আলথুসার (উপন্যাস) – মাসরুর আরেফিন
১
বেকনট্রি স্টেশন থেকে ডিস্ট্রিক্ট লাইনের ট্রেন নিয়ে যাচ্ছি অক্সফোর্ড সার্কাস স্টেশনের দিকে, তখন দুটো ঘটনা ঘটল। স্টেশনের সামনে দেখলাম কয়েকটা সাকুরাগাছ—- আমরা যাকে ওরিয়েন্টাল চেরি বলি—যারা ফুল-পাতা মিলে কালকেও ছিল গাঢ় গোলাপি ও কিছুটা রয়্যাল ইয়েলো রং, তারা এখন সাদা ও মরা গোলাপির এক আতঙ্কজনক মিশ্রণ। তিনটে গাছের এ রং পরিবর্তন কোনো বিষয় না; পুরো লন্ডন জুড়ে এই এপ্রিলে শত শত চেরি ব্লসম কদিন পরপর শহরের রংটাই একরকম বদলে চলেছে, তারা তাদের প্রজাতির নিয়মমতো প্রায় দশ ধরনের রং পরিবর্তনের খেলায় মেতেছে।
যেমন এবারের ট্রিপে যেদিন প্রথম আসি-পাঁচ দিন আগে—তখন যে রাস্তাটাকে দেখেছিলাম লাল-পার্পল, তা আজ ম্রিয়মাণ হয়ে যাওয়া স্রেফ সাদা, যা আবার কিনা বোঝা যায় দ্রুত চলে যাচ্ছে ধুলো-ময়লার অ্যাশের দিকে। আমার চোখ চার দিনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবে। এখানে বিষয় এটাই যে স্টেশনের দরজার মুখে—এবারের ট্রিপে এটাই আমার প্রথম লন্ডনের টিউবে ওঠা—ওই সাকুরাগাছগুলো ওভাবে দাঁড়ানো। বিষয় সেটাই কারণ, ‘সাকুরা’ জাপানের ‘পবিত্র’ বৃক্ষ, ওদের নামে মানুষকে বলি বা উৎসর্গ দিতে হয়। অতএব, আমার ভয় লাগল ওদের দেখে, মনে হলো ট্রেনের মধ্যে আবার না কিছু ঘটে।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ট্রেন চলার সময়ের। আমরা যত বেশি স্টেশনের পর স্টেশন পার হচ্ছি—বেকনট্রি থেকে আপনি, বার্কিং, আপটন পার্ক ইত্যাদি, তত আমাদের কামরা ভরে যাচ্ছে দেখলাম লোকে আর লোকে, এতটাই যে একসময় আমার আর নিজের পাশে দাঁড়ানো যাত্রীর মুখটুকু দেখবার উপায়ও থাকল না, কারণ আমার চারদিক থেকে মানুষ তাদের হাঁটু দিয়ে, কনুই, হাত, হাতের তালু ও আঙুল দিয়ে আমাকে ছেয়ে ফেলল, ঘিরে ফেলল। বাউ রোড স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছুতে আমরা আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই, প্রচণ্ড চাপে সবাই তখন দল বেঁধে ভাসছি কামরাজুড়ে। একমুহূর্তের জন্য এ-ও মনে হলো যে দুই সহযাত্রীকে—আমার একমাত্র শ্যালিকা ফারজানা ও তার স্বামী জোসেফ-আমি এমনকি কামরার ছাদের থেকে হাত-পা দিয়ে ছাদ আঁকড়ে নিচুমুখো ঝুলে থাকতে দেখলাম যেন। চাপের ওই উত্তুঙ্গ সময়েই, ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট সিস্টেমে তখন বাউ রোডে ঢোকার ঘোষণা চলছে, আমার খেয়াল হলো যে স্টেশনে কেউ আমাকে বা আমাদেরকে সিকিউরিটি চেক করেনি, কোনো বোমা বা বিস্ফোরক যন্ত্র শনাক্তকরণ গেট দিয়ে আমাদের ঢুকতে হয়নি। আমি শত শত লোক দেখেছি তাদের বড় বড় স্যুটকেস, থলে, ব্রিফকেস ইত্যাদি নিয়ে ট্রেনে উঠেছে। তাদেরকেও কেউ চেক করেনি একবারও, কোথায়ও, এবং তারাই এখন ঘিরে আছে আমাকে। তাদের অনেকেরই চেহারা সন্দেহজনক, আমার দিকে তাদের তাকানোটা সন্দেহজনক, যেভাবে তারা বারবার তাদের হাতের বড় ব্যাগ বা ব্রিফকেসে চোখ রাখছে, সেটা সন্দেহজনক।
ট্রেন বাউ রোডে থামার দোলাটা খেল, আমি নিজেকে ছেড়ে দিয়ে সামনের আলজেরিয়ান চেহারার এক বয়স্ক, হালকা দাড়িওয়ালা যাত্রীর গায়ের ওপরে আছড়ে পড়লাম, পড়তে পড়তে দেখলাম যে আমার পেছনের ইহুদি ভদ্রলোক (চার স্টেশন আগেই তিনি তার ক্রোশেড—যে শব্দের সঠিক বাংলা আমি জানি না, মোটামুটি বুঝি, এর অর্থ হাতে বুনে বুনে ফুল তোলা-বাটি আকারের, পাড়হীন কিপ্পা মাথায় পরে ট্রেনে উঠেছেন, আর আমার মনে পড়েছে এ ধরনের স্যাটিন না, ভেলভেট না ধরনের কিপ্পা পরে কেবল উগ্রবাদী জায়োনিস্ট ইহুদিরা) কোনোরকমে এক হাতে তার বড় ডাফেল ব্যাগ ও অন্য হাতে কামরায় দাঁড়ানোর পোলটা ধরে অর্ধবৃত্তাকারে দোল খেয়ে আমার পড়ন্ত গায়ের আধা ইঞ্চি দূরে নিজেকে স্থির করতে পারলেন, ঠিক ও রকম মুহূর্তে আমার মনে হলো এই দোলাটাই শেষ, এখনই বিরাট-বিশাল এক বোমা বিস্ফোরণে, রাষ্ট্রবিরোধী বা ইসলামি জিহাদবিরোধী বা ইহুদি-নাসারাবিরোধী এক বোমা বিস্ফোরণে এই ট্রেনটা ধুপ শব্দ করে আকাশের দিকে উড়ে যাবে শুধু নিজে না, শুধু আমাদেরকে সহ নিজে না, বাউ রোড স্টেশনের কোসটা কফিশপ (যাদেরকে সাম্প্রতিক কালে কিনে নিয়েছে আমেরিকান কোকা-কোলা কোম্পানি) এবং পুরো প্ল্যাটফর্ম ও স্টেশনের মূল দালানের বড় একটা অংশসহ। ‘আর ডেভিড ওপরে উঠে গেলেন জলপাই পাহাড়ের ঢালটা বেয়ে, কাঁদছেন ও উঠছেন, আর তার মাথা ঢাকা, তিনি হাঁটছেন খালি পায়ে আর যতগুলো লোক তার সঙ্গে আছেন, তাদের সবার মাথা ঢাকা [কিপ্লাটুপিতে], আর তারাও যেতে যেতে কাঁদছেন আর কাঁদছেন।’
না, অমন কিছু হলো না। ট্রেন বাউ রোড ছেড়ে যেতে প্রচুর লোক নেমে যাওয়াতে আমি বরং ফারজানা ও জোসেফকে ফিরে পেলাম। এবার আমরা তিনজন দাঁড়ালাম পাশাপাশি। ফারজানা আমাকে বলল যে কীভাবে এসব ট্রেনে লোক একটু নেমে যেতেই তাড়াতাড়ি বিশেষ কায়দায় শরীর পেছনের দিকে নিয়ে কোনো একটা খালি সিটে বসে পড়তে হয়। আমি শুকনো হাসলাম তার সে কথা শুনে এবং জোসেফকে বললাম বেকনট্রি স্টেশনের সামনে দাঁড়ানো সাকুরা বৃক্ষের কথা ও তার সঙ্গে মিশে থাকা জাপানিজ বলি বা উৎসর্গের কাহিনি, আর অন্যদিকে লন্ডনে এভাবে হাজার হাজার লোককে এই ২০১৯ সালের অগ্নিগর্ভ এপ্রিলে এসেও সামান্য তল্লাশিবিহীন ট্রেনে উঠতে দেওয়া মিলে আমি সন্ত্রাসী বোমা হামলা নিয়ে কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম। জোসেফ আমার মুখে বোমা, বম্ব ইত্যাদি শব্দ শুনে স্ ধ্বনিতে আমাকে মানা করল এসব শব্দ লন্ডনের টিউবে বসে উচ্চারণের ব্যাপারে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করা এক আঞ্চলিক বাংলায় (যাতে করে কোনো দিকে বসানো কোনো গোপন যন্ত্র তার কথা ঠিকভাবে ধরতে না পারে) মুখ চিপে জানাল যে তার জানা তথ্যমতে সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর থেকে লন্ডন টিউব কর্তৃপক্ষ ঠিক করেছে তারা আর আগের থেকে পাওয়া তথ্য ছাড়া যাত্রী তল্লাশি করবে না, তথ্যের ভিত্তিতে যেদিন বিপদের আশঙ্কা থাকবে, কেবল সেদিনই, শুধু তথ্য মোতাবেক নির্দিষ্ট স্টেশনে তথ্য মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট লোকগুলোকেই কেবল তারা তল্লাশি করবে, ধরবে। এ রকম একটা সাহসী, জুয়াখেলাসদৃশ সিদ্ধান্তের সঙ্গে নিউজিল্যান্ড মসজিদ শুটিংয়ের কী যোগাযোগ, তা আমি বুঝতে পারলাম না। কেবল বুঝলাম যে স্রেফ তাদের এই সিদ্ধান্তের কারণেই সামনের কোনো দিন—যদি আজ না হয় তো — সারা পৃথিবী শুনবে লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড রেলে আবার, আগেরবারের চেয়ে মৃত্যু-ক্ষতি-আহত হওয়া-ব্যাপ্তি এসবের বিচারে অনেক বড় আকারের এক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে, যাতে মৃতের সংখ্যা, ধরুন, আপাতত ৬৭৯ জন অ্যান্ড কাউন্টিং
মাঝখানে মাইল এন্ড স্টেশনে ট্রেন পাল্টে, সার্কেল লাইনের ট্রেন নিয়ে আমরা একসময়, অবশেষে, অক্সফোর্ড সার্কাস স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। প্ল্যাটফর্মে লাফিয়ে নামলাম ওখানে। তারপর খাড়া হওয়া এসকেলেটরের দীর্ঘ গলিপথ ধরে ওপর দিকে উঠছি, চারপাশে তাকাচ্ছি, আমি দেখছি কোন দিকে কয়টা সিসি ক্যামেরা বসানো, আর তখন মনে হলো এ মুহূর্তে এই ব্যাপারটুকু তাহলে রীতিমতো শান্তির যে তাদের কাছে থাকা তথ্য মোতাবেক আমি, ফারজানা কিংবা জোসেফ, আমরা চেহারায় পুরো এশিয়ান ও পুরো মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও (আমি জানি তারা চেহারার ও কাপড়ের প্রোফাইলিংয়ে কতটা দক্ষ ও পাকা) সন্ত্রাসী হিসেবে তাদের কাছে সন্দেহভাজন না। নিজেকে ‘ক্লিয়ারড’ মনে হওয়ার এ শান্তি অনেক স্বস্তির, কারণ তাদের সিকিউরিটি চেকিংয়ের পদ্ধতি বদলানোর সঙ্গে নিউজিল্যান্ড ক্রাইস্টচার্চ মসজিদ শুটিংয়ের সম্পর্ক আমি বুঝতে না পারলেও এবার লন্ডনে এটুকু বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না যে তারা আমাকে এবং সম্ভবত আমার মতো আরও লাখো-কোটি মানুষকে রেখেছে এক নিরন্তর নজরদারিতে—তাদের সার্বক্ষণিক কর্তৃত্বের মধ্যে, তাদের প্রবল অনুশাসনে। আলথুসার বলেছিলেন রাষ্ট্র দুভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার নাগরিকদের-রাষ্ট্রের আরএসএগুলো (রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস বা দমন-পীড়নমূলক রাষ্ট্রীয় যন্ত্রসমূহ) দিয়ে, আর সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের আইএসএগুলো (আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস বা আদর্শিক রাষ্ট্রীয় যন্ত্রসমূহ) দিয়েও। রাষ্ট্রের আরএসএগুলোর – যেমন আদালত, পুলিশ, আর্মি ইত্যাদি —কাজ হচ্ছে সাধারণত সহিংস পথে সব ঠিক রাখা, যে সহিংসতার (বা সহিংস না হয়েও চাপ দিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে রাজি করানোর) আবার আছে তিন ধাপ : প্রথমে পুলিশি চাপ, তারপর জেলে পোরা, আর শেষে সামরিক বাহিনী মাঠে নামানো। অন্যদিকে রাষ্ট্রের আইএসএগুলোর কাজ হচ্ছে সহিংস (বা প্রচ্ছন্নভাবে সহিংস) দমন-পীড়নের পথে না গিয়ে বরং ক্ষমতায় যারা আছে তারা যা যা যা যা বিশ্বাস করে সে সবকিছুকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে প্রচার করতে থাকা, নাগরিকদের মাথায় ঢোকাতে থাকা। আমরা তখন স্টেশন থেকে বের হব হব, আমি একটা প্রেটজেলের দোকানে দাঁড়িয়েছি পানির বোতল কিনতে, জোসেফ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘রাষ্ট্রের আরএসএগুলো তো বুঝলাম। কোর্ট, পুলিশ, আর্মি, গোয়েন্দা সংস্থা এসব। ঠিক আছে। কিন্তু আইএসএগুলো কী কী?’
আমি পানির বোতলটা কাউন্টারে বাড়ি মেরে রাখলাম, আওয়াজ শুনে দোকানের ম্যানেজার গোছের লোকটা আমার দিকে পেছন ফিরে তাকালেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন তার দোকানের এ আজব নাম : ‘একাডেমি প্রেটজেল?’ তিনি আমার কথার উত্তর করলেন না, শুধু বললেন, ‘প্লিজ গো, ইউ আর ক্লাটারিং মাই স্পেস ফর আদার কাস্টমারস’, এবং সে কথা শুনে আমি আবার বোতলটা সাঁৎ করে তুলে নিলাম কাউন্টার থেকে আর ডানে-বামে সামনে-পেছনে একবার করে তাকিয়ে জোসেফকে বললাম (ততক্ষণে আমরা হাঁটতে শুরু করেছি) : ‘আলথুসার বলেছেন, আইএসএগুলো সিভিল সোসাইটির অংশ। এদেরকে দেখতে মনে হয় এরা অরাজনৈতিক। কিন্তু জোসেফ মনে রাখবা এরা ভয়াবহ রকমের রাজনৈতিক সব প্রতিষ্ঠান, যেমন স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও যাবতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নাটক – সিনেমা-সংবাদপত্র-টিভির মতো সব মিডিয়া প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য নামের আপাত-অদৃশ্য প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির- চার্চ-মাদ্রাসাজাতীয় সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মোহামেডান ক্লাব-আবাহনী ক্লাব গুলশান ক্লাবের মতো সব সোশ্যাল ও স্পোর্টস ক্লাব, আর (একটু থেমে চিন্তা করে মনে করতে হলো আমাকে) ফ্যামিলি – পরিবার। এরা হচ্ছে রাষ্ট্রের ফ্যামিলি—পরিবার। আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস, অর্থাৎ শাসকের আইডিওলজি প্রতিষ্ঠা করার রাষ্ট্রযন্ত্র।’
জোসেফ হুঁ হুঁ করল। আমি বুঝলাম সে আমার কথা বুঝেছে। ফারজানা তাকে ও আমাকে মানা করল এসব নিয়ে কথা বলতে। ‘আপনারা থামবেন? সকাল থেকে কতবার বলেছি যে এসব নিয়ে পাবলিক স্পেসে কথা বলবেন না’, প্রায় রাগী এক গলায় বলল সে।
আমি ফারজানাকে আমার তরফ থেকেও এক কপট রাগের ভঙ্গিতে বললাম, ‘সমস্যা কী? আমরা তো বাংলায় কথা বলতেছি। ওদের মেশিনপত্তর তো বাংলা বুঝবে না। আর আলথুসার দার্শনিক, আমরা তার দর্শন নিয়ে কথা বলতেছি। তোমার কেন মনে হচ্ছে যে এগুলা সাবভারসিভ কথা হতেই হবে?’
ফারজানা মাথা নাড়ল। আমার সামনে ছিল সে। মাথা নেড়ে সে এবার ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে, বলল, ‘এই যে সাবভারসিভ শব্দটা বলছেন ইংরেজিতে, সমস্যা ওখানেই। বুঝলেন?’
যা কিছু সাবভারসিভ, তা-ই সরকার উৎখাতসংক্রান্ত, গোপনে সরকারের পতন ঘটানোর ষড়যন্ত্রসংক্রান্ত, অর্থাৎ সরকারের দিক থেকে দেখলে নাশকতামূলক। মাথার ভেতরে শব্দটার এ বাংলা অর্থ করে নেওয়ার পর আমি বুঝলাম কেন ফারজানার আপত্তি এই আপাত-সাদাসিধা শব্দটা নিয়ে, যার সঙ্গে এর আগে আমার মনে হচ্ছিল অনেক ফারাক আছে জিহাদ বা পিস্তল বা বন্ধ শব্দ কটার। আমি জোসেফকে (ফারজানাকে শুনিয়ে) জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেক্স” এবং “সাবমেরিন” কি লন্ডনে এখন সাবভারসিভ বা টেররিস্ট শব্দ হিসেবে ক্যাটেগরাইজড? জানো?’
জোসেফ হাসল। ফারজানা হাসল। জোসেফ বলল, ‘“সেক্স” না হয় বুঝলাম। “সাবমেরিন” বললেন কেন? কী যে সব পাগলের মতো কথা বলেন ভাইয়া!’
দূরে আমাদের এক্সিটটা দেখা যাচ্ছে, আমরা অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ওপরে গিয়ে উঠব, উঠলেই আমি জানি বাঁয়ে কী কী দোকান আছে, আর ডানে টটেনহ্যাম কোর্ট স্টেশনের দিকে কী কী, কারণ এ রাস্তাঘাট—এত বছর পরে আবার এলেও—আমার খুব ভালো করে চেনা। আমি হঠাৎ জোসেফকে আমার দিকে টেনে আনলাম, পানির বোতল খুললাম। পানি খাচ্ছি। ফারজানা দেখেনি যে আমরা থেমে গেছি, সে চলে যাচ্ছে এক্সিটের দিকে। আমি জোসেফকে বললাম, ‘আলথুসার বলেছেন, রাষ্ট্রের দেখতে নিরীহ কিন্তু কন্টিনিউয়াসভাবে সাইকোসোশ্যাল প্রক্রিয়ায় আমাদের মাথা নষ্ট করতে থাকা আইএসএগুলোর মাধ্যমে সরকার যদি আইএসএগুলোকে বশ না করে রাখে আর আইএসএগুলো দিয়ে আমাদেরকে বশীভূত না করে রাখে, তাহলে, আলথুসার বলেছেন তাহলে কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো সামাজিক গোষ্ঠীই তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারে না। যেমন ধরো, মতিঝিল মডেল স্কুল। রাষ্ট্রকে জানতে হয় রাষ্ট্রের একটা আইএসএ হিসেবে ওই স্কুলে কী কী পড়ানো হচ্ছে, কী কী পড়ানো হবে। আবার মতিঝিল মডেল স্কুলের টিচারদেরকেও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে বা বশে রাখতে হয়, যেন ওই টিচাররা ছাত্রছাত্রীদের এমনভাবে এমন সব বই-পুস্তক পড়ান, এমন সব নিয়মকানুন শেখান, যাতে করে ওই স্কুল তার পাঠ্যপুস্তক, পেনসিল, কলম, খেলার মাঠ, স্কুলের ক্যানটিন সবসহ ছাত্রছাত্রীদের ওপরে একটা স্রেফ স্কুলই না, বরং একটা আইএসএ, একটা আদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র হিসেবে কাজ করতে থাকে। আলথুসার বলছেন, আইএসএ ফেল করে গেলে শাসক স্রেফ পুলিশ-গোয়েন্দা- আর্মির আরএসএ দিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বিপদ দেখলে রাষ্ট্র চেষ্টা করবে তার আদালতগুলো দিয়ে নানা রুলিং দিয়ে বসতে, একে বা ওকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে, এর বা ওর সামাজিক ও রাজনৈতিক সব কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করতে, আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চেষ্টা করবে সিসি ক্যামেরার সব রেকর্ড নিয়ে বসে, টেলিফোন কলের সব রেকর্ড নিয়ে বসে বের করতে যে কবে তুমি কোন মেয়ের সঙ্গে কোথায় কোথায় গিয়েছিলে এবং ফোনে কার সঙ্গে কী কী খারাপ কথা বলেছিলে, সেক্সুয়াল অর্থে খারাপ ও পলিটিক্যাল অর্থে খারাপ।’
ঠিক তখনই, আমার বাক্য শেষ হয়নি, আরেক ঢোঁক পানি আমার গলা দিয়ে ঠিকমতো নামেওনি, ঠিক তখনই লন্ডন পুলিশের প্রচণ্ড সুদর্শন এক অফিসার আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তার মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, তার চেহারা ডেভিড বা দাউদ আলাইহেসসালামের মতো কাটা কাটা, সুচারু। সে তার সাদা ধবধবে হাফ শার্টের ওপরে পরেছে কালো একটা ভেস্ট, গলায় কালো টাই। তার ভেস্টের জিপার একদম বুক পর্যন্ত টানা, ডান কাঁধে একটা ওয়ারেবল ক্যামেরা, বাম কাঁধে একটা ওয়াকিটকি, বাম বুকের প্রথম ব্যাজটায় লেখা ‘কনস্টেবল 2285…’ যে সংখ্যার বাকিটা তার ওয়াকিটকির নিচের প্রান্ত দিয়ে ঢাকা পড়ে গেছে বলে আমি দেখতে পাচ্ছি না, আর ওই সংখ্যা ও নাম লেখা ব্যাজটারই নিচের ব্যাজে লেখা ‘মেট্রোপলিটন পুলিশ’ কথাটুকু এবং তারও নিচের ব্যাজটাতে, ওপর দিক থেকে তার বুকের তিন নম্বর ব্যাজে লেখা—না, সে আমাকে বাধা দিল ওই সব পড়তে। আমি অতএব তার মাথার সুন্দর পিকড ক্যাপটার দিকে তাকালাম। তার সামনের দিকে চোখের ওপর পর্যন্ত কী সুন্দর নেমে এসেছে ক্যাপটার ভিজর বা বিল অংশটা, আর ক্যাপের ক্রাউনের নিচের ফ্রন্ট প্যানেলজুড়ে কী রকম চোখজুড়ানো সাদাকালো দাবার বোর্ডের প্যাটার্ন।
কনস্টেবল আইজ্যাক—ওটাই তার নাম, বলেছে সে আমাকে—আমার ডান হাতের কনুইয়ের ওপর অংশ ধরল। বলল, ‘কাম উইদ মি, প্লিজ।’
জোসেফ বলল, ‘উই আর ব্রিটিশ সিটিজেনস। হি ইজ আ ব্যাংকার অ্যান্ড আ ভিজিটর হিয়ার। আই অ্যাম হিজ ব্রাদার ইন ল। ফারজানা ফা র জা না।’
জোসেফের ফারজানা ডাক ফারজানা শুনতে পায়নি। দেখলাম ফারজানা দূরে এক্সিটের সিঁড়িতে পা রেখেছে, কেমন গমগম এক আওয়াজে কিছুই শোনা যাচ্ছে না ভালো করে, আর তখন আইজ্যাক জোসেফকে বলল, “আই অ্যাম নট টকিং টু ইউ। উড ইউ প্লিজ।’ উড ইউ প্লিজ কী, তা খুলে বলল না সে, তবে থেমে সে জোসেফকেই আবার বলল, ‘বাট ইফ ইউ ওয়ান্ট টু কাম এলং, ইউ ক্যান কাম। ‘
জোসেফ আশ্বস্ত হলো তার এ কথা শুনে, কিন্তু উত্তরে ভয় টেনশন মিলে সে লন্ডন পুলিশের এই নিশ্চিত বাংলা না জানা কনস্টেবলকে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘ফারজানাকে ডেকে নিয়ে আসি?’
লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের অসংখ্য হিজিবিজি ও প্রায়ান্ধকার গলিপথের একটাতে আইজ্যাক এবার টেনে নিয়ে এল আমাকে, ওভাবেই আমার ডান কনুইয়ের ওপর দিক তার হাতে ধরে রেখে। আমরা একসঙ্গে হাঁটছি আর আমি চোরাচোখে আমার ব্যক্তিগত শখের বিষয় যে মারণাস্ত্র, তা দেখছি। আইজ্যাকেরটা একটা অ্যাসল্ট রাইফেল, একটা SA40 – 5.56X45 মিমি ন্যাটো স্মল আর্ম, গ্যাস-অপারেটেড, যার আরপিএম মিনিটে ৬১০ থেকে ৭৭৫টা গুলি। আমার বিশেষ করে চোখ গেল ওর অস্ত্রের ম্যাগাজিনের দিকে— পলিমার ইম্যাগ ম্যাগাজিন, তাতে ডিটাচেবল ডাস্ট কভার এবং ম্যাগাজিনের ভেতরে এখনো কটা গুলি আছে, তা বাইরের থেকে পরিষ্কার দেখার এক বিশেষ জানালামতো। হায়, এরা ওজন কত কমিয়ে ফেলেছে স্টিল ম্যাগাজিন থেকে পলিমারে এসে। হাহ্। আমি ভাবলাম আইজ্যাককে জিজ্ঞেস করব স্টিল ম্যাগাজিনের ২৫০ গ্রাম ওজন এখন এই পলিমারে এসে কত হলো? তখনই আইজ্যাক আমাকে বিদ্ধ করল একটা দেয়ালের গায়ে, যাতে বড় করে লাল রঙে লেখা CAMEL BRAIN এবং দুটো শব্দই কালো পেইন্টে আবার ক্রস করে কাটা বীভৎসভাবে। আমি তাকে প্রশ্নটা করিনি, প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে কোনোভাবে বরং আমার বাঁয়ে চোখ রেখে তখন আমি দেখছি কী করে এতক্ষণে একসঙ্গে হন্তদন্ত হয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে ওরা দুজন-জোসেফ ও ফারজানা।
ইতিমধ্যে আইজ্যাক আমাকে জিজ্ঞেস করে বসেছে তার প্রশ্নগুলো। স্পষ্ট ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে আমি কী করি, আমার কাগজপত্র কোথায়, মানে পাসপোর্ট-ভিসা এবং ঠিক কী কারণে আমি ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’-এর এই আন্দোলনের উত্তুঙ্গ সময়ে অক্সফোর্ড সার্কাস স্টেশনে এসে নামলাম?
আমি আইজ্যাককে খুলে বললাম সবকিছু। বললাম যে, ‘আমি একজন ব্যাংকার, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির একটা কোর্সে এসেছি, কোর্সের আয়োজক তোমাদের দেশের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, আমার পাসপোর্টটা ভিসাসহ পড়ে আছে ডাগেনহ্যামে আমার শালীর বাসায়, এই আমার বিজনেস কার্ড, ওই আমার শালী এদিকে আসছে, আর ওই তরুণ আমার শালীর হাজবেন্ড, নাম জোসেফ, আমি বাংলাদেশি, ওরা ব্রিটিশ-বাংলাদেশি, জানি না ব্রিটিশ- বাংলাদেশি বলাটা ঠিক হলো কি না, আর এই “এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন” না কী তুমি বললে, আমি সে ব্যাপারে কিছুই শুনিনি, ওদের আন্দোলনের কী উত্তুঙ্গ সময়ের কথা বললে তা আমার মাথার ওপর দিয়ে গেছে। বলো আমাকে, কারা ওরা? বলো কারা ওরা? কিসের আন্দোলন করছে ওরা? রাষ্ট্রবিরোধী কোনো আন্দোলন? বলো আমাকে।’
হড়বড় করে এ রকম অনেকগুলো কথা বললাম আমি। আমার কথার শেষ দিকে এসে ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’ দলটার বিষয়ে এমনভাবে উল্টো তাকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম যেন মনে হবে—-যে কারোরই মনে হবে—আমি ওদের আন্দোলনে যোগ দিতে অক্সফোর্ড সার্কাস স্টেশনে আসা দূরে থাক, বরং আমি বোধ হয় এসেছি ওদেরকে শেষ করে দিতে এবং মুহূর্তের মধ্যে ওদের আন্দোলন শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতাও যেন আমি রাখি।
আমার এই আন্তরিকতামাখা অবিমিশ্র সদিচ্ছা আইজ্যাকের মনে আমাকে নিয়ে উল্টো আরও সন্দেহের জন্ম দিল যেন। আমার কথার মধ্যেই সে তার ওয়াকিটকিতে কী এক সাংকেতিক মেসেজ দিয়ে বসেছে, বারবার তার অদৃশ্য সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেছে: ‘ওয়াইল্ডফায়ার- ওয়াইল্ডফায়ার, পিলার সেভেনটি ফোর নর্থ-নর্থ ইস্ট সাইড, ওয়াইল্ডফায়ার, এক্সট্রিম ওয়েদার, ক্রপ ফেলিওর, পিলার সেভেনটি ফোর, রিপিট সেভেনটি ফোর, নর্থ নর্থ।’ এ রকম।
জোসেফ ও ফারজানা ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা তিনজন এবার একসঙ্গে তিনটে বাচ্চা মুরগির মতো এই দীর্ঘদেহী ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারকে যার নিজের নাম কনস্টেবল, সম্ভবত পুরো নাম আইজ্যাক কনস্টেবল (আমি জানি কনস্টেবল মানুষের নাম হয়, জন কনস্টেবল নামের বিখ্যাত এক ইংলিশ ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার আছেন) কিংবা যার পদবি কনস্টেবল, অর্থাৎ সে হয় ডিটেকটিভ কনস্টেবল না হয় পুলিশ কনস্টেবল এবং সে আমাকে ধরার মাধ্যমে এবার কনস্টেবল থেকে প্রমোশন পেয়ে সার্জেন্ট হয়ে যাবে—আমরা তিনজন এই দীর্ঘদেহী অসম্ভব সুদর্শন পুলিশ অফিসারটার মনোযোগ কাড়ার জন্য ছোট ছোট লাফ দিয়ে তার মাথা ও মুখের উদ্দেশে বারবার উঠে চলেছি, ঠিক সে সময় আরও দুজন পুলিশ অফিসার- যাদের একজন একটানা তার নিচের ঠোঁট কামড়ে যাচ্ছে এবং অন্যজন তার দুহাতের তালু একসঙ্গে করে হাতের মধ্যে কী একটা পিষে চলেছে–আমাদের তিনজনের দুপাশে দু দেয়ালের মতো করে দাঁড়িয়ে গেল।
আইজ্যাককে ফলো করে এবার আমাদের পাঁচজনের দলটা ছোট ছোট পায়ে হেঁটে যাচ্ছি। আইজ্যাক সামনে সামনে যাচ্ছে এবং বারবার পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘হোয়াট ডু ইউ থিংক? তুমি কী মনে করো, আমরা জানি না? তুমি চার দিন আগে হিথ্রোতে নেমেছ। তারপর একদিন লন্ডনে থেকে একটা গ্রিন টম্যাটো ক্যাব নিয়ে কেমব্রিজ গিয়েছ। তারপর ওখানে তিন-চার দিনের কোর্স শেষ করে আজ সকালে লন্ডনে ফিরেছ, আবারও একটা গ্রিন টম্যাটো ক্যাব ভাড়া করে। আমরা জানি না?’ আবার হাঁটছি আমরা। আবার আইজ্যাক : ‘আমরা আমাদের অফিসে যাব, তোমার কিছু ডিটেইল সিস্টেমে মেলাব, তোমার ফোনের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখব, তোমাকে দু-একটা প্রশ্ন করব এবং সন্তুষ্ট হলে ছেড়ে দেব। অস্থির হয়ো না।’
হাঁটছি আমরা। হাঁটছিই। আমি বুঝতে পারছি ওরা আমার হাতের মুভমেন্ট খেয়াল করছে, যাতে করে আমি আমার ফোনে, ফোনের ফটো গ্যালারিতে হাত দেওয়ামাত্র ধরা পড়ি। ওভাবেই আমরা হাঁটতে লাগলাম বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের এই গলি ধরে, ওই গলি ধরে, একবার ওপরে, একবার নিচের দিকে, একবার ডানে, তারপর আবার ডানে, তারপর শেষে একটা সিঁড়ির চার ধাপ ওপরে উঠে দশ ধাপ নেমে আমরা হাজির হলাম এক পরিপাটি ঘরে, যার দরজার ওপরে আয়তাকার এক নীল বোর্ডে লেখা : ‘মেট্রোপলিটন পুলিশ’ (লোগোসহ), এবং তার নিচের লাইনে : ‘Working together for a safer London’
ভেতরে ঢুকলাম আমরা। তিনজনই। আমি ভেবেছিলাম জোসেফ ও ফারজানাকে ওখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না, বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। ঘরটায় ঢোকার মুখে জোসেফ আমাকে বাংলায় বলেছে যে আমার কোনো ভয় নেই। ‘ব্যাংকারের আবার ভয় কী?’ তখন ফারজানা বলেছে, ‘আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম। বলেছিলাম আলথুসার নিয়ে কথা বোলো না। শোনোনি। শোনোনি। উহ্হ্! ওহ্ মাই গড।’
ফারজানার ‘ওহ্ মাই গড’ ইংরেজি কথাটা ওদের কানে গেছে। ঠোঁট কামড়ানো পুলিশ লোকটা ফারজানার দিকে ঘুরে তাকে আশ্বস্ত করল যে, ‘ওহ্ মাই গড’ বলার মতো কিছু এখানে হয়নি। আর তখন, চেয়ারে বসতে বসতে, আইজ্যাক আমাকে জিজ্ঞেস করল, “ এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন” গ্রুপের লিডারের নাম কী, বলো দেখি?’
আমার রীতিমতো রাগ ধরল এই দফা। আমি আরেকবার বললাম, মোটামুটি ঝগড়ার গলায় বললাম, ‘আমি আগেও তোমাকে বলেছি “এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন” গ্রুপের নামটাও আমি এ জীবনে শুনিনি। এমন কিছু আমাকে জিজ্ঞাসা কেন করছ, যার উত্তর আমি জানি না?’
আইজ্যাক মুখে হাসি নিয়ে নিষ্ঠুরের মতো করে বলল, ‘আমাদের কাজই তেমন কিছু জিজ্ঞাসা করা, যার উত্তর মানুষ প্রথমে বলে যে জানে না, কিন্তু পরে দেখা যায় আমরা যতটা ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক অনেক বেশি করে জানে সে। হা হা। হোয়াট ডু ইউ সে, মার্ক? ‘
মার্ক লোকটা তখনো তার দু তালুর মধ্যে অদৃশ্য সেই জিনিস পিষতে ব্যস্ত। সে কোনো কথা বলল না। আমি বরং অধৈর্য হয়ে মার্ককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হোয়াই ডোন্ট ইউ আনসার, মার্ক?’
ঠোঁট কামড়ানো পুলিশটা মার্কের উদ্দেশে রাখা আমার এ প্রশ্ন শুনে প্রায় আমার দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘হোয়াই আর ইউ সো নার্ভাস? হোয়াট ডিড ইউ ডু? হোয়াট ডু ইউ প্ল্যান টু ডু? দেখি তোমার ফোনটা দাও। পাসওয়ার্ড দিয়ে খুলে তারপর দাও।’
আমি আমার আইফোন খুলে তার হাতে না, আইজ্যাকের হাতে দিলাম। ফোন ওকে দিতে দিতে এই প্রথম খেয়াল করলাম এ ঘরের দেয়ালে লাগানো তিনটে সিট, কোনো চেয়ার নয় ওরা, স্রেফ সিট, গাঢ় নীল রঙের, কোনো পায়া নেই আর ওদের শেষ মাথায় একটা সাদা রুম হিটার, যার ওপর দিয়ে একটা এবং নিচ দিয়ে একটা, মোট দুটো লম্বা সরু পাইপ চলে গেছে চেয়ারগুলো পার হয়ে দূরে কোথায়ও, আর আইজ্যাকের টেবিলে বলতে গেলে কিছুই নেই একটা বিরাট আকারের ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং চার- পাঁচ গোছা চাবি ও কয়েকটা টর্চলাইট ছাড়া। টেবিলটার বাঁ দিকে একটা সাদা দরজা, বন্ধ করা, তার গায়ে কালো রঙের অলক্যাপ বোল্ডে লেখা INMATE PROPERTY
আমি এসব কিছুরই মানে বুঝলাম না। কী কাজ টর্চলাইটগুলোর? কী লেখা ওই নোটিশ বোর্ডের তিন কলামে, যার বাঁয়ের কলামে একটা মেয়ের মুখের ছবি, মেয়েটা চিৎকার করছে এবং ছবিটার নিচে এমনভাবে লেখা CONTROL YOURSELF যে মনে হয় যেন অক্ষরগুলো গড়িয়ে বেরিয়ে পড়ছে মেয়েটার মুখ থেকে, মুখের লালার সামান্য ভেজা ভেজাসহ? আর মাঝখানের কলামে পিন দিয়ে আটকানো চারটা এ ফোর সাইজের কাগজ। আমার এখান থেকে কিছুই পড়া যাচ্ছে না ওই কাগজগুলোয় কী লেখা, স্রেফ একটা কাগজে বোঝা যাচ্ছে একটা ভিড়ের ছবি। এবং সব ডানের কলামে বোর্ডটার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত আটকানো মোট চারটা-চারটা আটটা এ ফোর সাইজ নোটিশ, যাদের পুরোটা বেড় দিয়ে আবার লাল মোটা অক্ষরে লেখা : OVER, এবং তার নিচের লাইনে : MIND IT!
হাহ্, কী চলছে আমাদের তিনজনকে নিয়ে? কী হবে ওরা আমার ফোনের গ্যালারির অশ্লীল ছবিগুলো দেখলে, বিশেষ করে সানি লিওনির? আর এ কী কথা যে আমাকে বাইরের রাস্তায় চলা (ওদের কথা শুনেই এটা আমার অনুমান থেকে ভাবলাম) ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’ নামের গ্রুপটার আন্দোলনের সদস্য হিসেবে ভাবা হচ্ছে? ওরা যদি জানবেই যে আমি মাত্র এক দিন লন্ডনে থেকে তিন দিনের জন্য কেমব্রিজে কাটিয়েছি, তো ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’ দলের কাছে আমি গেলামটাই-বা কবে? এ কী মূঢ়তা মানুষের? লন্ডন পুলিশের? সুপরিজ্ঞাত যাদের সব তথ্য, আমাকে ও আমার নিরপরাধ মুভমেন্ট নিয়ে সব সব তথ্য, তারা আমার সঙ্গে এতখানি হেঁয়ালি ও মানেবিভ্রাট ঘটানো আচরণ করছে কেন? সব দার্শনিক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে নিশ্চিত সমস্যাটা বর্তমান সময়ের সমস্যা নিয়েই ঠিক এ মুহূর্তে আমরা কারা ও কেমন আছি তা নিয়েই। এ কথাটুকুও শিক্ষিত লন্ডন পুলিশের এরা জানে না? নিরীহ একটা মেয়েকে পর্যন্ত এরা এভাবে আটকে রেখেছে আর আমাদেরকে বাধা দিচ্ছে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে সন্ধ্যা নামা দেখা থেকে? ১৭৮৪ সালে কান্ট যখন প্রশ্ন করলেন, লিখলেন, ‘হোয়াট ইজ এনলাইটেনমেন্ট?’ (‘মানুষের আলোকপ্রাপ্ত হওয়া কী জিনিস?’), তখন আমি কি বুঝি না যে কান্ট আসলে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘বলো এখন সমাজে আসলে কী চলছে? এই যে আমরা ঠিক এ সময়টায় বাস করছি, বলো কী এই সময়, কী এই পৃথিবী, কী এই আমরা?’ আমি কি জানি না সেসব? এরা কী মনে করে? আমি কি জানি না যে বারবার এরা যে কথাই বলুক, আমার ফোন ঘেঁটে যা-ই দেখতে চাক, এদের উদ্দেশ্য একটাই : ‘আমি কে’ সেটা জানা? এই যে এরা জিজ্ঞেস করছে ‘হোয়াই আর ইউ সো নার্ভাস?’ কিংবা ‘হোয়াট ডু ইউ ডু?’ আমি কি জানি না যে এসব প্রশ্নের মূল প্রশ্ন একটাই : ‘হু আর ইউ?’ আমাকে এতখানি বোকা মনে করে এরা?
বোকা এরা। আমি না। আমাকে ‘আমি কে?’-র মতো একটা ইতিহাসবিচ্যুত, জেনারেল প্রশ্ন করে বসা, তা-ও ২০১৯ সালে এসে যখন পৃথিবী — বিষকন্যা সে—ফুটছে একটা বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ওপরে বসানো বেল মেটালের মহাভাণ্ডের মধ্যে, সেরকম এক পৃথিবীতে যার আফগানিস্তান যুদ্ধের ঘা এখনো শুকায়নি, জর্জিয়াতে রাশিয়ান সৈন্যদের ফেলে যাওয়া চায়ের কাপ থেকে যেখানে এখনো ধোঁয়া উড়ছে, আর আফ্রিকার খনিজ সম্পদের দখল নিয়ে যেখানে এখনো যুদ্ধ চলছে অন্তত ছ-সাতটা, তখন, তেমন এক পৃথিবীতে কতটা বোকা হলে তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করবে ওই নন-হিস্টোরিক্যাল, আন-স্পেসিফিক, ইউনিভার্সাল ‘আমি কে’ প্রশ্নটা? কীভাবে দিন বদলে গেছে। চারদিকে এতগুলো হামলার পরে হামলা, নিও-লিবারালিজমের এই পরিমাণ দাপট, গ্লোবাল কনফ্লিক্টগুলো কীভাবে রোজকার সত্য হয়ে ঢুকে গেছে দূরের দূরের আমাদের জীবনেও, আর কীভাবে শেষ হওয়া যুদ্ধগুলো থেকেও ফুট ফুট করে ফুটছে থামা থামা অনেক নতুন যুদ্ধের অজস্র বুদ্বুদ, আর সেই পৃথিবীতে এ রকম ননসেন্স কী সব প্রশ্ন, কী সব কাজ করে চলেছে লন্ডনের পুলিশ?
না, আর থাকতে পারলাম না আমি। আইজ্যাককে মোটামুটি বিনয়ী গলায়ই বললাম, তার এবং তার সহকর্মী অন্য দুজনের উদ্দেশে একই সঙ্গে এক তুলির এক ছোপে তাকিয়েই বললাম, ‘হ্যাঁ, আমাকে জিজ্ঞাসা করো, লন্ডনের ইতিহাসের ঠিক এই ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল তারিখে আমি কে? বুঝতে পারছ কী বলছি? হুম্ম্। আর যদি সন্তুষ্ট হওয়ার মতো উত্তর পেয়ে যাও তো আমাদেরকে যেতে দাও। আমরা মার্বেল আর্চের হাইড পার্কে সন্ধ্যা নামা দেখব।’
নাহ্। তারা রীতিমতো উপেক্ষা করল আমার আর্তি। আমার প্রশ্নের ধারেকাছে দিয়ে গেল না কেউই, বরং এ ঘরে আমাদের মূর্তিমান অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে তিনজনই ব্যস্ত হয়ে থাকল আমার ফোনের গ্যালারির ছবি দেখা নিয়ে। যেহেতু তারা ফোনটা লম্বালম্বি না ধরে আড়াআড়ি ধরেছে, অর্থাৎ স্ক্রিনস্পেস বড় করে নিয়েছে এবং আইজ্যাক একমনে একেকটা ছবি তার আঙুলে পিঞ্চ করে করে বড় ও ছোট করে চলেছে এবং যেহেতু ছবি থেকে ছবিতে তাদের চোখের ভঙ্গিমা, রেটিনার আন্দোলন সব উচ্চাবচ হচ্ছে, তাই আমি নিজেকে বললাম, করুক, মজা করুক ওরা সানি লিওনির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওই ছবিগুলো নিয়ে, দেখুক যে সানি লিওনির অভ্যন্তরভাগ কত ডিপ হতে পারে এবং তার সম্মুখভাগ কত কুসুম-কুসুম কিন্তু নিজের মতো এক জাত্যভিমান নিয়ে উপচীয়মান।
আমার কী! আমি কে? আমি এক সামান্য বাংলাদেশ থেকে আসা এক সামান্য ট্যুরিস্ট, যার পেশা ব্যাংকিং এবং যার ধ্যান আলথুসারকে বোঝা। আলথুসার বলেছিলেন, পৃথিবী এমন সহিংস কারণ রাষ্ট্রের গঠনটাই এমন— প্রতিষ্ঠানগুলো চালাচ্ছে রাষ্ট্র এবং টিকিয়ে রাখছে ক্ষমতায় থাকা লোকদেরকে। রাষ্ট্রের গঠনটাই এমন যে ওটার বিরুদ্ধে, ওর নানা প্রকাশের বিরুদ্ধে লোক দাঁড়াবে, অর্থাৎ গোড়া থেকে ব্যবস্থাটা এমন যে, মারামারি-ফাটাফাটি হবেই। কেন ব্যবস্থাটা এমন? আলথুসার বলেছেন, যা পরে তার ছাত্র মিশেল ফুকো আরও স্পষ্ট করেছেন যে, ক্ষমতার সম্পর্ক শুধু এপক্ষ-ওপক্ষের সহিংসতা দিয়ে বুঝতে যেয়ো না, অপর পক্ষের সম্মতি পাওয়া দিয়েও বোঝো। মানে, ধরা যাক, লন্ডনের পুলিশ বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের খোঁজে, যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে টর্চার করে যাচ্ছে, চাইলে মেরেও ফেলছে—এটা ক্ষমতার সহিংস প্রকাশ। আবার পীড়িত পক্ষ যদি লন্ডনের পুলিশের সব দমন-পীড়নমূলক আচরণে সম্মতি দিয়েই বসল, তাদের নিজেদের স্বাধীন বিশ্বাসের স্বাধীন অবস্থান থেকে সরে গিয়ে দমন-পীড়নের হাতে নিজেদেরকে সঁপেই দিল, তো সেখানে ক্ষমতার সম্পর্ক আর কাজ করবে না। ক্ষমতা সম্মতির সঙ্গে বিরোধমূলক, এরা একে অপরের ওপরে বিপরীতমুখীভাবে কাজ করে। কিন্তু মানুষ সম্মতি দেয় না। মানুষের সম্মতি পাওয়া এত সোজা না। ইতিহাসজুড়ে নিরন্তর মানুষ শাসকের মুখের ওপরে সময়ে সময়ে ‘না’-ই বলে যায়, ‘হ্যাঁ’ পারলে বলেই না কখনো। একটা ‘হ্যাঁ’- মতো থাকে গোড়া থেকে, আর ঘটনাগুলো ওভাবেই ঘটে যায় এবং সেই হালকাপলকা ‘হ্যাঁ’-টার ওপর দাঁড়িয়েই রাষ্ট্র তার থাবা বিস্তার করে বসে। তারা ওই হ্যাঁ-টার ব্যাখ্যা করে বলে যে, জনতার রায় আমাদের সঙ্গে আছে। দ্যাখো, জনতা আমাদের শাসনকে উপভোগ করছে। অতএব নিজে নিজের স্বাধীনতা পরিত্যাগ করা, বা অন্য কথায় স্বেচ্ছায় অন্যের চাকর হয়ে যাওয়া, এ ব্যাপারটা ক্ষমতার আসল সমস্যা না। মানুষের পক্ষে কী করে সম্ভব নিজের থেকেই অন্যের দাস হতে চাওয়া? না, সম্ভব না সেটা।
আমি, সুতরাং, টেবিলে আমার হাতের একটা বাড়ি মেরে আমার এই সাময়িক দাসত্ব, এই সাময়িক বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হতে চাইলাম। বললাম, ‘ফ্রি আস। অ্যালাউ আস টু মাইন্ড আওয়ার ওন বিজনেস, প্লিজ।’
সুদর্শন আইজ্যাকের দুচোখ থেকে আগুনের বৃষ্টি ঝরল যেন। সে বলল, ‘পুল দ্য চেয়ার অ্যান্ড ইউ সিট ডাউন। অ্যান্ড দ্য টু অব ইউ, ইউ সিট দেয়ার।’
ফারজানা ও জোসেফ তার কথামতো দেয়ালে লাগানো ওই পায়াহীন ভাসমান দুই চেয়ারে গিয়ে বসল। ফারজানা এবার অনবরত বলে চলেছে, ‘ওহ্ মাই গড’, ‘ওহ্ মাই গড’। তার একদমই ভালো লাগেনি আমার ওই টেবিলে হাতের বাড়ি মেরে বসা। আর আমার ভালো লাগল না আইজ্যাকের রক্তচক্ষু। আমি তাকে বললাম, ‘হুইচ চেয়ার? দেয়ার ইজ নো চেয়ার।
আইজ্যাক বলল, ‘দেন কিপ স্ট্যান্ডিং অ্যান্ড ডোন্ট গেট অ্যাজিটেটেড সো ইজিলি। ওকে (সে বলল তার দুই সঙ্গীকে), লেটস ফেস ইট। আই থিংক উই হ্যাভ সিন এনাফ।’
কী এনাফ দেখেছে তারা? সানি লিওনিকে? তার বগল, জঙ্ঘা, ল্যাবিয়া মেজরা, ল্যাবিয়া মাইনরা–এসব? আর কীভাবে দেখেছে তারা ওসব? নিচের ঠোঁট কামড়ানো পুলিশটা নাম রাইসিংগার, এমন জার্মান নাম কেন ওর?–তো মনে হচ্ছে নিবিষ্ট মনে সানির পেরেনিয়াম, অ্যানাস ও ইউরেথ্রাল ওপেনিং দেখতে দেখতে তার নিচের ঠোঁট চিবিয়ে পুরো খেয়েই ফেলেছে এবং এখন সে কেবল এক ঠোঁটের মানুষ—একটা বিদ্যমান ঠোঁট ও একটা হারিয়ে যাওয়া ঠোঁট।
আমি দাঁড়ানো। তারা তিনজনই টেবিলের উল্টো পাশ থেকে আমার পাশে চলে এল। আইজ্যাকের হাতে আমার ফোন, আমার দুহাত বুকের ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। আইজ্যাক ফোনটা ধরল আমার চোখের সামনে, বলল, ‘এগুলো কী? এক্সপ্লেইন।’
আমি দেখলাম আমারই তোলা অজস্র গাছের ছবি, লন্ডন ও কেমব্রিজের শত শত গাছের। আমি বললাম, ‘গাছের ছবি। গত চার দিনে আমার তোলা।’
‘কেন?’
‘আমি গাছ খুব পছন্দ করি, আর লন্ডনের এই সিজনের গাছগুলো সুন্দর হয় এবং এখানকার অধিকাংশ গাছই বাংলাদেশে নেই। তাই তুলেছি।’
আইজ্যাকের সঙ্গী, দুহাতের তালু পেষা ওই অতিরিক্ত সাদা মার্ক নামের পুলিশটা এই প্রথম কথা বলল। তার উচ্চারণ আইরিশ, অতএব আমার অনেক কষ্ট হলো তাকে বুঝতে। ‘গাছ ঠিক আছে, কিন্তু প্রতিটা গাছের পেছনে, প্রায় প্রতিটা গাছের পেছনে তো অন্যের বাসাবাড়ির ছবি। আর শেষের এই গাছগুলোর পেছনে বেকনট্রি স্টেশনের এতগুলো ছবি। হোয়াই?’
আমি এতক্ষণে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। তারা সানি লিওনির সম্ভ্রম অক্ষত রেখেছে, তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দেখেনি, আর আমার তোলা গাছের ছবিগুলোর পেছনে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বাসাবাড়ি এবং রেলস্টেশনগুলোর ছবি দেখে তারা ভবিষ্যৎ জঙ্গি হামলার ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। আমি উত্তর দিলাম, ‘বলছি। তার আগে বলো, কেউ কি কোনো নালিশ জানিয়েছে আমার ব্যাপারে?’
আইজ্যাক কোনো ভণিতা করল না, স্পষ্ট তার মুখ থেকে হালকা কয়েক ফোঁটা থুতু ছড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ। একজন মানুষ লন্ডনে এক দিন আর এক দিন মোট দুদিন মাত্র থাকবে, আর প্রায় আঠারো শ ছবি তুলবে গাছপালার? ওকে। দ্যাটস ওকে। কিন্তু সেই গাছপালার পাশে, পেছনে, সামনে থাকবে কেমব্রিজের জাজ বিজনেস স্কুলের সিকিউরিটি রুম, বেকনট্রি স্টেশন আর বার্কিংয়ের ভদ্রলোকদের দালান-ঘর, বাড়ি, বাড়ির আঙিনা, আঙিনায় ফেলে রাখা হোসপাইপ এবং সামনের জানালা দিয়ে ভেতরে দেখা যাচ্ছে মতো এমন বাসন-কোসন, সিরামিকের জিনিসপাতি, এমনকি ইজিচেয়ার পর্যন্ত, আর এর পুরোটা আবার ঘটবে যখন সেন্ট্রাল লন্ডনের সব রাস্তাঘাট বন্ধ পরিবেশবাদীদের ডেমনস্ট্রেশনের কারণে? আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, তুমি ওই অহিংস ভান ধরা সহিংস পরিবেশবাদীদেরকে তোমার তোলা আঠারো শ গাছের ছবি তাদের ডেমনস্ট্রেশনের মূল বড় স্ক্রিনে প্রজেক্টরে দেখিয়ে দেখিয়ে বলতে যাচ্ছিলে যে, দ্যাখো, পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছে, দ্যাখো কীভাবে মারা যাচ্ছে বৃক্ষের সবুজ। হাহ্, তুমি কি মনে করো আমরা এই কানেকশনগুলো বুঝি না? তুমি কি মনে করো আমাদের কাছে তোমার ব্যাপারে কোনো ফোন আসেনি ওই ভদ্র মানুষদের নিরিবিলি ভদ্র পাড়াগুলো থেকে? তারা ভয় পায়নি তোমাকে নিয়ে? তুমি তাদের বাগানে ঢুকে যাবে একদম গাছের গাছের গাছের’ -আইজ্যাক যতবার বলছে গাছের, ততবার তার আঙুল আমার দিকে তাক করে শূন্যের মধ্যে আরও আরও ঢুকিয়ে দিচ্ছে বারবার –’পুটকির ছবি তুলতে, আর তারা সন্ত্রস্ত হবে না? লন্ডনে চলছে “এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন”-এর হুমকি-ধমকি, দাপট এবং ঠিক তখনই কিনা ক্যামেরায় একজন লন্ডন শহরের গাছগুলোকে ছবি তুলতে তুলতে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছে আর আন্দোলনের প্রধান দিনের মূল বক্তৃতার একটুখানিক আগে এসে হাজির হচ্ছে অক্সফোর্ড সার্কাস স্টেশনে, যেখানকার দরজা থেকে তাদের আন্দোলনের মূল মঞ্চের দূরত্ব মাত্ৰ বিশ পা? আশ্চর্য! আশ্চর্য নাটক পারো তুমি।’
আমি যা বোঝার সব বুঝে গেলাম। প্রথমে আমি ভাবছিলাম নিজের জন্য লইয়ার চাইব, নিজের ডিফেন্সে। কিন্তু আইজ্যাক যেভাবে বলল সব, যে কণ্ঠস্বর ও প্রলম্বিত ধীর শব্দোচ্চারণে বলল সে কথাগুলো, তাতে আমি বুঝতে পারলাম আমার লইয়ারের দরকার নেই, আমি নিজেই যথেষ্ট আমার ডিফেন্সের কাজে। স্রেফ আমাকে একটু মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, মুখে হাসি বজায় রাখতে হবে, পারলে কিছুটা হিউমার করতে হবে, তবে সেটা না পারলেও ক্ষতি নেই।
আমি বললাম, ‘সবটা এক মারাত্মক ভুল-বোঝাবুঝি। প্রথম কথা, আমি যে গাছপালার আঠারো শ-উনিশ শ ছবি তুলে ফেলেছি, সেটা আমি বুঝিনি, আসলে আমার “ট্রিজ অব লন্ডন” অ্যালবামে গিয়ে দেখা উচিত ছিল যে টোটাল ছবি কয়টা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় কথা, দাও, ফোনটা দাও, দেখাই’–এত নিশ্চিতির সঙ্গে প্রস্তাবটা রাখলাম আমি যে, আইজ্যাক অবলীলায় ফোন দিয়ে দিল আমাকে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ অন্য দুজন তাদের যার যার হাতে ধরা লন্ডন পুলিশের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ইস্যু গ্লক পিস্তল নিয়ে (পলিমার- ফ্রেমড, শর্ট রিকয়েল অপারেটেড, লকড-ব্রিচ সেমি অটোমেটিক পিস্তল; নির্মাতা ব্লক গেস ডট স্মল এম ডট স্মল বি ডট ক্যাপিটাল এইচ ডট — Glock Ges. m. b. H.) সাবধান হয়ে গেল যাতে করে আমি কোনো ছবি ডিলিট করার সুযোগ না পাই—’এই দ্যাখো, এতগুলো গাছের ছবি, এই যে কমন হাইড্রানজিয়া, এই যে কুসামাকি, এই যে ওয়াইল্ড হিমালয়ান চেরি, এই যে উইপিং চেরি, ইউরোপিয়ান বিচ, স-লিফ জেলকোভা, সাইবেরিয়ান বার্চ আর এই যে চতুর্দিকে খালি লন্ডন প্লেইন লন্ডন প্লেইন আর লন্ডন প্লেইন গাছ, দ্যাখো তো এগুলোর পেছনে কোনো বাসাবাড়ির, কোনো রেলস্টেশন, কোনো মার্কেটের ছবি দেখতে পাও কি না? না। পাবে না। মানে বলতে চাচ্ছি যে খুব বেশি হলে মাত্র দু শ ছবিতে গাছ বাদেও, অর্থাৎ গাছ ও আকাশ বাদ দিয়ে অন্য কিছু আছে। আঠারো শর মধ্যে মাত্র দুই শ। সেটা তো কিছু মিন করার কথা তোমাদের কাছে। নাকি? তৃতীয় কথা, আমার গাছের ছবির মধ্যে আবার বিরাট একটা অংশের ছবিই সেলফি, আমার সেলফি, এই দ্যাখো’–আমি হাতের আঙুল দিয়ে সাঁৎ সাঁৎ ছবি পাল্টে পাল্টে তাদেরকে দেখাতে লাগলাম আমার সেলফিগুলো; প্রতিবার আঙুল ফোনের স্ক্রিনের বাঁয়ে টানছি আর প্রতিবারই মনে মনে বলছি যে, ইয়া খোদা পরের ছবিটা যেন আবার সেলফি আসে—’আর এই দ্যাখো, বাসাবাড়ি, বিল্ডিং এসব এত ছবির মধ্যেও এতগুলো সেলফি। এমনকি এই শেষের বেকনট্রি স্টেশনের সাকুরাগাছের ছবিগুলোতেও দ্যাখো, ইউ আর রাইট যে স্টেশন আছে, স্টেশনমাস্টারের রুম আছে, কিন্তু সেলফি হয়ে আমিও তো আছি, নাকি? বলতে চাচ্ছি যে, যে লোকের ছবিতে এত এত সেলফি থাকে, সে রকম নিজেকে ভালোবাসা একটা লোক তোমাদের জন্য হুমকি হয় কী করে? আমার সেলফ পোর্ট্রেট হলে তুমি অন্য রকম কিছু ভাবতে পারতে। কিন্তু আমার ‘সেলফ’ তো আগের মতো সিকিওরড না, সব তো বদলে গেছে, মিলিয়ন মিলিয়ন মারা গেছে, যাচ্ছে। বোমার শেলের আঘাত না পেয়েই আমরা বলছি, “আই অ্যাম শকড, আই অ্যাম শেল শকড়”। মেন্টাল ইলনেস, চোখে আঘাত লাগেনি কিন্তু তারপরও অন্ধ হয়ে গেছি। বীর শিল্পীর সেলফ পোর্ট্রেটের যুগ শেষ। হা, হা। সেলফ ভেঙে গেছে, সেলফ এখন অনেক সেলফ। তো এই আমি, এ যুগের, এ পোস্টমডার্ন যুগের নন-হিরোইক ক্যামেরাম্যান, যার কিনা ঠিকভাবে ক্যামেরাও নেই একখানা, আছে শুধু ফোনের ফ্রি ক্যামেরা, সেই সেলফি তোলা আমি কী করে বিশ্বাস করব র্যাডিক্যাল পলিটিক্যাল ডিভাইডগুলোতে, ড্রামাটিক আন্দোলন-ডেমনস্ট্রেশন এসবে? আর চতুর্থ কথা,’ – আমি বুঝতে পারলাম, তারা আমার কথায় কনভিনসড হচ্ছে, আবার অধৈর্যও হয়ে উঠেছে—’এক লাইনে বলছি আমার এই শেষ কথাটা, মানে আমি আগেও যেটা বলেছি আইজ্যাক তোমাকে, যে তোমরা মনে করছ আমি গাছপালার ছবি নিয়ে এই “এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন”-এর মঞ্চে গিয়ে উঠব এখন আর ওদের আন্দোলনে ইন্ধন দেব, জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেব পৃথিবীর পরিবেশগত বিপর্যয় ও সরকারগুলোর হাত গুটিয়ে বসে থাকা নিয়ে? কিন্তু তোমাকে আগেই বলেছি যে আমি “ এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন”-এর আন্দোলন, ডেমনস্ট্রেশন, অক্সফোর্ড স্ট্রিটের ওপরে তাদের মঞ্চ, এসবের বিন্দুবিসর্গও জানি না। আমাকে বিশ্বাস করো আইজ্যাক। ‘
তারা তিনজন দেয়ালের দিকে সরে গিয়ে গুনগুন করে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলল। আমার ফোন এখন আমার হাতে। আমি ডিলিট করার মতো কোনো ছবি হাতের সামনে পেলাম না। সানি লিওনি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে, ভদ্রমহিলাকে জনসমক্ষে বের করে আবার পাতকুয়ায় ছুড়ে ফেলার ঝুঁকি নেওয়ার কোনো দরকার নেই। হাতের তালু ঘষতে থাকা মার্ক আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি ক্ষীণ একটা ‘কু’ বা ‘উহ্’ শব্দ শুনলাম ফারজানার গলায়। পুলিশটা আমাকে বলল (যখন কিনা বাকি দুজন তখনো দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সলাপরামর্শ করছে) : ‘অনেস্টলি স্পিকিং, সারা পৃথিবী জানে যে লন্ডনে এখন রিসেন্ট ব্রিটিশ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সিভিল ডিসওবিডিয়েন্সের ঘটনাটা চলছে, আর তুমি লন্ডনে থেকে তা জানো না, এ কথা আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। হেই, তুমি জানো না?’ জোসেফদের দিকে তাকিয়ে এবার জিজ্ঞাসা করল সে।
জোসেফ উত্তর দিল, ‘জানি।’
ফারজানা উত্তর দিল, ‘জানি।’
‘তো আমাকে বলোনি তো তোমরা কিছু?’ ওদের দুজনকে বিব্রত গলায় বললাম আমি, আফসোস করতে করতে।
‘বলার মতো তো কিছু দেখিনি ভাইয়া। আমরা তো এখানে আসছিলাম হয়েজ অ্যান্ড কার্টিস থেকে আপনার বন্ধুর জন্য সেলে জামা কিনতে আর আপনি যেমন বললেন মার্বেল আর্চের দিকে গিয়ে সন্ধ্যা নামা দেখতে।’
‘না, তোমাদের বলা উচিত ছিল আমাকে।’ আমি কপট রাগের ভঙ্গিতে বললাম ওদের, তারপর মার্ককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমার না জানাটা কি দোষের? কত কিছু তো মানুষ জানে না। নিউজিল্যান্ডে এত লোক মারা গেল, সে কথাটা তো জানে না ধরো উরুগুয়ের কৃষক বা মোজাম্বিকের জঙ্গলের ষোলোটা উপজাতি। তো?’
মার্ক আমাকে এবার তার হাতের তালু থেকে জিনিসটা বের করে বলল—আহা, জিনিসটা স্রেফ এক দোমড়ানো- মোচড়ানো লিফলেট, এতটা দোমড়ানো মোচড়ানো যে আমি ভাবলাম ওটা যদি মাটির কিছু হতো তো এতক্ষণে ওটা থেকে পানি বেরিয়ে যেত—একদম কুঁচকানো ওই কাগজটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই দ্যাখো।’
আমি দেখলাম। একটা ৬ ইঞ্চি বাই ৮ ইঞ্চি ছোট সবুজ কাগজ। তার সামনের পাশে মোটা মোটা লেখা : NON VIOLENT। কথাটার ওপরে একটা কালো বৃত্ত, তার মধ্যে দুটো ত্ৰিভুজ সোজা জেড ও উল্টো জেডের প্যাটার্নে ওপর- নিচে রাখা। হুহ, ওটা তাহলে ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’ গ্রুপের লোগো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম ওই লোগো, ওই মোটা NON VIOLENT কথা, ওদের হালকা সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডে আঁকা একটা বড় সাদা প্রজাপতি (লোগোটার পেছনে) এবং পনেরো-ষোলোটা গাছের বা লতাগুল্মের ছবি, সেই সঙ্গে পৃষ্ঠার চার কোনায় চারটে বালুঘড়ি, যা নিশ্চিত নির্দেশ করছে যে সময় চলে যাচ্ছে, পৃথিবীকে বাঁচানোর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এবার লিফলেটটার উল্টো পাশ। নাহ্, তা এতটাই কুঁচকানো যে পড়া যাচ্ছে না কিছু। তবু কষ্ট করে পড়লাম। পড়লাম না, চোখ বোলালাম লিফলেটের এ পাশে লেখা তাদের আন্দোলনের অ্যাজেন্ডায়।
এখানে মাথার দিকে বড় করে কালো রঙে লেখা আছে দেখলাম DISRUPTION শব্দটা। তার নিচে কিছুটা বড় ফন্ট সাইজে লেখা : We are protesting to demand that the government takes emergency action on the Climate and Ecological crisis। লক্ষ করলাম তাদের climate শব্দের C যেমন ক্যাপিটাল, ecological শব্দের Eও তেমন। তারপর নিচে ছোট ফন্টে অনেক লেখা, যা পড়া, এতটা দোমড়ানো মোচড়ানো কুঁচকানো অবস্থায় যা পড়া, কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। স্রেফ দু-একটা শব্দ দেখলাম এখনো উঁকি দিচ্ছে এই পুলিশ অফিসারের হাতের তালুর নিষ্ঠুর বর্বরতা ছাপিয়ে, যেমন: floods, wildfires, extreme weather, crop failure, breakdown of society। হাহ্। এখান থেকে শব্দ নিয়েই তাহলে আইজ্যাক সেই তখন ওয়াকিটকিতে সংকেত পাঠাচ্ছিল তার সহকর্মীদের? ‘ওয়াইল্ডফায়ার – এক্সট্রিম ওয়েদার—পিলার সেভেনটি ফোর নর্থ-নর্থ ইস্ট সাইড— ক্রপ ফেলিওর।’
তার মানে কী দারুণ মজা করেই না সে তার ওয়াকিটকিতে আমাকে সংজ্ঞায়িত করছিল তার বন্ধুদের কাছে, অনেকটা এ রকম যে, ‘আসো আসো, আরেকটা ওয়াইল্ডফায়ার পেয়েছি। শুধু তা-ই না, সেই সঙ্গে এক্সট্রিম ওয়েদার ও ক্রপ ফেলিওরও। অর্থাৎ মোট তিনটা জিনিস, অর্থাৎ Extinction Rebellion- এর বড় একটা হোমরাচোমরা সাঙাত যাকে আমরা ফলো করছিলাম আজ তিন-চার দিন ধরে, তাকে শেষমেশ পেয়ে গেছি ঠিক অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মূল মঞ্চে উঠবার কিছুটা আগে আন্ডারগ্রাউন্ডে। অতএব চলে আসো, জলদি স্টেশনের ভেতরে উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকের পিলার নম্বর চুয়াত্তরের কাছটায়।’
যাক, লিফলেটের এ পাশের নিচে এই প্রথম আমি অবশেষে Extinction Rebellion কথাটা দেখলাম। শব্দ দুটো ওপর-নিচে বসে আছে কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে সবুজ হয়ে, বসে আছে তাদের লোগোর পাশে। এর বাংলা করলাম আমি মনে মনে : ‘বিলুপ্তি বিদ্রোহ’, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ঠেকানোর জন্য বিদ্রোহ। কথাটার নিচেই লেখা, কোনোমতে পড়া গেল, শেষ লাইনে লেখা যে ইন্টারনেটে Extinction Rebellion লিখে সার্চ দিলেই জানা যাবে সব, সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদেরকে ফলো করলেও জানা যাবে সব।
ভালো কথা। ভাবলাম আমি।
আমি তখনো তাকিয়ে আছি দোমড়ানো কাগজটার দিকে, তালু-পেষা পুলিশ মার্ক আমাকে (কিংবা সম্ভবত কাউকেই না) উদ্দেশ করে বলেই চলেছে কীভাবে আজ পাঁচ দিন হয় এই সো-কলড নন ভায়োলেন্ট ডেমনস্ট্রেশন লন্ডন শহরকে পঙ্গু করে রেখেছে। ‘অক্সফোর্ড সার্কাস বন্ধ, ওয়াটার লু ব্রিজ এরিয়া বন্ধ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এরিয়া বন্ধ। তাহলে লন্ডনে চলাচলতির আর থাকে কী? বাসায় যাই না আজ তিন দিন, হারাম এক মিনিটের জন্যও যেতে পারি নাই। মোট অ্যারেস্ট, সো ফার, ১০৫০ জন। এর মধ্যে এক মেয়ে ফ্লিট স্ট্রিটের গোল্ডম্যান স্যাকসের ইউরোপিয়ান হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের সামনে তার ব্রেস্টস, হ্যাঁ তার ব্রেস্টস’-নিজের দুহাত বুকের ওপরে দুপাশে রেখে দেখাল সে আঠা দিয়ে বাইরের দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছে। লোকজন, সাংবাদিক এরা “গোল্ডম্যান স্যাকস কেন?” জিজ্ঞেস করতেই সেই মেয়ে মেশিনের মতো সারা দিন বলে চলেছে : “পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে অর্থনৈতিক গ্রোথের জন্য। সুতরাং ঋণনির্ভর অর্থনীতির এই ধাঁচ আমূল বদলাতে হবে। সুতরাং গোল্ডম্যান স্যাকস।” আমাদের লন্ডন পুলিশের চিফ ক্রেসিডা ডিক কাল বলেছেন উনি ওনার ৩৬ বছরের পুলিশ ক্যারিয়ারে এ ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আর কোনো দিন দেখেননি। এর মধ্যে কোথাকার’– ঠিক এ পর্যায়ে আইজ্যাক ও তার ঠোঁট কামড়ানো, ঠোঁট নাই হয়ে যাওয়া পুলিশ সহকর্মী রাইসিংগার এদিকে ছুটে এসে মার্ককে থামিয়ে দিতে উদ্যত হলো। কিন্তু মার্ক থামবে না, সে তাদের ‘স্টপ স্টপ, লেট আস টক’ চিৎকারের মধ্যেই বলে চলল তার কথা—’এর মধ্যে কোথাকার অ্যান্টি-ব্রেক্সিট একটা দলও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে কাল রাত থেকে, ওদের ব্যানারে লেখা “NO BREXIT ON A DEAD PLANET”।
সে এটুকু কোনোমতে বলে মাত্র শেষ করেছে, তখন আইজ্যাক ও রাইসিংগার তাকে একসঙ্গে মিলে প্রথমে ‘ওয়ান’, তারপরে ‘টু’, তারপর ‘থ্রি’ বলে হাত দিয়ে জোর ধাক্কা দিয়ে একরকম ছুড়ে দিল এ ঘরে ঢোকার মূল দরজার দিকে, যে দিকটায় বসে আছে জোসেফ ও ফারজানা। ওরা স্বামী-স্ত্রী একত্রে মার্কের দেয়ালের ওপরে গিয়ে হামলে পড়া ঠেকাল কোনোরকমে।
আইজ্যাক বলল, আমার চোখের দিকে তার আঙুল উঁচু করে এনে চোখ খুঁচিয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘এনাফ ইজ এনাফ। সেলফি নিয়ে তোমার কথাগুলো ভালো লেগেছে। সত্য সব সময় বলতেই হবে। গাছপালা তোমার নিরপরাধ নেশা, আর তাই তোমার অসংখ্য ছবিতে কোনো বাড়িঘর-দালানকোঠা নেই, সেটাও বোঝা গেল। সত্য সব সময় বলতেই হবে। কিন্তু যদি তুমি “এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন”-এর সিট-ডাউনের কথা নাই-বা জানবে তো, আর তোমার বাকি দু আত্মীয় সে কথা জানবে তো’—জোসেফ ও ফারজানার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল সে—’তোমরা বার্কিংয়ের সুন্দর পার্কে সূর্যাস্ত দেখা বাদ দিয়ে ওদের আন্দোলনের প্রধান দিনে, যখন কিনা একটা দোকানও অক্সফোর্ড স্ট্রিটে খোলা নেই, যখন কিনা হয়েজ অ্যান্ড কার্টিস শার্টের দোকানও বন্ধ, তো সে রকম এক দিনে মানুষের, ডেমনস্ট্রেটরদের ভিড়ে পিষ্ট হতে তুমি অক্সফোর্ড স্ট্রিটে আসবে কেন? বলো।’
আমার বদলে এবার জোসেফ দ্রুত কথা বলে উঠল। ‘স্যার, আমরা জানি অক্সফোর্ড স্ট্রিটে গাড়ি চলাচল বন্ধ। তাই আমরা উবার ট্যাক্সি না নিয়ে ট্রেনে করে এসেছি। ভাইয়াকে এসব বলার প্রয়োজন দেখিনি। আর অক্সফোর্ড স্ট্রিটের অনেক দোকানপাট খোলা। তুমি ভুল বলছ। আমার ও ফারজানার বন্ধুরা এখানকার অনেক দোকানে এ মুহূর্তে কাজে। কী বলছ এসব? আর আমরা তো স্রেফ এই “এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন”-এর ডেমনস্ট্রেশন দেখতেও আসতে পারি, নাকি? যত লোক ধরো বাইরে এখানে আছে ওদের মঞ্চ ঘিরে, তুমি কি মনে করো তারা সবাই ওদের পার্টির লোক? অসম্ভব। আমি শুনেছি ওখানে দারুণ গান হচ্ছে। মঞ্চের পাশে, মঞ্চের ওপরে শিল্পীরা দাঁড়িয়ে গান গাচ্ছে। তো, মানুষ যাবে না ওসব দেখতে?’
আইজ্যাক চিৎকার করে জোসেফকে বলল, ‘শাটআপ। উড ইউ প্লিজ।’
ফারজানা জোসেফের মুখ বন্ধ করল আক্ষরিক অর্থে তার হাত ওর মুখে চাপা দিয়ে। তালু-পেষা পুলিশ মার্ক দরজার বাইরে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। তার আর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এ ঘরে কী সব চলছে তা নিয়ে, কারণ (আমার ধারণা) সে বুঝে গেছে আমি ওয়াইল্ড ফায়ারও না, ক্রপ ফেলিওরও না, স্রেফ এক নিরীহ, গাছপাগল ট্যুরিস্ট।
আইজ্যাক তার ওই চিৎকারের পরে শ্বাস নিয়েছে দশ- বারো সেকেন্ড, এবং এবার হুস্ শব্দে অনেকটা বাতাস শ্বাসে টেনে আমার মুখের ওপর তেড়ে এসে বলেছে (চিৎকার করেছে) : ‘তাহলে তুমি এখানে কেন? কোনো একটা কিছু মিলছে না। বলো, তুমি এ মুহূর্তে এখানে কেন?’
আমি বুঝলাম, যথেষ্ট হয়েছে, আর চেপে রাখা যাবে না। সত্য একটা নির্দিষ্ট মাত্রার পরে আর চেপে রাখা যায় না। সত্যকথনের একটা গ্রিক দার্শনিক সাইড আছে। সত্য বলার সময়ে কোনো কিছু আমি গোপন করব না, পুরো সত্য বলব, আবার এমন সত্য বলব যা কোনো কিছুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যও হবে না, যা কিনা হবে প্রকাশ্য সত্য এবং সবচেয়ে বড় কথা, যে সত্য আমি বলব তা ভালো রকম ঝুঁকি নিয়েই বলব, অর্থাৎ ওই সত্য বলার মধ্যেই থাকবে সহিংসতা ঘটার ঝুঁকি—এই যে বিশেষ গ্রিক ধরনের সত্যকথন, এতে সত্য বলাটা আর স্রেফ সত্যকথন থাকে না, truth – telling তখন হয়ে যায় —গ্রিক ভাষায়- পারহেসিয়া। আমার চকিতে মনে পড়ল ‘First Philippic’- এর কথা। সেখানে ডেমসথেনেস প্রথমে বললেন, ‘আমি যা বলার খোলাখুলি বলছি,’ তারপর যোগ করলেন, ‘আমি খুব ভালোভাবে জানি, এই খোলাখুলি বলার মাধ্যমে আমি যা বলতে যাচ্ছি, তা বলার পরে পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হয়ে যাবে।’ ওটাই পারহেসিয়া, ওটা আর স্রেফ সত্যকথন নয়। তো, আমি আমার হাতে-পায়ে সামান্য, ক্ষীণ কিন্তু নিশ্চিত একটা ঝাড়া দিয়ে নিয়ে আইজ্যাকের প্রশ্নের উত্তরে বলেই ফেললাম আমার পারহেসিয়াটুকু, আমার ঝুঁকিপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ্য সতটুকু : ‘আমি এখানে এসেছি আলথুসারের জন্য।’