আরাবল্লী – ৬

৬.

এরপর কিছুদিন কাটে।

একদিন সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘর তৈরির সরঞ্জাম নিয়ে লোকজন আসতে শুরু করে। রানা পাঠিয়েছেন তাদের। কালপীর দলটির জন্যে সাময়িকভাবে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে। অনিশ্চিত অবস্থায় খোলা জায়গায় দীর্ঘদিন স্ত্রীলোক আর শিশুদের পড়ে থাকতে দেওয়া যায় না। অনেক কষ্ট তারা করেছে—এবারে অন্তত কিছুটা নিশ্চিন্ত হোক।

ঘরগুলি খুব মজবুতভাবে তৈরি করা সম্ভব হবে না—তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। নতুন রাজধানীতে গৃহসমস্যা রয়েছে। কিছু কিছু বাড়িঘর উঠলেও তাদের সংখ্যা খুবই কম। রানা চান, এদের মাথার ওপর সাময়িকভাবে একটা আচ্ছাদানের ব্যবস্থা করতে। তারপর এরা নিজেরাই ধীরে-সুস্থে মজবুত গৃহ তৈরি ক’রে নেবে।

যশোবন্ত সিং সবাইকে ডেকে বলে,–তোমরাও হাতে লাগাও। রানার এই সুমতির পেছনে রয়েছে কিকার পরামর্শ।

সেকথা বুঝতে কারও বাকি ছিল না। নইলে শংকরী জগমলের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করেছে, রানার বিরুদ্ধে যেরকম মন্তব্য করেছে তাতে ঘরের পরিবর্তে ওই জেলের ভেতরে আশ্রয় নেবার ব্যবস্থা হতে পারত।

যশোবন্ত বলে,—রানার সঙ্গে এবারে দেখা করতে যেতে হয়। ঘর তৈরির জিনিসের জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসা উচিত। এখনি চল না কেন? সবাই নয়। কেউ কেউ এস। জিৎ সিং যাবে নাকি?

—হ্যাঁ।

সেই প্রৌঢ়, যে অজিত সিংকে চিনত, সে-ও এগিয়ে আসে। এই দলটির মধ্যে বৃদ্ধের পরেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল জিৎ সিং-এর। কিন্তু প্রথমদিনের পর আর বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। তাকে দেখতে পায়নি জিৎ সিং কাছেপিঠে। শুধু দ্বিতীয় দিনে—যেদিন লীলাবতীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল—সেদিন দেখেছে ঘুমে কাতর মানুষগুলোকে কাঠির খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে রাখছে। পরে শুনেছে প্রৌঢ়ের অসুস্থ স্ত্রী রয়েছে দলে। তার দিকে বেশি নজর রাখতে গিয়ে মাঝে মাঝে সে অমন দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। স্ত্রী একটু সুস্থবোধ করলে আবার ফিরে আসে সবার মধ্যে আজ তার স্ত্রী সুস্থ।

প্রৌঢ় জিৎ সিংকে প্রশ্ন করে,—শুনলাম, তোমার পরিচয় পেয়েছেন কিকা?

—হ্যাঁ।

—তবে তো আমাদের ছেড়ে চললে।

—কেন?

—অজিত সিং-এর ছেলেকে তিনি এখানে রাখবেন ভেবেছ?

—কেন রাখবেন না?

—রাখতে পারেন না। তোমায় তিনি নিজের কাছে নিয়ে যাবেন।

—আমি যাবো না।

—তা হয় না জিৎ সিং। তিনি বললে তোমায় যেতেই হবে। তাছাড়া এখানে পড়ে থেকে শুধু শুধু কষ্ট করবে কেন?

—কষ্ট? তেমন কষ্ট তো তোমরাও করছ।

—আমাদের কথা আলাদা।

—কারও কথাই আলাদা নয়। সবাইকেই বোধ হয় কষ্ট করতে হবে এবার থেকে। আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না। অন্তত যতদিন এখানে আছি।

—তুমি অন্য কোথাও যাবে নাকি? চিতোরে ফিরে যাবে ভাবছ? –না, চিতোর নয়।

একটা অস্পষ্ট পথ দেখতে পাচ্ছে যেন জিৎ সিং, সে বুঝতে পারছে, এখানে পড়ে থাকবার জন্যে সে আসেনি। সে যাবে অন্যত্র। কিন্তু কোথায় যাবে, তা সে জানে না। শুধু এইটুকু জানে যেখানে গেলে অসির চেয়ে বুদ্ধিকে বেশি কাজে লাগানো যায় সেখানেই তাকে স্থান ক’রে নিতে হবে।

যশোবন্তের সঙ্গে সাত-আটজন লোক চলল প্রাসাদের দিকে। রানার সামনে নিজেকে উপস্থিত করতে হলে যেটুকু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয় সেটুকু করবার মতো অবস্থাও এদের নেই, এদের বাড়তি পোশাক নেই সঙ্গে। যে পোশাকে চিতোর ছেড়ে বের হয়েছে সেই পোশাক একটানা ব্যবহারে অতি মলিন। তবু মনে কোনো সংকোচ নেই। যোদ্ধার জাত এরা। পোশাক-পরিচ্ছদ আর চেহারার জন্যে সংকোচ করতে এরা শেখেনি, এদের যত সংকোচ লক্ষ্যভেদ না হলে। বন্দুক উঁচিয়ে নিয়ে গুলি ছুড়ে যদি দেখতে পায় এরা যে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে তবে এদের মুখ রাঙা হয়ে ওঠে—মাথায় করাঘাত করে এরা।

অনুর্বর পাহাড়ী রাস্তা ধরে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলে যশোবন্তের দল।

কোথায় চিতোর আর কোথায় এই নতুন রাজধানী। ইতিমধ্যে এর নামও নাকি স্থির হয়েছে একটা। দলের দু-চারজন এখানকার পথে-ঘাটে ঘুরে শুনতে পেয়েছে অনেকই জায়গাটিকে বলছে উদয়পুর। নাম একটা হলেই হল। কিন্তু তার সঙ্গে উদয় সিং-এর স্মৃতি জড়িত হয়ে থাকবে ভাবতেও যেন কেমন লাগে। উদয় সিং নামটি যেন রাজোয়ারার পক্ষে ঘোর অমঙ্গলসূচক। ভবিষ্যতে যদি এই বংশে কিংবা অন্য কোনো রাজপুত রাজার বংশে উদয় সিং নামে কেউ জন্মায় এবং সে যদি সিংহাসন পায়, তবে সেও এমনি চরিত্রের পুরুষ হবে। অন্যরকম হতেই পারে না। উদয় সিং নামটি রাজোয়ারা থেকে মুছে যাওয়া উচিত? ঢেঁড়া পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে। সে একঘরে হবে। এমনি একটা নিয়ম চালু হলে বেশ হত। কিন্তু তা হবার নয়।

যশোবন্ত সিং ভাবে, বৃথাই ধাত্রীপান্না পুত্রের জীবন বলি দিয়েছিল বাপ্পার বংশ রক্ষা করতে। বনবীরের খঙ্গ সে সময়ে যদি উদয় সিংহকে খুঁজে পেত, তাহলে চিতোরের পতন নাও হতে পারত। বনবীর যেমনই হোক না কেন, সে কাপুরুষ ছিল না। সে যে কাপুরুষ ছিল না, তার অনেক প্রমাণ রয়েছে।

ধাত্রীপান্না আজ বেঁচে থাকলে ক্ষোভে দুঃখে আত্মহত্যা করতেন। চল্লিশ বছরের আগের সেই ঘটনা মনে ক’রে এতদিন পরে নিজের গর্ভের পুত্রের শোকে বোধ হয় পাগল হয়ে যেতেন। বেঁচে না থাকায় বেঁচে গেছেন তিনি।

যশোবন্ত তার মনের কথা জিৎ সিং-এর কাছে প্রকাশ করতেই সে বলে ওঠে, তা কেমন ক’রে হবে?

—কেন?

—উদয় সিংহ যেমনই হোন, তিনি না বাঁচলে বাপ্পা বংশের কিকা কোথা থেকে আসতেন?

—তা বটে। ঠিক। এতটা তো আমার মাথায় আসেনি। বুড়ো হয়েছি কিনা? তাই মগজটা আগের মতো সক্রিয় নেই। কিন্তু চিতোর? চিতোর যে চলে গেল?

—চিতোর হয়তো এমনিতেই যেত। জয়মল্ল আর পট্ট যে বীরত্ব দেখিয়েছেন, তার পরেও যখন ওরা ঢুকতে পারল, তখন হয়তো রানা উপস্থিত থাকলেও অন্য কোনো কিছু ঘটত না।

যশোবন্ত রেগে ওঠে,–তোমার এ কথা আমি মানি না। জয়মল্ল আর পট্ট বীর ছিলেন। শুধু বীর নন—তাঁরা ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ। কিন্তু রানার উপস্থিতি রাজপুত সৈন্যের মনে কতখানি প্রেরণা জাগায়, সে খবর তুমি রাখো না। বুদ্ধি থাকলেও তোমার অভিজ্ঞতা কম।

অভিজ্ঞতার কথা যশোবন্ত সুযোগ পেলেই শুনিয়ে দেয় সবাইকে। কারণ সে ভালোরকম জানে, সাধারণ মানুষের চেয়ে সে বুদ্ধিমান হলেও, প্রকৃত বুদ্ধিমানের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা তার নেই। তীক্ষ্ণতা থাকলে গোপাল সিং-এর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সে জিতে যেতে পারত। সে সর্দার হতে পারত। তাই পক্ককেশ আর অভিজ্ঞতাই তার সম্বল। অভিজ্ঞতা তার সত্যই রয়েছে। চিতোর ছেড়ে আসবার পথে যে সব গল্প করেছে যশোবন্ত—সেই সব গল্প শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। মনে হয় যেন রূপকথা শুনছে। যশোবন্ত খুবই ভালো যোদ্ধা ছিল যৌবনে।

যশোবন্তকে রাগতে দেখে একজন রাজপুত প্রশ্ন করে,—হঠাৎ রেগে উঠলে কেন সর্দার? যাচ্ছো তো রানা-দর্শনে। এখন রাগের কি হল?

জিৎ সিংকে দেখিয়ে বৃদ্ধ বলে,—এই সব ছেলেমানুষদের কথা শুনে মাঝে মাঝে রাগ হয়, দুঃখও হয়। কোনো অভিজ্ঞতা নেই এদের।

—কি ক’রে থাকবে বল? কতই বা বয়স। তোমার এত বয়সেও তো অনেক বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই।

‘সর্দার’ সম্বোধনে যশোবন্তের মনটা ভিজে উঠেছিল। কিন্তু লোকটির বাঁকা কথা শুনে সে থমকে দাঁড়ায়।

—তার মানে?

—বিয়ে না করলে কি মানুষের কোনো অভিজ্ঞতা হয় সর্দার?

—হয় না?

—না। তার যত অভিজ্ঞতাই থাকুক, সে পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে না।

—এ জ্ঞান কোথা থেকে পেলে হে তুমি?

—এ আমার নিজের অভিজ্ঞতা।

যশোবন্ত একটু স্থির হয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলে,–তোমার কথা মানলাম। কিন্তু বিয়ের সমস্ত ঠিক হয়েও সেই বিয়ে বন্ধ হয়ে যাবার অভিজ্ঞতা আছে তোমার? তেমন ঘটনার মধ্যে পড়লে মনের কী অবস্থা হয়। সে অভিজ্ঞতা আছে? বল? আমার কথার জবাব দাও।

—না।

—আমার আছে। সুতরাং দেখতে পারছ, জগতে কোনো মানুষই পরিপূর্ণ নয়।

—তাই বুঝি তুমি বিয়ে করনি?

—হ্যাঁ।

—সবটা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলবে?

—সে সব পুরোনো কথা এতদিন পরে টেনে এনে লাভ কি?

—তবু শুনি। অবিশ্যি বলতে যদি আপত্তি না থাকে তোমার।

—না। আমার আপত্তি হবে কেন? এমন কিছু চমকপ্রদ ঘটনা নয়। তবে সেই বয়সে আমার মনকে বড্ড বেশি নাড়া দিয়ে গেছল।

সবাই যশোবন্তের একেবারে কাছে এসে উৎকর্ণ হয়। লোকটি সম্বন্ধে এতদিন তাদের বিশেষ কোনো কৌতূহল ছিল না। কিন্তু সর্দার হবার পর থেকে তার সম্বন্ধে কিছু জানবার আগ্রহ হওয়া স্বাভাবিক।

যশোবন্ত একটু ভেবে নিয়ে বলে—অনেকদিন আগের কথা। আমাদের দলে দেবী সিং বলে একজন লোক ছিল। তার সঙ্গে আমার বাবার ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। সেই দেবী সিং-এর একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটির বুদ্ধির খ্যাতি ছিল সে সময়ে খুব। আমি কখনো মেয়েটিকে দেখিনি। কিন্তু জানতাম তার সঙ্গেই আমার বিয়ে হবে। জন্মের দিন থেকেই সে আমার স্ত্রী হিসাবে নির্দিষ্ট হয়ে ছিল। দেবী সিং মাঝে মাঝে বাবাকে বলত, একবার আমাকে নিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে দেখিয়ে আনতে। কিন্তু আমার বাবার মনোভাব ছিল অন্যরকম। তিনি বলতেন, বিয়ের সময়ে অচেনা মেয়েটিকে বউ হিসেবে দেখতে পাবার একটা বিশেষ আনন্দ আছে, সেই আনন্দ থেকে তিনি আমাকে বঞ্চিত করতে চান না। দেবী সিং শুনে হাসত। শেষে একদিন হাসতে হাসতে বলে ফেলল, তার মেয়ে কিন্তু স্বামীকে দেখে নিয়েছে। মেয়েরা এ ব্যাপারে নাকি খুব বেশি রকম কৌতূহলী। একজনকে তার স্বামী হিসেবে জেনেও দেখবার চেষ্টা না ক’রে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, এত বোকা মেয়ে ভূভারতে নেই। কালপীর এক মেলায় সেই মেয়ে তার ভারী স্বামীকে ভালো ক’রে দেখে নিয়েছিল। আসলে স্বামীকে দেখবার জন্যেই সে মেলায় গিয়েছিল। বাবা প্রশ্ন করেছিলেন পছন্দ হয়েছে তো? দেবী সিং বলেছিল, বাবা হয়ে সেকথা সে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি। তবে হাবভাব দেখে আর তার সখীদের কাছে খোঁজ নিয়ে তার মা জানিয়েছে—খুব পছন্দ হয়েছে।

সামনে প্রাসাদ দেখা যাচ্ছিল। জিৎ সিং চঞ্চল হয়ে ওঠে। চঞ্চল হয়, কিকাকে আবার দেখতে পাবে বলে।

যশোবন্ত তার চঞ্চলতা লক্ষ্য ক’রে বলে,—এখন তবে আর বলে কাজ নেই। পরে একসময় বলব।

—না না, এই পথটুকু শুনতে শুনতে চলি। খুব ভালো লাগছে। তোমার চেহারা খুব ভালো ছিল তাই না?

যশোবন্ত হেসে বলে, কাঠামো, কেমন দেখছ?

জিৎ সিং বলে,—সুন্দর। এত বয়সেও এই রকম ঋজু শরীর দেখা যায় না।

—মুখ-চোখও নাকি ভালো ছিল আমার।

—বল।

—বিয়ের সব ঠিকঠাক। মেয়ের বুদ্ধির সুখ্যাতি চতুর্দিকে। আমার বীরত্বের খ্যাতি তার তুলনায় স্নান হবার কারণ, তখন পর্যন্ত বড় কোনো যুদ্ধ আমি করিনি। তবু সে আমার ঘরে আসবে—এই কল্পনায় নিজের ক্ষুদ্রত্ব চোখে পড়ছিল না। এমনি যখন অবস্থা, তখন আমার বাবার সঙ্গে দেবী সিং-এর এক অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল। জীবনে যাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয়নি কখনো, তাদের হঠাৎ পরস্পরের প্রতি এতখানি বিদ্বেষের কারণ কেউ বুঝতে পারল না। সবাই আশা করল, এ বিদ্বেষ ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আসলে তা নয়। মুখদর্শন বন্ধ হল পরস্পরের। কখনো মুহূর্তের বিচ্ছেদও হয়নি বলে বোধহয় এতটা সাংঘাতিক হয়ে উঠল তাদের সম্পর্ক।

যশোবন্ত একটু দম নিয়ে বলে,—দেবী সিং-এর মেয়ের প্রতি লোভ অনেকেরই ছিল। তারা এই সুযোগ গ্রহণ করল। একজন ধনী তার একমাত্র পুত্রের জন্যে মীরাকে চেয়ে বসল।

যশোবন্ত সংকুচিত হয়ে বলে ওঠে,—নামটা বলে ফেললাম। যাক, ক্ষতি কি? ও নাম অন্য অনেকেরই তো থাকতে পারে। ওই মেয়েটি এতদিনে হয়তো পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। সেকি আজকের কথা? আজকের কথা না হলেও যেদিন শুনলাম দেবী সিং ধনী লোকটির ছেলের সঙ্গেই মীরার বিয়ে স্থির করেছে, সেদিনের কথা মনে হলে আজও বুকের ভেতরে কেমন ক’রে ওঠে। সেদিন এবং তার পরে পুরো একটি বছর দিনে কিংবা রাতে কোনো সময়েই আমি ঘুমোতে পারিনি। বাবা ভেবেছিল, মেয়েটিকে অন্য কোথাও বিয়ে দেবার মতো হীন মনোবৃত্তি তার বন্ধুর হবে না। কিন্তু ভুল ভেবেছিল। তাই বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় সমস্ত সম্মান বিসর্জন দিয়ে ছুটে গেছল তার বাড়িতে। বলেছিল,—এ বিয়ে দিও না দেবী। এ বিয়ে হতে পারে না। উত্তরে দেবী সিং বলেছিল,–এ বিয়ে হবেই। অন্য কোথাও আমার মেয়ের বিয়ে হবে না। বাবা কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এসে বলেছিল,—আমিও তোর বিয়ে দেব। খুব সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব। দেখিয়ে দেব ওকে, ওর মেয়ের চেয়েও লক্ষগুণ ভালো মেয়ে আমার পুত্রবধূ। বাবার কথায় আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম,—তা হয় না। আমি আর বিয়ে করব না। স্তম্ভিত বাবা অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে বলেছিল, পারবি? আমি বলেছিলাম,—পারব।

যশোবন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, তাই আজ আমি তোমাদের মতো পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারিনি। মেয়েটিও পারেনি। কারণ বিয়ের ঠিক দুদিন পরেই তার স্বামী এক দুর্ঘটনায় হঠাৎ মারা যায়।

জিৎ সিং নির্বাক হয়ে থাকে। অন্য কয়েকজনেরও মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। যে বৃদ্ধকে এযাবৎ তারা একজন সাধারণ লোক বলে ভাবত, সে হঠাৎ অসাধারণ হয়ে দেখা দেয় তাদের চোখের সামনে। মানুষকে খালি চোখে দেখে চেনা আর বিচার করার মতো নির্বুদ্ধিতা বোধহয় কিছু নেই।

জগমল পায়চারি করছিল প্রাসাদের সামনে। রীতিমতো চিন্তিত সে। সারামুখে উদ্বেগের ছাপ। কিছু দূরে কয়েকজন কর্মচারী তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতি মুহূর্তে তাদের ভয়, এখনি বুঝি ফেটে পড়বে রাজকুমার। অথচ দোষ তাদের কিছুই নয়। তারা রানার আদেশ পালন করেছে মাত্র। তবে সেই আদেশ এসেছে কিকার মাধ্যমে। কিকাই তাদের বলেছিলেন গৃহ নির্মাণের যাবতীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ ক’রে কালপীর দলের কাছে পাঠাতে। সেই অনুযায়ী তারা সংগ্রহ করেছে সবকিছু। ভোর না হতেই পাঠিয়ে দিয়েছে কিছুটা। বাকি সব স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে সামনে।

জগমল চেঁচিয়ে ওঠে,—এসব বন্ধ কর এক্ষুনি। বুঝলে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—আজ্ঞে হ্যাঁ নয়। তোমরা আমার সব কথাতেই ভালো মানুষের মতো ‘আজ্ঞে হ্যাঁ’ বলে সরে পড়। তারপর সেই কাজগুলোই কর। ওসব চলবে না। এইসব কাঠ বাঁশ এমনিভাবেই পড়ে থাকবে। একটিও এখান থেকে আর নিতে পারবে না।

—কিন্তু রানার আদেশ।

—রানার নয়, কিকার।

—তিনি বলেছেন, রানার আদেশ।

—মিথ্যে কথা বলেছে।

কর্মচারীরা চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের মনে প্রবল অসন্তোষ। কিন্তু মুখে ফুটে কিছু বলতে পারে না। তারা ভালোরকম জানে, কিকা কখনো মিথ্যা কথা বলেন না। কিন্তু সেকথা প্রকাশ করবে কে? জগমল যে রানার নয়নের মণি।

ঠিক সেই সময়ে যশোবন্ত তার সঙ্গীদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। জগমল কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাদের চেয়ে চেয়ে দেখে। ঠিক চিনে উঠতে পারে না।

যশোবন্ত তার সামনে গিয়ে অভিবাদন জানায়।

—কে তোমরা?

—আমরা এলে প্রথমে আপনিই আমাদের কাছে গিয়েছিলেন।

—ওঃ তোমরা? এখানে কেন এসেছ? যাও, চলে যাও।

জগমল রাস্তার দিকে আঙুল নির্দেশ করে।

জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরে ধক করে ওঠে। অদ্ভুত ঔদ্ধত্য এই রাজপুত্রের যশোবন্ত শান্তস্বরে বলে,– আমরা রানার দর্শনপ্রার্থী।

ব্যঙ্গের হাসি হাসে জগমল—দর্শনপ্রার্থী? প্রার্থী হলেই কি দর্শন মেলে? মহারানা পথে-ঘাটে পাথরের কুচির মতো পড়ে থাকেন না। তাঁর দর্শন পেতে হলে যোগ্যতার প্রয়োজন।

—আমাদের সেই যোগ্যতা হয়তো নেই। তবে তিনি আমাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দিচ্ছেন—তাই কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি। তাঁর দয়ার সীমা নেই।

—এই কয়দিনের মধ্যে তিনি দয়াবান হয়ে গেলেন? সেদিন তাঁর সম্বন্ধে তোমরা কি বলে ছিলে মনে নেই?

—মনে আছে। তবে সেকথা তো আমরা বলিনি। একটা পাগলী বলেছিল।

—না। তাকে পাগলী সাজিয়ে, তার মুখ থেকে আমাকে শুনিয়ে দিয়েছিলে। তোমরা চতুর—তোমরা শঠ।

এবারে জিৎ সিং গম্ভীরস্বরে বলে,—আমরা শঠ নই।

—তুমি চুপ করো ছোকরা।

জিৎ সিং প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু যশোবন্তের ইশারায় থেমে যায়। যশোবন্ত প্রশ্ন করে, –সত্যিই কি রানার সাক্ষাৎ পাবো না?

—না। না। না।

—তবে আমরা এখানেই বসলাম। বসে পড় হে তোমরা। যতক্ষণ রানার সাক্ষাৎ না মেলে আমরা নড়ব না।

জগমল চেঁচিয়ে ওঠে,—উঠে পড়। উঠে পড় বলছি।

—আজ্ঞে না। রানা আমাদের অশেষ উপকার করেছেন। তাঁকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে আমরা এক চুলও নড়ছি না।

—তবে শোন। তাঁর উপকার এই দণ্ডে বন্ধ হয়ে যাবে। ওই যে দেখছ, তোমাদের ঘর তৈরির জিনিস সব পড়ে রয়েছে—ওগুলোতে এখুনি আগুন ধরিয়ে দেব।

জগমল আগুন ধরাবার আয়োজন করতেই একজন কর্মচারী তার অলক্ষ্যে ছুটে প্রাসাদের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যায়।

একটু পরেই বের হয়ে আসেন কিকা। তাঁকে দেখে নিশ্চিন্ত হয় যশোবন্ত।

—এ কী! তোমরা মাটিতে বসে কেন? ওঠো। ভেতরে চল।

—ওরা রানার দর্শন না পেলে নাকি নড়বে না।

কর্মচারীটির মুখে সবই শুনেছিলেন কিকা। কিন্তু কিছুই ভাঙলেন না। শুধু বললেন,—হ্যাঁ, রানাই তো ওদের ডাকছেন। সেই কথাই বলতে এলাম। আমি ওদের নিতে এসেছি। তবে তার আগে তোমার সঙ্গে রানার গোপন পরামর্শ রয়েছে জগমল। তুমি আগে যাও। আমরা একটু পরে যাচ্ছি।

জগমল বুঝতে পারে কিকা মিথ্যা বলেননি। তার মুখ রক্তিম হয়ে ওঠে। কতকগুলো হা-ঘরের সামনে নিজেকে রীতিমতো অপমানিত বোধ করে সে। গজ গজ করতে করতে ভেতরে চলে যায়।

কিকা স্তূপীকৃত জিনিসগুলোর সামনে ওদের নিয়ে যান। বলেন,–আপাতত তোমাদের মাথা গুঁজবার ঠাঁই অন্তত হোক। কি বল সর্দার?

যশোবন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বলে,—এ তো অনেক জিনিস। আমরা খুব ভালো-ভাবেই থাকতে পারব। আপনি এই অল্পসময়ে এত সব ব্যবস্থা কিভাবে করলেন কিকা?

—রানার আদেশে সব হয়।

জিৎ সিং বুঝতে পারে নিজের পিতার হৃত-সম্মান পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় আছেন কিকা। কিন্তু তা কি সম্ভব হবে কখনো? কিকার উদারতার সীমা নেই। এমন পুত্র কয়জন পিতার ভাগ্যে জোটে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *