আরাবল্লী – ২

২.

উষার আলো ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে একসময়। পুবের আকাশে ফিকে লালের আভাস দেখা দেয়। নতুন সূর্য উদিত হলেই চিতোরের ঘটনা অতীতের পর্যায়ে গিয়ে পড়বে। নতুন সূর্য উঠলেই, জানা অজানা অসংখ্য মৃত রাজপুত বর্তমানের কোঠা থেকে সরে যাবে।

জিৎ সিং হয়তো সেই কথাই ভাবছিল। বর্তমানে যাকে বলা হয়, সেই সময়টুকুর মেয়াদ একমুহূর্তও নয়। এই মুহূর্তে যদি তার মৃত্যু হয়, পরের মুহূর্তে সে হবে অতীতের এক জীবন্ত মানুষ। এই মুহূর্তে সে জিৎ সিং, বয়স আঠারো উনিশ, মুখে গোঁফের ভালোরকম আভাস। অথচ পরমুহূর্তে সে আর জিৎ সিং থাকবে না। সে হবে জিৎ নামে এক তরুণ রাজপুতের শব। বর্তমানকে কেউ এক মুহূর্তও ধরে রাখতে পারবে না। শত চেষ্টা করলেও পারবে না। কেউ পারেনি কোনোদিন।

বৃদ্ধের নির্দেশে দলের লোকেরা একটি জংলী জায়গা দেখে থেমে যায়। বিশ্রাম নেবার পক্ষে জায়গাটি মোটামুটি নিরাপদ। দলের অধিকাংশ অবসন্ন হয়ে বসে পড়ে। স্ত্রীলোকেরা কোলের শিশুদের ঘাসের ওপর বসিয়ে বিশ্রাম নেয়।

আশেপাশে ছোট ছোট গাছ। ইতস্তত পাথর ছড়ানো রয়েছে। একদিকে একটি বড়গোছের পাথর পড়েছিল। জিৎ সিং তার ওপর বসে ভেবে চলে। সারারাত সে একটিও কথা বলেনি। কেউ কোনো প্রশ্নও করেনি তাকে। প্রশ্ন করবার মতো মনের অবস্থা কারও ছিল না।

দূরে বৃদ্ধ লোকটি কয়েকজন যুবককে কি যেন নির্দেশ দিচ্ছে। স্ত্রীলোকেরা একটু জিরিয়ে নেবার পর আপন শিশুর খাদ্য তৈরির জন্যে শুকনো পাতা আর গাছের ডাল জড়ো ক’রে আগুন জ্বালায়। আগুন দেখে ঘিরে দাঁড়ায় আরও অনেকে। পুরুষেরাও আগুন জ্বালিয়ে হাত পা কান মুখ গরম করে নেয়। জিৎ সিং-এর কোনো বোধশক্তি নেই যেন। সে তার পিতার মৃতদেহের কথা চিন্তা করে। যেমনটি রেখে এসেছিল, ঠিক তেমনিভাবেই হয়তো এখনো শয্যার ওপর পড়ে রয়েছেন তিনি। কিংবা মুঘলেরা অসংখ্য মৃতদেহের সঙ্গে তার বাবাকেও নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে অথবা পুঁতে ফেলেছে। ভাবতে ভাবতে মাথায় আগুন জ্বলে। পাথর ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে

মৃত পিতার অতিদীর্ঘ তলোয়ার নিয়ে আস্ফালন করে। সে আস্ফালন লক্ষ্য করে অনেকে। যাদের বয়স হয়েছে একটু, তারা চিন্তান্বিত হয়। যুবকেরা কৌতুক অনুভব করে। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে তারা, অতবড় তলোয়ার নিয়ে আস্ফালন করা ওই ছোকরার শোভা পায় না। কারণ ওটিকে ঠিকভাবে কাজে লাগাবার শক্তি ওই দেহে কোনোদিনই হবে না।

শেষে যুবকদেরই একজন এগিয়ে এসে জিৎ সিং-এর সামনে দাঁড়ায়। বয়স হবে তার তেইশ কিংবা চব্বিশ। মুখখানা গম্ভীর ক’রে জিৎ সিংহকে সে বলে,—এখানে মশা লাগছে খুব?

—না।

—একটুও না?

—না তো।

—তবে তোমার এই পেল্লায় তলোয়ারখানা অমনভাবে নাড়াচাড়া করছিলে কেন? ওটি ছোটখাটো হলে বোধহয় বনবন ক’রে ঘোরাতেই শুরু করতে।

জিৎ সিং বুঝতে পারে একটু বাঁকাভাবে আলাপ জমাতে এসেছে লোকটি। চুপ ক’রে থাকে।

—তুমি বেশি কথা বলো না বুঝি? আমাদের মতো অভাগাদের সঙ্গে কথা বলতে বাধে?

–আমি কথা বলি। সবার সঙ্গেই বলি। তবে এখন ঠিক বলতে ইচ্ছে নেই।

—ও, তাই নাকি? আমার নাম কি জান? রাম সিং। ওই যে দেখছো আমার বয়সি একদল ছেলে এদিক পানে চেয়ে মিটমিট করে হাসছে, আমি ওদের নেতা। সর্দার গোপাল সিং মারা গেছে। এরপর আমিও সর্দার হতে পারি। তাই আমার সঙ্গে যদি কথা বলতে তোমার ইচ্ছে হয় সেটাই ভালো লক্ষণ বলে মানব।

রাম সিং-এর কথার ধরনে জিৎ-এর মনে বিতৃষ্ণা জাগে। এমন মানুষ ভাগ্যচক্রে যদি সত্যই দলের সর্দার হয় তাহলে এদের দুর্দিন আসতে বাকি থাকবে না। যে সর্দার হয় হোক—তার কি? সে তো এদের সঙ্গে থাকতে আসেনি।

—কি ভাবছ? তোমার নামটি কি?

—জিৎ সিং।

চমৎকার নাম। তুমি কখন এসে ভিড়েছ আমরা জানি। তবে ওই বুড়োটা সব সময় আগলে রেখেছিল বলে কথা বলতে পারিনি।

জিৎ সিং মনে মনে ভাবে, না বলতে পেরে ভালোই হয়েছে।

—এতবড় তলোয়ারখানা কোথা থেকে পেলে?

—আমার বাবার।

—বাবার তলোয়ার হলেই কি ছেলের নিতে হবে? এত ভারী জিনিস আসল সময় কোন কাজে আসবে না। তোমার বাবা নিশ্চয়ই এটিকে তুলে রাখত?

জিৎ সিং ভ্রূ কুঞ্চিত করে। তারপর ধীরে ধীরে বলে,—না। দস্তুরমতো ব্যবহার করতেন। –ও বাবা। তাই নাকি? গায়ে জোর ছিল বলতে হবে। তা, তার গায়ে জোর ছিল বলেই যে তোমার গায়ে থাকতে এমন কোনো কথা নেই। দেখতে তো রোগা। ওটি বরং বুড়োকে দিয়ে দাও। তোমাকে আর একখানা দেব আমরা।

—আমার এটিই ভালো।

—হুঁ। গোঁ আছে দেখছি। অত গোঁ ভালো নয় হে। গোপাল সিং-এর পর রাম সিং ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি সর্দার হবে না, এটি ভুলে যেও না।

জিৎ সিং অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। গায়ে পড়ে আলাপ ক’রে কথা শোনাবে আর সে চুপ ক’রে থাকবে? না। সহ্য করবে না সে। বলে,—রাম সিংই সর্দার হোক আর হরি সিংই হোক আমার কিছু এসে যায় না তাতে। আমি তোমাদের দলের সঙ্গে থাকতে আসিনি। আমি কোনো দলের সঙ্গে থাকব না। আমি একা।

রামের মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। এত কময়বসি এক ছোকরা এভাবে কথা বলতে সাহস পাবে সে বিশ্বাস করতে পারেনি। তার ধারণা, সবাই তাকে মানবে। সে বীর, সাহসী। তার নেতৃত্বে যুবকরা যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে চিতোর অবরোধের সময়ে। আর এই লিকলিকে ছেলেটি এভাবে কথা শুনিয়ে দেবে?

জিৎ সিং-এর হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে সে বলে, —চল।

—কোথায়?

—আড়ালে কোথাও। আমার অবাধ্য হয়ে কেউ এখানে থাকতে পারবে না।

—তোমার আদেশে আমি আসিনি। তাই তোমার কথায় কোথাও যেতে পারব না।

—কাপুরুষ। লড়তে ভয় পাও। চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।

—কার সঙ্গে লড়ব?

—আমার সঙ্গে।

—তোমার সঙ্গে? তুমি নিজেকে কোথাকার লোক বলে ভাব?

—কি বলতে চাও তুমি?

—বলতে চাই, তোমাদের দলের অন্য সবার মতো নিজেকে রাজপুত বলে ভাব তো?

—নিশ্চয়ই। আমার জন্মস্থান চিতোর।

—আমিও জানি! তোমাদের সবার জন্মস্থানই প্রায় চিতোর। সেই কালপী নয়।

—বড় বড় কথা ছাড়ো। চল আমার সঙ্গে।

—না। তুমি যদি নিজেকে রাজপুত বলে ভাব, আমি যাব না।

—যেতে হবে।

—অদ্ভুত মনোভাব দেখছি তোমার। নিজেকে রাজপুত বলে দাবি কর, আর এই দুর্দিনে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করতে চাও? এই মনোভাব নিয়ে তুমি হবে দলের সর্দার?

কথা বলতে ঘৃণায় জিৎ সিং-এর নাসিকা কুঞ্চিত হয়ে ওঠে।

রাম সিং-এর মুখ আবার লাল হয়। তবে এবারে ঠিক ক্রোধে নয়। যুক্তিতে হেরে যাবার অপমানে। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে বাঁকা দৃষ্টিতে জিৎ সিংকে একবার দেখে নেয়। যতটা নরম বলে ভেবেছিল তাকে ততটা নয়। বরং বেশ শক্তই। খুব শক্ত। একে বশ করতে হলে গরমের চেয়ে নরমে কাজ দেবে বেশি। মনে মনে সে জিৎ সিংকে নিজের সারা জীবনের শত্রুর তালিকায় ফেলে দেয়। তবে বাইরে সে-ভাব দেখালে চলবে না। তাতে অনেক অসুবিধে।

প্রাণখোলা হাসি হেসে ওঠে রাম সিং। জিৎ সিং চমকে ওঠে সেই হাসিতে। রাম তার পিঠে হাত রেখে মিষ্টি গলায় বলে,—পরীক্ষা করছিলাম। কৃতকার্য হয়েছ। তুমি আমার দলের সেরা ছেলে।

—আগেই বলেছি কোন দলের নই আমি। আমি একা।

—তবু যতদিন রয়েছ, ততদিন তুমি আমার দলে। সত্যিই তোমায় দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। গোপাল সিং-এর মেয়েকে দেখে যতটা মুগ্ধ হয়েছি ঠিক ততটা।

—গোপাল সিং-এর মেয়ে?

—দেখোনি তাকে?

—বলতে পারি না। কাউকে চিনি না।

—নিশ্চয় দেখেছ। সেও ঠিক তোমার মতো। শক্তের যম।

—খুব ভালো মেয়ে বলতে হবে।

—ভালো তো বটেই। তবে বড় কড়া। কাছে ভিড়তে দেয় না।

—কাছে ভিড়বে কেন?

—সেকি? অমন মেয়েকে হাতছাড়া করব? কেমন হয়ে উঠছে একবার দেখলে বুঝতে।

রামের কথার ধরন জিৎ সিং-এর আদৌ পছন্দ হয় না। লোকটি যে খুবই খারাপ প্রকৃতির বুঝতে পারে সে। গোপাল সিং-এর মেয়েকে সে চেনে না। চেনে শুধু একটি মেয়েকেই—কাল যে আকবর-বাতির সিঁড়ি আবিষ্কার করেছিল।

একটু দূরে ঝোপের আড়ালে খিলখিল করে হাসির শব্দ শোনা যায়। সেই সঙ্গে অপর একটি মেয়ের চাপা স্বর,—দুর মুখপুড়ী। সব তাতেই তোর হাসি।

—তোর কাঁদতে ইচ্ছে হয় কাঁদ। আমার হাসিই ভালো। হাসতে হাসতে মরে যাবার মতো সুখ কি আর আছে?

এ হাসি জিৎ সিং চেনে। কাল থেকে বারকয়েক শুনেছে।

রাম সিং কান খাড়া করে। দু’এক পা এগিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে। ফিসফিস ক’রে বলে,

—শুনলে তো?

—হাসি?

—হ্যাঁ। গোপাল সিং-এর মেয়ে।

জিৎ সিং বিস্মিত হয়। এই মেয়েটিকে নিয়েই এত আলোচনা। এই মেয়েই সর্দারের মেয়ে। বৃদ্ধ তাকে এর পরিচয় বলে দেয়নি। তবে এটুকু খবর সে সংগ্রহ করতে পেরেছে যে গোপাল সিং জীবিত নেই।

এতক্ষণে সব স্পষ্ট হয়। কাল আকবর-বাতির সামনে মেয়েটির বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে সবার মতো সেও মনে মনে তাকে তারিফ করেছিল। কিন্তু তখন তাকে দলের একজন সাধারণ মেয়ে বলেই জানত। এতক্ষণে বুঝতে পারে সেই স্ত্রীলোকটি কেন ‘হতভাগী’ বলে মন্তব্য করেছিল। তার মন্তব্য শোনবার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধের মুখ হয়ে উঠেছিল বজ্র-কঠিন। মেয়েটি নিশ্চয়ই জানে না তার বাবার মৃত্যুর কথা। জানলে এমন সুন্দর হাসতে পারত না।

রাম সিং-এর হাত চেপে জিৎ বলে,—ওকে আমি দেখেছি।

—দেখেছ? কেমন দেখতে?

—খুব ভালো। আচ্ছা, ওর বাবার কথা ও জানে না? জানে না তিনি বেঁচে নেই?

—এখনো জানানো হয়নি।

জিৎ সিং অস্ফুটস্বরে বলে,—ও।

—কি হল তোমার? মনে হচ্ছে যেন, দরদে গলে গেলে?

—না।

—না আবার কি? মন খারাপ হয়ে গেল? এত সহজেই? বাবা কারও চিরকাল বেঁচে থাকে না। তোমার বাবা কি বেঁচে আছে?

—না। তবে আমি জানি যে তিনি বেঁচে নেই।

—ও না হয় দু’দিন পরে জানবে।

—কিন্তু ওই হাসি শুনে কষ্ট হচ্ছে না তোমার?

কষ্ট? হুঁ, হচ্ছে বৈকি। তবে সে কষ্ট অন্য ধাতের। বুকের ভেতরে হু-হু ক’রে জ্বলে যাচ্ছে। ওই হাসিই আমাকে পাগল করবে।

রাম সিং একটু একটু করে ঝোপের দিকে চলে যায়।

জিৎ সিং একা বসে ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে একটু একটু ক’রে অনুমান করতে পারে কিসের আকর্ষণে রাম সিং মেয়েটির জন্যে পাগল। এসব সে নতুন দেখছে না। চিতোরে অনেক রাজপুতকে এ নিয়ে অসিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখেছে। কিন্তু সে-সময়ে সে নির্মল আনন্দই উপভোগ করেছে। শুধু আহত কিংবা নিহত ব্যক্তির জন্যে দুঃখ পেয়েছে। আজ সে ভাবতে ভাবতে সবই বুঝতে পারে। পিতার মৃত্যুর আঘাত এক রাতেই তাকে যেন নাবালকত্বের গণ্ডি থেকে বাইরে নিয়ে আসে।

জিৎ সিং-এর মাথায় মেয়েটির চিন্তাই ঘুরতে থাকে। তাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করেনি সে। নিজের বাড়ি থেকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে আসবার সময় মেয়েটি বিদ্রুপ ক’রে ‘বীরপুরুষ’ সম্বোধন করেছিল তাকে। তখন তাকে দেখতে চেয়েও দেখতে পায়নি। ভিড়ের ভেতরে ছিল মেয়েটি। তারপর আকবর-বাতির নীচে প্রথম দেখেছিল। আবার যেন চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুখের আদল স্পষ্টভাবে ধরা না পড়লেও যেটুকু ধরা পড়ে জিৎ সিং-এর কল্পনায়, তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না বেশ মিষ্টি ওই মুখ। কী যেন নামটি? লীলা। হ্যাঁ, লীলাবতী। নামটিও বেশ মিষ্টি তো?

জিৎ সিং উঠে দাঁড়ায়। আশেপাশের সবাই আগুন পোহাতে ব্যস্ত। রাম সিং-এর দলের যুবকেরা নিজেদের মধ্যে হই-হুল্লোড় করছে। ঘাসের ওপর শুয়ে শিশুরা সারারাতের অনাহারের পর ভরপেট খেয়ে ঘুমোচ্ছে। তাদের গায়ে সূর্যের বাঁকা রশ্মি এসে পড়েছে। সে রশ্মিতে এখনো যথেষ্ট পরিমাণে তাপের সৃষ্টি হয়নি বলে মায়েরা তাদের হাত-পা আগুন দিয়ে সেঁকে দিচ্ছে। বৃদ্ধ কিছুটা দূরে পাথর দিয়ে সারি সারি উনুন তৈরির উদ্যোগ করছে। সবার রান্না হবে একই সঙ্গে। এই একবার খেয়েই রওনা দিতে হবে আবার। ঘুমে অনেকের চোখ বন্ধ হয়ে এলেও গড়িয়ে নেবার উপায় নেই। গিরো উপত্যকায় পৌঁছবার আগে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। তাই কালকের সেই প্রৌঢ় রাজপুতটি ঘুমোতে না পেরে ঢুলুঢুলু চোখে হাতে একটি কাঠি নিয়ে শুয়ে পড়া লোকগুলোকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে দিয়ে হাসছে।

জিৎ সিং কিছুক্ষণ সেইসব চেয়ে চেয়ে দেখে। তারপর রাম সিং যে পথে গেছে সেদিকে পা বাড়ায়। মেয়েটিকে একবার ভালোভাবে দেখতে হবে।

ঝোপের কাছে আসতেই লীলাবতীর ক্রুদ্ধস্বর তার কানে আসে। সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

লীলাবতী বলছিল,—রাম সিং, এভাবে মেয়েদের দিকে আসা তোমার উচিত হয়নি।

—আমি জানতাম না তুমি আছো।

জিৎ সিং অবাক হয় তার কথা শুনে। মিথ্যে কথা বলছে সে।

লীলাবতী বলে,–বেশ ভালোভাবেই জানতে আমি আছি। এইবারই শুধু প্রথম নয়। চিতোর দেবীর মন্দিরের ভিড়ের মধ্যেও তুমি আমার পাশে এইভাবে বার বার চলে আসতে। এতগুলো ঘটনা হঠাৎ ঘটে না।

—বিশ্বাস করো লীলাবতী। সবই আকস্মিক। ভগবানের কোনো উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই রয়েছে।

লীলা বিদ্রূপের হাসি হাসে। বলে,—আমারও তাই মনে হচ্ছে।

উৎসাহিত রাম সিং বলে ওঠে,–তোমারও তাই মনে হচ্ছে তো? আমি জানতাম, একদিন না একদিন মনে হবেই।

—হ্যাঁ, আমার প্রথম দিনই মনে হয়েছিল। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, বেশিদিন পৃথিবীর বুকে হেসেখেলে বেড়াবার জন্যে তুমি জন্মাওনি।

—তার মানে?

—তার মানে, এর পরও যদি তুমি আমায় বিরক্ত কর, আমার শান্তিভঙ্গের চেষ্টা কর, তবে তোমার রক্ত মাটিতে ঝরে পড়বে।

তুমি আমার ওপর সুবিচার করোনি লীলাবতী। আমি তোমায় কত স্নেহ করি তা যদি জানতে—

—জানতে চাই না। চলে যাও এখান থেকে। এখনি চলে যাও। নইলে এতদিন যা করিনি, তাই করব। বাবাকে সব কথা বলে দিয়ে, তোমায় কঠিন শাস্তি দেব।

রাম সিং হেসে ওঠে।

সেই হাসি শুনে জিৎ সিং চমকায়। মানুষের দেহধারী এই পশুকে বিশ্বাস নেই। হয়তো এখুনি আসল কথা প্রকাশ করে দেবে। বলে দেবে যে, গোপাল সিং-এর মৃতদেহ চিতোরের প্রাকারের পাশে এতক্ষণে পচতে শুরু করেছে।

জিৎ সিং আর একটু এগিয়ে যায়। রাম যদি সত্যই সেই সাংঘাতিক কথা শুনিয়ে দেয়, তবে তাকে কিছুতেই মার্জনা করবে না সে। একেবারে কাছে আসায়, উভয়কেই দেখতে পায় সে পাতার আড়াল থেকে। কিন্তু লীলাবতীর সঙ্গের সেই মেয়েটি কোথায়? তাকে তো আর দেখা যায় না। জিৎ সিং লীলাবতীর দৃপ্ত মুখের দিকে চায়। মিষ্টি মুখেও এক অপূর্ব ব্যক্তিত্বের ছটা। এই ছটার জন্যেই আর পাঁচটা মিষ্টি মুখের মধ্যে এ-মুখ হারিয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। গতকাল এমনভাবে সে লক্ষ্য করেনি। লক্ষ্য করবার মতো মনের অবস্থা তার ছিল না। আজ তার মন শক্ত হয়েছে। এক রাতের পথচলতি চিন্তার মধ্যে সে বাস্তবকে দৃঢ়ভাবে মেনে নিতে পেরেছে।

রামের হাসি দেখে রাগে ফুলতে থাকে লীলাবতী। আকবর-বাতির সামনে পুরুষের কাতর চোখের কথা বলে রসিকতা করেছিল বৃদ্ধ রাজপুত। সেই কাতর চোখের খোঁজ সত্যিই এখনো রাখে না লীলা। বয়সের সেই সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেলেও, মন তার এখনো কচি। সে শুধু জানে, যে-পুরুষ মেয়েদের দিকে বেশি ক’রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, যে-পুরুষ বেশি করে মেয়েদের পাশে আসতে চায় তারা খারাপ,—তারা ঘৃণ্য। সেই বোধ নিয়েই সে রামকে দেখছে। রামের চোখের ভাষা পাঠ করবার মতো সময় আসতে তার কত দেরি কে জানে? এই নিরিবিলি স্থানে সে যদি ওর চোখের ভাষা পড়তে পারত, তাহলে কোমরে লুকোনো ছুরি নিয়ে এতক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ত রামের ওপর।

জিৎ সিং-ও অতটা বুঝতে পারে না। সে শুধু জানতে পেরেছে রাম লীলাবতীকে পছন্দ করে। সেই পছন্দের মধ্যে নোংরামি রয়েছে। তাই রামের হাসি শুনে সে তলোয়ারখানা চেপে ধরে ওদের অলক্ষ্যে এগিয়ে যায়।

লীলাবতী বলে ওঠে,—স্পর্ধার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ রাম সিং। তাই হাসতে পারছ। সর্দার গোপাল সিংকে তুমি চেনো। কিন্তু একথা সম্ভবত জানো না, প্রয়োজনে তিনি কতখানি নিষ্ঠুর হতে পারেন।

রাম এবারে হো-হো করে হেসে ওঠে।

লীলাবতীর মুখ সিঁদুরের মতো রাঙা হয়ে ওঠে। তার নাসা রন্ধ্র ফুলে ফুলে ওঠে। সে যে কী করবে ভেবে পায় না।

জিৎ সিং বুঝতে পারে, আর একটু দেরি হলে রাম সত্যি ঘটনা না বলে ছাড়বে না। তাই সোজা ভেতরে গিয়ে বলে,—হাসি শুনে দেখতে এলাম।

রাম সিং দূরে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে ওঠে,–কে তোমায় আসতে বলেছে?

—কেউ না। আমি নিজেই এলাম।

—চলে যাও এখান থেকে।

—রেগেছো মনে হচ্ছে। তবে কি ভুল শুনলাম? হাসি নয়?

—জিৎ সিং!

—চিৎকার করো না। ধীরে কথা বল। আমি কাছেই আছি।

—তোমার ওই তলোয়ার টেনে বের করবার আগেই দু-টুকরো হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে বলে রাখছি।

—ভয় দেখাচ্ছ? কেন? এখানে এসেছি বলে?

—হ্যাঁ।

—চলে যেতে বলছ?

—এই মুহূর্তে।

জিৎ সিং শান্ত হাসি হেসে বলে,—তুমি এখনো সর্দার হওনি। আগে হও, তারপর তোমার আদেশ মানব। অবিশ্যি যদি তোমার মতো অপদার্থের দলে বাধ্য হয়ে থাকতে হয়।

রাম সিং-এর অসি ঝলসে ওঠে।

জিৎ সিং চকিতে দু-পা পেছিয়ে গিয়ে বলে,—একটু দাঁড়াও। আমার কথাটা শোনো। বন্দুকের নিশানা তোমাদের অব্যর্থ, আমি জানি। কিন্তু অসিযুদ্ধে? তাতে কি খুব সুবিধে হবে?

লীলাবতীর চোখমুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি দু’জনার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিৎ সিংকে বলে,—কার সঙ্গে ওভাবে কথা বলছ তুমি? ওর গায়ে অমানুষিক শক্তি।

—সে শক্তি বন্য-বরাহেরও রয়েছে। তাই বলে কি তারা রাজ্য চালায়?

লীলাবতী মুহূর্তের জন্যে বিস্ময়ে মূক হয়ে যায়। রাম সিং চিৎকার করে ওঠে,—সরে দাঁড়াও লীলাবতী।

—না।

জিৎ সিং হেসে বলে,—সরে যাও। বলছে যখন ভাবী সর্দার।

লীলা বলে,—অদ্ভুত সাহস তোমার।

—সাহস নয় ঘৃণা। যারা মেয়েদের একলা পেয়ে অপমান করে তাদের ওপর ঘৃণা।

—শুধু শুধু কেন মরতে চাইছ?

—ক্ষতি কি? কাল যখন তোমাদের দলের দিকে এগিয়ে গেছলাম, তখন মরব বলেই গেছলাম। সেটি না হয় আজ হবে। তাছাড়া সত্যি সত্যিই যে মরব, তাই বা কে বলল? রাম সিং-এর শক্তি আছে মানলাম, কিন্তু সেই শক্তির পরীক্ষা আমার সঙ্গে হয়নি।

—তোমার কত কম বয়স। ওর মতো বলিষ্ঠও নও তুমি। তাছাড়া তোমার অস্ত্র যে অনেক বড়। অতবড় অস্ত্র নাড়াতে পারবে?

রাম সিং শ্লেষপূর্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে,–এর ওপর যে খুব মায়া দেখছি লীলাবতী। অচেনা লোককে একবার দেখেই মন ভিজে গেল?

লীলাবতী কিছু বলবার আগেই জিৎ সিং তার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। রাম অসি তোলে।

জিৎ সিং তার অসিতে আঘাত করার আগে বলে,—আমি কখনো সত্যি লড়িনি রাম সিং। বাবার কাছে শুধু শিক্ষাই নিয়েছি। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাবার কাছে শিক্ষা পাওয়া মেবারের যে-কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সৌভাগ্যের। তবু হয়তো আমার মৃত্যু হতে পারে। তবে কোনো কারণে যদি তুমি হেরে যাও, তোমায় প্রাণে বধ করব না আমি। এই দুর্দিনে রাজপুতের রক্তে অসি কলঙ্কিত করা পাপ। অবিশ্যি তোমাকে প্রাণে না মারলেও আমার লাভ, লীলাবতীরও লাভ কারণ ভবিষ্যতে তুমি আর উৎপাত করবে না। সাহস পাবে না।

জিৎ সিং-এর কথায় কোনো অহংকার, কোনো গর্ব না দেখে লীলাবতী আরও ভীত হয়। এতদিন সে পুরুষকে দেখে এসেছে দর্পী—অহংকারী। দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার আগে তারা কতরকম হম্বিতম্বি করে। রাম সিং শুরু করত এতক্ষণে। কিন্তু জিৎ সিং-এর ঠাণ্ডা মেজাজ দেখে সেও চুপ হয়ে থাকে। লীলাবতী আর একবার শেষ চেষ্টা করে দু’জনার মাঝখানে দাঁড়াতে। কিন্তু পারে না। তাঁর আগেই রাম সিং সহসা আক্রমণ চালায়। লিকলিকে ছোকরাটির অনেক কথা সে ধৈর্য ধরে সহ্য করেছে।

লীলাবতী রুদ্ধশ্বাসে দেখে জিৎ সিং শুধু সরে সরে গিয়ে রামের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করছে। এভাবে কতক্ষণ সরে থাকতে পারবে সে?

কিন্তু রাম সিং একবারও তো তাকে স্পর্শ করতে পারছে না? জিৎ সিং-এর দেহখানা যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকে। রামের প্রতিটি আক্রমণ সে ব্যর্থ ক’রে দেয় শুধু পায়ের কৌশলে। একবারও প্রতিঘাত হানবার চেষ্টা করে না। তার এই কৌশলে রাম আরও ক্রুদ্ধ হয়। হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এবারেও অসিখানা শূন্যে ঘুরে আসে।

তবু লীলাবতীর উদ্বেগ যায় না। জিৎ সিং আক্রমণ করলে সে নিশ্চিন্ত হত। অথচ সে আক্রমণের কোনো চেষ্টাই করছে না। এখনো সরে সরে যাচ্ছে। পায়ের কৌশলে এখনো বেঁচে রয়েছে বটে। কিন্তু আর কতক্ষণ? রামের ক্রমাগত আক্রমণের একটিও যদি সফল হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে টুকরো হয়ে যাবে।

আক্রমণ চালাচ্ছে না কেন জিৎ সিং? অসিখানা ওর দেহের তুলনায় খুবই বড়। তুলতে কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই। কোনোরকমে তুললেও জোরে আঘাত হানতে পারবে না। অমন ছিপছিপে শরীরের কতটুকুই বা শক্তি। উৎকণ্ঠিত হয়ে লীলাবতী দাঁত দিয়ে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কামড়াতে থাকে। আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায়–হে একলিঙ্গ, রাম সিংকে তাড়াতাড়ি পরিশ্রান্ত ক’রে দাও। শুধু শুধু যেন নরহত্যা না হয়।

দুই যোদ্ধার কপাল বেয়ে এই শীতের সকালেও ঘাম ঝরতে থাকে। দু’জনাই হাঁপিয়ে ওঠে। তবু লড়াই থামে না। লীলাবতীর এমন ইচ্ছেও হয় যে, রাম সিংকে অনুরোধ করে লড়াই বন্ধ করতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই আত্মমর্যাদা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাছাড়া জিৎ সিংকে কিছু বলতে তার ভরসা হয় না। তার কথা শুনে মুহূর্তের জন্যে যদি সে অন্যমনস্ক হয় তবে রামের অসি নির্ঘাত তার বক্ষ বিদীর্ণ করবে। তাই পাথর-প্রতিমার মতো অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখে সে।

শেষে তার পা কাঁপতে শুরু করে। চিতোরের মেয়ে হয়েও অজ্ঞাতে চোখে একটু জল এসে যায়। মুছতে পারে না সেই জল। যদি সেই মুহূর্তেই অঘটন ঘটে যায়?

সহসা রাম সিং দুর্বোধ্য শপথ উচ্চারণ করে প্রচণ্ডতম আক্রমণ হানে। আতঙ্কিত হয়ে লীলাবতী দেখে তার অসি আকাশের দিকে উঠে সবেগে নীচে নামছে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে জিৎ সিং। এবারে ধরা পড়েছে। কৌশল তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারল না। লীলাবতী চোখ বন্ধ করে।

ঝনঝন করে শব্দ হয়। জিৎ সিং সামান্য বাধাদানের চেষ্টা করেছিল হয়তো। লীলাবতী চোখ বন্ধ অবস্থায় অস্ফুটস্বরে বলে,—আমার জন্যই এর মৃত্যু হল বাবা। খাঁটি রাজপুত বীরের মতো আমার সম্মান রাখতে এগিয়ে এসেছিল। নিজেকে শক্তিশালী নয় জেনেও রুখে দাঁড়িয়েছিল।

কিছুক্ষণ স্তব্ধতা বিরাজ করে। ঝোপঝাড়ের ডালপালাও নীরব। শুধু একটু দূরে বৃদ্ধ সর্দারের চিৎকার শোনা যায়। রুটি সেঁকা এতক্ষণে বোধহয় শুরু হয়েছে।

লীলাবতী অনুভব করে কেউ তার হাত চেপে ধরেছে। রাম। এমন একটি বাহাদুরী দেখিয়ে তার সাহস বেড়েছে। সে জানে না তার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। গোপাল সিং-এর রোষ তাকে দগ্ধ করবে।

বাধা দিতে পারে না লীলাবতী। শরীরে তার কোনো শক্তিই যেন নেই। এমন কি চোখ দুটোও সে খুলতে পারে না। সামনে পড়ে রয়েছে আধা বয়সি ছেলেটি। তার চেয়ে বড় জোর তিন চার বছরের বড়। ওর রক্তাক্ত বীভৎস চেহারার দিকে চাইতে পারবে না সে। না।

—চল লীলাবতী।

—কে? লীলাবতীর সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে ওঠে। চোখ খুলে দেখে জিৎ সিং দাঁড়িয়ে রয়েছে অক্ষত দেহে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে।

জিৎ সিং তার হাত ধরে বলে—চল। এখান থেকে বের হয়ে যাই। একটু জলের খোঁজ করতে হবে। বড় জল পিপাসা পেয়েছে।

লীলাবতী লক্ষ্য করে রাম দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা নিচু করে। তার তলোয়ারখানা দু-টুকরো হয়ে সামনে পড়ে

খিলখিল ক’রে হেসে ওঠে লীলাবতী।

সে হাসিতেও রাম সিং-এর স্তম্ভিত ভাব কাটে না।

জিৎ সিং বিষণ্ণ সুরে বলে—ওভাবে হেসো না। রাম সিং যথেষ্ট শক্তিশালী। আজ বুঝেছি দীর্ঘ তিন মাস বাদশাহ আকবরকে কেন অপেক্ষা করতে হয়েছিল চিতোরের বাইরে। বন্দুকধারী হয়েও যে এমন সুন্দরভাবে তলোয়ার চালাতে পারে সে সামান্য যোদ্ধা নয়।

—কিন্তু তোমাকে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। এত বড় যোদ্ধা তুমি? তবে কেন রু বাবাকে মুঘল আক্রমণের সময় বাধা দিতে পারলে না?

—মুহূর্তে ঘটে গিয়েছিল সব। অস্ত্র নিয়ে আসবার রাস্তা ছিল না। আমাকে ঘিরে রেখেছিল ওরা। তাছাড়া আমি কল্পনাও করিনি রুগ্‌ণ ব্যক্তিকে বিনা প্ররোচনায় কেউ হত্যা করতে পারে। আমি নিজে মৃত্যুকে বরণ করবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলাম। কিন্তু ঘটে গেল ঠিক তার বিপরীত ঘটনা। এই একদিনে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। এই একদিনে আমি মানুষ হয়ে গেলাম। জিৎ সিং আর লীলাবতীর দৃষ্টি বিনিময় হয়। সে দৃষ্টিতে কিসের যেন লজ্জা, কিসের যেন আনন্দ।

.

ওরা দুজনে চলে যাবার পরও রাম সিং স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী অসিযুদ্ধে যে এতখানি সুনিপুণ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, মানুষের চেহারা আর বয়স দেখে জীবনে আর দ্বিতীয়বার এমন ভুল করবে না সে। জিৎ সিং-এর ওপর অপরিসীম ক্রোধে সর্বাঙ্গ কাঁপতে থাকলেও, তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা না ক’রে পারে না নিজের কাছে। শুধু পায়ে যে-কৌশল সে দেখাল তার অর্ধেকও যদি জানা থাকত তার, তবে নিজেকে গর্বিত বলে ভাবতে পারত সে। গায়ের জোরে সব কিছু হয় না। বলিষ্ঠ চেহারা অসিযুদ্ধের সহায়ক হবে, এমন কোনো কথা নেই। বরং অনেক সময়ে বলিষ্ঠ চেহারা রীতিমতো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। সে অবাক হয়ে দেখেছে, জিৎ সিং-এর দেহ যেন হাওয়ায় ভাসছিল। যতবার তাকে আক্রমণ করবার চেষ্টা করেছে, ততবারই মাছির মতো নিরুদ্বেগে পাশে সরে দাঁড়িয়েছে। ভারী শরীর হলে সেটি সম্ভব হত না। রাম সিং ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে এখনো যে সে বেঁচে রয়েছে এ শুধু জিৎ সিং-এর দয়ায়। নির্বোধের মতো সে আক্রমণ চালিয়েছিল। যে-কোনো মুহূর্তে নিজের খুশিমতো জিৎ সিং তাকে হত্যা করতে পারত। করেনি, কারণ সে রাজপুত। শুধু তাই নয়, জিৎ সিং হাতের কবজিতে অসাধারণ শক্তি রাখে। অতবড় তলোয়ার অমন অনায়াস ভঙ্গিতে সাধারণ যোদ্ধা হলে কিছুতেই তুলতে পারত না। জিৎ সিং আদর্শবাদী। রাম সিং-এর মুখে ধীরে ধীরে কুটিল রেখা ফুটে ওঠে। এই আদর্শবাদিতাই জিৎ সিং-এর শত্রুপক্ষের মস্তবড় রক্ষাকবচ। এই আদর্শবাদিতা সমস্ত রাজপুত জাতিকে যেমন ধ্বংসের শেষ সীমায় টেনে এনেছে, তাকেও তেমনি একদিন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবে।

ভাবতে ভাবতে নিজের বিষণ্ণতা আর অবসন্নতা কাটিয়ে ওঠে রাম সিং। মনে মনে শত্রুর তালিকায় জিৎ সিং-এর নামের ওপর আর একবার রেখা টানে সে। নামটি আরও উজ্জ্বল আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে লীলাবতীকে পুরোপুরি একটি বছরের চেষ্টাতেও সে সামান্য স্পর্শটুকু পর্যন্ত করতে পারল না তার অমন সুন্দর হাতখানা অনায়াসে চেপে ধরে জিৎ সিং বের হয়ে গেল? ভাবতে ভাবতে রামের মাথায় আবার রক্ত ওঠবার উপক্রম হয়। কিন্তু সে সামলে নেয়। আপন মনে বিড়বিড় ক’রে বলে যে, সামান্য ব্যাপারে এভাবে মাথা গরম করলে অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না। অভীষ্ট থেকে বরং দুরেই সরে আসতে হয়। মনের ভেতরে রাবণের চিতা জ্বললেও, মুখের ওপর তার কোনোরকম আভাস যেন ভেসে না ওঠে।

পায়ের কাছে ভাঙা তলোয়ারখানার দিকে দৃষ্টি পড়ে রাম সিং-এর। টুকরো দুটিকে তুলে নিয়ে সে মাটি খুঁড়ে অতি সাবধানে পুঁতে ফেলে। জিৎ সিং আর লীলাবতী এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাইকে শুনিয়ে বেড়াচ্ছে এই লজ্জার ঘটনাটি। তবু সে প্রমাণ রাখবে না। মুখে অনেকেই অনেক কিছু বলে বেড়ায়। প্রমাণ চাই তার। ভাঙা তলোয়ারের ওপর মাটি চাপা দিয়ে, শুকনো ডালপালা

ফেলে দেয় তার ওপর। তারপর অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,–লীলাবতীকে চাই-ই। জিৎ সিং-এর মৃত্যু চাই।

রাম লক্ষ্য করেনি তার ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে সেই মেয়েটি, যে কিছুক্ষণ আগে লীলাবতীর সঙ্গে ছিল এখানে, তার সঙ্গে কথা বলেছিল। তারপর রাম সিংকে এগিয়ে আসতে দেখেই সে সরে পড়েছিল কোনো অজুহাত দেখিয়ে।

পেছন ফিরে মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠে রাম সিং বলে,–তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে রাখী!

—কেন বল তো? রাখীর কণ্ঠস্বর ভারাক্রান্ত।

—এমনি জিজ্ঞাসা করছি। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে ছিলে বুঝি?

—হ্যাঁ। কিন্তু সব দেখেছি আমি।

মুখ বিকৃত করে রাম বলে,—খুব ভালো কাজ করেছ। এবারে বলে বেড়াও গে যাও। তোমার মুখ দেখাও পাপ।

রাখীর চোখদুটি সজল হয়ে ওঠে। এগিয়ে এসে রামের হাত চেপে ধরে বল,—আর কত সইতে বল? তোমার জন্যে সব করছি, তবু তোমায় খুশি করতে পারলাম না। তোমার মন পেলাম না।

—কী এমন করেছ আমার জন্যে?

—তোমাকে ভালোবেসেও তোমারই আনন্দের জন্যে লীলাবতীর সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিয়েছি। পৃথিবীতে কোন্ মেয়েটি এমন করে বল তো? লীলাবতী আমার অনেকদিনের বন্ধু। কিন্তু তোমার জন্যে ওর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ঘোরতর শত্রুর কাজ করেছি। তাতেও তোমার মন উঠল না?

—না। যেদিন তুমি আমার দিকে লীলাবতীর মন সম্পূর্ণভাবে ঘুরিয়ে দিতে পারবে, শুধু সেদিনই তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ হব। তার আগে নয়।

রাখী হেসে ওঠে,—ও। তার আগে নয়? কিন্তু লীলাবতীর মন যদি সত্যিই কোনোদিন নরম হয় তোমার প্রতি, আমার কথা কি সেদিন মনে থাকবে তোমার? শুধু কৃতজ্ঞ? আর সেই কৃতজ্ঞতাটুকু সঞ্চয় ক’রে আমি সুখে অভিভূত হয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেব। তাই না রাম সিং?

—তুমি বড় বাজে কথা বল।

—হ্যাঁ। আমি বাজে কথা বলি বটে। আর তোমার সব কথা যুক্তিসংগত। এত যে হীন কাজ করিয়ে নিচ্ছ আমাকে দিয়ে, এ কিসের সুযোগে? তোমার ক্ষমতায় আমি ভীত—এই সুযোগে? না রাম সিং। তা নয়। আমাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের সুযোগ তুমি পেয়েছ আমারই ভুলের জন্যে। এ ভুলের কোনো প্রতিবিধান নেই। এখানে যুক্তিও খাটে না। আমি তোমায় ভালোবাসি বলে।

—থাক। অতসব লম্বা-চওড়া কথা শুনতে চাই ন। তবে জেনে রেখে দাও, আমি তোমায় বিন্দুমাত্র ভালোবাসি না।

—মুখের কথা শুনে কি তা জানতে হয়? তবু আশা ছাড়তে পারে না মানুষ। তাই ছলনার পেছনে ঘুরে মরে। মনে মনে ভাবি, হয়তো তোমার মতিগতি সহসা পরিবর্তন হবে একদিন। হয়তো তখন কিছুটা ভালোবাসা পাবো তোমার কাছ থেকে।

রাম সিং হেসে ওঠে।

হাসো। যত পারো হাসো। এখন তোমার হাসির দিন। কিন্তু প্রথম তুমিই আমার ভালোবাসার কথা শুনিয়েছিলে। তখন কিন্তু আমি হাসিনি। তোমার সব কথার অর্থ না বুঝেও ভালো লাগত। সে তো খুব বেশিদিনের কথা নয় রাম সিং। আজ লীলাবতী তোমার কথা বুঝতে পারে না। তোমার জন্যে তাকে অনেকভাবে শিখিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ এমনি জিনিস যে জোর ক’রে শেখানো যায় না। এ জিনিস স্বতঃস্ফূর্ত। ফুলের কুঁড়িকে কি জোর করে ফোটানো যায়, রাম সিং?

মুচকি হেসে রাম বলে,– তোমার বেলায় তো ফুটেছিল।

—আমার সময় হয়ে এসেছিল। নিজের মা বোন না থাকলেও মামী রয়েছে আমার। আরও পাঁচজন স্ত্রীলোক আমাদের বাড়িতে আসত যেত। তাই এদিকে একটা স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল হয়তো। কিন্তু লীলাবতীর বেলায় তা সম্ভব হয়নি। সে তার বাবার কাছে মানুষ হয়েছে। তাছাড়া ওর চেয়ে আমি বয়সে বড়।

—তুমি দেখছি সুন্দর কথা বলতে পারো রাখী। এত গুণ তোমার রয়েছে জানতাম না।

–হয়তো আরও গুণ আছে। তুমি খুঁজে নিতে পারতে। নাওনি। এখন আর তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি এখন উন্মাদ। কিন্তু এ উন্মত্ততায় কোনো ফলই হবে না। লীলাবতী সরল হলেও অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। এক নজরেই সে মানুষের চরিত্র জেনে ফেলতে পারে। তোমার ফাঁদে সে কোনোদিনই পা দেবে না। তুমি শত চেষ্টা করলেও না।

গম্ভীর মুখে রাম সিং বলে,—হুঁ। দেখা যাক। ভুলে যেও না রাখী, গোপাল সিং এখন মৃত।

—তুমি ভুলে যেও না রাম সিং, জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না।

রাম একবার এদিক-ওদিক চেয়ে নেয়। তারপর রাখীর মুখের কাছে মুখ এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,—জোর ক’রে ভালোবাসা না পাওয়া গেলেও দেহ পাওয়া যায়।

—কী বললে? রাখী চমকে ওঠে।

—ঠিক বলেছি।

রাখী দু-পা পেছনে সরে যায়। সে উত্তেজিত। চোখ বড় বড় করে বলে,—লীলাবতীর ব্যাপারে আমার কাছে থেকে কোনোরকম সাহায্য ভবিষ্যতে আর আশা করো না।

রাম সিং আবার হেসে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে রাখীর কাছে গিয়ে একহাতে তার কটিদেশ জড়িয়ে ধরে ধীর গলায় বলে,—আশা আমি বরাবরই করব। তুমি যে আমায় ভালোবাসো রাখী।

.

জ্বলন্ত উনুনগুলোর দিকে চেয়ে বৃদ্ধ রাজপুত বসে বসে ভাবছিল। অনেক কথাই ভাবছিল সে। একে বৃদ্ধ, তার ওপর অসহায় আর পরিশ্রান্ত। মাঝে মাঝে তাই চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলছিল। তবু সে তন্ময়। জীবনের অনেক বছর পার হয়ে গেল। অনেক কিছুই সে দেখেছে। অনেক শুনেছে। কিন্তু চিতোর যে কখনো বাপ্পার বংশধরের হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে, এমন কল্পনা করেনি। চিতোর—চিত্রপুরী। কত বছর আগে বাপ্পা অধিকার করেছিলেন এই চিতোর। সে শুনেছে সেইসব গল্প। সে যেমন শুনেছে রাজোয়ারার প্রতিটি মানুষই শুনেছে। কত বছর ধরে শুনে আসছে। রামায়ণ মহাভারতের মতো এই কাহিনিও তাদের অতি প্রিয়।

রাজ্যহীন বালক বাপ্পা যখন রাখালদের সঙ্গে আরাবল্লীর উপত্যকায় ধেনু চরাতেন, সেই সময়ে ঘটেছিল অদ্ভুত ঘটনাটি। বাপ্পার ভাগে ছিল একটি দুগ্ধবতী বাদামী রঙের গাভী। হঠাৎ দেখা গেল প্রতি সন্ধ্যায় দুগ্ধহীন অবস্থায় সেটি ফিরে আসছে ঘরে। মালিক সন্দেহ করে বাপ্পাকে। নিশ্চয়ই বাপ্পা নিজে খেয়ে নেয় গাভীটির দুধ। অন্যান্য রাখাল বালকদের একান্তে ডেকে নিয়ে সে বলে দিল, বাপ্পার উপর নজর রাখতে। কিন্তু বাপ্পা নিজেও তো কম অবাক হননি এতে। তাই তিনি গাভীটির ওপর কড়া নজর রাখলেন। তিনি দেখলেন একসময় সেটি দল ছেড়ে ধীরে ধীরে পাশের বনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাপ্পা চুপি চুপি পেছু নিলেন। গাভীটি বনের মধ্যে অনেকদূর চলে গিয়ে শেষে এক নির্জন জায়গায় এসে থেমে যায়। বাপ্পা আড়াল থেকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখেন গাভীটির বাঁট থেকে দুধের ধারা আপনা হতে ঝরে পড়ছে একটি উঁচু পাথরের ওপর আর সেই পাথরের পাশেই একজন সন্ন্যাসী নিমীলিত চক্ষে ধ্যানমগ্ন। এই সন্ন্যাসীই হারিত আর এই পাথর সাধারণ পাথর নয়—একলিঙ্গ, স্বয়ং মহাদেব। হারিতের আদেশে অনেক পরে চিতোরের সিংহাসনে বসে বাপ্পা নির্মাণ করেছিলেন একলিঙ্গের মন্দির। সে মন্দির আজও অটুট।

বৃদ্ধ জ্বলন্ত উনুনগুলোর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর ভাবে, অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস। নইলে এই একলিঙ্গকে সাক্ষী ক’রে স্বয়ং দেবী যে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন বাপ্পার হাতে চিতোর উদ্ধারের জন্যে, এতদিন পরে সেই অস্ত্রটিও বাপ্পা-বংশের হাতছাড়া হয়ে গেল চিতোরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে। সেই অস্ত্র আকবর শাহের আদেশে লুঠ ক’রে নেওয়া হয়েছে। কতখানি পাপ মেবারের রানার বংশে জমা হলে এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব। উদয় সিংহ নিমিত্ত মাত্র। নিমিত্ত বৈ কি। কত যুগ আগে যে অস্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে বাপ্পা চিতোর অধিকার করেছিলেন, সেই অস্ত্রের মর্যাদা রাখতে না পারায় তাঁরই বংশধরকে চিতোর হারাতে হল। সেই অস্ত্রটিও হারাতে হল। তাই বাপ্পা সেদিন যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, এতদিন পরে মান-মর্যাদা হারিয়ে তারই এক গুণহীন বংশধর আরাবল্লীর সেই প্রান্তেই আবার ফিরে গেছে। গিরো উপত্যকা থেকে একলিঙ্গের বিখ্যাত মন্দির মাত্র তিন ক্রোশ পথ। বিধির লিখন ছাড়া আর কি বলা যায় একে? আবার প্রথম থেকে শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু বাপ্পা নেই এখন। একলিঙ্গের আশীর্বাদ সেই বহুবছর আগের মতো আর অজস্রধারায় বর্ষিত হবে না কারও ওপর। দেবী এগিয়ে এসে কারও হাতে অস্ত্রও তুলে দেবেন না আবার। বাপ্পার বংশের রক্তের আর সেই তেজ অবশিষ্ট নেই, যে তেজের বলে চিতোর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। ভাবলে হতাশ হতে হয়। তাই বৃদ্ধ রাজপুত ভাবতে চায় না। সে উঠে দাঁড়ায়। চিৎকার ক’রে বলে ওঠে,—কী হল? তোমাদের রুটি বানাতে যে দিন কাবার হতে চলল।

কে যেন মন্তব্য করে ওঠে,ইস, কী তেজ। এক রাতের খালিফা হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে বুড়ো।

কথাটা বৃদ্ধের কানে গেলেও সে কিছু বলেনি। যেন শুনতে পায়নি। কথা বাড়ালেই বাড়ে। এখন কথা বাড়াবার সময় নয়। গোপাল সিং-এর দলের ঐক্য বিনষ্ট হতে না দিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে পারলে সে নিশ্চিন্ত হবে। তারপর যার খুশি সর্দার হোক। সে কিছুই বলবে না। সর্দার হবার বাসনা এই বৃদ্ধ বয়সে আর তার নেই। যখন সময় ছিল যথেষ্ট চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু পারেনি। গোপাল সিং বয়সে ছোট হয়েও অনেক বেশি যোগ্য ছিল তার চেয়ে। একথা তখন স্বীকার করেছে, এখনো করে। তাই দু’জনার মধ্যে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকা সত্ত্বেও তাকেই সব চাইতে বিশ্বাস করত গোপাল সিং। মৃত্যুর আগে যার জন্যে লীলাবতীর ভার তার ওপরেই দিয়ে গেছে। আজীবন অবিবাহিত থাকবার পর বৃদ্ধ বয়সে এই স্নেহপুত্তলি যেন ভগবানের দান। অথচ এখনো কোনোরকম চাঞ্চল্য প্রকাশ করবার উপায় নেই। ক্ষুরধার বুদ্ধি ওই মেয়ের। বুদ্ধিমতী বলেই অনেক কিছু বুঝেও চুপ ক’রে রয়েছে।

বৃদ্ধ জানে তার প্রতি বিদ্রূপের বাণ কোন্ দল থেকে নিক্ষিপ্ত হল একটু আগে। সে রাম সিংকে দলবল পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখেও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। রাম সিং-এর সর্দার হবার বড় ঝোঁক। কে সাহসী, গায়ে শক্তিও রয়েছে তার যথেষ্ট। কিন্তু চরিত্রের যে দৃঢ়তা আর মস্তিষ্কের যে সূক্ষ্মতা থাকলে দলপতি হওয়া যায়, তার কিছুই নেই রামের মধ্যে। সারাজীবন ধরে চেষ্টা করলেও সে কোনোদিন সর্দার হতে পারবে না। কত কথাই তো শোনা যায় তার সম্বন্ধে! সব হয়তো সত্যি নয়। কিন্তু মেয়েদের দিকে তার নাকি একটু বেশি নজর—এ খবর দিয়েছে সেই বয়স্কা রসিকা রাতের বেলায় পথ চলতে চলতে। সারারাত রসিকা সঙ্গছাড়া হয়নি তার। অনেক কথা বলেছে রঙ্গ ক’রে। শুনতে ভালোই লাগে। নাম তার শংকরী। কালপীরই মেয়ে। তার বাবা চলে এসেছিল চিতোরে দলের সঙ্গে। চিতোরেই থাকে সে। তার জন্মও হয়েছে চিতোরে। বাবার নাম বলতে চায়নি, তবে বলেছে বিয়ে হয়েছিল তার। স্বামীর কথা তার বিশেষ মনে নেই। অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল, অল্প বয়সেই স্বামীকে হারিয়েছে। কোনো যুদ্ধে নয়, দুর্ঘটনায়। আপনার জনকে হারিয়ে সে এখন সবাইকে আপন ক’রে নিয়েছে। ভালোই আছে। সব কথা বলা শেষ ক’রে স্ত্রীলোকটি এক সময়ে বৃদ্ধকে সহসা প্রশ্ন ক’রে বলেছিল,—তুমি বিয়ে করনি কেন গো?

বৃদ্ধ হেসেছিল সে-কথা শুনে।

—হাসি নয়। বয়সটা পাকিয়ে ফেললে, অথচ বিয়ে করলে না। কেমন অদ্ভুত লাগে।

—লাগুক। এমন অদ্ভুত লাগবার জন্যেই তো আমার মতো দু-চারজনকে অবিবাহিত থাকতে হয়।

—খুব চালাক। কথা এড়িয়ে যাচ্ছো। বুড়ো হয়েও চালাকি গেল না।

বৃদ্ধ তাকে ছেড়ে অন্যদিকে সরে পড়েছিল রাতে।

সকালে এখানে পৌঁছেও যতবারই দৃষ্টি পড়েছে, দেখেছে তারই দিকে চেয়ে রয়েছে শংকরী। সে চাহনিতে ভাষা ছিল, যার ফলে এই বয়সেও বৃদ্ধের তামাটে মুখে লালের ছোঁয়া লেগেছিল। অথচ সে জানে, শংকরীর ওই দৃষ্টির মতলব তাকে লজ্জা দেওয়া রুটি প্রস্তুত শেষ হয়।

স্ত্রীলোকদের চিৎকার ক’রে ডেকে বৃদ্ধ বলে,—চলে এসো তোমরা আগে। বাচ্চাদের খাইয়ে তোমরা খেয়ে নাও।

রাম সিং-এর দল থেকে একজন ছিটকে বের হয়ে এসে বলে,—অনেক খেটেছ তুমি। এবার বিশ্রাম নাও।

আমরা ব্যবস্থা করেছি।

রসিকা শংকরী আগে এসে দাঁড়িয়েছিল। যুবকের দিকে চেয়ে হেসে বলে,–কেন বাবা এতক্ষণ তো বুড়োই সবকিছু করল। এখন সরিয়ে দিচ্ছ কেন তাকে?

—ওরে বাবা। ওকে সরিয়ে দেব? ঘাড়ে আমার একটাই মাথা। দলের সর্দারকে কি সরানো যায়। আমি বিশ্রাম নিতে বলছি।

—অত করে যখন বলছ, বিশ্রাম নেবে বৈ কি। তবে মেয়েদের খাবার দেবার ভার ওর ওপরই থাক। ছেলেদের বেলায় তোমরা না হয় এসো।

—এ তোমার কেমন কথা হল পিসিমা?

—পিসিমা? কোন সাতগুষ্টির পিসিমা আমি তোমার শুনি?

—পিসিমা না হও, দিদিমাই হলে।

—ওসব মতলব ছাড়ো নাতি। এতক্ষণ প্যাটপ্যাট ক’রে তাকিয়ে সবই দেখেছি। তোমাদের এই দলটি টিটকিরি দিয়ে আর হেসে এতক্ষণ কম বয়সি মেয়েদের জ্বালিয়ে খাচ্ছিল। এখন বুঝি ষোলকলা পূর্ণ করতে চাও? এই রাম সিং তোমাদের পাণ্ডা–আমি তাও জানি। ছিঃ ছিঃ, লজ্জাও নেই তোমাদের। শুধু যুদ্ধ করলেই বীর হওয়া যায় না। মেয়েদের সম্মান রাখতে শিখতে হয়। চেয়ে দেখ, তোমাদের বয়সি আরও অনেক ছেলে এখানে রয়েছে। কই তারা তো এমন নয়? তারা কত ভালো—কত ভদ্র।

রাম সিং এবারে এগিয়ে বসে বলে,– আমাদের এভাবে অপমান না করলেই ভালো করতে।

শংকরী রুখে দাঁড়ায়,—কী? ভয় দেখাচ্ছ? মেরে ফেলবে নাকি? সে সাহস রয়েছে তোমার? এই আমি দাঁড়ালাম। এসো দেখি?

রাম সিং একটু ঘাবড়ে যায়

শংকরী শ্লেষের হাসি হেসে বলে,–আমি জানি তোমাদের দৌড়।

বৃদ্ধ শংকরীর হাত চেপে ধরে বলে, যাক্! এখন আর ঝগড়া করো না। এই দুঃসময়ে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়।

—তাই বলে মেয়েদের অপমান সহ্য করব না।

—মেয়েদের অপমান করলে তার শাস্তি দলের পুরুষেরা দেবে। রাম নিজের দলকে যত ভারী মনে করছে, ওর দল তত ভারী নয়। এই ঘটনার পর থেকে আরও কমবে।

রাম কুটিল হাসি হেসে বৃদ্ধকে বলে, –দেখা যাবে।

—হ্যাঁ। সময় এলে দেখো, এখন আমার হুকুম, সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।

—হুকুম?

বৃদ্ধের দেহখানা মুহূর্তে ঋজু হয়ে ওঠে। তার দুই চোখ থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বার হয়। সে চিৎকার করে বলে,—হ্যাঁ হুকুম। আমি অল্প সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে তোমার দল নিয়ে একেবারে সরে দাঁড়াও নইলে —

—নইলে?

—শাস্তি—চরম শাস্তি পাবে।

রাম হো হো করে হেসে ওঠে। তারপর বলে,—বেশ! তবে এখনি পরীক্ষা হয়ে যাক। দেখি তোমার কতখানি শক্তি।

বৃদ্ধ দলের দিকে চেয়ে বলে,–তোমরা জান, চিতোর থেকে গিরো উপত্যকায় আমাদের দলকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার। সে ভার তোমরাই আমাকে দিয়েছ। আমি নিজে থেকে এগিয়ে যাইনি। দলের সর্দার হবার স্পৃহা আজ আর আমার নেই। তবে এই দলের সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে আমি রয়েছি। প্রধান যারা রয়েছে আমাদের মধ্যে তারা অনেকেই জানে সেকথা। তাই দলের প্রতি মমতা থাকা আমার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। সেই মমতাবশেই নিজেকে ততটা সক্ষম না জেনেও তোমাদের ভার কিছুদিনের জন্যে অন্তত নিয়েছি। কিন্তু এর মধ্যেই বাধা এসে উপস্থিত হয়েছে। তোমরা স্বচক্ষেই দেখছ। বাধা এসেছে এমন কয়েকজনের কাছ থেকে যাদের বাবারাও আমার চেয়ে ছোট।

রাম সিং চিৎকার ক’রে বলে ওঠে,—ওসব ফালতু কথা শোনাবার জন্যে আমরা বসে নেই কাজের কথা বল। যদি না পার, সরে দাঁড়াও। আমি বলছি।

বৃদ্ধ ধীরে গম্ভীরস্বরে বলে,–তোমাকে বলবার অধিকার এখানে কেউ দেয়নি।

—না দিলেও, এখন দেয় কি না দেখি।

বৃদ্ধ দলকে আহ্বান করে বলে,—রাম সিং-এর ধৃষ্টতা তোমরা দেখলে। এখন বল সত্যিই কি এর হাতে তোমরা নিজেদের ভালো-মন্দের ভার দিতে চাও?

একসঙ্গে প্রায় হাজার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, না।

—শুনলে রাম সিং?

রাম সিং গলার স্বরকে উচ্চে তুলে বলে—এই অপদার্থ বৃদ্ধের ওপরই তবে তোমরা নির্ভর করবে?

তার উক্তি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বিরাট আলোড়ন দেখা দেয়। একসঙ্গে চার পাঁচশো লোক এগিয়ে আসবার চেষ্টা ক’রে বলে—ও বাচালকে আমাদের হাতে ছেড়ে দাও, শেষ ক’রে দি।

বৃদ্ধ বলে,—না। তার প্রয়োজন হবে না। নিজের স্থানটি ওর কোথায়, একবার যখন জানতে পেরেছে, তখন শান্তই থাকবে আশা করি। আমি চাই না গিরো উপত্যকায় পৌঁছোবার আগে দলের একটি লোকও কমে যায়।

রাম সিং কাঁপতে থাকে। তার চোখ রক্তবর্ণ। মরিয়া হয়ে বলে,–তোমরা অনেকেই একটি খবর রাখো না। রাখলে, এমন মূর্খের মতো কথা বলতে না। এই বৃদ্ধ তোমাদের পৌঁছে দেবে ঠিকই। কিন্তু তারপর? তারপর কে সর্দার হবে? বৃদ্ধের আয়ু আর কতদিন? এই বয়সেও সর্দার হবার লোভে একটি খবর সে গোপন ক’রে রেখেছে। তোমাদের সৌভাগ্য যে আমি কোনোরকমে খবরটি জানতে পেরেছি। তোমরা কয়জন খবর রাখো যে, তোমাদের আসল সর্দার গোপাল সিং নিহত?

—কী?

একটা আর্তনাদ ওঠে। তারপর স্তব্ধ হয়ে যায় জনতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *