেই চেয়েছিলাম–ফুলমাসি দিল না যে। বলল, তোর বন্ধু কী ভাববে–
সোমার মুখ লাল হয়ে উঠল।
তপতীর মা হাসতে হাসতে উঠে পড়লেন, ভাববেই তো। আচ্ছা তোরা একটু বোস, আমি ভাতটাত নিয়ে আসি।
একটু পর খাবার-টাবার এসে গেল। টেবল চেয়ারে সাহেবি ব্যাপার কিন্তু খাওয়াটা একেবারে দিশি মতে। বড় বড় কঁসার থালা এবং বাটিতে ভাত-মাছ ডাল-তরকারি সাজিয়ে দিলেন তপতীর মা। একটা বেহারি ঠাকুর হাতের কাছে সব যুগিয়ে তাকে সাহায্য করতে লাগল।
সবাইকে খেতে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন তপতীর মা। কার পাত খালি হয়ে যাচ্ছে, কার কী দরকার, লক্ষ্য রাখতে লাগলেন।
সোমা খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে তপতীর মাকে দেখছিল। ইচ্ছা করে যে দেখছিল তা নয়, তপতীর মা দুরন্ত আকর্ষণে যেন তার চোখ দুটিকে নিজের দিকে টেনে রাখছিলেন।
তপতীর মা হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন। বললেন, আমায় কিছু বলবে সোমা?
না মাসিমা–সোমা মাথা নাড়ল, আমি আপনাকে দেখছি।
আমাকে দেখছ! তপতীর মা অবাক।
হ্যাঁ, আপনার মতন সুন্দর মানুষ আমি আর কখনও দেখিনি মাসিমা।
তপতীর মা লজ্জা পেয়ে গেলেন, তার কান আরক্ত হল, কী যে বলো!
তপতী ওধার থেকে বলে উঠল, জানিস সোমা, আমরা কেউ মার সঙ্গে কখনো রাস্তায় বেরুই না।
সোমা বিমুড়ের মতন জিগ্যেস করল, কেন?
লোকে বিশ্বাসই করতে চায় না আমরা এই মায়ের ছেলেমেয়ে। সবাই ভাবে সুন্দর বউটা কোত্থেকে কাকের ছানা বকের ছানা জোটাল।
দোলন চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিল। ফস করে বলল, সেবার নতুন এসপি. সাহেবের স্ত্রী আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। দিদি কলকাতায় ছিল, দাদা পাটনায়। আমাকে আর ঝুলনকে দেখিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, এরা কারা? মা বলল আমার মেয়ে। ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, তোমার নিজের ছেলেমেয়ে, না সতীনের?
তপতীর মা বিব্রত মুখে বললেন, মেয়েদের কথা শোনো!
দোলন বলল, মেয়েরা ঠিক কথাই তো বলছে
তপতীর মা বললেন, কী ভালো লাগছে রে?
এই যে সবাই মিলে তোমার রূপের এত প্রশন্তি গাইছে। দেমাকে নিশ্চয়ই খুব ফুলে যাচ্ছ।
ধমক দিতে গিয়ে হেসে ফেললেন তপতীর মা, চুপ কর হনুমান
সোমার মনে হল, ভদ্রমহিলা রাগ করতে জানেন না।
একটু নীরবতা। তারপর তপতীর মা সোমাকে বললেন, বাঁদরগুলো সমানে জ্বালাচ্ছে। তোমার সঙ্গে কথাই বলতে পারছি না মা। তপীর চিঠিতে জেনেছি তোমরা লক্ষ্ণৌতে থাকো। কদ্দিন আছ ওখানে?
সোমা বলল, অনেকদিন। প্রায় দু-পুরুষের মতন। আমার ঠাকুরদা তার পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে ওখানে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেই থেকেই আছি।
ওখানে বাড়ি-টাড়ি করেছ?
হ্যাঁ।
বাবা-মা?
আছেন।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সোমাদের বাড়ির অনেক খবর নিলেন তপতীর মা। তারপর বললেন, তোমারা কভাইবোন?
দুই ভাই, দুই বোন। আমি সবার ছোট।
অন্য ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
ওধার থেকে তপতী বলল, সোমার বিয়ের জন্যেও তো লক্ষ্ণৌ থেকে ওর বাবা-মা তাড়া দিচ্ছেন। ও কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না।
তপতীর মা বললেন, তা তো দেবেনই। মেয়ে যত লেখাপড়াই শিখুক আর যা-ই করুক, বিয়ে দিতে না পারলে কোনও বাপ মা-ই নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তারপর সোমাকে বললেন, তোমার বাবা-মা তো বললে বেশ অসুস্থ
হ্যাঁ-আবছা গলায় সোমা উত্তর দিল।
বিয়েটা করে ফেলো মা। যে বয়সের যা, জীবনে ওটা প্রয়োজন।
সোমা চুপ করে রইল। শুধু দুর থেকে মৃন্ময় লক্ষ্য করল, মুখটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেছে সোমার। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। সে অনুমানও করতে পারল না, এই মুহূর্তে সোমার রক্ত মাংসে কী দারুণ যুদ্ধ চলছে।
হঠাৎ মৃন্ময় বলল, তুমি কী ফুলমাসি!
কেন, কী! মৃন্ময়ের বলার ধরনে তপতীর মা চমকে উঠলেন।
নিজেরা তো বিয়ে-টিয়ে করে ল্যাজ কেটে বসে আছ। আবার অন্যের ল্যাজও কাটাতে চাইছ। কেন বাপু, আজাদি চিড়িয়া আকাশে উড়ছে, তাকে উড়তেই দাও না
তপতীর মা চোখ পাকালেন, তোর ল্যাজও এবার কাটাব। আজাদি চিড়িয়া হয়ে সারা জীবন উড়ে বেড়াবি, সেটি হবে না।
দোলনের পাশ থেকে ঝুলন দুম করে বলে বসল, মৃন্ময়দার ল্যাজ তত একবার কাটা গিয়েছিল।
পলকে সমস্ত ঘরটার হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য সবাই যেন বোবা।
ওদিকে হাজার হাতে এলোপাথাড়ি কালি ছুঁড়ে কেউ যেন মৃন্ময়ের মুখটা একেবারে বিকৃত কদর্য করে দিল। তার চোখের ওপর ধূসর সরের মতন কী পড়েছে। হাত-পা-ঠোঁট অসহ্য কঁপছিল। এক মিনিটও না। তারপরেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে হেসে উঠল মৃন্ময়, ঠিক বলেছিস ঝুলন। ল্যাজ কাটার কথাটি আমার একদম মনে থাকে না। সবসময় হইচই করে কাটাই তো বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল মৃন্ময়, কিন্তু যেই একলা হই, টের পাই সেই কাটার ঘাটা—
তপতীর মা ধমকে উঠলেন, চুপ কর, যত সব আজে বাজে কথা
মৃন্ময় হাসতে লাগল; ঠিক আছে ফুলমাসি, এই মুখে চাবি দিলাম। তুমি তো আবার ওই ব্যাপারটা পছন্দ করো না। বলেই ঘাড় গুঁজে বড় বড় গ্রাস মুখে পুরতে লাগল মৃন্ময়।
খেতে খেতে থমকে গিয়েছিল সোমা। সে মৃন্ময়ের দিকে তাকাল, তাকিয়েই থাকল। মনিহারি ঘাটে আলাপ-টালাপ হবার পর এই প্রথম মৃন্ময়কে স্থির পলকহীন চোখে দেখল সোমা। একবার তার ইচ্ছা হল, তপতীকে জিগ্যেস করে মৃন্ময়ের ব্যাপারটা জেনে নেয়। পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে একজন অধ্যাপিকা, গেঁয়ো মেয়েদের মতন কৌতূহল তার অন্তত শোভা পায় না।
হঠাৎ কি মনে পড়তে দ্রুত মুখ তুলল মৃন্ময়, ফুলমাসি, মেসোকে তো দেখছি না।
তপতীও প্রায় একই সুরে বলল, বাবা কোথায় মা?
তপতীর মা বললেন, আর কোথায়, সকালবেলা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে সাইকেলে করে যেখানে যান।
বা রে-আদুরে কিশোরীর মতন মুখ ভার করল তপতী, আমারা যে আসব বাবা জানে না?
তপতীর মা বললেন, জানে বইকি-
তবে বাড়িতে থাকল না যে?
নেশা। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়া চাই।
তুমি থাকতে বললে না কেন?
বলেছিলাম তো। তোর বাবা বললে তপীরা এসেই তো আর চলে যাচ্ছে না।
সন্ধেবেলা দেখা হবেখন।
সোমা কী ভাবল বলো তো?
সোমা ওপাশ থেকে বলে উঠল, রোজ সকালেই বেরিয়ে যান মেসোমশাই?
রোজ–তপতীর মা হাসলেন।
কোথায় যান?
বদ-বাদাড়ে–
কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতন তাকিয়ে থাকল সোমা, তপতীর বাবার সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করল না।
কথায় কথায় খেয়াল ছিল না। হঠাৎ সোমার পাতের দিকে তাকিয়ে তপতীর মা বলে উঠলেন, এ কী মা-তুমি কিছুই তো খাওনি! সব পড়ে আছে।
না না, অনেক খেয়েছি।
তোমাকে আর দুখানা ঝালের মাছ দিই—
দুহাত দিয়ে পাত ঢেকে সোমা ভয়ের গলায় বলল, আমার পাতে প্রথমেই যা দিয়েছেন তা আমার তিনবেলার খাবার। তার ওপর আবার যদি দ্যান মরেই যাব মাসিমা।
তুমি লজ্জা করছ না তো মা?
টেবিলের শেষ মাথা থেকে ধাঁ করে মৃন্ময় বলে বসল, পেট ভরে না খেলে নিজেই কষ্ট পাবে; আমাদের কী–
সোমার চোখ ঈষৎ কুঁচকে গেল। মৃন্ময়ের দিকে না তাকিয়ে তপতীর মাকে বলল, লজ্জা করব কেন? আমি কতটা খাই তপতীকেই জিগ্যেস করুন না—
নাঃ, কিছুই খেতে পারো না দেখছি–তপতীর মা হাল ছেড়ে দিলেন।
মৃন্ময় আচমকা আবার মন্তব্য করল, একেবারে পক্ষীর আহার। খাবেন এইটুকু, রাত্তিরে ইনসমনিয়া–আছেন ভালো।
একটু আগে ওদের কথাবার্তা শুনে সোমার মনে হয়েছিল মৃন্ময়ের জীবনে কোথাও দুঃখ আছে। নিজের অজান্তেই খানিকটা সহনুভূতি বোধ করেছিল। এই মূহুর্তে তার মুখ আবার শক্ত হয়ে উঠল। লোকটার রুচিহীনতা অসহ্য।