আরাবল্লী – ৮

৮.

পরদিন সকালে উদয়সাগরের তীরে কালপীর দলের প্রথম মৃতদেহ ভস্মীভূত হয়। চিতার অগ্নিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল দলের আবাল-বৃদ্ধবনিতা সবাই। শুধু একজন ছাড়া। রাম সিং এখনো শিকার থেকে ফিরে আসেনি।

জিৎ সিং রাতেই ফিরেছিল। কিন্তু ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গে শোচনীয় ঘটনার কথা শুনে ছুটে গিয়েছিল রাখীদের ঘরে। লীলার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে পারেনি। কথা বলবার মতো মন বা সময় দুজনার কারও ছিল না।

আগুনের শিখার দিকে চেয়ে শংকরী ভাবছিল, তার কপালদোষেই বোধহয় কালপীর দলে এই ভাঙন ধরল। শিশু ভাইটির কথা এত বছর বাদে এবারে কেন যেন বার বার মনে পড়ছিল। তখনি তার মনে খটকা লাগে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায়, এবারে মহরত কা শিকারের’ দিনে অঘটন কিছু যেন না ঘটে। কিকার দলের সঙ্গে রাম সিং-কে যেতে দেখে তাই তার বুক অমন কেঁপে উঠেছিল। জিৎ সিং-এর ফিরতে দেরি দেখে লীলাবতী যখন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, তখন ভেতরে ভেতরে তার নিজের মন আরও চঞ্চল, আরও অস্থির হয়ে উঠেছিল। সেই সময়ে সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি অঘটন ঘটতে চলেছে, তার অতি কাছেই, তাদেরই একজনের কুটিরের অভ্যন্তরে।

গৌরী দেবীর জন্য নির্দিষ্ট শিকারের দিনে এই মৃত্যু দলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আতঙ্কিত ক’রে তোলে শংকরীকে। সে আগুনের লেলিহান শিখার প্রতি হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে মনে মনে বলে, হে অগ্নিদেবতা, এবছরের মতো এই একটিকে নিয়ে সন্তুষ্ট হও। বড় দুঃখী এই দল। অনেক আঘাত, অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে এদের। নিজের দেশ কালপীতে এরা থাকতে পারেনি। আদর্শের সঙ্গে সংঘাত উপস্থিত হওয়ায় এক পুরুষ আগে তাই মেবারে চলে আসে মুঘল আর পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে বলে। নামে এরা ভাড়াটে। কিন্তু আসলে মনেপ্রাণে এরা রাজপুত হয়ে গেছে। যমুনার কালো জলের কথা এদের মনে নেই। এদের মনে চম্বলের প্রচণ্ড প্রভাব। হে দেবতা এই দলকে যদি তুমি আরও রূঢ় আঘাত দাও, তবে হয়তো সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে আবার এদের ফিরে যেতে হবে রাজোয়ারার সীমানার বাইরে সেই অদেখা কালপীতে। নীতিভ্রষ্ট হবে এরা। এদের তুমি বাঁচাও।

হঠাৎ শংকরী শিউরে ওঠে। দেবতা যেন বিশেষ করে তার দিকে চেয়েই হেসে ওঠেন, অট্টহাসি হেসে ওঠেন।

যশোবন্ত পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে,—চলে গেল অতটুকু মেয়েটি। অথচ যাবার কথা আমার। আমি গেলে কারও কোনো ক্ষতি হত না। কারও মনে আঘাতও লাগত না।

—জগতে উল্টোটাই ঘটে বেশি।

—হ্যাঁ। কিন্তু এবারে বল, ওর সর্বনাশ কে করল?

—শোনোনি? সবাই তো জেনে গেছে।

—কেউ বলেনি তো।

—রাম সিং?

যশোবন্ত হাত দুটো মুঠো ক’রে এদিকে ওদিকে চায়। তারপর দ্রুতপদে জিৎ সিং-এর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, —রাম কোথায় জিৎ?

—সে ফেরেনি।

—কেন?

—কিকার একটি ঘোড়ার পায়ে চোট লাগে। তাকে বন থেকে হাঁটিয়ে আনতে বলছেন তিনি রাম সিং-কে।

আসল ঘটনা প্রকাশ করে না জিৎ।

—হাঁটিয়ে আনতে বলেছেন? কেন? পায়ের চোট কি খুব বেশি?

—হ্যাঁ।

—তাকে ফেলে রেখে এলেই তো চলত।

—না। ঘোড়াটি কিকার সব চাইতে প্রিয়। তাঁর সব চাইতে ভালো ঘোড়া।

—রাম সিং-এর সঙ্গে আর কয়জন রয়েছে?

জিৎ সিং একটু চুপ করে থেকে বলে,—সে একা

—কি বললে, সে একা? সে একা ওই বনের মধ্যে পড়ে রয়েছে?

—হ্যাঁ।

—তাকে মরণের মুখে ফেলে রেখে এসেছেন কিকা?

—হাতে বন্দুক রয়েছে।

—তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ না নিশ্চয়ই। একটি বন্দুককে সম্বল ক’রে ওই বনের মধ্যে পড়ে থাকলে বিপদ এড়ানো যায় না।

—বিপদ তো আছেই।

—শোন জিৎ সিং। তুমি আমার কাছ থেকে আসল ঘটনা গোপন ক’রে রাখছ। সবটা শুনতে চাই আমি। রাম সিং কি কোনো সাঙ্ঘাতিক রকমের অপরাধ করেছে যার জন্যে কিকা এই শাস্তি দিয়েছেন?

মুহূর্তের জন্যে নিজেকে অসহায় বলে বোধহয় জিৎ সিং-এর। যশোবন্তের মতো বয়স্ক আর খাঁটি লোক সোজাসুজি প্রশ্ন ক’রে বসলে, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যায় না। যে নেয় সে মানুষ নয়। তাই জিৎ সিং তলোয়ার দিয়ে তার পায়ের কাছের মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে ভাবতে থাকে।

সম্মুখে নির্বাপিত প্রায় চিতা। দগ্ধাবশেষ কাঠগুলি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। কালও যে মেয়েটি অকারণে হেসেছে, কেঁদেছে ছুটে বেড়িয়েছে বিকৃত মস্তিষ্ক নিয়ে-আজ আর তার কোনো অস্তিত্বই নেই।

কিন্তু ওসব চিন্তা করবার মতো মানসিক অবস্থা জিৎ সিং বা যশোবত্তের নেই। যশোবন্ত তখন তার মনের স্থৈর্য হারিয়েছে। আর জিৎ সিং ভাবছিল, সত্যি কথা বলেও কি ভাবে আসল ঘটনা চেপে রাখা যায়।

হঠাৎ তারা পেছনে শুনতে পায় অশ্বপদশব্দ। সবাই ঘুরে দাঁড়ায়। রাজপ্রাসাদের রক্ষীদের দলপতি।

লোকটি ঘোড়া থামিয়ে চুপ ক’রে চিতার দিকে চেয়ে থাকে। যে-কথা বলতে এসেছিল সে, যে-খবর দিতে এসেছিল সব যেন গোলমাল হয়ে যায়। তার ঘোড়াটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পা নাড়াচাড়া করে।

উদয়সাগর থেকে মাটির পাত্র পূর্ণ ক’রে চিতায় জল ঢালা হয়। অনেকেই ঢালে। আগুন নিভে যায়। একেবারে নিভে যায়। সেখান থেকে কালো জল বের হয়ে ধীরে ধীরে সরোবরের দিকে গড়িয়ে যায়।

রাখীর মামী একবার কেঁদে ওঠে, তার নাম ধরে। অন্য রমণীরা তাকে ধরে ফেলে। তাদের চোখেও জল। রাখীর স্বভাবটি বড় মিষ্টি ছিল। তাকে অনেকেই চিনত, অনেকেই ভালোবাসত। পাগল হবার পরেও তাকে ভালোবাসত।

অশ্বারোহী এতক্ষণে প্রশ্ন করে,−কে গেল?

যশোবন্ত পাগড়ী দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে বলে,—একটি মেয়ে। পাগল হয়েছিল।

—ভালোই হয়েছে ওর পক্ষে। পাগল হয়ে বেঁচে থাকবার মতো বিড়ম্বনা আর নেই।

যশোবন্ত প্রশ্ন করে,–এই সময় হঠাৎ এদিকে যে?

—তোমার কাছে। কিকা ডেকেছেন তোমায়। এখনি যেতে বলতাম তোমায়। কিন্তু এখন যাওয়া সম্ভব হবে না দেখছি। সময় করে একসময়ে যেও।

যশোবন্ত বুঝতে পারে না, কিকা হঠাৎ তাকে ডাকবেন কেন। নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে। সাধারণত তিনি জিৎ সিং-এর মারফত খবর পাঠান। কাল জিৎ সিং-কে বলে দিতে হয়তো ভুলে গেছেন তাড়াতাড়িতে।

অশ্বারোহী ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারপর আবার কি মনে করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, —মেয়েটি পাগল ছিল। তার মৃত্যুতে তোমাদের দুঃখ হলেও আফশোস হবে না অতটা। কিন্তু এই চিতায় আজ যদি জিৎ সিং-এর মৃতদেহ চাপত?

জিৎ সিং-এর ইচ্ছে হয় রক্ষী সর্দারের ঘাড়ের কাছ-বরাবর তলোয়ারটি একবার টেনে দেয়। কিন্তু এখন আর লাভ হবে না তাতে। ক্ষতিটুকু সে প্রথম উচ্চারণেই ক’রে ফেলেছে।

সবাই মাথা উঁচু ক’রে অশ্বারোহীর দিকে চায়। জিৎ সিং অলক্ষ্যে একবার লীলাবতীর দিকে চেয়ে নেয়। বন্ধু বিয়োগের এই শোকের মধ্যেও অশ্বারোহীর কথা তার কানে যায়। তার চাহনি দেখে মনে হয়, পারলে সে অশ্বারোহীকে এই মুহূর্তে ভস্মীভূত ক’রে ফেলত।

যশোবন্ত বলে,—ওকথা বললে কেন?

—কালকের সেই শিকারের সময়ের ঘটনার কথা বলছি। জিৎ সিং-এর চিতাই তো এতক্ষণে জ্বলত।

উত্তেজিত যশোবন্ত একবার কঠোরভাবে জিৎ সিং-এর দিকে দৃষ্টিপাত ক’রে, অশ্বারোহীকে প্রশ্ন করে,—কি হয়েছিল কালকে?

—সেকি? শোনোনি?

—না।

জিৎ সিং বলেনি?

—না তো?

—আশ্চর্য! প্রাসাদে সেই আলোচনাই চলছে কাল থেকে। সে তোমাদের কাউকে এ পর্যন্ত কিছু বলেনি? আশ্চর্য ছেলে।

অধৈর্য যশোবন্ত বলে ওঠে,—কি হয়েছিল?

দলের লোকেরা এবারে চিতা ছেড়ে অশ্বারোহীকে ঘিরে ধরে। রাখীর মামীও বাদ যায় না। তার দুঃখও যেন সাময়িকভাবে অন্তর্হিত হয়। রাখীর ওপর যত মায়াই তার থাকুক না কেন, রাখী তার নিজের পেটের মেয়ে নয়।

অশ্বারোহী একবার জিৎ সিং-এর মুখের দিকে চায়। তারপর সে সবার দিকে চেয়ে নেয়। শেষে সে ধীরে ধীরে বলে চলে গতকালের ঘটনা। জিৎ সিং মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের মুঠো দুটো একবার শুধু বন্ধ ক’রে ছেড়ে দেয়। সে অবাক হয়ে দেখে লোকটির গল্প বলবার শক্তি অসাধারণ। সামান্য জিনিসটিকে অবধি অদ্ভুত রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করতে পারে। যশোবন্তের মতো লোকও কেমন স্তম্ভিত হয়ে শুনছে—তার চোখ দুটোও বড় বড় হয়ে উঠছে। ওদিকে লীলাবতী শক্ত ক’রে শংকরীর হাত দুটো চেপে ধরে রেখেছে।

অশ্বারোহী সবশেষে বলে,—জিৎ সিং কি ক’রে প্রাণে বাঁচল, আমরা এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। চোখের সামনে ভাসছে, মাটির ওপর পড়ে রয়েছে জিৎ সিং। ঘোড়াটি তার দেহের ওপর চেপে রয়েছে। ওদিকে সেই ভয়ঙ্কর জীবটি ছুটে আসছে। উঃ! সেই মুহূর্তের কথা ভাবাই যায় না। নিজের পরম শত্রুকেও কেউ ওই অবস্থায় দেখতে চায় না। ঘোড়াটি যদি না পড়ে যেত তবে নিশ্চয়ই শুয়ে থেকেও বরাহটিকে ঠেকাতে পারত। কিন্তু এ কথাও স্বীকার করতে হবে রাম সিং-এর গুলির আওয়াজ শুনে জন্তুটি একটু থতমত খেয়ে গেছল। তা যদি না যেত, তবে কিকা বল্লম ছুড়বার অবকাশই পেতেন না।

সবাই যেন গিলছে তার কথা। সেইদিকে ভ্রূক্ষেপ না ক’রে অশ্বারোহী একটু থেমে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে,—আচ্ছা, রাম সিং লোকটি কি রকম সর্দার? আমার মনে হয়, তার সম্বন্ধে জানবার জন্যেই কিকা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। জিৎ সিং-এর ওপর কি তার কোনো হিংসে রয়েছে? নইলে ওভাবে জিৎ সিং-কে বিপদে ফেলবার চেষ্টা করবে কেন? ঘোড়াটি ছিল বরাহ থেকে অনেক দূরে। তারই পায়ে গিয়ে বিধল গুলি?

লীলাবতী ছিটকে সামনে এগিয়ে আসতে চায়। কিন্তু শংকরী তাকে চেপে ধরে নীচু গলায় বলে,—এত উতলা হয়ো না লীলা। সত্যি কখনো চাপা থাকে না। প্রকাশ পাবেই একদিন না একদিন।

লীলাবতী রাগে ফুঁসতে থাকে। রাগ তার রাম সিং-এর চেয়েও বেশি জিৎ সিং-এর ওপর। এমন সাঙ্ঘাতিক একটা কাণ্ড ঘটে গেল, অথচ বলবার সময়ই হল না? যেন কিছুই হয়নি। অদ্ভুত মানুষ!

অশ্বারোহী আচমকা ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটতে থাকে। হয়তো কোনো জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে গেছে। গল্পের নেশায় সে কাজের কথা বোধহয় একবারে ভুলে গিয়েছিল।

যশোবন্ত সহসা ছুটে আসে। জিৎ সিং-এর হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে কোনোমতে সে বলে,তুমি—তুমি যদি আমার পুত্র হতে জিৎ তাহলে তোমাকে এই এতগুলো লোকের সামনে ধরে মারতাম। কিংবা—কিংবা হয়তো বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতাম। কিন্তু তুমি আমার ছেলে নও। তুমি বীর অজিত সিং-এর ছেলে। অজিত সিং বেঁচে থাকলে হয়তো তোমার মতোই নির্বিকার থাকতেন। তোমার মতোই তাঁর হয়তো মনে হত এসব অতি সাধারণ ব্যাপার। কারণ প্রকৃতই যে বড় হয়, পদে পদে বিপদও তার ঘন ঘন। সেগুলো তারা গায়ে মাখে না।

লীলাবতী আবার শংকরীর হাত চেপে ধরে। এবারে আর রাগে নয়, আনন্দে। জিৎ সিং-এর চরিত্রের প্রকৃত ব্যাখ্যা করেছে অভিজ্ঞ যশোবন্ত। এতটা তলিয়ে সে ভাবেনি।

শংকরীও অবাক হয়েছিল আর একটি কারণে। যশোবন্তের চিন্তাশক্তি যে কত গভীর, আজ এই প্রথম উপলব্ধি করে সে। যশোবন্ত জাগতিক মাপকাঠিতে হয়তো চতুর নয়। কিন্তু তার মনের গভীরতা, তার দূরদৃষ্টির এই নতুন পরিচয় পেয়ে সেই বহুকাল পূর্বে যৌবনের এক নেশাধরা ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে।

দলের সবাই চিৎকার ক’রে ওঠে,—রাম সিং-এর রক্ত চাই। সর্দার, এবারে তাকে আর ক্ষমা করবার প্রশ্ন উঠতে পারে না। সে ক্ষমার অযোগ্য।

—হ্যাঁ। সে তার শাস্তি পাবে। তোমার নিশ্চিন্ত থাকো। রাম সিং-কে দেখতে পেলেই ধরে আনবে। কৌশলে ধরতে হবে তাকে। কারণ তার শাগরেদরা এত কিছুর পরেও তাকে হয়তো বাঁচাতে চাইবে। সেই সব শাগরেদ এই দলের মধ্যেই রয়েছে। অবিশ্যি রামের পরিচয় পেয়ে এবারে তারা ওর সঙ্গ ছেড়ে দেবে—এই আশাই করব।

জিৎ সিং ভাবে, এত কাণ্ড ঘটে চলেছে দলের মধ্যে, অথচ রাখী মেয়েটি নেই তার দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেছে। এই রাখীই একদিন মাত্র আগে ওই শিমুলগাছের গোড়ায় পাগলামির ঝোঁকে কতো অমূল্য কথা বলেছিল।

সবাই ধীরে ধীরে চলে যায়। তখনো যশোবন্ত জিৎ সিং-এর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ইচ্ছে, জিৎ একবার লীলার সঙ্গে দেখা করুক। কিন্তু সেই কথাটা মুখ ফুটে বলতে সংকোচ হয় বৃদ্ধের।

—কি ব্যাপার সর্দার? ধরে রেখেছ কেন? আমাকেও শাস্তি দেবে নাকি?

—হ্যাঁ।

—কি শাস্তি?

—অন্যায়কারীকে শাস্তির ধরন আগে থেকে বলতে নেই সব সময়। ঠিক সময়ে জানবে।

—তবু শুনতে ইচ্ছে হয়।

—না। তবে আপাতত তোমাকে একটি আদেশ করছি। তুমি এখুনি গিয়ে শংকরীর সঙ্গে দেখা কর।

কেন? সেই রসিকার বিদ্রূপ শুনতে?

—হ্যাঁ।

—বেশ যাচ্ছি

জিৎ সিং চলে যেতেই যশোবন্ত অশ্বারোহীর যাওয়ার পথ ধরে অগ্রসর হয়। কিকার সঙ্গে এখনি দেখা করতে যাবে সে।

.

ঘরে একা লীলাবতী বসে ছিল।

জিৎ সিং প্রশ্ন করে, লীলা, শংকরী নেই?

জবাব নেই।

—লীলা।

লীলা চুপ।

—লীলাবতী।

তবু কথা নেই লীলাবতীর মুখে। সে যেন পাষাণ-প্রতিমা।

জিৎ সিং দু-পা অগ্রসর হয়ে আসে। বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যু বোধহয় খুব বেশিরকম বিচলিত করেছে লীলাকে। তাই অমন চুপ ক’রে বসে রয়েছে।

জিৎ সিং লীলাবতীর কাঁধে হাত রাখে। ছিকে দূরে সরে যায় লীলা।

—তুমি আমার ওপর রাগ করেছ লীলা?

তবু লীলা মুখ বন্ধ ক’রে থাকে।

—কেন অমন চুপ ক’রে আছো? আমার যে কষ্ট সেকথা বুঝি ভুলে গেলে?

ও-পক্ষ নীরব।

—বেশ, কথাই যখন বলবে না, আমি চলে যাচ্ছি।

—যেও না।

—আমি যাবই। এতক্ষণ ধরে ডাকছি, একটি কথাও বলছ না। যদি কোন অপরাধ করতাম কথা ছিল। কোন অপরাধ করিনি, শুধু শুধু। আমি যাবোই। বাধা দিতে পারবে না।

জিৎ সিং দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

—যেও না।

—আমি যাব।

—সাবধান ক’রে দিচ্ছি।

—তোমার কথা আমি মানি না। যে আমায় কষ্ট দেয়, তার কথা আমি মানি না।

–যেতে পারবে না তুমি।

—যাবই।

—এই দেখ তবে।

বিদ্যুতের মতো লীলাবতী জিৎ সিং-এর সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে তীক্ষ্ণ ছুরিকা ঝলসে ওঠে। সেই ছুরিকা জিৎ সিং-এর বুকের ওপর উদ্যত।

—তুমি আমায় মেরে ফেলতে চাও?

—আমার মনে হয় তুমি আমাকে কালপীর মেয়ে বলে ভুল কর। কিন্তু তা নয়। আমি রাজপুত্র মেয়ে। রাজপুত মেয়ে অপমান সহ্য করে না। সেই অপমান যার কাছ থেকেই আসুক না কেন।

—মারো তবে।

—যাবার চেষ্টা কর।

—এই তো যাচ্ছি।

জিৎ সিং তার দুই হাত দুইদিকে প্রসারিত করে। আর সেই প্রসারিত হাতের মধ্যে এসে লীলাবতী দুই হাতে জিৎ-এর গ্রীবাদেশ জড়িয়ে ধরে। তার হাতের অস্ত্র মাটিতে পড়ে যায়। সে বলে,—তুমি খুব অবাধ্য।

—আর তুমি?

—আমি লক্ষ্মী মেয়ে।

—ওরে বাবা। লক্ষ্মী মেয়ের নমুনা দেখালে বটে।

—তুমি আমাকে কালকের কথা বলনি কেন?

—রাখীর জন্যে সময় পেলাম কখন?

—না। রাখীর কিছু না হলেও তুমি বলতে না। তোমাকে আমি চিনি

—চেনো?

—হ্যাঁ। প্রথম দিনেই চিনেছি।

—তবে আর কি বলব?

—এত সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটল, অথচ আমাকে কিছুই বললে না। শেষে অন্য লোকের মুখে সব শুনতে হল! ছি ছি, ভাবতে লজ্জায় মরে যাচ্ছি। আমার সম্মানের আর অবশিষ্ট রইল না কিছু।

জিৎ সিং লীলার মাথায় আস্তে হাত বুলিয়ে দিলে বলে,–কেন তোমায় বলিনি জানো?

—কেন?

—তোমার ভয়ে।

—কি বললে? লীলাবতী দূরে সরে দাঁড়ায়।

—তোমার ভয়ে।

—তুমি ভেবেছ, আমি একথা বিশ্বাস করব?

—করবেই।

—তুমি পৃথিবীতে কাউকে ভয় পাও নাকি?

—না। কাউকে ভয় পাই না। শুধু—

—শুধু আমাকে?

—জানই তো।

লীলাবতী আবার এগিয়ে এসে জিৎ সিং-এর গলা ধরে ঝুলে পড়ে। তারপর খুব হাসতে থাকে।

—হাসছ যে?

—তোমার কথা শুনে খুব মজা লাগছে।

—তাতো লাগবেই। কালকে এসব কথা তোমায় বললে কি ঘটে যেত বল তো?

—কি ঘটত?

—সঙ্গে সঙ্গে তুমি যশোবন্তকে খবর দিতে। যশোবন্ত দলের সবাইকে ডাকত। হয়তো তখুনি ছুটত বনের দিকে। আমার কোনো কথা, কোনো যুক্তিই শুনতে চাইত না। নইলে আর কাউকে বলি আর না বলি, তোমাকে ঠিকই বলতাম।

লীলা আবার দূরে সরে যায়। জিৎ সিং-কে আপাদমস্তক চেয়ে চেয়ে দেখে সে। শেষে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলে—ভুল করলে জিৎ। আমাকে তুমি চিনতে পারনি। আমি গোপাল সিং-এর মেয়ে। আমি সহজে উতলা হইল না। তবে দুর্ভাবনা আমার হয়। তোমার জন্যে দুর্ভাবনা হয়েছিল আমার। কারণ তোমার সঙ্গে ছিলাম না আমি। তাই বলে, সব কিছু শুনবার পর চেঁচামেচি করব—একথা তুমি ভাবলে কি ক’রে?

জিৎ সিং সহসা লীলাবতীর সামনে হাঁটুর ওপর বসে পড়ে। লীলাবতীর মুখের দিকে চেয়ে বলে,—আমি সত্যিই ভুল করেছিলাম লীলা। আর কখনো ভুল হবে না। আর কখনো সাধারণ মেয়ে বলে ভাবব না তোমায়।

লীলাবতী তার হাত ধরে তোলে। তার মুখের দিকে নির্নিমেষ নয়নে বহুক্ষণ চেয়ে থাকে। শেষে বলে,—তুমি সত্যিই অপূর্ব জিৎ। তোমার তুলনা হয় না।

—তোমার?

—আমি তোমার মতো নই।

—তুমি আমার চেয়েও বেশি।

—না। একথা কিছুতেই মানি না। তুমি তোমায় চেনো না, তাই একথা বলছ।

বাইরে শংকরীর পায়ের শব্দ শোনা যায়। সে বড় বেশি জোরে পা ফেলছে। এত জোরে সে ফেলে না কখনে। আর এত জোরে কাশেও না।

জিৎ একটু দূরে সরে দাঁড়ায়।

দুজনা দুজনার দিকে চেয়ে পরিতৃপ্তির হাসি হাসে।

সেদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে রাখীর মামার কুটির থেকে মাঝে মাঝে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। কাঁদছে মামী! কাঁদবে না? রক্তের সম্বন্ধ না থাকতে পারে, মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা তো মিটেছিল কিছুটা পরিমাণ

মামী নিঃসন্তান। সন্তান জন্মাবার বয়সও পার হতে চলেছে। তাই সে নিজে না জানলেও রাখীর ওপর তার স্নেহ দিনের পর দিন আরও ঘন হয়ে উঠেছিল। এই চরম আঘাত প্ৰকাশ ক’রে দিল সেই সত্য। মানুষ অনেক সময়ে নিজের মনকেও চিনতে পারে না—সেইখানেই মানুষের জীবনের ব্যর্থতার বীজ সুপ্ত হয়ে থাকে। নইলে, নিজের মনকে মানুষ যদি চিনতে পারত, তাহলে অন্তত নিজের কাজের জন্যে পরে অনুশোচনা করতে হত না।

রাখীর মামীর বয়স যখন কম ছিল, তখন রাখীকে দেখে স্নেহ জাগলেও, সে স্নেহ রাখীর চারদিকে কঠিন বাঁধের সৃষ্টি করে রেখেছিল। কারণ তখন সে যুবতী। স্বামী তাকে সন্তান দেবে—সেই সন্তান তারই শরীরের উত্তাপে আর খাদ্যে গর্ভের মধ্যে বড় হয়ে উঠবে। তারপর সে ভূমিষ্ঠ হলে কত না আশা সেই সন্তানের ওপর ঢেলে দেবে সে তার অগাধ স্নেহ। শুধু শুধু একটি সম্পর্কহীন মেয়েকে ভালোবেসে সে স্নেহের সঞ্চয় কম ক’রে দেবে?

রাখীর মামী তার স্নেহ অতি সাবধানে সংরক্ষিত রেখেছিল নিজের সন্তানের জন্যে। কিন্তু সেই সন্তান আর ভূমিষ্ঠ হল না। তাই, যতই দিন যেতে লাগল, সেই সংরক্ষিত স্নেহের বাঁধে ভাঙন ধরতে শুরু হয়েছিল। সেই ভাঙনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা স্নেহধারা মামীর অজ্ঞাতে ধাবিত হয়েছিল, রাখীর দিকে। এই চরম বিপদ ঘটে যাবার পর সন্ধ্যার নির্জনতায় মামী বুক হাতড়ে দেখে নিজের সন্তানের জন্যে জমানো স্নেহের প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবটাই রাখী দখল করে নিয়েছিল।

তাই মামীর ঘর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ বের হয়ে ভেসে যাচ্ছিল উদয়সাগরের জলের ওপর দিয়ে, যেমনিভাবে রাখীর চিতা হতে ধূম নির্গত হয়ে উঠে গিয়েছিল আকাশ পানে।

শংকরী আর লীলাবতী কান পেতে শোনে। রাখীদের ঘরখানি ওদের ওখান থেকে বেশ কিছু দূরে। যেতে একটু সময় লাগে। মাঝে ঝোপ-ঝাড় গাছপালাও রয়েছে। শংকরী কিছুক্ষণ শুনবার পর আর থাকতে না পেরে বলে,—একটু দেখে আসি লীলা।

—আমি যাব।

—না, সবাই গিয়ে কাজ নেই। তুমি বরং কপাট বন্ধ ক’রে বস

লীলা আপত্তি করে না। জিৎ সিং এলেও আসতে পারে। তাকে কিকা ডেকে পাঠিয়েছেন প্রাসাদে। সকালে যশোবন্ত কিকার সঙ্গে দেখা করে রাম সিং-এর বিরুদ্ধে বলে এসেছে। কিকা নাকি বার বার জানতে চেয়েছেন, জিৎ-এর সঙ্গে রাম সিং-এর কোনোরকম শত্রুতা রয়েছে কি না। যশোবন্ত আসল ঘটনার কথা না জেনেও বলে এসেছে, শত্রুতা রয়েছে। অন্তত রাম সিং মনে মনে বিদ্বেষ পোষণ করে।

যশোবন্ত জানে না, রাম সিং-এর ক্রোধের মূলে লীলা। লীলা জিৎ সিং-কে পছন্দ করে। শংকরী যশোবন্তকে একথা বলেনি। তবে সে জেনেছিল, রাখীর মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য। সেই কথাও বলে দিয়েছে কিকাকে। শুনে নাকি, কিকা রাগে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।

যশোবন্ত এসে বলেছিল,—ঘোড়া নিয়ে ফিরে এলে, রাম সিং-এর কপালে অশেষ দুঃখ রয়েছে।

শংকরী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল, সে আর আসবে না।

—না এসে যাবে কোথায়?

—তা জানি না। তবে এখানে সে আর আসছে না। এলেও চুপি চুপি এসে ফিরে যাবে যশোবন্ত তার কথায় প্রতিবাদ করেনি। কারণ সে দেখেছে ওর সব কথাই প্রায় সত্যি হয়।

লীলাবতী শুধু মন্তব্য করেছিল তখন,—না এলেই ভালো।

শংকরী বলেছিল,—অতটা নিশ্চিত হয়ো না। রাম সিং পরাজয় স্বীকার ক’রে পালিয়ে যাবার ছেলে নয়। যাবার সময়ে একটা বড় রকমের ক্ষতি ক’রে দিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারে।

তাই রাখীর মামীর ঘরে যাবার আগে শংকরী লীলাবতীকে ঘরের কপাট বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকতে বলল।

লীলাবতী ভাবে, রাম সিং তার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। সে তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারবে না। সে তার ওপর অত্যাচারও করতে পারবে না। শুধু মেরে ফেলতে পারে। কারণ তার হাতে রয়েছে বন্দুক। ছুরি দিয়ে বন্দুকের গুলিকে রোধ করা যায় না।

তবু লীলাবতী শংকরীর কথামতো ঘরের কপাট বন্ধ করে দেয়। কারণ এখন সে মরতে চায় না। এখন তার মৃত্যু হলে সে সহ্য করতে পারবে না। পৃথিবী যে কতখানি রঙিন হতে পারে সবে সে দেখতে শিখেছে। পৃথিবীর সুগন্ধ সে পেতে শিখেছে সবে। জীবনকে আস্বাদন করতে যে শিহরন, তার মধুরতা এই তো পেতে শুরু করল। এখনো কত বছর বাকি। এখন কি কেউ মরতে চায়? চায় না। লীলাবতীও চায় না। তাই বাধ্য মেয়ের মতো কপাট বন্ধ করতে করতে ভাবে, এখন মরলে আমি পাগল হয়ে যাব একলিঙ্গ।

পাগল হবার কথাই। মনে মনে সে স্বপ্ন দেখছে ফাল্গুনের শেষের সেই রঙিন দিনটির। আকুল হয়ে প্রতীক্ষা করছে সেদিনের জন্যে। ফাগ আর আবীরের রঙে সব লাল হয়ে উঠবে। এখন থেকে সে ভেবে রেখেছে জিৎ সিং-কে প্রথমে কিছুতেই ধরা দেবে না। জিৎ সিং ছুটলে সে-ও ছুটবে। ছুটতে ছুটতে ওই শিমুলগাছ পার হয়ে ঝোপ-ঝাড় যেখানে আরও ঘন হয়ে উঠেছে তার মধ্যে গিয়ে তবে ধরা দেবে। তখন জিৎ সিং আবীরে তার মুখ যত খুশি লাল করে দিক। তখন তার মুখ তো এমনিতেই লাল হয়ে উঠবে পরিশ্রম আর উত্তেজনায়। তার ওপর জিৎ সিং আর কত লাল করতে পারবে?

কে যেন কপাটে টোকা দেয়।

রাম সিং?

লীলাবতী একটু স্থির হয়ে থাকে। তারপর বলে,—কে?

বাইরে যশোবন্তের কণ্ঠস্বর শোনা যায়,—কপাট খোলো।

লীলাবতী কপাট খোলে।

যশোবন্ত ভেতরে এসে চারদিকে চেয়ে দেখে। ওর দৃষ্টি একটু যেন নিষ্প্রভ হয়,—শংকরী নেই?

—না।

—কোথায় গেল?

—রাখীর মামী কাঁদছে। সেখানে গেছে।

—এখনি গেল বুঝি?

—হ্যাঁ।

—ও আচ্ছা।

যশোবন্তের কথার ভঙ্গিতে হতাশা। তার মনে হয় শংকরী যেন বহু দূরে চলে গেছে। আর দেখা হবে না। কোনোদিনও দেখা হবে না। একাকী নিজের ঘরে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। তাই শংকরীর কাছে সে এসেছিল দুটো কথা বলতে। শংকরীর কথা তার খুব ভালো লাগে। শংকরীর চুপ করে থাকাটাও ভালো লাগে। সে যখন কথা বলে না, তখনো মনে হয় যেন যশোবন্তের মঙ্গলের জন্যেই চুপ ক’রে রয়েছে। মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হয় সর্দার—এমন হয় কেন? ওই প্রৌঢ়া মহিলাটির হাব-ভাব কথাবার্তা সব কিছুই অত তৃপ্তি দেয় কেন তার মনে? ভেবে কূল-কিনারা পায় না সে।

রাম সিং-এর চিন্তায় অস্থির হয়েই চলে এসেছিল যশোবন্ত। শংকরী তার অশান্ত মনকে অনেকটা শান্ত করতে পারত। কিন্তু সে নেই। সে অনুপস্থিত। কখন ফিরে আসবে কে জানে। ইচ্ছে করলে রাখীদের ঘরে যাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে গেলে শংকরী হয়তো বিরক্ত হবে। ভাববে, ভীমরতি হয়েছে বুড়োর। ওদের সামনে বলেও ফেলবে হয়তো সেকথা। মুখে তো কিছুই আটকায় না তার। পুরুষেরা যে সব কথা বলতে সংকোচ বোধ করে সেসব কথাও নির্বিকার চিত্তে ফস ক’রে বলে দেয়। প্রথম প্রথম যশোবন্তের খুব খারাপ লাগত। এখন আর লাগে না। বরং ভালো লাগে। মুখে যা-ই বলুক না কেন, মনে মনে শংকরী যে তার মঙ্গল চায় একথা বুঝতে তো আর বাকি নেই।

শংকরী কতক্ষণে ফিরে আসবে কে জানে!

বিরহের কথা যশোবন্ত অনেক শুনেছে। সে নিজেও আজীবন বিরহী। যদিও নায়িকার সঙ্গে চক্ষুর মিলনও তার ঘটেনি কখনো। বহু বছর আগে দেবী সিং-এর সেই বুদ্ধিমতী মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাবার কথা শুনে তার মনে যে অবস্থা হয়েছিল, সে অবস্থাকে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বিরহ বলে মেনে নিয়েছিল সেদিন। নায়িকার রূপগুণের কথা লোকমুখে শুনে যে প্রেম হয়, সেই প্ৰেম থেকেও নাকি বিরহের উৎপত্তি হতে পারে।

কিন্তু আজ শংকরীর ঘরে এসে তাকে না পেয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে যে ভাবের উৎপত্তি হল, তাকে কি সংজ্ঞা দেবে লোকে? বিরহ? তা কি করে হবে! কিন্তু একথাও অস্বীকার করা যায় না, দেবী সিং-এর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার খবর শুনে যে অবস্থা হয়েছিল সেদিন, তার সঙ্গে আজকের এই মুহূর্তের অবস্থার যেন কোনো সাদৃশ্য রয়েছে। অথচ এর কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, শংকরী যুবতী নারী নয়। তৃতীয়ত, শংকরীকে যুবতী ধরে নেওয়া হলেও, সে তো একেবারে ছেড়ে যায়নি তাকে। সে ঘর ছেড়ে কিছু সময়ের জন্যে বাইরে গেছে মাত্র। এক্ষুনি ফিরে আসবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, সে শংকরীকে ভালোবাসে না। তবে কেন এই অবস্থা হল তার। যেন দেবী সিং-এর সেই মেয়েটিই আজ বিয়ে ক’রে চিরকালের জন্য পর হয়ে গেল। যশোবন্ত বাইরে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই লীলা প্রশ্ন করে,—কোথায় যাচ্ছ?

—ঘরে।

লীলাবতী লক্ষ্য করেছে বৃদ্ধ গভীর চিন্তায় মগ্ন। তাই সে বলে,—এখানে বসো। এক্ষুনি তো আসবে শংকরী।

—বসব? আচ্ছা।

যশোবন্ত ধীরে ধীরে আসন গ্রহণ করে। লীলাবতী তার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।

শংকরী রাখীর মামীর ঘর থেকে ফিরে আসছিল।

মামীকে শান্ত করতে তার বেশি সময় লাগেনি। দুটো সান্ত্বনা বাক্য আর বার দুয়েক চোখের জল মুছিয়ে দিতেই সে থেমে গিয়েছিল।

শংকরী জানে, কাল কিংবা অন্য কোনোদিন সামান্য উপলক্ষে আবার রাখীর জন্যে ভেতরটা গুমরে উঠবে মামীর। আবার কাঁদতে বসবে। প্রিয়জনের মৃত্যুতে এমনিই হয়। কাজকর্ম হাসি আনন্দের মধ্যেও বহুদিন পরেও হঠাৎ এক সময়ে আর নিজেকে স্থির রাখা যায় না। চাপা দুঃখটা চোখের জল হয়ে বের হয়। রাখীর মৃত্যু সদ্য হয়েছে এই শোককে নিজের দখলে আনতে সময় লাগবে মামীর।

বাইরের অন্ধকার আরও গাঢ়। গাছপালা ঘরবাড়ি উদয়সাগরের জল, সব যেন একাকার হয়ে গেছে এই অন্ধকারে। শংকরী এই অন্ধকারের মধ্যে ধীরে পায়ে ফিরে আসছিল নিজের ঘরে। লীলাবতী একা রয়েছে ঘরে। রাম সিং সম্বন্ধে কোনো মীমাংসায় আসবার আগে অবধি লীলাবতীকে একা রাখা নিরাপদ নয়। হয়তো জিৎ সিং এতক্ষণে সেখানে এসে হাজির হয়েছে। কিংবা নাও আসতে পারে সে।

শংকরী একটু তাড়াতাড়িই পথ চলার চেষ্টা করে। রাখীদের কুটির দিনের বেলা কাছে মনে হলেও, খুব বেশি কাছে নয়। অথচ রাখীর মামীর কান্না বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

রাম সিং কি আহত অশ্বটিকে সঙ্গে নিয়ে ফিরবে? কে জানে? যদি একলা ফেরে তবে হেঁটে এলেও এর মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। তেমন কিছু হলেই সর্বনাশ।

হঠাৎ একটি ছোট্ট ঝোপের পাশে এসে শংকরীর গতি বন্ধ হয়ে যায়। কারা যেন কথা বলছিল চাপা গলায়। তীব্র কৌতূহল হয় শংকরীর। এই সময়ে এত গোপনে কারা কথা বলছে? শেষে রাখীর মতো সর্বনাশ হবে নাকি অন্য কোনো হতভাগীর?

অস্থির হয়ে ওঠে শংকরী। গুটিসুটি হয়ে সে চুপ ক’রে বসে পড়ে। শুনতে হবে সব। তেমন কিছু দেখলে বাঁচতে হবে হতভাগীকে।

শংকরী কান পেতে থাকে।

হঠাৎ তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। রাম সিং-এর কণ্ঠস্বর। রাম সিং ফিরে এসেছে অরণ্য থেকে। ফিরে এসেছে গোপনে। ফিরে এসেছে কিকার আদেশ অমান্য করে। ঘোড়াটিকে নিশ্চয়ই সঙ্গে আনেনি সে। কিকার শ্রেষ্ঠ অশ্বটিকে নির্বিচারে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে এসেছে। এসে গোপনে তার দলের লোকদের জড়ো ক’রে পরামর্শ করছে। কোনো মেয়ের গলার আওয়াজ পাওয়া যায় না।

রাম সিং চাপা গলায় কাকে যেন বলে,—বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখে?

—সর্বনাশ কেন করলে তবে?

—আমি সেধে করিনি। ও-ই কেমন ক্ষেপে গেছল। তার ফল ভোগ করেছে। আমি কি করব?

—যাই বল না কেন। রাখী তোমার ভালোবাসত। আমরা দেখেছি তো?

—ওসব কথা ছাড়। ভালোবাসা-টাসা আমি বুঝি না।

—মেয়েটা ওভাবে মরল-তোমার কষ্ট হচ্ছে না একটু?

রাম সিং হেসে ওঠে। বলে,—ছাই। কষ্ট হবে কেন?

—তুমি সাঙ্ঘাতিক লোক দেখছি?

—এখনো দেখিসনি। এবারে দেখবি।

শংকরী আস্তে আস্তে আরও একটু অগ্রসর হয়। একেবারে ঝোপের গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসে।

রাম সিং বলে,—কিকা আমাকে মরণের ফাঁদের মধ্যে ফেলে রেখে এসেছিল। আমি এতই বোকা?

—এবারে কি করবে তবে। এখানে তো থাকবে পারবে না।

—এখানে থাকতে চাই না। চলে যাব এখান থেকে। তবে যাবার সময়ে একটি জিনিসকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

—কোন জিনিস?

—বুঝতে পারিসনি?

—না।

—লীলা। লীলাবতীকে চাই-ই। আজই ওকে নিয়ে চলে যাব। তোরা দুজন আমার সঙ্গে যাবি তো?

একজন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলে,—বুঝতে পারছি না।

আর একজন বলে,—কোথায় যাবে আগে শুনি, তবে তো বলব?

—আগে বলব না। আগে জানতে চাই, তোরা আমার সঙ্গে যাবি কি না। রাজি থাকলে তবে বলব কোথায় যাব আমি। কারণ যদি সঙ্গে না যাস, আমার হদিস ওরা তোদের কাছ থেকে পাবে। আমি তা হতে দেব না।

দুজনা বলে,—আচ্ছা যাব। তুমি ছাড়া আমাদের গতি নেই।

রাম সিং বলে, —হ। এবারে বলা যেতে পারে তোদের কাছে। শোন। এখানে পড়ে থেকে কোনো লাভ নেই। মেবারের দিন চলে গেছে। আকবর বাদশাহের বিরুদ্ধে কোনোদিনও আর মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়াতে পারবে না রাজোয়ারার কোনো রাজ্য। মেবারও আর দাঁড়াতে পারবে না। তাই আমি ভেবে দেখেছি, এখানে বসে থেকে কোনো লাভ নেই, বরং ক্ষতিই। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করে, গরিব হয়ে থাকার কোনোই অর্থ নেই। তার চাইতে এমন জায়গায় যাব, যেখানে সম্মান আছে, টাকা আছে, প্রতিপত্তি আছে। একটা কথা তোরা ভুলে যা। তোরা নিজেদের রাজপুত বলে ভাবিস—সেকথা ভুলে যা। সেই কালপীর সঙ্গেই তোদের নাড়ীর টান। সেই কালপীর লোকেরা বরাবর অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ ক’রে এসেছে। অর্থ। অর্থই হল এই জগতের সার পদার্থ। আর সব মিথ্যে। কালপীর লোকেরা এই খাঁটি সত্যটি জানে। তোদের ঠাকুরদাও জানত। তোর ভুলে গেছিস। তোরা রাজপুতদের মতো বোকা হয়ে গেছিস।

—কিন্তু আসল কথাটি তো বললে না?

—কোন্ কথা?

—কোথায় তোমার সেই স্বর্গরাজ্য?

—আগ্রা।

—কি বললে?

—অবাক হচ্ছিস কেন? আগ্রায় যাব আমরা।

—সে তো মুঘলদের জায়গা। ওখানে যাব কোন্ দুঃখে?

—ওখানেই আমাদের স্থান হবে। আমরা মুঘলদের দলে যোগ দেব। আমরা বীর। অল্পদিনের মধ্যে উন্নতি ক’রে মনের সুখে দিন কাটাব।

একজন বলে,—ছিঃ ছিঃ, ভাবতেই পারি না।

—কি বললি? রাম সিং একটু জোরে বলে ওঠে।

—ওদের দলে যোগ দিলে যদি মুসলমান হতে হয়?

—হতে হলে হব, ক্ষতি কি? কোনোদিন যদি মেবার আক্রমণের সুযোগ ঘটে তবে কিকাকে দেখে নেব।

—তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না রাম সিং।

—সব বুঝতে পারবে, আস্তে আস্তে বুঝবে। তবে একটা কথা এখুনি বুঝিয়ে দি। সব শুনে নিয়ে এখন যদি তোমাদের কেউ আমার সঙ্গে যেতে অস্বীকার কর, তবে এই রাতের পরে সে আর সূর্যোদয় দেখতে পাবে না।

—আমরা নিশ্চয়ই যাব। তবে দেশের জন্যে মন কেমন করে তো?

—দেশ? কোটা তোদের দেশ?

—রাজোয়ারা, মেবার।

—মেবার? মেবার তোদের দেশ? এতক্ষণ তবে বললাম কি? ভুলে যা–মেবারের কথা ভুলে যা। তোদের যদি কোনো দেশ থাকে, তবে সে দেশ কালপী

—না রাম সিং, কালপীকে আমরা দেশ বলে ভাবতে পারি না। আমরা মেবারে জন্মেছি।

—বেশ, মেবারই না হয় তোদের দেশ হল। কিন্তু এই দেশ তোদের কী দেবে? কিছুই না। হ্যাঁ, একটা জিনিস দিতে পারে। অভাব আর মৃত্যু। যদি বাঁচতে চাস আমার সঙ্গে চল। স্বর্গ কাকে বলে দেখবি গিয়ে, অদ্ভুত সব ব্যাপার। মাথা গুলিয়ে যাবে।

—তবে লীলাবতীকে নিয়ে টানাটানি করছ কেন?

—ওকে আমার চাই। যতদিন ওর ওই রূপটুকু রয়েছে ততদিন ওকে আমার প্রয়োজন। তারপর রাখীর মতো একদিন ওকে ছুড়ে ফেলে দেব, অন্য একজনকে টেনে নেব। আগ্রায় তার অভাব হবে না।

ওরা দুজন রাম সিং-এর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে থাকে।

—চুপ করলি কেন? রাজি তো?

একজন বলে,—লীলাবতী আমাদের সর্দারের মেয়ে। সর্দারের সম্মান অন্তত রাখো রাম সিং।

—লাথি মারো সম্মানে। মেবারকেই লাথি মেরে চলে যাচ্ছি তো সর্দার! ওসব কথা ভুলে যা, নিজের কথা ভাব। নিজের সুখ, নিজের আহ্লাদ—ঠিক মুঘলদের মতো। ওরা কি আজ শুধু শুধু এত রাজ্য জয় করে বেড়াচ্ছে? জীবনটাকে শুকিয়ে না রেখে ছড়িয়ে দেয় ওরা। তাই আজ রাজোয়ারা আকবর শাহের পদানত।

শংকরী উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। কোনোরকমে দৌড়ে গিয়ে যশোবন্তকে খবর দিতে হবে। কিন্তু যদি জিৎ সিং না এসে থাকে, তবে একা বুড়ো এই তিনজনের বিরুদ্ধে কি লড়তে পারে? পারুক, আর না পারুক, লীলাবতীকে ঘরের ভেতরে রেখে বন্ধ কপাটের সামনে সে রুখে দাঁড়াবেই। যশোবন্ত নিজের জীবনের মায়া কোনোদিনই করেনি। কিন্তু আর কয়েকজনকে অন্তত ডাকতে হবে। অত সময় পাওয়া গেলে হয়। এদের তিনজনের কাছে নিশ্চয় বন্দুক রয়েছে। ওরা বন্দুক তৈরি করতে করতে যদি এরা হানা দেয় তবে আর উপায় থাকবে না। লীলাকে ধরে নিয়ে যেতে না পারলেও, মেরে রেখে যেতে পারবে।

শংকরী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। তারপর ছুটতে যেতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।

রাম সিং চিৎকার করে ওঠে,–কে?

শংকরী মরার মতো পড়ে থাকে, একচুলও নড়ে না।

রাম সিং আবার হাঁকে,–কে? কে ওখানে?

এবারেও শংকরী চুপ। সে আশা করে, আরো একবার হেঁকেই বোধহয় রাম সিং চুপ ক’রে যাবে। কিন্তু তার আশা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। রাম সিং-এর মতো লোক এত বড় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে কখনো অসাবধানীর মতো কাজ করতে পারে না। ওরা তিনজন এগিয়ে আসে—এগিয়ে আসে পা টিপে টিপে।

ওদের চোখ এড়িয়ে যাবার আর আশা নেই। অন্ধকার যত গাঢ়ই হোক, কাছের মানুষকে একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়। তাই নিজেই চেঁচিয়ে ওঠে শংকরী, —আর পারি না বাবা। বুড়ো বয়সে কত কষ্টই লেখা রয়েছে কপালে। কার কে মরল, সব খোঁজ নিতে হবে এই শংকরীর। সবার বিনা পয়সার ঝি।

উঠে বসে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে আপন মনে বিড়বিড় করে শংকরী! পাশে যে ওরা তিনজন এসে দাঁড়িয়েছে ভ্রূক্ষেপই করে না সে।

রাম সিং গম্ভীর স্বরে বলে,—এখানে কি করছিলে?

শংকরী আড়চোখে দেখে অন্ধকারের ভেতরে রামের চোখ দুটো যেন ধকধক করে জ্বলছে। তার হাতের বন্দুক শক্ত মুঠোয় ধরা।

—ওমা, এ যে রাম সিং-এর গলা। আমার সাতগুষ্টির ভাইপো। পিসিমা! আহা, কী মিঠে ডাক তোমার সাকরেদদের ঝাঁটা মারো।

রাম সিং বন্দুকের নল দিয়ে শংকরীর পিঠ খুঁচিয়ে আবার বলে,–কি করছিলে এখানে?

—কী? এতবড় আস্পর্ধা? আমায় মারলে তুমি? বেশ, কালই বিচার হবে। কাল দলের সবার সামনে দাঁড় করাব। বলব, কিকার ঘোড়া হাঁটিয়ে আনতে হয়েছে বলে, তার ঝাল আমার ওপর ঝেড়েছে। ঠিক বলব। আমাকে তুমি চেনো না।

শংকরী কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর গজগজ করতে করতে চলতে শুরু করে।

—দাঁড়াও। রাম সিং-এর কণ্ঠস্বর বরফের মতো শীতল।

—তার মানে? ভয় দেখাচ্ছো? আমি ভয় পাবার মেয়ে ভেবেছো?

রাম সিং এবারে শান্ত হয়ে শংকরীর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে, —যতটা বোকা তুমি ভাবো আমায়, অতটা বোকা আমি নই।

চিৎকার ক’রে ওঠে শংকরী,—সে আমি প্রথম যেদিন দেখেছি, সেদিনই বুঝেছি। তাই বলে আমাকেও অত বোকা পাওনি। ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতে পারবে না। কালই সব বলে দেব। বলে দেব, বন্দুকের খোঁচা মেরেছ আমার পিঠে। রাতটা কাটতে দাও না। তার পর দেখো।

ফিসফিস ক’রে রাম সিং বলে,—রাত আর কাটবে না। দেখ শংকরী, আমার চোখে ধুলো দেওয়া কঠিন। তুমি একটা ভুল করেছ, বড় বেশি এগিয়ে এসেছিলে। আর একটু দূরে—অন্তত হাত দুয়েক দূরে থাকলে হয়তো সন্দেহ করতাম না। তোমার দ্বিতীয় ভুল হল, পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তুমি আর্তনাদ করনি বা বিড়বিড় করনি। আমরা যখন তোমার একেবারে কাছে এসে পড়লাম তখনই শুধু তুমি ওই সব শুরু করলে। তুমি আমাদের আলোচনা শুনছিলে।

—তোমাদের আলোচনা? তোমরা আবার আলোচনা কর নাকি? তোমরা তো মারধর কর, আর লোকের সর্বনাশ করে বেড়াও।

—বাজে কথা থাক।

—তবে কাজের কথাই বল শুনি।

—কাজের কথা নয়-কাজের একটি শব্দ শুনবে মাত্র। তোমাকে মরতে হবে। তুমি না মরলে, আমার একটু অসুবিধা আছে, বুঝতেই পারছ। তুমি বুদ্ধিমতী, অতিরিক্ত বুদ্ধিমতী! সুতরাং প্রস্তুত

শংকরী মনে মনে একলিঙ্গকে প্রণাম জানায়। তার মুখে কোনোরকম দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে না। সে মনে মনে যশোবন্তের মুখখানি স্মরণ করে। কিন্তু মুখে বলে,—ভাইপো দেখছি, সুন্দর রসিকতা শিখেছ?

—হ্যাঁ। এই যে—

রাম সিং-এর বন্দুক গর্জে ওঠে।

শংকরী নিমেষে একধারে সরে যাবার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর তার আগের চেয়ে অনেক ভারী হয়েছে। গুলিটি ঠিক হৃদপিণ্ডে না লেগে একটু পাশ দিয়ে বক্ষ ভেদ করে। মাটিতে পড়ে যায় রসিকা শংকরী।

সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে দূরে সব কয়টি কুটিরেই কলরব শুরু হয়ে যায়। মশাল জ্বলে ওঠে। গুলির শব্দ লক্ষ্য করে ওরা ছুটে আসতে থাকে। শংকরী যন্ত্রণার মধ্যেও ভাবে, রাম সিং প্রকৃতই যদি চালাক হয়, তবে এই সুযোগ ছাড়বে না। সবাই যখন এদিকপানে আসবে, তখন সে নিঃশব্দে লীলাবতীর ঘরে গিয়ে তাকে অপহরণের চেষ্টা করবে।

শংকরীর চোখে জল আসে। হে ভগবান, সর্দার গোপাল সিং-এর ওই মিষ্টি মেয়েটিকে রক্ষা কর। যশোবন্তের সম্মান রাখো। তারই হাতে মেয়ের ভার দিয়ে গেছে গোপাল সিং।

অনেকেই ছুটে আসে, প্রায় সবাই আসে। যশোবন্ত এসে শংকরীকে পড়ে থাকতে দেখে অস্ফুট আর্তনাদ ক’রে ওঠে। তারপর তাড়াতাড়ি তার পাশে মাটিতে বসে পড়ে ডাকে,—শংকরী, শংকরী।

—লীলাবতী কই?

—আছে।

—কোথায়?

লীলাবতী সামনে আসে। যশোবন্ত এতক্ষণ তারই ঘরে শংকরীর জন্যে অপেক্ষা করছিল, তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছে। নইলে হয়তো ঘরেই পড়ে থাকত।

শংকরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—যাক।

যশোবন্ত বলে,—কী হয়েছে তোমার শংকরী? কে এই কাজ করল?

—রাম সিং।

ধীরে ধীরে শংকরী অতিকষ্টে সব কথা সংক্ষেপে বলে যায়। শেষে যশোবন্তের দিকে চেয়ে বলে,—আমি চললাম বুড়ো।

—না! যশোবন্তের চোখে জল এসে যায়। সে হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল চেপে ধরে। শংকরী অস্ফুটস্বরে বলে, –বুড়োর ভীমরতি হয়েছে? এই বয়সে চোখে জল?

—শংকরী।

—এদের সরে যেতে বল, কথা আছে।

সবাই সরে দাঁড়ায়। তারা ভাবে আরও গোপনীয় কোনো খবর বলবে শংকরী দলের সর্দারকে। শংকরী বলে,– আমায় চিনতে পার?

যশোবন্ত ভাবে, মৃত্যু ঘনিয়ে আসার পূর্ব মুহূর্তে ভুল বকতে শুরু করেছে শংকরী। তার বুকের ভেতরে হুহু করে ওঠে। শুধু কথা বলবার লোকের অভাব নয়, আরও যেন কিসের অভাববোধ তাকে চঞ্চল ক’রে তোলে।

—তুমি শংকরী।

—সুন্দরীকে চেনো?

—সুন্দরী? সুন্দরী?

—হ্যাঁ! শংকরীর মুখ দিয়ে সামান্য একটু রক্ত বের হয়।

—অনেকদিন আগের এক সুন্দরীকে জানতাম। তার আর একটি নাম ছিল মীরা। এই পৃথিবীতে সে আজ হয়তো নেই। তবে আমার বুকের মধ্যে সে আজও রয়েছে। তাকে চিনতে তুমি শংকরী? সে এই পৃথিবীতেই ছিল এতদিন। দেবী সিং-এর সেই মেয়েই—সুন্দরী। কিন্তু আজ থেকে সে পৃথিবীতে থাকবে না গো।

—তুমি—তুমি?

—হ্যাঁ! আমি।

স্তব্ধ হয়ে যশোবন্ত মুহূর্তের জন্য কেমন যেন হয়ে যায়। কিন্তু তাড়াতাড়ি সামলে নেয়। সুন্দরী আর বেশিক্ষণ নেই। সে সুন্দরীর কপালে হাত রেখে বলে,—এত দেরিতে বললে মীরা?

—বলতে কি আর কম সাধ হয়েছিল। তবু বলতে পারিনি। আমাদের যে আর বয়স নেই গো। কিন্তু বুকের ভেতরে সেই কবেকার বদ্ধ জোয়ার এখনো বের হয়ে আসবার জন্যে ছটফট করে, তাই বলতে পারিনি। বললে আমরা জ্ঞান হারাতাম। আমরা আর কাউকে কাছে আসতে দিতাম না। দল থেকে তুমি নিজেকে সরিয়ে নিতে, তাই বলিনি। এ বয়েস অমন দেখলে ওরা তো ক্ষমা করত না।

যশোবন্ত ধীরে ধীরে সুন্দরীর হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে ডাকে, —মীরা।

শংকরী যেন স্বপ্নের ঘোরে বলে চলে,—তুমি আমার হৃদয়ের একমাত্র পুরুষ। তুমি আমার নিদ্রা, আমার জাগরণের একমাত্র বীর, তুমি আমার নায়ক। যার সঙ্গে বাবা বিয়ে দিলেন, তাকে সেই রাতেই সব কথা বলায় সে চলে গেল, বোধ হয় আত্মহত্যা করল। হয়তো এতে আমার পাপ হয়েছে। কিন্তু আমি নিষ্কলুষ, তোমারই মতো নিষ্কলুষ। আমি শুধু তোমারই ছিলাম বীর। সেই মেলায়—বীর দেখেছিলাম। বীর যশোবন্ত সিং–আমার জন্যে সে নিজেও—লীলাবতী বেঁচে গেল—ঘোড়ার নীচে থেঁতলে গেল তাই সূর্য দেখে নাচছিস—নাচে নাচে–তাই তাই তাই—

—মীরা, মীরা?

শংকরী শুধু একবার চোখ খুলতে চাইল। মুখে একটু হাসির রেখা ফুটে উঠল যেন।

—সুন্দরী, মীরা।

শংকরী এবারে নীরব।

যশোবন্ত একদৃষ্টে চেয়ে রইল সেই শান্ত মুখখানির দিকে। বহুক্ষণ। সবাই শংকরীকে নীরব হয়ে যেতে দেখে কাছে এসে ঘিরে দাঁড়াল। কিন্তু কেউ একটি কথাও কইল না।

অবশেষে লীলাবতী ঝুঁকে পড়ে। যশোবন্তের পিঠে হাত রেখে বলে,—শংকরীকে আশীর্বাদ কর সর্দার।

যশোবন্ত তার হাতখানি অনেক চেষ্টায় শংকরীর মাথার ওপর রেখে মনে মনে ভাবে—তোমাকে আমি কী আশীর্বাদ করব? তুমি কত বড়। আমার মতো নগণ্য একটি লোকের আশীর্বাদে তোমার কী হবে। তুমি যে আমার পূজ্য। তবু আশীর্বাদ করছি,–এর পরের প্রতিটি জন্মে যেন তোমার সুখের মধ্যে কষ্টের কণামাত্র ছোঁয়াও না থাকে। তবু আশীর্বাদ করছি—তাতে হয়তো তুমি শান্তি পাবে, তৃপ্তি পাবে। কারণ তুমি এই হতভাগাকে ভালোবেসেছিলে।

গভীর অন্ধকারের মধ্যে শুধু কয়েকটি মশাল জ্বলে। সেই মশালের আলো অন্ধকারকে বেশিদূরে ভেদ করতে পারে না। যদি পারত, তবে তারা দেখতে পেত কয়েকশত হাত দূর দিয়ে তিনটি প্রাণী চোরের মতো লুকিয়ে চলে যাচ্ছে। লীলাবতীর ঘরে গিয়ে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তবু দ্বিতীয়বার চেষ্টা করার উপায় নেই। কারণ এই সংবাদ কিকার কাছে পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গে দিগ্বিদিকে ঘোড়া ছুটবে ওদের তল্লাশ করতে। যেখানেই গিয়ে আত্মগোপন করুক না কেন ওরা, ঠিক খুঁজে বের করে টেনে নিয়ে আসবে। তাই ওরা পালাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *