আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৮–১৯৬১) – জীবনবাদী মার্কিন কথাসাহিত্যিক
একেবারে বখাটে ছেলে বললেও তাকে কম বলা হয়। পড়শোনায় মন নেই, পরীক্ষাতেও রেজাল্টও ভালো হয় না। হবে কেমন করে? যে-ছেলে রাইফেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বনেজঙ্গলে, লেকের জলে নৌকা ভাসিয়ে মাছ শিকার করে বেড়ায় এবং মুষ্টিযুদ্ধের কসরত দেখাতে গিয়ে নাকের হাড় ভেঙে ফেলে, চোখে আঘাত পেয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়—তার রেজাল্ট কী করে ভালো হতে পারে? কিন্তু ছোটবেলায় রেজাল্ট ভালো না হলেও পরবর্তী জীবনে এই বখাটে ছেলেটিই হয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের এক দিকপাল লেখক।
বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (Ernest Hemingway ) বাল্যকালে এমনই দুরন্ত আর উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেই ছিলেন। তাঁর বাল্যজীবন দেখে কেউ সেদিন কল্পনাও করে নি এই ছেলেই একদিন সারা বিশ্বে বরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জন্ম ১৮৯৮ সালে ২১ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ওক পার্কে। বাবা ক্লারেন্স এডমন্ড হেমিংওয়ে ছিলেন ডাক্তার। মা গ্রেস বিয়ের আগে ছিলেন পেশাদার গায়িকা। বাবার ইচ্ছে ছিল তাঁর ছেলেও ডাক্তার হোক। ভালো লেখাপড়া করে আয়ের পথ ধরুক। কিন্তু আর্নেস্ট বাবার সে আশা পূরণ করতে পারেননি। পড়াশোনায় তাঁর মন বসেনি। ১৯১৭ সালে তিনি কোনোমতে হাইস্কুল পাস করেন, পরে গ্র্যাজুয়েশন করেন। বলতে গেলে তাঁর লেখাপড়ার এখানেই ইতি ঘটে। তারপর আর এগুতে পারেননি আর্নেস্ট।
এই সময় চলছিল প্রথম মহাযুদ্ধ। চিরকালের দুরন্ত ছেলে তাই উচ্চাশিক্ষার জন্য কলেজে ভর্তি না হয়ে নাম লেখাতে গেলেন সেনাবাহিনীতে। কিন্তু তাঁর সে আশা পূরণ হলো না দৃষ্টিশক্তি কম ছিল বলে— শারীরিক পরীক্ষায় অযোগ্য বলে ঘোষিত হলেন।
কিন্তু যুদ্ধে যোগদান করতে না পারলেও অনেক চেষ্টা-তদ্বির করে ১৯১৮ সালে আমেরিকান রেডক্রসে তিনি যোগদান করতে সক্ষম হলেন।
তাঁকে পাঠানো হলো ইতালিয়ান সেক্টরে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার হিসেবে। এখানে তিনি মাস তিনেক কাজ করেন। এই সময় তিনি স্থানীয় পিয়েভ নদী পার হতে গিয়ে গুরুতর আহত হন। তিনি আহত হয়েছিলেন নদীর তীরের জঙ্গলের পথে পুঁতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণে।
আহত অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। হাসপাতালে তিনি তিন মাস ছিলেন। কিন্তু এই হাসপাতালে থাকার সময়েই তিনি এক ঘটনা ঘটিয়ে বসেন। যে নার্স- মেয়েটি তাঁর সেবাযত্নে নিয়োজিত ছিলেন, তিনি তাঁর প্রেমে পড়ে যান। তিনি ব্যাকুল হয়ে মেয়েটির কাছে প্রেম নিবেদন করে বসেন। কিন্তু মেয়েটি হেমিংওয়েকে পাত্তা দেননি। ফলে তাঁর প্রেম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
কিন্তু প্রেম ব্যর্থ হলেও মেয়েটিকে তিনি সহজে ভুলতে পারেননি। যুদ্ধের পর তিনি একটি উপন্যাস লেখেন, যে উপন্যাসটি তাঁর জন্য বয়ে আনে সুনাম এবং অর্থ। ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ (A Farewell to Arms) নামের এই উপন্যাসের যিনি নায়িকা, তিনিই ছিলেন হাসপাতালের সেই ব্যর্থ প্রেমের নায়িকা নার্স-মেয়েটি। এখানে অবশ্য তাঁর নাম পালটে রাখা হয়েছিল ক্যাথেরিন বার্কলে।
যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর রেডক্রসের চাকরিটিও চলে যায়। ফলে বেকার হয়ে কিছুদিন তিনি পথে পথে ঘুরে বেড়ান। চাকরির চেস্টা করেও ব্যর্থ হন।
অবশেষে টরোন্টোতে এসে র্যাফ্ কন্যেবল নামের এক ভদ্রলোকের ছেলের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। এই কন্যেবল সাহেব ছিলেন অসম্ভব ভালো লোক। তিনিই একদিন হেমিংওয়েকে নিয়ে পরিচয় করে দিলেন টরোন্টো থেকে প্রকাশিত ‘স্টার’ (Star) পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে। তিনি এই পত্রিকায় যুদ্ধ বিষয়ক খবরাখবর এবং নিবন্ধ প্রকাশ করতে লাগলেন। কিন্তু তাতে করে তাঁর আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না। তিনি ‘স্টার’ পত্রিকায় মোট ১৪টি প্রবন্ধ প্রকাশ করে সম্মানী পেলেন মাত্র ১৫০ ডলার। এই সামান্য আয় দিয়ে তাঁর নিজেরই চলা মুশকিল ছিল।
আর কোনো উপায় না দেখে তিনি ফিরে এলেন তাঁদের কাছে। বাবা-মায়ের এতদিন ধারণা ছিল, তাঁদের ছেলে যখন দূরে থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই ভালোই আয়- উপার্জন করে। কিন্তু তাদের সে আশা নিরাশায় পরিণত হলো।
কিন্তু বাড়িতে এসেও তাঁর মন টিকল না। ১৯২০ সালে তিনি আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লেন। চলে এলেন মিশিগানে।
এখানে এসেও তিনি ঘটিয়ে বসলেন আরেক ঘটনা। হ্যাডলি নামের এক উদীয়মানা লেখিকার প্রেমে পড়ে গেলেন। এবার আর প্রত্যাখ্যান নয়। প্রেম শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি হ্যাডলিকে বিয়ে করে ফেললেন।
তখনও অবশ্য তাঁর সাথে ‘স্টার’ পত্রিকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। তখনও তিনি নিয়মিত লিখতেন। যৎসামান্য আয়ও হতো। কিন্তু এই সামান্য আয় দিয়ে সংসার পাতা সম্ভব ছিল না।
এর মধ্যে তিনি ‘স্টার’ পত্রিকার সাথে পাকাপাকা চুক্তিতে উপনীত হলেন। তিনি পত্রিকার স্পেশাল করেসপন্ডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে ইউরোপে আসেন। পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়, তিনি লেখার জন্য নিয়মিত সম্মানী পাবেন এবং পত্রিকার প্রচারের ও সার্কুলেশন বৃদ্ধির জন্যও কাজ করবেন। এজন্যও তিনি আলাদা বেতন এবং অন্যান্য খরচ পাবেন। ফলে তাঁর ভালোই আয় হতে লাগল। তিনি সপ্তাহে প্রায় ৭৫ ডলার করে উপার্জন করতে লাগলেন। এতে তাঁদের দুজনের সংসারেও এল সচ্ছলতা।
এই সময় থেকে পত্রিকায় ফিচার লিখতে লিখতেই সহসা তাঁর লেখার ব্যাপারে ঝোঁক এসে যায়। তাঁর স্ত্রী হ্যাডলিও ছিলেন লেখিকা। তাই স্ত্রীর অনুপ্রেরণাতেই তিনিও লিখতে শুরু করেন।
তিনি প্রথম তিনি তার সাহিত্যিকজীবন শুরু করেন ব্যঙ্গরস্যাত্মক লেখা দিয়ে। তাঁর প্রথম ব্যঙ্গ রচনার নাম ‘শেকসপিয়ার অ্যান্ড কোং’ (Shakespeare and Co)। লেখাটি হালকা ধরনের হলেও বেশ খ্যাতি অর্জন করে।
ফলে তিনি নিজেও অনুপ্রাণিত হন এবং দু’হাতে লিখতে থাকেন। প্রকাশিতও হতে থাকে। তাঁর দ্বিতীয় গল্পর বই “থ্রি স্টোরিস অ্যান্ড টেন পোয়েমস’ (Three Stories and Ten Poems)। এর পরে প্রকাশিত হয় একটি গল্প গ্রন্থ ‘ইন আওয়ার টাইম’ (In our Time)। প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে।
হেমিংওয়ে তাঁর প্রথম সন্তানের জন্মের পরই একবার দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু এই সময় নানারকম নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘স্টার’ পত্রিকার সঙ্গে পর্যন্ত তাঁর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। পরে তিনি আবার তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে প্যারিসে ফিরে আসেন।
১৯২৪ সালে তিনি প্যাম্পলোনা ভ্রমণ করেন। সেখানে যাওয়ার পরই ১৯২৫ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস “দি সান অলসো রাইজেস’ (The Sun Also Rises) প্রকাশিত হয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রথম বিয়ে সুখের হয়নি। ১৯২৭ সালে হ্যাডলির সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে তিনি বিয়ে করেন ‘ভোগ’ (Vogue) পত্রিকার অন্যতম সম্পাদিকা সুন্দরী পলিনকে এবং ১৯২৭ সালেই প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ “দি মেন উইদাউট উইমেন’ (The Men Without Women)। হেমিংওয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ, প্রকাশের পর যার আশি হাজার কপি মাত্র তিন মাসে বিক্রি হয়ে বেস্ট সেলারের গৌরব অর্জন করেছিল, সেই ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ (A Farewell to Arms) উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এই গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকে হেমিংওয়ের আর্থিক অনটন কেটে যায়।
১৯৩৬ সালে হেমিংওয়ে আবার ছুটে আসেন স্পেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। তিনি মার্কিন পত্রপত্রিকার জন্য যুদ্ধের খবর সরবরাহ করতে থাকেন। এই সময় প্রকাশিত তাঁর প্রথম নাটক ‘দি ফাইট কলাম’ (The Fight Column)। এই নাটকটি তিনি স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন।
১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আর একটি পাঠকনন্দিত উপন্যাস ‘ফর হুম দি বেল টোলস’ (For Whom the Bell Tolls)। সেই বছরেই তাঁর জীবনে ঘটে যায় আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনের সঙ্গেও তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং মার্থজিল হার্নকে গ্রহণ করেন তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে।
এরই মধ্যেই শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। ১৯৪২ সালে তিনি আবার ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স থেকে যুদ্ধকালীন সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। যুদ্ধশেষে তিনি ফিরে আসেন কিউবায় নিজের বাড়িতে। এই সময় আবার ঘটে বিবাহবিচ্ছেদ। এবার তিনি বিয়ে করেন টাইম ম্যাগাজিনের মেরি ওয়েলশকে। এই মেরি ওয়েলশই হেমিংওয়ের সঙ্গে তাঁর জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন।
১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় হেমিংওয়ের আরেকটি গ্রন্থ ‘অ্যাক্রস দি রিভার অ্যান্ড দি ট্রিস’ (Across the River and the Trees)। কিন্তু বইটি খুব একটা পাঠক সমাদর লাভ করেনি। অবশ্য তাতে তিনি নিরুদ্যম হননি।
হেমিংওয়ের সবচাইতে উল্যেখযোগ্য গ্রন্থ এবং যে গ্রন্থ তাঁকে বিশ্বসাহিত্যে অমরত্বের আসন দান করেছে, এনে দিয়েছে জগৎজোড়া সম্মান, সেই ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দি সি’ (The Oldman and the Sea) গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এই গ্রন্থের অপূর্ব প্রকাশভঙ্গি এবং রচনাকৌশল বিশ্বের পাঠকসমাজকে হতবাক করে দিয়েছিল। আর সেইসাথে তাঁর জন্য বয়ে এনেছিল অজস্র খ্যাতি আর অর্থ।
তাঁর এই ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’ বইটির জন্যই পেলেন যুক্তরাস্ট্রের বিখ্যাত পুলিৎজার পুরস্কার। শুধু পুলিত্জার পুরস্কার নয়, এই গ্রন্থটির জন্যই তিনি ১৯৫৪ সালে লাভ করেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
হেমিংওয়েরে এই বিখ্যাত উপন্যাসটি রচিত হয়েছিল কোহিমার জেলেপল্লীর বাস্তব কাহিনী নিয়ে। এই পল্লীর সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তিনি ছিলেন তাদের প্রিয় পাপা। হেমিংওয়েরও তাদের জন্য ছিল আন্তরিক ভালবাসা। তাই ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’ গ্রন্থটির জন্য নোবেল পুরস্কার বাবদ যে অর্থ তিনি পেয়েছিলেন, তার সমস্তটাই তিনি ব্যয় করেছিলেন কোহিমার গরিব জেলেদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য।
এত খ্যাতি এত অর্থ পাওয়ার পরও আর্নেস্ট হোমিংওয়ের মনে কোনো শান্তি ছিল না, জীবনে কখনও তাঁর স্থিরতা আসেনি। দাম্পত্যজীবনেও তিনি শান্তি খুঁজে পাননি।
এই হতাশা তাঁকে ঘিরে ধরেছিল শেষ জীবনে আরও বেশি করে। আর তারই পরিণামে তিনি ১৯৬১ সালের ২ জুলাই রাইফেলের গুলিতে আত্মহননের পথ বেছে নেন।