আরাবল্লী – ৩

৩.

জিৎ সিং নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে সব কিছু লক্ষ্য করছিল। কিভাবে রাম সিং গায়ে পড়ে বৃদ্ধের তর্ক জুড়লো, দেখে বিস্ময়বোধ করছিল। আর মনে মনে ভাবছিল, যে মানুষের মধ্যে সংকোচ বলে কোনো পদার্থ নেই, আত্মসম্মানবোধের বালাই নেই, সে মানুষ সাংঘাতিক। তাকে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস করা যায় না। নইলে একটু আগে ওই ঝোপের মধ্যে যে ঘটনা ঘটে গেল তারপরই এমন বিক্রম দেখানো একমাত্র ওর পক্ষেই সম্ভব। তাই বৃদ্ধের আহ্বানে যখন সমস্ত দলটি সাড়া দিয়েছিল, মনে মনে আনন্দ অনুভব করেছিল সে।

কিন্তু একী? একী বলল রাম সিং!

সমস্ত বনভূমি যেন আর্তনাদ করে উঠল। সে আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয় গাছপালা পাথর আর ছোট ছোট পাহাড়ে। উত্তেজিত জিৎ সিং উঠে দাঁড়ায়। একবার ভাবে এখুনি ছুটে গিয়ে রামকে আক্রমণ করে। কিন্তু না। কোনো রাজপুতকে সে অযাচিত ভাবে আক্রমণ করবে না। কোনো অবস্থাতেই নয়। তবে? কি করবে সে? এতবড় দলটি যে প্রবল ঝাঁকি খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে।

জিৎ সিং লক্ষ্য করে, বৃদ্ধের চোখ ব্যাকুল হয়ে ভিড়ের মধ্যে কি যেন খুঁজছে? রামের দিকেও তার বিন্দুমাত্র লক্ষ্য নেই। রামের কথা দলের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল, তাও সে দেখল না।

আর রামের মুখখানা আত্মতৃপ্তির হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে ভেবে বুকখানা তার গর্বে ফুলে উঠেছে। গম্ভীর হয়ে এগিয়ে আসা ভিড়ের দিকে চেয়ে সে বলে—এবারে বল। এখনো বৃদ্ধকেই চাও তোমরা?

কোনো জবাব নেই। যারা গোপাল সিং-এর মৃত্যুর খবর কোনো রকমে জানতে পেরেছে, তারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। দলের এদিক ওদিক থেকে তারা ক্ষীণ কণ্ঠে বলে,—হ্যাঁ এখনো চাই।

কিন্তু আগের সেই সম্মিলিত কণ্ঠস্বর এবারে আর শোনা যায় না। কারণ রামের কথায় বিশ্বাস করেছে অধিকাংশ লোক। গোপাল সিং-এর মৃত্যুসংবাদ চেপে রাখবার দ্বিতীয় কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। একমাত্র উদ্দেশ্য হল ওই পক্ককেশ বৃদ্ধটির বহুদিনের হৃদয়ে পোষণ করা এক উচ্চাশার চরিতার্থতা সাধন। কুঁচকে ওঠে অতগুলো মুখ। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ক্ষীণকণ্ঠের সমর্থন তাদের কুঞ্চিত মুখে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে পারে না।

বৃদ্ধের কিন্তু কোনো বোধই নেই। সে উপলব্ধি করবারও চেষ্টা করে না যে তার প্রতি কতখানি অবিশ্বাস পুঞ্জীভূত হয়েছে ওদের মনে। সে আশঙ্কা করতে পারে না বেঁধে রাখা বন্দুকগুলো ওরা হাতে তুলে নিতে পারে। একসঙ্গে অসংখ্য গুলি তার হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ করতে পারে। তার উদ্বেগাকুল চোখদুটি তখন স্ত্রীলোকদের ভিড়ের মধ্যে একটি মাত্র মুখকে খুঁজে মরছে। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায় না। নিজের জীবন এখন তার কাছে তুচ্ছ। নিজের সম্মানের মূল্য তার কাছে এখন কানাকড়িও নয়। তার মন সাংঘাতিকরূপে আহত একটি কচি হৃদয়ের জন্যে কেঁদে কেঁদে উঠছে।

চিতোর যে-সময়ে পতনোন্মুখ। জয়মল্লের পর পট্টের মৃত্যুতে সমস্ত রাজপুত সৈন্যের মনোবল যখন ভগ্ন ঠিক সেই সময়ে সর্দার গোপাল সিং-এর মৃত্যু হয়েছিল। তার মৃত্যুসংবাদ গোপন রাখবার প্রধান কারণ দলের ঐক্যবদ্ধতা অটুট রাখা। সে সময়ে খবরটা রটে গেলে এমন সার্থকভাবে সমস্ত দলকে সঙ্ঘবদ্ধ রেখে মুঘলদের কবলের ভেতর থেকে কৌশলে বের করে আনা কখনই সম্ভব হত না। কারণ সে সময়ে রাম সিং-এর মতো আরও অনেকেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ভাঙন ধরিয়ে দিতে পারত। তাই সর্দার তার মৃত্যুর আগে বৃদ্ধকে এবং আরও কিছু লোককে, যারা উপস্থিত ছিল তার পাশে, সবাইকে আদেশ দিয়েছিল নিরাপদ স্থানে পৌঁছবার আগে যেন তার মৃত্যুর খবর কাউকে জানানো না হয়। সবশেষে মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে সজলচোখে বৃদ্ধকে অনুরোধ ক’রে বলেছিল,—লীলাবতীকে এ খবর এখন দিয়ো না যশোবন্ত সে তাহলে কিছুতেই চিতোর ছাড়তে চাইবে না। তাকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম, তার মঙ্গলের ভার সম্পূর্ণ তোমার ওপর।

যে ভাঙনের ভয়ে গোপাল সিং-এর মৃত্যুর সংবাদ আগে প্রচার করা হয়নি, সেই ভাঙনই ধরিয়ে দিল রাম সিং। কিন্তু বৃদ্ধের সেদিকে খেয়াল নেই। দলের মঙ্গল সে আজীবন চেয়েছে। তবু এই মুহূর্তে সেই দল তার মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়। পরিবর্তে জেগে ওঠে লীলাবতীর মুখখানি। সে চেয়ে থাকে মেয়েদের দলের দিকে। প্রতিমুহূর্তে সে আশঙ্কা ক’রে এখনি ছুটে আসবে লীলাবতী। আঘাত পেয়ে অভিভূত হলেও আগে কৈফিয়ত চাইতে ছাড়বে না। কিন্তু কই? তা তো এল না। তবে কি এই তীব্র আঘাত সহ্য করতে না পেরে অচৈতন্য হয়ে পড়েছে? তাই বা হবে কি করে? তাহলে অন্যেরা দেখতে পেত।

সমস্ত দলের ভেতরে মুষ্টিমেয় যে কয়জন বৃদ্ধের অবস্থা সঠিকভাবে বুঝেছিল, জিৎ সিং তাদের মধ্যে একজন। সে বুঝে নিল, শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধেরই হার হলো। রাম সিং জিতে গেল।

সে শুনতে পায় রাম নিজের ওপর আস্থা ফিরে পেয়ে স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে বলছে—বল। এবার বল। বুড়োকেই কি তোমরা সর্দার করতে চাও?

মনের এই টালবাহানার মধ্যে কেউ কিছু বলতে চায় না। বৃদ্ধকে তারা প্রত্যাখ্যান করলেও রামকে এত তাড়াতাড়ি মেনে নিতে পারে না।

রসিকা শংকরী হঠাৎ এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। ভিড়ের দিকে মুখ ক’রে বলে,– না। বুড়ো কখনই সর্দার হবে না।

আগের যুবকটি হেসে ফেলে বলে,–এরই মধ্যে ভোল পাল্টে ফেললে দিদিমা?

—না। ভোল আমি পালটাইনি। বৃদ্ধ কোনো সময়েই সর্দার হতে চায়নি। এখনো হতে চায় না। সে গোপাল সিং-এর অনুরোধ রাখছিল মাত্র। কিন্তু তোমাদের জন্যে সেটুকু সম্ভব হল না। তবু একলিঙ্গ রক্ষা করেছেন বলতে হবে। তোমরা যদি চিতোরে মুখ খুলতে তাহলে মুঘলদের মুঠো থেকে একটি প্রাণীকেও চলে আসতে হত না।

বৃদ্ধ এতক্ষণে যেন চেতনা পায়। বলে,—তুমি সবই বুঝেছ দেখছি।

—হ্যাঁ। আমি সবই বুঝি। আমি যে সবার আপনার লোক। আমি জানি গোপাল সিং তোমাদের শেষ হুকুম দিয়েছিল, তার মৃত্যুর কথা নিরাপদে কোথাও পৌঁছোবার আগে পর্যন্ত গোপন রাখতে। আমি জানি তার মৃত্যুর কথা তার মেয়ের কাছেও গোপন আছে। লীলা তা না হলে চিতোর ছাড়ত না কিছুতেই। তবু আকবর-বাতির সামনে আমার মুখ দিয়েই অজ্ঞাতে বের হয়ে পড়েছিল—’হতভাগী’ কথাটা। তুমি রাগ করেছিলে খুব। আমি সবই জানি গো। আমি যে সবার আপনার লোক।

ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যায়।

শংকরী রাম সিং এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গের দিকে ফিরে বলে,—একলিঙ্গ আমাদের রক্ষা করেছেন। বুঝলে? তিনিই তোমাদের মুখে এতক্ষণ কুলুপ এঁটে রেখেছিলেন। নইলে অনেক আগেই তোমরা মুখ খুলতে। এখন দল ভেঙে গেলেও প্রাণে বাঁচবে সবাই। যে যার ইচ্ছে মতো কাজ বেছে নেবে। তবে একটি জিনিস হয়তো হবে না। রাজোয়ারার সম্মানের জন্যে লড়াই করার দিন বোধহয় ফুরিয়ে গেল গোপাল সিং-এর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে।

জিৎ সিং শংকরীর বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানির দিকে চেয়ে বিস্মিত হয়। এই বুদ্ধি মহিলাটির গোপন সম্পদ। এই বুদ্ধিকেই রসিকতার আবরণে ঢেকে রাখে সে।

রামের মুখ ছাই-এর মতো সাদা হয়ে যায়। অনেক কষ্টে যে শক্ত মাটি খুঁজে পেয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই মাটি যেন আবার পায়ের নিচ থেকে দ্রুত অপসারিত হয়। আপ্রাণ চেষ্টায় সে চিৎকার করে ওঠে—চুপ কর।

—তোমার কথায়?

পাগলা কুকুরের মতো ছুটে এসে রাম তার হাত চেপে ধরে।

সঙ্গে সঙ্গে বহুকণ্ঠে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়,—খবর্দার।

রামের হাত শিথিল হয়ে খসে পড়ে। সে শত্রুর তালিকায় জিৎ সিং-এর নামের পরই শংকরীর নাম মনে মনে লিখে রাখে।

রসিকা বলে ওঠে,–কি হল বীরপুরুষ? হাতের শক্তি গেল কোথায়?

জিৎ সিং দেখতে পায় এত কিছুর মধ্যেও বৃদ্ধ রাজপুতটির দৃষ্টি অন্য দিকে। সে আকুলভাবে চারিদিকে চেয়ে দেখছে।

শংকরী এবারে সবাইকে প্রশ্ন করে,–তোমরা কি এখনো রামকে সর্দার করতে চাও?

—না।

—শুনে খুশি হলাম। এবারে তাহলে আমার কথাটি রাখো। গিরো উপত্যকায় পৌঁছবার আগে পর্যন্ত বুড়োকেই চালিয়ে নিতে দাও।

সবাই সম্মত হয়।

মেয়েরা এগিয়ে আসে। রুটির জন্য একে একে হাত পাতে। আর জিৎ সিং বৃদ্ধের চিন্তাকুল মুখের ছাপ মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে অন্যমনস্ক অবস্থায় দল ছেড়ে অনেক পেছনে চলে যায়। তারও মনে চিন্তা দেখা দিয়েছে লীলাবতীর কথা ভেবে। মেয়েটি কোথায় আছে ঠিক দেখতে পায়নি সে। আছে নিশ্চয়ই কোথাও। কিন্তু এখনো কেমন ক’রে স্থির হয়ে আছে ভেবে অবাক হয় সে। তবে কি গোপাল সিং মেয়ের সম্বন্ধে ভুল ধারণা পোষণ করত? যত ভুল ধারণাই পোষণ করুক, মেয়ে হয়ে পিতার মৃত্যুসংবাদ শুনে স্থির হয়ে থাকা অসম্ভব। হয়তো সে কাঁদছে, আর তার সাথীরা তাকে ঘিরে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু তেমন কোনো দৃশ্য তো চোখে পড়ল না জিৎ সিং-এর। মাত্র একসহস্র মানুষের মধ্যে তেমন দৃশ্য চোখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আপন মনে আরও পেছিয়ে আসে জিৎ সিং। যে পথ ধরে তারা চিতোরের দিক থেকে এসেছিল সেই পথেই এক-পা এক-পা ক’রে কিছুদূর অবধি চলে। শেষে অনেকটা সরে এসে থেমে যায়। কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি। লক্ষ্য করবার মতো মনের অবস্থা কারও নেই। যে ঝড় বয়ে গেল এইমাত্র তারই দাপটে সবাই উত্তেজিত। এতক্ষণে তারা রাম সিংকে হয়তো পিষে মেরে ফেলেছে।

একটা পাথরের ওপরে বসে পড়ে জিৎ। তার দৃষ্টি যায় কিছু দূরের গাছপালার ওপর। গাছপালা আরও গভীর হয়েছে পরে। সেই গভীর অরণ্যের ভেতর দিয়েই পথ ক’রে কাল রাতের বেলা তারা এসেছে মশাল জ্বালিয়ে। মশালের আলো আর এত লোকের পদধ্বনিতে হিংস্র পশুরাও পথ ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গিয়েছিল। তাদেরও প্রাণের মায়া আছে। এই বনের সব কয়টি পশু মিলে একসাথে আক্রমণ চালালেও, এক ফুৎকারে মিলিয়ে যেত এতগুলি অস্ত্রধারী লোকের প্রতিরোধ আর পালটা আক্রমণের মুখে। যে দল স্বয়ং আকবর বাদশাহের পরিচালিত বিরাট মুঘল-সেনাদলকে নাজেহাল করতে পারে, তারা অরণ্যের হিংস্রতম পশুদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না।

বনের দিকে চেয়ে জিৎ সিং তন্ময় হয়। সে ভাবে তার বাবার কথা। কোথায় নিয়ে ফেলেছে তাঁর দেহখানাকে ওরা? হয়তো অসংখ্য রাজপুতের মৃতদেহের মধ্যে কোন অলৌকিক কারণে লীলাবতীর বাবা গোপাল সিং-এর দেহের পাশেই রয়েছে তাঁর মৃতদেহ। এই জাতীয় কল্পনা উদ্ভট হলেও বাস্তবে ঘটে যাওয়া একেবারে অসম্ভব নয়। হয়তো এই দুই বীরের দেহ এক হয়ে মাটির নীচে আশ্রয় নিয়েছে। অথবা জড়াজড়ি করে ভস্মীভূত হয়েছে। অমন হলে বেশ হত।

সহসা জিৎ সিং-এর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। সে চোখদুটো রগড়ে নিয়ে একাগ্র হয়ে দূরে বনের দিকে চায়। এইমাত্র একটি মনুষ্যমূর্তি ক্ষণেকের জন্যে দেখা দিয়েই অদৃশ্য হল। মূর্তিটি ছুটে চলছিল। এই নির্জন স্থানে বাইরের কোন মানুষের পক্ষে আসা অসম্ভব। তবে কি মুঘলের চর? কিন্তু মুঘলের চর হলে হেঁটে আসবে কেন? বনের ভেতরে ঘোড়াটিকে লুকিয়ে রেখেছে কি?

জিৎ সিং চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাদের দলে একটি ঘোড়াও নেই। ঘোড়া নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। কারণ সঙ্গে রয়েছে অনেক স্ত্রীলোক আর শিশু। আর হাঁটাপথে এসেছে বলেই দলটিকে সন্দেহ করেনি মুঘলরা।

জিৎ সিং আরও একটু সময় চেয়ে থাকে। কিছুই দেখতে পায় না। অবশেষে সে মূর্তিটিকে অনুসরণ করবে ঠিক করে। কারণ লোকটি যদি মুঘলের চর হয়, তবে এত কষ্টের পরও সহস্র লোকের জীবন নষ্ট হতে বাধ্য। ওই লোকটিকে প্রাণ নিয়ে কিছুতেই ফিরে যেতে দেওয়া যায় না। একবার ভাবে, বৃদ্ধকে গিয়ে খবরটা দেবে। কিন্তু সেই সময়টুকু নষ্ট করলে ও হয়তো একেবারে নাগালের বাইরে চলে যাবে। নিজের ঘোড়ার কাছে পৌঁছবার আগেই ওকে ধরতে হবে। ঘোড়া ওর নিশ্চয়ই আছে। লুকিয়ে এসেছে কোথাও।

জিৎ সিং ছুটতে শুরু করে। ছুটতে ছুটতে বনের প্রান্তে এসে উপস্থিত হলে প্রথম মনে হয় তার, মস্ত ভুল ক’রে বসেছে সে। সঙ্গে তলোয়ার ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র নেই। অথচ দলে বন্দুকের অভাব নেই। সেগুলি প্রকাশ্যে প্রত্যেকে হাতে ক’রে নিয়ে না ঘুরলেও একসাথে জড়ো করা আছে। মুঘল সেনাদের চোখে ধুলো দেবার জন্যে এ-ও এক কৌশল। বন্দুকের বদলে তলোয়ার হাতে নিয়ে তারা চিতোর ছেড়েছে। অতগুলো লোকের হাতে বন্দুক দেখলে তারা একনজরেই বুঝতে পারত কোন দল চলেছে।

জিৎ সিং দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে মুহূর্তের জন্যে থেমে পড়ে আবার ছোটে। ভাগ্যে যা রয়েছে তাই হবে। এখন আর অন্য কিছু করবার অবসর নেই।

বনের ভেতরে প্রবেশ ক’রে কাউকে দেখতে পায় না সে। পায়ে চলার কোনো রাস্তা নেই। তবে যে-পথ ধরে অত বড় দলটি এসেছে সে পথ আভাসে চোখে পড়ে। সেই পথেই সে ছোটে। একজায়গায় বন কিছুটা অগভীর। খানিক দূর পর্যন্ত চোখের দৃষ্টি চলে। সেখানে পৌঁছে প্রথম দেখতে পায় জিৎ সিং। সে দেখতে পায় এতক্ষণের রহস্যাবৃত মনুষ্যমূর্তিটিকে। তখনো অনেকটা দূরে।

মূর্তিটির পায়ের গতি অনেক শ্লথ, মূর্তিটিকে নিদারুণ পরিশ্রান্ত বলে মনে হয়। চলতে চলতে সে টলছে। পা তার উঠছে না। তবু আপ্রাণ প্রয়াসে সামনে এগিয়ে চলেছে।

জিৎ সিং স্তম্ভিত হয়। সে চেনে ওই পোশাক। সে চেনে ওই পোশাকের রঙ। সে আজই দেখেছে। সে আজই ছুঁয়েছে।

মূর্তিটি স্ত্রীলোক।

লীলাবতী।

দ্রুত এগিয়ে চলে জিৎ সিং। একেবারে কাছে গিয়ে আস্তে ডাকে,—লীলাবতী।

সমস্ত দেহখানা কেঁপে ওঠে লীলাবতীর। সে পেছনে দৃষ্টি ফেলে থেমে পড়ে।

—কোথায় যাচ্ছো লীলাবতী?

—চিতোর। রীতিমতো হাঁপায় লীলাবতী।

—সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। জিৎ সিং সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ায়।

—তুমি আমাকে বাধা দিতে এসেছ?

—হ্যাঁ লীলাবতী।

—সময় নষ্ট করো না জিৎ সিং। পথ ছাড়ো।

—লীলাবতী চিতোরে কার কাছে যাবে?

—বাবার কাছে।

—তুমি তো শুনলে সবই। তার পরেও?

—হ্যাঁ। শুনেছি বলেই তো যেতে হবে।

—তাঁর দেহ খুঁজে পাবে না তুমি।

—চেষ্টা করব।

—ওরা চেষ্টা করতে দেবে না। লাখোটা তোরণের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার আগেই ওরা তোমায় তুলে নেবে। অত্যাচার করবে—মেরে ফেলবে।

—না।

—না?

—না জিৎ সিং। ওরা আমায় কিছু করতে পারবে না। লীলাবতী কোমর থেকে তীক্ষ্ণ ছুরিটা বের করে দেখায়।

—ওটিকে তবে হাতে করে নিয়ে যেতে হবে। চিতোরের মাটিতে পা দেবার আগেই ওটিকে ব্যবহার না ক’রে পারবে না।

—তাই করব।

—লাভ?

শেষ চেষ্টা। যদি ওরা বাধা না দেয় কোনো কারণে—

—শোন লীলাবতী—

—জিৎ সিং। রাজপুত হয়ে তুমি অনর্থক সময় নষ্ট করো না। এরপরেও কিছু বলতে চেষ্টা করলে বুঝব রাম সিং-এর সঙ্গে তোমার পার্থক্য নেই।

জিৎ সিং দৃঢ়স্বরে বলে,—তাহলে মুখে আমি কিছু বলব না। তবে পথও ছাড়ব না।

—আমার এই অস্ত্রটি তোমার ওপরই প্রথম ব্যবহার করতে হবে?

—অবুঝ হয়ো না লীলাবতী। তুমি জান, চিতোরে কোন রাজপুত পুরুষের পক্ষেও এখন যাওয়া সম্ভব নয়।

—তোমার উপদেশ আমি শুনতে চাই না জিৎ সিং। পথ ছাড়ো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

—পথ আমি ছাড়ব না।

—জিৎ সিং। লীলাবতী চিৎকার ক’রে ওঠে।

জিৎ সিং তেমনি অটল, অনড়। যেন আরাবল্লী এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। লীলাবতী কাঁপতে কাঁপতে তার ছুরি শূন্যে তুলে বলে, তবে প্রস্তুত হও।

জিৎ সিং অসি টেনে নিয়ে বলে,—আমি প্রস্তুত।

ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে লীলাবতী বলে,—তুমি নারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে? নারীর দেহে অস্ত্রাঘাত করবে?

—না। নারীর দেহে আমি অস্ত্রাঘাত করি না। তবে আত্মরক্ষা করতে অস্ত্র ধরব বৈ কি?

—রাজপুত মেয়ের হাত থেকে বাঁচতে অস্ত্র ধরবে?

—নিশচয়ই ধরব। রাজপুত মেয়ের অহেতুক উত্তেজনায় নিজের প্রাণ বলি দেবার কোনো অর্থ নেই।

—তুমি ভীরু, তুমি কাপুরুষ। পথ ছাড়ো।

—না।

—তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। তোমার দিকে চাইতে পর্যন্ত ইচ্ছে হচ্ছে না আমার। তোমার নাম মুখে আনতে আমার জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসছে। তুমি পথ ছাড়ো।

—না লীলাবতী। ওই অনুরোধটি করো না। পথ আমি ছাড়ব না। এখন চিতোর যাওয়া চলবে না। বুঝছ না কেন? অতদূর কি পৌঁছতে পারবে? আর একটু এগিয়ে গেলেই হিংস্র পশুরা তোমায় মেরে ফেলবে।

—আমি মরলে তোমার কি?

—কিছুই নয়। তবে অনর্থক কেউ মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেষ্টা করলে, তাকে বাধা দেওয়াই সাধারণ মানুষের কর্তব্য।

—সরে দাঁড়াও। লীলাবতী অধৈর্য হয়ে ওঠে।

—না।

—তুমি অমানুষ। তুমি অপদার্থ। রাম সিংও তোমার চেয়ে ভালো।

লীলাবতীর উত্তেজনা দেখে জিৎ সিং চিন্তিত হয়। সে বুঝতে পারে, কোনোরকমেই তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এই মুহূর্তে। সারারাতের পরিশ্রম এবং অনাহার, তার ওপর পিতার মৃত্যুসংবাদ তাকে উন্মাদের মতো ক’রে তুলছে। পিতার মৃত্যুশোক যে কী জিনিস, সে-অভিজ্ঞতা হয়েছে জিৎ সিং-এর। লীলাবতী তো নারী।

লীলাবতী সহসা তার পাশ দিয়ে ছুটতে চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে ফেলে জিৎ সিং। তারপর তার গালের ওপর হাত দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে। শক্ত মাটির ওপর অচেতন হয়ে পড়ে যায় অবসন্ন লীলাবতী।

জিৎ সিং স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অনাথ মেয়েটির দিকে চেয়ে তার প্রাণ কাঁদে সে লীলাবতীর মাথা নিজের জানুর ওপর তুলে নিয়ে তার নিমীলিত চক্ষের দিকে চেয়ে জ্ঞান ফিরে আসবার অপেক্ষায় বসে থাকে।

সময় কাটে। অথচ জ্ঞান ফিরে আসবার কোন লক্ষণই দেখা যায় না। জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরে কেঁপে ওঠে। শেষে নারীহত্যা করে বসল সে? মেয়েটিকে চিতোরের পথে মরতে না দিয়ে নিজেই মেরে ফেলল!

কোষবদ্ধ তলোয়ারের দিকে একবার চায় জিৎ সিং। মনকে দৃঢ় করে নেয় সে। এই নির্জন বনের মধ্যে লীলাবতীর মৃত্যু হলে সে নিজেও আর ফিরে যাবে না। তার দেহও পড়ে থাকবে এই মেয়েটির পাশে।

দূরে অনেক মানুষের চিৎকার শোনা যায়। ওরা হয়তো ডাকছে লীলাবতীকে। কিংবা নতুন কোনো ঝগড়া শুরু করেছে। ওই দল আর বেশিক্ষণ থাকবে না ওখানে। এতক্ষণে হয়তো মেয়েদের খাওয়া শেষ হল। তারা একটিমাত্র মেয়ের জন্যে শুধু শুধু বসে থাকতে চাইবে না। তাদের সর্দারের মেয়ের জন্যেও নয়। একটি জীবনের জন্যে একসহস্র মূল্যবান জীবনকে বিনষ্ট হতে দিতে পারে না তারা।

লীলাবতীর নাকের কাছে কান নিয়ে যায় জিৎ সিং। শ্বাস-প্রশ্বাসের কোনোরকম শব্দ শোনা যায় না। তবু একবার তার মাথায় হাত দিয়ে ডাকে—লীলাবতী।

সাড়া নেই।

জানু থেকে মেয়েটির মাথা সযত্নে মাটিতে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায় জিৎ সিং। কোষবদ্ধ তলোয়ারখানি টেনে বের করে সে। একবার সেই তলোয়ারের দিকে নির্নিমেষ নয়নে চায়। তারপর রাজোয়ারার আকাশ-বাতাস ভূমি অরণ্যানির দিকে চেয়ে নেয়। মৃদু কণ্ঠে প্রার্থনা জানা সে,—হে একলিঙ্গ! তুমি সবই জান। তুমি জান, ওকে আমি মেরে ফেলতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম, ওর মৃত্যু যাতে না ঘটে সেই চেষ্টা করতে। কিন্তু ভাগ্যদোষে নারী হত্যার পাপের ভাগী হলাম। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব আমি। নিজের হাতেই নিজেকে শাস্তি দেব। হে একলিঙ্গ! তুমি তো সব জান। এ মুখ নিয়ে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে আমার মন চাইছে না। মৃত্যুর পরও কি তিনি আমায় ক্ষমা করবেন? তাঁকে তুমি প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে দাও একলিঙ্গ। লীলাবতীকেও বল। সে কী ভাবছে আমার সম্বন্ধে? তার বাবাই বা কী ভাবছেন? হে রাজোয়ারা, তোমার কাছ থেকেই বিদায় নিচ্ছি। তোমাকে বড় ভালোবাসতাম। কিন্তু যে পাপ আমি করেছি, সেই পাপ নিয়ে তো ভালোবাসা যায় না তোমায়। সে অধিকার আমি হারিয়েছি।

জিৎ সিং তার অতিদীর্ঘ তলোয়ারের হাতল মাটির সঙ্গে চেপে ধরে। তারপর অগ্রভাগের দিকে ঝুঁকে পড়বার জন্যে প্রস্তুত হয়, যাতে তীক্ষ্ণ অস্ত্র তার হৃৎপিণ্ডকে ভেদ ক’রে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়।

ঠিক সেই সময়ে বহুদুর থেকে নারীকণ্ঠে কে যেন তার নাম ধরে ডাকে। বাধা পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় জিৎ। চারদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কাউকে দেখতে পায় না।

—আমি ডাকছি।

চমকে ওঠে জিৎ। যাকে সে মৃত ভেবেছিল, সেই লীলাবতী ডাকছে তাকে দুর্বল কণ্ঠে। তলোয়ারখানা কোষের মধ্যে রেখে মাটিতে বসে পড়ে সন্তর্পণে লীলাবতীর একটি হাত তুলে নিয়ে সে রুদ্ধকণ্ঠে বলে,—তুমি বেঁচে আছো লীলাবতী?

—হ্যাঁ।

—তোমার কষ্ট হচ্ছে?

—না।

—আমায় ক্ষমা কর লীলাবতী। আমি তোমাকে শুধু ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছি। তোমায় বাধা দেবার জন্যেই আঘাত করেছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমি অমানুষ, অপদার্থ।

কৈশোরের শেষপ্রান্ত অতিক্রান্ত দুই তরুণ-তরুণী পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। তরুণ অপরের আঁখিতে খুঁজে মরে ক্ষমার চিহ্ন। তরুণী নবীন যুবকের চোখে কী খোঁজে কেউ জানে না। সে নিজেও জানে না। তবে অনেক কিছুই খোঁজে অনেক কিছুই পায়।

লীলাবতী উঠে বসবার চেষ্টা করে। পারে না। জিৎ সিং তাকে ধীরে ধীরে ধরে তোলে। সে সামনে হাঁটু ভেঙে বসে আবার বলে,—আমায় ক্ষমা কর লীলাবতী।

—তুমি আমায় চিতোরে যেতে দেবে না এখনো?

—না। জিৎ সিং-এর স্বর আবার যেন একটু দৃঢ় হয়ে ওঠে।

—কেন দেবে না জিৎ সিং? আমি কী অপরাধ করেছি তোমার কাছে? লীলাবতীর কণ্ঠস্বর জীবনে এই প্রথম এত কোমল শোনায়। তার কথার মধ্যে এতখানি আবেদন, এতখানি নির্ভরশীলতাও এই প্ৰথম।

—তুমি অপরাধ করেছ? না লীলাবতী। অপরাধ করেছি আমি। তুমি ঠিকই করেছ। তবু চিতোরে যাওয়া ভুল হবে।

লীলাবতী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।

জিৎ সিং বলে,–আমায় ক্ষমা করলে না তবে?

—কিন্তু চিতোরে না গেলে যে আমি বাঁচব না জিৎ সিং?

দ্রুত সময় চলে যায়। জিৎ সিং অনুমান করে, এতক্ষণে দলের সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। তারা হয়তো যাত্রা শুরুর আয়োজন করছে। সে গম্ভীর হয়ে বলে,—বেশ তবে তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক লীলাবতী।

লীলাবতীর দুর্বল কণ্ঠেও আনন্দ ঝরে,—আমায় তুমি যেতে দেবে জিৎ সিং?

—হ্যাঁ। তবে একা নয়। আমিও যাব সঙ্গে।

—তুমি যাবে?

—হ্যাঁ।

—কিন্তু ওরা যে তোমাকে মেরে ফেলবে?

—তোমাকেও বাঁচিয়ে রাখবে না। একসঙ্গে দুজনে মরব। তুমি তোমার ওই ছোট্ট অস্ত্রটি নিজের বুকে বিঁধিয়ে দেবার আগে দেখে নেবে আমার এই তলোয়ার কজন শত্রুর বক্ষ ভেদ

করে। দেখে কিছুটা শান্তি পেয়ে মরতে পারবে।

—না। তুমি যাবে না।

—আমি যাব। তুমি গেলে আমি যাবোই।

লীলাবতীর চোখ দিয়ে ঝরঝর ক’রে জল গড়িয়ে পড়ে। সে ফুঁপিয়ে বলে ওঠে—তোমার মতো এমন জেদী মানুষ আমি দেখিনি। কখনো দেখিনি। কোথাও দেখিনি।

জিৎ সিং অপরাধীর মতো মাথা নীচু ক’রে থাকে। লীলাবতীর সমস্ত তিরস্কার মাথা পেতে নেয় সে।

—তুমি যাবেই?

—হ্যাঁ লীলাবতী।

বেশ। তবে আমি চিতোরে যাবো না।

জিৎ সিং আনন্দে চিৎকরে ওঠে। দাঁড়িয়ে লীলাবতীর হাত ধরে তুলে বলে,—তবে চল। শিগগির চল। ওরা বোধহয় এখুনি রওনা হয়ে যাবে। তার আগেই ওদের ধরে ফেলতে হবে। লীলাবতী কয়েক পা গিয়ে আবার টলতে থাকে। সে দাঁড়ায়। জিৎ সিং-এর দিকে চেয়ে বলে, —আমার যাওয়া হল না। তুমি যাও ওদের সঙ্গে।

—তুমি চলতে পারছ না?

—একটু বিশ্রাম না করে কিছুতেই পারব না।

—তবে আমি তোমায় নিয়ে যাচ্ছি। খাওনি বলেই অমন হয়েছে। খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিছু ভেবো না। কিন্তু একজন মেয়েকে একা ফেলে আমি চলে যাব একথা ভাবলে কি ক’রে? তুমি না রাজপুত? তুমি না সর্দার গোপাল সিং-এর মেয়ে?

লীলাবতীর চোখের মধ্যে প্রশংসার দ্যুতি দেখা যায়। সে কোনোমতে বলে,—সর্দার গোপাল সিং-এর মেয়ে বলেই একজন বীরকে আমি আটকে রাখতে পারি না। রানাকে যদি মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি করানো যায়, তবে তোমার মতো বীরের প্রয়োজন হবে জিৎ সিং।

—রাজোয়ারায় বীরের অভাব নেই। মেবারেও নেই। রানা যদি বীর হন, তবে মেবারের সব চাইতে কাপুরুষও তার কাপুরুষতা ভুলে গিয়ে বীর হয়ে যায়। চল, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। কিছু খাওনি বলে তুমি অবসন্ন হয়ে পড়েছ।

জিৎ সিং দুহাত বাড়িয়ে লীলাবতীকে তুলতে যেতেই সে বাধা দিয়ে বলে,—দাঁড়াও।

—কেন?

—তুমি খেয়েছ তো?

—আমি? তাই তো—আমিও খাইনি।

—নিজের কথা তোমার মনে থাকে না?

—আমি একটুও ক্লান্তি বোধ করছি না। চল।

—না।

জিৎ সিং গম্ভীর হয়ে বলে,—আমি জোর ক’রে নিয়ে যাব।

লীলাবতী তাড়াতাড়ি জিৎ সিং-এর হাতের কাছে এসে দাঁড়ায়। তাকে তুলে নিয়ে জিৎ সিং অগ্রসর হয় দলের দিকে।

চলতে চলতে জিৎ বলে,—আমার বাবাও তোমার বাবার মতো চিতোরে পড়ে রয়েছেন লীলা। তবু আমি যাচ্ছি না। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি অস্ত্র কিংবা বুদ্ধি দিয়ে রাজোয়ারার সেবা ক’রে যাব। বাবার শেষ সময়ে তাঁকে বলেছি, রাজোয়ারার মঙ্গলের জন্যেই আমি সারাজীবন চেষ্টা করে যাব। তোমার কথাও আমার মনে থাকবে লীলাবতী। তুমি মেয়ে। তোমার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু তোমার কথা ভেবে আমি দ্বিগুণ শক্তি পাবো। এই সময়ে চিতোরে গিয়ে তুমি কিছু করতে পারতে না।

—তুমি আমাকে দেখলে কেমন ক’রে? আর কেউ তো দেখতে পায়নি।

—দৈবাৎ। রাম সিং যখন তোমার বাবার কথা বলল, তখন থেকেই আমি তোমাকে দেখবার চেষ্টা করছিলাম। তোমার দেখা না পেয়ে দলের পেছনে সরে এসে বসেছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল কে যেন বনের আড়ালে চলে গেল। চলে গেল বললে ভুল হবে, পালিয়ে গেল। ভাবলাম মুঘলের চর। তাকে হত্যা করার জন্যে ছুটে এসেছিলাম।

লীলাবতী চুপ ক’রে থাকে, তার দেহের ভার জিৎ সিংকে একটু কষ্ট দিচ্ছিল। লীলাবতী তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে সে খায়নি। মনে পড়ার পর থেকে তীব্র ক্ষুধা অনুভব করে। সেই সঙ্গে ক্লান্তিও। কিন্তু তবু সে সতেজভাবে এগিয়ে চলে। কারণ লীলাবতী যদি কিছুমাত্রও বুঝতে পারে যে সে ক্লান্ত তাহলে আর এক পাও যেতে দেবে না। চলতে চলতে কথা বলায় পরিশ্রম বেশি। কিন্তু না বললে লীলাবতী সন্দেহ করবে।

—আমি আগেই জানতাম, তোমার বাবার মৃত্যুর কথা। কালই শুনেছি।

—শুনেছিলে?

—হ্যাঁ, তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেলে, তুমি চিতোর ছাড়বে না, একথা জেনেই তোমার বাবা বৃদ্ধকে মানা ক’রে দিয়েছিলেন তোমায় বলতে। বৃদ্ধ তোমার বাবার হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।

লীলাবতী কাঁদতে থাকে। তার চোখের জলে জিৎ সিং-এর পিঠ ভেসে যায়।

—তুমি আমাকে আগে বলনি কেন?

—তোমায় চিনতাম না। চিনলেও বলতাম না।

লীলাবতী চুপ ক’রে থাকে।

তারা ধীরে ধীরে অরণ্যের প্রান্তে ফিরে আসে আবার। গাছের পাশ দিয়ে জিৎ সিং দেখতে পায় দলটি তখনো রয়েছে। কিন্তু কোনোরকম চেঁচামেচির শব্দ কানে আসে না। চুপচাপ বসে রয়েছে তারা।

—এবার আমায় নামিয়ে দাও জিৎ সিং। ওরা দেখে ফেলবে।

—ফেলুক। তুমি তো অসুস্থ।

—তা হোক। আমার লজ্জা করছে।

—লজ্জা? কেন?

—কি জানি? আমার খুব লজ্জা করছে।

জিৎ সিং লীলাবতীকে নামিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে চলতে পারে সে। শরীরে শক্তি না থাকলেও মনের শক্তি সে অনেকখানি ফিরে পেয়েছে। সেই জোরেই সে চলে।

—যদি রাম সিং আমায় দেখতে পেত তোমার বদলে?

—সে-ও ফিরিয়ে আনত। রাম সিং-ও মানুষ লীলাবতী।

—তুমি জান না তাকে

—না জানলেও, এটুকু জানি, একজন মেয়েকে একা সে চিতোরের পথে ছেড়ে দিত না।

—বাধা দিত কেমন করে?

—আমি যেভাবে দিয়েছি।

—তুমি আমাকে আঘাত করেছ।

জিৎ সিং-এর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে বলে,—আমায় ক্ষমা করবে না লীলাবতী?

—আমি তোমার ওপর রাগই করিনি। আমি বলছি রাম সিং আঘাত করতে পারত না। তার সেই শক্তি নেই।

—তোমাকে আঘাত করতে শক্তির প্রয়োজন হয় নাকি?

—হ্যাঁ। রীতিমতো শক্তির প্রয়োজন।

জিৎ সিং অবাক হয়ে লীলাবতীর কথা শোনে। শেষে বলে,—অমন শক্তির আর দরকার নেই আমার।

লীলাবতী এই প্রথম হাসে। বড় ম্লান দেখতে লাগে সেই হাসি। তবু জিৎ সিং-এর আনন্দ হয়। খুব আনন্দ হয়।

বৃদ্ধ রাজপুত দলবল নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। লীলাবতীর চিন্তায় তার কুঞ্চিত ললাট আরও কুঞ্চিত। রসিকা শংকরী দলের মধ্যে বসে নানান গল্প ফেঁদে বসলেও মাঝে মাঝে বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে ছটফট করছিল। দু-চারজন যুবক লীলাবতীর সন্ধানে বের হয়েছে। কিন্তু কারও মনে সন্দেহ জাগোনি যে অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে সে। বৃদ্ধেরও খেয়াল ছিল না যে লীলাবতী গেলে, চিতোরের দিকেই যাবে—অন্য কোনদিকে নয়। আর চিতোরে যেতে হলে যে-পথ ধরে এসেছে ওরা সেপথ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। থাকলেও লীলাবতীর অন্তত জানা নেই।

রসিকা শংকরী বলে চলেছিল রাজপুতদের অতীত গৌরবের কীর্তি কাহিনী। বার বার শুনলেও এসব গল্প রাজপুতদের কাছে চিরনতুন। পুরোনো হয় না কখনো। অন্য কোনো সময় হলে এ-গল্প খুবই জমে উঠত। কিন্তু এই মুহূর্তে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সবাই পুরোপুরি মন দিয়ে শুনতে পারছে না। প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে তাদের, অনর্থক দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। দলের মধ্যে এই চঞ্চলতা আলোড়ন জাগায়। সবার দৃষ্টি আশেপাশে। লীলাবতীর সন্ধানে যারা গেছে, তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক তারা, এই প্রত্যাশাই করছে সবাই; মনে মনে ভর্ৎসনা করছে লীলাবতীকে। একেবারে কচি খুকীটি নয় সে। এ যুদ্ধে অনেকের বাবাই মারা গেছে। তারা শোক করেছে—কেঁদেছে। কিন্তু দলের সঙ্গেই আছে। দলবল ছেড়ে দিয়ে পালায়নি। অতটা বিচলিত হওয়া সাজে না কারও। তাই তাদের কাছে লীলাবতীর অদৃশ্য হওয়াটা আদিখ্যেতা। কয়েকজন তো প্রকাশ্যে বলে উঠল, যে গেছে সে যাক। তার জন্যে এতগুলো প্রাণীকে বিপদে ফেলার কোনো যুক্তি নেই। যে কোনো মুহূর্তে একদল মুঘল সেনা এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। বন্দুকগুলো হাতে হাতে তুলে নিয়ে প্রস্তুত হবারও সময় পাওয়া যাবে না।

রসিকা শংকরী খুব সম্ভব ওদের মন বুঝতে পেরেছিল। কিংবা হয়তো ওদের কথা তার কানে গিয়েছিল। সে উঠে বৃদ্ধের কাছে ফিসফিস করে কি যেন বলে।

বৃদ্ধের চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার চিহ্ন ফুটে ওঠে। সে সবাইকে বলে—তোমরা তোমাদের বন্দুকগুলো হাতে নিতে পার। চিতোর ছেড়ে আমরা খুব বেশিদূর না এলেও এপথে আগ্রার বাদশাহ বেশি সৈন্য পাঠাবেন না। চিতোরে গুছিয়ে নিতে ওদের অন্তত কয়েকদিন সময় লাগবে। তাই ছোটখাটো দল দৈবাৎ এসে পড়লে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। নিজের নিজের অস্ত্র কাছে রাখাই ভালো।

দলের মধ্যে সাড়া জাগে। এতক্ষণ যেন তাদের হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছিল। ছাড়া পেয়েই প্রথম চেষ্টায় যতটা সম্ভব টান টান হবার চেষ্টা করে। একজন অতি উৎসাহী আকাশের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি ছুড়ে দেয়।

বৃদ্ধ চেঁচিয়ে ওঠে,—থামো থামো! ওকি করছ? ওভাবে কখনো বিপদ ডেকে আনতে নেই। লোকটি চেঁচিয়ে বলে,—হাতের আলিস্যি একটু ভেঙে নিলাম সর্দার।

বৃদ্ধ হাসে ছোকরার কথার ধরনে। আর হাসে ওকে ‘সর্দার’ সম্বোধন করায়। ওরা মেনে নিয়েছে তাকে। নিলেই মঙ্গল। গিরো উপত্যকায় গিয়ে যা ইচ্ছে করবে। আশে-পাশে সে সময় রাম সিংকে দেখা যায় না।

ছোকরা আবার বলে,–এ জিনিস হাতে থাকলে আগ্রা এসে ভেঙে পড়লেও ভয় পাই না। এবারে অনেকে হাসে। সে হাসিতে নির্ভয়ের ছাপ।

বৃদ্ধ বুঝতে পারে, এখন লীলাবতীর জন্যে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেও ওরা বিশেষ আপত্তি করবে না। তারই ভুল হয়েছিল। রাজপুত হয়েও রাজপুতের মনের কথা সে বুঝতে পারেনি। রাজপুতরা অসহায় অবস্থায় শত্রু পক্ষের মার খেতে চায় না। মারাত্মক ভুল হয়েছিল তার। চিতোর থেকে বাইরে বের হয়ে গতকাল আকবর বাতির সামনে এসে ওদের হাতে বন্দুক দেওয়া সম্ভব না হলেও, আজ এখানে পৌঁছেই তার প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত ছিল ওগুলোকে হাতে নেবার অনুমতি দেওয়া। সর্দার গোপাল সিং হলে তাই করত। এই পার্থক্যটুকু ছিল বলেই সে প্রবীণ হয়েও সর্দার হতে পারেনি, অথচ নবীন হয়েও গোপাল সিং সর্দার হয়েছিল। বুদ্ধিমান ব্যক্তি অনেক সময়ে মানুষ চিনতে ভুল করলেও জনতা তা করে না। যদিও জনতার মধ্যে বুদ্ধিমানের সংখ্যা আঙুলে গোনা যায়।

বৃদ্ধ তার পাশে দণ্ডায়মান শংকরীর দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এই শংকরীর বুদ্ধি তাকে ক্রমশই বিস্মিত করে তুলছে। সে এসে দলের নাড়ীর খবর না দিলে লীলাবতীর জন্যে আর এক দণ্ডও অপেক্ষা করা চলত কি না সন্দেহ। অথচ এত ক’রেও নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় স্ত্রীলোকটি কিছুতে দিতে চায় না। হয়তো অতীতের কোনো লজ্জা বা কলঙ্ক জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে কিংবা কোনো অভিমান। নইলে স্পষ্টভাবে নিজের পরিচয় কেন দেবে না সে?

বৃদ্ধ আড়চোখে আর একবার শংকরীর দিকে চায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে শংকরী বলে ওঠে,—সময় মতো বিয়ে না করলে এ রোগ হতেই হবে।

—কি বললে?

শংকরী এবারে বুড়ের দিকে চেয়ে বলে,–এই বয়সেও বাঁকা চাহনি কেন বাপু? তার ওপর তুমি পুরুষ। পুরুষমানুষ তো সোজাসুজি তাকায় জানতাম। বুড়ো বয়সে রস বুঝি দৃষ্টিকে বাঁকা ক’রে দেয়?

সহস্র চিন্তা দুর্ভাবনার মধ্যেও বুড়ো হো হো করে হেসে ওঠে। হেসে ওঠে আশে-পাশে যারা বসেছিল সবাই।

শংকরী কৃত্রিম রোষে নাক ফুলিয়ে বলে,—খুব হাসছ সবাই। ও, বুড়ো হয়েছি বলে বুঝি হাসছ? আমারও যৌবন নেই মনে করছ তোমরা। বেশ। তোমাদের কথাই না হয় মানলাম। কিন্তু এমন নির্লজ্জ কাণ্ড যদি ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে ঘটত তাহলে হাসতে পারতে? বুকে হাত দিয়ে বল দেখি? তখন তো তোমাদের মধ্যেই ওই জোয়ানগুলো বুড়োকে সাবাড় করে দিত।

একজন তরুণ তার সদ্য ফিরে পাওয়া বন্দুকটির গায়ে সোহাগভরে হাত বুলিয়ে বলে ওঠে, —তুমি ঠিক বলেছ পিসি। এতক্ষণে আমার বন্দুক থেকে নির্ঘাত একটা গুলি ছুটে যেত। বয়সকালে তোমার রূপ ছিল, দেখলেই বোঝা যায়।

শংকরী ফোঁস ক’রে ওঠে,–কি বললি? পিসি বলে ডাকলি না? তুই কি রাম সিং-এর দলের লোক?

—না পিসি।

—আবার পিসি? পিসির সঙ্গে এসব ঠাট্টা কেউ করে? দিদিমা বল বলছি।

—দিদিমা।

পাশ থেকে আর একটি তরুণ বলে ওঠে,–দিদিমা আমায় বিয়ে করবে গো? তোমার এখনো যে রূপ আছে, সে-রূপ নিংড়ে শেষ করতে করতেই আমার যৌবন চলে যাবে। বল দিদিমা। একবার শুধু মুখ ফুটে বল নাগো। বলতে যদি সরম লাগে তাহলে ঘাড়টা শুধু কাত কর একটি বার। আমি তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।

—করবি বিয়ে? ঠিক বলছিস?

—তবে কি মিথ্যে বলছি? ছি ছি এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলে জানি না। কাল চিতোরের রাস্তায় তোমার ওই চোখের সঙ্গে আমার চোখের মিলন হবার পর থেকেই খাওয়া-দাওয়া ভুলেছি। রাতে তো কেউই ঘুমোতেই পারলাম না পথ চলার জন্যে। তাই স্বপ্নও দেখলাম না। কিন্তু এখানে এসেই ওই ঘাসের ওপর একটু গড়িয়ে নিয়েছিলাম। তার মধ্যেই তোমার উদয় হল স্বপ্নে। আহা! স্বপ্ন যদি অমন সত্যি হত। ওই এক ব্যাটা আছে কি যেন তার নামটা? কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে এমন এক স্বর্গীয় সময়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিল যে তারপর থেকে সব সময় মনের মধ্যে হাহাকার করছে।

—থাম্ মুখপোড়া। লজ্জার মাথা খেয়েছিস্ নাকি? ওদের দশাটা একবার চেয়ে দেখত? একটু রয়ে সয়ে বলতে হয়।

শংকরী আঙুল তুলে অল্পবয়সি কয়টি মেয়ের দিকে দেখিয়ে দেয়। তারা রক্তিম মুখে ঝুঁকে পড়েছিল সামনের দিকে।

তরুণটি তাই দেখে লাফ দিয়ে বন্দুক নিয়ে ছুটে পালায়। সে আগে মেয়ে কটিকে দেখতে পায়নি।

তার চলে যাবার ধরন দেখে আবার এক চোট হাসির রোল উঠল। এই রঙ্গরস শুধু উপলক্ষ মাত্র। হাসি আর আনন্দের আসল কারণ নিজের নিজের অস্ত্রগুলো ফিরে পাওয়া।

বৃদ্ধ ভাবছিল শংকরীর কথা। অদ্ভুত ধরনের স্ত্রীলোক। একে আগে সে কখনো দেখেনি কাল মুঘলেরা চিতোর অধিকারের পর নিজেদের দলবল একত্রিত করার সময়ে একজনের বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল শংকরী। অমন কত স্ত্রীলোক তো এসেছে। কিন্তু কিছুটা পথ চলার পরই শংকরী একসময়ে তার কাছে সরে এসেছিল। তার পাশে চলছিল। বৃদ্ধ বিরক্ত বোধ করেছিল। স্ত্রীলোকদের জায়গা করা হয়েছিল দলের মাঝখানে। তাই শংকরীকে সেখানে যেতে বললেই সে বলে উঠেছিল,—যাচ্ছি, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম।

—কী কথা?

—তোমার নাম কি যশোবন্ত সিং?

—হ্যাঁ। চেনো নাকি আমায়?

—না। কে যেন বলছিল। তাই জেনে নিলাম।

আর একটিও কথা না বলে শংকরী মেয়েদের দলে গিয়ে মিশেছিল। তবে পথ চলতে চলতে অনেক রসিকতাই করেছে। তারপর রাতের বেলায় সে আবার সরে এসেছিল বৃদ্ধের কাছে। অনেক কথা বলেছিল। সেই সঙ্গে নিজের নামটিও। তখন তাকে বৃদ্ধ একজন সাধারণ স্ত্রীলোক ভেবেছিল। কিন্তু সকালে পর পর দুটো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় এখন আর তাকে সাধারণ বলে ভাবতে পারছে না। অথচ কথা বলার ধরন এক এক সময় একটু যেন অশ্লীল।

—কি ভাবছ বুড়ো?

—কিছু না।

—মিথ্যে বলো না। ভাবছো মেয়েলোকটার মুখ বড় খারাপ। মেয়েদের মুখ বয়সকালে অমন একটু হয়ে যায়। চিরকাল চেপে চেপে থাকে কিনা

অবাক হয় যশোবন্ত সিং। মানুষের মনও ওর দৃষ্টির সামনে স্বচ্ছ নাকি?

ভিড়ের ভেতর থেকে রাম সিং বহুক্ষণ পর আবার কথা বলে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

—আমার কথার দাম হয়তো কেউ এখন দেবে না। তবে, এটুকু বলতে পারি লীলাবতী একা যায়নি।

বৃদ্ধ রুখে ওঠে,—তুমি বলতে চাও আর কারও সঙ্গে পালিয়েছে?

—না। তা বলতে চাই না। তবে সে একা যায়নি।

—কার সঙ্গে গেছে?

—যাকে তুমি চিতোরের পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলে—যে আমাদের দলের কেউ নয়?

—জিৎ সিং?

রাম মাথা ঝাঁকায়।

বৃদ্ধ ঘৃণিত কণ্ঠে বলে,–তোমার মন বড়ই নোংরা। জিৎ সিং-এর বয়স হলেও তার চোখে মুখে এখনো কিশোরের সরলতা। সে তোমার মতো নয়।

—আমি কোনো খারাপ ইঙ্গিত করছি না। আমি শুধু বলতে চাইছি, জিৎ সিং এদলে এখন অনুপস্থিত।

—কোথায় সে?

—তাকে পেছন দিকে চলে যেতে দেখেছি।

—লীলাবতী ছিল সঙ্গে?

—না।

—তবে?

রাম সিং-এর এক সঙ্গী বলে ওঠে,–একসঙ্গে কেউ যায় নাকি? গেলে তো সহজেই ধরা পড়ে যাবে।

বৃদ্ধ যশোবন্ত বুঝতে পারে, এরা আবার নতুন ক’রে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আছে। তাই সে হেসে বলে,–তোমাদের পক্ষেই একথা বলা সম্ভব। যে মেয়েটি তার পিতার মৃত্যু-সংবাদ শুনে শোকে অভিভূত, তার নামে এমন কলঙ্ক তোমরাই শুধু রটাতে পারো। পৃথিবীতে তোমাদের তুলনা নেই।

—হ্যা-হ্যা-হ্যা।

ভিড়ের মধ্যে মাটিতে থুতু ফেলবার হিড়িক পড়ে যায়। একজন বন্দুক উঁচিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, —এই খারাপ ছেলে কয়টি সাহসী হলেও, পদে পদে এরা দলের সম্মান জলাঞ্জলি দেবে। দেবো নাকি শেষ ক’রে সর্দার?

যশোবন্ত হাত উঁচিয়ে বলে,—না। গিরো উপত্যকা পর্যন্ত আমি কারও প্রাণহানি ঘটতে দেব না। তারপরে তোমরা নতুন সর্দার নির্বাচন ক’রে সবকিছুর মীমাংসা করো। তবে একটি অনুরোধ। এই রাম সিং আর তার দলবলকে চিনে রেখো। নতুন কৌশলে তোমাদের মন ভিজিয়ে যেন মাথায় উঠে না বসে।

—সে কথা আর বলতে হবে না। ভালো ক’রেই চিনেছি।

যশোবন্ত সিং একবার আকাশের দিকে দৃষ্টি ফেলে। তারপর চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। তার চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে। শেষে মাথা ঝাঁকিয়ে নিয়ে সে বলে,—আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না। তোমরা প্রস্তুত হও।

শংকরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বনের দিকে চেয়ে কি যেন দেখছিল। বৃদ্ধের কথা শুনে সে হাত উঁচিয়ে বলে ওঠে,—দাঁড়াও। আর একটু বসো তোমরা।

—কেন? বৃদ্ধ প্রশ্ন করে।

—বুড়ো হয়ে সত্যি চোখের মাথা খেয়েছ নাকি? তাকাও একবার ওদিকে।

বৃদ্ধ কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু দলের কেউ কেউ বলে ওঠে,—হ্যাঁ। আসছে দুজনা।

বৃদ্ধ চিৎকার করে ওঠে,—ফিরে আসছে? সত্যিই?

শংকরী মোলায়েম স্বরে বলে,—হ্যাঁ। মনে হচ্ছে ওরা দুজনাই। স্থির হয়ে বসো তো একটু। এখনি এসে পড়বে।

ওরা দুজনা এগিয়ে আসে। স্তব্ধ দলটি বসে থাকে। সবার দৃষ্টি ওদের ওপর। লীলাবতীর সঙ্গে জিৎ সিং রয়েছে, এ খবর দলের অধিকাংশই জানত না। যশোবন্তের আশেপাশে যারা বসেছিল তারাই শুধু জানত। তারা রামের কথা শুনেছিল। তাই অধিকাংশ লোকে বিস্ময়ভরা চোখে জিৎ সিংকে দেখে।

একটিও কথা বলে না কেউ। অথচ ওদের পথ করে দিতে দলটি আপনা হতে দু-ভাগ হয়ে যায়। ওরা এগিয়ে আসে সর্দারের দিকে। দুজনাই ক্লান্ত। তবে লীলাবতীর ক্লান্তি যেন অপরিসীম।

কাছে এসে দাঁড়াতে বৃদ্ধ আর সংবরণ করতে পারে না নিজেকে। উঠে দাঁড়িয়ে দুহাতে লীলাবতীকে জড়িয়ে ধরে আবেগ-রুদ্ধকণ্ঠে বলে,—কোথায় চলে গেছলি দিদি। তুই ফিরে না এলে তোর বাবার কাছে কী কৈফিয়ত দিতাম? তাকে যে আমি কথা দিয়েছি তোর মঙ্গল আমি দেখব। কোথায় পালিয়েছিলি?

—ওই বনে। ক্লান্ত লীলাবতী কোনোমতে উচ্চারণ করে। কথা বলতেও তার কষ্ট হচ্ছিল।

—কেন? আমার কাছে আসতে পারলি না? আমি কি তোকে একটুও সান্ত্বনা দিতে পারতাম না?

—আমি চিতোরে যাচ্ছিলাম।

—চিতোরে?

—হ্যাঁ কিন্তু ও যেতে দিল না। জোর করে ধরে নিয়ে এল।

—কে যেতে দিল না? জিৎ সিং?

—হ্যাঁ।

—জিৎ সিং ধরে নিয়ে এল তোকে? আনতে পারল?

—ভীষণ একরোখা। সাংঘাতিক লোক ও।

বৃদ্ধ সপ্রশংস দৃষ্টিতে চায় জিৎ সিং-এর দিকে। তারপর ধীরে ধীরে তাকে বলে,—তুমি অসাধ্যসাধন করেছ। গোপাল সিং-এর মেয়েকে কেউ জোর করে ধরে আনতে পারে, একথা ও নিজে মুখে না বললে আমি বিশ্বাস করতাম না।

জিৎ সিং ধীরে ধীরে বলে,—ওকে খেতে দাও। না খেলে সুস্থ হতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *