আর্লস
আর্লসের জ্বলন্ত সূর্য অমোঘ বর্শার মতো আঘাত করল ভিনসেন্টের কপালে ঠিক দু-চোখের মাঝখানে, ধাঁধিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল তার চৈতন্য। ইস্পাতকঠিন নীল আকাশের শীর্ষে সূর্য যেন পোড়া হলুদ রঙের ঘূর্ণযান তরল পাবককুণ্ড, চোখ অন্ধ-করা তার প্রতিটি রশ্মি। প্রচণ্ড উত্তাপ আর চক্রবাল থেকে চক্রবাল জুড়ে প্রদীপ্ত আলোকবন্যার ক্ষমাহীন বিস্তার, এ যেন কোনো অপরিচিত গ্রহান্তর!
ভোর বেলা ভিনসেন্ট থার্ড ক্লাস কামরা থেকে স্টেশনে নামল। স্টেশন থেকে বাজার পর্যন্ত আঁকাবাঁকা রাস্তা, একধারে তার রোন নদীর বাঁধ, অপর ধারে নোংরা নোংরা খাবারের দোকান, হোটেল, রেস্তরাঁ। সামনে চড়াইয়ের কিনারা বেয়ে আর্লস শহর, দূর থেকে ছবির মতো দেখতে, ঝাঁঝালো রৌদ্রে ঝিমোচ্ছে।
কোথায় উঠবে সে নিয়ে ভিনসেন্টের কোনো ভাবনা নেই। বাজারে পৌঁছে সামনেই যে-হোটেলটা চোখে পড়ল, তাতে ঢুকে একখানা ঘর ভাড়া নিল। হোটেলটার নাম হোটেল দ্য লা গেয়ার। ঘরে একটা পুরোনো পেতলের খাট, চটা-ওঠা একটা জলের কুঁজো আর একটা চেয়ার। মালিক একটা রং না-করা টেবিল এনে পেতে দিল। ইজেল পাতবার জায়গা নেই, কিন্তু ভিনসেন্টের আপত্তি নেই তাতে। সে তো সারাদিন বাইরে বাইরেই থাকবে।
খাটের ওপর সুটকেসটা ছুড়ে ফেলে সে শহর দেখতে বার হল। বাজার থেকে শহরের মাঝামাঝি পৌঁছোবার দুটো রাস্তা। একটা রাস্তা চওড়া, গাড়িঘোড়া চলে, চড়াইটার কিনার দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে শহরে গিয়ে পৌঁছেছে। আর-একটা আছে আঁকাবাঁকা শর্টকাট পায়ে-চলার পাথুরে পথ। দ্বিতীয় পথটাই ভিনসেন্ট বেছে নিল। চড়াইটা খুব কঠিন, পথও মাঝে মাঝে খুব সরু, দু-ধারে প্রাচীন সব পাথরের ঘরবাড়ি, সেই রোমক যুগ থেকেই তারা যেন এমনি খাড়া হয়ে আছে। সূর্যের প্রখর আলোর হাত থেকে বাঁচবার জন্যে দু-ধারের বাড়ির মাঝের গলিপথগুলো যতদূর সম্ভব সংকীর্ণ, ঝড়ের হাত এড়াবার জন্যে গলিগুলো গোলকধাঁধার মতো যতটা সম্ভব আঁকাবাঁকা। পথের ধারে ধারে নোংরা আবর্জনা। প্রতি দোরগোড়ায় শিশুর জটলা। সব জড়িয়ে’ কেমন একটা শুকনো বীভৎস রূপ।
ভিনসেন্ট শহরের প্রধান রাস্তায় এসে পৌঁছোল, তারপর শহরের পেছন দিয়ে পাথুরে টিলা টপকে টপকে একেবারে পৌঁছোল পাহাড়টার চুড়োয়। গভীর একটা খাদের ধারে কালো একটা পাথরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে এবার পাইপটা ধরাল।
সামনের পাহাড়ের ঢালু বেয়ে রোন নদীর তীর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে আর্লস শহর। বিভিন্ন রাস্তার বিচিত্র জ্যামিতিক প্যাটার্ন আর ছোটো বড়ো বাড়ির সারি। অধিকাংশ বাড়িরই লাল মাটির ছাদ, তবে রৌদ্রে জ্বলে জ্বলে কোনোটার রং বাদামি, কোনোটার পোড়া ইটের মতো, কোনোটার আবার ধূসর অঙ্গার।
রোন নদী বেগবতী। শহরের গা ঘেঁষে পাহাড়ের কিনার ঘিরে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়ে নদী চলে গেছে ভূমধ্যসাগরের দিকে। বাঁকের দু-ধারে পাথরের বাঁধ।
অপর তীরে ট্রিংকোয়েতেল শহর ঠিক যেন পর্টের মতো আঁকা সীমান্তের গায়ে। পেছন ফিরে দেখলে শুধু পাহাড়ের পর পাহাড়, সামনে দু-ধারে যতদূর চাও শস্যক্ষেত্র আর বাগান আর দিগন্তে মেশা উদ্ভিদতরঙ্গ।
এই মাঠ বন আর দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে উঠল ভিনসেন্টের। আকাশ নীল, এমনি প্রচণ্ড নিষ্ঠুর ভরসাহারা নীল যে, তাকে নীল বলেই মনে হয় না, মনে হয় ও-রঙের যেন কোনো নাম নেই। শস্যক্ষেত্রের এই সবুজ যেন এতদিনের পরিচিত স্নিগ্ধ শান্ত সবুজ নয়, এ-সবুজ আকাশের আলোকে সুরার মতো পান করে চিরমাতাল হয়ে রয়েছে। আকাশের সূর্যটা ঠিক যেন কমলা-হলুদ বিশাল একটা পিণ্ড…. দগদগে লাল নিষ্ফলা পোড়া মাটি, আকাশের কোন কোণে নিঃসঙ্গ একটি মেঘের অবর্ণনীয় শুভ্রতা……. অবিশ্বাস্য এইসব বর্ণবাহার। কোথায় ছিল এইসব রং, উলঙ্গ যারা নির্লজ্জতায়, আদিমতায় যারা আপোশহীন নিষ্ঠুর! লাল আর কমলা-হলুদ, নীল আর সবুজ—সমস্ত প্রকৃতিতে ওরা যেন জুড়ে বসেছে বিজয়ী সেনানীর মতো, প্যালেটে ওদের কুড়িয়ে আনা কি মানুষের সাধ্য!
বড়ো রাস্তা ধরে ভিনসেন্ট এবার ফিরে চলল। হোটেলে ফিরেই ইজেল, ক্যানভাস আর রং-তুলি নিয়ে আবার বার হল, হাঁটতে শুরু করল রোন নদীর তীর ধরে। বাদাম গাছে ফুল ধরেছে, নাকে তার তিক্ত-মধুর গন্ধ, জ্বলন্ত সূর্যরশ্মি চোখে এসে বিধছে। টুপিটা আনতে মনে ছিল না, তেতে পুড়ে আরও লাল হয়ে উঠল মাথার চুল। প্যারিসের নাগরিক জীবনে সঞ্চিত যা-কিছু ক্লান্তি আর হতাশা আর সহজ তৃপ্তির আলস্যবিলাস—সব যেন তার দেহ মন থেকে শুষে নিল সূর্যজ্বলা আকাশের জলন্ত দাহ।
কিছু দূর যাবার পর সামনে চোখে পড়ল সরু একটি পুল, ওপর দিয়ে চলেছে ছোটো একটি ঠেলাগাড়ি, নীল আকাশের পটে ছবির মতো যেন আঁকা। নদীর জলও তো নীল, দুই কিনারের হলুদ রঙের ওপর গাঢ় সবুজ তৃণক্ষেত্র। একলা একটি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কয়েকটি ধোপানি মেয়ে কাপড় কাচছে, মাথায় তাদের নানা বিচিত্র রঙের টুপি।
মাথার ওপর ইজেলটা পেতে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস টেনে ভিনসেন্ট চোখ দুটো বন্ধ করল। এমনি বর্ণাঢ্যতা উপলব্ধির গভীরে গিয়ে আঘাত করে, খালি চোখ
মেলে তাকে ধরা যায় না। অন্তর থেকে তার খসে খসে পড়তে লাগল অনেক আবর্জনা অনেক জঞ্জাল—বৈজ্ঞানিক পয়েন্টিলিজম নিয়ে সিউরাতের জ্ঞানগর্ভ যুক্তি, আদিমতার সপক্ষে গগাঁর যত বক্তৃতা, রূপের পেছনে রূপের সারাৎসার নিয়ে সেজানের তর্ক আর লোত্রেকের ঘৃণাবাদের ঘোষণা। ঘুচল এতদিনের সবকিছু অকিঞ্চিৎকর সংগ্রহ।
পড়ে রইল শুধু ভিনসেন্ট ভ্যান গক।
সারাদিন পরে সান্ধ্যভোজের সময় সে হোটেলে ফিরে এল। সারাদিন কেটেছে বিচিত্র অনুভূতির আলোড়নে, ভুলেই গেছে ক্ষুধার কথা। ছোট্ট একটা টেবিল টেনে বসে একটা আবসাঁত অর্ডার দিল। পাশের একটি লোক দেখল তার হাতে মুখে জামায় রং। আলাপ করল তার সঙ্গে।
পরিচয় দিয়ে বললে–আমি প্যারিসের একজন সাংবাদিক, তিন মাসের জন্যে এখানে এসেছি আমার রচনার কিছু মালমশলা সংগ্রহ করতে।
ভিনসেন্ট বললে—আমি এসেছি মাত্র আজ সকালে।
লেখক বললে—দেখেই তা মনে হল। অনেকদিন থাকবেন নাকি?
সেইরকমই তো ইচ্ছে।
লেখক বললে—ওটি করবেন না। আমার উপদেশ নিন, বেশি দিন এখানে কাটাবেন না। আর্লসের মতো এমনি পাগল-করা জায়গা দুনিয়ায় আর দুটি নেই।
আপনার এ-ধারণা হল কেমন করে? ভিনসেন্ট শুধোল।
ধারণা নয়, আমি জানি। এখানকার লোকদের আমি গত তিন মাস ধরে দেখছি। সবাই কিছু-না-কিছু পাগল। ওদের চোখগুলো দেখলেই ধরতে পারবেন। অস্বাভাবিক, অর্ধোন্মাদ দৃষ্টি।
আশ্চর্য তো!
সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বুঝতে পারবেন আমার কথা সত্যি কি না। সারা প্রভেন্সে এই আর্লসের মতো এমনি মার খাওয়া জায়গা দুটি নেই। মারছে সূর্য, মারছে ঝড়। রোদটা কেমন বলুন তো? যেন দাউদাউ করে জ্বলছে চারিদিক। এই রোদ বুকের মধ্যেটা জ্বালিয়ে দেয়, পুড়িয়ে খাক করে ফেলে মাথার মধ্যেটা। তারপর ঝড় তো এখনও দেখেননি। বছরের মধ্যে দু-মাসের বেশি উন্মাদ ঝড় এখানে বয়। তখন রাস্তায় যদি বার হন, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে বাড়ির দেয়ালে, মাঠে যদি থাকেন, ধাক্কায় ধাক্কায় শুইয়ে ফেলবে মাটির ওপর। বাতাসের দমকে সারা শরীরটা যেন ভেঙে ভেঙে পড়বে, ফাকা হয়ে যাবে বুকের ভেতরটা, বাইরে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইবে পেটের নাড়িভুঁড়ি। অসহ্য হয়ে উঠবে প্রত্যেকটা মুহূর্ত! আমি দেখেছি সে-বড় কেমন। সে ঝড়ে দরজা জানলা ভাঙে, গাছ ওড়ে, মানুষ পশু মাটিতে ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি দেয়। সবে তিন মাস এখানে থেকেছি, এরই মধ্যে আমিও যেন আধপাগলা হয়ে গেছি। আর নয়।
তাহলে?
কালই আমি পালাচ্ছি।
কিছু মনে করবেন না, বাড়িয়ে বলছেন না তো? এখানকার লোকজনদের যেটুকু দেখলাম সেরকম কিছু তো মনে হল না!
ওই ‘যেটুকু’ দেখেছেন বলেই। দেখেছেন আর কতটুকু? ভেতরে ভেতরে ভয়ানক একটা ব্যাপার চলেছে মশাই, শুনতে চান?
বাঃ, নিশ্চয়ই! আসুন আমার টেবিলে, একটা আবসাত খান।
শুনুন তাহলে। মৃগীরোগ জানেন তো? সমস্ত আর্লস শহরটা এই মৃগীরোগে ভুগছে। নার্ভাস উত্তেজনার চরমে এসে পৌঁছেছে, সময় এল বলে, যখন দাঁতে দাঁত বাধিয়ে হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করবে আর গাঁজলা গাঁজলা ফেনা বার হবে মুখ দিয়ে।
কিন্তু কখন আসবে সে-সময়?
আসে না, কখনও আসে না, সেইটেই আশ্চর্য। ভাঙনের ঠিক মুখের ওপর এরা বসে থাকে। কতবার আমার মনে হয়েছে এইবার পাগল হল সবাই, বাধল খুনোখুনি, টুটি টিপে ধরল এ ওর। ঠিক সেই মুখেই হঠাৎ হয়তো আকাশে একটু মেঘ দেখা দেয়, নাহয় ঝড়টা কমে। পাগলামির ঢেউটা আর আছড়ে পড়ে না, সরে যায় কিছু দিনের মতো।
যাক, মৃগীরোগের উপসর্গগুলো তাহলে শেষপর্যন্ত ফুটে ওঠে না বলুন! না, তা নয়। তবে রোগটা ঘুমিয়ে থাকে, ঝেঁকে ঝেঁকে ওঠে, আবার ঘুমিয়ে পড়ে। বিপদটা তাতেও কম নয়। এ সম্বন্ধে একটা জার্মান ডাক্তারি পত্রিকায় একটা রিপোর্ট আমি পড়েছি। তাতে কী বলেছে জানেন?
বলুন তো!
শত শত রোগীর ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে একরকম স্নায়বিক ব্যাধি আছে, যাকে ঠিক মৃগী না বললেও অর্ধমৃগী বলা যেতে পারে। রোগটা আসলে মৃগী কিন্তু উপসর্গ কখনও মূর্ছায় গিয়ে পৌঁছোয় না। স্নায়বিক উত্তেজনা বাড়ে আবার কমে, কিন্তু যখন বাড়ে আবার আগের চেয়ে বেশি বাড়ে। এমনি বেড়েই চলে, ঢেউ যেমন ফিরে যায় আর বারে বারে এগিয়ে আসে। এমনি চলে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত। বছর ছত্রিশ বয়সে প্রথমে প্রচণ্ড একটা ফিট দেখা যায়। তারপর বছর দুয়েকের মধ্যে আর দু-চার বার। তারপরই সব শেষ। হয় উম্মাদ অবস্থা নাহয় মৃত্যু।
কী বলেন! ছত্রিশ? এত অল্প বয়সে সব শেষ! এই বয়সেই যে! আত্মপ্রতিষ্ঠার সবে শুরু!
লেখক বললে—আপনি এ-হোটেলে আর কিছু দিন আছেন তো? এ-বিষয়ে আমি একটা প্রবন্ধ লিখছি। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, প্যারিস থেকে আপনাকে পাঠিয়ে দেব এক কপি। আমার কী ধারণা জানেন? সারা আর্লসের নাড়ি এমনি প্রচ্ছন্ন’ মৃগীর ধমকে খেপে খেপে চলছে। একদিন আসবে যে-দিন আগ্নেয়গিরি ফাটবে। সে-দিন আর রক্ষা নেই। তার জন্যেই তো তাড়াতাড়ি সরে পড়ছি। আপনাকেও বলছি, খুব বেশি দিন থাকবেন না।
২
প্রত্যেক দিন অতি প্রত্যুষে অন্ধকার থাকতে ঘুম থেকে উঠে জামাকাপড় পরে বার হয়ে যায় ভিনসেন্ট। ছবি আঁকার মনের মতো জায়গার সন্ধানে নদীর কিনার ধরে হাঁটে মাইলের পর মাইল। প্রতিদিন রাত্রে সে ফিরে আসে হাতে একটি করে সম্পূর্ণ ছবি নিয়ে। তারপর কোনো রকমে খেয়ে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে
সে যেন আর মানুষ নয়, অন্ধ একটা আঁকবার যন্ত্র মাত্র। রং চড়িয়ে চলেছে ক্যানভাসের পর ক্যানভাসে, কী যে আঁকছে তা-ই বোধ হয় জানে না। সারা দেশ জুড়ে যত বাগান আছে সব এখন ফুলন্ত। সবকটা পুষ্পগুচ্ছ সে কি এঁকে শেষ করতে পারবে না? আর সে ছবি আঁকার কথা ভাবে না, শুধু অশ্রান্ত নিরবচ্ছিন্ন এঁকেই যায়। গত আট বছরের পরীক্ষার ফল সে পাচ্ছে, এতদিনের সাধনা এবার ছবির পর ছবিতে বিজয়োচ্ছ্বাসে উদ্ঘাটিত হয়ে চলেছে। সকালে যে-ক্যানভাসটা ইজেলে সাজায়, কোনো কোনো দিন দুপুরের মধ্যেই সেটা শেষ হয়ে যায়। শহরে ফিরে এক কাপ চা গলায় ঢেলে আবার নতুন ক্যানভাস নিয়ে সে বার হয় প্রান্তরে।
এত যে আঁকছে, ছবি ভালো কি খারাপ হচ্ছে খেয়াল নেই তার। রঙের নেশায় সে মাতাল।
কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না, সেও কথা বলে না কারও সঙ্গে। ছবি আঁকার পর যেটুকু শক্তি থাকে সেটুকু লাগে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করতে। সপ্তাহে অন্তত তিনটে দিন দুর্দান্ত ঝড় বয়। মাটিতে খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে ইজেলকে বেঁধে রাখতে হয়। তবু খাড়া রাখা যায় না, উলটে পড়ে ইজেল, উড়ে যায় ক্যানভাস, হারিয়ে যায় রং তুলি। বাতাসের দমকার সঙ্গে সারাদিন যুদ্ধ করে সন্ধ্যা বেলা যখন ফেরে, শরীরের অবস্থা এমন হয়, কে যেন তার সর্বাঙ্গে ঠেঙিয়েছে।
বহুকাল ধরে টুপি মাথায় দেওয়ার অভ্যাস নেই ভিনসেন্টের। আর্লসের নৃশংস সূর্য ক্রমে ক্রমে মাথার চাঁদির চুলগুলো পুড়িয়ে দেয়। রাত্রি বেলা যখন হোটেলের বিছানায় এসে লুটিয়ে পড়ে, মনে হয় মাথার মধ্যে যেন অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। জ্বলে গেছে দৃষ্টিশক্তিও, শস্যক্ষেত্রের সবুজ আর আকাশের নীলের পার্থক্য চোখ দিয়ে সে ধরতে পারে না, তবে ঘরে ফিরে যখন নিজের আঁকা ক্যানভাস দেখে, ঠিক বুঝতে পারে ওতে প্রকৃতির নির্ভুল প্রতিচ্ছবি উজ্জ্বল, ভাস্বর হয়ে ফুটেছে।
.
একদিন সে একটি লাইলাক বাগানের ছবি আঁকল। ছবিতে লাল একটি বেড়া, গোলাপি রঙের দুটি পিচ গাছ, পেছনে জ্বলজ্বলে নীল আকাশ। ভারি পছন্দ হল কাজটা, নিজের মনে বললে—এত ভালো ল্যান্ডস্কেপ আর কখনও আঁকিনি।
হোটেলে ফিরে একটা চিঠি পেল। জানল যে হেগ-এ আন্টন মভ মারা গেছেন। পিচ গাছের এই ছবিটির তলায় লিখল–মভের স্মরণে—ভিনসেন্ট আর থিয়ো। ছবিটা পাঠিয়ে দিল হেগ-এ মভের স্ত্রীর কাছে।
পরদিন পথে বার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখে পড়ল কুল গাছের একটি বাগান। গাছগুলোর শাখায় শাখায় সবে কুঁড়ি ফুটতে শুরু করেছে। আঁকতে বসল ভিনসেন্ট। একটু পরেই বিশ্রী ঝড় উঠল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঝড়ের দাপট বারে বারে আসে আর ফিরে যায়। যখন বাতাস চুপ থাকে তখন সূর্যের আলোয় গাছের মাথায় মাথায় সারা পুষ্পস্তবকের রাশি জ্বলজ্বল করে জ্বলে। ভিনসেন্ট আঁকে আর ভাবে, এই কখন বাতাসের হুড়োহুড়ি ধাক্কায় ইজেলসুদ্ধ সব কাজ ধুলোয় গড়াগড়ি যায় বুঝি! মনে পড়ে শেভেনিনজেনের দিনগুলির কথা, যখন সে সমুদ্রের ধারে বসে আঁকত আর সমুদ্রের শীকররাশি ধুয়ে দিত তার ছবিকে, উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইত বালুকাঝড়। পুষ্পমঞ্জরির সাদা রং অনেক ছড়াল এই ক্যানভাসটাতে, সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্বর্ণহলুদ আর নীল আকাশরং। ছবিটা শেষ হবার পর হঠাৎ সে নিদারুণ আশ্চর্য হয়ে দেখল, ছবিটার মধ্যে অজানিতভাবে—নতুন একটা জিনিসকে সে স্থান দিয়েছে—সে হচ্ছে ঝড়।
ঝড় মথিত করেছে সমস্ত দৃশ্যপটকে। এই ঝড়ের রূপ আশ্চর্য অভিনবত্বে ছবির মধ্যে প্রকটিত।
নিজের মনে হেসে উঠল ভিনসেন্ট—লোকে ভাববে, আমি যখন এটা আঁকি নিশ্চয়ই তখন নেশা করেছিলাম।
থিয়োর গতকালকার চিঠির একটা লাইন মনে এল। মিনহার টারস্টিগ প্যারিসে বেড়াতে এসেছিলেন, থিয়ো তাঁকে ছবি দেখিয়ে বেড়াচ্ছিল। সিসলের একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে টারস্টিগ বলেছিলেন—আমি না ভেবে পারছিনে, যে-আর্টিস্ট ছবিটা এঁকেছে সে নিশ্চয়ই আঁকবার সময় কিছুটা নেশার ঘোরে ছিল।
ভিনসেন্ট ভাবল—টারস্টিগ যদি আমার আর্লসে আঁকা ছবি দেখতেন তাহলে নিশ্চয় ভাবতেন এ শুধু নেশা নয়, একেবারে প্রচণ্ড প্রলাপের অবস্থার ফল।
আর্লসের লোকজন ভিনসেন্টকে অনেক দূরে রেখে চলে। তারা দেখে লোকটা ভোর বেলা সূর্য ওঠার আগে শহর ছেড়ে দ্রুত পদক্ষেপে বার হয়ে চলে যায়; মাথায় টুপি নেই, পিঠে ভারী ইজেলের বোঝা, চোখে উত্তপ্ত উত্তেজনা। আর দেখে, দিনের শেষে ফিরছে লোকটা আপনমনে বকতে বকতে আর বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গি করতে করতে। সারাদিনের রৌদ্রভোগের পর কোটরে ঢোকা চোখ দুটো লাল ভাঁটার মতো, মাথার চুলবিহীন চাঁদিটা কাঁচা মাংসের মতো দগদগে লাল, বগলের তলায় ভিজে ক্যানভাস। শহরের লোক তার একটা ডাকনাম দিল। কথায় কথায় চালু হয়ে গেল নামটা সকলের মুখে মুখে—লাল-চুলো পাগল বা লাল পাগল। ভিনসেন্ট ভাবে, সত্যিই আমি লাল-চুলো পাগল, ওদের কাছে। বলে বলুক, বয়েই গেল।
হোটেলের মালিক ভিনসেন্টের শেষ ফ্র্যাঙ্কটি পর্যন্ত ঠকিয়ে নেয়। আর্লসে সবাই বাড়িতে খায়। হোটেলে খাওয়ার রেওয়াজ নেই। সত্যিকারের খাওয়াই জোটে না এই হোটেলে। রেস্তরাঁগুলোতেও খাবার খুবই খারাপ, দামও তেমনি চড়া।
ভিনসেন্ট হোটেলওয়ালিকে খাবারের জন্যে তাগাদা না করে পারে না। সে বলে—কয়েকটা আলু রান্না করা কি খুব শক্ত, মাদাম?
শক্ত? একেবারে অসম্ভব।
তাহলে একমুঠো চাল?
সে তো কাল হবে।
অন্তত ময়দার দুটো চাপাটি?
কী যে বলেন! ময়দা তো একেবারে বাড়ন্ত।
খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে চিন্তা করা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াল। যা জোটে তা-ই কোনো রকমে গলাধঃকরণ করা ছাড়া গতি নেই। জঠরে কান্না জমলেও অন্তর কিন্তু ভরে উঠছে সূর্যনেশায়। খাদ্যের অভাব মেটে তামাকে আর মদে। সারাদিন প্রচণ্ড উত্তাপে আর ঝড়ের তাণ্ডবে ইজেলের ওপর ঝুঁকে থেকে ঝিমিয়ে পড়ে স্নায়ুমণ্ডলী। তখন আবার ক্লান্ত স্নায়ুকে কশাঘাতের জন্যে দরকার হয় ঝাঁঝালো সুরার।
গ্রীষ্মের তেজ বাড়তে লাগল, সমস্ত প্রকৃতি জ্বলে পুড়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। যে-দিকে তাকাও রং শুধু ব্রোঞ্জের, ঝলসানো তামার, কোথাও-বা পুরোনো সোনার হাঁপ ধরা গরমে আকাশের নীলে পর্যন্ত কেমন যেন সবুজের আভাস লেগেছে। তামাটে রঙের ওপর সূর্যের আলো পড়ে ঠিকরে যায়, রং হয়ে যায় হলুদ। এই মাথা ঝিমঝিম করা নেশা ধরানো হলুদ তার প্যালেটের প্রধান রং হয়ে ওঠে, ছড়িয়ে যায় ক্যানভাসে। হলদে রংটা অচল, রেনেসাঁর পর থেকে ইয়োরোপীয় শিল্পে এই রংটা একেবারে অপাঙ্ক্তেয়, কিন্তু তাতে সে ভয় পায় না। টিউবের পর টিউব হলহলে হলদে রং গড়িয়ে গড়িয়ে সোজা এসে পড়ে তার ক্যানভাসে, আটকে আটকে যায়। হলদে ছাড়া রং কই? সূর্য যে তাকে মেরেছে! সূর্যের প্রচণ্ড কিরণে উদ্ভাসিত, বিদগ্ধ, জ্বলন্ত তার প্রতিটি ছবি। সেইসঙ্গে প্রতিটি ছবি জুড়ে উন্মত্ত বায়ুতরঙ্গের আলোড়ন।
সে জানে সার্থক একটি চিত্রসৃষ্টি দুর্লভ ভাগ্য, পরশপাথর খুঁজে পাওয়ার মতো। সে জানে পাগলের মতো প্রতিদিন যা সে এঁকে চলেছে মূল্য তার নিতান্ত নগণ্য। তবু ছবি আঁকতেই হবে। ছবি যদি না আঁকে, অন্তরকন্দরে চিত্রদীপকে যদি অনির্বাণ জ্বালিয়ে না রাখে, তাহলে তো মৃত্যু! ব্যক্তিগত জীবন বলতে তার কিছু নেই। সে যেন একটা কোন অদৃশ্য শক্তিতাড়িত অন্ধ অচেতন যন্ত্র, দিনে দিনে রঙিন ক্যানভাস বানিয়ে যাওয়া যার নিত্য-নির্দিষ্ট কাজ।
কিন্তু কেন? কী হবে এতে? বিক্রি হবে? পাগল! কোনো মোহ নেই আর। জানে ভিনসেন্ট, তার ছবি কেউ কিনবে না। তবে কেন এত ত্বরা, কেন এই অপরিসীম আত্মনিগ্রহ! কী হবে হোটেলের বন্ধ ঘরের মেঝের কোণে কোণে রং বোলানো ক্যানভাসের পাহাড় জমিয়ে তুলে?
সাফল্যের বাসনা আর ভিনসেন্টের নেই। কাজ করে চলেছে কাজ করতেই হবে বলে, আর কোনো স্বপ্ন নেই কাজের পেছনে। কাজ যদি না করে তাহলে পাগল হয়ে যাবে, এইজন্যে। স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, সংসার নেই, গৃহ নেই, নেই সন্তাপহর সামান্যতম স্নেহস্পর্শ। সুখ নেই, স্বাস্থ্য নেই, ক্ষুৎপীড়িত নিরাশ্রয় ভিক্ষুক জীবন। ভরসা নেই, নেই ঈশ্বরবিশ্বাস। আছে শুধু উন্মত্ত একটা প্রেরণা, যা সবকিছুর চাইতে বড়ো, আপন সত্তার চেয়েও, সৃষ্টির উদ্দাম উন্মাদনা।
৩
ভিনসেন্ট মডেল জোগাড় করবার চেষ্টা করল, কিন্তু পয়সা দিয়েও কাউকে বসানো শক্ত। আর্লসবাসীদের ধারণা লোকটা কিম্ভূত ছবি-আঁকিয়ে, সে-ছবি যদি কেউ দেখে তাহলে যাদের ছবি তারা হবে ঠাট্টার পাত্র। ভিনসেন্ট জানত সে যদি বুর্গেরুর মতো মিষ্টি মিষ্টি পোর্ট্রেট আঁকত তাহলে লোকে সেধে তার কাছে আসত। মডেলের আশা সে ছেড়েই দিল, দৃশ্যপটই আঁকতে লাগল সমানে।
একদিন ভাগ্যক্রমে মাঠের মধ্যে একজোড়া মডেল তার জুটে গেল। কিশোরী একটি মেয়ে, কফির রং গায়ে, ধূসর রঙের চুল, কটা চোখ। গায়ে একটি হালকা গোলাপি রঙের প্রায়-স্বচ্ছ ব্লাউজ, যার মধ্যে থেকে সুগোল শক্ত দুটি ছোটো ছোটো স্তনের আভাস সুস্পষ্ট। সরল সজীব কৃষাণকুমারী। সঙ্গে তার মা, নোংরা নীল রঙের পোশাক-পরা বিরাট মোটা এক মধ্যবয়সী স্ত্রীলোক। অল্প কিছু পয়সার বিনিময়ে তারা কয়েক ঘণ্টার জন্যে মডেল হতে রাজি হল।
সন্ধে বেলা যথারীতি হোটেলে ফিরে এল ভিনসেন্ট। শরীর জোড়া ক্লান্তি, কিন্তু সেই কফি রঙের মেয়েটির কথা মাথার মধ্যে ঘুরছে। কতদিন হয়ে গেল একটি মেয়ের সঙ্গে সে কথা পর্যন্ত বলেনি, অবশ্য হোটেলওয়ালি বা পথের কোনো দোকানদারনি ছাড়া। ঘুম আসে না, নারীসঙ্গের কামনা রক্তকে চঞ্চল করে তোলে। হঠাৎ মনে পড়ে মার্গটের কথা, তার আলিঙ্গন, তার চুম্বন, তার কম্পিত আত্মদান।
বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট। বার হল পথে। জানে সে, শহরে কয়েকটা বাড়ি আছে যেখানে ফ্র্যাঙ্ক পাঁচেক খরচ করলেই কয়েক ঘণ্টার জন্যে মেয়েমানুষ জোটে। সাধারণত সেগুলোর খদ্দের ভাড়াটে নিগ্রো সৈনিকের পাল। তবু তার পা চলল সেই পথে।
বিষম হট্টগোল। একজোড়া নিগ্রোকে কয়েকটা মাতাল ইতালিয়ান খুন করেছে। পুলিশ এসেছে, দৌড়োচ্ছে লোকজন। ভিনসেন্টও দৌড়োল। রু রিকোলেতের ১ নম্বর বাড়িটাতে সে ঢুকে পড়ল। এ-অঞ্চলের অন্যতম গণিকাগৃহ। মালিক তাকে খাতির করে হলঘরের পাশের একটা ফাঁকা ঘরে বসাল।
বললে—কীরকম চান স্যার? একটি মেয়েকে দেখাই, ভারি খুবসুরত। একেবারে কচি, র্যাচেল নাম। অবশ্য তাকে যদি পছন্দ না হয়, অন্য মেয়েও হাজির করব।
টেবিলের ধারে হেলান দিয়ে বসে ভিনসেন্ট পাইপ ধরাল। বাইরে একটু খিলখিল হাসির শব্দ, তার পরেই একটি মেয়ে নাচতে নাচতে এসে ঘরে ঢুকল। ভিনসেন্টের সামনের চেয়ারটায় বসে মেয়েটি হাসিমুখে তার দিকে তাকাল—আমার নাম র্যাচেল।
তোমাকে পাঠিয়েছে! বিস্ময়ে ভিনসেন্ট বললে—তুমি যে বাচ্চা খুকি।
খুকি? ইঃ, বললেই হল! জানেন? আমার বয়স ষোলো!
কতদিন থেকে তুমি এখানে আছ?
পুরো একটি বছর।
তা-ই নাকি? আচ্ছা, দেখি তো তোমাকে ভালো করে।
গ্যাসের হলদে আলোটা পেছন দিকে। আবছা অন্ধকারে মেয়েটির মুখ। দেয়ালের দিকে সরে গিয়ে সে উঁচু করে মুখটি তুলল।
গোলগাল সরল মুখটা, ভাষাহীন নীল চোখ, চিবুক। মাথার কালো চুলগুলি উঁচু করে বাঁধা, তাতে মুখটা আরও গোল দেখাচ্ছে। গায়ে একটা হালকা ছাপা কাপড়ের জামা, পায়ে পাতলা চটি। সুগোল বুকের বৃত্ত দুটি স্পষ্ট চোখে যেন চেয়ে আছে ভিনসেন্টের দিকে দ্বিধাহীন ইঙ্গিতে।
ভিনসেন্ট বললে—তোমাকে তো বেশ দেখতে র্যাচেল।
শিশুসুলভ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মেয়েটির শূন্য দৃষ্টি। কাছে এগিয়ে এসে ভিনসেন্টের হাত দুটি ধরল—ভালো লেগেছে আপনার? আমাকে যাদের ভালো লাগে, সেসব লোককে আমারও ভালো লাগে। নইলে কেমন যেন অসুবিধে হয়, তা-ই না?
ঠিক বলেছ। আচ্ছা আমাকে তোমার কেমন লাগছে?
খিলখিল করে হেসে উঠল র্যাচেল। বললে—আপনি তো মজার মানুষ গো, লাল পাগল!
লাল পাগল! চমকে উঠল ভিনসেন্ট, চেন তুমি তাহলে আমাকে?
বাঃ, আমি যে আপনাকে প্লেস লা মার্টিনে দেখেছি। ওইখানে তো আপনি থাকেন, তা-ই না? ভোর বেলা পিঠে মস্ত একটা বোঝা নিয়ে হনহন করে আপনি রোজ যান কোথায়? আর মাথায় টুপিই-বা দেন না কেন? রোদে মাথা পোড়ে না! চোখ দুটো তো দেখি টকটকে লাল, ব্যথা করে না?
হেসে উঠল ভিনসেন্ট মেয়েটির সোজাসুজি কথা বলার ঢঙে। বললে—তুমি ভারি মিষ্টি র্যাচেল। আমাকে ‘আপনি আপনি’ বলছ কেন? আচ্ছা, আমার নামটা যদি তোমাকে বলি, সেই নামে আমাকে ডাকবে?
কী নাম?
ভিনসেন্ট।
না, লাল পাগলই ভালো, ওই নামেই ডাকব, রাগ কোরো না। আর-একটা কিছু মদ নাও না! দেখছ না, বাড়িওয়ালা বুড়ো কেমন করে দূর থেকে তাকাচ্ছে?
সদা হাসি-হাসি মুখ মেয়েটির। খুশি হতে চায়, খুশি করতে চায়। দাঁতগুলো বেশ সমান সাজানো, যদিও খুব চকচকে নয়। ঘন নিম্নোষ্ঠটির নীচে চিবুকের ওপরের গভীর ভাঁজটি সুস্পষ্ট, সুন্দর।
ভিনসেন্ট আপত্তি করল না।
একটা বোতল নাও। তবে খুব দামি জিনিস নিয়ো না, বেশি টাকা নেই আমার কাছে।
মদ আসতে র্যাচেল বললে—চলো না, আমার ঘরে গিয়ে খাবে। অনেক ভালো লাগবে সেখানে!
বেশ তো, চলো।
পাথরের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে র্যাচেলের ছোট্ট ঘর। সরু একটি খাট, একটি চেয়ার, নীচু একটি টেবিল-আলমারি। টেবিলের ওপর আরশির দু-পাশে ছেঁড়াখোঁড়া দুটি পুতুল
র্যাচেল বললে–পুতুল দুটো বাড়ি থেকে এনেছি। এদের নিয়ে ছেলেবেলায় বাড়ি-বাড়ি খেলতাম। নাও, ধরো দেখি দু-হাতে, দেখি তোমাকে কেমন দেখায়। এই, এর নাম জ্যাকেস, আর এর নাম ক্যাথারিন। খোকা আর খুকি।
বোকার মতো হাসিমুখে দুই হাতে দুই পুতুল নিয়ে দাঁড়াল ভিনসেন্ট। এই দেখে র্যাচেলের হাসি আর থামে না। তারপর পুতুল দুটো ভিনসেন্টের হাত থেকে নিয়ে সে নামিয়ে রাখল টেবিলে। তারপর এক ঝটকায় পোশাকটা খুলে ফেলল গা থেকে। বললে—বোসো লাল পাগল। এবার আমরা বাড়ি-বাড়ি খেলব। তুমি হবে বাবা আর আমি মা, ঠিক না?
বেঁটে মোটাসোটা মেয়েটির দেহ, শক্ত বাঁধুনি। পৃথু জঘন, দৃঢ় দুটি স্তনের সূক্ষ্মাগ্র বৃত্তদ্বয়, সুগোল স্ফীত উদর, নিম্নোদরটি গভীর।
ভিনসেন্ট খাটে বসে বললে—র্যাচেল, তুমি যেমন আমাকে লাল পাগল বলে ডাকছ, আমিও তেমনি তোমার একটা ডাকনাম দেব।
হাততালি দিয়ে উঠল র্যাচেল—ভিনসেন্টের কোলে বসে পড়ে বললে, কী মজা! কী ডাকনাম, কী নামে ডাকবে?
পায়রা একটা তুমি। আমি তোমাকে ডাকব পায়রামণি বলে।
ঠোঁট ফুলোল র্যাচেল—ছাই নাম, পচা নাম। আমি বুঝি পায়রা?
ভিনসেন্ট র্যাচেলের ফুলো ফুলো গোলগাল পেটটির ওপর হাত বুলিয়ে দিল। বললে—হ্যাঁ ঠিক তোমাকে পায়রার মতো দেখতে যে! পায়রার মতো নরম নরম চোখ, আর তুলতুলে ফুলো পেটটি।
আচ্ছা বেশ। তা পায়রা হওয়া ভালো না খারাপ?
খুব ভালো। পায়রারা সুন্দর, সবাই তাদের ভালোবাসে। তুমিও তো তাই—
র্যাচেল ভিনসেন্টের গায়ে এলিয়ে পড়ে তার কানের কাছে চুমু খেয়ে কোল থেকে লাফিয়ে উঠল। মদ খাবার জন্যে দুটো বড়ো গেলাস নিয়ে এল সে। লাল টকটকে মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে সে বললে—লাল পাগল, তোমার কান দুটো কী ছোট্ট ছোট্ট, ভারি মজার দেখতে!
শেষপর্যন্ত আমার কান দুটো তোমার পছন্দ হল নাকি?
হ্যাঁ, ভারি নরম, ঠিক যেন কুকুরছানার কান। কেবল খেলা করতে ইচ্ছে করে ও-দুটো নিয়ে।
বটে! তাহলে আমার কান দুটো একদিন তোমাকে দিয়েই দেব।
আবার হাসিতে ফেটে পড়ল র্যাচেল। মুখের কাছে ধরা গ্লাসটা থেকে কয়েক ফোঁটা লাল মদ তার বাঁ-বুকের ওপর চলকিয়ে পড়ল, তারপর শীর্ণ একটি রক্তিম রেখায় দু-বুকের উপত্যকা দিয়ে গড়িয়ে স্ফীত উদরটি পার হয়ে হারিয়ে গেল ত্রিভুজের অন্ধকারে।
তুমি খুব ভালো লাল পাগল! সবাই বলে তোমার মাথাখারাপ, ওরা কেউ তোমাকে জানে না। আচ্ছা তুমি বলো তো, সত্যি তুমি পাগল? —
হেসে বললে ভিনসেন্ট—তা হবে, তবে কিনা একটু একটু। আবদারের সুরে র্যাচেল বললে এবার—আচ্ছা লাল পাগল, তুমি আমার ভালোবাসার মানুষ হবে? রোজ রাত্তিরে আসবে আমার কাছে?
রোজ পারব না, র্যাচেল।
কেন পারবে না?
অনেক কারণে, তার মধ্যে একটা ধরো এইজন্যে যে রোজ আসবার মতো টাকা আমার নেই।
ভিনসেন্টের ডান কানটা ধরে আদর করতে করতে র্যাচেল উত্তর দিল—ইঃ, ভারি তো মোটে পাঁচটা ফ্র্যাঙ্ক! না থাকে, তার বদলে তোমার একটা কান আমাকে দিয়ে দেবে বলো? আমি তাহলে রোজ তোমার কান নিয়ে খেলা করতে পারব।
কিন্তু পরে যদি পাঁচটা ফ্র্যাঙ্ক শোধ দিই, কানটা আমাকে ফেরত দেবে তো?
ও লাল পাগল, কী মজার মানুষ তুমি! কত লোক এখানে আসে, তোমার মতো লোক বেশি করে আসে না কেন!
কেন পায়রামণি? তোমার কি এখানে ভালো লাগে না?
তা লাগবে না কেন? তবে ওইসব কালো নিগ্রোগুলো, ওদের কি কেউ সইতে পারে নাকি?
মদের গ্লাসটা নামিয়ে র্যাচেল দু-হাতে শক্ত করে ভিনসেন্টের গলা জড়িয়ে ধরল। তার শক্ত বুক চেপে ধরল ভিনসেন্টের বুকে, গোল পেটটি একটু একটু ঘষতে লাগল তার শরীরে। ভিনসেন্টের মুখে মুখটি ডুবে গেল তার। নিম্নোষ্ঠটি তার কাপতে লাগল ভিনসেন্টের ক্ষুধার্ত চুম্বনে।
বলো লাল পাগল, কথা দাও আবার তুমি আসবে, ভুলে যাবে না আমাকে?
আসব, আসব পায়রামণি।
তাহলে আর দেরি নয়। এসো, এবার আমরা বাড়ি-বাড়ি খেলা শুরু করি, কেমন লাল পাগল?
৩
আধঘণ্টাটাক পরে ভিনসেন্ট নিষ্ক্রান্ত হল রাড়িটা থেকে। সারা বুকজোড়া জ্বালা-ধরা তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণা মিটল আকণ্ঠ ঠান্ডা জল পান করে।
৪
ভিনসেন্ট দেখল, শুকনো রংকে যত মসৃণভাবে গুঁড়ো করা যায়, তেলের সঙ্গে সেই রং জমে তত ভালো। তেলটা তো রং নয়, রঙের বাহক মাত্র। প্যারিসের গুঁড়ো রং চমৎকার, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রংওয়ালা গুঁড়িয়ে গুঁড়িয়ে পাউডার বানায় রঙের। ক্যানভাসের ওপরটা মসৃণ চেহারার নাই-বা হল, ভিনসেন্টের এমনকিছু তাতে এসে যায় না। থিয়োর নির্দেশমতো পিয়ের ট্যাঙ্কি তার কাছে মোটামুটি কয়েক প্রকার রঙের ডেলা পাঠিয়েছে, ভিনসেন্ট নিজেই তার হোটেলের ঘরে বসে গুঁড়িয়ে নিতে লাগল। ব্যবহার করতে শুরু করল নিজের হাতে তৈরি করা টাটকা রং, খরচও অনেক কম পড়তে লাগল এতে।
এরপর তার অসুবিধে হতে লাগল ক্যানভাস নিয়ে। সাধারণত ক্যানভাসের ওপর পাতলা করে প্লাস্টারের কোটিং লাগানো থাকে, রংকে শুষে নেবার জন্যে। কিন্তু যে মোটা রং সে চড়ায় তার ছবিতে, প্লাস্টারের অত পাতলা কোট তা টেনে উঠতে পারে না। থিয়োকে বলে সে কাঁচা ক্যানভাসের থান আনাতে শুরু করল। থান থেকে ক্যানভাস কেটে নিয়ে নিয়ে রাত্রে বসে নিজেই তাতে প্লাস্টার দিতে লাগল। রাত্রে প্লাস্টার শুকোবার পর পরদিন সেই ক্যানভাসে ছবি আঁকতে কোনো অসুবিধে নেই।
ছবির ফ্রেম সম্বন্ধে চিন্তা জর্জেস সিউরাতই প্রথম তার মাথায় ঢোকায় প্যারিসে থাকতে। আর্লস থেকে প্রথম প্রথম যখন থিয়োর কাছে ছবি পাঠাতে ভিনসেন্ট শুরু করল, তখন সে প্রতিটি ছবি কীরকম কাঠে কোন রঙের ফ্রেমে বাঁধাই করতে হবে তারও নির্দেশ দিতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের ছবির ফ্রেম নিজের চোখে না দেখে নিজের হাতে না তৈরি করে আর তৃপ্তি হয় না। দোকান থেকে লম্বা লম্বা চেরা কাঠ সে কিনে আনতে লাগল। সাইজমতো সেই কাঠ কেটে নিয়ে প্রত্যেক ছবির ফ্রেম নিজেই সে বানাতে লাগল। প্রতিটি ফ্রেম রং করতে লাগল ছবির সঙ্গে মানিয়ে।
নিজের রং নিজেই সে বানায়, ক্যানভাসেও নিজেই সে প্লাস্টার করে, নিজের ছবির ফ্রেম তৈরি করে রং করে নিজের হাতে।
মনে মনে বলে—এবার নিজের ছবিগুলো নিজেই যদি কিনতে পারতাম তাহলে আর কারও মুখের দিকে তাকাতে হতো না।
আবার ঝড়ের দিন এল। প্রকৃতিজোড়া উত্তাল তাণ্ডব। মেঘচিহ্নহীন আকাশে খরকরোজ্জ্বল সূর্য, এদিকে দুরন্ত বাতাসে তুহিনশীতল ঝাপট। ঘরে বসে বসে ভিনসেন্ট সযত্নে একটি স্টিল লাইফ আঁকল। নীল এনামেলের একটি কফি পট, নীল আর সোনালি রঙের পেয়ালা, নীল আর সাদা চৌখুপি কাটা দুধের পাত্র, লাল সবুজ আর ব্রাউন রঙের নকশা কাটা একটি জগ, তিনটি পাতিলেবু আর দুটি কমলা।
ঝড়ের দিন ফুরোবার পর ভিনসেন্ট আবার বার হল ঘর থেকে। আঁকল রোন নদীর ওপরে ট্রিংকোয়েতেলের লোহার পুলটাকে কেন্দ্র করে একটি বহির্দৃশ্য। আবসাত রঙের আকাশ আর নদীর বুক, গভীর কালচে নীল রঙের লোহার পুলটা,; কোথাও সুস্পষ্ট কমলা রং আর গভীর সবুজের ছোপ, পুলের ওপর রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়ানো ধূসর কয়েকটি মনুষ্যমূর্তি। সমস্ত দৃশ্যপট জুড়ে কেমন একটা হৃদয়বিদারক হতাশার ভাব জড়ানো।
যেমন দেখছি ঠিক তেমনটি আঁকতে হবে এ-কথা ভিনসেন্ট বিশ্বাস করে না। ইচ্ছেমতো রঙের ব্যবহার সে করে বলিষ্ঠতর অভিব্যক্তির প্রেরণায়। প্যারিসে তাকে পিসারো এই কথাটাই বলেছিল—রং শুধু প্রকৃতির প্রতিফলন নয়, রং অতিরঞ্জন করে আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনে। মোপাসাঁর রচনাতেও এই কথাটিই এক জায়গায় সে পেয়েছে—অতিশয়োক্তির অধিকার শিল্পীর আছে, কেননা শিল্পী জগতের বাস্তবতাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থাকতে পারে না, সুন্দরতর জগতের সন্ধান সে দেয়, আনে করুণতর আশ্বাসের ইশারা।
একদিন সে রৌদ্রজ্বলা শস্যক্ষেত্রে বসে সারাদিন খুব খাটল। ছবি আঁকল সে লাঙল-চষা মাঠের—ওলটপালট মাটির গাঢ় বেগুনি রঙের চাঙড়ের পর চাঙড়, নীল আর সাদা পোশাক পরা একজন কৃষাণ, চক্রবালের কাছাকাছি পাকা শস্যের আভাস, মাথার ওপর হলদে রঙের আকাশ আর হলদে রঙের সূর্য।
ভিনসেন্ট জানে, প্যারিসের সমালোচকদের মতে বড়ো তাড়াহুড়ো করে সে আঁকে। বয়ে গেল তাতে। প্রকৃতির অমোঘ আকর্ষণ যদি তাকে তাড়না করে নিয়েই চলে, কেন অনুভূতির উৎসদ্বার সে রুদ্ধ করে রাখবে? এমনি কত প্রহর যায় যখন সে আঁকে উন্মত্তের মতো, মনেই থাকে না যে সে আঁকছে, খেয়াল থাকে না কোন রঙের পর কোন রং সে চড়াচ্ছে, রেখার পর রেখার সামঞ্জস্য আসছে কেমন করে, কোন মন্ত্রবলে সম্পূর্ণ হচ্ছে ছবির পর ছবি। আবার কত নিষ্ফলা দিন হয়তো জীবনে আসবে যখন কোনো ভাবকে আঁকড়ে ধরতে পারবে না মন, কোনো প্রেরণা জাগবে না হৃদয়ে, দিনের পর দিন কাটবে কর্মহীন অচরিতার্থতায়। দেরি করবার, আস্তে আস্তে কাজ করবার সময় তাহলে তার এখন কোথায়?
.
ছবিটা শেষ করে দিনের শেষে পিঠে ইজেল বেঁধে সে যাত্রা শুরু করল শহরের দিকে। পথের সামনে আস্তে আস্তে হাঁটছিল একটি লোক আর একটি ছেলে। শীঘ্রই সে তাদের ধরে ফেলল। কাছে আসতে দেখল লোকটি ডাকপিওন রুলিন। কাফেতে অনেক বার সে রুলিনকে দেখেছে, তবে আলাপ হয়নি কোনোদিন।
কাছাকাছি এসে ভিনসেন্ট ডাকল—নমস্কার, মশিয়েঁ রুলিন।
কে? ও, শিল্পী বুঝি? নমস্কার। বিকেলে ছেলেকে নিয়ে একটু বেড়াতে বার হয়েছি।
সুন্দর দিনটা, তা-ই না?
সত্যি! এই ঝড়টা যখন বন্ধ হয়, তখনই দিন. ভালো হয়। ছবিটা আজই আঁকলেন নাকি? আমি অশিক্ষিত লোক মশিয়েঁ, আর্টের কিছুই জানিনো তবু কী আঁকলেন, দয়া করে একটু দেখাবেন?
নিশ্চয়ই, এ. তো আনন্দের কথা!
ছেলেটি এগিয়ে চলল। রুলিন নিবিষ্ট মনে ছবিটা দেখতে লাগল। ভিনসেন্ট এই অবসরে ভালো করে লক্ষ করল রুলিনকে। গায়ে তার নীল রঙের ইউনিফর্ম, মাথায় নীল টুপি। শান্ত কৌতূহলী চোখ দুটি রুলিনের, বুক পর্যন্ত নেমে আসা ঢেউ-খেলানো দাড়ি। সারা মুখে কেমন একটা সহৃদয় করুণ ভাব, ভিনসেন্টের মনে পড়ল পিয়ের ট্যাঙ্গিকে।
রুলিন বললে—আমি একেবারে মুখ্যু মানুষ, আবোল-তাবোল যদি কিছু বলে ফেলি, মনে কিছু করবেন না। আপনার ছবির এই শস্যক্ষেত্র আশ্চর্য জীবন্ত কিন্তু, ঠিক ওই খেত যেখানে বসে আপনি আঁকছিলেন, ওই সত্যিকারের খেতের মতোই জীবন্ত।
ছবিটা ভালো লাগল তাহলে আপনার?
তা বলতে পারব না। ভালো লাগল কি না বলা শক্ত। তবে এ-কথা বলব, ছবিটা যেন একেবারে এইখানে, এই বুকের মধ্যে এসে নাড়া দিল।
মো-মাজুরের প্রাচীন মঠটার কাছে এসে তারা একটু থামল। শেষসূর্যের রক্তিম ছটা মঠের চুড়োটা রাঙিয়ে দিয়েছে, আশেপাশে টিলার মাথায় মাথায় পাইন শাখার সবুজে সূর্যাস্তের সোনার মাখামাখি। দূরের বৃক্ষশ্রেণি নীলাভ ঘন সবুজ, পশ্চিম আকাশে যেমনি আরক্ত বর্ণাঢ্য, পুব আকাশে তেমনি নীলাভ ধূসরতা। ওই নীল যেন নেমেছে সাদা বালি আর সাদা পাথরের বুকে।
রুলিন চারিদিকে তাকিয়ে বললে—এও জীবন্ত, তা-ই না মশিয়েঁ?
ভিনসেন্ট বললে—হ্যাঁ, আর আমাদের জীবন যখন ফুরিয়ে যাবে, তখনও এমনি জীবন্তই থাকবে।
দুজনে পাশাপাশি আস্তে আস্তে গল্প করতে করতে এগোল। সরল রুলিনের মন, কথাবার্তায় সারল্য আর গভীরতার সমন্বয়। সংসারে তার স্ত্রী আর চারটি ছেলেমেয়ে। আয় মোটে মাসিক একশো পঁয়ত্রিশটি ফ্র্যাঙ্ক। প্রতি বৎসরে যৎসামান্য করে বেড়ে বেড়ে এতদিনে এই বেতনে এসে পৌঁছেছে।
আমার যখন বয়স কম ছিল মশিয়েঁ, রুলিন বললে—ভগবানের কথা খুব ভাবতাম। বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে ভাবনাটা কমে আসছে, তা-ই বলে অবিশ্বাসী আমি নই। আপনার আঁকা ওই শস্যের খেত, আর মো-মাজুরের এই সূর্যাস্ত, এদের মধ্যে তিনি বিরাজ করছেন। কিন্তু যখন মানুষের কথা ভাবি, মানুষের হাতে গড়া এই পৃথিবীর কথা ভাবি—
ভিনসেন্ট তাকে থামিয়ে দিয়ে বললে—আমি বুঝি রুলিন। কিন্তু মানুষের গড়া সভ্যতা দিয়ে ভগবানকে বিচার করা চলে না। এ যেন একটা ছবি, যেটা ঠিকমতো আঁকা হয়নি। কিন্তু যিনি চিত্রকর তাঁকে যদি ভালোবাসি তাহলে তাঁর এই একটা ছবি খারাপ হলেই-বা কী? নিন্দে করব না, বিশ্বাস হারাব না। হ্যাঁ, তবে মনে মনে কামনা করব বই কী, ভালো হোক, আর-একটু ভালো হোক।
রুলিন বললে—যা বলেছেন, বেশি চাইনি, একটুখানি ভালো হোক, তা-ই অনেক।
ভিনসেন্ট বললে—একটি ছবি দেখেই শিল্পীকে বিচার করলে চলবে না। তাঁর অন্য ছবিগুলোও দেখতে হবে। পৃথিবীটা ঈশ্বরের একটা তাড়াতাড়ি খারাপ করে আঁকা ছবি, শিল্পীর বদমেজাজের সৃষ্টি।
আঁকাবাঁকা গ্রাম্য পথে সন্ধ্যা নেমেছে। কালচে নীল আকাশের ঘন আস্তরণের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারছে কয়েকটি উজ্জ্বল তারা। রুলিনের সরল চোখ দুটি ভিনসেন্টের মুখে গভীর একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজল। শুধোল—আপনি বিশ্বাস করেন মশিয়েঁ, এই ইহজগতের পরেও জগৎ আছে?
জানিনে রুলিন। ছবি আঁকাকে কাজ বলে নেবার পর থেকে ওসব চিন্তা ছেড়ে দিয়েছি। তবে এটা ঠিক যে এ-জীবনটা বড়ো অসম্পূর্ণ, জীবন আর মৃত্যুর কথা ভাবলে মনে হয় যেন এই আছি আর এই নেই, কিছুই করা হয়ে উঠল না। আপনারা শিল্পী কিনা, কত কথাই যে আপনাদের মাথায় আসে!
ভিনসেন্ট এবার বললে—রুলিন, একটা উপকার আমার করবে? তোমার একটা পোর্ট্রেট আঁকব, আঁকতে দেবে?
কী বলেন আপনি! এ তো আমার মস্ত ভাগ্য! কিন্তু আমাকে যে বড়ো কুৎসিত দেখতে মশিয়েঁ, আমার ছবি আঁকবেন কেন?
কে বললে কুৎসিত? ঈশ্বর যদি সত্যি থাকেন, নিশ্চয়ই তাঁর তোমার মতো চোখ, তোমার মতো দাড়ি।
ঠাট্টা করছেন মশিয়েঁ?
ঠাট্টা নয়, সত্যি বলছি। তোমার একটা ছবি আমি আঁকতে চাই।
কাল রাত্রে তাহলে আপনি আমাদের সঙ্গে খাবেন। খুব সামান্য আমাদের খাওয়াদাওয়া, গরিব তো? তবে যদি আসেন বড়ো খুশি হব।
মাদাম রুলিন ভারি মিষ্টি স্বভাবের মহিলা। তাকে দেখে ভিনসেন্টের মাদাম ডেনিসের কথা মনে পড়ল। টেবিলের ওপর লাল-সাদা চেক কাপড়ের টেবিল–ঢাকা, আলুসেদ্ধ তরকারি, ‘ঘরে-সেঁকা রুটি আর টক মদ এক বোতল। খাওয়া শেষ হবার পর ভিনসেন্ট রুলিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মাদাম রুলিনের একটা স্কেচ করতে লাগল।
রুলিন বললে—বিপ্লবের সময় আমি, মশিয়েঁ, রিপাবলিকান ছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি লাভ আমাদের কিছুই হয়নি। শাসন আমাদের যারা করবে, তারা রাজাই হোক বা মন্ত্রীই হোক গরিবের ওপর শোষণ তাতে কমবে না। আমি ভেবেছিলাম রিপাবলিক হলে সত্যিই বুঝি সবাই সমান হবে, সমান হবে সকলের সুখ-সুবিধে।
তা হবার নয়, রুলিন।
দেখেছি তা, কিন্তু মনের প্রশ্নটা তাতে যায়নি। সারাজীবন ধরে এই কথাটা ভাবলাম, এ কেমনধারা কাণ্ড, একজন শুকিয়ে মরবে, আর-একজনের সচ্ছলতার শেষ থাকবে না? একজন রক্ত জল করবে খেটে খেটে, আর-একজন নিশ্চিন্ত আলস্যে দিন কাটাবার সুযোগ পাবে, এ কেমন করে সম্ভব? লেখাপড়া বিশেষ জানিনে, সেজন্যেই বুঝতে পারিনে হয়তো। খুব পণ্ডিত হলে বোধ হয় বুঝতে পারতাম, তাই না মশিয়েঁ?
চট করে ভিনসেন্ট তাকাল রুলিনের চোখের দিকে। না, কোনো ব্যঙ্গের আভাস নেই। তেমনি স্বচ্ছ সরল দৃষ্টি।
ভিনসেন্ট বললে—এর নাম সামাজিক অবিচার, রুলিন। পৃথিবীর নানা পণ্ডিত বড়ো বড়ো যুক্তি দিয়ে এই অবিচারকেই সুবিচার বলে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু আমিও তোমারই মতন অজ্ঞ অশিক্ষিত, রুলিন। তাই সেসব যুক্তি বুঝতেও পারিনে, মানতেও পারিনে।
৫
পর পর সাতটি দিন। প্রত্যুষ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সাত দিনে সাতটি ছবি সে আঁকলে, একটি করে রোজ। সাত দিন পরে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ল সারা শরীর মন। তুলি ধরতে পারে না হাতে, মনে পড়ে না কোন রঙের কী নাম।
এমনি সময়ে আবার শুরু হল সর্বনেশে ঝড়, ধুলোয় সাদা হয়ে উঠল গাছের পাতার রং। ঘর ছেড়ে বার হবার উপায় নেই, দিনে ষোলো ঘণ্টা করে ঘুমোতে লাগল ভিনসেন্ট।
আবার ভাগ্য খারাপ। সব পয়সা ফুরিয়ে গেল বৃহস্পতিবারের মধ্যে। সোমবার দুপুরের আগে থিয়োর কাছ থেকে টাকা আর চিঠি আসবার কথা নয়। থিয়োর দোষ নেই। আগেকার মতোই দশ দিন অন্তর অন্তর সে পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্ক করে পাঠায়। এর ওপর ছবি আঁকার সব রকমের সাজসরঞ্জাম তো আছেই। ছরিগুলোতে ফ্রেম লাগাবার আগ্রহে হিসেবের বাইরে অনেকগুলো টাকা সে খরচ করে ফেলেছে। তাই তার এই দুরবস্থা চলছে। পেটে পড়ছে শুধু শুকনো রুটি আর কফির পর কফি।
গৃহবদ্ধ ক্লান্ত শরীরে ও মনে নেমে এল পাণ্ডুর হতাশা। অর্থহীন তার জীবন, থিয়োর যে-ভালোবাসা আর নিঃস্বার্থ দান, এই নিরর্থক শিল্পীজীবন দিয়ে তার মূল্য শোধ করা যাবে না। থিয়োর যত টাকা সে খরচ করেছে, সে-টাকা নেবার অধিকার কোথায় তার ছিল? সে-টাকা সে ফিরিয়ে দেবে কোন উপায়ে? ছবির পর ছবি পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে, কী দাম তাদের? যে-মূল্য দিয়ে ওইসব ছবির আঁকিয়ে হবার আত্মপ্রসাদ সে পেয়েছে, তার এক কণাও মিলবে না ওই ছবি থেকে।
সমস্ত গ্রীষ্মকাল ধরে ঝাঁক ঝাঁক মৌসুমি পাখির মতো তার মনে ভিড় করে এসেছে কত ছবির আইডিয়া। পাগল হয়ে কাজ করেছে। দম ফেলবার সময় পায়নি, নিঃসঙ্গ মনে হয়নি একমুহূর্তের জন্যেও। এখন মাথাটা ফাঁকা, পকেট খালি, বুকজোড়া একাকিত্ব। এইসব ছবি একের পর এক সামনে ছড়ানো, ছবির জঞ্জাল সব।
মনে মনে বললে ভিনসেন্ট—যাই হোক, সাদা ক্যানভাসের চাইতে রং-লেপা ক্যানভাস ভালো, এইটুকুই হোক আমার কাজের সার্থকতা। এর বেশি অহমিকা নাই-বা থাকল। এইটুকুই থাক আত্ম-অধিকার।
এই আর্লসের উষ্ণ সূর্যের তলায় একক জীবনেই সে খুঁজে পাবে আপনার সৃষ্টিসত্তাকে। সময় নেই, জীবন বড়ো স্বপ্ন। ছবি তাকে আঁকতেই হবে, মুহূর্ত অপব্যয় না করে।
ভাবল মনে মনে—শরীর যায় যাক, শিল্পীর আঙুলগুলো আমার নরম হচ্ছে নিশ্চয়ই।
.
কী কী রং প্রয়োজন তার একটা তালিকা সে পাঠাল থিয়োর কাছে। হঠাৎ মনে হল, যেসব রং তার চাই, ডাচশিল্পে এসব রঙের একটিরও দেখা পাওয়া যাবে না। মুভ, মারিস বা উইসেনব্রাক সযত্নে এই তালিকার প্রত্যেকটি রংকে বর্জন করবে। হল্যান্ডের শিল্পরীতির সঙ্গে তার সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয়েছে এই আর্লসে এসে।
সোমবার দিন টাকা আসতে সে একটা রেস্তরাঁ জোগাড় করল যেখানে এক ফ্র্যাঙ্ক খরচ করলে বেশ একপেট ভালো খাওয়া যায়। বড়ো পছন্দ হল রেস্তরাঁটা।
দিন কয়েক সে চুপচাপ বাড়িতে বসেছিল। এবার ঠিক করল, ক-দিন রাত্রে কাজ করবে। রেস্তরাঁটির রাত্রির ছবি সে আঁকল, খদ্দেররা ডিনার খাচ্ছে, ছুটে বেড়াচ্ছে পরিচারিকার দল। আঁকল সে প্রভেন্সের বড়ো বড়ো তীক্ষ্ণোজ্জ্বল তারকাখচিত কালো-নীল উন্মুক্ত আকাশ। পথের ধারের সাইপ্রেস গাছ চাঁদের আলোয় ধরা পড়ল তার ছবিতে। কাফে দ্য ন্যুট সারারাত্রি খোলা থাকে, মাতাল আর যাযাবররা আশ্রয় নেয় দিনের শেষ থেকে দিনের শুরু পর্যন্ত যখন খুশি। এই কাফে হল তার শিল্পসৃষ্টির উপজীব্য।
এক রাত্রে সে কাফের বাইরেটা আঁকল, আর-এক রাত্রে ভেতরটা। লাল আর সবুজ এই দুটি মুখ্য রং দিয়ে সে প্রকাশ করতে চাইল মানুষের ভিন্নমুখী অন্তর্দাহকে। কাফের ভেতরটা সে আঁকল রক্তের মতো লাল আর জ্বলজ্বলে হলুদ রং দিয়ে, মাঝখানে বড়ো একটা বিলিয়ার্ড টেবিল সবুজ। চারটে কমলা রঙের বাতি, তাতে সবুজের আভা মাখানো হলদে আলো। এদিকে-ওদিকে ঘুমন্ত মানুষের মূর্তি। লাল আর সবুজ রঙের মধ্যে কোনো সমতা নেই, কোনো ছন্দ নেই। কেমন একটা বীভৎস রূপ সমস্ত ছবিটিকে জড়িয়ে, এই কাফে যেন একটা ভয়ংকর জায়গা, এখানে প্রকাশ মনুষ্যচরিত্রের ধ্বংসের চেহারা, অন্যায় আর পাপ যে-ধ্বংসের পথে মানুষকে টানে।
আর্লসের লোকেরা ভিনসেন্টের কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেল। দেখো লাল পাগলের খেয়াল! রাতে আঁকে, আর সারাদিন ঘুমোয়। ভারি মজা তো!
মাসকাবারে হোটেলওয়ালা বললে—ঘরভাড়া বাড়াতে হবে, আর যে ছোট্ট ঘরখানায় ভিনসেন্ট ছবি রাখে সেখানার জন্যেও আলাদা ভাড়া চাই। এই হোটেলটা ভিনসেন্টের অসহ্য হয়ে উঠেছে, ঘৃণিত এর মালিকের ব্যবহার। এখানকার খাওয়া খেয়ে পেটের অসুখ চলছে। পয়সাও জলের মতো নষ্ট। কিন্তু যাবে কোথায়? শীত আসছে। স্টুডিয়ো নেই, কাজই-বা করবে কেমন করে?
একদিন বুড়ো রুলিনের সঙ্গে প্লেস লা মার্টিন পার হবার সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ল হলদে একটা বাড়ি। তার গায়ে লেখা রয়েছে—বাড়ি ভাড়া। বাড়িটার মাঝখানে চওড়া একটা দেউড়ি, দু-ধারে দুটি অংশ। লোভী দৃষ্টিতে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভিনসেন্ট বললে—নাঃ, বাড়িটা যে বড্ড বড়ো! এমনি যদি একটা বাসা পেতাম নিজের থাকবার জন্যে!
রুলিন বললে—তা মশিয়েঁ, গোটা বাড়িটা ভাড়া নেবার আপনার কী দরকার? ওই ডানদিকের অংশটা আলাদা করে আপনি ভাড়া নিতে পারেন।
অ্যাঁ, তা কি সম্ভব? ক-খানা ঘর হবে ডানদিকটাতে? খুব বেশি ভাড়া পড়বে নাকি?
তিন-চারখানা ঘর হবে। আর ভাড়া হবে আপনার হোটেল ভাড়ার অন্তত অর্ধেক। কাল দুপুর বেলা খাওয়ার ছুটির সময় আপনাকে নিয়ে আসব। মালিকের সঙ্গে কতাবার্তা হবে তখন। কী বলেন?
পরদিন সকাল থেকে ভিনসেন্টের উত্তেজনার সীমা নেই। বাড়িটার সামনে পায়চারি করতে লাগল বারে বারে। ঘুরে এদিক-ওদিক থেকে বাড়িটাকে ভালো করে দেখতে লাগল কেবল। দেখল, বাড়ির ডান অংশটাই খালি, বাঁ অংশটাতে লোক বাস করছে। ডান অংশে ঢোকবার আলাদা একটা দরজাও আছে।
দুপুর বেলা রুলিনের সঙ্গে সে বাড়িটাতে ঢুকল। খালি অংশটা দিব্যি বড়ো। একতলা দোতলা মিলিয়ে চারখানা ঘর। চকচকে লাল টালির মেঝে, দেওয়ালগুলো চুনকাম করা পরিষ্কার।
বাড়ির মালিককে রুলিন আগেই খবর দিয়ে রেখেছিল, সে উপস্থিত। রুলিন আর বাড়িওয়ালা প্রভেন্সের ভাষায় কীসব কথাবার্তা বলল ভিনসেন্টের তা অবোধ্য। রুলিন তারপর ভিনসেন্টের দিকে ফিরে বললে—এ জানতে চায় ক-দিন আপনি এখানে থাকবেন।
ক-দিন? তা কী করে বলব! অনির্দিষ্টকালের জন্যে, বলে দাও।
অন্তত ছ-মাসের জন্যে নেবেন তো?
বাঃ, ছ-মাস তো নিশ্চয়ই!
বেশ। তাহলে বাড়িওয়ালা বলছে ভাড়া পড়বে মাসিক পনেরো ফ্র্যাঙ্ক। পনেরো ফ্র্যাঙ্ক? মাত্র? সারা অংশটা পাওয়া যাবে মাত্র পনেরো ফ্র্যাঙ্কে? এর তিন গুণ যে দিতে হয় হোটেলভাড়া! পকেট থেকে তাড়াতাড়ি টাকা বার করে ভিনসেন্ট বললে—এই নাও, এখুনি টাকাটা দিয়ে দাও। এ-বাড়ি আমি নিলাম। রুলিন আবার বললে—এ জিজ্ঞাসা করছে কবে থেকে আপনি আসবেন?
আজ থেকেই। এখুনি।
কী বলেন মশিয়েঁ! জিনিসপত্র কই আপনার? আগে কিছুটা গোছগাছ করে নিয়ে তবে তো আসবেন?
কিছু দরকার নেই রুলিন। একটা তোশক আর একটা চেয়ার এখুনি আমি কিনে নিচ্ছি। তা-ই যথেষ্ট। তুমি জান না, ওই হোটেলটা এই মুহূর্তে ছাড়তে পারলে আমি বাঁচি।
বাড়িওয়ালা বিদায় নিল। রুলিনও গেল তার কাজে। ভিনসেন্ট ঘুরে ঘুরে তার নিজের রাজত্বটা দেখতে লাগল ভালো করে। গতকালই পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্ক এসেছে, তার ত্রিশটা ফ্র্যাঙ্ক এখনও তার পকেটে। রাস্তায় বার হয়ে সে একটা তোশক আর একটা চেয়ার কিনে সেগুলো কাঁধে করে নিয়ে এল বাড়িতে। তোশকটা রাখল নীচের বড়ো ঘরে, এটা হবে তার শোবার ঘর। চেয়ারটা নিয়ে গেল দোতলার বড়ো ঘরটায়। এটা হবে তার স্টুডিয়ো।
হোটেলের মালিক আস্ত ঘুঘু। এটা-ওটার অজুহাতে সে হিসেবের মধ্যে অতিরিক্ত চল্লিশটি ফ্র্যাঙ্ক জুড়ে দিল। এও ভয় দেখাল যে কড়াক্রান্তিতে সব মিটিয়ে না দিলে ছবিগুলো পর্যন্ত সে আটকে রাখবে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের শরণাপন্ন হয়ে আর এই মিথ্যে হিসেবের অর্ধেকটা মিটিয়ে ভিনসেন্ট নিস্তার পেল।
বিকেল বেলা ভিনসেন্ট এক দোকানদারের কাছ থেকে ধারে জোগাড় করল একটা গ্যাসের উনুন, একটা কেরোসিনের আলো আর কয়েকটা বাসনপত্র। হাতে আর তিনটি ফ্র্যাঙ্ক। তা-ই দিয়ে সে কিনল কিছু রুটি, আলু, মাংস আর কফি। একতলার ছোটো ঘরটা হল রান্নাঘর। আশ্রয় মিলল, রইল কিছু সঞ্চিত খাদ্য। পকেট কেবল খালি।
রাত্রি বেলা একলা বাড়ির রান্নাঘরে স্টোভ জ্বেলে ভিনসেন্ট মাংসের ঝোল রান্না করল, বানাল কফি। তোশকের ওপর কাগজ পেতে তার ওপর সে খাবার নিয়ে বসল। কাঁটাচামচ নেই আগে খেয়াল ছিল না, তুলির একটা হাতল দিয়ে সে ঝোলের পাত্র থেকে মাংস আর আলু তুলে খেল। খাবারে কেমন রং-রং গন্ধা–
খাওয়া শেষ করে কেরোসিনের আলোটা হাতে নিয়ে একবার গেল দোতলায়। ফাঁকা ঘরখানা। একধারে চেয়ার, মাঝখানে ফাঁকা ইজেলটা পাতা। চাঁদের আলো এসে পড়েছে জানলা দিয়ে। জানলার বাইরে অদূরে প্লেস লা মার্টিনের বাগানের গাছপালায় অন্ধকারের জটলা।
ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই সে তাড়াতাড়ি গেল ওপরের ঘরে। জানলাগুলো সব খুলে দিল। সরে সূর্য উঠছে, সামনে বাগান আর আঁকাবাঁকা রাস্তাটির দৃশ্য চমৎকার। চমৎকার ঘরখানা সে জোগাড় করেছে। কী বড়ো ঘর, কেমন চকচকে মেঝে, কেমন ঝকঝকে নতুন চুনকাম করা দেওয়াল। চট করে কফি বানিয়ে কফির পাত্রটা হাতে নিয়ে সে পায়চারি করতে লাগল, আর ভাবতে লাগল কেমন করে স্টুডিয়োটা সে সাজাবে, কোথায় কী রাখবে, কোন দেওয়ালে টাঙাবে কী ছবি। এতদিন পরে সত্যিকারের নিজের বাড়ি হল তার। এল স্বস্তির দিন।
পরদিন বন্ধু পল গগার কাছ থেকে একখানা চিঠি এল। করুণ ভাষায় গগী তার চরম দুরবস্থার কথা জানিয়েছে। ব্রিটানির এক ছোটো শহরে একটা সরাইখানায় বন্দি হয়ে আছে গগাঁ, রুগ্ণ শরীরে, কপর্দকহীন অবস্থায়। দেনার জন্যে সরাইওয়ালা তার সবকটা ছবি আটকে রেখে দিয়েছে, অচেনা জায়গায় ভিক্ষের হাত পাতার মতোও কেউ নেই।
চিঠিটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইল ভিনসেন্ট। ভাবতে লাগল অন্য মনে। এই তো শিল্পীর জীবন! ভবঘুরে তারা, সমাজচ্যুত তারা, অসহায়, নিরন্ন, ভিক্ষুকের দল! অবহেলিত, উপহসিত তাদের ভাগ্য, দৈন্য, গ্লানি তাদের দৈনন্দিন জীবনের ভূষণ। কেন এমন হয়? কী তারা করেছে? কেন তারা একঘরে হয়ে পথের কোণে পড়ে থাকে কুকুরের মতো? এমনি প্রতিমুহূর্তের উপদ্রুত আত্মা নিয়ে কেমন করে তারা মহৎ সৃষ্টির সাধনা করবে? কেমন করে তারা স্বপ্ন দেখবে পরম সৌন্দর্যলীলার?
গগাঁ, তার প্রিয় বন্ধু, কোথায় পড়ে আছে, নিঃসহায়, নির্বান্ধব! স্বাস্থ্য নেই, অর্থ নেই, পথ্য নেই, ঔষধ নেই!
গগাঁ কি যে-সে লোক! অত বড়ো শিল্পী, অত বিরাট মানুষ, পৃথিবীতে কি দুটি মেলে? গগাঁ যদি না বাঁচে, শিল্পের তাতে অপূরণীয় ক্ষতি! এ-ক্ষতির ভাবনা দুনিয়ায় কেউ কি ভাবে না?
মনস্থির করতে একমুহূর্ত দেরি হল না। বাড়িটা তার দুজনের পক্ষে যথেষ্ট। চারখানা ঘর, প্রত্যেকের একটা করে স্টুডিয়ো আর একটা শোবার ঘর থাকবে। নিজে হাতে যদি রং তৈরি করে, রান্না করে, খরচের দিকে নজর রেখে চলে তাহলে থিয়োর দেড়শো ফ্র্যাঙ্কেই দুজনের স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। বাড়িভাড়া তো আর বেশি লাগবে না, আর একজনের খাবার খরচ আর কতটা পড়বে! বিনিময়ে সে বন্ধু পাবে, পাবে সহকর্মী, কতদিন সে কোনো শিল্পীবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেনি, তা ছাড়া গগার কাছে কত কী শিখতেও সে পারবে।
হঠাৎ তার মনে হল, কী ভয়ানক নির্বান্ধব, একলা সে! গগাঁর আঁকা একখানা করে ছবি যদি প্রতি মাসে থিয়োকে পাঠাতে পারে, তাহলে কি থিয়োর কাছ থেকে মাসে আর পঞ্চাশটা করে ফ্র্যাঙ্ক পাওয়া যাবে না? মনে তো হয় যাবে।
না, কোনো দ্বিধা নেই, গগাঁকে এখানে আনতেই হবে। এখানে আর্লসের এই প্রখর সূর্যতাপে সব রোগব্যাধি তার ঘুচবে। দুজনে মিলে তারা ছবি আঁকবে। দক্ষিণ দেশে তাদের স্টুডিয়োই হবে প্রথম। দেলাক্রোয়া আর মন্তিচেলির ট্র্যাডিশন তারা বহন করে চলবে। সূর্যের আলোয় আর জ্বলজ্বলে রঙে জ্বলন্ত হবে তাদের শিল্পসৃষ্টি, প্রকৃতির উন্মাদ বর্ণাঢ্যতায় তারা জাগিয়ে তুলবে পৃথিবীকে।
বাঁচাতেই হবে গগাঁকে।
৬
ব্যাপারটা কিন্তু অত সোজা নয়। প্রতি মাসে গগার একটা করে ছবির বিনিময়ে পঞ্চাশ ফ্র্যাঙ্ক করে বেশি পাঠাতে থিয়োর আপত্তি নেই, কিন্তু গগাঁর পুরোনো ধার মিটিয়ে রেলভাড়া দিয়ে তাকে আর্লসে পৌঁছে দেবার খরচ তার ক্ষমতার বাইরে। গগাঁর শারীরিক অবস্থাও খুব খারাপ। অতএব চিঠি লেখালেখিই শুধু চলল কিছুদিন ধরে।
হলদে বাড়িটার প্রেমে পড়ে গেছে ভিনসেন্ট। থিয়োর টাকা দিয়ে সে একটা টেবিল আর একটা আলমারি কিনল প্রথম সুযোগেই। থিয়োকে লিখল এক বছরের মধ্যে একেবারে অন্য মানুষ হয়ে যাব থিয়ো। তবে এ-কথা ভেবো না যে তখন আমি আমার এ-জায়গা ছেড়ে চলে যাব। কখনও না। আমার বাকি সারাটা জীবন আমি এই আর্লসেই কাটাব। তোমারও ছুটিতে আসবার একটা জায়গা হল। আমি আস্তে আস্তে সব ব্যবস্থা করে ফেলছি, যাতে ছুটির সময়টা আমার এখানে কাটাতে তোমার কোনো অসুবিধে না হয়।
যা পারে সব টাকা সে খরচ করতে লাগল এই বাড়িটার পেছনে। বাড়িটাকে সাজিয়েগুছিয়ে তোলাই হল তার প্রধান নেশা। কী দরকার মাংস খেয়ে? সেই টাকায় কয়েকটা সুন্দর পাত্র তো কেনা যায়। নতুন জুতো একজোড়া পরে কিনলেই চলবে, সেই পয়সায় গগাঁর জন্যে ওই সবুজ লেপটা কিনে রাখাই তো ভালো। থাক না ছবির ফ্রেমের কাঠ কেনা, তার জায়গায় কয়েকটা নীচু বেতের চেয়ার কিনলে বসবার ঘরটা সাজানো যায় না কি?
আসলে বাড়িটা তার মনে নতুন একটা প্রশান্তি এনে দিয়েছে। অস্থির যাযাবর জীবনে এনেছে স্বস্তির আস্বাদ, ভবিষ্যতের স্বপ্ন। অনেক সে ঘুরেছে সারাজীবন, আর নয়। এবার সে আর নড়বে না। স্টুডিয়ো বানাবে, যেখানে তার অবর্তমানে নতুন শিল্পী এসে বাসা বাঁধতে পারে। শিল্পীর একটা স্থায়ী আবাস সে রচনা করছে, নিজের জন্যে নয়, দক্ষিণ দেশকে ভালোবেসে যে আঁকতে চাইবে, এমনকী তার মৃত্যুরও পরে, তার জন্যে। মাথায় তার সর্বদা চিন্তা, বাড়িটাকে সাজাবে কেমন করে, কেমন করে সার্থক করে তুলবে তার এই স্টুডিয়োর প্রতিষ্ঠা।
.
সঙ্গে সঙ্গে কোমর বেঁধে কাজে লেগে গেছে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে। তার ধারণা, একটা দৃশ্যকে যদি বহুবার বহুক্ষণ ধরে দেখা যায় তাহলে সে-দৃশ্য নতুনতর অর্থ নিয়ে গভীরতর উপলব্ধিতে ধরা পড়ে। মো-মাজুরে সে পঞ্চাশ বার গেল একই দৃশ্যপটকে নিরীক্ষণ করবার জন্যে। আবার ঝড় জোর হল, বাতাসে ইজেল উলটে পড়তে চায়, মনের ভাবের সঙ্গে হাতের তুলির সাম্য থাকে না। তবু সে বারে বারে আঁকে।
রুলিন বললে এক সন্ধ্যা বেলায়—কালকের দিনটা শেষ কড়া রোদ পাবেন। তার পরের দিন থেকেই শীতের আরম্ভ।
ভিনসেন্ট জিজ্ঞাসা করলে—আর্লসে শীতকালটা কেমন?
মোটেই ভালো নয়। প্রচুর বৃষ্টি, ঝোড়োবাতাস আর কনকনে ঠান্ডা। সুখের কথা, মাস দুইয়ের বেশি শীত এখানে থাকে না।
তাহলে বলছ বাইরে বেরিয়ে ছবি আঁকার দিন কালই শেষ? ঠিক আছে। কোন বহির্দৃশ্যটা কাল আঁকব তাও চট করে আমার মাথায় এসে গেছে। কল্পনা করো দেখি রুলিন—শরতের একটি শ্যামল অরণ্য-প্রান্তরের দৃশ্য। বোতলের মতো চেহারার ঘন সবুজ একজোড়া সাইপ্রেস গাছ, তিনটি ছোটো ছোটো চেস্টনাট গাছ, সোনালি-কমলা রঙের পাতা তাদের, কয়েকটি লাল টকটকে পাতাবাহারের ঝোপ। এ ছাড়া কিছুটা বালি, কিছুটা ঘাস আর কিছুটা নীল আকাশ।
আহা মশিয়েঁ, আপনি যখন এমনি করে বর্ণনা দেন, ধিক্কার হয় মনে, ভাবি, এতদিন বুঝি অন্ধ হয়ে ছিলাম!
পরদিন ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিনসেন্ট উঠল। মনটা তার ভারি খুশি। দাড়ির গোড়াটা সে কাঁচি দিয়ে ছাঁটল, আর্লসের খর সূর্য মাথার যে-কটি চুল তখনও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খসিয়ে দেয়নি তা ভালো করে আঁচড়াল। পুরো একটা সুট গায়ে চড়াল, সঙ্গে প্যারিসে কেনা খরগোশের চামড়ার বনেটটা। আজ এবারকার মতো শেষ সূর্যের দিন। বিদায় দিতে হবে সূর্যকে আজ, তারপরে আসবে শীত আর কুয়াশা।
রুলিনের ধারণা ঠিকই হয়েছিল। হলুদ রঙের অম্লপিত্তের মতো জ্বলজ্বলে হয়ে সূর্য উঠল, ধাঁধিয়ে দিল ভিনসেন্টের চোখ। যে-শরৎদৃশ্যটি ভিনসেন্ট আঁকবে ঠিক করেছিল, তা ভিনসেন্ট্রে বাড়ি থেকে অন্তত দু-ঘণ্টার পথ, টারাসকনের রাস্তায়। একটা ছোটো পাহাড়ের পাশে জায়গাটা অবস্থিত। বাগানটার ধারে একটা সদ্য-লাঙল-দেওয়া শস্যক্ষেত্র।
ভিনসেন্ট সেখানে ইজেলটা বসাল। মাথা থেকে বনেটটা আর গা থেকে নতুন কোটটা খুলে মাটিতে ফেলল। পরিষ্কার সাদা একটা ক্যানভাস চড়াল ইজেলে। বেলা হয়নি মোটেও, এরই মধ্যে প্রখর রোদ জ্বালিয়ে দিল মাথার তালু।
খুব ভালো করে সামনের দৃশ্যটি নিরীক্ষণ করল, চিন্তা করে নিল কার কী রং লাগবে। দৃশ্যটি ভালো করে মনের পটে তুলে নেবার পর সে তুলিগুলি ভিজিয়ে নিল, রঙে টিউবগুলির মুখ খুলে পরিষ্কার করে নিল ছুরিটা, যার ওপর টিউব থেকে প্রথম রং সে ঢেলে নেয়। আবার একবার সামনের বাগানটির দিকে তাকিয়ে প্যালেটে সে কিছুটা রং মিশিয়ে নিল, তুলিটি তুলল আঙুলে।
পেছন থেকে মৃদু মধুর কণ্ঠে কে তাকে ডাকল— এখুনি তোমার আঁকা শুরু করবে, ভিনসেন্ট?
ভিনসেন্ট চমকে পেছন দিকে তাকাল।
এই তো সবে ভোর ভিনসেন্ট, সারাদিন তো রয়েছে তোমার হাতে নারী, অপরিচিতা। স্তম্ভিত বিস্ময়ে ভিনসেন্ট’ চেয়ে রইল বিস্ফারিত চোখে। পূর্ণযৌবনা তরুণী, আর্লসের রাত্রির মতো কৃষ্ণনীল তার চোখ, বিলম্বিত কেশগুচ্ছে সূর্যের সোনালি রং। তার দেহরেখা কে-র চেয়েও পেলব, অথচ প্রতিটি বঙ্কিম তটে দক্ষিণ দেশের সুপক্ক পূর্ণতা। তপ্ত কাঞ্চনের মতো গায়ের রং, হাস্যমধুর সুরক্তিম ওষ্ঠের নীচে শ্বেতকরবীর কুঁড়ির মতো তার দন্তরাজি। পরনে তার দীর্ঘ একটি সাদা গাউন, রুপোর বগলস আঁটা একটি বেল্ট কোমরে। পায়ে হালকা একজোড়া স্যান্ডাল। সাদা পোশাকের নীচে দেহের রেখাগুলি পরিস্ফুট, স্বাস্থ্যে কমনীয়তা আর প্রসন্ন রূপের প্রতিমূর্তি যেন।
আবার মধুরভাবে বললে অপরিচিতা—কতদিন তোমাকে ছেড়ে দূরে রয়েছি, তাই না?
ইজেলের ঠিক সামনে এসে সাদা ক্যানভাসটার ওপর হেলান দিয়ে সে দাঁড়াল ঠিক ভিনসেন্টের চোখের সামনে বাগানের দৃশ্যটাকে আড়াল করে। সূর্যরশ্মি আটকে গেল তার কেশজালে, মাথার পেছনে পিঠের ওপর দিয়ে যেন বয়ে গেল স্বর্ণাভ অগ্নিধারা। ভিনসেন্টের দিকে তাকিয়ে এমন সহজ স্বচ্ছ প্রাণখোলা হাসি সে হাসল যে ভিনসেন্ট দু-হাতে তার চোখ দুটোকে না কচলিয়ে পারল না। এ কি জাগরণ, না নিদ্রা? স্বপ্ন, না মতিভ্রম?
ঠিকই তো, আমারই ভুল হয়েছে। এতদিন দূরে রয়েছি, তাই তো চিনতে পারনি আমাকে।
কে তুমি?
আমি তোমার বন্ধু, ভিনসেন্ট। এ-পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু।
আমার নাম জানলে কী করে? আমি তো তোমাকে আগে কখনও দেখিনি!
না দেখনি। কিন্তু আমি তোমাকে দেখেছি, অনেকবার।
কী নাম তোমার?
মায়া।
মায়া? শুধু মায়া?
হ্যাঁ ভিনসেন্ট। তোমার কাছে এই নামটুকুই আমার যথেষ্ট।
তুমি আমাকে এই মাঠ পর্যন্ত অনুসরণ করে করে এসেছ। কিন্তু কেন?
যে-কারণে সারা ইয়োরোপে তোমার পেছনে পেছনে ফিরেছি, সেই একই কারণে। তোমার কাছাকাছি থাকব বলে।
তুমি নিশ্চয় ভুল করেছ। যে-মানুষের সন্ধানে তুমি ফিরছ, আমি সে নই।
শীতল নরম হাতটি মেয়েটি রাখল ভিনসেন্টের মাথায়, হাত বুলিয়ে দিল তার রোদে পোড়া রুক্ষ লাল চুলে। ওই শীতল করুণ স্পর্শটুকু, আর তার মৃদু করুণ কণ্ঠ, যেন কোন গভীর কূপের তৃষ্ণা-মেটানো পানীয়।
ভুল করব কেন? ভিনসেন্ট ভ্যান গক পৃথিবীতে একজনই আছে। তাকে চিনতে আমার ভুল হয়নি।
কতদিন হল তুমি আমাকে চেন?
আট বছর।
আট বছর? আট বছর আগে আমি তো ছিলাম—
আমি বলব বন্ধু? বরিনেজে।
সেই তখন থেকে তুমি আমাকে চেন?
শরতের এক অবসন্ন অপরাহ্ণে তোমাকে আমি প্রথম দেখি, মরচে-পড়া একটা লোহার চেয়ারের ওপর তুমি বসেছিলে মার্কাস খনির সামনে।
হ্যাঁ, শ্রমিকরা বাড়ি ফিরছিল, বসে বসে আমি দেখছিলাম।
ঠিক। প্রথম যখন তোমার ওপর আমার চোখ পড়ল, তুমি চুপটি করে বসেই ছিলে। আমি চলে যাচ্ছিলাম পাশ কাটিয়ে। হঠাৎ দেখি পকেট থেকে পুরোনো একটা খাম বার করে তুমি স্কেচ করতে শুরু করেছ পেনসিল দিয়ে। তোমার কাঁধের পেছন থেকে আমি উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম কী তুমি আঁকছ। সঙ্গে সঙ্গে প্রেমে পড়ে গেলাম।
প্রেমে পড়ে গেলে! কী বলছ তুমি? আমার প্রেমে?
হ্যাঁ ভিনসেন্ট, প্রিয় আমার, তোমার প্রেমে।
হবে। তখন আমাকে দেখতে এতটা খারাপ ছিল না নিশ্চয়ই।
না, এখন তোমাকে যত ভালো লাগে দেখতে, তার অর্ধেকও তখন তোমাকে লাগত না।
তোমার গলার স্বর, মায়া, কেমন যেন আশ্চর্য লাগছে। মনে হচ্ছে এ-স্বর যেন চেনা। কবে কোনদিন এমনি স্বরে অন্তত একটি মেয়ে বুঝি আমাকে ডেকেছিল।
ডেকেছিল বই কী। সে মার্গট। আমি যেমন ভালোবাসি সেও তেমনি ভালোবেসেছিল যে!
তুমি মার্গটকে চিনতে?
দু-বছর আমি ব্রাবান্টে ছিলাম তোমার কাছে-কাছেই। মাঠে যখন ছবি আঁকতে যেতে, রোজ আমি যেতাম তোমার পিছু পিছু। ঘরে বসে যখন আঁকতে, আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম জানলার ধারে। আমি দেখতাম, মার্গট তোমাকে ভালোবাসে। খুশিই হতাম তাতে।
তখন বুঝি আর তুমি আমাকে ভালোবাসতে না?
নিশ্চয় বাসতাম। প্রথম যে-দিন তোমাকে দেখেছি সে-দিন থেকে এ-ভালোবাসায় ছেদ কখনও পড়ল না।
তাহলে, মার্গটকে দেখে তোমার হিংসে হতো না?
মৃদু হাসল মেয়েটি। চোখে ফুটে উঠল অনন্ত কারুণ্যের বেদনাহত দৃষ্টি। হঠাৎ ভিনসেন্টের মেন্ডিস ডা কস্টাকে মনে পড়ে গেল।
না, হিংসে করব কেন? বললে মেয়েটি–ওর প্রেম তোমার মঙ্গলই করেছে। কিন্তু কে-কে যে তুমি ভালোবাসতে সেটা আমার ভালো লাগেনি। ওতে তুমি দুঃখই শুধু পেয়েছ।
উরসুলাকে যখন ভালোবেসেছিলাম সে-সময়টা আমাকে চিনতে?
না, সে আমার তোমাকে চেনবার অনেক আগে নিশ্চয়।
তখন চিনলে কিছুতেই আমাকে তোমার ভালো লাগত না। বোকা ছিলাম তখন।
তাতে কী এল গেল? জীবনে বোকামির পালা তো গোড়ার দিকে আসেই, নইলে পরে বুদ্ধিমান হবে কেমন করে?
কিন্তু বরিনেজে থাকতেই তুমি যদি আমাকে চিনতে, ভালোবাসতে, এতদিন দেখা দাওনি কেন?
এতদিন তুমি আমার জন্যে প্রস্তুত ছিলে না ভিনসেন্ট।
অ্যা? আর আজ?
হ্যাঁ, আজ মিলনের ক্ষণটি এসেছে।
এত বছর কেটে গেল, এখনও আমাকে ভালোবাস? এখন, এই মুহূর্তে?
হ্যাঁ ভিনসেন্ট, এখন, এই মুহূর্তে, আর অনন্তকাল পর্যন্ত।
কেমন করে তা সম্ভব? তোমার মতো মেয়ে কী করে আমাকে ভালোবাসতে পারে? দেখো, ভালো করে চেয়ে দেখো আমার দিকে। আমার মুখের মাড়িগুলো সমস্ত পচে গেছে, একটা দাঁতও আমার নিজের নয়। রোদে জলে পুড়ে খসে ঝরে গেছে মাথার চুলগুলো, চোখ দুটো যৌনরোগীর চোখের মতো টকটকে লাল। এবড়োখেবড়ো হাড় বার-করা কঙ্কালের মতো আমার মুখ। আমি জানিনে ভাবছ যে আমার মতো কুৎসিত পুরুষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই? ওলটপালট হয়ে গেছে আমার নার্ভের মধ্যে, হাড়ে একবিন্দু মজ্জা নেই, মাথা থেকে পা পর্যন্ত দূষিত আমার রক্ত। মানুষ নই, আমি একটা জীবন্ত ব্যর্থ প্রেত, আর আমার প্রেমে পড়ে আছ তুমি? পাগল!
বোসো ভিনসেন্ট, চুপটি করে বোসো তো!
ভিনসেন্ট তার টুলের ওপরে বসল। মেয়েটি বসল তার পাশে খেতের নরম মাটির ওপর।
কর কী, কর কী! অমন সুন্দর সাদা পোশাকটা যে নষ্ট হয়ে যাবে! ওঠো, আমার ছেঁড়া কোটটা পেতে দিই।
হাতের মৃদু স্পর্শে ভিনসেন্টকে নিবৃত্ত করল মায়া, বললে—কতবার তোমাকে অনুসরণ করে আমার পোশাক আমি নোংরা করেছি, কিন্তু প্রত্যেক বারই এ-পোশাক আমার আবার সাদা হয়ে গেছে।
ডান হাতের আঙুলগুলো সে রাখলে ভিনসেন্টের চিবুকের নীচে। তার মুখটা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে বললে—কে বললে তুমি কুৎসিত ভিনসেন্ট, তুমি বড়ো সুন্দর। তোমার এই সামান্য দেহটাকে তুমি কষ্ট দিয়েছ, ক্লিষ্ট করেছ, কিন্তু তোমার আত্মা তো তাতে মলিন হয়নি! উম্মত্ত পরিশ্রমে পরিশ্রমে একদা তোমার দেহ আর চলবে না, কিন্তু তোমার আত্মা এগিয়ে চলবে অব্যাহত অনির্বাণ, আর তারই সাথি হয়ে চিরন্তন চলরে আমার এই প্রেম।
ঘণ্টা খানেক হল সূর্য উঠেছে, খর হয়ে উঠল রোদ। ভিনসেন্ট বললে—চলো আমার সঙ্গে। এই রাস্তার ধারে কটা সাইপ্রেস গাছ। ওদের নীচে ছায়ায় বসে তৃপ্তি পাবে।
না, এখানেই ভালো। রোদে আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। কষ্ট হয় না।
অনেকদিন তাহলে আর্লসে আছ বলো?
তোমার সঙ্গে সঙ্গেই তো এখানে এসেছি প্যারিস থেকে।
দপ করে জ্বলে উঠল ভিনসেন্ট। উঠে দাঁড়িয়ে এক লাথিতে টুলটা সরিয়ে দিল সামনে থেকে। চেঁচিয়ে উঠল—জোচ্চুরি করবার আর জায়গা পাওনি? কার পয়সায় তুমি এসব করছ, ঠগ কোথাকার? আমার জীবনের পুরোনো খবর সব জানে এমন আমার কোনো শত্রু আমাকে বিদ্রূপ করবার জন্যে তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে। বলো, বলো কে সে?
রাগের আগুনে মেয়েটি ছুঁড়ল হাসির বাণ—ঠগ নই, মিথ্যে নই বন্ধু। সত্য আমি, তোমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো সত্য। শুধু ধমক দিয়েই কি আমার এ-ভালোবাসাকে তুমি এড়াতে পারবে?
ভালোবাসা! আবার তুমি মিথ্যে কথা বলছ? ঠাট্টা পেয়েছ আমাকে নিয়ে? ঠাট্টা তোমার ভাঙছি!
কর্কশ হাতে সে টেনে তুলল মেয়েটিকে। আপনি সে ঘনিয়ে এল তার রুক্ষ বাহুর বন্ধনে।
এখুনি যদি চলে না যাও, এমনি যদি আমাকে যন্ত্রণা দাও, আমিও তোমাকে যন্ত্রণা দেব। দেখবে?
মারো আমাকে, মারো ভিনসেন্ট। ভালোবাসার অঙ্গই তো হল দুঃখ পাওয়া।
বটে?
সজোরে বুকের কাছে জাপটে ধরল মেয়েটিকে ভিনসেন্ট। তার মুখে মুখ রেখে নিষ্ঠুর চুম্বনে নিপীড়িত করতে লাগল, তার পেলব ওষ্ঠ।
আত্মদানের সহজ আকৃতিতে মেয়েটি তার ঠোট দুটি ফাঁক করল, তার মুখের মধুর আস্বাদ গভীরভাবে পান করতে দিল ভিনসেন্টকে। তার প্রতিটি অঙ্গ মিশে যেতে চাইল ভিনসেন্টের দেহে।
এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিয়ে ভিনসেন্ট টলতে টলতে টুলটার ওপর গিয়ে বসল। মেয়েটিও ঢলে পড়ল মাটিতে, দু-হাতে তার পা জড়িয়ে তার হাঁটুর ওপর মাথা রেখে স্থির হয়ে রইল। ভিনসেন্ট আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল তার চুলে।
অস্ফুট স্বরে কেবল বললে মেয়েটি—বিশ্বাস হল এতক্ষণে?
অনেকক্ষণ পরে ভিনসেন্ট কথা বললে—আমার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি এখানে এসেছ বললে। তাহলে পায়রামণিকেও তুমি চেন?
র্যাচেল তো? ভারি মিষ্টি মেয়েটি।
ওতেও তোমার আপত্তি নেই?
শোনো ভিনসেন্ট। তুমি পুরুষ, নারীসঙ্গ তোমার চাই। এতদিন আমার সময় হয়নি, তাই তুমি এর-ওর কাছে গেছ। এবার থেকে–
এবার থেকে?
আর তার দরকার হবে না। কোনোদিন না।
কী বলছ? মানে তুমি–
হ্যাঁ ভিনসেন্ট, আমি। ভালোবাসি যে আমি তোমাকে।
বিশ্বাস করিনে, বিশ্বাস করিনে। কী করে তুমি আমাকে ভালোবাসবে? আর যা পাই, ভালোবাসা পাইনি। মেয়েরা আমাকে চিরদিন ঘৃণাই করে এসেছে।
ভালোবাসা পেলে যে তোমার চলত না ভিনসেন্ট। তোমার অন্য কাজ ছিল করবার।
কাজ? বাঃ, খুব কাজ! মূর্খ আমি! হাজার হাজার ছবি আমি এঁকেছি। কে নেবে এগুলো? কে পয়সা দিয়ে কিনবে অন্তত একখানা? প্রকৃতিকে আমি বুঝেছি, তার অধরা রূপের সামান্যতম কণাও আমি ধরতে পেরেছি আমার রং-তুলি দিয়ে, প্রশংসার এই সামান্যতম কথাটুকু কে বলবে?
সারা পৃথিবী একদিন বলবে ভিনসেন্ট, মুখরিত হবে তোমার নামে।
একদিন? কবে সে? সে তো অলীক স্বপ্ন দেখি, আবার আমি স্বাস্থ্য ফিরে পাব, পাব স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ভরা সংসার, আর এই ছবি এঁকেই পাব সচ্ছলতা। গত আট বছর ধরে আঁকছি। এ পর্যন্ত একটা ছবিও কেউ কেনেনি। তবু আঁকছি। আমার চেয়ে বড়ো মূর্খ আর কে আছে?
মূর্খ বটে, তবে হ্যাঁ, আশ্চর্য, অপরূপ মূর্খ তুমি! তুমি যে-দিন এ-মর্তে আকবে না, সে-দিন এ-মর্ত চিনবে তোমাকে, কী তুমি বলতে চেয়েছ কান পেতে স-দিন তা শুনবে, বুঝবে। আজ তোমার যেসব ছবির একশো ফ্র্যাঙ্কও দাম মেলে না, লক্ষ ফ্র্যাঙ্ক দিয়ে একদিন তা কিনতে লোকে পাগল হবে। হাসছ? ‘ভাবছ বাজে মিথা? তা নয়। আমস্টার্ডাম, হেগ, প্যারিস, ড্রেসডেন, মিউনিক, মস্কো, নিউইয়র্ক—সমস্ত বড়ো শহরের শিল্পাগারে তোমার ছবি পাবে শ্রেষ্ঠ সম্মানের আসন। অক্ষুণ্ণ হবে তোমার শিল্পসৃষ্টি, কেননা দাম দিয়ে তা কেনা যাবে না। তোমার প্রতিভা নিয়ে বই লিখবে লোকে, নাটক উপন্যাস রচিত হবে তোমার জীবনকে ঘিরে। চিত্রশিল্পকে ভালোবাসে এমনি দুটি লোক যেখানে দাঁড়াবে সেখানে নেমে আসবে তোমার নাম পবিত্র মন্ত্রের মতো
অবাক ভিনসেন্ট বললে—তোমার চুম্বনের স্বাদ এখনও যদি আমার মুখে না লেগে থাকত, তাহলে ভাবতাম হয়তো স্বপ্ন দেখছি, কিংবা পাগল হয়ে গেছি।
এসো, আমার পাশে এসে বোসো। হাত রাখো আমার হাতে।
সূর্য আকাশের শিখরে। সানুদেশ থেকে দূর পর্বতরেখা পর্যন্ত সমস্ত দিগঞ্চল জুড়ে তার স্বর্ণকিরণজাল। লাঙল-চষা মাটির ওপর মেয়েটির পাশে গা এলিয়ে দিল ভিনসেন্ট। গত ছ-মাস ধরে এক র্যাচেল আর এক রুলিন ছাড়া কারও সঙ্গে সে কথা বলেনি। সব কথা আর সব ব্যথা জমা হয়ে আছে বুকের মধ্যে। অপরিচিতা প্রণয়িনী গভীর দুটো চোখ রেখেছে তার চোখে, আস্তে আস্তে সে কথা বলতে শুরু করল।
নিজের সারা জীবনের দুঃখ-বেদনার ইতিবৃত্ত। বললে উরসুলার কথা, গুপিল গ্যালারিতে তার কেরানিজীবনের কথা। বললে কেমন সে ভালোবেসেছিল কে-কে, কোন বিবর্ণ আশায় ঘর বাঁধতে চেয়েছিল ক্রিস্টিনকে নিয়ে। শিল্পীজীবনের ধ্যানধারণা, আশা-বঞ্চনার কথাও বললে ধীরে ধীরে। কেন ড্রয়িংয়ে বিশুদ্ধতা আনতে সে চায়নি, কেন সে তার ছবির মধ্যে সুলভ সম্পূর্ণতা এড়িয়ে গেছে, কেন বৈপ্লবিক রঙের প্রতি তার আকর্ষণ। কত দুর্নাম শুনেছে, তবু শিল্পের জন্যে কী করতে চেয়েছে, কী স্বপ্ন দেখেছে! আর আজ তার এই শরীর—রুক্ষ চামড়ার তলায় জিরজিরে হাড়, কেমন করে রাজ্যের ক্লান্তি দুর্বলতা আর ব্যাধি এই শরীরে তার বাসা বেঁধেছে!
যত বলে, তত বুকের মধ্যে ফুলে ওঠে বলার ফোয়ারা। এতদিন পরে তার কথা কেউ মন দিয়ে শুনছে, টিউব নিংড়ে যেমনি রং বেরোয় তেমনি হৃদয় নিংড়ে উজাড় করে ঢেলে দিতে পারছে তার আত্মপরিচয়ের নিরুদ্ধ ভাষা।
স্তব্ধ হয়ে শুনছে পার্শ্ববর্তিনী নারী, চোখের দিকে তাকিয়ে যেন নীরবে বলছে সে—বলো বলো, সব কথা বলো তোমার, ঢেকে রেখো না আমার কাছে। বুঝতে চাই, জানতে চাই তোমাকে, অনুভব করতে চাই তোমার প্রতিটি হৃৎস্পন্দন।
হঠাৎ চুপ করল ভিনসেন্ট। রাশ টানল জিহ্বার, কম্পিত সর্ব অঙ্গ। কাছে টেনে নিল তাকে নারী, বললে–চুমু খাও আমাকে ভিনসেন্ট!
আতপ্ত ওষ্ঠ মেয়েটির। আতপ্ত মাটির ওপর দুজনে শুয়ে, এবার চুমু খেতে লাগল মেয়েটি তাকে। চুমু দিল তার চোখে, তার কানে, নাসারন্ধ্রে, ওপরের ওষ্ঠে। নরম লাল জিহ্বাটি দিয়ে আদর করতে লাগল তার মুখে। অঙ্গুলির বিস্তৃত স্পর্শ বুলিয়ে দিতে লাগল তার কণ্ঠে, দাড়িতে, কাঁধে, বাহুমূলে।
কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল ভিনসেন্টের প্রতিটি স্নায়ু। উতরোল তার রক্তধারা। দেহতটে বাসনার উন্মাদ জোয়ার, রক্তের বিন্দুতে বিন্দুতে অগ্নিপ্রদাহ, ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি দ্বারে কামনার এ কী মত্ত প্রহার! কোনো নারী এমনি উত্তপ্ত আশ্লেষে তার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি, চুম্বনে চুম্বনে আনেনি এমনি তড়িৎশিহরন।
ভিনসেন্ট দুই ব্যাকুল হাতে তাকে জড়িয়ে নিষ্পেষণ করতে চাইল বুকের মধ্যে, প্রতিটি অঙ্গ দিয়ে অনুভব করতে চাইল মসৃণ শ্বেত পোশাকের অন্তরালে তার প্রতিটি অঙ্গের রোমাঞ্চ শিহরন।
একটু থামো—অস্ফুট গলায় কানে কানে নারী বললে।
উঠে দাঁড়াল একটি বার। কোমর থেকে রুপোলি চাবিটি খুললে, ছুড়ে ফেলে দিল বরতনুর সর্ব আবরণ। আবার এসে ধরা দিল ব্যাকুল বাহুবন্ধনে। যেমন তার মুখ, তেমনি সুবর্ণ তার সমস্ত দেহত্বক, আত্মনিবেদনে উৎসুক পুলকিত কুমারীত্বই তার নগ্নতার শ্রেষ্ঠ ভূষণ। রমণীর দেহ যে এত অপূর্ব সুষমিত হতে পারে, ভিনসেন্টের কল্পনার বাইরে তা ছিল এতদিন। নারীর দেহদান যে এত মধুর, এত পবিত্র, এত হৃদয়বিদারী হতে পারে, সে-ধারণাও কখনও করেনি ভিনসেন্ট।
চুপি চুপি বললে—ভয় কী প্রিয়, ভয় কী? কাঁপছে কেন তোমার বুক? আমি তো তোমার! ধরো আমাকে, যেমন করে তুমি চাও, যত খুশি চাও, নাও আমাকে।
সূর্য পশ্চিম আকাশে। উত্তপ্ত মৃত্তিকা। এই মাটিতে কত বীজ উপ্ত হয়েছে, কত শস্য জন্মেছে, আবার ঝরে পড়েছে কত শুষ্ক বীজ। সৃষ্টি ও ধ্বংসের, জীবন ও মৃত্যুর অবিনশ্বর নিত্য লীলা এই মাটির অভ্যন্তরে নীরবে স্পন্দিত হয়ে চলেছে। এই মাটির বুকে এই মুহূর্তে পুরুষ ও প্রকৃতির রতিরভস স্পন্দন।
অনুভূতির বন্যায় আপ্লুত হয়ে গেল ভিনসেন্টের দেহমন। এই সংগম, এই দেহমিলন, রক্তে সুখের এই চরম ঝনঝনি, এ যেন নিরন্তর বেদনার মতো বাজে, যন্ত্রণা আর তৃপ্তি একাকার হয়ে যায়। বুকের ওপরে ভিনসেন্টকে নিল মেয়েটি, টেনে নিল বুকের মধ্যে একেবারে, আপন কম্পিত স্তনে তাল মিলাল তার হৃৎকম্পনের। এতদিন প্রতি প্রহরে প্রহরে যে অপরিসীম অতৃপ্ত বাসনা বিদীর্ণ করেছে তার স্নায়ুকে, বিধ্বস্ত করে চলেছে বুভুক্ষু উপবাসী তার প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে, বাসনার সেই অগ্ন্যুৎপাতকে গ্রহণ করল আপন অঙ্গের গোপন গভীর হ্রদতটে, বিচিত্র নিগূঢ় আন্দোলনে আন্দোলনে তাকে উত্তীর্ণ করে নিয়ে গেল সংগমের আত্মবিস্মৃত চরমে।
তন্দ্রা নামল চোখে। তৃপ্ত অবসন্ন ভিনসেন্ট ঘুমিয়ে পড়ল—জীবনপ্রণয়িনীর স্বপ্ন-আলিঙ্গনে।
ঘুম যখন ভাঙল, কেউ নেই আর, একা সে। আরক্তিম পশ্চিম দিগন্তে অবসিত দিনমণি। উপুড় হয়ে শুয়েছিল মাটিতে, ঘামে ভেজা গালে লেগে আছে মাটির চাবড়া। শীতল ধরিত্রী-অঞ্চল থেকে কেমন একটা ম্লান সুরভি ভেসে এল নাকে। উঠে দাঁড়াল। কোটটা পরে টুপিটা মাথায় দিয়ে ইজেল বেঁধে নিল পিঠে। ক্যানভাসটা নিল বগলের তলায়। অন্ধকার একলা পথে ফিরে চলল গৃহপানে।
মায়া! মায়া! চলে আর অস্ফুট উচ্চারণ করে–মায়া তোমার নাম? হলদে বাড়িতে পৌঁছে ইজেল আর ক্যানভাসের বোঝা ছুড়ে ফেলল তোশকটার ওপর। পথে বার হল, চলল কফিখানায়।
মায়া? মায়া তোমার নাম? কোথায়, কবে যেন এ-নাম শুনেছি? কী অর্থ এ-নামের?
পর পর দু-কাপ কফি খেয়ে ভিনসেন্ট আবার ফিরল বাড়িতে। ঠান্ডা বাতাসে আসন্ন বর্ষণের ইশারা।
দেশলাই জ্বেলে কেরোসিনের বাতিটা জ্বালল। ঘর ভরে গেল বিষণ্ণ হলদে আলোয়। হঠাৎ চোখ পড়ল বিছানায়। তোশকের একটা অংশ যেন রঙে জুলজুল করছে। চমকে উঠে এগিয়ে গেল, সকাল বেলাকার ক্যানভাসটা তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে কুড়িয়ে নিল মলিন শয্যা থেকে।
চারিদিকে দেয়াল দিয়ে মোড়া সেই একলা ঘরের মধ্যে কেরোসিনের ধূমল আলোয় তার ‘চোখের সামনে বিকশিত হয়ে উঠল শরতের অপূর্ব সুন্দর মায়াকানন। সেই দুটি ঘন সবুজ সাইপ্রেস, সেই ধূসর আর কমলা রঙের ইউ গাছটি, রক্তের মতো লাল ঝাঁকড়া পাতার সেই দুটি ঝোপ। ছবিটির সামনের দিকে কিছুটা বালি, কিছুটা সবুজ তৃণ, পেছনে সুনীল আকাশ, আর সেই আকাশের মাঝখানে জ্বলন্ত পাবক—সূর্য
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিনসেন্ট ছবিটা দেখল। তারপর চিৎকার করে উঠল—হয়েছে, ধরতে পেরেছি এতদিনে, চমৎকার হয়েছে!
৭
শীতকাল এসে গেল। স্টুডিয়োর আরামদায়ক উত্তাপে ভিনসেন্টের দিন কাটে। থিয়ো লিখেছে যে গগাঁকে অনেক চেষ্টায় প্যারিসে ফিরিয়ে আনা গেছে, কিন্তু আর্লসে যেতে সে একেবারে নারাজ। এদিকে ভিনসেন্টের পরিকল্পনা, তার হলদে বাড়িটা হবে দক্ষিণ দেশের সব আধুনিক শিল্পীর বাঁধা স্টুডিয়ো। যেকোনো শিল্পী এখানে আস্তানা নিতে পারবে, দরকার হয় বাড়িটার বাকি ঘরগুলোও এজন্যে ভাড়া নেওয়া যেতে পারে। এটা হবে শিল্পীর ধর্মশালা, বিনিময়ে কেবল প্রত্যেককে মাসে একটি করে ছবি পাঠাতে হবে থিয়োর কাছে। থিয়োর হাতে যখন যথেষ্ট সংখ্যক ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি জমবে, তখন সে স্বচ্ছন্দে গুপিল গ্যালারির চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিজের গ্যালারি খুলতে পারবে।
ভিনসেন্ট তার চিঠিতে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল যে গগাঁ যদি আসে তাহলে সে-ই হবে আর্লসের এই শিল্পীসংঘের পরিচালক, তার হাতেই থাকবে সমস্ত কর্তৃত্ব। গগাঁ এসে যে-ঘরটায় থাকবে সে-ঘরটিকে খাবারের পয়সাটুকু পর্যন্ত বাঁচিয়ে সাজাতে লাগল ভিনসেন্ট। ফিকে বেগুনি রং দিল দেয়ালে, মেঝেটা লাল টালির। চেয়ার খাট সব সাজাল, ফিকে হলুদ রং করল সেগুলোকে। খাটে পাতল নরম গদি, তোশকের সুন্দর বিছানা, কচি লেবু রঙের বালিশের ওয়াড় আর মসৃণ চাদর। পাশের বাথরুমের দরজাটা লাইলাক রঙের, নীল রঙের বেসিন, টয়লেট করার টেবিলটার রং কমলা। জানলার পুরোনো খড়খড়িগুলো সব খুলে ফেলল, তার জায়গায় টাঙাল রঙিন পর্দা, দেয়ালে খানকয়েক পছন্দসই ছবি। বর্ণাঢ্য ঘরটির একটি সম্পূর্ণ ছবি এঁকে সে থিয়োর কাছে পাঠাল, যাতে গগাঁ দেখে পছন্দ করতে পারে।
শীতকালে কাজ ঘরে বসে। মডেল ভাড়া করার পয়সা হাতে থাকে না, ভিনসেন্ট আরশির সামনে দাঁড়িয়ে বার বার নিজের ছবি আঁকে। র্যাচেল মাসে ক-বার এসে মডেল হয়ে যায়। একটা সপ্তাহ ধরে রোজ বিকেলে মাদাম রুলিন এল বাচ্চাদের নিয়ে। যে-কফিখানায় সে যায়, তার মালিকের স্ত্রীও এলেন ক-দিন।
আফ্রিকান একটা জোয়াভ তরুণকে ক-দিনের জন্যে অল্প পয়সার বিনিময়ে পাওয়া গেল। ষাঁড়ের মতো মোটা তার ঘাড়, বাঘের মতো জ্বলজ্বলে চোখ। ভিনসেন্ট তার নীল ইউনিফর্ম পরা পুরো চেহারাটা আঁকল। মাথায় তার লালচে একটা টুপি, ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডটা ঘন সবুজ। চোখ-ধাঁধানো অবিশ্বাস্য রকমের রং পাশাপাশি জমল ছবিটাতে, অত্যন্ত চড়া রকমের রং, চিৎকার করে গলা-ফাটানো রং, কিন্তু ছবির চরিত্রের সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে গেল।
এ ছাড়া প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা জানলার ধারে বসে সে কাগজ পেনসিল নিয়ে ড্রয়িংয়ের পর ড্রয়িং করতে লাগল। কখনও পুরুষ, কখনও নারী, কখনও-বা শিশু কিংবা ঘোড়া বা কুকুর। সামান্যতম বলিষ্ঠ রেখায় সম্পূর্ণ একটা অবয়ব বা চরিত্রকে কী করে প্রকাশ করা যায়, তার চেষ্টা সে করে চলল সমানে। গ্রীষ্মকালে নিজের আঁকা অনেকগুলো ছবির কপিও সে করল ঘরে বসে, এই আশায় যে এসব স্টাডি যদি থিয়ো সস্তায় বিক্রি করতে পারে, তাহলে থিয়োর কাছে তার ভার হয়তো কিছুটা লাঘব হবে।
রং নিয়েও নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সে করল সারা শীতকাল ধরে। এসমস্ত পরীক্ষা থেকে যেসব ফল সে পেল তা তার শিল্পীজীবনের মহার্ঘ সঞ্চয়।
ভ্যান গক পরিবারের তার এক কাকা মারা গেলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু টাকা থিয়ো পেল। থিয়ো স্থির করল এই টাকার অর্ধেকটা সে গগার পেছনে খরচ করবে, গগাঁ যাতে আর্লসে গিয়ে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। বিশেষ করে ভিনসেন্টের যখন এতটা ইচ্ছে। ভিনসেন্টের হাতে বেশ কিছু টাকা এই বাবদে এল। সে মহা আনন্দে.. গগাঁর শোবার ঘর আর স্টুডিয়ো সাজাতে মত্ত হল। কিন্তু গগাঁকে অবিলম্বে নড়ানো সম্ভব হল না। যেতে ট্রেন ভাড়া খরচ করতে হবে না নিজের, পৌঁছোলে স্বচ্ছন্দ আরামে থাকতে পারবে, এত প্রলোভন সত্ত্বেও গগাঁ আর্লসে যেতে নারাজ। যেখানে আছে, সেখানকার দুঃখ দৈন্য আর মালিন্য ঘাঁটতেই তার ভালো লাগছে।
বসন্ত এল। ভিনসেন্টের হলদে বাড়ির পেছনে রক্তকরবীর ডালে টকটকে লাল আগুন লাগল। মেদুর রং লাগল তৃণক্ষেত্রে, সুনীল আকাশের কোণে আবার জলহারা সাদা মেঘের হাতছানি। উদ্যানের ধারে দাঁড়িয়ে কয়েকটি প্রভাতী সূর্যমুখী ভিনসেন্ট আঁকল। বাকিগুলো ডালসুদ্ধ বাড়িতে এনে আঁকল সবুজ ফুলদানিতে বসিয়ে। প্রতিবেশীর হাসিঠাট্টা গায়ে না মেখে সে নিজের হাতে বাড়ির বাইরের দেয়ালে একপোঁচ হলুদ রং নতুন করে লাগাল।
বাড়ির রং শেষ হতে না হতেই এল গ্রীষ্ম। আবার জলন্ত সূর্য আর প্রচণ্ড ঝড়, মাঠে পথে দিগবিদিক-হারানো বিপর্যস্ত মানুষের নিত্য যন্ত্রণা।
সেইসঙ্গে শেষপর্যন্ত এল পল গগাঁ।
শেষরাত্রের গাড়িতে গগাঁ এসে পৌঁছোল আর্লসে। প্রভাতের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল রাত্রি জাগা একটা কাফেতে বসে। কাফের মালিক তার মুখের দিকে একবার ভালো করে চেয়েই বলে উঠল—হ্যাঁ, ঠিক চিনেছি, আপনিই আমাদের শিল্পীর বন্ধু, তা-ই না?
গগাঁ আশ্চর্য হয়ে বললে—কী করে বুঝলেন?
বাঃ, আপনি মশিয়েঁ ভ্যান গককে আপনার একটা ছবি পাঠাননি প্যারিস থেকে? সে-ছবিটা আমাদের যে তিনি দেখিয়েছেন!
দুই বন্ধুর উচ্ছ্বসিত পুনর্মিলন। এ ওর হাতে ঝাঁকুনি লাগায়, ও এর পিঠ চাপড়ায়। চিৎকারে সারা বাড়ি সরগরম। ভিনসেন্ট গগাঁকে সারা বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল, তার জিনিসপত্র খুলে খুলে সাজাল, জিজ্ঞাসা করল প্যারিসের অসংখ্য খবর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটল উত্তেজিত আলাপে -প্রলাপে।
তারপর হঠাৎ সংবিৎ ফিরল ভিনসেন্টের, জিজ্ঞাসা করল—হ্যাঁ হে গগাঁ, সারাদিন আড্ডা দিয়ে কাটাবে, না আজ কাজ করবে কিছু?
কাজ! প্রথম দিনই কাজ? পেয়েছ কী আমাকে! কলুর বলদ?
না, এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম।
ব্যাস, অমনি বোকার মতো আর জিজ্ঞাসা কোরো না।
অপ্রতিভ মুখে ভিনসেন্ট বললে—বেশ, তাহলে আমারও আজ ছুটি। চলো আমার সঙ্গে, শহর দেখিয়ে আনি তোমাকে।
গগাঁকে নিয়ে সে আর্লসের শহরবাজারের রাস্তায় ঘুরতে বার হল। বাজারের পেছনে জোয়াভ সৈনিকদের ব্যারাক। সামনের মাঠে তারা প্যারেড করছে। রোমান ফোরামের সামনের পার্কে তরুণীরা বেড়াতে বার হয়েছে। ভিনসেন্ট তো এখানকার মেয়েদের রূপ বর্ণনায় মুখর।
বললে—এখানকার মেয়ে দেখলে, কেমন লাগল বলো তো!
এমনকিছু আহামরি নয়, যতই বলো।
আরে ভায়া, ওদের চেহারা দেখতে বলিনি, গায়ের রং দেখো। চামড়ার ওপর রোদ পড়ে পড়ে গায়ের রং কেমন অদ্ভুত হয়েছে তা-ই দেখো।
গগাঁ বললে–পাওয়াটাওয়া যায়?
ভিনসেন্ট বললে—বাঁধা ঘর আছে কয়েকখানা, পাঁচ ফ্র্যাঙ্ক করে দর, জোয়াভরা সাধারণত যায়।
বাড়ি ফিরে এসে দুজনে সংসারনির্বাহের টুকিটাকি ব্যবস্থা করতে লাগল। ভিনসেন্ট বললে—তুমি তো বেশ ভালো রান্না করতে পারো, তা-ই না?
ফার্স্ট ক্লাস! জাহাজির কাজ করেছি যে কিছু দিন।
বেশ, ভবিষ্যতে রান্না করবে তুমি। আজ প্রথম দিন অবশ্য তোমার সম্মানে ঝোলটা আমিই রাঁধছি।
রাত্রে সেই ঝোল যখন রান্না হয়ে পাতে এসে পৌঁছোল গগাঁ তা মুখে তুলতে পারল না—ইস! কীসব মিশিয়েছ এর মধ্যে? ঠিক যেমন তোমার রং মেশানো, তেমনি তোমার রান্নার মশলা মেশানো! আরে, রামো রামো!
বটে? তা আমার ছবির রং মেশানোর ভুলটা কোথায় পেলে শুনি?
দেখো ভায়া ভিনসেন্ট, সত্যি কথা বললে খামোখা চটে উঠো না। আমি দেখছি যে তুমি এখন নিও-ইম্প্রেশনিজম-এর পাঁকে হাবুডুবু খাচ্ছ। কিন্তু এ-রাস্তা তোমার নয়। এ-পদ্ধতি তোমার রপ্ত হবে না। এ-পথ ছেড়ে তুমি তোমার নিজের পথেই যাও।
একচোখ দেখেই সব তুমি বুঝে নিয়েছ, তা-ই না? মস্ত সমালোচক তুমি হয়েছ! সামনে থেকে ঝোলের বাটিটা সরিয়ে চেয়ারে খাড়া হয়ে বসল ভিনসেন্ট।
বাঃ, তুমি নিজেই দেখো না! তুমি কি অন্ধ? ধরো, ওই যে হলহলে হলদে রংটা দিয়েছ। ওটা কি একটা রং হয়েছে নাকি?
চোখের সামনে দেয়ালে আঁটা ছবিতে জীবন্ত সূর্যমুখী ফুলগুলো।
ভিনসেন্ট বললে—আমার সূর্যমুখীগুলো সম্বন্ধে আর-কিছু বলবার নেই?
আছে বই কী, সমালোচনা করবার মতো আরও অনেককিছু আছে।
যথা?
যথা? যথা ওদের অসহ্য এলোমেলো ভাব। ওদের মধ্যে কোনো সুসমতা নেই, কোনো ছন্দ নেই, কোনো সম্পূর্ণতা নেই।
লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট—মিথ্যে কথা!
আরে, বোসো বোসো ভিনসেন্ট। অমন করে চোখ পাকাচ্ছ, খুন করবে নাকি? মনে রেখো তোমার চেয়ে বয়স হয়েছে. আমার অনেক, অভিজ্ঞতাও হয়েছে বেশি। আর তুমি এখন নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছ। আমার কথা শোনো, এতে তোমার উপকার বই অপকার হবে না।
ভিনসেন্ট লজ্জিত হয়ে বললে—আমাকে মাপ করো পল। তোমার কাছে সাহায্য পেতেই তো আমি চাই।
বেশ। তাহলে তোমার প্রথম কাজ হল তোমার মন থেকে অনেক আবর্জনা ঝাঁটিয়ে দূর করা। সারাদিন তুমি মিসোনিয়ার আর মস্তিচেলি নিয়ে বকবক করছ। ওদের দুজনেই যাচ্ছেতাই। ওদের মতো শিল্পীর ছবির কদর যতদিন তুমি করবে, ততদিন একটি ছবিও নিজে ভালো আঁকতে পারবে না।
ভিনসেন্ট প্রতিবাদ করে বললে—মন্তিচেলি মস্ত লোক ছিলেন। তাঁর যুগে রঙের জ্ঞান তাঁর চেয়ে বেশি আর কারও ছিল না।
রাখো রাখো! একটা মূর্খ মাতাল ছিল লোকটা!
আবার চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট। টেবিলে ঝোলের বাটিটা উলটে গেল। চিৎকার করে উঠল সে—খবরদার, অমনি কথা বোলো না! নিজের ভাইয়ের মতো আমি ভালোবাসি ওঁকে। মাতাল ছিলেন, তাঁর মাথাখারাপ ছিল, এসব হিংসুকদের মিথ্যে গুজব। মাতাল হলে অমন ছবি তিনি আঁকতে পারতেন না। ছটি মূল রংকে নিয়ে যে নিখুঁত নির্ভুল বিচার তিনি করে গেছেন, মাথাখারাপ লোকের পক্ষে তা অসম্ভব। তাঁর দুর্নাম রটনা করতে শুরু করেছিল যে জঘন্য স্ত্রীলোকটা, তুমি ঠিক তারই মতো জঘন্য মনের পরিচয় দিচ্ছ।
গগাঁ তার মুখের ওপর হেসে উঠল। সমস্ত মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল ভিনসেন্টের। কোনো রকমে রাগকে চাপা দিতে না পেরে ভিনসেন্ট তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।
৮
পরদিন সকাল বেলা আগের দিনের ঝগড়া ভুলে গেল দুজনেই। একসঙ্গে কফি আর প্রাতরাশ খেয়ে দুজনে বার হল নিজের নিজের পথে ছবির উপজীব্যের সন্ধানে। সন্ধ্যা বেলা ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরে ভিনসেন্ট দেখে, গগাঁ ইতিমধ্যেই রাত্রের সাপার রান্না আরম্ভ করেছে। শান্তভাবে কথাবার্তা চলল কিছুক্ষণ, তারপর যথারীতি আলোচনা শুরু হল শিল্প আর শিল্পী নিয়ে।
আবার বাধল যুদ্ধ।
যেসব শিল্পীদের গগাঁ পছন্দ করে, ভিনসেন্ট তাদের দেখতে পারে না, আর ভিনসেন্ট ভালোবাসে যাদের, গগাঁর তারা চক্ষুশূল। চিত্রশিল্পের পদ্ধতি নিয়েও তাদের মতের অমিলের শেষ নেই। অন্য বিষয়ে কথাবার্তা হলে অবশ্য কিছুটা শান্তি বজায় থাকত, কিন্তু চিত্রশিল্প নিয়েই দুজনের জীবন, ছবিই তাদের আহার্য আর পানীয়, ছবি ছাড়া সত্যিকারের আলোচনা তারা করবে কী নিয়ে? স্নায়বিক শক্তির শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত দিয়ে নিজের নিজের আইডিয়ার জন্যে তারা লড়াই করতে লাগল। দৈহিক শক্তিতে গগাঁ ভিনসেন্টের দ্বিগুণ, কিন্তু মানসিক উত্তেজনার শক্তিতে ভিনসেন্ট গগাঁকে ছাড়িয়ে যায়
এমনকী যে যে বিষয়ে কোনো মতান্তর নেই, সেইসব বিষয়ের আলোচনাও আগ্নেয়গিরির লাভাপ্রবাহের মতো। আলোচনার শেষে মাথাটা মনে হয় শুকনো একটা ব্যাটারির মতো, যা থেকে সমস্ত বৈদ্যুতিক শক্তি নিষ্কাশিত হয়ে গেছে।
কস্মিনকালে তুমি শিল্পী হতে পারবে না ভিনসেন্ট—গগাঁ জোর গলায় ঘোষণা করে—যদি না তুমি বাইরের প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করার পর স্টুডিয়োতে ফিরে এসে তবে আঁক, উত্তেজনা কাটিয়ে, ঠান্ডা মাথায়।
ঠান্ডা মাথায়? বোকা কোথাকার! আমি আঁকতে চাই গরম মাথায়, টগবগিয়ে ফোটা রক্ত নিয়ে। নইলে আর্লসে এলাম কেন?
আজ পর্যন্ত তুমি যা কাজ করেছ তাও শুধু প্রকৃতির নির্বোধ অনুকরণ ছাড়া আর-কিছু নয়। আঁকতে হয় মন থেকে, এক্সটেম্পোর বক্তৃতার মতো।
হা ভগবান! মুর্খের প্রলাপ আর তো শুনতে পারিনে!
আর-একটা কথা। সিউরাতের কাছ থেকে কিছুটা শিক্ষা নেওয়া তোমার উচিত ছিল। শিল্প হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক। তোমার ছবিতে তুমি যেন কাহিনি বলতে চাও, নীতিকথা আওড়াতে চাও। ওসব রাবিশ।
ছবিতে নীতিকথা! আমি?
হ্যাঁ তুমি! ধর্মকথা বলতে চাও তো গির্জেয় গিয়ে পাদরি হও গে আবার। রং রেখা আর রূপ—এই হল ছবির আদ্যোপান্ত। প্রকৃতির মধ্যে সজ্জা যেটুকু, সেটুকু নিয়েই শিল্পীর কারবার। তার বেশি নয়।
আর্টের কাজ হবে শুধু সজ্জা? এর বেশি নয়? প্রকৃতির থেকে এইটুকু উপলব্ধিই যদি তোমার মাথায় গজায়, ও-মাথাটাকে নিয়ে আবার তোমার স্টক এক্সচেঞ্জে ফিরে গেলেই পারো!
যাব বই কী, তবে তা যদি যাই তো প্রত্যেক রবিবার রবিবার এসে তোমার ধর্মবক্তৃতাও শুনে যাব, কেমন? প্রকৃতি থেকে তুমি কী পাও, ব্রিগেডিয়ার?
প্রকৃতির মধ্যে আমি খুঁজে পাই চলমানতা, গগাঁ, জীবনের স্পন্দন!
কেয়াবাত, কেয়াবাত!
আমি যখন সূর্য আঁকি, আমি চাই সূর্যের প্রচণ্ড বিঘূর্ণনকে প্রকাশ করতে, সমস্ত সৌরজগতে আলো আর উত্তাপ বিকিরণের সূর্যের যে অতুলনীয় শক্তি; সেই শক্তিকে উপলব্ধিগোচর করতে। আমি যখন একটা শস্যক্ষেত্র আঁকি, আমি চাই দর্শক উপলব্ধি করুক কোন গুপ্তমন্ত্রবলে কচি শস্য পাকা হচ্ছে, ফেটে পড়তে চাইছে অজ্ঞাত শক্তিতে। যখন একটা আপেল আঁকতে চাই, বীজ থেকে ফলের অপ্রতিরোধ্য ক্রমবিকাশ, খোসার অন্তরালে রসের আকর্ষণ!
ভিনসেন্ট, তোমাকে কতবার বলেছি যে শিল্পীর কোনো থিয়োরি থাকবে না!
থামো, থামো! আঙুর বনের এই দৃশ্যটা দেখো গগাঁ। মনে হচ্ছে না, আঙুরগুলো এখুনি যেন ঠিক তোমার চোখের সামনে একেবারে ফেটে পড়বে? দেখো দেখি এই ঝরনাটা! অনন্তকাল ধরে কত লক্ষ লক্ষ টন জল এই ঝরনাটা দিয়ে বয়ে বয়ে চলেছে, ঠিক সেই অনুভূতিটা ফুটে উঠেছে কি না বলো তো? আমি যখন কোনো লোকের পোর্ট্রেট আঁকি, তার মুখটাকেই শুধু আঁকিনে, তার সমস্ত আনন্দ-বেদনা, জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতার রূপ দিতে চেষ্টা করি।
খুব বক্তৃতা হয়েছে। আসলে তোমার বক্তব্যটা কী?
আমার বক্তব্য হল এই। যে-মাঠে শস্য ফলে, যে-নদীতে স্রোত বয়, যে–ফল রসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, আর যে-মানুষ জীবনকে স্বীকার করে চলার পথে এগিয়ে চলে, এরা সবাই এক প্রকৃতির, একই চলমানতার অঙ্গ। কী প্রকৃতিতে কী মানবজীবনে, একটা পরম ঐক্য আছে। সে-ঐক্য ছন্দের ঐক্য। তোমার মধ্যে যা আছে, একটা আঙুরের মধ্যেও তাই আছে, দুজনকে নিংড়োলে, সেই একই রস বার হবে। মাঠে যে-কৃষাণ কাজ করছে তাকে যখন আমি আঁকি, আমি চাই লোকে অনুভব করুক যে মাটি আর ওই কৃষাণ এক ছন্দে বাঁধা, সৃষ্টির একই স্পন্দনে স্পন্দিত। সূর্যের আলো এসে পড়ছে ওই কৃষাণের মাথায়, সঙ্গে সঙ্গে পড়ছে মাটিতে শস্যের শীষে আর লাঙলে, সে-আলোকে যে-প্রাণশক্তি উজ্জীবিত, সেই শক্তি সূর্যের অন্তশক্তি থেকে আলাদা নয়। সারা জল-স্থল-আকাশের সেই অমোঘ ছন্দোবদ্ধ শক্তিকে যখন বুঝতে পারবে, তখনই বুঝতে পারবে জীবনকে, অনুভব করতে পারবে সেই অদ্বিতীয় ছন্দবিধাতাকে—যাঁর নাম ঈশ্বর।
কথা বলতে বলতে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল ভিনসেন্ট, কেঁপে কেঁপে উঠছিল সে। গগাঁ হেঁকে উঠল—বাহবা, বাহবা ব্রিগেডিয়ার! কী বলাই না বললে! কী যুক্তি! কী তত্ত্ব!
চমকে উঠল ভিনসেন্ট। এমনি প্রচণ্ড শ্লেষের আঘাতে হতবাক হয়ে গেল সে। হাঁ করে চেয়ে রইল গগার মুখের দিকে।
একটু পরে গগাঁ বললে—অতঃপর?
অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে ভিনসেন্ট বললে—অতঃপর চলো কাফেতে যাই, আবসাঁত টানি গে।
দিন পনেরো পরে একদিন সন্ধ্যায় গগাঁ বললে—চলো, তোমার সেই গুপ্তগৃহে যাওয়া যাক। দেখি বেশ মোটাসোটা একটা মেয়ে আমার বরাতে জোটে কি না।
ভিনসেন্ট বললে—নিশ্চয়! চলো এখুনি। তবে, গিয়ে কিন্তু র্যাচেলের ওপর নজর দিয়ো না। ও আমার।
সরু সরু পাথুরে গলি পার হয়ে তারা পৌঁছোল সেই গণিকাগৃহে। ভিনসেন্টের গলা শুনেই র্যাচেল ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। বাড়িওয়ালা লুইসের সঙ্গে ভিনসেন্ট গগাঁর পরিচয় করিয়ে দিল।
লুইস প্রচুর সম্ভ্রম সহকারে গগাঁকে বললে—মশিয়েঁ গগাঁ, আপনি যখন একজন শিল্পী, তখন একটা উপকার আমার করতে হবে। গত বছর প্যারিসে গিয়ে দুখানা ছবি কিনে আনি। ছবি দুটো কেমন, সে সম্বন্ধে আপনার মত আমি জানতে চাই।
বেশ তো। কোত্থেকে কিনেছিলেন?
গুপিলস থেকে। আসুন আপনাকে দেখাই।
র্যাচেল ভিনসেন্টের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল পাশের ঘরে। ধাক্কা দিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে সোজা উঠে বসল তার কোলের ওপর।
ভিনসেন্ট বিরস মুখে বললে—দেখো, গত দু-মাস ধরে আমি এখানে আসছি, আর লুইস কিনা আমাকে একদিনও তার ছবি যাচাই করতে বলেনি!
তুমি যে সত্যিকারের শিল্পী তা ও ভাবতেই পারে না লাল পাগল!
তা হবে!
এবার বিবর্ণ মুখ করার পালা র্যাচেলের। ঠোঁট ফুলিয়ে বললে–তুমি আর আমাকে একটুও ভালোবাস না!
কেন এ-কথা তোমার মনে হল, বকবকম?
এতদিন তুমি আসনি কেন? সেই কবে এসেছিলে মনে আছে?
কী করব? বন্ধুর জন্যে ঘর সাজাতে ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম, যে!
তাহলে বলছ, দূরে থাকলেও তুমি ঠিক আমাকে ভালোবাসই?
ঠিক বলেছ। দূরে থাকলেও।
ভিনসেন্টের ছোটো ছোটো কান দুটি নিয়ে খেলা করতে করতে দু-কানে দু-বার চুমু খেল র্যাচেল। বললে—তার প্রমাণ দাও। তোমার এই কান দুটো আমার কাছে রেখে যাও। প্রতিজ্ঞা করেছিলে দেবে, মনে নেই!
সেই পুরোনো কৌতুকটা। হাসতে হাসতে ভিনসেন্ট বললে—বেশ তো, মাথা থেকে খুলে নিতে পার, তো খুলে নাও।
হি হি! লাল পাগল! তোমার কান কি আমার পুতুলের কান? সুতো দিয়ে সেলাই করা?
হলের ও-পারের ঘরটাতে হঠাৎ খুব শোর উঠল, কে যেন খুব চেঁচাচ্ছে, হয় হাসছে নাহয় কাঁদছে। কোল থেকে র্যাচেলকে ধপ করে নামিয়ে ছুটল ভিনসেন্ট।
মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে গগাঁ, জল ঝরছে চোখ দিয়ে। আলো হাতে লুইস অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ভিনসেন্ট তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে গগাঁর কাঁধে ঝাঁকুনি দিল।
পল, পল, কী হয়েছে তোমার!
হাসছে গগাঁ। হাসির দমকে দমকে বেঁকেচুরে যাচ্ছে সমস্ত শরীর, কথা বলতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ এমনি নিরুপায় হাসির পর হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললে—ভিনসেন্ট, ভিনসেন্ট, শেষ পর্যন্ত জিত হয়েছে আমাদের! প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে আমাদের!
হল কী?
দেখো, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। প্যারিসের গুপিল গ্যালারি থেকে বেশ্যাবাড়ির বৈঠকখানা সাজাবার জন্যে লুইস এত শখ করে যে-ছবি দুটো এনেছে সে-দুটোই বুর্গেরুর আঁকা!
কোনো রকমে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে টলতে টলতে গগাঁ চলল দরজার দিকে।
ভিনসেন্ট চিৎকার করল—দাঁড়াও এক মিনিট! কোথায় চলেছ?
যাচ্ছি টেলিগ্রাফ অফিসে! তার করতে হবে একটা। এমন একটা খবর, বাতিনোলসের আড্ডাধারীদের এখুনি জানানো চাই!
.
গ্রীষ্ম এল আবার, সেই দুর্দম প্রচণ্ড উত্তাপ। সমস্ত গ্রামাঞ্চল ফেটে পড়ল রঙে আর রঙে। সবুজ আর নীল, হলুদ আর লাল—এমনি নির্লজ্জভাবে প্রগল্ভ তারা যে চোখ যেন ফিরে ফিরে আসে। যেখানে লাগে সূর্যের স্পর্শ সেখানেই লাগে আগুন, আমূল দগ্ধ হয়ে যায়। সারা রোন নদীর উপত্যকা জুড়ে উন্মত্ত উত্তাপের উত্তাল তরঙ্গের পর তরঙ্গ। এর মাঝখানে নবাগত দুজন শিল্পী। সূর্য তাদের আঘাত হানছে পলে পলে, বিশুষ্ক করে দিচ্ছে দেহ, বিচূর্ণ করে দিচ্ছে সহনক্ষমতা। এর সঙ্গে মাবার ঝড়ের তাণ্ডব। ঝটিকার অত্যাচার তাদের শরীরে যেন প্রতিমুহূর্তের চাবুকের স্নহার, শুধু দেহে নয়, প্রতিটি স্নায়ুতে। হাওয়ার ধাক্কায় মাথার ভেতরে মস্তিষ্ক নড়ে সড়ে যায়, কখন বুঝি খুলি ভেঙে খানখান হয়ে পড়ে। তবু আশ্রয়ের লোভ নেই, ঐশ্রামের মমতা নেই, বিরতি নেই কাজের। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা বার হয় ঘর ছেড়ে পথে, আকাশজোড়া দিবসের নীল আর্তনাদ আবার যতক্ষণ না দিনান্তের নীল আর্তনাদে গিয়ে বিলীন হয়, ততক্ষণ তারা কাজ করে চলে।
ভিনসেন্ট আর গগাঁ, ঠিক যেন দুটি আগ্নেয়গিরি। একটি থেকে লাভাপ্রবাহ নির্গত হয়ে চলেছে,, আর-একটি ফুঁসছে অন্তরে অন্তরে। সারাদিন ধরে কাজের মধ্যে দুজনের মাঝখানে বিরাট একটা সংঘাত সৃষ্টি হয়। দিনান্তে ঘরে ফেরা-মাত্র সেই সংঘাত প্রচণ্ড নির্ঘোষে পেটে পড়ে। রাত্রে সারা দেহে এত ক্লান্তি যে ঘুমোতে পারে না, সারা স্নায়ুতে এত আক্ষেপ যে চুপ করে বসেও থাকতে পারে না, তখন সঞ্চিত শেষ শক্তিটুকু দিয়ে লড়াই করে এ-ওর সঙ্গে, মর্মান্তিক লড়াই। হাতের পুঁজি কমে আসে, অবসর বিনোদনের খোরাক থাকে না। নিরুদ্ধ কামনা মুক্তি পায় একে অপরকে আক্রমণ করে, আঘাত করে।
সুযোগ পেলেই গগাঁ ভিনসেন্টকে রাগিয়ে রাগিয়ে একেবারে পাগল করে তোলে। ভিনসেন্ট যখন একেবারে ছটফট করতে থাকে তখন চট করে পরিস্থিতিটা ঠান্ডা করে ঠাট্টার চরম অস্ত্র হানে—বাঃ বাঃ, ব্রিগেডিয়ার, চমৎকার!
গগাঁ বলে—ভিনসেন্ট, তুমি যে কাঁচকলা ছবি আঁক, তোমার স্টুডিয়োই তার প্রমাণ। এটা স্টুডিয়ো, না আঁস্তাকুড়? ইস, রঙের বাক্সটারই-বা কী ছিরি! ডাচ দেশের লোকের মাথায় আর কত বুদ্ধি হবে? ওই মাথায় যদি মন্তিচেলি আর দোদে অত না ঢোকাতে তাহলে মাথাটাও কিছুটা পরিষ্কার হতো, জীবনযাত্রাটাও খানিকটা ভব্য হতো।
—বেশ, বেশ! আমার স্টুডিয়ো নোংরা, তোমার তাতে কী? তোমার স্টুডিয়ো কেমন তা নিয়ে আমি তো কথা বলতে যাচ্ছিনে।
ও, হ্যাঁ। এই প্রসঙ্গে আর-একটা কথাও বলা দরকার। তোমার স্টুডিয়ো যেমন জঞ্জালভরতি, তেমনি জঞ্জাল তোমার মাথার খুলির নীচেও। তামাম দুনিয়ায় যত লোক পোস্টেজ স্ট্যাম্প এঁকেছে, সবাইয়ের নামে তুমি উচ্ছ্বসিত, অথচ এটা তোমার মাথায় ঢোকে না যে ডেগার মতো শিল্পী—
ডেগা! একটা ছবি সে এঁকেছে যা মিলেটের একটা আঁচড়ের পাশে দাঁড়াতে পারে?
মিলেট! সেই সেন্টিমেন্টাল বুদ্ধটা?
খেপে উঠল ভিনসেন্ট। এত বড়ো কথা? মিলেটের নামে? যিনি তার শল্পগুরু, যিনি তার আত্মার জনক! তাড়া করল সে গগাঁকে, গগাঁ দৌড়োতে লাগল এ-ঘর থেকে ও-ঘর। বাড়িটা বড়ো নয়। মুখোমুখি হল দুজনে। তারস্বরে চৎকার করতে লাগল ভিনসেন্ট। ঘুষি বসাল গগাঁর নাকের ওপর। বিনিদ্র উত্তপ্ত রাত্রির তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত চলল দুজনের বিচারহীন তর্ক আর হিংস্র সংঘাত।
সারাদিন কাজ যখন করে তখন তাদের অমিত শক্তি। খুঁজে পেতেই হবে প্রকৃতির গোপন রহস্যকে, সেই রহস্যের সঙ্গে শিল্পের আন্তররহস্যকে এক অচ্ছেদ্য যোগসূত্রে বাঁধতেই হবে। অনির্বাণ এই সন্ধান, চির অতৃপ্ত এই পিয়াসা।
সারাদিন তারা যুদ্ধ করে তাদের বর্ণবিধ্বস্ত প্যালেট নিয়ে, আর সারা রাত্রি তাদের ক্ষতবিক্ষত অহং নিয়ে। যখন তর্ক বা ঝগড়া করে না, তখন আলোচনাও এমনি প্রচণ্ড হয় যে ঘুম পালাতে পথ পায় না। থিয়োর কাছ থেকে টাকা আসতে না আসতেই মদ আর তামাকে সব টাকা উড়ে যায়। এত গরম যে খাওয়া যায় না কিছু। মনে ভাবে যে আবসাঁত খেলে স্নায়ুমণ্ডলী বুঝি ঠান্ডা হবে। উলটে উত্তেজনা শুধু বেড়েই চলে।
দিনের পর দিন ধরে দারুণ ঝড় চলল। বাড়ির বাইরে পা বাড়ানো অসম্ভব। অমনি সাংঘাতিক দুটো মানুষকে অতটুকু আস্তানার মধ্যে শান্তিতে ধরে রাখা অসম্ভব। এক বাড়ির মধ্যে ভিনসেন্টের সঙ্গে বাস করে ঘরে বসে তুলির একটা আঁচড়ও দিতে পারে না গগাঁ। তার একমাত্র কাজ হল ভিনসেন্টকে চটানো, কথায় কথায় পাগল করে তোলা। আইডিয়া নিয়ে তর্ক করতে করতে কোনো লোক যে এতটা খেপে যেতে পারে, গগার তা ধারণার বাইরে ছিল। ভিনসেন্টই তার খেলার উপকরণ—এই বীভৎস নিষ্ঠুর খেলায় সে মাতল পরম উল্লাসে।
এমনি কাটল চারদিন। পঞ্চম দিনের দিন ভিনসেন্টের প্রমত্ত উত্তেজনা যখন বাইরের ঝড়ের উদ্দীপনাকে হার মানিয়েছে, করুণা হল গগাঁর। বললে—থামো, থামো, ঠান্ডা হও ভিনসেন্ট!
দাঁত খিঁচিয়ে ভিনসেন্ট বললে—খুব হয়েছে, আর উপদেশ দিতে হবে না! ঠান্ডা হও তুমি।
একটা কথা তোমাকে বলা দরকার ভিনসেন্ট। তুমি জান না, আমার সঙ্গে একসঙ্গে থেকেছে আর তর্কবিতর্ক করেছে এমনি বেশ কয়েক জন লোক শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গিয়েছে।
তার মানে? ভয় দেখাচ্ছ নাকি আমাকে?
না, ভয় দেখাচ্ছিনে। সাবধান করে দিচ্ছি।
ওসব সাবধান করা তোমার নিজের জন্যে তুলে রাখো, বুঝলে?
বেশ! সাবধান করবার, আমি করলাম। পরে যদি কিছু হয় আমাকে যেন কেউ দোষ না দেয়, এও বলে দিলাম।
একেবারে ভেঙে পড়ল ভিনসেন্ট এই কথায়। চিৎকার করে উঠল—পল, পল, তুমি থামো! থামাও তোমার এই তর্ক আর ঝগড়া। আমি স্বীকার করছি যে আমার চাইতে তুমি অনেক ভালো আঁক। মেনে নিচ্ছি যে তোমার কাছে মুখ বুজে আমার অনেককিছু শেখবার আছে। কিন্তু তুমি যে এমনি করে আমাকে ঘেন্না করবে, আর ঠাট্টা করে করে দগ্ধাবে, তা আমি সইব না। কিছুতে সইব না, বুঝলে? ন-বছর ধরে আমি এই ছবি আঁকা নিয়ে ক্রীতদাসের মতো খেটেছি। রঙের ভাষাকে আলবত আমি আয়ত্ত করেছি, এই ভাষায় আমারও কিছু বলবার আছে দুনিয়ার কাছে। বলো, জবাব দাও তুমি—স্বীকার কর কি কর না?
গগাঁ শুধু বললে—বাঃ বাঃ ভায়া ব্রিগেডিয়ার, চমৎকার!
শান্ত হয়ে এল ঝটিকা। আবার লোকজন বার হল রাস্তায়। আবার সূর্যের ফোসকা পড়ানো তাপ। দুরন্ত একটা জ্বর নেমে এল সারা আর্লসের নাড়িতে। যেখানে-সেখানে মানুষে মানুষে হানাহানি, জমা হতে লাগল অত্যাচারের অপরাধ। পদে পদে হার মানতে লাগল পুলিশ। লোকজনের চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটা জ্বালা ধরা হিংস্রতা। কেউ হাসে না। কেউ কথা বলে না। ঝাঁ-ঝাঁ রোদে পাথরের দেয়াল আর ছাদগুলো পর্যন্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। পথে-ঘাটে ঘুষোঘুষি আর ছুরি-মারামারি লেগেই আছে। লেগেই আছে সুস্থ মানুষের হঠাৎ দাঁতে দাঁত লেগে মূর্ছা যাওয়া। বাতাসে যেন কোনো এক অশুভ দুর্ঘটনার সংকেত। সারা আর্লসের স্নায়ু থরথর করে কাঁপছে, সুস্থতার বাঁধ এবার ভাঙল বুঝি। রোন নদীর রৌদ্রজ্বলা বাঁধও কবে বুঝি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে, টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে দিগন্ত পানে।
ভিনসেন্টের মনে পড়ে প্যারিসের সেই জার্নালিস্টের কথা।
মনে মনে ভাবে—এবার? এবার কি ভূমিকম্প? না বিপ্লব?
তবু সে স্তব্ধ থাকে না, আশ্রয় খোঁজে না কোটরের অন্ধকারে, অবিশ্রান্ত কাজ করে যায় দাঁতে দাঁত চাপা আত্ম-অঙ্গীকারে। প্রত্যুষ থেকে প্রদোষ পর্যন্ত প্রতিদিন তার কাটে রৌদ্রজ্বলা প্রান্তরের ক্ষমাহীন রুক্ষতায়—খালি মাথায়, কেননা টুপি পরা তার অভ্যাস নেই। তার অন্তরের প্রচণ্ড জমাট অনুভূতিকে গলিয়ে ফেলে, প্রকাশের ধারাকে বেগবতী করার জন্যে ওই অমনি প্রচণ্ড উত্তাপেরই প্রয়োজন। তার মস্তিষ্ক যেন একটা ঘূর্ণমান জ্বলন্ত যন্ত্র, খালি জন্ম দিয়ে চলেছে তপ্ত লোহিত
ক্যানভাসের পর ক্যানভাস।
প্রতিটি ছবি সম্পূর্ণ হয় আর ভিনসেন্টের অন্তরে ফুলে ফুলে ওঠে সম্ভাবনার জোয়ার। এত বছরের পরিশ্রম এতদিনে বুঝি সার্থক হল। এত অনির্বাণ প্ৰয়াস আর সাধনা আর যন্ত্রণা এবার বুঝি চরম রূপ পেল সফল শিল্পসৃষ্টিতে। আর্লসের এই অগ্নিস্রাবী আকাশের নীচে গ্রীষ্মের এই অমূল্য ক-টি সপ্তাহ জীবনে হয়তো আর আসবে না, কিন্তু এই কটা দিনেই সে ভবিতব্যের হাতে রেখে যেতে পারবে সম্পূর্ণ ও মহত্তম শিল্পীর স্বাক্ষর। এমনি ছবি আগে সে কখনও আঁকেনি, ক্যানভাসের পর ক্যানভাসে প্রকৃতির নিগূঢ় নির্যাসের সঙ্গে আপন আত্মার নিগূঢ় নির্যাসকে এমন ওতপ্রোতভাবে আগে কখনও মেশাতে পারেনি, আর কখনও বুঝি পারবেও না জীবনে।
সূর্যের প্রথম রশ্মি প্রকৃতিকে যখন তার চর্মচক্ষের সামনে উদ্ভাসিত করে তখন সে আঁকা শুরু করে, শেষ করে দৃশ্য যখন দৃষ্টি থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায় : সূর্যরশ্মিহারা প্রদোষ-অন্ধকারে। কখনও দুটো বা কখনও তিনটে সম্পূর্ণ ছবি সে একদিনে এঁকে শেষ করে। জীবনে একটিমাত্র ঋতুকালের মধ্যে তার সমগ্র অন্তরমন্বিত সৃষ্টিজ্বালাকে উজাড় করে বার করে দিতে চায়, তারপর যা হবার হোক। মূল্য নেই জীবনের, মূল্য নেই সুদীর্ঘ আয়ুর, মূল্য শুধু সেই আশ্চর্য ক্ষণকালটুকুর যখন সমগ্র দেহ-মন-প্রাণ শিল্পসৃষ্টির চরমতম আবেগে থরোথরো, যখন সৃজনবেদনার নিষ্ঠুরতম আঘাতে হৃদয়তন্ত্রী পূর্ণ কম্পমান। শিল্পী সে, শিল্পসৃষ্টি দিয়েই তার জীবনের পরিমাপ, পঞ্জিকার ফুরিয়ে-যাওয়া পাতা দিয়ে নয়।
কেমন করে জানে না ভিনসেন্ট, মনে হচ্ছে তার, সে যেন তার শিল্পীজীবনের একটা তুঙ্গ ক্ষণে এসে পৌঁছেছে, এতদিনের প্রয়াসিত আকাঙ্ক্ষিত এই বিরল ক্ষণ। এ-ক্ষণ কতটুকু তা সে জানে না, এটুকু বোঝে, জীবনের মহার্ঘতম অংশ এই ক্ষণ। তাই একমুহূর্ত নষ্ট করা এখন চলবে না। আঁকতে হবে ছবির পর ছবি, তারপর আরও ছবি, রুদ্ধশ্বাস অনপচয়িত প্রতিটি প্রহর ধরে। এ-মাহেন্দ্রক্ষণ যেন অনন্ত কালসমুদ্রে বিশিষ্ট একটি তরঙ্গ। ফুলে উঠেছে আকাশের দিকে মুখ করে, এখনি আবার ভেঙে যাবে, মিশে যাবে বিপুল বারিধির সঙ্গে একাকার হয়ে। ভিনসেন্টের তাই সময় নেই, সৃজনকামনাকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিতে হবে, অন্তরাকৃতিকে সম্পূর্ণ নিংড়ে ‘দিতে হবে এই মাহেন্দ্রক্ষণটুকুর মধ্যে।
সারাদিন কাজ, আর সারারাত্রি গগার সঙ্গে যুদ্ধ। আহার নেই, নিদ্ৰা নেই। শুধু রং আর রৌদ্র, শুধু উত্তাপ আর উত্তেজনা, শুধু তামাক আর কড়া মদ। দেহের অঙ্গে অঙ্গে প্রকৃতির কষা, সৃষ্টির উত্তেজনা আর পারস্পরিক যুদ্ধের উত্তেজনার কষা মনে। ঝিমঝিম করে মাথা, টগবগ করে রক্ত, শুকিয়ে আসে কণ্ঠনালী বারে বারে। সূর্য তাদের দগ্ধ করে, চাবুক মারে ঝড়, প্রকৃতি আর প্যালেটের রং ছুরিকাঘাত করে চোখে। খালি পেটে সুতীব্র মদ স্ফীয়মান রক্তে আনে জ্বরের সংকেত। তারপর প্রতিটি রাতের প্রহরের পর প্রহর ধরে বাড়ির ক-খানা ঘরের দেয়ালে দেয়ালে বীভৎস উত্তেজনা। ঘুম নেই কারও চোখে, আক্রোশে, ঘৃণায়, তর্কে আর ঝগড়ায় সমানে ক্ষতবিক্ষত করে চলে একে অপরকে।
একদিন ভিনসেন্ট মাঠে বসে কয়েকটা লাঙলের ছবি আঁকছে, গগাঁ পাশে বসে ভিনসেন্টের একটা পোর্ট্রেট আঁকল। ভিনসেন্ট বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল ছবিটার দিকে। হঠাৎ এই প্রথম সে উপলব্ধি করল গগা সত্যি সত্যি কী তাকে ভাবে, গগার চোখে তার কী রূপটা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে গেছে।
একটু পরে অট্টহাসি হেসে বললে—ঠিক এঁকেছ। এ আমি, কিন্তু যে-আমিটা একেবারে পাগল হয়ে গেছে।
সে-দিন সন্ধ্যা বেলা দুই বন্ধু কাফেতে গেল। আবসাঁতের গেলাস সামনে। হঠাৎ কী হল, ভিনসেন্ট গ্লাসভরতি পানীয় ছুঁড়ে মারল গগাঁর মুখে। গগাঁ লাফিয়ে উঠে চেপে ধরল ভিনসেন্টকে। সবলে তাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেল কাফে থেকে বাড়িতে। বিছানায় পড়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল ভিনসেন্ট।
পরদিন সকাল বেলা উঠে খুব শান্ত গলায় বললে—ভাই গগাঁ, একটু একটু কেমন মনে পড়ছে কাল সন্ধ্যা বেলা যেন আমি তোমাকে অপমান করেছিলাম।
গগাঁ বললে—তার জন্যে সর্বান্তঃকরণে তোমাকে ক্ষমা করছি। কিন্তু আমার ভয়, কালকের ঘটনা আবার ঘটতে পারে। এও হতে পারে কোনোদিন এমনি অবস্থায় আমিও খেপে উঠে তোমার গলা টিপে ধরব। আমার মনে হয় আমি থিয়োকে চিঠি লিখে দিই যে আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
না, না, কখনও না! পল, এ-কাজ তুমি করতে পারো না! চলে যারে এখান থেকে? এ-বাড়ি যে আমি তোমার জন্যেই সাজিয়েছি! আর্ত কণ্ঠে একেবারে ভেঙে পড়ল ভিনসেন্ট।
সারাদিন বইল তর্কের ঝড়, হৃদয়াবেগের উদ্দাম হানাহানি। গগাঁকে আটকে রাখার জন্যে ভিনসেন্ট লড়তে লাগল প্রাণপণ। তেমনি প্রাণপণে গণা এড়াতে লাগল ভিনসেন্টের প্রতিযুক্তি, প্রতিটি অনুনয়। কখনও অনুনয়, কখনও ভিক্ষা, কখনও দাবি, কখনও হুহুংকৃত অভিশাপ। একবার এমনকী হাউহাউ করে কেঁদে উঠল ভিনসেন্ট। বন্ধু যদি রাগ করে ব্যথা পেয়ে চলে যায়, তাহলে কাজ কী এ-জীবনে? শেষ পর্যন্ত ভিনসেন্টেরই জয় হল। ক্লান্ত হয়ে পড়ল গগাঁ সারাদিনের এই হৃদয়রণে। দিনান্তে সে হার মেনে পেল মুক্তি। থাকবে, থাকবে সে, ছেড়ে যাবে না ভিনসেন্টকে। ছেড়ে যাবে না এই হলদে বাড়ি।
রাত্রি নামল। শুয়েছে যে যার বিছানায়। ভৌতিক স্তব্ধতা। এই স্তব্ধতায় কী যেন আসন্ন অশুভের ইঙ্গিত।
সারারাত ঘুম এল না গগাঁর চোখে। শেষরাত্রে তন্দ্রায় জড়িয়ে এল চোখ। হঠাৎ কী একটা অনুভূতির চমকে চোখ খুলল সে। দেখে, অন্ধকারে ভিনসেন্ট দাঁড়িয়ে তার বিছানার সামনে। নিস্পন্দ নির্বাক, শুধু জ্বলজ্বল করে ক্ষুধিত তার দুটো চোখ।
অন্ধকারে হেঁকে উঠল গগাঁ—এখানে দাঁড়িয়ে কেন? কী হয়েছে তোমার ভিনসেন্ট?
একটিও কথা না বলে ভিনসেন্ট বার হয়ে গেল ঘর থেকে।
তার পরদিন শেষরাত্রে ঠিক তেমনি আর্ত অনুভূতির ধাক্কায় ঘুম ভাঙল গগাঁর। দেখল, তেমনি নিশ্চল পাথরের মতো অন্ধকারে ভিনসেন্ট দাঁড়িয়ে তার সামনে।
লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে চিৎকার করে উঠল গগাঁ—যাও যাও, বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে!
নিঃশব্দে অপসৃত হয়ে গেল ভিনসেন্ট, সে যেন অন্ধ রজনীর ভাষাহারা প্রেতমূর্তি এক
পরের দিন রাত্রে খাবার সময় তুমুল ঝগড়া হল দুজনের।
গগা চেঁচিয়ে উঠল ঝগড়ার মাঝখানে নিশ্চয় তুমি আমার ঝোলে খানিকটা রং ঢেলে দিয়েছ, আমি অন্যমনস্ক ছিলাম যখন। এ-ঝোল আবার আমি মুখে তুলব ভেবেছ? স্বীকার করো, দাওনি মিশিয়ে?
প্রেতহাস্য হাসল ভিনসেন্ট। মুখে উত্তর না দিয়ে দেয়ালে রং-খড়ি দিয়ে বড়ো বড়ো করে লিখল–রং নয়, বিষ!
এর পর ক-দিন ভিনসেন্ট একদম চুপচাপ রইল। কেমন একটা বুক-চেপে ধরা বিষণ্ণ স্তব্ধতা। কথা বলে না, মুখ ধোয় না। পড়ে না এক লাইন, শুধু চেয়ারে খাড়া হয়ে বসে শূন্যমনে চেয়ে থাকে একদিকে।
চতুর্থ দিন বিকেল বেলা সে মুখ খুলল। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড় বইছে। গগাঁকে ডেকে বললে—চলো আমার সঙ্গে পার্কে, জরুরি কথা আছে।
কথা আছে, তা পার্কে কেন? বেশ আরামে তো আছি বাড়ির মধ্যে, এখানেই বলো না?
না, বসে বসে বলতে পারব না। হাঁটতে হাঁটতে তবে বলব।
বেশ, চলো তাহলে।
পথে বার হল। তুমুল দাপট ঝড়ের। দুঃসাধ্য সেই বাতাসের বেগের বিরুদ্ধে পথ করে চলা। ‘পার্কের সাইপ্রেস গাছগুলোর মাথা ঝড়ে যেন মাটিতে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
ভিনসেন্টের কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে শুধোল গগাঁ—কী বলবে, বলো?
এত হাওয়ায় কথা বলাও মুশকিল। বাতাস মুহূর্তে শব্দকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।
ভিনসেন্ট বললে—পল, গত ক-দিন ধরে আমি খুব ভাবছি। দারুণ একটা আইডিয়া এসেছে আমার মাথায়!
মাপ করো। ঝড়ে প্রাণ গেল আমার। তোমার আইডিয়া শোনার বিন্দুমাত্র কৗতূহল আমার নেই।
দেখো, শিল্পী হিসেবে আমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছি। কেন তা জান?
কী বললে? কিছু শুনতে পারছিনে। কানের কাছে চেঁচিয়ে বলো।
গলা চড়াল ভিনসেন্ট—জান তুমি কেন আমরা শিল্পী হিসেবে ব্যর্থ হয়েছি?
না, জানিনে। কেন?
আমরা সবাই একলা একলা আঁকি বলে।
সে আবার কী?
কোনো কোনো জিনিস আমরা প্রত্যেকে ভালো আঁকি আবার কোনো কোনো জিনিস খারাপ আঁকি। ভালো খারাপ দুই-ই একই ক্যানভাসে ধরা পড়ে। শুনছ?
বলো, বলো ব্রিগেডিয়ার, কান পেতে আছি।
হল্যান্ডের সেই বেথ ভাইদের মনে পড়ে? একজন দৃশ্য আঁকত ভালো, আর-একজনের হাত ছিল মানুষ আঁকার। দুজনে মিলে তারা একখানা ছবি আঁকত। একজন দৃশ্য, আর-একজন মানুষ। দুজনে মিলে তারা সার্থক শিল্পী হয়েছিল।
কী যন্ত্রণায় পড়া গেল, কখন যে শেষ হবে।
কী বললে? চেঁচিয়ে বলো এবার তুমি।
বলছিলাম যে, তারপর? থামলে কেন?
হ্যাঁ। শোনো পল, আমাদেরও তাই করতে হবে। তুমি, আমি, সিউরাত, সেজান, লোত্রেক, রুসো—একই ক্যানভাসে সবাই মিলে আমরা কাজ করব। সেই হবে আমাদের সত্যিকারের সাম্যবাদ। আমাদের প্রত্যেকের হাতে সত্যিকারের ভালো যেটুকু আসে একটি ছবিতে সেইটুকুই আমরা দেব। সিউরাত আঁকবে বাতাস, তুমি আঁকবে দৃশ্যপট, সেজান আঁকবে ছবির সামনের অংশটা, লোত্রেক আঁকবে মানুষ, আর আমি আঁকব চাঁদ তারা আর সূর্য। সবাই মিলে আমরা বিরাট একটা আর্টিস্টে পরিণত হবই। কী বল?
বাঃ বাঃ ব্রিগেডিয়ার! হো হো! হো হো! কেয়াবাত, কেয়াবাত! বর্বর কর্কশ অট্টহাস্যে একেবারে ফেটে পড়ল গগাঁ। প্রচণ্ড বিদ্রূপরাশির উম্মত্ত উচ্ছ্বাস যেন ছিটিয়ে দিল সমুদ্রের জলকণার মতো।
একবার নিশ্বাসটা আটকে নিয়ে গগাঁ বললে–ব্রিগেডিয়ার, অ্যাইসা বড়িয়া আইডিয়া পৃথিবীতে আর কারুর মাথায় কখনও গজায়নি, হলফ করে বলছি। দাঁড়াও, আর-একটু হেসে নিই।
দু-হাতে পেট চেপে পথের ধারে উবু হয়ে গগাঁ দমকে দমকে হাসতে লাগল।
নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ভিনসেন্ট।
সহসা আকাশ থেকে নেমে এল কালো কালো সব উড়ন্ত ছায়ার পাল, যেন কালো দাঁড়কাক সব। হাসছে গগাঁ, অসংখ্য কাকের কর্কশ কা-কা শব্দ স্পন্দিত হচ্ছে ভিনসেন্টের কানে। ছায়ার পাল জড়িয়ে ধরল ভিনসেন্টকে, আচ্ছন্ন করল তার প্রতিটি ইন্দ্রিয়, কান দিয়ে, মুখ দিয়ে, নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে যেতে লাগল তার মাথার মধ্যে, আক্রমণ করল তার মস্তিষ্ক। বায়ুহীন অন্ধ কৃষ্ণপক্ষ-বিধুননে অসংখ্য ছায়ার আস্তরণে মগ্ন হয়ে গেল তার চৈতন্য।
গগাঁ তাকে ডাকছে, ঝড়ের ওপার থেকে যেন—চলো চলো, এমনি আইডিয়ার পর লুইসের আড্ডায় গিয়ে বেশ একটু ফুর্তি না করে এলে চলে না।
নিঃশব্দে যন্ত্রচালিতের মতো ভিনসেন্ট চলল তার পিছু পিছু।
পৌঁছোবামাত্র গগাঁ একটি মেয়েকে ধরে তার সঙ্গে দোতলার ঘরে গেল। র্যাচেল দৌড়ে হলঘরে এসে বসল ভিনসেন্টের কোলে। বললে—ওপরে আমার ঘরে যাবে না, লাল পাগল?
না।
না! কেন না?
ওই তোমার দর্শনী, পাঁচ ফ্র্যাঙ্ক সঙ্গে নেই বলে।
না থাক, চলো। টাকার বদলে তোমার একটা কান দিলেই হবে। দেবে বলেছিলে মনে নেই?
মনে আছে।
একটু পরে গগাঁ নেমে এল। দুজনে চলল বাড়ির পথে। দুজনে আবার ঢুকল হলদে বাড়িতে। এবার রাত্রের খাবার পালা। দুজনকে মুখোমুখি বসতে হবে এক টেবিলে। গগাঁ পালাল। কোনো কথা না বলে সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল পথে।
হনহন করে হাঁটতে লাগল। প্লেস লা মার্টিন প্রায় পার হয়েছে, এমন সময় পিঠের শিরদাঁড়াটা যেন শিরশির করে উঠল। মনে হল কে যেন তাকে অনুসরণ করে ছুটে আসছে। হ্যাঁ, ঠিক, তবে দূরে, অনেক দূরে, ক্রমে দূর থেকে কাছে। অসংযত দ্রুত পদক্ষেপ, পরিচিত পদধ্বনি—কাছে, আরও কাছে, এবার একেবারে শিউরে ওঠা শিরদাঁড়াটার পেছনে যেন।
এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়াল গগাঁ।
ভিনসেন্ট। ছুটে আসছে মত্ত দানবের মতো। হাতে উন্মুক্ত একটা তীক্ষ্ণ ক্ষুর।
দেহমনের সমস্ত সচেতনতা সংহত করে স্থির হয়ে দাঁড়াল গগাঁ। চেয়ে রইল ভিনসেন্টের চোখের দিকে।
মাত্র দু-হাত দূরে থাকতে থমকে দাঁড়াল। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল গগাঁর দিকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর মুখ ঘুরিয়ে দৌড় দিল বাড়ির দিকে
গগাঁ সোজা গিয়ে উঠল একটা হোটেলে। সেখানকার ঘরে ভালো করে দরজা এঁটে বিছানায় গিয়ে আশ্রয় নিল।
ভিনসেন্ট ফিরে গেল তার হলদে বাড়িতে। টকটকে লাল সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছোল তার শোবার ঘরে। দেয়াল থেকে আরশিটা পেড়ে নিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। এই আরশিতে নিজের মুখ দেখে দেখে অনেকবার নিজের পোর্ট্রেট এঁকেছে।
তাকিয়ে রইল তার রক্তবর্ণ দুই চক্ষুর প্রতিচ্ছবির দিকে।
বাকি নেই আর। জীবনের সেই বিরল সুবর্ণক্ষণের পরিসমাপ্তি। বুঝেছে সে, নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে পেয়েছে নিশ্চিত সংকেত।
আর কেন? এইবার বাঁধ ভেঙে দাও।
ক্ষুরটা সে তুলল ডান হাতে। সুতীক্ষ্ণ ইস্পাতের স্পর্শ সে অনুভব করল নিজের চামড়ায় ঠিক কণ্ঠনালীর কাছে।
কথা বলছে কারা? কানের কাছে ভাষাহারা ফিসফিসানি কাদের?
হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেল দু-চোখ। সূর্য! সূর্য! আর্লসের আকাশজোড়া সূর্য ওই গভীর রাতের আকাশকে মন্থিত করে নেমে এল তার দৃষ্টি আর আরশিতে তার ওই প্রতিচ্ছবির সামনে। মুহূর্তে হারিয়ে গেল আত্মপরিচয়।
ডান হাতের একটা ঝটকায় তীক্ষ্ণ ক্ষুর দিয়ে ডান কানটা সে কেটে ফেলল। কানের গোড়াটুকু কেবল আটকে রইল গালের সঙ্গে।
ক্ষুরটা পড়ে গেল হাত থেকে। গাল বেয়ে রক্তের ধারা চুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে। একটা তোয়ালে দিয়ে মাথাটা সে জড়িয়ে নিল।
টেবিল থেকে কাটা কানটাকে হাতে তুলে ভালো করে বেসিনের জলে ধুল। তারপর ড্রয়িং পেপারে সেটাকে মুড়ে নিয়ে মোড়কটাকে আবার মুড়ল পুরোনো খবরের কাগজে।
মাথাভরতি ব্যান্ডেজ বেঁধে তার ওপর চড়াল একটা টুপি। বার হল রাস্তায়। প্লেস লা মার্টিন পার হয়ে চড়াই ছাড়িয়ে গিয়ে পৌঁছোল লুইসের গণিকাগৃহে।
অনেক রাত। দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিতে দিতে সাড়া মিলল। একজন পরিচারিকা এসে দরজা খুলল।
র্যাচেলকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
ও, লাল পাগল, তুমি? এত রাত্রে যে? কী দরকার?
একটা জিনিস এনেছি তোমার জন্যে।
আমার জন্যে? উপহার?
হ্যাঁ, উপহার
কী ভালো তুমি লাল পাগল! কই দাও।
এই নাও। সাবধানে রেখো। মনে কোরো, এই আমার স্মৃতিচিহ্ন!
কী আছে এতে?
খুললেই দেখতে পাবে।
দাঁড়াও তাহলে, খুলি।
মোড়কটা খুলল র্যাচেল।
আতঙ্কবিস্ফারিত চোখে কাটা কানটার দিকে চেয়ে রইল একমুহূর্তের জন্যে; তারপর দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল সংজ্ঞাহারা হয়ে।
ফিরে গেল ভিনসেন্ট আবার তার সেই নিঃসঙ্গ হলদে বাড়িতে। দরজায় খিল দিয়ে ওপরের ঘরে উঠে এসে চোখ বুজোল বিছানায়।
.
পরদিন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ গগাঁ এসে দেখে, হলদে বাড়ির দরজার সামনে ভিড়। রুলিন হাত মোচড়াচ্ছে।
গোল মস্ত টুপি মাথায় একটা লোক গম্ভীর গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করল—কী করেছেন আপনি আপনার বন্ধুর?
কী করেছি? জানি না তো!
জানেন, জানেন। খুব জানেন। আপনার বন্ধু যে বেঁচে নেই, সে-খবরটা আপনার অজানা?
তাকে ঘিরে সমস্ত জনতার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি। দম বন্ধ হয়ে আসে যেন। ভাবতে একটু সময় নিল গগাঁ। তারপর বললে—ওপরে চলুন, ওপরে না গেলে বোঝা যাবে না কিছু।
নীচেকার দুখানা ঘরের মেঝেতে রক্তমাখা ভিজে তোয়ালের রাশ। ওপরে ভিনসেন্টের শোবার ঘর পর্যন্ত সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ধাপে রক্তের রেখা। একগাদা চাদর জড়িয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে নিস্পন্দ ভিনসেন্ট। বেঁচে আছে তো! কম্পিত হাতে গগাঁ তার গাটা স্পর্শ করল। না, গরম রয়েছে, ভয় নেই। একমুহূর্তে গগাঁর চরম আশঙ্কাটা কাটল, আবার শক্তি ফিরে পেল সে।
পাশে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট। গগাঁ বললে—ঘুমুচ্ছে। কিন্তু ওকে খুব সাবধানে জাগাবেন মশিয়েঁ। আমার কথা জিজ্ঞাসা করে তো বলবেন আমি প্যারিসে চলে গেছি। আমার উপস্থিতি ওর পক্ষে মর্মান্তিক হতে পারে।
পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডাক্তারকে খবর দিল আর একটা গাড়ি আনতে পাঠাল। সবাই মিলে ধরাধরি করে ভিনসেন্টকে গাড়িতে তুলল। গাড়ি চলল হাসপাতালে। বুড়ো রুলিন হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটল গাড়ির পেছনে।
৯
হাসপাতালের স্থায়ী ডাক্তারটির নাম ফেলিক্স রে। বেঁটেখাটো শক্তসমর্থ চেহারার মানুষ। ভিনসেন্টের দেহের আহত অংশের শুশ্রূষা করে তিনি তাকে কয়েদখানার মতো ছোট্ট একটা ঘরে পুরলেন। সে-ঘর থেকে অন্য সবকিছু জিনিসপত্র আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে, শুধু একটা বিছানা।
বিকেলে সূর্যাস্তবেলায় ডাক্তার রে ভিনসেন্টের নাড়ি দেখছেন, এমন সময় রোগীর ঘুম ভাঙল। চোখ মেলল ভিনসেন্ট, একবার সাদা ছাদ, তারপর ঘরের সাদা দেয়াল, তারপর জানলার বাইরে ঘন নীল আকাশের দিকে তাকাল। আস্তে আস্তে তার চোখ ফিরে এল ডাক্তার রে-র মুখের ওপর।
ম্লান গলায় বললে—হ্যালো!
ডাক্তার উত্তর দিলেন—হ্যালো।
কোথায় আমি?
শহরের হাসপাতালে।
ও, বুঝেছি।
সহসা উপলব্ধি হল যন্ত্রণা। ডান হাতটা তুললে ডান কানের ক্ষতস্থানটার কাছে। হাতটা চেপে ধরলেন ডাক্তার।
না, ছোঁবেন না এখন।
হ্যাঁ। এখন….এতক্ষণে
মনে পড়েছে।
ক্ষতটা পরিষ্কার। কোনো ভাবনা নেই। ক-দিনেই আবার খাড়া হয়ে উঠবেন।
আমার বন্ধু কোথায়?
প্যারিসে চলে গেছেন।
ওঃ, চলে গেছে….ছেড়ে গেছে আমাকে। আমার পাইপটা?
এখুনি নয়, পরে।
ডাক্তার রে অতটা ভালো করে ধুয়ে মুছে নতুন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন।
ঘাবড়াবেন না আপনি। এটা একটা দুর্ঘটনা, নিতান্ত সামান্য দুর্ঘটনা। কান বলতে আমরা যা বুঝি, গালের দু-ধারে বাঁধাকপির মতো যে দুটো খাড়া হয়ে থাকে, আসলে তা দিয়ে তো আমরা শুনিনে! শ্রবণশক্তি নষ্ট না হলেই হল, কী বলেন? দু-দিন পরেই টেরই পাবেন না—
আপনার দয়ার সীমা নেই ডাক্তার। কিন্তু ঘরটা এমনি একেবারে ফাঁকা কেন?
জিনিসপত্র সব সরিয়ে নিয়েছি, আপনাকে রক্ষা করবার জন্যে।
আমাকে রক্ষা করবার জন্যে। কার হাত থেকে?
আপনার নিজেরই হাত থেকে।
ওঃ হ্যাঁ….বুঝেছি, বুঝেছি বই কী।
আচ্ছা, এবার আমি যাই। আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন, একটুও নড়াচড়া করবেন না। রক্তক্ষয়ে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। রাত্রে পরিচারক এসে খাবার খাইয়ে দিয়ে যাবে। কেমন?
.
পরদিন সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই ভিনসেন্ট দেখে, বিছানার পাশে থিয়ো বসে। আর্ত করুণ তার মুখ, চোখ দুটো লাল।
অস্ফুটস্বরে ভিনসেন্ট ডাকল—থিয়ো!
চেয়ার থেকে নেমে বিছানার ধারে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল থিয়ো, দু-হাতে জড়িয়ে ধরল ভিনসেন্টের হাতটা। নির্লজ্জ তার দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা, লজ্জার বাধা মানল না।
থিয়ো, যখনই তোমাকে আমার বড়ো প্রয়োজন হয়…ঘুম ভেঙে দেখি…ঠিক তুমি আমার পাশে আছ।
উদ্গত অশ্রু দমন করতে চেষ্টা করল থিয়ো। কথা ফুটল না মুখে তার।
থিয়ো, এত কষ্ট করে কেন তুমি এলে? এখানে কে আসতে বলল তোমাকে?
গগাঁ কাল টেলিগ্রাফ করেছিল। তার পেয়েই রাত্রের ট্রেনে রওনা হয়েছিলাম।
ছিঃ ছিঃ, ভারি অন্যায় গগাঁর। এতগুলো টাকা মিছিমিছি খরচ! তারপর আবার….সারারাত ঘুম হয়নি তো? ট্রেনে জেগে ছিলে তো?
তা ছিলাম।
কিছুটা চুপ থাকার পর থিয়ো বললে—ডাক্তার রে-র সঙ্গে আমার কথা হয়েছে ভিনসেন্ট। উনি বলেছেন—এ এমনকিছু নয়, মাথায় রোদ লেগে লেগে হঠাৎ সর্দিগরমির ফল। বাইরে যখন কাজ কর, মাথায় টুপি দাও না, না?
না, দিই না।
তার ফল এই দেখো। এরপর থেকে বাড়ির বাইরে বার হলেই সবসময় মাথায় টুপি দেবে। তবে, কিছু ভয় পেয়ো না তুমি। এমনি সর্দিগরমি আর্লসের লোকের লেগেই আছে। যা গরম!
ভিনসেন্ট থিয়োর হাতে মৃদু চাপ দিল। ঢোক গিলল থিয়ো।
ভিনসেন্ট, তোমাকে দেবার জন্যে একটা খবর আছে। তবে আজ থাক, ক-দিন পরেই জানাব।
ভালো খবর থিয়ো?
মনে তো হয় তোমার ভালোই লাগবে।
ডাক্তার রে এই সময় রোগীর ঘরে ঢুকলেন—কী খবর? কেমন বোধ করছ সকাল বেলায়?
খুব ভালো ডাক্তার। আমার ভাই থিয়ো একটা নতুন খবর আমাকে শোনাতে চায়। খবরটাও খুব ভালো। বলবে?
বেশ তো। আপত্তি কী? তবে, এক মিনিট। ঘা-টা একটু দেখে নিই।…. বাঃ, সুন্দর সেরে আসছে।
ডাক্তার ঘর থেকে যাবার পর থিয়ো বললে—ভিনসেন্ট, আমি বলছিলাম কি….বলছিলাম কিনা….হ্যাঁ, একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।
হ্যাঁ, তা কী হয়েছে তাতে?
আমাদের দেশেরই মেয়ে। হল্যান্ডের। জোহানা বাঙ্গার নাম। অনেকটা যেন আমাদের মা-র মতন তার প্রকৃতি।
ভালোবেসেছ থিয়ো?
হ্যাঁ। প্যারিস ছেড়ে তুমি যখন চলে এলে ভিনসেন্ট, তখন আমার এমন ভয়ংকর একলা লাগত! প্যারিসে তুমি আসার আগে এমন লাগেনি, কিন্তু এক বছর দুজনে একসঙ্গে থাকার পর—
আমাকে নিয়ে থাকা তো তোমার খুব কষ্টকরই হয়েছিল থিয়ো!
কে বললে ভিনসেন্ট? তুমি যদি জানতে তুমি আসার পর কতদিন আমি মনে মনে কত কামনা করেছি—এই বুঝি সন্ধে বেলা রু লেপিকের ফ্ল্যাটে ফিরে দেখব দরজার পাশে তোমার জুতোজোড়াটা আর ঘরে ঢুকে দেখব বিছানার ওপর তোমার সদ্য-আঁকা ভিজে রঙের ছবি! থাক। আমার খবরটা তো শুনলে, এখন আর কথা নয়। চুপটি করে বিশ্রাম করো। আমি আছি তোমার সঙ্গে ক-দিন।
থিয়ো দু-দিন আর্লসে রইল। ডাক্তার রে আশ্বাস দিলেন ভিনসেন্টের সেরে উঠতে আর দেরি হবে না, প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি, তাকে শুধু রোগী বলে নয়, বন্ধু বলে দেখবেন। নিশ্চিন্ত হয়ে থিয়ো প্যারিসে ফিরে গেল।
রোজ সন্ধ্যা বেলা রুলিন ফুল নিয়ে আসতে লাগল। রাত্রে ঘুম আসে না ভিনসেন্টের, জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখে। ডাক্তার রে ঘুমের ওষুধের ব্যবস্থা করলেন।
চারদিন কাটবার পর ডাক্তার রে দেখলেন রোগীর মধ্যে অপ্রকৃতিস্থতার কোনো লক্ষণ নেই, মাথা একেবারে পরিষ্কার। দরজা তালাবন্ধ থাকত বাইরে থেকে, সে তালা তিনি খুলে দিলেন। আসবাবপত্র সাজিয়ে দিলেন ঘরের মধ্যে
ভিনসেন্ট বললে—ডাক্তার, এবার উঠি? নিজে নিজে জামাকাপড় বদলাই?
নিশ্চয়! দুর্বল না লাগে তো একটু হাঁটতেও পারো। তারপর আমার অফিসে এসো।
হাসপাতালটি দোতলা বাড়ি, মাঝখানে চৌকো একটা উদ্যান, তাতে সরু নুড়ি-বসানো পায়ে-চলার পথ আর বর্ণবাহার ফুলগাছের সমারোহ। ভিনসেন্ট কয়েক মিনিট হেঁটে বেড়িয়ে একতলায় ডাক্তার রে-র অফিসে গেল।
বোসো ভিনসেন্ট, বোসো। তারপর নিজের পায়ে আবার দাঁড়াতে কেমন লাগছে?
চমৎকার লাগছে ডাক্তার।
আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি ভিনসেন্ট—এমন কাজ তুমি করলে কেন?
চমকে উঠল ভিনসেন্ট। চুপ করে রইল অনেকক্ষণ, তারপরে বললে—জানিনে ডাক্তার।
আচ্ছা, যখন করলে, তখন কী ভাবছিলে মনে পড়ে?
ভাবছিলাম? না, কিছুই তো ভাবছিলাম না!
আর ক-দিন কাটল। শরীর সেরে উঠল ভিনসেন্টের। একদিন ডাক্তার রে-র ঘরে বসে তাঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে ধোওয়ার বেসিনের পাশের টেবিল থেকে সে একটা ক্ষুর হাতে নিল।
ক্ষুরটা খুলে নিয়ে সে বললে—ওহে ডাক্তার, দাড়িটা তোমার কামানো নেই, কামিয়ে দেব?
চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ডাক্তার রে ঘরের এককোণে গিয়ে আশ্রয় নিলেন, আত্মরক্ষার্তে দু-হাত সামনে ধরে চিৎকার করে উঠলেন—না, না, রেখে দাও, শিগির রেখে দাও ক্ষুরটা!
সত্যি বলছি ডাক্তার, নাপিতের কাজ আমি খুব ভালো পারি। দেখোই না একবার!
ভিনসেন্ট! ভিনসেন্ট! রাখো, রাখো বলছি ক্ষুরটা নামিয়ে! কথা শোনো আমার!
হেসে উঠল ভিনসেন্ট। ক্ষুরটা নামিয়ে যথাস্থানে রেখে এসে বললে– ভয় পেয়ো না বন্ধু, ও-অবস্থা সত্যিই এখন আর আমার নেই।
দ্বিতীয় সপ্তাহ পার হবার পর ডাক্তার রে ভিনসেন্টকে ছবি আঁকার অনুমতি দিলেন। একজন লোক গেল হলদে বাড়ি থেকে ইজেল ক্যানভাস আর রং আনবার জন্যে। রোগীকে ঠান্ডা রাখবার জন্যে ডাক্তার নিজেই হলেন মডেল। রোজ একটু একটু করে ভিনসেন্ট কাজ করতে লাগল। পোর্ট্রেটটা আঁকা শেষ হলে সে সেটা উপহার দিল ডাক্তার রে-কে।
বললে–আমার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এটা তুমি রাখো ডাক্তার। তুমি আমার ওপর কত করুণা করেছ, তার কৃতজ্ঞতা জানালাম এইটুকু দিয়েই।
ডাক্তার বললেন—ভারি চমৎকার হয়েছে ভিনসেন্ট, অনুগৃহীত হলাম আমি।
বাড়ির দেয়ালে কোথায় একটা ফুটো ছিল। ছবিটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে সেটা দিয়ে সেই ফুটোটা ডাক্তার চাপা দিলেন।
আরও দু-সপ্তাহ ভিনসেন্ট হাসপাতালে রইল। এ ক-দিন বড়ো একটা খড়ের টুপি মাথায় দিয়ে হাসপাতালের বাগানে বসে বসে সে আঁকত। দু-সপ্তাহে সারা ফুলবাগানটাকে সে আঁকল।
যাবার দিন হাসপাতালের গেটে ডাক্তার রে ভিনসেন্টের সঙ্গে করমর্দন করলেন। বললেন—মনে আছে তো কী কী বলেছি? কোনোরকম উত্তেজনা চলবে না, আবসাঁত খাওয়া চলবে না, আর খালি মাথায় রোদ্দুরে কাজ করা চলবে না। এ ছাড়া রোজ আমার সঙ্গে একবার করে দেখা করে যাবে।
মনে আছে ডাক্তার। প্রতিজ্ঞা করছি। ধন্যবাদ ডাক্তার সবকিছুর জন্যে।
আমি তোমার ভাইকে লিখে দিচ্ছি যে তুমি একেবারে ভালো হয়ে উঠেছ।
.
আবার হলদে বাড়ি, যে-বাড়ির প্রতিটি দেয়াল তার নিজের হাতে রং করা, প্রতিটি ঘর নিজের হাতে সাজানো। তবে, নিছক একলা আবার।
ভয় করে, রাত্রে বুঝি ঘুম আসবে না। কারা বুঝি সর্বদা ফিসফিস করে কানের কাছে, কারা বুঝি তন্দ্রার কোণে কোণে দুঃস্বপ্ন সেজে উঁকি দেয়। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন, সেটা খুব উপকারে লাগে।
দুর্বলতা কাটেনি, বাইরে বাইরে আগের মতো কাজ করা অসম্ভব। তবে মনে প্রশান্তি ফিরে আসছে, ফিরে আসছে মস্তিষ্কের স্বচ্ছতা। দিনে দিনে ক্ষুধা বাড়ছে, রক্ত বাড়ছে শিরায় শিরায়। একদিন রুলিনের সঙ্গে খুব ফুর্তি করে সে ডিনার খেল। তার পরদিন রুলিনের স্ত্রীর অর্ধেক-আঁকা ছবিটা শেষ করতে বসল।
কাজে মন বসছে, ছবিতে যেভাবে রঙের পর রং চড়াচ্ছে, বেশ ভালোই লাগছে দেখতে।
আস্তে আস্তে শরীর মন সারছে, আস্তে আস্তে আবার মন টানছে কাজকে।
একদিন বিকেল বেলা সে গেল র্যাচেলের ওখানে।
বললে—বকবকম, তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, মাপ করো।
র্যাচেল বললে—কী আর হয়েছে লাল পাগল? ভাবনা কী তোমার? এ শহরে এমনি দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক নয় তো!
বন্ধুবান্ধবও তাকে বলে যে—প্রভেন্সে থাকলে রোগভোগ আছেই, হয় জ্বর নাহয় মাথার দোষ, এ তো অহরহ ব্যাপার।
রুলিনও প্রবোধ দিয়ে বলে—এ মোটেই অস্বাভাবিক নয়, ভিনসেন্ট। এই টারটারিনের দেশে আমরা সবাই তো কিছু-না-কিছু আধপাগল।
ভিনসেন্ট হেসে বললে—যাক, তাহলে সবাই আমরা এক দলে। তাহলে আর ভাবনা নেই।
আরও কয়েক সপ্তাহ কাটল। ভিনসেন্ট এখন অক্লান্তভাবে সারাদিন স্টুডিয়োতে বসে কাজ করতে থাকে।
মত্ততা বা মৃত্যু দুই চিন্তাই তার মন থেকে একেবারে চলে গেছে। স্বাভাবিক হয়ে গেছে সে। আর দেরি নয়, আবার ছবি আঁকতে মাঠে বার হবার সময় এসেছে।
পথে সে আবার বার হল। কিন্তু আঁকতে আর পারে না। সময়ে খেয়ে, সময়ে শুয়ে, সময়ে বিশ্রাম করে বড়ো বেশি স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে সে।
ডাক্তার রে তাকে বলেছিলেন—একেবারে স্বাভাবিক হওয়া তোমার মতো লোকের সম্ভব নয়, কখনও তুমি তা ছিলে না জীবনে। কারণ কোনো শিল্পীই স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের মানুষ নয়। যারা স্বাভাবিক মানুষ, খায়দায় ঘুমোয়, নির্দিষ্ট রুটিন-বাঁধা পেশা নিয়ে জীবন নির্বাহ করে, শিল্পসৃষ্টি তাদের কর্ম নয়। প্রকৃতি আর জীবন এই উভয়কে নিয়ে তোমার অনুভূতির তীব্রতা। সাধারণের বাইরে, তাই তুমি শিল্পী। কিন্তু সাবধান হওয়া তোমার দরকার, নইলে এই অনুভূতির তীব্রতাই শেষপর্যন্ত তোমার সর্বনাশ করবে।
ভিনসেন্ট বোঝে, তার সমস্ত আর্লসের ছবিতে যে প্রজ্বলন্ত হলুদ রঙের বন্যা সে বইয়েছে, সে-বন্যা তার হৃদয়বন্যা। মাথায় আগুন না জ্বললে, অনুভূতির তীক্ষ্ণতার দ্বারা অন্তর যন্ত্রণায় না ভরে উঠলে, ‘উত্তেজনার তীব্রতায় স্নায়ুতন্ত্রীতে ঝংকার না উঠলে এ-সৃজনবন্যা ফুলে ফেঁপে উঠতে পারে না। কিন্তু সেই বন্যার পেছনে আছে আত্মধ্বংসের প্রভঞ্জন।
কী হবে বেঁচে থেকে? সাধারণ হয়ে স্বাভাবিক হয়ে দীর্ঘ জীবন নিয়ে কী লাভ, বিনিময়ে শিল্পীর যদি মৃত্যু হয়?
আবার সে খালি মাথায় প্রান্তরে প্রান্তরে ঘোরে, মাথার মধ্যে সৌরশক্তিকে যেন গ্রহণ করতে চায়। আকাশের বর্ণাঢ্য বর্ণালি আর সৌরগোলকের রক্তরশ্মি, প্রান্তরের সবুজ তরঙ্গ আর পুষ্পমঞ্জরীর বিচিত্র লীলা আকণ্ঠ সে পান করে। প্রভঞ্জন তাকে প্রহার করে আবার, আকাশের আঁধার ভার তাকে করে রুদ্ধশ্বাস, ঊর্ধ্বমুখী। সূর্যমুখী তার হৃদয়বিদারী কল্পনাকে সঞ্চারিত করে দেয় ‘নিঃসীম দিগন্ত প্রান্তে। মানসিক উত্তেজনা যত বাড়ে, দৈহিক ক্ষুধা তত কমে। আবার শুধু কফি আবসাঁত আর তামাক, এই তিনটি বস্তু জুগিয়ে চলে দৈহিক ইন্ধন। রাত্রে ঘুম আসে না, একলা ঘরে অন্ধকারে রক্তবর্ণ অতন্দ্র চোখের সামনে কাতারে কাতারে ভেসে চলে রূপ আর রঙের শোভাযাত্রা।
শিল্পসৃষ্টির পূর্ণ প্রতিভায় বলীয়ান হয়ে ওঠে ভিনসেন্ট। প্রকৃতির বিচিত্র লীলায় চিরন্তন ছন্দের অনুভূতি স্পন্দিত হয় তার প্রাণে, তার সুদৃঢ় কুশলী হাতের ছোঁয়ায় বিরাট বিরাট সাদা ক্যানভাস বর্ণবিহুল ছবিতে রূপান্তরিত হয় একান্ত নির্ভর আত্মনিবেদনে। বাধা নেই, ছেদ নেই, ছবির পর ছবি সে এঁকে চলে। এমনিভাবে মাত্র ক-দিনে একটুও বিশ্রাম না করে পর পর সাঁইত্রিশটি ছবি সে শেষ করে।
শেষরাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছিল একদিন, উঠল গুরুভার ক্লান্তি নিয়ে। কাজ করতে পারে না, উঠতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। চুপ করে বসে রইল চেয়ারে সারাদিন, তাকিয়ে রইল দেয়ালের দিকে। ফিসফিস ফিসফিস, আবার কারা কত অস্ফুট কথা বলতে লাগল কানের কাছে, কারা যেন অন্তরের সুগুপ্ত অবচেতনে হাতছানি দিতে লাগল। দিনশেষে আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বার হয়ে রেস্তরাঁয় গেল। ছোটো একটা টেবিল টেনে বসল। কিছু খাবার অর্ডার দিল।
পরিচারিকা ঝোলের বাটিটি নামিয়ে রাখল সামনে। অজ্ঞেয় জগৎ থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে উঠল কানের কাছে—সাবধান!
এক হাতের ঝটকায় ডিশটা টেবিল থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে ভেঙে গেল খানখান হয়ে। চিৎকার করে উঠল ভিনসেন্ট—বিষ, বিষ! আমার খাবারে বিষ মেশাতে চাস তোরা? বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চাস আমাকে!
এক লাথিতে টেবিলটা উলটে পড়ল। আর্তনাদ করে কয়েক জন খরিদ্দার দৌড় দিল বাইরে। আর সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল তার দিকে।
বড়ো সোজা, না! আমি কানা, আমার চোখ নেই, না? চোখের সামনে আমার ঝোলে বিষ মিশিয়ে দেবে! খুন করতে চাও আমাকে, খুনে খুনে কোথাকার!
দু-দিক থেকে দুজন পুলিশ এসে হাত-পা চেপে ধরল, পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সোজা চালান দিল হাসপাতালে।
চব্বিশ ঘণ্টা যেতে না যেতে আবার স্বাভাবিক অবস্থা। ডাক্তার রে অন্য ব্যবস্থা করলেন। রোজ একটু একটু কাজ করা, কিছু কিছু মাঠে ঘুরে বেড়ানো, আবার দিনান্তে হাসপাতালে এসেই আশ্রয় নেওয়া। কখনও তার অন্তরের এ-পার থেকে ও-পার বিদীর্ণ ব্যথায় রণিত হয়ে ওঠে, কখনও-বা কোন অধরা যবনিকা মুহূর্তের জন্যে সরে যায়, শিউরে ওঠে আপন ভবিষ্যৎ ভাগ্যের কল্পরূপ দেখে।
ডাক্তার রে তাকে অনুমতি দিয়েছেন আঁকতে। একটা দৃশ্য সে আস্তে আস্তে আঁকল, রাস্তার ধারে পিচ গাছের একটি উদ্যান, পেছনে আলপস পর্বতমালা। আর-একটি ছবি একটি অলিভ কুঞ্জের, পাতাগুলি রুপোলি সবুজ, সেইসঙ্গে লাঙল-চষা মাটি, যার রং কমলা।
তিন সপ্তাহ হাসপাতালে কাটাবার পর ভিনসেন্ট আবার হলদে বাড়িতে ফিরে এল। এরই মধ্যে সারা শহর, বিশেষ করে প্লেস লা মার্টিন অঞ্চল তার বিরুদ্ধে খেপে উঠেছে। যে-লোক একবার নিজের কান নিজের হাতে কেটেছে আর সাধারণ ভোজনাগারে খেতে বসে বিষ বিষ’ বলে হাউহাউ করে উঠেছে, তার পাগলামিটা চোখ বুজে মেনে নিতে প্রতিবেশীরা নারাজ। আর্লসবাসীদের দৃঢ় ধারণা ছবি আঁকলে লোকে পাগল হয়। তাকে দেখলে আশপাশের লোকে কানাঘুষো করে, কখনও-বা প্রকাশ্যে কোনো কথা ছুড়ে মেরে দূরে সরে যায়। শহরের রেস্তরাঁতে তার ঢোকা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
এর সঙ্গে শুরু হয়েছে এক নতুন আপদ। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা হলদে বাড়ি ঘিরে তাকে খেপাতে শুরু করেছে। তারা সবাই মিলে তারস্বরে চেঁচায়—লাল পাগল, লাল পাগল, তোমার আর-একটা কান দাও।
ভিনসেন্ট দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে থাকে। তবু ফাঁক দিয়ে শিশুদের চিৎকার আর হাসি তিরের মতো কানে এসে বিঁধে—লাল পাগল! লাল পাগল! আর-একটা কান দাও।
বাচ্চারা ছড়া বানিয়েছে তার নামে। ভিনসেন্ট জানলার ধারে এলে সমস্বরে
তারা সুর করে গায় :
লাল পাগল, লাল পাগল,
কানটা কেটেছে,
যতই চেঁচাও, ভাবছ বুঝি
শুনতে পাবে সে?
ভিনসেন্ট ঘরে তিষ্ঠোতে পারে না। ছুটে পথে বার হয়। বাচ্চারা পথে পথে আর পথ থেকে মাঠে মাঠে তার পেছনে পেছনে দৌড়োয় আর চিৎকার করে। পাগল খেপিয়ে তাদের ক্লান্তি নেই, ফুর্তির শেষ নেই।
দিনের পর দিন ছেলেরা দলে ভারী হয়, অসহ্য হয় তাদের সমস্বর। ভিনসেন্ট কানে তুলো এঁটে বন্ধ ঘরে বসে নিজের পুরোনো ছবির কপি করতে চেষ্টা করে, পারে না কিছুতে। তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মতো ওদের চিৎকার ওর মাথার মধ্যে গিঁথে গিঁথে যায়।
ক্রমে এইসব শিশুগুন্ডাদের সাহস বাড়ে। বানরের মতো তারা জলের নল বেয়ে দোতলায় ওঠে, জানলার চৌকাঠের ওপর বসে ঘরের মধ্যে উঁকি মারে। দল বেঁধে চিৎকার করে—লাল পাগল, কানটা কেটে দাও, কানটা কেটে দাও!
পাগল খেপানোর উৎসাহ সংক্রামক। সারা প্লেস লা মার্টিনে যেন উৎসব লেগেছে। কাঠের মই লাগিয়ে ছেলেরা উঠেছে দোতলায়। জানলার খড়খড়ি শার্সি ভেঙেছে, এটা-ওটা ছুঁড়ে মারছে পিঞ্জরাবদ্ধ উন্মাদটার গায়ে। নীচে রাস্তার ওপর অসংখ্য লোকের ভিড়। হইহই করে তারা ছেলেদের উৎসাহ দিচ্ছে, চেঁচাচ্ছে ছেলেদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে লাল পাগল! কই, তোমার আর-একটা কান
ও পাগল, কলা খাবে? বিষ মাখানো কিন্তু!
ও পাগল, ঝোল খাবে? বিষ মেশানো কিন্তু!
লাল পাগল, লাল পাগল,
কানটা কেটেছে,
যতই চেঁচাও, ভাবছ, বুঝি
শুনতে পাবে সে?
ও পাগল, কালা নাকি? সত্যি শুনতে পাও না?
ছোটো বড়ো সবাই একসঙ্গে হাসছে নাচছে, চিৎকার করছে ছড়া কেটে কেটে
লাল পাগল লাল পাগল,
কানটা ছুড়ে দাও।
লাল পাগল, লাল পাগল,
কানটা ছুড়ে দাও!
লাফিয়ে উঠল ভিনসেন্ট ইজেলের ধার থেকে। জানলায় তিনটি ছেলে বসে। তাড়া করে গেল তাদের দিকে। মই বেয়ে তারা আর্তধ্বনি করতে করতে থামল। রাস্তার চিৎকার আরও বেড়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ভিনসেন্ট চেয়ে রইল ওই জনতার দিকে।
হঠাৎ আকাশ থেকে নেমে এল অসংখ্য কর্কশ কাকের মতো কালো কালো –ছায়ার পাল, আচ্ছন্ন করল তারা সামনের দৃশ্য, ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা ভিনসেন্টের মাথায়, কেউ ঢুকল মুখে, কেউ ঢুকল নাকে, কেউ ঢুকল কানে, কেউ ঘুরতে লাগল চুলের গোড়ায় গোড়ায়, আচ্ছন্ন করল মস্তিষ্ক, ঘন কালো ছায়ার আস্তরণে ঢেকে ফেলল সমস্ত চৈতন্য।
জানলার চৌকাঠের ওপর লাফিয়ে দাঁড়াল ভিনসেন্ট।
চলে যা, দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে শয়তানের দল, শান্তিতে থাকতে দে আমাকে!
উত্তরে খলখল হাসি আর চিৎকার—লাল পাগল, লাল পাগল, কানটা ছুঁড়ে দাও!
চলে যা, দূর হয়ে যা, আপদ! দে, দে, একলা থাকতে দে আমাকে! দিবিনে? তবে? মারব! খুন করব! আমার সঙ্গে চালাকি?
টেবিল থেকে হাত ধোওয়ার বেসিনটা তুলে ভিনসেন্ট ছুড়ে মারল নীচে। রাস্তার পাথরের ওপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল সেটা। শব্দটা যেন দেশলাই-এর কাঠি, একেবারে আগুন জেলে দিল। উন্মত্ত আক্রোশে সে ঘরের মধ্যে হাতের কাছে যা পায় তা-ই ছুড়ে ছুড়ে ফেলতে লাগল জানলা দিয়ে পথের লোকদের মারবার জন্যে। চেয়ার গেল, ইজেল গেল, আরশি, পর্দা, টেবিল, বিছানা সব একের পর এক। দেয়াল থেকে খসিয়ে নিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেলতে লাগল ছবির পর ছবি। কতদিন কত আশায় সে একটু একটু করে সাজিয়েছিল তার বাড়ি, তার স্বপ্নের শিল্পনিকেতন, প্রতিটি মিনিটের সঙ্গে সঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে লাগল তার কত আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর্লসের জনতা-ভরা পথে জমতে লাগল তার ব্যর্থ জীবনস্বপ্নের ভগ্নস্তূপ।
সারা ঘর যখন খালি হয়ে গেল, তখন সে আবার উঠে দাঁড়াল জানলার চৌকাঠে। হাত পা, শরীরের প্রতিটি স্নায়ু থরথর করে কাঁপছে। মূর্ছিত হয়ে উলটে সে পড়ল। মাথাটা ঝুলতে লাগল পাথর-বাঁধানো রাস্তার দিকে।
১০
মুহূর্তে নব্বইজন নাগরিক স্ত্রী-পুরুষের আবেদন গেল আর্লসের মেয়রের কাছে:
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ২ নং প্লেস লা মার্টিনের বাসিন্দা ভিনসেন্ট ভ্যান গক একজন বদ্ধউন্মাদ। তাকে মুক্ত অবস্থায় রাখা সাংঘাতিক বিপজ্জনক। এখনই এই উন্মাদকে বন্দি করা হোক।
পুলিশ এল। জানলার চৌকাঠ থেকে ভেতর দিকে গড়িয়ে এসে ভিনসেন্টের অচৈতন্য দেহ ঘরের মেঝেতে লুটোচ্ছে। সেই অবস্থায় তাকে তুলে নিয়ে জেলখানার একটা সেলে আবদ্ধ রাখা হল। তালাবন্ধ দরজার সামনে খাড়া রইল একজন প্রহরী।
জ্ঞান ফিরে আসতে ভিনসেন্ট চাইল ডাক্তার রে-র সঙ্গে দেখা করতে বা ভাই থিয়োকে চিঠি লিখতে। অনুমতি মিলল না।
অনেক কষ্টে ডাক্তার রে জেলখানায় প্রবেশের অনুমতি পেলেন। বুঝিয়ে বললেন—প্রাণপণে নিজেকে সংযত করবার চেষ্টা করো ভিনসেন্ট। এরা যদি প্রমাণ করতে পারে যে তুমি একজন বিপজ্জনক উন্মাদ, তাহলে আর তোমার রক্ষা থাকবে না। আমি তোমার ভাইকে ইতিমধ্যে চিঠি লিখছি আর এখান থেকে তোমাকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছি।
তোমার পায়ে পড়ি ডাক্তার, থিয়োকে তুমি এখানে আসতে লিখো না! দু-দিন পরেই ও বিয়ে করছে। ওর জীবনের এত বড়ো আনন্দটা যেন আমার জন্যে মাটি হয়ে না যায়!
বেশ, তা-ই হবে। দেখি তোমার জন্যে আর-কোনো ভালো প্ল্যান আমি বার করতে পারি কি না।
দু-দিন পরে ডাক্তার রে আবার এলেন।
শোনো ভিনসেন্ট, তিনি বললেন—এইমাত্র দেখে এলাম তোমার বাড়িওয়ালা তোমার বাড়িতে তালা আঁটছে। তোমার ছবিগুলো সে আটকেছে, অন্য মালপত্র একটা কাফের পেছনদিকের গুদামে বন্ধ করেছে। বাকি ভাড়া মিটিয়ে না দিলে তোমার ছবি বা জিনিসপত্র কিছুই সে ছাড়বে না।
ভিনসেন্ট চুপ করে রইল।
ডাক্তার রে বলে চললেন—ওখানে যাওয়া আর তোমার চলবে না। আমার মনে হয় আমার পরিকল্পনাটা তোমার নেওয়া উচিত। মৃগীরোগ তোমার, এইরকম মূর্ছা আবার কখন যে তোমার হবে, ক-বার হবে, তা কেউ বলতে পারে না। যদি খুব শান্ত পরিবেশের মধ্যে বিনা উত্তেজনায় দিন কাটাতে পার, তাহলে এই হয়তো শেষ, তা না হলে দু-এক মাস পরে আবার হয়তো রোগের নতুন আক্রমণ হবে। তোমার নিজেকে বাঁচানোর জন্যে, অপর সকলকে বাঁচানোর জন্যে আমার তো মনে হয় তোমার যাওয়া উচিত—
কোথায় ডাক্তার রে? পাগলাগারদে?
ধরো, কোনো উন্মাদ-আশ্রমে।
তাহলে ডাক্তার, তুমি বলছ, সত্যিই আমি পাগল হয়ে গেছি!
না, তা আমি বলছিনে। তুমি নিজেই দেখতে পাচ্ছ, আমি যেমন প্রকৃতিস্থ তুমিও তেমনি প্রকৃতিস্থ। কিন্তু মৃগীরোগের এমনি মুর্ছা হঠাৎ জ্বরের মতো। সাময়িক উম্মত্ততা আসে বই কী। তখন লোকে অস্বাভাবিক কাজ করে বসে নিজেরই অজান্তে। সেইজন্যেই তোমার এমন জায়গায় আশ্রয় নেওয়া উচিত যেখানে বিপদের সময় তোমাকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। বুঝেছ?
বুঝলাম ডাক্তার।
এখান থেকে ঠিক পঁচিশ কিলোমিটার দূরে সেন্ট রেমিতে এমনি একটা ভালো জায়গা আছে। জায়গাটার নাম সেন্ট পল দ্য মসোল। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির রোগী তারা নেয়। তৃতীয় শ্রেণির রোগীর জন্যে মাসিক খরচ মাত্র একশো ফ্র্যাঙ্ক। এ-খরচটা তুমি চালিয়ে নিতে পারবে! জায়গাটা আগে ছিল একটা সাধুদের মঠ, ঠিক পাহাড়ের গায়ে। ভারি নির্জন শান্ত পরিবেশ, খুব ভালো লাগবে তোমার। ডাক্তার থাকবে তোমাকে উপদেশ দেবার জন্যে, সিস্টার থাকবে তোমাকে দেখাশুনো করবার জন্যে। পুষ্টিকর জিনিস খেতে পাবে, ক-দিনে একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি।
আঁকতে পারব সেখানে?
নিশ্চয়ই। যা খুশি তা-ই করতে পারবে, কেবল নিজের পক্ষে যেসব কাজ ক্ষতিকর সেইসব কাজ ছাড়া। উন্মাদাগার বলে মনেই হবে না। মস্ত মাঠের মধ্যে ঠিক যেন একটা হাসপাতাল। এক বছর সেখানে বিশ্রাম করলে তুমি একেবারে নতুন মানুষ হয়ে ফিরে আসবে।
কিন্তু এই কয়েদ থেকে মুক্তি পাব কী করে ডাক্তার?
সে তুমি ভেবো না। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আমার কথা হয়ে আছে। আমি যদি সেন্ট রেমিতে তোমাকে নিয়ে যাই, তাহলে তোমাকে ছেড়ে দিতে তাঁর আপত্তি নেই।
তুমি বলছ জায়গাটা ভালো?
ভালো বলে ভালো? চমৎকার! ছবি আঁকার কত খোরাক যে সেখানে পাবে তার ঠিক নেই।
যাব তাহলে। মাসে একশো ফ্র্যাঙ্ক বেশি নয়। হয়তো বছর খানেক পাগলাগারদে থাকাই আমার মঙ্গল, মাথাটা তাতে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হবে।
তোমার ভাই থিয়োকে সব কথা খুলে লিখেছি। লিখেছি তোমাকে নিয়ে আমি কী করতে চাই, এও বলেছি প্যারিস পর্যন্ত তোমাকে নিয়ে যাওয়া এখন অসম্ভব।
বেশ। থিয়ো রাজি হলেই হল। ওর ঝঞ্ঝাট আর আমি বাড়াতে চাইনে।
ডাক্তার রে-র সঙ্গে ভিনসেন্ট চলল আর্লস ছেড়ে, জীবনের মতো। ট্রেন চলল টারাসকনে। সেখান থেকে ছোটো ব্র্যাঞ্চ লাইনে সেন্ট রেমি।
স্টেশন থেকে সেন্ট পল দ্য মসোল অনেকটা পথ। পাহাড়ের একটা দীর্ঘ খাড়াই পার হতে হয়। কালো কালো পর্বতমালার গা বেয়ে রাস্তায় চলল ডাক্তার রে আর ভিনসেন্টকে নিয়ে ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি। দূরে চোখে পড়ে সেই মঠের পিঙ্গল রঙের প্রাচীর, যেখানে তারা চলেছে। মঠের কাছাকাছি আশেপাশে প্রাচীন রোমকদের নানা ভগ্নস্তূপ।
রাস্তার ধারেই মজবুত লোহার গেট। দু-ধারে পাইন গাছ। গেটের গায়ে লোহার একটা ঘণ্টা। ডাক্তার রে সেটা বাজালেন। ডাক্তার পেরন এসে গেটটা খুললেন।—কেমন আছেন ডাক্তার পেরন? আপনাকে চিঠি লিখেছিলাম, পেয়েছেন তো? সেইমতো আমার বন্ধু ভিনসেন্ট ভ্যান গককে সঙ্গে এনেছি। এবার থেকে আপনার হাতেই এর ভার।
ঠিক আছে ডাক্তার রে, ভার আমি নিলাম। কিছু ভাববেন না আপনি।
তাহলে আমি যদি তাড়াতাড়ি বিদায় নিই কিছু মনে করবেন না ডাক্তার পেরন? টারাসকনের ফিরতি ট্রেনটা এখুনি গেলে ধরতে পারব।
নিশ্চয়ই, ডাক্তার রে।
ডাক্তার রে বিদায় নিলেন। বললেন—বিদায় ভিনসেন্ট। খুব ভালো থাকবে এখানে। সেরে উঠবে। সময় পেলেই আমি এসে তোমাকে দেখে যাব। এক বছরের মধ্যেই তুমি নতুন মানুষ হয়ে উঠবে, এ আমি বলে দিলাম।
ধন্যবাদ ডাক্তার। অসীম তোমার অনুগ্রহ। হ্যাঁ বিদায়!
ডাক্তার রে-র গাড়ি অদৃশ্য হল।
গেট ছেড়ে একধারে দাঁড়িয়ে ডাক্তার পেরন বললেন—ঢোকো ভিনসেন্ট।
পা বাড়াল ভিনসেন্ট।
বন্ধ হয়ে গেল উন্মাদনিকেতনের মজবুত লোহার দরজা।