আরাবল্লী – ৭

৭.

রানাকে দর্শন ক’রে হতাশ হয় ওরা। না দেখা করলেই ভালো হত। চিতোর ছেড়ে এসে আরও যেন কেমন হয়ে পড়েছেন তিনি। ঠিক যেন সাধারণ সংসারী একটি মানুষ। দেশের জন্যে যার চিন্তা নেই, দশের কথা যার মনে স্থান পায় না। শুধু নিজের কথাই ভাবেন তিনি—নিজের সুখের কথা। বৃহত্তর কিছু চিন্তা করা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা এই মানুষটির পক্ষে অসম্ভব। সেই ধাতুতে গড়া নন উদয় সিংহ। কিকা যদি তাঁর পুত্র না হতেন তাহলে এই দর্শন লাভের পর একটি মারাত্মক রকমের সন্দেহ করে বসত যশোবন্ত। ধাত্রীপান্না দেবী। তিনি তাঁর কর্তব্য ঠিকই করেছিলেন। কিন্তু যশোবন্ত সন্দেহ করতে পারত যে কোনো স্বার্থান্ধলোক নিজের পুত্রের সঙ্গে প্রকৃত উদয় সিংহের পরিবর্তন করেছিল হয়তো প্রাসাদের বাইরে। তেমন কোনো অঘটন ঘটেছিল বলে নিশ্চয়ই মনে করতে পারত যশোবন্ত, যদি না কিকা জন্মগ্রহণ করতেন মেবারের রানার ঔরসে।

বিমর্ষ যশোবন্ত দলবল নিয়ে প্রাসাদের বাইরে পা বাড়াতেই, কিকা দ্রুতপদে এগিয়ে আসেন। তারপর বলেন,—আমার একটি অনুরোধ আছে সর্দার।

—ছি ছি। ওভাবে কথা বলে আমায় লজ্জা দেবেন না। আপনি আদেশ করুন।

—জিৎ সিংকে কিছুক্ষণের জন্যে রাখতে চাই, সে পরে যাবে।

—বেশ তো। খুব আনন্দের কথা।

প্রৌঢ় রাজপুতটি জিৎ সিং-এর দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে চোখ টেপে। ইশারায় বলতে চায় সে, দেখলে তো? আমার কথা ঠিক কি না? প্রাসাদেই তোমার পাকাপাকি ব্যবস্থা হয়ে গেল।

যশোবন্তের দল চলে যায়।

কিকা শান্ত কণ্ঠে বলেন,—চল জিৎ।

জিৎ সিং তাঁকে অনুসরণ করে। চিতোরের মতো বিশাল না হলেও এই নতুন প্রাসাদে—কক্ষের অভাব নেই। অনেক কক্ষ পার হয়ে এক জায়গায় এসে থামলেন কিকা। জিৎ সিং চারদিকে চেয়ে বুঝতে পারে সে প্রাসাদের পশ্চাদ্ভাগে উন্মুক্ত স্থানে এসে পৌঁছেছে। সেই স্থানটির একদিকে একটি ঘর। সেটির সামনে এসে কিকা বলেন,–এটি আমার নিজস্ব অস্ত্রাগার। সারা রাজোয়ারায় আয়ুধ-পুজো বছরে একবার মাত্র অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু আমার অস্ত্রাগারে আয়ুধ পূজা নিত্য অনুষ্ঠিত হয়। সেই পূজায় আমিই পুরোহিত। দেখবে এসো।

জিৎ সিং চাপা কৌতূহল দিয়ে প্রবেশ করে। চারদিকে দৃষ্টিপাত করে সে বিহ্বল হয়। এই ক্ষুদ্রস্থানে এত অস্ত্র থাকতে পারে সে কল্পনা করতে পারেনি।

—সব আপনার?

—হ্যাঁ। সব আমার। রানার নয়, কারও নয়। কিন্তু এ কিছুই নয়। এমন আরও শত শত অস্ত্রাগার নির্মাণ করতে হবে। আর সেই অস্ত্রাগারের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ ক’রে যেদিন বিজয়ী হয়ে চিতোরের মাটিতে পা দেব সেদিনই হবে সব কিছুর সার্থকতা। আর আমার আয়ুধ -পুজোর সার্থকতা কবে হবে জান? যেদিন বাপ্পার হাতের তলোয়ার আগ্রা থেকে ছিনিয়ে আনব, চিতোরের সেই প্রকাণ্ড নাকাড়া যেদিন এনে তার নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করব, যেদিন আবার সূর্যতোরণ আর লাখোটা-তোরণের পাল্লাগুলো নিয়ে এসে তাদের নিজের নিজের কব্জার সঙ্গে যুক্ত ক’রে দিতে পারব—সেদিনই হবে আমার আয়ুধ পুজোর সার্থকতা। তার আগে নয়। তাই আমার অস্ত্র-পূজা বছরে শুধু একবার নয়—আমার অস্ত্র পূজা প্রতিদিনের।

জিৎ সিং স্তব্ধ হয়ে শোনে। সে দেখতে পায় তাদের পরিচিত কিকার মুখমণ্ডল থেকে যেন এক অদ্ভুত জ্যোতি নির্গত হচ্ছে। একি চোখের ভুল? বোধহয় না। এই জ্যোতিকেই কি বলে স্বর্গীয় জ্যোতি? জানে না সে। তবে এটুকু বুঝতে পারে, সাধারণ মানুষের চোখ মুখ থেকে এমন উজ্জ্বলতা বিচ্ছুরিত হতে পারে না। ইনি সাধারণ নন—অসাধারণ।

—তোমাকে এত কথা বলার প্রয়োজন ছিল না জিৎ। এত কথা আমি বলি না। কিন্তু তুমি বীর অজিত সিং-এর যোগ্য পুত্র। বয়স তোমার কম, অথচ দক্ষতা তোমার অপরিসীম। সেদিন থেকে আমি শুধু তোমার কথা ভেবেছি। সেদিন যেন আমি ইন্দ্রজাল দেখলাম। তুমি না এলে আমি যেতাম তোমার কাছে।

উদয় সিংহকে আজ স্বচক্ষে দেখেছে জিৎ সিং। উনিই মেবারের রানা। চেহারা বা কথাবার্তায় কোনো উৎসাহ নেই, কোনো উদ্দীপনা নেই। একেবারে ঠাণ্ডা—মৃত। দেখে ঘৃণা হয়েছে তার। সে বলে,—আমি শুধু আপনারই অনুগত। যেদিন প্রথম দেখেছি আপনাকে সেদিন থেকে। মেবারের রানাকে আমি চিনি না কিকা।

—ওকথা বলো না। শোন জিৎ সিং, মেবারের রানা আমাদের সবার ওপরে। তুমি কোন্ কথা ভেবে নিরাশ হচ্ছ আমি জানি। নিরাশ হয়ো না। আমি নিজে যুদ্ধ চালাবো।

—রানার অনুমতি ছাড়া সে কি সম্ভব হবে?

—হ্যাঁ। হয়তো তাড়াতাড়ি কিছু করতে পারব না। হয়তো অনেক সময় লাগবে। তবে উদ্দেশ্য আমার ব্যর্থ হবে না, এ দৃঢ় বিশ্বাস আমার আছে। তারই আয়োজন শুরু করব এখন থেকে। তুমি আমার দলের প্রথম সদস্য।

—আমায় কি করতে হবে?

—এখানে থাকবে তুমি। লোক সংগ্রহ করতে হবে। তাদের যুদ্ধে পারদর্শী ক’রে তুলতে হবে।

—যতদিন আমি নতুন রাজধানীতে রয়েছি, ততদিন আপনার আদেশ পালন করব।

—সেদিনও তুমি বলেছিলে চলে যাবে, আজও সেকথা বলছ। কোথায় যাবে তুমি?

—জানি না। তবে এটুকু আমি বুঝতে পেরেছি যে শুধু অস্ত্রের সাহায্যে আগ্রার বাদশাহকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। আরও কিছুর প্রয়োজন। বুদ্ধি। এ বুদ্ধি যুদ্ধকালীন বুদ্ধি নয়, অন্য কিছু। অন্তত আমার বাবার শেষ সময়ের কথায় সেই রকমই মনে হয়েছিল। তিনি মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিভাবে সেই বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে আমি জানি না। আমার কোনো ধারণা নেই।

—তুমি ধোঁয়াটে কল্পনা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ।

—আপনি ঠিকই বলেছেন, এখন সব ধোঁয়া। এখনো পথ দেখতে পাচ্ছি না। তবে পথ আমি একদিন না একদিন দেখতে পাবোই। চিতোরের দৃশ্য দেখে আমার এটুকু জ্ঞান হয়েছে, যত সৈন্যই আমরা সংগ্রহ করি না কেন, বাদশাহের সৈন্যের তুলনায় তা কিছুই নয়-যত অস্ত্রই আমরা নির্মাণ করি না কেন বাদশাহের অস্ত্রের তুলনায় তা নগণ্য।

কিকা গম্ভীর হন। তিনি তাঁর প্রিয় অস্ত্রগুলির দিকে চেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই তরুণের কথার মধ্যে নির্মম সত্য রয়েছে। সে বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে চায়। মৃত্যুর আগে অজিত সিং নিজের মুখে একথা বলেছে। তার মতো যোদ্ধাও যুদ্ধকে মুক্তির একমাত্র পথ হিসাবে ভাবতে দ্বিধাবোধ করেছিল শেষ সময়ে

দেয়াল থেকে একটি বন্দুক তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করেন কিকা। সেটিকে রেখে দেন। একটি তলোয়ার তুলে নেন তিনি, তীক্ষ্ণতা পরীক্ষা ক’রে সেটিও ঝুলিয়ে রাখেন।

শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,–বেশ। তুমি তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী চল। সেই স্বাধীনতা নিশ্চয় রয়েছে তোমার। তবে অস্ত্রে এতখানি পারদর্শী হয়েও এপথে না এলে ভুল করবে বোধ হয়।

—যদি বুঝতে পারি ভুল করেছি, তবে ফিরে আসব।

—কিন্তু কোথায় যাবে তুমি? কি করবে?

—এখনো জানি না।

—যতদিন রয়েছ এখানে ততদিন প্রাসাদে থাকো। আমার কাছে। এটুকু তো পারবে?

জিৎ সিং কিকার সামনে নতজানু হয়। অতি কষ্টে বলে,—যারা আমায় রক্ষা করেছে-যাদের সঙ্গে আমি চিতোর ছেড়ে এসেছি, তাদের কাছেই আমায় থাকতে অনুমতি দিন। আমি প্রতিদিন নিয়মিতভাবে এখানে আসব।

কিকা জিৎ সিং-এর হাত ধরে বলেন,—ওঠো। আমি জোর করছি না। কারও ওপর আমি জোর করি না কখনো। তাতে কোনো কাজ হয় না। তবে দুঃখ পাচ্ছি মনে এই ভেবে যে আমার দলের প্রথম সদস্যকেও পুরোপুরি হাতের মধ্যে পেলাম না।

—কিন্তু তার হৃদয়টি বহুদিন আগে থেকেই আপনার মুঠোর মধ্যে

কিকা হেসে বলেন,—দেখা যাক। সেটা প্রমাণসাপেক্ষ।

কতখানি দুঃখ পেয়ে একথা বললেন তিনি, অনুভব ক’রে বিচলিত হয় জিৎ সিং। কিন্তু উপায় নেই। সে যশোবন্তকে ছাড়তে পারে না। সে লীলাবতীকে ছেড়ে আসতে পারে না। দলটিকে ত্যাগ করা তার পক্ষে এখন অসম্ভব।

সমস্ত গিরো উপত্যকার প্রকৃতিতে অনেকই পবিরর্তন সূচিত হয়েছে। চিতোরে দু-একটি কোকিল ডাকত মাঝে মাঝে। এখন সব সময়ই ডাকে। গাছে গাছে ফুলের সমারোহ। সেই ফুলের মেলায় বিচিত্র সব পাখির কুজন।

বসন্ত ভালোভাবেই এসেছে। প্রতিবারই আসে। এবারেও এসেছে। কিন্তু এবারে যেন না এলেই ভালো হত। এবারে বসন্তের আগমন প্রতিবারের মতো কারও মনে তেমন রঙ ধরাতে পারছে না। কারণ এবারে চিতোর নেই।

চিতোর নেই—একথা ভাবতে পারা যায় না। চিতোরহীন মেবার—অলঙ্কারহীনা রূপসী। তাই বনে বনে সুমিষ্ট গন্ধের আভাস পেয়ে মন নেচে উঠে পরক্ষণেই আবার দমে যায়। না না—এখানে নেচে ওঠা ঠিক নয়। মৃতের স্তূপের ওপর বসন্তোৎসব হতে পারে না। জানাশোনা, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এবার। তাদের রক্তে চিতোরের মাটি কর্দমাক্ত। অতীতের সব বসন্তের উৎসবই যে তাদের স্মৃতিতে জড়ানো। যত আনন্দ, যত মত্ততা—সবটাতেই যে তারা অংশ গ্রহণ ক’রে এসেছিল এতদিন। এবারে কাদের নিয়ে উৎসব হবে?

তবু মন মানে না। মানুষের যুক্তি-তর্ক তাকে সংযত রাখলেও, অজ্ঞাতে ভেতরটা ঠিকই রাঙিয়ে ওঠে। নইলে পৃথিবী থাকে না, সৃষ্টি থাকে না।

যশোবন্তের দল নতুন ক’রে সংসার পেতেছে। সেখানেও বসন্তের স্পর্শ। ঠাণ্ডা বাতাসের গতি মাঝে মাঝে ঘুরে গিয়ে দক্ষিণ থেকে আসে ঈষদুষ্ণ হাওয়া। সে হাওয়া দেহকে চঞ্চল ক’রে তোলে, সে হাওয়ার পরশে যুবতীর মুখ অকারণে মাঝে মাঝে রাঙা হয়ে ওঠে। সে হাওয়ার পরশ পেয়ে কর্মরত যুবকরা আনমনা হয়ে পড়ে থেকে থেকে।

লীলাবতীর ঘর উঠেছে যশোবন্তের ঘরের গা-ঘেঁষে। সেই ঘরে শংকরীরও থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতের বেলা একটি মেয়ে একা এক ঘরে থাকতে পারে না। শংকরীর ওপর ভার পড়েছে লীলাকে দেখাশোনা করবার।

শংকরী প্রায়ই প্রশ্ন করে,–তোমার হল কি লীলা? অমন ছটফট কর কেন সব সময়? রাতেও তো ভালো ঘুমোও না। শুধু এপাশ-ওপাশ কর দেখি।

—কি জানি। কিছু ভালো লাগে না।

—আহা বাছা। বাবাকে মনে পড়ে বুঝি?

মনে নিশ্চয়ই পড়ে লীলাবতীর। কিন্তু সেজন্যে তার চঞ্চলতা নয়। একথা আর কেউ না জানুক সে নিজে ভালোভাবেই জানে। অথচ এর আসল কারণ কি তাও বুঝে উঠতে পারে না। এত বছর কেটে গেল, কিন্তু দেহ-মনে এমন একটা সূক্ষ্ম শূন্যতা সে কখনো অনুভব করেনি। তাই তার চঞ্চলতা।

শংকরীর কথার জবাবে তাই সে জোর করে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারে না—আবার ‘না’ও বলতে পারে না। তবু একথা সে জানে, বাবা থাকলে আজকের এই চঞ্চলতা মাঝে মাঝে এমন পাগল ক’রে তুলত না কখনই।

শংকরী কাজে বের হয়ে গেলে লীলাবতীও ঘরের বাইরে চলে আসে। বাইরে বসে নানান কথা ভাবে। শেষে ভাবতে ভাবতে একজনের ওপর তার সব রাগ নিয়ে আছড়ে পড়ে।

জিৎ সিং। হ্যাঁ, জিৎ সিং যদি মাঝে মাঝে তার কাছে আসত, তবে এতটা নিঃসঙ্গ বোধ করত না কিছুতেই। কথা বলে সময় কাটত। দলের আর কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। শংকরী মুখে ‘বাছা’ বলে, অথচ কেমন চতুর দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। সে দৃষ্টির মধ্যে সহানুভূতির চেয়ে কৌতূহলই বেশি ফুটে ওঠে।

রাখী এখন নাগালের বাইরে। রাখী যেন কেমন হয়ে গেছে অল্প কয়দিনের মধ্যেই। দিনের বেলায় উস্কো-খুস্কো চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কারও সঙ্গেই কথা বলতে চায় না। তবু এক-আধ সময় যদি লীলাবতীর সামনে পড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে,—আমি মরেছি। আমার সঙ্গে কথা বলিস না।

—কেনরে রাখী?

—বুঝবি। বোঝবার দিন এগিয়ে আসছে। আসছে। আসছে। অদ্ভুতভাবে হেসে ওঠে রাখী। অনেকে কানাকানি করে সে নাকি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তার ওই হাসি নাকি পাগলামির লক্ষণ। কিন্তু কেন সে অকারণে পাগল হবে? তেমন তো কিছু ঘটেনি তার? চিতোরে সে কাউকে ফেলে আসেনি। তার কেউ নেই-ই বলতে গেলে। দূর সম্পর্কের যে মামার কাছে থাকত, সে-মামা এখানে উপস্থিত। তবে কেন সে পাগল হতে যাবে?

৯৬ ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

এ বোধহয় রাখীর অভিনয়। লীলার সঙ্গে যাতে বেশি কথা বলতে না হয় তার জন্যে অভিনয়। কারণ সে জেনে-শুনে লীলার কোনো ক্ষতি করতে গিয়েছিল। এখন অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছে বেচারা।

লীলা মনে মনে স্থির করে, এবারে সে কাছে এলে তাকে বুঝিয়ে বলবে! বলবে, যত অন্যায়ই মানুষ করুক না কেন অনুতাপে সব দগ্ধ হয়, শুদ্ধ হয়।

বহু দূরে কোথাও কোকিল ডাকছিল। প্রাণখুলে ডাকতে যেন তার বাধো বাধো লাগে। সে কি বুঝতে পেরেছে মেবারবাসীর অন্তরের ব্যথা?

লীলা চেয়ে থাকে একটি ঘরের দিকে। সে-ঘরের কপাট বন্ধ। সব সময়ই ওই কপাট বন্ধ থাকে। দেখে বোঝবার উপায় নেই ভেতরে কেউ আছে কি না!

ও ঘর জিৎ সিং-এর।

প্রায় দশ বারো দিন হতে চলল, জিৎ সিং ভোরবেলা উঠে বের হয়ে যায়। আর ফেরে একেবারে সন্ধ্যা ঘোর হয়ে এলে। সে প্রাসাদে যায় রোজ। কিকা তাকে নাকি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ দিয়েছেন। সবাই বলাবলি করে সেকথা। সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে চায় তার দিকে। সে এখন দলের সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যশোবন্তের চেয়েও। যশোবন্তকে কিকা যথেষ্ট সম্মান করেন। যশোবন্ত দলের সর্দার। কিন্তু কিকা তাকে কোনো কাজের ভার দেননি। হয়তো তার

বয়সের কথা ভেবে।

দলের ভবিষ্যৎ সর্দার সহজেই স্থির হয়ে যেতে পারত। কালপীর লোক না হলেও অনেকে তাকে অনুরোধ করেছিল। সে কিছুতেই রাজি হয়নি। সে সর্দার হতে চায় না। অদ্ভুত মানুষ। সে নাকি কোথায় চলে যাবে। কোথায় যাবে, তা নিজেও জানে না।

লীলাবতীও তাকে বার বার প্রশ্ন করেছে এ সম্বন্ধে। কিন্তু জবাব পায়নি। জবাব না পেয়ে কাতর হয়েছে। সেই কাতরতা দেখে জিৎ সিং ব্যস্ত হয়ে বলেছে,—আমি সত্যিই জানি না লীলাবতী। তোমায় আমি কিছু গোপন করছি না। তোমায় আমি কিছু গোপন করব না। কোনোদিনও না।

আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিল লীলাবতী জিৎ সিং-এর বন্ধ কপাটের দিকে চেয়ে। হঠাৎ সে দেখতে পায় কপাট খুলে যায়। ভেতরে থেকে বের হয়ে আসে জিৎ সিং।

লীলার বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ ক’রে ওঠে। কেন এমন হল? কেন হৃৎপিণ্ড বুকের ভেতরে এভাবে অস্থির হয়ে উঠল? একটি মানুষকে দেখে কোনোরকম ভয় না পেয়েও এভাবে বুক কেঁপে ওঠে কেন?

জিৎ সিং দেখতে পায় লীলাকে। হাসে। হাত উঁচিয়ে অপেক্ষা করতে বলে। তারপর ঘরের কপাট বাইরে থেকে বন্ধ ক’রে এগিয়ে আসে।

—এখানে দাঁড়িয়ে একা একা কি করছ লীলাবতী?

—দেখছি।

—কি দেখছ?

—গাছপালা, পথঘাট, ফুল, ঘাস আর উদয়সাগরের জল।

জিৎ সিং চোখ বড় বড় ক’রে বলে,–সে কি?

—কেন?

—তোমার তো এ রোগ ছিল না। তুমি ঘোড়া ছোটাও, ছোরা খেলো। তুমি এসব করবে

কেন?

—ঘোড়া নেই। আর ছোরা? খেলব কার সঙ্গে? আমার যোগ্য কোনো মেয়ে নেই। তাই

এসব করতে হয়। দেখতে হয়।

আরাবল্লী থেকে আগ্ৰা ě ৯৭

—ছোরা আমার সঙ্গে খেলতে পার। আমি ছোরা খেলাও জানি। লীলাবতী গম্ভীর হয়ে বলে,—কখন খেলব?

—এখন?

—সে তো শুধু আজকের কথা বলছ।

—ও, এবারে বুঝতে পেরেছি। তুমি আমার ওপর রাগ করেছ।

লীলাবতী হেসে ওঠে,—রাগ করব? কেন? তোমার ওপর রাগ করব কেন?

—আমি তোমার কাছে আসতে পারি না বলে।

—তুমি না এলে রাগ করব কেন? এক হাজার লোকের মধ্যে তুমি মাত্র একজন। তাও বাড়তি। আমাদের দলের কেউ নও তুমি।

—লীলাবতী?

—বল।

—কি হয়েছে তোমার?

—কিছু না তো।

—এভাবে কথা বলছ কেন?

—হয়তো চিতোরের কথা মনে পড়ছে।

—চল, ওই শিমুল গাছের গোড়ায় যাই।

—ওখানে কেন?

—এমনি। কথা বলব।

—তুমি আজ প্রাসাদে যাবে না?

—না।

—কিকা রাগ করবেন না?

—তিনি ছুটি দিয়েছেন আজকের মতো।

—ও। শুধু আজকের মতো?

—চল।

—না।

—লীলাবতী, তুমি রাগ করেছ।

—না।

—তোমার কথা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।

—কষ্ট? কেন জিৎ?

—তুমি দুঃখ দিচ্ছ বলে।

—চল জিৎ। শিমুল গাছের নীচে যাই।

স্থানটি নির্জন। আশেপাশে অনেক আগাছা। দুজনা সেখানে গিয়ে বসে।

—এবার বল লীলাবতী।

—কি বলব?

—তুমি ওভাবে কথা বলে আমায় দুঃখ দিচ্ছিলে কেন?

—তুমি বুঝি আমায় কিছুই দিচ্ছ না? তুমি বুঝি আমায় শুধু আনন্দ দিচ্ছ?

লীলার চোখ ছলছল করে ওঠে।

জিৎ সিং অবাক হয়ে বলে,—আমি তোমায় কষ্ট দিচ্ছি লীলা?

—হ্যাঁ। একদিনও দেখা কর না। ভোর না হতে চলে যাও। তারপর কখন ফের আমি জানতেও

ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত : ৭

৯৮ ণ্ড ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

পারি না। কার সঙ্গে কথা বলব? কারও সঙ্গে কথা বলে সুখ পাই না। একা একা আমার দিন কাটে।

—আমার দিনও একাই কাটে।

—না। আমি শুনেছি, ওখানে তুমি খুব ব্যস্ত থাকো। তুমি নাকি অস্ত্র শিক্ষা দাও। কিকা থাকেন তোমার সঙ্গে। তুমি কেন একা থাকবে?

—আমি তোমায় মিছে কথা বলছি না লীলা। সবার মধ্যে থেকেও নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ বলে বোধ করি।

সামনের ছোট-বড় ঝোপের মধ্যে পাখিদের কলরব। বাতাসে ফুলের গন্ধ। দুরের কোকিল তখনো ডেকে চলেছে একটানা।

দুজনে ক্ষণেকের তরে যেন কথা ভুলে যায়।

তারপর একসময়ে পূর্বের কথোপকথনের জের টেনে লীলা আস্তে আস্তে বলে,—সত্যিই নিঃসঙ্গ বলে বোধহয় তোমার জিৎ? অত ব্যস্ততার মধ্যেও?

—হ্যাঁ লীলাবতী।

কেন জিৎ?

—জানি না। সেই সময়ে শুধু তোমার কথা মনে হয়। ইচ্ছে হয়, ছুটে চলে আসি তোমার কাছে। তুমি কি কখনো জানতে পেরেছ লীলাবতী, সন্ধ্যার পর অন্ধকার হয়ে এলে যখন তুমি ঘরের কপাট বন্ধ করে শংকরীর সঙ্গে গল্প কর, সেই সময় কতদিন কতবার কপাটের গায়ে হাত রেখে একা দাঁড়িয়ে থেকেছি?

লীলাবতী বিস্মিত হয়ে বলে—জিৎ!

—হ্যাঁ, লীলাবতী। বহুবার প্রলোভন হয়েছে ধাক্কা দিতে। কিন্তু সামলে নিয়েছি। সর্দারের কড়া হুকুম সন্ধ্যার পর কোন স্ত্রীলোকের ঘরে যাওয়া চলবে না।

—তাই বলে তোমাকেও এ হুকুম মানতে হবে?

—হবে না?

—কি জানি? না মানলেই ভালো হত।

—লীলাবতী।

—জিৎ।

—না, কিছু না।

—তুমি মাঝে মাঝে কি যেন বলতে চাও জিৎ। শেষে চুপ করে যাও।

—তুমিও।

—হ্যাঁ আমিও। ঠিক ভেবে পাই না, কি যেন বলব। অনেক কথা যেন বলবার রয়েছে। তুমি যখন চলে যাও, মনে হয় কিছুই বলা হল না। সব বাকি থেকে গেল।

—আশ্চর্য!

—কেন জিৎ? আশ্চর্য কেন?

—আমার কথাগুলোই তুমি বললে।

—তোমারও এমন মনে হয় তাহলে?

—হ্যাঁ লীলাবতী।

—কেন এমন হয়?

—জানি না। শংকরীকে জিজ্ঞাসা ক’রে দেখলে হয়। সে বলতে পারে।

—না না। কখনো নয়। ও যেন আমার দিকে কেমন ক’রে তাকিয়ে থাকে আজকাল।

—তাতে কি হল?

—জিৎ। একটা কথা তোমায় বলি। তুমি পুরুষ। তোমার শক্তি আছে, সাহস আছে—অনেক কিছু আছে। কিন্তু যে জিনিসটি না বুঝেও আমি বুঝতে পারি, তুমি সেটি পার না। কোনো পুরুষই বোধহয় পারে না! আমি মেয়ে, তাই বুঝতে পারি।

—কোন্ জিনিস?

লীলা উঠে দাঁড়ায়। সামনে ঝুঁকে পড়ে দুহাত দিয়ে জিৎ সিং-এর মাথা চেপে ধরে তার কানের কাছে মুখ দিয়ে গিয়ে খুব কোমল এবং ধীরস্বরে কি যেন বলতে যায়।

ঠিক সেই মুহূর্তে একেবারে পাশের একটি ঝোপের আড়াল থেকে একজন হেসে ওঠে, —হি-হি-হি-হি।

লীলাবতী তড়িৎবেগে দূরে সরে যায়।

জিৎ সিং-এর হৃদয় অপূর্ব এক অনুভূতিতে কানায় কানায় ভরে ওঠবার উপক্রম হয়েছিল। হাসি শুনে সে যেন শক্ত মাটির ওপর আছড়ে পড়ে। তার দেহ ঋজু আর শক্ত হয়ে ওঠে। সে ডান হাতে তার অসি স্পর্শ করে।

স্ত্রীলোকের হাসি। স্ত্রীলোকটি লীলাবতীর সখি রাখী।

রাখী হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায়। তার হাসি আর থামতে চায় না। সমানে হেসে চলে। শেষে অতিকষ্টে সংযত হয়ে সে বলে,–কোন্ জিনিস, তাও জান না জিৎ সিং? ওকথা কখনো মেয়েমানুষকে জিজ্ঞাসা করতে হয়? চিরকাল যে পুরুষরাই ওকথা প্রথম শুনিয়েছে। মেয়েরা বুঝতে পারলেও বলতে পারবে না। জান না বুঝি, মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। জানবেই বা কি ক’রে? তুমি ছেলেমানুষ। রাম সিং কিন্তু জানে। রাম সিং খুব বেশি ক’রে জানে। বেশি ক’রে জানে বলেই সে অভিনয় করতে পারে। চমৎকার অভিনয় করতে পারে। সেই অভিনয়ে অনেকে ভুলে যায়। ভাবে সত্যি বুঝি। তুমি অভিনয় করতে শেখোনি জিৎ সিং। তবে আর কেমন পুরুষ হলে? ভয় নেই। শিখবে। শিগগিরই শিখবে। হুঁ ঠিক শিখবে।

লীলাবতী ভীত হয়ে ডাকে,—রাখী।

—থাম্ মুখপুড়ী। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, লজ্জা সরমের বালাই নেই একটু? কোন্ জিনিস তাই আবার বলতে যাচ্ছিলি পুরুষের কানে? ছি—ছি—থুঃ। কিন্তু তোরই বা দোষ কি? তোর দেহটাই মেয়ের। আর সবই তো পুরুষের মতো। তুই যুদ্ধ করা শিখেছিস। তুই ঘোড়ায় চাপতে জানিস তোকে সাঁতার দিতেও দেখেছি চিতোরে। কিন্তু তবু বলে রাখছি লীলা—এতটা ভালো নয়। এদের চিনিস না। চিনলে এখনি ছুটে পালিয়ে যেতিস। ওরা তোর ওই দেহটাকেই জানে শুধু, আর কিছু নয়। তোর মনের দিকে ফিরেও চাইবে না। উঁহু।

লীলাবতী এতদিনে স্পষ্ট বুঝতে পারে যে রাখী সত্যিই প্রকৃতিস্থ নয়। তার যত অবনতিই হোক, এমন ঢঙে সে কখনো কথা বলতে পারত না। কখনো বলেনি। ছেলেবেলার বান্ধবীর দশা দেখে তার কষ্ট হয়। ওর পিঠের ওপর হাত রেখে বলে,—চল রাখী। তোর ঘরে যাই।

—আমার ঘরে? না। খবর্দার, আমার ঘরে গেলে জন্মের মতো অশুচি হয়ে যাবি।

—তবে অন্য কোথাও চল।

—যাব। দাঁড়া। কথা শেষ করতে দে।

লীলা হতাশ হয়। রাখী হেসে ওঠে আবার। সে জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে বলে,–শোন জিৎ।

কোন্ জিনিসটির কথা আমার সই তোমার কানে কানে বলতে যাচ্ছিল, আমিই বলে দি। ও নির্লজ্জ হলেও মেয়ে তো। ভালোভাবে বলতে পারবে না।

লীলাবতী প্রতিবাদ করে ওঠে, না না।

১০০ ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

না না? হুঁঃ। কেন, আমি বললে অতটা মিষ্টি শোনাবে না? শোনাবে ভাই শোনাবে। খুব মিষ্টি শোনাবে। একজনের কাছে সেদিন অবধি শোনত।

—তোকে অনুরোধ করছি রাখী, তুই চুপ কর। তুই চলে যা এখান থেকে।

রাখী রুখে উঠে বলে,—না। শোন জিৎ সিং আমার সই-এর কথাটা খুব ছোট্ট, অথচ খুব মিষ্টি। কথাটা হল ‘ভালোবাসি’।

লীলাবতী মাথা নিচু করে।

জিৎ সিং স্তব্ধ।

—ওমা। দুজনাই দেখছি কেমন হয়ে গেলে। তবে আরও ভালোভাবে বলে দি। তোমরা দুজনা ভালোবাসো দুজনকে। তোকে সেদিন অত ক’রে বলেছিলাম লীলা, তাও বুঝলি না? কানে কানে বলতে পারতিস এই কথাটা? পারতিস না। কিছুতেই পারতিস না। আবোল-তাবোল বকে মরতিস খালি। জিৎ সিং-এর অমন সুন্দর মাথাটা আরও ঘুলিয়ে যেত মাঝখান থেকে। হ্যাঁ ভালোবাসা। ভালোবাসা যদি না হত, তাহলে তোরা একসঙ্গে যখন রওনা হয়ে এলি এখানে, আমায় দেখতে পেতিস। আমি তোদের সঙ্গেই ছিলাম রে। ঠিক পেছনে। তবু দেখতে পেলি না। কী ক’রে দেখবি? তোরা যে তখন অন্য জগতে। এখানে এসে যখন বসলি, আমিও পাশেই বসলাম। মাঝখানে শুধু ওই ঝোপ। তবু দেখলি না আমায়। জিৎ সিং শুনি খুব বড় যোদ্ধা। কবে শত্রুর হাতে মারা পড়বে এমন অন্ধ হয়ে চললে।

রাখী আবার একচোট হেসে ওঠে। তারপর দ্রুত চলে যায় কয়েক পা। পরক্ষণেই ফিরে আসে। তার মুখে রেখার আমূল পরিবর্তন হয়ে যায় এই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। তার হাসি সম্পূর্ণ মিলিয়ে যায় মুখ থেকে। চোখে মুখে ফুটে ওঠে অপরিসীম ক্রোধ আর ঘৃণা।

সে লীলার পাশে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,—না। আমি যাবো না। আমি তোকে মরতে দেবো না লীলা।

—কি বলছিস রাখী?

—বুঝতে পারছিস না এখনো? পারবি। যদি এভাবে আর কিছুদিন চলিস বুঝতে পারবি। আমি তা হতে দেবো না। আমার মতো তোকেও মরতে দেবো না। আমি মরেছি সই, আমি মরেছি। কথাটা কতবার শুনল লীলা রাখীর মুখ থেকে। আজ সোজা প্রশ্ন করে বসে,—ওকথা কেন বার বার বলিস রাখী। কোথায় মরেছিস? বেশ তো বেঁচে আছিস।

—বেঁচে আছি? হ্যাঁ, বাইরে থেকে দেখলে তাই মনে হয় বটে। কিন্তু আমি মরেছি। অনেকদিন আগে মরেছি। তোর সামনে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে রাখী বলে ভাবছিস? না। সে রাখী নয়। সে রাখীর প্রেত। তুই-ও মরবি লীলা। সময় আছে এখনো। আয় পালিয়ে আয়।

রাখী লীলার হাত ধরে টানতে শুরু করে।

—না।

—কী? যাবি না? ওই শক্ত চেহারা দেখে ভুলে গেলি? ওই সরু কোমর আর চওড়া বুক দেখে তুই-ও ভুললি? মরবি। পালিয়ে আয়।

এতক্ষণ জিৎ সিং একটি কথাও বলেনি। এক পাশে চুপ ক’রে দাঁড়িয়েছিল। সে রাখীর হাবভাব আর কথাবার্তা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। তার মাথার মধ্যে অজস্র চিন্তার তরঙ্গ উঠেছিল। তার মধ্যে একটি তরঙ্গ তাকে সাময়িকভাবে বিচলিত করেছিল। রাখী তাকে একটি বিষয়ে অন্তত আলো দেখিয়েছে। সে রাখীর কাছে কৃতজ্ঞ। তাই এত অস্বাভাবিক আচরণের পরেও সে লীলাবতীকে বলে,—তুমি ওর সঙ্গে যাও লীলা। ও তোমার বন্ধু, বন্ধুর কথা সব সময় শুনতে হয়। কারণ বন্ধু সব সময়েই মঙ্গল কামনা করে।

রাখী চমকে ওঠে। অবাক হয় জিৎ সিং-এর কথা শুনে। লীলার হাত ছেড়ে দিয়ে মুখের সামনে সজোরে দুহাত নাড়িয়ে বলে,—না না। আমি ওর মঙ্গল চাইনি। আমি ওর সর্বনাশ চেয়েছিলাম। না না। তুমি ভুল বলছ। তুই থাক লীলা। তুই থাক।

রাখী ছুটতে ছুটতে চলে যায়।

ওরা উভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাখীর চলে যাবার পথ চেয়ে! সে অদৃশ্য হলে দুজনার দৃষ্টি বিনিময়। কিন্তু শুধু মুহূর্তের জন্যে। কারণ লীলাবতীর মাথা আপনা হতে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

জিৎ সিং কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর দু-পা সামনে এগিয়ে লীলাবতীর খুবই কাছে এসে দাঁড়ায়। আলগাভাবে ডান হাত দিয়ে তার মাথাটা তুলে ধরে বলে, —সব ধোঁয়া কেটে গেছে লীলা।

লীলা অসহায়ভাবে একটু চেয়ে থেকেই আকুল হয়ে মুখ লুকোয়। মুখ লুকোয় জিৎ সিং-এর বুকের মধ্যে। লজ্জা রাখবার অন্য জায়গা সে আর খুঁজে পেল না।

অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে সে বলে,—রাখীকে ভালো ক’রে দাও।

—আমি?

—তুমি চেষ্টা করলে পারবে।

—এ ধারণা কেন হল লীলা?

—কি জানি। মনে হচ্ছে তুমি সব পার।

জিৎ সিং-এর সেই মুহূর্তে মনে হয়, লীলাবতীর বিশ্বাস অটুট রাখতে সে জীবন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু রাখীকে ভালো করা তো তার সাধ্য নয়। রাখীর মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেছে।

উদয়সাগরের ওপারে সূর্য উঠেছিল সবে। শংকরী ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে উদীয়মান সূর্যের দিকে চেয়ে প্রণাম জানায়। তার মনে হয়, কত ঝড়-বাদল বয়ে যায় মানুষের জীবনের ওপর দিয়ে কত লোক রোগশোক ভোগ করে—কিন্তু প্রতিদিন সূর্যদেব ঠিক এমনি ভাবেই ঊষার লজ্জা ভেঙে দিয়ে বিকশিত হন। কোনো ব্যতিক্রম নেই। একটি দিনের তরেও ব্যতিক্রম নেই।

খুব ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে শংকরীর। ছোট একটি ভাই ছিল তার। সেই ভাইটির মৃত্যু হয়েছিল এক অভাবনীয় দুর্ঘটনায়! সেই দুর্ঘটনার কথা ভাবতে বহুদিন সে শিউরে উঠত। এখন আর বিচলিত হয় না। কারণ এই সুদীর্ঘ জীবনে তার চেয়েও অনেক বড় দুর্ঘটনা সে দেখেছে। সদ্য যে কাণ্ড সে দেখে এল চিতোর থেকে তার কথা না বলাই ভালো। যুদ্ধের নামে এ-জাতীয় নরহত্যা বোধহয় কখনো ঘটেনি ভূ-ভারতে।

ভাই-এর কথা সহসা এতদিন পরে এই সাত-সকালে মনে পড়বার কারণ রয়েছে। ভাইটি যেদিন মারা যায় তার পরের দিনও সকালে রক্তবর্ণ সূর্যের দিকে চেয়ে বিচলিত হয়েছিল শংকরী। ভেবেছিল, তার ভাই-ই যখন রইল না তখন সূর্য উঠল কেন? ওই সূর্যকে দেখে ভাই রোজ সকালে আহ্লাদে নেচে নেচে হাতছানি দিয়ে ডাকত, আয়-আয়। চাঁদের চেয়ে সে সূর্যকেই পছন্দ করত বেশি। বেঁচে থাকলে হয়তো সূর্যের মতো তেজস্বী হত।

ভাইটি মারা যায় বছরের এক স্মরণীয় দিনে। সেদিনের আবহাওয়াতেও ছিল আজকের মতো শীত চলে যাবার মৃদু উষ্ণতা। সেদিনও ছিল ফাল্গুন মাস। মহরত কা শিকার’-এর দিন। আগের দিনে রানা তাঁর সর্দারদের সবুজ রঙের পোশাক বিতরণ করেছিলেন। সেই পোশাক পরে পরদিন সবাই যাবে বরাহ শিকারে। রাজজ্যোতিষী পরের দিনটিকেই যাত্রার পক্ষে সর্বোত্তম দিন হিসাবে স্থির করেছিলেন। দেবী গৌরীর জন্য বরাহ শিকারে দিনক্ষণ দেখে যাত্রা করা মেবারের চিরকালের

প্ৰথা।

১০২ ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

মনে আছে শংকরীর, তার পিতা আগের দিনে সন্ধ্যায় উৎফুল্ল মনে একটি সবুজ রঙের পরিচ্ছদ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। তার পিতাও হবে রানার সহযাত্রী। কালপীর দলের মধ্যে কয়জনের ভাগ্যে এত বড় সুযোগ এসেছে?

কিন্তু সেই সুযোগে সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি তার পিতার। ভোরবেলা শংকরীর হাত ধরে তার শিশু ভাইটিও এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজপথে। আরও কতশত লোক জমায়েত হয়েছিল সেখানে। রানা যাবেন, ‘মহরত কা শিকারে’। সবাই সারি সারি দাঁড়িয়ে পড়েছিল রাস্তার দুধারে। দূর থেকে সবুজ পোশাকের ঘোড়সওয়ারদের দেখে শিশুটি চিৎকার ক’রে উঠেছিল,—বাবা! বাবা!

—চুপ কর। ওরা সবাই বাবা নয়রে। ওদের মধ্যে একজন শুধু আমাদের বাবা।

শিশু কি আর সেকথা বোঝে? সে সামনে চেঁচাতে থাকে। শেষে রানার দল একেবারে এগিয়ে এলে শিশুটি শংকরীর হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে রাস্তার ওপর পড়ে

সামলে নেবার সময় ছিল না। এক মুহূর্তের মধ্যে সব কাণ্ড ঘটে গেল। শংকরী নড়তে পারল না পর্যন্ত। নড়বার অবকাশই দিল না সেই একরত্তি ভাইটি। দু-তিনটি ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের নীচে তার নরম দেহ পিষ্ট হয়ে গেল।

রানার হুকুমে সমস্ত দল দাঁড়িয়ে পড়ল। কার ছেলে? সবার একই প্রশ্ন। তার বাবাও ঝুঁকে পড়ে বলে ওঠে,—কার ছেলে?

নিজের পুত্রকে নিজে চিনতে পারেনি সেদিন তার বাবা। চেনবার উপায় ছিল না।

শংকরী ছুটে এসে ভাই-এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন তার বাবা বুঝতে পারল সব। কিন্তু একটুও বিচলিত হল না। ঘোড়াটির রশি পথিপার্শ্বের একজন চেনা লোকের হাতে দিয়ে পুত্রের মৃতদেহ তুলে নিয়ে শংকরীকে বলেছিল, —চল সুন্দরী।

ডাকনাম তার সুন্দরীই ছিল এককালে। বাবা আর মা সেই নামে ডাকত। অন্য সবাই তাকে তার ভালো নাম ধরেই ডাকত। আজ দুই নামই মুছে গেছে। তেমন তো অনেক কিছুই মুছে গেছে। সেদিন চিতোরের সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন রানা সঙ্ঘ। সেইরকম বীর রানাও তো মুছে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর বড্ড ঘন ঘন পট পরিবর্তন শুরু হল। রানা সঙ্ঘের পর রানা রত্ন। তারপর রানা বিক্রমজিতের পর দাসীপুত্র বনবীর। তারপর এই উদয় সিংহ। সঙ্ঘের ওই সিংহাসনে যদি কিকা বসতেন, তবে হয়তো আবার রাজপুতদের সুনাম ফিরে আসত। কিন্তু তা কি হবে? ইতিহাস কি রানা প্রতাপ সিংহ বলে কাউকে কোলে তুলে নেবে? কে জানে?

সূর্য আরও উজ্জ্বল হয়।

শংকরী চাইতে পারে না সেদিকে। অন্যদিকে চেয়ে সে ভাবে বরাহ শিকারের কথা। রানা উদয় সিংহ এবারে নাকি শিকারের পাট নমো নমো করে সারবেন। শুধু কিকাকেই অনুমতি দিয়েছেন তিনি তাঁর দলবল নিয়ে শিকারে যেতে। অন্য রাজপুত্ররা প্রাসাদে থাকবে। রানার নাকি ভয়, শিকারের সুযোগে তারা পরস্পরকে হত্যা করতেও পারে। এমন অনেক নাকি ঘটেছে মেবারের ইতিহাসে। তিনি এমন হাতে দিতে চান না। গৌরীদেবীর অসন্তুষ্টি বা অভিশাপের ভয় না থাকলে হয়তো একেবারে উঠিয়ে দিতেন ‘মহরৎ কা শিকার’। ভুলে যেত মেবারের পরবর্তী বংশধরেরা এই শিকারের কথা। যেমন ভুলে গেছে সবাই যে শংকরীর বাবা-মা তাকে সুন্দরী

বলে ডাকত।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেরায় শংকরী। লীলাবতী ঘুমে অচেতন। সারারাত সে ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে। শংকরী বুঝতে পারে মেয়েটির মনে প্রবল দ্বন্দ্ব চলছে। কিসের দ্বন্দ্ব অনুমান করতে পারলেও জানবার উপায় নেই। মেয়েটি বড্ড চাপা। তবে ঘুমের মধ্যে মাঝে সে দু-চারটি কথা বলে ওঠে। সেই, কথা থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। ঘুমের মধ্যে সে প্রায়ই বাবার কথা বলে। বাবাকে ডাকে। জিৎ সিং আর রাখীর নামও তার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে কখনো কখনো। মৃত জীবিত এই কয়জন মানুষকে নিয়েই তার চিন্তা আবর্তিত হচ্ছে। মৃত পিতার কথা মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। রাখী শিশুকাল থেকে তার সাথী। তার সম্বন্ধে গতরাত্রে অনেক কথা বলেছে। বন্ধুটির জন্য রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছে লীলাবতী। কিন্তু জিৎ-এর নাম কেন স্বপ্নের মধ্যে তার মুখে আসবে? এক আধদিন হঠাৎ মুখে আসা বিচিত্র নয়। যে কোনো মানুষের নামই অমন আসতে পারে ঘুমের মধ্যে। কিন্তু নিয়মিতভাবে জিৎ সিং-এর নাম বলার একটি অর্থই হতে পারে। সেই অর্থ সুস্পষ্ট।

লীলাবতীর পছন্দ আছে বলতে হবে। তার হৃদয় অযোগ্য পুরুষের জন্যে উতলা হয়নি। তবে হতে পারত। এই কাঁচা বয়সে অভাবনীয় অনেক কিছুই ঘটে। কাঁচা বয়স আর অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অনেক দুশ্চরিত্র পুরুষ অর্থোস্ফুট কুমারিত্বকে সারা জীবনের মতো নষ্ট ক’রে দেয়। শংকরীর সন্দেহ হয়, ওই রাম সিং ছোকরাটা তেমন একটি মতলবে ছিল। তার হাবভাব দেখে সেই রকম মনে হয়েছিল। তবে বোধহয় খুব বেশি সুবিধে ক’রে উঠতে পারেনি। কারণ চিতোর ছাড়বার পর থেকে তাকে লীলাবতীর কাছে ঘেঁষতে দেখা যায়নি। তবে আর একজনের সঙ্গে তাকে দেখা গেছে। এখন সে দলের মধ্যেও বেশিক্ষণ থাকে না। সবাইকে এড়িয়ে নিজের নির্বাচিত কয়েকটি বদস্বভাবের ছেলেকে নিয়ে এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। কি করে ওরা সারা দিন-রাত কেউ বলতে পারে না।

শংকরীর চিন্তা-স্রোত বাধা পায়।

যশোবন্ত এগিয়ে আসে। আজকাল সে প্রায়ই কারণে অকারণে শংকরীর কাছে আসে। দুদণ্ড তার কাছে বসে। কথা বলে। তার মুখ দেখে শংকরীর মনে হয় অনেকক্ষণ সে থাকতে চায় কাছে। যখন সে চলে যায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যেন যায়। সারাজীবন নারী-সাহচর্য পায়নি বলেই হয়তো তার এই দ্বিধাগ্রস্ত লোলুপতা। কষ্ট হয় শংকরীর। কষ্ট হয় নিজের জন্যেও। কারণ যশোবন্তের লোলুপতা কি তার নিজের মধ্যেও নেই? বিশেষ করে যশোবন্তের জন্যে? কিন্তু এতদিন পরে এই বয়সে এসব হল নিছক পাগলামি। লোকেদের সন্দেহের অতীত হয়েও তাই যশোবন্তকে যত্ন করতে সংকোচে বাধে। ভগবান যদি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনটাকেও বুড়িয়ে দিতেন বড় ভালো হত। বয়স যত বাড়ে, হৃদয়ের স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসাও যেন তত বেড়ে চলে। এ এক অদ্ভুত রসিকতা ভগবানের। এই রসিকতার জবাবও রসিকতা। তাই সে নিজেকে রসিকা সাজিয়েছে। তাই যশোবন্তকে মাঝে মাঝে বেফাস দু-চার কথা বলে ফেললেও সে সন্দেহ

করতে পারে না।

যশোবন্ত কাছে এসে বলে,—কিগো শংকরী। সকাল হতে না হতেই এত দুর্ভাবনা কিসের জন্যে? অমন ঠায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?

—যত দুর্ভাবনা তোমার জন্যে বুড়ো।

—আমার জন্যে? আমার ভাগ্য খুবই ভালো বলতে হবে। পৃথিবীতে তবু একজন অন্তত আমার জন্যে ভাবতে শুরু করেছে।

—তোমার জন্যে সারাজীবনই ভেবে ভেবে মরলাম।

যশোবন্ত হেসে ওঠে প্রাণ খুলে। বলে,—শুনতে কিন্তু সত্যিই ভালো লাগছে। দুঃখ হয় এই ভেবে যে এমন জিনিস সত্যি হল না। একজন আমার জন্যে ভাবছে, একথা মনে হলেও জীবনটা মিষ্টি হয়ে ওঠে। তোমাকে ধন্যবাদ এই যে, তুমি রসিকতার মধ্যেও একমুহূর্তের জন্যে সেই মিষ্টত্বটুকু আস্বাদন করতে দিয়েছ।

১০৪ ≈ ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

শংকরী যশোবন্তের ডান হাতখানা ধরে সজোরে ঝাঁকি দিয়ে বলে,—ও বুড়ো।

–কি হল?

—তুমি জেগে আছো তো?

—একথা বললে কেন হঠাৎ?

—বড় বড় কথা বলছ কিনা। সজ্ঞানে এসব তো বলতে শুনিনি কখনো।

যশোবন্ত হেসে বলে,—কেন? এসব বলবার অধিকার কি তোমার একচেটিয়া?

—না। তা হবে কেন? তবে কারও কারও মুখে এসব কথা অদ্ভুত শোনায়।

—তুমি আমার বুদ্ধির ওপর কটাক্ষপাত করছ শংকরী। খুব খারাপ হচ্ছে। আমার বুদ্ধি তীক্ষ্ণ নয়, একথা জানি। কিন্তু বয়স হয়েছে ঢের। বয়সের অভিজ্ঞতাতেও অনেক সময়ে বুদ্ধির অতীত অনেক জিনিস ধরা পড়ে। আমি অনুভবের জিনিসের কথা বলছি।

শংকরী একটু চঞ্চল হয়। মানুষটির জন্য কারুণ্যে তার মন ভরে ওঠে।

মুখে বলে,—তবে আমি পালাই। তোমাকে বিশেষ সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না আজ। কি জানি বাবা।

যশোবন্ত অট্টহাসি হেসে উঠে বলে,—চমৎকার বলেছ এবারে। আমাকে দেখে ভয় হচ্ছে তোমার?

—হাসির কি হল?

—হাসির নয়?

—বেশ, হাসিরই না হয় হল। কিন্তু ওসব অনুভব-টনুভবের কথা শুনতে চাই না তোমার কাছে। মোটা বুদ্ধি বলে স্বীকার করেছ যখন নিজের, তখন মোটা কথাই বল।

—কার জন্যে ভাবছিলে শংকরী। স্বামীপুত্র তো নেই। এত ভাবনা কিসের? শংকরী গম্ভীর হয়ে বলে,—রাখী সত্যিই পাগল হয়েছে।

—দেখলাম। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

—কি আর করবে? তবে আমার মনে হয়, ওর পাগল হবার পেছনে কোনো কারণ রয়েছে।

—চিতোরের দৃশ্য দেখে বোধহয়।

—না। তা নয়।

—তবে?

—জঘন্য কোনো কারণ রয়েছে এর পেছনে। এখনো আমি ঠিকভাবে বলতে পারছি না। তবে আমার সন্দেহ মিথ্যে হবে বলে মনে হয় না।

—কি সন্দেহ হয় তোমার?

—ও ভালোভাবে খেতে পারে না।

—তাতে কি হল?

—ওকে আমি বমি করতে দেখেছি।

যশোবন্তের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে,—তার মানে?

—বুঝলে না? কেউ ওর সর্বনাশ করেছে। কে করেছে তাও আন্দাজ করতে পারি।

যশোবন্ত স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে শংকরীর চোখের ভেতরে বৃথাই রসিকতার ঝিলিক

খুঁজে মরে। কারণ সেই চোখও স্থির, সেই চাহনিতেও চিন্তা।

—তুমি বলছ কি শংকরী! একি সত্যি হতে পারে?

—যতদূর মনে হয় সত্যি!

—কে এমন সর্বনাশ করল? আমার দলে এমন হীন মনোবৃত্তির লোক কে রয়েছে?

—কেউ নেই? একহাজার মানুষের মধ্যে হীন মনোবৃত্তির কেউ নেই বলে তোমার ধারণা? এত সরল হয়ে দল চালাবে কি ক’রে বুড়ো? সবাইকে নিজের মতো ভাবতে হয়?

—কাকে সন্দেহ কর তুমি?

—এখন সেকথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। আগে জেনে নিতে দাও।

—বেশ। আগে থেকে কারও নাম শুনে আমি অনর্থক তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ক’রে রাখতে চাই না। হয়তো যাকে তুমি সন্দেহ করছ সে নিরপরাধ।

শংকরী দুঃখের হাসি হেসে বলে,—আমার ধারণা ভুল হলে আমিই সব চাইতে খুশি হব বুড়ো। দুঃখের বিষয় তেমন ভুল বড় একটা হয় না আমার।

—তুমি বুদ্ধিমতী।

—সত্যি?

—হ্যাঁ সত্যি। বয়সকালে তোমার দেখা পেলে কি হত বলা যায় না।

—কি হত?

—যে কারণে আজীবন অবিবাহিত রইলাম, সে কারণ হয়তো বাধা হয়ে দাঁড়াত না।

—তাহলে তোমার বিয়ে না করার এমন কিছু গুরুতর কারণ নেই বল?

—আছে। খুবই গুরুতর কারণ আছে। এই মুহূর্তে তোমাকে যে কথা বললাম, এতদিন পরে বলেই বলতে পারলাম। আগে হলে পারতাম না।

—তাহলে আমার দেখা পেয়েও লাভ হত না তখন, একথা স্বীকার করছ?

—লাভ না হলেও মুগ্ধ হতাম ঠিকই।

—কিন্তু আমি মুগ্ধ হতাম না একটুও। মোটা বুদ্ধিকে আমি আজীবন ঘৃণা করি। যুদ্ধ ছাড়া যারা আর কিছু বোঝে না, তারা আবার পুরুষ নাকি?

—এখন তোমার কথা শুনে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছে না শংকরী। কিন্তু সেই সব দিনে তুমি যদি আমার কাছে এসে একথা বলতে তবে হয়তো আত্মহত্যা করতাম।

—মোটা বুদ্ধি বলেই আত্মহত্যা করতে।

—আচ্ছা শংকরী, তোমার স্বামী কতদিন বেঁচে ছিলেন?

—এসব কথা কেন?

—এমনি শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।

—গতিক ভালো নয়। ফাল্গুন মাস চলছে। বাতাসে গরমের ছোঁয়াচ। ফুল ফুটছে। কোকিল ডাকছে। এ সময়ে নিজেকেই বিশ্বাস করতে নেই। পুরুষমানুষকে তো শত হস্তেন—

—তুমি বড় বাজে কথা বল। তোমার স্বামীর কথা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই প্রশ্ন করছি। হতভাগার জন্যে কষ্ট হয়।

—হয় নাকি? তার জন্যে কেন তোমার কষ্ট হয় বুড়ো? আমি বুঝি নারীরত্ন?

—ধেৎ। তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না।

যশোবন্ত চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। শংকরী হাত চেপে ধরে বলে,—রাগ কর কেন

বুড়ো? ওসব কথা এখন বলতে ভালো লাগে? তোমার কি পুরোনো কথা বলতে ভালো লাগবে?

—আমি শুনতে চেয়েছি, তাও বলবে না?

—বলব। একদিন সব বলব। এখন কাজের কথা শোনো। লীলাবতীর জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়েছি।

–কেন? তার কি হল আবার?

—কিছুদিন থেকে ওর মন বড় চঞ্চল।

—চঞ্চল? আবার চিতোরের দিকে ছুটবে না তো?

—সেরকম চঞ্চল নয়, অন্যরকম।

১০৬ ≈ ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

—কি রকম?

—চুপি চুপি শুধু তোমাকেই বলে রাখি। মেয়েটি বোধহয় মন দিয়ে ফেলেছে।

—মন দিয়ে ফেলেছে? মন আবার কেমন ক’রে দেয়?

—তোমার বুদ্ধি সত্যিই মোটা। মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার জান না?

—ও। এবারে বুঝেছি। কাকে দিল?

শংকরী, ফিসফিস করে বলে,—জিৎ সিং?

যশোবন্দ আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে,—জিৎ সিং?

—আঃ, আস্তে। লীলা ঘরে আছে। এসব কথা কি জোরে বলতে হয়?

—আমার খুব আনন্দ হচ্ছে শংকরী। জিৎ সিং ছেলেটি বেশ সুন্দর। দুটিতে যা মানাবে। হলে বড় ভালো হয়। দুজনার হাত যদি মিলিয়ে দিতে পারি, তবে পরপারে বুক ফুলিয়ে সর্দার গোপাল সিং-এর সামনে দাঁড়াতে পারব।

—সবই বুঝলাম। কিন্তু বয়সের যে বিশেষ তফাত নেই।

—তাতে কি হল? সমবয়সির সঙ্গে বিয়ে হয় না?

—হয়। কিন্তু অসুবিধাও আছে। লীলার যৌবন যখন হেলে পড়বে, তখনো জিৎ সিং যুবকই

থাকবে।

—অত ভাবলে চলে না।

—ভাবতে হয় বুড়ো। এসব ব্যাপারে ভাবতে হয়।

—দুজনার ভালোবাসাটা তবে কিছুই নয়?

—এখনো জানি না এটা সাময়িক মোহ কি না। যদি সত্যিই ভালোবাসা হয়, তবে কখনো বাধা দেব না। কিন্তু শুধু মোহ হলে চেষ্টা ক’রে নিবৃত্ত করতে হবে।

—অমন চেষ্টাও করতে যেও না।

সেই সময় লীলাবতী হাই তুলতে তুলতে ঘরের বাইরে আসে। সামনে দুজনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি হাসে।

যশোবন্ত বলে,—এত দেরিতে ঘুম ভাঙল লীলা! সূর্য যে মাথার ওপর।

লীলাবতী লজ্জা পায়। একটু আগে সে সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখছিল। ওই শিমুল গাছের গোড়ায় সে আর জিৎ সিং-কেউ কোথাও নেই—দু-চারটে শিমুলফুল ঝরে পড়ে ছিল—জিৎ সিং ঘন হয়ে এসেছিল।

লীলাবতীর মুখখানা রাঙা হয়ে ওঠে। সে উভয়ের অলক্ষ্যে চকিতে একবার জিৎ সিং-এর ঘরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ঘরের কপাট যথাযথ বন্ধ।

কথার মোড় ঘোরাতে শংকরী যশোবন্তকে বলে,—শুনলাম রাজজ্যোতিষী কালকের দিনটিকেই ভালো বলে স্থির করেছেন মহরত কা শিকারের’ জন্যে? তুমি যাবে না বুড়ো?

—আমি?

—কেন, তোমার যেতে নেই? গৌরী দেবীকে ভালো একটা বরাহ উপহার দাও, তিনি সন্তুষ্ট

হবেন।

~এই খাপছাড়া শিকারে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন না।

—হবেন। কারণ এবার কিকা হয়েছেন দলের নেতা। তিনি একাই যাচ্ছেন রাজপুত্রদের মধ্যে। বাপ্পার যোগ্য বংশধর তিনি। গৌরীদেবী অসন্তুষ্ট হতে পারেন না।

যশোবন্ত একবার লীলাবতীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,—জিৎ সিং নতুন পোশাক নিয়ে এসেছে?

লীলাবতী মুখখানা নত করে বলে—হ্যাঁ। শংকরী বলে ওঠে—আর একজন এনেছে।

—কে?

—রাম সিং। কিভাবে যেন সে কিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

—রাম সিং? কে বলল?

—খবর রাখতে হয়। শোন বুড়ো, রাম সিং-এর যাওয়াটা মোটেই ভালো বলে মনে হচ্ছে না। ওর বোধ হয় কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। মহরতের শিকারে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে বলেই এবারে রানা অন্য রাজপুত্রদের যেতে দেননি। তাঁর ধারণা রাজপুত্ররা পরস্পরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষের সুযোগ নেবে এই শিকারে। তাই একা কিকাই যাচ্ছেন। কিন্তু রাম সিং গেলে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না।

লীলাবতীর মন আশঙ্কায় ভরে ওঠে। তাড়াতাড়ি বলে,—দুর্ঘটনা ঘটবে কেন?

—রাম সিং-এর জন্মই হয়েছে দুর্ঘটনা ঘটাবার জন্যে।

লীলা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,—তবে তাকে নিষেধ করা যেত।

সে শুনবে কেন? সে কিকার অনুমতি পেয়েছে।

লীলাবতী বাধো বাধো স্বরে বলে,—তবে ওকে যেতে দিও না।

—কাকে?

—জিৎ সিংকে।

—তাকে যেতেই হবে। সে না গেলে কিকা দুঃখ পাবেন। কিন্তু জিৎ সিং-কে যেতে নিষেধ করব কেন লীলা? তোমার কি কোনোরকম সন্দেহ হয়?

—হ্যাঁ। আমার মনে হয় রাম সিং ওর অনিষ্ট করবার চেষ্টায় আছে। আমি তাকে অনেকদিন অন্ধকারে পা টিপে টিপে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। সে কিছু করতে পারছে না, জিৎ সিং অতিরিক্ত সাবধানী বলে।

যশোবন্ত চেঁচিয়ে ওঠে,—আমাকে কেন বলনি একথা? আমি ব্যবস্থা করতাম।

—এই সামান্য ব্যাপারে কাউকে বলতে সে সংকোচ বোধ করে, সে জানে রাম সিং তার

সমকক্ষ নয়।

—তার প্রমাণ আছে?

অসি যুদ্ধের কথা কাউকে এ পর্যন্ত বলেনি লীলা। কেউ জানে না। শুধু রাখী জানে। সে উন্মাদ। একবার লীলা ভাবে, এই মুহূর্তে সব বলে দেয়। পরক্ষণেই মনে হয়, জিৎ সিং দুঃখ পাবে। তাকে দুঃখ দেবার কথা কল্পনা করা যায় না।

যশোবন্তের কথার উত্তরে লীলাবতী শুধু বলে,—প্রমাণ আছে।

—আশ্চর্য। আমি নাকি দলের সর্দার। অথচ আমি কিছুই জানি না। শংকরী এত খবর রাখে, সে-ও জানে না। শুধু তুমি জান। জিৎ সিং দেখছি সব কথাই তোমাকে বলে। ব্যাপার কি?

লীলা থ’ হয়ে যায়। নিজের ওপর রাগ হয় তার। এত কথা বলা ভুল হয়েছে। সন্দেহ করেছে

ওরা।

সে গম্ভীর হয়ে বলে,- আমাদের দুজনারই বাবা মারা গেছেন চিতোর অবরোধে। দুজনার একই দুঃখ। সেই সব আলোচনা করতে গিয়ে অনেক কথাই বলেছিলাম দুজনা।

মিথ্যে বলেনি লীলা। অথচ আসল সত্যটুকুও বলতে হল না।

যশোবন্ত মাথা নাড়ে। শংকরী অন্যদিকে মুখ ফেরায়। মনে মনে বাহবা দেয় লীলাবতীকে। সত্য কথা বলেও সত্যিকে ঢাকা দেবার কৌশল জানে এই তরুণী। এই সব নারীই সার্থক স্ত্রী

১০৮ ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

হয়, সার্থক জননী হয়। সব চাইতে ভালো অভিনয় যে মেয়ে করতে পারে, মনের সব কষ্ট চেপে রেখে যে হাসতে পারে, সে-ই তো রমণী শ্রেষ্ঠ। দুজনার ঘনিষ্ঠতা একসময়ে ধীরে ধীরে প্রেমে রূপান্তরিত হয়েছে। এমন হত না, যদি-না তারা পরস্পরের যোগ্য হত।

যশোবন্ত বলে,—আমি জিৎ সিং-কে সাবধান করে দেব। যাতে সে সবসময় কিকার পাশে পাশে থাকে। তবে আমার কথা কি ও শুনবে। বড় একরোখা ওই ছেলেটি। যা ভাববে তা-ই করবে। তুমি বরং ওকে একটু বুঝিয়ে বলে দেখো লীলা। তোমার কথা ঠিক শুনবে।

যশোবন্তের বলার ধরন দেখে শংকরী হেসে ফেলে। কত ঢঙই জানে বুড়ো।

লীলা এবারে স্পষ্ট বুঝতে পারে, তার কিছুই গোপন নেই এদের কাছে। শংকরীর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সব ধরা পড়ে গেছে। শুধু ধরা পড়া নয়, সে আবার যশোবন্তকে সব বলে দিয়েছে।

প্রথমে প্রচণ্ড রাগ হয় লীলাবতীর। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভালোই হল। রাখী পাগল হবার পর মনের কথা বলবার কেউ নেই। মনের কথা না বলতে পারলে কেমন যেন লাগে। শংকরীকে সে বলতে পারবে। বয়স হলেও রসজ্ঞান আছে তার, আর আছে অভিজ্ঞতা। এ সব কথা কাউকে বলতে না পারলে মাথা ঠিক রাখা যায় না। রাখী হয়তো তার গোপন কথা কাউকে বলতে পারেনি বলেই আজ পাগল হয়েছে। মনের কথা চেপে রাখলে সে-ও পাগল হয়ে যাবে।

এই কদিনে জিৎ সিং-কে দেখে তার এটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, পুরুষেরা তার মন উজাড় করে দেয় বিশেষ এক স্ত্রীলোকের কাছে। আর নারীরা মন উজাড় করে বান্ধবী বা সমব্যথী অন্য স্ত্রীলোকের কাছে।

যশোবন্ত চলে যায় দলের সবার খোঁজ নিতে। শংকরীও তার সঙ্গে যায়। লীলা একা দাঁড়িয়ে থাকে। সে মনে মনে স্থির করে শিকারের ব্যাপারে জিৎ সিংকে কখনই সে যেতে নিষেধ করবে না। কারণ এ শুধু সাধারণ শিকার নয়। এটি ধর্মের অঙ্গ। এতে নিষেধ করা পাপ—ধর্মবিরুদ্ধতা শংকরী ঠিকই বলেছে। উদ্দেশ্য রয়েছে রাম সিং-এর কোনো। সে উদ্দেশ্য জিৎ সিং-এর দিকে ফণা উঁচিয়ে রয়েছে কি না কেউ জানে না।

নতুন রাজধানী থেকে বেশি দূরে নয় শিকারের স্থান। ভোরবেলা রওনা হয়ে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে গেলে দুপুরের আগে পৌঁছে যাওয়া যায়।

কিকার দল আরও আগে পৌঁছে গেল। কারণ এ-দল রওনা হয়েছিল রাত না ফুরোতে। জিৎ সিং-এর হৃদয় উৎসাহ, উদ্দীপনা আর আনন্দে ভরে উঠেছিল। ভরে ওঠবার কারণ রয়েছে। প্রথম, কিকার পাশেই তার স্থান। দ্বিতীয়ত বহুদিন পরে মনের মতো একটি ঘোড়া পেয়েছে সে। এত সুন্দর ঘোড়ায় সে জীবনে কখনো চাপেনি। কিকা নিজে তার জন্য এই অশ্ব নির্বাচন করেছিলেন। বলেছিলেন,–তোমার বাবা ভালো ঘোড়া পেলে স্নানাহার ভুলে যেতেন। ঘোড়ার গতির ছন্দ আকণ্ঠ পান করে, বুঁদ হয়ে থাকতেন। সেই কথা মনে পড়ায় তোমাকে আমার শ্রেষ্ঠ অশ্বটি দিয়েছি।

পাশ থেকে একজন সর্দার মন্তব্য করে, অশ্ব নয় কিকা, অশ্বা।

কিকা হেসে ওঠেন। বলেন, তা বটে। অশ্বা।

জিৎ সিং বলে,—আপনার ঘোড়াটি?

—এটিও ভালো। তবে তোমারটি একসময়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। এখন একটু বয়স হয়েছে। কিন্তু এর যে বাচ্চাটি রয়েছে, একটু বড় হলে আসমুদ্র হিমাচল এই ভূখণ্ডে তার সমকক্ষ কেউ থাকবে

না।

—এত তাড়াতাড়ি কি করে বুঝলেন?

—জাত ঘোড়া দেখলেই চেনা যায় জিৎ। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না, এদের মধ্যে ও প্রতিভা বলে জিনিসটি রয়েছে। আমি ভালোভাবে লক্ষ্য ক’রে দেখেছি কোনো ঘোড়া দীর্ঘদিন শিক্ষা পেয়ে ভালো হয়, কোনো ঘোড়া অল্পদিনেই সুন্দর হয়ে ওঠে, আবার কোনো ঘোড়া নিপুণ হাতের ছোঁয়া পেয়েই জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমার শিশু ঘোড়াটি শেষের দলের। ও একটি প্রতিভা। ওটি আমার জন্যেই বড় হচ্ছে।

জিৎ সি বলে,—ভালো দেখে একটি নাম রাখুন।

—রেখেছি। চেতক।

পাশে যারা চলছিল, তারা সবাই অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করে নামটি-চেতক। নামটি অর্থ আছে কি না কেউ জানে না। হয়তো আছে। কিংবা নেই। কিন্তু নামটির ধ্বনি অশ্ববিলাসীদের মনে সাড়া জাগায়। অদ্ভুত গাম্ভীর্য আর বৈরাগ্যের মিশ্রণ রয়েছে নামটিতে। চেতক। নামটির অর্থ নিশ্চয় হবে চেতনা-উদ্রেককারী।

চলতে চলতে কিকা ডাকেন—জিৎ সিং।

—আজ্ঞে।

—ওই লোকটি তোমার দলের। নাম জান?

কিকা রাম সিং-এর দিকে আঙুল দিয়ে দেখান।

এতক্ষণ রাম সিং-এর কথা মনেও ছিল না তার। এবারে খেয়াল হয়। লীলাবতী কাল সন্ধ্যায় বার বার সাবধান ক’রে দিয়েছে তাকে। সে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে যে রাম সিং তাকে হত্যা করতে পারে। লীলাবতী অল্পতেই বিচলিত হয়ে পড়েছে। কিকার দলে থেকে সেই দুঃসাহস রাম সিং—

—এর কখনই হবে না, এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। কিকার কথার জবাবে সে বলে—জানি কিকা। ওর নাম রাম সিং।

—লোকটি কেমন?

—বন্দুকের হাত চমৎকার। অসিযুদ্ধে ততটার পারদর্শী নয়। পায়ের কাজ খারাপ। শরীরের গতি ধীর।

সেজন্যে অসি না এনে বন্দুক এনেছে। অথচ আমি সবাইকে বার বার বলে দিয়েছি, এই শিকারে বারুদের স্থান নেই।

—ও শুধু সঙ্গে রাখতে চেয়েছে হয়তো।

—তবু আমার আদেশ পালন করা উচিত ছিল ওর। লোকটিকে প্রথমে দেখেই আমার ভালো বলে বোধ হয়নি। ওকে নিয়ে আসবার ইচ্ছে ছিল না। অথচ এমনভাবে অনুরোধ-উপরোধ শুরু

করল—

সিং।

—বলে দেব?

—কি?

—বন্দুক যাতে ব্যবহার না করে একটি বারের জন্যেও?

—হ্যাঁ। বলে দাও।

জিৎ সিং রাম সিং-এর পাশে গিয়ে বলে,-কিকা বন্দুক আনতে নিষেধ করেছিলেন রাম

—জানি।

—তবু আনলে? নিজে হাতে শিকার করতে পারবে না। শিকারের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। দাঁতে দাঁত চেপে রাম সিং বলে,–তোমার মাথাব্যথা কেন?

—একটি বারের জন্যেও বন্দুক ব্যবহার করো না।

তোমার হুকুম?

১১০ ঙ্ক ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

—না। কিকার। তিনি পাঠিয়েছেন আমাকে হুকুমটা জানিয়ে দিতে। কারণ দলের মধ্যে শুধু আমি তোমায় চিনি।

রাম সিং হেসে উঠে বলে,—চেনো? উঁহু আমাকে তুমি চেনো না।

—হেঁয়ালি ছাড়ো। কিকার আদেশ অমান্য করার ধৃষ্টতা যেন না হয়। ভুলে যেও না এই শিকারের ফল গৌরীদেবীর নামে উৎসর্গীকৃত

—যাও, কিকার পাশে যাও।

জিৎ সিং-এর মুখ ক্রোধে আরক্ত হয়। সে কথা বলতে পারে না। শেষে ফিরে আসে কিকার পাশে। আদেশ সে জানিয়ে দিয়েছে রামকে। এর পরও সে যদি বন্দুক ছুড়ে বসে তাহলে শাস্তি ভোগ করবে।

কিকা প্রশ্ন করেন, বলে দিয়েছ?

—হ্যাঁ।

জিৎ সিং-এর মনে লীলাবতীর কথাগুলো ভেসে ওঠে। তবে কি লীলার সন্দেহ অমূলক নয়? সত্যিই কি রাম সিং এত চেষ্টায় এই দলে স্থান ক’রে নিয়েছে শুধু তাকে হত্যা করবার জন্যে? কিন্তু তাই বা হবে কি করে? এত লোকের মধ্যে কেন সে তা করতে যাবে? অন্য কোনো নির্জন স্থানে ইচ্ছে করলেই সে সুযোগ পেতে পারে।

বনের ভেতরে এসে পৌঁছায় সবাই। চারদিকে গাছ আর আগাছার ঝোপ। সবাই যে যার মতো ছড়িয়ে পড়ে ঘোড়া নিয়ে বরাহের সন্ধানে। জিৎ সিং কিকাকে ছেড়ে যেতে চায়।

—তুমি আমার সঙ্গে থাকবে না জিৎ সিং?

—শিকারের আনন্দ কি তাহলে পাবেন আপনি?

—তা পাবো না বটে। আচ্ছা তুমি যাও। আজ সবাই স্বাধীন। ইচ্ছে মতো লাগাম ছেড়ে ছুটবে সবাই তবেই তো আনন্দ।

কিকা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে অদৃশ্য হন।

চারদিকে শুধু ডালপালা নড়ে ওঠবার আওয়াজ। ঘোড়ার গায়ে লেগে শব্দ হচ্ছে অমন। জিৎ সিং দেখে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। আশেপাশে কেউ নেই। অশ্বের ঘাড়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,—পারবি তো সন্ধান রাখতে? খুঁজে দেওয়া চাই।

সে ছুটে যায় একদিকে।

ওদিক থেকে রব ওঠে,হো-হো—

ওই রব শুনেই বরাহ সাধারণত বন থেকে বের হয়ে আসে। তখন তার পেছনে ধাওয়া করে সবাই।

জিৎ সিং দেখতে পায়, কিকা ছুটে চলেছেন। তাঁর মাথার শিরস্ত্রাণ নেই। জিৎ সিং-কে দেখতে পেয়ে মাথার ওপর হাত রেখে ইঙ্গিতে বলেন,—নেই। তার পরক্ষণেই তিনি মিলিয়ে যান ঘন

সন্নিবিষ্ট গাছের মধ্যে।

হো-হো – 1

কিন্তু কোথায় বরাহ?

জিৎ সিং অন্য দিকে ছোটে। অনেক ঝোপঝাড় পার হয়ে একটি ফাঁকামতো জায়গায় এসে উপস্থিত হয় সে। সেখানে দেখতে পায় রাম সিং-কে। চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে ছিল রাম সিং। যেন কারও জন্যে অপেক্ষা করছে।

জিৎ সিং রাশ টেনে ধরে ঘোড়া থামিয়ে প্রশ্ন করে,—তুমি ছুটছো না রাম সিং?

—শিকার করা নিষেধ তুমিই তো বলেছিলে।

—খুঁজে বের কর একটা। তাতেও তো লাভ। তাতেও আনন্দ।

—অত সহজে আমার আনন্দ হয় না।

কথা বলার মতো সময় ছিল না জিৎ সিং-এর। বিশেষত যার সঙ্গে কথা বলে সুখ হয় না। সে চলে যাবার উপক্রম করে।

—দাঁড়াও জিৎ।

জিৎ সিং থমকে দাঁড়ায়।

—তোমার সঙ্গে কথা আছে।

—বল।

—অমন তাড়াহুড়োর মধ্যে বলা যাবে না।

—তবে ফিরে গিয়ে বলো। এখন সময় নেই।

জিৎ চলে যেতে চায়।

—দাঁড়াও।

চমকে চেয়ে দেখে জিৎ সিং, তার দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছে, রাম সিং। মুখে তার নিষ্ঠুরতার ছাপ। সে নিষ্ঠুরতাকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না ক’রে অট্টহাসি হেসে ওঠে জিৎ সিং।

—ও হাসি কতক্ষণের জন্যে জিৎ?

—কতক্ষণের জন্যে? বলছ কি তুমি? তোমার মৃতদেহ দেখবার পরও কিছুদিন অন্তত অক্ষয় হয়ে থাকবে। সরে দাঁড়াও।

—আমি তামাসা করছি না জিৎ।

—আমিও তামাসা করবার জন্যে আসিনি রাম সিং। সরে দাঁড়াও।

রাম সিং বন্দুক উঁচিয়ে জিৎ সিং-এর বুকের দিকে লক্ষ্য করে।

—ও। তুমি আমাকে মেরে ফেলবে?

—হ্যাঁ।

—বেশ মারো। তবে একটা কথা মনে আছে তো? এই দলে তুমি ছাড়া আর কেউ বন্দুক আনেনি সঙ্গে ক’রে।

—সব মনে আছে।

—আমাকে এখানে পড়ে থাকতে দেখে কিকা কাকে সন্দেহ করবেন?

—আমাকে।

—তবে?

রাম সিং বাঁকা হাসি হেসে বলে ওঠে,-আমি এখানে থাকব নাকি?

—পালাবে?

—নিশ্চয়!

—কোথায়?

—তোমায় বলব না।

—বেশ বলো না। কিন্তু বন্ধুকের আওয়াজ শুনবার সঙ্গে সঙ্গেই যে এদিকে ছুটে আসবে সবাই। নিজের ঘোড়াটির চেহারা দেখেছ একবার? কতদূর যেতে পারবে ওটি। যোদ্ধা হয়েছ, অথচ ঘোড়া চেনো না?

রাম সিং-এর ওষ্ঠ বারকয়েক কেঁপে ওঠে। সে ঢোক গিলে বলে,—তোমার সঙ্গে একটি বিষয়ে মীমাংসা করে নিতে চাই।

—কোন বিষয়ে?

১১২ ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র ২/শ্রীপারাবত

—লীলাবতী।

—লীলাবতী?

—হ্যাঁ আমার অনুরোধ তার সঙ্গে তুমি আর মেলামেশা করো না। সে আমাদের দলের। তার ওপর শুধু দলের লোকের অধিকার। যমুনা তীরের মেয়ে চম্বলের ছেলের সঙ্গে মিশবে এ আমরা চাই না।

—তোমার অনুরোধকে আমি দুপা দিয়ে দলিয়ে যাই। তুমি বিভেদের সৃষ্টি করছ। চিতোরে দু-একপুরুষ বসবাস ক’রেও তুমি নিজেকে রাজপুত বলতে অস্বীকার করছ এখন। আশ্চর্য! তুমি নীচ।

জিৎ সিং ঘোড়া ছুটিয়ে স্থান ত্যাগ করে। সে ভালোভাবেই জানে, তার পৃষ্ঠদেশ বন্দুকের গুলিতে বিদ্ধ হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। রাম সিং-এর সে সাহস কর্পূরের মতো উবে গেছে। সহসা সে দেখতে পায় সেই পরম প্রার্থিত জীবটিকে। জীবটি একটি ঝোপ থেকে বের হয়ে ফাঁকা জায়গা অতিক্রম করে প্রাণ ভয়ে দ্রুত অন্য ঝোপে প্রবেশ করে।

চিৎকার করে ওঠে জিৎ সিং,–পেয়েছি।

—হো-হো- —পেয়েছি।

জিৎ সিং ছুটে চলে বরাহের পেছনে। জীবটি অদৃশ্য ইতিমধ্যে।

একটু পরেই কিকাকে দেখা যায় দূরে। ইশারায় তিনি বলেন, বরাহকে দেখতে পেয়েছেন তিনিও। পিছু নিয়েছেন তার। কিকার জামাকাপড় ছিন্ন। কাঁটা আর গাছের ডালপালা লেগে এ-দশা হয়েছে তাঁর। শরীরেও তাঁর রক্তের দাগ। তিনি এক ঝলকে মিলিয়ে যান আবার।

জিৎ সিং বোঝে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। সে পেছনে ছোটে। সর্বপ্রথম বরাহকে সেই দেখেছে আজ। ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। সবাই বলাবলি করবেন একথা। কিকাও বলবেন। ধন্যবাদ দেবেন। এইটিই প্রথা। এ-প্রথা বংশপরম্পরায় চলে আসছে।

অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। কিন্তু বরাহের খবর আর কেউ দিতে পারল না। কিকাও হারিয়েছেন তাকে। কয়েকবার দেখা দিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে জীবটি।

কিছুক্ষণ পর আবার একসময়ে দেখা যায় তাকে। এত লোকের চোখের দৃষ্টির আড়ালে ছুটে ছুটে সে তখন ক্লান্ত। তাই গতিবেগ অনেক শ্লথ। এবারে অনেকেই তাড়া করে তাকে।

তাড়া খেয়ে সে সামনে ছোটে। ছুটতে ছুটতে একটা উঁচু পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পালাবার সামর্থ্য আর অবশিষ্ট নেই তার দেহে। সে বুঝতে পেরেছে তার মৃত্যু অবধারিত। তাই কাপুরুষের মতো না মরে এই সর্বপ্রথম রুখে দাঁড়ায় একা সবার বিরুদ্ধে।

দলের সবাই একসঙ্গে ঘিরে ধরে তাকে।

—আমি মারব। একজন রাজপুত তার ফলা উঁচিয়ে ধরে।

কিকা বলেন,–ঘোড়ার ওপর থেকে অনেকেই মারতে পারবে এখন। ওর সামনে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে মারবার মতো সাহস কারও আছে? যদি থাকে সামনে এগিয়ে এসো।

স্তব্ধতা বিরাজ করে মুহূর্তের জন্যে। কিকার প্রস্তাবের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সবাই। মাটিতে নেমে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিপ্ত বরাহ আক্রমণ চালাবে। সেই আক্রমণের গতি সামলে তাকে চরম আঘাত হানা অসম্ভব।

জিৎ সিং ধীরে ধীরে বলে,—আমি চেষ্টা করে দেখি।

অবাক হন কিকা। সবাই অবাক হয়। সব চাইতে অবাক হয় রাম সিং। সে মনে মনে ভাবে লীলাবতীর মতো মেয়ে যার মুঠোর মধ্যে কেমন করে সে এই নিশ্চিত মৃত্যুর পথে পা বাড়ায়?

জিৎ সিং একটু এগিয়ে যায় তার ঘোড়া নিয়ে। বরাহটি তাকে কাছে আসতে দেখে মুখখানা বীভৎস ক’রে তোলে। সে জানে এইবারে হবে শেষ শক্তি পরীক্ষা।

ঘোড়া থামায় জিৎ সিং। তার তীক্ষ্ণদৃষ্টি বরাহের দিকে। বরাহের দিকে চেয়েই সে তার অসি কোষমুক্ত করে। বরাহের দিকে চেয়ে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামে। কিন্তু নামবার সময় দেখে নামেনি। লক্ষ্য করেনি কোথায় পা পড়ল। লক্ষ্য করলে কখনই সেখানে পা দিত না।

একটি ছোট্ট শ্যাওলা ধরা-পাথর। তার ওপর জিৎ সিং-এর পা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সে মাটিতে পড়ে যায়। আর সেই মুহূর্তে বরাহটি সুযোগ বুঝে একটা চাপা হুঙ্কার ছেড়ে ছুটে আসে।

নিশ্চিত মৃত্যুকে জীবনে এই দ্বিতীয়বার দেখতে পায় জিৎ সিং। দেখেছিল চিতোরে—পিতার অশক্ত দেহের ওপর যেদিন মুঘল সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেদিনও সে অসহায় অবস্থার মধ্যে চেয়ে চেয়ে দেখছিল শুধু। কিছু করতে পারেনি। তার নিজের তলোয়ার পাশের ঘরের দেয়ালে ঝুলতে দেখেও নিয়ে আসতে পারেনি। কারণ যাবার পথে বাধা হয়ে দণ্ডায়মান ছিল শত্রুরা। কিন্তু আজকের অসহায়তা সেদিনের চেয়েও বেশি। সেদিন সে অন্তত তার দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়েছিল। আজ সে মাটির ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছে। সেদিন সে ছিল নিরস্ত্র। আজ তার হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও সেটি মূল্যহীন। কারণ অস্ত্র ব্যবহারের সময় নেই। এই মুহূর্তটুকুর মধ্যে যদি সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, তাহলে অস্ত্র ব্যবহারের সময় পাবে না। আর যদি এইভাবেই পড়ে থেকে ওই ছুটে আসা যমদূতের দিকে তলোয়ার তুলে ধরে তাতেও কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ ওকে রুখে দেবার শক্তি পাবে না সে এই অবস্থায়।

আফশোসে মন ভরে ওঠে জিৎ সিং-এর। এইভাবে একটি বন্যজন্তুর হাতে প্রাণ দিতে হবে স্বপ্নেও ভাবেনি সে। এর চেয়ে এই বলিষ্ঠ মুঘল সেনাদের হাতে প্রাণ দেওয়াও ছিল সহস্রগুণে শ্রেয়। তারা বরাহ নয়—মানুষের হাতে জীবন দেওয়ার একটা সান্ত্বনা আছে। কিন্তু এ মুহূর্তে সে সান্ত্বনা নেই। বিশেষ ক’রে যখন এই মৃত্যুর জন্যে সে নিজে দায়ী। ওই রকম একটি মারাত্মক পশুর সম্মুখীন হবার আগে তার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল।

বরাহ ছুটে আসছে।

কিকা চেঁচিয়ে রাম সিং-কে বলেন,–চেয়ে দেখছ কি? একমাত্র তুমিই বাঁচাতে পার। তোমার বন্দুক রয়েছে, গুলি কর।

—আপনার নিষেধ রয়েছে।

—ছিল, এখন নেই।

রাম সিং বন্দুক উঁচিয়ে ধরে। সবাই উৎকণ্ঠিত।

বন্দুকের শব্দ হয়।

কিন্তু এ কী! বরাহ তো মাটিতে গড়িয়ে পড়ল না? সে শুধু থমকে দাঁড়াল। জীবনে এমন শব্দ সে শোনেনি বলে ঘাবড়ে গেছে। অথচ জিৎ সিং-এর ঘোড়াটি পেছন দিকে বসে পড়ে। তার দেহের কিছু অংশের চাপ পড়ে গিয়ে জিৎ সিং-এর একটি পায়ের ওপর। ফলে উঠে দাঁড়াবার যে সময়টুকু সে পেয়েছিল তাকে কাজে লাগাতে পারল না।

কিকা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে রাম সিং-এর দিকে মুহূর্তের জন্যে তাকান। যে ঘোড়া জীবনে কখনো বসে পড়েনি, এই সংকট সময়ে তাকে বসে পড়তে দেখেই তিনি বুঝে নিয়েছিলেন রাম সিং-এর গুলি কোথায় গিয়ে বিঁধেছে। তাই একটুও সময়ই নষ্ট না ক’রে তিনি ছুটে যান বরাহের দিকে। তাঁর বল্লম ধরা হাতখানা একবার শুধু নড়ে ওঠে। পরমুহূর্তে বরাহটির তীব্র আর্তনাদ বনভূমিকে প্রকম্পিত করে তোলে।

সবাই এগিয়ে যায়। আহত ঘোড়াটিকে কোনোমতে সরিয়ে জিৎ সিং-কে মুক্ত করা হয়। তার মহাভাগ্য ঘোড়ার চাপে তার পা ভেঙে যায়নি। সে সহজভাবে উঠে দাঁড়ায়। ঘোড়াটির পেছনে ডান দিকের পা দিয়ে তখন টাটকা রক্ত ঝরছিল।

জিৎ সিং হেসে বলে,—আপনার চেতকের মা আমার দোষে আহত হল।

—তোমার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল জিৎ।

—এমন ভুল জীবনে আর হবে না। আমাকে ক্ষমা করুন। ঘোড়াটির জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে।

—দুঃখ হলে উপায় নেই। ওর একটি পায়ের পরিবর্তে তোমার জীবন রক্ষা পেয়েছে সেইটুকুই যথেষ্ট।

—কিন্তু সত্যিই কি তাই?

—সত্যি হয়তো নয়। আবার মিথ্যেও নয়। কারণ বন্দুকের আওয়াজ পেয়েই বরাহটি মুহূর্তের জন্যে থেমে গিয়েছিল। গৌরী দেবীর আশীর্বাদে আমি সেই মুহূর্তটুকুর সদ্ব্যবহার করেছি।

কিকা রাম সিং-কে কাছে ডাকেন। সপ্রতিভ ভঙ্গিতে রাম সিং এগিয়ে আসে।

—নামটি কি যেন তোমার?

—আজ্ঞে রাম সিং।

—রাম সিং, তোমার হাতের নিশানা চমৎকার। এইভাবেই চিতোর প্রাকারে দাঁড়িয়ে মুঘলদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে লক্ষ্যভেদ করেছিলে বুঝি?

—আমি ঘাবড়ে গেছলাম।

কিকার কণ্ঠে ইস্পাতের কাঠিন্য,—জীবনে একটি দিনের তরেও যে বন্দুক নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে ঘাবড়ে গেলে অতখানি লক্ষ্যভ্রষ্ট তারও হয় না রাম সিং।

কিকা আবার বলেন,—তুমি বেশ ভালোরকম লক্ষ্য ক’রে ঘোড়াকে মেরেছ।

রাম সিং-এর চোখদুটো গোলাকার হয়ে ওঠে। তার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়।

কোনোমতে সে বলে,—না—না।

জিৎ সিং-এর দিকে ফিরে তাকান কিকা, –ব্যাপার কি জিৎ? কোনোরকম শত্রুতা রয়েছে তোমাদের মধ্যে।

জিৎ সিং রাম সিং-এর দিকে একবার চায়। ওই দুর্বিনীত মানুষটির চোখে অতটা ভয় ফুটে উঠতে পারে, সে ভাবতে পারেনি। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সে কিকাকে বলে,—না।

—কিন্তু আমি দেখেছি। বন্দুকের হাত আমার খারাপ নয় জিৎ। তাছাড়া শিকারের দলে স্থান লাভের জন্যে ওর আকুলতার কথাও এখন মনে পড়ছে।

—সবটাই দুর্ঘটনা কিকা। ওসব ভুলে যাওয়াই ভালো। আমরা বরাহ পেয়েছি। এ বরাহ প্রথম দেখেছি আমি আর এর মৃত্যু ঘটিয়েছেন আপনি। বন্দুকের গুলিতে এটি না মরে ভালোই হয়েছে জয়, গৌরী মায়ীজী জয়!

সমস্বরে সবাই গৌরী মায়ের জয়ধ্বনি করে।

কিকার দৃষ্টিতে প্রশংসা ফুটে ওঠে। অজিত সিং-এর পুত্র অস্ত্রশক্তির ওপর খুব বেশি বিশ্বাসী নয়। সে বুদ্ধি বলকে প্রথম স্থান দেয়। আজ তার বুদ্ধি সর্বপ্রথম তড়িৎ-চমকের মতো একটু দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। ভবিষ্যতের রাণা প্রতাপ সিংহ মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। রাম সিং-এর নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিল। অথচ এই নোংরা জিনিসকে চাপা দেবার জন্যে এমনভাবে গৌরীর জয়ধ্বনি করল জিৎ সিং যার ফলে রানার পুত্র হয়েও সেই প্রসঙ্গকে তিনি টেনে নিয়ে যেতে পারলেন না। বাহাদুর ছেলে বটে।

কিন্তু এই রাম সিং লোকটির ওপর এখন থেকে কড়া নজর রাখতে হবে। লোকটি কেন জিৎ সিং-এর ক্ষতি করতে চায় জানতে হবে। জিৎ সিং-এর মুখ থেকে কথা বের করা যাবে না। অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। ওদের সর্দার যশোবন্তকে প্রশ্ন করলে জানা যেতে পারে।

—রাম সিং।

—আজ্ঞে।

—তোমার ঘোড়া জিৎ সিং-কে দাও।

রাম সিং একটিও কথা না বলে, ঘোড়া থেকে নেমে লাগামটি জিৎ সিংকে দেয়।

—শোন রাম সিং, জিৎ-এর ঘোড়াকে তুমি আহত করেছ। একে প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব তোমার। এটিকে শুশ্রূষা ক’রে একে হাঁটিয়ে নিয়ে যেও।

—আজকের মধ্যে প্রাসাদে পৌঁছোনো সম্ভব হবে না তাহলে।

—আজ হোক, কাল হোক, একমাস দেরি হোক—একে রাজপ্রাসাদে পৌঁছে দেবার ভার তোমার। তুমি আজ মেবারের রানার সবচাইতে ভালো অশ্বটিকে আহত করেছ। ইচ্ছে করে আহত করেছ। আজ মহাপুণ্যের দিন। তাই তোমায় কিছু করতে চাই না। আজকের দিনের ঘটনার জেরও আমি টানতে চাই না। তবে ওই একটি হুকুম। ঘোড়াটিকে পৌঁছে দিতে হবে।

রাম সিং দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে,—এটি বাঁচবে কি?

—আমি ওই প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কারণ তোমাকে আমি চিনে গেছি। শোন রাম সিং, ও ঠিক বাঁচবে। ও মরতেই পারে না। পায়ের জোর শুধু কমে গেল বাকি দিনগুলির জন্যে। বয়স হয়েছে ওর—কতদিনই বা আর বাঁচবে। তবু ওকে সুস্থ করে তুলতে চাই। কারণ তুমি সারা জীবনের আপ্রাণ চেষ্টায় যতটুকু ক্ষতি করতে পার মানুষকে তার চেয়ে সহস্রগুণ বেশি উপকার ওই জীবটির কাছে থেকে আমরা পেয়েছি। তাই শূন্য হাতে প্রাসাদে ফিরে গিয়ে যদি হতাশ ভঙ্গিতে বল যে পথে আসতে আসতে ঘোড়াটি মারা গেছে, তবে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না। মনে রেখো, ওর মৃত্যু হলে, তোমারও মৃত্যু হতে বিলম্ব হবে না।

রাম সিং কাঁপতে কাঁপতে বলে,–আমি একে নিয়ে যাব।

সবার দিকে চেয়ে কিকা বলেন,—এবার চল। বরাহটিকে তুলে নাও।

রাম সিং-কে ফেলে রেখে সবাই ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলে। জিৎ সিং একবার পেছনে ফিরে দেখে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে রাম সিং।

একটু পরেই সূর্য পশ্চিমাকাশে অনেকটা এগিয়ে যাবে। তারপর তার রশ্মি নিস্তেজ হয়ে আসবে। তারপর গাঢ় অন্ধকার নেমে আসবে এই বনভূমির ওপর। হিংস্র পশুরা—যারা অনেক লোকের আগমনে এ-বন ছেড়ে দূরে সরে গেছে, তারাও ধীরে ধীরে ফিরে আসবে। একটিমাত্র বন্দুকের সহায়তায় কিভাবে তাদের সঙ্গে মোলাকাত করবে রাম সিং ভেবে পায় না জিৎ। শুধু নিজেকে বাঁচালে চলবে না—ঘোড়াটিকে বাঁচাতে হবে। ঘোড়াটির মধ্যেই রয়েছে রাম সিং-এর প্রাণ।

জিৎ সিং ঘুরে দাঁড়ায়।

কিকা থেমে যান।

জিৎ সিং বলে,—একটু আসছি।

কিকার কথার অপেক্ষা না করে সে রাম সিং-এর কাছে ফিরে যায়। কোমরে বাঁধা লীলাবতী আর শংকরীর তৈরি একগোছা রুটি খুলে নিয়ে রামের সামনে ফেলে দিয়ে বলে,—এগুলো রেখো।

—ধন্যবাদ।

জিৎ সিং একটু দূরে পাথরটার দিকে চায়। সেখানে বরাহটি থেমে গিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। রাম সিং-কে সে বলে,–ঘোড়াকে ওই পাথরের পাশে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করো।

—কেন?

—ওই পাথরে হেলান দিয়ে রাত কাটাতে পারবে। পেছন দিক থেকে পশুদের আক্রমণের ভয় থাকবে না।

—আবার ধন্যবাদ জানাই। হঠাৎ আমার মঙ্গলের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছো বলে মনে হচ্ছে।

—আমি এ অবস্থায় পড়লে কি করতাম তাই শুধু জানিয়ে গেলাম।

—যদি বেঁচে থাকি, তবে তোমার বন্ধুতে রূপান্তরিত হব এই আশা কর নাকি?

জিৎ সিং হেসে বলে,—মোটেই না। যেমন রয়েছ তেমনিই থাকো। আমার মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকবে তাহলে। নিশ্চিন্ত জীবন মানুষের মস্তিষ্ককে অকেজো ক’রে দেয় রাম সিং। মানুষ মূর্খে পরিণত হয়। আমি মূর্খ হতে চাই না। আমি অলসও হতে চাই না।

—একটা কথা জিৎ সিং।

—বল।

—ফিরে গিয়ে সবকিছু ওদের বলে দেবে না তো?

—না। আমি নিজে থেকে কিছু বলব না।

—বললেও, ভেবো না যে আমার ওখানে যাবার পথ বন্ধ হবে। আমি যাবোই।

—যেও। তোমাকে অভ্যর্থনার জন্যে আমিই প্রথমে এগিয়ে যাব।

—বিদ্রূপ করছ? সে-রাতে যে কথাটি বলেছিলাম মনে আছে?

—আছে।

—সেই কথা কয়টিই গেঁথে রেখো মনে।

—রাখব। তুমি ভাবতে পারনি যে বন্দুকের শব্দে বরাহটা অমন থেমে যাবে—তাই না রাম সিং।

—হ্যাঁ। ওটা বোকা।

জিৎ সিং হেসে ওঠে। বলে,—আচ্ছা চলি।

কিকার পাশে ফিরে গিয়ে পথ চলতে শুরু করে সে। কোনো প্রশ্ন করেন না কিকা।

জিৎ সিং ভাবে, অন্তত তিনদিনের আগে ফিরবার উপায় নেই রাম সিং-এর। এই তিনদিন একটু নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। ইতিমধ্যে যদি সে ভাগ্যবলে পাহাড়ী লোকদের সাহায্য পায়, তবে হয়তো একদিন আগে ফিরে আসতে পারে। এই দুদিন চোখকে তীক্ষ্ণ রাখতে হবে না—মনকে সজাগও রাখতে হবে না।

এদিকে লীলাবতী জিৎ সিং-এর চিন্তায় রীতিমতো ছটফট করে। বার বার বাইরে এসে দাঁড়ায়। জিৎ সিং-এর ঘরের কপাট তেমনি বন্ধ। আলো জ্বলছে না এখনো, অথচ সন্ধ্যা যে গাঢ় হয়ে এল। বরাহ শিকারে এত দেরি হয় নাকি? দিনের বেলা চেষ্টা করলে বনভূমির আভাস এখান থেকেই হয়তো পাওয়া যায়। এমন কিছু দূরে নয়। ওই বনেই তো কিকা গেছেন তাঁর দলবল নিয়ে। অন্ধকার থাকতে উঠে জোর কদমে ঘোড়া ছুটিয়ে মধ্যাহ্নের অনেক আগেই নাকি ওখানে পৌঁছনো যায়। তারপর বন-বাদাড় তছনছ করে একটি বরাহকে খুঁজে বের ক’রে মারা। কতটুকুই বা সময় লাগে?

ভাবতে ভাবতে লীলাবতী অস্থির হয়ে ওঠে। ছুটে শংকরীর পাশে এসে উপস্থিত হয়। জিৎ সিং-এর জন্যে কাল রাতে রুটি তৈরির সময় সব কথাই সে বলে ফেলেছে শংকরীকে। বলে পরম শান্তি পেয়েছে। শংকরী যে এত ভালো সে জানত না। মুখে যার শুধু রসিকতা আর বিদ্রূপ তার হৃদয় যে এতটা সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ থাকতে পারে, বাইরে থেকে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।

শংকরীর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে তার পিঠে হাত রেখে বলে,—খুব ভাবনা হচ্ছে। তাই না?

—হ্যাঁ। আমার মনে হচ্ছে শংকরী, ওর সঙ্গে আমি গেলে ভালো করতাম।

—তুমি মেয়ে।

—তাতে কি? অনেক পুরুষের চেয়ে ভালো ঘোড়া চালাতে জানি।

—তবু। মেয়েরা শুধু ঘরে বসে ভাবে। এই ভাবনাটুকুই পুরুষকে আবার ঘরে টেনে আনে। নইলে ওরা ঘর বাঁধতো নাকি?

—বাঁধতো না?

—কেন বাঁধবে? কী দায় পড়েছে ওদের?

—পুরুষের ওপর তোমার খুব আস্থা দেখছি?

—আমায় ভুল বুঝো না লীলা। এটাই ওদের স্বভাব। এই রকম ওদের স্বভাব বলেই আমরা মেয়েরা ওদের প্রতি আকৃষ্ট হই। ওদের ঘরে টানতে চেষ্টা করি। সফল হলে তৃপ্তি পাই।

—এসব নিয়ে তুমি খুব ভাব?

—না। ভাবব কেন? এসব ভাববার মতো অবকাশ তো পাইনি জীবনে।

—তোমার জীবনের কথা একদিন শুনব কিন্তু।

লীলা ছটফট করে।

—ভয় নেই। ও ফিরে আসবে একটু পরে।

লীলাবতীর গলার স্বর কেঁপে ওঠে,—কখন আর আসবে? রাত হয়ে এল।

—হয়তো এতক্ষণে প্রাসাদে পৌঁছে গেছে।

—না শংকরী। আমার যেন মনে হচ্ছে অমঙ্গল কিছু ঘটেছে। রাম সিং নিশ্চয়ই কিছু করেছে ওকে।

—পাগল? কিকা রয়েছেন সঙ্গে। ওর ঘাড়ে কটা মাথা আছে?

—ওকে তুমি চেনো না।

—আমি চিনি।

—না। চেনো না। লীলাবতীর স্বর আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে।

শংকরী একটু চুপ করে থেকে বলে,—তুমি চেনো?

—হ্যাঁ।

শংকরী লীলাবতীর মুখের দিকে চায়।

লীলা একটু ইতস্তত করে। জিৎ সিং বার বার মানা ক’রে দিয়েছে, চিতোর ছেড়ে আসবার পরের দিনের সেই অসিযুদ্ধের কথা কাউকে বলতে। কাউকে সে বলত না হয়তো। কিন্তু শংকরীর মতো রমণীকে সব বলা যায়। শংকরী কেন, নিদারুণ দুর্ভাবনার চাপে পড়ে যাকে তাকে বলে ফেলা যায় সেদিনের ঘটনা। তবু সে অন্য কেউ হলে বলত না।

একে একে সব কথা বলে দেয় লীলা। বলে দেয়, তার ওপর রাম সিং-এর দৃষ্টি চিতোর ছেড়ে আসবার অনেক আগে থাকতেই ছিল। রাখীর ব্যাপার, যা সে সন্দেহ করে তাও বলে। সব চাইতে শেষে বলে, জিৎ সিং-এর সঙ্গে রাম সিং-এর অসিযুদ্ধের ঘটনা আর তার ফলাফল। শংকরী স্তব্ধ হয়ে শোনে, লীলার কথা শেষ হবার পরও অনেকক্ষণ সে কোনো কথাই বলে না। তারপর ধীরে ধীরে স্বগতোক্তি করে—এবারে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার অনুমান মিথ্যে নয়।

—কী অনুমান শংকরী?

—এখন বলব না। কাল সকালে। সবার সামনে। রাম সিং-কে আমি দল ছাড়তে বাধ্য করব কালই।

শংকরীর হিংস্র মুখের দিকে চেয়ে লীলাবতী বিস্মিত হয়। এ যেন অন্য এক স্ত্রীলোক আসল শংকরীর সঙ্গে এর কণামাত্র মিল নেই।

—রাম সিং-কে তুমি এত ঘৃণা কর, আমি জানতাম না শংকরী।

—ঘৃণা আমি সহজে করি না মানুষকে। অনেক পুরুষ নিজেদের উন্নতি আর নিজেদের খ্যাতির জন্যে যে কতরকম হীন কাজ করে, তুমি জান না। তবু আমি সেজাতীয় পুরুষকে ঘৃণা করি না। নিজের উন্নতি সবাই চায়। খ্যাতিও তো পুরুষের ভূষণ। অলঙ্কারের জন্যে যদি মেয়েদের মনে লোভ আর হিংসার উদ্রেক হতে পারে, খ্যাতির জন্যে পুরুষের মনে তা হবে না কেন? সব পুরুষকে ভগবান মহৎ ক’রে সৃষ্টি করেননি। খুব কম পুরুষকেই তিনি তেমনি ভাবে সৃষ্টি করেন। পুরুষের চরিত্রও অতটা নীতিঘেঁষা হতে পারে না। আজ একটি মেয়েকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসছে—কাল তাকে ভুললেও ভুলে যেতে পারে। এমন হয় লীলাবতী। এতেও আমি দোষ দিই না। কিন্তু যে পুরুষ কৌশলে নিজের পশুপ্রবৃত্তির চরিতার্থতার জন্যে নিরপরাধ সরল প্রকৃতির মেয়ের সর্বনাশ করে, তাকে আমি ঘৃণা করি। তাকে আমি হত্যা করতে পারি। সম্ভব হলে তাই করব।

শংকরীর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। তার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হয়।

—কিন্তু সে তো আমার সর্বনাশ করতে পারেনি শংকরী। চেষ্টা করেছিল মাত্র। তবে রাখীর ওপর তার প্রভাব রয়েছে বটে। কারণ রাখী তাকে ভালোবাসে।

—ভালোবাসে। হ্যাঁ, রাখী হয়তো তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে? সে কি রাখীকে ভালোবাসে? না। সে ওই কচি মেয়েটির মনে ভালোবাসা জাগিয়ে তুলে তার সর্বনাশ করেছে লীলাবতী। সে রাখীর সব সুখ, সব সাধ আশা থেকে তাকে চিরজীবনের মতো বঞ্চিত করেছে।

—ভালোবাসার প্রতিদান না পেয়ে এমন পাগল হয়েছে রাখী?

—না। ভালোবাসলেই তার প্রতিদান পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। না, সেজন্য রাখী পাগল হয়নি। তাতে কয়জনই বা পাগল হয়?

—আমি হব। আজ যদি জিৎ সিং—

—তবু হবে না লীলাবতী। আমি জানি অতটা দুর্বল ধাতের মেয়ে তুমি নও।

—তবে রাখী পাগল হল কেন?

—এক বিষাক্ত দুশ্চিন্তা তাকে পাগল করেছে। সে মা হতে চলেছে।

লীলাবতী চিৎকার করে ওঠে,—শংকরী!

—হ্যাঁ লীলাবতী। এবং রাম সিং এর জন্য দায়ী। রাখীকে ভালোবাসতে না পারলে তার অপরাধ হত না। কিন্তু ভালোবাসার ছলনা ক’রে এই সর্বনাশ করেছে। রাম সিং-কে আমি বাঁচতে দিতে পারি না লীলাবতী। দিলেও, তাকে দল ছাড়া করব। করবই।

লীলাবতী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েও সে এভাবে কাঁদতে পারেনি। জিৎ সিং-এর কথা তার মন থেকে মুছে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার প্রিয় সখীর বেদনা-ক্লিষ্ট মুখখানি। বেচারা, কত আশা নিয়ে ছুটে আসত তার কাছে সব কিছু বলবার জন্যে। অথচ বলতে পারত না। বোবা হয়ে যেত। কারণ এ এক ঘোরতর কলঙ্কের কথা। একি বন্ধুকেও বলা যায়? বন্ধু যদি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই ভয়েই কাছে ছুটে এসেও শেষপর্যন্ত কিছু বলতে পারত না রাখী। শুধু মুখ থেকে তার আর্তনাদ বের হয়ে আসত,—আমি মরেছি ভাই। আমি মরেছি।

যত ভাবে, ততই চোখ দিয়ে অবিরল ধারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে লীলাবতীর। হয়তো কাউকে নিশ্চিন্ত মনে সব কিছু বলতে পারেনি বলে, কারও ওপর নির্ভর করতে পারেনি বলেই রাখী আজ পাগল হয়েছে। নইলে সে ভালোই থাকত। রাখীর শৈশবের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও রাখী তার ওপরও নির্ভর করতে পারেনি।

—আমি চলি শংকরী।

—কোথায়?

—রাখীর কাছে।

—এই অন্ধকারে?

—হ্যাঁ। এই অন্ধকারে। এ অন্ধকার তো শুধু বাইরের। এই অন্ধকারের পর আবার সূর্য উঠবে। কিন্তু রাখীর মনের ভেতরটাই যে অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করব সেখানেও যাতে সূর্য ওঠে আবার। আমি চেষ্টা করব শংকরী।

শংকরী একটু ভেবে নিয়ে বলে,–বেশ। তবে আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

—জিৎ যদি এসে ফিরে যায়।

—ফিরে গেলেও নিজের ঘরেই সে যাবে।

উভয়ে অন্ধকারের মধ্যে রাখীদের কুটিরের দিকে রওনা হয়। মামার কাছে থাকে রাখী। সেই মামা তাকে তেমন ভালো না বাসলেও দুর্ব্যবহার করে না। মামীও ভালো মানুষ।

দুজনা রাখীর ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়।

ভেতরে মামা আর মামী রাখীকে ডাকছিল,—ও রাখী। রাখী। তুই কি খেয়েছিস ঠিক ক’রে বল।

—কিছু না।

মামী আকুলভাবে বলে—বল রাখী। আমার মাথা খাস, বল মা। তোর শরীর অমন করছে কেন? তুই কি শেষে সর্বনাশ করলি?

লীলা চমকে ওঠে। ছুটে গিয়ে সজোরে কপাটে ধাক্কা দিতে থাকে।

—কে—কে?

—আমি। আমি লীলা—লীলাবতী।

তাড়াতাড়ি দরজা খুলে যায়। লীলার পাশে শংকরীকে দেখে রাখীর মামী যেন ভরসা পায়। তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরে বলে,—তুমি এসেছ। দেখো না গো, রাখী কেমন করছে। বোধহয় বিষ খেয়েছে।

—বিষ?

ওরা ছুটে যায় রাখীর পাশে। ভেতরের যন্ত্রণায় সে তখন শয্যার ওপর ছটফট করছে। তবু লীলার কণ্ঠস্বর পেয়ে চোখ খোলে সে। অতি কষ্টে বলে,–এই সময়ে তুই এলি লীলা? ভালোই করেছিস। আমি প্রায়শ্চিত্ত ক’রে গেলাম।

—কোথায় তুই যাবি রাখী। আমি তোকে যেতে দেব না।

রাখীর যন্ত্রণাকাতর মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। ওই হাসি পাগলের হাসি নয়। অতি শান্ত এবং সুস্থ প্রকৃতির হাসি। তার মন আজ আর রক্তাক্ত দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত নয়, তাই সে সুস্থ। লীলার একটি হাত চেপে ধরে বলে,—পারবি না সই। আমি বিষ খেয়েছি।

শংকরী মামীকে বলে, তাড়াতাড়ি খানিকটা লবণ-জল এনে দাও। ওকে খাইয়ে দেব। লবণ-জল তাড়াতাড়ি আসে বটে—কিন্তু রাখীকে খাওয়ানো যায় না। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকে সে। শেষ সময়ের সমস্ত শক্তিটুকু দিয়ে সে এদের প্রতিরোধ করে। এরা তাকে বাঁচাতে চায়। কিন্তু সে বাঁচতে চায় না। সে মরবেই।

হতাশ হয়ে সবাই যখন লবণ-জলের পাত্রটি পাশে রেখে দেয়, তখন রাখীর চোখ ফেটে জল আসে। সে বলে,—আমাকে আর কষ্ট দিও না। এমনিতেই খুব যন্ত্রণা।

মামী এবারে কেঁদে ফেলে বলে,—না। আর তোকে কষ্ট দেবো না মা। তুই শান্তিতে যা।—লীলা, আমি অনেক আগে জানতাম আমি মরব। না মরে উপায় ছিল না সই। সংসারে আমার জায়গা হত না।

—হত সই। সেজন্যেই ছুটে এসেছিলাম। সংসারে তোর জায়গা না হলে, আমি তোকে ছাড়তাম না। জিৎ সিং-এর বিনিময়েও না।

—তুই কিছু জানিস না।

—আমি সব জানি। সব শুনেছি। শংকরীর মুখে এইমাত্র শুনেই তো চলে এসেছি। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেল, আমি জেনেছি এর জন্যে দায়ী কে?

মামা আর মামী একসঙ্গে বলে ওঠে,—কিসের জন্যে দায়ী মা?

শংকরী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,—না, কিছু নয়।

মামা বলে,—আমি বুঝতে পেরেছি। আমার কেমন সন্দেহ হত। কিন্তু এমন যে হতে পারে, আমি ভাবিনি। ওর রকম-সকম দেখেও নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিন্তু কে সেই জঘন্য লোকটা, যে হতভাগীর সর্বনাশ করল? কে? বল তোমরা আমাকে। আমি এখুনি ছুটে যাব। এক্ষুনি আমি যাব রানার কাছে। বিচার চাইব। বিচার চাই।

মামী মেঝের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। সেদিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। কারণ ঠিক সেই সময়ই রাখীর দেহ ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসে। তার চোখের শেষ আলো স্তিমিত হতে হতে নিভে যায় এক সময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *