2 of 2

আরামকেদারায় বসে গোয়েন্দাগিরি – শোভন সোম

আরামকেদারায় বসে গোয়েন্দাগিরি – শোভন সোম

ইদানীং এ-দেশে নানা গোয়েন্দা-সংস্থা গড়ে উঠেছে। রীতিমতো ঘর সাজিয়ে কর্মচারী নিয়োগ করে এঁরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। তথাপি এ-দেশের মানুষদের মধ্যে তদন্ত-মনস্কতা তেমন লক্ষণীয়ভাবে গড়ে ওঠেনি। এ-দেশে এখনও তদন্তের ব্যাপারে সাবেকি পুলিশি ব্যবস্থাই চলেছে আর আদালতের রায়কেই শেষ বলে মেনে নেওয়া হয়। গোয়েন্দা-সংস্থাগুলিকেও প্রকৃত তদন্তের কাজে ডাকা হয় না। এদের মারফত রক্ষী, প্রহরী ইত্যাদিই বিভিন্ন দফতর তলব করে থাকেন। কদাচিৎ কোনও ধনী মহিলা তাঁর সন্দেহভাজন স্বামীর কিংবা কোনও স্বামী তাঁর সন্দেহভাজন স্ত্রীর কার্যকলাপের ওপর নজরদারির কাজে এঁদের লাগিয়ে থাকেন।

যেখানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলিরই এই হাল, সেখানে শৌখিন গোয়েন্দাদের হাল সহজে অনুমেয়। সুতরাং শুভ চৌধুরীর হাতে গত ছ’মাস কোনও কাজ নেই। বই পড়ে, দাবা খেলে, আড্ডা মেরে, সিনেমা দেখে, বিছানায় যখন-তখন শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিয়েও সময় কাটছিল না। এদিকে ভাঁড়ে মা ভবানী আসবেন-আসবেন করছেন।

গল্পে যা ঘটে থাকে, শুভর ক্ষেত্রেও তাই হল। একদা প্রাতে একটি বাহক-চালিত লাল মারুতি তার দোরগোড়ায় এসে থামল। কলকাতায় এই হালেও কালো অ্যাম্বাসাডার রাস্তা দাপিয়ে বেড়াত। অতি সম্প্রতি কালো অ্যাম্বাসাডারকে পিছনে ফেলে তার জায়গা দখল করেছে লাল মারুতি।

লাল মারুতি থেকে সাফারি সুট পরা, দামি জুতো পরা, স্থূল চেহারার এক ভদ্রলোক নেমে এলেন। শুভ জানলা দিয়ে সবই দেখছিল। তার ধারণা ঠিকই ছিল। ভদ্রলোক শুভর দরজার ঘণ্টিই বাজালেন। দরজা খুলে দিল শুভই।

মিস্টার চৌধুরী আছেন?

হ্যাঁ। আমিই। আসুন।

নমস্কার।

নমস্কার। আসুন ভেতরে।

শুভ দেখতে পেল ভদ্রলোকের আট আঙুলে গোটাকয়েক আংটি। নবগ্রহের হেন গ্রহ নেই যার অধিষ্ঠান এই ভদ্রলোকের আঙুলে নেই। জামার নীচে হয়তো নবগ্রহের তাবিজও দেখা যাবে, কিংবা কোমরে স্বপ্নাদ্য ঘুনসি থাকলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। ভদ্রলোক বিলক্ষণ গ্রহ-নক্ষত্রে, জ্যোতিষ্কে, বারবেলায়, পুজো-আচ্চায় বিশ্বাস করেন, পথে আসতে-যেতে সব মন্দিরের উদ্দেশে, এমনকী গাছের নীচে বসানো সব সিঁদুর-লেপা পাথরের উদ্দেশেও কপালে হাত ঠেকান। শুভ এ-ও অনুমান করে নিল যে, ইনি নির্ঘাত একজন ব্যবসায়ী, এঁর সুখের ঘরে আগুন লেগেছে, তাই তিনি শুভর মতো একজন গোয়েন্দার দ্বারস্থ। সাধারণত ব্যবসায়ী মানুষেরা থানা-পুলিশের বাইরে তাঁদের ঝুটঝামেলা মিটিয়ে নেওয়া পছন্দ করেন। ভাবনাগুলিকে শুভ মনে-মনে দাবার ঘুঁটির মতো সাজাচ্ছিল এবং তার একটাও বেচাল ছিল না।

ভদ্রলোক সোফায় বসে পকেট থেকে বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট খুলে শুভর দিকে এগিয়ে দিলেন।

শুভ বলল, আমি ব্র্যান্ড চেঞ্জ পছন্দ করি না। ধন্যবাদ।

ও, আই সি।

শুভ মৃদু হাসল।

ভদ্রলোক পকেট থেকে জাপানি লাইটার বার করলেন। এটা টিপলে আগুনও জ্বলে বাজনাও বাজে। বাচ্চারা যেমন নতুন খেলনা দেখলে হাত বাড়ায়, তেমনি এক ধরনের উঠতি বড়লোক যা নতুন দেখেন তাই কেনেন। কে সাবেকি বড়লোক, মানে ধনী, আর কে উঠতি বড়লোক, তা এই স্বভাব দেখেও চেনা যায়। উঠতিদের মধ্যে সৌন্দর্যহীন স্থূল দেখানে-স্বভাব বা ছেলেমানুষি রীতিমতো হাস্যকর।

হ্যাঁ, বলুন।

আমি দেবেন সাধুখাঁ।—ভদ্রলোক বুকপকেটে রাখা দামি ওয়ালেট থেকে এমবস-করা-অক্ষরে ছাপা দামি ভিজিটিং কার্ড বার করে শুভর দিকে এগিয়ে দিলেন : ছোটখাটো ব্যবসা করি, এই এয়ার কন্ডিশনিং-এর ব্যবসা। জানেনই তো আজকাল ব্যবসায় কত মন্দা!

এই ব্যাখ্যানা শুভর জানা, তাই ভদ্রলোককে আর ভনিতার অবকাশ না দিয়ে বলল, তা আমার কাছে কী প্রয়োজন, সেটা বলুন।

হ্যাঁ, সেই কথাতেই তো আসছি। জানেনই তো, আজকাল ব্যবসায় কত মন্দা আর সেই সঙ্গে রেষারেষি…কে কাকে কী করে ল্যাং মারবে…।

তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমার কাছে কী প্রয়োজনে আসা, সেটা খোলসা করুন।

একেই ব্যবসা ভালো চলে না। কলকাতায় এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম তেমন চলেও না, তার ওপর যদি আমাকে, বিশেষ করে আমাকে, পেটে লাথি মারার ষড়যন্ত্র হয়, তা হলে কী করে চলে বলুন তো!

শুভ এ-ধরনের লোককে চেনে। এরা সহজে আসল কথায় পৌঁছতে চায় না। তাই সে বিরক্ত না হয়েই বলল, আমি মশাই ব্যবসার কিছু জানি না। আদার ব্যাপারি, তাই আমার সালিশি আপনার কাজে লাগবে না। আমার কাছে আগমনের হেতুটা বলে ফেলুন তো!

আপনি কি ব্যস্ত আছেন নাকি?

না, ঠিক তা নয়। আপনি একটু বাদে এলেই আমাকে পেতেন না। আমি দাবা খেলতে বেরোতাম। যা-ই বলুন, বুদ্ধির বেড়ে খেলা।

আমার যে আপনার সঙ্গে ভীষণ জরুরি কথা আছে!

সেজন্যেই বলছি, ভীষণ জরুরি কথাটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন।

ব্যাপারটা আমার কনসার্নের জুনিয়ার এঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে। সেল-এর ব্যাপারটা তারাই দ্যাখে। তারাই ব্যবসার ঘুঁটি। এখানে-ওখানে ছোটে, অর্ডার আনে, প্ল্যান্ট-এর তদারকি করে, আফটার সেলস সার্ভিস দেখাশোনা করে। প্রথম ব্যাপারটা ঘটে ঠিক এক বছর আগে। বেলঘরিয়ায় একটা বড় কনসার্ন থেকে বেশ বড় একটা অর্ডার নিয়ে ফেরবার পথে আমাদের জুনিয়ার এঞ্জিনিয়ার ভূনাথ সরকার ট্রেনে কাটা পড়েন—।

ওয়েট এ মিনিট। আপনার এয়ার কন্ডিশনিং-এর ব্যবসা, এত বড় সব অর্ডার পান, আর তার কোনওটাই নিশ্চয়ই লাখের নীচে নয়। আর আপনার এঞ্জিনিয়াররা অর্ডার আনতে যান বাসে-ট্রেনে! সে কী মশাই! না মশাই, আপনার কী কেস, তা না জানলেও আপনার কেস আমি নিতে পারব না। তার চেয়ে দাবা খেলে দিন কাটানো ভালো।

ভুল বুঝবেন না, মিস্টার চৌধুরী। তাদের আমরা ট্র্যাভেলিং অ্যালাওয়েন্স দিই। ট্যাক্সিতেই তাদের যাতায়াত করার কথা। সেদিন কোনও কারণে ভূনাথ সরকার ট্রেনে ফিরছিলেন। আমার ধারণা, কেউ এর পেছনে ছিল যার পরামর্শে ভূনাথ সরকার ট্যাক্সিতে না গিয়ে টেন ধরতে ছুটেছিলেন। বেলঘরিয়ায় তো দেখেছেন, কেউ ওভারব্রিজ ব্যবহার করে না, আর কর্তৃপক্ষও ওই বিপজ্জনক ওভারব্রিজ মেরামত করেন না। দলে-দলে লোক প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও লাইন পারাপার করে। ভূনাথ সরকার রীতিমতো স্মার্ট তরুণ ছিলেন। আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস, কেউ তাঁকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে, যার ফলে উনি হোঁচট খেয়ে লাইনে পড়ে যান আর উঠে দাঁড়াতে-না-দাঁড়তেই একটা থ্রু টেন ওঁর ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে চলে যায়।

হুঁ, তারপর?

তার পরের ঘটনা ঘটে তার ঠিক চারমাস বাদে। সে এক বীভৎস ব্যাপার!

তার মানে দ্বিতীয় মৃত্যু?

মৃত্যু কী মশাই, আগেরটার মতো এটাও সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড!

যেমন?

অঙ্কুর দত্ত সবে যাদবপুর থেকে পাশ করে ঢুকেছিলেন। আমি জানতাম, অত চৌকস ছেলে ডি. কে. এস. এয়ার কন্ডিশনিং-এ বেশিদিন থাকার পাত্তর নয়—নেহাত মনের মতো চাকরি পাচ্ছিলেন না বলে ছিলেন। বেশিদিন থাকবেন না তা জানতাম, কিন্তু এভাবে যাবেন, তা তো জানতাম না!

হয়েছিল কী?

ন’টা থেকে দশটার মধ্যেই জুনিয়ার এঞ্জিনিয়াররা অফিসে এসে যান। এসে কফি খান, কাগজপত্র ঠিকঠাক করেন, তারপর সেলসের কাজে বেরিয়ে পড়েন। সেদিন অঙ্কুর দত্ত এসে দেখতে পান ওঁর টেবিলে সুদৃশ্য কাগজে মোড়া একটা ছোট প্যাকেট রয়েছে। প্যাকেটের ওপরে সেলোটেপ দিয়ে আটকানো একটা ছোট চিরকুটে টাইপ করে লেখা ছিল, বার্থ ডে সারপ্রাইজ ফ্রম এ নিয়ার ওয়ান—অতি নিকট একজনের কাছ থেকে জন্মদিনের চমক। অঙ্কুর দরোয়ান চাপরাশিদের ডেকে জিগ্যেস করেন, এটা কে রেখে গেছে। কিন্তু ওরা বলে, তেমন কাউকে ওরা দেখেনি। আর অফিসে তো কত লোকই যাতায়াত করে।

আশপাশে আর কোনও জুনিয়ার এঞ্জিনিয়ার ছিলেন না?

ছিলেন, অঙ্কুর দত্ত তাঁদেরও জিগ্যেস করেন। তাঁরাও জানতেন না, কে ওটা রেখে গেছে। তাঁরা ওটা নিয়ে ওঁর সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশাও করেন। কিন্তু কৌতূহল বড় বালাই। অঙ্কুর দত্ত প্যাকেটটা খোলেন। সেটা আলগা করে মোড়া একটা হালকা কাগজের বাক্স। তারপরেই সেই কাণ্ডটা ঘটে।

কী কাণ্ড!

বাক্সে ছিল একটা আকাসানো কালকেউটে, জীবন্ত বিষধর। বাক্সের ঢাকনা খোলামাত্র ওটা অঙ্কুরকে মোক্ষম ছোবল মারে মুখে। বহু চেষ্টায়ও ওঁকে বাঁচানো যায়নি। বেচারা জন্মদিনেই মারা যান। ওঁর বিধবা মায়ের কান্না যদি দেখতেন! আপনিই বলুন, এটা কি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয়!

হতে পারে। তবে হত্যাকারী অঙ্কুর দত্তর নাড়িনক্ষত্র জানত।

সে-কথায়ই তো আসছি।—দেবেন সাধুখাঁ আর-একটা সিগারেট ধরালেন। লাইটার জ্বালতেই আবার সেই একঘেয়ে বাজনাটা বাজল।—এবার আবার মাস-চারেক বাদে ঘটল তৃতীয় ঘটনাটা। এবারের শিকার হাসান আলি। বেগমপুরের বর্ধিষ্ণু পরিবারের ছেলে, সবে পাশ করে বেরিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিলেন হাসান। তাঁর কাজের দক্ষতা আর মধুর স্বভাবের তুলনা ছিল না। অত হাসিখুশি তরুণ কেন যে পনেরোতলা থেকে ঝাঁপ দেবেন, জানি না। ওঁর মনে তেমন কোনও দুঃখ ছিল বলেও শুনিনি। পুলিশি মতে এটা আত্মহত্যার ঘটনা। অঙ্কুর দত্তের ব্যাপারে পুলিশ আমাদের সবাইকে জেরায় জেরবার করেও কোনও কিনারায় পৌঁছতে পারেনি।

তা মোদ্দা কথাটা কী? এই তিনটে মৃত্যু…।

তিনটেই নয় মশাই, আরও একটি।

বাপরে! একটা মৃত্যুর ঠিকুজি মেলাতেই জান কাবার, আপনি যে মশাই, মৃত্যুর মেলা জমিয়েছেন।

ঠিক তাই। বেছে-বেছে আমার কনসার্নের দক্ষ এঞ্জিনিয়ারদের একটির পর একটি এভাবে সাবাড় করার পেছনে কোনও পরিকল্পনা নেই, তা আমি কী করে বিশ্বাস করি! আর পুলিশে আমার আস্থা নেই বলেই তো আপনার কাছে আসা।

পুলিশের কাজ করবে পুলিশ, আমার কাজ আমি। না মশাই, আপনি আজ আমার দাবা খেলাটাই মাটি করলেন। এককাপ কফি হোক।

কফি!

হ্যাঁ। আপনার গল্প হতে-হতে কফি তৈরি হয়ে যাবে। হ্যাঁ, এবার বলুন চতুর্থ হত্যাকাণ্ডের কথা। এটাই শেষ তো!

হ্যাঁ। এবার খুন হন আর-এক এঞ্জিনিয়ার। চন্দ্রদেব সাকসেনা। ইউ. পি.-র লোক। কলকাতায় জন্ম-কর্ম। এঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে ইনিই সবচেয়ে বয়স্ক ছিলেন। নানা চাকরির পর আমাদের এখানে আসেন। ইনি বিহার ইউ. পি.-র বেশ কয়েকটা কোল্ড স্টোরেজের কাজ জোগাড় করেছিলেন। সাতদিন আগে ইনি নিজের বাড়িতে খুন হন।

কীভাবে?

হত্যাকারী তাঁকে পিস্তল দিয়ে খুন করে। বেনম্বর, বেলাইসেন্স পিস্তল ওঁর বাঁহাতের কাছে টেবিলে পাওয়া যায়। বাড়িতে বৈঠকখানায় বসে উনি লেখাপড়া করছিলেন। সামনের দরজা খোলা ছিল। লোডশেডিং ছিল। গুমোটের সন্ধে। তাই বোধহয় দরজা খোলা রেখেছিলেন। টেবিলে কাচের বাতি ছিল। সেই অবস্থায় চেয়ারে বসে থেকেই খুন হন।

আর পিস্তলটা?

ওটা ওঁর বাঁহাতের কাছে টেবিলে ছিল। গুলি ওঁর বাঁ-চোয়াল ভেদ করে খুলি ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। উনি ন্যাটা ছিলেন না। হত্যাকারী নিশ্চয়ই ন্যাটা। তাই যাওয়ার আগে স্বাভাবিকভাবেই পিস্তলটা ওঁর বাঁ-দিকে ফেলে রেখে চলে যায়।

তা আমার কী করণীয়?

পরপর চারজন বীভৎসভাবে খুন হওয়ায় আমার ব্যবসা লাটে উঠেছে। বাকি চারজন জুনিয়ার এঞ্জিনিয়ার চাকরি ছাড়ার নোটিস দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, আমার সঙ্গে ব্যবসায় পেরে উঠছে না বলে সূরজপ্রকাশ ঝুনঝুনওয়ালা একে-একে আমাদের এঞ্জিনিয়ারদের খতম করে বাকিদের ভয় দেখাচ্ছে, যাতে আমাদের কনসার্নে লালবাতি জ্বলে, আর ও চুটিয়ে ব্যবসা করে।

আপনার এই ধারণা হল কী করে?

কফির কাপে চুমুক দিয়ে দেবেন সাধুখাঁ বললেন, একটা প্যাটার্ন লক্ষ করছেন না? ঠিক চারমাস পর-পর এক-একজন দক্ষ কর্মীকে এভাবে হত্যা করার পেছনে পরিকল্পনা না থেকে পারে? আপনি তো মশাই, একজন নামি গোয়েন্দা!

তা বটে, তবে সন্দেহের একটা পাকা ভিত থাকা চাই। নড়বড়ে ভিতে দাঁড়ানো সন্দেহ টেকে না।

আপনাকে এই কেসটা নিতেই হবে। হত্যাকারীকে খুঁজে বার করে আপনি আমাকে বাঁচান। আপনাকে আগাম পাঁচ হাজার টাকা আমি দিয়ে যাচ্ছি। নিষ্পত্তি হলে আপনার যোগ্য ফিজ অবশ্যই আমি দেব।

দেবেন সাধুখাঁকে ওয়ালেট খুলে নোটের তাড়া বার করতে দেখে শুভ বলল, আমার মশাই, সাদা ব্যবসা। তাড়া-তাড়া নোট ওভাবে দেবেন না। আপনি বরং আমাকে চেকেই টাকাটা দিন।

ভদ্রলোক একটু হতচকিত হলেও পরে হেসে বললেন, বেশ। তাহলে আপনি কেসটা নিচ্ছেন। আমাকে বাঁচালেন, মশাই!

চেক হাতে নিয়ে শুভ বলল, আপনার ওই চার এঞ্জিনিয়ারের নাম-ঠিকানা-বৃত্তান্ত আমাকে লিখে দিয়ে যান, কিংবা আজই পাঠান। আর-একটা কথা, আমার তদন্ত চলাকালে অহেতুক খোঁচাখুঁচি করবেন না। মনে রাখবেন, আমার সন্দেহভাজনদের মধ্যে কিন্তু আপনিও পড়তে পারেন।

সে কী?—দেবেন সাধুখাঁ বিষম খেলেন।

হ্যাঁ, তাই। আপনার নিজেরও তো লালবাতি জ্বালার কোনও মোটিভ থাকতে পারে, কিংবা এরা সরে গেলে আপনিও লাভবান হতে পারেন।

মানে! কী বলছেন মশাই! তাহলে আমি আপনার কাছে ছুটে আসব কেন?

অপরাধীরা নিজেদের নিরপরাধ দেখাবার জন্যে এরকম করে থাকে, যাতে তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

দেবেন সাধুখাঁর হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে শুভ জোরে হেসে উঠল, দুর মশাই, আপনি এত ভিতু!

নিরঞ্জন সেনমজুমদার এখন লালবাজারে মিসিং পার্সনস স্কোয়াডে আছে। শুভর ফোন পেয়েই নিরঞ্জন বলল, কেউ হারিয়েছে নাকি রে?

শুভ বলল, কলকাতায় রোজ এত বেশি লোক হারায় যে, তোর বোঝার ওপর আমি শাকের আঁটি চাপাতে চাই না। ভয় নেই। তোর এক্তিয়ার না হলেও, একটা ব্যাপারে তোর সাহায্য চাই।

যথা?

ছ’জন লোকের নাড়িনক্ষত্রের সন্ধান। দুজন জীবিত আর চারজন মৃত। একটা কেস হাতে নিয়েছি, তাই।

তথাস্তু। তালিকাটা পাঠিয়ে দে।

আগে হাতে পেয়ে নিই।

সন্ধের আগেই পিয়ন মারফত দেবেন সাধুখাঁ টাইপ করে মৃত চারজন এঞ্জিনিয়ারের নাম-ঠিকানা-বৃত্তান্ত পাঠালেন। তার একটি কপি করে সেইসঙ্গে দেবেন সাধুখাঁ আর সূরজপ্রকাশ ঝুনঝুনওয়ালার নাম যোগ করে শুভ নিরঞ্জনের কাছে গেল।

শুভর ধারণা, সব কাজ পুলিশি সূত্রে হয় না। ফুলবাগানের ফৈজু, শেখ ফৈজুদ্দিনকে ফোনেই পাওয়া গেল। বাইরের জগতে ফৈজু ব্যবসায়ী। তার ব্যবসা ধূপকাঠির। তবে সেটা একটা আড়াল। কলকাতার ভাড়াটে খুনির সমস্ত সুলুকসন্ধান তার হাতে।

ফৈজু, একটা খবর চাই যে।

বলুন, চৌধুরীসাহেব।

জোড়াবাগানের চন্দ্রদেব সাকসেনা। গত সতেরোই নিজের বাড়িতে পিস্তলের গুলিতে মারা গেছেন। এটা কোনও ভাড়াটে খুনির কাজ কি না, যদি হয়ে থাকে, তবে কে তাকে নিয়োগ করেছিল, এই খবরটা যে আমার চাই।

জি পাবেন।

নিরঞ্জনের রিপোর্ট পাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফৈজুরও ফোন এল। সে জানাল, এটা কোনও ভাড়াটে খুনির কাজ নয়। অন্য কোনও খুনির কাজ কি না, তা ওর জানা নেই।

নিরঞ্জনের রিপোর্ট অনুসারে ভূনাথ সরকার ছিলেন সম্পন্ন পরিবারের ছেলে। তাঁর বিয়ের কথা চলছিল। নৈতিক চরিত্রের ব্যাপারেও কোনও অভিযোগ ছিল না।

অঙ্কুর দত্ত ছিলেন বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। কিন্তু অভাব বলে কিছু ছিল না। বাবা কলকাতায় বাড়ি রেখে গেছেন। তার ভাড়া মাসে বেশ মোটা রকমই ওঠে। একলাখ টাকার বিমা করেছিলেন। ওয়ারিশ ছিলেন তাঁর মা। ফুর্তিবাজ, আমুদে ছেলে। দু-একটা প্রেম-ট্রেম করতেন বটে, তবে তার বেশি কিছু না। তবে তিনি ছিলেন খুবই উচ্চাকাঙ্খী। সহকর্মীদের সঙ্গে খুবই সদ্ভাব ছিল। তাঁর প্রেমের কথা সবাইকে বলে বেশ বাহবা নিতেন।

হাসান আলি সবে বিয়ে করেছিলেন তাঁর খালাতো বোনকে। তাঁর স্ত্রী বেগমপুরেই মেয়েদের স্কুলে পড়ান। ওঁদের বিরাট একান্নবর্তী পরিবার। জমিজমা, পানের বরজ, গাই-গোরু আছে।

চন্দ্রদেব সাকসেনার অতীত ও হাল খুব ভালো ছিল না। যেখানেই চাকরি করেছেন সেখানেই টাকা চুরি, ঘুষ ইত্যাদি মামলায় জড়িয়ে গেছেন। তার ওপর ছিল নানা বদ নেশা। রেসে যেতেন নিয়মিত এবং হেরে আসতেন নিয়মিত। বাজারে তাঁর মোট দেনাই ছিল হাজার পঁচাত্তর। তার ওপর সম্প্রতি তিনি একলাখ টাকার বিমা করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান বর্তমান। পৈতৃক বাড়ি তাঁর বাবা পুত্রবধূর নামে লিখে ওঁকে কবুল করে যাওয়ায়, স্ত্রী বাড়িটা স্বামীর হাতে ছাড়েননি কিংবা বিক্রি করেননি।

দেবেন সাধুখাঁ শাঁসালো লোক হলেও খুব কষ্ট ও পরিশ্রম করেই এতবড় ব্যবসা খাড়া করেছেন। দেব-দ্বিজে, জ্যোতিষে অগাধ ভক্তি এবং একটু ভিতু স্বভাবের লোক। যা করেন আটঘাট বেঁধেই করেন। এমনকী তাঁর ইনকাম-ট্যাক্সের হিসেবও পরিষ্কার।

সূরজপ্রকাশ ঝুনঝুনওয়ালা ব্যবসাজগতের রাঘব বোয়াল হলেও এয়ার কন্ডিশনিং তাঁর একমাত্র ব্যবসা নয়। তার বড় ব্যবসা কাগজের কলে প্রেসের ছাঁট, আসাম ও উত্তরবঙ্গের বাঁশ ও কাঠ সাপ্লাইয়ের, মেশিনারি পার্টসের। এয়ার কন্ডিশনিং-এ তিনি দীর্ঘদিন থাকলেও, এ-ব্যাপারে পুলিশের চোখে সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়েনি। সবচেয়ে বড় কথা, গত বছর-দেড়েক তিনি নানা অসুখে প্রায়ই নার্সিংহোমে কাটাচ্ছেন। ব্যবসা দেখছে ছেলেরা। সূরজপ্রকাশ ধুতি-কোট-টুপি পরা ফোঁটা-তিলক-কাটা সাবেকি লোক হলেও, তাঁর ছেলেরা সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়া সাহেবি মেজাজের। তারা আধুনিক ম্যানেজমেন্টে আস্থাবান আর ব্যবসা ডাইভার্সিফিকেশানের কথা ভাবছে। সম্ভবত কম্পিউটারাইজড প্ল্যান্ট বসাবে, তাই ইতালির এক আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছে। সল্টলেকে জমি দেখা হয়েছে। রাজ্য সরকার এ-ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন।

দুয়ে-দুয়ে চার হয়, পাঁচ হয় না। নিরঞ্জনের রিপোর্ট যদি ঠিক হয়, তাহলে শুভর ছকও ঠিক। অবশ্য নিরঞ্জনের রিপোর্ট ভুল হওয়ার কথা নয়।

শুভ আবার নিরঞ্জনকে ফোন করল।

খুবই সাহায্য করলি, নিরঞ্জন, তবে শুধু আর-একটা খবর চাই। জোড়াবাগানের চন্দ্রদেব সাকসেনা পুলিশের মতে খুন হয়েছেন কি না, এই খবরটা একটু আমার দরকার।

ঠিক আছে। আজ সন্ধেবেলা বাড়ি আছিস?

হ্যাঁ। আসবি?

সময় পেলে তোর খবরটা নিয়েই আসব।

বেশ।

সন্ধেবেলা যথারীতি লোডশেডিং। ইদানীং কলকাতার সর্বত্র মশার বিস্তৃতি ঘটেছে। লন্ঠন-জ্বালা ঘরে মশা তাড়াতে শুভ নিজের গায়ে চড়চাপড় মেরে চলেছিল।

নিরঞ্জন ঘরে ঢুকে বলল, মাইরি, বাড়িতেও আলো নেই, এখানেও তথৈবচ। তার চেয়ে আয়, একটু ঘুরে আসি। গাড়ি আছে।

না হে বন্ধু, আগে খবরটা বলো, শুনি।

পুলিশের মতে চন্দ্রদেব সাকসেনা অজ্ঞাত আততায়ীর হাতেই খুন হয়েছেন। মোটিভ অনেক কিছুই থাকতে পারে। খুনের সময় ওঁর স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। ছেলেরা টিউটরের বাড়িতে গিয়ে পড়ে। লোডশেডিংয়ে ওরা কী করে বাড়ি ফিরবে, তাই তাঁর স্ত্রী ছেলেদের আনতে গিয়েছিলেন। তাঁর অ্যালিবাই পাকা। পড়শিরা কেউ গুলির শব্দ শুনতে পায়নি। পিস্তলে ছিল সাইলেন্সার লাগানো। হাট করে খোলা দরজা দিয়ে দুই পুত্রসহ ঢুকে তাঁর স্ত্রী-ই লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

আচ্ছা নিরঞ্জন, আর-একটা খবর একটু জোগাড় করে দিবি?

কী?

চন্দ্রদেবের মৃত্যুতে কি তাঁর স্ত্রী মুষড়ে পড়েছেন?

তা জানতে তো সরেজমিনে যেতে হয়।

তাই না হয় যাস।

যতই ছদ্মবেশ ধরুক, শুভর চোখকে নিরঞ্জন ফাঁকি দিতে পারেনি। নকল গোঁফ, ব্যাকব্রাশ চুল, মড গগলস আর সাদা শার্ট-প্যান্ট, হাতে ব্রিফকেসে নিরঞ্জনকে পাক্কা সেলসম্যানই মনে হচ্ছিল।

আগে গোঁফ খুলি। চিড়বিড় করছে মাইরি।

যা বাথরুমে, মুখটা ভালো করে ধুয়ে নিস।

ঘরে ফিরে সুস্থির হয়ে বসে নিরঞ্জন বলল, গিয়েছিলাম পেস্ট কন্ট্রোলের সেলসম্যান হয়ে। কড়া নাড়তে একটা বাচ্চা ছেলে দরজা খুলে দিল। আমি বললাম, বাড়িতে কোনও পুরুষ আছেন? সে বলল, না, মা আছেন। শ্রীমতী সাকসেনা এলেন। তাঁর কাছে নিজেকে পেস্ট কন্ট্রোলের সেলসম্যান হিসেবে জাহির করলাম। ব্রিফকেস থেকে লিটারেচার খুলে কিছু বলবার আগেই তিনি বললেন, পেস্ট কন্ট্রোল করাবেন না। আমি বললাম, বাড়ির কর্তাকে কখন পাওয়া যাবে? উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, উনি ক’দিন হল মারা গেছেন। বললাম, সরি ম্যাডাম। পরে আসব। এই অবস্থায় বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। তবে আপনার পুরোনো বাড়ি, ফাঁকফোকরে বিছে-মিছে থাকতে পারে, তাই পেস্ট কন্ট্রোল করিয়ে নেওয়া ভালো।

দেখে কী মনে হল?

ভদ্রমহিলা শক্ত ধাতের। ক’দিন আগে যে স্বামী হারিয়েছেন, দেখে মনে হয় না। মুষড়ে পড়ারও কোনও লক্ষণ দেখলাম না।

ইউরেকা!—শুভ চেঁচিয়ে বলল, তাহলে আমার ছক ঠিক।

মানে! রহস্যের সমাধান করে ফেলেছিস?

হ্যাঁ রে।

ঘরে বসেই?

হ্যাঁ। ইজিচেয়ার ডিটেকশন—আরামকেদারায় বসে গোয়েন্দাগিরি বলতে পারিস। দাঁড়া, আগে দেবেন সাধুখাঁকে ডেকে আনাই।

বাজনা-লাইটার জ্বেলে বিলিতি সিগারেট ধরিয়ে দেবেন সাধুখাঁ বললেন, আপনার তদন্ত শেষ! খুনি ধরতে পেরেছেন?

হ্যাঁ। আপনি নির্ভয়ে থাকতে পারেন। দুয়ে-দুয়ে চারের মতো আমার হিসেব। খুনি আর কাউকে খুন করবে না। খুনি আত্মহত্যা করে আপনাকে অব্যাহতি দিয়ে গেছে।

সে কী? কে খুনি?

সবুর করুন। সিম্পল সাইকোলজি। ভূনাথ সরকারের মৃত্যুর পেছনে রহস্য ছিল না। তাড়াহুড়োয় নিজের দোষে বেলঘরিয়ায় প্রায়ই কেউ-না-কেউ কাটা পড়ে। ভূনাথ সরকারও নিজের দোষে ট্রেনে কাটা পড়েন। কিন্তু খুনি তার থেকে একটা ছক পেয়ে যায়। অঙ্কুর দত্তকে সে ঘনিষ্ঠভাবে জানত। না-জানার কারণ ছিল না। অঙ্কুর নিজের কথা হা-হা করে সবাইকে বলত। তাই তার জন্মদিনে বার্থ-ডে সারপ্রাইজ ফ্রম এ ডিয়ার ওয়ান—টাইপ করা চিরকুট আটকানো উপহার পেয়ে তার ধারণা হয় তাকে তার কোনও প্রেমিকা সেটা পাঠিয়েছে। অঙ্কুরের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে খুনি এই ফাঁদ পেতে কাগজের বাক্সে আকাসানো কালকেউটে পাঠায়। এই খুনিই হাসান আলিকে পনেরোতলার গরাদ ছাড়া জানলা থেকে ঠেলে নীচে ফেলে দেয়। খুনি হাসান আলির অতি পরিচিতজন ছিল, তাই তার পক্ষে হাসান আলিকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওই বাড়ির পনেরোতলায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। আর চতুর্থ মৃত্যু ছিল একটা সাজানো-গুছোনো আত্মহত্যা।

আত্মহত্যা! কিন্তু চন্দ্রদেব তো ন্যাটা ছিলেন না?—বিস্মিত দেবেন সাধুখাঁ বললেন।

আসল রহস্য সেইখানে। চন্দ্রদেব তাঁর আত্মহত্যার ব্যাপারটা এমনভাবে সাজান যাতে সেটা খুন বলে মনে হয়। লোডশেডিংয়ের সন্ধে, সদর হাট করে খোলা, বাড়িতে কেউ নেই। মনে হতে পারে, ওঁকে কোনও খুনি হত্যা করে এমনভাবে পিস্তল রেখে গেছে, যাতে মনে হয়, কোনও ন্যাটার কাজ। যাতে মনে হয় ওটা ছিল খুন, কেননা চন্দ্রদেব ন্যাটা ছিলেন না, আর খুনি ন্যাটা ছিল বলে ভুল করে পিস্তল ওঁর বাঁ-দিকে রেখে গেছে। গুলিও চালানো হয়েছে বাঁদিক থেকে। এখানেই খুনি ভুল করেছে মনে হলেও, আসলে ব্যাপারটা খুব ভেবেচিন্তে করা। চন্দ্রদেবই এই পরিকল্পনা করেছিলেন।

বলেন কী!—দেবেন সাধুখাঁ বিষম খেলেন।

হ্যাঁ, তাই।—সূরজপ্রকাশ অসুস্থ। ব্যবসা তাঁর ছেলেরা দেখে। চলতি ব্যবসা নিয়ে ওদের ভাবনা-চিন্তা নেই। ওরা পুঁজি নতুন খাতে নিয়োগ করে দেবে। এই অবস্থায় আপনার ব্যবসার সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথা ওঠে না।

তাহলে খুনি কে?—দেবেন সাধুখাঁ জিগ্যেস করলেন।

সেই কথাতেই আসছি। আপনাকে সন্দেহ থেকে অব্যাহতি দিয়েছি, কেননা, এটাই আপনার একমাত্র ব্যবসা। জুনিয়ার এঞ্জিনিয়াররা আপনার লক্ষ্মী। এঁদের কার্যকুশলতার জন্যেই আপনার রমরমা অবস্থা। উপরন্তু আপনার দেব-দ্বিজে, জ্যোতিষে অগাধ বিশ্বাস। আপনি নিজের ডাল নিজে কাটবেন না।

তাহলে?

ভূনাথ সরকারের মৃত্যু থেকেই খুনি একটা ছক পেয়ে যায়। আপনি আমাকে বলেছিলেন, ভূনাথকে নিশ্চয়ই কেউ ঠেলা দিয়ে লাইনে ফেলে দিয়েছিল। এই সন্দেহ নিশ্চয়ই আপনি ভূনাথ সরকারের মৃত্যুর পরে-পরেই আরও অনেকের কাছে প্রকাশ করে থাকবেন। এর থেকেই খুনি একটা ছক পেয়ে যায়। সে অঙ্কুর দত্ত আর হাসান আলিকে খুন করে। নিজের আত্মহত্যাও এমনভাবে সাজায় যাতে সেটাও খুন মনে হয়।

তার স্বার্থ?—দেবেন সাধুখাঁ আবার প্রশ্ন করলেন।

স্বার্থ! খুনি, মানে, চন্দ্রদেব ছিলেন দেনায় ডুবে। উপরন্তু একটা খুনের পর তিনি মোটা টাকার বিমা করেন। নিজের মৃত্যুকে তিনি ভূনাথ, অঙ্কুর আর হাসানের হত্যার সঙ্গে এমনভাবে জুড়ে দেন, যাতে মনে হয় কেউ আপনার ব্যবসাকে ডোবানোর জন্যে একের পর এক আপনার জুনিয়ার এঞ্জিনিয়ারদের হত্যা করে চলেছে। আর নিজে নিজেকে বাঁ-হাতে খুন করে চন্দ্রদেব এই হত্যা এক কল্পিত ন্যাটা খুনির ঘাড়ে চাপান। তাঁর আত্মহত্যা খুন বলে ধরা পড়লে চন্দ্রদেবের ওয়ারিশ বিমার পুরো টাকাটা পেয়ে যাবেন, দেনার হাত থেকেও তিনি রেহাই পাবেন। গোটা ব্যাপারটাই এক অস্তিত্বহীন খুনির ঘাড়ে চাপিয়ে চন্দ্রদেব আসলে নিজের কাজ হাসিল করার পরিকল্পনা করেছিলেন। চন্দ্রদেব মারা যাওয়ায় বস্তুত তাঁর স্ত্রী দেনার দায় থেকে রক্ষা আর বিমার টাকা—এই দুই পাওয়ায় স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারটা এত সহজে মেনে নিতে পেরেছেন। চন্দ্রদেব বেশ মাথা খাটিয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে আপনার কোনও ভয় নেই, মিস্টার সাধুখাঁ।

ঠিক বলছেন তো?

নিরঞ্জন সাক্ষী।

আপনার বাকি ফিজটা তাহলে চেকেই লিখে দিচ্ছি।

থাক। খুনি যখন পালিয়েই গেছে…।

তা কেন? আমি চেক লিখে দিচ্ছি।

নিরঞ্জন হেসে বলল, তাই দিন। শুভর সিদ্ধান্ত কখনও ভুল হয় না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে পারেন।

বাঁচালেন, মশাই। এ না হলে শুভ চৌধুরী!

দেবেন সাধুখাঁ চলে যেতে শুভ বলল, যাই এবার, দাবা খেলে আসি।

নিরঞ্জন বলল, তাই চল। তোকে নামিয়ে দেব।

তাই চল। আরামকেদারায় বসে তদন্ত করে দশ হাজার টাকা পাওয়া গেছে, এখন কিছুদিন নিশ্চিন্তে দাবা খেলা যেতে পারে। চল।

মাসিক রোমাঞ্চ

পুজো সংখ্যা, ১৯৮৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *