আলোকঝারির চিতাবাঘ

আলোকঝারির চিতাবাঘ

আসামের এদিকটাতে আগে আসিনি৷ বেশ লাগছে জায়গাটা৷ একপাশে আলোকঝারির পাহাড়শ্রেণি আর একপাশে লালমাটি পাহাড়ের লাজ রক্তিম হাতছানি, আর আরো দূরে আছে পর্বতজুয়ার৷ বাংলো থেকে আট মাইল হাঁটতে হয়, পথে সাঁওতাল সর্দারের বাড়ি পড়ে৷ আরও এগিয়ে আমঝোর, সবুজ শালবনে ঘেরা পাহাড়ে-পাহাড়ে সাঁওতালদের গাঁ, সবজি বাগান, ছবির মতো চোখে পড়ে আসা-যাওয়ার পথে৷

অনিমেষ সঙ্গে এসেছিল৷ শিকার করার চেয়ে ওর শিকার দেখার শখ বেশি৷ দিন কয়েক সঙ্গে থেকে ও কলকাতায় চলে গেছে৷ আমায় থাকতে হয়েছে গ্রামবাসীদের অনুরোধে, আলোকঝারির চিতাটির ঝামেলা সইতে৷ দিনে-দিনে অত্যাচারী হয়ে উঠছে চিতাটা৷ আজ এর ঘর থেকে ছাগল নিয়ে যায়, কাল গোয়ালে ঢুকে গরু মারে, পরশু হাট ফিরতি গাঁ-এর লোকেদের থাবা বসায়৷ এমনি উপদ্রবে বাতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল লোকজনেরা৷ তাদেরই অনুরোধে আমায় প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে যে, তাদের শত্রু দমনে যথাসাধ্য চেষ্টা করব৷

দিন দশেক আছি এখানে৷ লালমাটিতে তিনটি চিতল হরিণ পেয়েছি, আর বনশুয়োর গোটা পাঁচেক পর্বতজুয়ারে৷ সাঁওতালেরা ভারী আমোদে খাওয়া-দাওয়া করছে, অনিমেষের সঙ্গেও কিছু মাংস রওয়ানা হয়েছে কলকাতায় প্লেনে চড়ে৷

চিতাটির খোঁজ-খবর করছি৷ ঢোল দিয়েছি যদি কোনো জানোয়ার মারা পড়ে চিতার হাতে, সঙ্গে-সঙ্গে যেন খবর আসে আমার কাছে, পাঁচ টাকা বকশিশ মিলবে তবে৷ এখানকার যে লোক এমন দু’মাইল হাঁটাকে একটা বিষম দায় মনে করে, তাদের গরু-ছাগল মারা পড়লেও খুব কম লোকই এসে খবর দেবার কষ্টটুকু স্বীকার করতে চায়৷

ধূর্ত চিতাটার নাগাল মেলা ভার৷ তাই খবরের আশায় থাকি, সকাল-বিকেল বন্দুক কাঁধে করে তিতির আর বনমুরগি মেরে বেড়াই, আর দুপুরে রবীন্দ্রনাথের কাব্য পড়ি৷

সেদিন আলোকঝারির মেলা৷ পাহাড়ের বুকে মহামায়ার পীঠ৷ দলে-দলে পাহাড়ি লোক আসে পুজো দিতে—অসংখ্য বলি পড়ে৷ অনেক ছাগল আর আরো অনেক কবুতর৷ নির্জন পাহাড়টার বুকের মাঝে আলোড়ন ওঠে একটা, দূরে শোনা যায় চেঁচামেচি, হৈ-চৈ, সাঁওতালি বেদের কবুতর ফেরি করার চিৎকার৷ মেলা দেখতে গিয়েছিলাম৷ বসুমাতারীর দোকানে হঠাৎ ঝুমরুর সঙ্গে দেখা৷ ও বলল, সাহেব, এখুনি আপনার কাছে যাচ্ছিলাম৷ আজ শেষ রাতে মোদের গাঁয়ে গান্তিয়ার বাড়ি গরু মেরেছে একটা সেই দুশমন চিতাটা৷ জিজ্ঞেস করলাম, বাঘে খাওয়া গরুটাকে পাতাটাতা চাপা দিয়ে রেখেছো তো? শকুন পড়লে কিন্তু বাঘ আর আসবে না৷ ও ঘাড় নাড়লে৷ তখন দশটা বাজে৷ ওকে বললাম, চল আমার সঙ্গে বাংলোতে৷ সেখানে বসে যা-যা দরকার, সেগুলো ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম ওকে আর বললাম, গরুটা থেকে হাত পনেরো দূরে একটা ভালো গাছ দেখে মাচা বাঁধতে৷ আমি তিনটের সময় যাব৷ নমস্কার করে ঝুমরু চলে গেল, আমি আমার আদরের ৩৭৫ ম্যানলিকারটাতে তেল দিতে বললাম৷ চান-খাওয়া সেরে, ইজিচেয়ারে গড়িয়ে নিলাম একটু, তারপর কফির পাট সেরে দুটোর সময় বেরিয়ে পড়লাম রাইফেল আর হেডলাইটটা নিয়ে৷

ঝুমরুর গাঁ-এর নাম তিনতিরা৷ মাইল পাঁচেক পথ বাংলো থেকে; বৈশাখের খর রৌদ্রে রুদ্র প্রকৃতিকে ভারী নিষ্ঠুরা মনে হয়, মনে হয় তার দেহে কিংবা মনে কোথাও নেই একটু কমলতা৷ তিনতিরা যখন পৌঁছালাম, তখন তিনটে পাঁচ মিনিট৷ ঝুমরু, গান্তিয়া ও গাঁয়ের আরো লোকজন গরুটা দেখিয়ে দিলে আমায়৷ পাহাড় থেকে পাঁচশো’ গজ দূরে পড়ে রয়েছে গরুটা, ওর পিছনদিক থেকে কিছু মাংস খাওয়া৷ গান্তিয়ার ঘর সেখান থেকে শ’ দুয়েক গজ হবে৷ বাঘ এসে গরু ধরতে ওরা শোরগোল তোলে, তাতেই শেষ অবধি জঙ্গলে আর নিতে পারেনি গরুটাকে৷ ওরা মাচা বেঁধেছে একটা শিমুল গাছে৷ গাছটা একেবারেই ন্যাড়া৷ শুক্লপক্ষের রাত, পূর্ণিমার কাছাকাছি সন্ধে হতেই ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ন্যাড়া গাছে বসে আর যাই হোক, চিতার দৃষ্টি এড়ানো অসম্ভব৷

চারদিক ঘুরে দেখলাম৷ গান্তিয়ার ঘরের পিছন দিয়ে যে পাহাড়ি নালাটি গেছে তার পাশে একটি শিশুগাছ চোখে পড়ল, নীচটা ঝোপঝাড়ে ভরা৷ ঠিক করলাম, এ গাছের নীচেই বসব মাটিতে, ঝোপের আড়ালে৷ আমার অলিভ গ্রিন রংয়ের পোশাক মিশে যাবে পাতার রঙের সঙ্গে, চিতার চোখ এড়ানো যেতে পারে হয়তো৷ গাছটাতে বসবার সুবিধে থাকলে গাছেই বসা যেত৷ কিন্তু সে গাছটি বড় ঝুপসি, তাতে বসে গুলি ছোড়ার সুবিধে হবে না৷ এদিকে অসুবিধে দাঁড়াল দুটো৷ গরুটি থেকে শিশুগাছটি প্রায় শ’খানেক হাত দূর৷ রাতের বেলা অতদূর থেকে নির্ভুল এইম করা কঠিন হবে৷ তার উপর বাঘ যদি পাহাড় থেকে এ নালা দিয়েই নেমে আসে, তবে একেবারে আমার ঘাড়ে এসে উঠবে৷ জানবার আগেই আমার অবস্থা ওই গরুটার মতোই হবে৷ কিন্তু আর কোনোই উপায় নেই, ঝুঁকি একটু নিতেই হবে৷ ওখানে বসাই ঠিক করলাম৷

ততক্ষণে চারটে বেজে গেছে৷ আগুন রোদে কোমল লালিমা লেগেছে, সে লালিমা ছড়িয়ে আলোকঝারির বনে-বনে আর পাহাড়ের মাথায়৷ ঝুমরুকে মাচাটা খুলে ফেলতে বলে, গান্তিয়ার বাড়ি চিড়েভাজা আর চা দিয়ে বৈকালিক পর্ব সমাধা করলাম৷

তখন বেলা যায়-যায়৷ গাঁয়ের লোকদের সন্ধের পর বাইরে বেরুতে, কথাবার্তা কইতে এবং আলো জ্বালাতে মানা করে দিয়ে বসলাম গিয়ে ঝোপের মধ্যে৷ নিজেকে লুকিয়ে রেখেও এইম নেবার সুবিধে পাচ্ছিলাম৷ সামনেটা বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে৷ হেডলাইট সঙ্গে এনেছি, কিন্তু দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না৷ কাকজ্যোৎস্নায় চারদিক হেসে উঠছে৷ চাঁদের মা বুড়ি সাদা ধবধবে চুল নিয়ে, তার চেয়েও সাদা তুলো পিঁজে চলেছে, আর সেই তুলো আলো হয়ে ঝরে পড়ছে রহস্যময়ী আলোকঝারির পাহাড়ে-পাহাড়ে, বনে-বনে, পথে-পথে৷ কেমন আমেজ লাগে এই মৃদুশীতল আলোর ঝরনাতে৷

রাত এগিয়ে চলছে, চিতার চিহ্ন নেই৷ তখন সাতটা৷ ‘বৌ কথা কও’ আর সেই নাম-না-জানা খয়েরি রং-এর পাখিটা একটানা ডেকে চলেছে, আর পিছনের নালায় ঝিঁঝিদের কলস্বর৷ মাঝে-মাঝে ভয় করছে বাঘ যদি পিছনের নালা দিয়ে আসে, তবে করবার কিছু থাকবে না৷ নিরুপায় ভাবে করতে হবে আত্মসমর্পণ হিংস্র জন্তুর কাছে৷ হঠাৎ মনে হল গরুটার কাছে কি একটা জানোয়ার দুপায়ে ভর দিয়ে বসে আছে৷ সজাগ চোখে তাকালাম—একটা শিয়াল সুযোগের অপেক্ষা করছে৷ নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে দিলাম ছুড়ে—একলাফে সরে গেল শিয়ালটা৷ কেটে গেল আরো আধঘণ্টা৷ চেয়ে থাকতে-থাকতে চোখ ব্যথা করে৷ এক-এক মুহূর্ত মনে হয় যেন কতদিন৷ এমন সময় পেছনের নালা থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ পেলাম৷ উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম শব্দটার জন্যে—আবার সেই শব্দ৷ শুয়োরের শব্দ৷ নালার শটী গাছের ঝাড়ে এসেছে লোভে-লোভে৷ একটি নুড়ি গড়িয়ে দিলাম নালার গা দিয়ে৷ দ্রুত আওয়াজ তুলে শুয়োরটা ছুটে গেল পাহাড়ের দিকে৷ সঙ্গে সঙ্গে বাঘের গুরুগম্ভীর ডাকে বন-পাহাড় চমকিত হয়ে উঠল৷ সর্বনাশ বাঘ তাহলে নালা ধরেই এগিয়ে আসছিল, ভাগ্যে শুয়োরটা এসেছিল, নইলে—৷ কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমে উঠল৷ রাইফেলটাতে একবার হাত বুলিয়ে সামনে তাকালাম৷ ওই তো পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসছে—যার জন্যে আমার অপেক্ষা৷ একটু এগিয়ে আসে, আর দাঁড়িয়ে চারদিকে চায়—সন্দিগ্ধ চোখে ঘর-ঘর আওয়াজ করে একটা—সে আওয়াজে বিরক্তি পরিস্ফুট৷ নিঃশব্দে বসে আছি সামান্যতম নড়াচড়াও না করে, আমার ওভাবে মাটিতে দেখতে পেলে কী করে বলা যায় না৷ পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল চিতা, ধূর্ত চিতা, গায়ে চাকা-চাকা দাগওয়ালা সেই ভয়ংকর চিতা৷ গরুটার কাছে এসে চারপাশ একবার ঘুরলে, তারপর বাঘটা ঘাড়ের কাছ থেকে আরম্ভ করল খাওয়া৷ কিছুটা খায় আর চোখ তুলে চায়৷ দুর্গন্ধে বাতাস ভরে গেল৷ একটা চকচক শব্দ হল৷ মট করে হাড় ভাঙার শব্দ হল একবার৷ চাঁদের আলোয় রাইফেলের ফোরসাইট চিকচিক করছে৷ খুব সাবধানে রাইফেল তুলে যথাসম্ভব কম শব্দ করে আনসেফ করলাম রাইফেল৷ অতটুকু শব্দেই চিতা খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর হঠাৎ একলাফে সরে গেল পিছনের ঝোপে৷ বোকার মতো বসে রইলাম কিছুক্ষণ—মিনিট দশেক হবে—আবার সেই ঘরঘরানি শব্দ, আবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে অতি সাবধানে এসে খাওয়া শুরু করলে চিতাটা—এবার পেটের কাছ থেকে৷ আবার রাইফেল তুললাম, নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঘাড়ে এইম নিয়ে, নিঃশব্দে ট্রিগার চাপলাম৷ রাইফেলের বজ্রনির্ঘোষ ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ে-পাহাড়ে, বনে-বনে, গাঁয়ের লোকের মনে মনে৷ আলোকঝারির চিতা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, আর উঠল না৷ একবার ডাকবারও সুযোগ পেল না সে৷

তারপর নানান লোকের গলা, বাঁশ কাটার শব্দ, চা-এর পেয়ালার ঠুনঠুন, অন্দরে নারীকণ্ঠের হাস্যরোল, অবশেষে দীর্ঘ শোভাযাত্রা৷ চিতাটি লম্বায় সাড়ে সাত ফুট ছিল৷ চিতা হিসাবে বিরাট৷ ওকে মারার পর শিশুগাছের নীচে দাঁড়িয়ে ওই জায়গাটাকে আমার আরো ভালো লেগেছিল—আরো মধুর, আরো সুন্দর, আরো বিচিত্র৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *