আরাবল্লী – ৫

৫.

সরোবরের স্বচ্ছ জলে নিশ্চিন্ত অবগাহনে শরীর শীতল হয় সবার। তারপর আহার শেষ করে শুয়ে পড়ে তারা। শুধু জিৎ সিং জেগে থাকে পাহারা দেবার জন্যে। রানার রাজ্যে এসেও তাদের পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হবার উপায় নেই। কারণ জগমল রেগে স্থানত্যাগ করেছে। সে কাপুরুষ। কাপুরুষরা কখনো সরল চিত্তের মানুষ হয় না। তাই পাহারার ব্যবস্থা। বৃদ্ধ যশোবন্ত বলেছিল, কোনো প্রয়োজন নেই পাহারার। কিন্তু রসিকা শংকরী কিছুতেই শোনেনি। জিৎ সিংকে ডেকে সে বলেছিল,—তুমি তো আমাদের দলের নও গো। তুমি পাহারা দেবে? এরা সর্দারের কথা শুনুক। তুমি ভাই আমার কথা শোনো।

—বেশ। শুনব।

—আমি কিন্তু ঘুমোবো।

—ঘুমোও।

খেয়ে-দেয়ে উঠতেই সবার মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। কিন্তু জিৎ সিং-এর চোখে ঘুম নেই। তার দৃষ্টি রানার প্রাসাদে যাবার পথের দিকে। দূরে কোনো অশ্বারোহী কিম্বা সন্দেহজনক কিছু দেখলে শংকরীকে বলতে হবে। শংকরী বলবে যশোবন্তকে।

সহস্র লোক শুয়ে রয়েছে। সে একা শুধু দাঁড়িয়ে। পায়চারী করে সে। একসময় লক্ষ্য করে জিৎ সিং নিদ্রিত মানুষগুলির একজায়গায় একটু নড়ে ওঠে। জায়গাটি মেয়েদের। সে ভালোভাবে চেয়ে দেখে লীলাবতী উঠে বসেছে। বসে, তারই দিকে চেয়ে রয়েছে।সে হাত দিয়ে ইশারা ক’রে তাকে আবার ঘুমিয়ে পড়তে বলে। লীলাবতী মাথা ঝাঁকায়। তারপর নিদ্রিত মানুষগুলির দেহের পাশ দিয়ে অতি সাবধানে একটু একটু করে এগিয়ে আসে তার দিকে।

যত কাছে আসে লীলাবতী, জিৎ সিং-এর মন ততই সংকোচে ভরে ওঠে। এই কয়দিন সবসময় তার কথা মনে হলেও আপ্রাণ চেষ্টায় দূরে দূরে থেকেছে সে। সে বুঝতে পেরেছে লীলাবতী কথা বলতে চায়, কথা বলবার সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু সুযোগ দিতে চায়নি জিৎ সিং। মেয়েটির প্রতি তার রূঢ়তা প্রকাশ পাবে এই ভয়ে। সে লক্ষ্য করেছে পিতার সংবাদ পাওয়ার পর থেকে মেয়েটির পরিবর্তন হয়েছে। আগের মতো যখন তখন তার খিলখিল হাসি আর শোনা যায় না। হয়তো চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। এর পরেও কোনো কঠিন কথা বলে ফেললে চূড়ান্ত আঘাত পাবে মেয়েটি। নিজের ওপর আস্থা নেই জিৎ সিং-এর। কখন কি বলে ফেলবে নিজেই জানে না। তাই কাছে আসতে দিতে চায়নি। কিন্তু দূরে থেকেও মেয়েটি তার মনকে বেঁধে রেখেছে। এমন কি সামান্য যেটুকু তন্দ্রা এসেছে তার চোখে সেই তন্দ্রাটুকুর মধ্যেও স্বপ্ন দেখেছে মেয়েটিকে। স্বপ্ন মেয়েটি তার বড় পরিচিত হয়ে ওঠে। যেন চিরকালের পরিচয়। স্বপ্ন জিনিসটিই অদ্ভুত।

লীলাবতী কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে,—সবাই ঘুমোচ্ছে। তাই—

কথা শেষ করতে পারে না কেন যেন সে। জিৎ সিংও কিছু বলতে পারে না। কী বলবে সে?

লীলা আরও কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থাকে। শেষে বলে,—তুমি আমার ওপর বিরক্ত হয়েছ জিৎ?

—না। বিরক্ত হব কেন?

—কথা বলো না যে?

—আমি মেয়েদের সঙ্গে কখনো বেশি কথা বলিনি লীলাবতী। আমার কথাবার্তা খুব রূঢ়।

—–তোমার কথা রূঢ়? কে বললে?

—তুমি তো জানই। সেদিন শুনেছিলে তো।

—তোমার কথা খুব সুন্দর। তোমার মতো এত সুন্দর কথা আমি কখনো শুনিনি। জিৎ সিং বিস্ময়ে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,—তুমি আমায় ক্ষমা করনি লীলাবতী?

—ক্ষমা! অন্যায় করনি তো কোনো, ক্ষমা তুমি আমার করবে। আমি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। বল, ক্ষমা করেছ?

জিৎ সিং-এর কণ্ঠে কী যেন ঠেলে ঠেলে ওঠে। সে যতবারই চেষ্টা করে স্বাভাবিক হতে, কিছুতেই পারে না। শেষে সে তলোয়ারখানি শক্ত ক’রে চেপে ধরে মনের অসহায় ভাব কাটিয়ে ওঠবার জন্যে।

—জিৎ সিং।

—বল।

—এত লোকের মধ্যে একজনও আমার আত্মীয় নেই যাকে বাবার কথা বলে হাল্কা হতে পারি।

—আমি জানি লীলাবতী। আমারও কেউ নেই এখানে। বাবার কথা মনে এলে অন্য চিন্তা করি।

—তোমার বাবার কথা আমায় বলবে?

—তুমি শুনবে? সত্যি শুনবে?

—হ্যাঁ।

—কেন?

—আমিও যে আমার বাবার কথা তোমায় শোনাবো তাই।

কিন্তু কিছু বলার আগেই ওরা দূরে সরোবরের ধারে দেখতে পায় আর একজন ঘোড়সওয়ারকে। এদিকেই ছুটে আসছে সে। ভালোভাবে চেয়ে দেখে জিৎ সিং ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে আর কেউ আছে কি না। আর কেউ নেই। সে একাকী।

লীলাবতী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে জিৎ সিং-এর দিকে চায়।

—তুমি এখন যাও লীলাবতী।

—আবার আসছেন জগমল?

—না। অন্য কোনো রাজপুত্র। অমন সুন্দর সহজ অশ্বচালনা জগমলের নয়। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। অথচ চিনতে পারছি না। আর একটু কাছে না এসে চিনতে পারব না।

—যশোবন্তকে ডাকবে না?

—না। শুধু শুধু তার ঘুম ভাঙাবো না।

—আমি থাকি তোমার সঙ্গে?

—না লীলাবতী।

—কখন দেখা হবে আবার?

—যখন তুমি বলবে। আমি তোমার কাছাকাছি থাকব। লীলাবতী চলে যায়। নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।

জিৎ সিং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আগুয়ান ঘোড়সওয়ারের দিকে চেয়ে থাকে।

এই ঘোড়সওয়ার মেবারের সবার প্রিয় রাজপুত্র কিকা। আকবর শাহ্ও তাঁকে বরাবর কিকা বলেই ডেকে এসেছেন। আর ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ইনি বহুযুদ্ধের বীর, বহু অস্ত্রক্ষত-শোভিত দেহধারী অতিপ্রসিদ্ধ রানা প্রতাপ সিংহ।

জগমল ফিরে গিয়ে রানা উদয় সিংহের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রোধে ফেটে পড়েছিল। সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে অনেক কথা বলে এই বহিরাগত দলের চরম ধৃষ্টতার কাহিনী ব্যক্ত করেছিল। রসিকা শংকরীর প্রতিটি কথায় আরও শ্লেষ আরও বিদ্রূপ মিশিয়ে ছুড়ে দিয়ে ছিল রানার দিকে তার কথার প্রভাবে পার্শ্বে দণ্ডায়মান রাজপুত্র এবং সর্দারদের মধ্যে অনেকের তলোয়ার ঝনঝন করে উঠেছিল। আর রানা উদয় সিংহের ভ্রূকুটি প্রকট হয়ে উঠেছিল।

সব কথা বলার পর জগমল সিংহাসনের সামনে আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে মাটিতে পা ঠুকে বলেছিল,—ওরা মিথ্যেবাদী। খুবই অনিষ্টকর কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই ওরা এসেছে মেবারের নতুন রাজধানীতে। ওরা নিশ্চয় মুঘলের চর। চিতোর দখলের পর আকবর শাহ মেবারের রানার গতিবিধি জানবার জন্যে যে ওদের পাঠিয়েছেন, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

সভাকক্ষ যখন স্তব্ধ সেই সময়ে কিকা ধীরকণ্ঠে প্রশ্ন করেন,– তোমার কথা শুনে মনে হল, ওদের একটিও ঘোড়া নেই।

—না।

—সঙ্গে নারী আর শিশু রয়েছে বললে না?

—হ্যাঁ।

—তবে?

—তবে কি? জগমল চিৎকার ক’রে ওঠে।

—পায়ে হেঁটে, স্ত্রী পুত্র পরিবারের হাত ধরে কেউ মেবারের রানার পেছনে সংবাদ সংগ্রহের জন্য আসবে না।

—ওটা ওদের বাইরের আবরণ। কেউ কোনো কিছু সন্দেহ করতে পারবে না।

কিকা দুঃখের হাসি হেসে বলেন,—ভুলে যেও না জগমল, আকবর শাহ্ কিন্তু চিতোর অবরোধের আগে জানান দিয়ে এসেছিলেন। রানার আর চিতোরের হালচাল জানবার জন্যে একগাদা লোককে একসঙ্গে পাঠাননি। খবরাখবর যা নেবার এক আধজন গুপ্তচর দ্বারাই তো সম্ভব হয়েছে।

কিকার যুক্তিকে কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না। রানা উদয় সিংহ সবার অলক্ষ্যে জগমলের চোখের দিকে চেয়ে হতাশায় ঘাড় নাড়েন। ভাবখানা তাঁর এই, কত সুযোগই তোমায় দিয়ে থাকি, কোনোটাই কাজে লাগাতে পারো না। তোমার কর্মক্ষমতা আর বুদ্ধি কারও মনে ছাপ ফেলতে পারে না।

পিতার হতাশা লক্ষ্য ক’রে জগমল আরও ক্ষেপে ওঠে। বলে,—তবে কি ওদের কথাই বিশ্বাস করতে হবে যে চিতোর অধিকারের পর এরা আকবর শাহের চোখে ধুলো দিয়ে অক্ষত দেহে পালিয়ে এসেছে? এত বড় অসম্ভব ঘটনা জগতে কখনো ঘটতে পারে?

কিকার মুখে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে ওঠে। তিনি বলেন,—আগ্রার বাদশাহ্ সম্বন্ধে তোমার মনে দেখছি এখন থেকেই সুউচ্চ ধারণা আর সম্ভ্রমবোধ জেগে উঠেছে। ভালো লক্ষণ নয়। জানি না, মেবারের সিংহাসনে তুমি বসবে কি না। মাথাটা এখন থেকেই তাঁর পদতলে রাখবার জন্যে যেভাবে প্রস্তুত হয়ে আছ—সিংহাসনে বসলে দুদিনও সেটিকে নিজের কাঁধের ওপর উঁচু করে রাখতে পারবে না।

জগমল চিৎকার ক’রে ওঠে,–কিকা, তুমি আমায় অপমান করছ।

—না। আমি শুধু ভবিষ্যৎ আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করলাম। অন্যের সম্বন্ধে উঁচু ধারণা পোষণ করা অন্যায় নয় ভাই। কিন্তু রাজপুতদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলা পরিতাপের বিষয়।

—তুমি কি তবে বিশ্বাস কর ওদের কথা?

—নিশ্চয়ই করি। ওদের কাছে বন্দুক দেখেছ বললে। আমার ধারণা ওরা কালপীর সেই দল। দক্ষ নিশানী।

—তোমার ধারণা ভুল।

কিকা কোনো কথার জবাব না দিয়ে রানার সামনে এগিয়ে যান। তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে দলটিকে দেখে আসবার অনুমতি প্রার্থনা করেন।

রানার ইচ্ছা আবার জগমলকেই পাঠান। কিন্তু পারেন না সেকথা বলতে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও অস্ফুট স্বরে কিকাকে বলতে বাধ্য হন,—যাও দেখে এসো।

জগমল বলে ওঠে,–একা যাবে?

রানাও সেই প্রশ্নই করেন কিকাকে।

কিকা বলেন—হ্যাঁ, একাই যাব।

জগমল তার হাতের চাবুকটি এগিয়ে দেয়।

—না। ওটির দরকার হবে না।

কিকা তাঁর কোষবদ্ধ অসি খুলে ফেলে পার্শ্বে দণ্ডায়মান শক্তির হাতে দেন। শক্তি বলে ওঠে, —একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে নাকি ভাই?

কিকা হাসেন। বলেন, –হয়তো হচ্ছে। তবে এক সহস্র লোকের সামনে ওটি নিয়েও কোনো লাভ হবে না—যদি তাদের উদ্দেশ্য শুভ না হয়। উদ্দেশ্য অশুভ হলে জগমল ফিরে আসত কি? ভুলে যেও না ওদের বন্দুক আছে।

কিকার কথা সবাই শোনে। রানা উদয় সিংহ আর একবার আপশোসে মাথা নেড়ে তিরস্কারের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন ব্যর্থ পুত্রের দিকে। জগমল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে দাঁত দিয়ে ওষ্ঠ চেপে ধরে। যুবতী স্ত্রী আর শিশুপুত্রের কথা এবারেও একবারও মনে হয় না তার।

জিৎ সিং বিস্ময়-বিহ্বললোচনে চেয়ে থাকে।

চিনতে পেরেছে সে ঘোড়সওয়ারকে।

কিকা!

হ্যাঁ কিকা। অন্য কেউ হতে পারে না। কিকাকে সে ভালোভাবে চেনে। তাই অত পরিচিত মনে হচ্ছিল দূর থেকে। কিকাকে সে কত কাছে থেকে দেখেছে। কিকাকে সে দেখেছে তার নিজেরই বাড়ির আঙিনায়। তিন চারবছর আগের ঘটনা। পাড়ার লোকের ভিড় জমেছিল সেদিন অজিত সিং-এর বাড়ির বাইরে। পিতার সম্মানে জিৎ সিং-এর বুক সেদিন গর্বে ফুলে উঠেছিল। কিকার খাতিরে তারা পিতাপুত্রও সেদিন সবার দর্শনীয় বস্তু হয়ে উঠেছিল। অথচ অজিত সিং-এর মুখে কোনোরকম উত্তেজনার আভাস সে দেখেনি সেদিন। বরাবরের মতো শান্ত ও ধীর। মেবারের রানার পুত্রের একজন সাধারণ গৃহস্থের গৃহে পদার্পণ করার গৌরব সেদিন অজিত সিং-এর চোখে মুখে একটুও ফুটে ছিল না।

কিকা বিদায় নিলে সে পিতাকে বলেছিল,–তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন একটুও আনন্দ হয়নি তোমার

—খুব আনন্দ হয়েছিল।

—তবে অমন গম্ভীর হয়ে ছিলে কেন?

—উনি কতকগুলো জিনিস জানতে এসেছিলেন। সেগুলো বুঝিয়ে দিতে গেলে গম্ভীর না হলে চলে না জিৎ। উনি যা জানতে এসেছিলেন তোমাকেও বলব। তোমর মতামতেরও প্রয়োজন রয়েছে।

অসিচালনার কয়েকটি কৌশল সম্বন্ধে জেনে নিতে সেদিন কিকা এসেছিলেন চিতোরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অসিযুদ্ধবিদ্-এর কাছে। তাই অজিত সিং গলে যায়নি আনন্দে।

পরে বুঝতে পেরেছিল জিৎ সিং, আনন্দে গলে যাবার মতো সস্তা ব্যক্তিত্বের অধিকারী তার পিতা নন। তাই অজিত সিংকে খবর পাঠিয়ে প্রাসাদে না ডেকে নিজেই দেখা করতে এসেছিলেন কিকা। অবশ্য কিকার দ্বারা সবই সম্ভব। রাস্তাঘাটে কতবার তাঁকে দেখেছে সে। কোনো সময়ের জন্যেও মনে হতো না তিনি দূরের মানুষ। যেন তাদেরই একজন। তাদেরই সুখদুঃখে ওঁর বুকও দুলে ওঠে। তাই কালপীর দল চিতোর ছেড়ে আসবার দিন আকবর-বাতির সামনে দাঁড়িয়ে যখন বলে উঠেছিল যে মেবারের ভবিষ্যৎ রানা হবেন কিকা, তখন পিতৃশোকের তীব্রতার মধ্যেও তার চিত্ত পুলকিত হয়ে উঠেছিল।

আজ এখানে, চিতোর থেকে অনেক দূরে হওয়া সত্ত্বেও কিকার আবির্ভাব অপ্রত্যাশিত নয় জেনেও জিৎ সিং তাই বিস্ময়ে বিহ্বল। ইচ্ছে হয় তার ছুটে গিয়ে অভিবাদন জানাতে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে পিতার সেই গম্ভীর মুখ—নিজের আঙিনায় রাজপুত্রের উপস্থিতিতেও যে মুখ কৃতার্থের ভঙ্গিতে বিকৃত হয়নি।

অবিচল পদে দাঁড়িয়ে থাকে জিৎ সিং। বুকের ভেতরের দুরন্ত ঝড়কে সে শক্ত শাসনে বেঁধে রাখে।

ঘোড়ার গতি থেমে যায় জিৎ সিং-এর সামনে এসে। সে লক্ষ্য করে কিকার দৃষ্টি একমাত্র জাগ্রত প্রাণীকে ছাড়িয়ে নিদ্রিত মানুষগুলোর ওপর কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ায়। মুখখানি তাঁর থমথমে। অথচ দৃষ্টিতে সহানুভূতি ঝরে পড়ে। আপন মনে কিকা বলে ওঠেন,—এরা ক্লান্ত।

জিৎ সিং নীরব। চিন্তিত রাজপুত্রের দৃষ্টি আকর্ষণের কোনো চেষ্টাই সে করে না।

ঘোড়া থেকে ধীরে ধীরে নামেন কিকা। জিৎ সিং-এর সামনে এসে বলেন,–তোমার ঘুম পাচ্ছে না?

নত হয়ে অভিবাদন জানিয়ে জিৎ বলে,—আজ্ঞে না।

—তুমি পাহারায় আছো?

—হ্যাঁ। পাহারার প্রয়োজন নেই। তবু এত লোক—অস্ত্র রয়েছে সঙ্গে। নতুন জায়গা।

—ভালোই করেছ। কিন্তু তুমি—তোমার বয়স কত?

জিৎ সিং-এর চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। যদি বলতে পারত একুশ কিংবা বাইশ বড় ভালো হত। কিকার বয়সের প্রায় কাছাকাছি হত কিন্তু উপায় নেই। কোনোমতে বলে,—উনিশ বছর।

কিকা মৃদু হেসে বলে,—আরও ছোট দেখায়।

—আপনি নিরস্ত্র?

—হ্যাঁ। একথা জিজ্ঞাসা করলে কেন?

—এমনি। অস্ত্রের আপনার প্রয়োজনই বা কি এখানে।

—সর্দার কে? এ দলের সর্দার কি গোপাল সিং?

জিৎ সিং এবারে উত্তেজিত হয়। সব খবরই রাখেন কিকা। মেবারের অন্যান্য রাজপুতদের মতো তিনি নন। এমন কি রানার মতোও নন। সব খবর রাখেন বলেই তিনি সবার প্রিয়।

সংযত কণ্ঠে জিৎ বলে—হ্যাঁ।

—আমি অপেক্ষা করছি। ঘুম ভাঙলে দেখা করব।

—তিনি মৃত।

—ও। চিতোরেই?

—হ্যাঁ।

—এখন সর্দার কে?

—আপাতত একজন বৃদ্ধ। যশোবন্ত তার নাম।

কিকা আবার অন্যমনস্ক হন। জিৎ সিং মনে মনে বিচার ক’রে দেখে আজ যদি তার বাবা এখানে উপস্থিত থাকতেন তাহলে তাঁর কথাবার্তা তারই মতো হত কি না। হয়তো হত। কারণ সব অবস্থাতেই তাঁর চালচলন ছিল নিরুত্তাপ। মনকে কতখানি বশে রাখতে পারলে উত্তেজনার সময়েও শান্ত স্বরে কথা বলা যায়, সে উপলব্ধি করে। অজিত সিং-এর মৃত্যুর আগেরই মুহূর্তের কথা মনে হয়। পিতার কর্তিত হাতখানা দেখে সে বলে উঠেছিল,–তোমার হাতখানা বাবা?

ছোট জবাব বার হয়েছিল পিতার মুখ থেকে—ফেলে দে।

নিজের হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও, নিজেরই হাত ‘এখন আর আমার হাত নয়’ বলে একবারও সেইদিকে না চাওয়া কী অপরিসীম মনোবলের পরিচয়, যতবারই সে ভাবে স্তম্ভিত হয়। অন্য কেউ হলে নিজের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথা জেনেও হাতখানির দিকে একবার অন্তত সজল চোখে চেয়ে নিত।

জিৎ সিং চমকে ওঠে কিকার কণ্ঠস্বর শুনে,–তোমার তলোয়ারখানা দেখি? সে চেয়ে দেখে কিকা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তার তলোয়ারের হাতলের দিকে চেয়ে রয়েছেন।

—আমার তুলনায় খুবই বড়।

—সেকথা নয় ওটি আমার হাতে দাও। দেখবো।

জিৎ সিং কোষ থেকে সেটি টেনে বের করে দুহাতের ওপর আড়াআড়িভাবে রেখে কিকার দিকে বাড়িয়ে দেয়।

তার দেবার ভঙ্গিতে খুবই সন্তুষ্ট হন তিনি। কিন্তু সে শুধু ক্ষণেকের জন্যে। তলোয়ারখানি এক অদম্য কৌতূহল জাগিয়েছে তাঁর মনে। তাই তাড়াতাড়ি সেটিকে নিয়ে তিনি হাতল দেখেন – আগাগোড়া সব দেখে নেন। তারপর গম্ভীর হন। তাঁর এতক্ষণের কোমল ভাব সহসা অন্তর্হিত হয়। রুক্ষতা ফুটে ওঠে চোখের দৃষ্টিতে, একটু জোরে তিনি বলেন,–কোথায় পেলে এটি?

—আমার বাবার

—তোমার বাবার কখনই না। হতে পারে না।

জিৎ সিং আবার বলে,—আমার বাবার

উত্তেজিত কিকা বলে ওঠেন,– তোমার বাবার? হ্যাঁ, হতে পারে তোমার বাবার যদি সে এই অস্ত্রটি চিতোরের পথে একগাদা মুঘল সৈন্যের পাশে মৃত একটি রাজপুতের হাত থেকে নিয়ে থাকে।

দৃঢ়কণ্ঠে জিৎ সিং বলে,—না। এটি আমার বাবারই।

—তোমার বাবার? তোমার বাবার? তোমার বাবার কি এমন যোগ্যতা রয়েছে যে এটি তাকে উপহার দেওয়া হবে? এটি লাভ করতে হলে কতখানি দক্ষতার প্রয়োজন তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না। তবু তোমার ওপর আমার রাগ হচ্ছে না। তুমি সরল বিশ্বাসেই এটি নিজের কাছে রেখেছ। কিন্তু তোমার বাবার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। কালপীর দলের মধ্যে থেকেও কীভাবে সে অস্ত্রটি হাতে পেল আমি জানতে চাই। তাকে ডাকো।

—তিনি জীবিত নেই।

—ও। বেঁচে নেই।

কিকা আর একবার তলোয়ারখানা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর সেটিকে বুকের ওপর চেপে ধরে বলেন,–শোন, অস্ত্রটি কাছে রাখবার কোনো অধিকার তোমার নেই। এটি আমি নিলাম। তোমার জন্যে একটি খুব ভালো তলোয়ার প্রাসাদ থেকে পাঠিয়ে দেব।

—আমি অন্য অস্ত্র চাই না। এটি চাই আমি। এটি আমার অস্ত্র।

কিকা চঞ্চল হন তার কথায়। তারপর গরম স্বরে বলেন,–তুমি জানো না, কতখানি স্পর্ধা প্রকাশ পেয়েছে তোমার কথায়। এটিকে লাভ করতে হলে অসাধারণ পুরুষ হতে হয়। সে যোগ্যতা তোমার আছে?

—জানি না। হয়তো নেই। তবে শেষ মুহূর্তে বাবা যে জিনিস আমাকে দিয়ে গেছেন জীবন থাকতে আমি তাকে হাতছাড়া করতে পারব না। মেবারের রানার পুত্রের আদেশেও নয়।

—তুমি আমায় চেনো?

—চিনি।

—অসম্ভব নয়। তবু বলে রাখি এটি আমার আদেশ নয়। এর জন্যে আমি জীবন দিতে পারি। কারণ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে মেবারের এক অসামান্য বীরের স্মৃতি। তাঁরই বীরত্ব আর দক্ষতার সম্মান স্বরূপ বাপ্পার আমলের একখানি তলোয়ার তাঁকে আমারই হাত দিয়ে উপহার দিয়েছিলেন রানা। এ-জিনিস দেখলেই চেনা যায়। মেবারের প্রতিটি বীর এর হাতল দেখে চিনে ফেলবে। আমার চিনতে দেরি হয়েছিল। কারণ, এখানে, এ-অবস্থায় এমন কিছু দেখতে পাওয়া আমার স্বপ্নের অগোচর ছিল। তাই বলছি, অবুঝ হয়ো না। তোমার বাবা হয়তো এর ইতিহাস জানত না। জানলে যথাস্থানে পৌঁছে দিত এটিকে। তোমার বাবার প্রসঙ্গে যে রূঢ় ভাব প্রকাশ করেছি তার জন্যে কিছু মনে করো না। আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।

—আমি বেঁচে থাকতে ওই তলোয়ার হাত ছাড়া করব না।

গর্জে ওঠেন আরাবল্লীর সিংহ,—তবে হয়তো তোমায় মরতে হবে।

—মরব।

—ভুল করছ।

—ভুল আপনি করছেন। আমার পিতা মৃত জেনে এভাবে জিনিসটি আবার ফিরিয়ে নেওয়া আপনার অন্যায়। এটি আগেও নিতে পারতেন। পিতাকে প্রাসাদে ডেকে পাঠালেই চলত। তাছাড়া আমাদের বাড়িও আপনার অজানা নয়। গেছেন একবার।

—কি বললে?

—বাবার সঙ্গে আপনার যথেষ্ট পরিচয় ছিল। তখন চেয়ে নিলেই ভালো করতেন না কি? -বাবা?

—আপনি আরও ভুল করেছেন কিকা, আমায় কাপুরুষ ভেবে। চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে আমায় পেয়েও বাবার ওই তলোয়ারখানা নিয়ে প্রাসাদে ফিরে যেতে আপনাকে রক্তপাত ঘটাতেই হবে। সহজে আর নিশ্চিন্ত মনে কখনই পারবেন না।

কিকা চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন,—অজিত সিং তোমার বাবা?

—হ্যাঁ।

—অজিত সিং? তোমার বাবা?

—হ্যাঁ।

—তুমি অজিত সিং-এর পুত্র?

—হ্যাঁ কিকা।

কিকা দুপা এগিয়ে আসেন। ঠিক যেমনিভাবে জিৎ সিং এগিয়ে ধরেছিল তলোয়ার তার চেয়েও আরও দশগুণ সুষ্ঠুভাবে তিনি এগিয়ে দেন সেটি। মুখে ফুটে ওঠে সম্ভ্রম শ্রদ্ধা আর আবেগ

রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন,– নাও।

জিৎ সিং-এর চোখ আগের মতো শুষ্ক থাকে না। তার বাবার স্মৃতির প্রতি এতখানি শ্রদ্ধা দেখে সে বিচলিত হয়।

তলোয়ার কোষবদ্ধ করে দুই হাঁটুর ওপর বসে পড়ে নত মস্তকে বলে,—আমায় ক্ষমা করুন। তোমার জন্যে আমি গর্ববোধ করছি। তোমার বাবার হয়ে আমি গর্ব অনুভব করছি। তিনি কি দেখছেন না? কিন্তু আমাকে সব কথা বল। তোমার বাবার কথা বল। কেমন করে সব ঘটে গেল?

জিৎ সিং একে একে বলে যায়। বলে যায় কীভাবে কোন্ ঘটনাচক্রে আজ সে এই দলের সঙ্গে মিশে মেবারের নতুন রাজধানীর প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে। নতুন রাজধানী বৈ কি! রাজা যেখানে থাকেন তা-ই রাজধানী। চিতোর যখন হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন একেই রাজধানীর সম্মান দিতে হবে। যদিও এর কোনো ঐতিহ্য নেই। এক ঘোরতর কলঙ্কের মধ্যে প্রতিষ্ঠা। তবু এইটুকু সান্ত্বনা যে, বালক বাপ্পাদিত্য কোন এক কালে এরই আশেপাশে গরু চরিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন।

মৃদু হাওয়া বইতে শুরু হয়। সে হাওয়া উদয়সাগরের জলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গ তোলে। তীরের কাছে এসে এই তরঙ্গগুলি ভেঙে চুরমার হয়ে মিশে শেষ হয়ে যায়।

জিৎ সিং-এর কথা শেষ হয়।

কিকা নীরব।

দলের অনেকে মাথা তুলে সবাইকে ঘুমোতে দেখে আবার শুয়ে পড়ে। তবে কেউ কেউ উঠে বসে। কিকার দিকে চোখ পড়ে না কারও। তাঁর অশ্বের দিকেও নয়, নিদ্রাভঙ্গের আচ্ছন্ন ভাব কেটে যায়নি তখনো।

কিন্তু রসিকা শংকরী উঠে বসেই সোজা প্রশ্ন করে,—এবারে কে এল জিৎ সিং?

কিকা তার দিকে মুখ ফেরাতেই শংকরীর কথা বন্ধ হয়ে যায়! তাড়াতাড়ি উঠে এসে জিৎ সিংকে ভর্ৎসনার স্বরে বলে,—কতক্ষণ ওঁকে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছ? বুড়োকে ডাকতে পারনি?

—উনি মানা করেছিলেন যশোবন্তের ঘুম ভাঙাতে। নিজে থেকেই অপেক্ষা করছেন। শংকরীর মুখ থেকে স্বগতোক্তি বের হয়,–এইখানে পার্থক্য।

সে ছুটে যায় যশোবন্ত যেখানে বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল। আস্তে আস্তে তাকে ধাক্কা দিয়ে কোমলস্বরে বলে, —শুনছো?

যশোবন্তের ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই শংকরীর গলার স্বরের কোমলতা কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। হাত ঘুরিয়ে বলে,—আর কত ঘুমোবে বুড়ো। একেবারে দিন যে এগিয়ে এল। এখন যতটা পার জেগে থেকে পৃথিবীকে দেখে নাও।

যশোবন্ত সত্যিই বিরক্ত হয়। শুয়ে শুয়ে বলে,–চিতোর থেকে আমার পেছনে লেগেছে। এবারে আমার ঘুমের পেছনেও লাগলে?

—ওঃ, এতেই ক্ষেপে গেলে তুমি? ভগবান যে কেন আমার বয়সটা হুটহাট করে বাড়িয়ে দিলেন!

—চুপ কর। সব সময় ওসব কথা ভালো লাগে না। তোমার বুদ্ধির ধার থাকলেও, তুমি বড় বাচাল।

—হুঁ, তাই বুঝি? বেশ। রাজকুমার কিকাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে জিৎ সিংকেই যথেষ্ট বলে মনে কর দেখছি।

যশোবন্ত তাড়াতাড়ি উঠে এসে বলে,—কি বললে?

—ওই দেখ। চোখের মাথা তো একেবারে খাওনি। মানুষ চিনতে না পারলেও ঘোড়াটাকে চিনতে পারবে।

যশোবন্ত বয়সের অনুপাতে অনেক দ্রুত লাফিয়ে ওঠে,–কিক এসেছেন?

—তবে আর বলছি কি? তোমার সঙ্গে রসিকতা করার জন্যে ঘুম ভাঙিয়েছি বলে মনে কর? নিজের ওপর খুব উচ্চ ধারণা দেখছি।

—ইস। থামো। উন কি মনে করলেন? কথাটা প্রথমেই বলবে তো?

—চল চল। উনি তোমার ঘুম ভাঙাবার অপেক্ষায় ছিলেন। হতাশ হয়ো না।

যশোবন্ত তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কিকা দুই হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, সব শুনলাম। অজিত সিং-এর পুত্র আমায় সব বলেছে। আশ্চর্য কৌশল অবলম্বন করেছিলে। বড় আনন্দ হল শুনে।

যশোবন্ত গম্ভীর স্বরে বলে,—আমাদের কৌশল আমাদের একবিন্দু আনন্দ দিতে পারেনি। একটি জিনিস দলের কেউ মুখ ফুটে বলছে না বটে, কিন্তু আমি জানি সবার মনে সে চিন্তা অহরহ কাঁটা হয়ে বিঁধছে। আমরা পালিয়ে এসেছি। সবাই যখন যুদ্ধ করে কিংবা অসহায় অবস্থায় মুঘলদের অস্ত্রাঘাতে ধরাশায়ী হচ্ছে আমরা তখন সেই দৃশ্য চোখে দেখতে পেয়েও পালিয়ে এসেছি—চোরের মতো পালিয়ে এসেছি।

যশোবন্তের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। রসিকা শংকরী কেঁদে ফেলে। জিৎ সিং অবাক হয় শংকরীর কান্না দেখে। তার মতো স্ত্রীলোক যে কখনো কাঁদতে পারে এ ধারণা ছিল না তার। কেন যেন মনে হচ্ছিল জিৎ সিং-এর, শংকরী জীবনে কখনো কাঁদেনি। সে হাসতে আর হাসাতেই এসেছে দুনিয়াতে। তবু যশোবন্তের বলবার ধরনে, তার আবেগের অকৃত্রিমতায় শংকরীর চোখে জল এল। শত হলেও সে স্ত্রীলোক। কান্না নারীত্বের একটি প্রধান গুণ। যে মেয়ে কাঁদে না তাকে নারী বলতে জিৎ সিং-এর বাধো বাধো লাগে। শংকরীর বুদ্ধিতে সে চমৎকৃত হয়েছে—তার রসিকতায় সে আনন্দ অনুভব করেছে। কিন্তু এই কয়দিনের মধ্যে একবারও তাকে স্ত্রীলোক বলে মনে হয়নি। আজ প্রথম মনে হল। শংকরীর কান্না দেখে সে বুঝল যে এই নারীর হৃদয়েও স্নেহ আছে—মাতৃত্ব আছে।

কিকা বলেন,–এর জন্যে অনুশোচনার কিছু নেই সর্দার। আমি শুনেছি মুঘলদের তোমরা যথেষ্ট নাজেহাল করেছ। কিন্তু পরিস্থিতি যখন আয়ত্তের বাইরে চলে গেল তখন এই দলকে মরতে না দিয়ে রাজোয়ারার মস্ত উপকার করেছ। চিতোরের সঙ্গে সঙ্গে মেবারও ধ্বংস হয়ে যায়নি। যদি কেউ সেরকম ভেবে থাকে সে ভুল ভেবেছে। মেবার বেঁচে রয়েছে। সে লড়বে—আরও লড়বে। শেষ রক্তবিন্দুটুকু বিসর্জন না দিয়ে সে থামবে না।

কিকার চোখে আগুন জ্বলে।

শংকরী এবার মুখ খোলে—কিন্তু নেতা? আমাদের মনে অনুপ্রেরণা জাগাবার, আমাদের দলের সামনে বুক ফুলিয়ে রাজছত্র মাথায় দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যাবার কেউ কি আছে আজ?

স্তব্ধ কিকা সঙ্গে সঙ্গে কোন জবাব দিতে পারেন না। তিনি স্ত্রীলোকটির কথার অন্তর্নিহিত অর্থ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। জগমলকে এরা সোজাসুজি যা শুনিয়েছিল, তাঁকে সেই কথাই প্রকারান্তরে শুনিয়ে দিচ্ছে। তারা উদয়সিংহের কাপুরুষতার কথা ভুলতে পারে না। সারা রাজোয়ারা কোনোদিনই ভুলবে না। বাপ্পা-বংশের এই মসীলিপ্ত অধ্যায় চিরকাল প্রতিটি রাজপুতের গৌরবোদ্দীপ্ত মুখকে ম্রিয়মাণ করবে।

শংকরীর দিকে চেয়ে কিকা শান্ত গলায় বলেন—তোমার অভিযোগ সত্যি। যে সন্দেহের উদয় তোমার মনে হয়েছে, প্রতিটি মানুষের মনে সেই একই সংশয় উঁকি দিচ্ছে। তাই বীরত্ব আর সাহস থাকা সত্ত্বেও মনের বল তাদের অন্তর্হিত। তোমাদের দোষারোপ করবার অধিকার রয়েছে। তবু, এত সহজে ভেঙে পড়ছ কেন?

—আমরা ভরসা পাচ্ছি না। আমাদের মন দুলছে। অনেকে যুদ্ধ ছেড়ে চাষ শুরু করবে বলে ভাবছে।

কিকা বিমর্ষ কণ্ঠে বলে ওঠেন,—রানা উদয় সিংহের পঁচিশ পুত্র। জানি না মেবারের রানা কে হবে তাদের মধ্যে। যদি জানতাম, আমি হবো রানা তবে আজই তোমাদের অস্ত্র ত্যাগ করতে নিষেধ করে দিতে পারতাম। তবু তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আজ আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে-ই রানা হোক আমার দেহমন দেশের কাছে বাঁধা রইল। চিতোর উদ্ধার না করা পর্যন্ত আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাব—তার জন্যে যত দুঃখ যত কষ্ট, যত ঝড়-ঝঞ্ঝার সম্মুখীন হতে হয় ক্ষতি নেই।

শংকরী আগ্রহভরে বলে ওঠে,আপনি তো রানা হতে পারেন।

—কি করে?

—আমি না দেখে, না জেনে বলে দিতে পারি, রানা যাকেই তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে স্থির করুন না কেন, দেশের সবাই আপনাকে চায়। তাই পঁচিশজন রাজপুত্র থাকা সত্ত্বেও আপনাকেই তারা কিকা বলে ডাকে। সবাই যাকে চায়, তিনি সহজেই সিংহাসনে বসতে পারেন।

—ছিঃ, একথা মনে এনো না। মনে আনা পাপ। বাপ্পার বংশ হীনতা জানে না। শংকরীর ঢিলে মুখেও রক্তোচ্ছ্বাস দেখা যায়।

কিকা তার লজ্জা দেখে কাছে এসে একখানা হাত তুলে নিয়ে বলেন,—তুমি অন্যায় করনি। দেশের যা অবস্থা হয়েছে, তাতে এমন মরিয়া হয়ে ওঠা স্বাভাবিক।

—আমি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আমাদের দলটির কথা ভাবছিলাম। অনির্দিষ্টকাল তারা অপেক্ষা করতে পারে না। বর্তমান রানা আপনার পিতার আমল আর কতদিন চলবে কেউ জানে না। তিনি সম্মাননীয় জেনেও তাঁর ভরসায় এরা রুজি-রোজগার ছেড়ে চুপ করে বসে থাকতে পারে না।

শংকরীর কথায় যশোবন্ত চমকে ওঠে। জিৎ সিং চঞ্চল হয়।

কিকা কিন্তু তেমনি শান্ত। তিনি বলেন,—তুমি বুদ্ধিমতী। তোমার কথা মোটেই উড়িয়ে দেবার নয়। তোমাদের আমি এইটুকু কথা দিতে পারি, রানা হই আর না হই, আগ্রার বাদশাহের সঙ্গে আমি সংগ্রাম চালিয়ে যাব। সংগ্রাম চালাবো মেবারের হয়ে—সারা রাজোয়ারার হয়ে। তোমরা আমার পাশে এসে দাঁড়াও। যতদিন আমি সংগ্রাম শুরু না করছি, ততদিন এবং তারপরেও যাতে তোমরা স্বচ্ছন্দে খেয়ে পরে থাকতে পার তার ব্যবস্থা আমি করব। রানা আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। দেরি দেখে হয়তো এতক্ষণে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছেন। আজ আমি আর বেশিক্ষণ থাকতে পারছি না। তবে আমি গিয়ে রানাকে তোমাদের বিষয়ে ভালোভাবে বলব।

যশোবন্ত বলে,—আমরা নিশ্চিন্ত হলাম কিকা! এই বুড়ীর মুখ বন্ধ হল এতক্ষণে। রোষ-কষায়িত নেত্রে শংকরী যশোবন্তের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। মুখে কিছু বলে না। কিকা জিৎ সিং-এর দিকে ফিরে বলেন,—চল আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসবে।

—আমার ঘোড়া নেই।

—আমি হেঁটেই যাব।

জিৎ সিং সঙ্গে চলে। তার বুকের ভেতরে চাপা উত্তেজনা। তার মুখ আরক্ত। এভাবে আজ কিকার সঙ্গে একাকী পথ চলার সৌভাগ্যের কথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। সে একবার পেছনে ফিরে চায়। দেখে শংকরী তাকিয়ে রয়েছে—যশোবন্তও তাকিয়ে রয়েছে। দলের যাদের ঘুম ভেঙেছে তাদের সবারই দৃষ্টি এদিকে নিবদ্ধ। হঠাৎ যেন সে সবার কাছে অনেক উঁচুতে উঠে গেল।

.

—জিৎ সিং—জিৎ সিংই তো তোমার নাম?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—জিৎ সিং তুমি অসিযুদ্ধ জান নিশ্চয়ই।

—বাবা শিক্ষা দিয়েছেন কিছুটা।

—তোমাকে একটু বেশি রোগা বলে মনে হয়। অবিশ্যি গায়ে শক্তি থাকলে রোগা হওয়ার সুবিধে বেশি। এত বড় তলোয়ার ব্যবহার করতে তোমার অসুবিধা হয় না?

—বেশি ব্যবহার করিনি।

রাম সিং-এর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধের কথা ইচ্ছে করেই সে বলে না। কারণ রাম সিং-এর অসির হাত হয়তো উঁচুদরের নয়।

—শোন জিৎ সিং। এ অসি ব্যবহারের সম্পূর্ণ অধিকার তোমার রয়েছে। কিন্তু এর অপব্যবহার যেন কখনো না হয়। তোমার বাবার হয়ে আমিই বলছি একথা। তিনি হয়তো বলবার সুযোগ পাননি।

—আপনার আদেশ শিরোধার্য।

—আর একটি কথা। তুমি এটিকে ব্যবহারে সক্ষম কি না জানি না। তবে এটুকু মনে রেখো যে-বীর এটি ব্যবহার করবে, সে যদি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা না হয়, তবে বাপ্পার সময়ের এই অস্ত্রের মর্যাদা নষ্ট হবে।

জিৎ সিং-এর মুখ লাল হয়ে ওঠে। কিকা তাকে প্রকারান্তরে অস্ত্রটি ফিরিয়ে দিতে বলছেন। চেহারা দেখে তার শক্তি আর নিপুণতা সম্বন্ধে সংশয়ের ছায়াপাত ঘটেছে কিকার মনে।

সে বলে,—শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার পরীক্ষা হবে কি করে?

—তুমি দুঃখ করো না। তোমার জিনিস ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করছি আমি, একথা যেন ঘুণাক্ষরে মনে না হয়। ওটি তোমার কাছেই থাকবে। তবে ওটিকে ব্যবহার না করে বরং পুজো করো।

—কিন্তু বাবা আমায় ব্যবহার করতে বলে গেছেন।

—হয়তো তিনি সব কথা ভালোভাবে তোমাকে বুঝিয়ে বলে যেতে পারেননি।

জিৎ সিং হঠাৎ থেমে পড়ে। সে বলে,—আপনি আমার পরীক্ষা করুন কিকা।

—ছিঃ, জিৎ সিং!

—এই অস্ত্রের উপযুক্ত না হলে আমি শোভাবর্ধনের জন্যে শুধু এটিকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে চাই না। এটি আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব। আপনি পরীক্ষা করুন।

—এখন কী ভাবে সম্ভব?

—আপনি যেভাবে ভালো মনে করেন সেইভাবেই করুন। কারণ পরীক্ষা না করলে এটিকে সঙ্গে রাখতে আমার ভালো লাগবে না। সব সময় মনে হবে আমি এর যোগ্য নই।

—আমি তো বলেছি, সঙ্গে রাখবার এবং একে পুজো করবার অধিকার তোমার রয়েছে।

—পুজো? হ্যাঁ, পুজো নিশ্চয় করব। কিন্তু শুধু পুজো নয়। তাতে মন ভরবে না। আমি জানতে চাই, এটিকে ব্যবহার করবার যোগ্যতা আমার আছে কি না।

কিকা একটু ভাবেন। তারপর বলেন,—লাগামটা ধর তো ঘোড়ার। তোমার তলোয়ার দাও।

জিৎ সিং দেখে তার অস্ত্র নিয়ে কিকা একটি গাছের মোটা ডাল কেটে নিয়ে আসেন। সেটিকে টুকরো করেন।

—শোন জিৎ, এই গাছের টুকরোটি আমি আকাশের দিকে ছুড়ে দেব। ঠিক যখন তোমার মাথার কাছাকাছি নেমে আসবে তখন এটিকে তলোয়ার দিয়ে দুটুকরো ক’রে ফেলতে হবে। তবেই বুঝব তুমি যোগ্য ব্যক্তি। যে ব্যক্তি এই ভারী অস্ত্রটি মাথার ওপর দিয়ে অনায়াস ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে একটি শক্ত জিনিসকে দু-টুকরো করে দিতে পারে তার যোগ্যতা সম্বন্ধে কোনোরকম সন্দেহ থাকতে পারে না। রাজপুতদের মধ্যে কয়জন অমন পারে আঙুল গুনে বলে দেওয়া যায়।

জিৎ সিং-এর বুকের স্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন থেমে যায়। রাম সিং-এর সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই সে সুযোগমতো নির্জনে বহুক্ষণ ধরে অসি চালনা অভ্যাস করেছে। ভারী হলেও সে ভার এখন তার গা-সওয়া। বরং সাধারণ তলোয়ার হাতে নিয়ে অসুবিধা বোধ হয়েছে। নিজের তলোয়ারের চেয়ে সেগুলোকে বড় বেশি হালকা বলে মনে হয়

তবু কিকার ছুড়ে দেওয়া ডালটি এক মুহূর্তের ভুলে কিংবা দ্বিধায় অক্ষত দেহে মাটিতে পড়তে পারে। আর সেইভাবে মাটিতে পড়তে দেবার অর্থই হল, এইখানে দাঁড়িয়ে পিতা অজিত সিং-এর স্মৃতিবিজড়িত অস্ত্রটি কিকার হাতে চিরদিনের জন্যে সমর্পণ করা। অথচ পরীক্ষার কথা সে নিজেই তুলেছিল। কিকা রাজি হননি প্রথমে। এখন আর পশ্চাদপসরণের কোনো প্রশ্ন ওঠে না–সম্মুখীন হতেই হবে তাকে। নইলে পিতার সম্মান থাকবে না। পিতার সম্মান রাখতেও এই কঠিন পরীক্ষা সে এড়িয়ে যেতে পারে না। কিকা ভাববেন, অজিত সিং-এর মতো বীরের পুত্র কাপুরুষ।

হয়তো তার চোখেমুখে, ফুটে উঠেছিল ইতস্তত ভাব। সে-ভাব লক্ষ্য ক’রেই বোধহয় কিকা বলে ওঠেন,—তার চেয়ে অস্ত্রটিকে সঙ্গে রাখো। তোমার বয়স কম, শরীরকে আরও মজবুত করে তোলো। আমার কাছে এসে থাকো তুমি। আমি তোমায় শিক্ষা দেব।

—আপনার কাছে থাকতে পারা আমার পক্ষে খুবই সৌভাগ্যের। তবু আমি এখানে যশোবত্তের দলের সঙ্গেই থাকব। ওরা চিতোরের লোক না হলেও ওদেরকাছে আমি কৃতজ্ঞ, আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

—তুমি কি আবার চিতোরে ফিরে যেতে চাও?

—না। আপনি ডালটিকে ছুড়ে দিন। আমি চেষ্টা করব। বাবার কাছে ছেলেবেলা থেকে শিক্ষা পেয়েও যদি আমার শরীর মজবুত না হয়ে ওঠে, তবে ভবিষ্যতে আর কখনো হবে না।

—জিৎ সিং তুমি আমায় ভুল বুঝছ। তোমার পিতার শিক্ষার ওপর বিন্দুমাত্র কটাক্ষপাত আমি করিনি, শুধু তুমি ছোট এখনো।

জিৎ সিং জানে কিকা তার চেয়ে খুব বেশি বড় নন। হয়তো সে কিকার মতো পরিপূর্ণ যুবক নয়, তবে সে কিশোরও নয়। কিকা তার দেহের কৃশতার জন্যে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। কিন্তু কিকা জানেন না, দেহের এই ক্ষীণতা তার বাবারই পরামর্শে। তার খাওয়া-দাওয়া ছিল নিক্তির ওজনে। দেহের গতি ক্ষিপ্রতর ক’রে তোলবার জন্যেই এই ব্যবস্থা করেছিলেন অজিত সিং। কিন্তু এত সব কথা এখন বলা যায় না। তাই শুধু বলে,—আমার কৈশোর এখন অতীত দিনের গর্ভে কিকা। আমি যুবক। কম বয়সের অজুহাত আর দেখাতে পারি না।

তার কথায় রীতিমতো বিরক্ত হন কিকা। তিনি বিরক্ত হন ক্ষতি নেই। তাই বলে পিতার শিক্ষা সম্বন্ধে কোনো সংশয় সে বরদাস্ত করবে না। স্বয়ং কিকা হলেও না।

কোনোরকম ভূমিকা ব্যতীতই কিকা হঠাৎ ডালের টুকরোটি ওপর দিকে ছুড়ে দিয়ে বলেন, –এই নাও।

জিৎ সিং বুঝতে পারে প্রথম সাক্ষাতের পরই কিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হল। কিন্তু উপায় নেই।

ডালটি নীচে নামছে। কোষ থেকে অসিটি খুলে নিয়ে নিমেষের মধ্যে সে প্রস্তুত হয়। ডালটি মাথার কাছাকাছি আসতেই সে বিদ্যুৎগতিতে অস্ত্রটি উঠিয়ে বাঁ-পাশ থেকে ডান-পাশে সমস্ত শক্তিতে টেনে দেয়। সামান্য শব্দ হয়। তার বুক কেঁপে ওঠে। ফসকে গেছে। নইলে এত সামান্য শব্দ হবে কেন?

তলোয়ার নামিয়ে মাটির দিকে চায় সে। আনন্দে তার বুক নেচে ওঠে। দু-টুকরো হয়ে মাটিতে পড়েছে ডালটি।

সে চেয়ে দেখে কিকা ঘোড়ায় চেপে বসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন। তিনি এই পরীক্ষার অবধারিত ফল আগে থাকতে অনুমান ক’রে এদিকে চেয়ে থাকবার প্রয়োজনবোধ করেননি।

ধীরে ধীরে দণ্ডায়মান অশ্বের কাছে গিয়ে সে সম্ভ্রমের সঙ্গে বলে,—আমি এটিকে ব্যবহার করতে পারি কিকা।

—কি বললে?

—আপনার পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ।

—কী?

অশ্ব থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে কিকা ছুটে এসে ডালের টুকরো দুটি দুহাতে তুলে নেন। দুটিকে জোড়া লাগিয়ে বিস্মিত চোখে চেয়ে থাকেন তরুণের দিকে।

—আশ্চর্য। অবিশ্বাস্য।

—আপনি নিজের চোখে বোধহয় দেখেননি। আর একবার পরীক্ষা করুক কিকা। এত অল্প আয়াসে যে ডালটি টুকরো হবে আমি নিজেও ভাবতে পারিনি। ওই অর্ধেক টুকরো আর একবার ওপর দিকে ছুড়ে দিয়ে চেষ্টা করব?

—খুবই ছোট।

—তবু চেষ্টা করি। সুন্দর খেলা।

কৌতূহলান্বিত হয়ে কিকা নিজেই একটি অংশ নিয়ে ওপরে ছুড়ে দেন।

এবারেও মাথার ওপর তলোয়ার চালায় জিৎ সিং। তার অসি চালনায় বিমুগ্ধ হন কিকা আর অবাক হন, যখন দেখেন সেই ক্ষুদ্র ডালটিও টুকরো হয়ে নীচে পড়ল।

ছুটে গিয়ে জিৎ সিংকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরেন তিনি।

—আমার ভুল হয়েছিল জিৎ। তোমার বাবাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে আমি দ্বিধা বোধ করেছিলাম। আমার সংশয়, আমার দৈন্যতারই পরিচয়।

জিৎ সিং তৃপ্তচিত্তে কিকার উক্তি শোনে আর ভাবে কতখানি মহৎ হলে মানুষ এভাবে বলতে পারে। তার মনে কোনো ক্ষোভই থাকে না আর।

—তোমায় আমি কাল এসে নিয়ে যাব জিৎ।

কিকা বিদায় নিয়ে চলে যান। জিৎ সিং ফিরে আসে তার দলে। ভাবতে ভাবতে আসে সে। আজকের এই কঠিন পরীক্ষা এত সহজভাবে উত্তীর্ণ হবে সে কল্পনা করেনি। বাবা তাকে সব শিক্ষাই দিয়ে গেছেন, কিন্তু কখনো বলেননি যে সে-শিক্ষা তাকে কতখানি দক্ষ করে তুলেছে। হয়তো তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, এত অল্প বয়সে নিজের নিপুণতা সম্বন্ধে সচেতন হলে তার, গর্ব হবে। গর্ব জিনিসটি খুব খারাপ। বাবাকে একথা সে প্রায়ই বলতে শুনেছে। গর্ব মানুষের ভেতরের সদগুণকে ধ্বংস করে দেয়।

রাম সিং-এর সঙ্গে অসিযুদ্ধ, তারপর আজকের দিনের ঘটনায় জিৎ সিং নিজের সম্বন্ধে প্রথম সচেতন হয়। বুঝতে পারে মেবারের যে-কোনো যোদ্ধার সমকক্ষ সে। সেদিনের রাম সিং-এর পরাজয় শুধু একটি আকস্মিক ঘটনা নয়। তার চাইতে শ্রেষ্ঠতর যোদ্ধার কাছেই পরাজিত হতে হয়েছিল রাম সিং-কে। তাই সেদিনের পর থেকে কোনোরকম বিদ্রূপ বাক্য শুনতে হয়নি জিৎ সিংকে। কারণ সে নিজে না জানলেও রাম সিং বুঝে গিয়েছিল অসিযুদ্ধে জিৎ সিং তার চেয়ে অনেক বেশি উঁচুতে। এমন লোককে সে যে-কোনো রকমেই হোক দল থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল মনে মনে। তাই সেই ঘটনার ঠিক পরের দিনই জিৎকে কাছে ডেকে রাম বলেছিল,—গিরোয় গিয়ে তোমার সঙ্গে আমার দরকারি কথা রয়েছে।

—এখনি বলে ফেলো না।

—না। শুধু এইটুকু মনে রাখো বাহুবলে যেখানে পরাস্ত হবার সম্ভাবনা সেখানে যে-কোনো কৌশল অবলম্বন করতে আমি দ্বিধাবোধ করব না।

—মনে থাকবে।

রাম সিং-এর মনের নিদারুণ জ্বালার কথা বুঝতে সে-রাত্রে একটুও অসুবিধা হয়নি জিৎ সিং-এর।

রামের কথা মনে হবার সঙ্গে সঙ্গে লীলাবতীর কথা মাথায় আসে। তার সঙ্গে দেখা করবে কথা দিয়েছে জিৎ সিং। লীলাবতীর সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। কিকার সঙ্গে কথা বলেও আনন্দ। কিন্তু এই আনন্দের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। অথচ দুটোরই সমান আকর্ষণ।

লীলাবতীর কথা ভাবতে ভাবতে জিৎ সিং দলের কাছে ফিরে আসে।

রসিকা শংকরী বলে,—কিকা কী মন্ত্র দিয়ে গেলেন?

—নিজেকে চিনতে পারার মন্ত্র।

—এত লোক থাকতে তোমাকে?

—আর সবার চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু ছিল।

কেন? আমাদের বুড়ো? বুড়োকে বুঝি তাঁর চোখে পড়ল না? এবারে তিনি এলে আমি কোমর বেঁধে ঝগড়া করব।

শংকরীর ভঙ্গিতে জিৎ সিং হেসে ওঠে।

পাশে একটা বালক আপন মনে বসে বসে শুকনো রুটি চিবোচ্ছিল। সে বোকা বোকা চোখে প্রশ্ন করে,—বুড়ো তোমার কে হয় গো বুড়ী?

শংকরী তাড়াতাড়ি তার মুখ চেপে ধরে,—চুপ চুপ। শুনতে পাবে। এভাবে বলতে হয়? একবার যদি জানতে পারে আমি বুড়ী, তবে আর ফিরেও চাইবে না।

বালকটির মা সহাস্যবদনে বলে,–কেন? সে তোমায় চোখে দেখে বুঝতে পারে না বুড়ী কিনা?

—শেষে তোমার মুখে এমন অবুঝের মতো কথা গো? একছেলের মা হয়েছ আর এটুকু জানে না? পুরুষমানুষকে চিনতে পারলে না? রঙিন চোখে দেখা কাকে বলে এর মধ্যেই ভুলে গেলে?

যারা শুনছিল হেসে উঠল তারা।

জিৎ সিং ধীরে ধীরে আরও এগিয়ে যায় লীলাবতীর খোঁজে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *