১২.
অশ্বশালে গিয়ে একটি অশ্ব বেছে নিয়ে যখন রাজপ্রাসাদের বাইরে আসে, তখন অন্ধকার নেমে এসেছে গিরো উপত্যকার ওপর।
বাইরে এসে প্রথম মনে পড়ে তার যে, সারাদিন প্রায় অভুক্তই রয়েছে সে। পেটে কিছু পড়েনি।
ঘরে বাসি রুটি হয়েছে খানকতক।
লীলাবতী তৈরি করে দিয়েছিল আগের দিনে। সেই রুটি খেয়েই রাত কাটাতে হবে আজ।
শেষ বারের মতো লীলাবতীর হাতের তৈরি খাবার খাবে।
এরপর খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিকই থাকবে না। মোগলাই খানাও জুটতে পারে ভাগ্যক্রমে কোনদিন, আবার অভুক্তও থাকতে হতে পারে। ভবিষ্যৎ অজ্ঞাত, পথ অনিশ্চিত।
তবে যত কষ্টই আসুক, মেবারের কথা মনে রেখে রাজপুতদের স্বাধীনতা রক্ষার কথা মনে রেখে সে সব দুঃখ কষ্ট হাসিমুখে মেনে নেবে।
এখন তার জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান আগ্রায় আশ্রয় সন্ধান এবং মুঘলদের দুর্বলতা সন্ধান।
সহসা জিৎ সিং-এর দীর্ঘ অসিটির গায়ের হাত পড়ে যায়। চমকে ওঠে সে।
একদিন তাকে এমনি অনিশ্চিত পথে শত্রুর মুখে এগিয়ে যেতে হবে, এ কথা কি বাবা জানতে পেরেছিলেন? তাই কি অসিটি হাতে দিয়ে বলেছিলেন, সর্বদা এটি সঙ্গে রাখবে?
বীর ছিলেন তিনি। দেশভক্ত রাজপুত নিশ্চয় ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন।
জিৎ চলতে চলতে চক্ষু মুদ্রিত করে বাবার মুখ স্মরণ করবার চেষ্টা করে। বার বার স্মরণ করে কথাকটি।
পরমুহূর্তেই তার মনে ভেসে ওঠে লীলাবতীর মুখ। অশ্রুসজল চোখ দুটি। কানে বেজে ওঠে কাতর অনুনয়, তুমি আগ্রায় যেও না জিৎ।
জিৎ জোর করে লীলার চিন্তা মন থেকে দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে।
সে যে সঙ্কল্প নিয়ে নেমেছে, কোনো কিছুর আকর্ষণেই পথভ্রষ্ট হবে না।
মেবার রক্ষার চেষ্টা থেকে কেউ তাকে বিরত করতে পারবে না।
সে তার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে ঠিকই বুঝেছে প্রবল মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে শক্তি নিয়ে নয় বুদ্ধি নিয়ে সংগ্রামে নামতে হবে।
কৌশল ও শক্তি দুয়ের মণিকাঞ্চন যোগ করতে না পারলে রাজপুত জাতি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
অতীতে শক্তির গর্বে গর্বিত রাজপুত বীরপুরুষ কৌশলকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন কেবল সমরক্ষেত্রে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বাহুবলকেই তাঁরা নির্ভর করতেন।
জিৎ সেই সীমা এবার অতিক্রম করে এগিয়ে যাবে।
রণক্ষেত্রে আবির্ভূত হবার আগে শত্রুর দুর্বলতম স্থানে সে সুকৌশলে আঘাত হানবার ব্যবস্থা করবে।
ভাবতে ভাবতে দৃঢ়মুষ্টিতে তলোয়ারের হাতল চেপে ধরে জিৎ। সঙ্কল্প অনুরণিত হয়ে ওঠে মনে।
কিন্তু সেই ক্ষণেই আবার লীলাবতীর অশ্রুসজল সকাতর মুখখানি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
ঝন ঝন শব্দে লীলার কণ্ঠস্বর কানে বেজে ওঠে—গুপ্তচর! জিৎ তুমি গুপ্তচর-
না—না—না। জিৎ হীন গুপ্তচর মাত্র নয়। নিজের মনেই প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে জিৎ।
কিকা তো তাকে গুপ্তচর মনে করেননি?
যশোবন্তও মনে করেননি।
তাহলে তাঁরা নিশ্চয় তাকে আগ্রা যাবার জন্য উৎসাহ দিতেন না।
যথাসাধ্য বাধা দিতেন। বোঝাবার চেষ্টা করতেন। তাকে ভ্রান্তিমুক্ত করবার চেষ্টা করতেন।
কিন্তু এ সব কথা এখনো কেন ভাবছে জিৎ সিং?
তাহলে কি তার মনে এখনো ক্ষীণ দুর্বলতা রয়ে গেছে?
সে-ও কি দ্বিধান্বিত? না-কি, এ লীলাবতীর আকর্ষণ? কঠোর কর্তব্য সাধনে ভীরুতা?
এসব চিন্তাকে যত প্রশ্রয় দেবে ততই পল্লবিত হয়ে মনকে গ্রাস করবে। তাকে দ্বিধায় ফেলবে। সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে। এই মুহূর্ত থেকে সে কেবল আগ্রার চিন্তাই করবে।
ভাবতে ভাবতে জিৎ সিং অশ্বের গায়ে থাবা দেয় আস্তে।
সেটি চলতে শুরু করে।
আজ রাতটি কোনোরকম কাটিয়ে দেবে লীলাবতীর কাছাকাছি ঘরটিতে।
ভোর না হতেই হবে যাত্রা শুরু।
সেই যাত্রার শেষ হবে কবে কোথায় কেউ বলতে পারে না।
.
চলতে চলতে এক সময় তার কুটিরের কাছে এসে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে জিৎ সিং।
ঘোড়াটিকে এগিয়ে নিয়ে এসে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে।
ঘোড়ার মুখের সামনে ধরে দেবার মতো কোনো আহার্য না থাকায় কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থাকে সামনে। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস মোচন করে নিঃশব্দে স্নেহস্পর্শ বুলিয়ে দিতে থাকে অশ্বের কপালে।
তারপর একসময় ধীর পদক্ষেপে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।
শক্ত হাতে দরজা টেনে বন্ধ করে দেয়।
কোণে, খাটিয়ার ওপর অনুমানে হাতড়ে হাতড়ে একটি পাত্র থেকে কয়েকটি রুটি তুলে আনে।
লীলার হাতে তৈরি রুটি।
কে জানে এজীবনে হয়তো এই শেষবার
জীবনে আর কোনোদিন লীলার তৈরি খাবার তার ভাগ্যে জুটবে না।
রুটি ছিঁড়ে মুখে দেবার আগে, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে কিছুক্ষণ
তারপর এক সময় টুকরো টুকরো করে রুটি কটি গলাধঃকরণ করে।
বাইরে তখন রাতের নিস্তব্ধতা।
ঝিঁঝি আর রাতপাখির কর্কশ রব।
জিৎ এক সময় খাটিয়ায় সারাদিনের ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয়।
গভীর নিশীথে কে যেন কপাটে মৃদু ধাক্কা দেয়।
ঘুম ভেঙে যায় জিৎ সিং-এর। সে উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করে। ঘুম বেশ গাঢ় হয়েছিল। তাই জেগে উঠে কিছুই মনে করতে পারছিল না।
ভেবেছিল এ-রাতও অন্যান্য রাতের মতো বিশেষত্বহীন।
কিন্তু ঘুমের মধ্যেও বিষাদ ভাব তার কেটে যায়নি।
কেন এই বিষাদ?
ভাবতে ভাবতে চমকে ওঠে সে।
তাই তো, তাকে যে আগ্রা যেতে হবে ভোর রাতে।
ভোর হয়ে গেল নাকি?
লীলাবতী!
একবার তার সঙ্গে দেখা হলে বেশ হতো।
কতই বা ওর বয়স? কতটুকু বোঝে? সরল বিশ্বাসে ও যা বলেছে, তা তো এমন কিছু খারাপ বলেনি। ওর ওপর অভিমানের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
জিৎ সিং আকুল হয় লীলাবতীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
কে দেখবে তাকে? কে তাকে ভালোবাসবে? তার যে কেউই নেই পৃথিবীতে।
সর্দার আর কতদিন তার দেখাশোনা করতে পারবে?
জিৎ সিং শয্যার ওপর উঠে বসে। কে আসতে পারে এত রাতে?
যশোবন্ত? কিন্তু সে এলে এত আস্তে কেন ধাক্কা দেবে?
কোনো বন্যজন্তু? ভাবতেই জিৎ সিং-এর হৃৎপিণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
বাইরে অশ্বটি বাঁধা রয়েছে। কোনো অনিষ্ট হয়নি তো?
কিন্তু বন্যজন্তু এভাবে ধাক্কা দেবে কেন?
না। বন্যজন্তু হতে পারে না।
তারা এমন নিয়মিতভাবে ধাক্কা দিতে পারে না।
আবার নড়ে ওঠে কপাট।
শব্দ হয় আরও একটু জোরে এবং বেশ খানিকক্ষণ ধরে।
এক সঙ্গে অনেক চিন্তা দ্রুত খেলে যায় জিৎ সিং-এর মাথায়।
সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ করে উৎকর্ণ হয়ে থাকে।
নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দও কানে শুনতে পায় জিৎ।
নিঃশ্বাস হয় বিলম্বিত ও দীর্ঘ।
জিৎ সিং ইচ্ছে করেই কোনো সাড়া দেয় না।
প্রতীক্ষা করতে থাকে। কিন্তু নিজের অজান্তেই মুহূর্তে চকিতের জন্য মন ভাবনার একটি স্থির কেন্দ্রে স্থায়ী হয়ে পড়ে।
লীলাবতী নয় তো?
লীলা কি শেষ পর্যন্ত তার ভুল বুঝতে পারল? তাই ছুটে এসেছে এই রাতে তার কাছে?
পর মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চমকের মতো মন সরে আসে এ সম্ভাবনা থেকে।
আর তখনই নিজের অজ্ঞাতে অকস্মাৎ তার কণ্ঠে সাড়া জেগে ওঠে।
—কে?
কণ্ঠস্বর কানে যেতে নিজেই চমকে ওঠে জিৎ।
কিন্তু দ্বিতীয় কোনো শব্দ করে না।
—আমি জিৎ।
বাইরে থেকেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া জেগে ওঠে।
অধীর জিৎ সিং দ্বিতীয়বার চমকে ওঠে।
মনের ক্ষীণ সম্ভাবনা এমন ভাবে বাস্তব হয়ে উঠবে কে জানতো।
বিছানা ছেড়ে এক লাফে দরজার কাছে যায় জিৎ সিং।
লীলাবতী। লীলাবতীর কণ্ঠস্বর।
তার লীলা সত্যিই তাহলে তার কাছে ফিরে এসেছে
তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়।
তার লুব্ধ তৃষ্ণিত দৃষ্টি যেন আছড়ে পড়ে বাইরে।
বাইরে ততটা অন্ধকার নেই। আকাশের কোথাও চাঁদ রয়েছে।
দৃষ্টির অন্তরালে থেকে অস্পষ্ট আলোর আভা বিস্তার করেছে।
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ বলে প্রথম রাতে ওঠেনি।
কণ্ঠস্বর ভুল করেনি জিৎ সিং।
সত্যিই লীলাবতী দাঁড়িয়ে রয়েছে দোরগোড়ায়। ঠোঁটের কোনায় সলজ্জ স্মিত হাসি নিয়ে।
কিন্তু অস্পষ্ট চন্দ্রালোকেও চোখের বিষণ্ণ দৃষ্টি জিৎ সিং-এর চোখ এড়াতে পারে না।
বিস্মিত স্তম্ভিত জিৎ সিং-এর কণ্ঠে আবার ধ্বনি জেগে ওঠে।
—এত রাতে? তুমি?
—ভেতরে চল জিৎ।
ধীর অকম্পিত কণ্ঠে বলে লীলাবতী।
লীলার কণ্ঠস্বর যে প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছিল মুহূর্তে তা অন্তর্হিত হয়।
যেন আশা-ভঙ্গের বিহলতা স্তব্ধ করে দেয় জিৎ সিংকে। লীলা তো তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল না! চোখে জলের ধারা নিয়ে কাতর মিনতি জানাল না—আমি বুঝতে পারিনি জিৎ। না বুঝে তোমায় আঘাত করেছি। আমায় তুমি ক্ষমা কর। তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছ তা ভ্রান্ত নয়।
পরিবর্তে এ কী অবিচল দৃঢ় স্বর লীলার কণ্ঠে?
জিৎ সিং সরে দাঁড়ায় দরজার মুখ থেকে।
লীলাবতী ভেতরে এসে কপাট বন্ধ ক’রে দেয়।
তারপর ঘুরে দাঁড়ায় জিৎ-এর মুখোমুখি।
জিৎ সিং-এর মনে আবার আশা জেগে ওঠে।
সহসা বাইরে তীব্রস্বরে অশ্বের হ্রেষাধ্বনি জেগে ওঠে।
সচকিত হয়ে বন্ধ দরজার দিকে ফিরে তাকায় জিৎ।
ত্রস্ত হাতে দরজা খুলতে যায়। কিন্তু বাধা দেয় লীলাবতী।
—বাইরে বেরুবার দরকার নেই জিৎ। ও কিছু নয়। একা থাকলে ঘোড়া মাঝে-মাঝে এভাবে ডেকে ওঠে।
—তবু একবার দেখা দরকার নয়? কোনো বন্য পশু দেখে হয়তো ভয় পেয়ে থাকবে। এবারে মৃদু হাসির ঝিলিক খেলে লীলাবতীর ওষ্ঠে। বলে, তুমি ভীত জানোয়ারের স্বরও কি বুঝতে পার না? ও স্বর ভয়ের নয়। কিন্তু অশ্ব পেলে কোথায়?
—কিকা দিয়েছেন।
মুহূর্ত নীরব থাকে লীলাবতী। তারপর আবার বলে, কিকা মহানুভব। তোমার আগ্রা যাবার সঙ্কল্প তিনি শুনেছেন?
আশান্বিত জিৎ সিং-এর বুক জ্বলে ওঠে লীলাবতীর কথায়।
ব্যগ্রস্বরে বলে ওঠে—তিনি স্থির ভাবে শুনেছেন আমার কথা। কেবল তাই নয়, সর্বান্তঃকরণে আমায় সমর্থনও জানিয়েছেন। আগ্রায় তাঁর পরিচিত কয়েকজন রাজপুতের ঠিকানাও আমায় দিয়েছেন—প্রথমে ওদের সঙ্গে গিয়েই আমায় যোগাযোগ করবার পরামর্শ দিয়েছেন। আর আসবার আগে অশ্বটি তাঁর কাছ থেকে চেয়ে এনেছি।
—তবে তো তোমার আর কোনো বাধাই রইল না।
জিৎ সিং দুপা এগিয়ে এসে লীলাবতীর নিকটে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়
তারপর লীলাবতীর দুই কাঁধে হাত রেখে কাঁপা গলায় বলে,-তুমি, তুমি তবে—
—না জিৎ। তুমি যা ভাবছ তা নয়।
গম্ভীর স্বরে জিৎ সিং বলে,—তবে কেন এলে? এই রাতে একা ছুটে এলে কেন?
এতক্ষণ জিৎ সিং লক্ষ্য করেনি, এবারে লীলাবতী হাত তুলতে দেখতে পায় তার ডান হাতে মুঠিবদ্ধ একটি ছোট্ট কৌটো।
লীলাবতী ধীরে ধীরে কৌটো খোলে।
হাতে করে কৌটো থেকে সামান্য কোনো পদার্থ তুলে নিয়ে বলে,—একলিঙ্গের নির্মাল্য নিয়ে এলাম জিৎ। সেদিন সর্দার পুজো দিতে গিয়ে, নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। তোমার মাথার পাগড়িতে রেখে দিও। তোমার কল্যাণ হবে। কেউ তোমার কোনো অনিষ্ট করতে পারবে না।
—আমার কল্যাণ? দাও।
লীলাবতীর হাত কাঁপে।
সে কোনোমতে জিৎ সিং-এর হাতের ওপর নির্মাল্য রেখে দেয়।
তারপর আবার কৌটোর মুখ বন্ধ করে মুঠিতে নিয়ে নেয়।
জিৎ সিং বিড়বিড় ক’রে বলে,—আমার কল্যাণ?
সামান্য শ্লেষ বুঝি মেশানো ছিল জিৎ সিং-এর কণ্ঠস্বরে।
তা লীলাবতীর কান এড়ায় না।
—ওকথা বার বার কেন বলছ জিৎ। পৃথিবীতে তোমার কল্যাণ ছাড়া চাইবার আর দ্বিতীয় কি রইল আমার?
সহসা দুর্বার আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে জিৎ সিং।
কিন্তু নিজেকে সংযত করে নেয়। বলে, এই কল্যাণ-কামনার কী সার্থকতা লীলা?
—সে কথা তো ভেবে দেখিনি আমি জিৎ।
—তুমি তো না ভেবে কোনো কাজ কর না লীলা।
—তুমি ঠিকই বলেছ। তবে হৃদয়ের তাগিদ অনেক সময়ই চুলচেরা বিচার গ্রাহ্য করে না। তোমার কল্যাণপ্রার্থনা আমার নিঃশ্বাসের মতো স্বাভাবিক জিৎ। তুমি যেখানে যে অবস্থাতেই থাকো না কেন—আমি চিরদিন দূর থেকে তোমার কল্যাণ প্রার্থনা করে যাব।
—যাকে ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে দিলে—
—ভুল করছ জিৎ। ঘৃণা আমার তোমার প্রতি নয়। যে কাজের সঙ্কল্প তুমি গ্রহণ করেছ, ঘৃণা আমার সেই কাজের প্রতি।
—কিন্তু কিকা তো তা করেননি লীলা।
—তুমি ভুল করছ জিৎ। কিকা পুরুষমানুষ। তিনি যা পারেন আমি তা পারি না। আমি নারী। আমার সংস্কার আমার কর্তব্য স্থির করে দেয়।
সহসা জিৎ সিং-এর ভাবান্তর দেখা দেয়। সে লীলাবতীকে আকুলভাবে বুকের ভেতরে টেনে নিয়ে বলে,—দেখ তো লীলা। সবই তো শুনতে পাচ্ছ।
কান্নায় ভেঙে পড়ে লীলাবতী। জিৎ সিং-এর আদরে আর সোহাগে এক একবার থেমে যায় সেই কান্না।
ক্ষণেকের তরে মুখে হাসি ফোটে লীলাবতীর।
কিন্তু পরক্ষণেই আবার দ্বিগুণ বেগে কান্না পায় তার। সে কান্নায় এত অশ্রু নির্গত হয় যে, গিরো উপত্যকা থেকে ধাবিত হয়ে তা যেন চম্বলের সঙ্গে গিয়ে মিশবে।
কয়েক দণ্ড কেটে যায়।
কারও খেয়াল থাকে না। অনাস্বাদিত এক আনন্দ আর দুঃখের মধ্যে নিমজ্জিত হয় ওরা।
বুঝতে পারে—একান্তভাবেই তারা পরস্পরের।
তবু কাঁটার মতো কি যেন খচখচ করে বেঁধে তাদের অন্তরে।
সেই কাঁটা অনেক আদর সোহাগেও মন থেকে তুলে ফেলা যায় না।
এই না তুলে ফেলার ব্যর্থতা নিয়ে উভয়ে উভয়ের মুখের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে।
—তবু যাবার আগে পাথেয় সংগ্রহ ক’রে নিলাম লীলা। আমাকে গ্রহণ করতে না পারলেও তুমি আমারই।
—হ্যাঁ জিৎ। শুধু এই কথাটিই তোমায় বলতে এসেছিলাম। বলতে পারিনি। তবে বুঝিয়ে দিতে পেরেছি, একলিঙ্গের কৃপায়।
বাইরে থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,—এবারে প্রস্তুত হও জিৎ। ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই।
চমকে ওঠে জিৎ সিং।
যশোবন্তের কণ্ঠস্বর। কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেন সে নড়তে পারে না।
অমন চমকে উঠলে কেন জিৎ? তুমি কি সর্দারের গলা চিনতে পারছ না?
—সর্দার কখন এল?
সর্দার তো বরাবরই ছিল। তোমার অশ্বকে বাইরে দেখে প্রথম রাত থেকে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে পাহারা দিচ্ছে।
—তুমি তো এতক্ষণ বলনি?
—মনে হয়নি।
—তুমি এত রাতে এসেছ সর্দার জানে?
—হ্যাঁ। সে-ই তো আমাকে তোমার ঘরের সামনে পৌঁছে দিয়ে গেল। তুমি প্রাসাদ থেকে যখন ফিরলে আমি নির্মাল্য আনতে চেয়েছিলাম। সে মানা করল। বলল, ঠিক সময়ে আমাকে ডেকে দেবে। আমি তোমার খাবার আনতে চেয়েছিলাম। তাও আনতে দিল না। বলল, রুটির চেয়ে তোমার নিদ্রার প্রয়োজন বেশি।
জিৎ সিং বিচলিত হয়।
সর্দারকে মনে মনে প্রণাম না জানিয়ে পারে না।
বাইরে থেকে আবার যশোবন্তের গলা পাওয়া যায়,—কি হল জিৎ সিং? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?
—না সর্দার।
জিৎ কপাট খুলে দেখে একটু দূরে ঘোড়ার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে সর্দার। অন্ধকারের মধ্যেও অনুমান করতে কষ্ট হয় না তার যে সর্দারের মুখে হাসি ফুটে রয়েছে।
—তোমার ঘোড়াকে দানা দেওয়া হয়ে গেছে জিৎ। দারুণ তেজী ঘোড়া দেখছি। রানা দিলেন বুঝি?
—না সর্দার। কিকা দিয়েছেন।
—তাই বল। ওই একজনই রয়েছেন প্রাসাদে যিনি মানুষের মতো মানুষ।
—তিনি মানুষের মতো মানুষ কি না জানি না সর্দার। তবে আরও একজন বটে।
—আরও—কার কথা বলছ তুমি?
—তুমি সর্দার তুমি। তুমি যদি মেবারের রানা হতে, তবে আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে থাকতাম। কিন্তু সে ভাগ্য নেই আমাদের।
—কি যে বলছ। মাথা ঠিক নেই দেখছি। লীলাদিদি বুঝি জ্বালিয়েছে খুব। কান্নাকাটি করেছে, তাই না? মেয়েরা সবাই একরকম। একমাত্র সুন্দরী ছাড়া। আজ যদি সুন্দরী লীলার বয়সী হত, তবে সে বিনা দ্বিধায় বিদায় দিত। একথা আমি জোর করে বলতে পারি।
লীলা মাথা নীচু ক’রে থাকে।
.
জিৎ সিং অন্ধকারেই ঘোড়ার কাছে এগিয়ে যায়।
গলায় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে।
অদূরে দাঁড়িয়ে সর্দার।
আবছায়া অন্ধকারেও তাকে প্রায় স্পষ্টই চোখে পড়ে।
মাথার ওপর রাত জাগা পাখি প্রহর ঘোষণা করে।
জিৎ সিং একবার চোখ তুলে তারা-ভরা আকাশের দিকে তাকায়।
—আর দেরি করা ঠিক হবে না তোমার। রাতের অন্ধকার এখনো মরেনি। তোমার বেরিয়ে পড়বার এই উপযুক্ত সময় জিৎ সিং।
—হ্যাঁ সর্দার। আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। কিকার কাছ থেকে আগ্রার কয়েকজন ব্যবসায়ীর ঠিকানা পেয়েছি। তাদের খুঁজে নিতে হলে আমাকে ঠিক সময়ে আগ্রায় পৌঁছতে হবে।
—কিকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার কোনো ব্যবস্থা করতে পেরেছ?
—হ্যাঁ, সর্দার। সেই ব্যবসায়ীদের এ পথে যাতায়াত আছে বললেন কিকা। তাদের মাধ্যমেই আমাদের খবরাখবর আদান প্রদান হবে।
—কিকার পরিচিত যখন, বেইমানির ভয় নেই।
—সে বিষয়ে আমিও নিশ্চিত সর্দার। ব্যতিক্রম মনে হলে আমি রাজি হতাম না।
—এই ব্যাপারটা নিয়েই আমি সারা রাত ভাবনা-চিন্তা করেছি। এতক্ষণে নিশ্চিত হওয়া গেল। জিৎ সিং আর সেখানে দাঁড়ায় না। দ্রুত ফিরে এসে ঘর থেকে টুকিটাকি জিনিস এনে ঘোড়ার পিঠে বাঁধে।
তলোয়ারটি কোমরে ঝুলিয়ে নেয়।
তারপর মনে মনে একলিঙ্গকে প্রণাম জানিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে বলে, ‘চলি সর্দার।
—–এসো। নাম তোমার জিৎ। জিতে ফিরে এসো। এমনভাবে ফিরে এসো যাতে দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেও লীলাবতীর তৃষ্ণা না মেটে।
লীলাবতী ততক্ষণে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।
নিঃশব্দে একপাশে দাঁড়িয়ে সে লক্ষ্য করছে জিৎ সিংকে।
—চলি লীলা।
অতিকষ্টে কান্না সংবরণ করে লীলাবতী বলে,–এসো।
অশ্ব চলতে শুরু করে।
তখনো আবছা অন্ধকার।
চাঁদের আলো ফিকে হতে শুরু করেনি তখনো।
তার মধ্যে পেছনে ফিরে দেখতে পায় জিৎ, স্থাণুর মতো দুটি অস্পষ্ট মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে তারই ফেলে আসা কুটিরের সামনের আঙিনায়।
.
বিদায় মেবার! এ বিদায় কতদিনের জন্যে—একমাত্র একলিঙ্গ জানেন।
জিৎ সিং একবার হাত দিয়ে শিরস্ত্রাণে একলিঙ্গের নির্মাল্য অনুভব ক’রে নেয়।