আর-একটু হলে – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

আর-একটু হলে – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়

ভোর ছ’টা। উদয়পুর বাসগুমটির সামনে বাবলুর চায়ের দোকান এখন জমজমাট। বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার এই সময়টা বাবলুর দোকানে চা খেয়ে, একটু আড্ডা মেরে যে-যার গাড়িতে ওঠে।

এই ভিড়টার মধ্যে আজ একজন নতুন লোক। বেঞ্চের কোনায় চুপটি করে বসে আছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে লুঙ্গি, সাতপুরনো কোঁচকানো জামা, মাথায় গামছা বাঁধা। চা করতে করতে বাবলু আড়চোখে তাকায় লোকটার দিকে, কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে। আগে কোথাও দেখেছে কি? সন্দেহ নিরসনে লোকটার উদ্দেশে বাবলু বলে ওঠে, “ও কত্তা, চায়ের সঙ্গে বিস্কুট লাগবে তো, কী বিস্কুট দেব?”

“আপনার যেমন ইচ্ছে একটা দিয়েন।” নিরুত্তাপভাবে বলল লোকটা। কথার ধরন, চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, গ্রামের লোক। কোনও কাজে এসেছে হয়তো। কিন্তু এই সাতসকালে তার কাজটা কী। গ্রামের মানুষ উদয়পুরে আসে কোর্টের কারণে। বিচারের আশায়। কোর্ট খুলবে সেই বেলা এগারোটায়। এখন থেকে বসে আছে কেন? ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে হয়।

থালার উপর মাটির ভাঁড় সাজিয়ে চা ঢালছে বাবলু। আগন্তুককে নিয়ে মাথাব্যথার কারণ, তার দোকানটা খুব সুবিধের জায়গা নয়। ইচ্ছে না থাকলেও কবে থেকে যেন দোকানটা ত্রিভঙ্গ গুন্ডার মিটিং-এর স্থল হয়ে গেছে। কোনওভাবে ব্যানারটাকে আটকাতে পারেনি বাবলু। এখন ত্রিভঙ্গদার হয়েই তাকে কাজ করতে হয়, কোনও নতুন লোক দোকানে ঘুরঘুর করছে কি না, অন্য কোনও দল দোকানে বসে কী আলোচনা করছে, পুলিশ নজর রাখছে কি না, সব খবর দিতে হয়। এককথায় যাকে বলে ইনফর্মার। কাজটা করতে খুবই গ্লানি বোধ হয়, উপায় কী? অন্যথা হলে ত্রিভঙ্গর মস্তানবাহিনী মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাবলুর ছিটেবেড়ার দোকান মাটিতে শুইয়ে দেবে

চায়ের থালা নিয়ে লোকটার সামনে যায় বাবলু। হাতে ভাঁড় তুলে দিয়ে বলে, “তা কত্তা, সক্কাল সক্কাল এখানে কী দরকারে আসা?”

“খাটতে এয়েচি। বড় রাস্তার মোড়ে বিরিজ হচ্ছেনি, কনটাকটার বাবুর সঙ্গে দেখা করব।”

লোকটার কথায় নিশ্চিন্ত হয় বাবলু। অন্য খদ্দেরের দিকে এগিয়ে যায়। একই সঙ্গে আশ্বস্ত হন শ্রমিকের বেশধারী চিত্তদারোগা। ছদ্মবেশ, অভিনয় সবটাই তার মানে নিখুঁত হয়েছে। হাত দিয়ে নিজের পিঠটাই চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করে, উত্তেজনাটা সামাল দিতে পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরান। বেঞ্চে রাখা চায়ের ভাড়টা সবে মুখে তুলতে যাবেন, চোখে পড়ে তারাচরণ গোয়েন্দাকে। দোকানের সামনেটায় এসে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে। লোকটাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না চিত্তদারোগা। অযথা পুলিশের কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। তর্ক করে। কোথাও রহস্যজনক কিছু ঘটলেই, যেচে পৌঁছে যায়। লোকটা মূলত গোরু চুরি, ছেলে বখে যাওয়া, পুকুরে ফলিডল ফেলার কেসই বেশি পায়। হয়তো সেই হতাশায় বড়সড় কেসের পাশে ঘুরঘুর করে। এই যেমন লাইব্রেরির মূর্তি উদ্ধারের পর একদিন থানায় এল তারাচরণ। অভিমানী মুখ করে বলে কিনা, “স্যার, এটা কিন্তু ভাল করলেন না। আমি উদয়পুরের পুরনো গোয়েন্দা, আমাকে আড়ালে রেখে পুরো কাজটা সারলেন। আমার রেপুটেশনের কী হাল হল বলুন তো!”

তারাচরণের কথা শুনে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন চিত্তদারোগা। কী আবদার, পুলিশ তদন্ত করবে ওর মতো একটা হাতুড়ে গোয়েন্দাকে জানিয়ে। তা ছাড়া এলাকার ‘পুরনো গোয়েন্দা’ মানে কী? পুরনো ডাক্তার শুনেছেন, অনেক দিনের পুরনো পুরোহিত, নাপিত, মিষ্টির দোকান, সাইকেল সারাইয়ের দোকান, কোনও অঞ্চলে ‘পুরনো গোয়েন্দা’ সেই প্রথম শুনেছিলেন।

তারাচরণের অভিযোগগুলোকে পাত্তা না দেওয়া সত্ত্বেও, সে কিন্তু বলতে যাচ্ছিল, “আপনার আগের বড়বাবুকে আমি কি কম হেলপ করেছি। ফোন করে একবার জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন। আপনার কপাল ভাল, উদয়পুরে এসেই একটা মস্ত কেস পেয়ে গেলেন। কাগজে নাম বেরোল, চেহারা দেখাল টিভিতে, এখন আর আমায় পুছবেন কেন!”

ওই একটা কথাই ঠিক বলেছিল তারাচরণ। চিত্তদারোগাকে এখন এলাকার সবাই চেনে। সাধারণ পোশাকে থাকলেও লোকের চোখ এড়াতে পারেন না। সেই জন্যেই আজ এই ছদ্মবেশ।

তারাচরণ চায়ের অর্ডার দিয়ে চিত্তদারোগার পাশটিতে বসল। দারোগাবাবু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সিগারেট টানতে থাকেন। খুব একটা নার্ভাস লাগছে না। ছদ্মবেশ নিয়ে সংশয় একটু আগেই তাঁর কেটে গেছে।

চিত্তদারোগার ধারণা ভুল প্রমাণ করে তারাচরণ ফিসফিস করে বলে ওঠে, “কিছু পেলেন?”

চমকে ফিরে তাকান চিত্তদারোগা। তারাচরণ সামনের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছে। অর্থাৎ সে চায় না দারোগাবাবু অন্য কারও চোখে ধরা পড়ুন। যদিও তার ঠোটে একটা মিচকে হাসি লেগে আছে।

চিত্তদারোগা চাপা স্বরে জানতে চান, “কী করে বুঝলে আমি?”

“খুব সহজ, যে ড্রেস নিয়েছেন তার সঙ্গে সিগারেট মানায় না, তাও আবার সিগারেটের ব্যান্ডটা আপনার নিজস্ব। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, হাতের ঘড়িটা খুলে আসতে পারতেন।”

অস্বীকার করার উপায় নেই, ছদ্মবেশের এগুলোই দুর্বল অংশ। আর-একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। চিত্তদারোগা পালটা প্রশ্ন করেন, “তুমি এখানে কেন?”

“আপনার যে কারণে আসা, আমারও তাই।” একই রকমভাবে চাপা স্বরে কথাটা বলে তারাচরণ।

রাগে গরগর করতে করতে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ান চিত্তদারোগা। না, এই লোকটা দেখছি পিছু ছাড়বে না। যে কেসটা নিয়ে এখন তদন্তে নেমেছেন, আশা ছিল, সলভ করবেন একাই। বিশ্বস্তসূত্রে একটা তথ্য পেয়ে ভোর ভোর বাবলুর দোকানে ঘাপটি মেরে ছিলেন। দেখা যাচ্ছে খবরটা কোনওভাবে তারাচরণও জোগাড় করেছে, তার মানে কেসটা নিষ্পত্তি হলে অর্ধেক ক্রেডিট তারাচরণের পক্ষে চলে যাবে। এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এসব ভাবতে ভাবতে দোকান ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন চিত্তদারোগা। পিছন থেকে বাবলু ডেকে ওঠে, “কী হল কত্তা, পয়সা না দিয়ে চলে যাচ্ছ যে বড়!”

অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে যান চিত্তদারোগা। বলে ফেলেন, “সরি, সরি, খেয়াল থাকে না।” ‘সরি’ কথাটা এই পোশাকে বেমানান।

সুযোগ বুঝে টিপ্পনী কাটে তারাচরণ, “ছেড়ে দাও বাবলু, গরিব মানুষ। দামটা না হয় আমিই দিয়ে দেব।”

কটমট করে তারাচরণের দিকে তাকান চিত্তদারোগা। ইচ্ছে করছিল দৌড়ে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় মারেন। কোনওক্রমে নিজেকে সামলে বাবলুকে গিয়ে পয়সা দেন। তারপর হাঁটতে থাকেন জিপের উদ্দেশে। জিপটা দাঁড় করানো আছে সেই ধানকলের কাছে, হাঁটায় মিনিট তিনেকের পথ। অপরাধীরা যাতে পুলিশের উপস্থিতি টের না পায় তার জন্যই এই ব্যবস্থা।

আজকের অভিযানটা ব্যর্থ হওয়ায় বড্ডই আক্ষেপ হচ্ছে চিত্তদারোগার। খবর একেবারে পাক্কা ছিল, একটু পরেই ত্রিভঙ্গ তার দল নিয়ে মিটিং-এ বসত বাবলুর দোকানে। ত্রিভঙ্গকে আগে কখনও দেখেননি চিত্তদারোগা। ওর স্যাঙাতগুলোকেও চেনেন না। আজ সুযোগ বুঝে চিনে রাখতেন। উপরি পাওনা হত, যদি মিটিং-এর কিছুটা শোনা যেত। সবটাই গোলমাল পাকিয়ে দিল তারাচরণ এসে। নিজের ছদ্মবেশের উপর ভরসা রাখতে পারলেন না চিত্তদারোগা। যে কেসটার তদন্তে নেমেছেন, ভীষণ জটিল এবং বাজে কেস। প্রায় মরা কেস বেঁচে ওঠার মতো। উদয়পুরে বদলি হয়ে আসার সময় লোকমুখে শুনেছিলেন খুবই নিরালা শান্ত জায়গা। চিত্তদারোগার মনে একটা আশা জেগেছিল, তাঁর এই রোগা শরীরটা হয়তো এবার জল-হাওয়ার গুণে দারোগা পদের মানানসই হবে। কিন্তু কোথায় কী, গত কেসটায় একটু নামডাক হতেই আপাত শান্ত উদয়পুরের ভিতর লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন অপরাধ তাকে যেন ডেকে নিচ্ছে। যেমন এই কেসটার কথাই ধরা যাক না, গত দিনদশেক আগে থানায় খবর এল, মদন গুঁই তালডাঙা মাঠের এক পরিত্যক্ত মাটির বাড়িতে আত্মহত্যা করেছে। লোকটা কাঠের মিস্ত্রি। রুটিনমাফিক চিত্তদারোগা দু’জন কনস্টেবল নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলেন। ধুধু মাঠের মাঝখানে একটাই বাড়ি। কোন খেয়ালে এই নির্জন প্রান্তরে বাড়িটা করেছিল মালিক কে জানে। এখন কেউ বসবাস করে না। বাড়ির সামনে ছোটখাটো জটলা। এখনও এলাকার সব লোক খবর পায়নি।

পুলিশ-জিপ পৌঁছতেই ভিড় পাতলা হল। বডি মাটির দালানের পাশে ঝুলছে। দড়িটা দালানের ছাউনির আড়কাঠে বাঁধা। তার মানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে দালান থেকে লাফিয়ে পড়েছে। খুবই সরল পদ্ধতি, নিখাদ সুইসাইড কেস। কনস্টেবল দু’জনকে বডি নামাতে বলেছিলেন চিত্তদারোগা। তখনই পাশে এসে দাঁড়ায় তারাচরণ। চাপা গলায় বলে, “স্যার, আমার কিন্তু কেসটা সুবিধের মনে হচ্ছে না।”

“কীরকম?” জানতে চেয়েছিলেন চিত্তদারোগা।

তারাচরণ বলে, “কেসটা মনে হচ্ছে সুইসাইড নয়। খুন করার পর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“এরকম ধারণার কারণ?”

উত্তরে তারাচরণ বলেছিল, “লোকটার সম্বন্ধে খোঁজ করে জানলাম, ভীষণ অলস প্রকৃতির কাঠের মিস্ত্রি। রাতদিন নেশাভাঙ করে পড়ে থাকে। বউ লোকের বাড়ি কাজ করে খাওয়ায়।”

“তো, এর সঙ্গে খুনের কী সম্পর্ক?” বিরক্তির সুরে জানতে চেয়েছিলেন চিত্তদারোগা।

তারাচরণ বলে, “বউ কাজে যায় যখন, বাড়ি ওর ফাঁকাই পড়ে থাকে। সেই লোকটা খামোকা কেন এতদূর ঠেঙিয়ে আত্মহত্যা করতে আসবে?”

“ঠিকই তো, একটা অলস লোকের পক্ষে কাজটা বেশ বেমানান।” কথাটা বিদ্রুপের স্বরে বলেছিলেন চিত্তদারোগা।

একটু দমে গেলেও, তারাচরণ মিনমিন করে বলে, “ঠাট্টা করছেন স্যার। আমার কথাটা একটু ভেবে দেখতে পারতেন। যে লোকটা নিজেই একটা দুঃখের বোঝা, যে বোঝা মাথায় নিয়ে ওর বউ পরের বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়, সেই লোকটা কোন দুঃখে সুইসাইড করবে?”

সামান্য হলেও কথাগুলোয় যুক্তি আছে। কিন্তু স্বীকার করা যাবে না। পাত্তা দেওয়া হয়ে যাবে তারাচরণকে। ঠোঁটে শ্লেষের হাসি ঝুলিয়ে চিত্তদারোগা বলেছিলেন, “এখন তো বডিটার ময়না তদন্ত হোক। তারপরেই বোঝা যাবে, লোকটাকে আগে মেরে ঝোলানো হয়েছে, নাকি নিজেই ঝুলে মরেছে। তুমি এক কাজ করো, দু’দিন পর থানায় এসে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা দেখে যেয়ো।”

বডি জিপে তোলা হয়ে গেছে। জিপ স্টার্ট নিতে যাবে, চোখে পড়ে, একটি বউ মাঠে বসে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাদছে। নেশাভাঙ করা মৃত স্বামীর জন্য জোরে কাঁদতে কুণ্ঠা হচ্ছে হয়তো। পুলিশ হলেও বুকটা মুচড়ে উঠেছিল চিত্তদারোগার।

ময়না তদন্তে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। তারাচরণ এসে দেখে গেল রিপোর্ট। ওর মুখ থেকে সন্দেহের মেঘ কাটল না। যাওয়ার সময় বলে গেল, “স্যার, আপনি যাই বলুন, আমি কিন্তু এখনও মানতে পারছি না, মদন সুইসাইড করেছে। ওর বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নিতে গিয়ে আমার তেমনটাই ধারণা হয়েছে।”

পরের দিনই তারাচরণের সন্দেহের সপক্ষে একজন থানায় হাজির। সে আর কেউ নয়, মদন গুঁইয়ের বউ লতা। শোক অনেকটা সামলে উঠেছে। মুখে-চোখে একরোখা ভাব। বলল, “বড়বাবু, আপনার সঙ্গে একটু একলা কথা বলতে চাই।”

চিত্তদারোগা ঘর থেকে অন্য কনস্টেবলদের সরিয়ে দিলেন। তারপর মদনের বউ যা বলল, তা এই রকম— নেশাভাঙ করা ছাড়া মদনের আর কোনও দোষ ছিল না। বউ-ছেলেমেয়ের উপর যথেষ্ট মায়া ছিল। নেশা না করে থাকলে একদম অন্য মানুষ। মারা যাওয়ার ক’দিন আগে মদন খুব অস্থির অবস্থায় ছিল। বারবার বউকে বলত, আমাকে মেরে ফেলা হবে। আমি ওদের অনেক খারাপ কাজের সাক্ষী হয়ে গেছি। আমাকে দিয়েও খারাপ কাজ করাতে চাইছে ওরা। আমি কিছুতেই পারব না।’

“ওরাটা কারা?” লতার কথার মাঝখানে জানতে চেয়েছিলেন চিত্তদারোগা।

লতা বলে, “বারবার জিজ্ঞেস করেও নামগুলো বার করতে পারিনি। বলত, ‘ওদের চিনলে তুমিও তো সাক্ষী হয়ে যাবে।’ আমি অবশ্য ওর কথা শুনিনি, খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কিছুদিন ধরে ত্রিভঙ্গর দলের সঙ্গে ওর খুব মাখামাখি চলছে। এখন মনে হচ্ছে ওরাই আমার স্বামীকে মেরেছে।”

চিত্তদারোগা আর দেরি করেননি। লতা থানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ত্রিভঙ্গর ব্যাপারে এন্‌কোয়ারি শুরু করেন। ইনফরমেশন যা পাওয়া গেল, লোকটা মারাত্মক অপরাধী এবং ভীষণ চতুর। তার অপকর্মের কোনও প্রমাণ সে রাখে না। আগের বড়বাবু ত্রিভঙ্গকে ধরার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। সেই বিরক্তিতেই বদলি নিয়েছেন উদয়পুর থেকে।

চিত্তদারোগা প্রথমেই ত্রিভঙ্গর সমস্ত কুকর্মের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে, কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করেন। তারপর যান ত্রিভঙ্গর বাড়ি। যথারীতি তাকে পাওয়া যায় না। বাড়ির লোকদেরই হুমকি দেন দারোগাবাবু, “ত্রিভঙ্গকে বোলো, বেশিদিন সে পুলিশের চোখে ফাকি দিয়ে থাকতে পারবে না। আমারও নাম চিত্তদারোগা, ওকে একদিন প্রমাণসহ ধরবই।”

ত্রিভঙ্গর বাবা বলেন, “আপনার মতো কত অফিসার ঘুরে গেল, আগে তো হাতেনাতে ধরুন।”

বোঝাই গিয়েছিল বাবার আন্তরিক সহযোগিতা ত্রিভঙ্গকে কুখ্যাত হতে সাহায্য করেছে।

ত্রিভঙ্গর বাবার চ্যালেঞ্জটা অ্যাকসেপ্ট করেছিলেন চিত্তদারোগা। তারপর থেকেই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য, যে করেই হোক, ত্রিভঙ্গকে অপরাধকালীন ধরতে হবে। থানায় এনে উত্তমমধ্যম দিলেই মদন গুইয়ের ব্যাপারটা স্বীকার করবে। কাজটা যে বেশ কঠিন ক্রমশই মালুম পাচ্ছেন চিত্তদারোগা। তার উপর তারাচরণের মতো ছিচকে গোয়েন্দা এসে তাঁর কাজ আরও পণ্ড করেছে। ভাবনা শেষ হতে দারোগাবাবু খেয়াল করেন জিপটাকে তো আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। গেল কোথায়? ঝট করে পিছন ফেরেন। এইরে, অন্যমনস্কভাবে জিপ ছেড়ে অনেকটাই এগিয়ে এসেছেন।

জিপের কাছে ফিরে আসতেই পাশ থেকে কে যেন ডেকে ওঠে, “স্যার, একটা কথা ছিল।”

মুখ ঘোরাতে দেখেন, ধুলো-ময়লা পোশাকে রোগাভোগা একটা লোক। বিরক্তির সুরে চিত্তদারোগা বলেন, “তোমার আবার কী কথা?”

“মদনের ব্যাপারে স্যার।”

মনে কৌতূহলচলকে উঠলেও, যথাসাধ্য নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে দারোগাবাবু বলেন, “কোন মদন?”

“মদন গুঁই স্যার। ও আমার জিগ্‌রি দোস্ত ছিল। এখন আর বলতে লজ্জা নেই, আমরা একসঙ্গেই নেশাভাঙ করতাম। এমন বাজে পাল্লায় পড়ে গেল স্যার। মিছিমিছি প্রাণটা দিতে হল। আমি এমনই হতভাগা, চোখের সামনে ওকে খুন হতে দেখেও, কিছু করতে পারলাম না।” লোকটা হঠাৎ ফোঁপাতে শুরু করল।

চিত্তদারোগা বললেন, “তুমি জানো, কীভাবে খুন করা হয়েছে?”

“জানি স্যার, কারা করেছে তাও জানি। আপনাকে সব দেখাতে পারি। আমি সেসময় একটা ঢিবির পাশে লুকিয়ে ছিলাম।”

ক্রমশই উৎসাহিত হচ্ছেন চিত্তদারোগা। উত্তেজনার পারদ উঠছে। তবু লোকটাকে একটু যাচাই করে নিতে হয়। জিজ্ঞেস করেন, “তুমি যে পুলিশকে সব কিছু বলে দিচ্ছ, ওরা জানতে পারলে তোমাকেও তো খুন করবে।”

“জানি স্যার। কিন্তু দোস্তের জন্য এটুকু আমায় করতেই হবে। মনে বড্ড অশান্তি চলছে, রোজ স্বপ্নে মদন দেখা দেয়। বলে, ‘দোষীদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা কর ভজা, তুই না আমার বন্ধু।’ দোষীরা শাস্তি পাওয়া অবধি মদন আমাকে ছাড়বে না। ঠিক করেছি, আপনাকে সব কিছু দেখিয়ে আমি উদয়পুর ছেড়ে চলে যাব।”

“ভাল কথা। এখন বলো, কখন, কোথায়, কীভাবে আমাকে সবকিছু দেখাবে?”

মদনের বন্ধু ভজা বলে, “বিকেল ঠিক পাঁচটার সময় আপনি সাদা পোশাকে ‘মহামায়া’ সিনেমা হলের সামনে দাড়াবেন। আমি রিকশা চালাই। ড্রাইভারের সিটে থাকব। আপনি কোথাও একটা যাওয়ার নাম করে উঠে পড়বেন। দেখবেন আশপাশের লোক যেন টের না পায়। ত্রিভঙ্গর চর চারদিকে ছড়ানো। এমনকী আপনার থানার অনেক পুলিশকেও ত্রিভঙ্গ হাত করে রেখেছে। কাউকে কিছু না জানিয়েই আসবেন। সঙ্গে অবশ্যই মনে করে রিভলভার নেবেন। কোনওভাবে ওরা যদি টের পায়, আচমকা অ্যাটাক করবে। তখন কাজে দেবে রিভলভারটা।”

“সে তো বুঝলাম। কিন্তু আমরা যাব কোথায়?”

চিত্তদারোগার প্রশ্নের উত্তরে লোকটা বলে, “বিকেলে আসুন না, যেতে যেতে কথা হবে।”

“ঠিক আছে, তুমি থেকো, আমি আসব।” বলে জিপে ওঠেন চিত্তদারোগা।

ঘড়ির কাঁটা ঘোড়ার মতো ছুটে বিকেল পাঁচটা বাজিয়ে দিল। চিত্তদারোগা এখন ‘মহামায়া সিনেমা হলের সামনে। ভজাকে এখনও রিকশা সমেত চোখে পড়েনি। সহকর্মীদের না জানিয়ে একলা এই অভিযানে আসতে সামান্য দ্বিধা হচ্ছিল বটে, সংশয়মুক্ত হন ভজার চেহারার কথা ভেবে। ওই রোগভোগা শরীরে সে ব্যাটা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারবে না। তা ছাড়া সঙ্গে তো গুলিভরতি রিভলভারটা রইল। মদন গুঁইয়ের কেসটা তিনি যদি একা সমাধান করতে পারেন, চতুর্দিকে নাম তো ছড়াবেই, প্রমোশনও বাঁধা। ভাবনার মাঝেই রিকশা প্যাঁ-পোঁ। মুখ তুলে দেখেন, ভজা রিকশা নিয়ে হাজির। অন্যদিকে তাকিয়ে হর্ন বাজাচ্ছে।

চিত্তদারোগা অ্যাক্টিং শুরু করেন, “ও রিকশা, ও রিকশা, কানাইপুর যাবে?”

“যাব বাবু। দশ টাকা লাগবে।”

“কেন, এত কেন? শুনেছি সাত টাকা ভাড়া।”

“রাস্তা খুব খারাপ হয়ে গেছে, গেলেই বুঝতে পারবেন।” বিরস মুখে বলে ভজা। সেও অ্যাক্টিং-এ কম যায় না।

বসতি ছাড়িয়ে ভজার রিকশা এখন তালডাঙা মাঠের দিকে চলেছে। প্যাসেঞ্জারের সিটে বসে, সামনে-পিছনে দেখে নিয়েছেন চিত্তদারোগা, না কেউ ফলো করছে না। রিকশা চালাতে চালাতে ভজা বলে যাচ্ছে, “ত্রিভঙ্গর ভেজাল ওষুধের কারবারে মদন সবে দু’-চারদিন কাজ শুরু করেছিল। সেই ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে একটা বাচ্চা মারা যেতে, মদন কাজে যাওয়া বন্ধ করে। দু’দিন পর আমি আর মদন পালিতবাবুর বাগান পরিষ্কার করছি, ত্রিভঙ্গর চ্যালা নিতাই এসে মদনকে বলল, ‘অত ভাল কাজ ছেড়ে তুই কিনা লোকের বাড়ির বাগান পরিষ্কার করছিস। ছিঃ। শোন, বস তোকে দেখা করতে বলেছে। দুপুরবেলা তালডাঙার বাড়িতে চলে আয়। খানাপিনাও হবে।’

“তখনই আমি মদনকে বলেছিলাম, ‘ওদের সঙ্গে আর মিশিস না। বদসঙ্গ ছাড়।” শুনল না আমার কথা। খানাপিনার লোভটাই ওকে টানল। দুপুরবেলা আমিও মাঠ ধরে ওর সঙ্গে অনেকটা গেলাম। এক সময় ঢিবির আড়ালে লুকিয়ে পড়ি…” ভজার বর্ণনার মাঝে কখন যেন তালডাঙা মাঠ চলে এসেছে। মাঠের শেষ প্রান্তে লাল সূর্যের মাথাটুকু ডুবতে বাকি। মাঠময় হলুদ আলো। আকাশে পাক খাচ্ছে চিল। আর-একটু পরেই অন্ধকার নামবে।

সেই পরিত্যক্ত বাড়িটার সামনে এসে থামল রিকশা। জনমানবহীন প্রান্তর। দূরে কোথাও একটা গোরু হাম্বা হাম্বা করছে। রিকশা থেকে নেমে দু’জনেই বাড়ির মাটির দালানে এসে বসে। ভজা বলে, “সেদিন ঠিক এইখানে বসে খানাপিনা হচ্ছিল। ত্রিভঙ্গ, নিতাই কী সব বোঝাচ্ছিল মদনকে। দু’-একবার মদনের পিঠ চাপড়ে দিল। দাঁত বার করে হাসছিল মদন। এমন সময় হঠাৎ দেখি, ঘর থেকে হাতে দড়ি নিয়ে বেরোল ত্রিভঙ্গর আর-এক চ্যালা নাড়ু। ঘটনাটা ঘটছে মদনের পিছনে, ও টের পাচ্ছে না। প্রাণের ভয়ে আমিও পারছি না কিছু বলতে। নাড় দড়িটা টাঙিয়ে দিল দালানের আড়কাঠে।”

কথাটা শুনেই গায়ে কাটা দিল চিত্তদারোগার। ঝট করে মাথা তুলে আড়কাঠটা দেখে নিলেন, আজ অন্তত কিছু নেই। ভজার উদ্দেশে বললেন, “তারপর?”

কান্নাভেজা গলায় ভজা বলে, “তারপর আর কী স্যার, দড়িতে ফাঁস করাই ছিল, ধীরে ধীরে নেমে. এল সেটা। কথা বলতে বলতে ত্রিভঙ্গ ফাঁসটা ওর গলায় মালার মতো পরিয়ে দিল…” বলেই, হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করল ভজা।

চিত্তদারোগা সান্ত্বনার সুরে বলেন, “কাদিস না, মনে জোর আন। ত্রিভঙ্গকে আমি ফাটকে পুরবই। তোকে সাক্ষী হিসেবে লাগবে।”

চিত্তদারোগার কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হঠাৎ কানফাটা চিৎকার, “স্যার, মাথার উপরটা দেখুন।”

মুহূর্তের মধ্যে মাথার উপর চোখ তোলেন চিত্তদারোগা। আজও ফাঁসটা নিঃশব্দে নেমে আসছে। পকেটে হাত চলে গিয়েছিলই, রিভলভারটা বার করে, চিত হয়ে শুয়ে, দড়ি-ধরা লোকটার পায়ে গুলি করলেন। পরক্ষণেই সোজা হয়ে বসে মাঠ ধরে দৌড়ে যাওয়া ভজাকে গুলি করলেন। এটাও ভজার পায়ে লাগল।

দু’প্রান্তে দুই আততায়ী মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। চিত্তদারোগা এখনও বুঝতে পারেননি, কে তাঁকে সতর্ক করল।

আবছা অন্ধকারে হাঁফাতে হাঁফাতে সামনে এসে যে দাড়াল তাকে দেখে চিত্তদারোগা তো থ। তারাচরণ গোয়েন্দা। ঢিপ করে দারোগাবাবুকে একটা প্রণাম করে নিল। চিত্তদারোগা অবাক হন। বলেন, “তুমি আমায় প্রণাম করছ কেন? প্রাণে বাঁচানোর জন্য আমারই তো তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।”

বিগলিত কণ্ঠে তারাচরণ বলে, “সেসব ছাড়ুন স্যার, আপনার টিপ দেখে আমি তো অভিভূত। শেখাবেন স্যার, বন্দুক ছাড়া কি গোয়েন্দা মানায়! একটা রিভলভারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে কিন্তু…” কথা বলতে বলতে পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে তারাচরণ।

একটুর জন্য বেঁচে যাওয়ার আনন্দে চিত্তদারোগার গলা আবেগে বুজে আসছে, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে তারাচরণকে। নিজেকে সামলে চিত্তদারোগা বলেন, “সে পরে দেখা যাবে। আপাতত থানায় একটা খবর দাও তো। আমি ততক্ষণ এদের পাহারা দিই।”

আদেশ শোনামাত্র তারাচরণ উঠে দাঁড়িয়ে মাঠ ধরে ছুটতে থাকে। এখান থেকেই চেঁচাচ্ছে, “পুলিশ, পুলিশ।”

চিত্তদারোগা মনে মনে তারাচরণকে বলেন, “ওরে, গোয়েন্দাদের ওরকম ‘পুলিশ, পুলিশ” বলে চিল্লোতে নেই, একদম মানায় না।”

মে ২০০৪

অলংকরণ: অনুপ বায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *