1 of 2

আলঝাইমার

আলঝাইমার

এ কী! তপেনদা! হঠাৎ এদিকে কী মনে করে?

লিফট-এর সামনেই নির্মলের সঙ্গে দেখা।

নির্মল তপেনবাবুর আমলেই এল ডি সি হয়ে ঢুকেছিল। তারপর ইউ ডি সি হল, ইন্সপেকটর এবং তারপর অফিসারও।

হঠাৎ আবার কী? এই বাড়িতে যদিও কোনোদিন পোস্টিং হয়নি আমার কিন্তু এই ডিপার্টমেন্টেই তো জীবনের পঁয়ত্রিশটা বছর কাটিয়ে দিলাম দিনে আট ঘন্টা করে। এই তো আমার আসল বাড়ি।

আট ঘন্টা করে!

তা ছাড়া কী? আমাদের সময়ে তো সরকারি অফিসে এমন নৈরাজ্য ছিল না। ডিসিপ্লিন কড়া ছিল। কাঁটায় কাঁটায় দশটাতে অফিসে পৌঁছোতে হত। পাঁচটার আগে কেউ যাওয়ার কথা ভাবতও না। বড়সাহেব থেকে ছোটোসাহেব, বড়োবাবু থেকে ছোটো পিওন সকলেই আইন মানত।

তা ঠিক। তবে তখনও তো বাঙালি জাতটা ডেলি-প্যাসেঞ্জারের জাত হয়ে যায়নি, দাদা। প্রায় সকলেই কলকাতাতেই থাকত। আর তখন কলকাতা বলতে, টালা থেকে টালিগঞ্জ, আর দমদম থেকে বালিগঞ্জই বোঝাত। তখন বর্ধমান, কৃষ্ণনগর বা ডায়মন্ডহারবারও কলকাতা বলে গণ্য হত না। আমরা যে রোজ অফিসে আসি এই যথেষ্ট।

সেটা অবশ্য ঠিকই। আজকে ট্রেন লাইনে বসা-ধর্মঘট, কাল শোওয়া-ধর্মঘট, পরশু ট্রেনে মোষ কাটা পড়া, তার পরদিন টিকিট চেকারকে প্যাঁদানোর জন্যে রেলের স্টাফের স্ট্রাইক, তারও পরদিন টিকিট চাওয়ার অপরাধে যাত্রীদের স্ট্রাইক এই তো চলে রোজই, চাপান-উতোর। এরও ওপরে গোদের ওপর বিষফোঁড়া বনধ তো আছেই। তা ছাড়া, তোমাদের কালে কাজ না। করলেও, অফিসে না এলেও, মাইনে পাওয়া যায়, বোনাস পাওয়া যায়। ইনক্রিমেন্টও। শুধু ভোটটা দিলেই চলে। কিন্তু আমাদের সময়ে কাজ করতে হত। সলিড কাজ।

আমরা কি সব লিকুইড বা গ্যাসি কাজ করি তপেনদা? আপনারা কী করতেন তা জানা আছে। তখন কাজ ছিলই বা কতটুকু? ক-টা ফাইল ছিল? ক-টা ডিসপোজাল দিতে হত মাসে? সব জানা আছে।

তা ঠিক। কাজ কম ছিল আজকের তুলনাতে। কিন্তু যেটুকুই ছিল তা আমরা ভালো করেই করতাম। আমাদের সময়ে এখনকার দিনের মতো এই পদের সব উকিলও ছিল না, হাকিমও ছিল না। দেশটাই বদলে গেছে। সত্যিই আমাদের সময়টা অন্যরকম ছিল।

তা গেছে। আপনাদের দেখেই তো সব শিখেছি।

কী শিখেছ? ঘুষ-ঘাষ নেওয়া?

গলা নামিয়ে, চোখ নীচু করে বললেন, নির্মলকে, তপেনবাবু।

গলা চড়িয়ে নির্মল বলল, ঘুষ-ঘাষ আবার কী? নেতারা কোটি কোটি টাকার কাট-মানি নেবে, বড়োসায়েবরা আন্ডার দ্যা টেবল ডিল করবে, স্পিড-মানি নেবে, আর আমরা কি আঙুল চুষব? আমরা দু-পাঁচশো টাকা নিলেই তা ঘুষ-ঘাষ হয়ে যায়।

পাশে দাঁড়ানো একটি অপরিচিত ছেলে বলল, হিয়ার! হিয়ার! ঠিক বলেছ নির্মলদা।

তপেনবাবু আহত চোখে তাকালেন অচেনা ছেলেটির দিকে।

আজকাল ঘুষ নেওয়াটা এফিসিয়েন্সিরই লক্ষণ। এতে কোনো লজ্জা নেই। সততা কথাটা। রিলেটিভ তা মানেন তো। ত্রেতা যুগে যাকে সততা বলত দ্বাপরেও কি তাকেই বলে? আর কলি যুগে? ঘোর কলি এখন তপেনদা। দেখছেন না কার্তিক মাসে ভরা শ্রাবণ, আর শ্রাবণে খরা ছিল।

লিফট এসে গেল। তপেনবাবু উঠলেন। নির্মলও উঠল।

লিফট-এর অন্য যাত্রীরা ওঁদের কথোপকথন শুনছিলেন। সরকারি অফিসের লিফট-এ ঘুষ-ঘাষ নিয়ে চিকৃত আলোচনাতে কেউই বিচলিত নন দেখে তপেনবাবু নিজেই লজ্জিত হলেন। মুখ নামিয়ে চুপ করে রইলেন। ভাবলেন দিনকাল সত্যিই বদলে গেছে। না হলে কী আর পেঁয়াজ পঁচাশি টাকাতেও কেনার মানুষের অভাব নেই, না চিংড়ি মাছ পাঁচ-শো টাকাতে, পাঁঠার মাংস দেড়-শো টাকাতে। সঞ্চয়িতার সুদ যেন লাগাতার পেয়ে চলেছেন এখন অনেকেই, যাদের আয়ের উৎস এখনও শুকিয়ে যায়নি। অবসর নেওয়া আর বাঁধা-রোজগারের মানুষদেরই বিপদ। আর বেকারদের। চাকুরিজীবীদের মধ্যে যাদেরই আয়ের কোনো সূত্র আছে, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ঘুষ-ঘাষে সামিল হয়ে গেছে। আর সরকারেরাও হয়েছে তেমন, কী বড়ে সরকার, কী ছোটে সরকার। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত বেকার যেখানে, সেখানে চাকরি যাদের আছে তাদের ডি এ বাড়ছে, অবসরের বয়সসীমা বাড়ছে, অন্যান্য নানা সুবিধাও বাড়ছে অথচ বেকারদের জন্যে নতুন চাকরির কথা ভাবাই হচ্ছে না। তারা চুরি-ডাকাতি করতে বাধ্য হচ্ছে। যারা তা করতে পারছে না তারা আত্মহত্যা করছে। মালটিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে আবারও মালিকানা পুরোপুরি ফিরিয়ে দেওয়াতে তারা সব মুনাফা যার যার দেশে নিয়ে যাচ্ছে, কম্পিউটার বসিয়ে কর্মচারী ছাঁটাই করছে। তারা ভবিষ্যতে আর দিশি কর্মচারী, উপরের স্তর ছাড়া, প্রায় নেবেই না বলতে গেলে। তারও পরে দেশে একটিমাত্র শিল্প, কুটির শিল্প, যা সচল আছে, তা। হচ্ছে সন্তান উৎপাদনের ইন্ডাস্ট্রি। নিজেরা খেতে পাই নাই পাই সন্তানদের খাওয়াতে পারি আর পারি, বছর বছর সন্তান জন্মাচ্ছে। আশ্চর্য। এখনও জন্মাচ্ছে। তপেনবাবুর হাতে ক্ষমতা। থাকলে বন্দুক দেখিয়ে সকলকে জন্মনিয়ন্ত্রণ করাতে বাধ্য করতেন। দেশটার ভবিষ্যৎ দিনকে। দিন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মাথা ব্যথা কার আছে? পঙ্কেই তো পঙ্কজ জন্মায়! যত দারিদ্র, যত অশিক্ষা, যত জনসংখ্যা, ততই তো ভোট বাড়বে। সব দলেরই পক্ষে দরিদ্র আর অশিক্ষিতের ভোট পেতেই তো বেশি সুবিধা! বিহার ভারতের অন্যতম অশিক্ষিত রাজ্য বলেই লালুপ্রসাদ যাদবের মতো নেতাকে সে রাজ্য ভগবান-জ্ঞানে পুজো করে।

ভোট না পেলে ক্ষমতাতে থাকা যাবেই-বা কী করে! সব দলই সমান। দেশের-দশের ভালোর কথা আর কে ভাবে। ভাবে না কেউই তা নয়, কিন্তু দেশের-দশের ভালো করতে গেলে যে নিজের এবং নিজেদের দলের ভালো করা যায় না!

এত কথা তপেনবাবু ভাবলেনই। অনেক ভাবনাই ভাবা যায় চোখের পলকে কিন্তু এসব কথা বলবেন কাকে?

লিফট পৌঁছে গেল টপ-ফ্লোরে। অন্যান্যদের সঙ্গে তপেনবাবু আর নির্মলও নামলেন।

কার কাছে যাবেন?

নির্মল জিজ্ঞেস করল।

শ্যামলের কাছে।

কোন শ্যামল? শ্যামল সেনগুপ্ত?

হ্যাঁ। ওর চাকরি তো আমিই করে দিয়েছিলাম।

তপেনবাবু বললেন।

মানে?

মানে, ইন্টারভিউর সময়ে বড়ো সাহেবকে বলে পাশ করিয়ে দিয়েছিলাম। তখনও ইংরেজদের ট্রেইনড অফিসাররা সব ছিলেন। ইংরেজীতে ভালো না হলে, ইন্টারভিউতে পাশকরা অত সহজ ছিল না। প্রশ্নোত্তর সব চোস্ত ইংরেজিতেই হত।

তা ঠিক। কিন্তু পরীক্ষাতে তো সেনগুপ্ত সাহেব পাশ করেইছিলেন। নইলে, আর ইন্টারভুটা পেলেন কী করে! ওই ইংরেজি ফুটিয়েই তো দেশটার এই হাল।

সেকথা কি আমি অস্বীকার করেছি।

তা হলে আর বলছেন কেন যে, আপনিই চাকরিটা করে দিয়েছিলেন।

তুমি আমার সব কথাতেই অমন চটে যাচ্ছ কেন বলো তো নির্মল। তুমি তো আগে অমন ছিলে না। তুমি অনেকই বদলে গেছ দেখছি।

আপনিও বদলে গেছেন দাদা।

তপেনবাবু বিস্ময়ের গলাতে বললেন, তাই?

তাই তো!

করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, নির্মল।

তপেনবাবু দাঁড়িয়ে পড়ে পকেট থেকে নস্যির ডিবেটা বের করে একটু নস্যি নিলেন। উত্তেজিত হলেই…

ইস! এখনও নস্যি নেন? ঘাস্টলি হ্যাবিট। কোনো ভদ্রলোক নস্যি নেয় নাকি আজকাল?

আমি কি ভদ্রলোক?

আপনিই জানেন দাদা।

না। আমি নিজেই জানি না। মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন আমি নিজেও নিজেকে করি। আচ্ছা নির্মল, ভদ্রলোকের লক্ষণ কী কী বলতে পার?

আপনি জীবনানন্দ পড়েছেন?

জীবানন্দজি মানে, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের জীবানন্দ?

হাঃ। কোথায় জীবনানন্দ আর কোথায় জীবানন্দ।

নির্মল বলল।

তারপর জীবনানন্দ আবৃত্তি করল, আবহমানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে।

পড়েছি বই কী। আনন্দমঠ পড়ব না?

তপেনবাবু বললেন।

তারপর বললেন, আরে আমাদের বাড়িই যে ছিল বিপ্লবীদের বাড়ি। আমার বড়ো জ্যাঠামশায় তো ডিনামাইট দিয়ে ইংরেজদের রেল-লাইন ওড়াতেন। আন্দামানের সেলুলার জেলে নারকোল তেল পিষে পিষে আর চাবুকের বাড়ি খেয়ে খেয়ে পচে মরলেন। যদি কোনো দিন পোর্টব্লেয়ারে যাও তবে দেখে এসো। আমার বড়ো জ্যাঠামশাইয়ের নাম খোদাই করা আছে। মুকুন্দলাল রায়। গেলে, দেখবে অধিকাংশ নামই বাঙালির। অবশ্য পাঞ্জাবিও আছে বেশ কিছু। স্বাধীনতার জন্যে কী দামই না দিল বাঙালিরা আর পাঞ্জাবিরা, আর দ্যাখো, নেহরু সাহেব তড়িঘড়ি গদিতে বসার জন্যে বাংলা আর পাঞ্জাবকেই দু-টুকরো করে দিলেন।

নির্মল মনে মনে বলল, সেনাইল হয়ে গেলে বড়ো বেশি কথা মানুষে। মুখে বলল, অবান্তর যত কথা ছাড়ুন তো! ওই সব মান্ধাতার আমলেরকথা। তা ছাড়া জওহরলাল নেহরু কি দেশ ভাগ একা করেছিলেন নাকি?

বাঃ। তা কেন! জিন্নাসাহেবও ছিলেন। দুই সাহেব আর এক কৌপিন-পরা ভড়ংবাজে মিলে সর্বনাশ করল বাঙালি আর পাঞ্জাবির। জিন্না তো কোনো ভারতীয় ভাষাই জানতেন না। নেহরু খদ্দর পরলে কী হয়, মতিলাল নেহরুর নাতি, সেও তো ছিল সাহেবই.ইংল্যান্ডের হ্যারো স্কুলে পড়া, ভারতীয়ত্ব-বিবর্জিত, ভারতীয় নেতা। খদ্দর আর গান্ধী টুপি চড়ালেই কি সবাই ভারতীয় হয়ে যায় নাকি?

এত তিক্ততা কেন আপনার তপেনদা? একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না তো।

নির্মল বলল।

না। বলো।

আসলে আপনারা পঞ্চান্নতেই রিটায়ার করে গেলেন। তারপর রিটায়ারমেন্টের বয়স হয়ে গেল আটান্ন। ডি এ বাড়ল অনেক। অল্পদিন আগেও বেড়েছে একবার। তা থেকেও বঞ্চিত হলেন। তাই এখন আমাদের একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না আপনি, তাই না? ভাবছেন না কেন যে, আপনারা যে সস্তার দিনে পঞ্চান্ন বছর অবধি চাকরি করলেন সেই তো যথেষ্ট। এখন নাতি কোলে করে রোদে পিঠ দিয়ে বসে জম্পেস করে ধনেপাতা দিয়ে ফুলকপি খান। কেন ফালতু উত্তেজনায় ফাঁসছেন! তা ছাড়া আপনার একমাত্র ছেলে, সে তো হিরের টুকরো ছেলে, মালটিন্যাশনাল সাহেব কোম্পানিতে মস্ত বড়ো চাকরি করে শুনেছি। আপনার চিন্তা কী?

তারপর বলল, বাড়ি করেছেন নাকি আপনি। বাঁশদ্ৰোণীতে। দোতলা?

কে বলেছে? আমার কলিগদের মধ্যে যারা বাড়ি করেছে, তারা তো ঘুষের টাকাতেই করেছে। তুমিও জান তা, আমিও জানি। কেউ কেউ অবশ্য বাপের টাকাতেও করেছে। যেমন নিত্যানন্দ।

আহা নিত্যানন্দ। কোথায় ছিল নিত্যানন্দ, জলে পেয়ে মাছের গন্ধ, নাচিতে লাগিল, নাচিতে লাগিল।দুকলি গেয়ে উঠল নির্মল। তারপর বলল, ঘুষ-ঘাষের চেয়ে বড়ো বাপ আজ আর কী আছে তপেনদা? বাবার মতো বাবা। সে বাবাই তো আসল ভরসা। নিজের বাপের ওপরে আজকাল আর কেউ ভরসা করে না।

ছিঃ ছিঃ! তোমাদের মর‍্যাল ক্যারেকটার একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে নির্মল। ইড শুড বি অ্যাশেমড অফ ইওরসেলফ!

আস্তে বলুন তপেনদা। এ বাড়ির ইটগুলোও হাসবে। সেই মোগল আমল থেকেই তো ঘুষ-ঘাষ চলে আসছে। ভারতীয় রক্তেই বইছে ঘুষ-ঘাষ। তার কত নাম। কৃষ্ণের শতনামেরই মতো। এও তো আমাদের অজন্তা, ইলোরা, কোনার্ক, বিষ্ণুপুরের মন্দিরের মতো এক হেরিটেজ। ন্যাশনাল হেরিটেজ।

বলেই, নির্মল বলল, চললাম। দেখা হবে। প্লে কুল দাদা। অত উত্তেজনা ভালো নয়।

বলেই, নিজের ঘরের পর্দার আড়ালে চলে গেল নির্মল। এক কাপ চা খাবেন কি না সে কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না।

এক্কেরই অসভ্য হয়ে গেছে ছেলেটা। ওর বড়ো ভাই বিমল কত সভ্য, সৎ এবং ভালো ছিল। আজকালকার ছোঁড়াগুলোই এমন।

দুঃখ ভোলবার জন্যে আর একটিপ নস্যি নিলেন তপেনবাবু টিনের কৌটোটার ঢাকনি খুলে।

দাঁড়িয়ে পড়ে, একটু ভাবলেন, মনে করার চেষ্টা করলেন, এই চার্জ-এর কমিশনার সাহেব কে? লিফট-এর দিকে পিছিয়ে গেলেন উনি। তারপর লিফটটা অতিক্রম করে ওদিকে গিয়ে।

কমিশনারের নামের বোর্ডটা দেখলেন। নামটা দেখেই উত্তেজনা আরও বাড়ল। দাঁত কিড়মিড় করে নীচু গলাতে বললেন, শুয়ারের বাচ্চা। হারামি একটা। ডাকাত। আর একটিপ নস্যি নিলেন। এই কমিশনার এক নম্বরের ঘুষখোর, অসৎ, দুশ্চরিত্র। মর্কট একটা। নির্মলের নামে নালিশ করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু এ লোকের সঙ্গে তাঁর একবার ফাটাফাটি হয়ে গেছিল। তাঁর ঘাড়ে বন্দুক রেখে মোটা মাল কামাবার ধান্দাতে ছিল শুয়োরটা। বাদ সাধার পর থেকেই মর্কটটা তপেনবাবুর পেছনে লেগে গেল। আজকাল বামুন, কায়েত, সোনার চাঁদ, সোনার টুকরো সবই সমান। হরে-দরে সব এক।

শ্যামলের ঘরের দিকে ফিরে আসতে আসতে মনে পড়ে গেল কমিশনার আশু ব্যানার্জি এই টার্ম দুটো জয়েন করেছিলেন। সিডিউল কাস্ট আর সিডিউল ট্রাইবদের চাকরিতে ঢোকার সময়ে, উন্নতির সময়ে এরকম সুযোগ-সুবিধার কারণে ব্যানার্জি সাহেবের খুবই রাগ ছিল রিসার্ভেশানের উপরে। উনি বলতেন, চাকরিতে ঢোকার সময়ে সুবিধে পায় পাক, উন্নতির বেলাতেও কেন পাবে? তা ছাড়া চাকরিতে ঢোকার সময়ে সুবিধেও বা আরও কত বছর পাবে? পঞ্চাশ বছরেও কি যথেষ্ট হয়নি?

কিন্তু তপেনবাবু বলতেন, একবার ভেবে দেখুন দেখি কত হাজার বচ্ছর আপনারা এই উচ্চবর্ণের মানুষেরা এদের চুষে এসেছেন। কোন সুযোগটা পেয়েছে এরা এতদিন।

ব্যানার্জিসাহেব বলেছিলেন, যান। যান। যত্ত সব সোনার চাঁদ আর সোনার টুকরো। এরা কি এই বাড়তি সুযোগ-সুবিধে পেয়ে নিজেদের অবহেলিত নিপীড়িত স্বজনদেরও কোনো উপকার। করেছে? অধিকাংশই তো সিটি-লাইফে সামিল হয়ে গেছে। অনেকে অ্যাফিডেবিট করে নাম পর্যন্ত বদলে নিয়ে যাদের তারা ঘৃণা করে, সেই আমাদের আপার ক্লাস-এ উঠেছে। যেন, থ্রি টায়ার এ সি কম্পার্টমেন্টের ওপরের বাঙ্কে চড়ল।

তপেনবাবু ব্যানার্জিসাহেবকে বলেছিলেন, এটা অন্যায় কথা বলছেন আপনি। এমন করে বলাটা অন্যায়।

আশু ব্যানার্জি বলেছিলেন, আপনি তো মশায় কায়েত। আপনি বামুনদের দুঃখ কী বুঝবেন?

তপেনবাবু কিছুই বলেননি। ভেবেছিলেন, ব্যানার্জিসাহেব মিছেই প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছেন, আধুনিক ইতিহাসে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে, কমপিটিটিভ পরীক্ষাতে বসে ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস পেয়েছেন। আসলে শিক্ষিত বলতে যা বোঝায়, তা তিনি হননি।

২.

শ্যামলের ঘরের সামনে বেশ ভিড়। অনেকই মানুষ বসে আছেন। বড়ো বড়ো অ্যাসেসি। মাড়োয়ারি, গুজরাটি, বাঙালি। ভাবলেন, দরজা ঠেলে ঢুকেই যাবেন। তারপরই ভাবলেন, না। ডিপার্টমেন্ট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে গেছে। নির্মলের ব্যবহার তাঁকে বড়োই ব্যথিত করেছে। বহু বছর এই বিল্ডিংয়ে আসেননি উনি। শুধুমাত্র তাঁর কৃপাধন্য, তাঁর অনুরক্ত শ্যামল সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা করার জন্যেই এসেছেন আজকে। কী এমন ঘটল, যে পৃথিবীটা এতখানি বদলে গেল এই ক-বছরে। বাড়ি বসে এসব খবর তো তাঁর রাখার কথা নয়।

তারপরেই ওঁর মনে পড়ল, রিটায়ারমেন্টের বয়স ষাট হয়ে গেছে আটান্ন থেকে। ওঁদের সময় তো ছিল মাত্র পঞ্চান্ন। সত্যিই কি তিনি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছেন? নাকি আজকালকার ছেলেরা সকলেই নির্মলেরই মতো? দুর্বিনীত। অসভ্য!

পরক্ষণেই ভাবলেন, নাঃ। দরজা ঠেলে ঢোকাটা বোধহয় উচিত হবে না।

মনে পড়ে গেল, তিনি নিজে যখন হাকিম ছিলেন, তখন তাঁর কাছে রায়সাহেব যখনই আসতেন, স্লিপ পাঠাতেন তাঁর ঘরে। অতবড়ো নামী উকিল। ইচ্ছে করলে তিনি স্বচ্ছন্দে দরজা ঠেলে ঢুকে আসতে পারতেন। কিন্তু সবসময়েই কার্ড অথবা স্লিপ পাঠাতেন। এমন কেন করেন সেকথা বললে বলতেন আরে স্যার! আমি আমার স্ত্রীর ঘরেও স্লিপ দিয়ে ঢুকি। কার মেজাজ কখন কেমন থাকে, কে বলতে পারে। একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে লাগে বহু সময়। ভেঙে যেতে পারে তা। একমুহূর্তেই, দু-জনের কারোই বিনা দোষে এই ঝুঁকি নেবার দরকার কী?

পিয়োন একটি স্লিপ দিল তপেনবাবুর হাতে। তপেনবাবু স্লিপে নাম না লিখে একটা কার্ড দিলেন। পুরোনো কার্ড। হলুদ হয়ে গেছে। ভেবেছিলেন, কার্ডটা পেয়েই শ্যামল দৌড়ে আসবে ঘরের। ভেতর থেকে। বলবে, আরে দাদা! আপনিও স্লিপ পাঠালেন? আসুন। আসুন। ভেতরে আসুন! তখন তপেনবাবু বলবেন, না, না। তুমি কাজ করছ, কাজ সেরে নাও। নাথিং শুড কাম বিফোর ওয়ার্ক ইন আ ম্যানস লাইফ।

শ্যামল উত্তরে বলবে, তাতে কী? আমি কাজ করব, আপনি বসে থাকবেন ইজিচেয়ারে, চা-টা খাবেন। আমার কাছে এসে আপনি বাইরের বেঞ্চে বসে থাকবেন তা কী হয়! এই বিল্ডিংয়ের ক্যান্টিনে চমৎকার ছোলার ডাল আর লুচি করে। রসগোল্লাও। আপনি তো কখনো এখানে। পোস্টেড ছিলেন না। নাকি চাইনিজ দোকান থেকে চিংড়ি মাছ ভাজা আনিয়ে দেব? মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে। কখন বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে?

উত্তরে তপেনবাবু বলবেন, আরে না, না। শুধু এক কাপ চা-ই খাব। এই বয়সে অসময়ে কি কিছু খাওয়া যায়, না খাওয়া উচিত?

কিন্তু পিয়োন কার্ডটা ঘরে সেনগুপ্তসাহেবকে দিয়ে ফিরে এসে বলল, সাহেব ব্যস্ত আছেন। বসতে হবে। দেরি হবে। অন্য কাজ থাকলে সেরে আসতে পারেন। তপেনবাবু অবাক হয়ে বললেন, উনি কি আমার নামটা পড়েছেন?

কে?

মানে, সেনগুপ্তসাহেব?

হ্যাঁ। হ্যাঁ। পড়বেন না কেন? দু-বার পড়েছেন।

ও। তাই?

আরও অবাক হয়ে বললেন তপেনবাবু। তারপর পিয়োনের বেঞ্চে বসে পড়লেন প্রায়ান্ধকার করিডরে। ভ্যাপসা গরম। যখন নিজে হাকিম ছিলেন তখন কখনো পিয়োনের বেঞ্চে বসেননি। নীচু বেঞ্চে বসে, সামনের করিডর দিয়ে যাওয়া-আসা করা মানুষদের অনেক উঁচু বলে মনে। হচ্ছিল। সত্যি উঁচুই। যাঁরা কৃপা করেন, তাঁরা কৃপাপ্রার্থীদের চোখে চিরদিনই উঁচু।

পিওন বলল, একটু সরে বসুন। পাখাটা আমারই জন্যে।

তপেনবাবু আহত হলেও বললেন, ও হ্যাঁ। তাই তো। সরে বসছি।

ভাবলেন, তপেনবাবু যদি বড়ো অ্যাসেসি অথবা মান্যগণ্য উকিল হতেন তবে সে নিজে দাঁড়িয়ে উঠেই তাঁকে বসতে দিত। বকশিশ পেত যে! বকশিশ। বকশিশই তো এখন মান্যতার সবচেয়ে বড়ো চাবি।

তপেনবাবু ভাবছিলেন, ভারতবর্ষ যখন স্বাধীন হল, তারই আগে আগে ভারতের বডোলাট সাহেব ইংল্যান্ডের রাজাকে একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। সেই রিপোর্টে তিনি বলেছিলেন: We have done the worst in the field of education, because, we have given them (মানে ভারতীয়দের) education of letters but not of character.

ক্যারেকটারই তো আসল! ক্যারেকটারই একটি জাতের সঙ্গে অন্য জাতের পৃথকীকরণের উপায়। যে জাতের, যে মানুষের চরিত্র নেই, তার বা তাদের কিছুমাত্রই নেই। তাদের শিক্ষাটা শিক্ষাই নয়। কিন্তু সে তো পঞ্চাশ বছর আগের কথা। গত পঞ্চাশ বছরে কী হল? আমরা কী করলাম!

আবারও নস্যির কৌটোটা বের করলেন। আবারও বড়ো এক টিপ নস্যি নিলেন। দূরে হলেও ওপরে পাখাটা ঘুরছিল। একটু নস্যি তাঁর আঙুল থেকে উড়ে গেল পিয়েনের দিকে। তখন সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাশের ঘরের অফিসারের পিয়োনের সঙ্গে উইম্বলডন-এর টেনিসের গ্রান্ড-স্ল্যাম নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা করছিল। তপেনবাবু ভাবছিলেন, দেশে আসল সোশ্যালিজম এনেছে এই টিভি-ই। মহারাজা আর মোমফুলিওয়ালা, পোলো, গল্ক, আর ডাংগুলি সব বরাবর হয়ে গেছে।

দেখতে দেখতে প্রায় আধ ঘন্টার বেশি সময় কেটে গেল। চারটে বাজতে চলল। পেনসান। তুলতেই আজ দেরি হয়ে গেছিল। তারপর লুঙ্গি কিনতে গেছিলেন গ্র্যান্ট স্ট্রিটে। লুঙ্গিগুলো সব ছিঁড়ে গেছে। তাঁর স্ত্রী কামিনী চলে যাবার পরে এসব তাঁর নিজেরই দেখতে হয়। বড়ো শখ ছিল কামিনীর, নিজস্ব একটি ছোট্ট বাড়ি হবে। ছোটো হলেও নিজের মনমতো রান্নাঘর, ঠাকুরঘর। আরও অনেক অন্য অতৃপ্ত শখের সঙ্গে সেই স্বপ্ন নিয়েই মাত্র তেপ্পান্ন বছর বয়সে সেরিব্রেল অ্যাটাকে চলে গেছেন কামিনী। এখন মনে হয় যে, গিয়ে বেঁচে গেছেন! এই পৃথিবীতে, এই শহরে, মানুষের পক্ষে ক্রমশই মানুষের মতো বেঁচে থাকাটা প্রায় অসম্ভবই হয়ে যাচ্ছে। মানুষের। চেহারার প্রাণীতে গিসগিস করে পৃথিবী। কিন্তু মানুষ নেই। মানুষ দেখাই যায় না আজকাল।

তপেনবাবু ঠিক করলেন, এবার উঠেই পড়বেন। এরপর ট্রামে-বাসে-মিনিতে ভিড় বেড়ে যাবে। ড্যালহাউসিতে গিয়ে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে মিনির জন্যে। কী করবেন ভাবতে ভাবতে একসময়ে সত্যিই উঠে পড়লেন তপেনবাবু। শ্যামল সেনগুপ্তর কাছে তাঁর তো চাইবার কিছুই ছিল না। এসেছিলেন নেহাতই ভালোবেসে দেখা করার জন্যেই। শ্যামল প্রায় কুড়ি বছর দিল্লি বম্বেতে ছিল। এখানে ফিরেছে সেই খবর পেয়েই তপেনবাবু দেখা করতে এসেছিলেন। এমন অভ্যর্থনা পাবেন জানলে, হয়তো আসতেন না। দিল্লি-বোম্বেতে গিয়েই কি মানুষটা বদলে গেল?

উঠে দাঁড়ালেন উনি। পিয়োনটি দেখল, কিন্তু কিছুই বলল না বরং খুশিই হল কারণ সাদামাটা পোশাক এবং ছেঁড়া জুতো পরা ঘর্মাক্ত তপেনবাবু চলে গেলে তারও পরে যেসব মানুষ এসেছেন তাদের সাহেবের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া সহজ হবে ওর পক্ষে। কিছু রোজগারও হবে দিনশেষে। থাকলে, সাহেব হয়তো এই বুড়োকেই আগে ডাকতেন।

উনি চলে যেতে যাবেন এমন সময়ে শ্যামলের ঘর থেকে হাসতে হাসতে বেরুল বৃদ্ধিচাঁদ আগরওয়াল। তাকে দেখেই চমকে উঠলেন তপেনবাবু। এই ধুরন্ধর লোকটা একবার নিজের অ্যাসেসমেন্ট রেকর্ডটা অফিস থেকে চুরি করাবার চেষ্টা করে তপেনবাবু চাকরি প্রায় খেয়ে দিয়েছিল। তখন উনি ইউ ডি সি। নম্বরি চোর লোকটা। সে করতে পারে না এমন কাজই নেই।

অনেক হাকিমকে মেয়েছেলেও সাপ্লাই করে। এমন ব্যবসাদারেই এখন ছেয়ে গেছে দেশ, হয়তো এমনই হাকিমেও। এঁরা নিজেরাই নিজেদের উকিল। তখন যত বড়ো ব্যবসায়ী ছিল এখন আরও অনেকই বড়ো হয়েছে। ধুতি আর শার্ট পরত, এখন সুট পরেছে, ঝিনচ্যাক টাই।

তপেনবাবুকে দেখে চিনতে পেরে একটু বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে বৃদ্ধিচাঁদ বলল, কেমোন আছেন স্যার? ভালো?

দাঁত কিড়মিড় করতে করতে তপেনবাবু অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ভালো।

ভালো থাকবেন কী করে স্যার? বুদ্ধি যে আপনার চিরদিনই কম ছিল।

তপেনবাবু তার কথার উত্তর না দিয়ে ঝট করে নস্যির কৌটোটো বের করে আর এক টিপনস্যি নিলেন।

ঘরের কলিংবেল বাজল। তপেনবাবু ঠিক করতে পারলেন না, শ্যামলের ঘরে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না!

পিয়োন ঘরে গেল। তারপরে বাইরে এসে বলল, আপনি যান শর্মাসাহেব।

অপেক্ষমানদের মধ্যে একটি ছাতার কাপড়ের মতো কাপড়ের কালো সাফারি-স্যুট পরা ছোকরা উকিল ঢুকে গেল।

তপেনবাবু থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

পিয়োন বলল, আপনাকে কি সাহেব সত্যিই চেনেন?

অ্যাঁ?

অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন উনি।

একটু তুলে বললেন, হ্যাঁ। হ্যাঁ। চেনেন বই কী!

পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে বললেন, চেনেন মানে, চিনতেন। একসময়ে চিনতেন। বলেই, লিফট এর দিকে পা বাড়ালেন মাথা নীচু করে।

না। আর এখানে আসবেন না উনি। কোনোদিন না।

৩.

আপনার হিরের টুকরো ছেলে আছে।

নির্মল বলেছিল আজই, যখন ওর সঙ্গে দেখা হল।

ঠিকই বলেছিল। হিরের টুকরো অবশ্যই কিন্তু সেই হিরের ছটার ছিটেফোঁটাও আসে না তপেনবাবুর দিকে। বড়োলোকের মেয়ে বিয়ে করে প্রায় ঘরজামাই হয়ে গেছে। সল্ট লেকে। শ্বশুরের করে-দেওয়া চমৎকার লনওয়ালা বাড়িতে থাকে। মাসে এক দু-বার ফোনে খোঁজখবর নেয়।

বউমা নস্যি এবং লুঙ্গি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। অথচ তপেনবাবুর আজীবনের অভ্যেস। বউমা আর তপেনবাবুর উত্তর কলকাতার গলির ভাড়া বাড়িতে আসেনই না। তপেনবাবু নিজেই যেতেন সল্ট লেকে আগে সপ্তাহে একবার করে। রিলিজিয়াসলি। কিন্তু এখন প্রায় যানই না বলতে গেলে। বোঝেন যে, তিনি সেখানে বাঞ্ছিত নন।

তপেনবাবুর বহুদিনের পুরোনো কাজের লোক প্রহ্লাদ। তারও বয়স হয়েছে। কামিনীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবার পর থেকেই সে আছে। বলতে গেলে, আত্মীয়ের চেয়েও বেশি হয়ে গেছে। তপেনবাবুর একমাত্র সন্তানকে কোলে-পিঠে করে সেই বড়ো করেছে। হাঁপানি ছিল বলে কামিনী ভারী কাজ করতে পারতেন না। প্রহ্লাদেরও এক ছেলে। ওরা শিডিউলড কাস্ট। প্রহ্লাদের ছেলে রাম পড়াশুনা করে ভালো সরকারি চাকরি পেয়েছে। তাঁর ছেলে-বউ আর চায় না যে বৃদ্ধ প্রহ্লাদ তপেনবাবুর বাড়িতে কাজ করুক। ছেলে বলেছে, সারা জীবনই তো অনেকই কষ্ট করেছ আমার জন্যে।–ও নেই আমার। একমাত্র তুমিই আছ। আমাদের তুমিই মালিক। প্রহ্লাদের বউমাও নাকি তাই-ই বলেছে। ওরা ওড়িয়া। বউমার বাড়ি ওড়িশার অংগুলে। কটক ডিস্ট্রিক্ট-এ। বাবা, মানে প্রহ্লাদের বউমার বাবা, খুবই বড়ো ব্যবসায়ী সেখানকার। আর প্রহ্লাদের দেশ ছিল। ময়ূরভঞ্জের বেতনুটীতে।

প্রহ্লাদ এবং তার ছেলে জানকীবল্লভও প্রহ্লাদকে নিয়ে যাওয়াটা স্থগিত রেখেছে বহুদিন শুধুমাত্র তপেনবাবুরই মুখ চেয়ে। আর পারবে না। জানকীবল্লভের সরকারি ফ্ল্যাট সল্ট লেকে। সেখানেই নিয়ে যাবে প্রহ্লাদকে ছেলে জানকীবল্লভ আগামী মাসের পয়লা তারিখে। গাড়ি নিয়ে আসবে। বলেছে, সেদিন সকালেই।

এদিকে তপেনবাবুর বাড়িওয়ালা বহু বছর ধরে মুখে অনরোধ করার পরে নোটিশ দিয়েছেন।

তপেনবাবুকে। উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে জেনেছেন যে তাঁর কেস খুবই খারাপ। লড়ে কোনো লাভ নেই। তার চেয়ে দয়াপরবশ হয়ে ভদ্রলোক বাড়িওয়ালা পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন, তাই নিয়েই তপেনবাবুর খুশি থাকা উচিত। সবই বোঝেন তপেনবাবু কিন্তু করেনটা কী? অনেকই ভেবেছেন কিন্তু…

অপরেশ, তার তাসখেলার বন্ধু বলছিল, মধুপুরে একটা ওল্ড-এজ হোম হচ্ছে। বাড়ি নাকি প্রায় তৈরিই হয়ে গেছে। এক লাখ টাকা দিতে লাগবে থোক। আর মাসে মাসে আড়াইশো করে। অসুবিধের মধ্যে একটাই যে, বড়ো অসুখ হলে ওখানে ডাক্তার-বদ্যি বিরল।

তপেনবাবু সিরিয়াসলি ভাবছেন। মরে গেলেই তো বেঁচে যান। কলকাতার ডাক্তারদের হাতের গিনিপিগ হয়ে মরবার চেয়ে শান্তিতে বিনা-চিকিৎসাতে নির্জনে মরাই ভালো। ভাবছেন, অপরেশের সঙ্গে কালই দেখা করবেন। কিন্তু কলকাতা ছেড়ে যে থাকেননি কোথাওই। তা ছাড়া ছেলেটা…

যখন সূর্য, তপেনবাবুর ছেলে, ছোটো ছিল, দুপুরের টিফিনের পয়সা পর্যন্ত জুটত না তপেনবাবুর। স্ত্রী কামিনী বলতেন, ছেলেকে ভালো শিক্ষা দেওয়াটা জরুরি। আমাদের বঞ্চিত করেও এটা করা আমাদের কর্তব্য। কামিনীরই এক আই এ এস দূরসম্পর্কের মামাকে ধরে সূর্যকে লা-মার্টিনিয়ার স্কুলে ভরতি করেছিলেন কামিনী।

সেই স্কুলের যেমন মাইনে, তেমনই খরচ। কামিনী রোদে-জলে দু-বার বাস বদলে ছেলেকে স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করতেন। বড়োলোকের ছেলেরাই পড়ে ওই স্কুলে। বড়োলোকের ছেলে যে সবাই বড়োলোকের ছেলেদের কাছ থেকে, ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুল থেকে, ভালোর সঙ্গে খারাপও কম পায়নি সূর্য। নিজের ভালোটা কী করে করতে হয়, নিজের স্বার্থ কী করে নির্বিঘ্ন করতে হয় কী। করে জিততে হয়, বাইহুক অর বাইকুক তা অবশ্যই শিখেছিল কিন্তু মধ্যবিত্তের বিবেক নষ্ট হয়ে গেছিল। সেই থেকেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর ওপরে বড়ো রাগ তপেনবাবুর। ওইসব স্কুলের অধিকাংশই শিকড়হীন স্বয়ম্ভই তৈরি করে, দেখেছেন তিনি। বড়োলোক তৈরি করে, বড়ো মানুষ কমই তৈরি করে।

বাইরে বেরিয়ে দেখলেন অনেকই দেরি হয়ে গেল তাঁর। পথের আলো জ্বলে উঠেছে। দু-পাশের অফিস ও দোকানেরও। অনেকখানি হেঁটে পৌঁছোতে হবে বিবাদী বাগের মিনিবাসের টার্মিনাসে। ওখানে না গেলে বসার জায়গা পাবেন না। ডায়াবেটিসে পা-দুটো দুর্বল হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না বেশিক্ষণ। হাঁটতেও পারেন না স্বচ্ছন্দে।

চারদিকে লোক। একেবারে জনারণ্য। দশ বছর আগেও অফিসপাড়ার চেহারাটা এরকম ছিল না। পথ চলতে ধাক্কা লেগে যায় গায়ে গায়ে। মুখে রং-মাখা, উৎকট গন্ধমাখা দেহপসারিণীদের ভিড়। ফুচকা, ভেলপুরী, আলুচাটের ফিরিওয়ালা আর স্মাগলড জিনিসের অবাঙালি। ফিরিওয়ালাদের ভিড়। পুরো কলকাতা শহরটাই যেন বাঙালিদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে অন্যেরা। ফুটপাথে হাঁটাই দায়। তপেনবাবুর মনে হল, নেহাতই দায়ে না পড়লে এই শহরের পথে আজকাল আর কেউই সম্ভবত বেরোয় না। কী হেঁটে, কী গাড়িতে!

দাঁড়িয়ে পড়ে, আবারও একটিপনস্যি নিলেন উনি।

তুমুল গোলমালের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ পথ চললেন। কোথায় যাচ্ছেন বা যাবেন ঠিক করেছিলেন তা যেন ভুলে গেলেন। চারদিকে বড়োই গোলমাল।

তাঁর ছেলেবেলার গ্রামের হাটেও গোলমাল হত কিন্তু গ্রামের হাটের গোলমাল, ধুলোর গন্ধ, সর্ষের তেলের খোলের গন্ধ, গোরু-ছাগল-হাঁস-মুরগির গায়ের গন্ধর সঙ্গে শুকনো লঙ্কা, তেলে ভাজার আর তালের বড়ার গন্ধ মিশে গিয়ে একরকম ঘোর লাগত। অত গোলমালের মধ্যেও ধুলো-পা। খেটো-ধুতি আর ছিটের ভেঁড়া-শার্ট-পরা নবীন কিশোর ডাকত বাবা-আ-আ! তুমি কোথায় গেলে?

অন্য মানুষের কিশোর পুত্রর সেই বাবা ডাকে সেদিনও অবিবাহিত তপেনবাবুর বুকের মধ্যেটা মথিত হয়ে যেত। বাবা না-হয়েও তিনি বুঝতে পারতেন, বাবা হওয়ার আনন্দ ও গর্বর কথা। তখন বাবা হওয়ার কষ্টটার কথা একেবারেই জানতেন না। আশ্চর্য!

এ কী! এ কোথায় চলে এলেন উনি। কিছুই যে চিনতে পারছেন না? পথ, দু-ধারের আলো-জ্বলা দোকানপাট, নাঃ। কিছুই নয়। তিনি কোথা থেকে এলেন আর কোথায় যাবেন তাও মনে করতে পারছেন না। একেবারেই না। তিনি কে? তাঁর কী নাম, তাঁর ঠিকানাকী? না? তাও নয়। অথচ তিনি তবু চলতে লাগলেন। ঘাস-বিচালি-ঘাস। ঘাস-বিচালি-ঘাস।

কিন্তু ভারি এক শান্তি বোধ করছেন এখন। মাথাতে আর কোনো চিন্তা নেই, বুকে নেই কোনো অভিমান, অপমান। কোনো ঠিকানাতে, কোনো বিশেষ গন্তব্যতে যাওয়ার কর্তব্য নেই। সব যাওয়া-আসার, দেওয়া-নেওয়ার দায় থেকেই তাঁর ছুটি হয়ে গেছে যেন। তাঁর ওপরে দাবিও নেই কারোই কিছুমাত্রই। তাঁরও দাবি নেই কারো ওপরে। কোনো ব্যাপারেই তাড়াহুড়ো করার আর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই। কোনোরকম টেনশানই নেই তাঁর। নস্যি নেওয়ার তাগিদও আর কোনোদিনই বোধ করবেন না যেন উনি।

এমন সময় উলটোদিক থেকে আসা এক মহিলা বললেন, আরে। মৃগাঙ্কদা না আপনিই খড়গপুরের?

তপেনবাবু কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে। তাঁর কোনো নাম আদৌ ছিল কি? মৃগাঙ্কও হতে পারতেন। হয়তো মৃগাঙ্কই তাঁর আসল নাম। খুবই মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন তাঁর নিজের নামটা কী ছিল? মৃগাঙ্ক হলে বেশ হত।

কিন্তু ভদ্রমহিলা অপ্রতিভ হয়ে চলে গেলেন উলটো দিকে। ওঁর আর কোনো বিশেষ নাম নেই। তিনি আর কোনো নাম্বারি জীব নন আর এই পৃথিবীর জেলখানার।

উজ্জ্বল আলো-জ্বলা সামনের পানের দোকান থেকে একটি কমবয়সি ছেলে বলল, এই যে তপেনদা! কেমন আছেন?

তপেনদাটা কে? তিনি বুঝতে পারলেন না। ছেলেটিকেও চিনতে পারলেন না। কোনোদিন দেখেছেন বলেও মনে পড়ল না।

ছেলেটি পান হাতে করে দৌড়ে কাছে এসে বলল, কী হল? চিনতেই পারছেন না দেখি। আমি শেখর। পাশ করেছি ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দাদা।

কোন ডিপার্টমেন্ট? কোন পরীক্ষা? কে শেখর? কিছুই বুঝতে পারলেন না উনি। ছেলেটির উচ্ছ্বাস সাগরপারের ফেনার মতো মরে গেল। অপ্রতিভ মুখে সরে গেল সে।

ভারি শান্তি এখন। দীর্ঘদিন আগে চাকরি থেকে অবসর নেবার পর থেকে এত শান্তি আর কখনোই বোধ করেননি। অবসর যে নিয়েছেন, কোনো বিশেষ চাকরি যে করতেন, সেসব কথাও তাঁর মনে নেই আর। ভারি চমৎকার স্নিগ্ধ এক ভাব এখন তাঁর মস্তিষ্ক ঘিরে। ভারহীন, মান-অপমানহীন,। সবরকম চিন্তাভাবনাহীন এখন তিনি।

হঠাৎই তাঁর কানের কাছে কে যেন বলল, আবহমানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে।

কে বলল?

মনে পড়ছে না কিছুতেই। কে যেন বলেছিল এই পংক্তিটি কিছুক্ষণ আগে, মনে পড়ল।

কিন্তু কে?

কেন যে মনে পড়ল তাও বুঝতে পারলেন না। কিন্তু পংক্তিটি পড়ল মনে। কার লেখা কবিতা? কে জানে।

একটা ট্রাম আসছে। ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে। তার সামনের আলোটা জ্বলছে রক্তকরবীর

রাজার ঘরের বাইরের লাল আলোর মতন। কী করে এমন লাল হল! এক পা এক পা করে তপেনবাবু এগিয়ে যেতে লাগলেন তাঁর সমস্ত অতীত বয়ে নিয়ে এগিয়ে আসা সেই টং-টং করে ঘন্টা-বাজানো শ্লথগতি ট্রামটির দিকে–যেদিকে তাঁর নিয়তি তাঁর হাতে হাত রাখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে।

আবারও কার যেন উচ্চারিত সেই পংক্তিটা মাথার মধ্যে অনুরণ তুলল, আবহমানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে।

1 Comment
Collapse Comments

এই গল্পটা আগে পড়া হয়নি। ধন্যবাদ পড়ার সুযোগ করে দিলেন ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *