আরাবল্লী – ১১

১১.

এদিকে জিৎ সিং ধীরে অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলে।

পেছনে ফিরে চাইবার ইচ্ছে হলেও সে সামনে দৃষ্টি ফেলে চলতে থাকে।

পেছনে তার আকর্ষণ রয়েছে, কিন্তু সেই আকর্ষণ আর দুর্নিবার নয়।

লীলাবতী তাকে ছেড়ে দিয়েছে। লীলাবতী আস্ত এবং খাঁটি জিৎ সিং-কে চায় না। সে চায়

তার নিজের মনের মতো, তার সংস্কারগুলির পোষা জিৎ সিং-কে স্বামীত্ব বরণ করতে। কিন্তু তা হতে দিতে পারে না সে।

সে যা, তাই থাকতে চায়।

জিৎ সিং আরও এগিয়ে যায়।

প্রাসাদে যেতে হবে। কিকার সঙ্গে দেখা করতে হবে।

আজ সম্ভব না হলে, কালই ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে উঠে রওনা দিতে হবে আগ্রার দিকে। তাই যাবার আগে কিকাকে সব খুলে বলতে হবে।

রাজোয়ারার প্রতিটি মানুষ তার বিপক্ষে গেলেও কিকা অন্তত তাকে সমর্থন করবেন, এটুকু আশা তার রয়েছে।

তবু এতটা নিশ্চিন্ত থাকা কি উচিত হবে?

নিশ্চিন্ত তো সে আর একজনের ক্ষেত্রেও ছিল।

কিন্তু ফল হল বিপরীত।

কিকা যদি সম্মত হন, যদি তিনি প্রফুল্ল মনে বিদায় দিতে পারেন তাকে, তাকে, তবে সে একটি জিনিস চাইবে তাঁর কাছে।

একটি ঘোড়া চাইবে সে। কিকা প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না।

সমর্থন না করলেও প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না।

এই কয় মাসে তাঁর সম্বন্ধে যেটুকু ধারণা হয়েছে তার, তাতে সে বুঝেছে যে নিজের ইচ্ছে মতো জোর করে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবার পক্ষপাতী তিনি নন।

প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ইচ্ছার মূল্য দেবার মতো উদারতা তাঁর যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে।

হঠাৎ খেয়াল হল জিৎ সিং-এর, লীলাবতীর ঘর থেকে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে সে।

এখান থেকে আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। কে জানে ও এখন কি করছে ওখানে!

বুকের ভেতরে হু হু ক’রে ওঠে জিৎ সিং-এর। দুহাতে বুক চেপে আকুল নয়নে পেছনে ফিরে চায়। দেখতে পায় না তাকে। তৃষ্ণার্ত চোখদুটি বারবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।

উঁচু নিচু জমি আর ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে লীলাবতীর ঘর অদৃশ্য হয়েছে, অদৃশ্য হয়েছে যশোবন্তের কুটিরখানিও। কে জানে যশোবন্ত হয়তো লীলাবতীকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

একটি জিনিস এখনো অদৃশ্য হয়ে যায়নি। জিতের চোখ ঘুরে ফিরে সেখানেই স্থির হয়।

শিমুল গাছের মাথাটি সবার ওপরে থেকে তাকে শেষ বারের মতো যেন ডাকছে। মাথা দুলিয়ে যেন হাতছানি দিচ্ছে। আহা, লীলাকে যদি ওই গাছতলায় দেখতে পেত জিৎ!

বুকের ভেতরের শূন্যতা দ্বিগুণ হয়ে দেখা দেয় জিৎ সিং-এর। দুঃসহ একটা হা-হা-করা ভাব ছড়িয়ে যাচ্ছে সমস্ত সত্তায়। চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে আসতে চাইছে।

সে চোখ ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। পারে না। কিসের এক অদৃশ্য বন্ধন যেন চোখ দুটিকে আটকে রেখেছে সেখানে।

ঠিক সেই সময়ে তার পায়ের সামনে লুটিয়ে পড়ে ধবধবে সাদা রঙের একটি তুলোর ফুল। হাওয়ায় গড়িয়ে এগিয়ে আসে জিৎ-এর দিকে।

বার্তা পাঠিয়েছে শিমুল গাছ। তাই মনে হয় জিৎ সিং-এর। স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে শিমুলের সেই ফাগুন মাসের রূপ আর নেই। তবু সে ডাকছে। সে-ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে না জিৎ।

জিৎ সিং দু-আঙুলে তুলোটি তুলে নেয়। নরম পশমের মতো তুলোটির ভেতরে একটি কালো রঙের বীজ।

এবারে গাছটির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ফেলে জিৎ সিং। তেমনি ঠায় দাঁড়িয়ে হাওয়ায় শির দোলাচ্ছে।

পায়ে পায়ে গাছটির দিকে চলতে শুরু করে। কি ভেবে কেন এগুচ্ছে তা সে জানে না।

আসল আকর্ষণ ঝেড়ে ফেলে দিয়েও, গাছটির আহ্বান সে অস্বীকার করতে পারল না। বুকের হু হু করা ভাব ক্ষণিকের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। উপলব্ধি করে জিৎ।

শিমুল গাছের নীচে এসে জিৎ সিং ওপর দিকে চায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না সে। বুকের ভেতর থেকে একটা ডেলাপাকানো কিছু গলা পর্যন্ত উঠে আসে।

তারপর গাছের গায়ে হাত রেখে কেঁদে ফেলে। দুচোখ ছাপিয়ে গণ্ড বেয়ে জল নেমে আসে।

যার জন্যে এই গাছটি তার কাছে এত প্রিয় সে-ই আজ জীবন থেকে সরে যেতে বসেছে। অথচ গাছটিকে তো তেমনিই প্রিয় বলে মনে হচ্ছে। তেমনি আপনার কাছের জন।

কেন এমন হল? এর মধ্যেই কি লীলাবতী তার জীবনে অতীতের বিষয় হয়ে উঠল?

এর মধ্যেই কি লীলার ভালোবাসা স্মৃতির মণিকোঠায় স্থান নিতে শুরু করল? হয়ে উঠলো অতীত জীবনের ঘটনা? স্বপ্নে দেখা কোনো স্মৃতির মতো—যা আর কখনোই ফিরে আসবে না।

নইলে তার স্মৃতিবিজড়িত এই শিমুল গাছের আকর্ষণ কেন সে অবহেলা ক’রে চলে যেতে পারল না আজ? স্মৃতি তাকে দুর্বার আকর্ষণে টেনে নিয়ে এলো এখানে।

চোখের জল মুছে ফেলে গাছটিকে মনে মনে সম্বোধন ক’রে বলে জিৎ—তোমার আহ্বানে আমি এসেছি, তুমি আমায় চেয়েছ বলে। আমাকে তুমি বিদায় করতে চাওনি। আমার কার্যাবলীর কৈফিয়তও চাওনি। আমার ভালোমন্দ, আমার দোষ গুণ সব সমেত গোটা আমাকে তুমি চেয়েছ। তবু একটি কথা শুধাই তোমায় আজ। এতদিন ধরে তো আমায় দেখলে আমার কথা শুনলে, আমার দ্বারা কোনো হীন কাজ করা কি সম্ভব বলে তুমি মনে কর? বল। জবাব দাও। চুপ ক’রে থেকো না। আমায় সত্যিই যদি তুমি ভালোবাস তবে নিশ্চয়ই তুমি বলতে পারবে। আমি তো চোখ বুজে বলে দিতে পারি, লীলাবতী কখনো হীন কাজ করতে পারে না। সমস্ত ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে সে।

কিন্তু সে তো এভাবে বলতে পারল না। সে কেন আমায় ফেলে আমার কাজটিকেই প্রাধান্য দিল?

সে কেন সন্দেহ প্রকাশ করল? সন্দেহ প্রকাশ বৈ কি। আমার বুকে তো অনেক মাথা রেখেছে সে। আমার রক্ত চলাচলের শব্দ শুনেছে অনেক।

হৃৎপিণ্ডের উত্থান-পতন অনুভব করেছে কতবার। তবু কেন সে অমন শক্ত হয়ে গেল?

জবাব দাও। ওর হয়ে তুমিই জবাব দাও।

গাছের কাছ থেকে জবাব এল না। পরিবর্তে আর একটি তুলো ঝরে পড়ল জিৎ-এর মাথার ওপর। তারপর হাওয়ায় দুলে দুলে একসময় পেছনে ঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

গাছের নিঃশব্দ বিদায়-স্পর্শ অভিভূত আত্মমগ্ন জিৎ কিছুই বুঝতে পারল না। কিছুই টের পেল না।

গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে জিৎ বারবার বলতে লাগল, তুমি তাকে বুঝিয়ে বলো—তার ভুল ভাঙিয়ে দিও। বলো, তার জিৎ যা অন্যায়, যা ঠিক নয়, এমন কাজ কখনো করতে পারে না। জিৎ যে কাজের সঙ্কল্প গ্রহণ করেছে তা তার জাতির তার দেশের বৃহত্তর ভবিষ্যৎ মঙ্গলের কথা ভেবেই করেছে। যারা একাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবে তারা তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন করবে। লীলা যেন মনে কোনো দ্বিধা না রাখে।

লীলা অত সহজে কেন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে? তাহলে এতদিন সে খুঁজে পেল জিতের মধ্যে? জিৎ যা করবে তা সঙ্গত জেনেই করবে এ বিশ্বাস কেন সে রাখতে পারছে না? আগ্রায় যাবার সঙ্কল্প ত্যাগ করে মেবারে থেকে গেলে—নিজেদের ব্যক্তিগত মনোবাসনাই কি চরিতার্থ হবে? না তাতেও লীলা সুখী হতে পারবে না। যখন সে দেখবে, জিৎ নিজের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের ওপর স্থান নিয়ে সুখে দিন যাপনের আয়োজনে মেতেছে তখন সে আরও বেশি ঘৃণা করবে। আরও অশান্তি বাড়বে তার।

কাছে থেকে এক দুঃসহ ব্যবধান রচিত হবে দুজনের মধ্যে। সে জীবন বড় অভিশপ্ত বড় মর্মঘাতী হবে।

দুজনার কারুরই সেই জীবন কাম্য নয়। পেয়েও কাউকে পাওয়া হবে না। পেয়েও না-পাওয়ার বেদনা বড় মর্মান্তিক।

গাছের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে আবারও চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো জিৎ সিং-এর। ঝাপসা হয়ে গেল সামনের সব কিছু। শিমুল গাছটিও।

কিছুতেই সে নিজেকে সংবরণ করতে পারছে না।

এই আঘাত এই মর্মযন্ত্রণা কাকে কি করে সে জানাবে? বোঝাবে?

জিতের একবার ইচ্ছা হল এই নিঃশব্দ চরাচর বিদীর্ণ করে চিৎকার করে ওঠে। লীলাকে বোঝাতে না পারা কথাগুলো সোচ্চারে সকলকে জানিয়ে দেয়। তবে যদি বুকটা হাল্কা হয়।

কিন্তু জিৎ চিৎকার করতে পারল না।

কেবল গাছের গায়ে তার হস্ত সঞ্চালন দ্রুততর হল।

ঠোঁট দংশন করে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ আরও দাঁড়িয়ে থাকল স্থাণুর মতো।

একসময় আবার জিৎ মাথা তুলল। তাকাল গাছের প্রসারিত ডালপালার দিকে।

তার চোখের নীরব আকুতি যেন সে নিঃশব্দে আরও একবার জানাতে চাইল প্রিয় স্মৃতিবিজড়িত এই শিমুল গাছকে।

.

বিশেষ অনুসন্ধান বা প্রতীক্ষায় সময় ব্যয় করতে হয়নি। প্রাসাদে পৌঁছে কিকার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জিৎ সিং।

—কি খবর জিৎ, তুমি এসময়ে?

—আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম।

—যশোবন্ত পাঠিয়েছে?

—না কিকা, আমি নিজেই এসেছি।

—নিশ্চয়ই কিছু বলবে?

—হ্যাঁ।

কিকা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি চিন্তা করে। তারপর বলে, তোমার বক্তব্য বলতে পার।

—সবার আগে আমার একটা কথা জানবার আছে কিকা।

—বল।

—ব্যক্তিগত সুখশান্তি বড় না দেশের স্বার্থ বড়?

—একথা জিজ্ঞেস করছ কেন জিৎ?

—আমার কথার উত্তর দিন কিকা।

—জিৎ, আমরা রাজপুত। আমরা কখনোই নিজের স্বার্থ বড় করে দেখি না। কোনো দেশপ্রেমী-মানুষই দেখেন না। দেশ ও জাতির কল্যাণে রাজপুতদের জীবন উৎসর্গীকৃত।

—তাহলে দেশের স্বার্থই বড় বলুন।

—নিশ্চয়ই। দেশ মায়ের মতো। মায়ের জন্য সন্তান হাসিমুখে নিজের জীবন উৎসর্গ করে।

—আমিই জানতাম কিকা। তাই আমি আগ্রা যেতে মনস্থ করেছি। আগ্রাই হবে আমার কর্মস্থল।

—আগ্রা? সে তো মুঘলদের স্থান। আর মুঘলরা আমাদের মিত্র নয়। তুমি তা ভালো করেই জানো।

—জানি।

—তাহলে তুমি হঠাৎ আগ্রা যাবার সঙ্কল্প করলে কেন? আমাদের কারুর মাথায় তো এমন চিন্তা আসেনি।

—হঠাৎ নয় কিকা। দীর্ঘদিন ভেবে ভেবে আমি শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। এ আমার পবিত্র সঙ্কল্প।

—যশোবন্ত তোমার সঙ্কল্পের কথা জানে?

—জানেন।

—সে কিছু বলেনি?

—বিরূপ মতামত জানতে পারিনি।

—কিন্তু কি উদ্দেশে তুমি সেখানে যেতে চাও? তোমার উদ্দেশ্য বা কর্মপন্থা স্থির করেছ নিশ্চয় কিছু।

—উদ্দেশ্য একটাই কিকা। আর সে উদ্দেশ্য নিশ্চয় আপনি অনুমান করতে পারছেন।

কিকা বিস্ময়ে অনেকক্ষণ তার দিকে চেয়ে থাকেন। কোনো কথা বলেন না। নিঃশব্দে কিছু ভাবতে থাকেন।

জিৎ সিং-এর বুকের ভেতরে তোলপাড় করে। তবে কি কিকাও লীলাবতীর মতো তাকে নিরাশ করবেন? তাকে ভুল ব্যাখ্যা করবেন?

একসময়ে কিকা মুখ খোলেন। জিৎ সিং-এর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন,–জানো জিৎ, আজ মেবারের যা অবস্থা—কোনো দিকে আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে বড় শঙ্কা দেখা দেয়, রাজপুত জাতি কি ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে? আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না? তখুনি আবার দেহের রাজপুত রক্ত ঝনঝনিয়ে যেন বিদ্রোহ করে ওঠে। বুকের মাঝখানটায় টগবগ করে ফোটে। কিন্তু আবার হতাশায় মুষড়ে পড়ি—অবলম্বন করবার মতো কোনোদিকে কিছু দেখতে পাই না বলে। তোমার কথা শুনে আজ যেন নতুন করে উন্মাদনা পাচ্ছি। ভাবনা পাল্টাতে শুরু করছে ইতিমধ্যেই। হয়তো অদৃষ্টদেবতা মুখ তুলে চাইবেন।

কথাকটি বলতে বলতে কিকা কেমন তন্ময় হয়ে পড়েন। শেষে গম্ভীরভাবে তিনি শুধু বলেন, —চল, আমার অস্ত্রাগারে চল। সেখানেই কথা হবে।

অস্ত্রাগারে পৌঁছে তাকে একটি আসন দেখিয়ে দিয়ে বসতে বলেন।

নিজেও বসেন তার সামনে। জিৎ লক্ষ্য করে কিকার মুখ অস্বাভাবিক গাম্ভীর্য লাভ করেছে।

গভীর চিন্তার ছায়া পড়েছে মুখে। কি ভাবছেন কিকা, কিভাবে গ্রহণ করেছেন তিনি প্রসঙ্গটিকে। জিৎ মনের গভীরে তোলপাড় করেও কোনো অনুমান করে উঠতে পারে না।

সে বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে ধরে থাকে কিকার মুখের দিকে।

তারপর চিন্তিতভাবে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করেন,—কবে থেকে তুমি এসব ঠিক করেছ জিৎ?

আশ্চর্য কোমল শোনায় কিকার কণ্ঠস্বর। কোনো উদ্বেগ, বিদ্রুপ বা শ্লেষের ছোঁয়া খুঁজে পায় না জিৎ কিকার কণ্ঠস্বরে।

—বাবার মৃত্যুর দিন থেকে। বলতে পারেন চিতোরের যেদিন পতন হয় সেদিন থেকে।

—আশ্চর্য!

—বাবা আমার মনের মধ্যে এর বীজ বপন করে দেন। নতুন এক পথের সন্ধান তাঁর কাছেই আমি লাভ করি।

উৎসুক কিকা বলেন,—কি রকম?

—তিনি আমাকে তাঁর তলোয়ারখানি দিলে, আমি প্রতিশোধ নেব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন—শুধু অস্ত্র দিয়ে প্রতিশোধ নেবার দিন আর নেই। মানুষ বড় কুটিল হয়ে পড়েছে। অস্ত্রের চেয়ে এখন বুদ্ধিকে বেশি কাজে লাগায়। সেদিনের পর থেকে আমি শুধু ভাবছি। বুদ্ধিকে কাজে লাগাবার কোনো উপায় খুঁজে পাইনি এতদিন। তবে এটুকু আমি জানতাম, রাজপুত বীরের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে অসির দাপট আমি দেখাব না। আমি এও জানতাম, মেবারে বসে থেকে বুদ্ধিকে কাজে লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কাজের বৃহত্তর ক্ষেত্র নির্বাচন করা দরকার।

—আগ্রায় যাওয়া কবে স্থির করলে?

—আজই। ভাবছিলাম। রাম সিং-এর কথা। সে আগ্রায় গেছে। আমাদের দলের শংকরীকে হত্যা ক’রে সে আগ্রায় পালিয়েছে। তাকে শাস্তি দেবার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে আমার। সেই কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আলো দেখতে পেলাম আমি। কাজের আহ্বান শুনতে পেলাম।

—হুঁ।

—এর চাইতেও অনেক ভালো উপায় হয়তো রয়েছে। কিন্তু সে সব আমার অজ্ঞাত। আমি এই পথেই চেষ্টা করতে চাই। রাজপুত কোনো দিক থেকেই হীনবল নয় সেটা প্রমাণ করতে চাই।

—তুমি যে-কাজ করতে যাচ্ছ, তা সাধারণ কাজ নয় জিৎ। লোকে একে কি আখ্যা দেয় জান কি?

—জানি। সব চাইতে ঘৃণ্য ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে একে বলা হয় গুপ্তচরবৃত্তি। আর এও জানি গুপ্তচরকে লোকে ঘৃণা করে, বিশ্বাসের অযোগ্য মনে করে।

—কে বলল তোমাকে?

—গুপ্তচরবৃত্ত কথাটি আমিও জানতাম। তবে আমার এই কাজই যে তাই সেই খেয়াল আমার হয়নি। আর একজন অনুগ্রহ ক’রে আমায় বলে দিয়েছে। তার বলাটা কতটা সঠিক জানি না। তবে বুঝতে পেরেছি সে আমায় ঘৃণা করতে শুরু করেছে।

—কে বলে দিয়েছে? যশোবন্ত?

জিৎ সিং-এর গলা কেঁপে ওঠে।

ধীরে ধীরে তার চোখ নত হয়ে আসে মাটির দিকে, বলে,—না। একটি মেয়ে।

—মেয়ে? কে সে?

যেন চমকে উঠে বলেন কিকা।

বিস্ময় ও কৌতূহল ফুটে ওঠে তাঁর কণ্ঠস্বরে।

—লীলাবতী।

—সর্দার গোপাল সিং-এর মেয়ে? তার কথাই বলছিলে যে সে তোমায় ঘৃণা করে?

—হ্যাঁ।

—তুমি খুবই কষ্ট পেয়েছ শুনে মনে হচ্ছে। তার পরমুহূর্তে থেমে বলেন, অবশ্য দুঃখ পাবারই কথা। নিকটজন ভুল বুঝলে তার চাইতে দুঃখের আর কিছুই থাকে না।

জিৎ সিং-এর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

কোনোমতে বলে,—হ্যাঁ কিকা। কারও সমর্থন না পেলেও, আমার স্থির বিশ্বাস ছিল, অস্তত দুজনার কাছ থেকে আমি ভরসা পাব, প্রেরণা পাব। একজন আপনি, অপরজন লীলাবতী। কিন্তু তা হল না। লীলাবতী এ কাজকে ঘৃণা করে। তাই একবার যদি আমি এপথে নামি, আমাকেও সে শ্রদ্ধা করতে পারবে না আর। যদিও সে আমাকে আপনার মতোই ঘনিষ্ঠভাবে চেনে, আপনার চেয়েও বেশি চেনে।

কিকা জিৎ সিং-এর চোখের জলের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলেন,– তুমি বুদ্ধিমান, তুমি বীর। তবু তুমি ছেলেমানুষ রয়েছ এখনো। তাই কাঁদছ। তোমার ভয় নেই জিৎ। লীলাবতী মুখে যে কথাই বলুক, তুমি ফিরে এলে সে তোমায় অসম্মান করতে পারবে না। একদিন নিশ্চয় তার ভুল ভাঙবে। বুঝতে পারবে তার ধারণা ঠিক নয়।

—আপনি ওকে চেনেন না কিকা। বড় শক্ত প্রকৃতির মেয়ে। একবার যা ভাবে সহজে তা মন থেকে সরায় না।

—আমি চিনি বলেই বলছি। তোমার কথা শুনে বুঝলাম সে তোমাকে ভালোবাসে। যদি তার ভালোবাসা সত্যি হয়, তবে সে তোমাকে শ্রদ্ধা না ক’রে পারবে না। শোন জিৎ, মেয়েদের সংস্কার পুরুষের সংস্কারের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল। তাই পুরুষ একটা নতুন কিছু করতে গেলে ওরা বাধা দেয়, ভীষণভাবে বাধা দেয়। কিন্তু যখন দেখে, সেই পুরুষই সবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ক’রে সফলকাম হয়ে ফিরে এল তখন ওরাই সব চাইতে আগে এসে অভ্যর্থনা জানায়, আত্মসমর্পণ করে। তুমি হতাশ হয়ো না জিৎ। লীলার সম্পর্কে তোমার মনোকষ্ট থাকবে না, তুমি এ নিয়ে কষ্ট পেয়ো না।

—লীলাবতী সম্পূর্ণ অন্য ধাতুতে গড়া। ভীষণ শক্ত, ভীষণ জেদী মেয়ে। আমি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ও হয়তো নিজেকে ধ্বংস করবার জন্যে উঠে পড়ে লাগবে। আমি চলে গেলে ওর জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে কিকা। ও আমাকেই অবলম্বন করতে চেয়েছিল।

কিকা বুঝতে পারেন জিৎ সিং ছেলেমানুষের মতো কাঁদলেও, তার কথাগুলো ছেলেমানুষের মতো নয়। অনেক চিন্তাভাবনার ফল।

গভীর চিন্তা না করলে কেউ এভাবে বলতে পারে না।

নিঃশব্দে কিছুক্ষণ জিৎ-এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিকা।

কী বলে তাকে শান্ত করবেন যেন বুঝতে পারেন না।

তারপর এক সময় বলেন—তবে কেন যাচ্ছ জিৎ? অনিশ্চয়তার মধ্যে না হয় যেও না।

—আমি যাবো কিকা। লীলাবতী যাই ভাবুক আমার সংকল্প থেকে আমি বিচ্যুত হব না। আপনি আমায় বাধা দেবেন না তো?

—না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জিৎ বলে,—আমি জানতাম। আপনিও যদি বাধা দিতেন, তবে হয়তো আমার যাওয়া হত না। হয়তো আমাকে নতুন করে ভাবতে হত। আপনি আমাকে বাঁচালেন কিকা।

কিকার দৃষ্টি এতক্ষণ জিৎ-এর মুখের ওপর ছিল।

ধীরে ধীরে দৃষ্টি তাঁর উদাস হয়ে এলো।

বাইরের দিকে তাকালেন নীরবে।

যেন ভাবনার অতলে তলিয়ে গেলেন সুদূর কোনো ভবিষ্যতের পানে চেয়ে।

যেন তিনি দেখতে চেষ্টা করছেন নতুন ভূমিকায় জিৎ-এর কার্যকলাপ। তারপর বললেন এক সময় তেমনি বাইরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে,—ওখানে গিয়ে তোমার কার্যধারা কেমন হবে?

—সব চাইতে প্রথম আমি দেখব, মেবারের ওপর নতুন কোনো আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে কি না। যদি সেরকম আক্রমণের তোড়জোড় চলে আমি বাধা দেবার চেষ্টা করব। কারণ এর মধ্যে আর একবার যদি মুঘল বাহিনী এদিকে চালিত হয়, তবে মেবারের ধ্বংস অনিবার্য। আমি দেখব, যাতে প্রস্তুত হবার যথেষ্ট সময় পান আপনি। আত্মরক্ষার এবং প্রতি আক্রমণের।

কথাটা শুনেই যেন চমকে উঠলেন কিকা

মুহূর্তে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন জিৎ-এর মুখের দিকে।

—আমি? আমি কে? কে আমার কথা শুনবে? আমি যে-দলকে তোমাদের সাহায্যে গড়ে তুলছি, বড় আক্রমণের বিরুদ্ধে সে-দল দাঁড়াতে পারে না। তারা ছোটখাটো আক্রমণের দ্বারা শত্রুকে কিছুটা হয়রান করতে পারে। তবে মনে মনে আমার আশা চিতোর উদ্ধার আমি করবই। চিতোর পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখি রোজ। সেটাই আমার ধ্যানজ্ঞান সাধনা। যতই না কেন ত্যাগ স্বীকার করতে হোক তার জন্য আমি সদ্য প্রস্তুত।

—আমি ওদিকে যদি চেষ্টা করি, যথা সময়ে সঠিক খবরাখবর পাঠাতে পারি তাহলে রানা প্রস্তুত হবার সময় পাবেন। আপনি তাঁকে সেই পরামর্শ দিতে পারবেন। যৌথ উদ্যোগে কাজ অধিকার দৃঢ় হবে।

—রানা? তোমায় একটি সত্যি কথা বলি শোনো। তুমি চলে যাবে এখান থেকে, তাই বলছি। রানা কোনোদিনও নতুন শক্তি অর্জনের চেষ্টা করবেন না। রানা আমার পিতা হলেও তোমাকে অন্তত বলতে বাধা নেই যে, তিনি সেই প্রকৃতির মানুষ নন। তিনি যুদ্ধকে ভয় পান। তিনি চান শান্তি। সেই শান্তি যে-কোনো মূল্য দিয়ে অর্জন করার জন্যে তিনি প্রস্তুত। রাজপুত জাতির গৌরবের কথা এখন আর তাঁকে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

জিৎ সিং বিস্মিত হয় কিকার কথা শুনে।

তার নিজেরও লজ্জা হয়। কিকা এ ভাবে রানার সমালোচনা করবেন তা সে ভাবতে পারেনি।

খানিকক্ষণ তার মুখে কথা জোগায় না।

নির্বাক তাকিয়ে থাকে কিকার থমথমে মুখের দিকে।

একসময় সে কোনোমতে বলে,—রানাকে বড় বেশি ছোট করে ফেললেন আপনি। আমি মেনে নিতে পারছি না।

—না। খুব ছোট করিনি। আরও ছোট করা যায় তাঁকে। মেবারের কেউ জানে না, এমন কথাও আজ তোমায় বলব জিৎ! তুমি অজিত সিং-এর পুত্র। তাছাড়া তুমি বিপদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছ মেবারকে ভালোবেসে। সত্যি ঘটনা তোমার জানা দরকার। নইলে পরে হতাশা তোমার মনকে ছেয়ে ফেলবে। শের শাহের নাম শুনেছ জিৎ? আকবর শাহের পিতা হুমায়ুনকে যিনি বিতাড়িত করে মসনদ অধিকার করেছিলেন? নিজের বীর্যবলে ভারতের ভাগ্যবিধাতা হয়েছিলেন?

—হ্যাঁ। তাঁর নাম শুনেছি বৈ কি। তিনি বীর ছিলেন। তাঁর কর্মধারা যথার্থ বীরের আদর্শ হয়ে আছে।

—বুদ্ধিমানও ছিলেন। তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী ছিলেন তিনি। সেই শের শাহ্ চিতোরের দিকে আসতে চেয়েছিলেন, দখল করবার জন্যে। সেকথা শুনেই আমার পিতা একজন সেনাপতিকে পাঠিয়ে ছিলেন শের শাহের কাছে। সঙ্গে দিয়েছিলেন চিতোর দুর্গের চাবি। কোনো বাধা নয় প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধও নয় নিঃশব্দ আত্মসমৰ্পণ।

এতসব কথা জানতো না জিৎ।

কিকার মুখ থেকে শুনে তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না।

ভাবে, কী করে একজন রাজপুতের পক্ষে এ সম্ভব হতে পারে?

কিকার মুখ থেকে না শুনলে সে একথা কখনো বিশ্বাস করতো না।

তবু দ্বিধা-জড়িত স্বরে বলে—সত্যি কিকা!

—হ্যাঁ সত্যি। যেকোনো বীর রাজপুতের মতো কথাটা তোমার অবিশ্বাস হচ্ছে বুঝতে পারি, কিন্তু কথাটা মনে রাখবে। আমি কিকা বলছি, যথার্থ সত্যি ঘটনা এটি। এটা আমার রানাকে সমালোচনা মাত্র নয়, আমার ক্ষোভ বেদনা যন্ত্রণার কথা এটি জিৎ। তুমি বীর, তুমি আমার যন্ত্রণা বুঝতে পারবে।

—তবে কেন চিতোর ছেড়ে চলে এলেন তিনি? চিতোরে বসে থেকে আগ্রায় আকবর শাহের কাছে পত্র পাঠালেই পারতেন? সহস্র সহস্র অধিবাসীর জীবন রক্ষা পেত তাহলে? আমার আর লীলাবতীর বাবাও রক্ষা পেতেন। আমরা অনাথ হয়ে যেতাম না এভাবে?

—যদি সর্দাররা প্রবলভাবে রুখে না দাঁড়াত, যদি আমরা বাধা না দিতাম, তাহলে তিনি পত্ৰই পাঠাতেন। আমরা তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে দিইনি। আমরা তাঁকে বরং পালিয়ে আসতে দিয়েছি। কারণ জানি, যতদিন মেবারের অন্তত স্বাধীনতা রয়েছে, ততদিন আমাদের আশা একেবারে নির্মূল হবে না। সৌভাগ্য-সূর্য উদয়ের সম্ভাবনা থাকবে।

—আমার আগ্রায় যাওয়া কি তবে সত্যিই ব্যর্থ হবে বলে মনে হয় আপনার? আমার চেষ্টা কোনো কাজেই লাগবে না?

—এত তাড়াতাড়ি সেকথা বলা শক্ত। তবে একবার যখন মনস্থির করেছ তুমি, চলে যাও জিৎ। আমি সর্দারদের দিয়ে রানাকে বোঝাতে চেষ্টা করব। তিনি যদি রাজি হন, তাহলে একবছরের মধ্যে মেবারের সৈন্যসংখ্যা আগের মতো করে তুলব। তুমি যাও জিৎ সিং। যতই আমি ভাবছি, ততই মনে হচ্ছে, তোমার মতো এমন নির্ভুল পথের আবিষ্কার আগে কোনো রাজপূত করেনি। করতে পারলে আজকের ইতিহাস অন্যরকম হতো। তুমি সংকল্পচ্যুত হয়ো না। সব অবস্থায় অবিচলিত থেকে তোমার কাজ শুরু করো গিয়ে।

জিৎ এবার আশ্বস্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আশ্চর্য এক পুলকানন্দে ভরে ওঠে মন। কিন্তু উচ্ছ্বসিত হয় না। তখুনি তার মনে পড়ে যায় প্রয়োজনের কথা।

একটি উপযুক্ত অশ্ব তার প্রয়োজন। বিদেশ বিভুঁইয়ে অশ্ব ছাড়া কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয়। তাছাড়া পথও অনেকটাই যেতে হবে তাকে। প্রয়োজনের কথা মনে পড়তেই সে কিকার দিকে মুখ তুলে তাকায়। একটি প্রত্যাশা পূরণ করেছেন কিকা। তাকে তার কাজে সমর্থন জানিয়েছেন। আর একটি প্রার্থনাও কি পূরণ করবেন না তিনি?

বলতে গিয়েও প্রথমে থমকে যায় জিৎ। বলতে পারে না। কিন্তু এই মুহূর্তে সঙ্কোচের প্রশ্ন ওঠে না। সঙ্কোচকে বড় করে দেখলে সে ভুল করবে।

জিৎ বুঝতে পারে সে এখন আর একা তার নিজের নয়। সে গোটা রাজপুত জাতির।

তার কাজের পরিণতি গোটা জাতির ভাগ্যের দিকে লক্ষ্য করে। জাতির স্বার্থে কিকার কাছে প্রয়োজনের কথা জানাতে তার দ্বিধান্বিত হওয়া উচিত নয়।

মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় জিৎ সিং। বলে—আমি কাল প্রত্যুষেই রওনা হব কিকা কিন্তু একটি জিনিসের প্রয়োজন হবে আমার।

মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন কিকা।

—নিঃসঙ্কোচে বল।

অনেক চেষ্টা করেও যেন দ্বিধা সঙ্কোচ সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতে পারে না জিৎ সিং।

—রানাকে বলে আমায় একটি ঘোড়া দিতে হবে।

—রানাকে বলতে হবে কেন? আমার নিজের ঘোড়াগুলো থেকে যে কোনো পছন্দ ক’রে তুমি নাও। আমি আনন্দের সঙ্গে দেব। তবে একটিকে ছাড়া। আগেই বলে নেওয়া ভালো।

—কোন্‌টি?

—চেতক। এখনো ঠিক বয়স্ক হয়নি সে। তাছাড়া ওর ওপর আমার বড্ড বেশি মায়া। ওকে পশু বলে ভাবতে পারি না আমি। জান জিৎ, আমার কথাবার্তা আকার ইঙ্গিত সবই বুঝতে পারে ও। মানুষের মতোই তার আচরণ আবার মানুষের মতোই তার মান অভিমান আব্দার। ভাবতেও আশ্চর্য লাগে আমার

চেতকের প্রসঙ্গে কিকার মুখ চোখে স্নেহের দীপ্তি ফুটে ওঠে। লক্ষ্য করে বিস্মিত হয় জিৎ। কিকা যেন মুহূর্তে অন্য মানুষ হয়ে ওঠেন। জিৎ কিকার স্নেহসিক্ত স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয় কিকা যেন আরও কিছু বলবেন। সে যেন কিকার আবেগ সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারছে না। নীরবে সে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিকা মুহূর্তে যেন পরিবেশ ও প্রসঙ্গ ভুলে যায়। আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠস্বর।

সেদিন এক কাণ্ডই করেছে চেতক। শুনলে তুমি বিস্মিত না হয়ে পারবে না জিৎ সিং। জিৎ সাগ্রহে তাকিয়ে থাকে তাঁর মুখের দিকে।

কিকা উচ্ছ্বসিতভাবে বলতে থাকে—কি কারণে অশ্বশালার পরিচালক বিরক্ত হয়েছিল। মন্তব্য করেছিল, ঘোড়াগুলোও নবাব হয়ে গেছে। এত তোয়াজ করেও কিছুতেই এগুলোর মন পাওয়া যায় না।

—চেতককে বলেছিল? সাগ্রহে জিজ্ঞেস করে জিৎ।

আগ্রাপথযাত্রী জিৎ এই ভিন্ন প্রসঙ্গে অবলীলায় অংশগ্রহণ করে। সামনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বাধা, গুরুতর কর্মভার, সব প্রসঙ্গ আশ্চর্যজনকভাবে ভুলে গিয়ে চেতকের প্রসঙ্গে এই মুহূর্তে মনোনিবেশ করে জিৎ।

—না চেতককে নয়। তবে চেতকের সামনেই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিল। ব্যস, দুপুর নাগাদ আমার কাছে খবর এলো, চেতক কিছু খাচ্ছে না। খাবার দিলেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেলাম। কোনো অসুখ বিসুখ কি না ভেবে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, দিব্যি আছে—দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখতে পেয়ে, তুমি বিশ্বাস করবে না, আগের মতো গলা বাড়িয়ে দিয়ে আদর চাইল না। মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াল। ওর স্বভাব অনেকটাই আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। তখুনি বুঝলাম কোনো কারণে অভিমান হয়েছে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অভিমান ভাঙাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল না। তখন পরিচারককে আড়ালে ডেকে এনে নানাভাবে জেরা করে জানতে পারলাম, অন্য ঘোড়ার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সে মন্তব্যগুলো করেছিল। তখুনি তাকে চেতকের সামনে ডেকে নিয়ে গেলাম। বললাম, তার এই উক্তির জন্য ক্ষমা চাইতে। সে বেচারা অমন কাণ্ড দেখেনি আগে। তবু আমার কথায় নাককান মূলে জোড়হাত করে চেতককে শুনিয়ে বারবার তার অমন উক্তির জন্য ক্ষমা চাইল। কখনো আর অসাবধানেও অমন কথা বলবে না প্রতিজ্ঞা করল। আমি চেতককে বললাম, হল তো, ও অপরাধ স্বীকার করেছে। আর রাগ করে থাকে না। এবার খাবার খেয়ে নাও। বলে ওর মুখের সামনে ঘাস ধরতেই আমার সামনে আগের মতো গলা নামিয়ে দিল। আদর করে ওর মুখে ঘাস গুঁজে দিলাম। বল, একে পশু ভাবতে ইচ্ছে করে? কোনো পশুকে এ ভাবে মানুষের কথা বুঝতে শুনেছো?

নিবিষ্ট মনে জিৎ কিকার কথা শুনে যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিল চেতকের জন্য গর্বে তিনি অভিভূত।

কিকার স্নেহকোমল হৃদয়ের এই দিকটির পরিচয় আগে কখনো পায়নি জিৎ।

সেও অভিভূত মনে করে নিজেকে।

তারও ভালো লাগল চেতকের প্রসঙ্গ।

ভাবলো এমন একটি সচেতন বাহক যদি সে কোনোক্রমে লাভ করত। যদি তারও আর একটি চেতক থাকত।

পরক্ষণেই মনে হল, এমন সাড়াপ্রবণ অশ্ব পেতে হলে অতিযত্নে তাকে তৈরি করে নিতে হয়।

কিকা নিষ্ঠা ও ভালোবাসা দিয়ে অশ্বের মধ্যে মানুষের সচেতনতা জাগ্রত করেছেন।

সে বলল—আশ্চর্য! কিন্তু আপনার ভালোবাসা ও স্নেহই চেতককে এতটা সজীব করে তুলেছে।

—তা নয় জিৎ। চেতক স্বতন্ত্র—সত্যিই স্বতন্ত্র। আগেও তো আমার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে অশ্ব পালন করেছি। কিন্তু এমনটি এই প্রথম দেখলাম। চেতককে আমি পশু ভাবতে পারি না।

তুমি চেতক ছাড়া পছন্দমতো অন্য যে কোনো অশ্ব নিতে পারো। আর একটি কথা—জিৎ সচকিত হয়ে তাকায় কিকার মুখের দিকে।

—আগ্রায় তোমার পরিচিত কেউ আছে? –না, তেমন কেউ নেই।

—তাহলে কোথায় উঠবে ঠিক করেছ?

—কিছুই ঠিক করিনি। ব্যবস্থা একটা নিশ্চয় করে নিতে পারব। গুছিয়ে উঠতে দু-একটা দিন নষ্ট হবে গোড়ার দিকে।

—অপরিচিত স্থানে এভাবে যাওয়াটা বোধহয় খুবই ঝুঁকির কাজ হয়ে যাচ্ছে জিৎ। বিশেষ করে তুমি যে কাজে যাচ্ছ। দু-একজন পরিচিত লোক থাকলে কাজের সুবিধে—

জিৎ সিং-এর আগে কথাটা এভাবে ভেবে দেখেনি।

আগ্রা যাবার উত্তেজনা, লীলাবতীর জন্য বেদনায় এসব ভেবে দেখবার সুযোগ পায়নি।

কিকার উদ্বেগ এই মুহূর্তে তার মধ্যেও সঞ্চারিত হল। সে বলল—কিন্তু তেমন কেউ তো আমার নেই।

—তুমি সত্যিই দুঃসাহসী জিৎ। মুঘলদের দুর্বলতার সন্ধান করতে যাচ্ছ—কিন্তু তাদের সঙ্গে মিশবার, তাদের কথা জানবার কোনো সুযোগ তোমার নেই। নতুনভাবে গিয়ে সবই তৈরি করে নিতে হবে। এক দুঃসাধ্য কঠিন কাজে তুমি নিজেকে জড়াতে যাচ্ছ।

জিৎ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।

কিকা আবার বলেন, মনে হচ্ছে আমি তোমায় এব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারব। আমার পরিচিত কয়েকজন লোক আগ্রায় ব্যবসা করে। খাঁটি রাজপুত। তবে ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমার নাম করলে তারা তোমায় সর্বপ্রকার সাহায্য করবে। ব্যবসার কাজে তারা প্রায়ই যাতায়াত করে এদিকে। জরুরী কোনো খবর থাকলে তুমি তাদের মাধ্যমে আমায় নিশ্চিন্তে পাঠাতেও পারবে। তারা কখনো বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না। আমার বিশ্বাস, তাদের সাহায্য পেলে তোমার কাজ সহজ হবে।

কিকা আগ্রায় পরিচিত ব্যবসায়ীদের নাম জানিয়ে দেন তাকে। কোথায় গেলে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে তাও জানিয়ে দেন।

জিৎ সিং খুশি হয় তাদের নামধাম পেয়ে। শেষে একসময়ে বিদায় নেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *