আরাবল্লী – ১

১.

ইতিহাসে বিধৃত রয়েছে সেই দীর্ঘ তিনমাসের উজ্জ্বল-করুণ কাহিনী। আর রয়েছে রাজপুতদের মনে। ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের শীতের শুরু থেকে বসন্তের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত।

এত হিসাব, এত গণনা কিন্তু সেদিন ওরা কেউ করেনি। কখন শীত এল, কখন বা চলে গেল—কখন গাছে গাছে দুটি একটি করে কোকিল উড়ে এসে বসে তাদের মধুঝরা কণ্ঠে ডাকতে শুরু করল কেউ শোনেনি সেদিন। শোনবার মতো মনের অবস্থা তাদের ছিল না। সুদীর্ঘ আট শতাব্দীর কতশত বীরত্ব আর ব্যথার স্মৃতি-জড়ানো পূর্বপুরুষের বুকের রক্তে মহীয়সী তাদের বাসস্থান, তাদের তীর্থস্থান, সুউচ্চ পর্বতের ওপর সুরক্ষিত সুদৃঢ় মেবারের রাজধানী চিতোর সেদিন চরমতম বিপদের সম্মুখীন।

পঙ্গপালের মতো মুঘল সেনারা এসে ঘিরে ধরেছে তাদের প্রাণকেন্দ্র। বাদশাহ আকবর স্বয়ং তাদের নেতা। এসেই প্রবল আক্রমণ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে লোকক্ষয় হল প্রচুর। পেছনে সরে যেতে বাধ্য হলেন আকবর। তারপর সৈন্যদলকে তিনভাগে বিভক্ত করে হুকুম জারি করলেন দুর্গ-নগরীর প্রাকার পর্যন্ত সুড়ঙ্গ কাটতে।

রাজপুতরা চেয়ে চেয়ে দেখল সব। বুঝতে পারল, দুঃসময় ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে। অথচ কিছুই করতে পারল না। কারণ গোড়া থেকেই তাদের নৈতিক বলের অনেকটা অন্তর্হিত হয়েছিল এক মসীলিপ্ত ঘটনায়। বাপ্পা আর সংগ্রাম সিংহের উত্তরাধিকারী, রানা কুম্ভ আর রানা সঙ্ঘের উষ্ণ রক্ত যাঁর ধমনীর মধ্যে প্রবাহিত, মেবারের সেই বর্তমান রানা উদয় সিং আকবরের অভিযানের খবর পেয়েই চিতোর ছেড়ে আরাবল্লীতে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন।

চিতোরে ছিলেন শুধু জয়মল্ল আর পট্ট। শৌর্যে তাঁদের তুলনা নেই, বীর্যে তাঁরাও অসাধারণ। তাঁদের অনুপ্রেরণায় সহস্র রাজপুত সেই চরম মুহূর্তের জন্য জীবনপণ ক’রে প্রতীক্ষারত। তবু কী যেন নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা শুধু রানার নেতৃত্বেই যুদ্ধ ক’রে অভ্যস্ত।

কিন্তু এত সব কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমরা জানি, বাদশাহ্ আকবর তাঁর শিবির থেকে অনেক দূরে মেবারের প্রাচীরের উপর দণ্ডায়মান এক ব্যক্তির ওপর শুধু খেয়ালের বশে বন্দুক উঁচিয়ে গুলি ছুড়েছিলেন। তবু সেই একটি গুলিই চিতোরের হৃৎপিণ্ডে এসে আঘাত করে তাকে স্তব্ধ ক’রে দিয়েছিল। সেই একটি গুলিতেই মেবারের ভাগ্য সেদিন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। মুঘল বাদশাহের দীর্ঘ তিনমাসের প্রতীক্ষার সেদিন অবসান ঘটেছিল। কারণ গুলিটি রাজপুত নেতা জয়মল্লের মস্তিষ্ক ভেদ করেছিল। ভগ্ন প্রাচীরের এক অংশ মেরামতের কাজে যখন নির্দেশ দিচ্ছিলেন জয়মল্ল, সেই সময়ে এই অঘটন ঘটে গেল।

আকবর কিছুই বুঝতে পারেননি প্রথমে। দেখেছিলেন শুধু, তাঁর নিরিখ ব্যর্থ হয়নি। আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন নিজের অব্যর্থ লক্ষ্যে—দূর থেকে অন্তত একজন রাজপুতকে সামান্য আহত করতে পেরেছেন ভেবে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখে তিনি স্তম্ভিত হলেন। স্তম্ভিত হল মুঘল শিবিরের সবাই। তারা দেখতে পেল চিতোর নগরীর নানান স্থান থেকে গলগল করে ধোঁয়া উঠে ওপরের দিকে ছুটে অন্ধকার ক’রে দিচ্ছে ঊর্ধ্বাকাশ। সেই ধোঁয়ার যেন আর শেষ নেই। মনে হল, যেন নগরীর প্রতিটি গৃহে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কারা।

রাজা ভগবান দাস ছিলেন মুঘলদের সঙ্গে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ওই অগ্নিকাণ্ডের অন্তর্নিহিত অর্থ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটে এলেন তিনি বাদশাহের শিবিরে। এসে বললেন, —বাদশাহের এতদিনের স্বপ্ন সফল হল আজ।

—কেন?

—চিতোর আজ বাদশাহের কাছে মাথা নোয়াল।

—সে কি! কি ক’রে বুঝলে রাজা?

—ওই যে আগুন, অত ধোঁয়া—ওর থেকেই প্রমাণ পাওয়া গেল বাদশাহ্। ওদের জহর-ব্রত শুরু হয়েছে। আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে চিতোরের শতশত রমণী। রাজপুত নারীরা সতীত্বকে মরণ পর্যন্ত আঁকড়ে থাকে তা তো আপনি জানেন। কিন্তু কী এমন ঘটল যার ফলে এই জহর-ব্রত? আপনি কাকে লক্ষ্য করে তখন গুলি ছুড়েছিলেন জাহাঁপনা?

—জানি না। দেখে মনে হয়েছিল সর্দার গোছের কেউ হতে পারে

সঙ্গে সঙ্গে গুপ্তচর পাঠানো হয়েছিল সংবাদ সংগ্রহের জন্যে। আসল সংবাদ জেনে আসতে তার বিলম্ব হয়নি।

মুঘল- -শিবিরে আনন্দের ঢেউ বয়েছিল। অতটা বইত না, যদি তারা জানত তরুণ নায়ক পট্ট তখনো জীবিত রয়েছেন।

পট্রের বীরাঙ্গনা মা পুত্রকে যুদ্ধ-সাজে সাজিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। পুত্রবধূর হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে, নিজেও একখানি তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পরাক্রান্ত শত্রু-সৈন্যের স্রোতের মুখে। যুদ্ধ করতে করতে দুই নারীর প্রাণহীন দেহ শেষে লুটিয়ে পড়ল তাঁদেরই অস্ত্রে নিহত মুঘল সৈন্যের ওপর

সেদিনের যুদ্ধের কথা বাদশাহ্ আকবর জীবনে ভুলতে পারেননি। প্রতিটি পদ অগ্রসর হতে যে এত জীবন বলি দিতে হয়, এ ধারণা তাঁর আগে কখনো ছিল না।

পট্টের মৃত্যু কিন্তু বড়ই করুণ। যুদ্ধরত অবস্থায় অকস্মাৎ একসময় তিনি মুঘল দলের হস্তীর পায়ের নীচে পড়ে নিষ্পেষিত হন।

চিতোর যুদ্ধের দীর্ঘ অধ্যায়ের সমাপ্তি এইখানেই।

কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলেও অনেক কিছু বাকি ছিল তখনো। রাজপুতদের কাছে প্রবল বাধা পেয়ে মুঘল বাদশাহ্ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। যার নিদারুণ পরিণাম ত্রিশ সহস্র নিরপরাধ অধিবাসীকে নিষ্করুণভাবে হত্যা। এতখানি নিষ্ঠুর জীবনে সেই প্রথম হয়েছিলেন বাদশাহ এবং সেই বারই শেষ। চিতোরের রাজপথে এবং প্রতিটি গৃহে সেদিন মৃতের স্তূপ জমে উঠেছিল। সেই স্তূপের মধ্যে নারী শিশু, বৃদ্ধ, রু সবাই ছিল।

কিন্তু তাতেও কি তুষ্ট হয়েছিলেন বাদশাহ? না। তাতেও তাঁর ক্রোধবহ্নি নির্বাপিত হয়নি। তাই লাখোটা তোরণ থেকে শুরু করে প্রতিটি তোরণের পাল্লা খসিয়ে নিয়ে আগ্রায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মহামায়ার মন্দিরের অপূর্ব কারুকার্যখচিত দীপাধারগুলি লুণ্ঠন ক’রে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর নিয়ে গিয়েছিলেন চিতোরের বিখ্যাত প্রকাণ্ড নাকাড়া।

এতখানি উন্মত্ত হয়ে ওঠবার কারণ শুধু রাজপুতদের দৃঢ় প্রতিরোধ বললে ভুল হবে। এর পেছনে রয়েছে আরও একটি গূঢ় কারণ। সেইখান থেকেই আজকের কাহিনী শুরু। চিতোরে ত্রিশ সহস্র অধিবাসীর মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়েও কেন বাদশাহ্ আকবরের ক্ষিপ্ততা গেল না সেই কথাই বলি।

অবরোধের সময় প্রায়ই চিতোর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে গিয়ে মুঘল শিবিরের বহু লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছে। সৈন্যরা সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকত। কারণ তারা জানত না কখন গুলির ঝাঁক এসে তাদের বিদ্ধ করবে। কিন্তু তবু কিছুতেই কিছু হয়নি। প্রতিদিন বিনাযুদ্ধে এমনিভাবে শতশত মুঘল সৈন্য প্রাণ হারাতো। এমনি একটি গুলি একদিন বাদশাহের কানের পাশ দিয়ে ছুটে শিবিরে প্রবেশ করেছিল। তিনি চর পাঠিয়ে জেনেছিলেন কালপীর এক সহস্র নিপুণ বন্দুকধারীর একটি দল এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে। তখন থেকে তাঁর সংকল্প চিতোর অধিকারের পর তাঁর প্রথম কর্তব্য হবে এদের সমূলে ধ্বংস করা। কিন্তু তাঁর সে সংকল্প ফলবতী হয়নি। নির্বিচারে হত্যা করার পর অধিক রাতে প্রথম অবসর পেয়ে কালপীর দলের খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারলেন পাখির ঝাঁক উড়ে পালিয়েছে। তখন তিনি আরও ক্রুদ্ধ হয়ে হুকুম দিলেন, চিতোরের একটি প্রাণীও যেন বেঁচে না থাকে।

যাদের জন্যে অবশিষ্ট চিতোরবাসীদের ওপর সে-রাতে বাদশাহের এই নির্মম আদেশ বিধাতার নির্দেশের মতো অমোঘ হয়ে নেমে এল, সেই কালপীর দলকে কিন্তু খাঁটি রাজপুত বলা যায় না। রাজোয়ার সীমানা ছাড়িয়ে আরও পুবদিকে যমুনার তীরে এই কালপী জনপদ। সেখানকার নয় সহস্ৰ যুদ্ধপ্রিয় অধিবাসী অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ ক’রে জীবিকা নির্বাহ করত। তাদেরই মধ্যে কিছু-সংখ্যক যোদ্ধা মুসলমান আধিপত্য সহ্য করতে না পেরে বিচলিত হয়ে উঠেছিল দু-পুরুষ আগে। তাই তারা যমুনার তীর ছেড়ে এক উজ্জ্বল প্রভাতে তাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসে উপস্থিত হল চম্বলের তীরে। তারা পুলকিত চিত্তে অনুভব করল চম্বলের তীরের অধিবাসীদের হৃদস্পন্দনের সঙ্গে তাদের হৃদস্পন্দনের অপূর্ব মিল রয়েছে। তারা দেখল এখানে রয়েছেন এমন একজন রানা যাঁর মাধ্যমে তাদের আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারবে। সেই রানা হলেন কুম্ভ। সেই থেকে তারা মেবারের অধিবাসী। সেই থেকে চিতোর তাদেরও তীর্থস্থান। সেই থেকে নামে তারা কালপীর লোক হয়েও মনেপ্রাণে রাজপুত। তাদের সন্তান-সন্ততি নিজেদের রাজপুত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। রাজোয়ারার গৌরব তাদের গৌরব, রাজোয়ারার ঐতিহ্য তাদেরও ঐতিহ্য। ‘কালপী’ কথাটা শুধু তাদের পরিচয়ই বহন করে—আর কিছু নয়।

তবু তাদের নিজেদের মধ্যে ছিল এমন এক অলক্ষ্য বন্ধন এমন এক আশ্চর্য শৃঙ্খলাবোধ, যার গুণে বিধ্বস্ত চিতোরের মধ্যে থেকেও তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিজেদের লোকজন পরিবারকে একত্রিত ক’রে ফেলে এবং এক অদ্ভুত কৌশল অবলম্বন ক’রে মুঘল সেনার ভিতর দিয়ে পথ কেটে বের হয়ে যায়। তারা বাদশাহী-সেনা বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে স্ত্রী-পুত্ৰ পরিবার নিয়ে মুঘলদের চোখে ধুলো ছিটিয়ে চিতোর থেকে অদৃশ্য হয়।

এর পরের ঘটনা ইতিহাস বলুক। আমরা ক্রোধকম্পিত আকবরকে পেছনে ফেলে রেখে এখান থেকে বিদায় নিয়ে সেই এক সহস্র বন্দুকধারীকে অনুসরণ করি। কারণ ইতিহাস তাদের সম্বন্ধে আর কিছু বলেনি। আবুল ফজল তাদের ব্যাপারে নীরব। তিনি তখনো আগ্রায় আসেননি —বাদশাহকেও দেখেননি। বাদৌনীও তখন আকবরকে চেনেন না। চেনেন শুধু আকবরেরই ছেলেবেলার ভৃত্য জহুর—যাঁর লেখায় আমরা তৎকালীন অনেক ঘটনার কথাই জানতে পারি। কিন্তু জহুর শুধু আকবর বলে মানুষটিকেই চিনতেন। তাঁর যুদ্ধ ও রাজনীতি নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ও ঘামাননি তিনি। তাছাড়া সেই বিশাল সম্রাজ্যে মাত্র এক সহস্র বন্দুকধারীর খোঁজ কে-ই বা রাখে। আকবর নিজেই কি পরে সেকথা মনে ক’রে রেখেছিলেন? তিনি যখন চিতোর ছেড়ে সোজা রওনা হয়েছিলেন আজমীঢ়ের দিকে খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তির বেদির মূলে তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধা জানাতে তখন কি কালপীর এই দলটার কথা তাঁর মন থেকেও মুছে যায়নি?

তাই আমরা অনুসরণ করব সেই এক সহস্র বীরকে। কারণ তাদের সঙ্গে রয়েছে আঠারো উনিশ বছরের জিৎ সিং—যার মন দুঃখে রাগে শোকে বার বার গুমরে উঠছে। যার চোখে ঘুম আসবার উপক্রম হতেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃত পিতার অতি দীর্ঘ তলোয়ারখানা নিয়ে শূন্যে আস্ফালন করছে। সেই তলোয়ারে তখনো লেগে রয়েছে রক্তের দাগ। অসুস্থ হয়ে শয্যায় পড়েছিলেন তার পিতা। তবু মুঘল সৈন্য তাঁকে রেহাই দেয়নি। তিনি সেই অবস্থাতেই নিজের প্রিয় অস্ত্রটি পাশ থেকে টেনে নিয়ে শুয়ে শুয়ে একজন মুঘলকে খতম ক’রে প্রাণ দিয়েছেন। জিৎ সিং-এর চোখের সামনেই এই শোচনীয় ঘটনা ঘটে গেছে। সে ছিল নিরস্ত্র। আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল আট-দশজন শত্রু। তাই বাধা দিতে পারেনি। কিন্তু তারা যে কেন তাকে প্রাণে মারল না সে এক রহস্য। সবাই প্রস্তুত ছিল তাকে বধ করতে কিন্তু একজন শুধু সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তর্ক তুলে তাকে অক্ষত অবস্থায় ফেলে রেখে গেল। হয়তো ভেবেছিল বয়স খুবই কম। কারণ দেখতে সে ছিপছিপে। মুখে গোঁফের রেখা উঠলেও সেই মুখখানা কচি। কিংবা সেই বিশেষ ব্যক্তিটি মোটেই সাধারণ লোক ছিল না। যুদ্ধের বীভৎসতার মধ্যেও তার মনে দয়ামায়ার কিছুটা তখনো অবশিষ্ট ছিল। কিংবা হয়তো জিৎ সিং-এর চেহারার সঙ্গে সেই লোকটির অতিপ্রিয়জনের চেহারার অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল। যাই হোক না কেন সে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেছে।

মুঘল সেনারা চলে যেতে সে রক্তাক্ত পিতার শয্যার ওপর ঝুঁকে পড়ল। অতি কষ্টে মৃত্যুপথযাত্রী তাঁর চোখের ইশারায় পুত্রকে তলোয়ারখানা তুলে নিতে বললেন। সেটি পড়ে ছিল শয্যার পাশে মাটিতে। আহত রাজপুত্রের কর্তিত ডান হাতখানি তখনো দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে রেখেছিল অস্ত্রটি।

—তোমার হাতখানা বাবা?

—ফেলে দে।

—কিন্তু এ যে তোমার হাত!

অত যন্ত্রণার মধ্যেও যেন হাসি ফুটে ওঠে রাজপুতের মুখে,—এখন আর আমার হাত নয়। শোন্। কাছে আয়।

জিৎ সিং তলোয়ার তুলে নিয়ে আবার পিতার মাথার কাছে সরে আসে। তলোয়ার দেখিয়ে পিতা বলেন—এটিকে সঙ্গে রাখিস।

—আমি প্রতিশোধ নেব।

—প্রতিশোধ? নিতে পারলে নিস। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবি।

—কি কথা বাবা?

—শুধু অস্ত্র দিয়ে প্রতিশোধ নেবার দিন শেষ হয়ে গেছে। মানুষ বড় কুটিল, বড়ই হীন হয়ে পড়েছে। অস্ত্রের চেয়েও বুদ্ধিকে বেশি কাজে লাগাস।

জিৎ সিং পিতার কথার অর্থ বুঝতে পারে না। বুঝে ওঠবার সময়ও পায় না। সে দেখতে পায় পিতার দেহের সমস্ত রক্ত নিঃশেষিত হয়ে এসেছে। তাঁর মুখ সাদা। সেই মুখে মৃত্যুর করাল ছায়া। পিতা হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন—ওরা তোকে মারল না। কেন মারল না জানি না। তবু এইটুকুই আমার সান্ত্বনা। জয়মল্ল তোকে যুদ্ধে যেতে না দিয়ে এইটুকুই উপকার করে গেল আমার।

—তিনি যেতে বললে আমার উপকার হত বাবা। তোমায় এ অবস্থায় দেখতে হত না।

—ছিঃ জিৎ।

—সবাই যুদ্ধ করল। শুধু আমি একা ঘরে বসে রইলাম। তবু তোমায় রক্ষা করতে পারলাম না।

—কেউ পারত না। দুঃখ করিস না। একটু জল দিবি জিৎ? তেষ্টা পাচ্ছে।

—আনছি বাবা।

ছুটে ঘরের বাইরে চলে যায় সে। জলের পাত্রের কাছে গিয়ে দেখে পাত্র শূন্য। মুহূর্তের জন্যে একটা অসহায়তা তার মনকে আচ্ছন্ন করে। এখন জল পাবে কোথায়? আশেপাশে সব বাড়িতেই মুঘল সৈন্যের অত্যাচার চলছে। রাস্তার ওপরও তাদের ভিড়। এর মধ্যে জল আনবে কোথা থেকে?

স্থির হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় জিৎ। তার মুখে সংকল্পের দৃঢ় রেখা ফুটে ওঠে। হ্যাঁ, বাইরে যাবে সে। হয়তো আর ফিরে আসতে পারবে না। তবু ভালো। নিজেকে জীবিত রেখে পিতার শেষ সময়ে মুখে এক ফোঁটা জল না দিতে পারায় কোনো সান্ত্বনা নেই। চেষ্টা তাকে করতেই হবে। প্রাণ গেলে বরং ভালোই হবে, পিতার আত্মার সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারবে। বলতে পারবে, চেষ্টা করেছি বাবা। তাই তো তোমার কাছে এত তাড়াতাড়ি আসতে পারলাম।

জিৎ সিং আবার ঘরে যায়। পিতাকে আশ্বাস দিয়ে বলে-ঘরে জল নেই বাবা। আমি আনতে যাচ্ছি বাইরে থেকে

কিন্তু এ কি! পিতার দেহ স্থির। পিতার মাথায় আস্তে হাত রেখে জিৎ সিং ডাকে—বাবা!

সাড়া নেই।

বুকের ওপর হাত রেখে দেখে বুকের স্পন্দন চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। রক্তে ভেজা হাত মুছে পিতার তলোয়ার তুলে নেয় জিৎ সিং। তারপর মৃত পিতার মুখের দিকে চেয়ে কম্পিত স্বরে বলে—বুদ্ধির কথা কি বললে, আমি এখনো বুঝতে পারিনি বাবা। তবে সুযোগ পেলে এই অস্ত্রের ব্যবহার করতে দ্বিধা বোধ করব না।

শত্রুর লাল রক্ত তখনো তলোয়ার চুঁইয়ে পড়ছে। মৃত মুঘল সৈন্যটি মেঝের ওপর পড়ে রয়েছে। বয়স তার এমন কিছু বেশি নয়। বড় জোর বাইশ কিংবা তেইশ। জিৎ সিং ভালোভাবে চায় তার দিকে। তারপর বসে পড়ে তার পাশে। কোমরের কাছে কী যেন বাঁধা রয়েছে, সে খুলে ফেলে মুঘলের পোশাকের সেই অংশ। ঝন্ ঝন্ করে সোনার মোহর গড়িয়ে পড়ে। লুঠের মাল বোধ হয়। নিজের কামিজের ভেতরে সেগুলি ভরে নেয় জিৎ সিং। তারপর আরও অনুসন্ধান চালায় মৃতের দেহে। বুকের ওপর, যেখানে তার পিতার অসি আমূল বিদ্ধ হয়েছে, ঠিক তার পাশেই, কাপড়ে জড়ানো রয়েছে কোন জিনিস। কাপড়টির ভাঁজ আলগা করতে একটি পত্র বার হয়। ভালোভাবে দেখে জিৎ সিং। পত্র নয়, ঠিকানা। মৃতের নাম ইসলাম খাঁ। পিতার নাম ইব্রাহিম খাঁ। বাড়ি আগ্রা। ঠিকানাটি আবার কাপড়ে জড়িয়ে নিজের বুকের কাছে গুঁজে রাখে জিৎ সিং। উঠে দাঁড়িয়ে পিতার শীতল কপালে গাল রেখে ফিসফিস করে বলে,–তোমার শেষ আদেশ অনুযায়ী অস্ত্রের চেয়ে বুদ্ধির ব্যবহারই আগে শুরু করলাম বাবা। আমিই বোধহয় প্রথম রাজপুত যে শত্রুর মৃত মুখের দিকে ভালোভাবে চেয়ে দেখল। আমিই প্রথম রাজপুত যে শত্রুর মৃতদেহ নিজের হাতে তল্লাশি করল। যদি বেঁচে থাকি এই মোহরগুলো কাজে লাগবে।

জিৎ সিং পিতার পায়ের কাছে সরে এসে প্রণাম করে। তারপর শয্যা থেকে তলোয়ারের কোষ তুলে নিয়ে কোমরে বেঁধে আর একবার পিতার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে। সেই মুখে এক গভীর প্রশান্তি।

চোখদুটো একটু জ্বালা ক’রে ওঠে জিৎ সিং-এর। সঙ্গে সঙ্গে সে হেসে ফেলে। হয়তো এখনি তাকে বাইরে বের হতে হবে। আর বাইরে বের হবার পরিণাম তার জানাই আছে। শুধু শুধু এই কয়েক মুহূর্তের আগে-পরের জন্যে চোখকে প্রশ্রয় দেওয়া তার উচিত নয়। জয়মল্ল তাকে যুদ্ধে যেতে দেননি। জয়মল্ল, অনেক যুদ্ধের বীর অজিত সিংহকে একবিন্দু জলের অভাবে মেরে ফেলতে চাননি চিতোরের এই দুর্দিনেও। তবু সে পিতাকে রক্ষা করতে পারল না।

মৃত পিতার পাশে দাঁড়িয়ে সে আপন মনে বলে,—ওরা আমায় না মেরে ভালোই করেছে বাবা। অন্তত দুজনকে শেষ করতে পারব।

বাইরে খুব হইচই। একদল সৈন্যের কদম তালে চলবার আওয়াজ কানে আসে। সে বাইরে উঁকি দেয়। পোশাক রাজপুতের মতোই ওদের। বাদশাহ্ আকবরের পদলেহী রাজপুতদের কথা সে শুনেছে। ওরা বোধহয় তারাই। ওদের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে লাভ নেই। শত হলেও রাজপুত। এই রাজোয়ারার মাটিতেই এককালে জন্মেছিল ওরা। তবু ওদের উৎসাহ উদ্যম মুঘলদের চেয়ে বেশি বলে মনে হয়েছে। ওদের সামনে এগিয়ে গিয়ে খুব সুবিধা হবে না। তার চেয়ে লুণ্ঠনরত কিংবা পথ হারানো মুঘল সৈন্যদের সুযোগমতো হত্যা করাই ভালো হবে। চিতোরের বুকে যখন সন্ধ্যা নামবে, অন্ধকার যখন গাঢ় হয়ে উঠবে সেই সময়ে চিতোরের পথ-না-জানা সৈন্যদের একটি একটি করে হত্যা করতে কোনই অসুবিধা হবে না তার। কথাটা ভেবে একটু তৃপ্তি পায় জিৎ সিং। বাবা ঠিকই বলেছেন। অস্ত্র নিয়ে গোঁয়ার্তুমি সব সময় চলে না। সে-সব দিন চলে গেছে।

হঠাৎ তার খেয়াল হল, সৈন্যদের কুচকাওয়াজ থেমে গেছে। তারা তারই দিকে চেয়ে রয়েছে। মূর্খের মতো একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল জিৎ সিং। তাই নিজেকে আড়ালে রাখবার কথা ভুলে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। রক্ষা যখন নেই, তখন ওই দেশদ্রোহীদের কয়েকটিকে সাবাড় করাই ভালো। ঘরের ভেতরে মুখ ঘুরিয়ে পিতার শবের দিকে চেয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, —যাই বাবা সময় হয়েছে।

ছুটতে ছুটতে সে নামে। মাথায় তার আগুন জ্বলে। সে-আগুন আরও জ্বলছে সৈন্যদলের ভেতরে অনেক নারী আর শিশুকে দেখে। এদের হয়তো আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে বাজারে এদের বেচে দেওয়া হবে। চিতোরের মাটিতে যাদের জন্ম, তারা ক্রীতদাস হয়ে অবশিষ্ট জীবন কাটাবে।

আক্রমণের ভঙ্গিতে একেবারে কাছে যাওয়া সত্ত্বেও, ওদের কেউ বাধা দেবার কিংবা পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে না। অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায় জিৎ সিং।

সেই সময়ে ভিড়ের মধ্যে একটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে।

একজন বৃদ্ধ জিৎ সিংকে ডাকে—শোন।

—না।

—অবিশ্বাস করো না। আমরা এই দেশেরই।

চিৎকার ক’রে বলে ওঠে জিৎ—তাই তো বেশি অবিশ্বাস করছি!

—এই তিনমাস ধরে আমরাই চিতোরের প্রাকারের পাশে দাঁড়িয়ে মুঘল সৈন্যদের রুখে রেখেছিলাম।

বিস্মিত জিৎ প্রশ্ন করে,–তোমরা?

—হ্যাঁ আমরা।

—তবে এমন হল্লা ক’রে রাজপথ ধরে চলছ কোন সাহহে? মুঘলরা তোমাদের কিছু বলছে না?

—সব বলব। কাছে এসো আগে।

জিৎ সিং আবার সেই খিলখিল হাসির আওয়াজ শোনে। ভিড়ের ভেতরে ঠিক দেখতে পায় না। সৈন্যদলের একেবারে মাঝখানে মেয়েদের দল। তারা পা মিলিয়ে না চললেও তাদের গতি দ্রুত।

জিৎ প্রশ্ন করে—হাসছে কে?

—আমাদেরই একটি মেয়ে।

—কেন হাসছে?

—কি জানি। ওর হাসির কোনো কারণ থাকে না। যখন তখন অমন হাসে।

এবার মেয়েটি হাসতে হাসতে বলে,—ওঃ কী বীরপুরুষ। কেমন ক’রে এতগুলো লোকের দিকে এগিয়ে আসছিল? বাবাঃ, যেন এক ঘায়ে এই এক হাজার মানুষকে সাফ্ ক’রে দেবে।

বয়স্ক কোনো স্ত্রীলোক ধমক দিতে মেয়েটি থেমে যায়।

জিৎ সিং এতক্ষণে বুঝতে পারে মেয়েটির হাসির কারণ সে নিজে। রাগে তার মাথা গরম হয়ে ওঠে। ভাবে, বাবা-মায়ের সঙ্গে নিশ্চিন্তে চলতে চলতে মেয়েটি হাসছে। অথচ একবার ভাবতে চেষ্টা করছে না, পথের ধারের ওই বাড়িগুলোর ভেতরে কোন্ দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। রাস্তার ওপর যত্রতত্র মৃতদেহেরও তো অভাব নেই। তাও কি চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছে না মেয়েটি? নিশ্চয় পাগল। ওর কথায় প্রাধান্য দিয়ে লাভ নেই।

বৃদ্ধকে প্রশ্ন করে সে,—কোথায় চলেছ বল।

—চলেছি চিতোরের বাইরে।

—এরা যেতে দেবে কেন? নিরীহ মানুষদের মেরে ফেলছে। তোমাদের ছাড়বে কেন?

—বাদশাহের সঙ্গে যে প্রধান বাহিনী রয়েছে তারাই যখন ছেড়ে দিয়েছে সবাই ছেড়ে দেবে।

—তারা ছাড়ল কেন?

—তারা ভেবেছে আমরা বাদশাহী সৈন্য। অনেক হিন্দুই তো তাঁকে সাহায্য করছে। সেই ভুল যাতে তারা করে, আমরা তার ব্যবস্থা করেছিলাম।

—তোমরা যুদ্ধ না ক’রে পালিয়ে যাচ্ছ! জিৎ সিং-এর কণ্ঠে শ্লেষ।

বৃদ্ধ গম্ভীরে স্বরে বলে,—হ্যাঁ। এখানে যুদ্ধ ক’রে লাভ নেই। ভবিষ্যতে যাতে আরও ভালোভাবে মরতে পারি, তার জন্যে চলে যাচ্ছি। পালিয়ে যাচ্ছি, একথা তুমি বলছ কি ক’রে? ওদের সামনে দিয়েই যাচ্ছি। তবে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে—একটু কৌশল অবলম্বন ক’রে।

জিৎ সিং কথাটা নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করে। ঠিক করছে এরা। বাবার শেষ উক্তি তার কানে বাজে। র।জপুতদের জাতীয় চরিত্রে যেন পরিবর্তনের সূচনা দেখা দিল। শুধু অস্ত্র নয়। বুদ্ধি। এ-বুদ্ধি বরাবরই রয়েছে রাজপুতদের মস্তিষ্কে। কিন্তু ব্যবহার করেনি এতদিন আদর্শের অন্ধ মোহে। সেই আদর্শের রঙ বদলাবার সময় এসেছে। যুদ্ধে মুঘলরা নীতি মানে না। নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে তারা যুদ্ধে নামে। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুটা অন্তত তাদের মতো না হয়ে উপায় নেই।

বৃদ্ধের কথা শেষ হবার অনেক পরে সেই কথাটিরই জের টেনে মাটির দিকে চেয়ে জিৎ সিং মাথা ঝাঁকায়।

একজন প্রৌঢ় এতক্ষণ তাকে বার বার লক্ষ্য করছিল। এবারে সে বৃদ্ধের সঙ্গে জায়গা বদলায়। জিৎ সিং-এর পাশে চলতে চলতে সে বলে,—আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। তুমি কার বাড়ি থেকে এলে?

—কেন?

—আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই বাড়িতে বছর দশেক আগে একবার আমি গিয়েছিলাম।

—আমাদের বাড়িতে?

—ওটা তোমাদের বাড়ি?

—হ্যাঁ।

—দশ বছর আগে অস্ত্র যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখিয়ে বীর অজিত সিং রানার হাত থেকে পুরস্কার পেয়েছিল। আমরা তাকে কাঁধে তুলে নাচতে নাচতে ওই বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়েছিলাম।

জিৎ সিং-এর সারা দেহ কেঁপে ওঠে,—তুমি বাবাকে চিনতে?

—তুমি অজিত সিং-এর ছেলে?

—হ্যাঁ। জিৎ সিং-এর চোখের পাতা এই প্রথম সামান্য একটু ভিজে ওঠবার অবকাশ পায়।

—সে কোথায় পড়ল? মন্দিরের সামনে, না লাখো তোরণে?

—না।

—না? তবে বেঁচে আছে এখনো। কী ক’রে সম্ভব? অজিত সিং-এর মতো বীর এত কাণ্ডের পরেও বেঁচে আছে?

—না। তিনি বেঁচে নেই। তিনি ওই ঘরেই পড়েছেন।

প্রৌঢ়ের চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে একটুও অবিশ্বাসও। সে উত্তেজিত হয়ে বলে,—এত বড় যুদ্ধে অজিত সিং নিজের ঘরের মধ্যে পড়েছে? আমাকে বিশ্বাস করতে বল তাই?

তার কথার ধরনে আশেপাশের সবাই জিৎ সিং-এর দিকে দৃষ্টি ফেরায়। যেন সে মস্ত একটা অন্যায় ক’রে ফেলেছে। যেন এক প্রচণ্ড মিথ্যা কথা বলেছে। নিজেকে আর সামলাতে পারে না সে। আনন্দে গর্বে চোখের জল ফোঁটা হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে তার।

—অজিত সিং নিজের ঘরে মরতে পারে না। প্রৌঢ় অবিশ্বাসের হাসি হেসে ওঠে।

এবারে জিৎ শক্ত হয়। সে বলে,–তোমার কথা সত্যি। অজিত সিং নিজের ঘরের ভেতরে কখনই মরতে পারেন না। তবু তাঁর প্রাণহীন দেহ এখন সেইখানেই পড়ে রয়েছে। বহুদিন থেকে রোগে ভুগছিলেন তিনি। উঠতে পারতেন না। কিন্তু মুঘলরা রেহাই দিল না তবু। একসঙ্গে চার পাঁচজনে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওই উত্থান শক্তিরহিত মানুষটির ওপর।

—ইস! কোন স্ত্রীলোকের মুখ থেকে বার হয়ে আসে শব্দটি।

জিৎ সিং সহসা চেঁচিয়ে ওঠে,—কিন্তু তুমি তো তাঁকে চিনতে। অজিত সিং বিনা যুদ্ধে প্রাণ দিতে পারেন কখনো?

—না।

—তিনি তা দেনওনি। শয্যার ওপর উঠে বসবার ক্ষমতা ছিল না তাঁর। তবু পাশেই থাকত তাঁর চিরসাথী অসিটি। ওরা যে-মুহূর্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল, বাবা অসি তুলে নিয়ে একজনের বুকের ভেতরে বিঁধিয়ে দিলেন। লোকটির নিষ্প্রাণ দেহ সঙ্গে সঙ্গে শয্যার পাশে গড়িয়ে পড়ল।

একসঙ্গে অনেকগুলি কণ্ঠে ধ্বনিত হল, —শাবাশ্!

জিৎ সিং আপন মনে বলে চলে,—কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না। আমার অস্ত্র ঝুলছিল পাশের ঘরে দেয়ালে। ওরা কখন ঘরে ঢুকে পড়েছিল আমি লক্ষ্য করিনি। তাই অস্ত্র আনবার সময় পাইনি। আমি কাপুরুষ। একটু আগে যে মেয়েটি আমাকে বীরপুরুষ’ বলে ঠাট্টা করল, সে ঠিকই বলেছে। আমি ঠাট্টার পাত্র। আমি কাপুরুষ। কাপুরুষ না হলে চোখের সামনে নিজের বাবাকে ওই অবস্থায় কেউ মরতে দিতে পারে? কাপুরুষ ভেবেই শত্রুরা আমাকে অক্ষত দেহে সেখানে ফেলে রেখে চলে গেল। গায়ে হাত ছোঁয়ালো না পর্যন্ত।

প্রৌঢ় একটু পরে প্রশ্ন করে,–তোমার হাতের তলোয়ারটি কার?

—বাবার। এই যে—রক্ত লেগে রয়েছে। জিৎ সিং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে দেখায়। অনেকে স্পর্শ করে সেই রক্ত। প্রৌঢ় সেই রক্ত আঙুলের ডগায় তুলে নিয়ে জিৎ সিং-এর ফ্লাটে ফোঁটা দিয়ে দেয়।

স্ত্রীলোকদের মধ্যে একজন বলে ওঠে,—অমন করে চোখ মুছছিস্ কেন লীলা? চোখ যে লাল হয়ে উঠল।

—কী যেন পড়ল চোখে।

—কাঁদছিস না তো?

—কাঁদব কেন?

—কী জানি। কথায় কথায় খিলখিল করে যখন হাসতে পারিস, তখন কাঁদতেও পারিস হয়তো।

—আমি কালপীতে জন্মাইনি। রাজোয়ারা আমার জন্মস্থান। রাজপুত মেয়েরা অত সহজে কাঁদে না।

জিৎ সিং-এর কানে কথাগুলো যায়। শুনে ভালো লাগে তার। একটু আগে বড্ড রাগ হয়েছিল মেয়েটির ওপর। সে রাগ আর থাকে না। পিতার মৃত্যুর শোকটুকু ছাড়া নিজেকে অনেক হালকা বোধ হয় আগের চেয়ে।

ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মৃতদেহের মধ্যে দিয়ে পথ ক’রে চলে তারা। মৃতদেহের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে, স্তূপাকারে দেখা যায় এবার। নগরীর শেষ সীমায় এসে পৌঁছায় তারা। অসংখ্য মুঘল সৈন্য তখনো লুণ্ঠনে ব্যস্ত। লুণ্ঠন-রত অবস্থায় তারা চেয়ে দেখে এই একহাজারের দলটিকে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অনেকে। কিন্তু এরা ভ্রূক্ষেপ করে না। এদের ধরন-ধারণে অবহেলার ভাব। সন্দেহ ক’রে যে-সব মুঘল সেনাপতি এগিয়ে আসে, দু-এক কথার পরই তাদের সন্দেহ দূর হয়। ফিরে যায় তারা। এরা লক্ষ্য করে জহরব্রতের পোড়া কাঠ উঠিয়ে নিয়ে অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেয়ালের গায়ে গায়ে তারা সগর্বে ভুল বানানে লিখে চলেছে—’চিতোর আজ শাহানশাহ্ জালাল উদ্দিন মুহম্মদ আকবরের পদানত।’

জিৎ সিং তার কোষের তলোয়ার শক্ত করে চেপে ধরে। আগের বৃদ্ধটি কখন যে আবার তার পাশে চলে এসেছিল লক্ষ্য করেনি সে। বৃদ্ধটি তার হাতে হাত রেখে আস্তে চাপ দিয়ে বলে,—উত্তেজিত হয়ো না। ওই কাঠ-কয়লার লেখা যেমন চিরস্থায়ী হতে পারে না, চিতোরও তেমনি চিরকাল মুঘলের পদানত থাকতে পারে না।

—তুমি বিশ্বাস কর একথা?

—না-ই যদি বিশ্বাস করব তবে বাঁচব কি নিয়ে?

জিৎ সিং বৃদ্ধের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তার মসৃণ ললাটেও ভ্রূকুটি ফুটে ওঠে।

অবশেষে ভগ্ন প্রাচীর পার হয়ে চিতোর নগরীর সীমানার বাইরে পা দেয় দলটি। এবারে একটু দ্রুতপদে চলতে শুরু করে তারা। আকবর যেখানে ছাউনি ফেলে এই তিন মাস অপেক্ষা করেছিলেন সেখানে এসে জড়ো হয় সবাই। আকবরের নির্মিত স্তম্ভটির পাদমূলে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ দুহাত উঁচু ক’রে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

—শোনো তোমরা। এতক্ষণ আমরা অভিনয় ক’রে এসেছি। এবারে অভিনয়ের পাট চুকেছে।

কথা অসমাপ্ত থাকতেই ভিড়ের ভেতর থেকে একজন ছুটে এসে বৃদ্ধকে থামতে বলে। তারপর ইঙ্গিতে স্তম্ভটিকে দেখায়। সেই স্তম্ভের মাঝে মাঝে জানালার মতো ফাঁক রয়েছে। সবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টি গিয়ে পড়ে সেইদিকে। বৃদ্ধ কয়েকবার ভালোভাবে স্তম্ভকে প্রদক্ষিণ করে। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে পূর্বের জায়গায় ফিরে এসে বলে-আমরা ভেবেছিলাম স্তম্ভটির ভেতরে সিঁড়ি রয়েছে। আমরা বন্ধুটি আশঙ্কা করেছিল হয়তো মুঘলদের কোনো লোক লুকিয়ে রয়েছে ভেতরে। কিন্তু তার আশঙ্কা অমূলক, আমি ভালোভাবে দেখে নিয়েছি।

ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলে ওঠে—কিন্তু ওপরের ওই আলো তো তোমরা সবাই জ্বলতে দেখেছ। সিঁড়ি না থাকলে ওটি জ্বালাতো কে? যে জ্বালাতো তার কি পাখা ছিল?

বৃদ্ধ একটু ইতস্তত করে। কথাটা সে ভেবে দেখেনি। ওপরের বাতিটি জ্বালিয়ে দিয়ে আসবার রাস্তা নিশ্চয়ই রয়েছে একটি। কিন্তু কোথায় সেই রাস্তা? তবে কি কোনো গুপ্ত পথ রয়েছে? চৌকো পাথরের একটিকে সরিয়ে ফেললেই বোধহয় পথ পাওয়া যাবে।

হঠাৎ দেখা যায়, সেই মেয়েটি, লীলাবতী যার নাম, ভিড় ছেড়ে দৌড়ে একদিকে ছুটে যাচ্ছে। সবাই অবাক হয়। স্ত্রীলোকদের মধ্যে কে যেন বলে ওঠে, মরণ।

মেয়েটি দূরে গিয়ে এদিকে ঘুরে কি যেন দেখে ফিরে আসে। এসে খিলখিল করে হাসতে শুরু করে।

—অত হাসির কি হল?

—ওপরের বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আসবার রাস্তা খুঁজে পেয়েছি।

অতগুলো মাথা একসঙ্গে মেয়েটির দিকে ঘুরে যায়। সত্যিই পাগল নাকি মেয়েটি? স্তম্ভ ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে সে রাস্তা খুঁজে পেল? গালাগালি দিতে ইচ্ছে হয় অনেকের। বয়স্কা স্ত্রীলোকদের দু’একজন তো অস্ফুটস্বরে খারাপ কথাও বলে ফেলল। তবে প্রকাশ্যে কেউ কিছু ওকে বলে না। কারণ ওর বাবাই এই দলের সর্দার। গোপাল সিং তার নাম। এ যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়েছে। এতবড় দলের মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না সেকথা। সবাইকে জানানো নিষেধ। জানতে পারলে দলের মধ্যে হতাশা দেখা দেবে। দল ভেঙে যাবে। দল ভাঙার অর্থ সবার মৃত্যু।

মেয়েটি এখনো জানে না যে তার বাবা গোপাল সিং মৃত। তাকে বলা হয়নি। বললে সে কিছুতেই চিতোর ছেড়ে আসত না। বাপ্ কি বেটি। এই বয়সেই হাতের লক্ষ্য অসাধারণ। ছুরি দিয়েও ভেল্কি দেখাতে পারে। ছয়মাস বয়স থেকে বাবা তাকে অনেক যত্নে বড় করে তুলেছিল স্ত্রীর মৃত্যুর পর। অনাথিনী মেয়ের অদ্ভুত স্বভাবের পরিচয় জেনেও দলের সবাই তার প্রতি সহনশীল। সবার হৃদয়ের একটি স্থানে মেয়েটির জন্য দরদ ও সহানুভূতি তুলে রাখা রয়েছে। চিতোর থেকে অনেক দূরে চলে গিয়ে, যখন এখানে একা ফিরে আসবার আর কোনোই সম্ভাবনা থাকবে না মেয়েটির, তখন ধীরে ধীরেতাকে জানানো হবে আসল ঘটনা। এখন সে জানে, তার বাবা আগে রওনা হয়ে গেছে দলের বসবাসের ব্যবস্থা করতে।

দল এখন সর্দার-হীন তাই বৃদ্ধকে তার বয়সের সম্মান দেওয়া হয়েছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের পরামর্শে আপাতত তার কথা মানছে সবাই।

বৃদ্ধ মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলে, তোমার কথার অর্থ কি লীলা?

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লীলাবতী বলে,—ওখানে গেলেই বুঝবে।

সবাই গিয়ে দেখল জিনিসটি। মেয়েটির বুদ্ধির তারিফ না ক’রে পারল না। আচার-ব্যবহারে আর পাঁচটি মেয়ের মতো স্বাভাবিক না হলেও বুদ্ধি তার ক্ষুরধার এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। নইলে এত সব জোয়ান বীর থাকতে ওরই চোখে কেন পড়বে অত উঁচু কাঠের মইটি? স্পষ্টতই বোঝা যায়, মইখানি স্তম্ভের গায়ে লাগিয়ে ওপরে উঠে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে আসত কেউ। সেই বাতির আলো দেখেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় চিতোরের লোকেরা বলে উঠত, আকবর-বাতি জ্বালানো হয়েছে।

বৃদ্ধ যখন স্তম্ভটির চারদিকে ঘুরে ভেতরে প্রবেশের রাস্তা খুঁজে মরছিল, তখনি লীলাবতীর মাথায় ঢুকেছিল যে সামান্য একটি বাতি জ্বালানোর জন্যে চোরা পথের ব্যবস্থা কখনই করা হয়নি। তাই আশেপাশে তার দৃষ্টি ঘুরছিল ওপরে ওঠবার পথ আবিষ্কারের জন্যে। শেষে মইটি খুঁজে পেল।

বৃদ্ধ ও প্রবীণরা একসঙ্গে বলে ওঠে—শাবাশ্!

কোন স্ত্রীলোকের আবেগ-কম্পিত কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে—আহা, হতভাগী।

কথাটা কানে যেতেই লীলাবতী সাপের মতো ঘুরে দাঁড়ায়,–কে বলল একথা? আমি হতভাগী?

বৃদ্ধ জানত কে বলেছে কথাটা। যে বলেছে সে একজন বয়স্কা স্ত্রীলোক। সে প্রথম থেকেই কেন যেন বৃদ্ধের পাশে পাশে থাকবার চেষ্টা করছে। নানা রসিকতা ক’রে মনের ভার কমিয়ে দিচ্ছে। এবং স্ত্রীলোকেদের মধ্যে একমাত্র সেই জেনে ফেলেছে যে গোপাল সিং মৃত

তাড়াতাড়ি বৃদ্ধ লীলাবতীর পিঠে হাত রেখে স্ত্রীলোকটির দিকে বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার চেয়ে নিয়ে বলে—না না, তুমি হতভাগী হতে যাবে কোন্ দুঃখে? যে বলেছে সে-ই হল আসল হতভাগী। নইলে এমন নির্বোধের মতো কথা বলে? কিছু মনে করো না। তোমার বুদ্ধির কাছে, তোমার সাহসের কাছে ওরা কেউ দাঁড়াতে পারে? শুধু ওরা কেন? ওই যে ছোকরাদের দেখছ, দুদিন পরেই যাদের বোকা বোকা চোখের কাতর চাহনি দেখে তুমি আনন্দ পাবে, তারাও কি দাঁড়াতে পারে?

—কাতর চাহনি দেখব কেন? আহত নাকি ওরা?

বৃদ্ধ হেসে বলে,—এখনো কেউ আহত হয়েছে কি না জানি না। না হলেও, আহত হতে আর দেরি নেই। রীতিমতো ছটফট করবে তখন দেখো।

মেয়েদের মধ্যে হাসাহাসি ঢলাঢলির ধুম পড়ে যায়।

লীলাবতী তীব্রস্বরে বলে ওঠে,—আমি বুঝলাম না কিছুই।

—বুঝবে, ঠিক বুঝবে। অন্য মেয়ে হলে এখনই বুঝত। তবে তুমি একটু অন্যভাবে মানুষ হয়েছে কিনা, তাই দেরি হচ্ছে বুঝতে। এ-জিনিস বুঝিয়ে দিতে হয় না। আর কিছুদিন অপেক্ষা কর, আপনা হতেই সব বুঝতে পারবে।

—ওরা আহত হবে কি করে বুঝলে তুমি?

—আমার অনেক বয়স হয়েছে তো? তাই বুঝতে পারি।

সদ্য পিতৃহারা মেয়েটির সঙ্গে এভাবে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না বৃদ্ধের, কিন্তু দলের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্যে অনেক কিছুই করতে হয়। ভবিষ্যৎ তাদের অনিশ্চিত। মৃত সর্দারের জন্যে দুঃখ হলেও, দমে যাওয়া চলে না। যুদ্ধে নিহত কারও জন্যে চিতোরবাসীরা দমে না। তা যদি দমত তাহলে এই জিৎ সিং-এর মতো তরুণ অমন মাথা উঁচু করে চলতে পারত না।

লীলাবতী জিৎ সিং-এর দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলে—ও আহত হবে?

জিৎ সিং গম্ভীরভাবে বলে,—আমি আহত হই না। হলে, একেবারে নিহত হই।

একসঙ্গে অনেক কণ্ঠের দমকা হাসির হোহো শব্দ আকবর-বাতি স্তম্ভে প্রতিধ্বনিত হয়ে প্রান্তরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের জন্যে হলেও সবাই ভুলে যায় চিতোর নগরীর দুর্ভাগ্যের কথা।

লীলাবতী আর জিৎ সিং দুজনেই বোকার মতো ফ্যালফ্যাল ক’রে চেয়ে থাকে পরস্পরের দিকে।

বৃদ্ধ আবার স্তম্ভের গোড়ায় গিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে,–শোন তোমরা। যেকথা বলছিলাম। অভিনয়ের পাঠ চুকেছে আমাদের। এবারে পালাতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই দুর্গনগরীর থেকে দূরে সরে যেতে হবে। চিতোরের রাস্তায় যেভাবে চলছিলাম, সেভাবে চললে হবে না। আরও দ্রুত হবে আমাদের গতি। সন্ধের আর দেরি নেই। রাতের অন্ধকারে আমাদের অনেক দুরে গিয়ে পৌঁছোতে হবে। আজকের রাতে আমাদের বিশ্রাম নেই। জানি, আমাদের মধ্যে অনেক নারী রয়েছে, শিশুও আছে। কিন্তু উপায় কি? তাদের সম্মান আর তাদের জীবনের জন্যেই তো আমাদের চিন্তা। তাছাড়া তারা রাজপুত। রাজোয়ারায় যখন জন্মেছে রাজপুত তো বটেই। এই কষ্টটুকু তাদের কষ্ট বলে মনে হবে না, এ বিশ্বাস আমার আছে। কেউ অসুস্থতাবোধ করলেও আমাদের থেমে পড়ার উপায় নেই। কারণ মুঘল বাদশাহ্ একটু স্থির হলেই প্ৰথমে আমাদের মৃতদেহের খোঁজ করবেন। হয়তো ইতিমধ্যেই আমাদের খোঁজ পড়েছে। কারণ আমাদের কাছেই তিনি প্রবলতম সম্মুখীন হয়েছিলেন। আমরাই তাঁর দলের সবচেয়ে অধিক সংখ্যক লোকের জীবন কেড়ে নিয়েছি। চল তোমরাও এগিয়ে চল।

—কোনদিকে যেতে হবে?

—তাও ঠিক করে রেখেছি। আমাদের ঘুরে যেতে হবে একটু। চিতোরের এই দিক দিয়ে সোজা গিরো উপত্যকায়।

—গিরো উপত্যকা? আরাবল্লী?

—হ্যাঁ। তোমরা সবাই জান মেবারের কাপুরুষ রানা উদয় সিংহ সেখানে পালিয়ে আছেন। তবু সেখানেই যেতে হবে। কারণ কালপীর লোক হলেও, তাঁরই অধীনে কাজ ক’রে এসেছি এতদিন।

একজন যুবক ক্রোধদীপ্ত কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে—কয়েক বছর আগে সরোবর তৈরি করেছিল যখন, তখনি হয়তো মনে মনে পালাবার রাস্তা খুঁজছিল। ও জানত, চিতোরের ওপর একদিন না একদিন মুঘলরা আক্রমণ চালাবে। থুঃ থুঃ।

যুবকের দেখাদেখি অনেকেই মাটিতে থুতু ফেলে পা দিয়ে ঘষে দেয়।

একজন বলে,—ওর মুখদর্শন করাই পাপ।

বৃদ্ধ শান্তকণ্ঠে বলে,–শোন ভাই, তোমাদের রাগ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবু আমাদের সেখানে যেতে হবে দুটি কারণে। সেই দুটি কারণের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আমি বললে তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না।

অন্য একজন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে,—বল। একটু তাড়াতাড়ি বল, শুনে নিই তোমার কারণ দুটি।

বৃদ্ধ একটুও বিচলিত না হয়ে বলে,—প্রথম কারণ চিতোর থেকে শুধু নয়, আগ্রা থেকেও আমাদের দলটির আরও দূরে সরে যাওয়া উচিত। এখন বাদশাহ্ আকবর চিতোরে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আগ্রায় যোগসূত্র থাকবেই। লোকজন অনুচর, সংবাদদাতা, সবাই এপথে যাতায়াত করবে। চিতোর আর আগ্রার মাঝামাঝি কোথাও আমাদের থাকা নিরাপদ নয়। যে কোনো মুহূর্তেই আমাদের এই দল ওদের চোখে পড়ে যেতে পারে। সেটা কি খুব নিরাপদ হবে? তোমরাই বলো?

ধীরে ধীরে কয়েকজন বলে,—না। তা হবে না বটে।

বৃদ্ধ এবারে বলে,—আমার দ্বিতীয় কারণটি আরও মূল্যবান। চিতোর চিরকাল মুঘলের অধীনে থাকবে, এ কল্পনাও আমরা করতে পারি না। রানা যখন সেখানে রয়েছেন, তখন অনেক সর্দারও সেখানে জমা হয়েছেন বা হবেন। সেখান থেকে চিতোর উদ্ধারের উদ্যম আমরা পেতে পারি। অন্য কোনদিকে গেলে চিরকালই অনির্দিষ্টভাবে ভেসে বেড়াতে হবে। এতদিন পর নিজেদের দেশ কালপীতে ফিরে গেলেও জায়গা হবে না। তারা আমাদের সহ্য করতে পারবে না। আমরাও পারব না তাদের সইতে। আমরা এখন রাজপুত।

অনেকে এবারে একসঙ্গে বলে ওঠে,—ঠিক। বুড়োর কথায় যুক্তি আছে।

বয়স্কা রসিকাটি সুযোগ পেয়ে বলে ওঠে,—বুড়োর কথায় যুক্তি থাকবে না তো কি তোমাদের কথায় যুক্তি থাকবে? তোমাদের রক্ত টগবগ ক’রে ফুটছে। চিন্তাভাবনা তো নেই। সব সময় বন্দুক উঁচিয়ে বসে আছো। সাধে কি আর বলে, তিন মাথা যার, বুদ্ধি নেবে তার?

স্ত্রীলোকটির কথায় বৃদ্ধ রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়। তবে মুখে কিছু বলে না। স্ত্রীলোকটি আগেও দু-চারবার রসের কথা বলেছে। তার সব রস যেন বৃদ্ধকে উপলক্ষ ক’রেই বেশি উপচে পড়ে। হয়তো দলের আর সবাইকে সে নিজের উপযুক্ত বলে মনে করে না। কারণ প্রৌঢ় ব্যক্তিটি ব্যতীত আর কেউ বৃদ্ধের মতো যৌবনের সীমা ভালো ভাবে অতিক্রম করেনি।

মহিলাটির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বৃদ্ধ ভিড়ের দিকে চেয়ে বলে,—আমাদের আর একটি কারণ রয়েছে। ধর, ইতিমধ্যে যদি রানা উদয় সিংহের মৃত্যু হয় হঠাৎ? কে রানা হবে তাঁর পরে?

—কেন? তাঁর ছেলে?

—ভগবানের কৃপায় তাঁর মাত্র পঁচিশটি ছেলে। এই পঁচিশ-জনের মধ্যে কে রানা হবে? মৃদু গুঞ্জন ওঠে দলের মধ্যে। অনেকেই অনেকের নাম করে। কিন্তু কোনো নামই ঠিক মনঃপুত হয় না। শেষে কয়েকজন জোর গলায় বলে ওঠে,–কিকা রানা হবে।

বৃদ্ধ মৃদু হেসে বলে,—হ্যাঁ কিকা। তাঁর ওপরই একমাত্র ভরসা করতে পারে মেবার এবং সমস্ত রাজোয়ারা। এই বয়সেই তার বহু প্রমাণ আমরা পেয়েছি চিতোরে থাকবার সময়ে। কিন্তু তাঁকে যদি সিংহাসন না দেওয়া হয়?

একজন বলে—আলবত দেওয়া হবে। জোর ক’রে দিতে হবে।

—কিন্তু তোমরা কালপীর লোক। তোমাদের কথা শুনবে কে?

—ন্যায্য কথা সবাই শোনে বুড়ো।

—ঠিক বলেছ। বিশেষ ক’রে সেই ন্যায্য কথাটির পেছনে যদি এক সহস্র সাহসী বন্দুকধারী থাকে।

বৃদ্ধকে আর কিছু বলতে হয় না। সমস্ত দলটি নড়েচড়ে ওঠে,—চল গো। আর দেরি ক’রে কি হবে? চল। এবারে গিরোর জল হাওয়া দিনকতক খেয়ে নিইগে। আর সেই অপদার্থ রানার মুখদর্শন করে নরকবাসের পাকা বন্দোবস্ত করি।

লীলাবতী চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে। পেছনের সবাই তাকে দেখে ফেলে। নইলে সে হয়তো একা পড়ে থাকত আকবর-বাতির সামনে। বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি পেছনে এসে মেয়েটির হাত ধরে বলে,–থেমে পড়লে কেন?

—সত্যি কথা বল তো?

বৃদ্ধের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কেউ কি বলে দিল একে এর বাবার কথা?

কিন্তু বলবেই বা কে? কয়জনাই বা জানে। যারা জানে, তারা পাগল নয়।

—কোন্ কথা লীলা?

—বাবা কোথায়?

—বলেছি তো, আগে চলে গেছে।

—মিথ্যে বলো না। আগে যদি যেতেন তিনি, তবে এখানে দাঁড়িয়ে তোমরা ঠিক করতে না কোথায় যাবে।

বৃদ্ধ একটু ভেবে নিয়ে বলে,—শোন লীলা। তোমার বাবারই বলতে মানা আছে সে এখন কোথায়। নইলে ঠিক বলতাম। তুমি যদি অবুঝ হও, তোমার জন্যে সমস্ত দল বিপদে পড়বে। তোমাকে ফেলে রেখে আমরা কেউ চলে যেতে পারি না, একথা তুমি জান। আগে চল। গন্তব্যস্থানে পৌঁছোলেই তুমি সব জানতে পারবে।

লীলাবতী ভ্রূকুঞ্চিত ক’রে তীব্র দৃষ্টিতে বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। সে দৃষ্টি সহ্য করতে অসীম ক্ষমতার প্রয়োজন। বৃদ্ধ তাই মাথা নীচু করে।

শেষে লীলাবতী বলে,–বেশ চল। আমার জন্যে সবার বিপদ ঘটবে, এ আমি চাই না। পথে আর একটি কথাও জিজ্ঞাসা করব না। কিন্তু মনে রেখো, আজ যদি এ অবস্থায় সবাই না পড়ত, তবে তোমার ওই মুখ থেকে সত্যি কথা টেনে বের ক’রে নিতে পারতাম। সে শক্তি আমার আছে। আমি গোপাল সিং-এর মেয়ে।

—জানি লীলা জানি। তোমরাই হলে মহাশক্তির অংশ। তোমাদের বলে আমরা বলী।

হাত নেড়ে সমস্ত কথা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি ক’রে লীলাবতী বলে,—থাক। চল। আমি যাচ্ছি।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটির হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া দলের সঙ্গে গিয়ে মেশে বৃদ্ধ।

সারারাত নীরবে পথ চলে ওরা। শিশুরা কাঁদতে ভুলেছে। তারাও যেন বুঝতে পেরেছে এইভাবে যাত্রার মধ্যে গোপনীয়তা রয়েছে।

অসমতল পাথুরে রাস্তা। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাহাড়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কত লোক হোঁচট খেয়েছে। কত স্ত্রীলোকের কোল থেকে ছিট্‌কে পড়েছে শিশু। মাথায় গায়ে চোট লেগেছে তাদের। চিৎকার ক’রে কেঁদে উঠেই সঙ্গে সঙ্গে আবার থেমে গেছে তারা। কাঁদতে নেই তাদের। মায়েদের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে তারা অনুমান ক’রে নিয়েছে কাঁদতে নেই। হাসি ঠাট্টার মধ্যেও মায়েদের মুখের থমথমে ভাব কেটে যায়নি। আদর ক’রে তাদের চুমু খেলেও তাতে উষ্ণতার অভাব সহজেই ধরে ফেলেছে ওদের অতি সূক্ষ্ম অনুভূতি। তাই কান্না পেলেও কাঁদতে পারছে না। শীতের শেষ বলেই এই রাতে তার প্রচণ্ডতা অপরিসীম। শেষ বিদায় নেবার আগে দু-একদিন এইভাবে জানান দিয়ে যাবে। তারপর গাছে ফুল ফুটবে, মৌমাছির গুনগুনানি শুরু হয়ে যাবে। প্রজাপতির রঙিন পাখা পতপত করে উড়বে। কোকিলের কুহু ডাক কানে মধু ঢালবে।

কিন্তু চিতোর আর হাসবে না। চিতোর মরেছে হয়তো চিরকালের জন্য। অন্তত উদয় সিংহের পদদ্বয় যতদিন পৃথিবীর মাটিকে ‘কলুষিত করবে ততদিনের তরে মরেছে চিতোর। মৃত আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের জন্যে দুঃখ হলেও, তাতে কিছুই এসে যায় না। এমন মৃত্যু তাদের চিরকালের আকাঙ্ক্ষার জিনিস। এ মৃত্যুতে গৌরব আছে, গর্ব আছে। কিন্তু চিতোর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় যে আফশোস, যে শোক, তার আর কোনো সান্ত্বনা নেই।

মেবারের রাজধানী শুধু চিতোর। অথচ মাড়োয়ার, অম্বর, আজমীঢ়, মালওয়া সমস্ত রাজোয়ারার মধ্যমণি এই চিতোর। কালপীর লোকদেরও আপন এই চিতোর। একে পর বলে কেউ ভাবতে পারে না। এর জন্যে প্রাণ দিতে রাজোয়ারের প্রতিটি প্রাণী একসময় প্রস্তুত থাকত। এখন আর সেদিন নেই। তাই ভগবান দাসকে দেখা যায় শত্রুর শিবিরে। রাজপুতদের দুর্দিন এতদিনে ভালোভাবে শুরু হল। মহা অমঙ্গলের সূত্রপাত

অমঙ্গল বৈ কি! নইলে, যতবড় কাপুরুষই হোক, নিজে রানা হয়ে চিতোরের প্রজাবৃন্দকে বিপদের মুখে ফেলে রেখে উদয় সিংহ অমনভাবে চলে যেতে পারত না। তার তো অজানা ছিল না মেবারের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর হুকুম। দেশের জন্যে যতদিন রানা নিজে লড়বেন ততদিন দেশের পতন নেই। এমন কি রানার পতন হলেও দেশ রইবে স্বাধীন। তেমনি কতবার হয়েছে। কত রানা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু চিতোর ছিল চির স্বাধীন। সেই চিতোর, সেই মেবারের চেয়ে শেষে নিজের প্রাণটাই বড় হল উদয় সিংহের কাছে?

চলতে চলতে এসব চিন্তা সবার মনেই হচ্ছে। অথচ মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছে না। নিদারুণ শীতের অন্ধকারে পথ চলতে সব কয়টি মনের সুর একই। কিন্তু সে সুর অনুচ্চারিত। সেই অনুচ্চারিত সুরের রেশ শিশুদের মনেও সংক্রামিত। তাই তারা কাঁদতে চাইলেও কাঁদতে পারছে না। মায়ের কাঁধে মাথা রেখে শীতে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে। তারা জানে, ইচ্ছে করে এতখানি কষ্ট তাদের মা দিতে পারে না। তারা জানে প্রথম সুযোগই তাদের আরামের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের আহত স্থানে ওষুধের প্রলেপ দেওয়া হবে—তাদের ফাটা গালে আর মুখে তেল লাগানো হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *