আরাবল্লী – ৪

৪.

কোন রাজবংশের ধারাবাহিকতায় সব কয়জন রাজাকেই সমান সমর্থ বুদ্ধিমান প্রতিপত্তিশালী বা প্রতিভাবান আশা করা নিরর্থক। সবাই কখনো সমান হয় না—হতে পারে না। দুর্বলচিত্ত অক্ষম রাজাও দেখা যায় সেই বংশে। এবং সেইরকম দেখতে পাওয়াই স্বাভাবিক। বংশের এই দুর্বলতার সুযোগে সাধারণত সেই বংশের পতন ঘটে। পৃথিবীর ইতিহাস খুঁজলে এমন বহু দৃষ্টান্ত মেলে। তবে এও কম দেখা যায় না যে, বংশের সবচাইতে সক্ষম রাজা বাদশাহের সময়েই রাজ্যের পতন শুরু। এর নানান কারণ রয়েছে। সে সব কারণ নানান সূত্রে গাঁথা। আমাদের আলোচনার বিষয় তা নয়। আর এসব আলোচনার জন্যে আমরা একসহস্র বন্দুকধারীর পেছনে পেছনে ছুটে এসে তাদের সুখ দুঃখ, হাসি-কান্না, উদারতা আর হীনতার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলিনি শুধু শুধু। তবু ইতিহাসকে আমরা একেবারে ছুড়ে ফেলেও দিইনি। ইতিহাসই আমাদের চলার পথের বর্তিকা। তাই টড সাহেবের একটি আক্ষেপ আপনাদের শুনিয়ে রাখি। তিনি বলেছেন—রাজপুতানার এক মহাদুর্ভাগ্য এই যে মুঘলবংশের শ্রেষ্ঠতম সম্রাট যখন আগ্রার সিংহাসনে আরূঢ়, ঠিক সেই সময়ে চিতোরের পবিত্র সিংহাসনে উঠে বসলেন শিশোদীয় বংশের সব চাইতে দুর্বলচেতা ব্যক্তি রানা উদয় সিং।

এ হল নিয়তির খেলা। আবার নিয়তির খেলাই বা কি ক’রে বলি? একে অনিবার্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। বহু শতাব্দীর গৌরবময় ঐতিহ্যের এমন পরিণতি দেখলে দুঃখে মুহ্যমান হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তবু এই পরিণতির জন্যে প্রস্তুত থাকতে হয়। কারণ এই পরিণতি ইতিহাসের গতিকে রক্ষা করে। নইলে যে আকবরকে আমরা দেখি অসংখ্য মুঘল সৈন্য নিয়ে দিগ্বিদিক জয় করে বেড়াচ্ছেন তাঁর বংশেরই বা কি দশা হয়েছিল আলমগীরের রাজ্য শাসনের শেষ পর্যায়ে? নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে বিচার করলে মেবারের রানা-বংশে উদয় সিংহের মতো রানার উদয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। একটি বর্তিকা চিরকাল সমান ঔজ্জ্বল্য নিয়ে জ্বলতে পারে না। নিভবেই কোনো না কোনো সময়ে। বাপ্পা রাও-এর বংশেরও নিভে আসবার দিন হয়ে এসেছিল। তবু বর্তিকা নিভে যাবার পূর্ব মুহূর্তে যেমন একবার জ্বলে ওঠে তেমনি জলেও উঠেছিল বাপ্পার বংশ উদয় সিংহের পর রানা প্রতাপের সময়ে। রাজোয়ারার আবালবৃদ্ধবনিতা ভাবল আবার বুঝি ফিরে এল পুরাতন যুগ—যে যুগের গল্প আর কাহিনী তারা কত শুনেছে। কিন্তু তা হবার না। যা যায় তা আর ফিরে আসে না, যে কুঁড়ি একবার মাটিতে ঝরে পড়ে তা আর ফোটে না।

তবু আফশোস থেকে যায়। আফশোস হয় পুণ্যবতী ধাত্রীপান্নার কথা ভেবে। নিজের পুত্রকে বনবীরের অসির সামনে ফেলে রেখে উদয় সিংহের প্রাণ রক্ষা করা বৃথাই হল। জানি না চিতোরের এই ঘোরতর দুর্দিনে তিনি বেঁচে ছিলেন কি না। বেঁচে থাকলে কোনো সান্ত্বনাই পেয়ে যায়নি মৃত্যুর পূর্বে।

রানা উদয় সিংহের কোনো গুণই ছিল না একথা বলা পুরোপুরি ঠিক হবে না। একটি বিষয়ে তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল। তিনি বুঝেছিলেন আকবর বাদশাহের নজর চিতোরের ওপর একদিন না একদিন পড়বেই। তাই কয়েক বছর আগে পূর্বপুরুষ বাপ্পা রাও-এর শৈশবের আবাসস্থল গিরো উপত্যকায় একটি মনোরম সরোবর তৈরি করেন। এই সরোবরের নাম তাঁর নামেই রাখা হয়েছিল—উদয়সাগর। উদ্দেশ্য ছিল এই সরোবরের ধারে মেবারের দ্বিতীয় রাজধানী পত্তনের উদ্দেশ্য সফল হল চিতোরের পতনের পর।

বৃদ্ধ যশোবন্ত তার দলবল নিয়ে একদিন প্রভাতে এই উদয়সাগরের তীরে এসে উপস্থিত হয়। স্বচ্ছ সরোবরের জলে তখন প্রথম সূর্যের রশ্মি পড়ে অপার্থিব শোভার সৃষ্টি করেছিল।

দলের কে যেন মন্তব্য করে ওঠে,—অপূর্ব এই সরোবর

রসিকা শংকরী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়,—হ্যাঁ। রানা উদয় সিং-এই জলে ডুবে মরলে শোভা আরও বাড়ত।

যশোবন্ত বলে,—পৌঁছেই এসব শাপশাপান্ত করো না শংকরী।

—ইচ্ছে করে কি শাপ দিচ্ছি বুড়ো। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। গৌরীদেবী নিজে বলিয়ে দিলেন। ভাব তো একবার চিতোরের কথা। কী দেখে এসেছ সেখানে? সেই চিতোরের রানাই না তৈরি করেছেন এই উদয়সাগর? সেই চিতোরের রানাই না মেবারের এই দুঃসময়ে এখানে বসে সরোবরের দিকে চেয়ে নিশ্চিন্তে বিশ্রামসুখ উপভোগ করছেন?

যারা শুনল শংকরীর কথা, সবারই রক্ত গরম হয়ে উঠল। বৃদ্ধ আর কিছু না বলে চুপ করে থাকে। সে জানে, শংকরীর প্রতিটি কথার পেছনেই যুক্তি আছে। যুক্তি না থাকলেও খুবই ক্ষিপ্রভাবে যুক্তি খাড়া করতে পারে সে। তার কথার প্রতিবাদ করা মূর্খতা। তাই সে কোনো কথা বলে না। সে আপন মনে ভাবতে শুরু করে। আজ সে নিশ্চিন্ত। গোপাল সিং-এর দলকে সে অক্ষতদেহে এখানে পৌঁছে দিতে পেরেছে। আজ তাই সে অতিমাত্রায় ক্লান্ত। সে বিশ্রাম নিতে চায়।

কিন্তু বিশ্রাম নেবো বললেই তো সব সময় নেওয়া যায় না। এখনো একটি কাজ বাকি রয়েছে নিজের দলকে রানার সম্মুখে উপস্থিত করতে হবে। রানা যেমনই হোন, তিনিই মেবারের মাথা সুতরাং তাঁর ইচ্ছা বা আদেশ অনুযায়ী চলাই ভালো। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি নিজেদের খুশিমতো চলতে চায় চলুক। সে স্বাধীনতা তাদের রয়েছে।

বৃদ্ধ ভাবে, হয়তো আজই কিংবা কাল রানার সঙ্গে দেখা হবে। তারপর? তারপর সে কি করবে? সে তো একেবারে বিশ্রাম নিতে পারবে না। লীলাবতী রয়েছে সঙ্গে, তাকে মানুষ করতে হবে। তাকে উপযুক্ত পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে তবে নিশ্চিন্ত। তার আগে নয়। লীলাবতীর বিবাহের পর সে নিশ্চিন্তে অবসর নেবে। আরাবল্লীর এই অংশ রাজপুতদের তীর্থস্থান। এখানে রয়েছেন একলিঙ্গ। বৃদ্ধ মনে মনে সংকল্প করে, যদি আরও কিছুদিন তার পরমায়ু অবশিষ্ট থাকে, তবে একলিঙ্গের ঠাঁই-এ গিয়ে আশ্রয় নেবে। অমন নিশ্চিন্তের আশ্রয়স্থল ভূভারতে আর কোথাও তার মিলবে না।

একলিঙ্গের কথা মনে হতেই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। যেন মস্ত অপরাধ হয়ে গেছে। এত কাছে এসেও একবারও তাঁর নাম নেওয়া হয়নি। খুবই অন্যায়। যশোবন্ত চিৎকার করে ওঠে, —জয় একলিঙ্গের জয়।

সঙ্গে সঙ্গে সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—জয় একলিঙ্গের জয়।

এই জয়ধ্বনি ফাঁকা উপত্যকার ওপর দিয়ে গিয়ে ছুটে রানার ক্ষুদ্র প্রাসাদে প্রতিধ্বনিত হয়। রানা শোনেন। আর শোনে মুষ্টিমেয় সর্দারশ্রেণির লোক, যারা রানার সঙ্গে চলে এসেছে তাঁকে আগলাতে। তারা বিস্মিত হয়। এ সময়ে এতগুলো লোকের আগমন কি তবে শুভ ইঙ্গিত? তবে কি আগ্রার বাদশাহ্ কোনো কারণে চিতোর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন? এখানকার গুপ্তচর কালই শেষ সংবাদ নিয়ে এসেছে। শোচনীয় সে সংবাদ। একটি প্রাণীও নাকি জীবিত নেই চিতোরে? তবে এরা কারা? এরা কি মেবারের অন্য অংশের অধিবাসী?

চিন্তিত রানা তাঁর পঁচিশজন পুত্রকে ডেকে পাঠান। তারা এসে উপস্থিত হলে তিনি সবার দিকে একবার করে চেয়ে নেন। পঁচিশজনের মধ্যে অর্ধেকই নাবালক। তবু তারা পুত্র। সাবালক হবে একদিন। বনবীরের মতো কারও অভ্যুত্থান হলে এক ঘায়ে পঁচিশজনকে শেষ করতে পারবে না। এতগুলো পুত্ৰ লাভ পরম সৌভাগ্যের। তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলেন রানা। তিনি জানেন, এরা সবাই বীর। তিনি নিজে চিতোর ছেড়ে চলে না এলে এরা সবাই যুদ্ধে প্রাণ দেবার জন্যে প্রস্তুত ছিল।

শেষে সব চাইতে প্রিয় পুত্র জগমলকে ডেকে বলেন,—তুমিই যাও জগমল। দেখে এসো কি ব্যাপার।

জগমল মুখ নেড়ে বলে,—ব্যাপার আর কি? তীর্থ করতে এসেছে বোধ হয়। এরা হয়তো চিতোরের কোনো খবরই রাখে না।

উদয় সিংহ চিন্তিত মনে জগমলের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। শেষে বলেন—তুমি যা বলছ, সবই অনুমানের ওপর নির্ভর করে বলছ। হতে পারে এরা সত্যিই তীর্থযাত্রী। আমি তোমাকে যাচাই করে আসতে বলছি।

জগমলের ব্যবহারে রানা একটু বিচলিত হন। সে বুঝতে পেরেছে তারই প্রতি রয়েছে পিতার পক্ষপাতিত্ব। তাই ইতিমধ্যেই সেই পক্ষপাতিত্বের সুযোগ নিতে শুরু করেছে। চিতোর ছেড়ে আসবার পর থেকেই জগমলের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।

জগমল ধীর পদে বাইরে বের হয়ে একটি অশ্বে আরোহণ করে তার পিঠে অযথা চাবুকের আঘাত করে। অশ্বটি একবার পিঠ ঝাড়া দিয়ে ছুটে চলে উদয়সাগরের দিকে।

দূর থেকে যশোবন্তের দলকে দেখে জগমল থমকে দাঁড়ায়। এরা ঠিক তীর্থযাত্রী নয়। তীর্থযাত্রীদের এমন যুদ্ধের বেশ হয় না। জগমল চিন্তিত হয়। সে তখনো দলের নারী ও শিশুদের দেখতে পায়নি। তাই ভাবে, একা এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি না। এরা রাজপুত ঠিক। কিন্তু ভগবান দাস আর মানসিংহও রাজপুত। সেই জাতীয় রাজপুত এরা হলে আর রক্ষা নেই। মেবারের মুখে চুনকালি লেপে দিয়ে তার পিতা যে সুখের ঘর-সংসার পেতেছেন, এই মুহূর্তেই তা ধ্বংস হয়ে যাবে।

ওরা তাকে দেখতে পেয়েছে। সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফশোস হয় জগমলের। পিতার ওপর ক্রোধে উন্মত্ত হয়। বেশি ভালোবাসতে গিয়ে সর্বনাশটা করে ছাড়লেন তিনি। বিন্দুমাত্র দূরদর্শিতা তাঁর নেই। কিকা এবং অন্য ভাইয়েরা খুব এক চোট হেসে নিচ্ছে বোধহয় এ সময়। ওরা জানে উদয় সিংহের মনের খবর। কত সময়ে স্পষ্ট বলে ফেলে সে কথা। সেদিন এক ভাই বলে উঠেছিল—একটি আধটি নয় জগমল চব্বিশটি। এই চব্বিশজনের খাবার একা খেতে পারবি তো?

জগমল বুঝতে পারেনি এ-কথার অন্তর্নিহিত অর্থ। একটু অবাক হয়েছিল। তার বিহ্বলতার সুযোগে ওরা হেসে উঠেছিল।

আর এক ভাই কথার জের টেনে বলেছিল,—চ-ব্বি-শ-টি। চেয়ে দেখ। এই চব্বিশজনের ওপর যে স্নেহধারা সমানভাবে বর্ষিত হবার কথা, সে ধারার সবটুকু তোর ওপর ঝরঝর ক’রে ঝরে পড়ছে। মাথায় ব্যথা লাগছে না তো? তোর ধরনধারণ দেখে মনে হচ্ছে মাথার ঠিক নেই। তাই একটু জেনে নিতে চাইছি।

জগমল এবারে বুঝতে পেরেছিল ওদের বিদ্রূপ। মনে মনে ক্ষিপ্ত হলেও মুখে কিছু বলেনি। পঁচিশ ভাই-এর মধ্যে সে একা একদলে। সর্দারদের মধ্যেও দু-একজন ছাড়া সবাই অন্য ভাইদের সমর্থন করে। রানার একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভবিষ্যতে কার ভাগ্যে সিংহাসন রয়েছে বলা খুব কঠিন। তবে রানার ইচ্ছার বিরুদ্ধতা এ পর্যন্ত কোনো সর্দার কখনো করেনি। শিশোদীয় বংশে তেমন ঘটনা তখনো ঘটেনি—এই যা ভরসা।

কিন্তু সে সব পরে ভাবলেও চলবে। এখন এই দলটির সামনে একলা এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কি না। হে একলিঙ্গ! শেষে নিজের দেশের লোকের হাতে প্রাণটা হারাতে হবে?

জগমল অশ্বের লাগাম টেনে ধরে করুণ চোখে চেয়ে থাকে দলটির দিকে। ফিরে যাওয়া যেতে পারে ইচ্ছা করলেই। সহজেই ফিরে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ফিরে গেলেই কিকার ওপর ভার পড়বে এখানে আসবার। ওর ভয়ডর বলতে কিছুই নেই। ঠিক চলে আসবে। আর সে যদি এসে দেখে শত্রুপক্ষ নয়, তাহলে লজ্জা আর অপমানের সীমা থাকবে না।

—হোই!

ওরা ডাকছে। হাত উঁচু করে ডাকছে। হইচই করছে। বুকের পাষাণভার নেমে যায় জগমলের। শত্রুপক্ষের ধরন-ধারণ এমন হতে পারে না—এ জ্ঞানটুকু তার আছে। এবারে তার নিজের ওপর রাগ হয়। এই সামান্য মুহূর্তের মধ্যেই কতরকম না বিভীষিকা সে দেখল। যুবতী স্ত্রীর মুখখানাও মনের মধ্যে ভেসে উঠেছিল একবার। আসবার সময় তার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারেনি বলে বুকের ভেতরে কান্না ঠেলে উঠছিল। ছি ছি। অথচ অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে সমানভাবে বুক ফুলিয়ে সেও বলেছিল তার বাবাকে—তিনি যদি চিতোর ছেড়ে না আসতেন তাহলে যুদ্ধে প্রাণ দিতে সে-ও প্রস্তুত ছিল। বাবা বিশ্বাস করেছিলেন তার কথা।

—হোই! জোয়ান

জগমল হাত উঁচু করে উত্তর দেয়। ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় সে আসছে। তারপর বুক ফুলিয়ে লাগাম ঢিলে করে অশ্বের পেছনে থাবা মারে। বিদ্যুৎগতিতে ছুটে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাকে দলের সামনে নিয়ে আসে ঘোড়াটি।

যশোবন্ত সামনে এগিয়ে যায়। সে চিনতে পেরে জগমলকে। নত হয়ে প্রণাম জানায়। এরা অনুগত জেনে জগমলের ভঙ্গি হয়ে ওঠে উদ্ধত। সে বলে,—ওভাবে আমাকে ডাকছিলে

কেন? কী ভেবেছ তোমরা?

যশোবন্ত সংকুচিত হয়ে বলে—ওরা চিনতে পারেনি। আমিও পারিনি দূর থেকে।

—কোথা থেকে আসছ?

—আজ্ঞে চিতোর থেকে।

—চিতোর! অনেক ঘোরা পথ বুঝি?

—একটু ঘুরে আসতে হয়েছে বৈ কি।

জগমল নিশ্চিন্ত হয়ে বলে,—তাই বল।

যশোবন্ত রানার পুত্রের কথার অর্থ না বুঝে কি বলবে ভেবে পায় না।

জগমল সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে অশ্বের পিঠে কনুই ঠেকিয়ে বলে,—আগ্রার বাদশাহ্ চিতোর শেষ করার আগেই বোধহয় রওনা দিয়েছ? তীর্থে তীর্থে ঘুরছিলে তিন চার মাস?

—না। আমরা কোন তীর্থে যাইনি। চিতোর অবরোধের সময় ছিলাম সেখানে।

—–কি বললে?

—আকবর শাহ্ চিতোরে প্রবেশের পরেই আমরা রওনা দিয়েছি সেখান থেকে।

জগমলের মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। এরা মিথ্যে কথা বলছে। তার পরিচয় জেনেও মিথ্যে বলবার স্পর্ধা রাখে এরা। সে ঘোড়ার চাবুকটা একবার শূন্যে আস্ফালন করে। তারপর যশোবন্তের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চায়

সেই সময় ভিড়ের ভেতর থেকে রসিকা শংকরী উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে,—ঠিক ধরেছিলাম। ভয় পেয়ে ঘোড়া থামিয়ে দিয়েছিল। একেবারে বাপ্‌া বেটা। বাবা যুদ্ধের কথা শুনেই পালিয়েছিল। এ আবার সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ঘরপোড়া গরুর মতো ভয় পায়। বাপের ওপর এক কাঠি।

জগমল চিৎকার করে ওঠে—চোপ রহ। কে কথা বলছে?

যশোবন্ত গম্ভীরস্বরে বলে,—একজন পাগলী।

—পাগলী? দেখি কেমন পাগলী? আমার কাছে পাগলামির ভালো ওষুধ আছে। সামনে নিয়ে এসো দেখি।

ঋজু যশোবন্ত কঠোর অথচ বিনীতস্বরে বলে,—আমরা ওকে সামনে আনি না। ও নিজের মতো যা খুশি বলে যায়। সে স্বাধীনতা আমরা দিয়েছি।

—নিয়ে এসো বলছি।

যশোবন্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

—আনবে না?

জিৎ সিং ছিল সেখানে। সে ছিল যশোবন্তের পেছনেই। রানা বংশের পুত্রদের সম্বন্ধে তার মনে এতদিন ছিল অসীম সম্ভ্রমবোধ। জগমলের ব্যবহারে এক ফুৎকারে সেই সম্ভ্রমবোধ কোথায় মিলিয়ে যায়। সে দেখে যশোবন্তের শরীর রীতিমতো কাঁপছে। ভয় পেয়ে এরা কাঁপে না কখনো। জগমলের ব্যবহারে এতটা ক্রোধান্বিত হয়ে উঠেছে যশোবন্ত যে তার মতো বয়স্ক লোকের পক্ষে ধৈর্য রাখা কঠিন হয়ে উঠেছে। অথচ তার মুখে কোনোরকম বিকৃতি নেই। যেন পাথরে খোদাই করা সৌম্য এক বৃদ্ধের মূর্তি। জিৎ সিং দেখতে পায় আশেপাশের সবার দৃষ্টি বৃদ্ধের দিকে নিবদ্ধ। তারা রাগে ফুলছিল। বৃদ্ধের এক ইঙ্গিতে জগমলের দেহ সহস্র ছিদ্রযুক্ত হয়ে ওখানে লুটিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এক অদৃশ্য শৃঙ্খলাবোধ তাদের বেঁধে রাখে। কোনোরকম চাঞ্চল্য প্রকাশ করতে দেয় না।

জগমলের হুঙ্কারে পৃথিবীর গতি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্যে থেমে থাকে। সময়ের গতিও যেন স্তব্ধ হয়ে যায়।

সেই সময় শংকরীর কণ্ঠস্বর আবার স্তব্ধতা ভঙ্গ করে,–কি হল বুড়ো। অমন হাঁ করে আছো কেন? বন্দুকের চেয়ে চাবুকের জোর আবার কবে থেকে বেশি হল? তুমিও উল্টো বুঝলে নাকি? কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাঁচ-ছশো বন্দুক হবে না? ওই খ্যাপা ছোকরা মেবারের মাথায় বসলে যে রাজোয়ারা রসাতলে যাবে।

শংকরীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক অস্ত্রের একসঙ্গে নড়ে ওঠার মিলিত আওয়াজ শোনা যায়। চিতোরের বীভৎস দৃশ্য এদের চোখে এখনো স্পষ্ট। সে দৃশ্য এরা জীবনের শেষ মুহূর্তেও ভুলবে না—ভুলতে পারে না। তাই চিতোর থেকে অনেক দূরে এই নিরাপদ স্থানে পলাতক রানার এক অপদার্থ পুত্রের ঔদ্ধত্য তাদের পরিশ্রান্ত স্নায়ুর ওপর প্রবল চাপের সৃষ্টি করে। এতদিনের জন্মগত সংকল্প ভুলে গিয়ে অস্ত্রগুলো ভালোভাবে চেপে ধরে ওরা।

জগমলের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে কোনোমতে বলে,—রানা তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। কবে যাবে?

কেউ জবাব দেয় না।

জগমল এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে জবাব না পেয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় প্রাসাদের দিকে। তার মনে আশঙ্কা জাগে এখুনি হয়তো একসঙ্গে অনেক বন্দুক গর্জে উঠবে। কিন্তু তার আশঙ্কা অমূলক। পরিবর্তে শুনতে পায় মিলিতকণ্ঠের অট্টহাসি। বিদ্রূপ করছে ওরা তাকে।

অপস্রিয়মাণ অশ্বের দিকে জিৎ সিং একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ওদের হাসি তার কানে যায়। সে ভাবে, এই রাজপুত্রই একদিন হয়তো মেবারের রানা হয়ে বসবে। এই রাজপুত্র যে কয়েকখানা অস্ত্রের নড়ে ওঠার আওয়াজ শুনে নিজের ঔদ্ধত্য, নিজের গর্ব নিজের ক্রোধ, সবকিছুকে বিসর্জন দিয়ে কুকুরের মতো পালিয়ে গেল। হায় রাজোয়ারা! এ দৈন্য ঢেকে রাখবে কি করে? রাজপুতরা যে একমাত্র রানাকেই পৃথিবীর মাটিতে দেবতার সম্মান দেয়।

রাজপুতানার ললাটে ভবিষ্যতের জন্যে কী লেখা হয়েছে চিতোরের পতনেই তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু অসহায়ের মতো মার খেতে খেতে না মরে যুঝে মরতে যে আনন্দ সে আনন্দটুকু লাভের সুযোগও বুঝি হারিয়ে গেল। আগ্রার সূর্য এখন মধ্যাকাশের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সূর্যের বিপুল সম্ভাবনা, বিপুল তেজ। তবু তাকেও রাহুর গ্রাসের মতো সাময়িকভাবে আচ্ছন্ন ক’রে দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু দেবে কে? সারা রাজোয়ারায় কি তেমন একটি প্রাণীও আছে যাকে সম্মুখে রেখে সমস্ত অধিবাসী জীবনপণ করতে ভরসা পায়? হয়তো নেই।

হতাশায় ভরে যায় জিৎ সিং-এর মন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে শয্যায় শায়িত রক্তাক্ত কলেবর পিতা অজিত সিং-এর মুখ। বৃথাই তোমার সামনে শপথ করেছিলাম বাবা। কত আশা ছিল মনে—বাপ্পার বংশের ওপর কতখানি বিশ্বাস। অবশিষ্ট রইল না কিছুই। তবু শপথ রাখতে জীবন দেব। কিন্তু কোনো আনন্দ কোনো উৎসাহ পাব কি আমার এই কঠিন ব্রত পালনে? সামনে কোনো আলোই দেখতে পাই না। তুমি যেখানে গেছ বাবা সেখান থেকে আমার মনে কি এমন আলো প্রজ্বলিত করতে পার না যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে সব হতাশা থেকে মুক্ত রেখে সঠিক পথে নিয়ে চলবে? নইলে অস্ত্রবল বুদ্ধিবল…সবকিছুই হয়তো হারিয়ে ফেলব। কিংবা আলোর একটি রশ্মি অন্তত চোখের সামনে তুলে ধর, সেটুকু দেখে যাতে নিজেকে বুঝিয়ে রাখতে পারি। পারবে কি বাবা? যেখানে তুমি গেছ সেখানে একলিঙ্গের স্থায়ী আসন। সর্ব শক্তিমান একলিঙ্গ তোমায় দূরে সরিয়ে রাখেননি জানি। তাই তোমারও আজ অশেষ শক্তি এটুকু অন্তত কর। আলোর রশ্মি দেখাও।

মস্তকে কার করস্পর্শে জিৎ সিং-এর চমক ভাঙে। চেয়ে দেখে যশোবন্ত।

—কি ভাবছো?’

—না কিছু না।

—বলবে না? যশোবন্ত মৃদু হাসে।

জিৎ সিং চুপ ক’রে থাকে।

—দুঃখ পেয়েছ। তাই না।

—হ্যাঁ।

আমিও। তাই এদের মতো হেসে উঠতে পারলাম না। তুমি তো তরুণ, তোমার বিশ্বাস আরও গভীর। কিন্তু আমি? জীবনের ষাটটি বসন্ত পার হয়ে এসেছি। অথচ কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি রানাবংশের কোনো কুমার এমন হতে পারে।

—মেবার আর মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। তাই দুঃখ হয়।

—কে বলল সে কথা? বৃদ্ধের চোখদুটো জ্বলে ওঠে।

—দেখে তাই মনে হয়।

—না। ভুল মনে হয়েছে তোমার। বাপ্পার বংশের রক্তের ধারায় রয়েছে একলিঙ্গের আশীর্বাদ। সে ধারায় যত খাদই মিশুক না কেন, মাঝে মাঝে স্ফুলিঙ্গ দেখা দেবেই—যে স্ফুলিঙ্গ অগ্নিকাণ্ড ঘটাবার শক্তি রাখে।

জিৎ সিং-এর মস্তিষ্কের কোনো স্থানে প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগে। সেই ঝাঁকি কয়েক মুহূর্তের জন্যে তাকে আচ্ছন্ন করে। তারপর সে বৃদ্ধের দিকে চায়। সে দেখতে পায় একজন প্রকৃত রাজপুত কথা বলছে তার পাশে দাঁড়িয়ে। এর সাহস আছে, শক্তি আছে, সব আছে, কিন্তু তার সঙ্গে এমন আর একটি জিনিস রয়েছে যা সমস্ত রাজপুত জাতিকে দিয়ে মাঝে মাঝে যেমন অসাধ্যসাধন করিয়েছে তেমনি কখনো কখনো চরম দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই জিনিসটি হল ভাবাবেগ। এই ভাবাবেগের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক খুব সামান্যই

আজ বৃদ্ধও এই ভাবাবেগ পরিচালিত। হয়তো তার কথা সত্যি হয়েও উঠতে পারে। অন্তত রাজপুত জাতির চিত্তের দিগন্তব্যাপী হতাশাকে কিছু দিনের জন্যেও ঠেকিয়ে রাখবার শক্তি রাখে এ জিনিস। তবু জিৎ সিং নিজেকে সঁপে দিতে পারে না এর হাতে। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করে, এর প্রভাবে পড়ে কোনোদিনও নিজেকে চালিত করবে না। বাস্তবতা আর বুদ্ধি এই দুটিই হবে তার জীবন-শকটের দুই চাকা।

বৃদ্ধ জিৎ সিং-এর চিন্তান্বিত মুখের দিকে চেয়ে বলে,—আমার কথা বিশ্বাস করতে পারলে না?

—বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস কোনোটাই করিনি।

—তার মানে? বৃদ্ধের চোখে জিজ্ঞাসা।

—তোমার কথা হয়তো সত্যি। তবে সে শক্তি চোখে দেখে যাচাই ক’রে নিতে চাই।

—বাপ্পা-বংশের রক্তের ওপর অবিশ্বাস?

—বললাম তো। চোখে দেখব, তবে বিশ্বাস করব। না দেখলে বিশ্বাসও করব না।

বেশ। তাই দেখো। তবে এ অবিশ্বাস মোটেই শুভলক্ষণ নয় জিৎ সিং।

জিৎ সিং কোনো জবার দেবার আগেই শংকরী এগিয়ে এসে বৃদ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে কৃত্রিম রোষে বলে ওঠে,—আমি পাগলী?

—কে বলেছে?

—ওমা, তুমিই বললে যে গো, ওই ভীতু রাজকুমারকে।

—বলতে বাধ্য হয়েছিলাম।

—বাধ্য?

—হ্যাঁ।

—কেন? বাধ্য হলে কেন?

—তুমি রানাকে সুদ্ধ অপমান করেছ। অপ্রীতিকর কিছু ঘটতে পারত।

—কি ভাবে ঘটবে?

—রাজকুমারের হাতের চাবুক তোমার গায়ে পড়তে পারত

—অত সহজে?

—না। সহজে হয়তো নয়। তবে পড়লেও বিস্মিত হবার কিছু ছিল না। কারণ যুবকটি স্বয়ং রানার পুত্র।

—তোমরা ছেলে কি করতে?

—আমরা? আমরা হয়তো মেরে ফেলতে পারতাম ওকে। কিন্তু তার আগে অন্তত চাবুকের এক ঘা তোমায় খেতে হত। তোমার পিঠে চাবুক পড়তে পারে এই অনুমান ক’রে আগে থেকে কখনো তাকে হত্যা করা যেত না।

—হয়তো তোমার কথা সত্যি। হয়তো চাবুকই পড়ত আমার পিঠে। তবু সেও ছিল ভালো। জেনে যেতো একজন সুস্থ মস্তিষ্কের চিতোর-বাসিনীর রানার সম্বন্ধে কী ধারণা। কিন্তু তুমি আমার পাগলী বানিয়ে যে অপমান করলে তার তুলনা নেই।

জিৎ সিং অবাক হয়ে লক্ষ্য করে কৌতুকের ছলে কথা শুরু করেও বয়স্কা স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর হঠাৎ যেন অভিমানে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। বৃদ্ধ যশোবন্তও কম বিস্মিত হয়নি। সে অভিনিবেশ সহকারে লক্ষ্য করবার চেষ্টা করে এই কথাগুলোও তার অন্যান্য কথার মতো শংকরী অভিনয়ের ঢঙ-এ বলছে কিনা।

শংকরী হঠাৎ থেমে যায়। একটু লাজুক হয় যেন সে। তারপর লজ্জা দমন ক’রে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঢঙ-এ বলে,–কি দেখছ বুড়ো, আমার মুখের পানে চেয়ে?

—না, ভাবছি তুমি সুন্দর অভিনয় করতে পার। তুমি কি সত্যিই দুঃখিত হয়েছ শংকরী।

—হ্যাঁ। হয়েছি। শংকরীর স্বর গম্ভীর।

—আমায় তবে মাফ কর। আমি রানার সঙ্গে সাক্ষাতের আগে কোনোরকম শান্তিভঙ্গ হতে দিতে চাইনি। সবে তো এসে পৌঁছোলাম। এর মধ্যেই বিরোধ বাধিয়ে লাভ কি।

—বিরোধ কি এড়িয়ে যেতে পারলে? রাজপুত্র এতক্ষণে রানার সামনে দাঁড়িয়ে তোমাদের গুণকীর্তন করছে না নিশ্চয়ই। রানার চিত্তে বিরোধের বীজ ইতিমধ্যেই রোপণ করা হয়ে গেছে। তবে রানা, নামেই শুধু রানা—এই যা ভরসা। নইলে আমি যা বলেছি বাপ্পাবংশের অন্য কোনো রানা আজ যদি জীবিত থাকতেন তাহলে এই একসহস্র লোক ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়ে যেত। রানা ভীতু বুঝলে বুড়ো? রানা ভীতু। রানা সব রকম লড়াইকে ভয় করেন। আমি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম রানার মধ্যে আগুনের কিছুমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে কি না। তাই কথাগুলি ছুড়ে মেরেছিলাম কুমারের দিকে। কিন্তু নেই—আগুন নেই। নিভে গেছে আগুন। যেটুকু ছিল তাতে জল ঢেলে দিয়েছেন আগ্রার আকবর শাহ্। নইলে এতক্ষণে এই চমৎকার সরোবরের ধারে দেখতে পেতে সৈন্যদের কুচকাওয়াজ। আমার দুঃখ হয় বুড়ো। আমার যদি আজ কালপীর ওপর কিছুমাত্র টান থাকত তবে হয়তো সেখানেই চলে যেতাম। কিন্তু নেই। আমাদের কারও সে-টান নেই। তাই নামে কালপীর দল হয়েও আমরা রাজপুত হয়ে গেছি।

শংকরীর কথাগুলো শেষ হবার পর বহুক্ষণ স্তব্ধতা বিরাজ করে। জিৎ সিং সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। রমণী হয়েও এর মধ্যে ভাবাবেগ অনেক কম। তাই বৃদ্ধের চেয়ে এর বুদ্ধি তীক্ষ্ণ এবং কার্যকরী। এই কয়দিনে তার প্রমাণ বহুবার পেয়েছে সে।

.

লীলাবতী দুই হাতের ওপর মুখখানি রেখে বসেছিল।

সে বসেছিল একটি গাছের গায়ে হেলান দিয়ে। এতগুলি লোকের মধ্যে থেকেও সে নিঃসঙ্গ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল উদয়সাগরের জলের দিকে। সেই জলের ওপর সূর্যের রশ্মি ধীরে ধীরে রূপালি হয়ে উঠেছে। রূপালি রশ্মির তেজ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলের অনেক অংশে দৃষ্টি পড়লে চোখ ঝলসে উঠেছে। তবু সে মুখ ফেরায়নি।

গোপাল সিং তাকে বৃদ্ধ যশোবন্তের তত্ত্বাবধানে রেখে চলে গেছে। চলে গেছে অনেক—অনেক দূরে। বাবার নাগাল আর এ জীবনে সে পাবে না। এ দলের মধ্যে তার মতো ভাগ্যাহতা অনেক রয়েছে। তাদের জীবনে এ জাতীয় আঘাত নতুন নয়। এমন আঘাতের জন্যে মন সব সময় প্রস্তুত থাকে। তবু যেন ঠিক সামলে উঠতে পারছে না। হয়তো তার জীবনে পিতা ভিন্ন আর কেউ কখনো ছিল না বলে এমন হয়েছে। কে আছে তার? কেউ নেই। এককালে সমস্ত দলটি তার বাবার কথায় পরিচালিত হত। কিন্তু এরা তার নিজের লোক নয়। নিজের লোক হলে রাম সিং অমন ব্যবহার করতে পারত না। পিতা জীবিত থাকলে এমন ব্যবহার করলে ততটা ক্ষতি ছিল না। কিন্তু পিতা মৃত জেনেও তার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে রাম সিং, সেই ব্যবহার তাকে পশুত্বের শেষ সীমানা নামিয়ে দিয়েছে। এরা তার কেউ নয়। অনেকের মনে তার জন্যে সমবেদনা জেগেছে, অকৃত্রিম সহানুভূতিতেও অনেকের হৃদয় পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু সেই সমবেদনা, সেই সহানুভূতির সঙ্গে পিতৃস্নেহের কোনো তুলনা হয় না।

পিতার কথা কাকে বলবে সে? কাকে বলে মনের দুঃসহ বোঝা লাগব করবে? যাকে এতদিন সব কথা বলত সেও যে অন্য রকম হয়ে উঠেছে। রাখী তার ছেলেবেলার বন্ধু। সেই রাখীরও যে সহসা এতটা পরিবর্তন হবে কে জানত? রাম সিং-এর কথা তাকে বলতেই সে রেগে উঠেছিল। বলে উঠেছিল,—অতটা হীন কখনো হতে পারে না রাম। সে প্রকৃত বীর। জীবনে রাখী সেই প্রথম তার কথায় রাগ করল। খুবই স্বাভাবিক। আজ যে তার বাবা বেঁচে নেই। আজ যে তার মাথার ওপরের আশ্রয়টুকু বিলুপ্ত। তাই কেউ তাকে সহ্য করতে পারে না আজ

গত রাতে একটি জিনিস লক্ষ্য করেছে সে। লক্ষ্য ক’রে স্তম্ভিত হয়েছে। যে রাম সিংকে গুটিকয়েক যুবক ছাড়া দলের সবাই বর্জন করেছে, গাছের নিবিড় অন্ধকারের সুযোগ পেয়ে রাখী তারই কাছে চলে গেছে। কালকের ঘটনা দৈবাৎ সে দেখতে পেয়েছে। কিন্তু এমন আগেও কত হয়েছে কে জানে? কিন্তু কেন অমন যায় রাখী? সে কি তবে রাম সিংকে পছন্দ করে? তেমন কোনো গুণ রাম সিং-এর মধ্যে আছে কি?

লীলাবতীর মুখখানা একটু রাঙা হয়ে ওঠে পছন্দ করার কথা মনে হতে। তার চোখের সামনে ভাসে জিৎ সিং-এর রাঙা কোমল মুখখানা। সেদিনের পর পথের মধ্যে কতবার জিৎ সিং-এর কথা তার মনে পড়েছে। যতবারই মনে পড়ছে ততবারই তার একটি উক্তি যেন সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে,—’পথ আমি ছাড়ব না।’ দৃপ্ত ভঙ্গিতে অমন জোর গলায় ঘোষণা ক’রে জীবনে কাউকে সে রুখে দাঁড়াতে দেখেনি। তখনি জানত লীলাবতীর একে তুচ্ছ ক’রে কোনোমতেই সে চলে যেতে পারবে না। ভেতরে ভেতরে সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। শুধু পিতার মৃত্যুসংবাদ তাকে পাগল ক’রে তুলেছিল বলেই বৃথা চেষ্টা ক’রে চলেছিল তার পরেও।

এই ঘটনার পর জিৎ সিংকে সে কতবার দেখেছে প্রতিদিন। কতবার ইচ্ছে হয়েছে তার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু জিৎ সিং তাকে দেখতে পেয়েই সরে গেছে অন্য দিকে। আশ্চর্য মানুষ। এমন হয়, সে জানত না। রাখীর কাছে নানান গল্পে শুনে তার মন যতটুকু পরিণত হয়েছিল তাতে .এই ধারণাই ছিল তার, পুরুষেরা এগিয়ে আসে—সরে যায় না। জিৎ সিং সরে যায়। কেন? সে সবে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়, তা কি বুঝতে পারে না? লীলাবতী ভাবে, সে যেমন ক’রে জিৎ সিং-এর কথা চিন্তা করে জিৎ সিং কি তেমনি ক’রে তার কথা ভাবে? হয়তো ভুলেই গেছে এই এক সহস্র লোকের মধ্যে লীলাবতী নামে কোনো মেয়ে রয়েছে। ভুলে গেছে বললে ভুল হবে। তবে বিশেষভাবে তার মনে কোনো ছাপ পড়েনি নিশ্চয়ই। দলে তার বয়সি অন্য মেয়ের মতো সে-ও একজন মাত্র।

সেদিন যদি জিৎ সিং-এর সঙ্গে এমন রূঢ় ব্যবহার না করত, তবে হয়তো এভাবে সরে সরে যেত না সে। কারণ সেদিন সে স্পষ্ট বুঝেছিল ও-ও নিঃসঙ্গ। ও তার চেয়েও নিঃসঙ্গ। সে তো দলের অনেককেই চেনে। তার বাবারই দল এটা। কিন্তু জিৎ সিং চিতোরের রাস্তা থেকে এসে তাদের দলে মিশেছে। সেদিন অনেক কথা বলে মনের ভার লাঘব করতে পারত জিৎ সিং। ইচ্ছেও হয়তো ছিল তার। কিন্তু সুযোগ পায়নি তারই রূঢ় ব্যবহারে। আজ তাই দূরে থাকছে সে। বুঝে ফেলেছে, এদের সঙ্গে থাকতে হলে মুখ বন্ধ ক’রে থাকতে হবে। এদের সঙ্গে থাকতে হলে শুধু সাধারণ কথাবার্তাই বলতে হবে—তার বেশি নয়।

লীলাবতী গাছের সঙ্গে ভালোভাবে হেলান দিয়ে বসে। হাত দুটো গাল থেকে সরিয়ে দুই হাঁটুকে একত্রিত করে তার ওপর জড়িয়ে রাখে। তার দেহমন কেন যেন বড় বেশি চঞ্চল হয়ে ওঠে। নিজেকে নিজেই সে চিনে উঠতে পারে না। কেন এমন হচ্ছে? কেন একজন অপরিচিত তরুণ এভাবে তার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে?

লীলাবতী দেখতে পায় দল ছেড়ে রাখী এগিয়ে আসছে তার দিকে। চিতোর হলে এই রাখীকে এগিয়ে আসতে দেখলে তার মন আনন্দে নেচে উঠত। অথচ আজ আর তেমন হচ্ছে না। আজ রাখীকে দেখে বিতৃষ্ণা জাগছে। এসেই হয়তো রাম সিং-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে।

রাখী কাছে এসে নিঃশব্দে বসে পড়ে। লীলাবতী কোনোরকম আগ্রহ প্রকাশ করে না।

—তুই আমার ওপর রাগ করেছিস লীলা?

—না।

—হ্যাঁ, রাগ করেছিস।

লীলা চুপ ক’রে থাকে।

—লীলা। তুই কখনো ভালোবেসেছিস?

চমকে ওঠে লীলাবতী। রাখী যেন কাঁদছে। তার কথায় কান্নার রেশ। সে রাখীর মুখের দিকে চেয়ে দেখে অতিকষ্টে কান্না রোধ করবার জন্যে ঢোক গিলছে সে।

—তোর কিছু হয়েছে রাখী?

—হ্যাঁ। না কিছু হয়নি।

লীলাবতী আবার চুপ করে থাকে। হয়তো রামের সঙ্গে কোনো রকম ঝগড়া হয়েছে।

—লীলা। আমার কথার উত্তর দিবি না তো?

—কোন কথা?

—তুই কাউকে ভালোবেসেছিস?

—হ্যাঁ।

—বেসেছিস? কাকে? রাখীর চোখে কৌতূহল ফেটে পড়ে।

—বাবাকে। চিতোরকে। মেবারকে।

—সে ভালোবাসা নয় রে। মেয়েদের আসল ভালোবাসা।

—আসল ভালোবাসা? এগুলো তবে নকল?

—না। নকল নয়। তবে আসলও নয়।

—আসল তবে কি?

—আসল ভালোবাসায় সব সময় শুধু একজনের কথাই মনে হয়। একজনের কথা ভেবে কখনো আনন্দে মন নেচে ওঠে, আবার দুঃখে জল ঝরে। শুধু একজন। সে ছাড়া পৃথিবীর সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে যায়। পৃথিবীর কারও কথা মনে থাকে না। বাবা মা-ভাই-বোন-কারও কথা নয়। সেই ভালোবাসা কখনো আপন মনে কথা বলায়, কখনো অভিমান করায় কখনো দেহমনকে এমন আনন্দে ভরিয়ে দেয় যে ছোটাছুটি করতে ইচ্ছে হয়। বেসেছিস তেমন ভালো কখনো?

লীলাবতীর মুখের রক্ত অন্তর্হিত হয়। রাখী এ কোন্ রহস্যের কথা বলছে তাকে? এ রহস্য যেন একটু চেনা চেনা। অথচ ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। এ কোন্ ভালোবাসা?

ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সে বলে,—না।

—আমি জানতাম।

—এমনভাবে কাউকে ভালোবাসা যায়?

—যায় বৈ কি। নিশ্চয়ই যায়। নিজের জীবনের মূল্য তখন দেখবি কানাকড়িও নয়। আর একটি জীবনই সব। সেই জীবনটি ভগবান হয়ে ওঠে।

—তোর মন সুস্থ নেই রাখী।

—আছেরে আছে। সুস্থ আছে বলেই বলছি। কী জানি এর পরে হয়তো কোনোদিনই আর বলবার সুযোগ হবে না। জানিস লীলা, নিজের জীবন যেমন তুচ্ছ হয়ে যায়, তেমনি বাঁচতেও সাধ হয় খুব। ভালোবেসে বুকের ভেতরে তুষের আগুনের মতো পুড়তে থাকে। সেই পোড়াটাই সুখ।

—কী সব বলছিস রাখী?

—ঠিক কথা বলছি।

—কাকে এমনভাবে ভালোবাসা যায়?

—পুরুষকে।

লীলা এবার স্পষ্টতই কেঁপে ওঠে।

—কেঁপে উঠলি লীলা? কেন, পুরুষকেই তো ভালোবাসে মেয়েরা। অধিকাংশক্ষেত্রেই অপরিচিত পুরুষকে। সে পুরুষ সমবয়সিও হতে পারে। বয়সে বড়ও হতে পারে। সামান্য ছোট হলেও কিছু এসে যায় না।

—রাখী, তুই থামবি? লীলাবতী চাপা গলায় তাড়া দেয়। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তার বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করে। রাখী যেন তাকে পাগল ক’রে দেবার জন্যে ষড়যন্ত্র ক’রে এসেছে।

—না লীলা। আমি থামব না। আমি বলবার জন্যেই এসেছি যে। নিজের বুকের পাষাণভার হালকা করে দেবার মতো আরাম আর কিছুতে নেই। আমি বলতে এসেছি। আমি বলব।

রাখী রীতিমতো উত্তেজিত।

—তুই ভালোবাসিস রাখী?

—হ্যাঁ লীলা। আমি ভালোবেসেছি। যেমন ভালোবাসার কথা তোকে বললাম, ঠিক তেমনি কিন্তু আমার ভালোবাসায় গলদ রয়েছে। আমি প্রতিদানের প্রত্যাশা করি। আমি বাঁচতে চাই। বেঁচে থেকে ভালোবাসার স্বাদ আস্বাদন করতে চাই। তাই ঠকেছি আমি।

—ভালোবেসে ঠকেছিস! ভালোবেসে তবে ঠকেও?

—না। ভালোবাসায় ঠকে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার ভালোবাসায় স্বার্থ মিশেছিল কোথাও। নইলে এমন হবে কেন? নইলে এত নীচে নামব কি ক’রে আমি? তোর সঙ্গে আমার সেই শৈশব থেকে সখিত্ব। তোরও সর্বনাশ করবার চেষ্টা করেছি অন্ধ হয়ে। লীলা, আমার ভালোবাসা আমাকে মর্ত থেকে স্বর্গে না তুলে পাতালে নামিয়েছে।

—এসব তুই কি বলছিস রাখী?

লীলাবতীর মনের সমস্ত স্থৈর্য নষ্ট হয়। তার সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে ওঠে।

—যাকে আমি ভালোবাসি লীলা, সে আমায় বিন্দুমাত্রও ভালোবাসে না। সে পৃথিবীতে কাউকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে না। কারণ সে নিজেকে বড় বেশি ভালোবাসে।

—কে? কার কথা বলছিস?

—নাম বলব না। বলব না বটে, তবে একদিন নিশ্চয়ই তোরা জানতে পারবি। সেদিন আর বোধহয় বেশি দূরে নয়

লীলা অনুমান করতে পারে পুরুষটি কে। রাখীর কথাবার্তা এবং গত রাতের ঘটনা, এই দুয়ে মিলে তার অনুমানকে দৃঢ় ক’রে তোলে। সে চুপ ক’রে থাকে।

রাখী বলে চলে,—আমার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ নয় বলেই আমি যাচাই করতে গেছি সে আমায় ভালোবাসে কি না। সে ভালোবাসে না। সে যদি বিন্দুমাত্রও ভালোবাসত আমায়, তবে আমি মহীয়সী হয়ে উঠতে পারতাম—পিশাচী হতাম না।

লীলা এবারে উঠে দাঁড়ায়। রাখীর হাত ধরে টেনে তুলে বলে,—আর নয় রাখী। এবারে থাম।

—হ্যাঁ। আর বলব না। তবে একটি কথা বলে রাখি। আমি মরেছি সই, আমি মরেছি।

—মরেছিস? কেন?

—বুঝতে দেরি হবে না তোদের।

রাখী হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। লীলাবতী থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে সান্ত্বনা দেবে।

শেষে একসময় রাখী নিজেই উঠে চলে যায়। লীলাবতী নিশ্চিন্ত হয়। সে অনুভব করে, রাখীর এত কথা, এত আত্মবিলাপ আর অনুশোচনাও তাকে তার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারল না। সে অনেক দূরে সরে গেছে। বেঁচে থেকেও রাখী অনেক দূরে গেছে। তার বাবা গোপাল সিং যতটা দূরে প্রায় ততটা দূরেই। সেখান থেকে আর কোনোদিনও তার হৃদয়ে উষ্ণ সান্নিধ্যে ফিরে আসতে পারবে না রাখী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *