আলোকলতার মূল
বিদেশ থেকে যেমন অনেকে নটরাজ মূর্তি, সস্তার কার্পেট, এথনিক গয়না ইত্যাদি সংগ্রহ করে আনে, পল কক্স সেইরকম সংগ্রহ করলেন একটি জীবন্ত মানুষরত্ন। বয়স বেশি নয়। একুশ-বাইশ হবে, তার মুখে এখনও লেগে আছে কৈশোরের আভা, খুব পাতলা চেহারা, থুতনিতে কচি ঘাসের মতন দাড়ি, মাথার চুল নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত, চোখ দুটি হিরের কুচির মতন।
হংকং থেকে দেশে ফেরার পথে পল কক্স কয়েকদিনের জন্য থেমেছেন কলকাতায়। তাঁর সফরসূচির মধ্যে কলকাতা ছিল না, এখানে তাঁর কোনো কাজ নেই কিন্তু কলকাতায় আমেরিকান কনস্যুলেটের ফার্স্ট সেক্রেটারি ডেরেক রবিনসন তাঁর সাক্ষাৎ ভায়রাভাই, একদা দু-জন টেনিস খেলতেন একসঙ্গে। সেই ডেরেকের আমন্ত্রণে তিনি এখানে এসেছেন। টেনিস খেলা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকদিন, তবু একটু হাত ঘামিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
জেনারেল মোটর্স-এর প্রতিনিধি হয়ে পল কক্সকে অনেক দেশে ঘুরতে হয়। ভারতে এসেছেন তিনবার, কিন্তু কলকাতায় আসার কোনো উপলক্ষ্য ঘটেনি। তিনি যে মহলে ঘোরাফেরা করেন, সেখানে কলকাতা শহরের নামটা কেউ উচ্চারণ করে না। ব্যবসার স্বার্থে তো নয়ই, নিছক ভ্রমণের জন্যও কলকাতার কোনো আকর্ষণ নেই। খেলাধুলো ছাড়াও পল কক্সের ভ্রমণ ও গানবাজনার নেশা আছে।
ডেরেক রবিনসনের স্ত্রী ন্যান্সি পল কক্সের স্ত্রী ডরোনির ছোটো বোন। ছোট শালিকার সঙ্গে মধুর সম্পর্ক থাকে, ফস্টিনষ্টি করে অনেক সময় কাটানো যায়। কলকাতা শহরটা যদিও ধুলো, আবর্জনা, ট্রাফিক জ্যাম, সরু রাস্তা, মানুষ টানা রিকশা এবং চিটচিটে গরমের জন্য কুখ্যাত, কিন্তু এই সব উচ্চপদস্থ সাহেবদের সেসব কিছুই ভোগ করতে হয় না। তারা নিজেদের আরামের সব রকম ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তাদের বাড়ি চবিবশ ঘন্টা বাতানুকূল। গাড়ির ভেতরটা ঠান্ডা, ছাই রঙের কাচ থাকে বলে বাইরের কুদৃশ্য দেখা যায় না। অফিসেও ঠান্ডা, গরমের আঁচ একটুও তাদের গায়ে লাগে না। ছোটো একটা গণ্ডির মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু নিজেদের ধরনের মানুষের মেলামেশা। এত বড়ো শহরের বাকি অবস্থা সম্পর্কে তারা প্রায় কিছুই জানে না। বাড়ির বাইরে কখনো-কখনো তারা আড্ডা দিতে যায় টলি ক্লাবে, সেখানকার গাছপালা ঘেরা অনেকখানি সবুজ প্রান্তর দেখে নিউ ইংল্যান্ডের কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায়।
ন্যান্সির সঙ্গে ফুক্কুড়ি করে, টলি ক্লাবে দু-একবার গলফ খেলে এবং একবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে এসে কলকাতা সম্পর্কে পল কক্সের খুব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা হয়ে গেল। নিউমার্কেট ও কটেজ ইন্ডাস্ট্রিতে কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রায় কিছুই পছন্দ হল না তাঁর। ভারতীয় সংগীত শোনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রবিশঙ্কর ও আলি আকবর দুজনেই এখন আমেরিকায়। পল কক্স সেখানে তাঁদের বাজনা শুনেছেন একাধিকবার, কলকাতায় এখন বিশেষ কিছু হচ্ছে না।
হাতে আরও দু-তিন দিন সময় আছে। কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে গেলে হয় না? প্রথমেই মনে আসে দার্জিলিংয়ের কথা। ডেরেক আর ন্যান্সি মাত্র এক মাস আগেই দার্জিলিং থেকে ঘুরে এসেছে, এক্ষুনি আবার ভায়রাভাইকে নিয়ে সেখানে যেতে ইচ্ছে করে না, ডেরেকের ছুটিও নেই। আর তো কোথাও বেড়াতে যাবার নেই এই পশ্চিমবঙ্গে। এতখানি সমুদ্র তটরেখা রয়েছে, কিন্তু সমুদ্রতীরে নেই কোনো সুন্দর শহর। সমুদ্র উপভোগ করার জন্য একমাত্র যাওয়া যেতে পারে পুরীতে। তাও বেশ দূরে, সেখানে এত ভিড় হয় যে, ন্যান্সিরা একদিন থেকেই পালিয়ে এসেছিল।
আর একটা জায়গার নাম শোনা যায় বটে—শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সেখানে অবশ্য ন্যান্সি আর ডেরেক এ পর্যন্ত যায়নি, শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দেখার যোগ্য হবে কিনা জানে না।
পল জিজ্ঞেস করলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে?
ডেরেক বলল, একজন কবি। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপে তার খানিকটা নাম হয়েছিল। এখন সবাই ভুলে গেছে। আমেরিকায় অধ্যাপকরাও তার নাম জানে না। পৃথিবীতে এত কবি, ক-জনের নাম আর মনে রাখা যায়! এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে, ভাষা খুবই পুরোনা ও অপ্রচলিত, কেই বা কষ্ট করে পড়বে? ও হ্যাঁ, তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তা নিয়ে বাঙালিরা এখনও গর্ব করে।
পল কক্স অস্ফুট সুরে বললেন, টেগোর! টেগোর!
পল কক্স বাণিজ্য-বিশেষজ্ঞ হলেও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। সমাজে মেলামেশা করতে হলে সবরকম বিষয় জানতে হয়। ইমপ্রেশানিস্ট শিল্পীদের ছবি সম্পর্কে ভালো জানেন, পিকাসোর সঙ্গে সালভাদোর দালির তুলনা করতে পারেন, গানবাজনা বোঝেন, সাহিত্য সম্পর্কেও মোটামুটি ধারণা আছে, কথাবার্তার মধ্যে কেউ যদি বলে, ‘অ্যান্ড দা রেস্ট ইজ সাইলেন্স’ অথবা ‘মাইলস টু গো’, তাহলে ধরতে পারেন যে, এগুলো যথাক্রমে শেকসপিয়র ও রবার্ট ফ্রস্টের উদ্ধৃতি।
পল কক্স রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো লেখা পড়েননি, তাঁর পরিচিত সমাজে কেউ এ নাম উল্লেখ করে না। কিন্তু নামটা তাঁর স্মৃতিতে ধবনিত হল। তাঁর যখন দশ-এগারো বছর বয়েস, সেই সময় তাঁর বাবা প্রায়ই বলতেন এই কবির নাম, বাবার মুখে শুনে শুনে কয়েকটা লাইন পলের মুখস্থও হয়ে গিয়েছিল।
বাবা কখনও ভারতবর্ষে আসেননি, খুব আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শেষ বয়েসে বাবার কোমরে খুব ব্যথা হওয়ায় আর বিদেশ ভ্রমণের ঝুঁকি নিতে পারেননি।
অনেকটা যেন বাবার অতৃপ্ত বাসনা পূরণের জন্যই পল কক্স বললেন, তাহলে একবার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটাই দেখে আসা যাক।
বাতানুকূল গাড়িতে ভোরবেলা বেরিয়ে সন্ধের মধ্যে ফিরে আসা যায়। কিন্তু ডেরেক অফিসে খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, রাস্তা খুবই খারাপ, এই বর্ষায় একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। বড়ো বড়ো গর্ত, বিদেশি শৌখিন গাড়ির অ্যাক্সেল পর্যন্ত ভেঙে পড়তে পারে। যদি বা না ভাঙে, সামান্য একশো চল্লিশ কিলোমিটার পথ পেরুতেই লেগে যাবে ছ-সাত ঘন্টা, একদিনের মধ্যে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই।
পল কক্স বললেন, তিনি ট্রেনেই যাবেন। ওখানে হোটেল বা টুরিস্ট লজে রাত কাটানো যাবে নিশ্চয়ই!
ডেরেক দুটো দিন ছুটি নিতে পারবে না, ন্যান্সিকে অনুরোধ করল তার জামাইবাবুকে সঙ্গ দেবার জন্য। এদেশের ট্রেনযাত্রাতে ন্যান্সির বড়ো ভয়। কখন কোথায় যে থেমে যাবে, অপেক্ষা করতে হবে ঘন্টার পর ঘন্টা, তার ঠিক নেই। একবার ভুবনেশ্বর যেতে এই কাণ্ড হয়েছিল। সে নানা অজুহাত দেখাতে লাগল।
ডেরেক তখন তার অফিসের সুখেন্দু নামে এক নির্ভরযোগ্য ছোকরা কর্মচারীকে সঙ্গে দিয়ে দিল। বাংলা বুঝিয়ে দেবার জন্য এরকম একজনকে দরকারও বটে। সুখেন্দু সানন্দে রাজি, এর আগে আরও অনেক সাহেবকে নিয়ে সে ঘুরেছে, সাহেব তার কাছে জলভাত।
শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে একটি বাতানুকূল লাউঞ্জকার নামে বগি থাকে। এক-একদিন বিনা নোটিসেই সেটা খুলে রাখা হয়। সেটার ভাড়া খুব বেশি, তবু সাহেব-মেমদের তা গায়ে লাগার কথা নয়। সে কামরাটা ঠান্ডা তো বটেই, তা ছাড়া সুবিধে এই যে সেখানে ভিখিরি বা ফেরিওয়ালারা উঠে বিরক্ত করে না। আজ সেই বগিটা নেই।
তাহলে যেতে হবে সাধারণ ফার্স্ট ক্লাসে। সেটা ঠান্ডা তো নয়ই, বরং বেশ ভিড়। যাত্রীরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে, তাদের মধ্যে রেলের কর্মচারীই বেশি।
সুখেন্দু পল কক্সকে জিজ্ঞেস করলে, মিঃ কক্স আপনি সাধারণ সেকেন্ড ক্লাসে যাবেন? জানলার ধারে জায়গা পাওয়া যাবে। আজ মেঘলা আকাশ, গরম বেশি নেই। জানলার ধারে বসে বেশ দেখতে দেখতে যেতে পারব।
সুখেন্দুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে পল কক্সের পছন্দ হয়েছে। তিনি বললেন, তুমি যা ভালো বুঝবে—
যদি বাতানুকূল বগিটা সেদিন থাকত, পল কক্স বসতেন সেখানে, তাহলে এর পরবর্তী ঘটনাগুলো কিছুই ঘটত না।
গরম সত্যিই নেই, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। হাওড়ার ঘিঞ্জি অঞ্চল ছাড়বার পর দু-দিকে চোখ জুড়নো সবুজ প্রান্তর। পল কক্সের দেশে মানুষ বিশেষ দেখা যায় না। এমনকি ধান বা গমের খেতেও একটা-দুটো ট্র্যাক্টর ফট ফট করে, চাষি বলতে সেরকম কারোকে চোখে পড়ে না। কাস্তে হাতে কোনো চাষি ফসল কাটতে যায় না। বীজ বোনা থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত সবই যন্ত্রে সেরে ফেলা হয়।
আর এখানে মানুষ, শুধু মানুষ, ছোট্ট একটা ডোবায় জাল ফেলছে মানুষ, উদোম শিশুরা দাপাদাপি করছে কাদার মধ্যে। একদঙ্গল লোক এমনিই বসে আছে গাছতলায়, জীর্ণ চেহারার নারীরা কলমি শাক তুলছে। এই মানুষগুলোর স্বাস্থ্য ভালো নয়, মুখও সুশ্রী নয়, মলিন পোশাক, তবু সব মিলিয়ে এমন একটা শান্ত মন্থরতা আছে যা এই বিদেশিটির কাছে অভিনব মনে হয়। যেন এরা রয়ে গেছে বাইবেলের যুগে।
কামরার মধ্যে ফিরিওয়ালা যাচ্ছে অনবরত, তাদের কথা বোঝার সাধ্য নেই পলের, কে কী বিক্রি করছে তাও বুঝতে পারলেন না। সুখেন্দুর অনুরোধে এক ভাঁড় চা খেলেন। এত চিনি দেওয়া চা যে তাঁর প্রায় বমি এসে যাচ্ছিল। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ রোগা, তাই বোধহয় তাদের বেশি চিনি দরকার। চা-টা পছন্দ না হলেও তিনি ভাঁড়টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। বেশ সুন্দর গড়নটি চা খাবার পর লোকে এটা ফেলে দেয়। মাটি দিয়ে তৈরি, পরিবেশ দূষণের প্রশ্ন নেই। এত সুন্দর জিনিসটা এরা ফেলে দেয় কেন, ঘরে বেশ সাজিয়ে রাখা যায়। এঁটো খুরিটা পকেটে নিয়ে নিলেন পল।
হঠাৎ তিনি একটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলেন।
গেরুয়া কাপড় পরা একটি লিকলিকে চেহারার ছেলে, মাথায় লম্বা চুলে গিঁট বাঁধা, ঝকঝক করছে চোখ দুটি। সে গান ধরেছে .
গোলেমালে গোলেমালে পিরিত করো না
পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়বে না…
ভাষা বোঝার প্রশ্ন নেই, পল মহাবিস্ময়ে লক্ষ করতে লাগলেন ছেলেটার কণ্ঠস্বরের তেজ তার এক হাতে গুপি যন্ত্র, পায়ে বাঁধা ঘুঙুর। একই সঙ্গে পায়ে নাচের তাল দিচ্ছে। হাতে যন্ত্রটা বাজাচ্ছে আর ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে তুলেছে তার গলা, একসঙ্গে তিনটে কাজ করছে।
গান সম্পর্কে পলের বিশেষ উৎসাহ আছে। পাশ্চাত্য সংগীত ছাড়াও সে জাপানি, আরবি, আফ্রিকান গানবাজনার রেকর্ড সংগ্রহ করে। আলি আকবর, রবিশঙ্কর তাঁর কানে অপরিচিত নয়, কিন্তু কণ্ঠসংগীতে এরকম সোপ্রানো ক্বচিৎ শুনেছেন। এ যে অপেরা গায়কদেরও হার মানিয়ে দিতে পারে।
তিনি সুখেন্দুকে নিম্লস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, চলন্ত ট্রেনের কামরায় ওই ছেলেটি অত চেঁচিয়ে গান গাইছে কেন? অন্য যাত্রীরা আপত্তি করে না?
সুখেন্দু বলল, না। আপত্তি করবে কেন? ও বেচারারা গান গেয়ে ভিক্ষে করে।
পরের মুহূর্তেই নিজেকে সংশোধন করে নিয়ে সে আবার বলল, তা বলে ওদের সাধারণ ভিখিরি মনে করবেন না। ওরা হচ্ছে বাউল। ওদের একটা জীবনদর্শন আছে। ওরা কোনো জীবিকা অর্জনে বিশ্বাস করে না। এই বীরভূমে অনেক বাউল আছে।
পল বললেন, ব্যাউ-উ-ল?
সুখেন্দু বলল, আমেরিকাতেও তো একসময় বাউলরা খুব নাম করেছিল। আপনি নিশ্চয়ই বিখ্যাত গায়ক বব ডিলানের নাম শুনেছেন? সেই বব ডিলান একবার আমেরিকায় উডস্টক নামে একটা জায়গায় সমস্তরকম গাইয়ে-বাজিয়েদের জড়ো করেছিলেন। বিরাট একটা উৎসব হয়েছিল। আপনাদের কবি অ্যালেন গিনসবার্গের কাছে নাম শুনে বব ডিলান এদেশ থেকে আমাদের পূর্ণদাস বাউলকে স্পেশাল প্লেনে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, পূর্ণদাস সেই উডস্টকে গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছিল।
পল অস্ফুট স্বরে আবার বললেন, ব্যা-উ-উ-ল। আমার ধারণা ছিল সে আফ্রিকান।
সুখেন্দু বলল, না, না আফ্রিকান কেন হবে, ইন্ডিয়ান। শুধু ইন্ডিয়ান নয়, আমাদের এই বেঙ্গলেই শুধু বাউলদের দেখা পাবেন। ওরা বংশানুক্রমে বাউল ঐতিহ্য মেনে চলে।
উডস্টক উৎসব হয়েছিল কুড়ি বছর আগে। আমেরিকায় সে উৎসবের কথা কে না জানে।
পল কক্স তখন ছিলেন একত্রিশ বছরের যুবক, তিনি নিজেই গিয়েছিলেন সেই উৎসবে। তিন দিন তিন রাত খোলা মাঠে কাটিয়েছেন। গানবাজনা নিয়ে সে ছিল এক দুরন্ত পাগলামির সময়।
তখন একজন বাউলের গান শুনেছিলেন বটে, ক্ষীণভাবে মনে আছে। সুখেন্দু নিজের জ্ঞানের পরিচয় দেবার জন্য আরও অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে পল বললেন, এ ছেলেটিকে কাছে ডেকে কথা বলা যায়?
সুখেন্দু নিজে বাউল ভক্ত, সে উৎসাহিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিল। ছেলেটি কাছে আসবার পর তার হাতে দশটা টাকা গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
তরুণ বাউলটির নাম গৌরহরি দাস। সে কিন্তু সাহেব দেখে গদগদ হল না। এই লাইনের ট্রেনে অনেক সাহেব-সুবো যায়। কেউ কেউ গান শুনে পয়সাও দেয়।
পলের নির্দেশে সুখেন্দু জিজ্ঞেস করল, তুমি কবে থেকে গান গাইছ, গৌরহরি?
গৌর মুচকি হেসে বলল, মায়ের পেটে থাকবার সময়েই!
তোমার বাড়িতে কে কে আছে?
জগৎ-সংসার ভরা মানুষ, সব আমার বাড়িতে।
এই গুপি যন্ত্র বাজাতে শিখলে কার কাছে?
এটা তো আমি বাজাই না, নিজে নিজেই বাজে। সাহেবকে বলুন, গানও আমি গাই নাই। ভগবান আমাকে দিয়ে গাওয়াচ্ছেন।
খানিকক্ষণ এই ধরনের কথাবার্তা বলার পরই পলের মাথায় বিদ্যুতের মতন একটা চিন্তা এল। এই উনিশশো চুরানববইতে আবার উডস্টক উৎসব হচ্ছে। সেখানে এই বাউলটিকে নিয়ে যাওয়া যায় না?
গৌরহরি। এই সাহেব তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চান। তুমি যাবে?
এ প্রস্তাব শুনে গৌরহরি দারুণ কিছু বিস্মিত, পুলকিত কিংবা ভীত হল না। কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না তার মুখে। সে জানে, কত বাউল ঘুরে এসেছে বিলেত—আমেরিকা। তার পাশের বাড়ির পবন প্যারিসে যায় ঘন ঘন। এর আর নতুন কথা কী?
সে জানলা দিয়ে পিচ করে থুতু ফেলে এসে বলল, যেতে পারি!
ব্যবস্থা করতে দেরি হল না। পল কক্স গৌরহরি দাসকে সঙ্গে নিয়ে উড়ে গেলেন আমেরিকা।
আপ-স্টেট নিউইয়র্কের রোজ ভ্যালি নামে একটি ছোট্ট জায়গায় পল কক্সের বাড়ি। স্বামী, স্ত্রী ও একটি কুকুরের সংসার। ওদের দুটি ছেলে মেয়ে, বনি আর স্টিফেন, তারা কোথায় যে কখন থাকে তা বাপ-মাও জানে না। পলের স্ত্রী সুজান ছেলেমেয়ের চেয়েও কুকুরটিকে বেশি ভালোবাসে। সুজান একসময় একটি সুপার মার্কেটে ম্যানেজারের কাজ করত, এখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। চাকরি করার চেয়ে বাগানচর্চা সে বেশি পছন্দ করে। স্থানীয় কলেজের একটি ছাত্র সপ্তাহে দু-দিন তার বাগানের পরিচর্যা করে দিয়ে যায়। আর একটি ছাত্রী সপ্তাহে একদিন বাসন-টাসন, জামা ও ঘরদোর পরিষ্কার করে।
বেশ বড়ো বাড়ি, ওপরে পাঁচখানা ঘর, বেসমেন্টটাও অতি প্রশস্ত। গৌরহরিকে থাকতে দেওয়া হল বেসমেন্টে। সেখানে আলাদা টয়লেট ও স্নানের জায়গা আছে।
পলও লক্ষ করেছেন, গৌরহরি কোনো কিছুই চায় না, কোনো কিছু দেখেই বিস্মিত হয় না। এইটুকু ছেলে এত উদাসীন হয় কী করে?
মাসখানেকের মধ্যে গৌরহরি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি রপ্ত করে ফেলেছে। অনেক সময় কেউ বুঝুক বা না বুঝুক সোজাসুজি বাংলায় কথা বলে যায়।
হঠাৎ এরই মধ্যে একটি মেয়ে এসে মহা উপদ্রব শুরু করে দিল। পল আর সুজানের মেয়ে বনি এক স্প্যানিশ গিটারবাদকের সঙ্গে জোড় বেঁধেছিল কিছুদিন বোস্টনে। মাসখানেক আগে ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখন সে মনের জ্বালা জুড়োতে এক দঙ্গল বন্ধুর সঙ্গে মিলে মাদক সেবন করে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্রীও বটে। মাঝে মাঝে সে বাবা-মায়ের কাছে আসে কিছু টাকা-পয়সা নিতে। সবদিক থেকে স্বাধীন হলেও বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নেবার ব্যাপারে লজ্জা থাকলে চলে না।
গৌরহরিকে দেখে সে দারুণ আকৃষ্ট হল। ভারতীয় সে অনেক দেখেছে। কিছু ভারতীয় হয় অত্যন্ত ফর্মাল ও ভদ্র, কিছু ভারতীয় আবার বেশ হ্যাংলা। কিন্তু এ যে একটি টাটকা, গেঁয়ো ছেলে। শরীরে যেন বুনো ঝোপের গন্ধ। চুল আঁচড়াতে জানে না। দাড়ি কামাতে শুরু করেনি। সকলের সামনে উরু চুলকোয়, বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে, এরকম একটা প্রকৃত অমার্জিত মানুষ এদেশে পাওয়া যাবে কোথায়!
একবেলার জন্য এসেছিল বনি, থেকে গেল তিনদিন। বেসমেন্ট থেকে সে আর নড়ে না। অনবরত গান শোনে। গৌরহরির কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে খায়। তার নিজের গাঁজা ভরা সিগারেট ওকে দেয়। ছেলেটা একই সঙ্গে নাচে, বাজনা বাজায় ও গান গায়, কিছুতেই তার ক্লান্তি নেই।
দুপুর গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে মাঝরাত, পল আর সুজান ঘুমিয়ে পড়ে, তখনও বনির গান শোনার বিরাম নেই। বনি পা ছড়িয়ে বসে থাকে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে গৌরহরি গান করে যায়। ছোট্ট একটা প্যান্ট পরা বনির রক্তচন্দনের মতো উরু প্রায় খোলা। বুকে ব্রা-হীন জামা, সে সুন্দরের প্রতিমূর্তি। কিন্তু গৌরহরি বনিকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে না। তার দিকে লোভের দৃষ্টিও দেয় না।
বনি অবাক হয়। তার অহমিকায় একটু আঘাতও লাগে। এরকম নিরালায় তার কাছাকাছি থাকলে কোনো পুরুষই সংযম রাখতে পারে না। বিশেষ পছন্দ না হলে বনি তার এত কাছাকাছি ও নিরালায় থাকতেও দেয় না কোনো পুরুষকে।
বনি জিজ্ঞেস করল, তুমি ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষে করতে?
গৌরহরি বলল, না তো! লোকে আমার গান শুনে পয়সা দেয়।
বনি বলল, এ দেশে গান গেয়ে তুমি অনেক পয়সা রোজগার করতে পারবে। গৌরহরি বলল, একটা মোটে পেট, তার জন্য কত পয়সা লাগে?
বনি বলল, তুমি আমার সঙ্গে বোস্টনে যাবে? আমার অ্যাপার্টমেন্টে থাকবে। আমার বন্ধুদের শোনাব তোমার গান।
গৌরহরি বলল, আমি এখানেও থাকতে পারি, তোমার ওখানেও থাকতে পারি।
বনি তিনদিন পরে বাবা-মায়ের কাছে আবদার ধরল, সে বাউলটিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
পল আর সুজান দুজনেই বেঁকে বসেছে।
গৌরহরির সঙ্গে বনির এত ঘনিষ্ঠ মেলামেশা সুজানের পছন্দ হয়নি। স্প্যানিশ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকত, সেটাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একটা কালো ছেলেকে নিয়ে আদিখ্যেতা সহ্য করা যায় না। পলের আপত্তি অন্য কারণে। এই ছেলেটি পবিত্র, নিষ্পাপ, নির্লোভ। একে তিনি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবেন না। তাঁর মেয়েকে তিনি জানেন, সে ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খায়। তিনি নিজের দায়িত্বে গৌরহরিকে এদেশে এনেছেন, তাকে তিনি রক্ষা করবেনই।
কিন্তু বনি দারুণ জেদি। বাবা-মায়ের আপত্তির সে তোয়াক্কা করে না। একদিন বিকেলে গৌরহরিকে নিয়ে বেড়াতে যাবার ছুতোয় নিজের গাড়িতে চাপাল, তারপর হুশ করে বেরিয়ে গেল রোজ ভ্যালি ছাড়িয়ে। রাতারাতি সে বোস্টনে পৌঁছে যাবে।
তিন ঘন্টা ড্রাইভ করার পর একটা রেস্ট এরিয়ায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিল বনি। একটানা গাড়ি চালাতে তার ভালো লাগে না। সন্ধে হয়ে এসেছে, এখানে আর একটিও গাড়ি নেই, একেবারে নির্জন। জানলার কাচ নামিয়ে দিয়ে বনি একটা গাঁজাভরা সিগারেট ধরাল।
তারপর মুচকি হেসে বলল, তুমি কি বুঝতে পেরেছ যে আমি তোমাকে নিয়ে পালাচ্ছি?
গৌরহরি বলল, অনেক দূরে চলে যাচ্ছি, বুঝেছি।
তোমার আপত্তি আছে? আমার বাড়িতে থাকবে।
ও বাড়িও যা, তোমার বাড়িও তা।
আ, বাবা আর মা রেগে যা ছটফট করবে! ভারি মজা হবে। তোমার তো বাইশ বছর বয়স, তুমি অ্যাডাল্ট, তোমাকে ওরা জোর করে আটকে রাখতে পারেন না। ওগো বাউল, তুমি কি চুমু খেতে শেখোনি? জানো, চুমু খেতে কেমন লাগে? এরকম মনমাতানো সন্ধ্যায় চুমু খেতে হয়। এসো। আমি তোমায় শিখিয়ে দিচ্ছি।
জামার একটা বোতাম খুলে দিল বনি।
গৌরহরি বনির শেখাবার অপেক্ষা করল না। সে বলল, আমি পুরুষ, তুমি প্রকৃতি। ভগবানের ইচ্ছাতেই পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিলন হয়। তুমি যদি চাও।
সে হাত বাড়িয়ে বনিকে বুকে টেনে নিল।
গৌরহরি আবার ফিরে এসেছে দেশে। উডস্টক উৎসবে তার স্থান হয়নি শেষ পর্যন্ত। পল কক্স দারুণ ত্রুদ্ধ হয়ে, তার ভিসা ক্যানসেল করিয়ে, ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন।
গৌরহরি আবার ট্রেনে গান গায় নিয়মিত। একই রকম চেহারা, মুখে কোনো গ্লানির চিহ্ন নেই। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, কীরে, আমেরিকায় গিয়ে কী দেখলি?
গৌরহরি জানলার বাইরের দিকে হাত দেখিয়ে বলে, এখানে যা দেখি ওখানেও তাই। ভগবানের রাজত্বে সবই তো সমান। একই পুরুষ, একই প্রকৃতি। এ দেশেও গাছপালা, সে দেশেও গাছপালা, এ দেশেও ফুল, সে দেশেও ফুল…
কেউ কেউ ফুক্কুড়ি করে বলে, হ্যাঁরে গৌর, কোনো মেমসাহেব তোর সঙ্গে পিরিত করতে চায়নি?
গৌরহরি চুপ করে থাকে। কিছু বলতে চায় না। কিন্তু অন্যরা ছাড়বে কেন? সবাই রসের কথা শুনতে চায়। দু-একজন তাকে ঠেলা দিয়ে বলে, বল না, বল না, সাদা মেয়েদের পিরিত কেমন?
গৌরহরি ফিক করে হেসে ফেলে গান ধরে .
পিরিত যগ ডুমুরের ফুল
সে যে আলোকলতার মূল—