আলিম মুয়াজ্জিন
আলিম মুয়াজ্জিনের পাগলা খেতাব বহু পুরাতন।
“শেয়ান পাগল, সাহেব, শেয়ান পাগল,” মসজিদ কমিটীর দরাফ তালুকদার সঙ্গী ইমানিয়া মাদ্রাসার হেড মোদাররেস ফিদা আলি সাহেবের সম্মুখে চিরকুট দরখাস্ত তুলে ধরে বলতেন, “এই দ্যাখেন, নবাব সাহেবের বারো টাকায় হবে না। নিদেনপক্ষে আরো দশ টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে। আপনারা বলেন পরহেজগার, ভাল মানুষ। সব চালাকি। জামানার গরদেশ, লালচ বেড়ে গেছে।” ঢোক গিলে আরো একটু দার্শনিকতা জুড়ে দিতেন, “লালচে পাপ, পাপে মৃত্যু।”
আলিম সেই জমানায় হাঁক-ফুকার বলত, “এ্যায়সা দিন নেহি রহেগা। ধর্ম-প্রতিষ্ঠার জন্য এত দাঙ্গা-ফ্যাসাদ। ইসলামের রাজত্ব হোক, দেখে নেবেন। যে ভাল কাজ করবে, সে ভাল পুরস্কার পাবে। একদম আল্লার রাজ্য। আমার পেশা সবচেয়ে পবিত্র। আমি আল্লার ঘরের মোহাফেজ, খোদার নকীব। আমার সবচেয়ে বেশী মাইনা হবে। গবর্ণর জেরিলের এক লাখ হোলে আমার হবে সওয়া লাখ। আরো পঁচিশ হাজার বেশী। “
বলুন, বাতুল ছাড়া কেউ এমন কথা উচ্চারণ করতে পারে?
কিন্তু সত্যি আলিম একদিন পাগল হোয়ে গেল। আর উপাধির পাগল নয়, একদম ব্যাধির পাগল।
ষ্টেশনের ধারে বাজারের অলি-গলি আলিম ঘুরে বেড়ায় আজকাল পোষাক ছলছলিয়ে। আগে পরনে থাকত একটা লুঙ্গি। গায়ে আধ নয় পৌনে এক ময়লা পিরহান, ডজন দুই তালি-মার্কা। এখন দৈন্য ঘুঁচে গেছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত শুধু লেবাস। হরেক রকম পরিচ্ছদের অপূর্ব সমাবেশ। ব্লাউসের কুঁচির মত স্তর নেমেছে কোমর তক্। কোথাও পাহাড়ের খাড়াই। বাজুর উপর লেপ-ছেঁড়া খানিকটা বাঁধা। তার গায়ে সেলাই করা রঙ বেরঙের টুকরো কাপড়। হাঁটুর নিচের দিকে প্যাণ্টের কিয়দংশ লুঙ্গির পাড়, ধুতির ফালি। কোমর থেকে উপরে জিপসী ঘাঘ্রার মত দেখায়। স্তরবিন্যাস এখান থেকে শুরু। সুসংহত ছন্দ নেই, তবে হাঁটার সময় চাঞ্চল্য ছন্দ যোগায়। পোষাক-তরঙ্গ-রঙ্গ।
হেঁটে যাচ্ছে আলিম। হাতে জিভ-মেলা ঢোঁড়া সাপের মত দুই চক্ষু-বিশিষ্ট মোটা কঞ্চির লাঠি। টুংটাং শব্দ বেরোচ্ছে দেহের কুঠরি থেকে। কারণ আলিম ত পাগল নয়। রীতি-মত কল্প-তরু। এক দিকের ঝোলা থেকে বের করবে তেলের শিশি, আয়না, চিরুণী। অন্য দিক থেকে বাঁশের বাঁশি। হঠাৎ পিঁ পোঁ শব্দ উঠল। সেটা ঢুকিয়ে রেখে বের করলে দু’টো বিড়ি। আগে আলিম বিড়ি খেতনা। এখন রাস্তা ধোঁয়ায় ডুবিয়ে দিয়ে চলে। আবার নিতম্বের ন্যাকড়া-স্তূপ থেকে গজিয়ে উঠল কচি ছেলের রঙ্গীন বল। খেলনা হাওয়া হোয়ে গেল যথাস্থানে। বুকের ভেতর থেকে ঝক্ঝকিয়ে উঁকি দিল খাওয়ার বাসন, কৌটা-খোলাম-কুচি, বল্টু-পেরেক ইত্যাদি বোঝাই।
গোটা মানুষ নয়, আলিম গোটা সংসার। মাথায় আছে পুরানো হ্যাট। মাঝে মাঝে মাটির উপর ফেলে পা দিয়ে ঘষে, দু-হাতে দুমড়ায়, ছুঁড়ে ফেলে। আবার মাথায় তোলে।
সড়ক-মঞ্চের যাদুকর!
পাড়ার ছেলেরা জোটে। পুরানো রসিকতা অনেকে ভোলেনি। দুষ্ট ছেলেরা ত শ্রুতি-ধর। চেঁচিয়ে ওঠে পেছনে, “গভর্ণর জেলি, গভর্ণর জেরিল—।” ফিরে তাকায় আলিম। দাড়ি-গোঁফে তা দিয়ে নিজেই হাঁকে, “বড়া লাট সাহেব।” ছেলেরা হাসে, কেউ ঢেলা ছোঁড়ে। যেদিন মেজাজ তেতে থাকে,আলিম হাসে না। বলে, “তোর বাপও লাট সাহেব।”
কোন কোন পাড়ার ছেলেরা উত্যক্ত করে মারে। গায়ে পানি ঢালে, লেবাস ধরে টানে। “গভর্ণর জেলি সাহেব, গভর্ণর জেরিল সাহেব” হরদম চীৎকারে বেচারা ঝালাপালা।
বড় সড়কে এমন জুলুম নেই। অনেকে খাতির করে। আলিম ত পাগল নয়, তাদের কাছে দরবেশ। দোয়া করলেই মুকিল আসান অথবা বেড়া পার। চাকরি জুটতে পারে, লটারির টিকিট লেগে যেতে পারে। এমন ভক্ত-দল হোটেলের কিনারায় বসিয়ে চা খাওয়ায়, গল্প জমায়। ইমান যাদের আরো ঘন তারা গা পর্যন্ত টেপে। ওদিকে দরবেশ হয়ত নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। দোয়া কি সহজে বেরোয়?
আলিমের জীবিকার এই এক পথ। অনেক সময় খেয়ালবশতঃ ভিক্ষে চায়। পকেটে সমস্ত সংসার কি সাধে ঢুকেছে।
দুপুর বেলা গরমের দিনে হঠাৎ দ্যাখো, আলিম ট্রাফিক পুলিশের পার্শ্বস্থ গুমটির উপর দাঁড়িয়ে গেছে। চলল ফ্রি হ্যাণ্ড এক্সারসাইজ ঝাড়া পনর মিনিট। পুলিশের সঙ্গে তাল ঠিক থাকে। পুলিশ হাত তোলে, আলিম হাত তোলে। শেষে খেদিয়ে দিলে, আলিম গিয়ে বসবে সামনে বড় বাড়ীর রোয়াকে। লাঠি পাশে রেখে পার উপর পা তুলে চীৎকার শুরু করবে, “শাহান শাহে হকুমতে এলাহী, নকীবুল্লাহ মুয়াজ্জিন আলিম উদ্দীন খাঁ-বা-আদাব বা-মোজাহেজা হুশিয়ার হুঁশিয়ার!” পথচারী সকলে হাসে। আলিম সঙ্গে সঙ্গে দাঁত বের করে। মটর হর্ণ দিয়ে গেল, আলিম বাঁশি বাজাতে লাগল।
তার রাত্রির আস্তানা সারা দুনিয়া। বিনা-তাড়া বিনা ভাড়া যেখানে থাকা যায়। ফুটপাথ, সিনেমার বারান্দা, ফুটবলের মাঠ, পুলের তলা বা আর কোথাও।
আলিম তখন খেতাবী পাগল মাত্র। সে পায়ে হেঁটে মাসে-দু’মাসে একবার শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে বাড়ী ছুটত এশার নামাজের পর। ফজরের আগে দু-খানা পা নিয়েই ফিরে আসত। কোন নামাজ বা আজান কাজা হয়নি তার কোনদিন। সুরেলা গলা ছিল বটে। বুক-ছেঁড়া ঢাকের মত প্রতিধ্বনি তুলতো “আল্লাহো আকবর।”
এই গলা দিয়ে যৌবনে সে পাড়ার একটি মেয়ের বুক জয় করেছিল। হাল-ফিল শরীয়ৎ-মোতাবক তার স্ত্রী, বাসেদা খাতুন। গলা আর বুকে ব্যবধান আছে হাসুলির মত গোল হাড়ের, সেদিন স্ত্রীর জানার কথা ছিল না।
বাসেদা বলত : দরখাস্ দিছো?
—হ। দিছি।
—বাড়ছে কিছু?
—বাড়ছে। আষ্ট আনা।
বাসেদা হেসে উঠত বিদ্রূপোক্তি ক’রে : য্যামন মরদ। দাম ঠিকই কষছে তোমার তালুকদার সা’ব।
—হ।
আরো ঝাঁঝাঁলো কণ্ঠস্বর ফেটে পড়ত : বিবির লগে শোয়ার মরদ। আর কত দাম অইবো?
আলিম কোন জবাব দিত না। পৌরুষের ঝুঁটি ধরে টানাটানি, মনে বিধৃত বৈকি। মুয়াজ্জিনের উন্মার্গ মন সব ধোঁয়ায় ভরে দিত
মসজিদের প্রাঙ্গণ তক্তকে থাকে সব সময়। দু’পাশে সম্মুখে বাগান। হরেক রকম ফুলের গাছ। সিঁড়ির দুই দিকে ঝাঁকড়া কামিনী গাছ ফুলে ভরে থাকে। সব আলিমের মালীপনার কীর্তি। গোলাপের ঝাড় আছে পঞ্চাশের উপর। পাশে কবরস্তান। এখানেও মুয়াজ্জিনের শ্যামলতা-সরবরাহী দক্ষতা ঢালা। সে কবর খুঁড়তে ওস্তাদ। ধাঁই ধাঁই কোদাল চালাত। ছোট শিশুর বুকের কাছাকাছি লাগাত শিউলি গাছের ডাল। এখনও কমপক্ষে দু-ডজন শিউলি গাছ মসজিদের বাগানে আর কবরস্তানে। হেমন্তকালে ছোট শিশুদের কবর ফুলে ঢাকা হোয়ে যায়। হেনা গাছ আছে দূরে। সঙ্গে সাপের ভয়, তাই কুসুম-পল্লীর এক-টেরে বাস। ঋতুর চাকা এখানে ফুলের সড়ক ধরে চলে।
মসজিদ থেকে আধ ক্রোশের মধ্যে আলিম থাকত কয়েকজন আফিস পিয়নের সঙ্গে। সকালে কিছু কোরান পাঠের সাগরেদ ছিল। রোজগারের আর একটি বাড়তি পথ। কাজেই পরিচ্ছদ আর বেশী বাড়তি আশা করা যায় না। সাবান-কাচা লুঙ্গি একদিনে আধ ময়লা। পিরহানের ঝুল গোড়ালি পর্যন্ত। কাপড় লাগে অনেক বেশী। সেইজন্য তালি দেওয়ার পথ খোলা।
বাসেদা তা নিয়ে ঠাট্টা করত। স্মরণ করিয়ে দিত হযরত মুহম্মদের বাণী-পরিচ্ছন্নতা পবিত্রতার নামান্তর।
স্বামী উল্টে কোণ-ঠাসা করতে চাইত।
—তুমি ক্যামনে আছো?
সত্য কথা স্ত্রীর পরিচ্ছদ অতি ময়লা। দু’টো ফালি লুঙ্গি আর কুর্তা সম্বল। অন্য পরিধেয় বাসেদার নেই।
—আঁই মসজিদের ইমাম ন।
তাও সত্যকথা, বাসেদা মসজিদের ইমাম নয়। স্ত্রীর মুখ থেকে বিদ্রূপের ছুরি লিক্লিকিয়ে বের হোতো : দু-ডা লুঙ্গি। বর্ষাকালে একডা পইরা বেহানে গোসল করো। একডা পইরা আছো। হেই লইয়া ফের নামাজও পড়ো। মসজিদে শুইলেই মানুষে ফেরেশতা অয় না।
আরো শোনা যেতো স্ত্রীর কণ্ঠ : দু-ডার বেশী তিন-ডা লুঙ্গি অইল না দশ বছরে। আর কথা ছাড়ান দিলাম।
–আল্লার রহমৎ অইলে দিবো।
—হ। দিবো। এই মুল্লুকে থাহো, তোয়ার ফের পাকিজার (পরিচ্ছন্নতা) কাম কি? কিন্তু আঁই আর সবুর করতাম না।
শেষে বাসেদার গলা খনখনে কাঁসায় পরিণত।
কবর-খোঁড়ার মেহনৎ-স্বরূপ অনেকে কাপড় দিতে আসত। আলিম স্রেফ বলত, না। আল্লার রহমৎ চায় সে, মানুষের কৃপাপ্রার্থী নয়। মুখের উপর শুনিয়ে দিত।
সাধে কি আর পাগল খেতাব!
দরাফ তালুকদার ইদানীং বলত, “ভাল-মানুষিয়ানা হচ্ছে ওর খসলত নয়, খোলশ।”
একবার প্রায় দুপুর রাত্রে আলিম বাড়ী এলো। অন্ধকারে পথ ভুলে দু-ঘণ্টা ঘুরেছে।
স্ত্রী প্রথম জিজ্ঞেস করে : খাইয়া আইছো?
—হ।
—এ্যাতো রাইতে ক্যান্?
—পথ হারাইছিলাম।
—ঘুইরা ঘুইরা খাইছো তা অইলে?
বাসেদা ঈষৎ ঝাল মেশায়।
—হ।
—খাইছো?
—হ।
ডিপা জ্বালায় এইবার স্ত্রী। মাদুরের উপর আলিমের দুই ছেলে মেয়ে ঘুমাচ্ছে। দু’জনের বয়স একুনে বারোর বেশী নয়। ছেলেদের খাড়াই আলিমের পক্ষে বলা মুশকিল। কারণ যাতায়াতের সময় সে কাউকে জাগ্রত দেখে না।
ডিপার আলোয় আলিমের চোখে পড়ল, মাচাঙের উপর একটা হ্যাট রয়েছে। এগিয়ে গেল সে।
—হ্যাট কোথন পাইছো?
—আইছে। মাথায় দিমু। তুমি চব্বিশ পহর মাথায় টুপি দ্যাও, আঁই দিমু না? মুয়াজ্জিন সা’বের বিবি ত।
স্বভাবোচিত ব্যঙ্গ বাসেদার কণ্ঠে।
বাড়ীর পাশ দিয়ে সড়ক তৈরী হচ্ছে। ঠিকাদার, ওভারসীয়ার তদারকে আসে, কুলি-যোগাড়ে আসে। তাদের মাথায় আলিম এই টুপি দেখেছে। নচেৎ গ্রামে আসার মত হ্যাটের পা থাকে না। ঠিকাদার অগয়রহের কুলি-যোগাড়, রমণী-যোগাড়ের কাহিনী আলিমের কানে আসে বৈকি। খুব বেশী লোকের সঙ্গে সে মেশে না। কিন্তু কানে যা’ আসে শুরুয়ার মত বাধা দেয় না।
—সায়েবী টুপি কোখন পাইছো?
—সায়েবে আছে?
—কোথন পাইছে?
—বাচ্চারা আছে। পইড়াছিল কোথাও।
ব্যাখ্যায় আলিম সন্তুষ্ট হয়না। কিন্তু আর মুখ খোলেনা। পুরাতন টুপি নাড়াচাড়া ক’রে দেখে। পুরাতন, কিন্তু ফেলে দেওয়ার মত নয়।
বাসেদা স্বামীর নির্বিকার মেজাজে ধাক্কা দিল : ঘুমাইতা আইছো,না কাইজ্যা করতা আইছো?
—না, ঘুম ধরে না।
—তয় খাড়া রও। কেরাসিন এত সস্তা না।
স্ত্রী ডিপা নিভিয়ে দিল। হ্যাট হাতে ভুতের মত অন্ধকারে সত্যি দাঁড়িয়ে রইল মুয়াজ্জিন।
বাসেদার নাক ডাকছে ঘুমের ঘোরে, তখনও দাঁড়িয়ে রইল আলিম।
পরদিন রাত্রে সে আবার বাড়ী এসে উপস্থিত। অনেকক্ষণ দাওয়ার পাশে ওৎ পেতে ছিল। পরে হাজিরি জানান দেয়। মাচার উপর হ্যাট আর কোথাও নড়-চড় হয়নি।
ডিপা জ্বেলে স্ত্রী জিজ্ঞেস করে : এত ঘন ঘন? বুড়াকালে পীরিত ঘন অয়, কি কন্ মুয়াজ্জিন সা’ব?
—আইলাম।
বোকার মত আলিম জবাব দিল। পরে নানা অছিলায় ছেলেদের সে ঘুম থেকে তুলল।
—খলিল, হ্যাড কোখন পাইছো?
—জঙ্গলে পইড়াছিল, বা-জান। তুমি শহরখন আইছো?
—হ।
—মিঠাই দেবানি?
পুত্রের প্রশ্নে আলিম চুপ করে গেল। কাঁচা ঘুম ভাঙা, ছেলেরা আর ঘুমাতে চায়না। শেষে মার ধমকের চোটে দুইজনে শুয়ে পড়ল।
এবার বাবার পালা।
বাসেদা বলে : তোয়ার মন এতো ছোডো। মসজিদে শুইয়্যা মানুষে ফেরেশতা অয় না। আঁই বুঝি ন, আইজ ক্যান্ আইলে?
আলিমের জবাব খুব সংক্ষিপ্ত : বড্ড পেরেশান।
স্ত্রী স্বামীর পেরেশানী বোঝে না, নুনের ছিটা চালায় : পোলাগো হাতে এক প’হার চিজ ছোঁয়াতে পারে না। এহন আইছেন হারামী কিনা এগজামিন করতে। সরমের মাথা খাইছে, আর অইব কি?
আলিম লজ্জার মস্তক ভক্ষণই করেছিল বোধ হয়, আর কোন সাড়া দিল না। সেদিন ভোর হওয়ার অনেক আগেই বাড়ী থেকে চলে এলো।
পরবর্তী দু’দিন মসজিদের কাজে সে ডুবে গেল যেন। বাগানে আগাছা একটিও নেই। শুকনা পাতা ঝেঁটিয়ে দিয়েছে। দুটি শিউলি গাছের গোড়া বর্ষার জলে ক্ষয়ে গিয়েছিল। নিজে পলিমাটি ধরিয়ে দিল। সারা রাত্রি পড়ল ওজিফার কেতাব।
পরদিন শুক্রবার।
ফজরের আজান দিয়ে আলিম বসেছে ওজিফার কেতাব হাতে। আর ওঠার নাম নেই। বিড়বিড় শব্দে পড়ে আর চোখ বুজে মাথা দোলায়। একদম নিবিষ্ট-চিত্ত।
রক্তিম সূর্য উঠল পূর্বের আকাশে। রোজ আলিম সূর্যোদয় দেখে মিনার থেকে। দূরে নদীর চওড়া সীনা আর বনানী-বিথার, গ্রামের কালো ঝাপসা রূপ। উপরে লালিমার উঁকি। নর্তকীর মত ইশারার ঝিলিকের পর মিষ্টি হাসি চেপে মুখের উপর পাৎলা মেঘের ওড়না টেনে দিচ্ছে। আকাশ চিরে বাদুড় ভেসে যাচ্ছে শ্লথ-গতি। কাক ডাকছে। আজ কোনদিকে তাকায়নি আলিম।
জুম্মার আজানের সময় হোলো। সে উঠল না। মুসল্লীরা একে একে প্রাঙ্গণে জল। মুয়াজ্জিন উঠল না। একাগ্রমনা সে পড়ছে, পড়ছে।
মসজিদ কমিটীর সদস্য দু-তিনজন এলেন। শুক্রবারের হাজিরির বেলা কয়েকজনের গাফলতি থাকে না। দরাফ তালুকদার অন্যতম মুসল্লী।
তিনি এগিয়ে এসে বললেন : ওহে আজান দাও।
একবার চোখ তুলে মুয়াজ্জিন আবার কেতাবের পাতায় ঢুকল।
আরো কয়েকজন চারিপাশ দিয়ে অনুরোধ জানায়। আলিম কোন দিকে চায় না।
দরাফ হঠাৎ মুয়াজ্জিনের ঘাড়ে ঝাঁকুনি দিয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বলেন : ওহে উঠবে কিনা?
এবার আলিম লাফিয়ে উঠল। কেতাব ছুঁড়ে দিল একদিকে। গায়ের পিরহান ফড়ফড় ছিড়ে ফেলল। চেঁচিয়ে উঠল, “ছুটটা মিল গিয়া”- হো-হো-হে-হে…।
মুসল্লীরা একদম স্তব্ধ।
আলিমের মুখে এক কথা, “ছুটী মিল গিয়া।” আর সঙ্গে সঙ্গে উল্লম্ফন। কয়েক জন তাকে ধরে ফেলল। কিন্তু চীৎকার আর থামেনা।
দরাফ বললেন : কেউ আপনারা আজান দিয়ে দিন। শেষে পাগল হোয়ে গেল নাকি?
জনৈক মুসল্লী আজান দিতে উঠেছে মিনারে। আলিম সকলের হাত ছাড়িয়ে সচীৎকারে ছোটে, “নামো শালা-নামো। আমার বিশ বছর হোয়ে গেছে, দখলী স্বত্ব জন্মে গেছে। দেব ঠুকে আদালতে। নামো শালা।” আরো আনুসঙ্গিক চোস্ত খিস্তি।
দরাফ সাহেব ঠাস করে গালে দু-চড় কষিয়ে দিলেন। তাঁর সিল্কের আচকানে এক রাশ থুথুর পলেস্তার ছুঁড়ে দিল আলিম। কয়েকজন এসে ধরল মুয়াজ্জিনকে। আজান চলতে থাকে।
মন্তব্যের খই ফোটে।
—ইসম (মন্ত্র) পড়া নিয়েছে। সবাই কি ইসমের তেজ সহ্য করতে পারে?
—বেচারা পাগল হোয়ে গেল।
—কোন বে-আদবী করেছে, কত পীর পয়গম্বর মসজিদে থাকে।
—জীনের আসরও হোতে পারে।
—চুকচুক, আহা!
আলিম তখন প্রাণ-পণে চীৎকার করছে, বোধ হয়, ইসমের গরমে, “আমার জায়গা দখল হোয়ে গেল—ছুটটা মিল গিয়া।”
মসজিদ কমিটীর অন্যতম সদস্য বৃটীশ আমলের অবসর প্রাপ্ত একজন পুলিশ সুপার উপস্থিত ছিলেন। বললেন, “ Dismiss him with the kicks of an administrator. He has polluted the sanctity of this holy land. In England,”
হট্টগোলে তাঁর উপদেশ চাপা পড়ে গেল। কয়েকজন টেনেহিঁচড়ে আলিমকে মসজিদ থেকে বের করে দরজার খিল এঁটে দিল। নামাজের ওয়াক্ত, আর দেরী চলে না।
দরাফ সাহেবের ওজু ভেঙ্গে গেছে, মুখে পাগলের থুথু পড়েছিল। আবার ওজু শুধরে রুমালে হাত মুছতে মুছতে স্বীয় দূরদৃষ্টির প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন, “মৌলানা ফিদা আলি, আমি কি আগে বলিনি-লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। পাগল হওয়া মরা এক কথা।
মসজিদের দরজায় তখন দমাদ্দম লাথি পড়ছে ভূতপূর্ব মুয়াজ্জিনের। কণ্ঠে কি ইসম-তেজা জোরঃ “শালারা, গেটে তালা দিয়েছিলে, এখন আল্লার ঘর এঁটে দিলে। কেওয়াড়ী তোড় ডালুঙ্গা। ভেঙে ফেলব—ভেঙে ফেলব – ছুটটা মিল গিয়া…।”
অতঃপর-
এই দেওয়ানা আমল।
একদা-মুয়াজ্জিন আলিম সেদিনই গ্রামে ছুটে গিয়েছিল।
পড়ন্ত বিকেলে স্ত্রী রান্না-রত, চুলার পাশে ছেলে-মেয়ে দু-জন।
তাদের প্রথমেই সুসংবাদ দিল আলিম, “ছুট্টী মিল গিয়া।”
তারপর এক দৌড়ে ঘরের ভেতর। মাচাঙ থেকে হ্যাট নিয়ে এলো। আঙিনায় দু-শট দিল হ্যাটে। আকাশ-চারী টুপি মাটিতে পড়ার আগে লুফে নিয়ে বেরিয়ে এলো একদম সদর রাস্তায়।
আর কোনদিন আলিম নিজের গ্রামে ফেরেনি।
আলিম ছুটি পেয়েছিল সত্য। কোন ধান্দা নেই। স্নায়ুর গতি-বেগে চলা শুধু। খণ্ড-বিচিত্র দৃশ্যমান জগৎ চেতনায় ঝড় সৃষ্টি করে। আবার সব থিতিয়ে যায়। কখন হাসা, কখন কাঁদা। এই পিঞ্জর-বাসের দুঃখ আর কারো গায়ে পৌঁছাবে না।
গঞ্জে-শহরে চেনা-শোনা হোয়ে যায় অনেকের সঙ্গে। আলিমকে চেনে। এক তরফা পরিচয়। জীবিকার এক হাতিয়ার ছিল তার। আলিমের সুরেলা কণ্ঠ। সে কোরানশরীফ পড়ার সময় শাগরেদরা সব-কিছু ভুলে যেত। অমায়িত স্নেহে স্বভাবতঃ আট-দশ বছরের ছেলেরা বড় ঘরোয়া অনুভব করত মোয়াজ্জিনের সান্নিধ্যে। তার উপর সুরের আবেশ। আজ কাল এই জন্য আলিমের বন্ধুর অভাব হয় না। এক কাপ চা দিয়ে গান শোনে। কেউ দু-চার পয়সা দেয়। সুরেলা কণ্ঠের নূতন অভিযান নূতন পথে।
একদিন বিকালে ফিটফাট এক ভদ্রলোক ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে বলে, “এ গাইছিল?”
—ক্যান।
—আহা। আমি ভাবলাম আর কেউ
নেপথ্যে একজন উত্তর দিল : হতাশ হোলেন?
—সত্যি হতাশ হোলাম। পাগল না হোলে আমি রেডিয়োর জন্যে ধরে নিয়ে যেতাম।
“জন্ম-শিল্পী, মশাই, born-artist.” পরে আলিমের দিকে চেয়ে সে বলেছিল, “ভাই, জওয়ান বয়স থেকে এমন গলাখানা নষ্ট করছো? এখনও সময় ছিল, কিন্তু -।”
আলিম এবার জবাব দিল, “গলা কেটে দিই নিয়ে যান। মেরামত করে ফিরে দিয়ে যাবেন।”
উপস্থিত দর্শকেরা হাসে। পরে আলিম কি বুঝেছিল সেই জানে, চেঁচিয়ে উঠল, “ছুটটা মিল গিয়া।”
আর বসে থাকার বান্দা নয় মুয়াজ্জিন। কিন্তু আজ অনুরোধ-কর্তা অগণন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আলিম।
—একটা গান। একটা গান।
—না। গান আর গামুনা। তৌবা, গান হারাম।
—গান গাবানা, দোস্ত?
একজন নেপথ্য-বন্ধু এসে জুটল এই সময়।
দোস্ত-শব্দে আলিম বড় খুশী। তার দিকে হাসি বিনিময় করে জাঁকিয়ে বসল সে।
গান শুরু হয়।
ওরে…ও…বন্ধু…
আঁ-আরে রাত কান্দায়, দিন কান্দায়
লুনা দইজ্জার পানির ফরে
একলা গেলা কোন্ সফরে
ওরে…ও…বন্ধু…পেটের ধান্দায়!
বিরহিনী নাবিক-বধূর আর্তনাদ টেলিগ্রাফের তার দীর্ণ গোধুলির আকাশে ব্যঞ্জনা মাখায়। ট্রাফিকের হট্টরোল, হাঁক-ডাক, পথ-চারী শব্দের জনতা যেন ক্ষণিক কোথাও দূরে সরে যায়।
এমনই রোজনামচা আলিমের।
মাঝে মাঝে দু-চার ঘণ্টা সে বেশ ভাল মানুষ। লেবাস ছাড়া পাগলামির চিহ্ন নেই আর কোথাও। তখন জবাব দেবে স্বাভাবিক মানুষের মত। তারপর নিজেই ছুটবে পানির কলে কি পুকুরে। মাথায় পানি চোঁয়াবে বহুক্ষণ ধরে। বড় অস্থায়ী তার জগতের বিন্যস্ত-অখণ্ডতা।
আজ কাল আজান শুনলেই সে আঙুল দিয়ে কানের ছিদ্র বন্ধ করে।
চা-খানার দোস্ত জিজ্ঞেস করে, “ইড়া কি, মিয়া? মুয়াজ্জিন না তুমি?”
তখন মেজাজ ভাল। হেসেই জবাব দেবে, “মিয়া, আগে কানের গোড়ায় আঙুল দিতাম। এহন ভিতরে দিয়ে ফেলাই। দুষ কি?…ছুটা মিল গিয়া…’
এই শুরু হলো আবার!
চব্বিশ ঘণ্টায় বহুবার আলিমের রাগ চড়ে। অন্য কারো উপর নয়, বেচারা হ্যাটের উপর। তারপর চালাবে শট, কোন সময় লাথি। মাথা ঠাণ্ডা হোলে তুলবে মাথায়।
ফেল্ট হ্যাট। একদিন এক মুচি বলে, “দাও না, দোস্ত। ভাল জুতা হবে।”
দোস্ত-শব্দে ফিফিক্ হাসে আলিম। দাঁত বের করে বলে, “সত্যি জুতা অইব?”
–সত্যি।
—বা’লামতি বানাইবা, মিয়া। পায়ের লাথি খাওন চায়।
মুয়াজ্জিন হ্যাট মুচিকে দিয়ে ফেল্ল।
সেদিন কয়েকজন টুপির খোঁজ নিল।
—সা’ব, টুপি কই?
—বেইচ্যা দিছি।
—এহন মাথায় কি দিবা?
—কিছু দিমু না।
একজন দয়া-পরবশ হোয়ে কিস্তী টুপি দিয়েছিল। আলিম ফেরৎ দিল তখনই।
—মিয়া-বাই। আর কিস্তীর জরুরত নাই।
—ক্যান?
—পানির উপর কিস্তী থাহে। মাথার পর কিস্তী চাপাইমু? আঁর মাথাডা পানি-ভরা না। মগজ আছে। টাকা মগজ, মিয়া বাই।
তখন কে কত হাসতে পারে, তার প্রতিযোগিতা চলে।
কিন্তু টুপির অভাবে রৌদ্রে নয় শুধু, আলিমের মাথা খুব তেতে উঠলো। মাত্রা বেড়ে গেল পাগলামির।
চৌ-রাস্তার পাশে বড় চতুর ওয়ালা মসজিদ। মগরীবের আজান হোয়ে গেছে। দলে দলে মুসল্লীরা কাতার-বন্দী খাড়া। তকবীর শেষ হলো, এবার নামাজ শুরু হয় হয়। এমন সময় উঁচু গম্বুজের পাশ থেকে ছায়া-মূর্তি বেরিয়ে এলো। অন্ধকারে কিছু চেনা যায় না। কালো মোটা মানুষের ছায়া-রেখা। হাতে ঈষৎ বাঁকা লাঠি।
হাত নেড়ে এবার সে কর্ণভেদী শব্দ-বাণ ছাড়ল, “এই-এই-মুসল্লীরা।”
নামাজ আপাততঃ স্থগিত। চীৎকারের দাপট যা, শব্দ-ঘায়েল ইমাম মিম্বর ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
—এই-এই-মুসল্লীরা।
নিচে থেকে জবাব গেল -কি চাস?
ছায়া-মূর্তি পুনরায় প্রশ্ন করে : এই আহম্মকেরা, কি করতাছস?
উত্তরের সম্মিলিত রব :-নেমে আয়।
“এই-এই-এ্যাতো গভনর জেনরিল অইলে দ্যাশের শাসন চলব ক্যামনে? অরাজকতা লাইগব
না?” জোর চীৎকার।
টর্চ ফেলে দেখা গেল আলিম পাগল। সে তখন পঞ্চম মার্গে।
—এ্যাতো গভনর জেনরিল অইলে দ্যাশের শাসন চলব ক্যামনে? এই দ্যাহো-আঁই নামাজ পইড়্যা পইড়্যা গভনর জেনরিল অইছি। ছুট্টী মিল গিয়া।
বিকট উল্লাস-মাখা উন্মাদের হাসি হি-হিঃ- গভনর জেনরিল অইছি।
নামাজ শুরু করা যায় না। এই চীৎকার, তার উপর যদি গুম্বজ থেকে মুসল্লীদের উপর লাফিয়ে পড়ে। পাগলের কারখানায় আন্দাজ চলে না।
পুলিশ এলো টর্চ ও ব্যাটন হাতে। হাঁক মারে তারা : এই কি করছিস?
—হাওয়া খাইছি. মিয়া।
—আর জায়গা পানে?
—দুনিয়ায় গরম। গরমের চোটে হগ্গলের মাথা গরম। এহানে ঠাণ্ডা অইতাছি।
মুসল্লী পুলিশ হেসে উঠল।
একজন পুলিশ হাসি থামিয়ে জবাব দিল : দুনিয়া এখন ঠাণ্ডা আয়, নেমে আয়।
—ঠাণ্ডা! ঠিক কইতাছেন?
—হ্যাঁ, বিলকুল ঠাণ্ডা।
আর অন্য পাঁয়তারার প্রয়োজন হয় না। ভালো মানুষের মত নেমে এলো আলিম মুয়াজ্জিন। তার আগে একবার আজান দিল। অদ্ভুত কণ্ঠ। অনেকের রাগ পানি। কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করে : আহা!
পুলিশ তেড়ে এলো। মসজিদের রোয়াকে পা দিতে ভেংচি কেটে আলিম দু’ লাফে পগার পার।
নামাজ শুরু হোলো আবার।
তারপর বহুদিন এই তল্লাটে আলিমকে আর দেখা গেল না।
দাঙ্গা বেধেছিল শহরে। তখন ফিরে এলো। অলি-গলি ঘুরে বেড়ায় সে। মুখে একমাত্র চীৎকারঃ আমি হিন্দু, আমি হিন্দু।
রাস্তায় লাল দাগ-সিন্দুর, ইটের গুঁড়া, কি অন্য যে কোন রক্তিম পদার্থ দেখলে সে পথিকদের সাবধান করে দিত : দেইখ্যা চলেন, সাব। আর বা’ই মরছে।
অনেকে সাবধানের হেতু না বুঝে জিজ্ঞেস করত : তোমার ভাই মরেছে ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে গণ্ডগোল করছ কেন?
–দ্যাহেন না। হের কত খুন।
তারপর আঙুল বাড়িয়ে দিত লাল সামগ্রীর দিকে।
চার দিন পরে এলো রিফিউজীর বন্যা। ষ্টেশন, খোলা মাঠ, পুলের তলা, রেল লাইনের পাশ ছেয়ে গেল। চারিদিকে রিফিউজী।
আলিমও রিফিউজী। দলে ভিড়ে গেল।
সে একজন আগন্তুককে বলে : এবার আর ঘর ভাড়া দেওন পড়ব?
—কেন?
—জায়গা দখল কইরা ছাড়ছেন। বিনা ভাড়ায় ভালা ছিলাম।
পরে পাগলের দিকে চেয়ে আর কে জবাব দেবে? হাসত না আগন্তুক। মুখের হাসি ত অতীত যুগের স্মৃতি!
চারিদিকে এখন ঘুরে বেড়ায় আলিম একই এলাকায়। এত অগণন নবাগত! আলিম হয়ত বিস্ময়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘুম নেই। ক্লান্ত হোলে ওভার-ব্রীজের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বিড়ি টানে। নিজের মনে হাসে, আর অস্পষ্ট শব্দে বলে : হালা, এক পাগ্লা ছিলা আমা মুয়াজ্জিন। এহন দেহি, ঢের পাগ্লা বাড়ছে। নিদের জায়গা মেলে না।
চেনা লোক ছাড়া আর সকলের কাছে সে রিফিউজী।
কয়েকজন নবাগত সংসার পেতেছিল ষ্টেশনের পশ্চিমে ছোট খোলা মাঠে। ইটের চুলায় রান্না চড়িয়েছে। আলিম এক বোঝা কাঠ এনে দিল। পাগলের হৃদ্যতাও আজ অবহেলার বস্তু নয়।
একজন বলে : দুটো খেয়ে যান, রান্না হলো।
আলিম কোন জবাব দেয় না। এক ঠোঙা মিষ্টি যোগাড় করে আনল সে। ছোট ছেলেরা এগিয়ে এসে ছোঁ মেরে তার হাত থেকে নিয়ে গেল। একদম বেকুব আলিম। ক্ষতি কি? মিশে গেছে সে নবাগতদের জীবনে।
কোন সেবা-প্রতিষ্ঠানের একদল জোয়ান ছেলে এসে হঠাৎ রিফিউজীদের নাম টুকে টুকে কার্ড দিতে শুরু করল। আলিমও ভিড়ে বসে গেছে। ভ্রাম্যমাণ জীবনের চাকা কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে রেখেছে।
এক নও-জোয়ান জিজ্ঞেস করে : নাম?
—আলিম-উদ্দিন নকীবুল্লা খাঁ শাহে-
যুবক আর কথা শোনে না। তার চোখ এতক্ষণ শাহের লেবাসের উপর পড়েনি।
ধমক দিয়ে সে বলে : ভাগো-ভাগো।
দাঁড়িয়ে পড়ল আলিম : কার্ড দেবা না?
—না।
—দ্যান না মেহেরবানী কইরা। একখানা আগাখানি কার্ড I
দাঁত ছিরকুটে আলিম অনুনয় করে।
যুবক কৌতূহলে জিজ্ঞেস করে : আগাখানি কার্ড? সে আবার কি?
আলিম প্রশ্নকর্তার দিকে তাকায়। কিছুই জানে না, এমন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী।
—আগা খান ভেস্তে যাওনের সার্টিপিকেট দ্যান। আপনেরা ত ভেস্তে যাওনের তরে দিতাছেন?
হেসে উঠল নওজওয়ান : বেশ রসিক ত তুমি হে।
মুয়াজ্জিন আবার অনুনয় করে : দ্যান না একখানা আগাখানি কার্ড। আরও ভেস্তে যাওনের সখ অইছে। এবার জোর ধমক খায় আলিম। আর বসে থাকে না সে, উঠে পড়ল। ছেঁড়া খবরের কাগজ জোগাড় করে নিয়ে এলো কোথা থেকে। কলমের বদলে হাতের লাঠি। রিফিউজীদের ভিড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের মনে লেখে লাঠির কলমে। পরে কাগজ ছিঁড়ে-ছিঁড়ে জিজ্ঞেস করে : আগাখানি কার্ড নেবা?
কেউ হাসে, কেউ জিজ্ঞেস করে : বড় জবর কলম বানাইছ মিয়া?
—হ। বিরক্ত কইরো না। দ্যাহোনা লিখতাছি।
জনতা থেকে জনতান্তরে আলিমের গতিবিধি। হাসে অনেকে। কলম মুঠির ভেতর, আঙুলের ডগায় নয়।
রঙ্গ-মঞ্চে বিয়োগান্ত দৃশ্যের এক টেরে বৈহাসিকের অভিনয়-রত আলিম মুয়াজ্জিন।
আবার এক-আধ ঘণ্টা এই এলাকায় আলিম গর-হাজির থাকে। বোধ হয় ভক্তদের কাছে যায়। আবার ফিরে আসে। নতুন তামাসা পেয়েছে যেন সে। এলাকার মায়া কাটাতে পারে না।
কয়েকটি লোক সংসার পেতে বসে গেছে। ইটের চুলা। পাশে হাড়ি-পাতিল, পেটরা ইত্যাদি লোয়াজিমা। দু-জন একটা ঘর বানিয়ে ফেলল। বাঁশের চাঁচের দর্মা গোল করে মুড়ে মাটির সঙ্গে চার কোণে খুঁটায় বাঁধা। ঠিক গোল কবরের মত। গুঁড়ি মেরে ভেতরে ঢুকতে হয়। একদিকে জানালার মত ইঞ্চি ছয় কাটা। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কবরের আয়তনের চেয়ে একটু বড়। কবর নয়, ঘর। সেইজন্য একটু বড়। ভেতরে গোটা পরিবার সুখে থাকতে পারে। সামনে কয়েকটি টুকরো ইট বিছানো। একটু ঢালু বলে এইদিকে বৃষ্টির জল গড়ায়। তাই এই কংক্রিট ব্যবস্থা।
পাশে রেল কম্পাউণ্ডের রেলিং। তারপর শহরের চওড়া সড়ক।
আলিম রেলিঙে হেলান দিয়ে ঘুমায়। বৃষ্টি এলে ভাঙা ছাতা খোলে। সেখানেও শরীক বেড়ে গেছে। ঐ সংসারের কচি ছেলে-মেয়েরা হিস্যা চায়। বয়স্করা কেউ গাছতলায়, কেউ ওয়েটিংরুমের দিকে ছোটে। মেয়েরা সংসার আগলে বৃষ্টির জল পৃথিবীর পক্ষে পর্যাপ্ত নয় বলে তার সঙ্গে চোখের জল মেশায়। একটা বুড়ী হাউ-মাউ করে মারাই গেল সেদিন।
পরে আলিম আর এক বেকুফী করে বসল। মিঠাই বিতরণের অভিজ্ঞতা তার মনে ছিল না। হঠাৎ খেয়াল, ছেলেদের পয়সা দিতে শুরু করল। লেবাসের জঙ্গল থেকে ছ্যাঁদা পয়সা, আধ-আনি বেরোয়। ছোট ছেলে-মেয়ে সংখ্যায় দু-চার জন ছিল প্রথম। শেষে পঞ্চাশ জনের বেশী একসঙ্গে তাকে ছেঁকে ধরল। কয়েক জনের হাতে দিতেই পয়সা খতম। শেষে আর পয়সা বেরোয় না। হতাশ জনেরা ভাবল, আরো পয়সা আছে জাম্বিলে; আলিম শুধু কৃপণতা করছে। শুরু হোলো বডি সার্চ অর্থাৎ পোষাক ধরে টানাটানি। পেছনে টান দিতে ধুতির ছেঁড়া পাড় ঝুলে পড়ল। “লেজ বেরিয়েছে, লেজ বেরিয়েছে”–চীৎকার আর হট্টগোল শিশুদের। একজন হাতের দিকে মারল টান। বহু কাপড়ের ঝালরবিশিষ্ট আস্তিন খসে পড়ল। চারিদিকে বস্ত্রহরণ পর্ব। তাম্র মুদ্রার আস্বাদে মরীয়া সদ্য-ভিক্ষার্থীরা। শেষে আলিমের উলঙ্গ হওয়ার আর বেশী বাকী থাকে না।
এক ছুট মেরে সে কবর-স্মারক চাঁচের ঘরে ঢুকল। হাতে লাঠি। ছেলেরা কাছে ঘেঁষে না। দূর থেকে উঁকি মারে আর হল্লার তলানি ছিটোয়। রাগে ভেংচি কাটে আলিম। ছেলেরা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়। কয়েকজন বর্ষীয়ান এসে ধমক দিতে ওরা পালায়। নচেৎ আরো দুর্ভোগ ছিল আলিমের।
সে আর ঘর থেকে বোরোয় না। রাস্তায় লোকজন হাঁটছে।
ছোট জানালা (ছ-ইঞ্চির ঝরোকা) তুলে আলিম হাঁকে : এই-এই।
একজন পথিকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।
—এই-এই।
—কি?
চীৎকার করে উঠল আলিম : “আমি রিফিউজী, আমি রিফিউজী।”
আরো লোক জুটে। অনেকে আলিমকে চিনতে পারে না। কারণ মুখের কিয়দংশ আর এক জোড়া চোখ শুধু বেরিয়ে আছে।
নেপথ্যে কেউ বলে : তুমি রিফিউজী ত কি?
আরো কৌতূহলী পথিকের প্রশ্ন।
—কি হোয়েছে?
—এই দ্যাহো। আমি রিফিউজী। ওদিকে খেদাইছে। এহানে কবর তৈরী কইরা রাখছে। বেহেশত সাব। আহেন, ভিতরে আহেন। বয়েন না।
পথিকেরা হাসে।
পাগল বিকট উল্লাসে ফেটে পড়ে : আহেন না। ভিতরে ভেস্তখানা। হি হি হি।
—পাগল, পাগল।
ভিড় ভেঙ্গে গেল।
সমাগত সন্ধ্যা। মেঘ ধরেছে আকাশে। তামাসা দেখতে আর কেউ রাজী নয়।
যে যার পথ দেখে। গৃহস্বামী এসে তাড়া দিল। বেরিয়ে এলো আলিম।
দমকা ঝ’ড়ো বাতাসে ধুলো উড়ছে। সে একদিকে ছুট দিতে-দিতে গান ধরে : ও-হো ছুটী মিল গিয়া।
পরদিন বিকালে দেখা গেল, অবশিষ্ট লেবাসের মায়া কাটিয়ে উঠেছে আলিম। কোমরে সাদা থান- কাপড় গজ খানেক। বোধ হয় কারো দয়া বা গানের আসরের সঞ্চয়ে কেনা। আর সমস্ত শরীর বিবস্ত্র। হাতের লাঠি আছে। কানের পাশে চুলের গোছায় বাঁশি গোঁজা। আহা! সংসারের সর্বাশ্রয় পকেট নেই আজ। জাপানী চেরী গাছের তলায় বসে আছে মুয়াজ্জিন। কয়েকবার বাঁশি বাজিয়ে চুপ হোয়ে গেল। বিকুল তন্ময়-চিত্ত। পা ছড়িয়ে দিল ধীরে ধীরে।
দূরে-দূরে ইতঃক্ষিপ্ত রিফিউজীদের জটল্লা। ঈষৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন মুয়াজ্জিন।
হঠাৎ সম্মিলিত কণ্ঠ-ধ্বনির আঘাতে আচমকা চোখ মেলে সে কান খাড়া করল। শব্দ নিকটবর্তী।
উঠে দাঁড়ায় আলিম।
শোনা যাচ্ছে : “হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই। দেশত্যাগী হবো না। দাঙ্গাবাজ বরবাদ হোক।”
স্কুল-কলেজের ছেলেরা শান্তি-মিছিল বের করেছিল।
লাফ দিয়ে উঠল আলিম। ঘুরে যেতে হয় রাস্তায়। অত তর সয় না। এক লাফে রেলিং টপকে ওদিকে পৌঁছল সে।
মিছিল এখন কয়েক গজ দূরে মাত্র। কাতারের শেষে ছোট ছেলেরা। আলিম দৌড় মেরে তাদের পিছনে সামিল হয়।
বজ্রকণ্ঠে প্রতিধ্বনি তোলে : হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই।
আলিম আজানের ভঙ্গিতে কানের গোড়ায় হাত তুলল। এমন সময় শোভাযাত্রার একজন পরিচালক এসে বলল : এই, তুমি যে ছেলেদের সঙ্গে?
এবার গটগট হেঁটে আলিম একদম মিছিলের অগ্রভাগে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘সকলের চেয়ে বয়সে বড়’ ফের হেসে বলে : ঠিক হ্যায়?
শোভাযাত্রার পরিচালক হেসে জবাব দিল : ঠিক হ্যায়।
আলিম বলে : চুপচাপ ক্যান্? আজান দিতা আছিলা না? আজান দ্যাও।
আদেশ-অনুরোধপুষ্ট কণ্ঠস্বর।
কয়েকজন চীৎকার করে উঠে : “আল্লাহো-।”
রীতিমত ধমক দিয়ে উঠল আলিম : ও নয়। আজান দ্যাও।
পাগলের অনুরোধই বটে।
মিছিলের জোট-বাঁধা আওয়াজ শতধা তরঙ্গ তোলে : হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই।
হাসল পাগল। “ঠিক হ্যায়” বলে আজানের ভঙ্গী-মাফিক দুই কানে আঙুল ছোঁয়ায় তখন।
মিছিল এগিয়ে চলেছে। তেমনই আছে কানের ডগায় আঙুল। এগিয়ে চলল আলিম।
চলমান মিনার-বিশিষ্ট কোন মসজিদের বরখাস্ত-পদে আবার যেন বহাল হোয়েছে সে।