আর্ফিউসের ভুল
অ্যাম্বুলেন্সের লাল আলো জ্বলছে নিভছে। তাতে অন্ধকারটাকে আরও গাঢ় মনে হচ্ছে। তাকিয়া মহলের পুরো আঙিনাতে পুলিশের তৎপরতা। স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা এখনও তাকিয়া মহলের মূল ভবনের ভেতরে তল্লাশি চালাচ্ছে।
খাইরুল আর মেরিলিনা প্রাচীরের গা ঘেঁষে এগোচ্ছে। পায়ের নিচের ঝোপঝাড় ভাঙার খড় খড় শব্দ হলেও কিছু করার নেই। হওয়ার ওই একটাই রাস্তা আছে। কয়েকটা পুলিশ এলোমেলোভাবে টর্চের আলো ফেলে এদিকে ওদিকে খুঁজছে।
মেরিলিনা ফিসফিস করে প্রশ্ন করল, “তালা তো ফিরোজ বদলে ফেলেছিল, আপনি চাবি দিয়ে কিভাবে খুললেন?”
খাইরুল অন্ধকারে মুচকি হেসে বললেন, “তালেব আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। তালেব গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল। চাবি যে বদলে ফেলা হয়েছে তা সে দেখে গিয়েছিল। তাই প্রাচীরের পাশে একটা গর্ত করে যায়। সেই গর্ত ঝোপ ঝাড় দিয়ে ঢেকে দেয়। সেই গর্ত দিয়েই আমি ঢুকি। তারপর তোমাকে আর ফিরোজকে দেখতে পাই। তোমাদেরকে অনুসরণ করি।”
মেরিলিনা বুঝল, তখন কেন ফিরোজ বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আশেপাশে কেউ আছে। লোকটার জন্য একটু মন খারাপ করল তার। একটা খুনিকে সে একটু আগেই খুন করে আসল। তাহলে সে কি খুনি না? এই মুহূর্তের মেরিলিনা যার হাত ধরে আছে সে কি খুনি না? দিন শেষে সবগুলো চরিত্রই খুনি ফিরোজ খুনি। ফিরোজকে খুন করে খাইরুল খুনি। বশির খুনি আর বশিরকে খুন করে মেরিলিনা খুনি। মেরিলিনা প্রাণপণে নিজের স্বপক্ষে একটা যুক্তি দাঁড় করাতে চাইল।
হঠাৎ খাইরুল বলল, “সর্বনাশ”
“কী হয়েছে?” মেরিলিনা চমকে উঠে বলল।”গর্তের ওপাশে পুলিশের ভ্যান। বের হলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাব।”
মেরিলিনা বলল, “আমার সাথে আসেন।”
“কোথায়?”
“আসেন তো।”
মেরিলিনা আর খাইরুল ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে প্রধান ফটকের কাছে যেতে থাকল। একটু পরেই স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা বাড়ির আঙিনা তল্লাশী শুরু করবে। তাদের তল্লাশী পুলিশদের মত অগোছাল হবে না। সময় নেই হাতে। স্পেশাল ফোর্সের তল্লাশী শুরুর আগেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।
প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে সময়ের পিঠে চড়ে। ধরা পড়লে রক্ষা নেই। পুলিশের টর্চের আলো থেকে বাঁচতে রীতিমত যুদ্ধ করছে খাইরুল আর মেরিলিনা।
কুকুরের কর্কশ গর্জন শুনতে পেল দুজনেই। খাইরুল মেরিলিনার হাত খামচে ধরে বললেন, “ওরা ডগ স্কোয়াড এনেছে।”
আতঙ্কে দুজনেই জমে পাথর হয়ে গেল। সমীকরনটা এখন আরও বেশি জটিল হয়ে গেল। স্পেশাল ফোর্সের ডগ স্কোয়াড মৃত মানুষের আত্মাকেও খুঁজে বের করতে পারে!
মেরিলিনা দেখল, কয়েক গজ দুরেই তিনটা লাশের স্ট্রেচার রাখা আছে। তাতে তিনটা লাশ ঢাকা। মেরিলিনা ঝোপের ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে লাশ তিনটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেন। ফিসফিস করে খাইরুলকে বলল, শোনেন, ওই লাশ তিনটা এম্বুলেন্সে নিয়ে যাবে। আপনি একটা স্ট্রেচারে উঠে পড়বেন আর আমি একটা স্ট্রেচারে উঠে পড়ব। অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত যাওয়ার পরে ভেবে দেখা যাবে কী করা যাবে। আমার মনে হয় এখান থেকে বের হওয়ার এর থেকে ভালো উপায় এই মুহূর্তে নেই।
খাইরুলের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিলো। তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। কুকুরের গর্জন আরও কাছে সরে আসছে।
স্ট্রেচারের কাছেই একটা পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। স্ট্রেচারের ওপরে টর্চের আলো ফেলে কি যেন লিখছিল। পুলিশটাকে সরাতে হবে। মেরিলিনা একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে উল্টোদিকের ঝোপের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলল।
কাজ হল। পুলিশটা পেছনে তাকিয়ে ঝোপটার দিকে এগিয়ে গেল।
আশপাশটা দেখে নিয়ে মেরিলিনা একটা লাশের কাফন সরিয়ে সেটাতেই শুয়ে পড়ল। একটু পরে খাইরুল ঝোপ থেকে বেরিয়ে পাশের স্ট্রেচারের কাফন সরিয়ে শুয়ে পড়লেন।
কিছুক্ষণ পরেই দুইজন সাদা ইউনিফর্ম পরা লোক স্ট্রেচার দুটো তুলে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে যেতে শুরু করল। মেরিলিনা আবিষ্কার করল, সে যে লাশের স্ট্রেচারে শুয়েছে, সেটা আর কেউ না, বশির। গা ঘিনঘিন করে উঠল মেরিলিনার। রক্তমাখা জায়গাগুলো ব্যান্ডেজের কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকলেও মেরিলিনার বমি পেতে লাগল। ওদিকে খাইরুল নিখিলের লাশের ওপরে শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। বিশাল শরীরটা যেন পাথর আঁটা বস্তা।
আশেপাশে কোলাহল বাড়তে শুরু করল। এলোমেলো কথা শুনে খাইরুল বুঝতে পারলেন, স্পেশাল ফোর্স আঙিনা তল্লাশী শুরু করেছে। হঠাৎ তিনি কুকুরের ডাক শুনতে পেলেন। একটা না, কয়েকটা। খুব কাছে।
খাইরুল মেরিলিনাকে বলতে চাইল, অস্থির না হতে। কিন্তু ততক্ষণে মেরিলিনার স্ট্রেচারটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। তিনি কাফন উঁচু করে দেখলেন, ডগ স্কোয়াডের তিনটা কুকুর নিয়ে তিনজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ঠিক করলেন, এদিক ওদিক কিছু একটা হলে গুলি চালাবেন। এছাড়া আর কোন উপায় নেই। পালানোর চেষ্টা এই আঙিনায় বৃথা। পুলিশে গিজগিজ করছে। এলিট ফোর্সের সদস্যরা অবশ্য সবাই এখনও তাকিয়া মহলের মূল ভবনের ভেতরে।
কুকুরের গর্জন বাড়তে শুরু করল। চাপা গর্জন। স্ট্রেচারটা যতই কুকুরগুলোর কাছে যাচ্ছে ততই কুকুরগুলোর গর্জন বাড়ছে। খাইরুল রিভলভাবের ট্রিগারে আঙুল রাখলেন। আর মাত্র কয়েক মিটার। তারপরেই মূল ফটক। খাইরুলের হৃৎপিণ্ডটা বুকের ভেতরে ধড়াস ধড়াস করতে শুরু করল। মেরিলিনা চিৎকার দিয়ে উঠলে সব শেষ।
হঠাৎ একজন পুলিশ খেঁকিয়ে উঠল, “ওই মরার কুত্তা খ্যাপে ক্যান। ওই কুত্তা। পলাশ ভাই। পলাশ ভাই। পলাশ ভাই কই গেল?”
খাইরুল বুঝতে পারলেন, এদের হাতে কুকুর থাকলেও এরা ডগ স্কোয়াডের কেউ না। পলাশ নামের ভদ্রলোক আসতে আসতে স্ট্রেচার দুইটা গেট পেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের কাছাকাছি পৌঁছে গেল।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন খাইরুল। গলার কাছে জমে থাকা চিৎকারটা মেরিলিনাও গিলে ফেলল।
স্ট্রেচার দুইটা অ্যাম্বুলেন্সে রেখে সাদা ইউনিফর্ম পরিহিত লোকগুলো এক পাশে সরে দাঁড়ালো। একটা অচেনা লোকের কণ্ঠ শুনতে পেলেন খাইরুল। কণ্ঠটা বলল, “অ্যাম্বুলেন্স সোজা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাবে। ঠিক আছে? আমি আসছি। তোমরা রওনা হও।
খাইরুল বুঝতে পারলেন, অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। এই লাশগুলো এখন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের যাবে, মর্গে না। আর হেডকোয়ার্টার্সে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। কেউ একটা কথা বলারও সময় দেবে না। কারণ ফিরোজকে গুলি চালিয়েছে খাইরুল।
অ্যাম্বুলেন্সের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। অ্যাম্বুলেন্সটা স্টার্ট নিল। রওনা হয়ে গেল রাজধানীর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে। মেরিলিনা কাফনের কাপড় সরিয়ে কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিলো, খাইরুল চাপা স্বরে বললেন, “কাফন সরিও না। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকতে পারে। কিছু বলবে?”
মেরিলিনা ফিসফিস করে বলল, “থ্যাংক ইউ”।
খাইরুল একটা শুকনো হাসি হাসলেন। এই মেয়েটা জানেও না যে কত বড় বিপদের মধ্যে তারা দুইজন পড়েছেন। যেভাবেই হোক এই অ্যাম্বুলেন্স থেকে বেরোতে হবে।
ধীরে ধীরে অ্যাম্বুলেন্সটা বহরমপুর শহর পেরোতে শুরু করল। খাইরুল পা বাড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্সের দরজার নবটা ঘোরাতে চেষ্টা করলেন। কিছুটা ঘুরে নবটা আটকে গেল। মানে দরজাটা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। সর্বনাশ! তারা দুইজন এখন এই অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে বন্দী। খাইরুল সাহেবের মাথার ভেতরে চিন্তার ঝড় বইতে শুরু করল। দ্রুত এই অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের হতে হবে।
অ্যাম্বুলেন্সের গতি হঠাৎ করেই কমে গেল। একটা কোলাহল শুনতে পেলেন খাইরুল। কোলাহলটা আস্তে আস্তে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে এগিয়ে আসছে। খাইরুল কাফন সরিয়ে দেখে নিলেন কোন সিসিটিভি ক্যামেরা আছে কিনা অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে। নেই। তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন। তারপর জানালা দিয়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন কিসের কোলাহল।
জনতার মিছিল। কারফিউ ভেঙে সাধারণ জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। পালানোর এই সুযোগ। খাইরুল মেরিলিনাকে বললেন, “মানসিক ভাবে…’”
খাইরুলের কথা শেষ হল না। মেরিলিনা খাইরুলের বাহু খামচে ধরে কেঁপে উঠল। তার দৃষ্টি জানালার দিকে।
“কী হয়েছে? কী?”
মেরিলিনা বলল, “এই লোকটা আমার বাবার সাথে কাজ করত। লোকটা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। প্লিজ, প্লিজ আপনি আমাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের হতে বলবেন না। বের হলে আমাদের দুইজনকেই লোকটা শেষ করে দেবে। লোকটা আমাদেরকে ফলো করেছে। আমাদের মেরে ফেলার জন্যই ফলো করেছে
খাইরুল অধৈর্য্য হয়ে বললেন, “কে? কে শেষ করে ফেলবে?”
“লোকটা।” মেরিলিনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ অ্যাম্বুলেন্সের জানালায় লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি আমি।”
খাইরুল বললেন, “কিচ্ছু হবে না। চল তো। চল।”
জনতার মিছিল অ্যাম্বুলেন্সের কাছাকাছি চলে আসল একেবারে। অ্যাম্বুলেন্সের হর্ন বাজতে লাগল ঘন ঘন।
খাইরুল অ্যাম্বুলেন্সের দরজায় ভেতর থেকে খুব জোরে জোরে ধাক্কা দিলেন। অ্যাম্বুলেন্সটা থেমে গেল। খাইরুল হাঁটু গেড়ে বসে মেরিলিনার দিকে তাকিয়ে ইশারায় শাস্ত থাকতে বললেন। এখনি সামনে বসে থাকা লোকগুলো দেখতে আসবে কিসের শব্দ হল। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে হবে।
অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলে গেল। সাদা ইউনিফর্ম পরা একজন লোক এসে দরজা খুলেছে। খাইরুল বিদ্যুতগতিতে লোকটার কপালে রিভলভার দিয়ে একটা বাড়ি মারলেন। লোকটা কপাল চেপে ধরল। একটা আর্তনাদ করে সে বসে পড়ল। খাইরুল মেরিলিনার হাত ধরে নেমে পড়লেন অ্যাম্বুলেন্স থেকে।
ভিড়। মিছিল। মিছিলের কয়েকজন অবাক চোখে এই ঘটনা দেখলেও কেউ যেন গায়ে মাখল না। সবার মুখে স্লোগান- “এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে করতে হবে।”
খাইরুল মেরিলিনার হাত ধরে মিছিলের বিপরীতে যেতে শুরু করলেন।
মেরিলিনা চিৎকার করে বলল, “ওই তো। ঐ তো লোকটা। ওই যে।”
খাইরুল পেছনে তাকালেন। বললেন, “কোথায়? কই?”
তিনি কাউকেই দেখতে পেলেন না। এমনিতে পুরো মিছিলটা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। আলো বলতে ল্যাম্পপোস্টের আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই। কোলাহল মাখা মিছিলেও কেমন যেন থমথমে আবহ। যেন কবর থেকে মৃতরা উঠে এসে জীবিতদের বিরুদ্ধে মিছিলে নেমেছে।
খাইরুল আর মেরিলিনা মিছিলের বিপরীতে ভিড় ঠেলে যেতে শুরু করল।
খাইরুল বললেন, “মেরিলিনা, তাড়াতাড়ি হাঁটো। একটু পরে পুলিশ আসবে। গুলিও চলতে পারে। মিছিলের ভেতরে থাকা যাবে না। কোন একটা গলিতে ঢুকে পড়তে হবে। রাস্তায় থাকা যাবে না একদম।”
মেরিলিনাকে অবশ্য এগুলো না বললেও হত। সে খাইরুলের থেকেও তাড়াতাড়ি হাঁটছে। ভিড়ের ভেতরে ধাক্কা খেতে খেতে অন্ধের মত সামনে এগোচ্ছে।
লোকটার ছায়া দেখতে পেল মেরিলিনা। ভিড়ের ভেতরে লোকটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েকগজ। আতঙ্কে মেরিলিনার চোখের আইরিশ বড় হয়ে গেল। কারণ লোকটার হাতে একটা কুড়াল!
খাইরুল হাতে একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করলেন। মেরিলিনা কিসে যেন পা হড়কে পড়ে গেল। মেয়েটাকে তুলতে গিয়ে হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেলেন খাইরুল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাতাসে বোঁ করে একটা শব্দ হল। মেরিলিনাকে টেনে তুলতে গিয়ে নিজেই পড়ে গেলেন। মুহূর্তেরও কম সময়ের ভেতরে থ্যাচ করে একটা শব্দ হল। আর্তনাদ শুনতে পেলেন। আশেপাশের সবাই আর্তনাদ করে উঠল। তিনি অন্ধকারে দেখতে পেলেন, একটা বিশালদেহী লোক ভিড়ের ভেতরে একটা মানুষের পাঁজরে কুড়াল দিয়ে কোপ বসিয়ে দিয়েছে। লোকটা ছটফট করছে। আর কুড়ালধারী লোকটা কুড়ালটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
কোপটা যে তাকে উদ্দেশ্য করেই দেওয়া হয়েছিল তা আর বুঝতে বাকি থাকল না খাইরুলের।
এই সুযোগে তিনি লোকটার উরু বরাবর একটা লাথি কষলেন। লাথিটা যেন একটা পাথরের দেয়ালে গিয়ে পড়ল। খাইরুল বুঝলেন, এখানে লড়াই করতে যাওয়া বৃথা। পালাতে হবে।
খাইরুল মেরিলিনাকে জাপটে ধরে টানতে লাগলেন। মেয়েটা আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। এদিক ওদিকে ছুটে পালাচ্ছে মানুষ!
মোড়ের মাথায় দুটো পুলিশের ভ্যান এসে দাঁড়ালো। ভ্যান থেকে মাইকে কিছু বলার আগেই দেখা গেল মিছিল ভেঙে যাচ্ছে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ এদিকে ওদিকে পালাচ্ছে।
মেরিলিনাকে কোন রকমে টেনে নিয়ে পাশের একটা গলিতে ঢুকে পড়লেন খাইরুল। কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়েছে মেরিলিনা। লোকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ছুটতে থাকা মানুষের ভেতরে হারিয়ে গিয়েছে। খাইরুল মেরিলিনার হাত ধরে একরকম দৌড়াতে শুরু করলেন। অন্ধকার গলির শেষ মাথায় আলো। আর একটু।
একটা তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠলেন খাইরুল। ঝাপসা চোখে দেখলেন, তার উরুতে কুড়ালের ফলা বিঁধে আছে। লোকটা কুড়ালটা ছুঁড়ে মেরেছে। কুড়ালের ফলাটা সম্পূর্ণ বেঁধেনি। তিনি অন্ধকার গলির ভেতরে পড়ে গেলেন। মেরিলিনা দৌড়ে কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে, “প্লিজ আমাদের কেউ হেল্প করেন প্লিজ। প্লিজ কে কোথায় আছেন।” খাইরুল চিৎকার করে বললেন, “মেরিলিনা, তুমি পালাও। আমি আসছি। যাও, পালাও, যাও”
মেরিলিনা গেল না। আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকল।
খাইরুল হোলস্টারে হাত দিলেন। রিভলভারটা অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামার সময় কোথাও পড়ে গিয়েছে। মৃত্যুকে মেনে নেওয়া ছাড়া এখন আর উপায় নেই। তিনি দুই হাতে ভর দিয়ে পেছনে এগোতে লাগলেন। মেরিলিনা খাইরুলকে ছাড়া যেতে পারছে না। কিন্তু লোকটা খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে।
গলির শেষ মাথায় একটা গাড়ি এসে থামলো। হর্ন দিতে লাগল বারবার। মেরিলিনা দেখল, এক দাড়িওয়ালা লোক হাতের ইশারায় বলছে, চলে আসেন। চলে আসেন। মেরিলিনা গাড়িটার দিকে ছুটে গেল। খাইরুল ঝাপসা চোখে মেরিলিনার চলে যাওয়া দেখলেন। অবশেষে তিনি সব উপেক্ষা আর প্রাপ্য ভালোবাসার উর্ধ্বে চলে যাচ্ছেন ভেবে ভালো লাগল। তিনি দুই হাত ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। সব কিছু আস্তে আস্তে দৃষ্টি ঝাপসা হতে শুরু করল।
ঝাপসা চোখেই দেখতে পেলেন, একটা ছায়া গাড়িটা থেকে বের হচ্ছে। এগিয়ে আসছে তার দিকে। ভোঁতা গুলির শব্দ কানে এলো। তারপর দুই হাতে কার যেন হাতের স্পর্শ পেলেন তিনি। কেউ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িটার দিকে।
গাড়িটা দ্রুত বেরিয়ে গেল। অন্ধকার রাস্তা টপকে পাশের একটা গলির ভেতরে ঢুকে গেল। পেছনে পুলিশ।
মেজর ইকবালের মৃতদেহটা দেখতে পেলেন না খাইরুল। জ্ঞান হারালেন। জানতে পারলেন না, তিনি মেরিলিনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। মেরিলিনার চোখের পানিগুলো তার কপালে পড়ছে। সে বার বার বলছে, “একবার তাকাও। শুনছ? তোমার ছোট চাচার গল্পটা শেষ করবে না?” তাদের ভেতরের আপনি-তুমির সম্পর্কটা যে কখন তুমি-তুমির সম্পর্কে পরিণত হয়েছে, তা দুজনের কেউই বুঝতে পারেনি।
তালেব গাড়ি চালাচ্ছেন। সে বলছেন, “ছাররে জাগায়ে রাখ রনি। ছাররে জাগায়ে রাখ”। রনি তার পায়ে ব্যান্ডেজ চেপে ধরে আছে। এত স্নেহ, কিন্তু খাইরুলের সেটা অনুভবের সামর্থ্য নেই।
মানুষের জীবনে যখন সত্যিকারের স্নেহ আসে, ভালোবাসা আসে, দুঃখজনকভাবে সে সেটা স্পর্শ করতে পারে না।