আর্ট না আ্যাকসিডেন্ট

আর্ট না আ্যাকসিডেন্ট

আর্ট বলতে আমরা আজকাল মোটামুটি রস-ই বুঝি। তা সে কাব্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে সঙ্গীতে যে কোনও কলার মাধ্যমেই প্রকাশিত হোক না কেন।

এখন প্রশ্ন আর্ট বা রসের সংজ্ঞা কী? সে জিনিস কী? তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে চিনব কী করে? অন্যান্য রস থেকে তাকে আলাদা করব কী করে? সরেস আর্ট কোনটা আর নিরসই-বা কোনটা?

প্রাচীন ভারত, গ্রিস এবং চীন– এই তিন দেশেই এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং অধুনা পৃথিবীর বিদগ্ধ দেশ মাত্রেই এ নিয়ে কলহ-বিসংবাদের অন্ত নেই। বিশেষ করে যবে থেকে “মডার্ন আর্ট” নামক বস্তুটি এমন সব ‘রস’ পরিবেশন করতে আরম্ভ করল যার সঙ্গে আমাদের কণামাত্র পরিচয় নেই। এলোপাতাড়ি রঙের পোঁচকে বলা হল ছবি, অর্থহীন কতকগুলো দুর্বোধ শব্দ একজোট করে বলা হল কবিতা, বেসুরো বেতালা কতকগুলো বিদঘুঁটে ধ্বনির অসমন্বয় করে বলা হল সঙ্গীত। বলছে যখন তখন হতে পারে, কিন্তু না পেলাম রস, না বুঝলাম অর্থ, না দিয়ে গেল মনে অন্য কোনও রসের ব্যঞ্জনা বা ইঙ্গিত। তাই বোধহয় হালের এক আলঙ্কারিক মডার্ন ভাস্কর্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, যখন ভাস্কর এক বিরাট কাঠের গুঁড়ি নিয়ে তার উপর ছ মাস ধরে প্রাণপণ বাটালি চালানোর পর সেটাকে কাঠের গুঁড়ির আকার দিতে পারেন, এবং নিচে লিখে দেন ‘কাঠের গুঁড়ি’– তখন সেটা ‘মডার্ন ভাস্কর্য’।

ইতোমধ্যে এই মডার্ন আর্টের বাজারে একটি নতুন জীব ঢুকেছেন এবং সেখানে হুলস্থূল বাঁধিয়ে তুলেছেন– এর নাম অ্যাকসিডেন্ট, বাঙলায় দুর্ঘটনা, দৈবযোগ, আকস্মিকতা যা খুশি বলতে পারেন।

এঁর আবির্ভাব হয়েছে সুইডেনের মতো ঠাণ্ডা দেশে যেখানে মানুষ ঠাণ্ডাভাবে ধীরেসুস্থে কথা কয়, চট করে যা-তা নিয়ে খামখা মেতে ওঠে না।

***

 সুইডেনের মহাসম্মানিত ললিতকলা আকাদেমির বিজ্ঞ বিজ্ঞ প্রফেসর, কলারসিক গুণীজ্ঞানীরা অকস্মাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কর্ণমূলের পশ্চাদ্দেশ কয়ন করতে লাগলেন। তাঁদের মহামান্যবর প্রেসিডেন্ট তো খুদাতালার হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে সোজাসুজি বলেই ফেললেন, ‘কী করি, মশাইরা, বলুন। কে জানত শেষটায় এরকমধারা হবে? আজকাল নিত্য নিত্যি এতসব নয়া নয়া এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে যে, কোনটা যে এক্সপেরিমেন্ট আর কোনটা যে অ্যাকসিডেন্ট কী করে ঠাওরাই? আমরা ভেবেছি, চিত্রকর ফালস্ট্রোম আর্টের ক্ষেত্রে একটা অভিনব নবীন পন্থা আবিষ্কার করতে পেরেছেন এবং তাই ভেবে ওই ছবিটাও একজিবিশনের অন্যান্য ছবির পাশে টাঙিয়ে দিয়েছি–’

ওদিকে আর্টিস্ট ফালস্ট্যোম রেগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সর্বত্র চেঁচামেচি করে বলতে লাগলেন, তাঁকে লোকচক্ষে হীন করার মানসে দুষ্ট লোক কুমতলব নিয়ে এই অপকর্মটি করেছে।

অপকর্মটি কী?

ফালস্ট্রোম ছবি আঁকার সময় একখানা ম্যাসনাইটের টুকরোয় মাঝে মাঝে তুলি পুঁছে নিতেন। কাজেই সেটাতে হরেকরকম রঙ লেগে থাকার কথা। ওই সময়ে সুইডিশ ললিত-কলা আকাদেমি এক বিরাট মহতী একজিবিশনের ব্যবস্থা করেন—‘স্বতঃস্ফূর্ত কলা (স্পন্টানিসমুস বা Spontaneous art) ও তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ’ এই নাম দিয়ে সে চিত্র-প্রদর্শনীতে সুইডেন তথা অন্যান্য দেশের স্পন্টানিসমুস কলার উত্তম নিদর্শন তাতে থাকবে। (কুবিজম, দাদাইজমের মতো স্পন্টানিয়েজম-ও এক নবীন কলাসৃষ্টি পদ্ধতি আমি অবশ্য এখানে সে প্রশ্ন তুলছিনে যে সার্থক কলাসৃষ্টি মাত্রই স্পন্টানিয়াস বা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে থাকে বিশেষ পদ্ধতিতে এ নাম দিলে তাকে চেনবার কী যে সুবিধে হয় বোঝা কঠিন।)

এখন হয়েছে কী, আর্টিস্ট ফালস্ট্রোম তাঁর অন্য ছবি যাতে করে ডাকে যাবার সময় জখম না হয় সেই উদ্দেশ্যে রঙবেরঙের ম্যাসনাইটের টুকরোখানা তাঁর ছবির উপরে রেখে চিত্রপ্রদর্শনীতে পাঠিয়েছিলেন। আকাদেমির বড় কর্তারা ভাবলেন, এটাও মহৎ আর্টিস্টের এক নবীন মহান কলানিদর্শন এবং পরম শ্রদ্ধাভরে সেই ম্যাসনাইটের টুকরোটির নিচে আর্টিস্টের স্বনামখ্যাত নামটি লিখে ঝুলিয়ে দিলেন আর্টিস্টের অন্য ছবির পাশে!

ব্যাপারটা যখন ধরা পড়ল তখন আর্ট সমালোচকরা কী যে করবেন ঠিক করতে না পেরে চুপ করে গেলেন আর সুইডেনবাসী আপনার-আমার মতো সাধারণজন মুখ টিপে হাসল যে বাঘা বাঘা পণ্ডিতেরা ওই ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ রসিকতাটা ধরতে না পেরে ফাঁদে পা ফেলেছেন বলে।

কিন্তু এইখানে ব্যাপারটার গোড়াপত্তন মাত্র।

সুইডেনের কাগজে কাগজে তখন আলোচনা আরম্ভ হল এই নিয়ে : একখানা উটকো কাঠ জাতীয় জিনিসের উপর এলোপাতাড়ি রঙের ছোপকে যদি পণ্ডিতেরা আর্ট বলে মেনে নিতে পারেন তবে তাদের ঢাক-ঢোল-পেটানো এই মহাসাধনার ‘মডার্ন’ আর্টের মূল্যটা কী?

****

ওইভিন্দ ফালস্ট্রোম, সুইডেনের নামকরা তরুণ চিত্রকর। তিনি সম্প্রতি এই ‘স্বতঃস্ফূর্ত কলা-মার্গে’ প্রবেশ করেছেন এবং কলা নির্মাণের ক্রমবিকাশে তিনি ইতোমধ্যেই তাঁর ঢং একাধিকবার আগাপাশতলা বদলিয়েছেন। সুইডেনে এখন এই ‘কনক্রিট’, ‘স্থূল’ বা ‘বাস্তব’ মার্গের খুবই নামডাক; এঁরা নিজেদের অনুভূতি স্বতঃস্ফূর্ত অব্যবহিতভাবে রঙের মারফতে প্রকাশ করেন– সে প্রকাশে কোনও বস্তু বা কোনওকিছুর প্রতিকৃতি থাকে না, কোনওকিছু রূপায়িত করে না, ছবির নাম পর্যন্ত থাকে না– এবং দর্শক তাই দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, সরাসরি আর্টিস্টের অনুভূতি বুঝে গিয়ে তার অর্থ করে নেয়– কিংবা ওই আশা করা হয়।

এই হল মোটামুটি তার অর্থ—-অর্থাৎ অর্থহীন জিনিসকে যদি অর্থ দিয়ে বোঝাতে হয় তবে যে ‘অর্থ’ দাঁড়ায়।

ফালস্ট্রোম চিত্রপ্রদর্শনীতে দু খানি ছবি পাঠাতে চেয়েছিলেন, এবং পূর্বেই বলেছি, সে দু খানি ছবি যাতে করে পোস্টাপিসের চোট না খায় তাই সঙ্গে সেই ম্যাসনাইটের টুকরো দিয়ে সেগুলোকে প্যাক্ করে তিনি চলে যান গ্রামাঞ্চলে ছুটি কাটাতে। এদিকে আকাদেমির বাঘ-সিঙ্গিরা ছবি তিনখানা (আসলে অবশ্য দু খানা) ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার নিরীক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বাছাই করে নিলেন দু খানা এবং তার মধ্যে মনোনীত হয়ে গেল তুলি পোছার সেই ম্যাসনাইটের পট্টি! ক্রিটিকদের কারওরই কাছে ওই ম্যানসাইটের ‘অঙ্কিত তুলিপোছা রঙ-বেরঙ করা জিনিসটির স্টাইল বা বিষয়বস্তু অদ্ভুত বা মূল্যহীন ঠেকেনি। তার অর্থ একদিকে চিত্রকরের ‘ন্যায়ত’ ‘ধর্মসঙ্গত’ আঁকা ছবি ও অন্যদিকে তাঁর তুলি পোঁছার এলোপাতাড়ি রঙের ছোপ– এ দুয়ে কোনও পার্থক্য নেই।

তাই লেগেছে হুলস্থুল তর্কবিতর্ক, ‘সে আর্ট তবে কী আর্ট যেখানে “ভুল” জিনিস অক্লেশে খাঁটি আর্ট বলে পাচার হয়ে যায়?’

এটা ধরা পড়ল কী করে? ফালস্ট্রোম, ছুটি থেকে ফিরে একদিন স্বয়ং গিয়েছেন চিত্রপ্রদর্শনী দেখতে। সেখানে ওই ‘ম্যাসনাইট ছবি’র কাণ্ড দেখে যখন ভুলটা ধরা পড়ল তখন কোথায় না তিনি বিচক্ষণ জনের মতো চুপ করে থাকবেন তিনি উল্টো আরম্ভ করলেন তুলকালাম কাণ্ড!

ফলে জ্ঞানগর্ভ পণ্ডিতমণ্ডলী, তীক্ষ্ণচক্ষু কলাসমালোচকদের দল, ঝানু ঝানু আর্টসংগ্রহকারীগণ, সরলচিত্ত সাধারণ দর্শক এবং সর্বশেষে নিজেকে আর তামাম ওই ‘স্বতঃস্ফূর্ত-কলা-পন্থী’কে বিশ্বজনের সম্মুখে তিনি হাস্যাস্পদ করে ছাড়লেন।

এর কয়েক বছর পূর্বে এক বিদগ্ধ বিদূষক চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জির ‘আঁকা’ একখানি ‘ছবি’ ওইরকম এক চিত্রপ্রদর্শনীতে পাঠিয়ে শহরের লোককে বোকা বানিয়েছিল– তখনও কেউ ধরতে পারেননি, ওটা বাঁদরের মশকরা।

কিন্তু প্রশ্ন, এই ধরনের তামাশা চলবে কতদিন ধরে? এই যে স্পন্টানিস্টের দল, কিংবা অন্য যে কোনও নামই এদের হোক– এরা আর কতদিন ধরে আপন ব্যবহার দিয়ে ইচ্ছায় প্রকাশ করবেন যে এদের আর্ট কোনওকিছু সৃজন করার দুরূহ শক্তিসাধনায় আয়ত্ত নয়, আকস্মিক দৈবদুর্বিপাকে বা অ্যাকসিডেন্ট বা ঘটনাকে এঁদেরই মতো উত্তম উত্তম ছবি আঁকতে পারে, শ্রেষ্ঠ গান গাইতে পারে, সার্থক কবিতা রচনা করতে পারে– এতদিন যা শুধু সরস্বতীর বরপুত্রেরাই বহু সাধনার পর করতে পারতেন?

এই প্রশ্নটি শুধিয়েছেন এক সরলচিত্ত, দিশেহারা সাধারণ লোক– সুইডেনের কাগজে।

উত্তরে আমরা বলি, কেন হবে না? এক কোটি বাঁদরকে যদি এক কোটি পিয়ানোর পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়, এবং তারা যদি এক কোটি বংশপরম্পরা ওগুলোর ওপর পিড়িং পাড়াং করে তবে কি একদিন একবারের তরেও একটি মনোমোহন রাগিণী বাজানো হয়ে যাবে না? সে-ও তো অ্যাকসিডেন্ট।

আমার ব্যক্তিগত কোনও টীকা বা টিপ্পনী নেই। মডার্ন কবিতা পড়ে আমি বুঝি না, রস পাই না। সে নিয়ে আমার কোনও খেদ নেই। পৃথিবীতে যে অতশত ভালো জিনিস রয়েছে যার রসাস্বাদন আমি এখনও করে উঠতে পারিনি, ওগুলো আমার না হলেও চলবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *