আলবের্ট শ্বোয়াইৎসার
“আজিকে একেলা বসি শোকের প্রদোষ-অন্ধকারে
মৃত্যুতরঙ্গিণীধারা-মুখরিত ভাঙনের ধারে
তোমারে শুধাই,- আজি বাধা কি গো ঘুচিল চোখের
সুন্দর কি ধরা দিল অনিন্দিত নন্দনলোকের
আলোকে সম্মুখে তব,– উদয়শৈলের তলে আজি
নবসূর্য বন্দনায় কোথায় ভরিলে তব সাজি
নবছন্দে, নতুন আনন্দগানে?”
এই কবিতাটি রচিত হবার পর প্রায় চল্লিশ বৎসর কেটে গিয়েছে। আমার চেনা-অচেনা অনেক প্রখ্যাত পুণ্যশ্লোক জন ইহলোক ত্যাগ করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এ প্রশ্নটি তাঁদের উদ্দেশে শুধাইনি। হয়তো ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু আজ আর এ প্রশ্ন না শুধিয়ে থাকা গেল না।
কারণ এই মহাপুরুষ জীবনে সত্য সুন্দর শিবের যে সাধনা করেছিলেন সেটা সর্বযুগেই বিরল। এবং তার চেয়েও আশ্চর্য, তিনি একই পথে আজীবন সাধনা করেননি।
আলুসেসের কাইজারবের্ক অঞ্চলে ১৪ জানুয়ারি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে এঁর জন্ম।(১) সে অঞ্চল তখন জর্মন ছিল বলে তিনি জর্মন। ধর্মতত্ত্ব (প্রটেস্টান্ট বা এভানজেলিক) পড়ে তিনি চব্বিশ বছর সহপাদ্রিরূপে ঈশ্বর-মানুষ-গির্জার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কিন্তু বছর তিন যেতে না যেতেই খ্রিস্টধর্মের মূলতত্ত্ব নিয়ে তাঁর মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয় সেগুলো নিয়ে চিন্তা, গবেষণা ও সাধনা গির্জার সেবায় নিযুক্ত থেকে হয় না। তাই তিনি বিখ্যাত স্ট্রাসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হয়ে কাজে যোগ দেন। এই অল্প বয়সেই তিনি যে গবেষণা করেন সেটা খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবং সে গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য পাণ্ডিত্য সঞ্চয় বা পাণ্ডিত্য প্রকাশ আদৌ নয়। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কী প্রকারে খ্রিস্টের বাণী ও তৎপরবর্তী খ্রিস্টধর্মের প্রথম উৎপত্তিযুগের একটি অর্থপূর্ণ সর্বাঙ্গসুন্দর ছবি পাওয়া যায়, যেটা আজও এবং আবার নতুন করে খ্রিস্টসমাজে নতুন প্রাণ, নতুন ভক্তি, চরিত্র-সংগঠন ও সমাজবাস করার জন্য নতুন নীতি নির্মাণ করে দেবে।
এদেশে রামমোহন তাই করেছিলেন। অর্থাৎ উপনিষদের স্বর্ণযুগ পুনরায় আলোকিত করতে চেয়েছিলেন।
সউদি আরবের রাজা ইন্ সউদ যে সম্প্রদায়ভুক্ত তার প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহ্হাবও তাই করেছিলেন।
শ্বোয়াইৎসার এইসব তত্ত্বচিন্তায় ধ্যানধারণায় নিযুক্তকালীন প্রচুর সময় ব্যয় করেন সঙ্গীতস্রষ্টা য়োহান্ সেবাস্টিয়ান্ বাখৃ-এর ওপর। এখানেও সেই নবাবিষ্কারের কথা। এটা সত্য যে, বহু বৎসর দু-চারিটি কেন্দ্র ভিন্ন অন্য সর্বত্র বা অনাদরে থাকার পর সঙ্গীতস্রষ্টা মেন্ডেলজো পুনরায় রসিক-জনের দৃষ্টি বাখ-এর দিকে আকৃষ্ট করেন। এর পরেই বাখ-এর অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার শ্বোয়াইৎসার। গির্জার অর্গেনসঙ্গীত তারই প্রচেষ্টা ও প্রচারের ফলে পুনরায় নবজীবন লাভ করে। (অর্গেন ও অর্গেল এদেশের সঙ্গীতকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচুর প্রভাবান্বিত করে। এই নিয়েই কিঞ্চিৎ গবেষণা কিছুদিন পূর্বে এদেশে হয়। তার অন্যতম প্রশ্ন তখন ছিল অর্গেনকে কেটে হারমোনিয়ামরূপে প্রবর্তিত করে কে জনপ্রিয় হন কী করে, এর প্রতি আকাশবাণীর এত রাগ কেন, যদিও খান আবদুর করিম খানের মতো মহাপুরুষ যখন এরই সঙ্গতে গেয়েছেন? এ নিয়ে আরও আলোচনা হলে ভালো হয়। আবার কৃতজ্ঞচিত্তে শার্সদেবের শরণ নিচ্ছি। এবং এর সঙ্গে আরেকটি নিবেদন, ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয়কামী নবীন ভারতীয় শাগরেদকে একাধিক ইয়োরোপীয় বাখ নিয়ে আরম্ভ করতে বলেন। বাখ-এর রস খাওয়া আমাদের পক্ষে সহজতর। এ বিষয় নিয়েও তুলনাত্মক সঙ্গীতমহলে আলোচনা হওয়া উচিত।) এমনকি বলা হয় শ্বোয়াইৎসার স্বহস্তে উত্তম অর্গেনও নির্মাণ করতে শেখেন।
উপরের দুটি সাধনা– খ্রিস্টের জীবনানুসন্ধান ও বাখ– ভিন্ন তাঁর প্রধান অনুসন্ধান ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, রাষ্ট্ৰচালনায়, ধর্মনীতিকে পুনরায় দৃঢ় ভূমিতে স্থাপন করা।
***
সাধনা, অধ্যয়ন, ধ্যানধারণা, বাখ-এর ভগবদ্সঙ্গীত এ সমস্ত নিয়ে যখন শ্বোয়াইৎসার তন্ময়, যখন তাঁর খ্যাতি জৰ্মনির বাইরে বহুদূরে চলে গিয়েছে, তখন এই মহাত্মা হঠাৎ একদিন ত্রিশ বৎসর বয়সে, অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে। কারণটি সরল অথচ সুদূরে নিহিত।
ফরাসি-কঙ্গো অঞ্চলে যে-সব অনাচার হয়ে গিয়েছে তার খেসারতি মেরামতি করতে হবে। কঙ্গোর গভীরতম জঙ্গলে যে শত শত আফ্রিকাবাসী কুষ্ঠরোগে দিন দিন ক্ষয় হচ্ছে তাদের সেবা করতে।
তার পূর্বে কিন্তু তা হলে তো চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে হয়। ঠিক সেই জিনিসটিই সমাধান করে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মিশনারি ডাক্তাররূপে তিনি ফরাসি-কঙ্গোর দুর্গম অরণ্যের লাঁবারেনে-অঞ্চলে গিয়ে কুষ্ঠরোগীদের জন্য হাসপাতাল খুললেন। তার স্ত্রী দেশে নার্সের ট্রেনিং নিয়ে সেখানে সেবিকার কাজ গ্রহণ করলেন।
কিন্তু এই কঙ্গোবাসী কুষ্ঠরোগীদের অর্থসামর্থ্য কোথায়? শ্বেয়াইৎসা আবার সর্বশ্রেষ্ঠ ওষধি, সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, সর্বোত্তম সহকর্মী নিয়ে চিকিৎসা করতে চান। তার জন্য অর্থ কোথায়?
এর পরের ইতিহাস দীর্ঘ। তাতে আছে আদর্শবাদ, নৈরাশ্য, অকস্মাৎ অযাচিত দান এবং সর্বোপরি শোয়াইৎসারের অকুণ্ঠ বিশ্বাস : “মানুষের জীবন বিধিদত্ত রহস্যাবৃত– এর প্রতি প্রত্যেকটি মানুষের ভক্তির বিস্ময় ভয় থাকা উচিত।” এই অটল বিশ্বাস নিয়ে তিনি কিছুদিন পর পর সেই দুর্গম জঙ্গল অতিক্রম করে, ইয়োরোপে এসে অত্যুকৃষ্ট স্বরচিত আপন অভিজ্ঞতাপূর্ণ (বিশেষ করে অন্ধকার-কঙ্গোর) পুস্তক প্রকাশ করে, প্রাচীন দিনের বাখ-এর সঙ্গীত বাজিয়ে অর্থোপার্জন করতেন। প্রথম যুদ্ধের সময় তাঁর কাজে বাধা পড়ে; কারণ তিনি জাতে জর্মন হয়েও বাস করছেন ফরাসি কলোনিতে কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি এতই ভুবনবিখ্যাত যে দুই যুযুধান সৈন্যদলই তার হাসপাতালকে এড়িয়ে বাঁচিয়ে যুদ্ধ করে।
কিন্তু ১৯১৩ থেকে ১৯৬৫– এই দীর্ঘ বাহান্ন বৎসরের একনিষ্ঠ সাধনা তো ক্ষুদ্র একটি প্রবন্ধে শেষ করা যায় না। যদি কখনও সে সাধনার সিকি পরিমাণ খবরাখবর সংগ্রহ করতে পারি তবে পুনরায় চেষ্টা নেব।(২)
৯।১০।৬৫
———
১. মৃত্যু : ৪৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ কঙ্গোতে।
২. শ্বোয়াইৎসার ভারতীয় চিন্তাধারা সম্বন্ধে ১৯৩৫ সালে Dei Weltanse-hauung der indischen Denker নামক একখানা বই লেখেন। এই বই সম্বন্ধেও অনেক কিছু বলার আছে। আমি বহু বৎসর পূর্বে পড়েছি। সেখানি ফের পেলে কিছু লেখার দুরাশা আছে।