আলোর নেশা

আলোর নেশা

আমরা ‘আরও আলো’, ‘আরও আলো’ করিয়া গ্যেটের মতো খুঁজিয়া বেড়াইতেছি; কিন্তু হঠাৎ তীব্র আলোর সাক্ষাৎকার ঘটিলে চট্‌ করিয়া চোখ বুজিয়া ফেলি। অনাবৃত আলোকের উগ্র দেবসুরা আকণ্ঠ পান করিতে পারি না; নেশা হয়, টলিতে টলিতে আবার নর্দমার অন্ধকারে হোঁচট খাইয়া গিয়া পড়ি। আলোকের ঝরনা-ধারায় ধৌত হইবার প্রস্তাবটা মন্দ নহে, কিন্তু ঝরনার তোড়ে ডুবিয়া মরিবার আশঙ্কা আছে কি না, সে দিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত।

একরাশ এলোমেলো উপমার মধ্যে আসল কথাটা জট পাকাইয়া গেল। ইহাকেই বলে ধান ভানিতে শিবের গীত।

পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত প্রণয়-ব্যাপার ঘটিয়াছে, অন্তত যে-সব প্রণয় ব্যাপারের লিপিবদ্ধ ইতিহাস আছে, তাহা আলোচনা করিলে দেখা যায়, পনের আনা ক্ষেত্রে নায়ক নায়িকাকে কোনও বিপদ হইতে উদ্ধার করিবার ফলে উভয়ের মধ্যে প্রণয়-বীজ অঙ্কুরিত হইয়াছে। এই প্রথাটির অনেক সুবিধা আছে,—এক ঢিলে অনেকগুলি পাখি মারা যায়। নায়ক বীর, নায়িকা কোমলাঙ্গী, ইত্যাদি অনেক ভাল ভাল কথা একসঙ্গে বলা হইয়া যায়। তাই, আমারও লোভ হইতেছে যে, এই চিরাচরিত সুন্দর প্রথাটিকে অবলম্বন করিয়া গল্প আরম্ভ করি। কিন্তু একটা বড় প্রতিবন্ধক রহিয়াছে। অন্য সময় যাহা খুশি বলিতে পারি, কিন্তু গল্প বলিতে বসিয়া নিছক সত্য কথা বলিতেই হইবে, এমন কি, রসের রসান পর্যন্ত দেওয়া চলিবে না, ইহাই আধুনিক সাহিত্যকলার নব-ন্যায়। সুতরাং সত্যের খাতিরে স্বীকার করিতে হইতেছে যে, উপস্থিত ক্ষেত্রে নায়িকাই নায়ককে (প্রথম বিপদে ফেলিয়া) বিপদ হইতে উদ্ধার করিয়াছিল।

নায়কের নাম হারাণ। হারাণ নাম শুনিয়া ঘৃণায় শিহরিয়া উঠিবেন না। সে বাঙালী যুবক-সম্প্রদায়ের মূর্তিমান নমুনা,—অর্থাৎ তাহাকে দেখিলেই বাঙালী যুবক বলিতে কি বুঝায়, তাহা মোটামুটি আন্দাজ করিয়া লওয়া যায়। সে কলেজে পড়ে, সে রোগা ও কালো, লম্বাও নহে, বেঁটেও নহে। সে বুদ্ধিমান, কিন্তু বুদ্ধির লক্ষণ মুখে কিছু প্রকাশ পায় না। মুখখানি ঈষৎ শীর্ণ, চোখে একটা অস্বচ্ছন্দ সঙ্কোচের ভাব; কখনও কখনও আঘাত পাইয়া তাহা রূঢ়তার শিখায় জ্বলিয়া উঠে। বাঙালীর মজ্জাগত অভিমান— sensitiveness— চারিদিক হইতে খোঁচা খাইয়া যেন একই কালে ভীরু এবং দুঃসাহসী হইয়া উঠিয়াছে। শিক্ষার ধারা যে পথে গিয়াছে, সহবৎ সে পথে যাইতে পারে নাই—তাই মনটা তাহার আশ্রয়হীন নিরালম্ব হইয়া আছে।

হারাণ মেসে থাকিয়া কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ে। বয়স কুড়ি। তাহার বাবা গোয়ালন্দ জাহাজ অফিসের হেডক্লার্ক। হারাণ বি. এ. পাস করিলেই বাবার অফিসে ঢুকিবে এইরূপ একটা কথা স্থির হইয়া আছে।

কিন্তু তাই বলিয়া সে লেকে বেড়াইতে যাইবে না, এমন কোনও কথা নাই। আমি জোর করিয়া বলিতেছি, সে লেকে বেড়াইতে গিয়াছিল এবং সন্ধ্যার পর বৃষ্টিতে ভিজিয়া ঢোল হইয়া বাসায় ফিরিতেছিল। সঙ্গে ছাতা ছিল না।

ইহার অপেক্ষাও পরিতাপের বিষয়, তাহার পকেটে পয়সা ছিল না। আষাঢ় মাসের সন্ধ্যায় হাতে ছাতা ও পকেটে পয়সা না লইয়া যে ব্যক্তি পথে বাহির হয়, তাহার মতো ‘নিরেট’ পৃথিবীতে আর কয়জন আছে? তবে সত্য কথাটা বলিতেই হইল। হারাণের বাবা তাহাকে মাসে মাসে ত্রিশ টাকা করিয়া পাঠাইতেন বটে, কিন্তু তাহার ছাতা ছিল না। ছাতাটা গত বর্ষায় ছিঁড়িয়া ব্যবহারের অনুপযোগী হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাই বলিয়া সে লেকে বেড়াইতে যাইবে না? এ যে বড় অন্যায় কথা!

জলে ভিজিয়া হারাণের চেহারা হইয়াছিল একটি সিক্ত মার্জারের মতো। সে চুপসিয়া একেবারে আধখানা হইয়া গিয়াছিল—কাপড় ও কামিজ গায়ে জুড়িয়া গিয়াছিল, জুলপি হইতে জল গড়াইয়া চিবুক বহিয়া ঝরিয়া পড়িতেছিল। বৃষ্টি তখনও থামে নাই, তবে বেগ অনেকটা কমিয়াছিল; তাহারই মধ্যে দিয়া ভিজা ভারী জুতায় নানাবিধ শব্দ করিতে করিতে সে চলিয়াছিল।

কিন্তু যাইতে হইবে অনেক দূর—শহরের অন্য প্রান্তে। একটা রিকশ’য় ঝুনঝুনি পর্যন্ত কোথাও শুনা যাইতেছিল না। যে পথ দিয়া হারাণ চলিয়াছিল, সেটা সাধারণত একটু নির্জন, এখন বৃষ্টির প্রভাবে একবারে জনশূন্য হইয়া গিয়াছিল।

একটা ছোট চৌমাথা পার হইতে গিয়া তাহার বিপদ উপস্থিত হইল। রাস্তার মাঝামাঝি পৌঁছিতেই পিছন হইতে মোটর-হর্নের অধীর চিৎকার শুনিয়া সে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, মোটরখানা তাহার অত্যন্ত কাছে আসিয়া পড়িয়াছে। তাড়াতাড়ি সরিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেই পা পিছলাইয়া গেল, সে চিৎ হইয়া ভূমি-শয্যা গ্রহণ করিল।

মোটর-চালক ঠিক সময়ে মোটর রুকিয়া ফেলিল বটে, কিন্তু স্কিড্‌ করিয়া গাড়িখানা প্রায় গজ দুই অগ্রসর হইয়া গেল। চিৎ-পতিত হারাণ দেখিল, সে মোটরের তলায় বিরাজ করিতেছে।

মোটরের ভিতর হইতে একটি ভয়সূচক ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনা গেল। গাড়ির আরোহিণী চালকের আসন হইতে নামিয়া আসিয়া দেখিল, হারাণ সরসীসৃপের মতো কোনও প্রকারে মাথাটি গাড়ির তলা হইতে বাহির করিয়া সম্মুখের নম্বর প্লেটের পানে বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো তাকাইয়া আছে।

গাড়ির সোফার এতক্ষণে নিঃশব্দে নিজের ন্যায্য স্থানে আসিয়া বসিয়াছিল, আরোহিণী বিপন্নকণ্ঠে তাহাকে ডাকিল, ‘প্যারে, জলদি আও।’

প্যারে ও আরোহিণী দু’জনে মিলিয়া নম্বর প্লেট পাঠনিরত হারাণকে তলা হইতে টানিয়া বাহির করিল। হারাণের লাগে নাই, সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিজ্‌ বিজ্‌ করিয়া বলিল, ‘থ্রি সেভন নাইন ফোর টু।’

আরাহিণী ও সোফার মুখ-তাকাতাকি করিল। সোফার ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিল, পুলিস বা অন্য কেহ কোথাও নাই। সে পুনর্বার গাড়িতে উঠিয়া স্টার্ট দিল।

আরোহিণী কিন্তু ইতস্তত করিতে লাগিল, একটা লোককে চাপা দিয়া নির্বিকার চিত্তে প্রস্থান করিতে বোধহয় বিবেকে বাধিল। সোফার জাতীয় জীবের বিবেক বলিয়া কিছু নাই।

আরোহিণী জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার লাগেনি তো?’

হারাণ চমকিয়া উঠিল; দেখিল, একটি নব-যুবতী তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভিজিতেছে। সে যেন আঁৎকাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘অ্যাঁ! না না, লাগেনি।’ তারপর আর কোনও কথা ভাবিয়া না পাইয়া বলিল, ‘থ্রি সেভন নাইন ফোর টু।’

নব-যুবতীর মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়িল, সে বলিল, ‘আপনি আমার সঙ্গে আসুন, আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।’

হারাণ বলিল, ‘না না, দরকার নেই—’

এই সময় বিবেকহীন সোফারটা দূরে একজন লোক আসিতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলিয়া বলিল, ‘আইয়ে বাবু, জল্‌দি ভিতরে আইয়ে!’

তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো হারাণ গাড়ির ভিতর গিয়া বসিল, নব-যুবতীটি তাহার পাশে বসিল। গাড়ি ছাড়িয়া দিল। হারাণ মনে মনে ‘না না না’ বলিতেছিল, কিন্তু তাহা কেহ শুনিতে পাইল না।

নব-যুবতী সোফারকে বলিল, ‘ঘর চলো। তারপর হারাণের দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি ঠিক বলছেন আপনার লাগেনি?’

হারাণ সজোরে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না।’

যুবতী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক, তবু ভাল। আমার এমন ভয় হয়েছিল—’

কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না; হারাণের অঙ্গ নির্গলিত জল মোটরের ভিতরটা ক্লেদাক্ত করিয়া তুলিল! হারাণ কাঠের মতো শক্ত হইয়া রহিল।

যুবতী জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনার বাড়ি কোন্‌ দিকে?’

হারাণ বাসার ঠিকানা দিল; যুবতী বলিল, ‘আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে প্যারে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেবে।’ তারপর হঠাৎ হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, ‘আপনি এমন হঠাৎ পড়ে গেলেন যে, গাড়ি থামানো গেল না। আচ্ছা, কে মোটর চালাচ্ছিল আপনি দেখেছিলেন কি?’

হারাণ মাথা নাড়িল, এ প্রশ্নের মানেই বুঝিতে পারিল না।

গাড়ি আসিয়া চক্ৰবেড়ে রোডের কাছাকাছি একটা বড় বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইল। বাড়ির ঘরে ঘরে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলিতেছে। যুবতী নামিয়া পড়িয়া বলিল, ‘আচ্ছা, আপনাকে তাহলে পৌঁছে দিক—’

হারাণও নামিবার উপক্রম করিতেছিল, যুবতী বলিল, ‘না না, আপনি নামবেন না, please! প্যারে, বাবুকো মোকাম পৌঁছাও।’ তারপর গাড়ির মধ্যে গলা বাড়াইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, I am very Sorry for the accident—I hope you understand? —আচ্ছা— Good night!’ বলিয়া একবার নড্‌ করিয়া দ্রুত পদে গৃহে প্রবেশ করিল। বৃষ্টি এ-দিকটায় তখন থামিয়া গিয়াছিল।

যথাসময়ে হারাণ মোটর চড়িয়া বাসায় গিয়া পৌঁছিল।

অতঃপর হারাণের মনের ভাব যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করিতে আরম্ভ করা যায়, তাহা হইলে এ কাহিনী শেষ করিবার দুরাকাঙক্ষা ত্যাগ করিতে হয়। হিমাদ্রিশৃঙ্গে যেদিন অকস্মাৎ আসন্ন আষাঢ় নামিয়া আসে সেদিন শিলাসঙ্কীর্ণ পথে রুদ্ধবেগে স্রোতস্বিনীর কিরূপ অবস্থা হয়, তাহার যথার্থ বিবরণ দান করা সকলের কর্ম নহে। আমি কেবল এইটুকু বলিয়াই ক্ষান্ত হইব যে হারাণ সে রাত্রিটা জাগিয়াই কাটাইয়া দিল।

পরদিন বেলা প্রায় সাড়ে নয়টার সময় একটি ভদ্রলোক মেসে তাহার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। ইংরাজী বেশে সুসজ্জিত মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, চাল-চলনে একটা গাম্ভীর্য ও গুরুত্ব আছে; তাঁহাকে দেখিয়াই হারাণ সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। হারাণ তখন স্নান করিয়া চুল আঁচড়াইতেছিল, ভদ্রলোক পাঁশনে চশমার ভিতর দিয়া তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, ‘আপনিই কাল রাত্রে মোটর চাপা পড়েছিলেন? আমার মেয়ে মিন্টু গাড়িতে ছিল, তারই মুখে শুনলুম। আমার নাম শ্ৰীহেমেন্দ্র নাথ ভট্ট!’

ঘরে একটি মাত্র চেয়ার ছিল, হারাণ তাড়াতাড়ি তাহা অগ্রসর করিয়া দিল। হেমেন্দ্রবাবু তাহাতে উপবেশন করিয়া কার্ডকেস হইতে কার্ড বাহির করিয়া হারাণের হাতে দিয়া বলিলেন, ‘আমাকে বোধ হয় আপনি চেনেন না।’ তাঁহার কণ্ঠস্বরে একটু কৃপার আভাস পাওয়া গেল।

হারাণ কার্ড পড়িয়া দেখিল, হেমেন্দ্রবাবু বড় কেও-কেটা নন, হাইকোর্টের একজন মস্ত চাকরে; বোধ হয় দুই-আড়াই হাজার টাকা মাহিনা পান। হারাণ কার্ডখানি সসম্ভ্রমে হাতে ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। হেমেন্দ্রবাবু গম্ভীর মুখে বলিলেন, ‘কালকের ঘটনা যে রকম শুনলুম, তাতে আপনারই দোষ দেখা যাচ্ছে।’

হারাণের বুক ঢিব-ঢিব করিয়া উঠিল। যে দোষী তাহারই দণ্ড হইয়া থাকে, হেমেন্দ্রবাবু হাইকোর্টের মস্ত বড় লোক, তবে কি তিনি হারাণের দণ্ডবিধানের জন্যই আসিয়াছেন?

হেমেন্দ্রবাবু পুনশ্চ বলিলেন, ‘এ রকম বেপরোয়াভাবে পথচলা উচিত নয়, সকলেরই সিভিক-ডিউটি আছে। (হারাণ স্পন্দিত-বক্ষে ভাবিল—সিভিক-ডিউটি কাহাকে বলে?) ভবিষ্যতে সাবধান হয়ে পথ চলবেন।’

হারাণ ক্ষীণস্বরে বলিল, ‘যে আজ্ঞে।’

হারাণকে পুরাদস্তুর ভয় পাওয়াইয়া হেমেন্দ্রবাবু ঈষৎ সদয়কণ্ঠে বলিলেন, ‘যা হোক, আপনার যে আঘাত লাগেনি এই যথেষ্ট। আমার মেয়ে মিন্টু একটু চিন্তিত হয়েছিল, সেই আমাকে আপনার খোঁজ-খবর নিতে পাঠালে। আপনার নামটি কি? বাষ্পরুদ্ধ-স্বরে হারাণ বলিল, ‘শ্রীহারাণচন্দ্র লাহিড়ী।’

হেমেন্দ্রবাবু গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, ‘কের্টে যাব বলে তৈরি হয়ে বেরিয়েছি, on the way আপনাকে দেখে গেলুম।’ তারপর লৌকিক শিষ্টাচার অনুযায়ী বলিলেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভারী খুশি হলাম,—আমার বাড়িতে যদি কখনও যান, আরও খুশি হব।’ বলিয়া আঙুল তুলিয়া অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন।

তারপর কি হইল? এইখানেই তো এ ব্যাপার শেষ হইবার কথা। গরুর গাড়ির চাকার সহিত দৈবক্রমে পুষ্পক-রথের মার্ড্‌-গার্ডের ছোঁয়াছুঁয়ি হইয়াছিল, তাহাতে গরুর গাড়ির তো জখম হইবার কথা নহে। অথচ—

ফিল্‌-আপ্‌-দি-ব্ল্যাঙ্কস্ নামক যে ধাঁধার সৃষ্টি করিয়া পরীক্ষকবৃন্দ ছাত্রদের ঠকাইয়া থাকেন, সেইরূপ একটি ধাঁধার অবতারণা এখানে করা দরকার। কারণ হারাণের ন্যায় লোকের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করার মতো ক্লান্তিকর কাজ আর নাই। মৌখিক শিষ্টাচার ও আন্তরিক নিমন্ত্রণে কি তফাৎ তাহা হারাণ বুঝিত না; অবশ্য বিজ্ঞ ব্যক্তিও যে সব সময় ধরিতে পারেন না, এ কথাও স্বীকার করিতে হইবে। ধমক দিয়া ফরিয়াদীকে আসামী করা যায়, এ তত্ত্বও সকলের সুবিদিত নহে। তাহার উপর, যে নব-যুবতীটির নাম মিন্টু সে হারাণের জন্য চিন্তিত হইয়াছিল, ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে। এক দিকে সঙ্কোচ-জড়তা— inferiority complex, অপর দিকে দুর্নিবার্য্য বাসনা, এই দুই পক্ষে দেব-দানবের দড়ি টানাটানি;—এক কথায় হারাণের মনস্তত্ত্বরূপ নীরস সমস্যার পাদপূরণের ভার পাঠকের হতে অর্পণ করিয়া আমরা পুরা এক সপ্তাহ কাটাইয়া দিলাম।

এক সপ্তাহ পরে একদিন বৈকালে হারাণ গুটি গুটি হেমেন্দ্রবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইল। বুকের ধড়ফড়ানি চাপিয়া দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাবু কোথায়?’

দারোয়ান অফিস-ঘর দেখাইয়া দিল। হারাণের ইচ্ছা হইল, এখান হইতেই পলায়ন করে; আর পা উঠিতেছিল না। তবু সে জোর করিয়া অফিস-রুমে ঢুকিয়া হেমেন্দ্রবাবুকে একটা নমস্কার করিয়া দাঁড়াইল।

হেমেন্দ্রবাবু চিনিতে না পারিয়া ঈষৎ ভ্রুকুটি করিলেন; প্রথমটা ভাবিলেন, তাঁহার অফিসের কোনও ছোকরা কেরানী, হয়তো কোনও বিপদে পড়িয়া তাঁহার শরণাপন্ন হইয়াছে। তারপর হঠাৎ চিনিতে পারিয়া বলিলেন, ‘ও! You are the young man whom—, মনে পড়েছে। তারপর খবর কি? বসুন।’

হেমেন্দ্রবাবু একটু অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলেন। মিন্টুর অবৈধ গাড়ি চালানোর ফলে যে ক্ষুদ্র ঘটনার উৎপত্তি হইয়াছিল, তাহা সম্পূর্ণরূপে মিটিয়া গিয়াছে মনে করিয়া তাহার হিসাব তিনি মন হইতে মুছিয়া ফেলিয়াছিলেন। এখন হারাণকে পুনরায় আবির্ভূত হইতে দেখিয়া তিনি অবিলেন,—‘আবার কি হল?’

হারাণ উপবিষ্ট হইলে দু’একটা সাধারণ কথার পর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি খবর বলুন তো? আমার সঙ্গে কি কোনও দরকার আছে?’

একটা কোনও দরকারের কথা আবিষ্কার করিতে পারিলে বোধ করি হারাণ বাঁচিয়া যাইত; সে সঙ্কুচিত হইয়া ক্ষীণস্বরে বলিল, ‘না—আমি এমনি দেখা করতে এসেছি।’

‘Social call! ও—তা বেশ বেশ’,—মুখে উৎফুল্লতার ভাব আনিয়া হেমেন্দ্রবাবু দ্বিধাভরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, ‘আসুন, ড্রয়িং রুমে গিয়া বসা যাক।’ বলিয়া পাশের দরজা দিয়া হারাণকে একটি চমৎকার সুসজ্জিত কক্ষে লইয়া গেলেন।

ড্রয়িং-রুমে মিন্টু বাহিরে যাইবার জন্য সাজিয়া-গুজিয়া বসিয়াছিল, হেমেন্দ্রবাবু কন্যাকে সম্বোধন করিয়া একটু অস্বাচ্ছন্দ্যের হাসি হাসিয়া বলিলেন, ‘মিন্টু, দেখ তো এঁকে চিনতে পার কি না?’ আসলে হারাণের নামটা তিনি কিছুতেই স্মরণ করিতে পারিতেছিলেন না।

পিতার চেয়ে মিন্টুর স্মরণশক্তি বেশী, সে তাহার সহাস্য চোখ দুটি তুলিয়া বলিল, ‘চিনেছি বৈ কি, উনি তো হারাণবাবু!’

হারাণ একটা অনভ্যস্ত আড়ষ্ট নমস্কার করিল। সকলে উপবিষ্ট হইলেন। শিক্ষা ও আবহাওয়ার গুণে মিন্টু বাহিরে একটু চপল ও তরলস্বভাব হইয়া পড়িলেও তাহার মনের ভিত্তিটা সরল ও সাদাসিধাই রহিয়া গিয়াছিল। আলোর সমুদ্রে সে মনের সুখে সাঁতার কাটিতেছিল, নিম্নের অতলে যে সব দংষ্ট্রাকরাল ক্ষুধিত জীব ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় তখনও হয় নাই। সে ভারী সুন্দরী, সবেমাত্র আঠারোয় পা দিয়াছে; রূপ, যৌবন, শিক্ষা, মিষ্ট স্বভাব, ধনী বাপ ইত্যাদি নানা কারণে মিলিয়া সে উচ্চ সমাজের মধ্যে পরম লোভনীয় belle-এর আসনে অধিষ্ঠিত হইবার উপক্রম করিতেছিল।

হারাণের সঙ্গে সে বেশ সহজ সহৃদয়তার সঙ্গেই কথা আরম্ভ করিল, কিন্তু হারাণ এমন মূক বধির প্রাণীর মতো বসিয়া রহিল যে, শেষ পর্যন্ত তাহাকে থামিয়া যাইতে হইল। হারাণ অনেক চেষ্টা করিয়াও না পারিল তো ভাল করিয়া মিন্টুর মুখের পানে চাহিতে, না পারিল গুছাইয়া দুটা কথা বলিতে। হাঁ—না—এই একাক্ষর শব্দ দুটা ছাড়া তাহার মুখ দিয়া আর বিশেষ কিছু বাহির হইল না। অথচ গত সাত দিন ধরিয়া সে কতই না সঙ্কল্প করিয়াছিল।

মিনিট পনের পরে হেমেন্দ্রবাবু আলস্যভরে একটা হাই চাপিয়া উঠিবার উপক্রম করিতেই হারাণও চমকাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘আমি তাহলে আজ—’

মিন্টুও উঠিয়া দাঁড়াইয়া স্মিতমুখে বলিল, ‘চললেন? আচ্ছা, আবার আসবেন।’

হারাণ ঘাড় নাড়িয়া একটা নমস্কার করিয়া তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

সে চলিয়া যাইবার পর পিতা ও কন্যা কিছুক্ষণ পরস্পর মুখের দিকে তাকাইয়া রহিলেন, তারপর হেমেন্দ্রবাবু মুখের একটা ভঙ্গি করিয়া বিরসকণ্ঠে বলিলেন, ‘Poor fellow! He was out of his depth here. I wonder why he came.’

মিন্টু হাসিয়া বলিল, ‘জড়ভরত গোছের লোক—না? এই জন্যেই বোধ হয় সেদিন মোটর চাপা পড়েছিল।’

হেমেন্দ্রবাবু বলিলেন, ‘বুদ্ধি-সুদ্ধি বিশেষ আছে বলে তো বোধ হয় না। বললে বি. এ. পড়ে; পড়ে হয়তো। কিন্তু কি যে পড়ে তা ভগবানই জানেন।’ বলিয়া উদাসভাবে হাতটা উল্টাইলেন।

মিন্টু কব্জির ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘বাবা, আমি চললুম, আমার already দেরি হয়ে গেছে। ছ’টার আগে মিসেস সিনহার বাড়িতে পৌঁছুবার কথা।’

হেমেন্দ্রবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘একলা যাচ্ছ? তোমার মা যাবেন না?

‘মা’র মাথাটা ধরেছে, তিনি যেতে পারবেন না।’ সকৌতুকে ভ্রূ তুলিয়া কহিল, ‘আমার কি আবার স্যাপেরোণ দরকার না কি? বাবা, তুমি দিন দিন একদম সেকেলে হয়ে যাচ্ছ।’

হেমেন্দ্রবাবু কন্যার চেহারাখানি একবার আগাগোড়া নিরীক্ষণ করিয়া একটু গম্ভীর হইয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা যাও, কিন্তু নিজে ড্রাইভ করো না যেন। একে তোমার লাইসেন্স নেই, তার ওপর আবার কোন্‌ হারাণকে চাপা দিয়ে বসে থাকবে।’

মিন্টু হাসিয়া বলিল, ‘ভয় নেই, একটি হারাণকে চাপা দিয়েই আমার শিক্ষা হয়ে গেছে।’

ওদিকে বুদ্ধিহীন এবং জড়ভরত হারাণের অবস্থা আরও কাহিল হইয়া পড়িয়াছিল। মিন্টুকে সে মুখ তুলিয়া দেখে নাই বটে, কিন্তু দু’ একবার আড়চোখে যতটুকু দেখিয়াছিল তাহাতেই তাহার সর্বনাশ সম্পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। প্রবল স্রোতের টানে অপটু সন্তরণকারী যেমন কখনও ভাসিতে ভাসিতে, কখনও ডুবিতে ডুবিতে বহিয়া যায়, সেও তেমনই অসহায়ভাবে ভাসিয়া চলিল। একূল ওকূল কোনও কূলেই যে সে কোনও দিন উঠিতে পারিবে এমন আশা রহিল না।

হারাণ হেমেন্দ্রবাবুর বাড়ি রীতিমত যাতায়াত আরম্ভ করিল; কোনও হপ্তায় দু’ বারও যাইতে লাগিল। কিন্তু তবু তার মুখে ভাল করিয়া কথা ফুটিল না। সে মুগ্ধের মতো—মূঢ়ের মতো ড্রয়িং-রুমে বসিয়া থাকিত; মিন্টুর হাসি-কথা শুনিত। যখন অন্য লোক কেহ থাকিত তখন সে দ্বিগুণ অস্বচ্ছন্দতা অনুভব করিত, সুবিধা পাইলে পলাইয়া আসিত। তাহাকে লইয়া অন্য সকলের মধ্যে যে নেপথ্যে মুচ্‌কি হাসি ও চোখ-টেপাটিপি চলিত তাহা দেখিবার মতো চক্ষু তাহার ছিল না। বস্তুত এই একান্ত অপরিচিত সমাজের লোকেরা তাহাকে কি চক্ষে দেখে, তাহা সে কোন দিন ভাবিয়া দেখে নাই, বুঝিতেও পারে নাই।

কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সে মাঝে মাঝে ঈর্ষার তীক্ষ্ণ সূচীবেধ অনুভব করিত। কোনও যুবক—হেমেন্দ্রবাবুর বাড়িতে যুবকদের গতায়াত সম্প্রতি খুব বাড়িয়া গিয়াছিল—মিন্টুর সহিত ঘনিষ্ঠভাবে হাসি-গল্প করিতেছে দেখিলেই তাহার গায়ে কাঁটার মতো ফুটিত। কিন্তু বদনমণ্ডল যাহার ভাব-লেশহীন ও মুখে যাহার কথা নাই, তাহার মনোভাব কে বুঝিবে? তবু কেহ কেহ যেন আন্দাজ করিয়াছিল।

একদিন হারাণ উঠিয়া যাইবার পর মিন্টুর মা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হ্যাঁরে, ও ছেলেটা কি জন্যে আসে বল তো? কথাও কয় না, কেবল জড়সড় হয়ে বসে থাকে—কি চায় ও?’

মিন্টু হাসিতে লাগিল, ইংরাজীতে যাহাকে gigle বলে সেই ধরনের হাসি; শেষে বলিল, ‘জানি না।’

সেই দিনই দৈবক্রমে হারাণের সহিত একজন পরিচিত ব্যক্তির সাক্ষাৎ হইয়া গেল। হারাণ হেমেন্দ্রবাবুর বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ফুটপাথে পড়িয়াছে, এমন সময় পিছন হইতে কে ডাকিল, ‘আরে! কে ও, হারাণ না কি?’

হারাণ পিছু ফিরিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল বলিল, ‘খগেন!’

খগেন গোয়ালন্দের স্কুলে সহপাঠী ছিল। খগেনের মতো সুন্দর চেহারা বাঙালীর মধ্যে সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না। সাহেবদের মতো টকটকে রঙ, একহারা লম্বা চেহারা, মুখখানা যেন গ্রীক শিল্পী বাটালি দিয়া কুঁদিয়া বাহির করিয়াছে; মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল, চোখের মণির মধ্যে যেন আগুন প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে। ঠোঁট দুটি পাকা বিম্বফলের মতো লাল।

কিন্তু তবু তাহার চেহারার মধ্যে এমন কিছু ছিল—যাহা মানুষকে আকর্ষণ না করিয়া দূরে ঠেলিয়া দিত। বোধ হয়, তাহার চোখের দৃষ্টি ও অধরের ভঙ্গিমার এমন একটা নির্মম বুদ্ধি ও আত্মপ্রধান দাম্ভিকতা ফুটিয়া উঠিত যে, লোক সঙ্কোচে তাহাকে পাশ কাটাইয়া যাইত। হারণের সঙ্গেও তাহার বন্ধুত্ব ছিল না, কেবল পরিচয় ছিল। খগেন বড়লোকের ছেলে, সে হারাণকে চিরদিনই নিরতিশয় অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখিত। তা ছাড়া, চরিত্রগত প্রভেদও এমনই দুর্লঙ্ঘ্য ছিল যে প্রীতির ভাব জন্মিবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। স্কুলে পাঠকালেই খগেন একটি মাস্টারের কন্যাকে লইয়া যে কাণ্ড করিয়াছিল—নেহাৎ বড়মানুষের টাকার জোরেই ব্যাপারটা চাপা পড়িয়া গেল, অন্যথা একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারী হইয়া যাইত।

স্কুলের পড়া শেষ করিয়া দু’জনেই কলিকাতায় আসিয়াছিল, এ কয় বছরে দুই তিনবার পথে ঘাটে দেখাও হইয়াছিল; কিন্তু খগেন যে হারাণকে চেনে, ইতিপূর্বে একবার ঘাড় নাড়িয়াও তাহা স্বীকার করে নাই।

খগেন এখন হারাণের দিকে সহাস্যে অগ্রসর হইয়া বলিল, ‘কি হে, ব্যাপার কি? আজকাল খুব high circle-এ move করছ দেখছি।’ বলিয়া বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উল্টাইয়া হেমেন্দ্রবাবুর বাড়ির দিকে নির্দেশ করিল।

হারাণ এই অযাচিত সহৃদয়তায় কিছুকাল বিস্মিত হইয়া থাকিয়া বলিল, ‘না—হ্যাঁ, ওঁদের সঙ্গে পরিচয় আছে—’

‘তা তো বুঝতেই পারছি। Lucky old dog!’ বলিয়া খগেন মুরুব্বীর মতো তাহার পিঠ ঠুকিয়া দিল।

দু’জনে আবার চলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, হারাণ একটু শঙ্কিতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি ওদের চেন না কি?’

খগেন বলিল, পরিচয় নেই, তবে মুখ চিনি। হেমেন্দ্রবাবু is one of the leaders of enlightened society, বলতে গেলে নব্য সমাজের মাথা। আর তাঁর মেয়ে মিন্টু, she is a peach.’

হারাণের মুখখানা উত্তপ্ত হইয়া উঠিল; খগেন তাহার দিকে একবার আড়চোখে চাহিয়া কথা ফিরাইয়া বলিল, ‘তারপর, তুমি আছ কোথায়? প্রায়ই মনে করি তোমার সঙ্গে দেখা করব, কিন্তু ঠিকানা জানি না বলে হয়ে ওঠে না। আমি এই কাছেই ভবানীপুরের দিকে থাকি। চল না, বাসাটা ঘুরে আসবে।’

হারাণ বলিল, “না, আজ থাক। কোথায় যাচ্ছ?’

‘আমি সিনেমায় যাচ্ছিলুম, কিন্তু বিশেষ কোনও আগ্রহ নেই; just to kill time. কলকাতায় এসে বন্ধুবান্ধব বড় একটা জোটেনি—যারা জুটেছিল তারা, you know the sort, পরের মাথায় কাঁটাল ভেঙে ফুর্তি চালাতে চায়। I have choked them off. —তাই একলা পড়ে গেছি। তা চল না, একসঙ্গে সিনেমাই দেখা যাক; বেশ ভাল জিনিস, Fox Production.’

হারাণ অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিল, ‘না ভাই, আমি এখন বাসায় ফিরি। একটু কাজ আছে—’

খগেন পীড়াপীড়ি না করিয়া বলিল, ‘Right O! business first, কিন্তু তোমার ঠিকানা তো বললে না।’

হারাণ ঠিকানা দিল। তখন খগেন সহাস্য-মুখে ‘টা-টা’ বলিয়া ছড়ি ঘুরাইতে ঘুরাইতে অলস-পদে ভিন্ন পথে প্রস্থান করিল।

দিন দুই পরে খগেন হারাণের বাসায় গিয়া দেখা দিল। বিকালবেলা হারাণ কলেজ হইতে ফিরিয়া স্টোভে চা তৈয়ার করিতেছিল, চার পয়সার জলখাবার ঠোঙ্গায় করিয়া টেবিলের উপর রাখা ছিল, খগেনকে দেখিয়া সে তটস্থ হইয়া উঠিল। খগেন ঘরে ঢুকিয়া একবার ঘরের চারিদিকে চক্ষু ফিরাইয়া দেখিল; নিরাভরণ ঘর, একটা তক্তপোষ, একটা কাঠের আসনযুক্ত চেয়ার ও একখানা কেরোসিন-কাঠের টেবিল—ইহাই ঘরের আসবাব। ঘরের এক কোণে দুই দেওয়ালে দড়ি টান করিয়া কাপড়-চোপড় রাখিবার ব্যবস্থা। বইগুলি টেবিলের উপরেই থাক করিয়া সাজানো; তক্তপোষের নীচে কাদা-মাখা জুতা যেন লজ্জিতভাবে আশ্রয় লইয়াছে। খগেনের ঠোঁট নিজের অজ্ঞাতসারে কুঞ্চিত হইয়া উঠিল,—সে সন্তর্পণে চেয়ারে বসিয়া হাতের ছড়িটা টেবিলের উপর রাখিয়া মৃদুহাস্যে বলিল, ‘Plain living and high thinking! বেশ বেশ! চা হচ্ছে না কি? আমাকেও এক পেয়ালা দিও।’

হারাণ তাড়াতাড়ি আরও কিছু জলখাবার আনাইল। তারপর দুইজনে কলাই করা পেয়ালায় চা পান করিল। ঘণ্টাখানেক ধরিয়া খগেন নানা প্রকার গল্প করিতে লাগিল; ত্রুটি-কুণ্ঠিত অস্বচ্ছন্দভাবে হারাণও কথাবার্তা কহিতে লাগিল বটে, কিন্তু তাহার এই শ্রীহীন দারিদ্র্যের মধ্যে সুবেশ, সুন্দর ও পরিমার্জিত খগেনকে যে নিতান্ত বেমানান্‌ ঠেকিতেছে, ইহা সে প্রতি মুহুর্তে অনুভব করিতে লাগিল।

খগেন হঠাৎ এক সময় বলিল, ‘কি হে, তোমাকে detain করছি না তো? তোমার কোথাও engagement থাকে তো বল।’

হারাণ অকারণ লজ্জিত হইয়া বলিল, ‘না না, আমি তো রোজ ওখানে যাই না— মাঝে মাঝে—’

খগেন বলিল, ‘The lady protests too much! তুমি দেখছি বেজায় shy, আমার কাছে অত লুকোচুরি নাই বা করলে! যাবে তো চল—আমিও ঐ দিকেই যাব, একসঙ্গে যাওয়া যাক।’

একবার একটু প্রলোভন হইলেও ভিতরে ভিতরে হারাণের মনটা বাঁকিয়া বসিল। খগেন যে কিসের জন্য টোপ ফেলিতেছে, তাহা ঠিক ধরিতে না পারিলেও একটা আশঙ্কা তাহাকে সন্দিগ্ধ করিয়া তুলিল, ‘না, আজ আর যাব না।’

খগেন হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া—‘আচ্ছা, আমি তবে চললুম’ বলিয়া একটু যেন বিরক্তভাবে বাহির হইয়া গেল।

খগেনের আসা-যাওয়া কিন্তু বন্ধ হইল না, সে প্রায়ই হারাণের বাসায় আসিতে লাগিল। ভাবে ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে ইসারা দিলেও সে যে হারাণের কাছে কি চায়, তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে কিন্তু তাহার আত্মসম্মানে বাধা পাইতে লাগিল। সে হেমেন্দ্রবাবুর বাড়ির কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করিত, মিন্টুর বিষয়ে দু’একটা ঠাট্টা-তামাসাও করিত, কিন্তু হারাণ এমনই নিরেট নির্বোধের মতো বসিয়া থাকিত যে কথাটা অগ্রসর হইতে পাইত না। একদিন এই ধরনের কথাবার্তা আরম্ভ হইতেই হারাণ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, খগেন,—কিছু মনে করো না—তোমার আগেকার অভ্যেসগুলো এখনও আছে কি?’

বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া খগেন বলিল, ‘আগেকার অভ্যেসগুলো—O-you mean—those!’

খগেন উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল— ‘My dear boy. তুমি কি মনে কর আমি একটা saint? Young blood must have its way, lad, and every dog his day! তোমার মতো কেবল বই পড়ে আর কলেজে গিয়ে যৌবনটা বরবাদ করে ফেলতে তো পারি না।’

হারাণ অস্বস্তিপূর্ণ হৃদয়ে চুপ করিয়া রহিল—আর কিছু জিজ্ঞাসা করিল না। প্রশ্নটা উত্থাপন করিবার সাহস সে কোথা হইতে পাইল তাহাই যেন বুঝিতে পারিল না।

উঠিবার সময় খগেন বলিল, ‘ভাল কথা, কাল রাত্রে আমার বাসায় তোমার ডিনারের নেমন্তন্ন রইল। আমি এতবার তোমার বাসায় এলুম আর তুমি একবারও return visit দিলে না— this is extremely rude of you!’

হারাণ অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল, কিন্তু খগেন বলিল, ‘সে হবে না, ওজর আপত্তি শুনছি না—বুঝলে?’ বলিয়া হারাণকে রাজী করাইয়া প্রস্থান করিল।

পরদিন সন্ধ্যার পর খগেনের ঠিকানায় গিয়া হারাণ দেখিল—চমৎকার ছোট একটি বাসা; নীচে বসিবার ঘর ও ডাইনিং রুম, উপরে শয়নকক্ষ, পড়িবার ঘর ইত্যাদি। খগেন তাচ্ছিল্যভরে সমস্ত দেখাইয়া বলিল, ‘সত্তর টাকা এই বাড়িটার জন্যে ভাড়া দিই। কিন্তু বাসাটা আমার পছন্দ নয়। একলা থাকি বটে, তবু যেন কুলোয় না। ভাবছি একটা ভাল বাসায় উঠে যাব।’

বাড়ির সব ঘর দেখাইয়া খগেন হারাণকে নীচের বসিবার ঘরে আনিয়া বসাইল। ঘরটি ছোট, মেঝেয় কার্পেট পাতা, কয়েকটি গদি-মোড়া চেয়ার ইতস্তত সাজানো, মাঝখানে একটি ছোট টিপাইয়ের উপর বিলাতী কাচের ভাসে একগুচ্ছ গোলাপফুল। সিগারের বাক্স বাহির করিয়া খগেন হারাণের সম্মুখে ধরিল, হারাণ নীরবে ঘাড় নাড়িল। খগেন বলিল, ‘ও তুমি বুঝি এ-সব খাও না। সিগারেট? তাও না। O dear! তুমি একেবারে পুরোদস্তুর পিউরিটান।’ বলিয়া নিজে সাবধানে একটি সিগারেট বাছিয়া লইয়া ধরাইল।

খগেন ইচ্ছা করিলে বেশ চিত্তাকর্ষকভাবে গল্প করিতে পারিত; তাই দেখিতে দেখিতে রাত্রি সাড়ে আটটা বাজিয়া গেল। ভৃত্য আসিয়া খবর দিল, ‘খানা তৈয়ার!’

দু’জনে ডাইনিং-রুমে উঠিয়া গেল। টেবিলের উপর খানা পরিবেশিত হইয়াছিল, খগেন হাসিয়া বলিল, ‘তোমার বোধ হয় ছুরি-কাঁটা চালানো অভ্যেস নেই, তা—হাতই চালাও; এখানে তো আর কেউ নেই।’

খগেনের একতরফা বাক্য-স্রোতের মধ্যে আহার শেষ হইয়া গেল। দু’জনে আবার বসিবার ঘরে ফিরিয়া আসিল।

খগেন ইঙ্গিত করিতেই ভৃত্য একটা বোতল ও দুটি মদের গেলাস আনিয়া সম্মুখে রাখিল। বোতলের ছিপি খোলা হইতেছে দেখিয়া হারাণ ভীতভাবে বলিল, ‘ও কি?’

খগেন হাসিয়া উত্তর করিল, ‘ভারমুথ। নাও—খাও।’ বলিয়া একটা গেলাস আগাইয়া দিল।

হারাণ সভয়ে হাত নাড়িয়া বলিল, ‘আমি মদ খাই না।’

খগেন বলিল, ‘আরে, খাও একটু for old times sake! Liquor নয়, সরবৎ, নেশা হবে না।’

‘না না, আমি ও-সব খাব না।’

খগেন মুখ বাঁকাইয়া হাসিয়া বলিল, ‘তুমি চিরকালই একটা—ইয়ে রয়ে গেলে। ভদ্রসমাজে মিশছো—এ-সব খেতে শেখো। আচ্ছা, এমনি না খাও, তোমার—কি বলে—মিন্টুর health drink কর। Here it to the sweetest loveliest’—বলিতে বলিতে গেলাস ঊর্ধ্বে তুলিল।

হারাণ ধড়মড় করিয়া চেয়ার ঠেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, অর্ধ-রুদ্ধ স্বরে বলিল, ‘আমি চললুম—’

‘আরে বোসো। আচ্ছা, না হয় খেও না। আমি একাই খাচ্ছি।’

গেলাস নিঃশেষ করিয়া একটা টার্কিশ সিগারেট ধরাইয়া খগেন বলিল, ‘বোসোই না ছাই—একেবারে দাঁড়িয়ে উঠলে যে! তোমার সঙ্গে দুটো কাজের কথা আছে।’

হারাণ দাঁড়াইয়া রহিল, ‘কি কথা, বল, আমি শুনছি।’

খগেন খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, কথাটা বলিতে তাহার দারুণ অপমান বোধ হইতেছিল। শেষে সিগারেটের ছাই ঝাড়িতে ঝাড়িতে গলার সুরটা খুব হালকা করিয়া বলিল, ‘তোমার বন্ধু হেমেন্দ্রবাবুর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দাও না। কলকাতায় আছি, অথচ নিজের ক্লাসের লোকের সঙ্গে আলাপ হল না; বুঝতেই তো পারছ—সময় কাটাবার অসুবিধা হয়—’

অস্বাভাবিক তীব্র কষ্ঠে হারাণ বলিয়া উঠিল, ‘ও-সব হবে না। আমি পারব না।’

একটা ভ্রূ ঈষৎ তুলিয়া খগেন বলিল, ‘পারবে না? কেন?’

কোণ-ঠাসা বিড়াল যেমন নখ বাহির করিয়া ফোঁস করিয়া উঠে, হারাণ তেমনই ভাবে বলিয়া উঠিল, ‘তুমি একটা লম্পট, জঘন্য চরিত্রের লোক—তোমার মতলব কি আমি বুঝিনি? তোমার মতো লোককে তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার চেয়ে—’ কথার অভাবে হারাণ চুপ করিল।

খগেনের মুখের উপর দিয়া একটা কুটিল বিদ্রূপের ছায়া খেলিয়া গেল, কিন্তু গলার আওয়াজ চড়িল না। অনুচ্চ গরল-ভরা সুরে হাসিয়া সে বলিল, ‘You fool! you abysmal fool! তুই ভেবেছিস তোর গলায় মিন্টু মালা দেবে—না! আমি গিয়ে তোর মুখের গ্রাস কেড়ে নেব—এই তোর ভয়! তোর মতো গাধা দুনিয়ায় নেই। তোকে তারা কি চোখে দেখে জানিস? একটা ঘোড়ার সহিসকে তারা তার চেয়ে বেশি খাতির করে। তোকে নিয়ে তারা সঙ সাজিয়ে বাঁদর-নাচ নাচায়, তা বোঝবারও তোর ক্ষমতা নেই। অসভ্য uncultured চাষা কোথাকার!’

হারাণ আর সেখানে দাঁড়াইল না—একবার তাহার ইচ্ছা হইল খগেনের মুখখানা দেওয়ালে ঠুকিয়া থেঁতো করিয়া দেয়; কিন্তু তাহা না করিয়া সে কশাহত ঘোড়ার মতো ছুটিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। খগেনের শ্লেষবিষাক্ত হাসি ফুটপাথ পর্যন্ত তাহার অনুসরণ করিল।

বাসায় ফিরিয়া হারাণ অনেকটা সুস্থ বোধ করিতে লাগিল। খগেনের সঙ্গে মাখামাখির পালা যে এমনভাবে শেষ হইবে ইহা সে প্রত্যাশা করে নাই। বস্তুত, অনীস্পিত সহৃদয়তার জাল হইতে মুক্তিলাভ করিবার উপায় তাহার জানা ছিল না, তাই খগেনের এই জোর-করা বন্ধুত্ব তাহাকে ভিতরে ভিতরে পীড়িত করিয়া তুলিলেও পরিত্রাণ পাইবার পথ সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না। আজ নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে এই অযাচিত বন্ধন হইতে মুক্তি পাইয়া সে খুশি হইয়া উঠিল। খগেনের মতো লোকের বাড়িতে বসিয়া তাহার মুখের উপর কড়া কথা শুনাইয়া দিবার ক্ষমতা যে তাহার আছে ইহাতে তাহার আত্মবিশ্বাস অনেকটা বাড়িয়া গেল।

কিন্তু তবু খগেনের বিষ-তিক্ত কথাগুলিও তাহার কানে লাগিয়া রহিল— You abysmal fool! তোকে নিয়ে তারা সঙ সাজিয়ে বাঁদর নাচায়—অসভ্য uncultured চাষা—

ইতিমধ্যে সে যথারীতি হেমেন্দ্রবাবুর বাড়ি যাতায়াত করিতেছিল; অনেকটা অভ্যাসও হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু এই ঘটনার পর যেদিন সে হেমেন্দ্রবাবুর দ্বারে উপস্থিত হইল সেদিন তাহার সেই প্রথম দিনের সঙ্কুচিত জড়তা ফিরিয়া আসিল। কেবলই মনে হইতে লাগিল,—‘সত্যিই কি ওরা আমাকে—’

কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করিয়া সে অনেকটা আশ্বস্ত হইল—কাহারও ব্যবহারে অবজ্ঞা বা অবহেলার লক্ষণ দেখিতে পাইল না; মিন্টু স্বাভাবিক সরল হাসিমুখে অভ্যর্থনা করিল; এমন কি মিন্টুর মা তাহার সাংসারিক অবস্থা ইত্যাদি সম্বন্ধে ঔৎসুক্য প্রকাশ করিলেন। হারাণ তৃপ্ত হইয়া ফিরিয়া আসিল।

এইভাবে আরও দুই হপ্তা কাটিয়া গেল। তারপর একদিন আত্মবিস্মৃত আলোর-নেশায়-মাতাল হারাণ ল্যাম্পপোস্টে মাথা ঠুকিয়া পরিপূর্ণ চেতনা ফিরিয়া পাইল।

সে দিনটা শনিবার ছিল। কলেজ হইতে সকাল-সকাল ফিরিয়া হারাণ একটু বিশেষ সাজগোজ করিয়া লইল। পাঁচ সিকা দিয়া একজোড়া রবার-সোল্‌ টেনিস্‌ সু কিনিয়াছিল, তাহাই পরিয়া পাঞ্জাবির বাহার দিয়া বাহির হইয়া পড়িল। পূজার ছুটির আর দেরি নাই, শীঘ্রই বাড়ি যাইতে হইবে, অতএব—

হেমেন্দ্রবাবুর বাড়িতে যখন পৌছিল তখনও চারটে বাজে নাই। ড্রয়িং রুমের নিকটবর্তী হইতেই, অনেকগুলি যুবতী-কণ্ঠের হাসির ঢেউ তাহার কানে আসিয়া লাগিল। ভিতরে বহু সখী মিলিয়া একটা ভারী কৌতুককর আলোচনা চলিতেছে—সঙ্কোচে হারাণের পা আপনিই থামিয়া গেল।

ঘরের মধ্যে হাসি মিলাইয়া গেলে একটি কন্ঠস্বর শুনা গেল, ‘তুই এত নকল করতেও পারিস! এমন অদ্ভুত জীবটি কোত্থেকে জোগাড় করলি, ভাই

আর একটি কন্ঠস্বর,—‘আমাদের একদিন দেখা না, মিন্টু।

হঠাৎ ঘরের ভিতর হইতে নিজের কণ্ঠস্বর শুনিয়া হারাণ চমকিয়া উঠিল,—‘আজকেই আপনারা—অ্যাঁ—তাঁর দেখা পাবেন, তিনি এলেন বলে! আজ শনিবার তো—ঠিক পাঁচটার সময় উদয় হবেন। তার নাম—হ্যাঁ—কি বলে—হারাণচন্দ্র—’

কি আশ্চর্য! তাহার জড়তাপূর্ণ দ্বিধা-বিঘ্নিত কথা বলিবার ভঙ্গিটি পর্যন্ত অবিকল নকল হইয়াছে!

আবার এক-পশলা সুমিষ্ট হাসির বৃষ্টি হইয়া গেল। হারাণ স্থাণুর মতো দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিল।

‘মিন্টু, কোত্থেকে এমন চীজ আবিষ্কার করলি, বল?’

মিন্টুর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর শুনা গেল, ‘আবিষ্কার করিনি, ভাই, আপনি এসে জুটেছে। দোষের মধ্যে একদিন ওকে মোটর চাপা দিয়েছিলুম—সেই থেকে আসতে শুরু করেছে। কিছু বলাও যায় না।’

একজন টিপ্পনী কাটিয়া বলিল, ‘বুকের ওপর দিয়ে চাকা চালিয়ে দিয়েছিলি বুঝি?’

আর একজন সরু গলায় বলিল, ‘তুই encourage করিস কেন? একদিন একটু শক্ত হলেই আর আসে না। ও-সব uncultured লোকগুলোকে আমল দেওয়াই উচিত নয়।

মিন্টু বলিল, ‘সে ভাই আমি পারি না। আর, লোকটি এমন helpless কাঠের পুতুলের মতো বসে থাকে যে কিছু বলতে মায়া হয়।’

একজন হাসি-হাসি গলায় বলিল, ‘ও নিশ্চয় তোর লভে পড়েছে। মন্দ হয়নি— beauty and the beast.’

আর একটি পরিহাস চপল কণ্ঠ বলিল, ‘দেখিস মিন্টু, তুই যেন উল্টে ওপর প্রেমে পড়ে যাসনি। তা হলেই বিপদ!’

হাসির উচ্ছ্বাস থামিলে মিন্টু বলিল, ‘এবার চুপ কর ভাই, হয়তো এক্ষুনি—’

পা টিপিয়া টিপিয়া চোরের মতো হারাণ ফিরিয়া আসিল, পাছে কেহ তাহাকে দেখিয়া ফেলে, এই ভয় তাহার অন্তরের অপরিসীম গ্লানিকেও যেন ঢাকিয়া দিল।

ফুটপাথে নামিয়া সে ঊর্ধ্বশ্বাসে একদিকে ছুটিয়া চলিল। চোখের সম্মুখে একটা রক্তাভ কুজ্ঝটিকা তাল পাকাইতেছিল,—তাহার ভিতর দিয়া সমস্ত পৃথিবীটাই ঘোলাটে বোধ হইতেছিল। কিন্তু পৃথিবীর দিকে তাহার দৃষ্টি ছিল না,—তাহার বুকের মধ্যে যে কালকূট ফেনাইয়া উঠিতেছিল, তাহাই কাহারও উপর উদ্‌গিরণ করিবার জন্য তাহার অন্তরাত্মা সাপের মতো ফণা বিস্তার করিয়া গর্জন করিতেছিল।

সে কোন্ দিকে চলিয়াছিল তাহারও ঠিকানা ছিল না, কতক্ষণ এইভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে তাহাও খেয়াল ছিল না। স্থান-কালের ধারণা তাহার মন হইতে মুছিয়া গিয়াছিল; হঠাৎ একজনের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়া তাহার বাহ্য চেতনা ফিরিয়া আসিল। ক্রুদ্ধ আরক্ত নেত্রে তাহার দিকে ফিরিতেই দেখিল—খগেন!

কিছুক্ষণ দু’জনে পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিল। তারপর হারাণ হাসিয়া উঠিল—বিকৃত কণ্ঠের বিষ-জর্জরিত হাসি! খগেনের সুবেশ মূর্তিটা আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘খগেনবাবু! কোন্‌ দিকে চলেছেন?’

খগেন উত্তর দিল না, ভ্রূ তুলিয়া চাহিল! হারাণ তখন তিক্তস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘তুমি ওদের সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলে না? করবে আলাপ? ঠিক রাজঘোটক হবে। এস।’ বলিয়া খগেনের সম্মতির অপেক্ষা না করিয়া তাহার একটা বাহু ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল।

হেমেন্দ্রবাবুর ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করিয়া হারাণ দেখিল, সম্মুখেই সখীপরিবৃতা মিন্টু! কোনও দিকে না তাকাইয়া সে মিন্টুর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল, খগেনের প্রতি অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়া কহিল, ‘ইনি আমার বন্ধু বাবু খগেন্দ্রনাথ—খুব বড়মানুষের ছেলে, অতিশয় পরিমার্জিত, এঁর সঙ্গে আলাপ করুন। খগেন, ইনি মিন্টু দেবী! Good luck!—আচ্ছা, চললুম!’ বলিয়া যেন একটা দুর্দমনীয় হাসি চাপিবার চেষ্টা করিতে করিতে ঝড়ের মতো ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

কাহিনীটা এইখানেই শেষ করিতে পারিলে ভাল হইত,—পাঠক দীর্ঘ গল্প-পাঠের শ্রান্তি হইতে মুক্তিলাভ করিতেন, এই হতভাগ্য লেখকও অপ্রিয় সত্যভাষণের প্রয়োজন হইতে নিষ্কৃতি পাইত। কিন্তু শেষ করিতে চাহিলেই কথা শেষ হয় না, নিজের গতির বেগে নূতন কথার সৃষ্টি করিয়া চলে। ব্রেক্‌ কষিতে কষিতে ধাবমান ট্রেন ভাঙ্গা পুলের মাঝখানে আসিয়া পড়ে।

যা হোক, আর বাজে কথা নয়; দ্রুতবেগে কাহিনীটা শেষ করিয়া ফেলি।

তিন মাস কাটিয়া গেল। হারাণ শামুকের মতো দু’দিনের জন্য মুণ্ড বাহির করিয়াছিল, আবার খোলের মধ্যে মুণ্ড ঢুকাইয়া লইয়াছে। তাহার মুখখানা আরও কৃশ ও সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছে; সে-মুখ ভাবপ্রকাশের উপযোগী কোনকালেই ছিল না, তাই ক্ষণিক আলোক-অভিসারের কোনও চিহ্নই সেখানে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

সে দিন, অগ্রহায়ণের গোড়ার দিকে বেশ শীত পড়িয়াছিল, সন্ধ্যার পূর্বে হারাণ গায়ে একটা র‍্যাপার জড়াইয়া কলেজ স্কোয়ারের সম্মুখের রাস্তা দিয়া চলিয়াছিল। একখানা খোলা মোটর ঠিক তাহার পাশ দিয়া চলিয়া গেল; মোটরখানা এত নিকট দিয়া গেল যে হারাণ ইচ্ছা করিলে তাহাতে উপবিষ্ট যুবতীকে হাত বাড়াইয়া স্পর্শ করিতে পারিত।

কিন্তু যুবতী তাহাকে দেখিতে পাইল না—তাহার চক্ষু সম্মুখের শূন্যের পানে তাকাইয়া ছিল। চক্ষু যখন দৃশ্য বস্তুকে দেখে না অথচ উন্মীলিত হইয়া থাকে—এ সেই দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণ দুটি একটু চাপা—যেন নীচের দিকে নামিয়া গিয়াছে। একটু শুষ্ক ক্লান্ত ভাব-অনবদ্য সুন্দর মুখের ডৌলটি যেন ঈষৎ শীর্ণ। হারাণ সে দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইতে লইতে মোটরও মৃদুমন্দ গতিতে বাহির হইয়া গেল। কলেজ স্কোয়ারে পঁচিশ বার দ্রুতপদে চক্র দিয়া হারাণ বাহির হইল। পকেটে কয়েকটা পয়সা ছিল, সে ভবানীপুরের বাসে চাপিয়া বসিল।

খগেন বাড়িতেই ছিল, হারাণকে দেখিয়া সবিস্ময়ে দীর্ঘ শিস্‌ দিয়া বলিয়া উঠিল, ‘Hullo! হারাণ যে!’

হারাণ ঘরে গিয়া বসিল, কিছুক্ষণ ঘাড় গুঁজিয়া চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ জ্বলন্ত চক্ষু তুলিয়া বলিল, ‘তুমি মিন্টুকে এ কি করেছ?’

খগেন ভ্রূর একটি বিদ্রুপপূর্ণ ভঙ্গি করিয়া বলিল, ‘কি করেছি?’

‘তুমি—তুমি তাকে—’ হারাণ কথাটা শেষ করিতে পারিল না। কি বলিবে? কেমন করিয়া উচ্চারণ করিবে?

খগেন একটা চুরুট ধরাইয়া বলিল, ‘যদি কিছু বলতে চাও, স্পষ্ট করে বল। আমার সময় নেই, এখনই একটা পার্টিতে যেতে হবে।’

হারাণ সহসা ভাঙিয়া পড়িয়া বলিল, ‘খগেন, একটি বালিকার জীবন নষ্ট করে দিলে?’

খগেন বলিল, ‘My dear fellow, don’t be melodramatic. Please, I can’t stand it. অবশ্য মিন্টুর সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল, যত দূর ভাব হতে পারে হয়েছিল। সেজন্যে তোমাকেই আমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কিন্তু সে সব এখন শেষ হয়ে গেছে। মিন্টুর সঙ্গে এখন আর আমার কোনও সম্বন্ধই নেই। Social-এ পার্টিতে মাঝে মাঝে দেখা হয়, কিন্তু আমরা যতদূর সম্ভব পরস্পরকে এড়িয়ে চলি। That affair is closed.’ বলিয়া মুখের একটা অরুচি-সূচক ভঙ্গিমা করিল।

হারাণ বলিল, ‘খগেন, তুমি মিন্টুকে বিয়ে করলে না কেন?’

খগেন যেন চিন্তা করিতে করিতে বলিল, ‘এক সময় মনে হয়েছিল বুঝি বিয়েই করতে হবে। কিন্তু—‘খগেন হাসিতে লাগিল,—‘মিন্টু বাইরে খুব স্মার্ট গার্ল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটু বোকা আছে। নিজেই এসে ধরা দিলে—’

কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানিয়া খগেন আবার আরম্ভ করিল, ‘জানো, মিন্টু আমার এই বাসায় কতবার এসেছে? ত্রিশ বারের কম নয়। প্রথম দু’একবার তার মা সঙ্গে ছিল, তারপর একলা। Well, you know after that—’

‘কিন্তু তুমি তাকে বিয়ে করলেই তো পারতে, খগেন!’

‘কথাটা নেহাৎ আহাম্মকের মতো বললে, বিয়ের আগেই যে মেয়ে বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে, তাকে বিয়ে করব কি জন্যে? শেষ পর্যন্ত আমাকেই বলতে হল,—মিন্টু, নেশা ছুটে গেছে, এবার বিদায় দাও।’

‘কিন্তু কেন? কেন?’

‘তা জানি না। প্রকৃতির এই নিয়ম বোধ হয়। রবিবাবুর পুরুষের উক্তি পড়েছ তো—‘ক্রমে আসে আনন্দ আলস!’ কিন্তু তোমাকে এত কথা কেন বলছি জানি না; তুমি মিন্টুর গার্জেনও নও, ভাবী স্বামীও নও!’ হাসিয়া খগেন উঠিয়া দাঁড়াইল—‘আমায় এখনি বেরুতে হবে।’।’

‘খগেন, তুমি একটা পশু—একটা জানোয়ার।’

খগেন ফিরিয়া দাঁড়াইল। ‘তোমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করতে আমার ভাল লাগে না। আমি যা হাতের কাছে পেয়েছি—নিয়েছি; সেজন্য কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নই। আমি না দিলে আর কেউ নিত। যাও—বেরোও এখন।’ বলিয়া দ্বারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিল।

হারাণ বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, রাস্তায় গ্যাস জ্বলিয়াছে, শীতের আকাশে নক্ষত্র মিটমিট করিতেছে। হারাণকে বুকে পিষিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস বাহির হইল—‘আমার দোষ! আমার দোষ! কেন আমি এমন পাগলের মতো কাজ করলুম!’

দেয়ালীর সময় অসংখ্য পোকা পুড়িয়া মরিতে দেখিয়া মনে হয় বুঝি পোকার বংশ নিঃশেষ হইয়া গেল, পৃথিবীতে আর পোকা নাই। পরের বৎসর আবার অসংখ্য পোকার আবির্ভাব হয়—যুগে যুগে এই চলিতেছে। আলো যতদিন আছে ততদিন পতঙ্গ পুড়িয়া মরিবে। দোষ কাহার?

১৪ আশ্বিন ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *