আরাবল্লী – ১০

১০.

তাই আজ শিমুলগাছের তলায় বসে আছে জিৎ সিং।

প্রতীক্ষা করছে যশোবন্তের।

সে এলে সব রহস্যের অবসান হবে।

দেবী নিজের মুখে কী এমন কথা বলে গেছেন যার ফলে যশোবন্তের মতো পুরুষের মাথা ও সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এই সব আকাশ-পাতাল চিন্তা করবার সময়েই জিৎ সিং-এর মনে হয় রাম সিং-এর কথা।

আগ্রায় গিয়েছে রাম সিং।

হয়তো জগমলের কথাই সত্য হবে।

রাম সিং আকবর শাহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে আর তারপর মুঘলসৈন্য এগিয়ে আসবে গিরো উপত্যকার দিকে।

হঠাৎ যেন আলো দেখতে পায় জিৎ সিং।

সে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়।

যশোবন্তের কথা ভুলে যায়। লীলার কথা ভুলে যায়।

ভুলে যায় সব কিছু।

সে তার পথের সন্ধান পেয়েছে।

তলোয়ারের পথ নয়, বুদ্ধির পথ।

রীতিমতো বুদ্ধি আর কৌশলের পথ।

সে আগ্রায় যাবে।

হ্যাঁ, আগ্রায় সে যাবেই। শুধু যাবে তাই নয়। সেখানে সে থাকবে।

একদিন দু’দিনের জন্যে নয়, বহু দিনের জন্যে থাকবে।

যতদিন তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হয়, ততদিনই থাকবে।

সে দেখে নেবে মুঘলদের যুদ্ধ কৌশল, সে জেনে নেবে আকবরের অভিসন্ধির কথা।

রানা তাতে আগে থাকতে প্রস্তুত হবার অবসর পাবেন।

লড়াই করবার শক্তি সঞ্চয় করতে পারবেন।

হ্যাঁ, সে যাবেই!

তার স্থান এখানে নয়। এখানে থেকে সে হয়তো দু’দশজনকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারবে, এখানে থেকে সে হয়তো মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে পাঁচদশজনকে হত্যা করতে পারবে।

কিন্তু তুচ্ছ এসব কাজ

তার চাইতে আগ্রায় বসে শত্রুদের সব কিছু জেনে নিতে পারলে অনেক সুবিধা হবে।

মেবারের অনেক বেশি উপকার হবে তাতে।

কিন্তু লীলা? লীলাবতী?

খুবই কষ্ট হবে তার জন্যে।

অথচ উপায় নেই।

নিজের কষ্ট নিজের দুঃখের কথা ভেবে দেশের মঙ্গল না চাওয়াকে বলে দেশদ্রোহিতা। নিজের সুখের দিকে চেয়ে দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিলে লীলাও কি তাকে ক্ষমা করবে? কখনই নয়।

সে সাধারণ মেয়ে নয়।

সে অন্য ধাতুতে গড়া এক অসামান্যা রমণী।

সে কষ্ট পাবে, জীবন তার ব্যর্থ হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তবু সে বিদায় দেবে।

এইখানেই লীলার বিশেষত্ব।

সে তার জন্যে অহরহ বসে ভাববে, কিন্তু ফিরে আসবার জন্যে অনুরোধ করবে না কখনো।

তারপর সত্যিই যদি কখনো ফিরে আসতে পারে সে, তখন লীলার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে নিজের ঘরে তুলবে।

সেখানে তাকে দেবীর আসনে বসাবে।

সেই সুখের দিন কত দূরে কে জানে?

জিৎ সিং লীলাবতীর কথা ভেবে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল বটে, কিন্তু তার উত্তেজনা কমল না।

সে শিমুলগাছের গোড়ায় অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল।

যশোবন্ত এসে একটু দূরে থমকে দাঁড়ায়।

জিৎ সিং-কে এভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে প্রথমে সে বিস্মিত হয়।

তারপর ভাবে, তার আসতে দেরি হবার জন্যে অমন অস্থির হয়ে উঠেছে।

কাছে এসে সে ডাকে,—জিৎ সিং।

—কে? ও সর্দার এসে গেছ?

—আমার দেরি হচ্ছিল বলে ছট্‌ফট্ করছ মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করে দেরি করিনি। লীলাবতী ছাড়তে চাইছিল না। তাকে ভুলিয়ে রেখে আসতে হয়েছে। তোমার সঙ্গে আমার যে আলোচনা হবে ওকে তা জানতে দিতে চাই না।

—আমি সেজন্যে অস্থির হইনি সর্দার

—তবে?

—আমি অন্য কথা ভাবছিলাম। এতদিনে আমি আমার কর্তব্য খুঁজে পেয়েছি।

—যাক্, এবারে তুমি সুস্থির হতে পারবে। কিন্তু কী সেই কর্তব্য আমায় বলবে কি?

—বলব। সব বলব। তার আগে তোমার কথা শুনে নিতে দাও। এমন কী দৈববাণী তুমি শুনেছ যা তোমার মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেও বিচলিত করেছে?

—বলতেই এসেছি। কিন্তু বলতে ইচ্ছে হয় না। হয়তো আমি যা শুনেছি, সবটাই ভুল। হয়তো আমি উদয়সাগরের তীর ধরে চলতে চলতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছিলাম। সেই সময়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় কোনো স্বপ্ন দেখেছি, আগাগোড়াই স্বপ্ন।

—স্বপ্ন হোক, সত্যি হোক, আমি শুনতে চাই। স্বপ্ন হলেও সে স্বপ্ন তোমার মনের শান্তি ভঙ্গ করেছে।

—হ্যাঁ, আমার মনের শান্তি ভঙ্গ করেছে। একথা তুমি ঠিকই বলেছ।

—অমন জিনিস চেপে রাখতে নেই সর্দার, তাতে অশান্তি আরও বাড়ে।

—কিন্তু যদি সত্যিই স্বপ্ন হয়? কেন তবে বলতে যাই? তোমারও মন খারাপ হয়ে যাবে শুনে। তার চেয়ে মনের জিনিস মনেই থাক। মনের মধ্যে থেকে থেকে একদিন আপনা হতেই পচে গলে নষ্ট হয়ে যাবে।

জিৎ সিং যশোবন্তের সেই সময়ের ইতস্তত ভাব, হেসে উড়িয়ে দিলে বলে,–কেন অমন করছ সর্দার? কোটা স্বপ্ন আর কোটা সত্যি তা কি তুমি জান না? স্বপ্ন আর সত্যির মধ্যে সীমারেখা কি তুমি ধরতে পার না? তবে কেন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছ? বলে ফেল।

জিৎ সিং-এর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে যশোবন্ত চাইতে পারে না।

সে বলে,–বেশ। শোন তবে। একটা কথা জেনে নিতে চাই বলবার আগে।

—কোন্ কথা?

—লীলাবতীকে কি তুমি সত্যিই ভালোবাস জিৎ সিং?

জিৎ সিং বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

তারপর ধীরে ধীরে যশোবন্তের চোখের দিকে চেয়ে বলে,–শেষে এই কথা জিজ্ঞাসা করলে আমাকে? এতদিনে এটুকু বুঝলে না?

—শোন জিৎ সিং। আমি জানি তুমি লীলাবতীকে ভালোবাস। তবু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

—মুখের কথায় আমি প্রকাশ করতে চাই না। যদি সম্ভব হতো মনটিকে তোমার সামনে মেলে ধরতাম।

—বুঝেছি। আচ্ছা, লীলাকে তোমার বিয়ে করতে আপত্তি আছে?

—আপত্তি? আমি শুধু সেই দিনটিরই স্বপ্ন দেখি সর্দার। সেইদিনে আমার জীবন হবে সার্থক। কবে আসবে সেদিন আমি জানি না।

—হুঁ। যশোবন্ত অনেকক্ষণ ঝিম ধরে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আবার বলে, হুঁ, এবারে শোন দৈববাণীর কথা।

একটু একটু ক’রে সে উদয়সাগরের তীরের ঘটনা বলতে শুরু করে।

সে বলে, চলতে চলতে কীভাবে তার চোখে আঁধার নেমে এল। দেবী এসে কীভাবে তার হাত ধরে ফেললেন।

কীভাবে তার মনের কথা—

এইটুকু বলেই সহসা থেমে যায় যশোবন্ত

কিছুটা দূরে লীলাকে দেখতে পাওয়া যায়। এইদিকেই আসছিল সে।

—এখন আর বলা হবে না জিৎ সিং।

—তাই দেখছি, কিন্তু এদিকে আসছে কেন হঠাৎ। ও তো জানে না, আমরা এখানে?

যশোবন্ত হেসে বলে,—আমি এখন লুকোই কোথায়? আমায় দেখতে পেলে তোমাকে ক্ষমা করবে না লীলা!

—তুমি পশ্চিমদিক দিয়ে চলে যাও।

—যাচ্ছি। যাবার আগে তোমার কথাটা শুনে যাই। তুমি কর্তব্য খুঁজে পেয়েছ বললে, কী সেই কর্তব্য জিৎ সিং?

—এখন সময় নেই সর্দার, তুমি পালাও! সর্দার হয়েছ বলে লীলাবতী তোমায় ছেড়ে দেবে না।

—তবু এক কথায় বল।

—আমার কাজ আগ্রায়। সেখানেই যাব আমি।

যশোবন্তের মুখের রক্ত অন্তর্হিত হয়।

সে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

পালিয়ে যাবার কথা সম্পূর্ণ ভুলে যায়।

—ওকি করছ সর্দার, পালাও শিগগির? তুমি কি চাও, লীলাবতী আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করুক? পালাও।

—হ্যাঁ যাই। শোন জিৎ সিং। দৈববাণী এর মধ্যেই ফলতে শুরু করেছে।

যশোবন্ত কোনোরকমে নিজেকে সোজা রেখে ঝোপের আড়ালে চলে যায়।

.

লীলাবতী জিৎকে একটুও আশা করেনি শিমুলগাছের নীচে।

সে ভেবেছিল জিৎ সিং গেছে প্রাসাদে।

শিমুলগাছের কাছে একা একা ওরা আসে না কখনো। এলে দুজনাই একসঙ্গে আসে। তাই অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা পাওয়ার আনন্দে মন তার নেচে ওঠা সত্ত্বেও অভিমান হয় লীলাবতীর।

—আমাকে ডেকে আনোনি যে?

—এখানে আসবার তো কথা ছিল না আমাদের দুজনার।

—তবে এলে কেন?

—তুমিও তো এসেছ লীলা। মনে হয়, ভগবান আমাদের এখানে এনেছেন আজ। লীলাবতী জিৎ সিং-এর মুখের দিকে চায়। সেই মুখের রেখায় আনন্দের চিহ্ন ফুটে উঠলেও, ভাবনার ছাপ ছিল।

—তুমি বোধহয় একা বসে কিছু ভাবছিলে জিৎ?

—হ্যাঁ লীলা। আমার ভাবনার কোনো কূল-কিনারা নেই।

—তুমি কত কিছুই ভাব, কিন্তু আমি তো ভাবতে পারি না। আমি বড় স্বার্থপর হয়ে পড়েছি, তাই না জিৎ?

—একথা বলছ কেন?

—আমি শুধু তোমার কথা ভাবি।

—আমিও তাই। আমি অনেক কিছুই ভাবি, কিন্তু সব ভাবনা একজনকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সব ভাবনার শক্তি একই জায়গা থেকে সঞ্চারিত হচ্ছে।

লীলার মুখ লজ্জায় খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

—লীলাবতী।

—বল জিৎ।

—চল লীলাবতী। আজ এখানে নয়, আজ আমরা উদয়সাগরের জলে সাঁতার দেব।

—সে কি! আমি কি এতদিন পরে সাঁতার দিতে পারব?

—পারবে। চল তো।

দুজনা উঠে দাঁড়ায়।

উঁচু নীচু জমি পার হয়ে অগ্রসর হয়।

জিৎ সিং বুঝে উঠতে পারে না কিভাবে সে তার কর্তব্যের কথা লীলাবতীকে জানাবে।

জানাবার সঙ্গে সঙ্গে যে ওই সুন্দর মুখখানা ম্লান হয়ে যাবে।

অনেকক্ষণ চলবার পর সহসা লীলাবতী প্রশ্ন ক’রে বসে,—অত কি ভাবছ জিৎ?

—কিছু না তো।

—নিশ্চয়ই কিছু ভাবছ। আমি এত কথা বলে চলেছি, তুমি শুনছ না। অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছ শুধু। তুমি কিছু ভাবছ জিৎ। আমায় বলছ না, আমার কাছে গোপন করছ।

—তোমার কাছে আমার গোপন করবার কিছু নেই।

—তবে মাঝে মাঝে অমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছ কেন?

—ভাবছি, এতদিনে বোধহয় আমার কাজে নামার সময় এল।

—কেন? মুঘলরা কি এদিকে আসছে?

—না।

—তবে?

—আমি যুদ্ধের কথা বলছি না লীলাবতী, অন্য কাজের কথা বলছি।

লীলাবতী ভাবে, কিকা হয়তো নতুন কোনো কাজের ভার দিয়েছেন জিৎকে, তাই কোনো রকম প্রশ্ন করে না সে।

ওরা এসে পৌঁছোয় উদয়সাগরের কিনারায়।

স্থানটি নির্জন।

আশে-পাশের গাছপালা জায়গাটিকে বাইরের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রেখেছে।

—এইটিই সব চাইতে ভালো জায়গা লীলাবতী। কেউ দেখতে পাবে না আমাদের দুজনাকে। লীলাবতী একটু হাসে, বলে,–একজন অন্তত পাবেন।

—কে?

—যশোবন্তকে যিনি দেখা দিয়েছিলেন, সেই দেবী।

এবারে জিৎ সিং-ও হাসে।

লীলার কথায় তার অশান্ত মন একটু স্বস্তি পায়।

—চল লীলা, জলে নামি।

এতক্ষণে লীলার মনে হয় যে বাড়তি পোশাক তারা কেউ সঙ্গে আনেনি।

বাড়তি পোশাক তাদের অনেকের নেই-ও বিশেষ।

যারা স্নান করে উদয়সাগরে, তারা এইভাবে আড়ালে আবডালে একা একা স্নান করে ঘরে ফেরে।

কিন্তু তারা একা নয়।

লীলার মনের কথা জিৎ সিং জানতে পারে।

সে কৌতুক অনুভব করে।

সে লীলার দিকে চায়, লীলাও তার দিকে চায়।

দুজনা একসঙ্গে প্রাণখোলা হাসি হেসে ওঠে।

লীলা জিৎ সিং-এর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,—তুমি একাই সাঁতার দাও বীরপুরুষ। আমি ডাঙায় বসে দেখি।

—আমারও তো একই অবস্থা।

—ইস্! তোমাদের আবার ভাবনা। ওগুলো খুলে রেখে নেমে পড়।

—আমাদের বুঝি লজ্জা থাকতে নেই?

—না, লজ্জা শুধু নারীরই ভূষণ। আর পুরুষের—

—থামলে কেন? বলে ফেল?

—আর পুরুষের কলঙ্ক। লজ্জা পুরুষের কলঙ্ক।

—ওসব কথা বলে আমাকে জলে নামাতে পারবে না।

লীলাবতী তার মুখে কৃত্রিম বিষণ্ণতার ছায়া টেনে এনে বলে,—তুমি আমায় হতাশ করলে জিৎ। আজ বুঝলাম, তেমন কোন বিপদ উপস্থিত হলে তুমি আমায় রক্ষা করতে পারবে না।

—কেন? একথা বললে কেন?

—ধর, এমন বিপদে পড়লাম আমি, যা থেকে রক্ষা করতে হলে তোমাকে সমস্ত পোশাক খুলে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তুমি পারবে না তা করতে, লজ্জা এসে বাধা দেবে। আমি সেই বিপদের মধ্যে অসহায় অবস্থায় ছটফট করব, তুমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে। শেষে এক সময়ে—

জিৎ সিং লীলাবতীকে বুকের মধ্যে টেনে এনে একহাতে তার মুখ চেপে ধরে বলে,—আর বলতে হবে না। তুমি ভালোভাবেই জান, তেমন বিপদে পড়লে উদ্ধার আমি করবই।

—বিশ্বাস কি? এই সামান্য ব্যাপারেই যখন এত দ্বিধা।

—বাঃ! সামান্য বলেই তো দ্বিধা।

—তবু তোমায় পরীক্ষা করতে চাই।

জিৎ সিং জানে, হয়তো এভাবে আর কখনো আনন্দ করতে পারবে না তারা দুজনে। করলেও, বহুদিন পর।

কারণ দু-একদিনের মধ্যেই সে রওনা হবে আগ্রায়।

মনস্থির করে ফেলেছে সে।

যাবার আগে শুধু একবার কিকার সঙ্গে দেখা করবে।

জেনে নেবে, আগ্রায় তাঁর জানাশোনা কোনো লোক রয়েছে কি না।

কারণ তেমন লোকের সন্ধান পেলে খবর আদান-প্রদানের সুবিধা হবে।

লীলার মুখের দিকে চায় সে।

সে মুখে মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে, সে মুখে কৌতূহলও ভেসে উঠেছে।

সে অপেক্ষা করছে।

—আমায় তুমি কোনো পরীক্ষাতে ব্যর্থ হতে দেখবে না লীলা।

—খুব যে গর্ব দেখছি।

—আমার গর্ব হবে না তো কার হবে? পৃথিবীতে কয়জনাকে লীলাবতীর মতো মেয়ে আসকারা দেয়?

—ও বুঝেছি।

—কি বুঝলে?

—তুমি আমাকে তোষামোদ করে ভোলাতে চাও।

—না না। ওকথা বলতে নেই লীলা। তোমাকে তোষামোদ করব কেন?

—আর কিছু শুনতে চাই না। নামো জলে।

জিৎ সিং সহসা লীলাবতীকে দুহাত দিয়ে তুলে নেয়।

এমনিভাবে, আর একদিন তুলে নিয়েছিল সে লীলাবতীকে।

সর্দার গোপাল সিং-এর মৃত্যুসংবাদ শুনে যেদিন সে ছুটেছিল চিতোরের দিকে।

সেদিন উভয়ের মধ্যে পরিচয় ছিল অতি সামান্য।

লীলাবতী কোনোরকম বাধা দেবার আগেই জিৎ সিং তাকে নিয়ে জলে নেমে পড়ে।

—একী করলে? এখন কি করব?

—সাঁতার দেবে। স্নান করবে। খেলা করবে।

—তার পরে?

—ওপরে উঠবে। ওড়না দিয়ে শুধু মাথার ওই রেমশীর মতো চুলগুলো মুছে নেবে।

—–গায়ের পোশাক?

—ওই যে সূর্য দেখছ লীলাবতী। ওই সূর্য আদিম কাল থেকে উঠছে। কত নদ নদী, এমন কি সাগর অবধি শুকিয়ে গেছে ওর তেজে। তোমার পোশাকও শুকোবে।

—তুমি ভীষণ—

—এসো এদিকে। সাঁতার দিয়ে এসো আমার কাছে।

—না।

—এসো লীলা, লক্ষ্মীটি।

লীলা এগিয়ে যায়।

আরো এগিয়ে যায়। দুজনা ভাসে উদয়সাগরের জলে।

মাথার ওপরে প্রখর সূর্য।

জলে তার প্রতিফলন। আশেপাশে সব নিস্তব্ধ।

কিছু দূরে কালপীর দলের ছোট ছোট ঘরগুলোর অধিকাংশ পুরুষই কাজে গেছে।

অস্থায়ীভাবে ঘর বাঁধলেও, কাজ করতে হয় তাদের। নইলে পেট ভরে না। যুদ্ধ চিরকাল থাকে না। চিরকাল বন্দুক উঁচিয়ে ধরে মানুষের বক্ষ ভেদ করা যায় না।

অনেকক্ষণ সাঁতার দেয় তারা।

জলের মধ্যে খেলা করে দুই তরুণ-তরুণী।

পরস্পর পরস্পরের কাছে যায় একবার, আবার দূরে সরে আসে।

আনন্দ আর উত্তেজনায় জগৎ-সংসার সব ভুলে যায়।

শেষে একসময়ে পরিশ্রান্ত হয় ওরা।

জল থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসে হাত ধরাধরি করে।

জিৎ সিং হাত দিয়ে নিজের পোশাক নিংড়ে জল বের ক’রে দেয় যতটা পারে।

তারপর লীলারতীর কাছে যায়।

তার পাশে বসে পড়ে জল বের করে দেয় তার পোশাক থেকে।

লীলাবতী আপত্তি না ক’রে বরং নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ছেড়ে দেয়।

তার শীত করছিল।

—তোমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে লীলা।

—এখন তো বেশ গরম পড়েছে। অথচ আজকের দিনটা একটু ঠাণ্ডা।

—কাল রাতে মেঘ ক’রে সামান্য বৃষ্টি হয়েছিল। মেঘ কেটে গিয়ে ঠাণ্ডা পড়েছে। তোমার কষ্ট হচ্ছে?

—না জিৎ।

—কিন্তু তুমি যে কাঁপছ? চল ঘরে যাই।

—এইভাবে?

—তাতে কি হল?

—ওরা কি ভাববে? না। আমি যাবো না জিৎ। তুমি আমার কাছে এসো। আরও কাছে, আরও।

জিৎ সিং লীলাবতীকে চেপে ধরে প্রাণপণে।

সে বলে,–তোমাকে এভাবে জলে নামানো উচিত হয়নি। আমার অন্যায় হয়েছে লীলা।

অর্ধশায়িত অবস্থায় লীলা চোখ মেলে বলে,–কোন অন্যায় হয়নি জিৎ। আমি জানতাম জলে আমি নামব।

—জানতে?

—জানব না? তবে এলাম কেন এখানে? ঘরে গিয়ে পোশাক আনতে গেলে সর্দার বাধা দিতো।

জিৎ সিং জানে যশোবন্ত কখনই বাধা দিত না।

কিন্তু সেকথা প্রকাশ করতে হলে শিমুলগাছের নীচে তাদের সাক্ষাতের কথাও বলে দিতে হয়।

—জিৎ।

—লীলা।

—কানে কানে একটা কথা শুনবে?

জিৎ মাথা নামায়। লীলা দুহাত দিয়ে তার গাল নিজের গালের সঙ্গে চেপে ধরে।

—বল।

—তোমার গাল বেশ গরম জিৎ। ভালো লাগছে।

—কি বল কানে কানে?

—শুনতে পাওনি?

—না তো?

—এ মা। সত্যি শুনতে পাওনি?

—না। – না।

লীলাবতী খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে বলে,—অনেক আগেই তো বলা হয়ে গেছে।

এবার জিৎ সিং বুঝতে পারে। সে নীরবে হাসে।

—এতক্ষণে হাসছ? জানো, তোমার ওপর আমার মাঝে মাঝে ভীষণ রাগ হয়।

–সত্যি? কেন আমি কি দোষ করেছি।

—জান না?

—না তো!

—ঠিক বলছ?

—ঠিক।

—থাক, তাহলে আর বলব না। ক্ষমা করে দিলাম।

—বাঃ, নিজের দোষ শুধরোতে হবে না? নইলে আবার তো রাগ করবে।

—না জেনে দোষ করলে অপরাধ হয় না।

—তবু। বলো না লক্ষ্মীটি। একটু শুনব।

—ইস কী আদর।

—বেশ, শুনতে চাই না তবে। আদরও করব না আর।

—করবে না?

—না।

—ঠিক বলছ?

—ঠিক ঠিক ঠিক

—তবে আমিও শাস্তি দেব।

—কী শাস্তি?

—বলব না।

—বলবে না?

—না।

—বলো লক্ষ্মীটি।

—কাছে এসো তবে।

—এই তো।

—আরও কাছে।

—এই তো।

—আরও—হ্যাঁ। এই শাস্তি—

জিৎ সিং হেসে বলে,—আমাকে যত খুশি শাস্তি দাও। সারাদিন সারারাত ধরে শাস্তি দাও লীলাবতী।

লীলাবতীর চোখে জল এসে যায় আচম্বিতে।

—একি চোখে জল তোমার?

লীলাবতী উঠে বসে বলে,—কি জানি। আমার সবচেয়ে সুখের সময় এমন জল আসে চোখে।

—আনন্দের?

—না, মনে হয় এত সুখ কি সত্যিই আমার ভাগ্যে আছে?

—ছি লীলাবতী। ওসব ভাবতে নেই।

—জানি। আমার মনে হয়, সব মেয়েরই অমন হয়। তুমি কিছু মনে করো না। ওঃ ভুলে গিয়েছি, তোমার অপরাধ কি জানো?

—কি?

—তুমি মাঝে মাঝে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাও। কেমন গম্ভীর হও। তখন তোমাকে চেনা যায় না। মনে হয় অন্য কেউ।

—সত্যি?

—হ্যাঁ।

—আর তুমি? তুমি গম্ভীর হয়ে থাকলে আমার ভীষণ ভয় হয়। কথা বলতে সাহস হয় না। লীলাবতী হেসে ওঠে।

এইভাবে কখনো হাসে তারা, কখনো অভিমান করে।

সময় কাটে এক অনাস্বাদিত আনন্দের মধ্যে।

শেষে এক সময়ে উভয়ের পোশাক শুকিয়ে যায়।

সূর্যের রশ্মি সামান্য একটু বাঁকা হয়ে পড়তে শুরু করে।

দুজনা দূরে সরে বসে।

—জিৎ।

—বল লীলা।

—কোনোদিন সাঁতার দেবার কথা তো মনেও হয়নি। আজ হঠাৎ এ খেয়াল হল কেন তোমার?

লীলাবতীর প্রশ্ন শুনে জিৎ-এর সব কথা মনে পড়ে যায়।

সে চেয়েছিল আগ্রায় চলে যাবার আগে দুজনা অনেকক্ষণ ধরে আনন্দ ক’রে নেবে।

অনেকক্ষণ ধরে সে লীলার মুখের মিষ্টি কথা শুনে নেবে। তার সান্নিধ্য উপভোগ ক’রে নেবে।

ডাঙায় দাঁড়িয়ে লোকচক্ষুর সামনে সে সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব হবে না বলেই উদয় সাগরের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার।

তাই সাঁতার দেবার খেয়াল হয়।

সে জানত লীলাবতী সাঁতার জানে। লীলাবতীই বলেছিল একদিন কথাপ্রসঙ্গে।

সাঁতার দিয়ে সে ঠকেনি। কতবার সে হাঁপিয়ে গিয়ে জিৎ সিং-এর কাঁধে মাথা রেখেছে।

আর প্রতিবারই তার স্পর্শ নতুনভাবে শিহরন জাগিয়েছে তার দেহে মনে। অনেক আনন্দ পেয়েছে সে আজ। আকণ্ঠ পান ক’রে নিয়েছে।

তবু সব আনন্দের মধ্যেই কোথায় যেন বাধা ছিল।

একটা কাঁটা বরাবরই তার হৃদয়ের অজ্ঞাত কোণে খচখচ ক’রে বিঁধে চলেছিল।

সে ভুলে গিয়েছিল আগ্রায় যাবার কথা। লীলাবতী তাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছিল।

এতক্ষণ পরে আবার সে-ই প্রশ্ন তুলে মনে করিয়ে দিল সেকথা

জিৎ সিং-এর বুক ফেটে যায়।

কত আনন্দ, কত আগ্রহ ওই সুন্দর চোখ-দুটিতে। কত স্বপ্ন-মাখানো ভবিষ্যতের কল্পনা।

অথচ এখনি এক রূঢ় আঘাতে সেই স্বপ্ন সেই কল্পনা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। এখনি বলে দিতে হবে লীলাবতীকে যে, বিদায় নেবার আগে একটু সুখ-স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যেই আজ সাঁতার দেবার কথা মনে হয়েছিল তার।

লীলা নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জিৎ সিং-এর মুখের পানে।

ওকে আর এইভাবে চেয়ে থাকতে দেওয়া যায় না। ও দৃষ্টি অসহ্য। ও দৃষ্টিতে জিৎ সিং-এর মনে অপরাধ-বোধ প্রবল হয়ে ওঠে।

সে শক্ত ক’রে লীলার হাত দুটো চেপে ধরে তার ওপর মাথা রাখে।

—অমন করছ কেন জিৎ? এত আনন্দ করলে, এত আনন্দ দিলে আমায়। তবে কেন অমন করছ? ঠিক আগের মতো একরাশ মেঘ যেন তোমার মুখখানাকে ঢেকে ফেলল। কি হয়েছে তোমার? বল। আমায় না বললে, আর কাকে বলবে?

—তোমায় বলব বলেই এখানে এসেছি লীলা।

—বল। তুমি ভাবছ, তোমার কথা শুনে আমার কষ্ট হবে? হোক। তোমার মন হাল্কা হবে।—বলো জিৎ।

জিৎ সিং তবু ভাবে।

শেষে বলে,—লীলা, আমি কাজে নামব স্থির করেছি।

—বেশ তো। আগে তোমায় বলেছিলাম, লজ্জা হল নারীর ভূষণ। তেমনি কর্ম যে পুরুষের ভূষণ জিৎ? যত কঠিনই হোক না কেন তোমাকে এগিয়ে যেতে দেখলে আমার বুক গর্বে আনন্দে ভরে উঠবে। আমি কি জানি না জিৎ, রাজপুতের কাজ কত বিপদসঙ্কুল। জিৎ, কালপীর নামটিই শুধু আমি জানি। আমি রাজপুত রমণী। প্রিয়তম ব্যক্তিকে হাসিমুখে বিদায় দিয়ে আমরা ঘরের কোণে ফুলে ফুলে কাঁদি। আমরা জান, যাকে বিদায় দিলাম, সে আর নাও ফিরে আসতে পারে। তবু অশ্রুজলে তার এগিয়ে যাবার পথ পিচ্ছিল ক’রে দিই না।

—তুমি অসামান্যা লীলাবতী। জানতাম তুমি অসামান্যা।

—আমি নই জিৎ। আমরা, রাজোয়ারার মেয়েরা।

—হ্যাঁ তোমরা। তবু তোমাদের মধ্যে তোমার তুলনা মেলা ভার। কিন্তু আমি যে সাধারণ মানুষ। হ্যাঁ সাধারণ, তাই তোমাকে সব কিছু খুলে বলতে এতটা প্রস্তুতির প্রয়োজন হল।

—বল জিৎ।

—লীলাবতী, আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় চাইব।

—বিদায়?

—হ্যাঁ লীলাবতী, আমায় যেতে হবে অনেক দূরে।

—বিদায় নেবে? অনেক দূরে যাবে? কবে ফিরবে জিৎ?

—বলতে পারি না।

—এক বছর?

—হ্যাঁ, আবার তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। আবার হয়তো নাও ফিরে আসতে পারি।

—বিপদের কথা আলাদা জিৎ।

—আমি যে কাজে যাচ্ছি, তাতে প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পদে বিপদ।

—তবে কি যুদ্ধে যাচ্ছ? রানা যুদ্ধযাত্রা করছেন?

—না, যুদ্ধের প্রশ্ন এখন কোনোরকমেই ওঠে না। মেবার আজ বীরশূন্য। সে শূন্যস্থান পূর্ণ করতে বীর-প্রসবা মেবারের বেশি সময় না লাগলেও এখন রানার পক্ষে যুদ্ধের কল্পনা করাও অসম্ভব। তাছাড়া যুদ্ধের বিপদ দু-চারদিনের। আর আমার কাজের বিপদ অনেক দীর্ঘ।

—কোন কাজে তুমি যাচ্ছ? রানা তোমায় কোথায় পাঠাচ্ছেন?

—রানা নন।

—তবে কিকা?

—না, কিকাও নন। আমি নিজে থেকেই যাচ্ছি। আমার এ-কাজের ভার, আমিই দিয়েছি আমাকে। অন্য কেউ নয়।

—জিৎ সিং আমাকে ভালো ক’রে সব বল, আমি বুঝতে পারছি না। আগে বল, কোথায় যাচ্ছ তুমি?

—আগ্রায়।

—কি বললে? আগ্রায়?

—হ্যাঁ লীলাবতী, আগ্রায় যাচ্ছি।

—তুমি আগ্রায় যাচ্ছ? সে তো মুঘলদের জায়গা। সেখানে কেন যাবে তুমি। সেখানে তোমার কি কাজ? ও বুঝেছি, তুমি রাম সিংকে খুঁজতে যাচ্ছ। প্রতিশোধ নিতে চাও।

—না, তুচ্ছ রাম সিংকে আমি প্রতিশোধ গ্রহণের যোগ্য ব্যক্তি বলে মনে করি না। শুধু তার জন্যে আমি কখনই আগ্রায় যেতাম না। অবশ্য সেখানে গিয়ে যদি ওর দেখা পাই, তবে উচিত শিক্ষা দিতে ছাড়ব না।

—কেন তুমি আগ্রায় যাচ্ছ তবে?

—মেবারের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। মুঘল সৈন্য যদি রানাকে আবার আক্রমণ করে, তার জন্যে তাঁকে প্রস্তুত রাখবার জন্যেই আমি যাচ্ছি।

—তুমি ওখানে গিয়ে আগে থেকে সব সংবাদ পাঠাবে?

—ঠিক তাই। তাছাড়া মুঘল সৈন্যদের দুর্বলতা কোথায়, সে খবরও জেনে নেব।

—কে তোমাকে সেই খবর দেবে? তুমি অচেনা মানুষ হয়ে কেমন ক’রে সেই খবর পাবে?

—চেনা হতে বেশি সময় লাগবে না লীলাবতী। আমি মুঘলদের একজন বন্ধুর মতো থাকব। ওদের সঙ্গে ঘুরব। প্রয়োজন হলে ওদের সৈন্যদলেও যোগ দেব। সংবাদ সংগ্রহের জন্যে সব কিছুই করব।

লীলাবতী এবার চিৎকার ক’রে ওঠে,—জিৎ সিং।

জিৎ সিং-এর বুক যেন কেঁপে ওঠে।

এই ভয়ই সে করছিল প্রথম থেকে। কোনোমতে বলে,—বল লীলাবতী।

রাগে দুঃখে আরক্ত মুখখানাকে তুলে ধরে তীব্রস্বরে লীলাবতী বলে,—তুমি গুপ্তচর হবে?

—আমায় ভুল বুঝো না লীলা। সাধারণ গুপ্তচর বলতে যা বোঝায়, এ ঠিক তা নয়। সাধারণ গুপ্তচরের মতো শুধু দু-একটি গোপন খবর বের করে আনতে আমি যাচ্ছি না। আমি ওখানে ওদের সঙ্গে মিশে অনেক কিছু জেনে নিতে চাই।

—আর বলতে হবে না আমায়। আর কিছু শুনতে চাই না। গুপ্তচরবৃত্তিকে সম্মানের আসনে তুলে ধরবার যত চেষ্টাই তুমি কর না কেন, কোনো লাভ হবে না। আমি সব বুঝতে পেরেছি। ছিঃ ছিঃ! তুমি না বীর অজিত সিং-এর পুত্র—যে অজিত সিং-এর অসিচালনায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে পড়ত। ছিঃ ছিঃ! জিৎ সিং, তুমি না রাজপুত? তোমার মনে এতখানি দৈন্য দেখা দেবে আমি কল্পনা করিনি!

এবারে জিৎ সিং-এর দ্বিধা ভাব কেটে যায়। সে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।

সোজা দৃষ্টিতে লীলাবতীর দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,–তোমার এ মনোভাব অসংগত নয় লীলা। কারণ তুমি রাজপুত কন্যা। রাজপুতদের ইতিহাস তোমার জানা। তুমি চারণ কবির গান শুনেছ। অনেক গান মুখস্থও রয়েছে তোমার। তোমার সংস্কার, তোমার ধারণা, এই সব ক্রিনিসকে অবলম্বন ক’রেই বেড়ে উঠেছে। তোমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

—দোষ দেবার মতো কোনো যুক্তি তুমি খুঁজে পাবে?

—পাবো! একটি নয়, অসংখ্য যুক্তি রয়েছে আমার। তুমি কি জান লীলাবতী আমার বাবা বীর অজিত সিং জীবনে অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন? তাঁর অভিজ্ঞতার মূল্য কি কম? সেই তিনিই জীবনের শেষ সময়ে উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু বীরত্ব দেখিয়ে, শুধু যুদ্ধ ক’রে দেশকে বাঁচানো যায় না। এর পেছনে অন্য জিনিসেরও বড় অভাব। এই অভাবের জন্যেই শ্রেষ্ঠ বীরদের জন্ম দিয়েও রাজোয়ারা নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। রাজপুতরা সারা ভারতে তার রাজ্যবিস্তার করতে পারেনি।

—কোন্ জিনিসের অভাব? গুপ্তচর বৃত্তির?

—তুমি যদি একে গুপ্তচর বৃত্তি বল বার বার, তবে আমি জোর গলাতেই বলব, হ্যাঁ, গুপ্তচরবৃত্তি। এই বৃত্তি আজই প্রথম নয়। আমাদের প্রাচীন ভারতবর্ষেও এর অস্তিত্ব ছিল। সুতরাং একে পা দিয়ে ঠেলে দেবার কোন চেষ্টা করো না। লীলাবতী, আদর্শে আশ্রয় করা ভালো, খুবই ভালো সন্দেহ নেই। কিন্তু আদর্শের নামে চোখ বন্ধ ক’রে থাকাতেও কোনো যুক্তি নেই। আদর্শের সঙ্গে যতদিন বাস্তবের যোগ থাকে, ততদিনই তার মূল্য। কিন্তু যেদিন সেই আদর্শ বাস্তব-সম্পর্কশূন্য হয়ে যায়, তখন তাকে আঁকড়ে থাকায় সর্বনাশ হয়। সেই সর্বনাশই আমাদের হয়েছে আজ।

—তুমি অনেক বড় বড় কথা বলছ জিৎ। এত সব আমি বুঝতে পারি না। কারণ বোঝবার চেষ্টা করিনি কখনো, ভাববারও চেষ্টা করিনি। আমার মনে হয় নিজের যুক্তিকে অকাট্য প্রমাণ করার জন্যেই তুমি মরিয়া হয়ে এসব কথা বলছ। আমি শুনে যাচ্ছি, তবে বিশ্বাস করছি না।

—তুমি হিংসাকে পুণ্য বলে মনে কর লীলাবতী?

—না। হিংসা কোনোদিনই পুণ্য নয়।

—ঠিক। কোনো ধর্মই হিংসাকে প্রশ্রয় দেয় না। তাই নয় কি?

—নিশ্চয়ই।

—তবে কেন যুদ্ধ করব আমরা? যুদ্ধ মানেই তো হিংসা। যুদ্ধ মানেই হত্যা। নরহত্যা। তবে কেন আমরা হাতে অস্ত্র তুলে নেব? তবে কেন শত্রুর বুকে আঘাত হানব? সে-ও তো মানুষ তারও ঘর-সংসার আছে। ঘরে স্ত্রী-পুত্র, মা-বাবা সবাই আছে।

—সে-হিংসাকে হিংসা বলা যায় না জিৎ। সে-হিংসা তুমি করছ দেশকে বাঁচাতে। দেশ-মায়ের মর্যাদা রক্ষা করতে হিংসা পাপ হতে পারে না।

—একথা তুমি স্বীকার করছ তবে? তুমি স্বীকার করছ, যাকে সাধারণত আমরা পাপ বলে জানি, দেশের খাতিরে, দেশের মঙ্গলের জন্যে তা পাপ নয়!

—হ্যাঁ জিৎ।

—তাহলে যাকে তুমি গুপ্তচরবৃত্তি বলছ, তাকেও কেন পাপ বলে ঘৃণ্য করছ? সে-ও যে মেবারের মঙ্গলের জন্যেই। আমি নিজের স্বার্থের জন্যে এ-কাজ করতে যাচ্ছি না। যুদ্ধে গেলে যে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, এতে তার চাইতেও বেশি বিপদের সম্ভাবনা।

—তবু একে আমি মহৎ কাজ বলে মানতে পারি না।

—কেন? কেন পার না লীলাবতী? মেবারের অন্য কোনো রমণী না মানলেও তুমি কেন মানবে না? তুমি তো সাধারণ নও।

—শোন জিৎ! যুদ্ধ করাটা প্রকারান্তরে হিংসা হলেও, সে হিংসার হিংস্রতা মনের ওপর কোনো ছাপ ফেলে না। বরং সেই হিংসা বুকের মধ্যে আনে এক আশ্চর্য ধর্মভাব। যে সুউচ্চ আদর্শ আমরা অনুসরণ ক’রে আসছি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, সেই আদর্শই এই ধর্মভাব আনতে সাহায্য করে আমাদের মনে। কিন্তু তুমি যে পথে চলতে চাইছ, সেই পথ তোমার মনে তেমন কোনো ভাব কখনই জাগাবে না।

—এ ধারণা কেন হল তোমার লীলাবতী?

—কেন হল? কারণ তুমি যে পথ নিতে যাচ্ছ, সে পথ লুকোচুরির পথ। সে পথ তীরের মতো সোজা নয়। উন্মুক্ত প্রান্তরে শত্রুর দিকে এগিয়ে গেলে বীরের হৃদয়ে যে উচ্চভাব জাগে তোমার পথে সে-ভাব জাগাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, অবসর নেই। কারণ তুমি শত্রুর অগোচরে তার দুর্বলতা জানতে চাইছ। তোমার পথ চৌর্য-বৃত্তির পথ।

এবারে জিৎ সিং কোনো কথা বলে না।

সে গম্ভীর হয়ে থাকে।

সে চিন্তায় ডুবে যায়।

উদয়সাগরের ওপারে সূর্য আরও খানিকটা হেলে পড়ে ততক্ষণে।

জিৎ সিং-এর চিন্তা দেখে লীলাবতীর চোখে আশার আলো ফুটে ওঠে।

সে তাড়াতাড়ি জিৎ-এর একটি হাত চেপে ধরে বলে,– তুমি যেও না জিৎ। ও পথে যেও না।

জিৎ সিং ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।

ভাবতে ভাবতে সে মাথা নাড়ে। শেষে বলে,—শোন লীলাবতী। তোমার কথার মধ্যে যথেষ্ট আবেগ আর বিশ্বাস রয়েছে। এই আবেগ আর বিশ্বাসের শক্তি খুবই প্রবল। কারণ একে সত্য বলে মনে হয়। আমারও তাই মনে হত।

লীলাবতী জিৎ সিং-এর হাত ছেড়ে দেয়।

দেহটাকে শক্ত ক’রে বলে,—তুমি আমার সব কথাকে মিথ্যে বলে ভাব তবে?

—না। মিথ্যা নয়। আবেগ আর বিশ্বাসের বশে মানুষ অনেক কীর্তিই ক’রে যেতে পারে! এর বলে মানুষ নিজের জীবনেও বিসর্জন দিতে পারে। এর বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ অনেক কাজ করতে পারে। কিন্তু এই জিনিস মানুষের দূরদৃষ্টিকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলে।

—তোমার কথা আমি বুঝছি না জিৎ সিং।

—আমার সব কথা বলা হয়ে গেলে হয়তো বুঝতে পারবে, কিংবা না-ও বুঝতে পার। কারণ কিভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে আমি নিজেও জানি না। তাছাড়া যে সব যুক্তি তুমি দেখালে আবেগ আর বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে, সে সব যুক্তি অসার হলেও তার ধার বড় কম নয় লীলাবতী। কারণ ওই যুক্তিগুলো বহু বছরের ঘষা মাজায় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। ওর সম্মোহিনী শক্তি সাধারণ, ওর বিপক্ষে আমি যে-সব যুক্তি খাড়া করব সে-সবের জন্ম নতুন। নতুন জিনিসকে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না, নির্ভর করতে পারে না। তাই আমার পক্ষে নীরব থাকাই বাঞ্ছনীয়।

—তুমি আগ্রায় যাবে জিৎ?

—হ্যাঁ লীলাবতী।

—না, যেও না।

—আমার যেতেই হবে। শোন লীলাবতী, সময়ের সঙ্গে যেমন অনেক জিনিসের পরিবর্তন হয়, আদর্শেরও তেমন পরিবর্তন হওয়া উচিত।

—কী বললে? তোমার কি মাথা খারাপ হল? আদর্শের পরিবর্তন? তুমি কি বলতে চাও, রামের পিতৃভক্তির আদর্শ বলে যাক? সীতার পতিভক্তি যে আদর্শ ধরে রেখেছে আমাদের সম্মুখে তা মুছে গিয়ে অন্য আদর্শ এসে দাঁড়াক? তুমি বলছ কি জিৎ? আদর্শ কখনো বদলায় না। আদর্শ চিরকালের।

জিৎ সিং আবার চিন্তার মধ্যে ডুবে যায়।

লীলাবতীর উত্তেজনা তাকে বিব্রত করতে পারে না।

সে জানে, লীলাবতী নারীর স্বাভাবিক হৃদয়-ধর্মের বশবর্তী হয়েই কথা বলে যাবে। তবু তাকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করতে হবে যে, কাজটাকে যতটা হীন বলে সে ভাবছে, অতটা হীন নয়।

হয়তো সে বুঝবে না শেষ পর্যন্ত।

তবু চেষ্টা তাকে করতেই হবে।

শান্ত স্বরে সে বলে,—আদর্শের পরিবর্তন বলতে তুমি যা বুঝেছ, ঠিক তা নয় লীলাবতী। পিতৃভক্তি বা পতিভক্তি চিরকালের আদর্শ। কিন্তু সেই ভক্তি প্রকাশের ভঙ্গিটি যুগের সঙ্গে পালটে যেতে পারে।

—না জিৎ। তা পারে না।

—আমার কিন্তু মনে হয়, পারে। এই যেমন ধর যুদ্ধের কথা। এমন দিন আসতে পারে যখন যুদ্ধটা সামনা-সামনি হবে না হয়তো। কিন্তু তখনো দেশপ্রেমের আদর্শ ঠিক এমনই উজ্জ্বল থাকবে।

—আমি তর্ক করব না জিৎ। তর্ক মনকে বড় তিক্ত ক’রে দেয়। চল, ঘরে চল। সেই সকালে খেয়েছ তুমি।

—তুমিও তো।

—হ্যাঁ।

—কিন্তু আমি যে তোমায় বুঝিয়ে দিতে পারলাম না এখনো।

এবারে লীলা দুঃখের হাসি হেসে বলে, –বুঝিয়ে দিতে পারব না জিৎ। যা হীন, তা চিরকালই হীন। যা মহৎ তা চিরকালই মহৎ। চল জিৎ।

—আচ্ছা লীলা, তোমার জয়মল্লর মৃত্যুর দিনের কথা মনে পড়ে?

—পড়বে না কেন জিৎ? এই তো সেদিনের কথা। তাঁর মৃত্যুর পরেই তো মুঘলরা চিতোরের দিকে ছুটে এল। প্রবেশ করল।

—কেন প্রবেশ করল?

—জয়মল্লের মৃত্যু হয়েছে, এই খবর পেয়ে

—কিভাবে এ খবর তারা পেল?

—–তা তো জানি না।

—আমি জানি, আমার বাবা বলেছিলেন।

—তিনি কি বলেছিলেন?

—চিতোরের রাস্তায় যখন জয়মল্লের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে লোকে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে, তখন তিনি জানতে চেয়েছিলেন, জহরব্রত শুরু হয়েছে কি না। বাইরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসে তাঁকে বলেছিলাম, জহরব্রতের আয়োজন চলছে। শুনে তিনি বলেছিলেন—এবারে মুঘলরা চিতোরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল।

—কি করে বুঝেছিলেন তিনি?

—খুব সহজে। বলেছিলেন—ওই, জহরব্রতের ধোঁয়া দেখে আকবর শাহের সন্দেহ হবে। তিনি লোক পাঠিয়ে সংবাদ নেবেন। তারপরই আক্রমণ শুরু হবে।

—তুমি কী বলতে চাও জিৎ?

—বলতে চাই যা আমরা বরাবর ক’রে এসেছি, ঠিক সেই জিনিসই যে চিরকাল করতে হবে তার কোনো মানে নেই। সে জিনিস এখনকার দিনের পক্ষে অচলও হতে পারে।

—কিভাবে অচল হবে?

—জয়মল্লের মৃত্যুর পর জহরব্রতের অনুষ্ঠান না করলে চিতোর আরও কিছুদিন রক্ষা পেত। বাদশাহ্ আকবর চিতোরের অবরোধ উঠিয়েও নিয়ে যেতে পারতেন। তেমন ঘটেছে অনেকক্ষেত্রে।

—তাই বলে, জয়মল্লের মতো বীরের মৃত্যুর পরও রাজপুত রমণীরা নিশ্চিন্তে বসে থাকবে? –কেন থাকবে না? একা জয়মল্লই শুধু বীর ছিলেন না চিতোরে। আরও অনেক বীর ছিল। তারা চেষ্টা ক’রে অবরোধ ঠেকিয়ে রাখতে পারত। কিন্তু তারা সুযোগ পায়নি। কারণ আমরা পুরোনো প্রথা অনুসরণ করছি। যাঁর ওপর চিতোর রক্ষার ভার ছিল, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ভেবে বসলাম, আমাদের হার হয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয় লীলাবতী। আমাদের হার যুদ্ধে হয়নি, হয়েছে স্নায়ুর মধ্যে। আমাদের বীরত্বের অভাব নেই, কিন্তু স্নায়ু বড় দুর্বল। এই দুর্বলতা জন্মেছে কতকগুলো তথাকথিত আদর্শের ফাঁসের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। সেই ফাঁস আমি ছিন্ন করতে চাই। ছিন্ন করার ইঙ্গিত আমার বাবাই দিয়ে গেছেন—শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বমুহূর্তে।

এতক্ষণে লীলার মস্তিষ্কে সামান্য চিন্তার উদ্রেক হয়। সে থেমে পড়ে।

জিৎ সিং-এর অস্পষ্ট কথা যেন এক নতুন সত্যের দিকে ইঙ্গিত করছে।

সে বুঝতে পারছে না, অথচ অনুভব করতে পারছে।

তবু সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,—না, না জিৎ। তুমি যে কথাই বল না কেন, গুপ্তচর বৃত্তি কখনো সম্মানের আসনে উঠতে পারে না।

—হয়তো পারে না, হয়তো কোনোদিনও পারবে না, তবু এর প্রয়োজন রয়েছে লীলাবতী। এর প্রয়োজনকে অস্বীকার করা যায় না। দেশের স্বার্থে যে কাজই করা যাক না কেন, সে কাজ কখনো হীন হতে পারে না। মুঘল বাদশাহের অসীম শক্তির কথা এখন আর কারও অজানা নেই। এখন আর কারও অজানা নেই, আকবর বাদশাহ্ শুধু তাঁর রাজ্যের মালিক নন, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সেনাপতি। তাঁর রাজ্যের পাশাপাশি থেকে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে এর প্রয়োজন আছে। তিনি চান আমাদের গ্রাস করতে। আমরা চাই আমাদের নিজেদের মতন ক’রে বাঁচতে। শক্তি দিয়ে তাঁকে ঠেকিয়ে রাখতে না পারলে, কৌশল দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। এই কৌশলকে সমস্ত রাজোয়ারা হীন আখ্যা দিলেও আমি দেবো না। যুদ্ধ? কতদিন যুদ্ধ করতে পারব আমরা? সেই লোকবল কোথায়, সেই অস্ত্রবল কোথায়? তুমি বলবে, না থাকুক কিছু, যুদ্ধ ক’রে ধ্বংস হয়ে যেতে তো পারব? ধ্বংস হয়ে যাবার এক মহান্ রূপ তুমি কল্পনা করবে। আমি কিন্তু তা করব না। আমি চাই মেবারকে বাঁচিয়ে রাখতে, গৌরবের সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখতে। হয়তো সফল হব না, কিন্তু চেষ্টা করতে ছাড়ব কেন? চেষ্টা আমি সবই।

—তুমি তাহলে যাবেই আগ্রায়?

—হ্যাঁ লীলাবতী, আগ্রায় আমাকে যেতে হবে। কিন্তু একটা কথা—

—কি কথা?

—যদি কোনোদিন ফিরে আসি তুমি আমায় গ্রহণ করবে তো? আমার জন্যে অপেক্ষা করবে তো?

লীলাবতী চুপ করে থাকে।

যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে সে ধীরে ধীরে বসে পড়ে।

সে জিৎ সিং-এর দিকে চাইতে পারে না। চোখ দিয়ে তার অশ্রু ঝরে পড়ে।

জিৎ সিং-এর কণ্ঠে আর্তস্বর ফুটে ওঠে,–লীলাবতী?

—জিৎ, আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু যে কাজ তুমি করতে চলেছ, সেই কাজ আমি মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারব না।

—ও!

—আমায় ভুল বুঝো না জিৎ! আমি নারী। একজনকে শুধু ভালোবাসি বলেই গ্রহণ করতে পারি না। ভালোবাসার সঙ্গে শ্রদ্ধারও প্রয়োজন হয়। তোমায় যদি আমি শ্রদ্ধা করতে না পারি, তবে কি ক’রে আমার সেই মন সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করব তোমায়?

স্তব্ধ হয়ে থাকে জিৎ সিং।

উদয়সাগরের ওপারে চলে গেছে সূর্য। জলের ওপর তার রশ্মি আগের মতো আর তীব্র নয়।

মাটিও অনেক কম উত্তপ্ত। শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলে,—আমি বুঝেছি লীলাবতী, তুমি ঠিকই বলেছ।

—আমায় ভুল বুঝো না জিৎ। তোমায় আমি চিরকাল ভালোবাসব।

—আমি জানি। আর এও জানি, তোমার কাছে আসার পথ আমার চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল।

—না, না। আমি এখনো জানি না। এখনো প্রস্তুত নই আমি। হয়তো তুমি ঠিকই করছ, হয়তো আমার ধারণা ভুল। আমি শুধু একটু সময় চাই, আমি ভাববার সময় চাই।

জিৎ সিং সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

দেহ মনে তার অসীম অবসাদ। সে বুঝতে পারে জীবনের এক মহাসন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছে সে।

একদিকে লীলাবতী—অপরদিকে কর্তব্য।

এই কর্তব্য সে ঝোঁকের মাথায় স্থির করেনি। অনেক বিনিদ্র রজনীর গভীর চিন্তার পর সেই কর্তব্য স্থির করেছে, লীলাবতীর জন্য সেই কর্তব্য থেকে সে বিচ্যুতি হতে পারে না।

লীলাবতী তার বুকের সবটাই প্রায় খালি ক’রে দিল।

এ শূন্যস্থান হয়তো কোনোদিনই পূরণ হবে না। তবু সে এগিয়ে যাবে, থামবে না কিছুতেই। তার পিতা বীর অজিত সিং-এর শেষ সময়ের আদেশ তাকে থামতে দেবে না। শত সহস্র বাধা বিপত্তির মধ্যে প্রেরণা দিয়ে চলবে।

—চল লীলাবতী।

—তুমি আর আগ্রা থেকে ফিরে আসবে না জিৎ?

—তুমি যদি ডেকে পাঠাও নিশ্চয়ই আসব।

—কিন্তু জিৎ—

—সর্দার হয়তো এতক্ষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে, তাড়াতাড়ি চল লীলা।

লীলাবতী কান্নায় ভেঙে পড়ে জিৎ সিং-এর পায়ের কাছে।

ধীরে ধীরে তাকে তুলে ধরে জিৎ সিং।

তাকে বুকের ভেতরে টেনে নেবার দুরন্ত প্রলোভন হয় তার, তবু সংযত থাকে সে।

—লীলাবতী, তোমায় ছেড়ে যেতে আমার বুকের ভেতরে যে কী হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না। তবু আমি থাকতে পারি না। তাহলে নিজের কাছেই আমার নিজের কোনো মূল্য থাকবে না। তেমনি তুমি যদি জোর ক’রে বলতে যে আমার জন্যে তোমার দ্বার অবারিত রইল, তাহলে মনের দিক থেকে তুমি খাঁটি থাকতে পারতে না। আমরা দুজনা দুজনকে ভালোবেসেও মিলতে না পারার দুঃসহ ব্যথার মধ্যে এইটুকুই সান্ত্বনা রইল যে আমরা খাঁটি।

লীলাবতী আবার ফুঁপিয়ে ওঠে।

—কেঁদো না লীলা। হয়তো সত্যিই তুমি একদিন বুঝবে যে আমার পথ চৌর্যবৃত্তির পথ নয়, হীনতার পথ নয়। আমি সেদিনের জন্যে অপেক্ষা করব।

লীলাবতীকে নিয়ে জিৎ সিং ফিরে চলে।

দুজনার হৃদয় অশান্ত, মুখে একটিও কথা নেই। শুধু মাঝে মাঝে লীলাবতী তার চোখদুটো মুছে ফেলে।

জি সিং-এর চোখও জ্বালা করে, তার মনে জেগেছে চরম হতাশা।

সে স্বপ্নেও ভাবেনি লীলা তাকে ভালোবেসেও তার ফিরে আসবার পথ বন্ধ করে দেবে। বন্ধ ক’রে দেওয়া ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে একে? যে কাজকে এখন সে ঘৃণ্য বলে মনে করেছে সেই কাজকে সম্মানের বলে মনে করতে হলে তার মনের ওপর চেপে বসা বহুদিনের সংস্কারের জঞ্জালকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার ক’রে ফেলতে হবে।

একটি মেয়ের পক্ষে এক জীবনে তা অসম্ভব।

যশোবন্তের ঘরের কাছে এসে জিৎ সিং বলে,—তুমি ঘরে যাও লীলা।

—তুমি?

—আমি একটু কিকার সঙ্গে দেখা ক’রে আসি।

—না, না জিৎ। তুমি খেয়ে যাও, তোমার খাওয়া হয়নি।

—ফিরে আসি আগে।

লীলাবতী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সে দেখতে পায় জিৎ চলে যাচ্ছে। কিন্তু বাধা দিতে পারে না। কেন যেন তার মনে হয়—এই দেখাই যদি শেষ দেখা হয়?

জিৎ সিং তার জীবনে যেমন হঠাৎ এসে দেখা দিয়েছিল, তেমনি হঠাৎই চলে যাচ্ছে। সে আসবার সময় যেমন তাকে আহ্বান জানাতে পারেনি, চলে যাবার সময়ও তেমনি বিদায় জানাতে পারছে না।

কিন্তু সত্যিই কি জিৎ একেবারে চলে যাচ্ছে?

যাবার আগে কি সে আর দেখা করবে না? আর কি সে তার মিষ্টি কণ্ঠস্বরে লীলা বলে ডাকবে না? না না—তা হতে পারে না, জিৎ সিং নিষ্ঠুর নয়। কিন্তু সে যে চলে যাচ্ছে। এখনো তাকে ডাকা যায়।

সে ক্লান্ত পা ফেলে ফেলে যাচ্ছে, ক্লান্ত অথচ দৃঢ়।

সত্যিই কি সে একেবারে চলে গেল?

আর কখনো কি দেখা হবে না জীবনে? তা কি করে সম্ভব। না, না—

লীলাবতী পাগলের মতো দুহাত উঁচিয়ে চিৎকার ক’রে ডাকতে চেষ্টা করে,—জিৎ সিং।

কিন্তু তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না, সে বসে পড়ে মাটির ওপর।

সে আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে।

সেই সময়ে যশোবন্ত এসে দাঁড়ায় পেছনে। লীলাবতীর পিঠে হাত রাখে।

—ও চলে গেল সর্দার।

—আমি জানতাম লীলা, ও চলে যাবে।

—জানতে? তুমি জানতে ও চলে যাবে? তুমি জানতে ও আগ্রায় যাবে?

—জানতাম।

—তবে বলনি কেন আমায়? কেন বলনি সর্দার?

—লাভ হত না। দেবী আমায় এই কথাই জানিয়ে দিলেন লীলা, তোমাদের মিলন হবে না।

—কিন্তু অমন ঘৃণ্য কাজে হাত দিতে যাচ্ছে কেন ও?

—ঘৃণ্য কাজ? কাকে তুমি ঘৃণ্য কাজ বলছ লীলা?

—গুপ্তচরবৃত্তি।

—এবারে বুঝেছি। আমি শুধু জানতাম সিং আগ্রায় যাচ্ছে। কিন্তু কেন যাচ্ছে জানতাম না। এবারে বুঝেছি কেন সে যাচ্ছে। মুঘলদের নাড়ীর খবর টেনে বের করে আনবে। তারপর তাদের দুর্বলতম স্থানে আঘাত হানার চেষ্টা করবে। এইভাবে সে মেবারকে বাঁচাবে। তাই না লীলা?

—সেই কথাই বলল ও।

—একে তুমি ঘৃণ্য কাজ বলছ?

—ঘৃণ্য ছাড়া কি?

—একথা তুমি বলেছ ওকে?

—হ্যাঁ।

—লীলাবতী তুমি ওকে চূড়ান্ত আঘাতে দিয়েছ। তবে একদিক দিয়ে ভালোই করেছ। ও নিশ্চয়ই, ভেবে আকুল হচ্ছিল, কিভাবে বিদায় নেবে তোমার কাছ হাতে। তুমি সেই ভাবনা থেকে ওকে নিষ্কৃতি দিয়েছ। ওই যে ধীরপদে ও চলে গেল একটু আগে, একবারও পেছন ফিরে চাইল না পর্যন্ত, অমনভাবে কি যেতে পারত?

—সর্দার, যাবার আগে ওকি সত্যিই আর দেখা করবে না?

—মনে হয় না।

—কিন্তু ও যে ক্ষুধার্ত, কিছুই খায়নি।

—সেকথা কি ওর মনে আছে দিদি? ক্ষুধার কথা ওর মনে নেই, ও ভাবছে অন্য কথা পৃথিবীর সব জায়গায় রূঢ় আঘাত পেয়ে পুরুষেরা যার কাছে এলে সমর্থন পায়, সান্ত্বনা পায়, তার কাছ থেকেই ও কিছুই পায়নি। ক্ষুধার কথা ওর মনে নেই লীলা।

সর্দারের কথা লীলার বুকে এক একটি কান্নার ঢেউ তোলে। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে, উছলে পড়ে তার চোখ বেয়ে।

সে রুদ্ধকণ্ঠে বলে—তুমি জেনেশুনে ওকে সমর্থন করলে কেন? আগ্রায় চলে যাবে শুনে

কেন ওকে মানা করলে না?

—মানা করবার অবসর পাইনি। কারণ তখন আমি অন্য ব্যাপারে চিন্তিত ছিলাম। তোমাদের দুজনাকে যে মিলিয়ে দিতে পারব না, এই দুঃখে অভিভূত ছিলাম। তাছাড়া মানা করব কেন? ও কি আমার কথা শুনত? তোমার কথা তো শুনলো না লীলা। কিন্তু তোমার কাছ থেকে ওর উদ্দেশ্য জানতে পেরে মনে হচ্ছে, তখন যদি এসব জানতাম তাহলে ওকে আমি সমর্থনই করতাম। রাজোয়ারার ইতিহাসে একটি নতুন পথ খুলে দিচ্ছে জিৎ সিং। এ পথের সন্ধান যদি হুমায়ুন কিংবা শেষ শাহের সময়ে পেতাম আমরা তবে এখানকার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত। কিন্তু আকবর শাহ্ ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তিনি শুধু অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী নন। তিনি নিজেকে খাঁটি হিন্দুস্থানী বলে মনে করেন। তাই আমার চিন্তা হচ্ছে, জানি না জিৎ সিং কতখানি সফল হবে।

—তুমি সত্যিই একে ঘৃণ্য কাজ বলে মনে করো না সর্দার?

—না, না, না। নিজের জীবনকে বিপন্ন ক’রে, নিজের স্বার্থের দিকে বিন্দুমাত্র দৃকপাত না ক’রে, একজন মানুষ যদি শুধু দেশের জন্যে কাজ ক’রে যায়, তবে তার সেই কাজকে পৃথিবীর কোনো ধর্ম, কোনো শাস্ত্র, কোনো মানুষই ঘৃণা বলে ভাবতে পারে না।

—সর্দার?

—কাঁদছ কেন দিদি?

—আমি বোধ হয় ভুল করেছি, মস্ত ভুল করেছি।

—না, তুমি অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করেছ। অদৃষ্টের কাছে সব মানুষই হেরে যায়। তাছাড়া আমার কথা শুনে তুমি ভাবছ ভুল করেছ। কিন্তু মনে মনে এখনো কি সমর্থন করতে পারছ জিৎ সিং-কে? না। তবে কেন উতলা হচ্ছ? ওকে যেতে দাও।

লীলাবতী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে।

কৃষ্ণপক্ষ বলে চাঁদ উঠবে শেষ রাতে।

অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়।

একটি দুটি করে আকাশে অনেক তারা ফুটে ওঠে। সন্ধ্যাতারা উঁকি দেয় ওই শিমুল গাছের ফাঁকে।

জিৎ আর তার শিমুল গাছ।

কিন্তু আজ কিছুর সঙ্গেই তার সম্পর্ক নেই। আজ প্রকৃতি তার কাছে নিষ্করুণ।

এক বিরাট একাকীত্ব লীলাবতীকে ঘিরে ধরেছে।

বাবার মৃত্যু নতুন করে তাকে অভিভূত করছে।

বাবা নেই—কেউ নেই তার। আজ জিও চলে যাচ্ছে? কেন তার মাথায় এ-খেয়াল চাপল।

কেন সে মেবারের মঙ্গলের জন্যে এই অদ্ভুত পথ বেছে নিল? হয় তো তার পথই শ্রেষ্ঠ পথ। কিন্তু এত আকস্মিকভাবে কেন সে মনস্থির করল?

একটু সময়ও তো দিতে পারত।

লীলাবতীর চিন্তাশক্তি ক্রমশ বিলুপ্তি হয় যেন।

একটা বোবা অবসাদে আর চাপা কষ্ট তার বুকের ভেতরটা ভারী করে তোলে।

—চল দিদি। ঘরে চল।

—সর্দার। ওকি আর ঘরে ফিরবে না?

—ফিরবে আশা করি। ওর অস্ত্র, ওর সব কিছুই তো পড়ে রয়েছে। সেগুলো নিতে আসতেই হবে।

—আসবে। আবার আসবে?

—ও তো কিকার কাছে গেল। হয়তো অনুমতি নিতে।

লীলাবতীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে—অনুমতি নিতে? যদি কিকা অনুমতি না দেন? যশোবন্ত বিষণ্ণ হাসি হেসে বলে,–কিকার সাধ্য কি ওকে বাধা দেন।

—কেন? তিনি বুঝিয়ে বলবেন, একাজ জিৎ-এর মতো বীর যোদ্ধার শোভা পায় না।

—রাজোয়ারার সবচেয়ে সাহসী বীর ছাড়া এ-কাজ যে কারও পক্ষেই সম্ভব নয় দিদি।

—যদি কিকা তাকে বলেন রাজপুত জাতির চরিত্রে এতে কলঙ্কের ছাপ পড়বে।

—সত্যিই কি তাই? সত্যিই যদি তা হত তাহলে কিকা নিঃসন্দেহে তাকে মানা করতেন। কিন্তু জিৎ সিং জাতির এই সংকটে যে পথের সন্ধান পেয়েছে সেই পথকে অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস কিকারও হবে না।

—তাহলে?

—জিৎ আগ্রায় যাবেই দিদি। কিকা তাকে সমর্থন করবেন।

—আমি কিকার কাছে যাব। তাঁর পায়ে ধরে বলব, ওকে ফিরিয়ে দিন।

—ছিঃ দিদি। তুমি কার মেয়ে ভুলে গেলে? নিজের সুখের জন্যে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেবে?

ডুকরে কেঁদে ওঠে লীলাবতী। বলে—আমি তবে সারাজীবন কি নিয়ে থাকব?

যশোবন্ত লীলাবতীর মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,—জিৎ সিং আগ্রা থেকে ফিরে আসবে কি না জানি না। যদি না ফেরে, তাহলে তার কীর্তিই তোমার পাথেয় হবে। আর যদি সত্যিই ফিরে আসতে পারে তাহলে দিদি, এই বৃদ্ধ তোমাকে শুধু একটি উপদেশই দেবে, দ্বিধাহীন চিত্তে তাকে হৃদয়ে গ্রহণ করো। দেখবে তুমিই হবে মেবারের সব চাইতে গর্বিতা রমণী। তবে কেন জানি না, আমাক দৃঢ় ধারণা বিধাতা চান না, তোমাদের মিলন হোক।

লীলাবতী আরও কিছুক্ষণ বসে থাকে—যশোবন্ত তার মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে।

—কিন্তু ওকে যে একলিঙ্গের নির্মাল্য দেওয়া হয়নি। কত বিপদ-আপদে পড়বে ও। ওকে রক্ষা করবে কে? নির্মাল্য যে দিতেই হবে।

—ফিরে আসুক। আমি পৌঁছে দেব।

—আমি? আমি নিজে হাতে দিলে ওকি নেবে না?

—তোমাকে কি ফেরাতে পারে দিদি। তুমিই দিও যদি ও ফেরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *