৯.
উদয়সাগরের তীরে পর পর দুই দিন চিতার আগুন জ্বলে উঠেছিল। সে আগুনের উত্তাপ দলের সবাইকে বিষণ্ণ করে দিয়েছিল।
তার পর প্রায় এক মাস হয়ে গেল।
রাখীর মামী আর কাঁদে না। সে তার কান্নাকেই শংকরীর মৃত্যুর কারণ বলে দায়ী করে। সে যদি সেদিন না কাঁদত, শংকরী তবে কিছুতেই ঘর থেকে বের হয়ে আসত না। শংকরী না এলে রাম সিং হয়তো সব দিক দিয়েই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেত। কারণ যশোবন্তের ঘরের কাছাকাছি লীলাবতীর ঘরের বন্ধ কপাট ভেঙে ফেলে তাকে অপহরণ করতে যথেষ্ট দুঃসাহসের প্রয়োজন। তাছাড়া যশোবন্ত ঘরে রয়েছে জেনেও অতখানি সাহস তারা শেষ পর্যন্ত দেখাতে পারত কি না সন্দেহ রয়েছে। রাম সিং দুঃসাহসী হলেও, তার দুই সঙ্গী ততটা মরিয়া নয়।
রাখীর মামীর কথা কেউ শুনতে চায় না। কেউ তাকে দায়ী করে না। সবই নিয়তি। কপালে যা লেখা ছিল তাই হয়েছে। কপালের লেখা খণ্ডানো যায় না। হয়তো লীলাবতীর সম্মানের বিনিময়ে শংকরীর মৃত্যু হবে, একথা বহুদিন আগেই বিধাতাপুরুষ লিখে রেখে দিয়েছিলেন শংকরীর কপালে। এতে আতঙ্কেরও কিছু নেই, আফশোসেরও কিছু নেই।
কিন্তু আফসোসেরও কিছু নেই বলে চোখ বন্ধ ক’রে থাকলেও তো চলবে না। কিছু আছে বৈ কি। শংকরীর শূন্যস্থান পূর্ণ করবার মতো একটি স্ত্রীলোকও দলে নেই। এত দুঃখ, এত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তার এক একটি ছোট্ট মন্তব্য শুনে দলের স্ত্রীপুরুষ সবাই দা হাসি হেসে উঠত। সেই দম্কা হাসি শংকরীর সঙ্গে সঙ্গেই বিদায় নিয়েছে। অনেকে চেষ্টা করেছে শংকরীর স্থান পূরণ করতে—কিন্তু পারেনি। সর্বাংশে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক বিদ্যা, অনেক বুদ্ধি এবং মনের অনেক সূক্ষ্মতাপ্রসূত যে রসিকতা সেই রসিকতা শত চেষ্টাতেও আয়ত্ত করা যায় না। তার জন্যে সাধনার প্রয়োজন। সে সাধনা সব সময় সম্ভবও নয়। শংকরীর মতো রমণীর পক্ষেও তা সম্ভব হত না, যদি না সে কঠিন আঘাত পেত। আঘাত পেয়ে সে নিজের অশান্ত মনকে ঢেকে রাখবার জন্যে রসিকতার আশ্রয় নিয়েছিল।
তাই আফশোস নেই বললেই সব চুকে যায় না। একটা অভাববোধ সবাইকেই পীড়িত করে। বিশেষ করে ওই বৃদ্ধকে।
যশোবন্তের দিকে চাওয়া যায় না। সেই ঘটনার পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে সে। উদয়সাগরের তীরে সব সময় একা বসে থাকে। বিশেষ কথা বলে না কোনো। শুধু দলের সর্দার হিসাবে কর্তব্যটুকু ক’রে যায়। কিন্তু সেই কর্তব্যে প্রাণ কোথায়? সে কর্তব্যে উদ্যম কোথায়?
যশোবন্ত প্রায়ই চেয়ে থাকে উদয়সাগরের জলের দিকে।
সেদিনও চেয়েছিল। ওই জলে শংকরীর দেহের ভস্মাবশেষ গিয়ে মিশেছে। যশোবন্ত জল থেকে চোখের দৃষ্টি তুলে নিয়ে আকাশের দিকে চায়। ওই আকাশে শংকরীর দেহ ধূম হয়ে উধাও হয়েছে। যশোবন্ত চায় চিতার কাছে মাটিতে। মাটিতেও যে শংকরীর দেহাবশেষ গিয়ে লুকিয়েছে। সবদিকেই শংকরী একাকার হয়ে গেছে। সব দিকেই তার মীরা—তার সুন্দরী। সুন্দরী আর সুন্দরী।
যশোবন্তের চোখে জল আসবার আগেই উঠে দাঁড়ায়। এ বয়সে ওসব ভালো নয়। লীলাবতীর খোঁজ নিতে হবে। শংকরী নেই এখন। লীলাবতীকে এবার ভালোভাবে প্রশ্ন ক’রে জেনে নিতে হবে জিৎ সিং-কে সে কতটা পছন্দ করে। কথার উত্তর হয়তো সে দেবে না, দিতে লজ্জা পাবে। তার মুখ দেখেই বুঝে নেওয়া যাবে তার উত্তর। সেই অনুযায়ী পাকাপাকি ব্যবস্থা ক’রে ফেলতে হবে। আর দেরি করা যায় না। দলের ওপর এখন শনির দশা চলছে। কখন কোন্ দুর্ঘটনা ঘটে যায় আবার কে জানে। জিৎ সিং-এর হাতে লীলাবতীকে সমর্পণ ক’রেই এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই দলের মধ্যে রাখা আর চলে না। কিকার প্রিয় জিৎ সিং। কিকাই তাকে অন্যত্র বসবাসের ব্যবস্থা ক’রে দেবেন রাজার অনুমতি নিয়ে।
সূর্য অস্ত যায়।
যশোবন্ত ঘরের দিকে ফিরতে শুরু করে। অনেকটা দূরে চলে এসেছে সে আজ। ঘর থেকে অনেক দূরে। ঘরের কাছাকাছি থাকতে আদৌ ভালো লাগে না। তাই ঘুরতে ঘুরতে অজ্ঞাতে রোজই প্রায় শংকরীর চিতার পাশে চলে আসে। লীলাবতী বার বার মানা করা সত্ত্বেও সে চলে আসে। আসতে একটু কষ্ট হয় তার। পা দুটো কাঁপে একটু একটু। না খাওয়ার জন্যে এই দুর্বলতা। মুখে কিছুই ভালো লাগে না। সেদিন লীলাবতী যত্ন ক’রে দই-বড়া তৈরি করেছিল। তার সামনে জোর করে খেল যশোবন্ত। কিন্তু আড়ালে গিয়ে বমি ক’রে ফেলল। অথচ শরীরে বিশেষ কোন্ রোগ নেই। শরীরের যা রোগ, এ বয়সে সবারই হয় সেই সব
কয়েকদিনের মধ্যেই তার চির-উন্নত মস্তক সামনে দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আগের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে কষ্ট হয়।
আজও সে ঝুঁকে পড়ে চলতে থাকে ঘরের পানে। বাতাসে বেশ গরম ভাব। ফাল্গুনের সেরা দিন কবে চলে গেছে। ‘ফাগুয়া’ উৎসব এবারে নমো নমো ক’রে সারা হয়েছে। প্রাসাদের উৎসবে অংশগ্রহণ করতে যায়নি কেউ। এমন কি জিৎ সিংও আবীর সংগ্রহ করেনি।
লীলাবতীর জন্য আবীর এনে দিয়েছিল যশোবন্ত। শত হলেও সে ছেলেমানুষ। শংকরী কিংবা রাখীর জন্যে মন তার বেশিদিন খারাপ হয়ে থাকতে পারে না। জীবনের শুরুতে মানুষ শোককে প্রাধান্য বিস্তার করতে দিতে চায় না মনের ওপর। তাতে আনন্দ নষ্ট। একটি বছরের ফাগুয়ার আনন্দ মাটি হয়ে যাওয়া কম কথা নয়। বিশেষত মনে যখন প্রথম বসন্তের ছোঁয়াচ লাগে।
নিজের জীবনে—ফাগুয়ার উৎসব আনন্দ কোনোদিনই উপভোগ করতে পারেনি যশোবন্ত। সুন্দরী চিরকালই তার নয়নের আড়ালে থেকে গেছে। তাই লীলাবতীর এই নবীন বসন্তের প্রথম আনন্দ যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্যেই আবীর এনে দিয়েছিল যশোবন্ত। মেয়েটি জিৎ সিং-এর সঙ্গে খেলা করবে, স্ফূর্তি করবে বলে। কিন্তু না। লীলাবতী সেই আবীর ব্যবহার করতে চায়নি।
তখনই যশোবন্তের প্রথম সন্দেহ হয়, জিৎ সিং-কে ততটা পছন্দ হয়তো করে না লীলাবতী। সেই সন্দেহ আজও যায়নি। তাই স্পষ্ট প্রশ্ন করতে হবে লীলাবতীকে, সত্যিই কতখানি ভালো সে বাসে জিৎ সিং-কে
ফাগুয়ার দিনে অবশ্য অন্য কারণ দেখিয়েছিল লীলাবতী। বলেছিল,–চিতোর গেল, বাবা গেল, অনেক প্রিয়জনই আমাকে ছেড়ে চলে গেল সর্দার-ওর মধ্যে কি প্রাণ খুলে আনন্দ করা যায়? একটি বছর না গেলে এই শোকের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারব না।
কথাটায় যুক্তি ছিল না। তাই সেই একই দিনে জিৎ সিং-কে খুঁজে বের করে একই প্রশ্ন করেছিল সে।
সঙ্গে সঙ্গে জিৎ সিং পাল্টা প্রশ্ন করেছিল,–তোমাকে যদি এনে দিই, তুমি পারবে?
বুকের ভেতরে ধাক্কা দিয়েছিল জিৎ সিং-এর কথাটা। বেশ কিছুক্ষণ চুপ ক’রে ছিল সে। সময় লেগেছিল সামলে নিতে। তার পর ধীরে ধীরে বলেছিল,—আমি বৃদ্ধ, আনন্দ করবার বয়স তো আর নেই আমার।
—তা অবশ্য নেই। কিন্তু যদি থাকত? পারতে?
এবারে যশোবন্ত কঠিন স্বরে বলে উঠেছিল,—তবু পারতাম না। কারণ সুন্দরীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা তোমরা জান। জেনে ফেলার পরেও এভাবে বলা নিষ্ঠুরতার পরিচয়।
জিৎ সিং সেদিন অপলক দৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে কিছুক্ষণ চেপে থেকে হাতখানা বাড়িয়ে বৃদ্ধের একটি হাত ধরে একটু চাপ দিয়েছিল। মুখে কিছু বলেনি।
যশোবন্ত চলতে চলতে ভাবে, আশ্চর্য ছেলে জিৎ সিং। লীলাবতী যদি তার হৃদয়ে ছেলেটিকে স্থান দেয়, তবে ঠকবে না। বরং জিতবে। এমন জেতা খুব কম মেয়েই জেতে।
হঠাৎ পা দুটো একটু বেশিরকম কেঁপে ওঠে যশোবন্তের। চোখের সামনে অন্ধকার দেখে। দুর্বলতার জন্যে এমন আজকাল হচ্ছে মাঝে মাঝে। তাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার চেষ্টা করে। অন্ধকার কেটে গেলে আবার চলতে শুরু করবে।
কিন্তু এ কী? এ যে আঁধার আরও ঘন হয়ে এল। যশোবন্ত এক পাও চলতে পারে না। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকবার চেষ্টা করে। যদিও বুঝতে পারে একটু পরেই মাটিতে পড়ে যাবে সে।
ঠিক সেই সময় কে যেন এসে তার হাত ধরে ফেলে। ঠান্ডা কোমল নারীর হাত –কে তুমি বাছা?
—আমায় তুমি চিনতে পারলে না?
কথায় যেন মধু ঝরে মেয়েটির! অল্প বয়স হবে। কণ্ঠস্বর অচেনা।
—না!
—চিতোরে কতদিন আমায় দেখেছ যশোবন্ত।
সঙ্কুচিত হয় যশোবন্ত। দলের সব মেয়েরই মুখ তার মোটামুটি চেনা। গলার স্বর অতটা জানা নেই, তবে এত মধুর স্বর কারও থাকলে কি জানত না সে? নাও জানতে পারে। হয়তো মেয়েটি কথাই বলেনি বেশি। কিংবা হয়তো এই অসহায় অবস্থায় পড়ে মেয়েটিকে অবলম্বন হিসেবে পেয়ে তার সহানুভূতিপূর্ণ কথা শুনতে এত মিষ্টি লাগছে।
কোনোরকমে যশোবন্ত বলে—তোমায় দেখতে পেলে হয়তো চিনতে পারতাম।
—আমি তো কাছেই রয়েছি। দেখো আমায়।
—পারব না এখন। আমার চোখ দুটোই শুধু খেলা রয়েছে, তাতে দৃষ্টি নেই। আমি দৃষ্টিহীন মা। আমার মাথা ঘুরছে।
—সেকি! তবে তুমি একটু বসো। আমি উদয়সাগরের জল নিয়ে আসি।
—না মা। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি আমার কাছে থাকো। আমার খুব ভালো লাগছে। আমি বরং একটু বসি।
মেয়েটির হাত ধরে রেখেই যশোবন্ত বসে পড়ে। যদি হাত ছেড়ে দিলে সে আর না আসে?
—যশোবন্ত।
—বল মা।
—তুমি আরও অনেকদিন সর্দার থাকবে।
যশোবন্ত হেসে বলে,—আর কয়দিন বাঁচব? তবু তোমার কথা শুনে আনন্দ হল। এই সর্দার হবার জন্যে আগে একসময়ে কত চেষ্টাই করেছি। সে সব দিনের কথা আজ মনে পড়ে।
—কিন্তু আসলে তো সর্দার হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তোমার ছিল না কোনোদিন। সেই আগের দিনেও নয়।
চমকে ওঠে যশোবন্ত। কে এই মেয়েটি? সে আসেনি তো? সে? না না—সে হবে কেমন করে? তার গলার স্বর জানা। তাছাড়া সে-ও তো অন্তরের অন্তস্তলের কথা এভাবে টেনে বের করতে পারত না। তাকে বলবার অবসর কখনো হয়নি। পৃথিবীর একটি প্রাণীও জানে না যে যশোবন্ত তার শূন্যতায় ভরা মনকে সর্বদা ব্যস্ততার মধ্যে রাখবার জন্যেই চিরকাল সর্দারের আসনে বসবার চেষ্টা করে এসেছে। সর্দার পদটির জন্যে তার বিন্দুমাত্র লোভও ছিল না কোনোদিন। কিন্তু সর্দার হতে হলে যে প্রতিযোগিতা, যে বাধা সৃষ্টি হয়, শুধু সেইটুকুর ওপরই ছিল তার অদম্য লোভ।
—কে তুমি মা?
—বলছি তো, চেয়ে দেখো আমায়।
—আমার চোখের আঁধার যে কাটছে না। এতদিন শুধু কয়েক মুহূর্তের জন্যে এমন হত। এত দীর্ঘ সময় থাকত না কখনো। তবে কি আমি সত্যিই অন্ধ হয়ে গেলাম। কিংবা আমার চোখের আলো নিভে আসছে, আমার সময় ফুরিয়ে আসছে?
—তুমি আরও বেশ কিছুদিন বাঁচবে যশোবন্ত। অনাহারে থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছো, তাই এমন হচ্ছে।
—কে তুমি? তুমি কি লীলাবতীর বন্ধু? তার তো কোনো বন্ধুই নেই। ছিল শুধু রাখী। এতসব কথা জানলে কোথা থেকে? লীলা কিছু জানে। সে আমাকে দেখাশোনা করে আজকাল।
—লীলাবতী খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠল, তাই না সর্দার?
—ওকথা বলছ কেন?
—মনে আছে সেই চিতোর ছেড়ে আসবার দিনের কথা? আকবর-বাতির সামনে তাকে তুমি ঠাট্টা করেছিলে?
—মনে নেই তো। কি বলে ঠাট্টা করেছিলাম?
—বলেছিলে, আর ক’দিন পরেই ছোকরাদের বোকা কাতর চোখ দেখবে তুমি লীলা। সে জানতে চেয়েছিল, কাতর চোখ দেখবে কেন?
—হ্যাঁ, মনে পড়ছে। কিন্তু তুমি সবই জান দেখছি।
—তোমাদের সঙ্গে থাকছি সব সময়, জানব না কেন?
যশোবন্ত কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
মেয়েটিকে খুবই কম বয়সী বলে মনে হয়
সে এত খবর জানল কি ভাবে? হয়তো সে লীলার চেয়েও ছোট ছিল। হঠাৎ বড় হয়ে উঠেছে। মেয়েদের অমন হয়। দু-একদিনের মধ্যেই অনেক সময় গলার স্বর, শরীরের গঠন সব বদলে যায়।
—তোমার নাম কি মা?
—আমি বলব না। তুমি জান আমার নাম।
—আশ্চর্য!
—যশোবন্ত, সেদিন লীলাকে নিজের নাতনির মতো দেখেছিলে, তাই অমন কথা বলতে পেরেছিলে। আজও তেমনি চোখেই দেখছ। তবে কেন সোজাসুজি প্রশ্ন করতে সংকোচ বোধ করছ আজ?
—কোন্ প্রশ্ন?
—যা এতক্ষণ ভাবছিলে, সেই প্রশ্ন। জিৎ-এর ওপর তার কতখানি ভালোবাসা রয়েছে একথা জানতে চাইতে অত দ্বিধা কেন? আকবর-বাতির নীচের সম্পর্কটা কি মুছে গেল?
যশোবন্ত মনে মনে ভগবানের কাছে আকুল প্রার্থনা জানায়,–হে একলিঙ্গ, চোখ দুটোতে সামান্য সময়ের জন্যেও দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দাও। এই মেয়েটিকে একবার দেখব। এ শুধু দলের ঘটনাবলীর কথাই জানে না, এ মানুষের মনের খবরও জানে।
—চুপ ক’রে রইলে কেন যশোবন্ত।
—সেদিনের কথা আলাদা মা। সেদিন দলের বিপদ ছিল প্রতি মুহূর্তে। তাই অমন হাল্কা ধরনের কথা বলেছিলাম। সেই একদিনই শুধু লীলাবতীর সঙ্গে ঠাট্টা করতে পেরেছিলাম। ঠাট্টা করতে বাধ্য হয়েছিলাম। নইলে সদ্য পিতৃহারা মেয়ের সঙ্গে ওভাবে কথা বলা চরম হৃদয়হীনতা। কিন্তু অন্য উপায় ছিল না সেদিন। সুন্দরীর মুখ ফসকে হতভাগী কথাটি বের হয়ে পড়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল লীলা।
সেই মুহূর্তে যদি জানত, তার বাবা নেই, তবে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম না।
—আমি জানি। মরিয়া হয়ে তুমি অমন কথা বলেছিলে। ভালোই করেছিলে। ওই বিপদের মধ্যেও দলের লোকদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলে। তোমার কথা শুনেই বেশ জোরে হেসে উঠেছিল তারা।
—কিন্তু—
—অত উতলা হয়ো না যশোবন্ত, আমার পরিচয়ের জন্যে অতটা ছটফট করা তোমার শোভা পায় না।
—কিন্তু আমি যে অন্ধ হয়ে গেলাম। এই দেখো, আমি তাকিয়ে রয়েছি, অথচ কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
—পাবে। তবে একটা কথা দিতে হবে আমায়। ভালোভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে তোমায়।
—খেতে একটুও ইচ্ছে করে না।
—ইচ্ছে করাতে হবে। নইলে স্বর্গে থেকেও সুন্দরী ছট্ফট্ করবে।
যশোবন্ত চেঁচিয়ে ওঠে,–কে তুমি? আমি তোমায় কিছুতেই ছাড়ব না।
—ছেড়ো না। কিন্তু অত জোরে চেপে ধরছ কেন? পুরুষের হাত কত কঠিন হয়, তা কি জান না? আমার বড় ব্যথা লাগছে।
যশোবন্ত তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দেয়।
মেয়েটি সরে যায়।
যশোবন্ত হাত বাড়িয়ে তার নাগাল পায় না।
বলে ওঠে,—তুমি আর কাছে আসবে না? আমার হাত ধরবে না?
—তুমি বড় ব্যথা দিয়েছ।
—আর দেবো না মা। লক্ষ্মীটি আমার হাত ধর।
—তুমি শরীরের যত্ন নিও যশোবন্ত।
—নেবো মা। তুমি যখন বলেছ, ঠিক যত্ন নেবো।
—আর একটি কথা। লীলাবতীকে কোনো প্রশ্ন করো না।
—কোন্ প্রশ্ন?
—যে প্রশ্ন করবে বলে, তুমি রওনা হয়েছো ঘরের দিকে।
যশোবন্ত এবারে আর চমকায় না।
মেয়েটি যে সাধারণ কেউ নয়, একথা সে বুঝতে পেরেছে।
তাই শুধু বলে,–কেন মা? প্রশ্ন করব না কেন?
—সে জিৎ সিং-কে ভালোবাসে যশোবন্ত। তার ভালোবাসার অন্ত নেই। জীবনে আর কাউকে সে ভালোবাসতে পারবে না। কোনো দিনও নয়।
আর জিৎ সিং? সে কি ভালোবাসে আমার লীলা দিদিকে?
—হ্যাঁ। সেও ভালোবাসে লীলাবতীকে। তবে তার কথা আলাদা। সে পুরুষ। একটি মেয়েকে ভালোবাসে বলেই মেয়েটির কাছে চিরকাল পড়ে থাকবার ছেলে সে নয়। তার মনের মধ্যে অন্য আগুন জ্বলছে। সেই আগুনের জ্বালায় সে স্বস্তি পাচ্ছে না, পিতার মৃত্যুর সময় যে-প্রতিজ্ঞা করেছিল তা পালন করবার জন্যে সে বদ্ধপরিকর।
—শুনে খুব আনন্দ হল মা। পুরুষের তেমনিই হওয়া উচিত। তোমার পরিচয় না জানলেও, তোমার কথায় আমার খুব বিশ্বাস হচ্ছে। আমি তবে ওদের দুজনাকে মিলিয়ে দেবার আয়োজন করি?
—না!
—না? কেন মা?
—মিলিয়ে দিতে পারবে না তুমি। ওদের বিয়ে হবে না। কোনোদিনই হবে না।
যশোবন্তের মাথার ভেতরে কেমন করে ওঠে।
সে দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে।
এই মাত্র সে যেন দৈববাণী শুনল। অলঙ্ঘনীয় দৈববাণী।
শত সহস্ৰ চেষ্টাতেও সেই দৈববাণীকে খণ্ডানো যায় না।
—এ কী বললে তুমি? এ কী বললে মা? এ যে সত্যি হতে পারে না। এ সত্যি হলে লীলা বাঁচবে না।
কোনো জবাব পায় না যশোবন্ত। অচেনা মেয়েটি কোনো জবাব দেয় না।
ধীরে ধীরে যশোবন্ত মাথা তোলে। চোখ খোলে, এবারে সব দেখতে পায় সে।
চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ।
পশ্চিম আকাশে তখনো সূর্য-বিদায়ের শেষ রক্তাভা।
যশোবন্ত পাগলের মতো চারদিকে চায়। নেই! সে নেই!
উঠে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে দেখে সে।
না নেই। কোথাও কেউ নেই।
পরিবর্তে রয়েছে এক অতি সুমিষ্ট গন্ধ।
মেয়েটির কণ্ঠস্বরের মতোই সেই গন্ধ মনকে আচ্ছন্ন করে।
যশোবন্তের অতি পরিচিত সে সুঘ্রাণ।
চিতোর মায়ের মন্দিরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই এ সুঘ্রাণ সে প্রতিবারই পেয়েছে।
যশোবন্ত কেঁদে ওঠে। ঠিক শিশুর মতো কেঁদে ওঠে।
জীবনে অনেক আঘাত, অনেক দুঃখ সে পেয়েছে।
কিন্তু এইভাবে কখনো কাঁদেনি সে।
এ-কান্নার মধ্যে সব গর্ব, সব ব্যক্তিত্ব, সব অহমিকা বিসর্জন দেওয়া আত্মসমর্পণের আকুলতা ফুটে ওঠে।
যশোবন্তের খেয়াল হয় না, কত সময় অতিবাহিত হল।
কখন সন্ধ্যা নেমে এল উদয়সাগরের ওপর।
সে একই ভাবে কেঁদে চলে।
তার সারাজীবনের জমানো অশ্রু রাশি এই প্রথম বাইরে আসবার পথ পেল।
নিঃশেষ না হয়ে কিছুতেই থামবে না।
.
শিমুল গাছটির নীচে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল জিৎ সিং।
ফাল্গুন চলে গেছে, চৈত্রও যাবার মুখে।
শিমুল গাছের বাকি ফুলগুলি ফল হয়ে ফেটে ফেটে তুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগ্বিদিকে।
জিৎ সিং ভাবছিল রাম সিং-এর কথা।
শংকরী শেষ সময়ে বলে গেছে রাম সিং আকবর শাহের দলে নাম লেখাবে।
সে যাবে আগ্রায়। এমন কি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতেও সে প্রস্তুত।
যেমন স্বভাব নাম সিং-এর সবই সম্ভব তার পক্ষে।
শংকরী ভুল শোনেনি। ভুল শোনেনি বলেই তাকে জীবন দিতে হয়েছে। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সে শংকরীর বুকে গুলি ছুড়েছিল সেই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে।
তাই তার চক্রান্তের কথা সবাই জানে।
সেদিন প্রাসাদে রাজপুত্র জগমল কিকার সঙ্গে ঝগড়া করলেন এই ব্যাপার নিয়ে সবার সম্মুখে।
শিকারের দিনে রাম সিং-এর প্রতি কিকার ব্যবহার নাকি অত্যন্ত রূঢ় হয়েছিল।
আর রূঢ় হয়েছিল বলেই নিজের প্রাণ বাঁচাতে রাম সিং আজ শত্রু শিবিরে গিয়ে ভিড়েছে।
কিকা হেসে বলেছিলেন, কি হয়েছে তাতে?
—কি হতে বাকি রয়েছে? যে-রকম সাংঘাতিক লোক শুনেছি, বাদশাহকে নিজে কিংবা অন্য কোনো প্রভাবশালী লোককে দিয়ে উত্তেজিত করবে নিশ্চয়
কিকা চিৎকার ক’রে উঠেছিলেন,–কি বলছ তুমি জগমল? মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার?
জগমলও ধৈর্য রাখতে পারেনি।
বলে ফেলেছিল,—আমার মাথা খারাপ হয়নি। হয়েছে তোমার। এই সময় মুঘল সৈন্য যদি সত্যি সত্যিই এগিয়ে আসে, ঠেকাতে পারবে?
—তুমি দেখছি, ওই রাম সিংকে মনে মনে বিখ্যাত লোক বানিয়ে ফেলেছ। কে ওই রাম সিং? কালপীর দলের এক অতি জঘন্য প্রকৃতির ছোকরা ভিন্ন কেউ নয়। তার পক্ষে আকবর শাহের সামনে দাঁড়াতে অনেক দিনের সাধনার প্রয়োজন হবে। তাঁকে প্রভাবিত করার কথা ছেড়েই দিলাম।
—হয়তো তোমার কথা সত্যি। তবু এই সুযোগ দেওয়া উচিত হয়নি।
—যদি জিৎ সিং-এর মৃত্যু হত?
—কী ক্ষতি হত তাতে? তাই বলে যাকে খারাপ বলে জান, তাকে উসকে দেওয়া উচিত হয়নি।
সর্দার আর উচ্চ কর্মচারীদের সামনে ভবিষ্যতের রানা প্রতাপ সিংহের মুখ লজ্জায় ঘৃণায় রাঙা হয়ে উঠেছিল।
প্রথমটা তিনি কোন কথাই বলতে পারেননি। তারপর শুধু বলেছিলেন,—তুমি যদি কোনোদিন মেবারের রানা হও জগমল, তবে সেদিন মেবারের সত্যিই দুর্দিন। সেদিন মেবারের গৌরব-সূর্য চিরকালের মতো অস্তমিত হবে।
—সাবধান কিকা, এত লোকের সামনে ওভাবে কথা বলো না।
—আমি যা বললাম, তার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। তোমার মতো কল্পিত ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে আমি পাগলের মতো প্রলাপ বকছি না।
—আমি পাগলা হইনি। জ্ঞানও হারাইনি আমি।
—জ্ঞান যদি না হারাতে, তবে বীর অজিত সিংহকে এভাবে অপমানিত করতে পারতে না।
—অজিত সিং-এর অপমানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না আজ। সে এখন মান-অপমানের অতীত।
—তার পুত্রকে অপমান করার অর্থ হল তাকেই অপমান করা।
—তোমার কথা আমি মানি না।
—মান না? একলিঙ্গের মন্দিরে চল। সেই মন্দিরের পাশে যে পাথরটায় বাপ্পা বসেছিলেন কোনোদিন, সেখানে চল। ওই পাথরটার ওপর পা তুলে দেবে তুমি। বাপ্পাও তো মৃত।
জগমল চুপ ক’রে থাকে।
—উত্তর দিতে পারল না। কারণ পারবে না তুমি পা তুলে দিতে। যদিও সেটা পাথর, নির্জীব পদার্থ। অথচ জিৎ সিং নির্জীব পদার্থ নয়। সে অজিত সিং-এর পুত্র। পিতার রক্ত তার শরীরে বইছে—পিতার মতোই সে বীর উদারচেতা। তার মৃত্যু তোমার কাছে কিছুই নয়, কোনো গুরুত্বই নেই!
—তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব না কিকা। তবে আমার মনে হয়, ওই রাম সিং লোকটি প্রতিশোধ নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
—করুক। অমন কত লোকই চেষ্টা করে। তাই বলে একজন হত্যাকারীকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তাকে ভয় পেলে চলে না। জিৎ সিং-কে হত্যা করতে না পারলেও, একজন নিরস্ত্র নিরপরাধ স্ত্রীলোককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা ক’রে সে পালিয়েছে। ছি ছি জগমল। তবু যদি বুঝতাম আকবর শাহ্ জীবনে আর এ-মুখো হবেন না। আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু, আগ্রার বাদশাহের সম্মুখীন হতেই হবে আমাদের। চিতোরকে আমরা চিরকাল মুসলমানদের দখলে ফেলে রাখতে পারি না।
বিস্মিত জগমল বলে ওঠে—কি বললে? চিতোর দখল করবে নাকি?
—হ্যাঁ। অবাক হলে মনে হচ্ছে।
—একটু হয়েছি বৈ কি। ওদের হাত থেকে চিতোরকে ছিনিয়ে নেবার স্বপ্ন দেখো তুমি?
জগমলের কথা শুনে আশেপাশের সবাই আকারে ইঙ্গিতে বিরক্তি প্রকাশ করে। চিতোর চিরকাল মুঘলদের পদানত হয়ে থাকবে এটি যেন সে মেনে নিয়েছে।
একজন বলেই ফেলে—স্বপ্ন দেখব না কেন? আমাদের প্রতিজ্ঞা আমরা চিতোর পুনরাধিকার না ক’রে কিছুতেই থামব না।
জগমল বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠে বলে—তোমার প্রতিজ্ঞা জীবনে পূরণ হবে না।
এবারে কিকা বলেন, –না হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে তোমার মতো বীরের আবির্ভাব ঘটেছে যখন বাপ্পার বংশে। তবে একথা জেনে রেখো জগমল, চিতোর দখলের কোনোরকম চেষ্টা না করে যদি লুকিয়েও থাকো এই গিরো উপত্যকার বনে জঙ্গলে, মুঘলদের হাত থেকে রেহাই পাবে না কখনো। একদিন না একদিন তার থাবা এসে পড়বেই তোমার ওপর।
একথা শুনবার পর জগমল আর কিছু বলেনি।
সে উপস্থিত সবার মনোভাব জানতে পেরেছিল। তাই রাগে বিড়বিড় করতে করতে স্থান ত্যাগ করে।
সে বুঝতে পেরেছিল রানা উদয় সিংহের প্রিয়তম পুত্র হয়েও সর্দারদের মনে এতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
সর্দারদের সারা মন জুড়ে রয়েছে কিকা।
শিমুল গাছের গোড়ায় বসে জিৎ সিং এই সব কথাই ভাবছিল।
কিকা ও জগমলের মধ্যে বাকযুদ্ধের কাহিনী সে শুনে এসেছে প্রাসাদের লোকদের কাছে। শুনে অবধি খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার মন।
সেই থেকেই সে ক্রমাগত ভাবতে শুরু করেছে। ভাবনা যেন তার মাথায় বোঝা হয়ে চেপে বসেছে।
তার ক্রমাগত মনে হচ্ছে এভাবে আর বসে থাকা নয়, কাজে নামার সময় এসে গেছে এর মধ্যেই।
কিন্তু কী তার কাজ, এখনো বুঝে উঠতে পারছে না সে।
তাই ছট্ফট্ করছে।
কাল সন্ধ্যার পর লীলাবতীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল যশোবন্তের ঘরে।
ঘর থেকে বের হয়ে লীলাবতী তাকে জানিয়েছিল এক অদ্ভুত ঘটনার কথা।
যশোবন্তকে নাকি স্বয়ং দেবী দেখা দিয়েছিলেন।
দেখা দিয়েছিলেন বললে ভুল হবে। কারণ যতক্ষণ তিনি উপস্থিত ছিলেন ততক্ষণ বৃদ্ধ সর্দারের দৃষ্টিশক্তি হরণ করে নিয়েছিলেন।
কিন্তু দেখা না দিলেও স্পর্শ করতে দিয়েছিলেন।
লীলাবতী ফিসফিস করে বলেছিল জিৎ সিং-কে যে তারপর থেকেই যশোবস্তের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
শংকরীর মৃত্যুর পরে জোর ক’রে যে হাসি মুখে এনেছে, সে হাসিটুকুও মুছে গেছে।
দেবী বোধহয় কোনোরকম ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন—যে ভবিষ্যৎ বাণী মোটেই সুখের নয়। রাখী ও শংকরীর মৃত্যুর মতোই দুঃখদায়ক কিছু বলেছেন দেবী। নইলে তাঁর স্পর্শ পেয়ে তো আরও উৎফুল্ল হয়ে ওঠা উচিত ছিল বৃদ্ধের। এমন মুষড়ে পড়ল কেন?
জিৎ সিং লীলাবতীর কাছ থেকে এসব শুনে আবার যশোবত্তের ঘরে প্রবেশ করেছিল। সে বুদ্ধের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। যশোবন্ত যেন এ জগতের মানুষ নয়। তার দৃষ্টি আশেপাশের কোনো কিছুর ওপরই নিবদ্ধ নয়। তার দৃষ্টি সব ছাড়িয়ে অসীমের দিকে ধাওয়া করেছে। তবু মাঝে মাঝে সর্দার, জিৎ সিং-এর দিকে চেয়েছিল। চেয়ে অবাক হয়ে দেখছিল কি যেন।
—কি দেখছ সর্দার অমন ক’রে?
—একটা কথা ভাবছিলাম।
—বল।
—না। না। কিছু নয়। এ তো ঘটবেই।
—কি ঘটবে?
—কিছু না।
অসহিষ্ণু জিৎ সিং বলেছিল,—ওসব হেঁয়ালি রেখে সোজা কথা বললেই তো হয়।
—হেঁয়ালি? হ্যাঁ, হেঁয়ালিই বটে। হেঁয়ালির সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে দুদণ্ড থাকতে পেরে আমার কথাতেও হেঁয়ালি এসে গেছে। কিন্তু হেঁয়ালির সাম্রাজ্ঞী সত্যেরও সম্রাজ্ঞী। তাঁর কথা মিথ্যা হয় না। বুঝেছ জিৎ সিং?
—বুঝেছি।
—কি বুঝলে?
—কিছুই না।
বাইরে লীলাবতী দাঁড়িয়ে ছিল।
সে জিৎ সিং-এর জবাব শুনে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
এই হাসি তার সেই আগেকার হাসির কথা মনে করিয়ে দিল জিৎ সিং-কে। প্রায় ততখানি প্রাণময়ী। তবে একটু বিষণ্ণতা, একটু গভীরতা রয়েছে এতে। যশোবন্ত সেই হাসি শুনে একটি দীর্ঘশ্বাস চাপে। তারপর বলে,
—এই হাসি কেন অক্ষয় করলি না মা। তুই কি শুধু দুঃখ দিতে চাস?
লীলাবতী তাড়াতাড়ি ঘরে এসে বলে,—তার মানে?
যশোবন্তের অনুশোচনা হয় কথাটা জোরে বলে ফেলেছে বলে,—কিসের মানে দিদি?
—আমায় তুমি মা বললে যে এখনি?
—তোমায়? না। তোমায় মা বলব কেন? মা বললাম সেই দেবীকে।
—দেবীকে? আমার হাসি অক্ষয় নয় তবে?
—না না। ও কিছু না। যা মনে এল বলে দিলাম।
—উঁহু। বলতেই হবে তোমাকে।
—কী বলব?
—কেন ওকথা বললে? দেবী আমার সম্বন্ধে তোমায় কি বলেছেন? বল। এড়িয়ে গেলে চলবে না।
যশোবন্ত এতক্ষণে প্রথম ধাক্কা খায়।
জিৎ সিং-কে সাক্ষী মেনে সে বলে,– পাগলীর কথা শুনেছ? মুখ থেকে যত কথা নিঃসৃত হয় মানুষের, সব কথার যেন মানে হয়। অতই যদি বাসংযম থাকত মানুষের তাহলে সে দেবতা হয়ে যেত। মানুষ কারণে অকারণে অনেক কিছুই বলে ফেলে যার কোন মানে থাকে না।
—আমি জানি, তুমি খুব বেশি বাজে কথা বলো না কখনো।
—তা হয় তো বলি না। কিন্তু একেবারে বলি না, এও তো ঠিক না। এই এখনি যেমন বলে ফেললাম। দুটো অঘটন পর পর ঘটে যেতে দেখে মনের মধ্যে একটা ভীতি বাসা বেঁধেছে। তাই অমন বলে ফেললাম। তোমার হাসি সেই দেবীর হাসির মতো।
—ইস্। আমাকে ভোলানো হচ্ছে।
—ভোলাবো আমি? সে সুযোগ কি আর এ-জন্মে হবে দিদি? আমার সেই বয়স নেই। যশোবন্তের কথার ধরনে জিৎ সিং অবধি হেসে ওঠে। সে ভাবে রসিকা শংকরী এর একটি উপকার ক’রে গেছে যাবার সময়। বেরসিক বুড়োকে একটু রসের সন্ধান দিয়ে গেছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার ভুল ভেঙে যায়।
লীলাবতী তার নিজের ঘরে চলে যেতেই বৃদ্ধের মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আপন মনে সে যখন মাথা তোলে তখন তার দু’চোখ বেয়ে স্পষ্ট দুটো জলের রেখা গড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
—জান জিৎ সিং, মন যখন শোকে দুঃখে অভিভূত থাকে, সেই সময়ে হাসির কথা বলার মতো কষ্ট আর কিছুতেই নেই। তবু বলতে হয়, অন্তত আমি বলি। এমনিতে রসের ছিটেফোঁটাও নেই আমার মধ্যে। অথচ এই সব বিশেষ মুহূর্তে কে যেন আজকাল আমার মুখে কথা ফুটিয়ে দেয়।
—আজ তোমার মন কোন দুঃখে অভিভূত সর্দার?
—সে কথা বলতে পারব না। যদিও সেই দুঃখের কারণ তুমি।
—আমি?
—হ্যাঁ, জিৎ সিং।
—তবে তোমায় বলতেই হবে সর্দার।
যশোবন্ত দৃঢ়ভাবে ঘাড় বাঁকায়,—না।
—অত দ্বিধা কিসের সর্দার? দেবী যদি তোমাকে আমার আসন্ন মৃত্যুর কথা জানিয়ে দেন, নিঃসংকোচে বলতে পার।
—মৃত্যু? মৃত্যুকে আবার কবে ভয় পায় রাজপুত? বিশেষ ক’রে অজিত সিং-এর পুত্র যে মৃত্যুর সঙ্গে সব সময় পাঞ্জা কষতে প্রস্তুত সে কথা আমি জানি। না জিৎ সিং, মৃত্যু নয়। তাহলে আমি সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিতাম।
এবারে জিৎ সিং-এর মনেও আশঙ্কার ছায়া নামে। কী এমন কথা, যা সর্দারকে এতখানি দমিয়ে দিয়েছে?
জিৎ সিং বলে,—মৃত্যুর চেয়ে সহস্রগুণ ভীষণ কিছু হলেও বলতে পারো। আমি ভয় পাবো না।
—হ্যাঁ বলব। তুমি ভয় পাবে না জানি। আমি তোমায় বলব। অন্তত বলবার চেষ্টা করব। তবে আজ নয়, কাল।
—কোথায় বসে বলবে? এখানে লীলাবতী আসতে পারে।
—না, এখানে না। ওই শিমুল গাছের গোড়ায়। ওই তো তোমার প্রিয় জায়গা।
—তুমি সেকথা জান?
—হ্যাঁ আমি জানি। শংকরীও জানত। সে-ই আমাকে বলেছে। এসব আমাকে জানতে হয় জিৎ। এ আমার কর্তব্য।