আলোকিত অন্ধকার

আলোকিত অন্ধকার

তখন ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প লিখতাম। কেউ আমাকে উপন্যাস লেখার প্রস্তাব তখনও দেয়নি, ৫০ হাজার শব্দের উপন্যাস লেখার চিন্তা মাথায় আসেনি। হঠাৎ একদিন কিংবদন্তি সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ডেকে বললেন, ‘তুমি তো গ্রুপ থিয়েটার করতে, সিনেমা দ্যাখো?’

গল্প লেখা ছাড়া আমার নেশা ছিল যাবতীয় গান শোনা আর সিনেমা দ্যাখা। ‘৫০ থেকে ‘৭৪ সাল পর্যন্ত যেসব বাংলা ছবি হলে এসেছে, তার অধিকাংশই আমার দ্যাখা। তারপর সিনে ক্লাবের সৌজন্যে বিদেশি ছবি দ্যাখাও অভ্যেস ছিল। তাই সাগরদা যখন দেশ পত্রিকার চলচ্চিত্র সমালোচকের দায়িত্ব দিলেন, তা আমার কাছে বড় পাওয়া। ঠিক হল যেহেতু গল্প লিখি, তাই সমালোচনা লিখব ছদ্মনামে। অমিত রায় নামটা সম্পাদকই পছন্দ করলেন।

তারপর ছবি দ্যাখা শুরু হল। তখন বছরে অন্তত ৩০টি বাংলা ছবি মুক্তি পেত। ১০টার বেশি ছবি কেন যে তৈরি হত ভেবে পেতাম না। তখন আমি বুঝেছিলাম, বাংলায় তিন শ্রেণির পরিচালক ছবি করেন। সত্যজিৎ রায় তো শুধু বিখ্যাত এবং প্রতিভার শেষকথা ছিলেন না, তিনি পরিচালকদের পরিচালক ছিলেন। তাঁর পরে তপন সিংহ, অসিত সেন, তরুণ মজুমদার, অজয় কর, আমাদের শ্রদ্ধা আদায় করেছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের ছবি দেখেছি দর্শক হিসেবে। দেখে নাড়া খেয়েছি। কিন্তু সমালোচকের দায়িত্ব নেওয়ার পর ওঁর মাত্র একটি ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

দ্বিতীয় শ্রেণির পরিচালকদের ধারাবাহিকতা ছিল না। হঠাৎ কোনো ছবিতে তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও পরের ছবিগুলোতে হারিয়ে যেত। তবু তাঁদের মধ্যে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, সলিল দত্ত সুস্থ ভাবনার ছবি করতেন যা দেখতে দর্শকরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন।

তৃতীয় শ্রেণির পরিচালকদের ছবিগুলো তৈরি হত এমন সব কাহিনি নিয়ে যা তাঁরা মনে করতেন দর্শকরা খাবে। গদগদে গল্প যাতে থাকত প্রচুর কান্নার মিশেল। প্রথম সপ্তাহে ম্যাটিনি শো’র ইন্টারভ্যালে হকাররা রুমাল বিক্রি করার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকত। যে—ছবি দেখার সময় রুমালের বিক্রি বেড়ে যেত সেই ছবির নির্মাতারা ভাবতেন হিট হয়ে গেছে। এছাড়া তাঁরা দর্শকদের শ্রেণিবিভাগ করতেন। গ্রামের দর্শকরা কান্না গেলে, মোটাদাগের রসিকতায় হেসে গড়িয়ে পড়ে। তাই শহরে ছবি না চললেও ক্ষতি নেই, গ্রামের দর্শকদের পেলেই ছবি তৈরির যা খরচ তার দ্বিগুণ ঘরে আসবে। এইসব ছবি দেখতে গিয়ে মনে হত কখন শেষ হবে! আজ স্বীকার করছি, অর্ধেক দেখার পর বসে না থেকে চলে এসেছি অনেকবার, সাগরদাকে বলেছি ছবিটি নিয়ে লিখব না। তিনি বলেছেন, ‘যা দেখেছ তাই লেখো।’ সেসময় বিভিন্ন কাগজে পরিচিত চিত্রসমালোচক চাকরি করতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যি বিদগ্ধ। ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাওয়ার পর যখন সবাই ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নন, তখন দেশ পত্রিকার তখনকার চিত্রসমালোচক পঙ্কজ দত্ত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখেছিলেন যেসব কথা, তা পরবর্তীকালে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। শ্রীযুক্ত সেবাব্রত গুপ্ত এই রকম আর একজন সমালোচক যিনি চিত্রসমালোচক হিসেবে স্মরণীয়।

বেশিরভাগ ছবি যেদিন মুক্তি পেত সেই রাত্রে প্রযোজক নামী হোটেল বা ক্লাবে ককটেল এবং ডিনারের আয়োজন করতেন। চলচ্চিত্রজগতের বিখ্যাতদের সঙ্গে কাগজের সমালোচকদের ডেকে আপ্যায়ন করতেন। এই রেওয়াজটা এখনও হয়তো আছে কিন্তু আগের মতো জৌলুস নেই, কিছু সমালোচক সেইসব আসরে নিজেকে সংযত রাখতে পারতেন না। দামি মদ তাঁদের পায়ের জোর কেড়ে নিত। লক্ষ করতাম, তখনও চাকরি যায়নি কিন্তু সম্পাদক সমালোচনা লিখতে দেন না এমন একজন সমালোচক ওইসব পার্টিতে না গিয়ে থাকতে পারতেন না। একজন সমালোচক তো ওই পার্টিতে আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, যে—ছবি দেখলাম তার কী কী ভালো বা খারাপ লাগল? প্রথমদিকে আমি সরল গলায় বলতাম। আর সেই কথাগুলোই ভদ্রলোকের কলম থেকে বেরিয়ে তাঁর কাগজে ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে যেত।

সত্যজিৎ রায় বা তপন সিংহের ছবি মুক্তি পেলে সমালোচকরা তটস্থ থাকতেন। যেন ডার্বি ম্যাচ হচ্ছে। অসুস্থ হওয়ার পর সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে আগের মতো শারীরিক ক্ষমতা না থাকায় ছবির বিষয় নির্বাচন করতেন সতর্কভাবে, যাতে তাঁর পরিশ্রম কম হয়। এই পর্যায়েও আমরা তাঁর কাছ থেকে কিছু ভালো ছবি পেয়েছি যা অন্যদের কাছ থেকে আশাই করা যেত না। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সাগরদা তখন অসুস্থ হয়ে বেলভিউ নার্সিংহোমে রয়েছেন। এই সময় সত্যজিৎ রায়ের একটি ছবি মুক্তি পেল। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি সেই ছবি দেখে আমার মনখারাপ হয়ে গেল। প্রথমত, ওই ছবিতে যিনি নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তাঁকে মেনে নিতে পারছিলাম না। শুধু আমি নই, রবীন্দ্র—উপন্যাসের প্রায় সব পাঠকই এব্যাপারে একমত ছিলেন। দ্বিতীয়ত, আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ঘরের দেওয়াল যেন নড়ে উঠল। অর্থাৎ, যে—সেটে শুটিং হয়েছিল, তা কোনো কারণে কেঁপে গিয়েছিল যা পরিচালকের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া মনে হচ্ছিল, ছবি গল্পের গতি স্বস্তি দিচ্ছিল না। খুব বিনীত ভঙ্গিতে এইগুলো কেন হল তা সমালোচনায় জানতে চেয়েছিলাম। সম্পাদকীয় দফতরে লেখা দিয়ে এলাম। তখন দেশ পত্রিকা সাপ্তাহিক। জ্যোতিষদা দেখাশোনা করতেন সমালোচনার পাতাগুলো। প্রুফ এলে আমার লেখা পড়ে জ্যোতিষদার চোখ বড় হয়ে গেল। তিনি সেই প্রুফ নিয়ে গেলেন সাগরদার কাছে, নার্সিংহোমে। সঙ্গে সঙ্গে আমার ডাক পড়ল সেখানে। সাগরদা বিছানায় শুয়েই বললেন, ‘তুমি কি মনে কর ঠিক লিখেছ?’

‘হ্যাঁ সাগরদা।’

‘আমার মনে হয় আর একবার ছবিটা দেখা দরকার। তোমার মত তাতে বদলে যেতে পারে। তুমি ছবিটা আবার দ্যাখো।’ সাগরদা বললেন।

বললাম, ‘আমি মন দিয়ে দেখেছি।’

‘আর একবার দ্যাখো। আসলে কী জানো। তোমার পিতা অথবা পিতামহ, যাঁরা অনেক পরিশ্রম করে তোমাদের সংসারকে দাঁড় করিয়েছেন, তোমাকে শিক্ষিত করেছেন, তাঁদের সামান্য ভুলভ্রান্তি নিয়ে সোচ্চচার হওয়া একধরনের অকৃতজ্ঞতা।’

সেদিনই ম্যাটিনি শো’তে আবার ছবিটা দেখলাম। প্রথমবারে যা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয়বারে তাও চোখে পড়ল। বাড়ি ফিরে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসটা বের করে পড়তে বসলাম। পুরোটা পড়ার পর কিছুক্ষণ ভেবে সমালোচনাটা দ্বিতীয়বার লিখলাম। পরদিন জ্যোতিষদাকে লেখাটা দেওয়ার পর তিনি বললেন, ‘একটু বসো, পড়ে দেখি, সাবধানের মার নেই।’ পড়ার পর মাথা নাড়লেন তিনি, ‘না, ঠিকই আছে, খারাপ কিছু লেখোনি।’

সমালোচনা ছাপা হল। যে পড়েছে সে—ই বলেছে, এটা কি চলচ্চিত্র সমালোচনা, না বুক রিভিউ? রবীন্দ্র উপন্যাসের সমালোচনা লেখার পর চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে কয়েকটি কথা, পরিচালকদের নাম, শিল্পীদের নাম লিখে কর্তব্য শেষ করেছি। শুনেছি, সত্যজিৎ রায় খুব বিরক্ত হয়েছিলেন, সাগরদার কাছে এই ধরনের লেখা, কেন লেখা বা ছাপা হয়েছিল তা জানতে চেয়েছিলেন। সাগরদা কী বলেছিলেন তা জানতে পারিনি কিন্তু এ ব্যাপারে সাগরদা আমাকে একটি কথাও বলেননি।

চিত্রসমালোচনা লেখার সুবাদে চলচ্চিত্রজগতের অনেক রথী—মহারথীর সঙ্গে পরিচয় এবং পরে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। পিছন ফিরে তাকালে যাঁদের দেখতে পাই, তাঁদের মধ্যে উত্তমকুমার এবং অবশ্যই সূচিত্রা সেন ছিলেন না। অনিলদা, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো দাদা—ভাইয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। অনেকেই জানেন না, অনিলদা অনবদ্য স্কেচ করতেন। কথা বলতেন চমৎকার। আমার যখন পরিচিতি একটু বাড়ল, তখন একদিন এন টি ওয়ান স্টুডিয়োতে গিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখে অনিলদা চেঁচিয়ে বললেন, ‘এই যে সমরেশ, এতদিন ছিলে শিল্পী, এখন তো শিল্পিপতি। বাঃ!’ আর একজনের কথা এই প্রসঙ্গে বলব। তিনি নির্মলকুমার। আমার দেখা কয়েকজন ভদ্রলোকের মধ্যে নির্মলদা অন্যতম। পড়াশুনা করতেন প্রচুর। কোনো অপ্রীতিকর কথা বলতেন না। আমি যখন জানতে পারলাম নির্মলদা গল্প লিখতেন, দেশ বা অন্যান্য পত্রিকায় গল্প লিখেছেন একসময়। একসময় যে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাংলা চলচ্চিচত্রের জগতে কম ছিলেন না তা প্রমাণিত। বিখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদারের লেখার হাত নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ওঁর লেখা গল্প দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। রাধামোহন ভট্টাচার্য, বিকাশ রায়ের সাহিত্যপ্রীতির কথা সবাই জানেন। আর সৌমিত্রদা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে শুধু প্রতিষ্ঠিত কবি নন, ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমাদের শ্রদ্ধেয় মানুষ হয়ে আছেন। এই ব্যাপারটা দ্রুত কমে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, অভিনয় করার জন্যে শিক্ষার কোনো দরকার নেই। একজন গ্রামে বসে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না, তার চেহারা যদি সুদর্শন হয় এবং ক্ষমতাবান পরিচালকের চোখে পড়ে যায়। সে স্বচ্ছন্দে বাংলা ছবির নায়ক হয়ে যেতে পারে, এখন তা প্রমাণিত।

শেষপর্যন্ত একটা সময় এল যখন মনে হল, সমালোচকের কাজটা আর আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এমন সব ছবি মুক্তি পেতে লাগল যা দেখার জন্যে ১০ মিনিটও বসা যায় না। মনে হচ্ছিল, অনর্থক সময় নষ্ট করছি। সাগরদার কাছে গিয়ে বললাম, আর নয়, আমি পারছি না। সমস্যার কথা শোনার পর তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমাকে আর সিনেমার রিভিউ করতে হবে না। তুমি নতুন নাটক দেখে লেখো।’

নাটকের সমালোচনা আমি আগেও লিখছিলাম। বছরে ১০ কী ১২টা। সিনেমা দ্যাখার চেয়ে ভালো নাটক দেখতে অনেক বেশি ভালো লাগত। এই প্রসঙ্গে বলি, আমি শম্ভু মিত্রের অনুরাগী। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর নাটক দেখে আসছি। এখনও মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে ‘চার অধ্যায়’ নাটকের সেই দৃশ্যটির কথা, যেখানে শম্ভু মিত্র আমার প্রিয় কবিতার লাইন বলছেন তৃপ্তি মিত্রকে, ‘প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’ ওঁর বাচনভঙ্গি, স্বর এবং অভিব্যক্তি আমার শরীরে অজস্র পুলকের জন্ম দিয়েছিল।

শম্ভু মিত্র যখন নিয়মিত অভিনয় করছেন না, তখন পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি দলের প্রথম সারির অভিনেতা—অভিনেত্রী তাঁকে রাজি করালেন অভিনয় করার জন্যে। সবাই মিলে করবেন গ্যালিলিওর জীবন। প্রধান চরিত্রে শম্ভু মিত্র। তার আগে গ্রুপ থিয়েটারের সংগীত পরিচালক হিসেবে দেবাশিস দাশগুপ্ত খুব নাম করেছে, তার সুরের গান, ‘কথা বলো না, কেউ শব্দ করো না’ তো সুপারহিট। ওর একটা লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে সাগরদাকে বলেছিলাম। সেটা পড়ে সাগরদা দেবাশিসকে দেশ পত্রিকার সংগীত সমালোচকের দায়িত্ব দেন, সেই সঙ্গে ছোট নাটক দলগুলোর নাটকের সমালোচনাও সে লিখত। এই দেবাশিসের ছোট ছেলে যে তখন একেবারেই বালক, ‘গ্যালিলিওর জীবন’—এ একটি ছোট চরিত্রে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিল। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে নাটক দেখতে গিয়ে শুনলাম, ছোট্ট ছেলেটা দারুণ গাইল। তারপর শম্ভু মিত্র। অপূর্ব অভিনয় তাঁর। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার পছন্দ হল না। গ্যালিলেও কেন নিজের কথা বলতে গিয়ে বারংবার ঊরুতে থাপ্পড় মারবেন? নিজেকে অল্পবয়সি প্রমাণ করতে? সেটা সমালোচনায় লিখেছিলাম। এই লেখাটা শম্ভু মিত্রকে অপ্রসন্ন করেছিল। অভিনয় চলাকালীন দশর্কদের মধ্যে ছিলেন উৎপত্ত দত্ত। মাঝে মাঝেই অভিনয় দেখে উল্লসিত হয়ে ‘বাঃ বাঃ’ বলছিলেন। শম্ভু মিত্র অভিনয় করার সময় চাইতেন না দর্শকরা কোনো শব্দ করুক। উৎপল দত্তের প্রশংসাও তাঁকে প্রসন্ন করেনি, এখন ভাবি, বাংলা সংস্কৃতি জগতের দুই স্তম্ভ, সত্যজিৎ রায় এবং শম্ভু মিত্রের বিরক্ত—হওয়া কথাবার্তা সাগরদাকে শুনতে হয়েছিল আমার কারণে, কিন্তু তিনি আমাকে তার আঁচ পেতে দেননি।

ধারাবাহিক উপন্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ক্রমশ আমি সরে এলাম সমালোচকের ভূমিকা থেকে। মনেও হচ্ছিল, এইসব লেখা লিখে আমি শত্রু তৈরি করছি। কিন্তু ‘সায়ক’—এর মেঘনাদ ভট্টাচার্য, যাদের নাটক ‘দায়বদ্ধ’ নিয়ে দীর্ঘ লেখা লিখেছিলাম; বলেছিল, ‘আপনার লেখা পড়ে আমাদের দর্শক বেড়ে গেছে।’ এরকম কথা বলেন, এমন মানুষ খুব কম। যখন শুধু নিজের লেখা লিখছি, তখন একসকালে ফোন এল সুপ্রিয় ব্যানার্জির কাছ থেকে।

সুপ্রিয় ব্যানার্জি। ফরসা, মোটাসোটা মানুষটি ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিসের কলকাতা অফিসের প্রাণপুরুষ বললে কম বলা হবে না। সাহেবদের সমীহ যিনি আদায় করেছেন স্বচ্ছন্দে, তিনি মনেপ্রাণে ঘোর বাঙালি ছিলেন। অতিশিক্ষিত, সুভদ্র যেসব বঙ্গসন্তানকে উনিশ শতক থেকে আমরা সমীহ করে এসেছি, সুপ্রিয়দাকে তাঁদের একজন বলে মনে হত।

রসরচনায় সিদ্ধহস্ত হলেও তেমন উৎসাহ নিয়ে লেখালেখি করেননি। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি স্যার উমেশচন্দ্র ব্যানার্জির উত্তরপুরুষ হলেও সুপ্রিয়দা কখনওই ওই প্রসঙ্গ তুলতেন না।

আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ এই সুপ্রিয়দার সৌজন্যে। সেই সময় মার্কিন সরকার প্রতি বছর কোনো তরুণ লেখক বা শিল্পীকে দিন পনেরোর জন্যে তাঁদের দেশ ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে যেতেন। ওদেশ থেকেও তরুণ লেখক—শিল্পী ভারতে আসতেন। আমার আগে বেশ কিছু বাংলা ভাষার লেখককে ওঁরা আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেছেন। সুপ্রিয়দার সঙ্গে পরিচয় দূরের কথা, মানুষটি কেমন দেখতে তা—ই জানতাম না। হঠাৎ চিঠি পেলাম বিনীত ভাষায় লিখেছেন, কয়েকজন তরুণ লেখক—শিল্পী আমেরিকা থেকে এসেছেন। তাঁদের তিনি বাংলা খাবার খাওয়াতে চান। আমি যদি সেই মধ্যাহ্নভোজনে অংশ নিই তাহলে আনন্দিত হবেন। ইউএসআইএস—এর প্যাডের পাতায় যে—খাবারের দোকানের নাম লেখা রয়েছে, তা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। বউবাজার এবং নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে বঙ্গলক্ষ্মী রেস্টুরেন্টকে যেতে—আসতে বহুবার দেখেছি। সাদামাটা বলেই মনে হত। কিন্তু সেসময় আজকের মতো নামী নামী বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্ট ছিল না, তবু বিদেশিদের খাওয়ানোর জন্যে বঙ্গলক্ষ্মীতে যাওয়াটা একটু অস্বাভাবিক ছিল।

চিঠিতে—দেওয়া সময়ে সিঁড়ি ভেঙে বঙ্গলক্ষ্মীর দোতলায় উঠতেই দেখলাম ধুতি—পাঞ্জাবি পরা হাসিমুখের একটি মানুষ এগিয়ে এসে বললেন, ‘আসুন ভাই। আমি সুপ্রিয় ব্যানার্জি। আপনি যে সমরেশ তা দেখেই বুঝেছি। এঁরা আমাদের অতিথি। আলাপ করিয়ে দিই!’

তিনজন সাদা বিদেশিনী, একজন কালো বিদেশির সঙ্গে পরিচিত হলাম। সূর্য সেন স্ট্রিটের পাইস হোটেলের থেকে সামান্য উন্নত বঙ্গলক্ষ্মীর চেহারা। কিন্তু রান্না চমৎকার। খেতে খেতেই আমি সুপ্রিয়দার ভাই সমরেশ হয়ে তুমিতে পৌঁছে গেলাম।

এর কয়েক মাস পরে আমন্ত্রণপত্র পেলাম। দ্রুত পাসপোর্ট, ভিসা হয়ে গেল। প্যানঅ্যাম এয়ারলাইন্সের টিকিট যখন সুপ্রিয়দা আমায় দিলেন, তখন তাঁকে প্রশ্নটা করেছিলাম, ‘আচ্ছা, আমাকে কেন নির্বাচন করলেন?’

সুপ্রিয়দা হেসেছিলেন, ‘আমি তো করিনি। তাঁদের কর্ম তাঁরা করেছেন, আর তুমি বলছ আমি করেছি। তোমার ‘দৌড়’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ এই মুহূর্তে শুধু ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসেই নেই, অনেক শহরের বড় লাইব্রেরিতেও গিয়ে পড়া যাচ্ছে। তোমার বয়সি অন্য কোনো লেখকের এই রকম বই না থাকায় ওরা তোমাকে বেছে নিয়েছে।’ আমার এখনও বিশ্বাস, সেদিন নিজেকে আড়াল করতেই সুপ্রিয়দা কথাগুলো বলেছিলেন। সজ্জনরাই নিজের প্রচার চান না।

আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছি। ‘কালপুরুষ’ লেখা শেষ হয়েছে। কপালে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কারটাও জুটে গিয়েছে। নিজেই অবাক হয়ে ভেবেছি। কী করে সম্ভব হল? তখনও সুনীলদা, শীর্ষেন্দুদা, যাঁদের অবশ্যই পুরস্কৃত করা কর্তব্য ছিল, তা না করে ‘কালবেলা’কে বেছে নেওয়া কেন হল? এ যেন আমারই লজ্জা! আমি এখনও ভাবি, অকাদেমির জুরিরা একটু তাড়াতাড়ি করে আমাকে বেছেছিলেন।

এদিকে তিনটে ধারাবাহিক, ‘উত্তরাধিকার’—’কালবেলা’— ‘কালপুরুষ’ লেখার পরেই ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ আমাকে চতুর্থ ধারাবাহিক উপন্যাসের জন্যে প্রস্তুত হতে বললেন। বিষয় যখন ভেবে পাচ্ছি না, তখনই সুপ্রিয়দার ফোন এল।

গেলাম ধর্মতলার ইউএসআইএস অফিসে। কোনো ভণিতা না করে তিনি বললেন, ‘শোনো সমরেশ। আমরা বাঙালিরা তো সব ব্যাপারে পিছিয়ে পড়ছি, তাই কেউ কিছু করার উদ্যোগ নিলে ভালো লাগে;তুমি নিশ্চয়ই দূরদর্শন দ্যাখো। সেখানে সরকারি কর্মচারীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে নাটক বানান। বেশিরভাগ নাটকের মান ভালো নয়। তা এখন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বেসরকারি প্রযোজকরা যদি সময় কেনেন তাহলে তাঁদের নাটক করতে দেওয়া হবে। কিন্তু নাটকের খরচ তাঁদেরই তুলতে হবে বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন দেখিয়ে। এই সুযোগটা নিতে এগিয়ে এসেছে একজন বাঙালি নাট্যকার, পরিচালক, অভিনতা। কিন্তু মাধ্যমটা যেহেতু নতুন তাই তিনি একজন ক্রিয়েটিভ মানুষকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চান। তুমি যদি রাজি হও তাহলে আমি খুশি হব।’

প্রস্তাবটা অভিনব। আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম সেই ভদ্রলোকের নাম।

সুপ্রিয়দা বললেন, ‘জোছন দস্তিদার। তুমি নিশ্চয়ই নাম শুনেছ!’

একটু হতাশ হলাম। কয়েক বছর আগে ‘দেশ’ পত্রিকায় আমি জোছন দস্তিদার পরিচালিত ‘প্রাগৈতিহাসিক’ নামের অল্পদৈর্ঘ্যের ছবির সমালোচনা লিখেছিলাম। ছবিটা যে ভালো লাগেনি তা ব্যাখ্যা করে লিখেছিলাম। সেই সমালোচনা পড়ে জোছনদা নিশ্চয়ই অখুশি হয়েছিলেন, তাই—সুপ্রিয়দাকে জিজ্ঞাসা করলাম, জোছনবাবুকে কি আমার কথা বলেছেন?

‘অবশ্যই। বলামাত্র জোছন রাজি হয়ে গেছে। দাঁড়াও, তোমাকে ওর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’ সুপ্রিয়দা ল্যান্ডলাইনের রিসিভার টেনে নিলেন। তখনও মোবাইল ফোন কল্পনার মধ্যে ছিল না।

জোছনদার সঙ্গে সেদিন কথা হল। বললেন, ‘আগামী রবিবার সকাল দশটায় আমার বাড়িতে কয়েকজন এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে বসব। আপনার যদি খুব অসুবিধে না হয় তাহলে এলে খুশি হব।’

কোনো অভিমান বা খারাপ লাগার চিহ্ন তাঁর গলায় ছিল না।

রবিবারে ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছেন। আমরা আলোচনা করলাম। থিয়েটার না বলে দূরদর্শন ধারাবাহিক বলা ঠিক হবে। আর যদি এক বা দুই পর্বে শেষ হয় তাহলে তাকে টেলিফিল্ম বলাই সঙ্গত হবে। সেদিন জোছন দস্তিদার তাঁর সহকর্মী এবং ‘চার্বাক’ নাট্যদলের সদস্য শ্যামল সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেখলাম, ভদ্রলোক শান্ত ভঙ্গিতে বুঝেসুঝে কথা বলেন। আবেগে ভেসে যান না।

পর পর কয়েকটা দিন বসার পরে জোছনবাবু আমার দাদা হয়ে গেলেন। আমাদের সংস্থার নামকরণ করা হল ‘সোনেক্স’। লেক গার্ডেন্সের শ্যামল সেনগুপ্তের বাড়ির একতলায় ক্যামেরা এবং এডিটিংয়ের ব্যবস্থা হল। দোতলায় অফিস। প্রথম দিকে চেয়ার—টেবিল না থাকায় মেঝের ওপর কাগজ পেতে বসে কাজ করতাম।

এই সময় গৌতম ঘোষ টিভির জন্যে বাংলা ‘গল্পবিচিত্রা’ নামে একটি টেলিফিল্ম বানাচ্ছিলেন। সম্ভবত ১৩টি পর্বের চুক্তি ছিল। আমার মাথায় তখন যে—চিন্তাটা পাক খাচ্ছিল তা হল, এমন একটা ধারাবাহিক নাটক তৈরি করতে হবে, যার কাহিনি কোনো প্রকাশিত গল্প—উপন্যাস থেকে নেওয়া হবে না। টিভির দর্শকদের কথা মনে রেখে তাঁদের জন্যে তৈরি করতে হবে। চিন্তাটা যখন ধীরে ধীরে একটা চেহারা নিচ্ছে, তখন ১০টি পর্বের টেলিফিল্ম শেষ করে গৌতম অন্য কোনো জরুরি প্রয়োজনে কাজটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। ওই পর্বগুলোর স্পনসর ছিল দেজ মেডিক্যাল, ১৩টি পর্বের ভাড়া তারা দিয়ে রেখেছিল দূরদর্শনকে। ফলে, তিন পর্বের ভাড়া ফেরত পাওয়া যখন সম্ভব ছিল না, তখন যোগাযোগ হওয়ায় সোনেক্স দায়িত্ব পেয়েছিল ওই তিনটি পর্বের জন্যে বাংলা গল্পবিচিত্রা তৈরি করতে। বাংলা ভাষায় টিভির টেলিফিল্মের ইতিহাসে একটি অভিনব ঘটনা ঘটল। তখন নতুন গল্প ভাবার সময় নেই বলে আমি আমার ‘উৎসবের রাত’ গল্পটির চিত্রনাট্য লিখে দেখলাম সেটি শেষ করতে দুটো পর্ব দরকার। তদ্দিনে রমাপ্রসাদ বণিক আমাদের সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছে। তাঁর অনুরোধে বিশিষ্ট নাট্যপরিচালক এবং অভিনেতা বিভাস চক্রবর্তী পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। সে সময় টিভি সিরিয়াল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি না হওয়ায় দূরদর্শনের কলাকুশলীরাই বেনামে কাজ করতেন। উৎসবের রাতের মূল দু’টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শ্রীযুক্তা তৃপ্তি মিত্র এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নাটক না, চলচ্চিচত্রের আঙ্গিকে শুটিং হয়েছিল। আশ্চর্য স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন ওঁরা। পরের একটি পর্বের নাটক ছিল ইন্দ্র মিত্রের হাসির গল্প ‘পরিণাম রমণীয়’ অবলম্বনে। অভিনয় করেছিলেন মমতা শংকর এবং এন বিশ্বনাথন।

‘উৎসবের রাত’ টেলিকাস্ট হওয়ামাত্র প্রশংসা পেলাম। আমরা খুশি হলাম। সেইসঙ্গে দেজ মেডিক্যালের কর্ণধার ভূপেন দে মশাই দেখা করতে চাইলেন। ওঁদের লিন্ডসে স্ট্রিটের অফিসে নয়, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে গিয়ে আমি আর জোছনদা দেখা করলাম। ছোটখাটো চেহারার মানুষটি দেজ মেডিক্যালের মতো প্রতিষ্ঠান শক্ত হাতে চালাচ্ছেন। বললেন, ‘আপনারা একটা ধারাবাহিক নাটক তৈরি করুন যাতে বাঙালি নিজেদের দেখতে পায়।’ জোছনদা তাঁকে আমার ভাবনা বলতেই তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘এটা তৈরি করতে যা খরচ তা আমরাই বহন করব। আপনি কোনো নাম ভেবেছেন সমরেশবাবু?’ হেসে বলেছিলাম, মাথায় যে—নামটা ঘুরছে তা হল, ‘তেরো পার্বণ।’

‘বাঃ। চমৎকার। বাঙালির বারো মাসে তো তেরো পার্বণ লেগেই আছে। এই নামটাই রাখুন। বাকি সমস্যাগুলো আমাদের দিলীপ আপনাদের সঙ্গে বসে সমাধান করবে। ব্যস, এটাই ফাইনাল।’ ভূপেনবাবু হেসে হাত মেলালেন।

তারপর ক’দিন ধরে শুধু ‘তেরো পার্বণ’ ছাড়া আর কিছু মাথায় নেই। সবে আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের দেখে এসেছি। জেনেছি, তাঁদের কেউ কেউ এখনও দেশের কথা ভাবেন, কে কেমন আছেন জানতে চান। এইরকম এক যুবক প্রায় ১২ বছর পরে কলকাতায় ফিরেছে কয়েক সপ্তাহের জন্যে। ওই ১২ বছরে প্রচুর পরিবর্তন হয়ে গেছে কলকাতার। সামাজিক, আর্থিক, পারিবারিক জীবনের গড়নেও বদল এসেছে। ওই যুবকের চোখে সেই বদলে যাওয়া চেহারা ধরা পড়ছে একের পর এক। তার মা, দাদা, বউদি, দুই ভাইপো—ভাইঝির সংসারে থেকে সে আত্মীয়বন্ধুদের দেখছে। এই ছেলেটির নাম রাখলাম গৌরব। ডাক নাম গোরা।

জোছনদা ঝটপট ঠিক করলেন গোরার মায়ের চরিত্রটিতে অভিনয় করবেন চন্দ্রাদি, যিনি চার্বাক নাট্যদলের অন্যতম শিল্পী এবং ব্যক্তিজীবনে জোছনদার স্ত্রী। চন্দ্রাদির সঙ্গে ইতিমধ্যে পরিচিত হয়েছি। মনে হল, এই নির্বাচন যথাযথ। কিন্তু গোল বাধল গোরা চরিত্রটি নিয়ে। জোছনদার ইচ্ছে ওই চরিত্রে সিনেমার নায়ক তাপস পালকে নেবেন। প্রথম বাংলা ধারাবাহিকে তাপস পাল নায়ক হলে লোকে দেখবে। কিন্তু আমি বলেছিলাম, তাপস যত ভালো অভিনেতাই হোক না কেন, ওই চরিত্রে তাকে মানাবে না। কারণ, গৌরব ১২ বছর আমেরিকায় ছিল। তার বাচনভঙ্গি বিশেষ করে, ইংরেজি উচ্চচারণ, হাঁটাচলায় যে—ছাপ পড়েছে, তা কলকাতায় থাকলে সম্ভব হবে না। সরল, মফসসলের যুবক তো নয়, তাপসকে দেখে মনেই হবে না সে ১২ বছর আমেরিকায় থেকেছে।

রোজ ঝগড়া হত আমাদের। অন্যান্য চরিত্রগুলোয় একের পর এক শিল্পী নেওয়া হয়ে গেছে। আমাদের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার ছিল সঞ্জয় হালদার। সে তার দুই ছেলে—মেয়েকে নিয়ে আসতেই দেখলাম ওরা গৌরবের ভাইপো—ভাইঝির বয়সি। মেয়েটিকে খুব ভালো লাগল। ওদের দু’জনকেই নির্বাচন করা হল। ওই দু’জনের নাম ইন্দ্রনীল এবং ইন্দ্রাণী। সেই ইন্দ্রাণী হালদার তার যোগ্যতা প্রমাণ করে পরবর্তীকালে খ্যাতনামা অভিনেত্রী হয়েছে। এখনও দেখা হলে বুঝতে পারি, সে সেই দিনগুলো ভুলে যায়নি।

কিন্তু গৌরব পাওয়া যাচ্ছিল না। সোনেক্সের অন্যতম স্তম্ভ শ্যামল সেনগুপ্ত প্রথম থেকেই আমাকে সমর্থন করায় তাপস পালকে পাকা কথা দিতে পারছিলেন না জোছনদা। এদিকে শুটিংয়ের আর কয়েকদিন বাকি। রেগে গিয়ে জোছনদা বললেন, ‘শোন সমরেশ, কাল বিকেলের মধ্যে তুই যদি কোনো নাম না বলিস তাহলে আমি তাপসকেই ফাইনাল করব!’

খুব সমস্যায় পড়লাম। কিন্তু সেই বিকেলে দোতলায় জানলা থেকে দেখলাম নীচের লনে যারা ব্যাডমিন্টন খেলছে, তাদের মধ্যে লম্বা চেহারার যে—যুবক রয়েছে, যে আমাদের ক্যামেরা—এডিটিং; ইত্যাদির দেখাশোনা করে, তার সঙ্গে আমার কল্পনার গৌরবের প্রচুর মিল রয়েছে। আমি চিৎকার করে তাকে ডাকলাম। বললাম, ওপরে আসতে।

ছয় ফুটের চেহারাটা টান টান, মেদ নেই। ওপরে উঠে বিনীত ভঙ্গিতে যুবক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, কিছু বলবেন?’

ওকে দেখলাম। ‘সোনেক্স’ চালু হওয়ার পর শ্যামলবাবুর এই বাড়িতে অফিস হয়েছে। বেশ কয়েকবার আসা হল। এই যুবক জোছনদার আত্মীয়, দেখা হলে সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। ঘনিষ্ঠ হওয়ার কোনো কথাই নয়। তাই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি দিল্লিতে থাকতে, তাই তো?’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

‘অভিনয় করবে? তেরো পার্বণে?’

‘সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।’

‘ঠিক আছে, পরে কথা বলছি।’ নেমে গেল দোতলা থেকে সে, যার নাম সব্যসাচী চক্রবর্তী।

জোছনদাকে প্রস্তাবটা দিতেই কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর চোখে কি ছানি পড়েছে? ভালো দেখতে পাচ্ছিস না?’

‘বুঝলাম না।’

‘ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিস?’

হ্যাঁ, সব্যসাচীর মুখের চামড়া মোলায়েম ছিল না।

বেশ কিছু ব্রণর দাগ, অমসৃণ মুখ হওয়া সত্ত্বেও একটা অন্য রকম স্মার্টনেস থাকায় সেটা দৃষ্টিকটু লাগত না।

জোছনদা বললেন, ‘ওই মুখ টিভির পর্দায় দু’সেকেন্ড ক্লোজে ধরা যাবে না। ধরলেই পাবলিক টিভি বন্ধ করে দেবে। তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস সমরেশ। তিন—চারটে এপিসোডের পর স্পনসর টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেবে। না, না, আমি তাপসের সঙ্গে কথা বলছি।’

শ্যামল সেনগুপ্ত আমাকে সমর্থন করলেন। বললেন, ‘কিন্তু ওই চরিত্রের সঙ্গে বেণুর হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গির খুব মিল রয়েছে। তাপসকে দেখে কি মনে হবে বিদেশে অনেকদিন থেকেছে?’

আমাদের দলভারী হল যখন জোছনদার স্ত্রী চন্দ্রাবউদি আমাকে সমর্থন করলেন। পরের দিন জোছনদা আমাকে বললেন, ‘তোর পছন্দ বেঠিক নয়। একদম নতুন নায়ককে পাবলিক যদি না নিতে পারে, তারপর ওই মুখ, ঠিক আছে কপালে যা আছে তা—ই হবে। তপনকে বলতে হবে বেশি ক্লোজ—আপে যেন না যায়। মেক—আপের পঞ্চুদাকে বলতে হবে যতটা সম্ভব মুখটাকে মেরামত করে দিতে।’

এখানে বলে রাখা ভালো, সব্যসাচীর ডাক নাম বেণু। ইউনিটের সবাই ওকে বেণু বলেই ডাকত। তপন দূরদর্শনের ক্যামেরাম্যান এবং পঞ্চুদা ওখানকার মেক—আপম্যান ছিলেন। তখনও পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে ছেলে—মেয়েরা বেরিয়ে আসেনি, তাই দূরদর্শনের কর্মচারীদের সাহায্য নিতে হত। সরকারি চাকরি বাঁচাতে তাঁরা নিজের নামে কাজ করতেন না।

তেরো পার্বণের শুটিংয়ের আগে ওয়র্কশপের জন্যে বেশি সময় পাওয়া যায়নি। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল শ্যামলের সূত্রে তেরো পার্বণের গৌরবের প্রেমিকার চরিত্রে অভিনয় করতে এসেছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের এয়ার হোস্টেস খুশি মুখার্জি। খুশিকে চমৎকার মানিয়েছিল।

‘তেরো পার্বণ’ পরিচালনা করেছিলেন জোছন দস্তিদার, তাঁকে সাহায্য করেছে রমাপ্রসাদ বণিক। পরে রমাপ্রসাদকে পূর্ণ দায়িত্ব দিলেন জোছনদা। প্রতি বৃহস্পতিবারে রাত আটটায় আধঘণ্টার স্লটে ধারাবাহিকটি প্রচারিত হত। দুই সপ্তাহের মধ্যে তেরো পার্বণ জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে গেল। হিন্দিতে ‘বুনিয়াদ’ যে—জনপ্রিয়তা সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে পেয়েছিল, তেরো পার্বণের গণ্ডি ছোট হলেও মুখে মুখে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

আমার সেই প্রথম ধারাবাহিকের জন্যে চিত্রনাট্য লেখা। স্বাভাবিকভাবেই বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। মাঝে মাঝে দে’জ মেডিক্যালের বড়কর্তার সঙ্গে আলোচনা করতে আমাদের যেতে হত। জোছনদা প্রায়ই আমাকে সঙ্গে নিতেন। দে’জ মেডিক্যালের একজন অফিসার, দিলীপবাবু আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এই হাসিখুশি ভদ্রলোকের সহযোগিতার কথা এখনও মনে আছে। সাধারণত আমরা ভূপেন দে মশাইয়ের বাড়িতে অথবা বালিগঞ্জ ফাঁড়ির অফিসে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতাম। একবার কোনো কারণে দিলীপবাবু আমাকে ওঁদের লিন্ডসে স্ট্রিটের অফিসে যেতে বললেন। সেখানে গিয়ে কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় দিলীপবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমাদের আর এক কর্তা কথা বলতে চান, আসুন।’ জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এই কর্তার নাম শ্রীযুক্ত ধীরেন দে। নামটি জানেন না এমন ফুটবল অনুরাগী তখন কলকাতায় ছিলেন কিনা সন্দেহ। মোহনবাগান ক্লাবের সম্পাদক এই মানুষটির ক্লাবের প্রতি ভালোবাসার যে শেষ ছিলনা একথা আমরা মোহনবাগানি বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম।

ওঁর ঘরে নিয়ে গেলেন দিলীপবাবু। বললেন, ‘ইনি সমরেশ মজুমদার।’

টেবিলের উল্টো দিকে শীর্ণ চেহারার প্রৌঢ় মানুষটি একটু কেৎরে বসেছিলেন। মুখ দেখেই বুঝলাম, ওঁর মেজাজ একটুও ভালো নেই। আমাকে একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলেন, প্রায় মিনিটখানেক চুপ করে বসে থেকে বললেন, ‘বেশ তো লেখালেখি হচ্ছিল, এই লাইনে এলেন কেন? ছিঃ!’

আমি হতভম্ব। যে—কোম্পানি আমাদের তেরো পার্বণ স্পনসর করছে, তার একজন কর্তা এ কী কথা বলছেন! ধীরেনবাবু আবার বললেন, ‘এইসব নাচগান আর ফালতু নাটক করে সময় নষ্ট করছেন কেন?’

ওঁর বিরক্ত মুখ দেখে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। তবু বললাম, ‘দর্শকরা তো খুব প্রশংসা করছে। সবাই ভালো বলছে।’

‘দর্শকদের চরিত্র জানেন না? টিম জিতলে মাথায় তুলে নাচে আর হেরে গেলে বাপ—মা তুলে গাল দেয়। কী করা যাবে! ভূপেনবাবুর ইচ্ছে হয়েছে তাই দে’জ মেডিক্যাল স্পনসর করছে। আমি কী বলব! কিন্তু আপনাকে বলছি, নিজের সর্বনাশ আর করবেন না। এসব ছেড়ে দিয়ে লেখা নিয়ে থাকুন। আচ্ছা—’

বাইরে বেরিয়ে এলে দিলীপবাবু আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিলেন—’উনি একটু ওইরকম। মনে যা আসে তা বলে দেন। আসলে আপনাকে লেখক হিসেবে দেখতে উনি বেশি পছন্দ করেন, তাই।’

ঠিক তখনই ধীরেনবাবু তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, ‘একটা প্লাস পয়েন্ট, ওই গোরা ছেলেটিকে কোথায় পেয়েছেন? খুব ভালো। রাইট চয়েজ।’ বলে চলে গেলেন।

সেই চুরাশি সালে যখন তেরো পার্বণে মজে আছি, তখন আমার বন্ধুরা, অভিভাবকরা প্রায় ধীরেনবাবুর মতোই কথা বলেছিলেন। টিভি এবং ফিল্ম গুলিয়ে ফেলে তাঁরা বলেছেন, ‘সিনেমা লাইনে গিয়ে নিজের সর্বনাশ করলে সমরেশ। এত অল্পবয়সে অকাদেমি পুরস্কার পেয়েও সিনেমা লাইনে গিয়েছ? এরপর কি আর লিখতে পারবে? একজন বুঝিয়েছিলেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র যদি সিনেমা না বানাতেন তাহলে বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছ থেকে আরও ভালো লেখা পেত। শৈলজানন্দ সিনেমা করে নিজের সর্বনাশ করেছেন। এঁরা কেউ সত্যজিৎ বা ঋত্বিক হতে পারেননি, আবার তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণকেও স্পর্শ করতে পারলেন না। অতএব ভেবে দ্যাখো সমরেশ, ভেবে দ্যাখো।’

ধীরেন দে মশাই বয়সে অনেক বড়। তাঁর মুখের ওপর কথা বলা ধৃষ্টতা হত। কিন্তু আমি একটা পথ খুঁজে নিলাম। সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখা, শুটিংয়ের আয়োজন করার নেশা থেকে বেরিয়ে আসার কথা তখন ভাবছিলাম না। আবার লেখা ছেড়ে দেব তা স্বপ্নেও চিন্তা করিনি। হঠাৎ মনে হল, অনেক লেখক দশটা—পাঁচটা চাকরি করেন। সকাল—সন্ধে লেখেন। বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, শংকর যদি চাকরির সঙ্গে লেখা চালিয়ে যেতে পারেন তাহলে আমি পারব না কেন? সকালে খেয়েদেয়ে এগারোটার সময় সোনেক্সের অফিসে এসে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত যা কাজ করছি তা করে বাড়ি ফিরে যাব। লিখব সকাল এবং সন্ধ্যায়। লেখার সময় যেমন সিরিয়াল নিয়ে ভাবব না তেমনই সিরিয়ালের কাজ করার সময় লেখা নিয়ে ভাবব না। ক’দিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম, এইরকমভাবে কম্পার্টমেন্ট ভাগ করতে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। সিরিয়ালের পাশাপাশি লেখালেখি চালাতে সমস্যা হয়নি। এই সিরিয়াল করতে করতেই ‘গর্ভধারিণী’ অথবা ‘সাতকাহন’ লিখেছি, লিখতে পেরেছি।

তখন সোনেক্স ছিল জমজমাট। জোছনদা এবং শ্যামলবাবু তো ছিলেনই, আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল রমাপ্রসাদ বণিক। তারপর এল দেবাংশু সেনগুপ্ত। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে। এল যিশু দাশগুপ্ত। যিশু এসেছিল লাইটের অ্যারেঞ্জার হিসেবে। কিন্তু ওর বাসনা ছিল ক্যামেরাম্যান হওয়ার। বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান মহাজন সাহেবের ছায়ায় ছিল কিছুদিন। কিন্তু নতুন কারওর পক্ষে চট করে সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। তাছাড়া আমাদের পূর্বঅভিজ্ঞতা না—থাকায় জোছনদা ক্যামেরা, সম্পাদনার দায়িত্ব দূরদর্শনের অভিজ্ঞদের হাতে দিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। আমরা খুব ভাগ্যবান, বিখ্যাত সেতারশিল্পী দীপক চৌধুরীকে পেয়েছিলাম সংগীত পরিচালক হিসেবে।

প্রথমে ঠিক ছিল, তেরো পার্বণ শেষ হবে তেরো সপ্তাহে। নামকরণের সময় সেটাই ঠিক ছিল। প্রতি সপ্তাহের এপিসোড যেন একটা পার্বণ। দশ নম্বর যখন লিখছি, তখন জোছনদা বললেন, ‘দ্যাখ, সিরিয়াল এখন জমে ক্ষীর হয়ে গেছে। প্রতি বৃহস্পতিবার তেরো পার্বণ দেখা দর্শকদের অভ্যেসে এসে গেছে, তাই স্পনসররা চাইছে না তেরোটায় শেষ করে দিতে। তুই গল্প বাড়িয়ে যা।’

বললাম, ‘দুধে জল মেশালে স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।’

জোছনদা বললেন, ‘জল মেশাতে কে বলেছে? দুধে দুধ মেশা। তুই পারবি। আর তেরো পার্বণ হল নানান রকমের উৎসব। তেরো সপ্তাহে তা শেষ না—ও হতে পারে।’

যে—গল্প তেরো পর্বে ভেবেছিলাম, তা ছাব্বিশে নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আর নয়। ছাব্বিশে গোরা আমেরিকায় ফিরে যাবে।’

তখন তিন শিফটে এক পর্বের শুটিং করা হত। একটি এপিসোডের জন্যে পাওয়া যেত এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা। এখন নাকি একদিনে দেড় এপিসোডের শুটিং হয়। ফলে, নানান কৌশলের আশ্রয় নিতে হয় পরিচালকদের। কিন্তু সেই শুরুর সময় আমরা প্রচুর সময় অনেক যত্ন নিয়ে সিরিয়াল তৈরি করতে পেরেছিলাম।

কিন্তু ছাব্বিশেও থামতে চাইলেন না জোছনদা। অবশ্য এ ব্যাপারে স্পনসরের চাপ তাঁর ওপর ছিল। সোনেক্স তৈরি করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়েছিল। একটা চালু সিরিয়াল থাকলে সেই আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়। তাছাড়া সিরিয়ালের সঙ্গে জড়িত শিল্পী—কলাকুশলীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। কিন্তু আমার পক্ষে আর গল্প বাড়ানো সম্ভব ছিল না। আমি সরে যেতে রমাপ্রসাদ এবং জোছনদা যৌথ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেই ওঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, রবার টেনে লম্বা করা হচ্ছে। তখন আমাকে অনুরোধ করলেন, ‘তুই শেষটা করে দে।’ শেষ এপিসোড লেখা হল। তেরো পার্বণের বেশির ভাগ শুটিং হয়েছিল সল্ট লেকের একটি বাগানওয়ালা বাড়িতে। দারুণ অভিজ্ঞতা হল।

সোনেক্স পর পর কয়েকটা সিরিয়ালে হাত দিল। ‘উড়নচণ্ডী’, ‘আশ্চর্য দীপক’, ‘সেই সময়’। বাংলা সিরিয়ালে সোনেক্সের অবদান কখনওই ভোলা যাবে না।

কিছুদিন থেকেই আমার মনে হচ্ছিল, শুধু চিত্রনাট্যকার হিসেবে নয়, প্রযোজক হিসেবেও কাজ করা উচিত। তাতে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়। আর এই সময় আলাপ হল ‘বহুরূপী’ এবং ‘চেনামুখ’—এর অভিনেতা অরিজিৎ গুহের সঙ্গে। রমাপ্রসাদও আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। তিনজনে ঠিক করলাম, আমরা নতুন ধরনের সিরিয়াল করব। তখনও চ্যানেল বলতে ছিল একমাত্র দূরদর্শন। পূর্ণদাস রোডে আমাদের অফিস হল। সংস্থার নাম রাখা হল ‘টেলিফ্রেম’।

সাহিত্যিক সাংবাদিক সন্তাোষকুমার ঘোষ আমাকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছিলেন। সাহিত্য ও জীবনবিষয়ক অনেক পরামর্শ তাঁর কাছে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি।

পেছনে তাকিয়ে মনে হয়েছে যতটা যোগ্য হলে তার সদব্যবহার করা যেত তা আমি ছিলাম না। তখন সপ্তাহের অন্তত দিনতিনেক সন্তাোষদার সঙ্গে বিকেল—সন্ধে কাটত। রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে তাঁর পাণ্ডিত্য সমস্ত রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞরা তো বটেই, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে সুচিত্রা মিত্র স্বীকার করতেন। ফলে, প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ পেতাম।

সন্তাোষদার সঙ্গে আড্ডা জমত গণেশ অ্যাভেনিউয়ের এক পানশালায়। অভিনেত্রী সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী মামাজি ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আড্ডার দ্বিতীয় জায়গা ছিল পার্ক স্ট্রিটের লাগোয়া রাতদিন হোটেলের বাগানে। ওই রাতদিন হোটেলেই আলাপ হল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। ভারী শরীর, পায়ে প্রতিবন্ধকতা থাকায় ক্রাচের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করেন অথচ মোটরসাইকেল চালান। অবশ্য সেই মোটরসাইকেলের ব্যালান্স রাখার জন্যেই সম্ভবত পাশে একটি ক্যারিয়ার লাগানো থাকত। ভদ্রলোক থাকতেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের হৃষীকেশ পার্কের কাছে। নাম আশুতোষ গুপ্ত। আলাপের সূত্র ছিল, আশুতোষবাবু ‘কালীয়’ নামে একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করতেন। তাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তিনি প্রতিবন্ধীদের সমস্যা নিয়েই লিখতেন। হাতের কাছে সন্তাোষদার মতো বড়মাপের লেখককে পেয়ে তিনি খুশি হয়েছিলেন। আমরা রাতদিনে গেলেই একবার দেখা করে যেতেন। যতদূর মনে পড়ছে, আশুতোষবাবু রাতদিন হোটেলের রিসেপশনের দায়িত্বে ছিলেন।

এই আশুতোষবাবু এবং তাঁর কালীয় পত্রিকার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হতেই আমার মাথায় নতুন ধরনের টিভি ধারাবাহিকের ভাবনা আসে। প্রতিবন্ধীদের জীবন, তাদের সমস্যার কথা বললে সেটা নিছক ডকুমেন্টারি টেলিফিল্ম হবে। দর্শকরা যেমন আকর্ষণ বোধ করবেননা, স্পনসর পাওয়াও শক্ত হবে। একজন প্রবীণ অবিবাহিত ডাক্তার, যিনি প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্যে নার্সিং হোম চালান আর একটি কলগার্ল, যার প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে তাদের দু’জনকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে টিভি ধারাবাহিক তৈরি করার কথা ভাবলাম।

ভাবনাটা শক্ত হতে কয়েক বছর লেগে গেল। সন্তাোষদা গত হয়েছেন। আমার ‘তেরো পার্বণ’ পর্ব শেষ হয়েছে। অরিজিৎ গুহ এবং রমাপ্রসাদ বণিককে বিষয়টা বললাম। ওদের পছন্দ হল। স্থির হল, একদা যাত্রিক পরে ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবির নায়ক এবং তারও পরে বেশ কিছু ছবির পরিচালক—নায়ক দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেব। তখনও দিলীপবাবুকে কোনো টিভি ধারাবাহিক তো দূরের কথা, টেলিফিল্মেও দেখা যায়নি। আমরা ওঁর লেক মার্কেটের কাছের বাড়িতে গিয়ে দেখা করলাম। প্রথমে কিন্তু কিন্তু করছিলেন। কারণ, টিভি—মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক তৈরি ছিল না। শেষপর্যন্ত রাজি হলেন। বললেন, ‘আপনার লেখা গল্প উপন্যাস এতদিন পড়েছি, অভিনয় করলে হয়তো খুব ভালো লাগবে।’

সব ঠিক হল কিন্তু টাকা পাব কোথায়? আমাদের তিনজনের সামর্থ্য ছিল না একটা টিভি ধারাবাহিক প্রযোজনা করার। শেষপর্যন্ত অরিজিৎ বন্ধুদের সাহায্য চাইল। চারজন দেড়লক্ষ করে টাকা আমাদের দিল এই শর্তে, টেলিকাস্ট হওয়ার পর টাকা পেলেই তাঁদের শতকরা দশ টাকা সুদসমেত ফেরত দিতে হবে।

এখন ব্যাপারটা স্বপ্ন বলে মনে হয়। ছয় লক্ষ টাকার পুঁজি নিয়ে কেউ যদি টিভি সিরিয়াল তৈরি করতে চায় তাহলে সেই স্বপ্নবিলাসীকে পাগল বলা হবেই। শুনেছি, এখন অন্তত একশোটি এপিসোড তৈরি করে অপেক্ষা করতে হয় কবে দেখানোর সুযোগ পাওয়া যাবে। স্পনসরদের টাকা পেতে পেতে একশো এপিসোড প্রায় ফুরিয়ে আসে। এই লেখা লেখার সময় একজন প্রযোজক জানালেন, তিনি প্রথম দশটি এপিসোডের টাকা পেয়েছিলেন একশো তিরিশ এপিসোড টেলিকাস্ট হওয়ার পরে। অথচ আমরা মাত্র ছয় লক্ষ টাকা ধার করে টেলিফ্রেম শুরু করেছিলাম, ভাবা যায়?

ঠিক হল নতুন ধারাবাহিকের নাম হবে ‘মুক্তবন্ধ’, পরিচালনা করবে রমাপ্রসাদ বণিক। সোনেক্সে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। এই দলে ছিলেন হিমাংশু দাস। হিমাংশু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি দফতরের ইনস্পেক্টর হওয়া সত্ত্বেও সোনেক্সে গিয়েছিলেন শখ মেটাতে। শুটিং, সিরিয়ালের অন্য কাজকর্ম যা পর্দার পেছনে হয়, তা ওকে আকর্ষণ করত। কিন্তু কোনো টেকনিক্যাল ব্যাপারে ওর অভিজ্ঞতা না থাকায় জোছনদা হিমাংশুকে সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে নিয়েছিলেন। যে—কোনো কাজের দায়িত্ব হিমাংশুকে দিলে তা ঠিকঠাক করে দিতে পারত সে। প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিল সঞ্জয় হালদার। কিন্তু তাকেও নির্ভর করতে হত হিমাংশুর ওপর। একটা ঘটনার কথা বলছি। সদ্য শেষ হয়েছে তেরো পার্বণের চার নম্বর এপিসোড। হিমাংশু এসে জোছনদাকে একটা কাগজ দিল যাতে খরচের হিসেব রয়েছে। শুটিংয়ের জন্যে যে যা কিনেছে, যাদের টাকা দিতে হবে তার তালিকা বানিয়ে বলল, ‘সই করে দিন, ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে টাকা নেব।’

জোছনদা হিসেবে আলতো চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘সাড়ে তিন হাজার টাকা!’ তারপর কলম বের করে কেটে আড়াই হাজার লিখে দিলেন। দেখামাত্র হিমাংশু চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনি এককথায় হাজার টাকা কমিয়ে দিলেন? আমি কি পকেট থেকে টাকা খরচ করব? অসম্ভব। এভাবে কাজ করা আমার দ্বারা হবে না।’ বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার প্রতিবাদ শোনার পর জোছনদা কাগজটা টেনে নিয়ে আড়াই হাজার কেটে তিন হাজার লিখে দিলেন। বিড়বিড় করতে করতে হিমাংশু ক্যাশিয়ারের কাছে গেল টাকা নিতে। ব্যাপারটা লক্ষ করে জোছনদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কী হল? আপনি তো স্ক্রুটিনি না করেই টাকা কমিয়ে দিলেন।’

‘যদি হিসেবটা ঠিকঠাক হত তাহলে শেষপর্যন্ত পাঁচশো টাকা কম পেলেও ও মেনে নিত? ফিল্মের হিসেবে জল থাকে। তা থেকে সিরিয়াল আলাদা হবে না।’ জোছনদা হেসে বলেছিলেন।

বললাম, ‘তাহলে জেনেশুনেও মেনে নিচ্ছেন কেন?’

জোছনদা তখন একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন, ‘দ্যাখ সমরেশ, একটা সৎ লোক যে কিনা অকর্মণ্য, আর একজন যে হয়তো অসৎ কিন্তু কাজে পটু, তুই দু’জনের কাকে পছন্দ করবি?’

একটু ভেবে বলেছিলাম, ‘দ্বিতীয়জনকে।’

‘কারেক্ট। কিন্তু আলগা করা চলবে না, তাহলেই কাজটা ভালোভাবে হবে। যে টাকা খরচ করছে তাকে একটু—আধটু স্বাধীনতা দিলে ক্ষতি নেই।’ জোছনদা বলেছিলেন।

আশুতোষবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাঁর কালীয় পত্রিকা পড়ে আমি মুক্তবন্ধের চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। যেহেতু প্রতিবন্ধী শিশুদের সমস্যা ধারাবাহিকে প্রাধান্য পেয়েছিল, তাই সতর্ক থাকতে হয়েছিল কোনো ভুল না থেকে যায়।

চিত্রনাট্য শেষ হল। ঠিক করেছিলাম মোট তেরোটি পর্বে ধারাবাহিক শেষ হবে। কিন্তু কলগার্লের চরিত্রে কোনো অভিনেত্রীকেই আমাদের পছন্দ হচ্ছিল না। আমরা স্থির করেছিলাম, দর্শকরা যাঁকে জানেন, চেনেন এমন কোনো অভিনেত্রীকে আমরা ওই চরিত্রে নির্বাচন করব না। নতুন অভিনেত্রীকে দেখলে দর্শক তাঁকে ধারাবাহিকের চরিত্র হিসেবেই ভাববে। মুশকিল হল সেরকম নবাগতা অভিনেত্রীকে আমরা পাচ্ছিলাম না। বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর যেসব ছবি এল, তাদের কাউকে পছন্দ হল না। এই সময় রমাপ্রসাদ বণিক একটি মেয়েকে নিয়ে অফিসে এল। মেয়েটি নাকি কলকাতায় তৈরি হিন্দি টেলিফিল্মে কাজ করেছে কিন্তু সেটা তাকে তেমন পরিচিতি দেয়নি। নতুন অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের অনেকেই ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এই মেয়েটিকে সেই অসুবিধায় পড়তে হবে না। কিন্তু রমাপ্রসাদ যাকে নিয়ে ঘরে এল, তাকে দেখে মনে মনে মুষড়ে পড়লাম। মেয়েটির চোখ দু’টি অত্যন্ত আকর্ষণীয়, সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু মুখে ঈষৎ ব্রণর দাগ এবং শরীর অত্যন্ত শীর্ণ ছিল। কথা বলার সময় বুঝলাম মেয়েলি মিষ্টি গলা ওর নয় যা চরিত্রের সঙ্গে মানানসই।

মেয়েটি চলে গেলে রমাপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোন চরিত্রে ওকে ভেবেছিস?’ সে সরল গলায় জবাব দিয়েছিল, ‘কেন? ওই কলগার্লের চরিত্রে।’

বয়সে অনেক ছোট, মান্য করে কথা বলে যে তাকে ব্যাপারটা বোঝাতে একটু বিপাকে পড়লাম। শেষপর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুই কোনো কলগার্ল দেখেছিস। মানে বাস্তবে না—হোক সিনেমা—থিয়েটারে?’

‘প্রস্টিটিউট আর কলগার্লের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে?’

‘আছে।’

‘তা হলে দেখিনি।’

‘শোন, কথা বলা, হাঁটাচলায় চটক থাকবেই আর সেইসঙ্গে শরীরের গঠনও এমন যা অনেক পুরুষকে আকর্ষণ করে। আর এটাই ওদের ব্যবসার মূলধন। এই মেয়েটির শরীরের সঙ্গে কি তা মিলছে? এত রোগা মেয়েকে কি দর্শক কলগার্ল হিসেবে মেনে নেবে?’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল রমাপ্রসাদ। দু’দিন পরে আমাদের মেক—আপম্যান পঞ্চুদা এসে বললেন, ‘ওই মেয়েটিকে আর একবার দেখুন।’

‘কোন মেয়েকে?’

‘যাকে রমাপ্রসাদ কলগার্লের চরিত্র করাতে এনেছিল।’ পঞ্চুদা বললেন।

তখন অরিজিৎ অফিসে ছিল। পঞ্চুদা মেয়েটিকে নিয়ে এলেন। ওর দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ব। দু’দিন আগে যাকে দেখে সাদামাটা রোগা মেয়ে বলে মনে হয়েছিল, তাকে এখন অনেক আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। অরিজিৎ ওর সঙ্গে টুকটাক কথা বলার পর আমাকে বলল, ‘মনে হচ্ছে আমরা পেয়ে গেছি।’

বাংলা সিরিয়াল এবং পরবর্তীকালে হিন্দি সিরিয়ালের বিখ্যাত নায়িকাকে আবিষ্কার করার কৃতিত্ব রমাপ্রসাদ বণিকের, যাকে সাহায্য করেছিলেন পঞ্চুদা। অরিজিৎ আর আমি ওদের বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এলাম। এই মেয়েটির নাম রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।

অভিনয় শেখার ব্যাপারে রূপা রমাপ্রসাদের অনুগত ছাত্রী ছিল। যেমন থিয়েটারের রিহার্সালে, তেমনই শুটিংয়ের ফ্লোরে রমাপ্রসাদ কোনো আপস করত না। যতক্ষণ—না সে যা চাইছে তা কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রী দিতে না পারছেন, ততক্ষণ সে হাল ছাড়ত না। রূপাকে রমাপ্রসাদ অভিনয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।

টেলিকাস্ট চলছিল। আমরা মুক্তবন্ধের শুটিং করতাম বেহালার একটি প্রতিবন্ধীদের হোমে। ওখানে কিশোর সাহু নামে একটি তরুণ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সে আগে গাড়ি চালাত। চলে এল প্রোডাকশনের কাজে। অনেক বছর পরে কিশোর সিরিয়ালের প্রযোজক হয়েছিল। একদিন শুটিংয়ে এসে রূপা সরাসরি চলে এল আমার সামনে। এসে প্রণাম করে বলল, ‘আচ্ছা, আপনি প্রভাত রায়ের নাম শুনেছেন?’ হেসে বললাম, ‘বিলক্ষণ। খুব ভালো পরিচালক।’

‘মুক্তবন্ধে আমার অভিনয় দেখে উনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন। কী করব, যাব?’ রূপা জিজ্ঞাসা করেছিল।

বলেছিলাম, ‘অবশ্যই যাবে। কবে ডেকেছেন।’

‘আজ বিকেলে।’

সেদিন আমাদের শুটিং তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার কথাই ছিল। তাই রূপাকে ছেড়ে দিতে সমস্যা হয়নি। পরের দিন সে এসে জানাল, প্রভাতবাবু তাঁর পরের ছবির জন্যে ওকে নির্বাচিত করেছেন। সেদিন আমরা সবাই খুব খুশি হয়েছিলাম। তারপর মহাভারতের দ্রৌপদী করে সে খ্যাতির শীর্ষে উঠে গেল। এর মধ্যে একদিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে গিয়েছি একটা কাজে, হঠাৎ দেখি রূপা দৌড়ে আসছে। ওর পরনে যে—সিরিয়ালে কাজ করছিল তার পোশাক। এসে প্রণাম করে হাসল, ‘কেমন আছ?’

মুক্তবন্ধ শেষ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে ঘটনাটা ঘটেছিল। ওপরে উঠে গেলে সাধারণত কেউ নীচের মাটির দিকে তাকায় না। হয়তো ভার্টিগো হয়, তাই? এটা অভিনেতা— অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে খুব প্রযোজ্য। রূপা কিন্তু ব্যতিক্রম।

টেলিফ্রেম তখন বেশ পরিচিতি পেয়েছে। আমাদের পরের ধারাবাহিক ‘কলকাতা’, কেন জানি না লোকে নাম দিয়েছিল ‘কলকাতা—কলকাতা’। এর অন্যতম কারণ সিরিয়ালের টাইটেল মিউজিক। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই নাম। তার কথায় কলকাতা—কলকাতা থাকায় ওটাই নাম হয়ে গেল। যদিও সিরিয়ালের টাইটেলে শুধু কলকাতাই লেখা হত। আর এই কলকাতার শিল্পী নির্বাচন করতে গিয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম।

‘কলকাতা’ ধারাবাহিকের কাহিনি কোনো প্রকাশিত গল্প বা উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়নি। টিভির দর্শকরা কয়েক হাত দূরে বসে দেখছেন।

কী দেখবেন তা তাঁরাই ঠিক করবেন। ততদিনে আরও কয়েকটি সংস্থা এগিয়ে এসেছে টিভির জন্যে ধারাবাহিক বানাতে। যে—ধারাবাহিক ভালো লাগে সেটা দেখতেই দর্শকরা সময় বেছে নেন। আমার মনে হয়েছিল, এই দর্শকদের আকৃষ্ট করতে নতুন ধরনের গল্প দরকার। প্রকাশিত এবং পঠিত গল্প—উপন্যাসের আগাগোড়া জানা থাকায় সামান্য পরিবর্তনও অনেক দর্শকের অপছন্দের কারণ হয়। সাধারণত একটি উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, ধারাবাহিকের সাতটি পর্বেই মূল উপন্যাস শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তাকে টেনে তেরো—ছাব্বিশ—ঊনচল্লিশ করতে গেলে কাহিনির উপকাহিনিগুলো বাড়াতেই হবে, নতুন কাহিনি জুড়ে দিতে হবে। এই কাজটা অনেক ক্ষেত্রেই দুধে জল মেশানোর বদলে জলে দুধ মেশানো হয়ে যায়। দর্শক সেটা বুঝতে পারেন।

তাই যে—গল্প দর্শক পড়েননি, জানেন না, তা—ই ধারাবাহিকের বিষয় হলে অনেক সুবিধে হয়। ‘কলকাতা’ সিরিয়ালের বিষয় হল একটি মাল্টিস্টোরিড বাড়ি, যেখানে নানান ভাষী মানুষ থাকেন, তাঁদের সমস্যা যা বাড়ির ম্যানেজার এবং কেয়ারটেকার সমাধান করার চেষ্টা করছে।

যেহেতু অরিজিতের চেহারা বেশ জাঁদরেল ছিল, কমেডি অভিনয়ও চমৎকার করতে পারত, তাই ম্যানজার হিসেবে ওকে দিব্যি মানিয়ে গেল। কিন্তু সমস্যায় পড়লাম কেয়ারটেকার চরিত্রটি নিয়ে। পরিচালক রমাপ্রসাদ বণিকের ইচ্ছে ছিল ওই চরিত্রটি রবি ঘোষমশাই করুন। ছোটখাটো চেহারা, অত্যন্ত সরল, অর্ধশিক্ষিত, মুখে বোকা বোকা হাসি, এমন ভূমিকায় রবি ঘোষকে দারুণ মানাবে। আমিও ওর সঙ্গে একমত ছিলাম। আমরা রবিদার বাড়িতে গেলাম, আগেই পরিচয় ছিল; রমাপ্রসাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। চরিত্রটির বর্ণনা শুনে তিনি খুব উৎসাহিত হলেও দেখা গেল, আগামী নয় মাস তাঁর ব্যস্ততা থাকায় সময় বের করতে পারছেন না।

আমরা বিপাকে পড়লাম। নয় মাস অপেক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। ‘টেলিফ্রেম’ তৈরি করার পর আমাদের খরচ বেড়েছে। অথচ ওই চেহারার কোনো ভালো অভিনেতার কথা মনে আসছিল না। তার ওপর অন্যান্য চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করবেন বলে ঠিক করা হয়েছে, তাঁদের বেশিরভাগই অভিনয়জগতের মানুষ নন। একজন পারসি বৃদ্ধার চরিত্র কোনো বাঙালি অভিনেত্রী যত ভালো অভিনয় করুন, মানানসই হবে না। পার্ক স্ট্রিটের একটি পারসি পরিবারের সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধাকে রাজি করিয়েছে অরিজিৎ। সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় নামী অভিনেত্রী। কিন্তু আমরা ওঁর স্বামী কাপুর সাহেবকে, যাঁকে সবাই ‘মামাজি’ বলে চিনত, রাজি করিয়েছি অভিনয় করাতে। একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতি ‘কলকাতা’ ধারাবাহিকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে ছিল। বাঙালি অভিনেতা নেব না, কিন্তু কোথায় পাই তাঁদের। খবর এল, হিমাংশু খবর নিয়ে এল, শর্ট স্ট্রিটের একটি বাড়িতে অনেক ভাড়াটে থাকেন। তাঁদের মধ্যে দু’টি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারও আছেন। যোগাযোগ করা হল। ছেলেটিকে হিমাংশু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভেবেছিল কিন্তু আসলে সে নেপালি বাবা আর আমেরিকান মায়ের ছেলে। নাম বলল, ববি ইয়ং। যে—মেয়েটি ওই বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটে থাকে, সে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে, তবে তার জন্যে মাস ছয়েক দেরি হবে। ওদের নির্বাচন করা হল। যতটা সম্ভব কম হিন্দি—ইংরেজি সংলাপ ওদের দিয়ে বলানো হবে বলে স্থির হল। ওই মেয়েটির আর অস্ট্রেলিয়াতে যাওয়া হয়নি। ওই বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসা বিখ্যাত ফুটবলার চিমা ওকোরির প্রেমে পড়ে সে, পরে ওরা স্বামী—স্ত্রী হয়ে যায়।

বাঙালি দম্পতির জন্যে বেশি ভাবতে হয়নি। আমার কলেজজীবনের বন্ধু, যে পরে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করছিল, সেই সুব্রত নায়ককে চরিত্রটির সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গেল। এর মধ্যে একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে গিয়েছি। করিডরে যে—মেয়েটির সঙ্গে দেখা সে ‘সানন্দা’ পত্রিকায় চাকরি পেয়েছে। কিন্তু কয়েক বছর আগে ক্যাথিড্রাল চার্চের মুক্তমঞ্চে ওকে নাটক করতে দেখেছি। জিজ্ঞাসা করলাম, ধারাবাহিকে অভিনয় করতে আগ্রহী কিনা? সে রাজি হতেই টেলিফ্রেম অফিসে আসতে বললাম। সেই মেয়ে আজকের সুদেষ্ণা রায়। এখন অভিনয় মাঝে মাঝে করে বটে কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালিকা হিসেবেই সে বেশি পরিচিত।

আমার বন্ধু মুকুন্দচন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ‘বহুরূপী’তে ছিল, শম্ভু মিত্রের স্নেহধন্য সে। একদিন তার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, সুনীলদা আড্ডা মারছেন। ওঁকে দেখামাত্র মন ভালো হয়ে গেল। সুনীলকান্ত বহুরূপীতে শম্ভু মিত্র—কুমার রায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ধুতি—পাঞ্জাবি পরা খাটো মানুষটির চোখ যেন কথা বলত। দৃষ্টিতে সহজেই কৌতুক আনতে পারতেন। তখন তো মোবাইল ছিল না যে, অরিজিৎ বা রমাপ্রসাদের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ আলোচনা করব। যেহেতু ওই দু’জনও বহুরূপীর প্রাক্তনী, তাই সুনীলদা ওদের খুব পরিচিত। একটু ঝুঁকি নিয়েই সুনীলদাকে প্রস্তাব দিলাম। উনি অবাক হলেন। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় চাকরিসূত্রে। যে সরকারি অফিসে উনি চাকরি করতেন, সেখানে আমিও কিছুদিন ওঁর পাশে বসে কাজ করেছি। সুনীলদা বললেন, ‘ধ্যেৎ! কী যে বলিস!’

মুকুন্দ আমাকে সমর্থন করল। অনেক বোঝানোর পরে সুনীলদা আমাদের অফিসে আসতে রাজি হলেন। ষোলোটি এপিসোডের ওই ধারাবাহিকের অন্তত পঁচাত্তর ভাগ দৃশ্যে নিবারণ ঢোল অর্থাৎ, কেয়ারটেকার থাকবে। রমাপ্রসাদ ওঁকে চরিত্রটি বোঝাল। অরিজিৎ উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘জমিয়ে কাজ করা যাবে।’

সেদিন বিকেলে সুনীলদাকে নিয়ে বাইপাস দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সল্টলেক স্টেডিয়ামের কাছে বেলেঘাটা যাওয়ার রাস্তায় সুনীলদা গাড়ি থামাতে বললেন। ওখান থেকে তিনি রিকশায় বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার আগে আমার দুটো হাত দু’হাতে ধরে তিনি ককিয়ে উঠলেন, ‘তুই আমাকে ছেড়ে দে সমরেশ। আমি পারব না। চিরকাল বহুরূপীতে ছোট চরিত্রে অভিনয় করে এসেছি, ক্যামেরার সামনে এত বড় চরিত্র আমি করতে পারব না।’ পঞ্চাশের কাছাকাছি একজন মানুষ কাকুতিমিনতি করছেন তাঁকে অব্যাহতি দিতে, আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেই পূর্ণদাস রোড থেকে স্টেডিয়াম অবধি পৌঁছতে অন্তত আধঘণ্টা সময় লেগেছিল, আর এই সময়টা সুনীলদা চুপচাপ বসেছিলেন। শেষপর্যন্ত আমি বললাম, ‘তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? এইরকম চরিত্র অনেক বড় অভিনেতা সারাজীবনে পান না। আমরা প্রথমে রবিদার কথা ভেবেছিলাম। ওঁর সময় নেই—’ আমাকে শেষ করতে না দিয়ে সুনীলদা বললেন, ‘কার সঙ্গে কার তুলনা করছিস। আমি ওঁর নখের যোগ্য নই।’ বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন বেলেঘাটা যাওয়ার রিকশা ধরতে। দেখে মনে হচ্ছিল, ওঁর মাথা থেকে বিরাট বোঝা নেমে গেছে।

পরদিন সকালে ওঁর বাড়িতে গেলাম। অনেক বোঝানোর পরে সুনীলদা রাজি হলেন একটি শর্তে, ধারাবাহিকের পঁচাত্তর ভাগ নয়, চল্লিশ ভাগের বেশি তাঁর চরিত্র থাকবে না। আমি যখন তাঁকে ছাড়ছি না, তখন চোখ—কান বুজে ওইটুকু তিনি করে দেবেন।

শুটিং শুরু হল। প্রথম কয়েকদিন সেইসব দৃশ্য তোলা হচ্ছিল যেখানে সুনীলদার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা রমাপ্রসাদ ইচ্ছে করেই করছিল। কিন্তু আমরা ক্রমশ দেখলাম, চরিত্রটির ভেতরে ঢুকে গিয়েছেন সুনীলদা। যখন টেলিকাস্ট শুরু হল, তখন সুনীলদা প্রায় স্টার হয়ে গেলেন। যেখানে যাচ্ছি সেখানেই নিবারণ ঢোলের প্রশংসা শুনছি। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, বহুরূপীতে ওঁর অভিনয় দেখে সত্যজিৎ রায় তাঁর দু’টি ছবিতে সুনীলদাকে অভিনেতা হিসেবে নিয়েছিলেন। দু’টি চরিত্রই বেশ ছোট। তারপর দীর্ঘদিনের ব্যবধানে ‘কলকাতা’। রাতারাতি দর্শকদের মন জয় করে সুনীল সরকার, নিবারণ ঢোলের চরিত্র করে। দেখা হলেই বলতেন, বুঝলি, তোর জন্যেই এসব হল।’ আমাদের আপশোস, ধারাবাহিক শেষ হওয়ার পর যখন ছবি এবং ধারাবাহিকে অভিনয়ের প্রস্তাব একের পর এক আসছে, তখন চিকিৎসা বিভ্রাটের শিকার হয়ে চলে গেলেন সুনীলদা।

এই ‘কলকাতা’ ধারাবাহিকের শুটিং যখন চলছে, তখন এক বিকেলে পেটের সমস্যায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল রমাপ্রসাদ বণিক। অথচ পরের দিন আউটডোরে শুটিং। বাইপাসের পাশে চায়না টাউনে নিবারণ ঢোল যাচ্ছে একটি চিনা পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে। সেখানকার চামড়ার ফ্যাক্টরি, চিনা পত্রিকার অফিস ইত্যাদি বুক করা হয়ে গেছে। শুটিং না করতে পারলে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অথচ পরিচালক অসুস্থ। কী করা যায় যখন ভেবে পাচ্ছি না, তখন অরিজিৎ বলল, ‘এই পর্বটা তুমিই পরিচালনা করো। গল্প তোমার, চরিত্রগুলো তোমার মাথায় আছে। এতদিন শুটিংয়ে থেকে অভিজ্ঞতাও তো হয়েছে।’

খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম এই প্রস্তাবে। তার ওপর খবর এল, আমাদের ক্যামেরাম্যানকে দূরদর্শন আচমকা গুয়াহাটিতে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। অতএব শুটিং বন্ধ করতেই হবে বলে যখন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি, তখন যে—ছেলেটি ফ্লোরে আলোর তদারকি করে, সেই যিশু দাশগুপ্ত এগিয়ে এসে বলল, ‘সমরেশদা, ক্যানসেল করবেন না। আমাকে যদি সুযোগ দেন তাহলে ক্যামেরার কাজটা করতে পারি। প্লিজ সমরেশদা।’

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। হাসিখুশি, পরিহাসে পটু ছেলেটির মুখে বেশ সিরিয়াস অভিব্যক্তি। হঠাৎ মনে হল, ওকে সুযোগ দিয়েই দেখা যাক।

সেদিনের কথা যিশু পরে বহুবার বলেছে। ক্যামেরাম্যান থেকে পরিচালক এবং শেষে প্রযোজক হয়ে সে একের পর এক ধারাবাহিক বানিয়েছে। বিপুল সম্পদ অর্জন করেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ক্যানসারের কাছে হার মানতে হয়েছে ওকে।

ঠিক হল, সকাল সাতটায় আমরা চায়না টাউনে পৌঁছে শুটিং শুরু করব। সুনীলদার মেক—আপ বলতে শুধু পাউডার লাগানো, চিনে চরিত্রদের তো সেই প্রয়োজনও ছিল না। সেই প্রথম ‘স্টার্ট ক্যামেরা’, ‘অ্যাকশন’ এবং ‘কাট’ বললাম চেঁচিয়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছিলাম, এ আমার কম্ম নয়। যিশুকে ক্যামেরা কোন অ্যাঙ্গেলে বসবে তা বলছি, অভিনেতা— অভিনেত্রীদের তাঁদের অভিনয় কেমন হওয়া উচিত তা বোঝাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি, যার কর্ম তারে সাজে…। এর মধ্যে একটা কাণ্ড হয়ে গেল। বড় বড় চামড়া, সম্ভবত গরু বা মোষের —শুকোতে দিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। শুটিং চলাকালীন সুনীলদা তার দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে নাকে রুমাল গুঁজে হাঁটছিলেন। হঠাৎ হইহই চিৎকার এবং তারপর গালাগালি ভেসে এল। কিছু চিনে মহিলা তাঁদের কাজ ফেলে সুনীলদার চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে যাচ্ছিলেন। সুনীলদা প্রথমে তাঁদের দিকে হাসি হাসি মুখ করে হাঁটছিলেন। শেষপর্যন্ত বেগতিক দেখে চেঁচিয়ে বললাম, ‘নাক থেকে রুমাল সরান।’

‘তাহলে বমি হয়ে যাবে।’ নাকে রুমাল চাপা দিয়েই চেঁচালেন সুনীলদা।

ফলে, ‘কাট’ বলা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

সেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ঘণ্টা দুয়েক চুপচাপ শুয়ে থাকার পর স্থির করলাম, কোনো প্রলোভনে পড়ে আর পরিচালনা করতে যাব না। সত্যি কথা বলতে কী, যাঁরা সারাজীবন ধরে পরিচালনা করে যাচ্ছেন, তা ভালো বা মন্দ হোক, তাঁরা আমার কাছে নমস্য, কারণ প্রচুর শারীরিক কষ্ট দিনের পর দিন তাঁরা সহ্য করতে পারেন।

‘কলকাতা’ ধারাবাহিক টেলিফ্রেমকে পরিচিতি দিয়েছিল। এই সময় রমাপ্রসাদ বলল, ‘সমরেশদা, আমার ইচ্ছে ‘উত্তরাধিকার’ করি।’

আমি প্রথমে এককথায় নাকচ করে দিয়েছিলাম। ছাপা উপন্যাস কখনওই টিভির ধারাবাহিকে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু রমাপ্রসাদ ক’দিন ধরে বলে গেল, ‘আমরা ষোলো এপিসোডের বেশি করব না। গল্প বিকৃত বা নষ্ট হবে না, কারণ চিত্রনাট্য আপনি লিখছেন। দেখুন, দর্শক এখনও চা বাগান বা সেখানকার ঘটনা দ্যাখেনি। তাছাড়া, ‘উত্তরাধিকার’ ধারাবাহিক হচ্ছে শুনলেই লোকে দেখতে আগ্রহী হবে।’

মাসখানেক পরে হার মানতে বাধ্য হলাম। এই সময় দু’টি ছেলে—মেয়ে আমার সঙ্গে চিত্রনাট্য লিখতে যোগ দিল।

শেখর সমাদ্দার এবং প্রীতিকণা পালরায়। অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত। শেখর পরবর্তীকালে নাট্যপরিচালক হিসেবে খ্যাত হয়েছে। চিত্রনাট্যকার হিসেবে প্রীতিকণা এখন সুপরিচিত।

‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাস লিখেছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়, ঊনআশি সালে। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সেই উপন্যাস ছত্রিশ বছর পরেও বছরে দুটো সংস্করণ বিক্রি হয়।

সেই সময় আমাকে অনেকেই বললেন, ‘যাঁরা বইটি পড়েননি, তাঁদের যদি ধারাবাহিক দেখে খারাপ লাগে, তাহলে কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।’ অর্থাৎ, ধারাবাহিক খারাপভাবে তৈরি হলে বইটির ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। বাংলা সিনেমার দৌলতে অনেক বিখ্যাত উপন্যাসের এই পরিণতি হয়েছে। তাছাড়া, প্রযোজকের একজন আমি, আমার উপন্যাস নিয়ে ধারাবাহিক তৈরি হচ্ছে বলে লেখক হিসেবে নিজেকে দক্ষিণা দিচ্ছি না। এটা ‘মুক্তবন্ধ’ থেকেই নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে, ধারাবাহিক খারাপ হলে দু’দিক দিয়েই আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব। তাই, আমরা সতর্ক থাকলাম কোনো ত্রুটি না রাখতে।

উত্তরাধিকারের কাহিনি একটি বালককে কেন্দ্র করে, যে উত্তরবঙ্গের একটি নির্জন চা বাগানে সাতচল্লিশ সালের পনেরো অগাস্টের সকালে জাতীয় পতাকা তুলেছিল। অতএব শুটিংয়ের সিংহভাগ হবে একটি চা বাগানে। লোকেশন দেখে বানারহাটের কাছে কাঁঠালগুঁড়ি চা বাগান আমাদের পছন্দ হল। অনিমেষের ঠাকুর্দার চরিত্রে অরিজিৎ গুহ, বাবা শংকর চক্রবর্তী এবং কাকা হিসেবে পীযূষ গাঙ্গুলিকে বেছে নিল রমাপ্রসাদ। ‘বহুরূপী’ থেকে বেরিয়ে ওরা ‘চেনামুখ’ নামে যে—গ্রুপ থিয়েটার করেছিল, সেখানে লাবণী সরকার নামে যে—মেয়েটি অভিনয় করত, তাকে অনিমেষের মা হিসেবে ভাবল রমাপ্রসাদ। মৌমিতা গুপ্তর প্রথম অভিনয়জগতে আসা বোধ হয় উত্তরাধিকার ধারাবাহিকের হাত ধরেই। রমাপ্রসাদের কৃতিত্বে ধারাবাহিক সফল হয়েছিল, আমার বইয়ের বিক্রিতেও ঘাটতি পড়েনি।

ট্রিলজির দ্বিতীয় বই ‘কালবেলা’। কিন্তু আমি জানতাম, কালবেলা প্রযোজনা করতে যে—টাকার প্রয়োজন, তা স্পনসরদের কাছে পাওয়া যাবে না। গল্পটাকে নষ্ট করতে চাইলাম না আমি। বহু বছর পরে গৌতম ঘোষ কালবেলা ছবি করেছিল। ওর মতো পরিচালকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয়েছিল।

রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল যা এখনও রয়েছে। আমার দেখা হাতেগোনা কয়েকজন ভদ্রলোকের একজন রঞ্জিত মল্লিক। উত্তমকুমারের পরে প্রথম হিট ছবি ‘শত্রু’র নায়কের সৌজন্যবোধ কখনও নষ্ট হয়নি। আমার ইচ্ছে হল, রঞ্জিতকে নিয়ে একটা বাংলা ধারাবাহিক করা উচিত। এর আগে তিনি জোছনদার পরিচালনায় ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ নামে হিন্দি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন। প্রস্তাব পেয়ে রঞ্জিত রাজি হলেন কিন্তু অন্যান্য ছবিকে ডেট দেওয়া থাকায় সপ্তাহের প্রতিদিন শুট করতে পারবেন না বলে জানালেন। আগে থেকে সময় ঠিক করা থাকলে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, আমরা এগোলাম। ধারাবাহিকের নাম ‘বালিকার প্রেম’। মা হারানো মেয়ে বাবাকেই ধ্যানজ্ঞানে পৃথিবী মনে করে। মেয়ে বড় হলেও বাবার কাছে সে বালিকামাত্র। সেই মেয়ে কলেজে পা দিতেই একটি তরুণ এল তার জীবনে। এই টানাপোড়েনেই নাটক এগিয়ে যাবে।

রঞ্জিতের মেয়ের চরিত্রটিতে ভালো অভিনেত্রীর প্রয়োজন। সমস্যা হল, তার বয়স বেশি হওয়া চলবে না। সেসময় ওই বয়সের অভিনেত্রী ইন্ডাস্ট্রিতে ছিল না। অথবা কেউ থাকলেও উল্লেখযোগ নয়। আমরা চারপাশে খোঁজ করতে লাগলাম। তখনও পনেরো—ষোলো বছরের মেয়ে পড়াশুনার ক্ষতি করে অভিনয় করবে, তা অভিভাবকরা চাইতেন না। তাই, যাকে পছন্দ হচ্ছিল তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না।

এই সময় একজন পরিচিত ভদ্রলোকের সূত্রে যে—মেয়েটি অফিসে এল, সে প্রায় ওই বয়সি। থাকে বিরাটিতে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সে ইতিমধ্যেই বিএ পাশ করেছে। খাটো চেহারায় এবং মুখে—চোখে সারল্য থাকায় বয়স বোঝা যায়নি। সে এসেছিল শাড়ি পরে। অভিনয় করতে হবে স্কার্ট পরে। সেটা জানানোর সঙ্গেসঙ্গে মেয়েটি বেরিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এল স্কার্ট পরে। চমৎকার দেখাচ্ছিল তাকে। সংলাপ বলিয়ে ওকেই চরিত্রটিতে নেওয়া হল। আমাদের দুর্ভাগ্য, নানান কারণে ধারাবাহিকটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মেয়েটির অভিনয়ের খ্যাতি স্টুডিয়ো থেকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। পরে সে অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। মেয়েটির নাম শ্রীলেখা মিত্র।

‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তখনও টিভির ব্যবসায় পুরোপুরি নামেনি। তারা আমাদের প্রস্তাব দিল ছয় পর্বের ধারাবাহিক তৈরি করে দিতে। কোনো প্রকাশিত গল্পের চিত্রনাট্য তারা চাইল।

ভাবলাম, সিনেমাজগৎ নিয়ে লিখলে কেমন হয়। তার কিছুদিন আগে একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় যিনি বিয়ের পরে নিউ ইয়র্কে আছেন বহুকাল। গল্প চালু ছিল কলকাতায় থাকার সময় অর্থাৎ, বিয়ের আগে এই অভিনেত্রী একজন অতিবিখ্যাত মন্ত্রীর ছেলের প্রেমে পড়েন। এতে মন্ত্রী শঙ্কিত হন, ছেলে যদি অভিনেত্রীকে বিয়ে করে তাহলে তাঁর মর্যাদা নষ্ট হবে ভেবে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ওই অভিনেত্রীকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।

এই কাহিনিকে অন্যভাবে সাজিয়ে চিত্রনাট্য লিখে নাম রাখলাম ‘সিনেমাওয়ালা’। কিন্তু অভিনেত্রীর চরিত্রে যাঁকেই ভাবা হচ্ছে, তাঁকে পছন্দ হচ্ছে না আনন্দবাজারের। তখন ‘আনন্দলোক’ পত্রিকার সম্পাদক ছিল দুলেন্দ্র ভৌমিক। দুলেন্দ্র আমাকে একটি মেয়ের ছবি পাঠাল। বেশ সুন্দরী মহিলা, ব্যতিক্রমী চেহারা। খবর দেওয়া হল। ভদ্রমহিলা এলেন। কথা বলে খুশি হলাম। শুটিংয়ের দিন ঠিক হল।

আমার টিভি সিরিয়াল জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটি এই সময় ঘটল। আজও আমি সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাইনি। ভদ্রমহিলার নাম নন্দিনী ঘোষাল। খুব ভালো নাচেন এবং সুন্দরী তো বটেই। ধারাবাহিকটির পরিচালক ছিল অভিনেতা দুলাল লাহিড়ি। প্রথম দু’দিনের অভিনয় দেখে দুলাল খুব খুশি। খুশি আমরাও। কিন্তু তৃতীয় দিনে স্টুডিয়োতে শুটিং দেখতে এল প্রযোজকদের একটি দল। শুটি চলাকালীন একজন নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই মহিলা কি বাড়ির কাজের লোক?’

‘আজ্ঞে না, উনিই নায়িকা!’ নিচু গলায় বললাম।

ভদ্রলোকের মুখ কালো হয়ে গেল। শুটিং দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন তিনি। তাঁকে উঠতে দেখে বাকিরাও চলে গেল। রাত্রে খবর এল, শুটিং বন্ধ রাখতে হবে। কারণ, আমরা যাঁকে নায়িকা হিসেবে নির্বাচিত করেছি, তাঁকে ওই চরিত্রে নাকি মানাচ্ছে না। আমি বোঝাতে চাইলাম, নায়িকা মানে সবসময় সেজেগুজে পটের বিবি হয়ে থাকা যায়, জীবনের লড়াইয়ের সময় সাজগোজ করলে খারাপ দেখাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

এই অবস্থায় আমাদের উচিত ছিল ধারাবাহিক থেকে সরে দাঁড়ানো। শুটিং বন্ধ হয়েছে, কাল কোনো কাজ নেই, কথাটা নন্দিনীকে জানানো দরকার। কিন্তু সবাই কুণ্ঠিত হচ্ছিল খবরটা জানাতে। শেষপর্যন্ত অপরাধটা আমাকেই করতে হল। ফোনে নন্দিনীকে জানালাম, ‘বিশেষ কারণে আপাতত শুটিং বন্ধ রাখতে হচ্ছে।’ নন্দিনীর সঙ্গে কখনও আমার দেখা হয়নি। মুখোমুখি হইনি বলে প্রকাশ্যে লজ্জিত হইনি। নন্দিনী তার পরে বেশ কয়েকটি সিরিয়ালে কাজ করেছেন, বোধহয়, ছবিতেও তাঁকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ভাগ্য তাঁর ওপর সদয় হয়নি। আমি এখনও এই অপরাধবোধ থেকে বের হতে পারিনি।

‘সানন্দা’ পত্রিকা নায়িকা খোঁজার দায়িত্ব নিল। কিন্তু তারা যেসব ছবি পাঠাত, তাদের চেয়ে নন্দিনী হাজারগুণ যোগ্য ছিলেন। আমরা যখন হতাশার শেষ গণ্ডিতে পৌঁছে গিয়েছি, সেসময় একটি মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে অফিসে এল। মেয়েটির ছিপছিপে লম্বা শরীর, চোখ এবং হাসি দেখে মনে হল যদি অভিনয় করতে পারে তাহলে একে নিয়ে সিনেমাওয়ালার কথা ভাবতে পারি, যদি তাতে প্রযোজকরা রাজি না হন তাহলে এই ধারাবাহিক থেকে আমরা সরে দাঁড়াব। দুলাল লাহিড়ি এসেছিল আড্ডা দিতে, তাকে বললাম মেয়েটিকে রিহার্সাল ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে। মনে আছে, মিনিট চল্লিশ পরে দুলাল এসে বলল, ‘একদম গলা নেই; এতক্ষণে যেভাবে বলতে বললাম, তার টেন পার্সেন্ট পেরেছে।’ বললাম, ‘একদিনে, আচমকা এসে যদি টেন পার্সেন্ট পারে তাহলে ওকে আর একটা সুযোগ দে। কাল আসতে বল।’

পরদিন দুপুরে মেয়েটি তার মাকে নিয়ে এলে দুলাল রিহার্সাল বসল। সে সময় আমাদের অফিসে এসেছিলেন ষাট—সত্তর দশকের একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী যিনি পরবর্তীকালে পরিচালক হিসেবে খুব খ্যাত হয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওঁর অভিনয়, পরিচালনা এবং দীর্ঘমেয়াদি অপূর্ব সৌন্দর্যে মুগ্ধ। একটি নাটকের ব্যাপারে অরিজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি খোলা দরজা দিয়ে মেয়েটিকে দুলালের সঙ্গে যেতে দেখে বললেন, ‘আরে, ও এখানে কেন? আপনাদের সিরিয়ালে অভিনয় করবে?’

অরিজিৎ বলল, ‘দেখা হচ্ছে।’

‘বিপদে পড়বেন, অভিনয়ের ‘অ’ জানে না।’

সেদিন যদি আমরা ওই কথায় প্রভাবিত হতাম তাহলে বাংলা চলচ্চিত্র হয়তো বঞ্চিত হত। এই জীবনে বহুবার এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি। বুঝেছি, কোনো একটি কাজ প্রথম দিকের আড়ষ্টতাকে যদি আক্রমণ করে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হবে। দেখা যাবে, সেই মানুষটি পরবর্তীকালে তার কাজের মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে।

দুলাল হাসিমুখে জানাল, ‘একদিনে খুব ইমপ্রুভ করেছে। মনে হচ্ছে পারবে।’

আমরা মেয়েটির কাছে তার ছবি চাইলাম। বললাম, ‘সব ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহেই শুটিং শুরু হবে।’

ছবি পাঠানো হল প্রযোজকদের কাছে। তাঁরা আপত্তি জানালেন না। এবার মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে কীরকম পারিশ্রমিক আশা করছে? সে লজ্জা পেল। বলল, ‘আপনারা যা ভালো মনে করবেন তা—ই হবে।’ এই মেয়েটির নাম ঋতুপূর্ণা সেনগুপ্ত। এখন ভাবতেই অবাক হয়ে যেতে হয়!

সিনেমাওয়ালার শুটিং শুরু হল। এই ধারাবাহিকের আগে ঋতুপূর্ণা মাত্র একটি ছবিতে অভিনয় করেছিল। ছবির নাম সম্ভবত ‘শ্বেতপাথরের থালা।’ ছোট্ট, নেগেটিভ চরিত্র। কিছুই করার ছিল না। তাই সিনেমাওয়ালার নায়িকার চরিত্রে সে যে অভিনয় করল, তা রাতারাতি দর্শকের মন জয় করে নিল। তারপর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মজার ব্যাপার হল, বহু বছর পরে সেই বিখ্যাত পরিচালিকার একটি সফল ছবিতে নায়িকার চরিত্রে ঋতুপর্ণা চমৎকার কাজ করেছে। পরিচালিকা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর ধারণা সঠিক ছিল না।

রাজা সেন তখন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। কিন্তু আমাদের অফিসের আড্ডায় নিয়মিত আসত। আসত রাজা দাশগুপ্ত। তখন ‘টেলিফ্রেম’ বেশ জমজমাট। কিশোর তো ছিলই, সহকারী পরিচালক হিসেবে সুশান্ত বসুও ভালো কাজ করছিল। এই সময় রাজা দাশগুপ্ত প্রস্তাব দিল, সে ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসটি নিয়ে ধারাবাহিক করতে চায়। অনেক তর্ক—বিতর্কের পর আমি রাজি হলাম। কসবায় একটি বিশাল খালি গোডাউনে সেট ফেলা হল। একটি বস্তির সেট। সেটা বানালেন সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত শিল্পনির্দেশক অশোক বসু। তৈরি হওয়ার পর মনে হচ্ছিল, ওটা সত্যি বেলগাছিয়ার বস্তি।

কালপুরুষের অনিমেষ আর মাধবীলতার চরিত্রে প্রদীপ এবং অনসূয়া মজুমদারকে পরিচালক বেছে নিয়েছিলেন। সমস্যা হল অর্ক চরিত্র নিয়ে। পনেরো—ষোলো বছরের বেপরোয়া ছেলে অর্ক। শেষপর্যন্ত রাজা নিয়ে এল যাকে, তার বাবাকে চিনতাম। শ্যামল সেন এবং চিত্রা সেন গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা হিসেবে সুপরিচিত তাঁদের ছেলে কৌশিক, কৌশিক সেন। প্রথম সুযোগকেই ভালোভাবে ব্যবহার করেছিল কৌশিক, তাই এখন সে চুটিয়ে কাজ করে চলে।

কালপুরুষ রাজা দাশগুপ্তর একটি প্রথম শ্রেণির কাজ।

সেই সময় গ্রুপ থিয়েটারের যেসব দক্ষ অভিনেত্রী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম ছিল অনসূয়া মজুমদারের। ‘বহুরূপী’ দলের বিখ্যাত প্রযোজনা ‘মৃচ্ছকটিক’—এ বসন্তসেনার চরিত্রে অভিনয় করে বেশ বিখ্যাত হয়েছিলেন।

নাটকটির পরিচালক ছিলেন কুমার রায়। পরে বহুরূপী থেকে বেরিয়ে এসে রমাপ্রসাদ বণিক, অরিজিৎ গুহ, শংকর ঘোষরা যখন ‘চেনামুখ’ দল তৈরি করল, তখন অনসূয়া সেই দলের অন্যতম অভিনেত্রী। আমার উপন্যাস ‘শরণাগত’র নাট্যরূপ দিয়েছিল রমাপ্রসাদ, অনসূয়া চমৎকার অভিনয় করেছিলেন। মাঝে মাঝে মনে হত, ভদ্রমহিলা অসাধ্যসাধন করছেন। একটি বহুজাতিক কোম্পানির উঁচু পদের দায়িত্ব নিয়ে চাকরি করতেন ভদ্রমহিলা, সেখানকার জীবনযাপন, কথাবার্তার ধরনের সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারের আবহাওয়ার বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও দুই জীবনের সঙ্গে সমান তাল মিলিয়ে চলেছিলেন। এই অনসূয়াকে যখন ‘কালপুরুষ’—এর মাধবীলতার চরিত্র করার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছিল, তখন একটু সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি। অফিস ছুটির পরে নাটকের রিহার্সাল দেওয়া যতটা সহজ, দিনের পর দিন অফিস কামাই করে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করা তার বহুগুণ কঠিন ব্যাপার। যদি সরকারি চাকরি হত, বিশেষ করে যাঁরা সাধারণ চাকরি করতেন, তাঁদের অনেকেই অফিসকে ম্যানেজ করতে সক্ষম হতেন।

‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় থেকেই মাধবীলতা পাঠকদের অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র হয়ে গিয়েছিল। পুরুষ পাঠকরা জানতে চাইতেন, ওরকম কোনো মেয়েকে আমি দেখেছি কি, না সবটাই আমার কল্পনা? বাংলাদেশে গিয়ে দেখেছি, একজন যুবতী যাঁর নাম ছিল তামান্না, তিনি আদালতে গিয়ে সেই নাম বাতিল করে মাধবীলতা রেখেছিলেন। এসব ব্যাপারের পর শিল্পী নির্বাচন করা বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিল। মাধবীলতার মধ্যে শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব এবং সুন্দরী না হওয়া সত্ত্বেও চেহারায় যে—আকর্ষণের কথা আমি লিখেছিলাম, তা অনসূয়ার সঙ্গে খুব মিলে যাচ্ছিল। কিন্তু টিভি সিরিয়াল তো সিনেমা নয় যে, পরিচালক আগেভাগেই অভিনেতাকে জানিয়ে দিতে পারেন অভিনয়ের জন্যে তাঁকে ক’দিন দরকার হবে! শুধু একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী যে—চরিত্রে অভিনয় করছেন এবং ধারাবাহিকের যেসব দৃশ্যে তিনি থাকবেন, সেগুলো টানা শুটিং করে ফেলাও সম্ভব নয়। শেষপর্যন্ত অনসূয়া লাঠি না ভেঙে সাপ মারতে চেয়েছিলেন।

অনিমেষ ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসে ছিল বালক থেকে তরুণ বয়স পর্যন্ত। ‘কালবেলা’য় সে যুবক। কিন্তু কালপুরুষে সে জেল ফেরত এক প্রৌঢ়। তার যৌবন যেমন অস্তমিত, তেমনই মানসিকতায় আগের সেই দৃঢ়তা নেই। এই চরিত্রে প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে অভিনয় করার প্রস্তাব দিলাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘জনঅরণ্য’ করে বেশ নাম করেছিল প্রদীপ। তারপর আমার প্রথম উপন্যাস নিয়ে শংকর ভট্টাচার্য যখন ‘দৌড়’ ছবি করে, তখন প্রদীপ তার নায়ক হয়। কিন্তু তারপর অভিনয়ের চেয়ে আয়কর বিভাগে ওকালতিতেই সে বেশি মন দিয়েছিল। কখনওসখনও ছোট চরিত্রে অভিনয় করে শখ মেটাত। এই সময়টায় প্রদীপের সঙ্গে আমার মোটামুটি যোগাযোগ ছিল। অনিমেষ চরিত্রটি পেয়ে সে খুশি হয়েছিল।

কালপুরুষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রের নাম অর্ক। উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল চুরাশি সালে। তার আগে অর্ক নামের বাঙালি খুব কম পাওয়া যেত। কালপুরুষ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে প্রচুর শিশুর নাম রাখা হল অর্ক। এই সেদিনও একটি যুবকের সঙ্গে আলাপ হল। সে তার নাম বলল, অর্ক। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি চুরাশি—পঁচাশিতে জন্মেছিলেন?’ যুবক অবাক হল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু কী করে বুঝলেন?’ উত্তরটা স্পষ্ট করিনি। তবে, শুধু ওই সময়ে নয়, তার অনেক পরে জন্মেছে এমন শিশুরও নাম রাখা হয়েছে অর্ক।

এই অর্ক চরিত্রে কোনো প্রতিষ্ঠিত অভিনেতাকে নেওয়া যাবে না। তাছাড়া, তার বয়স হতে হবে কুড়ির অনেক নীচে। আমরা তখন অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখছি, যদি এমন ছেলের দেখা পাই। হঠাৎ রমাপ্রসাদ বলল, সমরেশদা, আপনি শ্যামল সেন—চিত্রাদিকে চেনেন?’

শ্যামলবাবুকে চিনতাম, ওঁর স্ত্রী চিত্রা সেনের অভিনয় দেখেছি। খুব ভালো অভিনেতা ছিলেন শ্যামলবাবু। যতদূর মনে পড়ছে, ‘আনন্দবাজার’—এর নাটক—যাত্রার পাতা সম্পাদনা করতেন যিনি, সেই লেখক প্রবোধবন্ধু অধিকারীর মাধ্যমেই ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। রমাপ্রসাদ বলল, ‘ওদের ছেলেকে একবার দেখতে পারেন। অর্ক হিসেবে মানাবে খুব, ওই বয়সেরই। তাছাড়া, বাবা—মায়ের রক্তের কল্যাণে অভিনয় নিশ্চয়ই খারাপ করবে না।’

খবর পেয়ে ছেলেটি এল। ছিপছিপে, মাথা ভর্তি চুল, চোখ দুটো কথা বলে। নাম বলল, ‘কৌশিক সেন’। মুখে জেদি ভাব থাকলেও বিনয়ের অভাব নেই। বলতে দ্বিধা নেই, তথাকথিত নায়কের চেহারা কৌশিকের ছিল না। অথচ প্রায় আড়াই দশক ধরে সে গ্রুপ থিয়েটারের সফল পরিচালক—অভিনেতা ছাড়াও ছবিতে নিয়মিত অভিনয় করে চলেছে। কিন্তু ওর শুরুর সময়ে দেখেছিলাম, সে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি।

কালপুরুষের সাফল্যের পর ‘টেলিফ্রেম’ যখন খানিকটা সচ্ছল, তখন আমরা আকাশে ছুঁতে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়েছিলাম।

চুরাশি সালে যখন আমি আমেরিকায় গিয়েছিলাম ইউএসআইএস—এর আমন্ত্রণে, তখন নিউ ইয়র্কের কুইন্সে বন্ধু মনোজ ভৌমিকের বাড়িতে ছিলাম বেশ কিছুদিন। মনোজ ইঞ্জিনিয়ার। থিয়েটারকর্মী এবং একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করত যার নাম ‘আন্তরিক’। মনোজ চমৎকার লিখত। ওর গল্প দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। যতদূর জানি, ওর একমাত্র উপন্যাসের নাম ‘এই দ্বীপ এই নির্বাসন’ ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। আন্তরিক পত্রিকায় ওই উপন্যাস পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলম। মূলত, যেসব বঙ্গসন্তান বড় ডিগ্রি নিয়ে আমেরিকায় চাকরি করতে গিয়ে শেকড় গাড়ার চেষ্টা করেছেন, বাড়ি ফিরেছেন, গ্রিন কার্ড থেকে সিটিজেনশিপ নিয়েও যাঁদের দেশ সম্পর্কে মনকেমন করা অনুভূতি মরে যেতে যেতে থেকে গেছে, তাঁদের নিয়েই মনোজ উপন্যাসটি লিখেছিল। মনোজ হেসে বলেছিল, ‘ভাববেন না, আমরা আমেরিকায় এসে গ্রিন কার্ড পেয়ে একদম আমেরিকান সাহেব হয়ে যেতে পারিনি, চেষ্টা সত্ত্বেও পারিনি। আমাদের অনেকেই এখনও অজপাড়াগাঁর পুকুরপাড়ের বিধবা পিসিমা হয়ে আছেন।’

কোনো কোনো মানুষ একটু ঠোঁটকাটা হন। মনে হয়েছিল, মনোজ সেরকম হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় নাটক করা ছেলে নিউইয়র্কের সামারে পাজামা—পাঞ্জাবি আর চটি পরে ম্যানহাটনে যখন হাঁটে, তখন ওর মধ্যে একটা চাপা বিদ্রোহ ফুটে ওঠে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এদেশে এলেন কেন?’

মনোজ হেসে বলেছিল, ‘অদৃশ্য সোনার শেকল পরব বলে।’

পরের শনিবারে মনোজ তার গাড়িতে আমাকে নিয়ে গেল ওর পরিচিত একজনের বাড়িতে, যিনি নাকি আমার লেখা খুব পড়েছেন। দু’ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে একটি সুন্দর সাজানো কমপ্লেক্সে পৌঁছল মনোজ। দেখলাম, একটি বাড়ির সামনে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ করলাম, ওই রাস্তার সব বাড়ির চেহারা একদম একইরকম। গৃহকর্তা দরজা খুলে হাতজোড় করে অভ্যর্থনা জানালেন। বাড়িতে অনেক অতিথি। সবার সঙ্গে ওপর ওপর আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর গৃহকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী নেবেন? ভদকা উইদ টনিক, না স্কচ?’

আমার হয়ে মনোজ জবাব দিল—’স্কচ।’

ওদেশে যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁরা কখনওই পান করেন না। মনোজ কিছু নিল না। দেখলাম, আমাকে আধপেগ হুইস্কি আর দু’টুকরো বরফ দেওয়া হল। আমি একটা চুমুক দিতেই গৃহকর্তা এসে বললেন, ‘আসুন মিস্টার মজুমদার, ডিনার সার্ভ করা হয়ে গেছে।’

আমি হতভম্ব। এখনই ডিনার খেলে হুইস্কি কেন দেওয়া হল? গ্লাস রেখে ডিনার খেতে যেতে বাধ্য হলাম। এই অবধি মনে হয়েছিল, এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। অনেক মানুষ যখন খেয়ে বাড়ি ফিরবে, তখন একজনের জন্যে সেটা দেরি করানো ঠিক নয়। কিন্তু বিস্মিত হলাম, দু’ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরে। মনোজের স্ত্রী বাচ্চচাদের একজনের শরীর খারাপ বলে বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন। দরজা খুলে তিনি আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি সুস্থ আছেন তো?’

‘তার মানে?’

‘আপনি ওখানে গিয়ে প্রচুর পান করেছেন? ছি—ছি, এটা ঠিক হয়নি!’

‘আমি প্রচুর খেয়েছি?’ হতভম্ব হয়ে গেলাম।

‘একটু আগে লস এঞ্জেলেস থেকে আমার পরিচিত এক মহিলা ফোন করে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁরে, তোদের বাড়িতে যে—রাইটার সমরেশ মজুমদার এসেছে সে নাকি পাঁড় মাতাল? আজ লং আইল্যান্ডে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে গলা পর্যন্ত মদ গিলেছে। জানিস তুই?’

স্ত্রীর কথা শেষ হওয়া মাত্র মনোজ হো হো করে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, ‘কী বলেছিলাম সমরেশ? বাংলার অজপাড়াগাঁর পুকুরপাড়ে বসে কুচুটে বুড়িরাও এদের প্রতিভার ধারে—কাছে আসবেন না।’

‘এই দ্বীপ নির্বাসনকে সিনেমায় রূপান্তরিত করলে কেমন হয়?’ মনোজের সঙ্গে কথা বলতেই সে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘সমরেশ, আপনি ঠিক বলেছেন, এটা আমার স্বপ্ন। ঢাল নেই তলোয়ার নেই তবু যুদ্ধ করতে চাইছিলাম।

মনোজের উপন্যাসের কাহিনিতে ওখানকার বাঙালিদের কিছু সমস্যা জুড়ে চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি করার চেষ্টা করলাম।

কলকাতায় ফিরে আসার পরে এ নিয়ে মনোজ আমাকে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছিল। তার একটাতে সে আমাকে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিল। মনোজের কলকাতার বন্ধু কল্যাণ সর্বাধিকারী দেখা হতেই আমাকে তাগাদা দিত। আর তখনই আকস্মিক দুর্ঘটনায় মনোজকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হল।

জল পড়ল উৎসাহের আগুনে। কিন্তু একেবারে নিবে গেল না। মনোজ চলে যাওয়ার চার বছর বাদে আমরা স্থির করলাম, সিনেমা নয়, এই দ্বীপ এই নির্বাসন অবলম্বনে টিভি সিরিয়াল করব। সে কারণেই রেকি করতে অরিজিৎ, সুব্রত নায়েক এবং আমি আমেরিকায় গেলাম। পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত ঘুরে শুটিংয়ের জায়গা নির্বাচন করলাম।

ফিরে এসে চিত্রনাট্য লেখা হল। এবং তখন মনে হল, কলকাতা থেকে শিল্পী এবং কলাকুশলীদের নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে এবং থেকে শুটিং করতে বিপুল খরচ হবে। সেই খরচ বাংলায় সিরিয়াল তৈরি করে তোলা সম্ভব নয়। একমাত্র হিন্দিতে যদি সিরিয়ালটি তৈরি হয়, তাহলে খরচের ধাক্কা সামলানো যেতে পারে।

কিন্তু আমি বা রমাপ্রসাদ হিন্দি ভাষায় চিত্রনাট্য—সংলাপ লিখতে অক্ষম। তাই, মদনসূদনজিকে অনুরোধ করলাম বাংলায় লেখা চিত্রনাট্যকে যতটা সম্ভব বজায় রেখে হিন্দিতে রূপান্তরিত করতে। মদনসূদনজি কলকাতার হিন্দি নাট্যজগতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ছিলেন। তিনি কাজ শুরু করলেন।

ঠিক হল, রমাপ্রসাদ বণিক পরিচালনা করবে। দীপংকর দে, শকুন্তলা বড়ুয়া, মনোজ মিত্র অভিনয় করবেন। অন্যান্য চরিত্রে আমরা নিউ ইয়র্কের বাঙালিদের মধ্যে থেকে অভিনেতা— অভিনেত্রী নির্বাচন করব বলে ঠিক করলাম। এঁদের অনেকের সঙ্গে মনোজ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।

কলাকুশলীদের সবাই যাঁরা টেলিফ্রেমের অন্য প্রযোজনায় কাজ করেছেন, তাঁরাই থাকবেন। মুশকিল হল, এঁদের অনেকের পাসপোর্ট ছিল না। আবেদন করে সেটা পেতে সময় লাগল। এরপর ভিসা পাওয়া। আমেরিকান ভিসা সাধারণত সহজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কপালে ছিল বলে আমরা পেয়ে গেলাম।

হিসেব করে দেখলাম, খুব কম করেও খরচ হবে বারো লক্ষ টাকা। ছাব্বিশ বছর আগে বারো লক্ষ প্রায় স্বপ্নের মতো মনে হত।

অরিজিতের বাল্যবন্ধু সিদ্ধার্থ দত্ত থাকত নিউ জার্সিতে। ওর স্ত্রী বনানী খুব ঘরোয়া মহিলা। আমেরিকায় রেকি করতে গিয়ে আমরা ওদের বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম।

সিদ্ধার্থর বেশ নাটকপ্রীতি ছিল। ওর কথা বলা, হাঁটাচলার মধ্যে একটা আলাদা ধরন ছিল যাকে বেশ কেতাদুরস্ত বলা যায়। দত্ত দম্পতি মনোজকে চিনত। সেটা নাটকের সূত্রেই। শোনামাত্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল ওরা। সিদ্ধার্থ, যার ডাক নাম অসি। বলল, ‘ভাই, আমাদের এই গরিবখানায় জনাচারেক থাকলে খুব খুশি হব। তাদের যাতে কোনো অসুবিধে না হয় সেটা আমরা লক্ষ রাখব। কিন্তু তার বেশি কোনো কিছু করার সামর্থ্য আমাদের নেই।’

বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকায় এটুকু সাহায্য পাওয়া কিন্তু কম কথা নয়। সিদ্ধার্থ আমাদের নিয়ে গেল নিউ জার্সির একটি হোটেলে। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে হাইওয়ের পাশে হোটেল। গেট পেরিয়ে যে—অফিসঘর, সেখানে দু’জন ভারতীয় কাজ করছেন, দু’জনের একজন প্যাটেল, অন্যজন জোশী। জানলাম, এই দোতলা হোটেলটির মালিক এক গুজরাতি ভদ্রলোক, যাঁর পদবি প্যাটেল। আমাদের যে—কয়েকটা ঘর লাগবে দেখে নেওয়ার পরে সিদ্ধার্থ এমনভাবে দরাদরি করতে লাগল যা লোকে শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটে কিছু কেনার সময়ে করে থাকে। গোটা আষ্টেক ঘর মাত্র ৮০ ডলার দিতে হবে প্রতিদিনের জন্যে যা আমাদের বাজেটের কম বলাই ভালো।

এবার গাড়ি চাই। একটা মাইক্রো বাস যাতে সবাই একসঙ্গে শুটিং স্পটে যেতে এবং আসতে পারে। সিদ্ধার্থ আমাদের নিয়ে সেইরকম বাস ভাড়া করতে গেলে জানা গেল, ড্রাইভার—সমেত মাইক্রো নিলে প্রতি ১০ ঘণ্টায় ৩০০ ডলার, ড্রাইভার না লাগলে বাসের জন্যে ১০০ ডলার দিতে হবে। আমরা ঢোক গিললাম। আমেরিকায় প্রতিটি মানুষ সক্রিয়, কেউ বেকার বসে নেই। অন্তত যেসব ভারতীয় ওখানে গিয়েছে, তারা তো বটেই। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে যারা সারাদিন কাটায়, তারা কাজ করতে অনিচ্ছুক কালো মানুষ। তাই ৩০০ ডলার খরচ করা ছাড়া কোনো উপায় দেখলাম না।

এখানেই শেষ নয়। গাড়ির মালিক উপদেশ দিলেন— ‘আপনারা তো রাস্তাঘাটে শুটিং করবেন, তার জন্য অবশ্যই ইনসিয়োরেন্স করে রাখবেন।’

সর্বনাশ। কলকাতার রাস্তায় শুট করতে হলে পুলিশের অনুমতি নিতে হত। কোনো ঝামেলার দিন না হলে আবেদন করলেই অনুমতি পাওয়া যেত। কিন্তু এখানে পুলিশ শুটিং করতে দেবে না যদি ইনসিয়োরেন্স করা না থাকে। ফুটপাতে যারা যাওয়া—আসা করবে, তাদের কেউ ক্যামেরার তারে জড়িয়ে আহত হলে মোটা ডলার ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। শুটিংয়ের সময় নানা কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ইনসিয়োরেন্স না থাকলে তার ক্ষতিপূরণ করতে হলে চোখে সর্ষেফুল দেখতে হবে।

আমাদের ভরসা দিল সিদ্ধার্থ। সে ম্যানহাটনের একপাশে এক ইনসিয়োরেন্স কোম্পানিতে পাঠাল আমাদের। খুব খাতির করে তাঁরা অঙ্ক কষে বললেন, পনেরো দিনের জন্যে ৬০০০ ডলার প্রিমিয়াম দিতে হবে। তাহলে ওঁরা এক লক্ষ ডলারের কভারেজ দিতে পারবেন। দরাদরি করেও যখন কোনো লাভ হল না, তখন বেরিয়ে আসতে হল। কিন্তু আমাদের অবাক করে ভেতর থেকে একটি লোক চলে এসে বলল, ‘আপানরা এই কোম্পানিতে ট্রাই করতে পারেন। রাশিয়ান কোম্পানি কিন্তু রেট কম।’ লোকটা একটা কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।

রাশিয়ান ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির অফিসের সামনে পৌঁছে মনে হল চিৎপুরের মতো এলাকা। দোতলায় ওঠার সিঁড়িও ধোপদুরস্ত নয়। ওঁদের এক অফিসার খুব মন দিয়ে আমাদের সমস্যার কথা শুনলেন। তারপর বললেন, ‘আমরা আপনাদের জন্য একটা ভালো প্রিমিয়ামের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনো অ্যাকসিডেন্ট না হয়। আপনারা ৭৫০ ডলার প্রিমিয়াম দেবেন। কাগজপত্র সবসময় সঙ্গে রাখবেন। কিন্তু ডিডে লেখা থাকবে কোনো অবস্থাতেই ৫০০০ ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। দয়া করে এই ডিডটা পুলিশকে দেখাবেন না।’

‘সে কী! মাত্র ৫০০০।’ আমরা হকচকিয়ে গেলাম।

‘ছয় হাজারের বদলে মাত্র ৭০০ ডলার দিলে এর চেয়ে বেশি কী আশা করবেন? আপনারা যদি সতর্ক হয়ে কাজ করেন তাহলে দেখবেন কোনো সমস্যা হবে না। পুলিশ দেখতে চাইলে আমরা যে—সার্টিফিকেট দেব সেটা দেখাবেন।’ ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন। আমরা খুশি হয়েছিলাম এই জেনে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশও ভারতীয় মানসিকতা এড়াতে পারেনি। ঠিক হল, আমরা যখন শুটিংয়ের সময় আসব, তখন ইনসিয়োরেন্স করিয়ে নেব।

ওয়াশিংটনের ভয়েস অফ আমেরিকায় চাকরি করতেন রমেন পাইন। একশো ভাগ বাঙালি এই ভদ্রলোক একসময় কলকাতা দূরদর্শনে খবর পড়তেন। ‘৮৪ সালে যখন প্রথমবার ওয়াশিংটন যাই, তখন ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়। বাড়িতে যাই। ওঁর মেয়ে জয়ন্তী তখন কিশোরী। খুব মিষ্টি দেখতে এবং ওদেশের মেয়েদের ছাঁচে বড় হচ্ছে। নিউ ইয়র্কে ফিরে গিয়ে মনোজকে ওঁর কথা বলেছিলাম। তখন সিনেমার ভাবনা মাথায় ছিল। সেই সিনেমায় ওই বয়সের একটি মেয়ে মূল চরিত্রে ছিল। মনোজের খুব পছন্দ হয় ছবি দেখে। পরে সে কথা বলে ওকেই নির্বাচিত করে।

পাঁচ বছর পরে জয়ন্তীর বয়স বাড়লেও নিয়মিত ভরতনাট্যম নাচের কারণে চট করে বোঝা যায় না। আমরা রমেনবাবু বাড়িতে গেলাম। রমেনবাবু এবং জুলি বউদির আপত্তি ছিল না। জয়ন্তীও খুব উৎসাহিত। রমেনবাবু ততদিনে আমাদের রমেনদা হয়ে গিয়েছেন। তিনি সাহায্যের হাত বাড়ালেন। ঠিক হল, পাইনবাড়ি ছাড়া জয়ন্তীর পরিচিত একজনের খালি বাড়িতে আমাদের পুরো ইউনিট থাকবে। ওয়াশিংটনে শুটিংয়ের সময় আমাদের থাকার খরচ বেঁচে গেল। স্বস্তিকর সংবাদ।

বলতে দ্বিধা নেই, আমরা এই প্রজেক্ট নিয়ে এতটা উত্তেজিত ছিলাম যে আগুপিছু ভাবিনি। বিবেক ব্যানার্জি তখনই বেশ নামকরা ক্যামেরাম্যান। খুব সাহায্য করেছিল সে। প্রথমেই বলল, ‘আপনারা কেন আমেরিকায় গিয়ে ক্যামেরা ভাড়া করার কথা ভাবছেন? কলকাতা থেকে নিয়ে গেলে তেমন আধুনিক ক্যামেরা হয়তো হবে না কিন্তু খরচ বাঁচবে। তাছাড়া, যে—ক্যামেরায় এখানে কাজ করি তা ওখানে ব্যবহার করলে ক্ষতি কী?’

আমাদের ইউনিট তৈরি হল। তিনজন শিল্পী ছাড়া বাকিরা সবাই কলাকুশলী। এদের বেশিরভাগই কখনও বিদেশে যায়নি। হাতে প্রথমবার পাসপোর্ট পেয়ে ওরা বেজায় খুশি। প্রোডাকশন বয় ভানু আমেরিকায় যাচ্ছে, একথা স্টুডিয়োগুলোতে গর্বের সঙ্গে প্রচার করল। যাচ্ছে কিশোর, প্রোডাকশন ম্যানেজার হয়ে। ঠিক হল, অরিজিৎ থেকে যাবে কলকাতায়। ওর ভাষায়, ‘ফোর্ট আগলাব।’ অর্থাৎ, রমাপ্রসাদ বণিক শুটিং সামলাবে আর আমি পুরো ইউনিট যাতে ভালো থাকে তার দেখাশোনা করব।

রওনা হওয়ার দিন দশেক আগে হঠাৎ কামাল বাড়িতে এল। এই কামালকে আমরা জেনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। সুনীলদা ওকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। যতদূর মনে পড়ছে, তার নাম ছিল ‘ভালোবাসা প্রেম নয়’। কামালের বাড়ি ছিল ঢাকার ধানমন্ডিতে। সেখানে তার মা—ভাইরা আছেন। কিন্তু সে ভাগ্যান্বেষণে গিয়েছিল কানাডায়, আমেরিকায়, কিন্তু তার একটা বদঅভ্যাস ছিল, সে কোথাও শেকড় গাড়তে পারত না। কামালকে নিয়ে লিখতে হলে একটা উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে। এই লেখায় তার জায়গা নেই। আমরা আমেরিকায় শুটিং করতে যাচ্ছি শুনে কামাল বলল, ‘ঠিক আছে, ওই কয়েকদিন তোমাদের মাইক্রো বাস আমি চালিয়ে দেব। পার ডে ৫০ ডলার এবং থাকা—খাওয়ার খরচ দিলেই হবে।’

আমরা হাতে স্বর্গ পেলাম। পরের দিন কামাল ফিরে যাচ্ছিল আমেরিকায়। তাকে সিদ্ধার্থর নাম্বার দিয়ে বললাম, যোগাযোগ করে যেদিন কেনেডি এয়ারপোর্টে পৌঁছাব, সেদিন বাস নিয়ে চলে আসতে।

১৮ জনের দল নিয়ে রওনা হলাম আমরা। দীপঙ্কর এলেন, মনোজদার সঙ্গে দীর্ঘকালের সুসম্পর্ক। শকুন্তলা বড়ুয়ার আন্তরিক কথাবার্তায় মনে হল বিদেশ সফর শান্তিতেই কাটবে। বোর্ডিং কার্ড নেওয়ার সময় দীপঙ্কর বলেছিলেন, ‘সবাই একসঙ্গে বসবে এমন সিট নিয়ো না, দুটো আলাদা গ্রুপ করে নাও।’

ফলে, বেশিরভাগ টেকনিশিয়ান অনেকটা পেছনে বসেছিল। এতে ওদের সুবিধেই হল। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে সফট ড্রিংক ছাড়াও হুইস্কি বা ভদকা পরিবেশন করা হয়। পাশাপাশি বসলে ওদের হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিতে অস্বস্তি হত। সেটা হল না। আবার এয়ারহোস্টেসরা কখনওই দেড় বা দুইয়ের বেশি পেগ পরিবেশন করেন না। তাই কারওর মাতাল হওয়ার সুযোগ থাকছে না।

টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তাঁরা যা দক্ষিণা কলকাতায় কাজ করলে পেয়ে থাকেন তা তো পাবেনই, তাছাড়া প্রত্যেককে ১০০ ডলার করে হাতখরচ বাবদ দেওয়া হবে। প্রস্তাবে কেউ অখুশি হননি।

ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসের বাধা পার হওয়ার সময় বিবেক যেসব ক্যামেরা এবং সাউন্ডের যন্ত্রপাতি নিয়ে যাচ্ছে, তা ডিক্লেয়ার করে রসিদ সংগ্রহ করে নিল। এর ফলে ফিরে আসার সময় কাস্টমস কোনো আপত্তি করতে পারবে না। ওই লিস্ট আমি দেখিনি। শুনেছি, এটা খুব জরুরি। প্লেনে ওঠার সময় লক্ষ করলাম, প্রত্যেকের মুখে বেশ সপ্রতিভ ভাব। যে—ভানু আধমলিন জামাপ্যান্ট পরে কলকাতায় শুটিংয়ে সবাইকে চা—জল দিয়ে থাকে, তার পরনেও বেশ ঝকঝকে শার্টপ্যান্ট। সদ্য চুল কেটে বেশ স্মার্ট হয়ে হাঁটছে। দেখে ভালো লাগল।

জন কেনেডি এয়ারপোর্টে নেমে সমস্ত ফর্ম্যালিটি শেষ করে বাইরে বের হতেই দলের কেউ সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘এটা আমেরিকা? আমরা আমেরিকায় এসেছি? ভাবা যায়? কিন্তু এখানকার মাটি তো আমাদের দেশের মতোই।’

কামাল এগিয়ে এল—’ওয়েলকাম। ওয়েলকাম।’ হাত বাড়াল সে।

সত্যি বলতে হলে বলা উচিত, আমি একটু ভয়েই ছিলাম। সঙ্গী হিসেবে খুব মজার মানুষ কিন্তু কামাল যে স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করে না, তার প্রমাণ সে অনেকবার দিয়েছে। তাই যদি বাস চালিয়ে আমাদের রিসিভ করতে সে এয়ারপোর্ট না আসে—এমন আশঙ্কা আমার মনে ছিল। ওকে দেখে এত খুশি হয়েছিলাম যে জড়িয়ে ধরেছিলাম।

প্রথমে হাডসন নদী পেরিয়ে নিউ জার্সির কোস্টার শহরে সিদ্ধার্থর বাড়িতে যাওয়া হল। সেখানে দীপঙ্কর, মনোজ মিত্র, শকুন্তলা বড়ুয়া নেমে গেলেন। ওঁদের সঙ্গে আমাদের তরফ থেকে থাকল শংকর ঘোষ।

বাকিদের নিয়ে চলে এলাম হোটেলে। দোতলার ঘরগুলোয় কে কোথায় থাকবে ঠিক করার পর কামালই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করল। সবাই যে—যার ঘরের দরজা বন্ধ করার পর যখন শোয়ার তোড়জোড় করছি, তখন গাড়ির আওয়াজ কানে এল। আমার ঘরে আমি একাই ছিলাম। দরজা খুলে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, একটা ট্যাক্সি এসে থামল সামনের খোলা জায়গায়। ট্যাক্সি থেকে যে নামল, তাকে এই রাতের হোটেলের আলোয় অপ্সরার মতো মনে হচ্ছিল। হাঁটু পর্যন্ত জুতো, তার ওপর অনেকটা খোলা, তারপর স্কার্টের প্রান্ত। কোমরের দুই ইঞ্চির চামড়া চকচক করছে। মেয়েটি বুক উঁচিয়ে হেঁটে আসতে আসতে ওপরের দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নাড়ল সে। তারপর অদ্ভুত হাসি হেসে হোটেলের নীচের ঘরে ঢুকে গেল।

মনে হচ্ছিল, সিনেমার একটি দৃশ্য দেখলাম।

মুখ ফিরিয়ে ডান দিকে তাকাতেই অবাক হলাম। দোতলার বারান্দাজুড়ে প্রায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ছেলেরা। মুখ দেখে মনে হল, মুগ্ধ হয়ে সিনেমা দেখল। আমি লক্ষ করেছি বুঝেই যে—যার ঘরে ঢুকে গেল।

বুঝলাম, এই হোটেলে অনেক নাটক অপেক্ষা করছে।

নিউ ইয়র্ক শহরে শুটিং করছি, মনোজ ভৌমিকের উপন্যাসকে ক্যামেরাবন্দি করছি। তাঁর ইচ্ছেকে বাস্তবে পরিণত করছি কিন্তু তিনি নেই! সামনে হেসে একমুখ দাড়ি নিয়ে এসে বলবেন না, ‘একদম ফাটাফাটি ব্যাপার, কী বলুন!’

প্রথম রাতে একা মোটেলের ঘরে শুয়ে ওঁকে খুব মিস করছিলাম; মনে পড়ল একটি দিনের কথা। নিউ ইয়র্কে প্রথমবার এসে যা দেখেছি তার সবই মনোজ দেখিয়েছিলেন। ছবি করবেন এমন কথা রোজ হত, চরিত্রগুলোর চেহারা নিয়ে আলোচনা করতেন। এক দুপুরে বললেন, ‘ছবিটা যদি বাংলায় হয় তাহলে একজনকে রাজি করাতে পারলে দারুণ হবে। ভদ্রমহিলা বাংলা বলতে পারেন, কাউকে দিয়ে ডাব করিয়ে নিতে হবে। হিন্দিতে হলে তার দরকার হবে না।’

কৌতূহলী হলাম, ‘কাকে দিয়ে করাতে চাইছেন?’

‘নিউ ইয়র্কেই থাকেন। দাঁড়ান, ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলে আসি।’

সেসময় মোবাইল ফোন কী তা আমরা জানতাম না। মনোজ পাশের ঘরে গিয়ে ফোনে কথা বলে এসে বললেন, ‘চলুন, বেরিয়ে পড়ি।’

আমি প্রশ্ন করতাম না, কোথায় যাচ্ছি। ওই শহরের কিছুই তো আমি জানতাম না। পাজামা—পাঞ্জাবি—চটি পরে মনোজ গাড়ি চালিয়ে মিনিট চল্লিশেক দূরত্বের এক বাড়ির সামনে আমাকে নিয়ে এলন। ফ্ল্যাট বাড়ি। ওপরের একটি ফ্ল্যাটের বেল টিপলে যিনি খুললেন, তাঁকে পরিচয় দিতে আমাদের বসতে বলে ভিতরে চলে গেলেন। ছিমছাম সাজানো ঘর, কোনো ছবি দেওয়ালে টাঙানো নেই। এই চরিত্রটি সুন্দরী ছিলেন একসময় যা এখনও তাঁকে দেখলে বোঝা যায়। অতএব যাঁর বাড়িতে এসেছি, তাঁকে দেখার জন্যে বেশ উৎসুক ছিলাম। একটু পরে ভদ্রমহিলা এলেন।

ইনি যে একদা অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বয়সের ছাপ পড়েছে এখন, ঈষৎ চর্বিও জমে গেছে শরীরে। কিন্তু মুখে বলিরেখা পড়েনি। গলায় আঁচল বা ওড়না জড়ালে চট করে বয়স ধরা মুশকিল হবে।

সোফায় বসে হেসে ইংরেজিতে বললেন, ‘কী ব্যাপার মনোজ? অনেকদিন দেখতে পাইনি, আজ ফোন করেই আসতে চাইলে!’

‘ইনি একজন বাঙালি লেখক। আমার বাড়িতে আছেন এখন। ওঁর সঙ্গে আমার সেই ছবির চিত্রনাট্যের লাইন—আপ সাজাচ্ছিলাম। আপনাকে একবার একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে অনুরোধ করেছিলাম। যদিও আপনি কথা দেননি, তবু সমরেশকে নিয়ে এলাম আপনাকে দেখানোর জন্যে।’ মনোজ বললেন।

‘কী আশ্চর্য! আমি যে অভিনয় করব তা তো তোমাকে বলিনি। হ্যাঁ, তোমার প্রজেক্টটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। বলেছিলাম, ফিনান্সের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললেন, ‘নমস্কার। আমার দুর্ভাগ্য, আমি বাংলা পড়তে পারি না।’

‘তাতে কী হয়েছে! আমিও তো ওড়িয়া, তামিল, তেলুগু পড়তে পারি না। কিন্তু আপনি অভিনয় করলে চরিত্রটা প্রাণ পেত। খুব ভালো লাগত দর্শকদের।’ বিনীতভাবে বললাম।

‘মুশকিল! আমি তো বাংলায় কথা বলতেই পারব না!’

মনোজ বললেন, ‘ছবিটা যদি হিন্দিতে করি?’

‘হিন্দিতে? তার তো অনেক খরচ!’

‘চেষ্টা তো করা যেতে পারে!’

মহিলা হাসলেন, ‘আগে তোমার চেষ্টা সফল হোক, তারপর আমি কথা বলব! এখন কী খাবে বলো!’

‘কিছু না।’ মনোজ মাথা নেড়েছিলেন।

‘তা কি হয়। উনি প্রথমবার আমার কাছে এসেছেন!’

‘আপনি কথা না দিলে আমরা কিছুই খাব না।’ মনোজ বলেছিলেন।

ভদ্রমহিলা তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, ‘মনোজ, যখন কিছু হয় তখন আপনাআপনি হয়, তার জন্য জোর করতে হয় না। জোর করে কিছু আদায় করলে তার ফল ভালো হয় না।’

মনোজ হেসে বলেছিলেন, ‘ওকে! কফি খাব।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে ভিতরে চলে গিয়েছিলেন।

বাইরে বেরিয়ে এসে মনোজ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কেমন দেখলেন?

‘খুবই ভালো, কিন্তু—’

‘চরিত্রটা যা তা থেকে বয়সে বড় বলছেন?’

‘না। তা বলছি না। বাংলায় হলে তো উনি রাজি হবেন না। হিন্দিতে করা কি সম্ভব হবে? সেটা সত্যি অনেক টাকার ব্যাপার!’

‘হুঁ!’ মনোজ গাড়িতে উঠলেন। খানিকটা চলার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা সমরেশ, ভদ্রমহিলাকে কি আপনার চেনা মনে হল?’

মাথা নেড়ে বললাম, ‘না। উনি নিউ ইয়র্কে থাকেন আর আমি কলকাতায়, চেনার সুযোগ কোথায়?’

‘আচ্ছা, হিন্দি সিনেমার পদ্মিনীকে আপনার মনে আছে?’

‘অবশ্যই। ওঁর শেষ ছবি দেখেছি—’মেরা নাম জোকার’। ভদ্রমহিলা দারুণ ভরতনাট্যম নাচ জানতেন। তামিল, তেলুগু ছবিতেও অভিনয় করেছেন। কেন বলুন তো?’

মনোজ হাসলেন, ‘আপনি এতক্ষণ সেই পদ্মিনীর সঙ্গে কথা বলে এলেন। আমি আপনাকে সারপ্রাইজ দেব বলে আগে বলিনি।’

আমি তাজ্জব। হ্যাঁ, মীনাকুমারী, নার্গিস বা ওয়াহিদা রেহমানের মতো অভিনেত্রী ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু তামিল এবং হিন্দি ফিল্মে পদ্মিনীর একটা বিশেষ জায়গা ছিল। ওই ‘মেরা নাম জোকার’—এ রাজ কাপুরের সঙ্গে তিনি চুটিয়ে অভিনয় করেছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই, ওঁর শরীরের আকর্ষণ চমৎকার ছিল! অথচ সেই পদ্মিনীর সঙ্গে আধঘণ্টার বেশি সময় কাটিয়েও আমি তাঁকে চিনতে পারলাম না? নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চেহারা কী দ্রুত বদলে যায়!

একথা স্বীকার না করে উপায় নেই, আমাদের শিল্পী এবং কলাকুশলীরা যে—কষ্ট স্বীকার করে শুটিং করেছেন তা সচরাচর হয় না। মোটেলের ঘরে থাকাটা সমস্যার ছিল না, কিন্তু খাওয়া নিয়ে অভিযোগ করতেই পারতেন, করেননি। গাড়ি থামিয়ে ম্যাকডোনাল্ডের সামনে নেমে একটা হ্যামবার্গার আর চা খেয়ে ব্রেকফাস্ট করে কাজে নামতে ওঁরা আপত্তি করেননি। লাঞ্চে কিশোর ভানুকে সঙ্গে নিয়ে কিনে আনত বিগম্যাক, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। নামের জৌলুস ছিল, আসলে সেদ্ধ মাংসের দু’পাশে নরম পাউরুটি আর আলুভাজা। রাত্রে একটা গুজরাতি রেস্টুর্যান্টকে ম্যানেজ করে রুটি আর দু’রকমের সবজি নিয়ে আসত ওরা। এই খাবার দিঘা বা শান্তিনিকেতনে শুটিং করতে গিয়ে কোনো টেকনিশিয়ান খেতে চাইবেন না। আমাদের কলাকুশলীরা করেননি, কারণ তাঁরা জানতেন এর বেশি খেতে চাইলে আমাদের বাজেটে টান পড়বে।

শকুন্তলা, মনোজ মিত্র, দীপঙ্করদের খাওয়ার সমস্যা হয়নি। সিদ্ধার্থ আর বনানী যত্ন করে ব্রেকফাস্ট আর ডিনার খাওয়াতেন। দুপুরে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চে খেতে তাই অসুবিধে হত না। মনে পড়ছে, একদিন লাঞ্চ খেতে খেতে যিশু দাশগুপ্ত জিজ্ঞাসা করেছিল মনোজদাকে—’কাল রাত্রে বনানীবউদি আপনাদের কী খাইয়েছিল?’

মনোজদা সরল মনে বলেছিলেন, ‘দীপঙ্কররা রুটি আর মুরগির মাংস খেয়েছিল। আমি খাইনি।’

‘সে কী! কিছুই খাননি?’ যিশুর চোখ বড় হয়েছিল।

‘না না। আমি একটু ভাত আর মাছের ঝোল খেয়েছিলাম।’

মনোজদার কথা শুনে যিশু এক মিনিট চুপ করে বসেছিল। তারপর বলেছিল, ‘সমরেশদা, আজ রাত্রে আমি মনোজদাদের সঙ্গে থাকব।’

‘সে কী! কেন?’ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

‘কতদিন মাছের ঝোল খাইনি! কীরকম স্বাদ তা ভুলেই গিয়েছি। আজ রাত্রে সেটা মনে রিনিউ করে যদি দরকার হয় মোটেলে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে যাব। প্লিজ, না বলবেন না।’ যিশু বলেছিল।

পুরোটাই মজার কিন্তু কষ্টটা বোঝা যায়।

শুটিং চলছে। কখনও ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে, কখনও সেন্ট্রাল পার্কে, ম্যানহাটনের রাস্তায়। সস্তায় বিমা করানো থাকায় পুলিশ আপত্তি করেনি। শুধু বলেছিল, আমাদের জন্যে যদি জ্যামজট হয় তাহলে ফাইন দিতে হবে। সেটা হয়নি। সে সময় নিউ ইয়র্কের বাঙালিরা মজে ছিলেন হেমন্ত—সন্ধ্যা—শ্যামলে, উত্তম—সুচিত্রা—সৌমিত্রতে। তারপর যে গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেছে তার খবর তাঁরা রাখার দরকার মনে করতেন না। ফলে, নব্বই সালে যিনি বাংলা চলচ্চিচত্রের স্টার ছিলেন, তিনি ম্যানহাটনের ফুটপাথে হেঁটে গেলে কোনো বাঙালি ফিরেও তাঁর দিকে তাকাত না। দীপঙ্কর—শকুন্তলাকে দেখে ভিড় জমার তো কোনো কারণ ছিল না।

রোজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুটিং চলত। যিশু এবং বিবেক গিয়ে ম্যানহাটনের দোকান যারা শুটিংয়ে আলো সাপ্লাই দেয়, তাদের কাছ থেকে কাজ চালাবার মতো আলো ভাড়া করে এনেছিল। কাজ শেষ হলে মোটেলে ফিরে খাওয়া—দাওয়ার পর আমি সবাইকে ঘুমাতে যেতে বলে নিজের ঘরে চলে আসতাম। কিন্তু ইউনিটের একজন এসে জানাল, রোজ রাত্রে কয়েকজন চুপচাপ বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে ঘণ্টা আড়াই পরে। যাদের নাম বলল, তাদের একজনকে বেশ স্নেহ করতাম। তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেই স্বীকার করল, ‘বিশ্বাস করুন, কোনো খারাপ কাজ করি না। ওখানে গিয়ে একটা বিয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে সব দেখি। কলকাতায় এসব দেখার সুযোগ হয় না তো!’

‘কী দেখিস?’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

‘ওই আর কী! নাইট ক্লাব তো! ইংরেজি সিনেমায় দেখা যায়।’

‘কী দেখা যায়?’

‘উঃ, আপনি এত জিজ্ঞাসা করবেন না তো! মাইরি বলছি, আমরা কেউ কোনো খারাপ কাজ করিনি।’

‘কিন্তু নাইট ক্লাবে ঢুকতে তো ভালো ডলার লাগে!’

‘একটু বেশি। আমরা তো কলকাতা থেকে এনেছিলাম।’

দেখলাম, বেশি জোরজারি করা ঠিক হবে না।

দু’দিন পরের রাত্রে দরজায় শব্দ। খুলে দেখলাম, বালিশ হাতে রমাপ্রসাদ দাঁড়িয়ে। করুণ মুখে জিজ্ঞাসা করল, ‘সমরেশদা, আপনার ওপাশের খাটে আজ রাত্রে শুতে পারি?’

‘কেন রে?’ অবাক হলাম—’তোর সমস্যা কী?’

‘কাল মাঝরাতে কেউ দরজায় নক করেছে। ঘুম হয়নি।’

‘বেশ, থাক।’

খানিক পরে মদনসূদনজি এসে হাজির—’দাদা, আপনার ঘরে কি আমি রাত্রে শুতে পারি?’

‘তোমার আবার কী হল? দরজায় কেউ নক করেছে?’

‘হ্যাঁ দাদা, নীচের ওই মেয়েটা।’

‘কোন মেয়েটা?’

‘ওই যে, একা থাকে। খুব চালু।’

‘কিন্তু আমার পাশের খাটে তো রমাপ্রসাদ শুয়ে আছে।’

‘তাতে অসুবিধে নেই। আমি ওর পাশে শুয়ে পড়ব।’

‘দ্যাখো।’

ঘণ্টাখানেক পরে, একটু ঘুমিয়ে পড়ার পর দরজায় শব্দ হল। খুলে দেখলাম বিবেক দাঁড়িয়ে আছে। মুখ—চোখে বেশ ভয়ের ছাপ। ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে বলল, ‘দাদা, আপনরা ঘরে আজ ঘুমোতে পারি?’

‘কেউ দরজায় নক করেছিল?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

বিবেক অবাক হয়ে তাকাল, ‘আপনি কী করে জানলেন?’

‘জেনেছি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, কে না কে তোমাদের দরজায় নক করছে আর তোমরা ভয় পেয়ে কেন আমার ঘরে শোয়ার জন্যে চলে আসছ? দরজা খুলে দেখেছ কে কাজটা করছে?’ রেগে গেলাম আমি।

‘দেখেছি।’ বিবেক মাথা নাড়ল।

‘কে সে?’

‘ওই মেয়েটা যে নীচেরতলায় থাকে।’

আমি অবাক। মোটেলের নীচেরতলায় যে—মেয়েটিকে ঢুকতে দেখেছি তার সাজগোজ, চেহারা বলে দিচ্ছে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করে না। সে কেন দোতলার ঘরে মাঝরাতে নক করবে? বিবেককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাকে জিজ্ঞাসা করেছ কী চায়?’

‘হ্যাঁ। ও সোজা ঘরে ঢুকে এসে আমার হাত ধরে বলল যে, খুব বিপদে পড়েছে। আমি যদি পাঁচশো ডলার ধার দিই তাহলে ওর উপকার হবে।’ বেশ নার্ভাস গলায় বলল।

‘কীসের বিপদ?’

‘ওর মা নাকি অসুস্থ হয়েছে। তার চিকিৎসার জন্যে।’

‘প্রথম কথা, এদেশের নাগরিকদের চিকিৎসার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয়ত, এত লোক থাকতে সে তোমার কাছে পাঁচশো ডলার চাইতে এল কেন? আগে আলাপ হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। মানে ওই আসা—যাওয়ার পথে হাই হ্যালো করেছিল। আমাকে বলে গেছে দু’ঘণ্টা পরে এসে ডলার নিয়ে যাবে। আমি তাই আমার ঘরে থাকব না।’ বিবেক বলল।

এটা খুবই অন্যায় কথা। ভাবছিলাম কী করা উচিত। বললাম, ‘তোমার কাছে ধার চেয়েছে। সেই ধার কখনওই শোধ করবে না।’

ওপাশের খাটে বসে মদনসূদনজি কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার বললেন, ‘অন্যভাবে শোধ করবে। ওটাই ওর ব্যবসা।’

আমি টেবিলের কাছে গিয়ে মোটেলের অফিসের নাম্বার ইন্টারকমে টিপলাম, একটু পরে ওপাশ থেকে জানান দিল। নিজের পরিচয় দিয়ে ব্যাপারটা জানাতেই অফিস থেকে বলল, ‘কখনও মেয়েটাকে ডলার দেবেন না। শোধ তো করবেই না, তাছাড়া ওর যৌনরোগ আছে।’

‘সর্বনাশ। এইরকম মেয়েকে মোটেলে রেখেছ কেন?’

‘কী করব বলুন। কেউ ঠিক সময়ে ভাড়া যদি দেয়, যদি অন্য কাউকে বিরক্ত না করে, কোনো অপরাধে না জড়ায় তাহলে আমরা ওকে থাকতে দিতে বাধ্য। আমি ওকে ফোন করে বলছি যেন আপনাদের কাউকে আর বিরক্ত না করে। এর জন্য স্যার, আমরা খুব দুঃখিত।’ লোকটি বলল।

আমরা যখন কথা বলছি, তখন বাইরে গাড়ির শব্দ হল। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। পেছনে ওরাও এল। দেখলাম, নীচের খোলা জায়গায় দুটো পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। দু’জন অফিসার রিভলভার হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। তারপর মোটেলের একতলার দিকে এগিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল ইংরেজি সিনেমা দেখছি। বিবেক চাপা গলায় বলল, ‘সর্বনাশ!’

তারপরেই নীচের ঘর থেকে মহিলার চিৎকার ভেসে এল। কান্না জড়ানো গলায় গালাগাল দিচ্ছে। তার পরেই দেখলাম, বিশাল চেহারার একটি কালো লোককে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে দিতে একজন অফিসার গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটার হাতে হাতকড়ি লাগানো। তার পরেই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। সম্ভবত শুয়েছিল সে। শরীরে নামমাত্র পোশাক। তাকেও হাতকড়া পরিয়ে দ্বিতীয় অফিসার বের করে নিয়ে এল। সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। অশ্রাব্য গালাগাল করছে, ঠেলতে ঠেলতে দু’জনকে দুটো গাড়িতে তুলে অফিসাররা বেরিয়ে গেল।

ওরা চলে যাওয়ার পর আমার ঘর খালি হতে সময় লাগেনি। পরদিন শুটিংয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, মেয়েটির ঘরে তালা দেওয়া। অফিসে কথা বলে জানলাম, কোর্ট যদি মেয়েটিকে শাস্তি না দেয় তাহলে সে ফিরে এলে তাকে ঘর খুলে না দিয়ে উপায় নেই। যে কালো, বিশাল চেহারার লোককে ওর ঘর থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, সেই নাকি মেয়েটির নতুন বন্ধু। হয়তো তার প্রয়োজনেই বিবেকের কাছে মায়ের অসুখের গল্প বলে টাকা হাতাতে এসেছিল মেয়েটি। এরপর যতদিন ওই মোটেলে ছিলাম মেয়েটির দেখা পাইনি। কিন্তু শেষদিন, যখন মোটেল ছাড়ছি, তখন একটি রোগা, কালো ছেলের সঙ্গে সে ট্যাক্সি থেকে নামল। তারপর আমাদের চেনেই না এমন মুখ করে পাশ দিয়ে অফিসের দিকে চলে গেল। আমার ধারণা, আমাদের কেউ এজন্যে কষ্ট তো পায়নি, হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল।

নিউ জার্সির কয়েকটি বাড়িতে আমরা শুটিং করেছিলাম। ওঁরা সবাই মনোজের বন্ধু ছিলেন। আলোলিকা—ভবানীর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। ওঁরা সবাই আমাদের সিরিয়ালে কোনো—না—কোনো ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। শমিতার বাড়িতে অনেক সময় ধরে শুটিং হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে বিরক্ত হয়েছেন তা বোঝা যায়নি। সাধারণত, এদেশেও, কারওর বাড়িতে সিনেমার শিল্পীদের নিয়ে ছবির শুটিং করতে চাই প্রস্তাব দিলে প্রথমে খুশি মনে অনুমতি দিয়ে থাকেন। তারপর যখন দ্যাখেন, তাঁর সাজানো বাড়ি তছনছ করা হচ্ছে, কলাকুশলীরা শুটিংয়ের প্রয়োজনে যা করছে তা তাঁর মনঃপূত হচ্ছে না, তখন ভাবেন এরা কবে বিদায় হবে! ভদ্রতাবশত তাড়াতে পারেন না, চলে গেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। নিউ জার্সির বাঙালিরা এই অত্যাচার চুপচাপ সহ্য করেছেন।

সাধারণত শট নেওয়ার আগে শিল্পীরা সংলাপ রপ্ত করতেন। মদনসূদনজি লক্ষ রাখতেন যাতে উচ্চচারণ নিখুঁত হয়। এ ব্যাপারে শকুন্তলা বেশ চৌকস ছিলেন, দীপঙ্করও স্বচ্ছন্দ কিন্তু মনোজ মিত্রকে নিয়ে একটু সমস্যায় পড়তেন মদনসূদনজি। বাজারের বাঙালি—হিন্দিকে ঠিকঠাক করতে বেশ সময় দিতে হত। মনোজদাও ছাত্র হিসেবে বিনীত থাকতেন। বিবেক ছিল ক্যামেরায়, তাকে সাহায্য করত যিশু। এছাড়া আলো সাজত সে।

নিউ ইয়র্ক ছেড়ে ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে একটি ঘটনা ঘটল যার পরিণতি বেদনাদায়ক হতে পারত। প্রতিদিন সকাল—সন্ধ্যা কাজ করে যাচ্ছে সবাই, নিউ ইয়র্ক শহর ঘুরে দেখা দূরের কথা, বিশ্রামও হচ্ছে না! তাই যাওয়ার আগের দুপুরে শুটিং প্যাক—আপ হলে সবাইকে নিয়ে হাডসন পেরিয়ে ম্যানহাটনের পোর্ট অথরিটি টার্মিনালে চলে গেলাম শুটিংয়ের বাসে চেপে। তখন দুপুর তিনটে। সবাইকে বলে দিলাম সন্ধে ছ’টার মধ্যে যেন বাসের কাছে চলে আসে।

পোর্ট অথরিটি পার হতেই ফর্টি সেকেন্ড স্ট্রিটে তখন প্রচুর সেক্স শপ, লাইফ শো, পিপ হোল থেকে নানান ব্যবস্থা যা টুরিস্টদের আকর্ষণ করার জন্যে তৈরি। চুরাশি সালে ওখানে গিয়ে দেখেছিলাম বিশাল লাইন পড়েছে দোকানগুলোর সামনে। ঊননব্বুইতে গিয়ে সেই লাইন দেখিনি। কিছু বৃদ্ধা—বৃদ্ধ টুরিস্ট ঢুকছেন। শুনেছিলাম, ব্যবসা খারাপ হচ্ছে বলে ওগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমাদের শুটিংয়ের সময়ও তা চালু ছিল।

দলের ছেলেরা এক একটা ভাগে ভাগ হয়ে বেড়াতে গেল। সন্ধে ছ’টার আগেই সবাই ফিরেও এল। কিশোর মাথা গুনে বলল, ঠিক আছে। রমাপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করলে সে একই কথা বলল। কামাল বাস ছেড়ে যখন প্রায় হাডসনের কাছে চলে গেছে, তখন রমাপ্রসাদ চিৎকার করল, ‘মদনসূদনজি ওঠেনি।’

ওইসব রাস্তায় চট করে বাস থামানো মুশকিল। জিজ্ঞাসা করলাম, তুই যে তখন বললি সব ঠিক আছে?’

রমাপ্রসাদ বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম ও আমার পেছনে বসে আছে।’

শেষপর্যন্ত কামাল বাস ঘুরিয়ে যেখানে এতক্ষণ ছিলাম, সেখানে চলে এল। কিন্তু মদনসূদনজি নেই। রাত নেমে গেলেও আলো এত জোরালো যে দিন বলেই মনে হচ্ছে। মদনসূদনজিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা যে একা নিউ জার্সির মোটেলে ফিরে যেতে পারবেন এ বিশ্বাস আমাদের নেই। রুট চেনেন না, কোথায় নামবেন তাও জানেন না। এমনকী মোটেলের ফোন নাম্বারও ওঁর কাছে নেই। খুব অসহায় লাগছিল। মদনসূদনজি যদি পুলিশের কাছে যান তাহলে কি মোটেলের নাম বলতে পারবেন?

আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কামালকে বললাম ম্যানহাটনের ওই এলাকার রাস্তাগুলোতে পাক মারতে। যদি ওঁকে দেখতে পাওয়া যায়। দু’বার ঘোরা হল কিন্তু কোথাও ভদ্রলোক নেই। ফিরে তো যেতেই হবে কিন্তু তার আগে পুলিশকে জানানো দরকার। একজন পুলিশ অফিসার গাড়িতে বসেছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে কাছাকাছি পুলিশ স্টেশনের হদিশ জেনে আমরা একটা গলি দিয়ে যখন এগোচ্ছি, তখন কামাল চিৎকার করে উঠল, ‘ওই যে, ওই যে!’

সামনের কাচের ভেতর দিয়ে দেখলাম, মদনসূদনজি রাস্তায় নেমে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে দু’হাত মাথার ওপর তুলে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

গাড়ি থেকে নামামাত্র মদনসূদনজি প্রায় ঝাঁপিয়ে এলেন। কিশোর দরজা খুলে দিয়েছিল। ওপরে উঠে একটা সিটে বসে পড়ে চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে লাগলেন। ওঁর শ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কামাল গাড়ি চালু করল। আমি সবাইকে বললাম এখন ওঁকে কোনো প্রশ্ন না করতে! প্রায় রক্তশূন্য মুখে বসেছিলেন মদনসূদনজি। কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। একজন বয়স্ক মানুষ অজানা জায়গায় সঙ্গীদের হারিয়ে এরকম নার্ভাস হবেন, ভাবিনি।

হাডসন পার হওয়ার পর একটু স্বাভাবিক হলেন ভদ্রলোক। ওঁকে আমার পাশে নিয়ে এলাম। হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন লাগছে এখন?’

‘অনেক ভালো।’

‘একটু জল খাবেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ!’

জল খেয়ে মদনসূদনজি বললেন, ‘আজ আমি মরেই যেতাম।’

যে—কাহিনি তিনি শোনালেন, তা রীতিমতো ভয়ংকর।

সবাই যে—যার ইচ্ছেমতন জায়গায় ঘুরছে দেখে মদনসূদনজি ফুটপাত ধরে একাই হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ—দোকান সে—দোকানে উইন্ডো শপিং করে তিনি দেখতে পেলেন মেয়েরা দ্রুত টিউব স্টেশনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তাদের জুতোর হিলের আওয়াজ যেন ঘোড়ার নালের শব্দের মতো মনে হচ্ছিল। ক্রমশ রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেলে উনি বুঝলেন এটা অফিসপাড়া। ছুটির পরে সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। ডালহৌসিতে সন্ধের পর যা হয়। ছ’টা বাজতে দেরি নেই দেখে মদনসূদনজি যখন ফেরার জন্যে পা বাড়িয়েছেন, তখন তাঁর সামনে ফুটপাতজুড়ে দু’জন বড় চেহারার কালো মানুষ এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হাই বেবি! কাম উইদ আজ।’

একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে বেবি বলায় মদনসূদনজির মনে হল এরা খারাপ লোক। তিনি পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে একজন তাঁকে টেনে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে চাইল। সর্বশক্তি এক করে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়তে লাগলেন মদনসূদনজি। পেছন পেছন লোক দুটো খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে ছুটে আসছে। হাই বেবি, হাই বেবি চিৎকার কানে আসায় আরও জোরে পা চালালেন তিনি। মাঝে মাঝে খালি বিয়ারের ক্যান পেছন থেকে উড়ে আসছিল।

পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে মদনসূদনজি বাঁ দিকের দুটো বাড়ির মাঝখানের খাঁজের ভেতর ঢুকে পড়েছিলেন। নড়াচড়ার জায়গা ছিল না। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলেন, পাশের রাস্তা দিয়ে সেই লোক দুটো দৌড়ে যাচ্ছে সামনে, তাঁর খোঁজে। ওই অবস্থায় কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন তিনি জানেন না, যখন মনে হল লোক দুটো ধারে—কাছে নেই, তখন বেরিয়ে এসেছিলেন ফুটপাতে। আর তখনই দূরে আমাদের গাড়িকে আসতে দেখেন তিনি।

মদনসূদনজি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই দেশে এমন হয় জানতাম না। ওরা পশুর অধম। সরকার কিছু বলে না কেন?’

বলেছিলাম, ‘পৃথিবীর সব দেশেই ওরা আছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি!’

নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন পৌঁছতে গাড়িতে ঘণ্টা চারেক—পাঁচেক লাগে। পথে পড়ে বাল্টিমোর, সেখানে, মানে শহরের মধ্যে ঢোকার কথা ছিল না। কিন্তু কয়েকজনের আগ্রহ দেখে ড্রাইভিং সিটে বসে কামাল বলল, ‘চলো, আজ যখন শুটিং নেই, তখন শহরটা দেখিয়ে দিই।’ আমি আপত্তি করিনি।

না করার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমাদের ওই ইউনিটের বেশিরভাগ মানুষ সিনেমার সঙ্গে জড়িত। কেউ অভিনয় করেন, কেউ টেকনিশিয়ান, কেউ প্রোডাকশনের কাজ করেন। এঁরা যখন শুটিংয়ের জন্যে আউটডোরে যান, তখন বেশ যত্নে থাকেন। পান থেকে চুন খসে গেলে চট করে মেনে নিতে পারেন না। অভিনেতারা, যাঁরা নাম করেছেন, থাকেন রাজার হালে। নিজের পয়সায় পরিবার নিয়ে সচরাচর তাঁরা বেড়াতে যান না। কারণ, ওইরকম আরামে থাকতে হলে নিজেকেই খরচ করতে হবে। আর বাকিরা, বাড়িতে যা পান না, আউটডোরে গিয়ে সেই আরাম পেতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের এই প্রজেক্টে আমেরিকায় শুটিং করতে এসে ওঁরা সেই আরাম পাচ্ছেন না। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের কর্মীদের মতো সব কিছু মানিয়ে তাঁদের থাকতে হচ্ছে। ভারতবর্ষের যে—কোনো জায়গায় আউটডোর শুটিংয়ে গেলে ওঁরা এরকম অবস্থায় বিদ্রোহ করতেন। কিন্তু দুটো কারণে সবাই হাসিমুখে থাকতেন। এক, ওঁরা আমেরিকায় এসেছেন। ওঁদের মধ্যে অনেকেরই আমেরিকায় আসার সামর্থ্য ছিল না। আর থাকলেও ভিসা পেতেন না। সেই খুশিটা কাজ করত। দ্বিতীয়ত, আমাদের সম্পর্ক এত নিবিড় ছিল, দাদা এবং ভাই ছাড়া কেউ কিছু ভাবত না, সমস্যা তৈরি হলে প্রোডাকশন বয় থেকে ক্যামেরাম্যান এবং আমি একসঙ্গে বসে সমাধান করার চেষ্টা করতাম, এটাও প্রত্যেকের মনের চেহারা বদলে দিয়েছিল। তাই কামাল কথাগুলো বললে আমারও মনে হয়েছিল, ওরা আমেরিকায় এসে একটু ঘুরে বেড়াবে না, তা হয় নাকি!

ছিমছাম শহর বাল্টিমোর। সমুদ্রের একটা অংশ ঢুকে গেছে শহরের ভিতরে। তার দু’পাশে অনেক সাজানো বেড়াবার জায়গা, রেস্টুর্যান্ট। বাস থেকে নেমে সবাই দেখতে বেরিয়ে গেল। মনোজদা, মনোজমিত্র আমার পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে বললেন, ‘ইস, আমাদের দিঘাকে যদি এরকম সাজানো যেত!’ বিদেশের ভালো কিছু দেখে যিনি দেশের কথা ভাবতে পারেন, তাঁকে শ্রদ্ধা করতেই হয়। বহু বছর দিঘায় যাইনি, জানি না জায়গাটা কতটা সুন্দর হয়েছে!

বাল্টিমোরের সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে সেদিন ভাবতেও পারিনি আর সাত বছর বাদে এই শহরে ঘুরে ফিরে দিন দশেক থাকতে হবে। সেটা সাতানব্বুই সাল। নাটক করতে গিয়েছিলাম আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। আমারই লেখা নাটক ‘তিন নম্বর চোখ’। অভিনয় করেছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক, দুলাল লাহিড়ি, শংকর ঘোষ, শকুন্তলা বড়ুয়া এবং লাবণী সরকার। সেটা অন্য কাহিনি। ভবিষ্যৎ যদি বুঝতে পারা যেত তাহলে আমাদের আয়োজক ঘোষমশাইয়ের সঙ্গে সাত বছর আগেই দেখা করে আসতাম।

ওয়াশিংটনে রমেন পাইনের বাড়ির সামনে আমাদের মাইক্রো বাস যখন থামল, তখন ঘড়িতে সন্ধে সাড়ে ছ’টা কিন্তু চারপাশে ঝকঝকে আলো। রমেনদার মেয়ে জয়ন্তী যে কিনা আমাদের সিরিয়ালের নায়িকা, কথা দিয়েছিল, থাকার ব্যবস্থা সে করে দেবে। রমেনদার একটি বেডরুমে এত লোক থাকতে পারবে না। শকুন্তলা, লাবণী ছাড়া দীপঙ্কর এবং মনোজদা, আমি আর দুলাল থেকে গেলাম রমেনদার বাড়িতে, জুলিবউদির তদারকিতে। বাকিদের নিয়ে জয়ন্তী চলে গেল। তখন জানতে পারলাম, ওইটুকু মেয়ে একটা বাড়ি কিনেছে কিছুদিন আগে। সেখানে বাকিরা আরামে থাকতে পারবে। ওদের রাতের খাবার জুলিবউদি করে দেবেন, সকাল—দুপুর ম্যাকডোনাল্ড থেকে যেমন খাই, তেমন খেয়ে নেব। কৃতজ্ঞতার সীমা—পরিসীমা নেই। রমেনদা— জুলিবউদি এবং জয়ন্তী না থাকলে আমাদের পক্ষে শুটিং করা সম্ভব হত না।

রমেনদাদের বাড়িটি ছবির চেয়েও সুন্দর। বাড়ির সামনে নির্জন রাস্তাটি বাঁক নিয়ে নীচে নেমে গিয়েছে। এই জায়গাটির নাম ভার্জিনিয়া। ভার্জিনিয়া থেকে বেরিয়ে পটম্যাক নদীর ব্রিজ দিয়ে ওয়াশিংটনে পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না। সারাদিন আমরা ওয়াশিংটন শহরে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনমতো শুটিং করতাম। আমেরিকা রাষ্ট্রপতির বাসভবনের পাশের মাঠে অনুমতিপত্র দেখিয়ে শুটিং করেছি। সেখানে একটি কালো ছেলে, যার বয়স বড়জোর একুশ, এসে বলল, ‘তোমাদের ছবিতে আমাকে অভিনয় করার সুযোগ দাও। দেখবে, তোমাদের একদিন পৃথিবীর সবাই কুর্নিশ করবে।’

ছেলেটি কথা বলছিল আর শরীর দোলাচ্ছিল, রোগা ছেলেটির দাঁতের তলায় চিউইংগাম। যিশু জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কে হে?’

‘আমি কে?’ ছেলেটা যেন হেসে গড়িয়ে পড়ল—’ঈশ্বর তোমাকে চোখ দিয়েছেন কিন্তু দেখার শক্তি দেননি। ভবিষ্যতে আমি হলিউডের সিডনি হতে পারি, মাইকেল জ্যাকসন হওয়াও অসম্ভব নয়। অন্তত ওই বাড়িটায় পাঁচ কী দশ বছর আরামে থাকতে পারি। তখন তোমাদের ছবির দাম কীরকম বেড়ে যাবে ভেবে দ্যাখো। অতএব, আমাকে একটা চরিত্র দাও ও বিখ্যাত হও।’

রমাপ্রসাদ তাকে বোঝাতে চাইল, এটা ছবি নয়, টিভি ধারাবাহিক। অনেক কষ্টে ছেলেটার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, অনেকেই অভিনয়ের সুযোগ চাইতে এসেছে কিন্তু এইরকম প্রস্তাব আজ পর্যন্ত কারওর মুখে শুনিনি।

আমাদের সিরিয়ালের নাম ছিল ‘নির্বাসিত’। মনোজ লিখেছিল ‘এই দ্বীপ এই নির্বাসন’। সেখানে আমেরিকায় গিয়ে শিকড় গেড়েছিলেন এক বাঙালি দম্পতি, যাঁদের একমাত্র মেয়ে ওদেশীয় আবহাওয়ায় বড় হয়ে উঠলেও মেয়েটির বাবা দেশের ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তিনি চাইতেন, মেয়ে যতই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, যেন মনেপ্রাণে বাঙালি হয়ে থাকে। এই ব্যাপারে মেয়েটির মা ছিলেন একেবারেই চুপচাপ। স্বামীর সঙ্গে তিনি একমত না হলেও বিরোধিতা করতেন না। সারাজীবন স্বামীর ছায়া হয়ে সংসার সামলে সেই সাহস অর্জন করেননি। ফলে যে—কষ্ট পেতেন তা চুপচাপ সহ্য করতেন।

সেই মেয়ে একটি কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের প্রেমে পড়ল। খবরটা কানে আসতেই বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। বাবা ও মেয়ের মধ্যে যে—উত্তেজিত কথাবার্তা, তাতে মেয়ে যতটা যুক্তি দেখাচ্ছিল বাবা তার বিন্দুমাত্র নয়।

এই কালো ছেলেটির সন্ধান আগেরবার যখন নিউইয়র্কে এসেছিলাম, তখনই করেছিলাম। ছেলেটির অভিনয়টা জানতে হবে। নিউ ইয়র্কে ব্রডওয়ে থিয়েটার মানে থিয়েটারের ফাইভ স্টার ব্যাপার। তার নীচের শ্রেণিতে আছে অফ—ব্রডওয়ে থিয়েটার, অফ—অফ—ব্রডওয়ে থিয়েটার। প্রচুর ছেলেমেয়ে সেসব নাটকে নিয়মিত অভিনয় করে। একজন খোঁজখবর নিয়ে জানালেন, একেবারে সাধারণ নাটকের দলে অভিনয় করে এমন ছেলে ভারতীয় সিরিয়ালে অভিনয় করার জন্যে দিনে অন্তত এক হাজার ডলার চাইছে। এই পারিশ্রমিক দেওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আবার ওই চরিত্রে কালো অভিনেতাকে না নিলে সমস্যাগুলো বিশ্বাসযোগ্য করা যাবে না।

আমরা যখন ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসছি, তখন সুদীপ্তর ফোন এল রমেনদার বাড়িতে। এই সুদীপ্ত অদ্ভুত লড়াকু মানুষ। যখন কলকাতায় ছিল, তখন ‘চেনামুখ’—এ অভিনয় করত। রমাপ্রসাদ বণিক তখন চেনামুখের পরিচালক। ওর কাছে অভিনয় শিখে পরবর্তীকালে খ্যাতি পেয়েছে খরাজ মুখার্জি, শান্তিলাল মুখার্জি, চন্দন সেনরা। সুদীপ্তও কিছুদিন রমাপ্রসাদের সঙ্গে ছিল। তারপর আমেরিকায় চলে যায় নাটক বিষয়ে পড়াশুনা করতে। পরে এই নিয়ে সে—দেশে শিক্ষকতাও করেছে। রমাপ্রসাদ আমেরিকায় ধারাবাহিকের শুটিং করতে এসেছে বলে যখন খবর পেয়েছিল, তখনই যোগাযোগ করেছিল। রমাপ্রসাদ তাকে কালো যুবক অভিনেতার কথা বলেছিল। ফোনে সুদীপ্ত জানাল, তাদের সঙ্গে অভিনয় নিয়ে পড়ছে এমন একটি ছেলের সঙ্গে, তার কথা হয়েছে যে কাজটা করতে রাজি হয়েছে। টাকাপয়সা নিয়ে সমস্যা হবে না।

নিউ জার্সির মোটেলে ছেলেটিকে নিয়ে সুদীপ্ত এল। ছিপছিপে লম্বা ছেলে। কালো হলেও মুখের গড়ন ভারতীয়দের পছন্দ হবে। রমাপ্রসাদের মুখে চরিত্রটা শুনে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘গুড, গুড!’

রমাপ্রসাদ ওকে দিয়ে কয়েকটা সংলাপ বলালেন। শোনার পর বলল, ‘আমরা তোমাকে কীরকম পারিশ্রমিক দিলে তুমি কাজটা করবে?’

ছেলেটি একটু ভেবে বলল, ‘আমি হার্লেমে থাকি। ওখান থেকে আমাকে পোর্ট অথরিটিতে এসে বাস ধরতে হবে এখানে আসার জন্যে। তোমরা আমাকে আসা—যাওয়ার বাস ভাড়াটা দিয়ে দিও।’

আমরা অবাক। বলে কী ছেলেটা?

পাঁচদিন শুটিং করেছিল ছেলেটা। ইউনিটে সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। যিশু ওর ভালো বন্ধু হয়ে গেল, যদিও যিশু বয়সে বেশ বড়। যিশু ওকে অনুরোধ করেছিল হার্লেমে নিয়ে যেতে। আমি আপত্তি করেছিলাম। নিউ ইয়র্কের একপাশে কালোমানুষরা যে—এলাকায় নিজেদের মতো থাকে, সেখানে সাদা পুলিশরা সবসময় ঢুকতে সাহস পায় না। গোলমাল সেখানে লেগেই থাকে। ঝুঁকি নেওয়ার কোনো মানে নেই।

ওই ধারাবাহিকে দীপঙ্কর দে বাবার ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেছিল। মনোজদাও মামুর চরিত্রে অসাধারণ। শকুন্তলা বড়ুয়া রমাপ্রসাদকে খুশি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এঁরা তো পেশাদার অভিনেতা। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল জয়ন্তী পাইন। ভার্জিনিয়াতে সে নাচের স্কুল করবে প্ল্যান করেছিল। ভরতনাট্যম শেখাবে। রমেন পাইনের মেয়ে জয়ন্তীর অভিনয় দেখে রমাপ্রসাদ বলেছিল, ‘এই সিরিয়াল টেলিকাস্ট হওয়ার পর তোমাকে আমেরিকা ছাড়তে হবে।’

জয়ন্তী চমকে গিয়েছিল—’সে কী! কেন?’

‘হিন্দি আর বাংলা ছবির প্রযোজকরা তোমাকে নায়িকা করে ছবি বানাতে চাইবে। আমি যেটুকু বুঝি তাতে বলছি, তোমার অভিনয় হিট করবেই।’

আমি জানি না, জয়ন্তী স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল কি না!

তারপর এল সেই ভয়ংকর দিন।

শুটিংয়ের শেষদিন দুপুরে কলকাতা থেকে সিদ্ধার্থর বাড়িতে ফোনটা এল। এই শুটিং বন্ধ করার জন্যে কলকাতার আদালতে আবেদন করা হয়েছে এবং আদালত ইনজাংশন জারি করেছে যাতে শুটিং আর না করা হয়। মাথা ঘুরে গেল। যে ফোন করেছিল সে এর বেশি কিছু বলতে পারল না। কলকাতা—নিউ ইয়র্কের সময়ের পার্থক্য প্রায় সাড়ে নয় ঘণ্টা। তখন আমরা নিউ জার্সিতে সিদ্ধার্থর বাড়ির সামনে শুট করছিলাম। তৎক্ষণাৎ ওর বাড়িতে গিয়ে অরিজিৎকে ফোন করলাম।

অরিজিৎ বলল, ‘হ্যাঁ, খবরটা সত্যি।’

‘সে কী! তুমি জানাওনি কেন?’

‘জানাতাম। শুটিং তো আজই শেষ হওয়ার কথা।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপারটা কী?’

‘মনোজ ভৌমিকের স্ত্রী আদালতে আবেদন করেছেন, আমরা তাঁর পরলোকগত স্বামী অথবা তাঁর অনুমতি না নিয়ে আমেরিকায় যে—ধারাবাহিকের শুটিং করতে গিয়েছি, তার কাহিনি মনোজ ভৌমিকের লেখা। তিনি মনোজ ভৌমিকের একমাত্র স্বত্বাধিকারী। তাঁর অনুমতি না নেওয়া মানে তাঁকে প্রতারণা করা। এই কারণে ধারাবাহিকের শুটিং যাতে আদালত বন্ধ করে দেয় তার জন্যে আবেদন করেছেন।’ অরিজিৎ জানাল।

‘কিন্তু—’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে অরিজিৎ বলল, ‘টেলিফোনে এ নিয়ে আলোচনা করে কোন লাভ নেই। তোমরা ভালোভাবে ফিরে এসো, তারপর ভাবা যাবে।’

রিসিভার রেখে দেখলাম, ইউনিটের সবাই আমার পেছনে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যিশু জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে সমরেশদা?’

বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। একটু ভুল বোঝাবুঝি, সব ঠিক হয়ে যাবে?

রমাপ্রসাদ চেঁচিয়ে বলল, ‘প্যাক—আপ। শুটিং শেষ।’

সিদ্ধার্থর স্ত্রী বনানী এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘জলটা খেয়ে নিন। আপনি একটু বসুন সমরেশ।’

বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় বলে শুনেছিলাম, সেদিন প্রত্যক্ষ করলাম। এই এত পরিশ্রম, এতগুলো মানুষকে দেশ থেকে নিয়ে এসে এতদিন ধরে যে—শুটিং করা হল, তা বিফলে যাবে?

‘টেলিফ্রেম’ শুরু করেছিলাম ‘মুক্তবন্ধ’ নামে একটি বাংলা ধারাবাহিক দিয়ে। তারপর অনেকগুলো সিরিয়াল করেছি, কাউকে ঠকাইনি, যা জমিয়েছিলাম তার পুরোটা খরচ করে আমেরিকায় এসেছিলাম হিন্দি ধারাবাহিক ‘নির্বাসিত’ করতে। দিল্লির মান্ডি হাউসের কর্তারা আগ্রহী ছিলেন। ভেবেছিলাম, টেলিকাস্ট হলে পুরো টাকা দিয়ে একটা টিভি সিরিয়ালের শুটিং করার মতো বাড়ি কিনব। নাম দেব ‘টেলিফ্রেম’। কিন্তু এটা কী হল?

আজ এত বছর পরে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছি না। সেই মানসিকতাও নেই। যে—দুঃখ এবং কিছুটা ক্রোধ তৈরি হয়েছিল, তা এই পঁচিশ—ছাব্বিশ বছরে ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু মনোজের লেখা চিঠিগুলোর দিকে যখনই তাকাই, তখনই ভাবি মনোজ যদি ভবিষ্যৎ দেখতে পেত তাহলে খুব কষ্ট পেত।

”সমরেশ, ‘এই দ্বীপ এই নির্বাসন’ আন্তরিক পত্রিকার পাতায় পড়ে থাকত যদি না আপনি উদ্যোগী হয়ে আনন্দ পাবলিশার্সকে বই করতে অনুরোধ না করতেন। আমার মনে এই গল্প নিয়ে ছবি করার ইচ্ছে ছিল। আপনি এসে ইচ্ছেটা উসকে দিলেন। কলকাতায় গিয়ে আপনার সঙ্গে চিত্রনাট্য নিয়ে অনেক কথা বলতে গিয়ে দেখেছি আপনি গল্পে ঢুকে গেছেন।”

আর একটি চিঠিতে, ”অভিনেতাদের ভিসা করে ফেলুন। কাগজ পাঠাচ্ছি। জয়ন্তী ফাইন্যাল। আচ্ছা, আমি যদি কোনো কারণে ছবিটা না করতে পারি তাহলে আপনি কি করতে পারবেন? আমি জানি ছবিটা ঠিকঠাক হবে।”

এর কয়েকদিন পরে দুর্ঘটনায় মনোজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

আর আমার মাথায় ভাবনাকে সে চাপিয়ে দিয়ে গেল। তখন ওর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, তারও আগ্রহ ছিল।

দীর্ঘ কয়েক বছর পরেও আদালতে যখন ফয়সালা হল না, তখন অর্থদণ্ড দিয়ে ওর স্ত্রীর কাছ থেকে ছাড়পত্র পেলাম। ইনজাংশন উঠল। কিন্তু শুটিংয়ের ক্যাসেট চালিয়ে দেখা গেল এই কয়েকবছর ক্ষত সর্বাঙ্গে বসে গেছে। ওদের আর ব্যবহার করা যাবে না। তাছাড়া লো ব্যান্ডে শুট করা ক্যাসেট তখন একেবারেই অচল।

হজম করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

আজ পেছন ফিরে তাকালে বুক ভারী হয়। রমাপ্রসাদ বণিক চলে গিয়েছে পৃথিবী থেকে। যিশু দাশগুপ্ত নেই, নেই মদনসূদনজিও। এই তিনজনই ছিল ‘নির্বাসিত’র তিন স্তম্ভ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *