আরোগ্য
নটীর হাটের এই স্টেশনের সামনেটিতে দাঁড়িয়ে থাকি রোজ। সকালে-দুপুরে বিকেলে-সন্ধ্যায়-রাত্রে-মধ্যরাত্রে। কখনও সজ্ঞানে আসি, কখনও নিশির টানে। না এসে পারিনে।
নটীর হাট যেন এক অদৃশ্য পাঁচিলে ঘেরা, ছন্নছাড়া কোন এক আদ্যিকালের নগরী। সবই তার পুরনো, প্রায় প্রাচীনের পর্যায়ে গিয়ে পড়ে। বাড়ি ঘর, রাস্তাঘাট, তাবত বাসাড়ে-বাসিন্দে-অধিবাসী, মন্দির-বিগ্রহ-ধর্মশালা, সবই। নতুন উঠেছে যেগুলি, সেগুলি যেন পুরনো ছেঁড়া ধুলোমাখা কাগজের স্তূপে কয়েকখণ্ড নতুন কাগজ। চোখে পড়েও পড়ে না। বাসু পুরুতের গলিটি এখনও আছে ঠিক তেমনি। আছে তার শেওলা-ধরা, বেঁটে-খাটো নিচু একতলা দোতলা বাড়িগুলি, এবড়ো খেবড়ো রাস্তাটি, খোপে খোপে বংশ পরম্পরায় সেই শালিকেরা, আর সেই একই গোত্রের মেয়েরা, যাদের চেহারা ও নাম বদলায় প্রায়ই, দলে দলে যায় আর আসে। কিন্তু সন্ধ্যাকালে সবাই রং মাখে, সাজে, এসে দাঁড়ায় রাস্তার দরজায়। নটীর হাটের একেলে পৌরকর্তারা রাস্তাটির নাম করে দিয়েছেন সাহিত্য-সম্রাট-ভ্রাতা রোড। কেমন একটু কানে লাগে খট করে। কে সেই সাহিত্য-সম্রাট, কে তার ভ্রাতা কে জানে। ভ্রাতার নাম না থাকাটাও বড় বিচিত্র, কিন্তু এইটি বিশেষত্ব নটীর হাটের। কেননা, ও নামে তো কিছুই যায় আসে না, রাস্তাটা যে নটীর হাটের মজ্জায় মজ্জায় বাসু পুরুতেরই গলি। আর ঠিক এমনি গলি এত আছে নটীর হাটের এই সোয়া বর্গমাইলের চৌহদ্দিতে…যাক, প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি।
বছর ষাটেক আগেও পশ্চিমে গঙ্গাই ছিল নটীর হাটের সদর দেউড়ি। এখন এই স্টেশন। পুরনো সদর এখন খিড়কি-দোর। যত রাজ্যের যাওয়া আসা এখানে। শুধু শহর নয়, মনে হয়, স্টেশনের এখানটা যেন সেই অলক্ষিত পাঁচিল-ঘেরা নটীর হাটের সুউচ্চ সর্বোচ্চ চিলেকোঠাখানি। এখান থেকেই দেখা যায় নটীর হাটের সব অন্দর ও অন্ধকারের ঘটনা, শোনা যায় অস্ফুট সব কলকাকলি।
এই চিলেকোঠাখানি আমার খেলাঘর। এর অগুনতি ঘুলঘুলিতে আমি সকৌতুক অস্থির চোখ নিয়ে ছুটে বেড়াই। তার মধ্যে একটি ভুল সম্প্রতি ধরা পড়েছে। আমি অনুভব করেছি, এ শুধু আমার খেলাঘর নয়, আমার যত শিক্ষা গোড়া বাঁধার এটি একটি স্কুলও বটে।
জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ-শ্রাদ্ধ, পাপ-পুণ্য, কলঙ্ক-অকলঙ্ক, নটীর হাটের যত প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য ঘটনার ঢেউ শেষ পর্যন্ত আছড়ে এসে পড়ে এখানেই। স্টেশনের সামনে এই একশো দেড়শো গজের নানান ভিড়ের মধ্যেই। নটীর হাটের এই প্রবেশমুখে, যত চেনা-অচেনার যাওয়া আসার পথের ধারে।
ওই যে লাঠি হাতে, চটি পায়ে, চাদর গায়ে বুড়ো মানুষটি চলেছেন, তাঁর শিখায় বাঁধা কাঠগোলাপ উড়িয়ে, উনিই হলেন নটীর হাটের চক্রবর্তীদের বারো শরিকের এখনকার দিনের সবচেয়ে প্রবীণ। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলেন, নটীর হাটের কথা বলছ তো? না, আমরা এখানকার সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দে নই। রাম কুণ্ডুকে চেনো তো, এখানে যার সতেরখানা বাড়ি আছে? তাকে সব দিয়ে গেছে উলুপী বারুণী।…গদাই সাধুখাঁকে চেনো? যার সাতটা ইট কাঠের গোলা, পেট্রল পাম্প, সিনেমা আছে? সে পেয়েছে তার ঠাকুদার কাছ থেকে সৌরভীবালার সম্পত্তি। অধর পালকেও চেনো, লোহা আর সোনা দুই-ই তার অনেক। সে ভোগ করছে সুখদার দান। এই পাল কুণ্ডু সাধুখাঁদের দেশ নটীর হাট। অবিশ্যি সবাই পরের সম্পত্তিতে বড়লোক নয়, নিজেরও আছে অনেকের। ব্যবসাটা ওদেরই একচেটে।
কিন্তু ওই উলূপী বারুণী, সৌরভীবালা, সুখদারা কারা?
ওরা সেকেলে নটী, অর্থাৎ বেবুশ্যে। নটীর হাটের আদিবাসিনী। তবে শোনো, তখন সেই..
থাক, প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি আবার। যদি ওঁকে জিজ্ঞেস করা যায়, কিন্তু এত ব্রাহ্মণবসতি হল কী করে, ফোকলা দাঁতে হেসে বলেন, ধর্মের কলে।
উনি বেশি বলেননি। ধর্মের কলটা বাতাসে কিংবা আর কিছুতে নড়ছিল, সেটা ধরা পড়েছে, আমার চিলেকোঠার ঘুলঘুলিতে। তাহলে চক্রবর্তীদের ইতিহাস…
সেসব থাক। ওই ঘোড়ারগাড়ির ভুনু গাড়োয়ান যেদিন ওর আগুনের মতো ষোড়শী বউ ঝুনিয়াকে নিয়ে এল প্রথম…থাক সেসব।
ওই যে যাচ্ছেন ফণীন্দ্র ঘটক, তাঁর পরমাসুন্দরী সাত মেয়ের কথা…না, সেটি এখন নয়।
গজেন্দ্রগমনে যাচ্ছে পথের মাঝখান দিয়ে ধবধবে ফর্সা, মেদবহুলা বাড়িউলী সুখবালা, গোটা মালপোঁতা পাড়াটা ওর নিজেরই। ওর গায়ের ভাঁজে ভাঁজে আছে নটীর হাটের আদি ইতিকথা। তেরো বছরের মেয়ে যেদিন প্রথম এল…থাক, সেই অপ্রাসঙ্গিক কথাই এসে যাচ্ছে। তা হলে মালপোঁতা পাড়ার অজ্ঞাতকুলশীল শিরীশ কেমন করে কার্তিক হালদারের মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল, সেকথাও বলতে হয়।
আর ওই যে যাচ্ছে সুধারাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, নটীর হাটের হাল কলেজের ছাত্রী। ওর কিংবা অধ্যাপক ত্রৈলোক্যনাথ গুপ্ত কিংবা কৃষ্ণপ্রিয়া স্কুলের মাস্টার রেণুপদ নাথের জীবনবৃত্তান্ত সামান্য জিনিস নয়। কোনটা সামান্য!
নটীর হাটের এম এল এ অথবা শ্ৰমিক-নেতা, সাহেব-সাহেবকুঠি, ক্লাব, সাহেবদের পরকীয়া প্রবৃত্তি–কিছুই যাবে না ফেলা।
আমি তো আজকে এসব বলতে বসিনি। তবু যে বলতে হল, তার কারণ, বলব, তা নটীর হাটের বৃন্তছেঁড়া একটি কুসুমের মতো। তাই এত কথা।
আমার ঘুলঘুলি দিয়ে দেখতে পাচ্ছি অবনীকে। তার বিষয়ই হচ্ছে নটীর হাটের সবচেয়ে হালের ঘটনা। যে ঘটনা নিয়ে নটীর হাটে অনেক আলোড়ন হয়েছে। অবনীকে দেখলে এখনও যে আলোড়নের ছায়া লোকের চোখে ফুটে ওঠে।
স্টেশন থেকে নেমে, কোনওরকমে একটি টুথপেস্ট কিনে অবনী হন হন করে চলেছে বাড়ির দিকে। ওর চিনা বাড়ির চিকন মসৃণ মোটা সোলের চটিজুতোর শব্দ শুনলেই বোঝা যায়, খুশিতে ডগোমগো কুরঙ্গটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে।
নটীর হাটের মধ্যে কয়েকটি বাছা সুন্দর দেখতে ছেলের মধ্যে ও একটি। চোখা নাক, টানা চোখ, রক্তাভ ঠোঁট আর ধবধবে ফর্সা রং, কিন্তু একেবারেই উন্নাসিকের মতো দেখায় না। মাথার চুল কোঁকড়ানো নয়, বড় বড় কয়েকটি ঢেউয়ে যেন একটি বিহ্বল অবসাদ চুলের বিন্যাসে। সেটিও বিচিত্র একটি সৌন্দর্য। এমনিতেই অবনী সুন্দর, তার উপরে নিপুণ হাতে টাই বেঁধে, কোট চাপিয়ে যখন বেরোয় ওর সেই সাবলীল ভঙ্গিতে, তখন পুরুষের ভিড়ে পুরুষ দেখেও তাকিয়ে থাকতে হয় একটুক্ষণ। ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে সে বি-এ পাশ করেছে। তারপর তেইশ বছর বয়সেই একটা ভাল চাকরি পেয়ে গেছে বিলিতি মার্চেন্ট অফিসে।
আমি দেখছি, অবনী যাচ্ছে। দক্ষিণ দিকে খানিকটা গিয়ে বেঁকে গেল পুবে। তারপরে আবার দক্ষিণে, পুবে আবার, দাঁড়াল গিয়ে সেই বাড়িটার সামনে। সেই মান্ধাতার আমলের বাড়ি, প্রায় বিঘে দুয়েক জমি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীর উপরে। এ বাড়ির খ্যাতি শুধু নটীর হাটে নয়, সারা বঙ্গে। নাম বললে সবাই চিনি চিনি করে উঠবে, তাই পরিচয়টা চাপা থাক। অবনী এই বাড়ির বিখ্যাত বংশের ছেলে।
আমি ওকে আজ দেখছি, আরম্ভ করছি তিন বছর আগে থেকে। তখন চাকরি-জীবন শুরু হয়ে গেছে। তিন বছর আগে, সেদিনও সন্ধ্যাবেলা ঠিক এমনিভাবে এ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল অবনী। থমকে দাঁড়াল সেকেলে বাড়িটার গজাল-মারা সদর-দেউড়ির সামনে। ইলেকট্রিক নেওয়া হয়েছে, তবু বাড়িটার গা থেকে পিদিম হ্যারিকেনের রেশ ঘুচতে চায় না। দেউড়ির আলোয় মনে হয়, গত শতাব্দীর ভূতুড়ে আলোটাই যেন জ্বলছে। সামনে পোড়ো উঠোন আর ঠাকুরদালান, ওখানটা অন্ধকার। পাঁচ শরিকের যাওয়া-আসার পথ তাই কেউ তার ভাগের সামান্য মিটার ওখানে খরচ করতে রাজি নয়। ছুঁচো ব্যাঙ ছাড়া সাপও থাকতে পারে, আছেও। তবু।
উঠোনের বাঁ দিকে যে ঘরগুলিতে আলো দেখা যায়, ওগুলি অবনীর বাবা মা ভাই বোন, সব মিলিয়ে সংসার ওদের, এখনও পুরনো বংশ হিসেবে খুবই জমাট।
অবনী থমকে দাঁড়াল। ওদিকটায় ও যেতে চায় না। কার্তিক মাসের হেমন্ত-জ্যোৎস্নায় এখনও কোথায় শরতের সোনার আভাস রয়ে গেছে একটু তার উপরে হৈমন্তিক কুয়াশা কুহকের একটু রেশ নির্বাক কৌতুকে রয়েছে চেয়ে। যেন পোড়ো উঠোন আর ঠাকুরদালানে ঘাপটি মেরে বসে আছে কারা আলো-আঁধারিতে।
অবনী যেতে চায়, ওদের ঘরগুলি পেরিয়ে, ন-জ্যাঠামশায়ের পরিত্যক্ত মহলটায়। কিন্তু ঘরের লোক দেখে ফেলে, সেই ভয়। উঠোনে ঢুকে বাঁদিকের উপরে ওঠার সিঁড়ি। কিন্তু ভাঙা। উপরে এখন আর মানুষ ওঠে না। যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে হুড়মুড় করে। এই ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে উঠে, একটি চোরা সিঁড়ি আছে পিছনের মহলে যাবার। কিন্তু…
এগিয়ে গেল অবনী পা টিপে টিপে। পায়ের চাপে সিঁড়িগুলিই দুরু দুরু করে, কিংবা ধুক ধুক করে নিজের বুক, ঠিক ধরতে পারে না অবনী। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে, সবে মাত্র চোরা সিঁড়ির শেষ ধাপটায় এসেছে। এমন সময় অস্ফুট আর্তনাদ শুনে থমকে গেল। দেখল, সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ভয়ে জড়োসড়ো ললনা। চিনতে ভুল হয়নি, তাই।
অবনী তাড়াতাড়ি বলল, আমি, ললনা, আমি অবনী।
ললনা কাঁপছিল। আর একটি শীৎকার দিয়ে ও অবনীর বুকের কাছে ঘেঁষে এসে ত্রাস-ফিসফিস গলায় বলল, মা গো! কী ভয় পেয়েছিলুম। এখানে কী করে এলে?
ওধারের পুরনো সিঁড়ি দিয়ে।
কী সর্বনাশ। যদি সাপ খোপ—
ললনার কথার উপরেই অবনী ঠোঁট চেপে দিল।
ললনা বলল, এত ভয় কীসের যে, এমন খারাপ পথ দিয়ে এলে?
অবনী বলল, মার চোখে যে সন্দেহটা দেখা দিয়েছে, সেটা চাপা দেবার জন্য। সামনে দিয়ে এসে তোমাদের দোর ঠেলতে হবে না। ভাববে, তবু ছেলেটা একদিন ললনাদের ওদিকে যাওয়া কামাই দিয়েছে।
ভয় ছিল না ললনার বাবা-মাকে। ওরা এ-বাড়ির লোক নয়, দুর্গতির দায়ে কলকাতা থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছে আজ ছ মাস। অবনীর ন-জ্যাঠামশাইরা প্রায় দু-পুরুষ ধরে আছেন কলকাতায়। নটীর হাট থেকে মুছে গেছেন তাঁরা। কিন্তু শরিকানার ভাগটুকু খালি রাখতে হয়েছে। এখন এসে আশ্রয় নিয়েছেন ন-জ্যাঠামশায়ের ভায়রাভাই, অর্থাৎ ললনার বাবা। ভদ্রলোক নিজের জীবনটা মামলার বাজি খেলে হেরে গেছেন নিজের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কাছে। সব হারিয়ে এসেছেন, আর কাকাও নয়, ভায়রাভাইয়ের পোড়োভিটায়। ইতিমধ্যেই নটীর হাটের মার্কেটে বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছেন নিজেকে। মনে হয়, ঠিক নটীর হাটের আদিবাসিন্দা যেন। প্রায় প্রতিদিনই নানান পার্টির সঙ্গে যান। মহকুমা আদালতে, সাক্ষী হিসেবে। হক কথা না বলুন যুধিষ্ঠিরের বিকিকিনির হাটে বিকোচ্ছেন মন্দ নয়।
সে কথা যাক। ভদ্রলোকের কিছু না থাক, রূপ ছিল ঘরে একরাশ। নিজের মধ্যবয়সী স্ত্রী থেকে তিন মেয়ে সব কটি শুধু রূপ নয়, অপরূপ। একটা ভয়ঙ্কর সর্বনাশের মতো, যেন বৈশাখের তপ্ত বাতাসে শিয়রে রাখা অগ্নিশিখা। অবনীর মায়ের মনের কথায়–পোড়োবাড়িটায় যেন কতগুলি নাগিনী ঘুরছে কিলবিল করে।
আমি আমার চিলেকোঠার ঘুলঘুলি থেকে দেখতে পাই, নটীর হাটের যত বাদলাপোকাগুলি পড়ন্তবেলায় যায় অবনীদের নির্জন পাড়াটায়। দেখে ভাবি বাদলাপোকা শুধু আগুনে পোড়ে না, সুযোগ পেলে তাদের সাপেও সাপটে দেয় টপাটপ।
ওই একরাশ রূপের একটি বড় মেয়ে ললনা। অবনীর পাশে, একটি সুদৃশ্য সোনার হারের সুন্দর লকেটের মতো। সুগৌরী, একহারা, কিন্তু একটি আশ্চর্য ধার ওর দেহলাবণ্যে। খর চোখে দীপ্ত দুটি তারা। যেদিকে চায়, সেখানেই দাগ দিয়ে দেয় একটু। কিন্তু রক্তাভ ঠোঁট দুটি কেমন যেন বিলিতি পুতুলের মতো বিহ্বল আবেগে ফুলো ফুলো। প্রথম যেদিন চোখে পড়ল, দাগ পড়ে গেল অবনীর বুকে। তারপর শেকড় গাড়তে গাড়তে, জড়িয়ে ধরল আষ্টেপৃষ্ঠে।
ললনার বাবা মা এসব দেখেও দেখেননি। কিন্তু দেখতে ভোলেননি অবনীর বাবা মা, ভাই বোন, আরও পাঁচ শরিকের খুড়ো-জ্যাঠা-দাদারা। প্রথমে কানাকানি, তারপরে ফিসফাস, তারও পরে গুঞ্জন। কিন্তু এই দু-বিঘে পুরনো বাড়িটার ভিতরেই যত। পারিবারিক ব্যাপারটা কেউ বাইরে টেনে নিয়ে গেল না।
অবনী একটু সাবধান হওয়ার চেষ্টা করল। তাই অন্ধকারে, ভাঙা পরিত্যক্ত চোরা সিঁড়ি দিয়ে, গোখরোর খোলস মাড়িয়ে এই দুঃসাহসিক অভিসার।
.
সেটাও ধরা পড়ে গেল। আন্দোলন উঠল সারা বাড়িতে।
কিন্তু এই দুজনের আন্দোলন তার চেয়ে অনেক বেশি। গোটা বাড়িটায় এঁটে উঠতে পারল না। ওরা দুজনে হল আরও বেপরোয়া। মাঝখান থেকে ছলনাটুকু গেল। অবনী সোজাসুজি নিজেদের উঠোন পেরিয়েই যাতায়াত করতে লাগল ললনাদের মহলে।
অবনীর মা রান্নাঘরে ভাত দিতে এসে, অভিমানক্ষুব্ধ গলায় বললেন, এসব কী হচ্ছে। তুই না বড় ছেলে এ-ঘরের। তবে যা খুশি তাই কর, আমি যাই কিছুদিন দাদার বাড়ি।
অবনী বলল, তার চেয়ে তোমরা থাকো, আমিই চলে যাব।
মনে মনে ভয়ে বিস্ময়ে শিউরে চুপ করে রইলেন অবনীর মা। ঘর ছাড়তেও ছেলে রাজি আছে তবে!
বাবা তো মুখে একেবারেই কুলুপকাটিই এঁটেছেন। এখন চেয়েও দেখেন না। অবনীর রোজগার ছাড়া সংসার চলবে না, ওঁর মুখে-চাবির ওইটিই কারণ। যদিও জানেন, ছেলে তাঁর বিদ্যায় বুদ্ধিতে রূপে, ব্যবহারে ও কথায়, গোটা নটীর হাটে প্রায় বেজোড়।
সব জানে, কিন্তু প্রাণ মানে না অবনীর। ললনার চোখের তারা ওকে টেনে নিয়ে যায়। সাড়া পড়ে গিয়েছে রক্তে, তাকে কী দিয়ে আটকে রাখবে অবনী।
রক্তে দোলা লেগেছে ললনারও। একটু দেরি হলে ঝড় ওঠে তার দু চোখে। অবনী কাছে এলেই, দু চোখে আলো জ্বেলে যেন আরতি করে। ঠোঁট দুটি আর একটু ফুলিয়ে বলে, এত দেরি করলে যে?
দেরি কোথায়? পাঁচ মিনিট তো।
ওইটুকুই অনেকখানি।
অবনী অবাক বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে ললনার রূপ দেখে ডুবে যায়। তার চেয়ে বেশি ললনা। অবনীকে বলে, তুমি যখন আমার রূপের প্রশংসা করো, মনে হয় ঠাট্টা করছ।
কেন?
নিজের রূপটা বুঝি তাকিয়ে দেখ না?
দেখে, কিন্তু সেটা স্বীকার করার মতো অবিনীত নয় অবনী। বলে, পুরুষের আবার রূপ!
ললনা কথাও জানে। বলে, হ্যাঁ, সেটা বলার জিনিস নয়, মনে মনেই জানি। তা ছাড়া, তোমার কত গুণ! তোমার পায়ের যুগ্যিও নই আমি।
অবনী বলে, তা ঠিকই। কেননা, তুমি যে বুকের যুগ্যি।
আহা ইয়ার্কি!
কখনও বলে, আচ্ছা, তোমার হাতের লেখাটা তুমি কী দিয়ে লেখো?
অবনী হেসে বলে, কেন, হাত দিয়েই।
তোমার হাতে তবে ছাপাখানার মেশিন বসানো আছে। আশ্চর্য। কী সুন্দর তোমার হাতের লেখা।
কথাটা ঠিক। অফিসে বড় সাহেব থেকে আদালিটি পর্যন্ত তার হাতের লেখায় মুগ্ধ। তার ইংরেজি ড্রাফট না হলে ছোট সাহেবের মন ওঠে না। নটীর হাটের ও অফিসের বন্ধুদের অনেকের ইংরেজি চিঠি লিখে দেওয়ার দায়টা সে সানন্দে নিয়েছে।
অবনী ললনাকে টেনে নিয়ে যায় বাড়ির পিছনের উঠোনের নির্জনে। বলে, আমার লেখার চেয়ে তোমার কথা যে আরও সুন্দর।
কিন্তু দেখা যায়, জিতটা শেষ পর্যন্ত ললনার। কেননা অবনীর চেহারা পোশাক, গুণ, সবই অতুলনীয়। ললনার বেলায় ললনা নিজেই মুখথাবাড়ি দেয় অবনীকে।
যদিও ক্ষীণ ললনা রেখায় কাজল টানতে গিয়ে চোখের ধারটা বাড়িয়েই ফেলে বেশি। কাঁধকাটা লাল জামাটার উপরে শাড়িটা এলিয়ে দিতে গিয়েও কষে জড়িয়ে ফেলে কোমরে। তাতে তার যৌবন যেন কী এক সর্বনাশ ও রহস্যের মতো বিচিত্রময়ী হয়ে ওঠে।
.
এমনি করে কেটে গেল আরও ছটি মাস। কখনও ভাঙা সিঁড়ি ভেঙে নড়বড়ে দোতলার ঘরে, কখনও পিছনের উঠোনের হাসনুহানার তলায়, ঘোর সন্ধ্যায়, খিড়কি দোর খুলে, লতাজঙ্গলে আবৃত পরিত্যক্ত বাগানে।
বাড়িতে সকলের অস্বস্তি। নটীর হাটের মানুষেরা নিশ্চিন্ত। সদরে কোনও সাড়াই নেই।
আমি ভাবি, তারপর? ঘুলঘুলি দিয়ে মাঝে মাঝে একটি লোককে আসতে দেখেছি ললনাদের বাড়িতে। বয়স হবে প্রায় পঁয়তাল্লিশ। ললনারা ডাকে বসন্তকাকা বলে। বাড়ি কলকাতায়, অবস্থাপন্নও বটে।
বসন্তকাকা একদৃষ্টে চেয়ে দেখেন ললনাকে। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলেন, নটীর হাটে আছ তাহলে ভালই!
যেমন দেখছেন।
দেখতে খুব ভাল নয় অবিশ্যি, মনে হয় অন্তরে অন্তরে ভালই।
ললনা কোনও জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে, আঙুলে ফাঁস জড়ায় আঁচল দিয়ে। বসন্তকাকা শান্ত মানুষ, চোখ-খাবলার মতো তাকিয়ে থাকেন ললনার দিকে। বলেন, মাসখানেকের মধ্যেই বাড়িটা বোধহয় কেনা হয়ে যাবে। আলিপুরের সেই বাড়িটা।
অবনী জিজ্ঞেস করে ললনাকে, উনি কে?
বসন্তকাকা।
আপন কাকা?
না, বাবার বন্ধু।
একথা সেকথার পর আজকাল অবনী বলে প্রায়ই, বাড়ির লোকেরা না বিয়ে দিলে আমরা রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ করতে পারি।
অবনীর একথার উপরে ললনা শুধু ওর বিলিতি পুতুলের মতো রক্তাভ ঠোঁট দুটি দেয় তুলে। অবনীর অসাড় অনুভূতিতে চাপা পড়ে যায় সিদ্ধান্তটা।
তারপর আমি দেখলাম আমার এই চিলেকোঠার ঘুলঘুলি দিয়ে, আসল সিদ্ধান্তটা বয়ে নিয়ে এলেন বসন্তকাকা। অবনী তখন অফিসে গেছে। বসন্তকাকা একেবারে লরি নিয়েই এসেছেন কলকাতা থেকে। ললনাদের মালপত্র উঠল তার মধ্যে। মালপত্র সামান্যই। ললনার মা বাবা-বোনেরাও উঠল বসন্তকাকার সঙ্গে।
ললনা উঠবার আগে অসঙ্কোচে এল অবনীদের উঠোনে, একেবারে অবনীর ঘরে। একটি খাম রাখল টেবিলে, তারপর অবনীর মাকে প্রণাম করে, বসন্তকাকার হাত ধরে লরিতে গিয়ে উঠল।
নটীর হাটের একটি বিশেষত্ব, মানুষ যেমন আসে, তেমন ফিরে যেতে পারে না। নটীর হাটের স্মৃতি নিয়ে গেল ললনা।
সন্ধ্যাবেলা যখন নটীর হাটের সদরে আমি শুনতে পেলাম অবনীর পদশব্দ, সাহস করে উঁকি দিতে পারলাম না ঘুলঘুলি দিয়ে।
বাড়ি এসে ন-জ্যাঠামশায়ের উঠোনের দরজাটা সপাটে খোলা দেখে অবাক হল অবনী। অন্ধকার দেখে আরও অবাক।
.
ঘরে এসে খাম দেখে খুলে ফেলল। চিঠিতে লেখা ছিল, বসন্তকাকা আমার নামে একটি বাড়ি কিনেছেন আলিপুরে। আমরা এখন থেকে সেখানেই থাকব। আমাদের পুরনো সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার জন্যে বাবাকে সাহায্য করবেন বসন্তকাকা।…নটীর হাটের স্বর্গর্বাসে এইটুকু বুঝে গেলাম, সংসারে এখনও কত ভাল মানুষ আছে, কত সুখ ও সৌন্দর্য আছে।–ললনা।
অবনী চিঠি রেখে, হাত মুখ ধুয়ে বলল, মা, খেতে দাও।
যেন কিছুই হয়নি, এমনি একটি ভাব করে বলল অবনী। কেবল ওর সুন্দর প্রসন্ন মুখের ঠোঁট আর নাকের পাশে কয়েকটি সুগভীর রেখা দেখা দিল। আমার ঘুলঘুলিতে ধরা পড়ল, অবনীর চোখে মুখে ওগুলি বিদ্রূপের চিহ্ন। নিঃশব্দে সবকিছুকেই সে বিদ্রূপ করছে।
তারপর মাসখানেক বাদে, অফিসে ছোটসাহেব প্রথম ওকে ডেকে পাঠালেন নিজের ঘরে। একটি কাগজ দেখিয়ে বললেন, এটা কার হাতের লেখা অবনী?
আমার!
ছোটসাহেবের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলেও বোধহয় এত বিস্মিত হতেন না। লাফিয়ে উঠে বললেন, ইমপসিবল! এত কুৎসিত হাতের লেখা তোমার?
সত্যি, হাতের লেখাটা অতি কদর্য, বকের ঠ্যাং-এর মতো। অবনী নির্বিকারভাবে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমারই।
ডেস্ক খুলে ছোটসাহেব আর-একটি কাগজ বার করলেন। তাতে ছিল মুক্তোঝরা হস্তাক্ষর। বললেন, এটা কার হাতের লেখা তবে?
ও বলল, আমারই। কিন্তু এখন আর আমি ওর চেয়ে ভাল লিখতে পারিনে।
ছোটসাহেব হাসবেন না কাঁদবেন, বুঝতে পারলেন না। কয়েক মিনিট প্রায় রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়তীব্র চোখে তাকিয়ে বললেন, কাগজ নাও আমি ডিকটেট করছি, তুমি লিখে যাও।
অনায়াসে লিখে গেল অবনী, অবিকল সেই কদর্য হাতের লেখাগুলির মতোই। ছোটসাহেব আরও খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা তুমি যাও।
চলে এল। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গোটা অফিস হাঁ করে তাকিয়ে রইল অবনীর দিকে। মানুষের পরিবর্তনের সঙ্গে যে তার হাতের লেখাও পরিবর্তন হয়, এমন বিচিত্র ব্যাপার কেউ দেখে নি। ব্যাপার কী?
নটীর হাটের মানুষের চোখে তখনও কিছুই ধরা পড়েনি।
কিন্তু একদিন ধরা পড়ল, চোখে-না-পড়ার ভিতর দিয়ে। অবনীর যাওয়া-আসার পথে, দোকানি আর পড়শী, সবাই ওকে একবার তাকিয়ে দেখত। এইজন্য দেখত যে, পাড়ার সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটা যাচ্ছে।
একদিন কেউ ফিরেও দেখল না, কারণ তারা চিনতে পারেনি যে, অবনী যাচ্ছে। কেননা, নটীর হাটের কড়ি মিস্তিরির মতো, ছোট ছোট চুলের মাঝখানে সিঁথিকাটা অবনীকে চেনাই দুষ্কর।
ওর ডেলি-প্যাসেঞ্জার বন্ধুরা, নটীর হাটের মানুষেরা সবাই অবাক হল, হাসল, দুঃখিত হল। কেউ বলল, এ আবার কেমন ফ্যাশান হে। কেউ বলল, অমন সুন্দর চুলগুলি! এ কী বিচ্ছিরি, ছি ছি…
অবনী হাসে। আমি দেখি, হাসির মধ্যে ওর সেই বিদ্রূপই আরও তীব্র হয়ে উঠছে। কিন্তু তার মুখটা যাচ্ছে বদলে, আর হাসিটা অবিকল নটীর হাটের তেজারতি কারবারি নফর কুণ্ডুর মতো ছুঁচলো আর কুৎসিত হয়ে উঠল।
এর সঙ্গে সঙ্গেই এল একটু শীর্ণতা, গোমড়া মুখ আর অঙ্ক কষিয়ে বুড়ো-মাস্টারের মতো নীরবতা। চোখে ছানি পড়েনি নিশ্চয়ই। কিন্তু চোখের মণি দুটিও কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে উঠল। ধবধবে রংটা গেল কালো হয়ে। শেষে প্যান্টশার্টগুলির রং-এর রুচিই শুধু গেল না, শরীরের তুলনায় বড় ঢলঢলে হল।
ঠিক সেই দুটি হাতের লেখার মতো। প্রায় চাঁদের সঙ্গে জোনাকির মতো তফাত। ছ মাসের মধ্যে ওকে দেখাতে লাগল যেন পসারহীন বয়স্ক উকিলের মতো।
আমি ভাবি, এ ভয়ঙ্কর প্রতিশোধটা নিচ্ছে কেন প্রকৃতি, কীসের জন্যে। নটীর হাটের ফিসফাস গুঞ্জরিত হয়ে উঠল। মন্দিরে, বৈঠকখানায়, ক্লাব-ঘরে আর রকের সান্ধ্য আসরগুলির সব মাথা টনটন করে উঠল ব্যথায়। বাঁড়ুজ্যেদের সেজ শরিকের ঘরের ভিতরে ঘটছেটা কী? হিং-টিং-ছট-এর মতো উদ্ধারের আশায় ঘোল খেতে লাগল সবাই।
ছোট ছোট ছেলেপিলেরা অবনীর পিছনে লাগল একটু-একটু করে। কেননা, তারা জানে অবুদা পাগল হয়ে গেছে। আর পাগল হলেই সে আর মানুষ থাকে না, তখন তাকে ঢিল মারতে হয়, কাদা ছুঁড়তে হয়, পিছনে লাগতে হয়। পথে পড়ে ফণীন্দ্র ঘটকের বাড়ি। তার রূপসী সাত মেয়ে রাস্তার ধারে জানালায় দাঁড়িয়ে হেসে মরে। কেননা, অবনীটা যদি পাগলই হল, তবে তাদের সাতবোনের খপ্পরে পড়তে বাধা ছিল কোথায়?
এসব শুধু উপরে-উপরে। ভিতরে ভিতরেও অবনীর নতুন পরিবর্তন দেখা গেল। অফিসের লেখায় ভুল বেরিয়ে পড়ে রোজই। সেখানে ওকে করুণা করল সাহেব।
বাড়িতে তো কান্নাকাটির দাখিল। বাবা মরতে লাগলেন গুমরে গুমরে। মা চেয়ে থাকেন জলভরা চোখে। ভাইবোনেরা ভীত, বিস্মিত।
ছ মাস বাদে, মাইনে পেয়ে অবনী বাড়িতে টাকা কমিয়ে দিল অর্ধেক।
মা বললেন, এ কী, এত কম?
ও বলল মোটা ঘড়ঘড়ে গলায়, ওর চেয়ে বেশি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার একটা ভবিষ্যৎ দেখতে হবে তো।
মায়ের প্রাণটা ধক করে উঠল। ও মা! বলে কী। বললেন, কী বলছিস তুই অবন?
অবনী হাসল, ঠিকই বলছি। আর তা ছাড়া খাওয়ার অত বাছাবাছি কীসের? শুধু ডাল-ভাত করতে পারো না?
মায়ের মনে হল, তিনি জ্ঞান হারাবেন, পড়ে যাবেন ধুলোয়। এটা কে? বাড়ির কারুর খাওয়ার দুঃখ যে সহ্য করতে পারে না, সেই ছেলে এই?
তারপর দেখা গেল, অবনীকে ভাত দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। মুখে নয়, অন্তরে বললেন, শুধু ভাতগুলি অমন রাক্ষসের মতো খায় কী করে ছেলেটা। মনে মনে বলতে হল মাকে, কী বিশ্রী খাওয়া!
এখন অবনী সরষের তেল মাখে মাথায় খাবলা খাবলা, ঘসর ঘসর দাঁত মাজে ছাই দিয়ে।
একদিন ঠাকুরদালানের উঠানে এক তাল গোবর দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল অবনী। গোবর এরকম বহুদিন চোখে পড়েছে, কিন্তু ফিরেও দেখেনি। হঠাৎ ছোট বোনকে ডাকল কেমন একটা গোঁয়ারের মতো করে। বলল, খেতে পারিস, আর গোবরটুকু কুড়িয়ে দেয়ালে চাপটি মেরে রাখতে পারিসনে। রোজ রোজ অত ঘুঁটের পয়সা আসে কোত্থেকে।
বিষয়টা সামান্য, কিন্তু কত যে অসামান্য সেইটি ভেবে, আড়ালে বসে আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন ওর মা।
অনেকদিন পর সাহস সঞ্চয় করে একদিন মা বলে ফেললেন, অবন, ললনাকে তুই বিয়ে করে আন।
মায়ের দিকে তাকিয়ে ওর এখনকার স্বভাব-কুৎসিত হাসি উঠল ফুটে, বলল, দোকানের পুতুল নাকি সে?
আরও কয়েক মাস বাদে দেখা গেল, অবনীর ডান কাঁধটা যাচ্ছে উঁচিয়ে। একটু একটু করে বেশ খানিকটা উঁচু হয়ে শরীরটা গেল বেঁকে। তারপরে বাঁ পা খোঁড়াতে লাগল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোমর বেঁকে হাঁটু ভেঙে কেমন একটা বিশ্রি হ্যাঁচকা দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল ও।
আমি আমার ঘুলঘুলি থেকে দেখলাম, অবনীর চলার ভঙ্গিতেও একটা ভয়ঙ্কর বিদ্রূপ ফেটে পড়ছে। ঠিক একটা ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত মানুষ একজনকে ভেংচালে যেমন হয়, সেইরকম।
রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে রোজ দেখল ওকে নটীর হাটের মানুষেরা। আর সে সবাইকে যেন ভেংচাতে লাগল এই কদর্য ভঙ্গিতে। চলার তালে তালে ওর বুকের থেকে একটি শব্দ এসে বাজল আমার কানে, এই, এই তো দ্যাখ চেয়ে, এই আমি।
ঘরে বাইরে সবাইকে জানিয়ে দিল, আপনি আপনি ওর হাত পা এমনি বেঁকে যাচ্ছে, নার্ভগুলি যাচ্ছে মরে, হাত আর পা যাচ্ছে শুকিয়ে।
ঘরে বলল, বাইরের ডাক্তার দেখছে। বাইরে বলল, দেখছে ঘরের ডাক্তার।
আর মধ্যরাত্রে আয়নার সামনে ঠিক সেই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তেমনি কুৎসিত হেসে বলল, চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত অনেক ভান করেছি। আসল রূপটা ফুটেছে আমার এতদিনে।
আমি আমার চিলেকোঠাখানিতে বসে ভাবছিলাম, মানুষের মনের চিলেকোঠায় কতগুলি ঘুলঘুলি আছে।
কিন্তু সামনের রাস্তায় অনেক লোক ওর পিছনে লাগল। অকারণ ডেকে ডেকে নানান কথা জিজ্ঞাসাবাদ করে। কেউ ঠাট্টা করে, করুণা করে কেউ। ছোঁয়াচে রোগের ভয়ও আছে অনেকের।
ওদের বাড়ি থেকে পশ্চিমে, হোমিওপ্যাথি ডাক্তার গোকুল মিত্তিরের বাড়ির কাছে এসে, দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে যেতে লাগল রোজ। আগে যেত গোকুল ডাক্তারের বাড়ির উত্তর দিক দিয়ে।
এতদিন আমার ঘুলঘুলি থেকে যেটা দেখেও দেখিনি, তা হল দুটি চোখ। লক্ষ করে দেখলাম, অবনীর যাওয়া-আসার সময়টিতেই ঠিক নির্বাক নিশ্চল পটের মতো সেই চোখ দুটি গোকুল ডাক্তারের জানালার গরাদ থেকে তাকিয়ে থাকে অপলক। সেই চোখে যত মুগ্ধতা, তত বিস্ময়, তত করুণা।
চোখ দুটি গোকুল ডাক্তারের মেয়ে পারুলের। মনে পড়ল, পারুলের চোখদুটি এমনি পটে আঁকা ছবিটির মতো তিন বছর ধরে তাকিয়ে আছে। কারও চোখে পড়ে না। অবনীরও পড়েনি।
পারুলের রূপ বলতে কিছু নেই। কালো রং, সাদাসিধে মুখ। আটপৌরে শাড়িতে কুড়ি বছরের একটি নির্জন নদীর জোয়ার আপন উল্লাসে টলোমলো। অতি সাধারণ চোখ দুটিতে অতল গভীরতা। চুলগুলি বাঁধে রোজ আঁট খোঁপা করে। পারুলকে চোখে পড়তে চায় না।
আমার মতো অবনীটাও কানা ছিল এতদিন। এতদিন ও উত্তরে বেঁকেছে। এখন দক্ষিণে বেঁকতে গিয়ে সহসা একদিন চোখ পড়ে গেল পারুলের চোখে।
পারুলের মুগ্ধ বিস্মিত করুণ চোখ দুটিতে কী ছিল, কে জানে। অবনীর উঁচিয়ে ওঠা কাঁধটা হঠাৎ একটু নেমে গেল যেন।
তেমনি লেংচে খানিকটা এগিয়ে আবার ওর কাঁধটা উঁচু হল।
পরদিন মনে ছিল না। কিন্তু চোখাচোখি হতেই, অবনীর কাঁধ আর বাঁ পাটা সহসা যেন নাড়া খেয়ে সোজা হয়ে উঠল।
আমিও নাড়া খেয়ে গেলাম আমার এই অদৃশ্য চিলেকোঠার মধ্যে। এ যেন কেমন এক শক-ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেল অবনীর।
কিন্তু পরমুহূর্তেই ও আবার লেংচে বেঁকে চলল উত্তরে। দূর থেকে একবার আড়চোখে ফিরে দেখল।
অথচ পরদিনই আবার তেমনি নাড়া খেয়ে সোজা হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা গেল অবনীর। মুখে বিদ্যুৎ-চকিতে দেখা দিয়ে গেল সেই কোমল মিষ্টি ভাবখানি। কিন্তু সবটুকুই বিদ্যুৎ-চমকের মতোই। রোজই প্রায় চলল এরকম।
আর আমি দেখলাম পারুলের মুগ্ধ চোখদুটিতে এক বিচিত্র আবেগের সঞ্চার। জানালায় আসার সময়টা গেল ওর আরও বেড়ে। যেন এই নটীর হাটের মতো, নটীর হাটের আকাশের মতো–চিরদিন সে জানালায় বসে থাকতে চায়, থাকবে। ছিলও তাই, বারো বছর বয়স থেকে, উমার তপস্যার মতো।
আমি দেখলাম পরম কৌতূহলে, অবনীর কাঁধটা কেমন সমান হয়ে আসছে, পাটা খুব ধীরে ধীরে, একটু একটু করে সোজা হয়ে উঠছে। তারপরে কেশে-বেশেও যেন একটি অস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দিল। হাসিটা ফিরে পেতে লাগল আগের মাধুর্য।
সেটাও সকলের চোখে পড়ল, ঘরে ও বাইরে কিন্তু রহস্যটি ধরা পড়ল না কারুর কাছে।
.
তারপর একদিন ফেরার পথে, সন্ধ্যাবেলা অবনী দাঁড়িয়ে পড়ল পারুলের জানালাটার কাছে। একবার পারুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটু সলজ্জ ভাবেই মাথা নত করল সে। ওর পুরনো কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করল, গোকুলকাকা ভাল আছেন?
পারুলের মনে হল, ওর নির্জন নদীটা হঠাৎ বানে এক্ষুনি প্লাবিত হয়ে যাবে। কোনওরকমে বলল, হ্যাঁ।
চলে গেল অবনী।
পরদিন আবার দাঁড়াল। বলল, গঙ্গার ধারে শিবের ঘাটে আসবে?
পারুলের বুকের মধ্যে কাঁপছিল থরথর করে। বলল, যাব। আপনি যান।
প্রায় আগেরই মতো হেঁটে অবনী নির্জন শিবের ঘাটে এল। সন্ধ্যা তখনও উতরোয়নি। নটীর হাটের পশ্চিমাকাশে লাল রং লেগে আছে তখনও।
অবনী ভাবতে চেষ্টা করল এটা কোন ঋতু, কী মাস। বাতাসে ঈষৎ শীতের আভাস আছে।
পারুল এল। দাঁড়াল একটু দূরে। নির্জন নদীটি সঙ্গমের বাঁকে এসে থমকে গেছে যেন।
অবনী বলল, এসো।
পারুল কাছে এল। এসে, তাকিয়ে আবার চোখ নামাল। দুজনেই খানিকক্ষণ চুপচাপ।
অবনী বলল, এমন করে রোজ কী দেখো পারুল।
বলতে গিয়েও পারুল প্রথমে জবাব দিতে পারল না। কয়েকবার জিজ্ঞাসার পর বলল, বুঝতে পারেন না?
পারুলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল অবনী। তারপর বলল, পারি। কিন্তু কেন পারুল?
পারুল তাকাল ওর সেই মুগ্ধ চোখ তুলে।
আবার দুজনেই চুপচাপ।
খানিকক্ষণ পর পারুল বলল, আপনার অসুখ একেবারে সেরে গেছে?
সেইটাই ভয় করছিল আজ অবনীর। সত্যি, সেরেছে তো? ওর রোগ, পঙ্গুতা, ভীরুতা, নীচতা। গলার কাছে বড় শক্ত লাগছিল কিছু। পারুলের হাত ধরে তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে বলল, বুঝতে পারছিনে পারুল।
কিন্তু পারুলের চোখে কোনও সংশয় নেই।
নির্জন ঘাট। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে আরও। পারুল নিজেই ওর মুখখানি বাড়িয়ে নিয়ে এল অবনীর দিকে।
অবনীর অসুখটা যেন শেষবারের মতো বেড়ে উঠল। মুখ বিকৃত করে, চোখ কুঁচকে সে তাকাল পারুলের চোখের দিকে, ঠোঁটের দিকে।
পরমুহূর্তেই তার মুখ চোখ স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। জল এল বোধ হয় চোখে। আকণ্ঠ-পিপাসায় পারুলের ঠোঁটের ওপর নেমে এল সে চাতকের মতো। বলল, হ্যাঁ, সেরেই তো উঠেছি পারুল।
.
চোখ ফিরিয়ে নিলাম ঘুলঘুলি থেকে। অবাক হয়ে ভাবলাম, ঘরের কোণে পড়ে থাকা ওষুধ-লতার এমনি গুণ নাকি! শুধু দুটি চোখের তারায় অসুখও সেরে যায় এই মানুষের সংসারে।
নটীর হাটের মাথাব্যথা আবার একবার নতুন করে উঠল কয়েকদিন। কেউ বলল, ভূতে ধরেছিল। কেউ বলল, না, এরকম একটা রোগ সম্প্রতি দেখা দিয়েছে। সেবারে আমার দিদির…
মুণ্ডু! খোঁজ নিয়ে দেখ, নির্ঘাত কোন তালে ছিল। ফেরেব্বাজ নয়ন সাধুখাঁ জালিয়াতির দায়ে একবার বোবা আর কালা হয়ে গেছল, মনে আছে?
বাসু পুরুতের গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে বললে গদাই, ওসব শালা কিছু নয়, সেরেফ ভি-ডি বাবা। গদাশালার চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না, ওসব শালা অনেক, শালা…
তা বটে। গদা একসময়ে হামা দিয়েও চলেছে। এর উপরে আর কথাই নেই।