আলেকজান্ডার রহস্য

আলেকজান্ডার রহস্য

ক্যাপ্টেন রামশরণ সিংহ আমার সামরিক জীবনের বন্ধু। থাকেন ছোটনাগপুর অঞ্চলের ভৈরবগড়ে। জায়গাটা কালক্রমে সমৃদ্ধ জনপদের রূপ নিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা অবশ্য টাউন-ই বলে। গত মার্চে ক্যাপ্টেন সিংহ কী একটা কাজে কলকাতা এসেছিলেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন। যদিও প্রায় বছর পাঁচেক পরে দেখা, তার চেহারায় বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করিনি। আমার মতো দাড়ি না রাখলেও তার গোঁফের রং এবং গড়ন আগের মতোই দেখনসই। কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, আমি আপনার মতো লেপিডস্টারিস্ট নই। তবে আমার ফার্ম হাউসে বিশেষ করে বসন্তকালে যত রকমের প্রজাপ্রতি আসে, দেখতে দেখতে তাদের প্রায় প্রত্যেকটা প্রজাতিকেই চিনে ফেলেছি। আপনার জন্য একটা সুসংবাদ আছে।

কথাটা বলে তিনি সকৌতুকে হেসে উঠলেন। আমি বললুম, আপনার ফার্ম হাউসের স্মৃতি আমার মনে এখনও স্পষ্ট। সেবার দশটা প্রজাতির প্রজাপ্রতি আমি ওখান থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলুম। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি নিশ্চয় কোনো আশ্চর্য নতুন প্রজাপতির খবর আমাকে দিতে চাইছেন।

ক্যাপ্টেন সিংহ মুখে সেই হাসি রেখেই বললেন, ব্যাপারটা খুব আশ্চর্য। আপনার কাছেই শুনেছিলুম কোনো কোনো প্রজাপতি বিষাক্ত হয়। তাই পাখিরা তাদের এড়িয়ে চলে। আমি যে প্রজাপতিটার কথা বলছি সেটার দুই ডানার দৈর্ঘ্য ইঞ্চি ছয়েকের কম নয়। আর সেই দুই ডানায় গোলাকার চোখের মতো চিহ্ন আছে। যেদিন প্রথম ওটাকে লক্ষ করি, সেদিন একটা শালিখ পাখি বারবার তার দিকে উড়ে যাচ্ছিল আর যেন ঐ রাক্ষুসে চোখ দেখেই ভয় পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। প্রজাপতিটা কিন্তু একটুও নড়েনি। আমার মনে হচ্ছিল পাখিটা বুঝি ভেবেছিল ওটা একটা প্যাঁচা।

ক্যাপ্টেন সিংহ আবার হেসে উঠেছিলেন।

আমি বলেছিলুম, ক্যাপ্টেন সিংহ, আমার মনে হচ্ছে ওটা নিমফ্যালইডি গোত্রের প্রজাপতি। আপনি যে বর্ণনা দিলেন তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় লেপিডক্টারিস্ট অর্থাৎ প্রজাপতি-বিশারদরা ওদের আউল বাটারফ্লাই বলেন। এই প্রজাতির নাম ক্যারেগি অ্যাট্রেউস। এবার একটা প্রশ্ন, ওটার গায়ের রং কি ফিকে খয়েরি অথচ খুবই উজ্জ্বল?

ক্যাপ্টেন সিংহ বলেছিলেন, ভীষণ উজ্জ্বল। অনেকটা দূর থেকেও চোখে পড়ে, যদিও ওটা গাঁদাফুলের ঝাড়ের উপর বসেছিল।

এরপর ক্যাপ্টেন সিংহ শেষ অবধি যে কথাটা বলেছিলেন, আমি বুঝতে পেরেছিলুম তাঁর আসল বলার কথা সেটিই ছিল। ঐ প্রজাপতিটিকে শেষ পর্যন্ত সেই শালিখটা খেয়ে ফেলে এবং কয়েক ঘন্টা পরে ক্যাপ্টেন সিংহ পাখিটাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন।

এর পরের ঘটনা আরও মারাত্মক। তাঁর প্রিয় টেরিয়ার কুকুর জনি তাঁর অজ্ঞাতসারে মরা শালিখ পাখিটাকে খেয়ে ফেলে এবং সেদিনই রাত্রে জনিও মারা যায়।

আমি জানতুম, ক্যাপ্টেন রামশরণ সিংহের স্বভাবই এরকম। সামরিক জীবনে কাছাকাছি থাকার সময়ে লক্ষ করতুম, যে কথাটি তিনি বলতে চান তা আগে না বলে লম্বা-চওড়া ভূমিকার অবতারণা করেন।

আউল বাটারফ্লাই এমনিতে বিষাক্ত নয়। তবে কোনো একটা পর্যায়ে বিশেষ করে পুরুষ প্রজাতির মধ্যে ওদের পাকস্থলীতে যেটুকু বিষ জমে তা অন্তত দুতিনটে বেড়ালকে মেরে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট।

প্রিয় কুকুর জনির মৃত্যুতে ক্যাপ্টেন সিংহ অবশ্যই শোকার্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তার কলকাতা আসার আগের দিন বিকেলে ফার্মের ফুলবাগিচায় আবার একটা একই প্রজাতির প্রজাপতি দেখেছিলেন। সেটাকে তিনি ধরার চেষ্টা করেও ধরতে পারেননি। এদিকে তার ফার্ম হাউস পাহারা দেবার জন্য একটা অ্যালসেশিয়ান আছে। তার লোকেদের তিনি প্রজাপতিটা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে এসেছেন।

দু রাউন্ড কফি খাওয়ার মধ্যে এইসব কথা বলার পর তিনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি যখন তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যাচ্ছি, তখন তিনি হঠাৎ চাপা স্বরে বলেছিলেন, জনির মৃত্যুর পর থেকে তার একটা অদ্ভুত ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। তার স্ত্রী মিসেস অপালা সিংহের ইচ্ছে অনুসারে ফার্মে তার বাংলো বাড়িতে একটা পুকুরের পাশে মন্দির বানিয়েছেন। ভৈরবগড়ে পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার পর সেখান থেকে মিসেস সিংহের উপাস্য বিষ্ণুমূর্তিটি এনে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

এই কথাগুলো বলার পর তিনি আমার হাত ধরে আস্তে বলেছিলেন, আমি খুব অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আপনি শিগগির একবার গেলে স্বস্তি পাব।

.

ক্যাপ্টেন রামশরণ সিংহ চলে যাওয়ার পর আমি প্রজাপতি সংক্রান্ত দুর্লভ এনসাইক্লোপিডিয়া নিয়ে বসেছিলুম। আউল বাটারফ্লাই দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে আমাজন অববাহিকায় বাস করে। কিন্তু পাখিদের মতো তাদেরও। মাইগ্রেশনের স্বভাব আছে। এরা একটানা প্রায় দশ মাইল উড়ে যেতে পারে। তারপর জাহাজের মাস্তুলে নিরাপদ জায়গা খুঁজে নিয়ে সঙ্গিনীসহ এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায়। এক-দেড় হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে পৌঁছতে পারে তারা। তারপর সেই দেশে কয়েক প্রজন্ম কাটিয়ে আবার একই ভাবে অন্য কোনো দেশে চলে যায়।

এই কোষগ্রন্থটি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল আউল বাটারফ্লাই আমি একবার সিকিমের পাহাড়ি এলাকায় দেখছিলুম। কিন্তু জালবন্দি করতে। পারিনি, ক্যামেরাবন্দি করেছিলুম। এরা খুব ধূর্ত এবং ওড়ার গতিও বিস্ময়কর। হঠাৎ যেন ছোট্ট ঘুড়ি বোঁও করে আকাশে উড়ে গেল।

সেই রাত্রে ক্যাপ্টেন সিংহের শেষ কথাগুলো আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছিল না। এই প্রজাতির প্রজাপতি দর্শন, তারপর একটি শালিখ পাখির মৃত্যু এবং শেষে তাঁর টেরিয়ার কুকুর জনির মৃত্যু, এসবের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর আরাধ্য বিষ্ণুমূর্তির কী সম্পর্ক আছে যাতে তিনি অদ্ভুত একটা অস্বস্তিতে ভুগছেন? তিনি কি আশঙ্কা করছেন এরপর তার অ্যালসেশিয়ান টমিও একই ভাবে মারা পড়বে এবং মন্দিরের বিষ্ণুমূর্তি…

নাঃ ক্যাপ্টেন সিংহের কলকাতা আগমনের একান্ত উদ্দেশ্য হয়তো আমিই। রাত একটায় ঠিক করে ফেললুম পরদিনই ভৈরবগড় রওনা হব।

সকালে আমার ছাদের বাগান পরিচর্যা করে ড্রয়িং রুমে এসেই জয়ন্তকে টেলিফোন করলুম। রিং হতে থাকল, কেউ ধরল না। তখন দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার নিউজ ব্যুরোর চিফ সত্যবাবুকে টেলিফোন করলুম। তার কাছেই শুনলুম জয়ন্ত পত্রিকার পক্ষ থেকে আমেরিকার বোস্টনে ট্রেনিং ট্যুরে গেছে।

ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। কফি খেতে খেতে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদার মশায়ের কথা ভাবলুম। কিন্তু তারপরই মনে হল যখন কোনো ঘটনাই ঘটেনি তখন তার মতো হঠকারী প্রাক্তন পুলিশ অফিসারকে সঙ্গী করা ঠিক হবে না।

ক্যাপ্টেন সিংহ আমাকে বলে না গেলেও জানতুম ভৈরবগড় যেতে হলে রাত সাড়ে নটার ট্রেনই ভালো। আরামে ঘুমিয়ে সকাল নটার মধ্যে পৌঁছনো যাবে। স্টেশন থেকে ক্যাপ্টেন সিংহের ফার্ম হাউস প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে।

সেদিনই দুপুরে সঙ্গে যা নেবার, সব গুছিয়ে নিলুম। তারপর পূর্ব রেলের অফিসে আমার স্নেহভাজন অমিত রুদ্রকে আমার ভৈরবগড় যাত্রার কথা জানিয়ে দিলুম। প্রাক্তন সামরিক অফিসার হিসেবে এবং বিশেষ করে সরকারের অনেক কাজকর্ম করে সুনাম অর্জনের ফলে ট্রেনে বা প্লেনে উৎকৃষ্ট আসনে বিনি পয়সায় যাবার সুবিধে আমার আছে।

সন্ধ্যা আটটায় ষষ্ঠীচরণকে ট্যাক্সি ডাকতে পাঠিয়েছি, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই কানে এলো ক্যাপ্টেন রামশরণ সিংহের কণ্ঠস্বর। –কর্নেল সরকার, আমি আজ সকালে পৌঁছেছি। তারপর একবার ভৈরবগড়ে এক ডাক্তারের কাছে আমার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলুম, ওঁর হঠাৎ কী একটা অসুখ হয়েছিল। অসুখটা কী ডাক্তার তা খুলে বলেননি। এদিকে এক ঝামেলা। গতরাত্রে আমি যখন ট্রেনে, তখন আমার ফার্মের ম্যানেজার রতনলাল তার ঘর থেকে অ্যালসেশিয়ান টমির গর্জন শুনতে পায়। টমিকে ছেড়ে দেওয়া ছিল। তারপর পাহারাদার নাথুলাল আর বিন্ধ্যেশ্বরের চিৎকার শুনতে পেয়ে রতনলাল বন্দুক হাতে নেমে যায়। একটা খালের ধার টমি রক্তবমি করে পড়ে ছিল।

আমি দ্রুত বললুম, দ্যাটস এনাফ ক্যাপ্টেন সিংহ। আমি এখনই বেরিয়ে পড়ছি। ট্যাক্সি ডাকতে পাঠিয়েছি।

ক্যাপ্টেন সিংহ শুধু বললেন, আমার অস্বস্তিটা ঠিকই ছিল।

 তারপর ফোনের লাইন কেটে গেল।

.

মার্চ-এপ্রিলে ভৈরবগড়ে ট্যুরিস্টদের খুব ভিড় হয়। আশেপাশে ওখানে প্রচুর। দেখার জায়গা আছে। পাতাল-ভৈরবের মূর্তি দর্শন এবং মেলা ছাড়াও ভৈরব নদের জলপ্রপাত এবং প্রাচীন যুগের রাজপ্রাসাদ ও গড় ঘিরে যে দুর্গম জঙ্গল, তার আকর্ষণও কম নয়। পাঁচ বছর আগে আমি যখন এসেছিলুম তখন কলকাতার একটি ফিল্মের কোম্পানিকেও জলপ্রপাতের কাছাকাছি জায়গায় শুটিং করতে দেখেছি।

ফাস্টক্লাসেও ভিড় ছিল। তবে আমি অমিত রুদ্রের চেষ্টায় সুন্দর লোয়ার বার্থ পেয়েছি। ক্যাপ্টেন সিংহের কথাগুলো আমার মাথার ভিতরে মাছির মতো ভনভন। করছিল। তার অ্যালসেশিয়ানের মৃত্যুর কারণ সেই অদ্ভুত প্রজাপতিটা কি না সে। বিষয়ে নিঃসংশয় না হলেও মিসেস সিংহকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মিসেস সিংহের উপাস্য বিষ্ণুমূর্তিটা…

ট্রেনটা ঠিক সময়ে ভৈরবগড়ে পৌঁছল। এক হাতে আমার ব্যাগেজ ঝুলিয়ে স্টেশনের গেট দিয়ে বেরুতেই কেউ সেটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। তারপরই দেখলুম ক্যাপ্টেন সিংহ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন এবং ব্যাগেজ ছিনতাইকারী লোকটি আমার চেনা। তার নাম রঘুবীর। সে ক্যাপ্টেন সিংহের ড্রাইভার শুধু নয়, বাড়তি অনেক কাজও করে থাকে। সেবার গড়ের জঙ্গলে এই। রঘুবীরই ছিল আমার সঙ্গী।

ক্যাপ্টেন সিংহ চাপা স্বরে মর্নিং বলে করমর্দন করলেন তারপর আমার কাঁধে হাত রেখে চুপচাপ তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর মুখে গাম্ভীর্য ঘন হয়ে ছিল।

হেঁটে যেতে যেতে আস্তে বললুম-মন্দিরের বিষ্ণুমূর্তি–

 ক্যাপ্টেন সিংহ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সেটা অদৃশ্য।

 ড্রাইভার রঘুবীর ভৈরবগড়ের ভিতরের রাস্তা না ধরে ডানদিকে একটা সংকীর্ণ পিচ রাস্তায় গাড়ি নিয়ে চলল। বুঝলুম গত পাঁচ বছরে ভৈরবগড়ের রাস্তাঘাটে ভিড় বেড়েছে। তাই এই পাশ কাটিয়ে যাওয়া। তবে আমার পক্ষে এমন নির্জন পথ আনন্দদায়ক। পথটা বারবার চড়াইয়ে উঠছে, আবার টিলা পাহাড়ের কাঁধের উপর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে উতরাইয়ে নামছে। বাঁদিকে ভৈরবগড়ের সমৃদ্ধি উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছিল। ডানদিকে মাঝে মাঝে আদিবাসী বস্তি আর জঙ্গল চোখে পড়ছিল। জঙ্গলের পিছনে দূরে পশ্চিমে ঘন নীল পাহাড়ের রেঞ্জ। ক্যাপ্টেন সিংহ। এতক্ষণে একটু হেসে বললেন, এই রাস্তাটা দিয়ে আপনাকে নিয়ে এলুম কারণ খুব শিগগির আমার ফার্ম হাউসে পৌঁছানো যাবে।

এতক্ষণে আমি চুরুট ধরালুম। তারপর বললুম, এই রাস্তার শেষ দিকটা আমি চিনি মনে হচ্ছে।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, হ্যাঁ, সেবার আপনার সঙ্গে ঐদিকটায় অর্কিডের খোঁজে বেরিয়েছিলুম।

একটু হেসে বললুম, মনে পড়ছে আমাদের বেরুনোটা ব্যর্থ হয়নি। এনিওয়ে, আপনার ফার্ম হাউসের ঘটনা নিয়ে এখন কথা বলা কি ঠিক হবে?

ক্যাপ্টেন সিংহ ড্রাইভার রঘুবীরের দিকে চোখের ইশারা করে বললেন, কেসটা পুলিশের হাতে। আমি আপনাকে সেই অদ্ভুত প্রজাপতির একটা খবর দিতে পারি।

বলুন।

আমার ফার্ম হাউসের পুবে নদীর ধারেই এক ভদ্রলোক সম্প্রতি একটা বাংলো বাড়ি করেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। একসময় তিনি ঐ এলাকায় খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে কীসব কাজ করতেন।

কী সব মানে, শিক্ষকতা নয়?

না। আমি তার সঙ্গে আলাপ করে যেটুকু বুঝেছিলুম তাতে আমার ধারণা উনি সায়েন্স সেকশনে ল্যাবে কাজ করতেন। তাছাড়া তিনি বাঙালি।

ভৈরবগড়ে তো একসময় অনেক বাঙালি থাকতেন।

আমার কথা শুনে ক্যাপ্টেন সিংহ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, ইনি ভৈরবগড়ের বাসিন্দা নন। মিশন স্কুল থেকে রিটায়ার করার পর এখানে বাড়ি করেছেন। নাম নীলমাধব রায়। তো যা বলছিলুম, কাল বিকেলে খেয়াল হল একবার নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি। বাংলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল বাংলোর বাউন্ডারি ওয়ালের উপর ঝুঁকে পড়া হলুদ রঙের ফুলে সেই রকম কয়েকটা প্রজাপতি বসে আছে। ইচ্ছে হল ভদ্রলোককে ডেকে একটু সতর্ক করে দিই। কারণ তার কুকুর আছে। সাধারণ কুকুর নয়, ডোবারম্যান পিঞ্চার।

একটু অবাক হয়ে বললুম, এ জাতের কুকুর তো একসময় বড়োলোক শিকারিরা পুষতেন। বন্দুকে পাখি মারলে এরা তা কুড়িয়ে এনে দেয়।

ক্যাপ্টেন সিংহ মৃদু স্বরে বললেন, মিঃ রায় বন্দুক আর কুকুরটাকে নিয়ে মাঝে মাঝে জলপ্রপাতের নীচে সেই লেকে যান। লেকটা তো আপনি দেখেছেন।

সে কী! এখন তো পাখি শিকার করা বেআইনি। ১৯৭৬ সালেই ভারত সরকার বন্য প্রাণী আর পাখি শিকার আইন করে নিষিদ্ধ করেছে।

ক্যাপ্টেন সিংহ একটু হেসে বললেন, এই এলাকায় পুলিশ সন্ত্রাসবাদী আর নানা রকমের খুনখারাপি নিয়েই ব্যস্ত।

কিন্তু আইনটা মেনে চলছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের।

তা হবে। তবে আমি যা লক্ষ করেছি তাই বললুম।

 বাংলোয় নিশ্চয়ই ওঁর ফ্যামিলি আছে?

না। বাংলোয় শুধু এক আদিবাসী খ্রিস্টান দম্পতিকেই দেখেছি। তারা থাকে একটা একতলা ঘরে। মিঃ রায়ের সব কাজকর্ম ওরা দুজনেই করে দেয়।

ততক্ষণে আমরা ভৈরবগড় পিছনে ফেলে শালবনে ঢাকা পাহাড়ের কাঁধে পৌঁছে গেছি। জায়গাটা চিনতে পারলুম। উত্রাই-এর পরেই পিচরাস্তাটা বাঁক নিয়ে ডাইনে চলে গেছে। বাঁ দিকে ক্যাপ্টেন সিংহের ফার্ম হাউসে ঢোকার মোরামবিছানো পথ। শতিনেক মিটার মোরামবিছানো রাস্তায় ঢোকার মুখে প্রাইভেট ওয়ে লেখা সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল। গেটের সামনে গাড়ি গিয়ে দাঁড়াতেই যে গেট খুলে দিল, তাকে চিনতে পারলুম। সে নাথুরাম। সেলাম ঠুকে সে গেট বন্ধ করে দিল। গাড়ি এগিয়ে গিয়ে পোর্টিকোর নীচে থামল। ফার্মের ম্যানেজার রতনলালকে দেখতে পেলুম। তিনি করজোড়ে আমাকে নমস্কার করলেন। কিন্তু মুখটা গম্ভীর।

ফার্ম হাউসের এই বাংলোটা দোতলা। দেখতে বিদেশি বাংলোর মতো।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, একেবারে আপনার থাকার ঘরে নিয়ে যাব আপনাকে।

প্রশস্ত বারান্দা দিয়ে ঘুরে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে, যে ঘরে পাঁচ বছর আগে আমি কিছুদিন কাটিয়ে গিয়েছিলাম, সেই ঘরে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন সিংহ। একটি আদিবাসী মেয়ে বহাল হয়েছে দেখলুম। সে দুদিকের জানলাগুলো পর্দা সরিয়ে দিল। ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, এর নাম সুশীলা। রঘুবীরের মেয়ে। ওর দুর্ভাগ্য বিয়ের পরেই স্বামী মারা যায়। রঘুবীরের কথায় একে আমার কাছে এনে রেখেছি। সুশীলা, তোর বাবার কাছে কর্নেল সাহেবের গল্প শুনেছিস বলেছিলি। ইনিই সেই কর্নেল সাহেব।

সুশীলা প্রণাম করতে এল। আমি পিছিয়ে গিয়ে সহাস্যে বললুম, আগে কফি, তারপর অন্য কিছু।

ইতিমধ্যে রঘুবীর আমার প্রকাণ্ড ব্যাগটা ঘরের ভিতর কোণের দিকে একটা টুলে রেখে গিয়েছিল।

সুশীলা বেরিয়ে গেল। আমি আমার পিঠের কিটব্যাগটা খুলে টেবিলে রাখলুম। তারপর গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার ও ক্যামেরাটা রেখে দিলুম। ক্যাপ্টেন সিংহ। সুইচ চালিয়ে ফ্যান খুলে দিলেন। আবহাওয়া এমনিতেই কলকাতার তুলনায় ঠান্ডা। তবে বাড়তি হাওয়ারও দরকার ছিল। জানলার কাছাকাছি সোফায় বসে টুপিটা খুলে ফেললুম। ক্যাপ্টেন সিংহ আমার মুখোমুখি বসলেন। তারপর মৃদু স্বরে বললেন, অপালাকে ডাক্তার আপাতত ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। এতক্ষণে হয়তো সে উঠতে পেরেছে। আমার ধারণা আপনাকে দেখলে সে মানসিক আঘাত অনেকটা সামলে নেবে। তবে আগে কফি খেয়ে নিন। তারপর পোশাক বদলে এবং বাথরুম সেরে ফ্রেশ হয়ে নিন।

তখনো আমার হাতে জ্বলন্ত চুরুট। সেটা অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে তারপর বললুম, আগে একটা কথা বলে নিই। আপনার অ্যালসেশিয়ান টমিও কি কোনো মরা পাখি খেয়েছিল?

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, যেখানে ও রক্তবমি করে মরে পড়েছিল সেখান থেকে কয়েক হাত দূরে শালিখ পাখির ছেঁড়াখোঁড়া পালক পাওয়া গেছে। তবে এটাই আশ্চর্য, টমি পাখিটাকে এমনভাবে চিবিয়েছে যে তার মুখেও প্রচুর পালক আটকে ছিল।

জিগ্যেস করলুম, দুটো পাখিরই পালক যেখানে পড়েছিল সেখানে এখনও কি তেমনিই পড়ে আছে নাকি?

ক্যাপ্টেন সিংহ আমার কথার উপরে বললেন, হ্যাঁ, আমার লোকেরা বুঝতে পেরেছে দুটো পাখিই প্রজাপতির বিষে মারা পড়েছে। তাই ওগুলো ছুঁতে সাহস পায়নি। তাছাড়া কলকাতা যাওয়ার আগে আমি প্রথম পাখিটার পালকগুলো ওখানেই যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায় যেন থাকে, তা বলে গিয়েছিলুম। কারণ, আমার মনে হয়েছিল যদি দৈবাৎ আপনাকে এখানে আনতে পারি, আপনি ওগুলো দেখবেন।

জিগ্যেস করলুম, পুলিশ কি ওগুলো দেখেছিল?

পুলিশকে আমি প্রজাপতি এবং পাখির ব্যাপারটা জানাইনি। আমার লোকেদেরও জানাতে নিষেধ করেছিলুম। শুধু কুকুর দুটোর বিষাক্ত কিছু খেয়ে মারা পড়ার কথা পুলিশকে বলা হয়েছে। জনিকে আগেই কবর দেওয়া হয়েছিল। বুদ্ধিমান রতনলাল টমিকেও তার পাশে পুঁতে দিয়েছিল। পুলিশ শুধু কবর দুটো দেখেই সন্তুষ্ট। বুঝতেই পারছেন, পুলিশের ধারণা মন্দির থেকে বিষ্ণুমূর্তি চুরির জন্য কেউ কুকুর দুটোকে বিষ খাইয়ে মেরেছে। ওরা নাথুলাল আর তার সঙ্গী বিন্ধ্যেশ্বরকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী বাধা দেয়।

এই সময় সুশীলা ট্রেতে কফির পট, পেয়ালা আর স্নাকস রেখে চুপচাপ চলে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন সিংহ তাকে জিগ্যেস করলেন, তোর মাইজি কি উঠেছে?

সুশীলা বলল, উনি অনেকক্ষণ উঠেছেন। এখন উনি দোতলার ব্যালকনিতে বসে আছেন।

সুশীলা চলে গেল। দরজার পর্দা ফাঁক করা ছিল। বারান্দায় ম্যানেজার রতনলালকে দেখতে পেলুম। তিনি বললেন, স্যার, মাইজি কর্নেল সাহেবের আসার খবর শুনেছেন। উনি নীচে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু ওঁর শরীরের যা অবস্থা–আমি নিষেধ করলুম। বললুম কফি খেয়ে কর্নেল সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, রতনলাল, তুমি বরং আজ রঘুবীরকেই নদীর ধারে গিয়ে জেলেদের কাছ থেকে মাছ আনতে বলো।

রতনলাল চলে গেলেন। আমি কফিতে চুমুক দিয়ে হাসতে হাসতে বললুম, আপনি কি ভেবেছেন আপনার পোষা মোরগ-মুরগিগুলো শরীরে প্রজাপতির বিষ নিয়ে বেড়াচ্ছে?

এতক্ষণে ক্যাপ্টেন সিংহ স্বাভাবিকভাবে হেসে উঠলেন। বললেন, না। তবে আপনি ভৈরব নদের মাছের সুখ্যাতি করে গিয়েছিলেন মনে আছে।

কথাটা বলার পর কফির পেয়ালা হাতে নিয়েই ক্যাপ্টেন সিংহ উঠে গিয়ে দরজার বাইরে ডানদিক এবং বাঁদিক দেখে নিলেন। তারপর ফিরে এসে তেমনই মুখোমুখি বসলেন। বললেন, উপাস্য ঠাকুরের জন্য অপালার মনস্তাপ স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি তো জানেন আমি কট্টর নাস্তিক। আমার ঠাকুর্দার কাছে শুনেছিলুম আমাদের গৃহদেবতা বিষ্ণুর মূর্তিটি নিরেট সোনায় তৈরি। তাছাড়া তার গায়ে অনেক রত্ন খচিত ছিল। মাথার মুকুটেও ছিল নানা রকমের রত্ন। আমার হিসেবে প্রায় নয় ইঞ্চি উঁচু বিষ্ণুমূর্তিটির দাম এখন প্রায় কোটি টাকারও বেশি।

কথাটা বলেই তিনি একটু নড়ে উঠলেন–মাই গুডনেস! আপনাকে তো বিষ্ণমূর্তি অপালা দেখিয়েছিল। আমি নাস্তিক বলে সে আমাকে এখনো মন্দিরের বারান্দায় উঠতে দেয় না।

কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললুম, মার মনে পড়ছে মন্দিরের দরজায় লোহার কপাট আছে। তাছাড়া হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলতে হলে একটা বিশেষ কৌশল দরকার হয়। মিসেস সিংহ আমাকে কতকগুলো ইংরেজি অক্ষর দরজায় খোদাই করা ছিল তা দেখিয়েছিলেন। সেই অক্ষরগুলো হাতল ঘুরিয়ে ঠিকমতো সেট করতে পারলেই দরজা খোলে। অবশ্য আমাকে তিনি এর বেশি কিছু বলেননি।

ক্যাপ্টেন সিংহ হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আমিও ঐ কৌশলটা জানি না। কারণ আমাদের পরিবারের নিয়ম হল বংশপরম্পরায় বাড়ির বড়বৌমা শুধু ঐ কৌশলটা জানবেন। আমার মা মৃত্যুর আগে অপালাকে ওটা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।

চুরুট ধরিয়ে চুপচাপ টানছিলুম। এবার বললুম, চোর কি দরজার হাতল ভেঙে মূর্তি নিয়ে পালিয়েছে?

ক্যাপ্টেন সিংহ এবার গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বললেন, না। সব ঠিকঠাক আছে, শুধু মূর্তিটাই নেই।

কথাটা শুনে চমকে উঠলুম। বললুম, তার মানে চোর যেভাবেই হোক দরজা খোলার কৌশলটা জানতে পেরেছিল, এই তো?

ঠিক ধরেছেন। বলে ক্যাপ্টেন সিংহ বুক পকেট থেকে বিদেশি সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করলেন। বললেন, ধুমপান আমি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলুম, কিন্তু এই ঘটনার পর টেনশন কমাতে আবার কখনো কখনো সিগারেট টানছি।

চোখ বুজে চুরুট টানছিলুম। হঠাৎ মনে হল এখনই একবার মন্দিরটা দর্শন করে আসা উচিত।

কথাটা বলতেই ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, বেশ তো, চলুন।

.

 এই বাংলো বাড়িটার চারদিক ঘিরেই চওড়া বারান্দা। পূর্বের বারান্দা দিয়ে উত্তরে কিছুটা এগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হল। নুড়ি-বিছানো খানিকটা পথের শেষে রেলিং ঘেরা জায়গার উপর বিষ্ণুমন্দির। রেলিঙের পাশ দিয়ে এগোলে বাউন্ডারি ওয়ালের দরজা এবং মন্দিরে ঢুকতে হলে বাঁদিকে রেলিঙের খানিকটা।

জায়গা ফাঁকা। মন্দিরের নীচের মাটিটা ঘাসে ঢাকা।  ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, আপনি জানেন, তবু মনে করিয়ে দিচ্ছি, এখানে জুতো-মোজা খুলে রেখে ভিতরে ঢুকতে হবে।

জুতো-মোজা খোলার পর মুখ ঘুরিয়ে দোতলার দিকটা একবার দেখে নিলুম। একটা ব্যালকনিতে মিসেস সিংহ বসে আছেন। আমাকে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি যেন ধ্যানস্থ। তবে তার চোখ দুটিতে যেন অস্বাভাবিক দৃষ্টি। তার মানে তিনি আমাকে যেন দেখেও দেখছেন না। আমার মাথায় তখন টুপি ছিল না। তাই তাকে দেখার জন্য মুখ তত উঁচু করতে হয়নি। ক্যাপ্টেন সিংহও তার স্ত্রীকে একবার দেখে নিয়ে চাপা স্বরে বললেন, আমার ভয় হচ্ছে অপালা কোনো মানসিক অসুখ না বাধিয়ে বসে।

ঘাসে পা ফেলে পশ্চিমমুখী মন্দিরের সামনে দাঁড়ালাম। বললুম, আমার মনে পড়ছে সেবার আপনাকে বলেছিলুম মন্দিরটা এত অরক্ষিত অবস্থায় আছে কেন? আপনি বলেছিলেন মন্দিরের লোহার দরজা খোলা কোনো চোর-ডাকাতের পক্ষে সম্ভব নয়।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, কেন বলেছিলুম তা আপনার জানা।

আমি আমার অভ্যাসমতো সামনের এবং দুপাশের ঘাসের উপর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলুম।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, পুলিশ এই জায়গাটা তন্ন তন্ন খুঁজেছে, যদি চোরের কোনো ক্লু পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি।

আমি কয়েক পা এগিয়ে মন্দিরের দরজার সমনাসামনি দাঁড়ালুম। কয়েক ধাপ সিঁড়ির পর চওড়া বারান্দা, মসৃণ মার্বেলের উপর বিচিত্র কারুকার্য করা আছে। এ ধরনের কাজ শুধু মোগলদের স্থাপত্যেই দেখা যায়।

মন্দিরের লোহার দরজার দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলুম পাঁচ বছর আগে ক্যাপ্টেন সিংহ যা বলেছিলেন তা সত্য। তাঁর পূর্বপুরুষের আমলে তৈরি এই লোহার দরজায় সত্যিই মরচে ধরেনি। প্রাচীন যুগের কারিগরদের এইসব সৃষ্টি বিস্ময়কর। প্রাচীন কালের মরচে না ধরা লোহার কামান নানা জায়গায় আমি দেখেছি। কিন্তু মন্দিরের এই দরজায় হাতলের চারপাশে গোলাকার চক্রে খোদাই করা রোমান হরফগুলো দেখে বোঝা যায় ব্রিটিশরা এদেশে আসার পরই কোনো দক্ষ কারিগর দরজাটা তৈরি করেছিল। কাজেই ক্যাপ্টেন সিংহ বা তাঁর স্ত্রী যা-ই বলুন, দরজাটা দুই থেকে আড়াইশ বছরের মধ্যে তৈরি। অবশ্য ভিতরে যে বিষ্ণুমূর্তি দেখেছিলুম, তার প্রাচীনতা অস্বীকার করা যায় না।

এই সময় ক্যাপ্টেন সিংহ এক মিনিট, আসছি বলে উপরের দিকের দরজার কাছে চলে গেলেন। তার পায়ে অবশ্য এখন চটি ছিল। কে জানে কেন তিনি দরজা খুলে হঠাৎ বেরিয়ে গেলেন।

এই সময় আমি ক্যামেরায় দরজার একটা ফোটো দ্রুত তুলে নিলুম। তারপর বাইনোকুলারে রোমান হরফগুলো দেখে নিলুম।

এই সময় একটু ঘুরে দোতলার ব্যালকনি লক্ষ করতে ভুলিনি। মিসেস সিংহ তেমনই বসে আছেন।

পিছোতে গিয়ে হঠাৎ পায়ের তলায় শক্ত কী একটা জিনিস ঠেকল। পা তুলে দেখি একটা গোলাকার চ্যাপ্টা লোহার টুকরো পড়ে আছে। সেটার তলায় পেরেকের মতো খানিকটা অংশ ভাঙা। কিছু না ভেবেই সেটা তুলে নিয়ে প্যান্টের পকেটে চালান করে দিলুম।

এই সময় ক্যাপ্টেন সিংহ ফিরে এলেন। তাঁকে রুষ্ট দেখাচ্ছিল। তিনি বললেন, পিছনের পুকুরে শ্বেতপদ্ম আছে আপনি জানেন। এখন অবশ্য পদ্ম আর নেই, কিন্তু প্রায়ই আদিবাসী বাচ্চা মেয়েরা পদ্মের ফল জল থেকে তুলে নিতে আসে। কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে আসতে ওদের কোনো অসুবিধা হয় না।

বললুম, আপনার শ্রবণশক্তি তীক্ষ্ণ, তা আমি জানি।

ক্যাপ্টেন সিংহ একটু হেসে বললেন, আজ তিন-চারটি মেয়ে পুকুরে নেমেছিল। পদ্মের ফল বা বীজগুলো ওরা নিয়ে যাক, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ওরা ডুব দিয়ে পদ্মের শেকড়ও উপড়ে নেয়। ঐ শেকড়গুলো ওরা খেতে ভালোবাসে।

বললুম, হ্যাঁ, আমি জানি। আদিবাসীদের হাটে পদ্মের শেকড় বিক্রি হতে আমি দেখেছি।

কথা বলতে বলতে আমি ঘাসের উপর বসেই মোজা এবং জুতো পরে নিলুম। তারপর বললুম, চলুন একবার পুকুরটা দর্শন করি।

ক্যাপ্টেন সিংহ হাসতে হাসতে বললেন, অপালার কাছে পুকুরটা পবিত্র। পুজোর আগে সে স্নান করে নেয়। অবশ্য বিষ্ণুদেবের পুজোর জন্য একজন ঠাকুর আছেন। তিনি থাকেন ভৈরবগড়ে।

খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বললুম, দেবতা নেই বলে তিনি কি পুজো করতে আসছেন না?

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, না, সে আসবে কী করে? তাকে পুলিশ জেরা করার জন্য হাজতে রেখেছে।

বললুম, আমি যাকে পুজো করতে দেখে গিয়েছিলুম–

আমার কথার উপর ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, না, হরিরাম শর্মাকে আপনি দেখেছিলেন। গত বছর সে মারা গেছে। তার ছেলে অশোক শর্মাকে আমার স্ত্রী বহাল করেছিল। বছর তিরিশ বয়সের এই পূজারীটি সম্পর্কে কিছু অপবাদ শুনেছিলুম। কিন্তু অপালার মতে বংশপরম্পরায় ওরাই পূজারী হবে বলে আমার মা নাকি তাকে বলে গিয়েছিলেন।

ততক্ষণে পুকুরের বাঁধানো ঘাটের উপর গিয়ে পৌঁছেছি। চতুষ্কোণ পুকুরটির সর্বত্র পচে যাওয়া পদ্মের উঁটা আর ফল ভেসে আছে। অন্যমনস্কভাবে বললুম, নতুন পূজারী সম্পর্কে কী অপবাদ শুনেছেন?

নেশাখোর। চরিত্রদোষও নাকি আছে। বলে ক্যাপ্টেন সিংহ পুকুরের ডান পাড়ে একটা ছাতিম গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

সেখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অনেকটা দূরে একটা মনোরম বাংলো বাড়ি দেখে বুঝতে পারলুম ওটাই সেই নীলমাধব রায়ের বাংলো। বাড়িটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার সামনে দাঁড়ালুম। তারপর বাইনোকুলারে চোখ রাখলুম। নদীর পাড়ে একটা টিলার গায়ে রঙিন বাড়িটা উজ্জ্বল রোদে স্পষ্ট ফুটে উঠল। বাড়িটা যথেচ্ছ ফুলে সাজানো। আমি খুঁটিয়ে দেখছিলুম সেই ভদ্রলোক যদি দৈবাৎ আমার বাইনোকুলারে ধরা পড়েন।

আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। শর্টস এবং টি-শার্ট পরা এক ভদ্রলোক ফুলের ঝোঁপ থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তার মাথায় রোদ বাঁচানো ক্যাপ। কিন্তু তারপরই আমার মনে চমক খেলে গেল। আশ্চর্য! ভদ্রলোকের হাতে একটা আমারই মতো প্রজাপতি-ধরা জাল। তিনি জালের স্টিকটা হাতে নিয়ে একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর বাংলোর বারান্দায় গিয়ে বসলেন।

ক্যাপ্টেন সিংহ আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনি কি মিঃ রায়কে খুঁজছিলেন?

বাইনোকুলার নামিয়ে তার কাছে এসে বললুম, ক্যাপ্টেন সিংহ, নীলমাধব রায় আমারই মতো একজন লেপিডপ্টারিস্ট।

ক্যাপ্টেন সিংহ চমকে উঠে বললেন, সে কী! আমি তো জানতুম না তিনি একজন প্রজাপতিবিশারদ। কথাটা বলে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তিনি লাইটার দিয়ে ধরালেন। তাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। একটু পরে তিনি মৃদু স্বরে বললেন, কর্নেল সরকার, এখন আমার মনে হচ্ছে ঐ ভদ্রলোকই আমার ফার্ম হাউসে ঐসব উদ্ভুট্টে প্যাচা প্রজাপতি ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মনে হচ্ছে এ ব্যাপারটা পুলিশকে জানানো দরকার।

হাসতে হাসতে বললুম, এমনটা হতেই পারে তিনি আউল বাটারফ্লাই নিয়ে চর্চা করছেন এবং এই প্রজাতির প্রজাপতি ব্রিডিং গ্রাউন্ড তাঁর বাংলোতেই আছে। সেখান থেকে কয়েকটা প্রজাপতি আপনার ফার্ম হাউসে উড়ে আসতেই পারে। কাজেই আইনের দিক থেকে তাঁকে শেষাবধি দোষী করা কঠিন।

ক্যাপ্টেন সিংহ কি বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় তার ম্যানেজার রতনলাল এসে বললেন, স্যার, থানা থেকে টেলিফোন এসেছে। ম্যাডাম আপনাকে যেতে বললেন।

ক্যাপ্টেন সিংহ তখনই তার সঙ্গে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। আমি এবার পুকুরের ঘাটের দিকে গিয়ে বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের দিকে তাকালুম। ভিতরে মন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। উঁচু দেওয়ালের নীচে গিয়ে ঘন ঘাসের ভেতর ঝুঁকে পড়লুম। কিছু যে দেখতে পেয়েছিলুম এমন নয়,কিন্তু এটা আমার নিছক অভ্যাস। ঘটনাস্থলে চারপাশটা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে না দেখলে স্বস্তি পাইনে।

কিন্তু মন্দিরের সামনে ঘাসের ভিতর যেমন একটা অদ্ভুত জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছি, এখানে তেমন কিছু খুঁজে পেলুম না। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে চোখে পড়ল ছোপ-ধরা দেওয়ালে দুটো জায়গায় যেন বাচ্চা ছেলেদের আঙুলের ছাপ। দেওয়ালটা পশ্চিমে, সূর্য পূর্বে। তাই ক্যামেরায় দ্রুত একটা স্ন্যাপ শট নিয়ে নিলুম।

আদিবাসী ছেলেমেয়েরা এখানে পদ্মফুল বা পদ্মের শিকড় ওপড়াতে আসে। দেওয়ালের প্রায় ছফুট উঁচুতে তাদের আঙুলের দাগ পড়বে কেন? এমন তো নয় যে দেওয়ালে তাদের পা রেখে ওঠার মতো কোনো জায়গা আছে।

এরপর বাইনোকুলারে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঐ আঙুলের দাগের মতো দুটো চিহ্ন খুঁটিয়ে দেখলুম। কিন্তু ও দুটো যে বাচ্চা ছেলেদের আঙুলেরই দাগ, এই বিশ্বাস মন থেকে ঘুচল না। স্যাঁতলা ধরা পিচ্ছিল দেওয়ালে ঐ চিহ্ন দুটো কী, তা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। তারপর দরজার দিকে এগোতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল এই এলাকায় বানরের উপদ্রব আছে। হয়তো জনি বা টমির তাড়া খেয়ে কোনো বানর পাঁচিল টপকে এপারে পড়েছে। তার ফলে তাদের দুটো হাতের চিহ্ন দেওয়ালে থেকে গেছে।

ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলুম। তারপর মন্দিরের পাশ দিয়ে বারান্দায় উঠলুম। আমার ঘরের কাছাকাছি যেতেই ক্যাপ্টেন সিংহের সঙ্গে দেখা হল। তিনি হাসিমুখে বললেন, আপনি যেখানেই যান, সেখানকার পুলিশকর্তাদের কি আগাম খবর দিয়েই যান? এস. পি. সাহেব ফোন করেছিলেন, আপনার খবর জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আজকে সময় করে উঠতে পারবেন না, কাল সকালের দিকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

বললুম, এস. পি. দেবদত্ত রাও একসময় পশ্চিমবঙ্গেই ছিলেন। সেই সূত্রে তার সঙ্গে আমার পরিচয়।

ক্যাপ্টেন সিংহ আমার সঙ্গে ঘরে ঢুকে বললেন, লোকাল থানার অফিসার-ইন-চার্জ রাকেশ সিংহও ফোন করেছিলেন। মনে হল এস. পি. সাহেব ওঁকে আপনার সাহায্যের জন্য কিছু বলেছেন। রাকেশবাবু এখনই আসতে চাইছিলেন। আমি ওঁকে সন্ধ্যার দিকে আসতে বলেছি। কারণ আজকের দিনটা আপনি ফার্ম হাউসের আনাচে-কানাচে তদন্ত করবেন, তা আমি জানি। যাই হোক, এবার পোশাক বদলে বাথরুম সেরে রেডি হয়ে নিন। দশটায় আমরা ব্রেকফাস্টে বসব।

কিচেন আর ডাইনিং রুম একতলায়। ব্রেকফাস্টের সময় ম্যানেজার রতনলাল দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালেন। ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, কিছু বলবে?

রতনলাল সেখানে দাঁড়িয়েই বললেন, বিন্ধ্যেশ্বর বলল কুকুরওয়ালা সালিম খান খবর পাঠিয়েছেন একটা ভালো জাতের অ্যালসেশিয়ান এখনই তিনি পাঠাতে পারেন। তাছাড়া তার খোঁজে একটা টেরিয়ারও আছে। আপনি বললে তিনি কালই সেটা নিয়ে আসবেন।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, ঠিক আছে। তুমি বিন্ধ্যেশ্বরকে এখনই পাঠিয়ে দাও। অ্যালসেশিয়ানটা আজই পেলে ভালো হয়।

রতনলাল চলে গেলেন।

আমি জিগ্যেস করলুম, সালিম খান কি কুকুর বেচাকেনার ব্যবসা করেন?

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, হ্যাঁ। ভদ্রলোক একটু ছিটগ্রস্ত। একসময় ভৈরবগড়ে ওঁর পূর্বপুরুষের জমিদারি ছিল। দেশভাগের পর ওঁদের ফ্যামিলির সবাই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। সালিম খানের বাবাও যান। বাড়িঘর যেটুকু ছিল, দেনার দায়ে বিক্রি করে বাঙালিটোলায় এক ভদ্রলোকের বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন। ভদ্রলোক কলকাতায় থাকেন। বাবার মৃত্যুর পর সালেম খানকেই তিনি কেয়ারটেকার বহাল করেন। ভদ্রলোকের চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ আছে। তাছাড়া তিনি দুর্ধর্ষ প্রকৃতির মানুষ। তাই বাড়িটা বেহাত হয়ে যায়নি। কিন্তু বাড়ির মালিকের টাকায় সংসার চলে না। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, ছোটবেলা থেকেই উনি কুকুর ভালোবাসেন। এখন বয়েস প্রায় চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। পাকাপাকি ভাবে বিলিতি কুকুরের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখনও ঐ নিয়েই আছেন।

বললুম, আপনার জনি আর টমিকে কি এই ভদ্রলোকই আপনাকে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। কুকুর দুটোর মৃত্যুতে খানসাহেবও খুব বিচলিত। গতকাল এসে খুব শোক প্রকাশ করে গেছেন।

জিগ্যেস করলুম, খানসাহেব তাহলে কুকুর দুটোর মৃত্যুর কারণও শুনেছেন।

হ্যাঁ, তবে মন্দির থেকে মূর্তি চুরির খবরটা ওঁকে বলা হয়নি। কুকুরের মৃত্যুর ব্যাপারে পুলিশ তদন্ত করতে এসেছে দেখে খানসাহেবের সিদ্ধান্ত, আমার কোনো। শত্রু ফার্মের ক্ষতি করতে চায়।

ব্রেকফাস্টের পর ক্যাপ্টেন সিংহের নির্দেশ মতো সুশীলা দুপেয়ালা কফি এনে দিল।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, তোমার মাইজি কিছু খেয়েছেন? সুশীলা বলল, খেয়েছেন। মাইজি কর্নেল সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য নীচে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু মাইজির শরীর কমজোর হয়ে গেছে। কর্নেল সাহবকে উনি উপরে যেতে বলেছেন।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, তুই গিয়ে বলবি কর্নেল সাহেব ফার্মের জমি দেখতে যাবেন। তারপর ফিরে এসে তার সঙ্গে দেখা করবেন।

কফি পানের পর দক্ষিণ দিকের লনে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্যাপ্টেন সিংহ দোতলায় গেলেন। দক্ষিণ দিকটায় পাঁচিল ছফুটের বেশি উঁচু নয়। তার উপর কাঁটাতারের বেড়া। ছোট গেটের মাথায় বোগেনভোলিয়ার ঝাড়। থোকা থোকা। লাল ফুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে গেটের কাছ থেকে বাইনোকুলারে ভেতরটা দেখছিলুম। দূরে শেষ প্রান্তে গমের ক্ষেতে আদিবাসী। মজুর-মজুরনিরা গম কাটছে। ডান দিকে সবুজ ভুট্টার ক্ষেত। এপ্রিলে ভুট্টা ফলতে শুরু করবে। বাঁদিকটায় সূর্যমুখীর ক্ষেত।

ক্যাপ্টেন সিংহ তার প্রায় ত্রিশ একর জমিতে শুধু পাম্প দিয়ে জলসেচ ছাড়া অন্য যন্ত্র ব্যবহারের পক্ষপাতী নন। রাসায়নিক সারও তিনি ব্যবহার করেন না। দেখতে দেখতে হঠাৎ বাইনোকুলারে ভেসে উঠল দুটো আউল বাটারফ্লাই। প্রজাপতি দুটো বাঁদিকে রঙ্গন ফুলের উপর এসে বসল।

তখনই আমার খেয়াল হল সঙ্গে প্রজাপতি ধরার নেটটা আনা উচিত ছিল। তাই দ্রুত ঘুরতেই ক্যাপ্টেন সিংহের সঙ্গে আমার প্রায় ধাক্কা লাগার উপক্রম। দেখলুম তার কাঁধে বন্দুক। তিনি বললেন, কী ব্যাপার?

বললুম, দুটো প্যাঁচা-প্রজাপতি অনুপ্রবেশ করেছে। এক মিনিট, আমি নেটটা নিয়ে আসি।

আমার থাকার ঘরে গিয়ে কিটব্যাগ থেকে নেটটা বের করলুম। জাপানি নেটটার স্টিক ছাতার বাঁটের মতো ভাজ করা থাকে। বোতাম টিপলে দূরত্ব। অনুসারে জালা ব্যবহার করা যায়।

ফিরে আসার পর দেখলুম গেট খুলে ফার্মের ঘাসে ঢাকা একটুকরো জমিতে ক্যাপ্টেন সিংহ দাঁড়িয়ে আছেন। এটা স্পষ্ট যে তিনি প্রজাপতি দুটোকে খুঁজছিলেন।

আমি গিয়ে তাকে বললুম, আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন। আমি প্রজাপতি দুটোকে জালে আটকাতে পারি কিনা দেখি।

প্রজাপতি ধরতে হলে নিঃশব্দে হেঁটে চলার উপযোগী যে জুতো চাই, তা আমার পায়ে আছে। এছাড়া তাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কিছু কৌশলও আছে। বিশেষ করে এই প্রজাতিরা খুব ধূর্ত। তাই আমি যে তাদের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি তা যেন ওরা টের না পায়। যে রঙ্গন ফুলের ঝোপে ওরা বসে আছে তার দূরত্ব প্রায় পঁচিশ মিটার। আমি একবার ডাইনে ভেষজ গাছের দিকে এগিয়ে গুঁড়ি মেরে। বসলুম, তারপর আবার সোজা এগিয়ে বাঁদিকে ঘাস ছেঁড়ার ভঙ্গি করলুম।

বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি না। এককথায় অনেক ছলচাতুরি করে রঙ্গন ঝোঁপটার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ নেট স্টিকটার বোতাম নির্দিষ্ট দূরত্বে জালটা খুলে যাওয়ার মতো করে টিপে দিলুম। আমি জানি, ওদের স্বভাব আপদকালে সোজা উপরে ওঠা নয়। তার বদলে ওরা বাঁদিকে পিছিয়ে গিয়ে উপরে ওঠে।

আমার এই সৌভাগ্য কল্পনাও করতে পারিনি। জালটা ঠিক ওদের পিছনেই বাঁদিকে খুলে গিয়েছিল। দুটো প্রজাপতিই জালের গোলাকার মুখ দিয়ে ভিতরে আটকে গেল। অমনি আরেকটা বোতাম টিপে জালের মুখটা বন্ধ করে দিলুম। প্রজাপতি দুটো চুপচাপ ভিতরে আটকে রইল।

ক্যাপ্টেন সিংহ সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এসেছিলেন। তিনি খুশি হয়ে বললেন, কর্নেল সরকার, মর্নিং শোজ দি ডে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনার পরের কাজগুলোতেও সাফল্য সুনিশ্চিত।

বললুম, এবার আমি অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা যেখানে রক্তবমি করে পড়ে ছিল, সেই জায়গাটা দেখতে চাই।

পূর্বের বাউন্ডারি ওয়ালের পাশ দিয়ে ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতে ক্যাপ্টেন সিংহ এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ফার্ম হাউসের চারদিকের দেওয়াল ছফুট উঁচু এবং তার উপর তারকাঁটার বেড়া। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে নানা রকমের ফুলের ঝোঁপ। একখানে ফুটদুয়েক চওড়া জলসেচের নালা। সেখানে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, বিন্ধ্যেশ্বর বা কেউ রক্তগুলো ধুয়ে ফেলেছে। পাঁচিলের তলায় ঐ যে জালি বসানো ড্রেন দেখছেন, ওখান দিয়ে বাড়তি জল বাইরে চলে যায়।

আমি হাঁটু মুড়ে সেখানে বসলুম। আমার কাঁধে প্রজাপতি ধরা জালের স্টিক এবং পিছনের দিকে জালে আটকানো দুটো প্রজাপতি। নালার মুখে লক্ষ করলুম পাখির একরাশ পালক। একটা পালক তুলে নিয়ে বুক পকেট থেকে আতস কাঁচটা বের করে (জালটা আনতে যাবার সময় বুদ্ধি করে এটা বুক পকেটে ভরে নিয়েছিলুম) পালকটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকলুম। খালি চোখে কিছু বোঝা যাবে না কিন্তু আমার এই ম্যাগনিফাইং গ্লাস অনেক অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে। দেখলুম রক্তের জমাট কণা পালকের গায়ে আঠার মতো সেঁটে আছে। আর পালকের কিছু কিছু অংশ কুঁকড়ে গেছে। আমার অভিজ্ঞতায় জানি বিষাক্ত কিছু খেলেই এরকম হতে পারে, যদিও পালকের লোমশ অংশে কোনো স্নায়ুকোষ নেই।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, কী বুঝলেন, কর্নেল সরকার?

উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, আপনার কুকুর জনি রক্তবমি করেনি। টমি রক্তবমি করে মারা গেছে। কিন্তু তার আগে এই দেখুন অনেকটা জায়গা জুড়ে টমি যন্ত্রণায় আর্তনাদ আর দাপাদাপি করেছে। ঐ দেখুন, ওপাশে ছেঁড়া ঘাসে টমির নখের আঁচড়।

ক্যাপ্টেন সিংহ খুঁটিয়ে ব্যাপারটা দেখার পর বললেন, আশ্চর্য! এগুলো আমাদের কারও চোখে পড়েনি। এমনকি পুলিশের চোখও এড়িয়ে গেছে। কর্নেল সরকার, এবার আশা করি বুঝতে পেরেছেন মরা শালিখ পাখিটা এখানেই কোথাও পড়ে ছিল। আমার ভেবে ভীষণ রাগ হচ্ছে, পাখিটা নিশ্চয় দিনের আলো থাকতেই মারা পড়েছিল অথচ এখান দিয়ে আমার লোকেরা আর আদিবাসী মজুর-মজুরনিরা নিশ্চয় চলাফেরা করেছে। তাদের কেন চোখে পড়েনি!

আমি তখন পাঁচিলের নর্দমার কাছ থেকে উপরের কাঁটাতারের বেড়া অবধি বাইনোকুলারে লক্ষ করছিলুম। এই যন্ত্রে কাঁটাতারগুলো প্রায় তিন-চার ইঞ্চি মোটা দেখাচ্ছে। বললুম, ক্যাপ্টেন সিংহ, আমি দেখতে পাচ্ছি কাঁটাতারের গায়ে এখানে-ওখানে লোমশ পালক লেগে আছে, যা পাখিদের পেটের দিকে থাকে।

ক্যাপ্টেন সিংহ চমকে উঠে বললেন, তার মানে বিষাক্ত প্রজাপতি খেয়ে মরা পাখিটাকে কোনো শয়তান ইচ্ছে করেই বাইরে থেকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমাদের কারও মাথায় এই সামান্য কাণ্ডজ্ঞানটুকুও ছিল না যে টমিকে তো সন্ধ্যার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি।

তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে। চলুন, ফেরা যাক।

ঘরে ফেরার পর কিটব্যাগ থেকে ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিকের জার বের করলুম। তারপর সরু চিমটে দিয়ে প্রজাপতি দুটোকে একে একে বের করে জারে ঢুকিয়ে দিলুম। জারটা প্রায় আট-নয় ইঞ্চি লম্বা। কাজেই প্রকাণ্ড দুটো প্রজাপতিকে লম্বালম্বি ঢুকিয়ে রাখা সম্ভব হল।

ক্যাপ্টেন সিংহ বন্দুকটা দুপায়ের ফাঁকে রেখে চাপা স্বরে বললেন, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

বলুন।

এমন কি হতে পারে না জনিকে বিষাক্ত প্রজাপতি খেয়ে মরে যাওয়া পাখি খেতে দেখেছিল আমারই ফার্মের লোকজন। তাদেরই কারও মাথায় টমিকে মারার জন্য

তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, সেভাবে একটা থিয়োরি নিশ্চয় খাড়া করা যায়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না মন্দির খোলার কৌশল শুধু মিসেস সিংহই জানেন।

হ্যাঁ। অপালা জানে। তবে আমার স্বভাবের কথা আপনি জানেন। মন্দির নিয়ে বা কোটি টাকা দামের বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কথা নয়। যদি বলেন, কৌশলটা জানতে আমার কি কোনোদিনই একটুও আগ্রহ হয়নি? আমি বলব একবার হয়েছিল। কিন্তু অপালা ধর্মের ব্যাপারে অন্ধ। সে বলেছিল আমার মা। তাকে বলে গেছেন যদি সে আমাকে কৌশলটা জানিয়ে দেয় তাহলে এক মাসের মধ্যে নাকি সে বিধবা হবে।

কথাটা বলার সময় ক্যাপ্টেন সিংহের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখতে পেলুম। তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার বললেন, এই ফার্ম হাউস ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আপনাকে বলেছিলুম ফার্মে আমি ভেষজ উদ্ভিদের চাষ করব, তা করেছি।

বললুম, হ্যাঁ। লক্ষ করলুম আপনি জাফরানেরও চাষ করেছেন। খাঁটি জাফরান আজকাল দুর্মূল্য।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, আমি এই জাফরান, যাকে বলা হয় ক্রোকাস স্যাটিভ্যাস জাতীয় উদ্ভিদ, তা আনিয়েছিলুম ইরান থেকে। ইরানে আগাছার মতো এইসব উদ্ভিদ দেখা যায়। মোগলাই রান্নায় জাফরান নাকি খাদ্যকে আরও সুস্বাদু করে।

এই সময় দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলুম সুশীলার কাঁধে হাত রেখে মিসেস অপালা সিংহ আমার ঘরে ঢুকছেন। তখনই উঠে দাঁড়িয়ে তাকে নমস্কার করলুম।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, আহা, তুমি আবার কষ্ট করে কেন নীচে এলে? এখনই কর্নেল সরকারকে নিয়ে আমি উপরে যেতুম।

অপালা বললেন, সকাল থেকে আমার সন্দেহ হচ্ছে তুমি যেন ইচ্ছে করেই আমার কাছ থেকে কর্নেল সাহেবকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছ।

মিসেস সিংহের কণ্ঠস্বরে তীব্র উত্তেজনা ছিল।

ক্যাপ্টেন সিংহ হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে। এই তো তুমি কর্নেল সাহেবকে কাছে পেয়ে গেছ। যতক্ষণ খুশি বাক্যালাপ করো। আমি ফার্ম হাউসে যাই।

অপালা রুষ্টমুখে বললেন, হ্যাঁ, তাই যাও। ঐ ফার্ম হাউসই দেখবে একদিন তোমার কী সর্বনাশ করে।

ক্যাপ্টেন সিংহ হাসতে হাসতে বন্দুক কাঁধে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। তারপর অপালা আমার মুখোমুখি বসে বললেন, সুশীলা, তুই কর্নেল সাহেবের জন্য এক পেয়ালা কফি দিয়ে গিয়ে তারপর নিজের কাজ করবি।

সুশীলা বেরিয়ে গেল। তখন অপালা খুব চাপা স্বরে বললেন, আমি ছাড়া কাউকেও বিশ্বাস করি না। আপনাকে আমি কতকগুলো কথা জানাবার জন্যই অধীরভাবে আপনার প্রতীক্ষা করছিলুম।…

.

সুশীলা কফি দিয়ে চলে যাওয়ার পর অপালা সিংহ যেন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। কতকটা আপনমনে তিনি শ্বাসপ্রশ্বাস ক্লিষ্ট কণ্ঠস্বরে বিড়বিড় করছিলেন– আমি আর এ বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করি না, একজনকেও না।

আমি চুপচাপ কফি পান করতে করতে তাঁর দিকে লক্ষ রেখেছিলুম। মনে হচ্ছিল ভদ্রমহিলা সত্যিই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত।

অপালা মুখ নিচু করে আঙুল খুঁটছিলেন। টের পাচ্ছিলুম মুখে উচ্চারণ না করলেও মনের ভেতর তার অনেক কথা উচ্চারিত হচ্ছে।

কফি শেষ করার পর একটু হেসে বললুম, আমার মনে পড়ছে চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধ আপনার সহ্য হয় না।

অপালা তখনই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। আস্তে বললেন, না, আপনি চুরুট খেতে পারেন। কারুণ আমি বুঝি চুরুট না টানলে আপনার মাথা কাজ করে না।

চুরুট ধরিয়ে সাবধানে অন্য দিকে হালকা ধোঁয়া ছেড়ে বললুম, সবই অভ্যাস। এনি ওয়ে, আপনি যা বলতে চান, এবার বলুন।

অপালা চাপা স্বরে বললেন, আজ সকালে যখন আপনি আর আমার স্বামী মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন আমি উপরের ঘরে আমার ব্যালকনিতে বসে ছিলুম।

হ্যাঁ, লক্ষ করেছিলুম।

সেই সময় আমার চোখে পড়েছিল নাথুলাল বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে এমন ভাবে দাঁড়িয়েছিল, তাকে আমি দেখতে পাচ্ছিলুম কিন্তু সে আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না। আপনাকে বলা উচিত গতকাল থেকে নাথুলালের হাবভাব আমার খুব সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।

জিগ্যেস করলুম, হাবভাব বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

অপালা আরও চাপা স্বরে বললেন, ওকে পিছন থেকে ডাকলেই চমকে উঠছে। যখন সে কোনো কথা বলছে, শুনেই মনে হচ্ছে ও যেন অসুস্থ।

হাসতে হাসতে বললুম, আমি শুনেছি পুলিশ নাথুলাল আর বিন্ধ্যেশ্বরকে খুব জেরা করেছে। এমনকী দুজনকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেন সিংহ পুলিশকে বাড়াবাড়ি করতে দেননি।

অপালা আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার স্বামীকে আমি চার্জ করেছিলুম। কারণ আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানি নাথুলাল আমাদের মন্দিরের পূজারী অশোকের সঙ্গে গাঁজা খায়। অশোকের কিছু বদনামও আছে।

বললুম, কথাটা শুনেছি। কিন্তু প্রশ্ন হল, মন্দিরের দরজা খোলার কৌশল আপনি ছাড়া অন্যের তো জানার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া দরজা খোলার গুপ্ত সংকেত রোমান অক্ষরে লেখা আছে। আমি অন্তত এটুকু বুঝতে পারি, ঐ অক্ষরগুলো দিয়ে কোনো বিশেষ শব্দ গড়ে উঠলে তবেই মন্দিরের দরজা খুলে যাবে।

অপালা সিংহের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। তিনি বললেন, আপনার প্রখর বুদ্ধির প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। তাই আপনার কাছে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। আপনার সিদ্ধান্ত সত্য।

বললুম, সেবার এসে আমি হরফগুলো লক্ষ করেছিলুম কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কিন্তু এবার এসে রোমান হরফগুলো দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে হাতল ডাইনে বাঁয়ে ঘুরিয়ে অক্ষরগুলোকে এদিক-ওদিক করে কোনো একটা শব্দ তৈরি করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল রাত্রিবেলায় নাথুলালের মতো লোকের পক্ষে এই কাজটা কি করা সম্ভব?

 অপালা বললেন, নাথুলাল ছোটোবেলা থেকে আমার শ্বশুর পরিবারে বড় হয়েছে। এমন কি হতে পারে না ভৈরবগড়ে আমাদের স্বামীর বাড়িতে থাকার সময় সে আড়াল থেকে আমার বা আমার শাশুড়ির হাতে মন্দিরের দরজা খোলা সে দিনের পর দিন লক্ষ করেছিল।

একটু হেসে বললুম, মিসেস সিংহ, আপনি একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন। এ বাড়ির দুটো সাংঘাতিক কুকুরের মৃত্যুর পরেই মন্দিরের বিগ্রহ চুরি গিয়েছে। নাথুলালকে কুকুরদুটো দিনে বা রাত্রে কোনো সময়েই বাধা দিত না। তাছাড়া কুকুরদুটো কীভাবে এবং কেন মারা পড়েছে তা তো আপনি জানেন।

অপালা মুখ নামিয়ে বললেন, প্রজাপতির গল্পে আমার বিশ্বাস নেই।

বুঝতে পারলুম যে কোনো কারণেই তোক এই ভদ্রমহিলার মানসিক অবস্থা এমন স্তরে পৌঁছেছে যেখানে সাধারণ বুদ্ধি আর যুক্তির কোনো স্থান নেই। প্যাঁচা-প্রজাপতি সম্পর্কে আমি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারতুম। কিন্তু এখন যা অবস্থা তাতে ওঁকে অন্য কিছু বোঝানো নিষ্ফল হবে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আমি চুরুটের ধোঁয়ার রিং পাকানোর চেষ্টা করছিলুম। পরপর দুটো রিং আমার মাথার উপর এলোমেলো হয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হল বিগ্রহ চুরির আগে অনেকদিন থেকেই কেউ কি ওঁকে নার্ভ সংক্রান্ত কোনো ওষুধ খাইয়েছিল? কারণ, পাঁচ বছর আগেকার স্মৃতি অন্তত এই মহিলা সম্পর্কে, আমার কাছে স্পষ্ট। তখন অবশ্য উনি যৌবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন, কিন্তু তাঁর হাসি, প্রতি মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে ওঠা, কখনো বালিকার মতো ছটফটে স্বভাব আমার মনে পড়ছে। পাঁচটা বছর যদিও একদিক থেকে দীর্ঘ সময়, তাই বলে অপালার মতো মহিলা এত বেশি বদলে যাবেন?

আমি মৃদু স্বরে বললুম, সংকোচের সঙ্গে একটা কথা জিগ্যেস করছি। যেন অন্যভাবে নেবেন না।

অপালা সিংহ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, বলুন। আমি কিছু মনে করব না।

বললুম, পাঁচ বছর পরে আপনার সঙ্গে আবার দেখা। এই সময়ের মধ্যে আপনি কি কোনো অসুখ-বিসুখে ভুগেছিলেন বা এখনও ভুগছেন?

অপালা একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, গত পাঁচ বছরে অসুখ-বিসুখ আমার হয়েছে। মানুষ মাত্রেই তা হয়। কিন্তু গতবছর অগাস্ট মাসে একটা ঘটনা ঘটেছিল। আপনার নিশ্চয় মনে আছে আমাদের একমাত্র সন্তান সুমন্ত্র আমেরিকার হিউস্টনে থাকে। তার আসার কথা ছিল সেপ্টেম্বরে। কিন্তু সুমন্ত্র বলেছিল আসতে পারবে না। কারণ সে এক বড়লোক আমেরিকান ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করে হনিমুনে যাবে। আমার স্বামী তখনই নিউ ইয়র্কে আমার দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আমার দাদা এক সপ্তাহ পরে খবর দিয়েছিলেন, সুমন্ত্র সত্যিই বিয়ে করেছে এবং একেবারে বদলে গেছে।

বললুম, আপনার ছেলের আমেরিকায় থাকার কথা আমি জানি। কিন্তু ক্যাপ্টেন সিংহ এবার কলকাতায় গিয়ে আমাকে তা বলেননি। গত পাঁচ বছরে তার কাছ থেকে মাঝে মাঝে আমি চিঠি পেয়েছি। আমাকে প্রতিবারেই তিনি এখানে আসতে বলেছেন, কিন্তু আমি সময় করে উঠতে পারিনি।

অপালা ভ্রূ-কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বিকৃত মুখে বললেন, আপনার বন্ধু আপনাকে এমন একটা পারিবারিক সর্বনাশের খবর কেন জানাননি বুঝতে পারছি না।

বললুম, গত এক বছরে ক্যাপ্টেন সিংহের কোনো চিঠি পাইনি। তাছাড়া যখন উনি দুদিন আগে কলকাতা গিয়েছিলেন, তখন অন্য একটা বিপদের সম্ভাবনা তাঁকে উদ্বিগ্ন রেখেছিল। তাই সুমন্ত্রের কথা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। অবশ্য আমি যদি তাকে জিগ্যেস করতুম, তিনি নিশ্চয় সুমন্ত্রের খবরটা আমাকে জানাতেন। এখানে আসার পরও তার যা মনের অবস্থা তাতে নিজের ছেলের কথা ভুলে থাকাই স্বাভাবিক। আবার বলছি, ভুলটা আমারই। এমন একটা পরিস্থিতিতে সুমন্ত্রের খবর জিগ্যেস করতে আমারও মনে ছিল না।

অপালা সিংহ হঠাৎ আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে খুব চাপা স্বরে বললেন, আপনার কি সত্যিই মনে হয়েছিল আমার স্বামী টমির মৃত্যুতেই বিগ্রহ চুরির সম্ভাবনা আঁচ করেছিলেন?

বললুম, হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন সিংহের এই স্বভাবটা আপনারও জানা-আমার চেয়ে বেশি করেই আপনার জানা যে তিনি মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করেন।

অপালা অবশ্য তখনই শান্তভাবে বললেন, হ্যাঁ, তার এই স্বভাবটা আছে। কিন্তু আমার খুব অবাক লাগছে টমির মৃত্যুর পর সে আমাকে এমন সর্বনাশের সম্ভাবনা সম্পর্কে কোনো আভাসই দেয়নি। হঠাৎ করে সে কলকাতা চলে গেল এবং যাবার। কয়েক মিনিট আগে শুধু বলে গিয়েছিল সে আপনার কাছে যাচ্ছে। তারপর তো যা ঘটবার তা ঘটে গেল। সে যখন ফিরে এলো, দেখলুম, আপনি তার সঙ্গে আসেননি। অবশ্য আমার সামনে আপনাকে সে টেলিফোন করেছিল। কর্নেল সাহেব, আমার স্বামীর এই আচরণ আমার কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে।

 দেখলুম ভদ্রমহিলা এবং আমি যেসব কথাবার্তা বলছি, তা থেকে বিগ্রহ চুরির তেমন কোনো সূত্রই বেরিয়ে আসছে না। এদিকে বেলা তখন প্রায় এগারোটা। এখনই সেজেগুজে নীলমাধব রায়ের বাংলোর ওদিকে আমার যাওয়ার খুবই দরকার। সুযোগ পেলে তার সঙ্গে আলাপও করতে চাই।

এইসব কথা ভেবে আমি বললুম, আপনার কাছে আরও কথা শোনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এখনই আমাকে একবার বেরুতে হবে।

অপালা সিংহ বললেন, ঠিক আছে। তবে আপনি আরেকটা কথা জেনে যান। নাথুলালকে পুলিশ চাপ দিলে সত্যকথাটা ঠিকই বেরিয়ে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

বললুম, দেখা যাক, কী করতে পারি। তবে আমাকে আরেকটা কথা আপনি স্পষ্ট করে বলুন। অশোক অর্থাৎ আপনাদের পূজারী যখন পূজা করতে আসত তখন আপনাদের তো মন্দিরের দরজা খুলতে হত। সেই সময় সে কি আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত?

অপালা দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বললেন, না। এই পরিবারের বংশানুক্রমিক নিয়ম আগে গৃহকত্রী গিয়ে মন্দিরের দরজা খুলবেন, তখন পূজারী দাঁড়িয়ে থাকবেন মন্দির-এলাকার বাইরে।

বলে অপালা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি একটু টলছে, দেখে আমি উঠে দ্রুত বাইরে গেলুম। দেখলুম সুশীলা বারান্দার এক কোণে হেলান দিয়ে বসে আছে। বললুম, তোমার মাইজিকে উপরে নিয়ে যাও, সুশীলা।

সুশীলা দ্রুত এগিয়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। অপালা তার কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে গেলেন।

ঘরে ঢুকে যখন আমি পোশাক বদলাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল মেয়েটি যেখানে বসেছিল সেখান থেকে এ ঘরের কথাবার্তা শোনা যায়। সুশীলা কি কারও হুকুমে ওখান থেকে আড়ি পেতেছিল?

এই সন্দেহটা হওয়ার কারণ অপালা তাকে নিজের কাজে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সে যায়নি। কেন?

পোশাক বদলে নিয়ে হান্টিং বুট পায়ে ঢোকালুম। এই এলাকায় সাপের উৎপাত আছে। এখন তাদের হাইবারনেশন পিরিয়ড শেষ। তারা এখন ক্ষুধার্ত।

প্যান্টের পকেটে আমার সিক্স রাউন্ডার রিভলবারের বুলেটকেস ভর্তি করে রাখলুম। তারপর পিঠে কিটব্যাগ এঁটে বেরিয়ে পড়লুম। বাংলোর সদর গেটের কাছে ড্রাইভার রঘুবীর দাঁড়িয়ে ছিল। সে সেলাম ঠুকে বলল, বেরোচ্ছেন স্যার? গাড়ির দরকার হলে বলুন।

বললুম, না রঘুবীর। আমি পায়ে হেঁটেই ঘুরব। ক্যাপ্টেন সিংহ তোমাকে নদীর ধারে জেলেদের কাছ থেকে মাছ আনতে বলেছিলেন। কী মাছ পেয়েছ?

রঘুবীর খুশি মুখে বলল, রোহিত মাছ স্যার। পাহাড়ি রোহিত। কলকাতার লোকেরা রুই মাছ বলে। কিন্তু আমাদের এলাকার মাছের স্বাদ কেমন তা তো আপনার মনেই আছে।

আছে। বলে আমি বেরিয়ে গেলুম।

নীচে মোরাম বিছানো প্রাইভেট রোড দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পিচরাস্তার মোড়ে পৌঁছলুম। ওখান থেকে পিচরাস্তাটা পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমি পূর্ব দিকে আগাছা ঢাকা মাঠ দিয়ে ফার্ম হাউসের সমান্তরালে দক্ষিণে এগিয়ে গেলুম। এরপর অনেকটা জায়গা –টু বড় বড় পাথরের চাই পড়ে আছে। জায়গাটা পেরিয়ে গিয়ে পূর্বে একটা শালবনের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকলুম। তারপর ভৈরব নদের দেখা মিলল। এখনও এই নদ কানায় কানায় ভরা। কারণ জলপ্রপাতের লেক থেকে এখনও প্রচুর জল আসছে। নদের ধারে ধারে বাঁদিকে অর্থাৎ উত্তরে বাঁধের পথে এগিয়ে চললুম। নীচে জেলেদের নৌকা দেখা যাচ্ছিল। একটা পিপুল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে বাংলোটা দেখতে থাকলুম। তারপর বাংলোর দিকে এগিয়ে গেলুম।

বাংলো বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই নীলমাধব রায়ের ডোবারম্যান কুকুরের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছিল।

 বাংলো বাড়িটা একটা ছোট্ট টিলার গায়ে। নদী থেকে বাড়িটার পেছন দিকের উচ্চতা তিরিশ ফুটেরও বেশি। ওদিকটা বড় বড় কালো রঙের গ্রানাইট পাথরে ঢাকা।

আমি কাছাকাছি গেছি, এমন সময় শর্টস এবং টি-শার্ট পরা এক ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি করজোড়ে তাকে বললুম, নমস্কার, মিঃ রায়।

ভদ্রলোকের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তিনি বললেন, আপনি কি বাঙালি, নাকি এদেশে এসে বাংলা শিখেছেন?

আমার চেহারা দেখে এই ভুলটা অনেকেই করে। বলে তার কাছাকাছি হলুম।

তিনি বললেন, আপনি কোথায় থাকেন?

তার প্রশ্নের জবাবে বুক পকেট থেকে আমার একটা নেমকার্ড বের করে তার হাতে দিলুম। তিনি বিড়বিড় করে পড়তে লাগলেন-কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নেচারোলজিস্ট। তারপর তিনি সহাস্যে বললেন, আমার নাম নীলমাধব রায়। আমারও আপনার মতো নেচারোলজির নেশা আছে। খুব খুশি হলুম আপনাকে দেখে। প্লিজ, আমার বাংলোয় আসুন।

.

বাংলো বাড়িটার গেট পশ্চিম দিকে। ভিতরে ঢুকতেই ডোবারম্যান কুকুরটা আমাকে ক্রমাগত ধমক দিচ্ছিল। একজন আদিবাসী যুবক মিঃ রায়ের ইশারায় তার গলার চেন ধরে পেছনের দিকে নিয়ে গেল। বারান্দায় বেতের চেয়ার এবং টেবিল পাতা ছিল। নীলমাধব রায় আমাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, সকালের দিকে ক্যাপ্টেন সিংহের ড্রাইভার রঘুবীর নদীতে জেলেদের কাছে মাছ কিনতে এসেছিল। তার কাছে কথায় কথায় শুনেছিলুম কলকাতা থেকে তার মনিবের একজন বন্ধু এসেছেন এবং তিনিও রিটায়ার্ড সামরিক অফিসার। কর্নেল। কাজেই আপনাকে বলা দরকার, আপনাকে দেখে আমার একটু ভুল হয়েছিল। যাক গে, যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে স্কচ হুইস্কি দিয়ে আপ্যায়ন করতে পারি।

বললুম, ক্ষমা করবেন মিঃ রায়, আমি কখনো যে ড্রিঙ্ক করি না তা নয়, তবে এখন অসময়।

মিঃ রায় বললেন, তাহলে চা বা কফি?

বললুম, ধন্যবাদ। আমি কফি খেয়েই বেরিয়েছি। এবার আমার পক্ষ থেকে আপনাকে বলা দরকার আপনার সঙ্গে আলাপ করবার উদ্দেশ্যেই আমি এদিকে আসছিলুম। ক্যাপ্টেন সিংহের ফার্মে কী ঘটেছে সম্ভবত আপনি শুনেছেন।

শুনেছি। ঘটনাটা খুব সাংঘাতিকই বলব। আমি বুঝতে পারছি না কোথা থেকে ঐ মারাত্মক প্রজাতির প্রজাপতি এখানে এসে জুটেছে। খুলেই বলি, আমি প্রজাপতি নিয়ে একটু আধটু চৰ্চা করি। খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে আমি বহু বছর বিজ্ঞানী ফাদার ওরুকটের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলুম। সায়েন্সে আমার একটা ডিগ্রি আছে। যাই হোক, তিনিই আমাকে প্রজাপতি বিষয়ে হাতেকলমে কিছুটা ট্রেনিং দিয়েছিলেন।

এবার একটু হেসে আমি বললুম, আপনাকে জানানো উচিত মনে করছি, আমিও কিছু কিঞ্চিৎ প্রজাপতি চর্চা করে থাকি।

মিঃ রায়ের মুখে চমক লক্ষ করলুম। তিনি বললেন, মাই গুডনেস! তাহলে তো আপনি ফাদার ওরুকটের মতোই একজন অভিজ্ঞ লেপিডস্টারিস্ট।

বললুম, হ্যাঁ। আপনিও যে তাই, তা আমি বাংলোয় ঢোকার সময় টের পেয়েছি।

মিঃ রায় আবার একটু চমকে উঠলেন। আস্তে বললেন, বাংলোর পেছন দিকে প্রজাপতিদের একটা ব্রিডিং গ্রাউন্ড আছে। সেই কাঁচের ঘরটা আপনার চোখে পড়েছে।

বললুম, তার আগে ঐ ফুলের ঝোপে কয়েকটা আউল বাটারফ্লাই আমার চোখে পড়েছে। ওগুলো কি আপনি ইচ্ছা করেই বাইরে ছেড়ে দিয়েছেন?

নীলমাধব রায় জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না, না। ঐ কয়েকটা প্রজাপতি কাঁচের ঘর থেকে আমারই ভুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। গত কয়েকদিন ধরে ওদের নেটে আটকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু পারছি না।

এই সময় একটি কমবয়সী আদিবাসী মেয়ে দুকাপ চা রেখে গেল। মিঃ রায় হাসতে হাসতে বললেন, এই মেয়েটির নাম ফুলমণি। ওর কাজ কেউ বাড়িতে এলেই তাকে চা দিয়ে আপ্যায়িত করা। আপনি চা না খেলে ফুলমণির মনে দুঃখ হবে। মেয়েটি বোবা ও কালা।

ফুলমণি আমার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিল। আমি চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিতেই সে ভিতরে চলে গেল।

মিঃ রায় চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আপনার চেহারার সঙ্গে ফাদার হেনরি ওরুকটের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। তাই ফুলমণি আপনাকে দেখে খুশি হয়েছে।

একটু পরে বললুম, ক্যালিগো অ্যাট্রেউস প্রজাতির এই প্রজাপতি আপনি নিশ্চয়ই ফাদার ওরুকটের সাহায্যেই সংগ্রহ করেছিলেন?

নীলমাধব রায় বললেন, আপনি ঠিক ধরেছেন। ফাদার যতবার বাইরে যেতেন ততবারই বিদেশি প্রজাতির প্রজাপতির দম্পতি সঙ্গে নিয়ে আসতেন। আমি তার। কাছ থেকেই এক দম্পতিকে উপহার পেয়েছিলুম। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার কাছ থেকেও কীভাবে পরের জেনারেশনের কয়েকটা প্রজাপতি পালিয়ে যায়। তাই ফাদার এলাকার আদিবাসীদের মিটিং ডেকে বলে দিয়েছিলেন কোথাও এই ধরনের প্রজাপতি দেখলেই তারা যেন মেরে ফেলে। কারণ বিশেষ করে পুরুষ প্রজাপতির পেটে সাংঘাতিক বিষ জন্মায়।

এরপর তিনি দীর্ঘক্ষণ প্রজাপতি নিয়ে ভাষণ দিয়ে গেলেন এবং আমাকে চুপচাপ ধৈর্যের সঙ্গে তা শুনতে হল। একসময় তাকে থামিয়ে দিয়ে বললুম, আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন ক্যাপ্টেন সিংহের দুটো কুকুর মারা পড়েছে, এখানেই ঘটনার শেষ নয়।

আমাকে থামিয়ে মিঃ রায় বললেন, জানি। ক্যাপ্টেন সিংহের মন্দির থেকে খুব দামি একটা বিগ্রহ চুরি গেছে। তবে আমার ধারণা তার দুটো কুকুরের মৃত্যু এবং বিগ্রহ চুরির মধ্যে সম্পর্ক না থাকতেও পারে। কর্নেল সরকার, বাইরের লোকের পক্ষে বিগ্রহ চুরি করা একেবারেই অসম্ভব। কারণ আমি শুনেছি তাঁদের মন্দিরের দরজা না ভেঙেই চোর বিগ্রহ চুরি করেছে। এও শুনেছি, মন্দিরের দরজা খোলার নাকি একটা বিশেষ কৌশল আছে যা মিসেস সিংহ ছাড়া কেউ নাকি জানেন না।

বললুম, আপনি তো সবই জানেন। সমস্যা হল আমি ক্যাপ্টেন সিংহের পরিবারে এমন একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনার সময়ই এসে পড়েছি। পাঁচ বছর আগে একবার এসে এ এলাকা থেকে দুটো বিরল প্রজাতির অর্কিড সংগ্রহ করেছিলুম। তখন অবশ্য এই প্রজাতির প্রজাপতি কোথাও দেখিনি।

নীলমাধব রায় বললেন, মঙ্গলডিহার কাছে একটা টিলা পাহাড়ের গায়ে গত সপ্তাহে একটা বিশেষ প্রজাতির অর্কিড ফুল ফুটিয়েছে দেখে এসেছি। কিন্তু ওখানে পৌঁছনোই কঠিন। মাউন্টেনিয়ারিং-এ ট্রেনিং না থাকলে কারও পক্ষে সেখানে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

চুরুট ধরিয়ে বললুম, আপনি নিশ্চয় ক্যাপ্টেন সিংহের বাড়িতে যাতায়াত করেছেন।

মিঃ রায় হাত নেড়ে বললেন, নাহ। ক্যাপ্টেন সিংহের সঙ্গে পরিচয় আছে বা তার ফার্মের লোকজনও নদীর দিকে আসে বলে তাদের চিনি। কিন্তু ক্যাপ্টেন সিংহ কেমন যেন মেজাজি মানুষ। তাছাড়া তার লোকেদের কাছেই শুনেছি তার স্ত্রী নাকি বাড়িতে বাইরের লোকদের সহ্যই করতে পারেন না।

বললুম, ক্যাপ্টেন সিংহের একমাত্র সন্তান আমেরিকায় থাকে। সে মেমসাহেব বিয়ে করেছে এবং দেশে ফিরতে চায় না। মিসেস সিংহের মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগা স্বাভাবিক। তাই তিনি নাকি চুপচাপ একলা থাকতেই ভালোবাসেন।

মিঃ রায় ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হেসে বললেন, সবই জানি। এনি ওয়ে, কর্নেল সরকার, আপনি তো একজন লেপিডস্টারিস্ট। আমি যদি আপনাকে অনুরোধ করি ঐ পাঁচটা পালিয়ে যাওয়া প্রজাপতিকে আপনি ধরে দিন, আমি নেট দিচ্ছি, আপনি কি তা করবেন?

বললুম, আপনি যখন বলছেন, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। আপনাকে নেট দিতে হবে না। আমার কাছে বিশেষ ধরনের জাপানি নেট আছে, যা অটোমেটিক প্রক্রিয়ায় কাজ করে।

মিঃ রায় একটু উত্তেজিতভাবে বললেন, তাই বুঝি! কোথায় আপনার নেট?

আমি কিটব্যাগে গুটিয়ে রাখা নেটটা বের করলুম। তারপর স্টিকের বোতাম টিপে টিপে নেটের দৈর্ঘ্য এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিলুম।

মিঃ রায় খুব খুশি হয়ে বললেন, বাঃ! এই ধরনের একটা নেট প্লিজ আমাকে যোগাড় করে দেবেন।

উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, দেব। এবার আমি আপনার পালিয়ে যাওয়া প্রজাপতিগুলোকে জালবন্দি করতে পারি কিনা দেখি।

বারান্দা থেকে নেমে সাবধানে পা ফেলে আজ সকালে যেভাবে ক্যাপ্টেন সিংহের ফার্মে দুটো প্রজাপতিকে ধরেছিলুম, এখানে আমাকে তার চেয়ে একটু বেশি ধূর্তামি করতে হল। বাউন্ডারি ওয়াল সংলগ্ন উঁচু ফুলের ঝোঁপটার পাশ দিয়ে আমি সোজা কয়েক পা এগিয়ে গেলুম। তারপর খুব আস্তে ডানদিকে ঘুরে দূরত্বটা। আন্দাজ করলুম। পাঁচটা অতিকায় প্রজাপতি সারবন্দি স্থির হয়ে বসে আছে। এটা ওদের বিশ্রামের লক্ষণ। ডানা দুটো প্রত্যেকেরই আঁকা ছবির মতো একেবারে স্থির। এরপর নির্দিষ্ট বোতামটি টিপে দিতেই স্টিকটা লম্বা হয়ে গিয়ে দলটার মুখের দিকে নেটের মুখটা প্রসারিত করল। অমনি এক ঝটকায় পাঁচটা প্রজাপতিকে নেটে ঢুকিয়ে বোতাম টিপে নেটের মুখ বন্ধ করে দিলুম।

নীলমাধব রায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, ও মাই গড, আপনি দেখছি সত্যিই একজন যাদুকর। প্লিজ, কর্নেল সরকার, এবার ওগুলোকে কাঁচঘরে ঢুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করুন।

বললুম, একটা পুরুষ এবং একটা স্ত্রী প্রজাপতি কিন্তু আমার পারিশ্রমিক মিঃ রায়।

আমার কোনো আপত্তি নেই।

এবার বাংলোর ডান পাশ দিয়ে এগিয়ে খড়ের ছাউনি দেওয়া কাঁচের একটা ঘর দেখলুম। আলো-হাওয়া যাবার ব্যবস্থা করা আছে। ভিতরে লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি অনেকগুলো জীর্ণ বাঁশ এবং কাঠ রাখা আছে। একটা দম্পতিকে রেখে। বাকি তিনটেকে একটা একটা করে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলুম। ভিতরে ঐ বাঁশ এবং কাঠগুলোতে অনেক লার্ভা বিভিন্ন পর্যায়ে বসে আছে। কয়েকটা প্রজাপতিও চোখে পড়ল।

এই সময় ডোবারম্যান কুকুরটার খুব হাঁকডাক শোনা যাচ্ছিল। মিঃ রায় চেঁচিয়ে বললেন, হারুয়া, ডনের কী হল?

সেই আদিবাসী যুবকটি বাংলোর ঘর থেকে বেরিয়ে তাকে শান্ত করতে থাকল। এই সময় আমার চোখে পড়ল প্রজাপতি ঘরের বাঁপাশে একটু তফাতে একটা ফুলের ঝোঁপ একটু কাৎ হয়ে আছে। গোড়ার মাটিটা ভিজে কাদা হয়ে আছে। বুঝতে পারলুম না একটা ফুলের ঝোঁপ কেন প্রায় ৬০° ঝুঁকে থাকবে।

মিঃ রায় বললেন, চলুন। সামনের বারান্দায় গিয়ে বসা যাক।

বললুম, না মিঃ রায়। যে প্রজাপতি দুটোকে আপনি উপহার দিয়েছেন তাদের রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া আমাকে এবার ক্যাপ্টেন সিংহের ফার্মে ফিরতে হবে।

মিঃ রায় বললেন, অর্কিডের খোঁজে যখন এসেছেন, তখন আশা করি। কয়েকদিন থাকবেন। মাঝে মাঝে আমার এখানে আড্ডা দিতে এলে খুশি হব। তাছাড়া আপনার কাছ থেকে প্রজাপতি সম্পর্কে আমার অনেক কিছু জানার আছে। তবে আসবার আগে টেলিফোন করে এলে ভালো হয়। এক মিনিট, আপনাকে আমার একটা নেমকার্ড এনে দিচ্ছি।

নীলমাধব রায় তাঁর নেমকার্ডটা এনে দিলে সেটা পকেটে রেখে আমি বেরিয়ে পড়লুম। আমার হাতে নেট স্টিকটা ততক্ষণে গুটিয়ে ছোটো করে নিয়েছি, জালের মুখটা বন্ধ আছে। এবার সোজা উত্তর-পশ্চিম কোণে ক্যাপ্টেন সিংহের পুকুরটা লক্ষ করে হাঁটতে থাকলুম।

.

যেতে যেতে এক স্থানে আমাকে বাধা পেতে হল। সামনেই মাঠটা বড়ো বড়ো পাথর ও ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি। নদী কাছাকাছি থাকায় পুরো মাঠটায় ইতস্তত জল জমে আছে। অগত্যা ডাইনে নদীর ধারে বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলুম। কিছুটা চলার পর নেহাৎ খেয়ালবশে পিছু ফিরে নীলমাধব রায়ের বাংলোটার দিকে তাকালুম। অদ্ভুত ব্যাপার, বাংলোর উত্তরদিকে পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বাইনোকুলারে আমার দিকে লক্ষ রেখেছেন।

এটা আমার পক্ষে বিরক্তিকর এবং অস্বস্তিকরও বটে। অবশ্য আমিও এভাবে বাইনোকুলারে অনেক কিছু দেখি। কিন্তু মিঃ রায় আমার মধ্যে কি কোনো সন্দেহজনক আচরণ লক্ষ করেছেন, তাই এভাবে আমাকে দেখছেন?

এই সন্দেহ শব্দটাই আমার কাছে চিন্তাযযাগ্য বিষয় হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পরে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাপ্টেন সিংহের ফার্ম হাউসের সংলগ্ন বাংলো বাড়ির পিছন দিকটায় পৌঁছলুম। পুকুরের পূর্ব পাড়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি কাঁটাতারের বেড়া। একখানে অনেকটা ফাঁক হয়ে আছে। বোঝা গেল এখান দিয়েই আদিবাসী ছেলেরা পুকুরে পদ্মফুল তুলতে নামে। সেই ফাঁক দিয়ে আমার এই প্রকাণ্ড শরীর গলিয়ে দেওয়ার দক্ষতা সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতাপ্রসূত। পুকুরপাড় ধরে ঝোঁপঝাড় ও গাছপালার আড়াল দিয়ে ঘাটের মাথায় গেলুম। তারপর দরজার কড়া নাড়ব নাকি ভাবছি, হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল এবং নাথুলাল একটা গাই গরুর গলার দড়ি ধরে বেরুচ্ছে দেখলুম।

আমাকে দেখে সে প্রথমে চমকে উঠেছিল। তার এই চমক সন্দেহযোগ্য নয়, কারণ হঠাৎ দরজা খুলে আমাকে তার দেখতে পাওয়ার কথা নয়। আমি একটু হেসে বললুম, তুমি গরুটাকে কোথায় বেঁধে রাখবে নাথুলাল? পুকুরপাড়ে তো ঘাস দেখছি না।

নাথুলাল বিনীতভাবে বলল, পুকুরপাড়ের নীচে ঘাসের জমি আছে স্যার।

 কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া?

সে গরু এবং বাছুরটাকে বের করে এনে বলল, উত্তর কোণে একটা দরজা আছে, স্যার।

কিন্তু পূর্ব দিকের বেড়ায় অনেকখানি জায়গায় ফঁক আছে। ওটা মেরামত করো না কেন?

নাথুলাল গরুর গলার দড়ি ধরে টানতে টানতে বলল, যতবার মেরামত করা হয়েছে, দেহাতি বাচ্চারা টানাটানি করে তা ঢিলে করে দিয়েছে। তাই ক্যাপ্টেন সাব রাগ করে আর মেরামত করেন না।

আমি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। তারপর দোতলার দিকটা দেখে নিলুম। কেউ নেই। এইবার মন্দিরের রেলিঙের শেষ প্রান্তে মন্দিরের দরজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রজাপতি ধরার জালটা নীচে রাখলুম। তারপর বুক পকেট থেকে নোটবই এবং কলম বের করে মন্দিরের দরজার হাতলের চারপাশে অক্ষরগুলো উপর থেকে ডানদিকে ঘুরে লিখতে লিখতে আবার উপরের জায়গায় পৌঁছলুম। লেখা হল–

EAXREDLNA

নোটবইটা পকেটে ভরে এবং জালটা তুলে নিয়ে বাংলোর বারান্দায় উঠলুম। তারপর আমার ঘরে ঢুকে টেবিলের উপর রেখে যাওয়া জারটার ভিতরে আগের মতো চিমটে দিয়ে জালে আটকানো দুটো প্রজাপতিকেই ভিতরে ঢুকিয়ে দিলুম। লক্ষ করলুম আগের প্রজাপতি দুটো একটুও নড়ল না। একসঙ্গে এত বড়ো চারটে প্রজাপতি জারের ভেতরে একটু ভিড় সৃষ্টি করল। কিন্তু কী আর করা যাবে। আমি কলকাতা ফিরে যাওয়া অবধি এরা হয়তো মরেই যাবে। তাতে অবশ্য আমার কোনো ক্ষতি নেই।

পিঠের কিটব্যাগ খুলে এবং গলা থেকে বাইনোকুলার ও ক্যামেরা বের করে টেবিলে রাখলুম। এই সময় কানে এলো বাংলোর সামনের দিকে কেউ ধরে যাওয়া কণ্ঠস্বরে তালে তালে গাইছে :

দম দমাদম মস্ত কলন্দার

আমি বেরিয়ে গিয়ে দেখি পোর্টিকোর তলায় একটা অদ্ভুত চেহারার লোক একটা প্রকাণ্ড কালো রঙের অ্যালসেশিয়ানের চেন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে-ই গানটা গাইছে। তার মাথার চুল সন্ন্যাসীদের মতো লম্বা, কিন্তু লালচে। গায়ের রঙ খসখসে তামাটে। খাড়া নাক। মুখে তেমনই লালচে রঙের গোঁফ আর দাড়ি। তার গায়ে একটা হাতকাটা লম্বা পাঞ্জাবি। পরনে লুঙ্গি।

ক্যাপ্টেন সিংহ আর রতনলাল উপরের ধাপে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে দেখে ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, আসুন, কর্নেল সরকার। এই হচ্ছে আচ্ছে ডগ সাপ্লায়ার সালিম খান। সালিম, ইনি আমার কলকাতার এক বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

সালিম খান একটু ঝুঁকে কপালে তিনবার হাত ঠেকিয়ে আমাকে কুর্নিশ করল। তারপর বলল, আপনি কি বাঙালি আছেন, কর্নেল সাব?

বললুম, হ্যাঁ।

সালিম খান বলল, আপনার চেহারা বিলাইতি আদমির মতো। হুজুর কর্নেল সাব, আমি কলকাত্তার জজসাব সুরঞ্জন সরকারের কোঠির কেয়ারটেকার আছি। এখন বুড়া জজসাব আর আসেন না। উনহির ছেলে, কখনও জামাই আসেন।

বললুম, খানসাহেব, ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে শুনেছি তুমি খানদানি ঘরের মানুষ। তুমি কি একা বাঙালি জজসাহেবের বাড়ি দেখাশোনা কর?

জি সাব। আমি কেয়ারটেকার আছি। লেকিন আমি পেডিগ্রিওয়ালা উঁচু জাতের কুত্তার কারবার করি। বলেই সে হেঁট হয়ে অ্যালসেশিয়ানটার গালে হাত বুলিয়ে বলল, দেমাক খারাপ করিস না, বেটা। তোকে কুত্তা বলি, লেকিন তোর সর কা অন্দর গোয়েন্দা পুলিশের মগজ আছে।

সালিম খান যে আমুদে লোক তা বোঝা যাচ্ছিল। বললুম, তোমার কুকুরের কি নাম রেখেছ খানসাহেব?

সালিম খান হাসতে হাসতে আবার সেই গানটা ধরল :

দম দমাদম মস্ত কলন্দার
তু হ্যায় ইহা কা শাহ সেকেন্দার।

তারপর সে ক্যাপ্টেন সিংহের দিকে তাকাল। বলল, ক্যাপ্টেন সাব, আমার শাহ সেকেন্দারকে চুপচাপ থাকতে বলেছি। তাই সে আনজান জায়গায় এলেও খামোশ আছে। তো এবার আপনার কাছে সেকান্দারকে জিম্মা দিয়ে আমি কোঠিতে যাব।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, আমি তোমার বাদশা সেকেন্দারকে আদর করতে গেলে সে রাগ করবে না তো?

সালিম খান বলল, হুজুর ক্যাপ্টেন সাব, কুত্তা আদমি চেনে। মালিককে একবার পরখ করেই বুঝতে পারে তার মালিক হওয়ার তাকত আছে কি না। আপনাকে আমি জনি আর টমিকে দিয়েছিলুম। তারা আপনার হাতের আদর খেয়েই বুঝেছিল আপনি ঠিক মালিক আছেন। এই লিন আপনার শাহ সেকেন্দারকে।

বলে সে হাতের চেনটা ক্যাপ্টেন সিংহকে দিয়ে কুকুরের গায়ে দুবার মৃদু থাপ্পড় মারল। ক্যাপ্টেন সিংহ তখনই সিঁড়ি বেয়ে নেমে কুকুরটার গলা জড়িয়ে ধরে কুকুরটার গালে গাল ঘষলেন। তারপর পিঠে কয়েকবার মৃদু থাপ্পড় মেরে বললেন, হ্যাল্লো আলেকজান্ডার! এখানে থাকতে চাও তো?

কুকুরটা তার বুকে মাথা ঘষতে থাকল। আর ঠিক এই সময় সদর দরজায় এসে দাঁড়ালেন মিসেস অপালা সিংহ। তিনি কান্নাজড়ানো গলায় বলে উঠলেন, কে আলেকজান্ডার বলল?

ক্যাপ্টেন সিংহ উঠে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন, অপালা, সালিম খান আমাদের জন্য এই কুকুরটা এনেছে। এর নাম সে রেখেছে শাহ সেকেন্দার। তাই আমিই একে আলেকজান্ডার নাম দিলুম। কারণ ফার্সিতে সেকেন্দার আলেকজান্ডারেরই নাম।

সালিম খান আবার ঝুঁকে মিসেস সিংহের উদ্দেশে তিনবার কপালে কুর্নিশ করল। তারপর বলল, মাইজি, আপনি ভি সাব সেকেন্দারকে একটু আদর করুন। দেখতে পাচ্ছেন সে আপনার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে আছে।

ক্যাপ্টেন সকৌতুকে বললেন, হাল্লো আলেকজান্ডার, যাও, তোমার মাইজির হাতের আদর খেয়ে এসো।

মিসেস সিংহ দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, না। আমি এখন কুকুর ছোঁব না। আর একটা কথা শোনো, কুকুরটার নাম সেকেন্দারই রাখো। ওকে যদি আলেকজান্ডার বলো, আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাব। বলে তিনি ভিতরের ঘরে অদৃশ্য হলেন।

ক্যাপ্টেন সিংহ ব্যাপারটা গ্রাহ্য করলেন না। কিন্তু আমি মিসেস সিংহের আচরণে অবাক হয়েছিলুম।

সালিম খান বলল, হুজুর ক্যাপ্টেন সাব, মাইজি যখন আমার নামই রাখতে চাইছেন, তাই-ই রাখুন।

ক্যাপ্টেন সিংহ চুপচাপ কুকুরটাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আদর করতে শুরু করলেন।

ম্যানেজার রতনলাল বললেন, খানসাহেব, তুমি চেকে পেমেন্ট নেবে, না ক্যাশ?

সালিম খান বলল, ঐ কোঠিতে ক্যাশ টাকা রাখার ঝামেলা আছে, ম্যানেজারবাবু। আমি আগের মতো চেকেই পেমেন্ট নেব।

রতনলাল ক্যাপ্টেন সাহেবের দিকে ঘুরে বললেন, স্যার, আমি তাহলে অফিসঘরে গিয়ে ওকে চেক দিয়ে দিচ্ছি।

ক্যাপ্টেন সিংহ শুধু বললেন, ঠিক আছে।

ম্যানেজারের সঙ্গে সালিম খান ফার্ম হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আমি বললুম, এক মিনিট খানসাহেব।

সালিম থমকে দাঁড়িয়ে বলল, বোলিয়ে কর্নিল সাব।

বললুম, নদীর ধারে একটা বাংলোতে একটা কুকুর দেখে এলুম। দেখে মনে হল ডোবারম্যান পিনচার।

সালিম খান বলে উঠল, ও অে আমারই সাপ্লাই আছে কর্নিল সাব। আমি ওর নাম রেখে ছিলুম চেঙ্গিজ খান। বাঙালিবাবুর সে নাম পছন্দ হয়নি। কী নাম। রেখেছেন জানি না।

বলে সে ম্যানেজারের সঙ্গে দক্ষিণ দিকের দরজা দিয়ে ফার্ম হাউসের ভিতরে চলে গেল।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, কর্নেল সরকার তো কুকুর পছন্দ করেন না।

বললুম, হ্যাঁ। ছোটবেলা থেকেই কুকুর দেখলেই আমার কেমন যেন আনক্যানি ফিলিং হয়। এনি ওয়ে! আপনি কুকুরটার নাম আলেকজান্ডার দিতে চেয়েছিলেন। ম্যাডামের তা পছন্দ নয়। এর কি কোনো কারণ আছে?

ক্যাপ্টেন সিংহ গম্ভীর মুখে বললেন, জানি না। গৃহদেবতা চুরি যাবার পর থেকে অপালা যেন ক্রমশ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। আবার একবার সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারকে খবর দিতে হবে।

বললুম, ডাক্তার যে সাইকিয়াট্রিস্ট, তা কি ম্যাডাম জানেন?

ক্যাপ্টেন সিংহ আস্তে বললেন, না। প্লিজ, আপনি যেন এ বিষয়ে মুখ খুলবেন না।

ক্যাপ্টেন সিংহ কুকুরটার চেন ধরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন,কত দূর ঘুরলেন?

বললুম, নীলমাধব রায়ের বাংলোয় গিয়েছিলুম। বেশ আলাপী লোক। তার কুকুরটাকেও দেখলুম। কিন্তু তিনি যে একজন লেপিডক্টারিস্ট, আপনি কি তা জানতেন না?

ক্যাপ্টেন সিংহ একটু অবাক হয়ে বললেন, না তো! তবে ওঁর একটা ল্যাব আছে। কী সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তা জানি।

একটু হেসে বললুম, আপনার জ্ঞাতার্থে বলছি, মিঃ রায় একজন প্রজাপতি বিশারদ শুধু নন, উনি রকমারি দুর্লভ প্রজাপতির ব্রিডিং গ্রাউন্ডও তৈরি করে রেখেছেন। আমার ধারণা ওঁর বাংলো থেকেই পাচা-প্রজাপতি আপনার ফার্ম হাউসে উড়ে এসেছিল। ভবিষ্যতেও যে আসবে না এর গ্যারান্টি নেই।

ক্যাপ্টেন সিংহ ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, এবার যদি আমার ফার্মে পাচা-প্রজাপতি দেখি, আমি সোজা গিয়ে ঐ লোকটাকে গুলি করে মারব।

হাসতে হাসতে বললুম, প্লিজ ক্যাপ্টেন সিংহ, উত্তেজিত হবেন না। আপনাকে অন্তত আমি যে কয়েকটা দিন এখানে আছি, মাথা শান্ত রাখতে হবে।

ক্যাপ্টেন সিংহ কুকুরটাকে নিয়ে দক্ষিণের বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলেন। তারপর বললেন, আমার মেজাজের জন্য আমি দুঃখিত কর্নেল সরকার। লাঞ্চের সময় বেলা একটা। আপনি একটু বিশ্রাম করে নিয়ে স্নান করুন। আমি আসছি।

আমি ঘরে গিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে একটা চুরুট ধরালুম। কারণ আমার মধ্যে, একটা চাপা উত্তেজনা এসেছিল। ধূমপান ছাড়া এটা কাটানো যাবে না।

মিসেস অপালা সিংহ কেন তার স্বামীর মুখে আলেকজান্ডার শব্দটা শুনে অমন। করে ছুটে এসেছিলেন? কেন তিনি অমন করে কান্নাজড়ানো কণ্ঠস্বরে কথা বলছিলেন?

প্রশ্নগুলো চুরুটের ধোঁয়ার রিং হয়ে আঁকাবাঁকা হতে হতে মাথার উপর মিলিয়ে যাচ্ছিল। একটু পরে আমি টের পেলুম, মিসেস সিংহের আলেকজান্ডার-কে আমার মাথার ভিতরে সহসা অন্য একটা প্রশ্ন চুরুটের ধোঁয়ার মতোই ভাঙচুর করে ফেলল। তখনই উঠে দাঁড়ালুম। সাড়ে বারোটা বাজে। একটায় লাঞ্চ। তার আগে বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আমাকে প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে।

ঘর থেকে বেরিয়ে মন্দিরের পাশ দিয়ে পুকুরঘাটের দরজার দিকে এগিয়ে। গেলুম। দরজাটা ভিতর থেকে কেউ বন্ধ করেনি। তার মানে, নাথুলাল এখনও। ফিরে আসেনি। দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে ঘাটের মাথায় দাঁড়িয়ে মন্দিরের পিছনে উঁচু বাউন্ডারি ওয়ালের মাথায় সেই দুটো দাগ খুঁটিয়ে দেখে নিলাম। বাচ্চা ছেলে বা বানরজাতীয় প্রাণীর হাতের আঙুলের দাগ মনে হয়েছিল। এখন দুটো দাগের মধ্যে তফাত অনুমান করলুম। একফুটের বেশি নয়।

এবার নীচের মাটিতে আমার পায়ের সামনে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালুম। আমি একটা ষাট ডিগ্রি কোণের কল্পনা করছিলুম। এক মিনিটের মধ্যেই পায়ের সামনে শুকনো ঘাসের ভিতর দুটো জায়গার মাটিতে গর্ত চোখে পড়ল। দ্রুত হাত দিয়ে মেপে নিলুম। ঠিক একফুট তফাতে এক/দেড় ইঞ্চি গভীর গর্ত হয়ে আছে। তাহলে একটা সমাধান বেরিয়ে আসছে। হ্যাঁ, আট/নফুট লম্বা এবং ফুটখানেক চওড়া একটা মই দেওয়ালে লাগানো হয়েছিল।

তৃপ্তিতে জোরে শ্বাস ছাড়লুম। আমার প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে গেছি। এখানে মই ব্যবহারের একটাই কারণ থাকা উচিত। তা হল কোনো একটা জিনিস ওপার থেকে তুলে নেওয়ার জন্য কেউ মইয়ের ডগায় উঠেছিল। তাছাড়া আর কোনো কারণই ব্যাখ্যা করে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, জিনিসটা আর কিছুই নয়, প্রাচীন মন্দিরের প্রাচীন বিগ্রহ সেই বিষ্ণুমূর্তি।

এরপর আমি কাঁটাতারের বেড়া, ঝোঁপঝাড় এবং গাছপালার ফাঁক দিয়ে নাথুলালকে খুঁজলুম। গাই গরু নীচের জমিতে আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। আর বাছরটা ছোটাছুটি করে খেলা করে বেড়াচ্ছে। একটু এগিয়ে দক্ষিণে মিঃ রায়ের বাংলোর দিকে তাকালুম। বাইনোকুলারটা আনলে ভালো হত, কিন্তু দুপুরের উজ্জ্বল রৌদ্রে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। নদীর ধারের বাঁধটাও খুঁটিয়ে দেখলুম। কোথাও কোনো জনমানুষ নেই।

এবার দ্রুত দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে কপাট দুটো ভিতর থেকে হুড়কো দিয়ে বন্ধ করে দিলুম। সেই সময় চোখে পড়ল এই দরজায় ভিতর থেকে তালা লাগানো হয়। একটা কড়ায় বন্ধ তালাটা ঝুলছে।

তারপর যেন নেশার ঘোরে বাংলোর বারান্দার নীচে দিয়ে উত্তর প্রান্তে আকাশিয়া, শিরীষ এবং অশোক গাছের ছায়ায় একতলা দুটো ঘরের দিকে এগিয়ে গেলুম। আমি পাঁচ বছর আগে এসে দেখে গিয়েছিলুম এই দুটো ঘরের একটা ঘরে নাথুলাল অন্যঘরে বিন্ধ্যেশ্বর থাকে। আর ড্রাইভার রঘুবীর থাকে পশ্চিমে গেট সংলগ্ন গ্যারাজ ঘরে। আমি একতলা ঘরের বারান্দায় উঠলুম। তারপর নাথুলালের ঘরের দরজা ভেজানো আছে দেখলুম। বিন্ধ্যেশ্বরের ঘরটাও তাই। আমি নাথুলালের ঘরে ঢুকে পড়লুম। একপাশে একটা খাঁটিয়া আছে। অন্যপাশে একটা বেঞ্চের ওপর টিনের সুটকেস আর কাপড়ের পুটলি রাখা আছে। কিছু না ভেবেই আমি তার বিছানার বালিশ তুলে সেটা পরীক্ষা করতে থাকলুম। ওয়াড়ের ভিতরে কী একটা শক্ত চৌকা জিনিস হাতে ঠেকল। সেটা বের করে দেখি একটা বাঁধানো খাতা। প্রথম কয়েকটা পাতায় হিন্দিতে দোঁহা বা গান লেখা আছে মনে হল। নাথুলালের হাতের লেখা পড়া খুব কঠিন। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা পাতায় চোখ পড়তেই আমি চমকে উঠলুম। এটা কি গান নাকি কোনো ধাঁধা? হিন্দি হরফগুলো পড়তে আমার কয়েক মিনিট সময় লাগল–

দো সাত এক
তিন নও আট
ছে পাঞ্চ চার

কিছু না ভেবেই বুক পকেট থেকে নোটবই বের করে বাংলা হরফে শব্দগুলো টুকে নিলুম। তারপর খাতাটা বালিশের ভেতর তেমনি করে ভরে বিছানার মাথায় বালিশটা যেভাবে রাখা ছিল সেভাবেই রেখে দিলুম।

ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে সাবধানে বারান্দা থেকে নেমে এলুম এবং বাংলোর বারান্দায় উঠে সোজা গিয়ে আমার ঘরে বসে পড়লুম।

দেখলুম প্রচণ্ড ঘেমে গেছি। আজ আমার স্নানের দিন নয়। কিন্তু জামা খুলে রেখে সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকে রগড়ে মুখ এবং ঘাড়ে জল দিলুম। তোয়ালেতে মুছে দাড়ির জল ঝাড়তে ঝাড়তে টের পেলুম আমার মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। সেই শার্টটাই পরে নিয়ে ফিটফাট হয়ে সোফায় বসে হেলান দিলুম।

ঘড়িতে বারোটা পঞ্চাশ বাজে। এতক্ষণে ক্যাপ্টেন সিংহ নতুন কুকুরটার চেন ধরে টানতে টানতে বারান্দায় এসে উঠলেন। তারপর পর্দার ফাঁকে মুখ গলিয়ে বললেন, আমার আলেকজান্ডার-স্যরি, সেকেন্দার খুব শিক্ষিত কুকুর। আপাতত ওকে যতটা শান্ত ভেবেছিলাম তা নয়। আপেল বাগিচায় বানরেরা হানা দিয়েছিল।

ওর গলার চেন খুলে নিতেই সেকেন্দার আপেল বাগিচার দিকে ছুটে গিয়েছিল এবং ওর প্রচণ্ড ধমক খেয়ে বানরগুলো কাটাতারে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে পালিয়ে গেল। আমি সেকেন্দারের খাওয়ার ব্যবস্থা করেই আসছি। ঠিক একটায় লাঞ্চে বসব।

লাঞ্চে বসতে অবশ্য পাঁচ-সাত মিনিট দেরি হয়েছিল। সেই সময় ডাইনিং রুমের দরজা দিয়ে দেখলুম নাথুলাল সদর গেট দিয়ে ঢুকছে। রোদে ঘেমে মুখটা বিকৃত। সে রঘুবীরের উদ্দেশে বলল, পুকুরঘাটের দরজা আটকে দিল কে? এই রোদে আমাকে অতটা পথ ঘুরে আসতে হল। তুমি তো দিব্যি খেয়েদেয়ে শুয়ে আরাম করছ। অত ডাকাডাকি করলুম, বাড়ির কারো কানে যায়নি?

রঘুবীর বলল, তোমার জিগরি দোস্ত বিন্ধ্যেশ্বরকে ডাকলেই পারতে।

 বিন্ধ্যেশ্বরকেও ডেকেছিলুম। সে যে শ্মশানে গেছে তাতে ভুল নেই।

আরও কী সব কথা বলতে বলতে নাথুলাল ফুল বাগিচার পেছন দিয়ে তার ঘরের দিকে চলে গেল।

ক্যাপ্টেন সিংহ একটু হেসে বললেন, সুশীলা, নাথুলালকে জব্দ করতে নিশ্চয় তুই-ই পুকুরঘাটের দরজা বন্ধ করে রেখেছিস।

সুশীলা গম্ভীর মুখে বলল, না সাব। আমি ওদিকে কখন যাব? আমি মা-জিকে দোতলায় স্নান করিয়ে খাওয়াচ্ছিলুম। কারও ডাকাডাকি আমি শুনিনি।

ক্যাপ্টেন সিংহ হাসতে হাসতে বললেন, কর্নেল সরকার, আমার ফ্যামিলিতে সবাই, এমন কী মজুর-মজুরনিরাও নাথুলালকে নিয়ে তামাশা করে। একটুতেই চটে যায় কিনা তাই ওকে এইসব তামাশা সহ্য করে চলতে হয়।

বললুম, সেটা স্বাভাবিক।

.

লাঞ্চের পর ক্যাপ্টেন সিংহ আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোতলায় তার ঘরে বিশ্রাম করতে গেলেন। আমি সোফায় হেলান দিয়ে বসে চুরুট টানতে টানতে আমার খুদে নোটবইয়ের পাতা উল্টে নাথুলালের ছড়া অথবা ধাঁধাটার ওপর চোখ রাখলুম। একটু পরে ওটাকে আমি বাংলায় রূপান্তরিত করলুম :

দুই সাত এক
তিন নয় আট
ছয় পাঁচ চার

এরপর ওগুলো সংখ্যায় রূপান্তরিত করলুম :

২৭১৩৯৮৬৫৪

আমার মাথার ভেতর ক্রমে যেন একটা বন্ধ দরজার কপাট খুলে যাচ্ছিল। নোটবইটা আবার পকেটে ভরে চোখ বুজে নীলমাধব রায়ের বাংলোর ভেতরটা দেখতে থাকলুম। প্রজাপতির ব্রিডিং গ্রাউন্ড খড়ের চালে ছাওয়া। সেই ঘরটা এবং ষাট ডিগ্রি ঝুঁকে থাকা ফুলের ঝোঁপটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। হঠাৎ যেন দেখতে পেলুম খড়ের চালাঘরটার পাশে একটা বাঁশের মই রাখা আছে। আবার সেই ষাট ডিগ্রি অবস্থান।

চুরুট শেষ হয়ে গেলে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে ফার্ম হাউসে ঢোকার সেই দরজা দিয়ে এগিয়ে ডান দিকে ম্যানেজার রতনলালের অফিসের দিকে তাকালুম। রতনলাল চেয়ারে বসে একটু ঝুঁকে কী সব লিখছেন। সেবারও এসে দেখেছিলুম মানুষটি খুব পরিশ্রমী। পাশের ঘরগুলো গোডাউন এবং চালাঘরগুলো নানা রকম ফসলের বীজ রাখার জায়গা।

মুখ তুলে আমাকে দেখতে পেয়ে রতনলাল বললেন, স্যার কি আবার তদন্তে বেরিয়েছেন?

বললুম, না মিঃ লাল, আপনার অফিসে সেবার টেলিফোন দেখেছিলুম। আমার একটা টেলিফোন করা দরকার।

রতনলাল ব্যস্ত হয়ে উঠলেন–টেলিফোনটা আছে, স্যার। আপনি আসুন।

তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি তাকে বসতে ইশারা করে পাশে একটা চেয়ারে বসে বললুম, ক্যাপ্টেন সিংহ এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাই আপনার এখানে চলে এলুম।

কলকাতা থেকে আসার সময় এস. পির কাছে আমি ভৈরবগড় থানার অফিসার-ইন-চার্জের নাম্বার নিয়ে এসেছিলুম। বুক পকেট থেকে খুদে নোটবই বার করে নাম্বারটা দেখার পর ডায়াল করলুম। ভারী গলায় সাড়া এল-নমস্তে, ভৈরবগড় পুলিশ স্টেশন।

বললুম, ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

আপনি কে বলছেন?

আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কলকাতা থেকে ক্যাপ্টেন রামশরণ সিংহের ফার্মে বেড়াতে এসেছি।

নমস্তে নমস্তে, কর্নেল সাহেব। আমি ওসি যোগীন্দ্র রাও। আমি স্যার ঠিক চারটেয় আপনার কাছে যাব বলেছিলুম। ক্যাপ্টেন সাব কি আপনাকে বলেননি?

বলেছেন। কিন্তু আপনি তিনটেতে এলে ভালো হয়। আর একটা কথা। এবেলা আপনার থানায় যা ফোর্স আছে তা কি কোনো জায়গায় রেইড করার পক্ষে যথেষ্ট?

হ্যাঁ স্যার। রিজার্ভড ফোর্স একটু বেশি পরিমাণেই রাখতে হয় আমাদের। কারণ বুঝতেই পারছেন এলাকায় খুনি ডাকাত ছাড়াও ইদানিং জঙ্গীদের উৎপাত আছে। ফোর্স কখন লাগবে বলুন, স্যার।

সন্ধ্যা, সাতটা নাগদ।

 ঠিক আছে, স্যার। আমি কি একাই তিনটেয় যাব?

হ্যাঁ। আপনি এখান থেকে টেলিফোনে কোনো অফিসারকে ঐ সময় ফোর্স পাঠাতে বলবেন। কোথায় আমরা হানা দেব তা আপনাকে এখানে এলে বলব। আচ্ছা, রাখছি।

রিসিভার রেখে দেখি ম্যানেজার রতনলাল তীক্ষ্ণদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি একটু হেসে বললেন, তাহলে কি আপন সিংহ ফ্যামিলির হারানো বিগ্রহের খোঁজ এখানে এসেই পেয়ে গেছেন?

উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, বিগ্রহের খোঁজ পেয়েছি কি না আমি নিজেই জানি না। তবে কাজটা যারা করেছে তাদের শনাক্ত করতে পেরেছি।

কথাটা বলে আমি আমার ঘরে ফিরে এলুম। ঘড়ি দেখলুম দুটো বেজে সতেরো মিনিট। তিনটে বাজতে এখনো তেতাল্লিশ মিনিট বাকি। অঙ্কটা কষে ফেলতে হাতে যথেষ্ট সময় আছে। আমি কিট ব্যাগ থেকে একটা প্যাড বের করে নিলুম। তারপর জানলার কাছে একটা টেবিলে রেখে অঙ্ক কষা শুরু করলুম। লিখলুম :

EAXREVLNA

তার নীচে লিখলুমঃ

২৭১৩৯৮৬৫৪

বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমার আঁকজোখ চলতে লাগল। তারপর আমি চেয়ারে হেলান দিলুম। এই সময় দরজার বাইরে থেকে সুশীলা মৃদু স্বরে বলল, আমাকে মাপ করবেন, কর্নেল সাহেব, আপনি খাওয়ার পর কফি খান, তাই আমাকে মাইজি জিগ্যেস করলেন আপনাকে কফি দিয়েছি কিনা? ভুলে গেছি শুনে মাইজিও খুব বকলেন।

প্যাডটা টেবিলে উপুড় করে রেখে একটু হেসে বললুম, তাই কি তুমি এখন কফি নিয়ে এসেছো?

সুশীলা কফির পেয়ালা হাতে ঘরে ঢুকে ম্লান হেসে বলল, নাথুলাল আমার সঙ্গে খেতে বসে ঝগড়া করছিল। তাই কথাটা ভুলে গিয়েছিলুম।

অপ্রত্যাশিতভাবে এখন এই অমৃত পানীয় পেয়ে পরম তৃপ্তিতে বললুম, নাথুলাল খুব বদরাগী লোক, তাই না?

সুশীলা মুখ নামিয়ে বলল, পুকুরঘাটের দিকে দরজা নাকি আমিই ইচ্ছে করে বন্ধ করে রেখে ওকে কষ্ট দিয়েছি। তাই আমাকে বকাবকি করছিল।

বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি তারিয়ে তারিয়ে কফি পান করতে থাকলুম। কফি শেষ করার পর আরেকটা চুরুট ধরিয়ে টানতে থাকলুম। সময় যেন কাটতে চায় না। কিছুক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন সিংহ দরজার বাইরে থেকে সাড়া দিয়ে ভেতরে এলেন। সোফায় বসে। তিনি বললেন, থানা থেকে ওসি মিঃ রাও এইমাত্র আমাকে ফোন করেছিলেন। উনি বললেন আপনি নাকি ওঁকে তিনটেয় এখানে আসতে বলেছেন। আপনি কি ম্যানেজারের অফিস থেকে ফোন করেছিলেন?

বললুম, হ্যাঁ। আপনার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনি।

ক্যাপ্টেন সিংহ আমার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করছি। আপনাকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে।

বললুম, আমার মতোই আপনার সামরিক জীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতা অটুট আছে দেখছি। আমি এই জিনিসটাকে বলি ইনটুইশন।

ক্যাপ্টেন সিংহ হেসে উঠলেন, ঠিক বলেছেন, ইনটুইশন। আমার মনে হচ্ছে আপনি কিছু একটা আবিষ্কার করেছেন।

একটু হেসে বললুম, হ্যাঁ। আলেকজান্ডার।

ক্যাপ্টেন সিংহ যেন প্রচণ্ড চমকে উঠলেন। বললেন, আলেকজান্ডার? কী ব্যাপার?

আমি ঘড়ি দেখে বললুম, ওসি আসতে এখনও মিনিট পনেরো দেরি আছে। ম্যাডাম কি তার ঘরে বিশ্রাম করছেন?

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু আপনি–

তার কথায় বাধা দিয়ে বললুম, আপনি এখনই গিয়ে নাথুলালকে কোনো কাজে বাইরে পাঠিয়ে দিন। আর বিন্ধ্যেশ্বর তার ঘরে থাকলে

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, সে ফার্মের ভিতর গমের ক্ষেতে কাজ করাচ্ছে।

উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, তাহলে নাথুলালকে বরং অন্য কোথাও না পাঠিয়ে পুকুরের উত্তর কোণে যেখানে ও গাইগরুটা বেঁধে রেখে এসেছে, সেখানে গিয়ে গরুটাকে আনতে বলুন।

ক্যাপ্টেন সিংহ বিস্মিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পূর্বের বারান্দা দিয়ে তাকে যেতে দেখলুম। এবার আমি টেবিল থেকে আঁক কষা প্যাডের কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে ভাঁজ করে বুক পকেটে ঢোকালুম এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেলুম। পূর্বের বারান্দায় গিয়ে দেখলুম নাথুলাল তার ঘর থেকে বেরিয়ে মন্দিরের সামনের দিক দিয়ে পুকুরঘাটের দরজায় গেল। এবং দরজাটা খুলে সে বাইরে চলে গেল।

আর হাতে বেশি সময় নেই। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ক্যাপ্টেন সিংহকে বললুম, চলুন। আপনাকে আলেকজান্ডার দেখাচ্ছি। আমিও আপনার মতো নাস্তিকই বলতে পারেন। অবশ্য আমার ঈশ্বর প্রকৃতি। কাজেই আমি জুতো পায়েই মন্দিরের বারান্দায় উঠব। আপনিও আমার পাশে থাকবেন।

৪৪৩৮ রেলিঙের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দুজনেই মন্দিরের বারান্দায় উঠলুম। তারপর তাকে চাপা স্বরে বললুম, লক্ষ করুন দরজার হাতলের চারদিকে বৃত্তাকারে এই রোমান হরফগুলো লেখা আছে। হাতলের গায়ে তীর চিহ্নটা দেখুন। চিহ্নটা যেখান থেকে আছে সেখান থেকে ডান দিকে ক্রমশ খোদাই করা অক্ষরগুলো দেখুন।

EAXREDLNA

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, তারপর? বললুম,

দুই সাত এক
তিন নয় আট
ছয় নয় চার

ক্যাপ্টেন সিংহ অধীর হয়ে বললেন, বুঝলুম না!

আমি হাতলটা ঘুরিয়ে প্রথমে দুনম্বর অক্ষর A-কে E-র জায়গায় রাখলুম। এরপর সাত নম্বর অক্ষর L-কে ডানদিকে হাতল ঘুরিয়ে A-এর পাশে বসালুম। তারপর হাতল ঘুরিয়ে এক নম্বর অক্ষর E-কে L-এর পাশে টেনে আনলুম। এভাবে তিন নম্বর অক্ষর X-কে E-র পাশে দাঁড় করালুম। তারপর হাতল ঘুরিয়ে ননম্বর অক্ষর A-কে ঘুরিয়ে X-এর পাশে দাঁড় করালুম। হাতল ঘুরিয়ে আট নম্বর অক্ষর N-কে A-এর পাশে রাখলুম। এরপর ছনম্বর অক্ষর D-কে N-এর পাশে রাখলুম। পাঁচ নম্বর অক্ষর E-কে ঘুরিয়ে D-এর পাশে রাখলুম এবং হাতল ঘুরিয়ে চার নম্বর অক্ষর R-কে E-এর পাশে দাঁড় করিয়ে দিলুম।

ক্যাপ্টেন সিংহ রুদ্ধশ্বাসে বললেন, মাই গুডনেস ALEXANDER হয়ে গেল যে!

দরজায় একটা চাপা ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছিল। তারপরই নিঃশব্দে দুদিকের লোহার কপাট দুটো সরে গেল। মন্দিরের ভিতর উঁচু কালো রঙের পাথরের বেদি শূন্য পড়ে আছে।

ক্যাপ্টেন সিংহ উত্তেজনায় আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন।

বললুম, আর দেরি নয়। দরজা বন্ধ করে দিই।

হাতল ধরে একটা কপাট টানতেই আরেকটা কপাট এসে দুটো কপাটই একসঙ্গে জোড়া লেগে গেল।

ক্যাপ্টেন সিংহের হাত ধরে তাকে টেনে নীচে নামালুম। তারপর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বাংলোর বারান্দায় উঠলুম। আমার ঘরের দিকে যেতে যেতে একবার ঘুরে দেখলুম নাথুলাল এতক্ষণে গরুর দড়ি টেনে ধরে ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। আর দুমিনিট দেরি হলেই সে ব্যাপারটা দেখে ফেলত।

আমার ঘরে গিয়ে ক্যাপ্টেন সিংহ ক্লান্তভাবে সোফায় বসে মৃদু স্বরে বললেন, আমি কোনো দিনই ঐ অক্ষরগুলো কী ছাইপাঁশ খোদাই করা আছে, তাকিয়ে দেখিনি। অবশ্য বিগ্রহের বাজারদর সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল। তাই এদিকটায়, ওদিকটায় সারারাত উজ্জ্বল আলো জ্বালানো থাকতো।

বললুম, পরশু রাত্রে যখন আপনার টমি রক্তবমি করে মারা যাচ্ছিল, তখন সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সেই সুযোগে কেউ বিগ্রহ চুরি করেছিল।

ক্যাপ্টেন সিংহ তেমনই ক্লান্ত স্বরে বললেন, কে চুরি করতে পারে! বাইরের কেউ তো আপনার মতো এমন বুদ্ধিমান নয় যে ঐ রোমান হরফের ধাঁধার জট ছাড়াতে পারবে। নতুন পূজারী অশোক দেবশর্মা তো লেখাপড়াই জানে না। বাবার কাছে মুখে মুখে শেখা মন্ত্র পড়ে পুজো করে।

এই সময় রঘুবীর দরজার বাইরে সাড়া দিয়ে বলল, স্যার, থানা থেকে ওসি সাহেব এসেছেন।

আমি বললুম, রঘুবীর, তুমি ওসি সাহেবকে এই ঘরে নিয়ে এসো। আর তোমার মেয়ে সুশীলাকে বলো আমাদের জন্য তিন পেয়ালা কফি শিগগির-যেন পাঠিয়ে দেয়।

.

ও সি যোগীন্দ্র রাওয়ের কণ্ঠস্বর টেলিফোনে শুনে মনে হয়েছিল রাশভারী মধ্যবয়সী মানুষ। কিন্তু তিনি যখন ঘরে ঢুকে নমস্কার করলেন, তখন আমি বুঝতে পারলুম আমার সব ধারণাই যে নির্ভুল হবে এমন নয়। যোগীন্দ্রকে বয়সে তরুণই বলা চলে। গায়ের রঙ ফর্সা এবং গড়ন ছিপছিপে। কিন্তু তার শরীর ঘিরে যে বলিষ্ঠতা আঁচ করলুম তা একটা শিকারি চিতাবাঘের। হাসিখুশি চেহারার এই তরুণটি এই বয়সেই অফিসার-ইন-চার্জ হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কৃতিত্ব আছে। বিশেষ করে ভৈরবগড়ের মতো থানায় যখন তাকে কর্তৃপক্ষ বহাল করেছেন। ক্যাপ্টেন সিংহ তার কাঁধে হাত রেখে সহাস্যে বললেন, আনঅফিসিয়ালি এই মারাত্মক প্রকৃতির পুলিশ অফিসারটিকে তুমি বলি।

যোগীন্দ্র মিটিমিটি হেসে বললেন, কর্নেল সাহেবও স্বচ্ছন্দে আমাকে তুমি বলতে পারেন। এস. পি. সাহেব আমাকে কর্নেল সাহেব সম্পর্কে কিছু প্রাইভেট মেসেজও দিয়েছেন। তবে আমার কাকা মেজর সতীন্দ্র রাও আজ দুপুরে পাটনা। থেকে আমার বাসায় এসেছেন। তার কাছে কর্নেল সাহেবের কথা শুনলুম।

ক্যাপ্টেন সিংহ বলে উঠলেন, মেজর সাহেব এসেছেন নাকি! তাঁকে আমি গতমাসে আমার ফার্ম হাউসে বেড়াতে আসতে বলেছিলাম।

যোগীন্দ্র বললেন, তিনি দুটোর ট্রেনে এসেছেন। আপনার বাড়ির ঘটনা শুনে তিনি খুব অবাক। তাঁর মতে সিংহের গুহায় ঢোকার হিম্মত কার হতে পারে!

তারপর কর্নেল সাহেবের কথা তাকে বলতেই তিনি লাফিয়ে উঠেছিলেন– যোগীন্দ্র, তুমি বেশি নাক গলাতে যেও না। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে তুমি চেনো না। সেবার রাজপুরে আমার বাড়িতে বেড়াতে এসে কর্নেল সাহেব মাত্র পাঁচ ঘন্টায় একটা সাংঘাতিক রহস্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

আমি বললুম, মেজর সতীন্দ্র রাও এসেছেন শুনে খুশি হলুম। তবে উনি আমার সম্পর্কে একটু বাড়িয়েই বলেছেন।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, তোমার কাকার কেসটা কী ছিল?

যোগীন্দ্র বললেন, একটা পোর্ট্রেট চুরি। কাকার পেন্টিং সংগ্রহের বাতিক আছে। কোন ইটালিয়ান পেন্টারের আঁকা তার পোর্ট্রেট চুরি গিয়েছিল। কর্নেল সাহেব নাকি সেটা কাকার বাড়ির একটা ঘরের পালঙ্কের তলা থেকে উদ্ধার করেছিলেন চোর সমেত।

 ক্যাপ্টেন সিংহ কিছু বলার আগেই আমি বললুম, ব্যাপারটা সামান্য। চোর পোর্ট্রেটটা নিয়ে মেজর রাও-এর মায়ের ঘরের পালঙ্কের তলায় লুকিয়েছিল। সময়। মতো সে ওটা নিয়ে বেরিয়ে যেত। কিন্তু নিছক অঙ্ক কষেই আমি পালঙ্কের তলায় উঁকি দিয়েছিলাম।

ক্যাপ্টেন সিংহ বলে উঠলেন, চোর নিশ্চয় বাড়ির লোক ছিল?

বললুম, তা আর বলতে! আসলে সেই ইটালিয়ান পেন্টার নাকি বিশ্ববিখ্যাত। নামটা আমি ভুলে গেছি। তবে তার আঁকা যে কোনো ছবিরই বাজার আছে।

এই সময় রঘুবীর একটা ট্রেতে তিন পেয়ালা কফি আর বড় এক প্লেট স্ন্যাক্স রেখে গেল।

আমি বললুম, মেজর রাও-এর ভ্রাতুস্পুত্রকে তুমি বলা যায়। যোগীন্দ্র, তোমার কাকা নিশ্চয় ঘটনাটা খুব জমকালো করে বলেছেন।

যোগীন্দ্র কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আমার অবশ্য বাড়াবাড়ি মনে হয়নি। আমার পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখে আসছি কোনো বাড়ি থেকে মূল্যবান কিছু হারালে বাড়ির কোনো লোকই তার পেছনে থাকে।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, কিন্তু আমার পূর্বপুরুষের মূল্যবান বিগ্রহ এবাড়ির মন্দির থেকে চুরি গেলেও আমি এ বাড়ির কোনো লোককেই সন্দেহভাজন মনে করতে পারছি না।

যোগীন্দ্র বলল, হ্যাঁ। আপনাকে বলা দরকার, আপনাদের পূজারী অশোক দেবশর্মাকে আজ এখান থেকে যাওয়ার পর থানার কাস্টডিতে ঢুকিয়েছি।

ক্যাপ্টেন সিংহ নড়ে বসলেন, কী সর্বনাশ! অশোক তো নিরক্ষর আর হাবাগোবা টাইপের ছেলে। মুখস্থ করা মন্ত্র পড়ে পুজো-আচ্চা করে। তাকে মারধর করছ না তো তোমরা?

যোগীন্দ্র হাসতে হাসতে বলল, না। তবে পুলিশের যা নিয়ম খুব ভয় দেখানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে জেরা। কিন্তু সে প্রলাপ বকছে। তার কথাবার্তা থেকে কিছু একটা আঁচ করেছি। তবে ওটা পুলিশ সিক্রেট। আপনাকে বলছি না।

এই সব কথাবার্তা বলতে বলতে আমরা কফি খাচ্ছিলুম। কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে ঘড়ি দেখলুম সাড়ে তিনটে বাজে। আমি বললুম, ক্যাপ্টেন সিংহ, আপনি যদি কিছু মনে না করেন আপনার নতুন কুকুর আলেকজান্ডার-স্যরি, সেকেন্দারকে নিয়ে ফার্মে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আসুন। আমি যোগীন্দ্রর সঙ্গে কিছু জরুরি কথা ততক্ষণে সেরে নিই।

ক্যাপ্টেন সিংহ একটু হেসে বললেন, মেজর রাও-এর চুরি যাওয়া জিনিসটা পাঁচ ঘন্টায় উদ্ধার করে দিয়েছিলেন। আমাদের পরিবারের জিনিসটা উদ্ধার করতে কঘন্টা লাগবে?

বললুম, জানি না। মেজর রাওকে জিগ্যেস করলে জানতে পারতেন আমার সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও কম নেই।

ক্যাপ্টেন সিংহ উঠে পঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, আপনি যখন মন্দিরের দরজা খুলতে পেরেছেন তখন আপনার সাফল্যের জন্য আমি প্রতীক্ষা করছি।

কথাটা বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

যোগীন্দ্র আমার দিকে তাকিয়েছিল। সে চাপা স্বরে বলল, তাহলে আপনি মন্দিরের দরজা খুলতে পেরেছেন?

বললুম, পেরেছি।

কীভাবে পারলেন, জানাতে আপত্তি আছে?

আমি বুক পকেট থেকে ভাজ করে রাখা প্যাডের কাগজটা তাকে দেখিয়ে রোমান অক্ষরগুলোর ধাঁধার সূত্রটা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলুম।

যোগীন্দ্র গম্ভীর মুখে বলল, ক্যাপ্টেন সিংহ কিছুতেই মানতে চাইছেন না যে তারই বাড়ির কোনো লোক এই অপকর্মর্টা করেছে। কিন্তু সর্বত্র অপরাধের ক্ষেত্রে এটা একটা সাধারণ ঘটনা যে বাড়িরই কোনো লোক যুক্ত না থাকলে কোনো অপকর্ম সম্ভব নয়। অবশ্য এটা ঠিক, ম্যানেজার রতনলাল, ড্রাইভার রঘুবীর, নাথুলাল, বিন্ধ্যেশ্বর এরা সবাই দীর্ঘকাল সিংহ পরিবারের বাড়িতে কাজ করছে। কিন্তু আমার একটা পয়েন্ট হল বাইরে থেকে মোটা টাকার প্রলোভন কেউ দেখালে এদের অনুগত্যে চিড় ধরতে পারে। আপনার কি মত?

বললুম, তুমি ঠিকই ধরেছ। প্রতিদিন ভোরে এবং সন্ধ্যায় যখন মিসেস সিংহ মন্দিরের দরজা খুলতেন এবং পূজারী পুজো করত তখন এদের মধ্যে কেউ না কেউ নিছক ভক্তিতে বা ভক্তির ছলে মন্দিরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

যোগীন্দ্র বলল, ঠিক অই। আমি এই কথাটাই ক্যাপ্টেন সিংহকে জোর দিয়ে বলেছি। দিনের পর দিন কেউ যদি মন্দিরের দরজা খোলা লক্ষ করে যায়, তাহলে তার পক্ষে আপনার মতো অঙ্ক কষে ব্যাপারটা জেনে যেতে পারে। অবশ্য তাকে কিছু ইংরেজি জানতেই হবে।

বললুম, ততো বেশি ইংরেজি না জানলেও চলবে। রোমান অক্ষরগুলো কি ধরনের আকার নিলে দরজা খোলে এটা একজন নিরক্ষর লোকের পক্ষেও মুখস্থ হয়ে যাওয়া কি সম্ভব নয়?

যোগীন্দ্র বলল, খুবই সম্ভব। এক্ষেত্রে রোমান হরফগুলো ALEXANDER রূপ নিলেই বারবার চোখে দেখে এই রূপটা ছবির মতো কারও মনে গেঁথে যাওয়া সম্ভব।

এবার বললুম, আমি তোমাকে এক ঘন্টা আগে ডেকেছিলুম তার কারণ আছে। আমি এখনই টেলিফোন করে নদীর ধারে নীলমাধব রায় নামে যে বাঙালি। ভদ্রলোক বাংলো বাড়ি করেছেন, তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমার সঙ্গে আজ তাঁর আলাপ হয়েছে। তিনি একজন প্রজাপতি বিজ্ঞানী। আমাকে তিনি নেমকার্ড দিয়েছেন। আমি তার ওখানে সন্ধ্যাটা কাটাতে চাই।

যোগীন্দ্র ভ্রূকুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে আস্তে বলল, আপনি পুলিশ ফোর্সের কথা বলেছিলেন।

বললুম, হ্যাঁ। কেন ফোর্স দরকার হবে আশা করি আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। সময় সন্ধ্যা সাতটা।

আমি উঠে দাঁড়ালুম। যোগীন্দ্রও উঠে দাঁড়াল। আমি বাইরে গিয়ে তাকে বললুম, তোমার আর এখানে থাকার দরকার নেই। থানায় ফিরে যাও।

যোগীন্দ্র বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেল। পোর্টিকোর নীচে তার জিপগাড়ি রাখা ছিল। সে হর্ন দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমি দক্ষিণের বারান্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা ফার্মের গেটে গেলুম। দেখলুম ক্যাপ্টেন সিংহ নাথুলালকে কিছু বলছেন। তারপরই নাথুলাল গমক্ষেতের দিকে এগিয়ে গেল। আমি ভিতরে ঢুকলে নতুন কুকুরটা আমার উদ্দেশে ধমক দিতে শুরু করল।

ক্যাপ্টেন সিংহ আমাকে দেখতে পেলেন। তারপর এগিয়ে এসে বললেন, যোগীন্দ্র কি চলে গেল?

বললুম, হ্যাঁ, সে থানায় ফিরে গেল। আমি আপনাকে বলতে এলুম ম্যানেজারের ঘর থেকে নীলমাধব রায়কে একটা টেলিফোন করব।

ক্যাপ্টেন সিংহ অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার!

বললুম, বিকেলটা তার সঙ্গে প্রজাপতি চর্চা করে কাটাতে চাই। তার ল্যাবের পাশে প্রজাপতিদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড আছে।

ক্যাপ্টেন সিংহ একটু হেসে বললেন, আপনাকে নিয়ে এই এক সমস্যা। ন্যাচরাল মিস্ট্রির দিকে একবার আপনার ঝোঁক পড়লেই আপনি ক্রিমিনাল মিস্ত্রির কথা একেবারে ভুলে যান।

বললুম, নাহ্, ক্রিমিনাল মিস্ট্রির দায়িত্বটা সুষ্ঠুভাবে পালন করার মতো যোগ্যতা যোগীন্দ্র রাওয়ের আছে। বিশেষ করে এই তরুণ পুলিশ অফিসারটির তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় আমি পেয়েছি। কাজেই আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

অফিস ঘরে ম্যানেজার রতনলাল চা খেতে খেতে কাজ করছিলেন। আমাকে দেখে তিনি ব্যস্তভাবে বললেন, আসুন, স্যার।

বললুম, আবার একটা টেলিফোন করব।

করুন।

আমি চেয়ারে বসে রিসিভার তুলে মিঃ রায়ের কার্ডটা দেখে ডায়াল করতে থাকলুম। একটু পরে সাড়া এল। বললুম, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মিঃ রায়, আমি প্রজাপতি দুটোকে নিয়ে একটু সমস্যায় পড়েছি। আমি আপনার কাছে এখনই যেতে চাই।

মিঃ রায় বললেন, বেশ তো, চলে আসুন।

বললুম, আমার কিন্তু কুকুরভীতি প্রচণ্ড। আপনার ডোবারম্যান সাহেবকে প্লিজ একটু সামলাবেন।

হাসির শব্দ ভেসে এল। মিঃ রায় বললেন, খবর পেয়েছি ক্যাপ্টেন সিংহ সালিম খানের কাছে আবার একটা অ্যালসেশিয়ান কিনেছেন।

বললুম, আমি তার নাগালের বাইরে আছি। হ্যাঁ, একটা কথা। আপনার বাংলোয় যাওয়ার জন্য গাড়ি চলার কোনো রাস্তা নেই?

অবশ্যই আছে। বাংলোর পিছনে বাঁধের পথ ধরে দক্ষিণে জলপ্রপাতের দিকে এগিয়ে গেলে ডাইনে একটা রাস্তা আছে। আপনি কি গাড়িতে আসছেন?

হ্যাঁ। পায়ে হেঁটে পৌঁছতে সময় লাগবে। তাই আমি ক্যাপ্টেন সিংহের গাড়িতে যাচ্ছি। তার ড্রাইভার আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে।

বেরিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন সিংহ বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, চলুন, রঘুবীরকে বলে দিই। আপনি যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ রঘুবীর যেন গাড়ি নিয়ে ওখানে অপেক্ষা করে।

বললুম, না, আমাকে পৌঁছে দিয়ে এলেই চলবে। আশা করি মিঃ রায় তাঁর গাড়িতে আমাকে এখানে পৌঁছে দেবেন।

যাওয়ার সময় আমি আমার ফায়ার আর্মসটা প্যান্টের ডান পকেটে রেখে দিলুম। পিঠে কিটব্যাগটাও এঁটে নিলুম। তারপর চারটে প্রজাপতি ঢুকিয়ে রাখা জারটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম।

গাড়িতে আমি রঘুবীরের বাঁপাশে বসেছিলুম। এগিয়ে যেতে যেতে তাকে বললুম, আমি ফিরে আসার আগে তোমাদের বাড়িতে পুলিশ এসে দৈবাৎ কাকেও অ্যারেস্ট করে, তোমরা হৈচৈ করবে না। আর এই কথাটা ক্যাপ্টেন সিংহকেও বলবে। যা কিছুই ঘটুক তিনি যেন চুপচাপ বসে আমার জন্য অপেক্ষা করেন।

রঘুবীর অবাক হয়ে বলল, ক্যাপ্টেন সাহেবকে আপনি নিজে কিছু বলে আসেননি?

না। যাই হোক, তুমি ফিরে গিয়ে চুপিচুপি তাকে এই কথাটা বলবে।

পিচরাস্তাটা যেখানে বেঁকে পশ্চিমে চলে গেছে, সেখান থেকে অসমতল মাঠের উপর দিয়ে একটা লালমাটির রাস্তা সোজা দক্ষিণে এগিয়ে গেছে। পর্যটকরা এই রাস্তা ধরেই জলপ্রপাতে বেড়াতে যায়।

নীলমাধব রায়ের বাংলোয় পৌঁছতে মিনিট কুড়ি লেগে গেল। কারণ নদীর সমান্তরালে উঁচু বাঁধের রাস্তাটা খানা-খন্দে ভর্তি। একটু অসতর্ক হলেই গাড়ি নদীর ভেতর পড়ে যাবে। অবশ্য দুধারে গাছপালা, ঝোঁপঝাড় আছে। সেই যা স্বস্তি।

গাড়ির হর্ন শুনে বাংলোর ভিতরে ডোবারম্যানটা খুব চেঁচামেচি করছিল। মিঃ রায় এবেলা জিনস আর টি-শার্ট পরে আছেন। তিনি নিজেই গেট খুলে দিয়ে বললেন, ক্যাপ্টেন সিংহের ড্রাইভারকে বলে দিন ও গাড়ি নিয়ে চলে যাক। আমি আমার জিপ গাড়িতে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব। কারণ আসবার সময় নিশ্চয় বাঁধের রাস্তাটার অবস্থা লক্ষ করেছেন। ঐ রাস্তায় জিপ গাড়ি চলার অসুবিধে নেই।

রঘুবীর গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মিঃ রায় আমার হাত থেকে জারটা নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, প্রবলেম তো হবেই। আপনার এই জার চারটে প্রকাণ্ড আউল বাটারফ্লাই বাস করার উপযুক্ত নয়। আমি আপনাকে আর একটা জার দেব।

পশ্চিম দিকের বারান্দায় সোজা রোদ এসে পড়েছিল। তাই মিঃ রায় আমাকে পূর্ব দিকের বারান্দায় নিয়ে গেলেন। বললেন, এখান থেকে নদী এবং ওপারের কাশবনটা দেখা যায়।

সেই আদিবাসী যুবকটি দ্রুত বেতের চেয়ার এবং গোলাকার বেতের টেবিল দিয়ে গেল। আমরা পূর্ব দিকে মুখ করেই বসলুম। নদীর জলে বিকেলের রৌদ্রের ছটা ঝিলমিল করছে। ওপারের বিস্তীর্ণ কাশবনের উপর দিয়ে দূরের পাহাড় দেখা যাচ্ছিল। মিঃ রায় উঠে গিয়ে ভিতরের ঘর থেকে ঠিক একই সাইজের একটা সচ্ছিদ্র প্লাস্টিকের জার আনলেন। দেখলুম তার হাতে আমার মতোই একটা সূক্ষ্মাগ্র চিমটে। তিনি জার খুলে দুটো প্রজাপতিকে একে একে বের করে খালি জারে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর জারের মুখ এঁটে বারান্দা থেকে নেমে দ্রুত রঙ্গন ফুল ছিঁড়ে আনলেন। দুটো জারে একটা করে ফুল ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, এতে ওদের আয়ু সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন।

এই ব্যাপারটা আমার জানা। কিন্তু ক্রিমিনাল মিস্ত্রি আমাকে প্রকৃতির এই মিস্ট্রিটা ভুলিয়ে রেখেছিল। সেই কালা-বোবা মেয়েটি ট্রেতে দুপেয়ালা কফি আর স্ন্যাকস রেখে আমার দিকে অবাক চোখে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।

বললুম, আমি কয়েকটা দিন আছি। আমাকে কাল যদি আপনার সময় থাকে, একবার সেই দুর্গম পাহাড়ের কাছে নিয়ে যাবেন, যেখানে দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড ফুল ফুটিয়েছে।

মিঃ রায় অর্কিড সম্পর্কে বক্তৃতা শুরু করলেন। কফি খেতে খেতে আমি তার কথায় সাড়া দিয়ে যাচ্ছিলুম। কিন্তু আমার চোখ খুঁজছিল আট/নফুট লম্বা একটা বাঁশের মই। একটু পরেই মইটা বাউন্ডারি ওয়ালের নীচে পড়ে আছে দেখতে পেলুম। তারপর তাকালুম, ষাট ডিগ্রি ঝুঁকে থাকা ফুলের ঝোঁপটির দিকে। সেটা বারন্দার নীচে লনের বাঁদিকে আরো সব মরশুমি ফুলের পাশে একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। যতবার তার দিকে তাকাচ্ছিলুম আমার মাথার ভিতর দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা হিম শিহরন টের পাচ্ছিলুম।

মিঃ রায় অর্কিড সংক্রান্ত ভাষণ হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, কাকে কী শোনাচ্ছি। আপনি তো এ বিষয়ে আমার চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখেন।

বললুম, আপনি অর্কিড সম্পর্কে এত বেশি জানেন, অথচ আপনার বাড়িতে অর্কিড নেই বলেই মনে হচ্ছে।

মিঃ রায় বললেন, না। আমার অর্কিডের নেশা নেই। অবশ্য আমার বাংলার চারধারে এত সব ফুলের সমারোহ দেখতে পাচ্ছেন, এদের মধ্যে বেশির ভাগই আমি সংগ্রহ করেছি পাহাড়ি জঙ্গল থেকে। ভৈরবগড়ে একটা নার্সারি আছে। সেখান থেকেও প্রচুর মরশুমি ফুলের বীজ ও চারা আনি।

বললুম, আপনার ফুলের প্রতি এত অনুরাগ কি বাইরের প্রজাপতিদের আকৃষ্ট করার জন্য?

মিঃ রায় বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। এক মিনিট বলে তিনি হঠাৎ উঠে ভিতরে গেলেন। কারণ টেলিফোন বাজছিল।

আমি উৎকণ্ঠ হয়ে তার ফিরে আসার প্রতীক্ষা করছিলুম। এই সময় সারা বাড়িতে আলো জ্বলে উঠল। সবে সূর্য পশ্চিমে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে এবং আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। বোবা মেয়েটি এসে ট্রে নিয়ে আমার দিকে তেমনই তাকাতে তাকাতে চলে গেল।

এই সময় কানে এল মিঃ রায় কাকে ধমক দিচ্ছেন–ডোন্ট টক লাইক এ ফুল। ওসব চালাকি ছেড়ে দাও। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।

একটু পরে আবার তিনি প্রায় গর্জন করে বললেন, আমার এক কথা। যা বলেছি দ্যাটস অল। পারলে এসো নয়তো বলে দাও। আমার কাছে একজন গেস্ট এসেছেন। বাজে সময় নষ্ট করো না। ঠিক আছে রাখছি।

একটু দেরি করেই মিঃ রায় ফিরে এলেন। মুখে তার চাপা রোষের ভাব তখনও মুছে যায়নি। চেয়ারে বসে তিনি বললেন, ক্ষমা করবেন কর্নেল সরকার, এক ব্যাটাচ্ছেলে আমার মুডটা নষ্ট করে দিয়েছে। একটা লোক-হাতুড়ে ডাক্তার বলাই ভালো, আমার কাছে প্রজাপতির বিষ কিনতে চায়। আপনি জানেন শুধু এই প্রজাপতিই নয়, আরও কয়েকটা প্রজাপতির পেটে বিষ থাকে। এই বিষ থেকে নাকি মানুষের অসুখ-বিসুখের ওষুধও তৈরি করা যায়। ফাদার হেনরি ওরুকট আমাকে বলেছিলেন প্রজাপতির বিষ থেকে ক্যানসারের ওষুধ তৈরি করা নিয়ে বিদেশে নাকি গবেষণা চলেছে।

বললুম, হ্যাঁ। একটা মেডিকেল জার্নালে আমি পড়েছিলাম প্রজাপতির বিষ ইঁদুরের গায়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে ঢুকিয়ে দিলে এক ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সেগুলোকে বের করে নিয়ে কী একটা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে শোধন করে মানুষের। দেহকোষে বংশগত রোগাক্রান্ত জিন থাকলে তাদের মেরে ফেলা যায়।

কথা বলতে বলতে ঘড়ি দেখে নিলুম। সাতটা বাজে। বাইরে থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছি না কেন?

মিঃ রায় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বাঁধের পথে গাড়ির আলো দেখতে পাচ্ছি। সম্ভবত ক্যাপ্টেন সিংহ আপনার জন্য আবার তার ড্রাইভারকে পাঠিয়েছেন। ক্যাপ্টেন সিংহ মানুষটি এমনিতে খুব ভালো কিন্তু বড্ড জেদি। তাছাড়া গোঁয়ার্তুমিও আছে।

বললুম, আপনি বসুন, মিঃ রায়। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে।

মিঃ রায় হাসিমুখে বললেন, তাহলে গাড়ি ফিরিয়ে দিন। আমার সঙ্গে ডিনার খেয়ে এখানেই রাতটা কাটিয়ে যান।

এই সময় তার কুকুরের প্রচণ্ড হাঁকডাক শোনা গেল। নীলমাধব রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এক মিনিট আসছি।…

.

মিঃ রায় চলে যাওয়ার পরই আমি আসন্ন নাটকীয় পরিস্থিতির জন্য তৈরি হয়েছিলুম। একটু পরে বাংলোর গেটের দিকে তাঁর উত্তেজিত কণ্ঠে তর্কবিতর্কের শব্দ শোনা গিয়েছিল। তখনই উঠে গিয়ে দক্ষিণের বারান্দার কোণে উঁকি দিয়েছিলুম। দেখছিলুম, গেটের কাছে ওসি যোগীন্দ্র রাও এবং পুলিশের একটি সশস্ত্র দল মিঃ রায়কে ঘিরে ধরেছে। তারপরই আচমকা বাংলোর সব আলো নিভে গিয়েছিল।

আমার সামরিক জীবনের সেই ইনটুইশন মুহূর্তে আমাকে সতর্ক করে দিল। পিনে ডোবারম্যান কুকুরটার ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেই যখন ঘুরে দাঁড়ালুম, তখন আমার বাঁ হাতে ছোট্ট কিন্তু জোরালো আলোর টর্চ এবং ডান হাতে রিভলভার।

দেখলুম, কুকুরটা দাঁত বের করে বেতের টেবিলের উপর দুই পা সবে তুলেছে এবং এরপরই সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার গলা কামড়ে ধরবে, এটা নিশ্চিত! মানুষের আক্রমণে মৃত্যু আমার পক্ষে সম্মানজনক। কিন্তু ওই কুৎসিত প্রাণীটার আক্রমণে মৃত্যু আমার পক্ষে অপমানজনক!

সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। কুকুরটা ঝপ দেবার উপক্রম করতেই প্রায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে তার দুই চোখের মাঝখানে গুলি করলুম। সে নিঃশব্দে টেবিল থেকে গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।

পিছনে কার চিৎকার শুনতে পেলুম-কর্নেল সরকার! আর ইউ অলরাইট?

জবাব দেবার সময় টর্চের আলোয় দেখলুম, সেই আদিবাসী যুবকটি একটা শাবল হাতে নিয়ে এদিকের লনের শেষে বাঁপাশে বেঁকে থাকা সেই ফুলের ঝোঁপটির কাছে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল।

পিছনে আবার কেউ চিৎকার করে উঠল–মিঃ ছেত্রী! বাংলোয় ঢুকে মেনসুইচ অন করে দিন। কুইক!

ঘুরে দেখে নিলুম, যোগীন্দ্র রাও এগিয়ে আসছে। আবার সে বলল, কর্নেল সরকার! আর ইউ অলরাইট?

বললুম, হ্যাঁ যোগীন্দ্র। আমি ঠিক আছি। বাধ্য হয়ে নীলমাধব রায়ের হিংস্র, কুকুরটাকে আমাকে মেরে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু তোমরা ওই আদিবাসী যুবকটিকে এখনই পাকড়াও করো। সাবধান! ওর কাছে সাংঘাতিক কোনো অস্ত্র থাকতে পারে! প্রজাপতির বিষে ভরা কোনও ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ!!

একজন পুলিশ অফিসার তার দিকে রিভলবার তাগ করে এগিয়ে গেলেন। তারপর ধমক দিয়ে বললেন, হাত ওঠাও।

সে দুহাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে রইল। পুলিশ অফিসার তার বাঁ কানের নীচে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে তার পিছন দিক থেকে প্রথমে প্যান্টের বাঁ পকেট তারপর ডান পকেটে বাঁ হাত ভরে বললেন, রুমালের মধ্যে কী একটা আছে।

বললুম, খুব সাবধান কিন্তু। রুমালটা আস্তে বের করে নিন।

আমার অনুমান ঠিকই ছিল। রুমালে জড়ানো ছিল একটা দুইঞ্চি লম্বা ছোট্ট সিরিঞ্জ। সূচটা আধইঞ্চিরও কম। আমি এগিয়ে গিয়ে সিরিঞ্জটা অফিসারের কাছ থেকে নিয়ে সেই রুমালেই সাবধানে জড়িয়ে আমার কিটব্যাগে চালান করে দিলুম। তারপর বললুম, মিঃ রায়ের এই সহযোগীকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যান।

পুলিশ অফিসার তার গেঞ্জির কলার ধরে মাথার পিছনে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে নিয়ে চলে গেলেন।

এবার বললুম, তাহলে আমি বিষ্ণুদেবকে উদ্ধার করি।

যোগীন্দ্র বলে উঠল, জাস্ট কয়েকটা মিনিট কর্নেল সরকার। ক্যাপ্টেন সিংহকে আসবার সময় বলে এসেছি তিনি যেন দুজন বিশিষ্ট ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আসেন। কারণ আইনত এই ঘটনার অন্তত দুজন নিরপেক্ষ সাক্ষী থাকা দরকার।

কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হল না। ক্যাপ্টেন সিংহ এবং দুজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, যোগীন্দ্রের কথামতো দুইজন ভদ্রলোককে এনেছি। ইনি ডাঃ শোভন ভার্মা আর এই ধুতি পাঞ্জাবি পরা অমায়িক চেহারার ভদ্রলোককে তো সবাই চেনেন। ইনি ভৈরবগড়ের পুরসভার সভাপতি অম্বিকাচরণ প্রসাদ। কিন্তু নীলমাধব কোথায়?

নীলমাধব রায়ের দুই বাহু ধরে দুজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি বাঁকা মুখে প্রায় গর্জন করে বললেন, সব ষড়যন্ত্র। ক্যাপ্টেন সিংহ, তাহলে পুরনো প্রতিশোধটা এমনি করেই তুমি নিলে?

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, পনেরো-কুড়ি বছর আগে তুমি আমাদের একজন আদিবাসী প্রজাকে ক্ষেপিয়ে মাঠের ফসল লুঠতে প্ররোচিত করেছিলে। সে কথাটা আমি ভুলেই গিয়েছিলুম।

আমি বললুম, ওসব কথা থাক। আপনারা স্বচক্ষে দেখুন আমি কী করছি।

 বলে আমি ষাট ডিগ্রি বেঁকে থাকা সেই ফুলের ঝোঁপটিকে দুহাতে উপড়ে একপাশে রেখে দিলুম। শেকড়-বাকড়ে অনেকটা মাটি জমে ছিল। এরপর শাবল দিয়ে গর্তের মাটিগুলো একটু সরাতেই দেখলুম সাদা রঙের পলিথিন পেপারের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। সেটা দুহাতে টেনে তুললুম। পলিথিন প্যাকেটের উপরের দিকটা সাদা সুতো দিয়ে বাঁধা ছিল। সুতো খুলে প্যাকেটটা লনে নিয়ে গেলুম। তারপর ভিতর থেকে সাবধানে একটা বিগ্রহ বের করলুম। উজ্জ্বল আলোয় মূর্তির মুকুট, চোখ, বাহু এবং কোমরের দিকে বসানো মূল্যবান ধাতুর টুকরোগুলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল।

ক্যাপ্টেন সিংহ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাকে নিবৃত্ত করে যোগীন্দ্র বলল, প্লিজ ক্যাপ্টেন সিংহ, ওটা এখন আপাতত আমাদের কাস্টডিতে থাকবে। আগামীকাল ওটা আদালতে একজিবিট করা হবে। তবে মূর্তিটা পেতে আপনাদের একটা দরখাস্ত করতে হবে। আপনার চিন্তার কারণ নেই। আমাদের পাবলিক প্রসিকিউটার বাধা দেবেন না। তবে লিখিত শর্তে আপনি ওটা আদালত থেকে কালই ফেরত পাবেন।

এই সময় আমি লক্ষ করলুম বারান্দায় দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে বসে আছে সেই বোবা-কালা মেয়েটি। তার চোখ দুটিতে জল টলটল করছে।

আমি বললুম, যোগীন্দ্র, মিঃ রায়কে তোমরা কাস্টডিতে নিয়ে যাবে। এই বাংলোয় ঐ বোবা-কালা মেয়েটা কি একলা থাকতে পারবে?

মিঃ রায় বলে উঠলেন, হ্যাঁ, ও থাকবে। ওকে নিয়ে কারও মাথাব্যথার কারণ নেই।

যোগীন্দ্র বলল, মিঃ রায়, আমাদের হাতে খবর আছে আপনার সঙ্গে এই এলাকার আদিবাসী জঙ্গি গোষ্ঠী ব্ল্যাকপ্যান্থারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মাঝে মাঝে আপনার বাড়িতে তারা এসে বৈঠকও করে। আর ঐ মেয়েটিকে যদি এখানে একা রেখে যাওয়া হয়, বোবা-কালা হলেও সে ব্ল্যাকপ্যান্থারদের আপ্যায়নের ক্রটি করবে না। কাজেই আমরা ওকে রাজডিহির খ্রিস্টান অনাথ আশ্রম পাঠিয়ে দিচ্ছি। জামিনে আপনি মুক্তি পেলে ওকে নিয়ে আসবেন।

মিঃ রায় বললেন, আর আমার এই বাংলোর কি হবে?

যোগীন্দ্র একটু হেসে বলল, বাংলোর দরজা-জানলা বন্ধ করে বাইরের দরজায় তালা লাগিয়ে দেব। গেটও সিল করে দেব।

মিঃ রায় গলার ভেতর বললেন, আলোগুলো কিন্তু নেবেন না। আশা করি আমি কাল জামিন পেয়ে যাব।

যোগীন্দ্রের হাতে পলিথিনের প্যাকেটে ভরা বিষ্ণুমূর্তি। সে পা বাড়িয়ে একজন অফিসারকে বলল, মিঃ আনোয়ার, আপনি ঐ মেয়েটিকে হোমে পাঠাবার দায়িত্ব নিন আর বাংলো সিল করে দিন। আমরা এগোচ্ছি।

যাবার সময় আমি প্রজাপতি-দম্পতি ভরা জার দুটো বারান্দার নীচে থেকে কুড়িয়ে নিলুম। হিংস্র কুকুরটা টেবিল পেরিয়ে আমার দিকে ঝপ দেবার সময় জার দুটো ছিটকে পড়েছিল। গেট দিয়ে বেরিয়ে দেখলুম একটা প্রিজনভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন কনস্টেবল মিঃ রায় ও আদিবাসী যুবকটিকে সেই ভ্যানে ঢোকাল। তারপর ভ্যানটি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন সিংহ তার গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। তাকে বললুম, আপনি এগিয়ে যান। আমার কফির তৃষ্ণা পেয়েছে। গিয়ে সুশীলাকে বলবেন, সে যেন তৈরি থাকে।

ক্যাপ্টেন সিংহ একটু হেসে বললেন, আপনার ঘরে যোগীন্দ্রের কাকা মেজর সত্যেন্দ্র রাওকে বসিয়ে রেখে এসেছি।

কথাটা বলেই তিনি আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। আবার বললেন, এ সময়ে আমার মাথাটা গোলমাল করছে। তাই বলতে ভুলে গেছি। নাথুলাল একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পুকুরঘাটের দরজা দিয়ে বেরুতে যাচ্ছিল। সুশীলার চোখে পড়ায় তার বাবাকে তখনই খবর দেয়। কী রঘুবীর, চুপ করে আছ কেন? বাকিটা তুমিই বলো।

রঘুবীর হাসতে হাসতে বলল, আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে জাপটে ধরেছিলুম। সে একটা ছুরি বের করেছিল পকেট থেকে। ছুরিটা না ধরে ফেললে আমাকে জখম করে ফেলত। সেটা কেড়ে নিয়ে ওকে কয়েকটা কিল চড় থাপ্পড় মেরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বাংলো ঘরের বারান্দায় একটা লোহার থামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছি।

অমনি বলে উঠলুম, এই দেখুন, আমারও মাথা গোলমাল হয়ে গেছে। যোগীন্দ্র, তোমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলে সেখানে প্রজাপতিদের ব্রিডিং ঘর। তার পাশেই পাঁচিলের নীচে একটা মই রাখা আছে। ওটা আনতে বলো।

যোগীন্দ্র একজন কনস্টেবলকে নির্দেশ দিল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, মইটাও কি কোটের এক্সিবিট হবে?

বললুম, নিশ্চয় হবে। কারণ গতরাত্রে মন্দিরের পিছনে বাউন্ডারি ওয়ালে ঐ মইটা লাগিয়ে হয় মিঃ রায় কিংবা ঐ আদিবাসী যুবকটি মইয়ের উপরে উঠেছিল। ভেতর থেকে নাথুলাল পলিথিনের প্যাকেটে ভরে বিগ্রহটি তার হাতে তুলে দেয়। পাঁচিলে এবং নীচের মাটিতে মইয়ের দুটি করে দাগ খুব স্পষ্ট হয়ে আছে।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, আমার ধারণা রায়সাহেব মই বেয়ে ওঠেনি। সে নীচে দাঁড়িয়েছিল। আর ঐ তার সহযোগী ছোকরাটি মইয়ের ডগায় উঠেছিল।

বলে তিনি গাড়ির সামনের সিটে বসলেন। তাঁর সঙ্গীদ্বয় ব্যাকসিটে বসলেন।

বললুম, আমি যোগীন্দ্রের জিপে যাব।

রঘুবীর আগে তার গাড়ি স্টার্ট করে বাঁধের দিকে এগিয়ে গেল।

 যোগীন্দ্র তার ড্রাইভারকে বলল, তুমি পিছনে কনস্টেবলদের সঙ্গে বসো। আমি গাড়ি ড্রাইভ করব।

.

ক্যাপ্টেন সিংহের বাংলোর সামনে পৌঁছতে প্রায় আধঘন্টা লেগে গেল। কারণ তার গাড়িটি অ্যামব্যাসাডার। সারা পথ বেশ আস্তে সুস্থে এগিয়েছে। যোগীন্দ্র জিপগাড়ি চালিয়েছে তাদের পেছনে।

ক্যাপ্টেন সিংহের বাংলোর সামনে পৌঁছে যোগীন্দ্র বলল, আমি এখন ভিতরে ঢুকছি না। কারণ আমার কাকা মেজর সাহেব আমাকে দেখলে সহজে ছাড়বেন না।

বললুম, কিন্তু আরেক জন আসামী, এই কেসের মূল আসামীই বলা যায়, নাথুলালকে তোমরা থানায় নিয়ে যাবে না?

যোগীন্দ্র বলল, আমি থানায় পৌঁছে এই গাড়িতেই একজন অফিসার এবং কয়েকজন কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দেব। তারা ওকে নিয়ে যাবে।

জিপগাড়ি থেকে নেমে দুটো জার দুই বগলে চেপে ধরে ক্লান্তভাবে আমি ভিতরে গেলুম। দেখলুম নাথুলালকে সত্যিই একটা লোহার থামের সঙ্গে শক্ত দড়ি দিয়ে রঘুবীর আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।

আমি সোজা আমার ঘরে গিয়ে ঢুকলুম। মেজর সত্যেন্দ্র রাও আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর চমকে উঠে বললেন, আপনার বগলে ও দুটো কী?

হাসতে হাসতে বললুম, আপনি এই বাঙালি প্রবাদটা জানেন না-চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আপনার ভ্রাতুস্পুত্র তাঁর কাজ করতে গিয়েছিলেন, আমি গিয়েছিলুম আমার কাজ করতে।

তিনি বললেন, এই মাত্র ক্যাপ্টেন সিংহ এসে আমাকে সব ঘটনা বলেছেন। আমার বাড়ি থেকে সেবার পোর্ট্রেট উদ্ধার করতে আপনার সময় লেগেছিল পাঁচ ঘন্টা। সিংহ ফ্যামিলির আরাধ্য দেবতা বিষ্ণুকে উদ্ধার করতে কতক্ষণ লাগল?

জার দুটো টেবিলে রেখে তার মুখোমুখি বসে বললুম, উদ্ধার করতে অবশ্য একটু বেশি সময় লেগেছে। কিন্তু মূর্তি চুরির রহস্য ফাঁস করতে আমার লেগেছে। মাত্র সওয়া তিন ঘন্টা।

তিনি বললেন, বলেন কী! একটু ব্যাখ্যা করুন।

বললুম, এখানে পৌঁছেছি সকাল সাড়ে নটায়। আর বেলা বারোটা পঞ্চাশ নাগাদ আমি পুকুরঘাটের দিকে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম পিছন থেকে বাউন্ডারি ওয়ালে মই লাগানো হয়েছিল। তারপর চুপিচুপি নাথুলালের ঘরে ঢুকে ওর বালিশের ভেতর থেকে একটা খাতা বের করেছিলুম। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মন্দিরের দরজা খোলার মন্ত্রটা পেয়ে গেলুম।

মেজর রাও বলেলেন, মন্ত্র? মন্ত্র দিয়ে দরজাটা খোলা হয় নাকি?

বললুম, মন্ত্রটা শুনুন :

দো সাত এক
তিন নও আট
ছে পাঞ্চ চার

মেজর রাও বিস্মিত মুখে বললেন, এর মানে?

বললুম, আলেকজান্ডার। ALEXANDER

মেজর রাও হো হো করে হেসে উঠলেন আপনার সেই হেঁয়ালি করার অভ্যেস এখনও ছাড়তে পারেননি।

বললুম, কফি আসুক। কফি খেতে খেতে সব কিছু বুঝিয়ে বলব।

একটু পরে সুশীলা ট্রেতে কফি আর স্ন্যাকস রেখে গেল। কফি খেতে খেতে আমি মন্দিরের লোহার দরজার মাঝখানে হাতলের চারপাশে লেখা রোমান হরফগুলো তাকে বুঝিয়ে দিলুম। অবশ্য পকেট থেকে আমার সেই প্যাডের পাতাটা খুলে তাকে দিতে হল। তিনি মন দিয়ে সবটা শোনার পর বলে উঠলেন–ব্রাভো কর্নেল সরকার! ব্রাভো!

একটু পরে রঘুবীর উঁকি মেরে বলল, থানা থেকে একজন অফিসার আর কয়েকজন পুলিশ এসেছে।

কফি পান অসমাপ্ত রেখেই আমি দ্রুত বেরিয়ে গেলুম। তারপর পুলিশ অফিসারকে বললুম, ওর কাঁধের ব্যাগে একটা খাতা আছে কিনা দেখুন। ওটাও কোর্টে একজিবিট হবে।

অফিসারটি নাথুলালের ব্যাগ খুঁজে সেই খাতাটা বের করে বললেন, আপনি কি এটার কথা বলছেন স্যার?

আমি পাতা উল্টে দেখে নিয়ে বললুম, হ্যাঁ। এটা আপনাদের ওসি সাহেবকে দিয়ে বলবেন এটাই সবচেয়ে মূল্যবান একজিবিট। অবশ্য আমি টেলিফোনে বলে দেব। আপনারা আসামীকে থানায় নিয়ে যান।

ঘরে ফিরে কফি পানে মন দিলুম। মেজর রাও তখনো সেই কাগজটার ওপর চোখ রেখে বসে আছেন এবং মুখে শব্দহীন হাসি।

বললুম, কফি জুড়িয়ে যাচ্ছে মেজর রাও।

এই সময় ক্যাপ্টেন সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী অপালা সিংহ ঘরে ঢুকলেন। অপালা আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে ঝুঁকেছিলেন। আমি দ্রুত সরে গিয়ে বললুম, মিসেস সিংহ, সব কৃতিত্ব কিন্তু আপনার। কারণ আপনিই আমাকে বলেছিলেন মন্দির খোলার সময় নাথুলাল লুকিয়ে দৃষ্টি রাখে। আপনার বোধবুদ্ধির ওপর আমার আস্থা আছে। প্লিজ, আপনারা বসুন।

তারা দুজনে পাশাপাশি বসলে মেজর রাও তাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

দো সাত এক
তিন নও আট
ছে পাঞ্চ চার।

ক্যাপ্টেন সিংহ বললেন, এর মানে?

 মেজর রাও বললেন, এর মানে ALEXANDER.

অপালা সিংহ বিস্মিত মুখে বললেন, আপনি জেনে গেছেন?

মেজর রাও বললেন, আমি জেনে গেছি। কিন্তু আপনি এখনও জানেন না। কর্নেল সরকার, আপনি চুরুট টানতে টানতে অপালা দেবীকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিন।